সন্ধ্যারতির সময় ভক্ত ও দর্শকদের মধ্যে ঐ বিশেষ মানুষটিকে অসমঞ্জ রায় অনেক আগে থেকেই লক্ষ করেছিলেন। টাইট প্যান্ট ও সাদা টুইলের শার্ট পরা লোকটির হাঁটু মুড়ে বসতে কষ্ট হচ্ছিল নিশ্চয়ই, বসার ভঙ্গি বদলাতে হচ্ছিল বারবার। লোকটির চোখ ও নাক বেশ ধারালো, মাথার কুচকুচে কালো চুল নিখুঁত ভাবে ব্যাক ব্রাশ করা। এ রকম আধুনিক ও তরুণবয়স্ক কারুকে ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে দেখলে অসমঞ্জ রায় আজকাল আর বিশেষ অবাক হন না। তবে এই লোকটির মুখের হাসিটা যেন কী রকম কী রকম।
আশ্রম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সন্ধেবেলা মন্দিরের সামনের শামিয়ানার নিচের জায়গাটায় এক একদিন মানুষ ধরে না। অসমঞ্জ আগে ভাবতেন, শুধু বুড়ো বুড়িরাই ধর্মকর্ম করতে আসে। অথবা যারা পাপ করে, যারা মানুষ ঠকায়, যারা ফাটকাবাজ, যারা চট করে ভাগ্য ফেরাতে চায়, তারাই ভয়ে কিংবা অলৌকিক কিছু পাবার আশায় কোনো গুরুজী বা মাতাজীর পায়ে ধরনা দেয়। কিন্তু চন্দ্রামার আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হবার পর থেকে তিনি দেখছেন আঠেরো উনিশ বছরের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে কত শিক্ষক- অধ্যাপক-সরকারি অফিসার, ব্যবসায়ী, রাজনীতির নোক এখানে আসে, প্রণাম করবার সময় তাদের চোখ-মুখ ভক্তিতে একেবারে মাখো-মাখো হয়ে থাকে।
চন্দ্রার মতন একজন রূপসী সন্ন্যাসিনীর টানেও নিশ্চয়ই অনেকে আসে।
অসমঞ্জ রায় শুধু এই আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি নন, তাঁর আর একটি বড় দায়িত্ব চন্দ্রার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কারুকে আসতে না দেওয়া। তিনি নিজেই এই দায়িত্বটা নিয়েছেন, এ বিষয়ে চন্দ্রার সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হয়নি, কিন্তু চন্দ্রা নিশ্চিত তাঁর এই ভূমিকাটা সমর্থন করে, চন্দ্রা অসমঞ্জর কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে না, অসমঞ্জ তিন চারদিন না এলে আশ্রমের লোক তাঁর বাড়ি যায় খবর নিতে। গেটের বাইরে দু’জন দারোয়ান থাকে, তারা অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের আটকায়, যেমন কোনো মাতালের এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ, গাড়ি নিয়ে কেউ এই আশ্রমের কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকতে পারবে না, হতদরিদ্র চেহারার লোকরা সন্ধেবেলা প্রার্থনার সময় আসতে পারে বটে কিন্তু অন্য সময় তাদের জন্য গেট বন্ধ। অসমঞ্জ তীক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ রাখেন, অতিশয় ভক্তির ভাব দেখিয়েও কেউ অন্য কোনো মতলবে চন্দ্রার খুব কাছাকাছি আসতে চায় কি না। এ রকম ঘটনা কয়েকবার ঘটেছে।
এই আশ্রমের প্রথম ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক দত্ত মশাইকে নিয়েও বেশ কিছুদিন সমস্যা চলেছিল। একটা নিঃশব্দ দ্বৈরথ। দত্তমশাই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, অসমঞ্জ সেক্রেটারি, দু’জনের যখন তখন মতবিরোধ হয়েছে। চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বেশী, সুতরাং অসমঞ্জ বারবার পদত্যাগ করতে চেয়েছেন, প্রত্যেকবারই মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে চন্দ্রা, সে কিছুতেই অসমঞ্জকে ছাড়বে না, দত্তমশাইকে অগত্যা মেনে নিতে হয়েছে চন্দ্রার কথা। অসমঞ্জর বরাবরেরই ধারণা, ঐ দত্ত লোকটা একটা প্রচণ্ড ভণ্ড, ধর্মে-টর্মে তার বিশ্বাস নেই। এই আশ্রম করা তার একটা ভড়ং, আসলে সে চন্দ্রাকে নিয়ে খেলাতে চায়। চন্দ্রা কখনো ধরা দিতে চায় না বলেই তার জেদ চড়ে গেছে। লোকটা কিন্তু খাঁটি বর্বর নয়, জোর-জবরদস্তির দিকে যেতে চায় না। বুদ্ধির খেলার দিকেই তার ঝোঁক।
দত্তকে নিয়ে অসমঞ্জর শিরঃপীড়া হঠাৎ দূর হয়ে গেল অদ্ভুত ভাবে, আশ্রম প্রতিষ্ঠার বছর খানেকের মধ্যেই। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে দত্তমশাই ভর্তি হলেন পি জি হাসপাতালে, অসমঞ্জ ধরে নিলেন ও আর বাঁচবে না। চন্দ্রা যাতে মনে না করে যে দত্তমশাই চলে গেলে আশ্রমের খরচ চালাতে অসুবিধে হবে, তাই অসমঞ্জ এই সুযোগে একটা বিরাট চ্যারিটি শো-এর ব্যবস্থা করে তুলে দিলেন সতেরো হাজার টাকা। অসমঞ্জ দেখিয়ে দিলেন আশ্রমের জন্য অর্থ সংগ্রহের ক্ষমতা তাঁরও কম নয়।
কিন্তু দত্তমশাইয়ের জান অতি কড়া। অত বড় হার্ট অ্যাটাক সামলেও তিনি আবার উঠে বসলেন, শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই জীর্ণ হয়ে যায় নি, নিজের পায়ে হেঁটে তিনি বেরুলেন হাসপাতাল থেকে, তবে তারপর থেকে তিনি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মানুষ। নিজের ব্যবসাপত্তরের ভার সব ছেড়ে দিলেন জামাই ও ভাইপোদের ওপর। তিনি বারবার বলতে লাগলেন, ডাক্তারদের চিকিৎসায় নয়, তিনি সেরে উঠেছেন চন্দ্রামার অলৌকিক কৃপায়। কোমায় থাকার সময় চন্দ্রা প্রতিদিন এসে পুজোর ফুল-বেলপাতা ছুঁইয়ে দিয়ে যেত। দত্তমশাইয়ের মাথায়। সেই আচ্ছন্ন অবস্থাতেও তিনি দেখতে পেতেন এক জ্যোতির্ময়ী দেবী মূর্তি তাঁকে আশীর্বাদ করছেন, সেই দেবীর স্পর্শে তিনি নিবিড় শান্তি অনুভব করতেন সারা শরীরে। সবার সামনে তিনি চন্দ্রাকে মা মা বলে ডেকে পায়ের কাছে বসে পড়েন।
প্রথম প্রথম অসমঞ্জ সন্দেহ করতেন যে এটাও দত্তমশাইয়ের আর এক রকম চতুরালি। চন্দ্রার মাহাত্ম্য প্রচার করে আশ্রমের প্রতি আরও ভক্তদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা। আজকাল অধিকাংশ ধনী ব্যক্তিই হার্টের রুগী, তারা অনেকেই চন্দ্রার কাছ থেকে আশীবাদ, ফুল, প্রসাদ পাওয়ার জন্য লালায়িত হবে। সে রকম ঘটতেও শুরু করলো, বড়বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অনেক টাকার প্রণামী দিয়ে সামান্য ফুল-বেলপাতা আর দু’চার টুকরো সন্দেশ কিনে নিয়ে যেতে লাগলো।
তবু অসমঞ্জকে এক সময় স্বীকার করতেই হলো, দত্তমশাই আর আগের মতন নেই, চোখের দৃষ্টিটাই বদলে গেছে, চন্দ্রার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ে, প্রতিদিন দুবার চন্দ্রাকে তার প্রণাম করা চাই, কিন্তু চন্দ্রার পা পর্যন্ত স্পর্শ করেন না। একটু দূরের মাটি ছুঁয়ে জিভে ঠেকান। আমিষ আহার ত্যাগ করেছেন, আশ্রমের বাগানের গাছগুলির নিজে হাতে যত্ন করার ঝোঁক হয়েছে তাঁর। অসমঞ্জর সঙ্গে কোনো ব্যাপারে মতবিরোধ নেই তাঁর। যে-কোনো সমস্যা উঠলেই তিনি বলেন, ওসব আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই-ই হবে। আগে তিনি অসমঞ্জকে ডাকতেন মাস্টারবাবু বলে, এখন বলেন মাস্টারদা। এ আশ্রমের ছোট বড় সবাই তাঁর দাদা কিংবা দিদি।
শরীর দুর্বল হয়েছে বলে দত্তমশাইয়ের ভোগ বাসনাও অন্তর্হিত হয়েছে। শরীর এখন আর শরীর চায় না। এখন শুধু কোনোক্রমে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার লোভ। অসমঞ্জ এখন দত্তমশাইকে খরচের খাতায় তুলে দিয়েছেন।
চন্দ্রা সম্পর্কে ধাঁধার ভাবটা কিছুতেই অসমঞ্জর মন থেকে গেল না। চন্দ্রার সত্যিই কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আছে, এ তিনি মেনে নিতে পারেন না। কয়েকবছর আগেই এই চন্দ্রা টেনিস খেলতো, সিগারেট খেত, কখনো কখনো মদের গেলাসেও চুমুক দিয়েছে। হঠাৎ কি আকাশ থেকে তার ওপরে আধ্যাত্মিক শক্তি নেমে এলো? চন্দ্রার মুখে অনেক সময়ই একটা ভাবের ঘোরের মতন দেখা যায়, সেটা কি আরোপিত? মাঝে মাঝে যেন পুরোনো চন্দ্রা উঁকি মারে।
অসমঞ্জ এ আশ্রমের পরিচালনার ভার নিয়েছেন, কিন্তু এখনো ভক্ত হতে রাজি হননি। পুজো ও আরতির সময় তিনি মন্দিরের সামনে বসেন না, অফিস ঘরের জানলা দিয়েই সব দেখতে পান। চন্দ্রাও তাঁকে কখনো দীক্ষা নেবার কথা বলেনি। চন্দ্রা যেন জানে, অসমঞ্জ তার কাছে বাঁধা পড়ে থাকবেই। এখনো হঠাৎ হঠাৎ অসমঞ্জ চার হাত কিংবা শরীরের কোনো অংশ ছুঁয়ে দিয়ে বিদ্যুতের শিহরন বোধ করেন, সেই শিহরনে সুখ নেই, প্রত্যেকবার তাঁর মনে হয়, চন্দ্রা তাঁর জীবনটা ধ্বংস করে দিল, শেষ নিঃশ্বাস ফেলার সময় পর্যন্ত অসমঞ্জর এক গভীর অতৃপ্তি থেকে যাবে।
এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার ফলে, শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানই প্রধান হয়নি, সতেরোটি অনাথিনী নারী আশ্রয় পেয়েছে এখানে। এদের কয়েকজনকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে রাস্তা থেকে, ওরা হাতের কাজ ও কিছু লেখাপড়া শিখছে, দুটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা এপর্যন্ত ভালোই আছে। এই বিশাল দেশে অসংখ্য অসহায় নারী, তাদের মধ্য থেকে মাত্র সতেরোজনের পুনবার্সন, হয়তো কিছুই না, তবু তো একটা কাজ। চন্দ্রার আশ্রম প্রতিষ্ঠার শখের এই ভালো দিকটা অসমঞ্জ অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু এ দেশে যে-কোনো সামাজিক কাজ করতে গেলে কি একটা ধর্মের বাতাবরণ তৈরি করে নিতেই হবে?
সন্ন্যাসিনী হবার বছর খানেক পর থেকে চন্দ্রা একটু মোটা হতে শুরু করেছিল। আলো চালের ভাত ও আলু সেদ্ধ, ঘি মাখনের ফল। তা ছাড়া যে মেয়ে নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেলতো, সে যদি দিনের অধিকাংশ সময় বসে বসে ধ্যান করতে শুরু করে, তবে তার গায়ে তো চর্বি লাগবেই। অসমঞ্জ কষ্ট পেয়েছিলেন। চন্দ্রার ঐ রূপ, এত তাড়াতাড়ি ফ্যাকাসে হয়ে যাবে? এ যে সৌন্দর্যের অনর্থক অপচয়। চন্দ্রা যদি ক্রমে একটি গোলগাল, নিরামিষ চেহারার গুরুমা-তে পরিণত হত, তা হলে হয়তো উপকারই হতে অসমঞ্জর, চুম্বকের টান ছিন্ন হয়ে যেত।
কিন্তু ঠিক সময়ে সচেতন হয়ে গেল চন্দ্রা। সে কি গোপনে ব্যায়াম শুরু করেছে? সে আর মিষ্টি খায় না, সপ্তাহে একদিন সে সম্পূর্ণ উপবাস করে ও মৌন থাকে। আবার সে রূপের ঔজ্জ্বল্য ও ধারালো ভাবটি ফিরে পেয়েছে। শুধু পরমার্থের চিন্তাই নয়, চন্দ্রা তা হলে নিজের শরীর নিয়েও চিন্তা করে। তা হলে শরীরের অন্যান্য দাবিগুলোর কথা কি সে ভাবে না? তার বুকে, দু’বাহুর মধ্যে একটা আলিঙ্গনের শূন্যতা নেই? অসমঞ্জ চন্দ্রার চোখের দিকে চেয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করে সেটাই বুঝবার চেষ্টা করেন। এখনো তাঁর আশা, একদিন না একদিন চন্দ্রার সংযমের বাঁধ ভাঙবে।
আরতি শেষ হয়ে যাবার পর আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হয়ে এলো। যারা নিয়মিত আসে, যাদের বাড়িতে হয়তো কথা বলার বিশেষ কেউ নেই, তারা আরও কিছুক্ষণ থেকে যায়। আজ অবশ্য চন্দ্রার বদলে প্রার্থনা পরিচালনা করেছে পূর্ণিমা, তাই আজ অন্যদের আকর্ষণ কম।
সেই সাদা শার্ট পরা নতুন লোকটি আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো মন্দিরের সিঁড়ির কাছে। পূর্ণিমা তার হাতে এক টুকরো সন্দেশের প্রসাদ দিতে, সেটি নিয়ে সে কপালে ঠেকালো কিন্তু খেল না, পকেটে রেখে দিল।
তারপর অতি নম্র স্বরে সে জিজ্ঞেস করলো, আপনাদের এই আশ্রমের গুরুমার সঙ্গে একবার দেখা করা সম্ভব?
এই সময় অসমঞ্জ বেরিয়ে এলেন অফিস ঘর থেকে। মানুষের মুখের রেখাতেই অনেক কিছু প্রকাশ পায়। এই যুবকটি এতক্ষণ ধরে বসেছিল, কিন্তু এর মুখে ভক্তিভাব ছিল না একবিন্দু, শুধু কৌতূহল।
অসমঞ্জ জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী চাইছেন?
অসমঞ্জর এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে যুবকটি চেয়ে রইলো পূর্ণিমার দিকে। তার কাছ থেকে সে নিজের প্রশ্নের উত্তর আশা করছে।
পূর্ণিমা বললো, আজ তো দেখা হবে না। আজ বেস্পতিবার, ওঁর মৌন।
যুবকটি বললো, কথা বলবার দরকার নেই, আমি শুধু একটু দেখা করবো।
পূর্ণিমার বদলে অসমঞ্জ গলা ভারি করে বললেন, না, আজ দেখা হবে না। আজ উনি কারুর সঙ্গে দেখা করেন না।
এতেও বিচলিত হলো না সেই আগন্তুক, পকেট থেকে একটি নোট বই ও কলম বার করে খসখস করে দু লাইন লিখে কাগজটি ছিঁড়ে বললো, এই চিঠিটা একটু দিয়ে আসবেন, আমি অপেক্ষা করছি।
পূর্ণিমা অসমঞ্জর দিকে তাকালো। চন্দ্রার মৌনব্রতের দিনেও চিঠি পাঠাবার কোনো নিষেধ নেই। আশ্রমের নানান খুঁটিনাটি কথা তাঁকে সারাদিন ধরেই ছোট ছোট চিঠিতে জানানো হয়। চন্দ্রা উত্তরও লিখে দেয়। অসমঞ্জও একটু আগেই একটা চিঠি পাঠিয়েছেন।
মৌনব্রতের দিন চন্দ্রা যে সর্বক্ষণ ধ্যান বা পুজো-আচ্চা করে তাও না। সেদিন সে। চিলেকোঠায় একলা একলা কাটায়, সঙ্গে প্রচুর বই থাকে। সে বইও ধর্মপুস্তক নয়। শতবার্ষিকীর বছরে রাজ্য সরকার প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলীর পুরো এক সেট আছে সেখানে, ইয়েটস-এজরা পাউণ্ড-এলিয়টের কাব্য সংগ্রহ আছে, অসমঞ্জ প্রায়ই চন্দ্রার জন্য নতুন বই এনে দেন।
অসমঞ্জ আপত্তি জানাতে পারলো না, পূর্ণিমা চিরকুটটি নিয়ে চলে গেল। অসমঞ্জ জিজ্ঞেস করলো, আপনি কোথা থেকে আসছেন? যুবকটি এবারে ফিরে বললো, আপনি অসমঞ্জবাবু, তাই না? আপনার কথা শুনেছি। আমি কাছ থেকেই আসছি। এখানকার গুরুমার যিনি বাবা, সেই আনন্দমোহন চক্রবর্তী আমায় চেনেন, তাঁর সোর্স ধরেই এসেছি, আমার একটা জরুরী সমস্যা আছে।
অসমঞ্জু বললো, আনন্দমোহনবাবু তো প্রায়ই এখানে আসেন, প্রার্থনা শোনেন, আজই আসেননি দেখছি।
–হ্যাঁ, তিনি এলে আমার খানিকটা সুবিধে হতো। আচ্ছা, এই আশ্রমের মধ্যে সিগারেট খাওয়া যায় না, তাই না? আমি একটু কম্পাউণ্ডের বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।
–অফিস ঘরের মধ্যে আসুন।
বাইরের লোক অনেকেই চলে গেছে। দুটি আশ্রমের মেয়ে মন্দিরের সামনে উবু হয়ে বসে পরিষ্কার করছে ফুল-বেল পাতা। এদের মধ্যে একটি মেয়ে শিয়ালদা স্টেশনে ছিল। এখন খুব মন দিয়ে সব কাজ করে।
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে বাঁধা কপির তরকারি রান্নার গন্ধ। এক একদিন অসমঞ্জ এখান থেকেই খেয়ে যান। আগে এক বেলাও নিরামিষ খেতে পারতেন না। এখন মাঝে মাঝে মন্দ লাগে না।
নিজেও একটি সিগারেট ধরিয়ে অসমঞ্জ জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম?
যুবকটি হেসে বললো, নাম শুনে আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি অতি সাধারণ মানুষ, আমি এসেছি একটা খুব ব্যক্তিগত ব্যাপারে।
ব্যক্তিগত শব্দটির ওপর বেশি জোর দিয়ে সে যেন বুঝিয়ে দিতে চাইলো, অসমঞ্জর কাছ থেকে সে আর কোনো কৌতূহলী প্রশ্ন শুনতে চায় না।
এই সময় পূর্ণিমা ফিরে এলো সবেগে। বোঝাই যায় সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছে ছুটতে
–আপনি চলে যান, দেখা হবে না!
অসমঞ্জ এবং যুবকটি পূর্ণিমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারা দু’ জনেই আরও কিছু শুনতে চায়।
পূর্ণিমা বললো, চিঠিটা পড়েই চন্দ্রামা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেললেন, আমার দিকে রাগ রাগ চোখে তাকালেন।
যুবকটি মুখ নিচু করে সিগারেটে একটা জোর টান দিল। তারপর যখন আবার মুখ তুললো, তার চরিত্র বদলে গেছে। কঠিন গলায় সে বললো, ঠিক আছে, আমি আবার কাল আসবো! কালকে উনি প্রকাশ্যে দেখা দেবেন আশা করি?
অসমঞ্জ বললেন, আপনার কী দরকার যদি আমাকে বলতে পারেন…
কোনো উত্তর না দিয়ে সে পেছন ফিরে চলে গেল হনহনিয়ে।
পূর্ণিমা ফিস ফিস করে বললো, মাস্টারদা, খুব রেগে গেছেন চন্দ্রামা। বোধ হয় লোকটা ওঁর চেনা।
চিঠিখানা কেন আগে অসমঞ্জ সেনসর করে পাঠাননি, সে জন্য অসমঞ্জ অনুতপ্ত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে গেল, এর পর থেকে কোনো উটকো লোকের চিঠিই চন্দ্রার কাছে পাঠানো হবে না। অসমঞ্জ নিজে আগে পড়ে দেখবেন। কে এই যুবকটি?
যেদিন চন্দ্রার মৌনব্রত থাকে, সেদিন অসমঞ্জ আর বেশিক্ষণ থাকেন না আশ্রমে। কিন্তু আজ তাঁর যেতে পা সরলো না। তিনি হিসেবের কাগজপত্র নিয়ে বসে গেলেন। মেয়েদের অনাথ আশ্রম চালাবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি ইংরিজি আবেদন পত্রের মুশাবিদা করলেন অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু কিছুতেই তাঁর ঠিক মনঃপূত হচ্ছে না। এই যুবকটির ব্যবহার তার মনের মধ্যে একটা খটকা ধরিয়ে দিয়ে গেছে। ও সাধারণ কেউ নয়।
একসময় অসমঞ্জর মনে হলো, আজ চন্দ্রার সঙ্গে একবার দেখা না করে গেলে কিছুতেই রাতে ঘুম হবে না। তিনি দেখা করতে গেলেও কি চন্দ্রা ফিরিয়ে দেবে? সব নিয়মেরই তো ব্যতিক্রম আছে।
তিনি সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠে এলেন ছাদের ঘরে। তিনতলায় এই একটিই মাত্র ঘর। এদিকে এখনও তেমন নতুন বাড়ি ওঠেনি, ছাদ থেকে অনেকদূর পর্যন্ত ফাঁকা দেখায়। বোধ হয় শুক্লপক্ষ চলছে। সন্ধের পর থেকে আকাশে পাতলা জ্যোৎস্না। ছাদের পাশেই দুটি নারকোল গাছের ডগা দুলছে বাতাসে। শেয়াল ডাকছে জলাভূমির ধারে।
চন্দ্রার ঘরের দরজাটা বন্ধ নয়, ভেজানো। খুব কাছে গিয়ে তিনি দু’বার আস্তে ডাকলেন, চন্দ্রা, চন্দ্রা।
বই পড়তে পড়তে চন্দ্রা অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। আবার জেগে উঠে পড়ে। একদিন ভোর থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত এই রকম চলে। এই ঘরের সংলগ্ন একটি বাথরুম আছে, সুতরাং চন্দ্রাকে একবারও বেরুতে হয় না।
জেগে থাকলেও তো চন্দ্রা সাড়া দেবে না। অসমঞ্জ নিজেই দরজাটা ঠেলে খুলবেন কিনা ভাবছেন, এমন সময় দরজাটা খুলে গেল। শ্বেতবসনা চন্দ্রা, মাথার চুল খোলা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। অসমঞ্জ খানিকটা কম্পিত বক্ষে লক্ষ করলেন, এরকম অসময়ে এলেও চন্দ্রার চোখে রাগ বা বিরক্তির চিহ্ন নেই।
অসমঞ্জ বললেন, একটু ভেতরে আসব? সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট-এর কাছে চিঠিটা ড্রাফট করার জন্য দু একটা পয়েন্ট…
দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে চন্দ্রা মেঝেতে বসে পড়লো, এ ঘরে খাট-বিছানা নেই, শুধু একটি কম্বল পাতা। একটি কাঁচের জগ ভর্তি জল ও গেলাস। চন্দ্রার উপবাস নিরঙ্কু নয়। আর একটা বেস্পতিবার মাত্র অসমঞ্জ এই ঘরে চন্দ্রার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন বিশেষ দরকারে। এ ঘরে চন্দ্রাকে দেখলেই তার “যৌবনে-যোগিনী” শব্দ দুটি বার বার মনে পড়ে।
রবীন্দ্ররচনাবলীর একটি গল্পের পৃষ্ঠা খোলা। রাজা নাটক পড়ছে চন্দ্রা। পাশে একটি খাতা। সেই খাতাটা টেনে নিয়ে চন্দ্রা লিখলো, গভর্নমেন্টের চিঠির কথা কাল হবে। তুমি নিশ্চয়ই অন্য কথা বলতে এসেছো? বলো।
খাতাটা নিয়ে লেখাগুলি পড়ে অসমঞ্জ তার তলায় লিখলেন, আজ একটি লোক এসেছিল, তোমাকে চিঠি পাঠালো। তুমি তাকে চেনো? সে কে?
চন্দ্রা আবার লিখলো, ও কথা থাক, অন্য কথা বলো।
অসমঞ্জ আবার কিছু লিখতে গিয়ে থেমে গেলেন। চন্দ্রার আজ মৌন, সে লিখে লিখে কথা বলবে। কিন্তু অসমঞ্জর তো লেখার দরকার নেই। তিনি তো মুখে বললেই পারেন। তা ছাড়া তাঁর বাংলা হাতের লেখা ভালো নয়।
তিনি বললেন, লোকটি আবার কাল আসবে বলে গেল। খুব রাগ রাগ ভাব। তুমি চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছো শুনে অপমানিত বোধ করেছে।
“আসুক কাল।”
–মনে হয় কাল একটা কিছু গণ্ডগোল করবে। আমরা কি ওকে গেটে আটকাবো?
“কোনো দরকার নেই। ও কী বলবে তা আমি জানি।”
–চন্দ্রা, তুমি ওকে চেনো? ও কে?
“তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন, অসমঞ্জ? অন্য কথা বলো।”
–না, আমি জানতে চাই ঐ লোকটা কে? যদি আশ্রমের মধ্যে চ্যাঁচামেচি করে, যদি তোমাকে কোনো খারাপ কথা বলে…আগে থেকে তার প্রতিকার করা আমাদের কর্তব্য।
চন্দ্রা কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো অসমঞ্জর দিকে। তারপর আবার লিখলো, “ও বিমান! আমার স্বামী। এতদিন পরে এসেছে। ও খুব ভদ্র, ওর মুখ দিয়ে খারাপ কথা বেরোয় না।”
অসমঞ্জ প্রায় ফিসফিস করে বললেন, তোমার স্বামী? আমি প্রথমে তাই-ই ভেবেছিলুম। কিন্তু দেখলে তোমার চেয়ে বয়েসে ছোট মনে হয়…এতদিন পর এসেছে… কেন?
“ও কী চায়, আমি জানি। ও আবার বিয়ে করতে চায়…কিন্তু আমি ওকে বিবাহ-বিচ্ছেদ দেবো না। ওকেও সন্ন্যাসী হতে হবে?”
এবারে গলা চড়িয়ে অসমঞ্জ বললেন, ও তোমার স্বামী…ডিভোর্স চাইতে এসেছে…একটা প্রচণ্ড স্ক্যান্ডাল হবে, আশ্রমের সুনাম নষ্ট হবে…চন্দ্রা, তুমি কোনোক্রমেই কাল ওর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। তুমি কয়েকটা দিন অন্য কোথাও গিয়ে থাকো।
“কোথায়?”
–তুমি পুরী যাবে বলছিলে, জগন্নাথ দর্শন করতে। আমি তোমায় নিয়ে যেতে পারি। চন্দ্রা, প্লীজ, ঐ লোকটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল, একটা কিছু অঘটন ঘটতে চলেছে। ওকে তুমি কেন ডিভোর্স দেবে না?…
“ও আর একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করবে। সে অধিকার ওকে দেওয়া চলে না।”
চন্দ্রা যতক্ষণ ধরে লিখছে ততক্ষণ যেন অসমঞ্জ ধৈর্য ধরে থাকতে পারছেন না। আবেগের আতিশয্যে তিনি চন্দ্রার অন্য হাতটা চেপে ধরলেন।
চন্দ্রা মুখ তুলে নিবিড়ভাবে দেখলো অসমঞ্জকে। তারপর আবার লিখলো, অসমঞ্জ, তুমি কী চাও?
–আমি চাই, তুমি কয়েকদিনের জন্য…আমার সঙ্গে পুরী যেতে নিশ্চয়ই তোমার আপত্তি নেই। তুমি তো একা যেতে পারো না…
চন্দ্রা আবার ঐ একই কথা লিখলো, “অসমঞ্জ, তুমি কী চাও?”
এবারে অসমঞ্জ গভীর অভিমানের সঙ্গে বললেন, আমি কী চাই, তুমি জানো না। এতদিন ধরে… চন্দ্রা, তুমি আমার বউকেও তোমার মতন সন্ন্যাসিনী করেছে, তাকে দীক্ষা দিয়েছো, সে আমাকে আর স্বামীর মর্যাদা দেয় না…আমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছো তুমি, দিন দিন আমি শুধু এই আশ্রমের সেবাদাস হয়ে যাচ্ছি…সে সব কেন, কিসের জন্য? আজও তুমি জিজ্ঞেস করছো, আমি কী চাই?
চন্দ্রাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে তিনি তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে গেলেন। চুম্বনের একটা ভঙ্গি মাত্র, প্রকৃত চুম্বন নয়, শুধু ঐটুকু স্পর্শেই সাতচল্লিশ বছর বয়স্ক অসমঞ্জ রায় এমন কেঁপে উঠলেন যে নিজেই পরের মুহূর্তে চন্দ্রাকে ছেড়ে সরে গেলেন দূরে। একটা ভয়ার্ত পশুর মতন বসলেন দেয়ালে ঠেস দিয়ে।
ঠিক যেন সম্মোহন করার মতন অসমঞ্জর দিকে চন্দ্রা নিষ্পলকভাবে চেয়ে রইলো প্রায় পুরো এক মিনিট। তারপর রাগের বদলে তার মুখে ফুটলো হাসি। এবারে সে কথাও বললো। বুক থেকে আঁচল ফেলে দিয়ে সে বললো, তুমি এই চাও, অসমঞ্জ, এসো।
পটপট শব্দে ব্লাউজের টিপ বোতাম খুললো চন্দ্রা। ব্রেসিয়ার সে অনেকদিনই পরে না। অনেকদিন অস্পৃষ্ট, অনাঘ্রাত, নিটোল স্তন দুটির দিকে চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে রইলো অসমঞ্জ। মা যেমন করে তার সন্তানকে স্তন্য পান করায়, সেইভাবে নিজের একটি বুকে হাত দিয়ে চন্দ্রা বললো, এসো।
অসমঞ্জ দেরি করছে দেখে চন্দ্রা নিজের শায়ার দড়িতে হাত দিয়ে আরও মধুর করে হেসে বললো, তুমি যা চাও, আজ সব দেবো, অসমঞ্জ। আমার তো কোনো লজ্জা নেই। পাপ নেই।
অসমঞ্জর মনে হলো যেন তার শরীরে হাজার হাজার তীর বিধছে। হাজার হাজার চোখ। এই আশ্রমের সব মেয়েরা, রাস্তার লোকেরা, তার স্ত্রী, তার শ্বশুরবাড়ির সবাই দেখছে, এক্ষুনি তার ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। চন্দ্রার মতন এই জ্বলন্ত আগুন নিয়ে সে কী করবে, কোথায় পালাবে, এই আশ্রম ভেঙে যাবে, কেউ আর তাদের দু’জনকে আশ্রয় দেবে নাঃ না, না, এতখানি সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর নেই, তিনি তো এত বেশি চাননি। চন্দ্রার একটু স্পর্শ, মুখের হাসি, যদি চন্দ্রা তার বুকে একবার মাথা রাখতে দেয়। সেই-ই তো যথেষ্টরও বেশি।
অদ্ভুত ভয় মাখানো গলায় অসমঞ্জ বললেন, না, না, চন্দ্রা, আমায় ক্ষমা করো, আমি অন্যায় করেছি। আমার মাথার ঠিক ছিল না।
চন্দ্রা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, এত ভয় কিসের, অসমঞ্জ? তোমার যখন এতটাই ইচ্ছে, এই অতি সামান্য শরীর, রক্তমাংসের পিণ্ড, তার প্রতি তোমার যদি এতটাই মোহ থাকে, তবে সে মোহটাকে মিটিয়ে নাও। শরীরের তো পাপ-পুণ্য নেই, সব কিছুই মনের। অসমঞ্জ, যতদিন তোমার চোখে লোভ থাকবে, মোহ থাকবে, ততদিন তো তুমি কোনো বড় কাজে মন বসাতে পারবে না! এসো অসমঞ্জ, আমাকে ছুঁয়ে দেখো, আমার ভেতরেও যদি ষড়রিপুর কিছু অবশিষ্ট থাকে, তাকে শেষ করে দাও!
অসমঞ্জর মনে হলো, চন্দ্রা যেন তার মাথা ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে আরও ওপরে। চন্দ্রার দুই স্তন, তার নিম্ন উদর, তার দুই ঊরু, সবকিছুই বিশাল। চন্দ্রার তুলনায় তিনি কুঁকড়ে ছোট হয়ে যাচ্ছেন খুব দ্রুত। ঘরের অনেকগুলি জানলা দিয়ে শত শত নারী-পুরুষ সকৌতুকে দেখছে সেই দৃশ্য।
একটু এগিয়ে এসে চন্দ্রা আবার বললো, অস্বীকার করতে পারি না, আজ আমার মধ্যেও চাঞ্চল্য ঘটেছে। আজ যে এসেছিল, সে আমার স্বামী, বিমান, কেন তাকে ছেড়ে এসেছিলাম এ পর্যন্ত কারুকে তা বলিনি। তুমি শুনতে চাও?
কথা বলার ক্ষমতাই যেন চলে গেছে, অসমঞ্জ শুধু ঘাড় হেলালেন।
চন্দ্রা আস্তে আস্তে থেমে থেমে বললো, আমাদের মধ্যে ভালোবাসা হয়েছিল, যেমন যুবক যুবতীদের মধ্যে হয়। বিমান আমাকে বিয়ে করার জন্য সাধ্যসাধনা করেছিল, আমি তখনও ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, পরীক্ষা না দিয়েই ঝোঁকের মাথায় রাজি হয়ে গেলুম বিয়ে করতে। এই ঝোঁকটা আসলে কী বলো তো, শারীরিক মিলনে দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা মেটাবার জন্য একটা সামাজিক স্বীকৃতি। তার নামই তো বিয়ে, তাই না? বিয়ে আমাদের হলে, শারীরিক মিলনের তীব্র সুখও যে পেয়েছিলাম, তা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু আমাদের বিয়ের ঠিক এক বছর এক মাস সতেরো দিন পর বিমান তার এক মাসতুতো বোনের সঙ্গে শুয়েছিল, আমার চোখে পড়ে গিয়েছিল। তাতে আমি প্রচণ্ড দুঃখ পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশী অবাক হয়েছিলাম। তা হলে ভালোবাসা কী? ভালোবাসা বলে কি কিছুই নেই? কিংবা শরীর পুরোনো হয়ে যায়, তবু ভালোবাসা থাকে। বিমান আমাকে ঠিক আগের মতনই ভালোবাসার ভান করতো, কিংবা সেটা ভান নয়, শরীর-নিরপেক্ষ ভালোবাসা? রবীন্দ্রনাথ তো এরকম ভালোবাসার কথা লেখেননি? কোনো কবি-সাহিত্যিক লেখে না। তুমি বিমানের সঙ্গে মিশে দেখো, অসমঞ্জ, সে চমৎকার মানুষ, তার ব্যবহারে কোনো খুঁত নেই, কিন্তু সে কি শুধু শরীরের মধ্যে ভালোবাসা খোঁজে? অসমঞ্জ, তুমি আরও শুনবে?
কম্পিত গলায় অসমঞ্জ বললেন, চন্দ্রা, চন্দ্রা, তুমি শান্ত হও! বাকি সব কথা পরে শুনবো!
চন্দ্রা অসমঞ্জর কাঁধে একটা হাত রেখে বললো, আমিও শরীরের মধ্যে ভালোবাসা খুঁজেছি। কিছুতেই পাইনি। সে যে কী কষ্ট! শরীরে একটা জৈবিক সুখ আছে। কিন্তু ভালোবাসা না পাবার উপলব্ধির বেদনা যে আরও অনেক, অনেক বেশী তীব্র! তোমার স্ত্রী অসুস্থ, তুমি তার কাছ থেকে সুখ পাও না, তুমি আমার শরীরের মধ্যে কি ভালোবাসা খুঁজতে চাও, অসমঞ্জ? তবে নাও, খুঁজে দেখো, এসো অসমঞ্জ, লজ্জা কী?
অসমঞ্জ বলে উঠলেন, না, না, না!
চন্দ্রা নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে বললো, ভালো করে ভেবে দ্যাখো, অসমঞ্জ, মনে কোনো দ্বিধা রেখো না। যদি এই শরীরটাকে পেলে তোমার মোহ মিটে যায়…
রক্তচন্দনবণা, খলিতবসনা চন্দ্রাকে অসমঞ্জর মনে হলো যেন কালী মূর্তি। তিনি আর তাকাতে পারছেন না। সত্যিকারের ভয়ে তার শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে।
হাত জোড় করে তিনি প্রায় কেঁদে ফেলে বলতে লাগলেন, এই শেষবারের মতন আমায় ক্ষমা করো, চন্দ্রা। আমি স্বীকার করছি, তুমি অসাধারণ, তোমার অলৌকিক শক্তি আছে, তুমি আমাদের থেকে অনেক ঊর্ধ্বে…
মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে অসমঞ্জ চন্দ্রাকে প্রণাম করে ফেললেন।