রেল লাইনের ধারে একটা ভাঙা পাঁচিলের ওপর দুপাশে দু’জন সঙ্গীকে নিয়ে বসে বাদাম খাচ্ছে সুচরিত। জায়গাটা একেবারে মিশমিশে অন্ধকার। সামনেই ঢাকুরিয়া লেক, সেখানে কিছু কিছু আলোর ব্যবস্থা থাকলেও একটু রাত হতেই কায়দা করে নিবিয়ে দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে শুধু চোখে পড়ে দু’একটা গাড়ির হেড লাইট। আকাশে আজ চাঁদ নেই।
সুচরিতকে তার নাম ধরে আর কেউ ডাকে না এখন। সে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে, তাই তার নাম, ল্যাঙা। সে ভালো করে হাঁটতে পারে না বটে কিন্তু দৌড়োয় হরিণের মতন। রোগা ছিপছিপে শরীর, বেশ লম্বা হয়েছে সে। তার দুই সহচরের নাম লেটো আর মুঙ্গি, ওদের আর কোনো ভালো নাম থাকতে নেই, কোনো পদবীরও দরকার নেই। নামের বদলে অর্থহীন একটি ধ্বন্যাত্মক শব্দ। ওরা সরু ঘেরের প্যান্ট পরে, গায়ে রঙীন গেঞ্জি, মুঙ্গির বাঁ হাতে মোটা লোহার বালা, লেটো গলায় একটা রুমাল বাঁধতে ভালোবাসে।
বাদাম শেষ করার পর সুচরিত মুঙ্গিকে বললো, দে, একটা সিগ্রেট দে।
সিগারেট ধরাবার পর লেটো বললো, এবারে অ্যাকশানে যাই?
সুচরিত বললো, আর একটু দাঁড়া। কটা বাজলো?
একমাত্র লেটোর হাতেই ঘড়ি আছে। সে দেশলাই জ্বেলে দেখে নিয়ে বললো, পৌনে আটটা।
সুচরিত বললো, আর একটু লোকজন কমুক।
সারাদিন অসহ্য গুমোট গরম গেছে, আকাশ মেঘলা হলেও দুতিনদিন বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। সন্ধের পর থেকে হু-হুঁ করে আসছে বঙ্গোপসাগরের হাওয়া, অনেকেই বাড়ি ছেড়ে এই কৃত্রিম হ্রদের কিনারে সেই হাওয়া খেতে এসেছে।
এই শহরে তরুণ-তরুণীদের গোপনে দেখা করে মুখোমুখি বসে কিছুক্ষণ হৃদয়-বিনিময় করার জন্য জায়গা পাওয়া খুবই দুর্লভ। মানুষের পায়ের দাপাদাপিতে সব নিভৃত স্থান তছনছ হয়ে গেছে। এই লেকের পাড়ে পাড়ে সন্ধের পর অন্ধকারে ব্যাকুল যুবক-যুবতীরা কোনো রকমে এখানে সেখানে জায়গা খুঁজে নেয়। কিন্তু একটুও সুস্থির হয়ে বসবার উপায় নেই। একজন আর একজনের কাঁধে হাত রেখেছে কি রাখেনি অমনি মাটি খুঁড়ে উঠে আসবে কোনো ভিখিরি বালক। লেকের ধারে প্রেম করতে এলে সঙ্গে অনেক খুচরো পয়সা নিয়ে আসতে হয়। একটি ভিখিরি বালক পয়সা পেয়ে চলে গেলেই আর একজন আসবে। তারপর আসবে ফেরিওয়লা, বাদাম, চকলেট এমনকি ধূপকাঠিও কিনতে হবে, না কিনলে ওরা ঘনিষ্ঠ জড়াজড়ির সুযোগ দেবে না।
তবে সব কিছুরই নির্দিষ্ট সময় আছে। আটটা-সাড়ে আটটা বেজে গেলে যখন লোকজন কমতে থাকে, তখন ভিখিরি-ফেরিওয়ালারাও দূরে সরে যায়, তখন আসে সুচরিতের দল।
বড় গাছের নিচের মনোরম অন্ধকারে পুরোনো কালের একটা কামানের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে একটি বলিষ্ঠ যুবক ও এক তন্বী। ওরা শারীরিক উষ্ণতা বিনিময় করছে না, কোনো গভীর সঙ্কট নিয়ে আলোচনায় এমনই তন্ময় যে কখন যে একটি ছায়ার মতন প্রাণী তাদের ঘিরে ধরেছে তা খেয়ালই করেনি।
লেটো ফস্ করে একটা দেশলাই জ্বালাতেই যুবকটি উঠে দাঁড়ালো।
সুচরিত জিজ্ঞেস করলো, দাদা, কটা বাজে?
যুবকটি উদ্ধত ভাবে বললো, যটাই বাজুক না কেন!
সুচরিত বললো, আহা রাগ করছেন কেন? আপনার হাতে ঘড়ি রয়েছে তো, তাই জিজ্ঞেস করছি কটা বাজে?
যুবকটি এবারে বাঁ হাত তুলে বললো, আটটা কুড়ি।
সুচরিত বললো, উঁহু, এত কম তো হবার কথা নয়। আপনার ঘড়ি ঠিক আছে? মনে হচ্ছে গোলমাল আছে! দেখি ঘড়িটা একটু দিন তো!
মুঙ্গি ছেলেটির ঘড়িশুধু হাতটা চেপে ধরতেই সুচরিত ধমক দিয়ে বললো, এই এই, গায়ে হাত দিচ্ছিস কেন? দাদা ভদ্দরলোক, নিজে থেকেই খুলে দেবেন।
যুবকটি ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, আপনারা ভেবেছেন কী? এখানে গুণ্ডামি করতে এসেছেন? পুলিস ডাকবো!
সুচরিত সপ্রশংস দৃষ্টিতে যুবকটির দিকে তাকালো। এর বেশ সাহস আছে স্বীকার করতে হবে। অনেকেরই গলা শুকিয়ে যায়, তো-তো করে। সে মেয়েটির দিকে একবার তাকালো। ভালো বাড়ির মেয়ে, বসার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়।
সুচরিত হাসি মুখে বললো, পুলিস ডাকতে চান, ডাকুন! আমরা কিন্তু এখান থেকে নড়ছি না।
যুবকটি এদিক ওদিক তাকালো। কাছাকাছি আরও যে কয়েকটি যুগল বসে ছিল, কখন তারা উঠে গেছে। সে বিমর্ষ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার গায়ের জোর আছে, কিন্তু মনের জোর কমে যাচ্ছে। তার ধারণা, পুলিশ ডাকলেই তাদের দু’জনকে সারা রাত থানায় কাটাতে হবে, পরের দিন খবরের কাগজে নাম ছাপা হয়ে যাবে দু’জনের।
সে ঘড়িটা খুলে দিল সুচরিতের হাতে।
লেটো নাকি সুরে আদুরে গলায় বললো, ওকে ঘড়ি দিলেন, আর আমায় কিছু দিলেন না? দশ-বিশটা টাকা দিন অন্তত!
যুবকটি গম্ভীরভাবে বললো, আমার কাছে টাকা নেই।
লেটো বললো, আপনার কাছে না থাকে, দিদিমণির কাছে আছে নিশ্চয়ই! ঐ তো ব্যাগ। রয়েছে।
লেটো ঝুঁকে মেয়েটির হাত ব্যাগটা নিতে যেতেই যুবকটি আর রাগ সামলাতে পারলো না, লেটোকে এক হাতে ঠেলে দিয়ে অন্য হাতে ঠাস করে এক চড় কষালো।
সঙ্গে সঙ্গে মুঙ্গি একটা ছুরি খুলে যুবকটির মুখের সামনে ধরলো।
সব কিছুই আগে থেকে নিখুঁত ভাবে মহড়া দেওয়া। এমনি এমনি এসব কাজ হয় না, বুদ্ধি খরচ করতে হয়। অনেক ছেলে মেয়েই তো এসে বসে, তাদের মধ্য থেকে বেছে নিতে হয় দু’একজনকে, তাদের ওপর ওয়াচ রাখতে হয়। তারপর ঠিক টাইমিংটা বেছে নেওয়াই হল আসল কথা। এই সব শিকারদের কাছ থেকে ধরা বাঁধা দু’তিন রকম ব্যবহারই আশা করা যায়। মেয়েটির মাথায় সিঁদুর না থাকলে কোনো ছেলেই পুলিস ডাকতে সাহস পায় না, বরং পুলিসের নামে ভয় পায়। আর, গায়ে হাত তুলতে সাহস পায় খুব কম ছেলেই।
সঙ্গে ছুরি ছোরা থাকলেও সুচরিত সহজে রক্তারক্তি পছন্দ করে না। মুঙ্গিকে শেখানো আছে, সে শুধু লম্বা ছুরিটা মুখের সামনে তুলবে, আর কিছু না।
সে মুঙ্গিকে নকল ধমক দিয়ে বললো, অ্যাই, আ্যাই ছুরি তুলছিস কেন? দাদার মাথা গরম হয়ে গেছে বলে একটা চড় মেরেছে, তা বলে তুই ছুরি দেখাবি? সরে আয়!
তারপর সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার কাছে যদি কিছু টাকা থাকে তো দিয়ে দিন না। কেন ঝাট বাড়াচ্ছেন?
মেয়েটি তার ব্যাগ খুলতে যেতেই যুবকটি একটি বোকামি করলো। সে বললো, তুমি দিও না, আমি দিচ্ছি!
এর ফলে দু’জনকেই টাকা দিতে হলো। সব শুদ্ধ পঁয়তিরিশ। মন্দ না।
যাবার আগে চরিত একটু ইয়ার্কি করার লোভ সামলাতে পারে না। সে যুবকটির কাঁধ চাপড়ে বললো, দাদা, এ জায়গাটা ভালো নয়, আর বেশি দেরি করবেন না। বাড়ি যান। এসব জায়গায় ঘড়ি হাতে দিয়ে আসেন কেন?
একটু দূরে সরে গিয়ে ওরা তিনজন একসঙ্গে হাসতে থাকে। শোনা যায় মেয়েটির কান্নার ফোঁপানি।
এক রাতে একটার বেশি কেস করতে নেই। তা হলে বদনাম রটে যাবে, ভয়ে আর ছেলেমেয়েরা সন্ধের পর বসবে না। অতি লোভে যে তাঁতি নষ্ট হয় তা সুচরিতরা জানে।
যা পাওয়া গেল তার সবটাই রোজগার নয়, এরও অনেক ভাগ আছে। লিলি পুলের ধারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন কনস্টেবল। একজন অনুচ্চ স্বরে ডাকলো, আরে এ ল্যাংড়া, ইধার আ, শুন শুন্!
সুচরিত বললো আসছি রে বাবা, আসছি। পালিয়ে যাচ্ছি নাকি?
ওরা তিনজন জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে এগিয়ে এসে পুলিস দু’জনকেও সিগারেট দিল। দু’জনেই সিগারেট দুটি রেখে দিল পকেটে। একজন য় বললো, পুরা চাহি শ’ রূপিয়া!
সুচরিত বললো, একশো টাকা? পাগল হয়েছে নাকি সেপাইজী? এখানে সব ফালতু পার্টি আসে, পকেটে দশ-পাঁচ টাকার বেশি থাকেই না।
–ঘড়ি কটা পেলি?
–একটা।
–সাচ্ বলছিস?
–তোমাদের কাছে মিথ্যে কথা বলে কোনো লাভ আছে?
মিথ্যে-সত্যি যাই-ই হোক, সেপাইরা ওদের মুখের কোনো কথাই বিশ্বাস করে না। ওদের একজন সুচরিতদের সমস্ত শরীর থাবড়ে থাবড়ে খুঁজে দেখলো। এমনকি ওদের পুরুষাঙ্গ ধরে নাড়াচাড়া করে কৌতুক করলো খানিকটা।
অন্যজন জিজ্ঞেস করলো, কী ঘড়ি পেয়েছিস? বিলাইতি?
সুচরিত বললো, আরে নাঃ! আজকাল তো সব দেখছি রদ্দি মার্কা দিশি ঘড়ি। কিংবা সস্তার জাপানী মাল!
কিন্তু সেপাইটি সহজে ভোলে না। সে পকেট থেকে একটা কেরোসিন-লাইটার বার করে জ্বেলে ঘড়িটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে অভিজ্ঞের মতন অভিমত দেয়, এ খাঁটি বিলাইতি আছে।
সুচরিত সঙ্গে সঙ্গে বললো, খুব পুরোনো। অন্তত থার্ড হ্যাণ্ড!
সেপাইটি ঘড়িটা তাকে ফেরত দিয়ে বললো, দে পঁচাশ রূপিয়া!
সুচরিত বললো, পঞ্চাশ? হে-হে-হে, পেয়েছিই মোটে তিরিশ-পঁয়তিরিশ।
–ঘড়ি বেচে অনেক পাবি।
–এ ঘড়ির বিশ পঁচিশের বেশি দাম পাওয়া যাবে না।
–হামার সঙ্গে দিল্লাগি করছিস?
–শোনো সেপাইজী, আমাদেরও পড়তা পোষাতে হবে? এখনও দ্যাখো গিয়ে বড় লেকের ওপাশটায় দু’তিনখানা গাড়ি আছে। সেখানে বাবুরা মাল খাচ্ছে আর মাগীদের সঙ্গে চুমোচুমি জড়াজড়ি করছে। সেখানে গিয়ে টাকা চাও না!
–তুই আগে দে!
শেষ পর্যন্ত কুড়ি টাকায় রফা হলো। লেটো আর মুঙ্গি প্রায় চুপচাপ ছিল এতক্ষণ! পুলিসের সঙ্গে দরাদরি করতে সুচরিত একেবারে নাম্বার ওয়ান। পুলিসরাও ওকে পছন্দ করে।
পুলিসের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর ওদের নিজেদের মধ্যে বখরা ভাগ হয়ে গেল। ঘড়িটা মুঙ্গি কিনে নিল পঞ্চাশ টাকায়। সে প্যান্টটা খুলে ফেলে ল্যাঙ্গোটের ভেতর থেকে বার করলো টাকা। সেপাইটি যে এই টাকাটার খোঁজ পায়নি, এটা তার পরম ভাগ্য। সেপাইটি আসলে সুচরিতকেই তল্লাশ করেছে মন দিয়ে।
মুঙ্গি পঞ্চাশ টাকায় ঘড়িটা কিনে নিল, এরপর ওটা বিক্রি করে যত বেশি লাভ করতে পারবে, সেটা তার নিজস্ব। তিনজনের বখরা সমান সমান নয়। দলপতি হিসেবে সুচরিত পায় অর্ধেক, বাকি দু’জন এক চতুর্থাংশ করে। এরপর সুচরিত নিজের টাকায় ওদের মাল খাওয়ার প্রস্তাব দিল।
পঞ্চাননতলা বস্তি থেকে কেনা হলো দু’বোতল চোলাই। তিনটে ভাঁড় জোগাড় করে ওরা বসে গেল রেল লাইনের ধারে। দু’তিন ঢোঁক দেবার পর লেটো বললো, গুরু, আমাদের লেকে আরও একটা পার্টি ঘুরছে। দু’তিনটে কেস হয়ে গেছে, মুড়িওয়ালা ধনাদা খবর দিল।
সুচরিত মাথা নেড়ে বললো, আমিও টের পেয়েছি। কোথাকার দল বল তো? এই পঞ্চাননতলার?
লেটো বললো, মনে হচ্ছে যাদবপুরের। ক’টা ফচকে ফচকে ছোঁড়া। দেবো একদিন চড়িয়ে?
মুঙ্গি বললো, এ শালারা যাদবপুরের রিফিউজি পার্টি। এই হারামীর বাচ্চা রিফিউজিগুলো উইপোকার মতোন সব জায়গায় ঢুকে পড়ছে! তবে লেকে আমাদের কাজে বখরা করলে আমি শালাদের পেটে চাকু চালাবো!
সুচরিত মুঙ্গির ওপর রাগ করলো না। এরা তার পূর্ব পরিচয় জানে না। সুচরিতের উচ্চারণেও কোনো টান নেই। সে যে কাশীপুরের কলোনিতে এক সময় ছিল, তা তার প্রায় মনেই পড়ে না। মা বাবার কথাও মনে পড়ে না। তবে একদিনের জন্যও সে ভোলেনি চন্দ্রাকে।
লেটো বললো, গুরু, ওদের কালকেই ঝাড় দেবো?
সুচরিত বললো, নাঃ, এবার ওদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে, বুঝলি? আমাদের এআর পোষাচ্ছে না। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ। আজ কটা টাকা হলো বল?
মুঙ্গি জিজ্ঞেস করলো, অন্য লাইনে যাবে?
ওদের সামনে দিয়ে খুব ধীর গতিতে একটা মালগাড়ি যাচ্ছে। সেদিকে আঙুল তুলে সুচরিত জিজ্ঞেস করলো, এই লাইনটা কেমন?
মুঙ্গি বললো, আমাকে বড় তাজু একবার জিজ্ঞেস করেছেলো, আমি হ্যাঁ-না কিছু বলিনি।
লেটো বললো, বড় তাজুটা মহা হারামি, যখন তখন ঝুটি নেড়ে দেয়। ওর আণ্ডারে কাজ করতে গেলে মুখ বুজে থাকতে হবে।
সুচরিত বললো, সেই তো মুশকিল, এ লাইনে ঢুকতে গেলে কারুর না কারুর আণ্ডারে থাকতে হবে। সেটাই যে আমি পারি না।
–তা হলে একটা অন্য লাইন দ্যাখো।
–দেখছি, দেখছি!
আস্তে আস্তে রাত ঘন হয়, শব্দ লুপ্ত হতে থাকে, ওদের নেশা জমে। লেটো আরও এক বোতল চোলাই কেনার জন্য ঝুলোঝুলি করলেও সুচরিত রাজি হয় না। তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। তার বাড়ির টান আছে।
লেকের মধ্যে যেখানে যুদ্ধের সময় সামরিক হাসপাতাল ছিল সেখানে এখন অনেকগুলি রিফিউজি পরিবার জবর দখল করে বসে আছে। এই তো কিছুদিন আগে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ওদের উচ্ছেদ করার একটা চেষ্টা হয়েছিল। ছেলেমেয়ে বুড়ো সবাই এককাট্টা হয়ে পুলিসের লাঠির সামনে দাঁড়াতে শেষ পর্যন্ত পুলিস হঠে যায়।
ইদানীং আবার নতুন করে উচ্ছেদের হুজুগ উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন নাকি ক’দিন
আগে এদিক দিয়ে যেতে যেতে বলেছেন, আরে ছি ছি, লেকটাকে একেবারে বস্তি বানিয়ে ফেলেছে? রিফিউজিদের এত আবদার সহ্য করা হবে না!
অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে কে যেতে দেখেছে বা তাঁর এই উক্তি কে নিজের কানে শুনেছে তার কোনো ঠিক নেই, কিন্তু এই গুজবটা কলোনির প্রত্যেকের মুখে মুখে ঘুরছে। কেউ কেউ ঘরের মধ্যে লাঠি, সোঁটা জমা করছে।
এই কলোনির একখানা ঘরে থাকে সুচরিত। ঘরখানা তার নিজস্ব নয়। বিপিন নামে একজন মোটর-মেকানিকের কাজ করে, সুচরিতও কিছুদিন একটা গ্যারাজে ওয়েল্ডিং-এর কাজ শিখেছিল, সেই সূত্রে বিপিনের সঙ্গে তার পরিচয়। খাওয়া থাকার জন্য সে বিপিনকে মাসে একশো টাকা দেয়। সুচরিত ভাত খেতে ভালোবাসে, রাস্তার দোকানের খাওয়া তার পছন্দ নয়।
যত রাতেই ফিরুক, সুচরিতের জন্য ভাত ঢাকা দেওয়া থাকে। বিপিনের স্ত্রীকে সে বড়দি বলে ডাকে। সুচরিতের কোনো কালেই কোনো দিদি ছিল না, তবু বৌদির বদলে বড়দি ডাকটা কেন তার প্রথম মনে এসেছে কে জানে!
এই বড়দির মোটা সোটা আলুথালু চেহারা, পাঁচটি সন্তানের জননী। দুটি সন্তান মারা গেছে, বড় ছেলেটি জেল খাটছে। সে ট্রেনে পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়েছিল।
সুচরিত ফেরার আগেই বিপিনের সংসারে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। কেরোসিনের খুব অনটন বলে বেশিক্ষণ ওরা কুপি বা হ্যারিকেন জ্বালে না। সুচরিতের ঘরে মোম রাখা থাকে। অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে আন্দাজে আন্দাজে সে মোম খুঁজে নিয়ে জ্বালালো। তারপর রান্না ঘরে এসে খেতে বসলো।
পাশের ঘরটি পুরোপুরি অন্ধকার হলেও বড়দি ঘুমোয়নি। সে বললো, এই ল্যাঙা, কড়াইতে দ্যাখ ডিমের ঝোল আছে। ভাত সবটুক নিস, রাখতে হবে না।
সুচরিত বললো, আচ্ছা!
মন দিয়ে সে খাওয়া শেষ করলো। ভাত, পুঁইশাকের তরকারি, আলুর খোসা ভাজা আর অনেকখানি ঝোলের মধ্যে আধখানা ডিম। ঝোলের স্বাদটা বড় অপূর্ব। ঐ ঝোলের জন্যই সবটা ভাত খেয়ে ফেললো সুচরিত।
বাইরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে সে চটপট করে মেজে নিল নিজের থালা-গেলাস। এসব কাজ সকালে ভালো লাগে না।
সব শেষ করে নিজের ঘরের বিছানা মেলেও সে শুয়ে পড়লো না। একটা সিগারেট জ্বেলে বসে রইলো। এখন প্রতীক্ষার প্রত্যেক দিনই এরকম হয়, নেশা করে এলেও সুচরিত খাওয়া-দাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ জেগে থাকে। কোনো কোনোদিন বড়দি উঠে আসে তার ঘরে।
দিনের বেলা বড়দিকে দেখে বিশ্বাস করাই শক্ত যে তার ঐ শরীরের মধ্যে এতখানি লোভ আছে। দিনের বেলা সারাক্ষণ সে তার অতি দুরন্ত দুটি ছেলেমেয়েকে সামলাতেই ব্যতিব্যস্ত থাকে। তাছাড়া, উপরি রোজগারের জন্য সে ঠোঙা বানায়। দরজার সামনে সে পা ছড়িয়ে বসে মেশিনের মতন দু’হাতে ঠোঙা বানিয়ে যায়। তার স্বামী বিপিন নিরীহ ধরনের মানুষ। কোনোরকমে যে মাথার ওপরে একটা চাল জুটেছে আর দু’বেলা খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে যাচ্ছে, তাতেই সে সন্তুষ্ট। সন্ধের পরই সে ঘুমোয়, ঘুমের মধ্যে তার জোরে জোরে নাক ডাকে।
কাপড় চোপড়ের খসখস শব্দ হতেই সুচরিত উৎকর্ণ হলো। আজ বড়দি আসছে। দুঘরের মাঝখানে রান্না ঘর। বাইরের দিক দিয়ে ঢোকার একটা দরজা আছে সুচরিতের ঘরে। উঠোন দিয়ে ঘুরে এসে সেই দরজা প্রায় পুরোটা জুড়ে দাঁড়ালো বড়দি। তারপর আঙুল দিয়ে মোমবাতিটা দেখালো।
সুচরিত ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিবিয়ে দিতেই বড়দি তার বিছানার ওপর চলে এসে সুচরিতের গায়ে চেপে ধরলো নিজের বুক। বড়দির গায়ে শুধু একটা শাড়ী জড়ানো। সে নিজেই সুচরিতের একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের উরুর ওপর রাখে।
প্রত্যেকবার এই সময়ে সুচরিতের মনে পড়ে চন্দ্রার কথা। বড়দিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সে চন্দ্রার মুখখানা দেখতে পায় অন্ধকারের মধ্যে।