টেবিলের ওপর জোর একটা চাপড় মেরে হোসেন সাহেব দাঁত কড়মড়িয়ে বললেন, ইন্ডিয়া! তোমাগো সব কথায় ইন্ডিয়া আসে ক্যান? ইন্ডিয়ার থিকা আমরা সেপারেট হইছি কি সব সময় ইন্ডিয়ার নাম জপ করার জইন্য?
আলতাফ বললো, চাচা, মাথা গরম করছেন কেন? এমনিই একটা তুলনা দিতেছিলাম।
হোসেন সাহেবের ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে গেছে, চক্ষু দুটি বিস্ফারিত, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, যখন তখন ইন্ডিয়ার নাম শুনলে সত্যি আমার ম্যাজাজ গরম হইয়া যায়। আমি ব্লাড প্রেসারের রুগী, সে কথাটা মনে রাইখখো!
আলতাফ প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য বললো, চাচা, দুই প্লেট ফিস ফিংগারের অর্ডার দ্যান। হোসেনসাহেব আঙুল তুলে বললেন, বেলটা বাজাও!
একজন বেয়ারা যেন দরজার পাশেই অপেক্ষা করছিল, বেল বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে সে দরজা খুলে উঁকি মারলো।
হোসেন সাহেব ঘরে উপস্থিত সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, দুই প্লেট ফিস ফিংগার আর দুই প্লেট চিলি চিকেন আনো। জলদি করবা!
শাখাওয়াত হোসেনের নতুন সাততলা হোটেলের সপ্তম তলার এই ঘরটিতে খাট বিছানা নেই, রয়েছে একটি গোলাকার টেবিল, অনেকগুলি চেয়ার, দুটি আলমারি, এটা তাঁর অফিস ঘর। একদিকের দেয়ালের গায়ে একটি বন্ধ দরজা, তার ওপাশে আর একটি ছোট ঘর আছে। খাট-বিছানায় সুন্দর করে সাজানো, সেটি তাঁর বিশ্রাম কক্ষ, কখনো কখনো তিনি রাত্রে সেখানে থেকেও যান।
হোটেল ব্যবসায় শাখাওয়াত হোসেনের কপাল এমনই খুলে গেছে যে তিনি নিজেই যেন সব সময় বিশ্বাস করতে পারেন না। এই সব ব্যবসায় নিয়মই হলো, একবার ছড়াতে শুরু করলে থামানো যায় না। টাকাকে তুমি দ্বিগুণ-চতুগুণ করার চেষ্টা না করলেই সে অর্ধেক সিকি হয়ে যাবে। হোসেন সাহেব এখন ঢাকায় দুটি এবং চিটাগাং ও করাচিতে একটি করে হোটেলের মালিক। একটি ফরেন চেইনের সঙ্গে কোলাবরেশানে তিনি শিগগিরই ঢাকা ও রাওয়ালপিন্ডিতে আরও দুটি ফোর স্টার খুলতে যাচ্ছেন।
হোটেলের ব্যবসা নিজে না দেখতে পারলে চুরিতে ফাঁক হয়ে যায়। কিন্তু তিনি নিজে কতদিক সামলাবেন? তাঁর পাঁচ কন্যা ও দুটি পুত্র, এর মধ্যে বড় ছেলেটি বরাবরই পিতৃ-বিরোধী, সে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে আলাদা ব্যবসা শুরু করেছিল, দু বছর আগে হঠাৎ সে মারা গেছে। ছোট ছেলেটি এখনও স্কুলের ছাত্র। নাদেরা ও মনিরা নামে তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু দুটি জামাই-ই কাজের ব্যাপারে অপদার্থ কিন্তু পয়সা খরচে ওস্তাদ। এইসব কারণে হোসেন সাহেব বড় অসুখী ছিলেন।
তাঁর আর একটা অতৃপ্তির কারণ, তিনি ধনপতি হয়েছেন বটে, তবু সমাজে সেরকম স্বীকৃতি পাননি। লোকে আড়ালে তাঁকে হোটেলওয়ালা হোসেন বলে। অনেককাল আগে আমিনবাজারে প্রথম একটা ভাতের হোটেল খোলার পর সেই যে তাঁর এই নাম হয়েছিল, এখনও সেটা রয়ে গেছে। তিনি লেখাপড়া বিশেষ করেননি, জীবনে কখনো রাজনৈতিক কোনো দলে ঢোকেননি, এমন কিছু কাজ কখনো করেননি, যাতে খবরের কাগজে নাম বেরুতে পারে। ব্যবসায়ী মহল ছাড়া তাঁকে কেউ চেনে না। বছরখানেক আগে, বায়তুল মোকাররমের কাছে তাঁর গাড়িটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছিল, একটা দোকানে ঢুকে তিনি তাঁর হোটেলে টেলিফোন করলেন আর একটা গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য, সেই দোকানের মালিক তাঁকে চিনতে পারলো না। দ্বিতীয় গাড়িটা আসতে দেরি হচ্ছিল, তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলেন, রাস্তা দিয়ে দলে দলে লোক যাচ্ছে, ছেলে-ছোঁকরারা হই-হট্টগোল করছে, কেউ ভূক্ষেপও করছে না তাঁর দিকে। এতে তাঁর মনে খুব লেগেছিল। তিনি যে-কোনো জায়গায় দাঁড়াতেই লোকে আঙুল তুলে ঐ যে শাখাওয়াত হোসেন, ঐ যে শাখাওয়াত হোসেন বলবে, হলে আর কোটি কোটি টাকার কারবার করে লাভ কী হলো?
কিন্তু শাখাওয়াত হোসেন শুধু হোটেলের ব্যবসাটাই বোঝেন, কী করে যে লোকের দৃষ্টি বা আঙুল নিজের দিকে ফেরাতে হয় তা তিনি জানেন না!
কয়েকমাস আগে বিদেশী পার্টনারদের আমন্ত্রণে শাখাওয়াত হোসেন ইওরোপের বিভিন্ন হোটেল ঘুরে দেখতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন তাঁর ছোট জামাই আবু সালেক-কে। সে ছোঁকরা অস্থিরমতি হলেও ইংরিজিটা ভালো জানে। ঘুরতে ঘুরতে পশ্চিম জার্মানির বন শহরে এসে দেখা পেলেন তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র আলতাফের। সেই সময়েই আবু সালেক কয়েক দিনের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিল।
আটান্ন সালের আগে এই আলতাফ যখন সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল তখন একে দু’ চক্ষে দেখতে পারতেন না হোসেন সাহেব। পরে অবশ্য তিনি শুনেছিলেন যে সব ছেড়েছুঁড়ে আলতাফ জামানিতে গিয়ে ভালোই কাজকর্ম করছে, ছোটখাটো ব্যবসাও করছে, তবু তিনি আলতাফের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেননি। গত বছর আলতাফ যখন ঢাকায় এসেছিল, তখন একদিন মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে, একটি বিয়ে বাড়িতে।
বন্-এ এসে তিনি দেখলেন, আলতাফ বিষম বিমর্ষ হয়ে আছে, তার হিন্দু স্ত্রীর সঙ্গে তার সদ্য ডিভোর্স হয়েছে। সে মেয়েটি দুটি সন্তানকে নিয়ে চলে গিয়ে মিউনিখে একজন জামানকে বিয়ে করে ফেলেছে এর মধ্যেই। কেউ কেউ বলে, আলতাফই তার স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহার করতে ইদানীং, আবার কেউ কেউ বলে তার স্ত্রীই গোপনে গোপনে অন্য একজনের সঙ্গে পীরিত করে স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছে। সে যাই-ই হোক, যাবার সময় সে জেদ করে তার সন্তান দুটিকে নিয়ে গেছে বলেই আলতাফ একেবারে ভেঙে পড়েছিল।
আলতাফের সেই অবস্থা দেখেই হোসেন সাহেব গোপনে গোপনে উল্লসিত হয়ে উঠলেন এবং তাকে আবার পছন্দ করতে শুরু করলেন। তাঁর ধারণা, ঐ হিন্দু-প্রভাবেই আলতাফ এক সময় কমুনিস্ট হয়েছিল। তার শ্বশুর ঐ টাঙ্গাইলের উকিলটার প্রশংসায় আলতাফ এক সময় এমন পঞ্চমুখ থাকতো যে তাতেই বোঝা গিয়েছিল, আলতাফ হিন্দুদের কথায় নাচে। হিন্দুরা কেউ পাকিস্তান চায়নি, পাকিস্তান সৃষ্টিতে তারা খুশী হয়নি, তারা তো এখন কমুনিজ চাইবেই। যাতে পাকিস্তান আবার ভেঙে যায়, ইসলাম মুছে যায়, তখন হিন্দুদের আবার কর্তৃত্ব ফলাবার সুযোগ আসবে।
ব্যক্তিগত গোপন দুঃখের কারণে, হিন্দুদের ওপর শাখাওয়াত হোসেন সাহেবের জাতক্রোধ আছে। কমলা, আজও কমলার কথা মনে পড়ে! সে অনেককাল আগেকার কথা, তখন পাকিস্তান নামটা ইকবালের কল্পনাতেও ছিল না, ইংরেজ চলে যাবে এমন কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি, সেই সময় তিনি নরসিংদির মেয়ে কমলাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কমলাদের বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না, এমনকি ওদের পরিবারে সেরকম বিদ্বানও কেউ ছিল না, কমলার বাবা ছিল নরসিংদি বাজারে সামান্য একটা মুদিখানার মালিক, ব্রাহ্মণও নয়; কায়স্থ, সেই লোকটাই শাখাওয়াত হোসেনের প্রস্তাব শুনে জুতো খুলে মারতে এসেছিল। একগাদা লোকের সামনে। সেই ভিড়ের মধ্যে কে যেন একজন বলেছিল, ঐ নেড়ে ব্যাটার মাথা ন্যাড়া করে তার ওপর গরম কল্কির একটা দাগ দিয়ে দে!
সব মনে আছে, শাখাওয়াত হোসেনের সেদিনের সব ঘটনা স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করে।
তারপর, অনেকগুলি বছর গেছে, জীবন তাঁকে অনেক কিছু দিয়েছে, হোসেন সাহেব অন্তত সাতটি হিন্দু মেয়েকে নিজের শয্যায় নিয়ে শুয়েছেন, তবু তৃপ্তি হয়নি, কমলার কথা ভুলতে পারেননি। কমলার বিয়ে হয়েছিল বরিশালের এক স্কুল মাস্টারের সঙ্গে, পঞ্চাশের রায়টে সে বিধবা হয়, তারপর সে কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে! হোসেন সাহেবের এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, কমলার বাবা সেই নারায়ণ ঘোষবাবুটাকে হাতের কাছে পেলে তিনি প্রথমে। জোর করে তার মুখে গোমাংস ভরে দিয়ে তারপর তার গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নুন ছিটিয়ে দিতেন! কিন্তু সে ব্যাটা ফরটি সেভেনেই পালিয়েছে।
সেই নারায়ণ ঘোষের ওপর রাগেই হোসেন সাহেব যখন যেখানেই কোনো হিন্দু সম্পত্তি পান, অমনি তা গ্রাস করতে উদ্যত হন। তাঁর এই নতুন হোটেলটিও একটি প্রাক্তন হিন্দু জমিদারের বাড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে।
যাই হোক, বিদেশে আলতাফের এ অবস্থা দেখে হোসেন সাহেবের মাথায় একটা পরিকল্পনা খেলে গিয়েছিল। এখন তো এই ছেলেটাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আলতাফ লেখাপড়া জানে, চালাক-চতুর, বিদেশে সাহেব-মেমদের সঙ্গে মেলামেশার সহবৎ শিখেছে, তাকে তাঁর হোটেল-গ্রুপের জেনারাল ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত করলে কাজের কাজ হবে। রক্তের সম্পর্ক তো আছে।
আলতাফ প্রথমে রাজি হয়নি, পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সে আর কোনো সম্পর্কই রাখবে না ঠিক করেছিল। মাত্র বছরখানেক আগেই সে সপরিবারে ঢাকা ঘুরে গেছে, সকলের কাছে সে সুখী ও সার্থক মানুষ হিসেবে অহংকার করেছে। এবার ফিরে গেলে লোকে বলবে, সে তার ছেলে-মেয়ে দুটিকেও ধরে রাখতে পারলো না?
নিজের সব দুঃখ সে মদে ডোবাতে চেয়েছিল, সেই সময় শাখাওয়াত হোসেন স্নেহশীল চাচার ভূমিকা নিয়ে তাকে ফেরাতে চেষ্টা করলেন। বন-এ তিনি থেকে গেলেন অতিরিক্ত দশ দিন। আলতাফ সেবারেই তাঁর সঙ্গে ফিরে এলো না বটে, কিন্তু তিনি লেগে রইলেন, দু’বার তার কাছে লোক পাঠালেন।
মাস চারেক আগে জার্মানির পাট একেবারে গুটিয়ে চলে এসেছে আলতাফ। মদের নেশা কমিয়েছে অনেকটা, এখন সে সুস্থ মানুষ, হোটেলের পরিচালনা ভার নিয়েই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
হোসেন সাহেব লোক-চরিত্র পর্যবেক্ষণ করেন তীক্ষ্ণভাবে। যে-কোনো মানুষের গুপ্ত দোষ-গুণ বুঝে নিতে তাঁর বেশি সময় লাগে না, তাঁর জীবনের উন্নতির মূলে আছে এই ক্ষমতাটি। তিনি লক্ষ করলেন যে আলতাফ বিলাসী প্রকৃতির মানুষ, লোকজনকে দেখিয়ে দেখিয়ে সে অপব্যয় করতে ভালোবাসে, কিন্তু সে কাজে ফাঁকি দেয় না, কাজের প্রতি নিষ্ঠা আছে, মিথ্যে কথা বলার অভ্যেস নেই। হোসেন সাহেব তাকে টাকা খরচের ঢালাও অধিকার দিয়েছেন, নিজের জন্য কত খরচ করবে করুক, দু’লাখ, পাঁচ লাখ?
আলতাফও তার চাচার বর্তমান মনোবাঞ্ছটি টের পেয়েছে। চাচা টাকা করেছেন অনেক, এখন নাম করতে চান। কিছুদিন ভেবে চিন্তে সে একটা প্রস্তাব দিল। একটা কাগজ বার করা। যাক, একটা দৈনিক পত্রিকা, নাম করার সেটাই দ্রুততম উপায়। নিজের কাগজে প্রায়ই নিজের নাম ছাপা হবে, ছবি ছাপা হবে, নিজের অনেক মতামত দেশবাসীকে জানানো যাবে।
প্রস্তাবটা লুফে নিলেন হোসেন সাহেব। এইজন্যই লেখাপড়া জানা ছেলেদের দরকার, এই রকম একটা চিন্তা তো তাঁর মাথাতেই আসতো না। তিনি বড়জোর ভেবেছিলেন, নিজের গ্রামে একটা বড় সড় মসজিদ বানিয়ে দেবেন, কিন্তু তাতে তো মাত্র দু পাঁচখানা গ্রামের লোক তাঁর নাম জানবে, কিন্তু খবরের কাগজে যে নাম ছড়াবে সারাদেশে।
এখন প্রত্যেকদিন সেই পত্রিকা বিষয়ে আলোচনা চলছে। হোসেন সাহেব আগে আয় ব্যয়ের হিসেব কষে দেখেছেন। প্রথম ছ’ মাস তাঁকে টাকা ঢালতে হবে, সেই টাকা আসবে ব্যাঙ্ক থেকে। ব্যাঙ্কে তাঁর গুডউইল যথেষ্ট। পত্রিকার মূল আয় বিজ্ঞাপনে, সেদিকে অসুবিধে হবে না, ব্যবসায়ী মহলে তাঁর দহরম-মহরম আছে, শুধু এখানে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানেও। ভালো ভালো সাংবাদিকদের ভাঙিয়ে আনতে হবে অন্য কাগজ থেকে। মেসিনপত্র আনাবেন জার্মানি থেকে, সে ব্যবস্থা আলতাফই করতে পারবে।
কাগজ শুরু হলে লোকবল দরকার। বছর পাঁচেক বিদেশে থাকায় আলতাফ তার বন্ধুবান্ধবদের থেকে বিচ্ছিন্ন, পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মীরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। সেইজন্য আলতাফ ধরলো তার ছোট ভাই বাবুলকে। মফঃস্বল ছেড়ে বাবুল এখন ঢাকাতেই অধ্যাপনা করে, তার বন্ধুবান্ধবের একটি গোষ্ঠী আছে। বাবুল প্রথমে আসতে রাজি হয়নি, তার এই বড়লোক চাচার সঙ্গে সে বিশেষ সম্পর্ক রাখে না, রাখতে চায় না। সে লেখক নয়, সাংবাদিকতায় তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, এই সব বলে সে আলতাফের প্রস্তাব উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আলতাফ প্রায় জোর করেই বাবুলদের আড্ডায় হাজির হলো দু একদিন। সেই দলে রয়েছে কয়েকজন কবি-লেখক, কয়েকজন প্রাক্তন সাংবাদিক, বইয়ের ব্যবসায়ী। আলতাফ নিজে তাদের আমন্ত্রণ জানাতে তারা কিন্তু উৎসাহ দেখালো প্রায় সবাই। একটা নতুন কাগজ, একটা নিজস্ব কাগজ, এর টান সাংঘাতিক।
এখন প্রতিদিন সন্ধেবেলা হোসেন সাহেবের নতুন হোটেলের সাততলার ঘরে আলোচনা সভা বসে। পল্টন, কামাল, জহির, বসির এই সব বন্ধুদের টানে বাবুলকেও আসতে হয়েছে। সম্পাদক হিসেবে হোসেন সাহেবেরই নাম থাকবে। ইত্তেফাক কাগজের এক প্রবীণ সাংবাদিকের সঙ্গে মানিক মিঞার মনোমালিন্য চলছে এই খবর পেয়ে তাঁকে এই কাগজে যোগ দেবার জন্য টোপ দেওয়া হয়েছে। নিত্য নতুন আরও খবর আসে।
সন্ধের এই আলোচনা সভায় হোসেন সাহেবই মধ্যমণি। খাবার-দাবার, সরবৎ, চাকফি-ঠাণ্ডা পানি পরিবেশিত হয় ঢালাওভাবে, কিন্তু মদ নেই। হোসেন সাহেব মদ্যপানের ঘোর বিরোধী। নিষ্ঠাবান মুসলমান, এখানে বসে আলোচনা করতে করতেও তিনি মাগরেবের আজান শুনে পাশের ঘরে গিয়ে নামাজ পড়ে আসেন। বাবুলের মদ্যপ বন্ধুদের এই ব্যবস্থায় একটুও আপত্তি নেই, এখানে আলাপ-আলোচনা করতে করতে খাওয়া-দাওয়াটা বেশ ভালোই হয়। এর পর একটু অধিক রাত্রে আলতাফের নিজস্ব চেম্বারে আর একবার বৈঠক হয়, সেখানে আলতাফ উদারভাবে স্কচের বোতল খোলে।
পত্রিকার নীতি নির্ধারণ বিষয়ক আলোচনায় মতামত দিতে দিতে হোসেন সাহেব কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। রীতিমতন পাকাঁপোক্ত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতন তিনি মাঝে মাঝে এক একটা মন্তব্য ছুঁড়ে দেন। তিনি বেশি দূর লেখাপড়া শিখতে পারেননি, ইংরিজি কাগজ পড়েন না, তবু এই সব ইংরিজি লেখাপড়া জানা অধ্যাপক-লেখকরা যে তাঁর যুক্তির মূল্য দেয়, এতেই তিনি গভীর আনন্দ পান।
চাচার কথাবার্তা শুনে আলতাফ মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়। সে আগে জানত, তার চাচা একজন কট্টর মুসলিম লীগপন্থী, হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দিদের দু চক্ষে দেখতে পারতেন না। আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার দুর্নীতি ও অপদার্থতার জন্যই যে সরকারের পতন হলো এবং আইয়ুব সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা হাতে নিয়ে পাকিস্তান রক্ষা করেছে, এই প্রচারের প্রবল সমর্থক। কিন্তু এখন হোসেন সাহেব সুর পাল্টে ফেলেছেন। তিনি চান তাঁর পত্রিকায় প্রথম থেকেই দাবি তুলতে হবে যে দেশে অবিলম্বে নির্বাচন চাই। গরম গরম লেখা দিয়ে ছাত্রদের ক্ষ্যাপাতে হবে, নইলে কাগজ চলবে না।
সেদিন কথায় কথায় তিনি বললেন, আমি আইয়ুব খাঁর ওপর কবে থেকে চটেছি জানো? আগের সংবিধান বাতিল করে দিয়ে যেদিন তিনি তাঁর পেটোয়া লোকদের দিয়ে নতুন সংবিধান কমিশান বসালেন। সেই কমিশান রায় দিল কী? না, পাকিস্তানের নাগরিকেরা গণতন্ত্রের যোগ্য নয়। সর্বসাধারণের ভোটের অধিকার নাই। এইটা কি একটা বিবেচনা মতন রায় হইলো? পাশের দ্যাশ ইন্ডিয়া, সেখানে সকলে ভোট দিতে পারে, আর পাকিস্তানীরা ভোটের অযোগ্য?, ইন্ডিয়ানরা যা পারে, আমরা তা পারি না? অরা আর আমরা কি আলাদা? এই সেদিনও পর্যন্ত একই দেশ আছিল, একই মানুষ, সব দিক থিকা এক, আর এখন ইন্ডিয়ানরা আমাগো চাইতে বেশি যোগ্য হইলো কিসে?
বসির হাসতে হাসতে বললো, চাচা, এখন কিন্তু আপনিই বারবার ইন্ডিয়ার নাম উচ্চারণ করছেন।
বেশি উত্তেজিত হলে হোসেন সাহেব হাঁপিয়ে পড়েন। তিনি একটু দম নিয়ে বললেন, তোমরাই আমারে বুঝাও, কেউ সেধে সেধে নিজের মুখে চুনকালি দ্যায়? আইয়ুব খান হোল ওয়ার্লর্ডরে জানাইলো যে ইন্ডিয়ার লোকেরা ভোট দিয়া ডেমোক্রেসি রাখতে পারে, আর পাকিস্তানী নাগরিকরা ভোটের মর্ম বোঝে না। তারা বর্বর, অশিক্ষিত! এই কথাটা ভাবলেই আমার পিত্তি জ্বইলা যায়।
বসির বললো, কেন চাচা, আইয়ুব খান তো তাঁর কোটের আস্তিন থেকে এক নতুন চিড়িয়া বার করেছেন। অন্যরকম এক ডেমোক্রেসি, সারা দেশে মাত্র আশী হাজার লোক ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে!
হোসেন সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন, ঐটারই আমরা অপোজ করবো। বেসিক ডেমোক্রাসি না কচু পোড়া! ভোট হবে, দ্যাশের সকল প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ-মেয়েলোক ভোট দেবে! সোজা কথা, আমরা ইন্ডিয়ার সমান!
বসির আবার বললো, ইন্ডিয়া এমন কিছু অ্যাচিভ করে নাই যে তার সমান হবার জন্য আমাদের ব্যস্ত হতে হবে। পাকিস্তানকে হতে হবে ওয়ার্লড-এর যে-কোনো পাওয়ারের সমান। তার জন্য আগে ওয়েস্ট পাকিস্তান আর ইস্ট পাকিস্তানের মধ্যে প্যারিটি আনতে হবে। ফেডারাল স্ট্রাকচারের প্রশ্নে আমরা কী স্ট্যান্ড নেবো, সেটা আগে ঠিক করেন।
জহির বললো, আমি আজ উঠি। বাসায় ফিরতে হবে, দিনকাল ভালো না, শুনছি নাকি আবার দাঙ্গা হতে পারে।
কামাল আর পল্টন সচকিত হয়ে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলো, আবার দাঙ্গা? কে বললো তোমারে?
জহির বললো, শুনতে পাচ্ছি নানান জায়গা থেকে। বড় বিশ্রী লাগে। যা সব ঘটনা শুনি, তাতে মুখে ভাত রোচে না। মনে হয়, কোন্ যুগে বাস করছি।
পল্টন বললো, এই জানুয়ারি মাসেই তো একটা বীভৎস দাঙ্গা হয়ে গেল।
হোসেন সাহেব বললেন, ঐ সব কথা বাদ দাও। ইন্ডিয়ায় অনেক বেশি দাঙ্গা হয়। অনেক বেশি মুসলমান মরে।
জহির একটু গলা চড়িয়ে বললো, দাঙ্গা ইন্ডিয়ায় হউক আর পাকিস্তানেই হউক, এই একটা বিষয়ে পরস্পরের তুলনা চলে না। একপক্ষকে তো আগে বন্ধ করতেই হবে, নইলে অন্য পক্ষে বন্ধ হবে না। আমাদের এদিক থেকে যে বেশি লোক ভয়ের চোটে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সেকথা অস্বীকার করতে পারবেন? আমি ইন্ডিয়ার একটা কাগজে পড়লাম যে এই বছর সাড়ে চার মাসে সাড়ে তিন লক্ষ উদ্বাস্তু গেছে পাকিস্তান থেকে। শুধু ওয়েস্ট বেঙ্গলেই ডেইলি পাঁচ থেকে সাত হাজার উদ্বাস্তু ঢুকতেছে। আর ইন্ডিয়ায়: স্বাধীনতার পর মুসলমানের সংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ।
হোসেন সাহেব ভুরু তুলে বললেন, তুমি ইন্ডিয়ার কাগজ পড়ে বিশ্বাস করেছো? ওরা কক্ষনো সত্য কথা লেখে না। পাকিস্তান সম্পর্কে সব মিথ্যা লেখে। ইন্ডিয়ায় মুসলমানের কী অবস্থা তা তোমরা জানো না। দ্যাখো না, কাশ্মীরের শ্যাখ আবদুল্লারে পণ্ডিত জওহরলাল ক্যামন পুতুলের মতন নাচাইত্যাছে।
জহির বললো, ইন্ডিয়ার কাগজে মিথ্যা লেখে মানলাম। আমাদের যে কাগজ বাইরাবে তাতে সব সত্য কথা লেখা হবে তো? জানুয়ারিতে যে দাঙ্গা হইল, তার আসল কারণ এখানকার কোনো কোনো কাগজে বেরোয়নি। আমি আপনার কাগজে লিখবো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। ঢাকা শহরেই যে বাস্তুহারা হিন্দুদের জন্য পঁচিশটা শিবির হয়েছিল, সে ছবি বেরিয়েছিল কোনো কাগজে?
পল্টন বললো, ঐ দাঙ্গাটা বাধিয়েছিল আদমজী জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজার করীম। ও রটিয়ে দিয়েছিল যে কলকাতায় ওর ভাই খুন হয়েছে, সেই শোকে মিল দু’দিন ছুটি।
হোসেন সাহেব বললেন, তোমরা এই সব বাজে গুজবে বিশ্বাস করো?
পল্টন বললো, গুজব হোক আর যাই-ই হোক, গুজবেরই কি কম শক্তি? সেই রটনা শুনেই তো আদমজী জুট মিলের হাজার হাজার অবাঙালী শ্রমিক আল্লার নামে জেহাদ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আমি তখন মাধবদি বাজারে ছিলাম। গোলকানদয়াল গ্রামে হিন্দুদের পৌষ সংক্রান্তির মেলা চলছিল, শ্রমিকরা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাথারি খুন করতে লাগলো, বাচ্চা, মেয়েছেলে কারুরে বাদ দেয় নাই। একে দাঙ্গা বলে না, হিটলারের নাৎসীবাহিনীর সঙ্গে এর তুলনা দেওয়া চলে!
জহির বললো, সেই সময়েই তো ঢাকেশ্বরী কটন মিল, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল আক্রমণ করা হলো। হিন্দুদের একেবারে জানে-মালে শেষ করে দিয়ে, এ দেশ থেকে নিশ্চিহু করে দিলে কি আমাদের খুব লাভ হবে?
হোসেন সাহেব বললেন, তোমাদের দেখি হিন্দুদের জইন্য খুব দরদ? এটা তো আগে জানতাম না?
পল্টন বললো, হোসেন চাচা, এখানকার হিন্দুদের ঘৃণা করে আপনি যদি বিহার-উত্তর প্রদেশের মুসলমানদের প্রতি দরদ দেখান, তা হলে ওদিককার মুসলমানদেরই বেশি ক্ষতি করবেন।
হোসেন সাহেব বললেন, কইলকাতাতেও বড় রকমের দাঙ্গা হয়েছে। ইন্ডিয়ায় অনেক জায়গায় রায়ট হয়। গান্ধীরে যারা খতম করছে, সেই হিন্দুগুলা এখন আরও স্ট্রং, ব্রাহ্মণের বাইচ্চা জওহরলালের সাইধ্য নাই তাগো কন্ট্রোল করে। অরা মুসলমান মারলে আমরা হিন্দু মারুম না? জাতভাইয়ের গায়ে যেখানেই হাত পড়ুক, কোনো সাচ্চা মুসলমান তা সহ্য করবে না! ভাবলেই আমার রক্ত গরম হইয়া ওঠে!
কামাল বললো, ওদেশে যারা মরে তারা যেমন নিরীহ মুসলমান, তেমন এদেশে যারা মরে তারাও নিরীহ হিন্দু। দাঙ্গার সময় অসহায়, নিরীহ আর গরিবরাই মরে। চোখের সামনে নিরীহ মানুষকে মরতে দেখেও যে লোক আনন্দে লাফায়, সে কোনো ধর্মেই সাচ্চা মানুষ হইতে পারে না।
জহির বললো, জগন্নাথ কলেজে প্রায় দশ হাজার হিন্দুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, আমি নিজে দেখতে গিয়েছিলাম…অধ্যক্ষ সৈদুর রহমান যেভাবে তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন…তিনি না থাকলে আরও অনেকে মারা পড়তো…তিনি আপনার চেয়ে কম খাঁটি মুসলমান নন।
পল্টন বললো, আমার যা লজ্জা লেগেছিল–জগন্নাথ কলেজের সেই ক্যাম্পে গিয়ে শুনি সেখানে রয়েছেন ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী, এককালের কতবড় নাম করা বিপ্লবী, লোকে তাঁকে মহারাজ বলে, তিনিও শেষে…
হোসেন সাহেব হাত তুলে বললেন, বাদ দাও, ঐ সব কথা বাদ দাও!
এতক্ষণ বাদে আলতাফ বললো, আমি আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবর রহমানেকে পছন্দ করতাম না, সে গুণ্ডা লেলিয়ে একবার আমার মাথা ফাটিয়েছিল…এবারের দাঙ্গা কিন্তু সেই লোকই প্র্যাকটিক্যালি থামিয়ে দিল। পুলিস গুণ্ডাদের প্রশ্রয় দিচ্ছিল, সরকার থেকে হিন্দুদের। কোনো প্রোটেকশানই দেয়নি, তখন শেখ মুজিবর রহমান আর বোধ হয় শাহ আজিজুর রহমান মিলে একদিন চীফ সেক্রেটারি আলি আসগরকে শাসিয়ে এলো, গুণ্ডামি বন্ধ না করলে তাঁরা মীরপুরের বিহারী কলোনি উড়িয়ে দেবেন। তারপরেই তো সরকারের টনক নড়লো।
জহির বা পল্টন কেউই আওয়ামী লীগের সমর্থক নয়, তবে এখন তারা আলতাফের কথার প্রতিবাদ করলো না।
হোসেন সাহেব বললেন, তাহলে আজ এ পর্যন্তই রইলো। কাল সন্ধ্যাবেলা আবার সকলে চলে এসো। কাল আমরা কাগজ বার করার একটা টারগেট ডেট ঠিক করে ফ্যালবো।
সবাই উঠে দাঁড়ালো। বাবুল একটাও কথা বলেনি, প্রায় প্রতিদিনই সে নীরব শ্রোতা। জহিরের সঙ্গে সে একসঙ্গে বাড়ি ফেরে। তার মতন জহিরও এর পরে আলতাফের মদের আসরে যোগ দেয় না।
বাবুলের কাঁধে হাত রেখে জহির ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, তা হলে ঐ কথাই ঠিক রইলো, হোসেন চাচা। আমাদের কাগজে আমরা সব সত্যি কথা লিখবো। সত্যের মতন বড় অস্ত্র আর নাই!
হোসেন সাহেব বললেন, সে ঠিক আছে। কিন্তু তোমরা ইন্ডিয়া নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে পারবা না। আমি ইন্ডিয়ার খবর ছাপাবো না, নেহাৎ বড় কোনো খারাপ খবর না থাকলে
জহির বললো, চাচা, আমাদের চেয়ে আপনিই তো অনেক বেশিবার ইন্ডিয়ার নাম উচ্চারণ করেন। আপনার ইন্ডিয়া বাতিক হয়ে গেছে!
সকলের ঠোঁটে ঠোঁটে একটা মৃদু হাসির ঢেউ খেলে গেল।