সীট রিজার্ভেশানের কোনো সুযোগ পাওয়া যায়নি, প্রতাপদের উঠতে হয়েছে ভিড়ের কামরায়। কুলিকে বেশি পয়সা দিয়ে কোনোক্রমে একটি মাত্র বসার জায়গা পাওয়া গেছে, সেখানে জোর করে বসানো হয়েছে সুপ্রীতিকে। তুতুলকে নিয়ে প্রতাপ দাঁড়িয়েছেন বাথরুমের দরজার পাশে।
মানুষের ভিড় তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু এই সব কামরার লোকে এত মালপত্র তোলে যে সামান্য একটু নড়াচড়ার জায়গাও পাওয়া যায় না। লাগেজ কেরিয়ারে ভারি মালপত্র বুক করার প্রথা বোধহয় উঠেই গেছে। থার্ড ক্লাস কামরায় এক একজন যাত্রী তিন চারখানা বস্তা, স্টিলের ট্রাঙ্ক নিয়ে ওঠে, বাংকে রাখার জায়গা না থাকলে সীটের তলায় না ঢুকলে সেগুলো যেখানে সেখানে পড়ে থাকে।
ট্রেন চলতে শুরু করার পর আস্তে আস্তে একটু একটু জায়গা হয়ে যায়। যারা করিকমা তারা অন্যদের ঠেলেঠুলে প্রথমে সূচ হয়ে ঢোকে। কেউ কেউ মালপত্রগুলোর ওপরেই বসে। প্রতাপ আর তুতুল সেরকমও কোনো জায়গা পেল না।
সুপ্রীতি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন মেয়ে আর ভাইয়ের দিকে। একটুও স্বস্তি নেই তাঁর মনে, দাঁড়িয়ে যেতে তাঁর একটুও কষ্ট হবে না, কিন্তু ওদের দু’জনের কেউই রাজি হবে না তাঁর জায়গায় বসতে। তিনি উঠে দাঁড়ালে অন্য কেউ জায়গাটা দখল করে নেবে। এক একবার সুপ্রীতি ভাবছেন, সেটাই ভালো কি না। তিনজনেই বেশ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যাবেন, তাতে তাঁর মনে শান্তি আসবে অন্তত।
কিন্তু সুপ্রীতি জানেন, তিনি উঠে দাঁড়াতে গেলেই বকুনি খাবেন ভাইয়ের কাছে। এ এক মহা জ্বালা!
রাত্রির ট্রেনের শব্দ বেশি। রাত্রির ট্রেনের দুলুনিও বেশি। রাত্রির ট্রেন ছোটেও কি বেশি জোরে? এটা একটা মেইল ট্রেন। আগেকার দিনে বলতো ডাক গাড়ি। মেইল শব্দটার সেই অর্থ এখন অনেকেরই মনে পড়ে না। মেইল ট্রেন শুনলেই মনে হয় এক দুর্দান্ত প্রকৃতির পুরুষ, দিগন্ত ভেঙে আর এক দিগন্তে যাচ্ছে। পাহাড় ডিঙিয়ে যায় অনায়াসে, গভীর জঙ্গলও এই মেইল ট্রেনকে দেখলে যেন দু’পাশে সরে যায় ভয়ে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই প্রতাপের ঝিমুনি এসে গেল। মা তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, মা তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, কী কথা, কী কথা! এই চিন্তাটা সর্বক্ষণ তাঁর মাথার মধ্যে এমন ঘুরছে যে ক্রমশ তাঁকে ক্লান্ত করে দিচ্ছে। মার সঙ্গে শেষ দেখা হবে তো?
তুতুল প্রতাপের বাহু চেপে ধরে বলে উঠলো, মামা!
প্রতাপের চটকা ভেঙে গেল। তিনি ঢুলতে ঢুলতে পড়ে যাচ্ছিলেন, তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে জোর করে চোখ মেলে তাকালেন। দু’এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে পড়লো না তিনি কোথায় আছেন।
তুতুল বললো, মামা, তুমি আমার কাঁধে মাথা রাখো।
একটা বিস্ময়ের ধাক্কায় মিলিয়ে গেল ঘুমঘোর। অনেক দিন পর তুতুল নিজে থেকে একটা কথা বলেছে। তার মুখে অন্ধকার-অন্ধকার ভাবটা নেই। সে প্রতাপের ভার বহন করতে চায়।
–না রে, আমি এখন ঠিক আছি।
–তোমার মাথাটা এখানে রাখো না!
প্রতাপ নিজের মাথা রাখলেন না। তুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোর বুঝি কষ্ট হচ্ছে না?
বর্ধমানের পরে একজন টিকিট চেকার উঠলো। অল্পবয়েসী, বেশ চটপটে স্বভাবের। ঘুমন্ত মানুষগুলিকে ঠেলে ঠেলে তুলে টিকিট দেখতে চাইছে। এক একজন মানুষের এক এক রকম প্রতিক্রিয়া। প্রতাপ সেদিকে চেয়ে রইলেন, এতক্ষণে তবু খানিকটা একঘেয়েমি কাটলো।
টিকিট চেকারটি ঘুরতে ঘুরতে এলো প্রতাপের সামনে। প্রতাপ আগে থেকেই টিকিট বার করে হাতে রেখেছিলেন, ছেলেটি তুতুলকে দেখতে দেখতে টিকিটগুলোনিল। রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা, ভালো করে খায় না, তবু আগেকার মাধুরীর কিছুটা রেশ তো রয়ে গেছে, অল্পবয়েসী ছেলেদের এখনও চোখ টানবেই।
টিকিটগুলো ফেরত দিতে গিয়ে ছেলেটি প্রতাপের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল যেন। অবাক ভাবে কয়েক পলক চেয়ে থেকে বললো, প্রতাপদা না?
প্রতাপ চিনতে পারলেন না। আদালতে কত লোক যায় আসে, কত লোক কথা বলে, সকলের মুখ কি মনে রাখা সম্ভব!
ছেলেটি এরপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলো। প্রতাপের পায়ের কাছে একটা বস্তা, সেটার মধ্যে কিছু কঠিন দ্রব্য আছে, মনে হয় লোহা-পাথর নিয়ে যাচ্ছে কেউ। টিকিট চেকারটি নিচু হয়ে, সেই বস্তাটা সরিয়ে প্রতাপের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ফেললো।
প্রতাপ অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আরে, আরে, একী একী!
আবার সোজা হয়ে সে বললো, প্রতাপদা, আমায় চিনতে পারছেন না? আমি সুবীর!
এই নাম শুনেও প্রতাপের কিছু মনে পড়লো না। তিনি এক দৃষ্টিতে ছেলেটির মুখের দিকে। তাকিয়ে পূর্ব-পরিচয়ের কোনো চিহ্ন খুঁজতে লাগলেন।
মালখানগরে আপনাদের বাড়ির কাছেই আমাদের বাড়ি ছিল। বোস বাড়ি। আমার বাবার নাম সুধাকান্ত বসু। আপনার বাবাকে আমরা জ্যাঠামশাই বলতাম। কতবার গেছি আপনাদের বাড়িতে।
–তুমি সুধাকাকার ছেলে?
–আমার ডাক নাম নাড়। আমাদের বাড়িতে বড় রথ ছিল, রথের দিন আপনারা সবাই আসতেন।
ওপাশ থেকে সুপ্রীতি সব শুনছেন। তিনি বলে উঠলেন, নাড়ু! তোমার দিদির নাম ছিল মনিকা।
প্রতাপ হঠাৎ খুব অধীর হয়ে উঠলেন। তাঁর ইচ্ছে করলো নাডুকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। এ এক অদ্ভুত টান। প্রতাপের সব মনে পড়ে গেছে। বোসেদের বাড়ি অনেকবার গেছেন তিনি। এই নাড়ুরই জ্যাঠতুতো দাদা প্রথম সিগারেট টানতে শিখিয়েছিল প্রতাপকে। ওদের বাড়ির সামনেই বকুল গাছ ছিল দুটো, পাশাপাশি, কাছাকাছি গেলেই গন্ধ পাওয়া যেত… সেই প্রিয়. বাল্যকাল, টুকরো টুকরো স্মৃতি, সব কিছু যেন ফিরে এলো এই ছেলেটির ডাকের মধ্যে দিয়ে।
নাড়ু বললো, আপনি… আপনি এই ভাবে যাচ্ছেন, দাঁড়ান, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কত ব্যাটা বিনা টিকিটে জায়গা দখল করে আছে।
প্রতাপ বললেন, না, না, আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। আমরা ঠিক আছি।
নাড়ু গিয়ে সুপ্রীতিকেও প্রণাম করলো। তুতুলের পরিচয় জানলো। একটু আগে সে তুতুলের দিকে অন্য চোখে তাকাচ্ছিল, এখন তুতুল হয়ে গেল তার বোনের মতন।
তারপর শুরু হলো পুরোনো স্মৃতির বিনিময়। কে কোথায় আছে! নাড়ু বছর তিনেক আগেও একবার ভিসা নিয়ে গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে, সে ওখানকার খবর অনেক বেশি জানে। নাড়ুর এক কাকা অনেকদিন ওখানে ছিল, সে মারা যাবার পর আর কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতাপদের বাড়িটাও সে দেখে এসেছে, সেখানে এখন একটা সরকারি অফিস হয়েছে, গোয়ালঘরের জায়গাটা ভেঙে একটা পাকা দোতলা কোঠাবাড়ি উঠেছে…
পরবর্তী স্টেশন আসতেই নাড় বললো, আজ স্পেশাল চেকিং হচ্ছে, সব বিনা টিকিটের যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হবে। প্রতাপদা, আপনার জন্য আমি অন্যায় কিছু করছি না। এবারে জায়গা পাবেন, বসুন।
বিনা টিকিটের যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রতাপ আপত্তি জানাতে পারেন না। কিন্তু এত রাত্রে ঘুমন্ত লোকগুলোকে টেনে টেনে নামানো… সেই জায়গাতেই বসতে হলো প্রতাপ আর তুতুলকে।
নাড়ু যখন বিদায় নেবে তখন আর প্রতাপ আবেগ দমন করতে পারলেন না। তিনি তাকে আলিঙ্গন করে বলতে লাগলেন, বড় ভালো লাগলো রে, তোকে দেখে নাড়ু। বড় ভালো লাগলো। ভালো থাকিস, নাড়ু, সুধাকাকাকে বলিস আমাদের কথা।
তারপর বাকি রাত আধো ঘুমে, তন্দ্রায় প্রতাপ যেন ফিরে গেলেন নিজের জন্মস্থানে। বিশ্বনাথের টেলিগ্রামের উত্তর পাঠানো হয়নি, তাই স্টেশনে কেউ নেই। প্রতাপের খুব চায়ের নেশা। ঘোড়াগাড়িতে ওঠার আগে প্রতাপ তাই একটু চা খেয়ে নিলেন। নিজের টাকা থেকে এক বাক্স মিষ্টি কিনলেন সুপ্রীতি।
যেখানে একসময় গেট ছিল, এখন সেখানে গেটের চিহ্নমাত্র নেই। যেখানে বাগান ছিল, এখন সেখানে বাগান নেই। দারোয়ানের সেই ছোট ঘরটিতেও ভাড়াটে বসানো হয়েছে।
ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শুনেই আগে বেরিয়ে এলেন শান্তি। লম্বা কাঠির মতন চেহারা, শাড়িটা যেন গায়ের সঙ্গে ঝুলছে। প্রতাপের মনে হলো, আসল ক্ষয় রোগ যেন ধরেছে তার এই দিদিকেই। সুপ্রীতি দৌড়ে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, শান্তি, শান্তি, তোর এ কী চেহারা হয়েছে?
শান্তি নিষ্প্রাণ গলায় বললো, বড় দেরি কইরা ফেলাইলা তোমরা। মায়ের শ্বাস ওঠছে সে। গেছে ডাক্তার আনতে।
প্রতাপরা ছুটে গেলেন দোতলায়। যেটা আগে ঠাকুরঘর ছিল, সেটাই এখন সুহাসিনীর শোবার ঘর। নোংরা চিটচিটে বিছানা, পানের পিকদানিতে গত রাত্রের বমি, সেখানে মাছি। উড়ছে। চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন সুহাসিনী, তাঁর বুকে ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে, শান্তির মেয়ে হাত বুলাচ্ছে দিদিমার বুকে।
মায়ের এই অবস্থা দেখেও সুপ্রীতি ভেঙে পড়লেন না। দ্রুত হাতে তিনি শুরু করলেন ঘর পরিষ্কার করতে। তুতুল তার ব্যাগ নিয়ে বসলো শিয়রের কাছে।
একটু পরীক্ষা করে তুতুল মুখ তুলে বললো, মামা, অক্সিজেন সিলিণ্ডার পাওয়া যাবে? তাহলে ভালো হতো।
প্রতাপ তখুনি ছুটলেন। বাড়ি থেকে বেরুবার পরই বিশ্বনাথের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ডাক্তার নয়, বিশ্বনাথ একজন বৃদ্ধ কবিরাজকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছেন। বিশ্বনাথের মুখে এখন দাড়ির জঙ্গল, বাঙালী বলে চেনাই যায় না। কবিরাজটিও প্রবাসী বাঙালী।
কবিরাজ বললেন, অত চিন্তার কিছু নেই। কালই তো আমি দেখে গেছি। শ্লেষ্ম জমেছে, অতিরিক্ত শ্লেষ্ম।
প্রতাপ বললেন, আমার ভাগ্নীকে সঙ্গে এনেছি, সে ডাক্তারি পড়ে। সে বলছে, অক্সিজেন দেওয়া দরকার।
কবিরাজটি মাথা নেড়ে বললেন, প্রয়োজন হবে না, আমি ওষুধ দিলেই কাজ হবে।
বিশ্বনাথ বললেন, আগে একজন অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারকে দেখিয়েছি। তিনি অ্যাডভাইস করেছিলেন হাসপাতালে রিমুভ করতে। তোমাদের মতামত না নিয়ে তা করতে সাহস পাইনি।
প্রতাপ খানিকটা ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, অবস্থা এত খারাপ, আগে জানাননি কেন আমাকে? বিশ্বনাথ উদাসীন ভাবে বললেন, বয়েস হয়েছে, অসুখ-বিসুখ তো লেগেই থাকবে। তোমার কাছে একবার টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছিলাম, তুমি পাঠাওনি।
–মায়ের জন্য প্রতি মাসে যা পাঠাবার তা তো নিয়মিতই পাঠাচ্ছি। বাড়তি টাকা দেবার সামর্থ্য আমার নেই। তবু মায়ের চিকিৎসার জন্য যদি টাকা লাগতো… আপনি সেকথা তো লেখেননি, লিখেছিলেন বাড়ি সারাবার কথা!
–পরশু থেকেই হঠাৎ ক্রিটিক্যাল হলো। তোমার কথা বারবার বলছিলেন, তোমাকে কী যেন জানাবার আছে
–অক্সিজেন সিলিণ্ডার কোথায় পাওয়া যাবে? আমি সেটা নিয়ে আসতে চাই।
–সে তো পাওয়া যাবে হাসপাতালে। আমাদের দেবে কেন? এখানে কি আর দোকানে বাজারে ওসব জিনিস পাওয়া যায়?
কবিরাজটি বললো, আগেই এত উতলা হচ্ছেন কেন? আমি গিয়ে দেখি!
সবাই মিলে ওপরে আসার পর তুতুল সুহাসিনীর শিয়র ছেড়ে উঠে এসে বললো, একটা কোরামিন ইঞ্জেকশন দিয়েছি।
কবিরাজ বললেন, বেশ করেছো মা, ভালো করেছে। অধিকন্তু ন দোষায়। আমার ওষুধেই কাজ হবে। অ্যালোপ্যাথি-কবিরাজিতে ঝগড়া নাই। হোমিওপ্যাথি হলে আলাদা কথা ছিল।
আধঘণ্টা দেখে কবিরাজ মশাই দশটি টাকা নিয়ে বিদায় হলেন। সুহাসিনীর তখনও জ্ঞান ফেরেনি। যাবার সময় কবিরাজ মশাই আবার বলে গেলেন, ভয়ের তেমন কারণ নাই। আমি তো বুকে শুধু শ্লেষ্মাই দেখলুম।
প্রতাপ নিজেকে সামলাতে পারছেন না। মা আর চোখ মেলবেন না? মা একটিবারও দেখবেন না? কী কথা বলতে চেয়েছিলেন মা?
কবিরাজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রতাপ বাইরে এসেছিলেন। আবার ফিরতে যেতেই বিশ্বনাথ তাঁর হাত ধরে বললেন, শোনো ব্রাদার, একটা কথা আছে। তোমার মা যদি চলে যান, তাহলে এ বাড়ি কী হবে, তা নিয়ে কিছু ভেবেছো?
প্রতাপ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এখন এই কথা বলতে পারলেন বিশ্বনাথ? বাড়ি মানে কি, সম্পত্তি? প্রতাপ তার ভাগ নিতে আসবেন!
–এ বাড়ি আপনাদেরই থাকবে, ওস্তাদজী।
–তোমার মা কোনো উইল করেননি। আমি আগে অনেকবার বলেছি, উনি বুঝতেন না।
–তাতে কী হয়েছে, আপনারা যেমন আছেন, তেমনই থাকবেন।
–উইলে একটা সই না থাকলে—
–আমি তো বলছি আপনাকে, এ বাড়ি ছোড়দি পাবে!
কাষ্ঠহাসি হেসে বিশ্বনাথ বললেন, তোমার মুখের কথাই তো যথেষ্ট নয়। কাগজপত্রে লেখাপড়া থাকা দরকার। ধরো, তোমার ছেলে যদি কোনোদিন এসে ক্লেইম করে…
বিশ্বনাথের ঐ হাসিটা যেন অগ্নিশলাকার মতন প্রতাপের কানে বিধলো। বিশ্বনাথ এত নিচে নেমে গেছেন! মানুষের এত ডিগ্রেডেশন! এই সেই বিশ্বনাথ গুহ, যিনি গানবাজনার নেশায় মজে একদিন ঘর-সংসার ছেড়ে ছিলেন, টাকাপয়সার কোনো চিন্তা করেননি কোনোদিন…
প্রতাপ গম্ভীর ভাবে বললেন, ওস্তাদজী, আমি আইন জানি। যদি সে রকম কিছু হয়, এখান থেকে যাবার আগেই আমি আপনাকে সব লিখেটিখে দিয়ে যাবো।
–তোমার মা বোধ হয় এই কথা বলার জন্যই তোমাকে ডেকেছেন।
প্রতাপ আর সে কথায় কর্ণপাত না করে ফিরে গেলেন মায়ের ঘরে। তুতুলকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে, কোনো বড় ডাক্তারকে কল দেবো?
তুতুল মাথা তুলে, একটুক্ষণ থেমে থেকে বললো, বোধ হয় তার আর দরকার হবে না।
প্রতাপ এই কথার মর্ম ঠিক ধরতে পারলেন না। তার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। তাহলে মা সত্যি ভালো হয়ে উঠবেন?
সুহাসিনীর চেতনা ফিরে এলো দুপুরের দিকে। তিনি দু’বার ডাকলেন, খুকন! খুকন! প্রতাপ দৌড়ে এসে বিছানার ওপর বসে পড়ে বললেন, মা! মা!
সুহাসিনী পরিষ্কার চোখ মেলে তাকালেন, টলটলে দৃষ্টি। একটা হাত তুলে প্রতাপের মাথার ওপর রাখলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, খুকন, তুই আমার একটা কথা রাখবি?
–হ্যাঁ, মা। বলো, বলো!
–খুকন, তুই আমাকে একবার সেখানে নিয়া যাবি!
প্রতাপ কেঁপে উঠলেন। আর কি কেউ বুঝতে পেরেছে মা কোথায় যেতে চান? মা কেন প্রতাপকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
প্রতাপ কোনো উত্তর দিতে পারলেন না।
সুহাসিনী ছেলের চুল আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে সবরকম অনুনয়ের সুরে বলতে লাগলেন, খুকন, একবার আমারে নিয়া চল। এখানে মইরা ‘আমি শান্তি পাবো না, সেই তুলসীমঞ্চের নিচে…
ট্রেনে নাড়ুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার পর থেকে মালখানগরের স্মৃতি সর্বক্ষণ প্রতাপের মনে উথাল-পাথাল করছে। প্রতাপ পরিষ্কার দেখতে পেলেন উঠোনের মাঝখানে সেই তুলসী মঞ্চটি, যেখানে তাঁর বাবাকে শোওয়ানো হয়েছিল… সেটা কি আর আছে? নাড় কিছু বলেনি। সেখানে আর কোনোদিন ফিরে যাওয়া যাবে না।
–ও খুকন, লক্ষ্মী সোনা আমার, একবার নিয়া চল।
একদিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে তুতুল আর টুনটুনি, বিশ্বনাথ আর শান্তি। প্রতাপ মায়ের হাত ধরে আছে, সেই হাতে কোনো উত্তাপ নেই। নিশ্বাস এত মৃদু যে বক্ষস্পন্দন বোঝা যায় না। সারা শরীরে আর কোথাও জীবন-চিহ্ন নেই, শুধু যেন প্রাণটুকু এখনো থেমে আছে চোখের দৃষ্টিতে আর কণ্ঠস্বরে। সুহাসিনীর শরীরটা এখন বালিকার মত ছোট্ট।
–ও খুকুন। তুই আমার এই কথাটা শুনবি না? আর একবার, তুলসী, তুলসী, তুলসীতলায়…
এ কী মাতৃ-আজ্ঞা, না এক অবুঝ বালিকার আবদার? প্রতাপ যেন নিজেই বালক হয়ে, দেখতে পেলেন তার বহুকাল আগেকার যুবতী মাকে। প্রতাপ যখন যা চেয়েছেন, মা সঙ্গে সঙ্গে দিয়েছেন। চাইবার অতিরিক্ত অনেক কিছু। এখন মায়ের এই শেষ অনুরোধ রক্ষা করার সাধ্য তাঁর নেই।
সারা ঘর নিস্তব্ধ। একটা সাঙ্ঘাতিক অসহায়তায় প্রতাপ অবসন্ন বোধ করতে লাগলেন। তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে ঝরে পড়তে লাগলো জল।