শনিবার দুপুরে লোদি গার্ডেনসে ত্রিদিব আর সুলেখার নেমন্তন্ন। এক সপ্তাহ আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। ত্রিদিব বেলা দেড়টার সময় অফিস থেকে ফিরেই সুলেখাকে তুলে নেবে, এই রকম কথা আছে, কিন্তু যা আগে কোনোদিন ছিল না এখন ত্রিদিবের সেই রোগ ধরেছে। অফিসের কাজে মত্ত হয়ে সে মাঝে মাঝে বাড়ির কথা ভুলে যায়। পদোন্নতির মূল্য দিতে হচ্ছে তাকে।
সুলেখা সব কিছু গুছিয়ে তৈরি, একটা চল্লিশ বেজে যাওয়ার পর ও ত্রিদিব এলো না দেখে সে একবার ভাবলো বাইরে বেরুবার শাড়ি খুলে ফেলবে কি না। ক্ষীণ অভিমান জমা হয়েছে তার বুকে। কলকাতায় থাকার সময় সে নিজেও কলেজে পড়াতো। অধিকাংশ গৃহিণীদের মতন তাকে বাড়িতে বসে স্বামীর ফেরার প্রতীক্ষায় পল-অনুপল গুণতে হতো না। কিন্তু দিল্লিতে তার সময় কাটতে চায় না কিছুতেই।
এক মিনিট পরেই টেলিফোন বেজে উঠলো।
সেই ঝনঝন শব্দ শুনেই অভিমানটা বাষ্প হয়ে উড়ে গিয়ে সেখানে জুড়ে বসলো খানিকটা লজ্জা। ত্রিদিবই টেলিফোন করেছে, সুলেখাও তো আগে টেলিফোনে দেরির কারণ জিজ্ঞেস করতে পারতো নিজে থেকে।
ত্রিদিব বললেন, শোনো, আমি তো এক্ষুনি যেতে পারছি না, আটকে গেছি, কখন যে শেষ হবে–তুমি খেয়ে নাও…
সুলেখা খানিকটা কৌতুকের সুরে বললো, খেয়ে নেবো, কোথায়? না, না, শোনো, শোনো, আমার খাওয়াটা তো এমন কিছু নয়, আমি বাড়িতে খেয়ে নিচ্ছি, কিন্তু তুমি কোথায় খাবে? ৪৫৬
ত্রিদিব একটু অধীরভাবে বললেন, আমি স্যাণ্ডউইচ আনিয়ে নেবো।
–তা হলে লোদি গার্ডেসের নেমন্তন্নটা আজ ক্যানসেল্ড তো? কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা যেন বেশ কয়েকটি অনুভবের। তারপর ত্রিদিব টেলিফোনে হেসে উঠে বললেন, জানো, জাপান থেকে দু’জন ডেলিগেট এসেছে, তারা একবর্ণও ইংরেজি বোঝে না। অনেক কষ্টে একজন সাউথ ইণ্ডিয়ান ইন্টারপ্রেটার জোগাড় করা হয়েছে। তার ইংরিজি উচ্চারণ আবার এত খারাপ, যে প্রত্যেকটা কথা প্রায় তিনবার করে বলতে হচ্ছে। ফলে সময় লেগে যাচ্ছে তিনগুণ, সেইজন্যই ঐ কথাটা একেবারে ভুলে হজম করে দিয়েছিলুম!
সুলেখা জিজ্ঞেস করলো, তুমি সত্যিই স্যাণ্ডুউচ এনে খাবে তো, না উপোস করে থাকবে! আমি আদালিকে দিয়ে খাবার পাঠাতে পারি।
ত্রিদিব বললেন, যাঃ, ভারত-নিপ্পন বাণিজ্য সম্পর্ক আরও চল্লিশ ঘণ্টা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করতে পারে। আমি ঠিক কুড়ি মিনিটের মধ্যে গিয়ে তোমাকে তুলে নিচ্ছি। আমার এরকম ভুল হলো কী করে!
সুলেখা বললো, শোনো, তা বলে তোমাকে কাজ নষ্ট করে… ত্রি
দিব বললেন, ঠিক কুড়ি মিনিটের মধ্যে…তৈরি থেকো, এখন রেখে দিচ্ছি!
কুড়ি মিনিটের বদলে একুশ বা তেইশ হতে পারে, কিন্তু পঁচিশের বেশি না, ঠিক পৌঁছে গেলেন ত্রিদিব। গেটের সামনে গাড়ি থামতেই খানসামা কয়েকটি টিফিন কেরিয়ার তুলে দিল, সুলেখা এসে উঠলো হাতে একটি বড় প্যাকেট নিয়ে।
আবার গাড়ি ছাড়ার পর ত্রিদিব বললেন, আমার খানিকটা দেরি হয়ে যাওয়াটা এমন কিছু অপরাধ নয় জানি, কিন্তু আমার ভুলে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড় অপরাধ। ছি ছি, কী যে হচ্ছে আমার আজকাল।
সুলেখা বললো, তুমি তো ঠিক ভুলে যাওনি, তোমার সাব-কনসাস মাইণ্ডে ঠিকই ছিল, নইলে তুমি ফোন করতে না। অন্য দিন বাড়ি ফিরতে আধ ঘণ্টা এক ঘণ্টা দেরি হলে তো তুমি ফোন করো না। তোমাকে শনিবারেও এত কাজ করতে হয় কেন?
–জাপানীরা কাজের ব্যাপারে শনিবার রবিবার মানে না। কাজটা ওদের কাছে প্রায় ধর্মীয় গোঁড়ামির মতন, খুঁটিনাটি পর্যন্ত নিখুঁত হওয়া চাই, দেখছি তো কদিন ধরে।
–তোমাকে কাজ নষ্ট করে চলে আসতে হলো না তো?
–আলাপ আলোচনা এখন চলবে কদিন ধরে। ভার্গবকে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে বলে এসেছি, আমি আবার বসবো কাল সকালে।
–আমি তোমাকে জোর করে দিল্লি নিয়ে এলাম, তোমাকে এখানে খাটতে হচ্ছে বেশি!
–দিল্লি আমার চমৎকার লাগছে!
লোদি গার্ডেনসে ওদের জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। নেমন্তন্নটা শুধু ওদের দু’জনের এবং পরস্পরের। বিয়ের পর কলকাতায় থাকার সময় ওরা প্রায়ই ছুটির দিন বা শনি-রবিবার দু’জনে চলে যেত কাছাকাছি কোথাও, দিল্লিতে এসে ওরা আবার শুরু করেছে দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমা। এক সপ্তাহ সুলেখা ত্রিদিবকে নেমন্তন্ন করে, অন্য সপ্তাহে ত্রিদিব সুলেখাকে।
দিল্লি শহরটা পুরোনো’ হতে সময় লাগে। ছড়ানো শহর, দ্রষ্টব্য অনেক। স্বাধীনতার পর রাজধানীকে নতুন ভাবে সাজানো হচ্ছে, চওড়া হচ্ছে রাস্তাঘাট, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন উপনগরী। দিল্লির সঙ্গে রোমের অনেকটা তুলনা করা যায়। প্রাচীন ও আধুনিকের পাশাপাশি সহাবস্থান। কংক্রিটের নতুন রাস্তার পাশেই হাজার খানেক বছরের পুরোনো কোনো সমাধি ভবন।
লোদি গার্ডেনসের মধ্যেও লোদি সম্রাট-বংশের অনেক সমাধি রয়েছে। এই শহরে ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরের নিদর্শন এখানে রয়ে গেছে, এটা ত্রিদিবের খুব পছন্দ। ইতিহাস তাঁর শখের বিষয়।
এতখানি ছড়ানো, এমন সুন্দর একটা বাগান, কিন্তু ভিড় বিশেষ নেই। আগে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে ওরা দু’জন সব কটি সমাধি ভবন ঘুরে ঘুরে দেখলো, ত্রিদিব শোনালেন ইতিহাসের নানারকম চুটকিলা। তারপর এক সময় একটা বড় গাছের ছায়ায় বসে পড়ে বললেন, জানো, এইসব পুরোনো জায়গায় এলেই আমার মনে হয়, দিল্লিতে একটার পর একটা বংশ দাপটের সঙ্গে রাজত্ব চালিয়ে কিছুদিন পর একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এখনকার এই কংগ্রেস-বংশই বা কতদিন টিকবে?
সুলেখা বললো, জওহরলাল নেহরু চলে যাবার পরেও তো কংগ্রেস টিকে গেলই মনে হচ্ছে।
ত্রিদিব একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, কী জানি! আমি বাতাসে যেন যুদ্ধের গন্ধ পাচ্ছি!
–আবার যুদ্ধ? কার সঙ্গে? চীনের সঙ্গে?
–হতে পারে। চীন যে জায়গা দখল করেছিল, তা ছাড়ে নি। পাকিস্তানের সঙ্গেও হতে পারে। ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখো, যুদ্ধ ছাড়া কোনো রাজত্ব চলে না। হয় প্রতিবেশীকে আক্রমণ করো, নয় আক্রান্ত হও! শান্তি অতি কঠিন, দুর্লভ ব্যাপার। ক’টা মানুষের জীবনে সত্যিকারের শান্তি আছে বলো! একটা রাষ্ট্রের জীবনে শান্তি তো আরও অসম্ভব।
সুলেখা মুখে বেদনার রেখা ফুটিয়ে বললো, আমার যুদ্ধ-টুদ্ধের কথা ভাবতেই খুব খারাপ লাগে।
ত্রিদিব মৃদু হাস্যে বললেন, যদি সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে একটা ভোট নেওয়া যায়, তা হলে দেখা যাবে, অন্তত নব্বই ভাগ মানুষই যুদ্ধ চায় না। তবু যুদ্ধ হয়। পৃথিবীতে সব সময় কোথাও না কোথাও যুদ্ধ চলছে।
–এই ছোট্ট-খাট্টো মানুষ লালবাহাদুর শাস্ত্রী কি কোনো যুদ্ধ চালাতে পারবে? মনে হয় তো শান্ত-শিষ্ট একটি পুরুত ঠাকুর।
–যুদ্ধ কি আর শুধু ওঁর একলার ইচ্ছেতে হচ্ছে! ভারত আর পাকিস্তানের রাজধানী বড্ড কাছাকাছি, সেইজন্য উত্তাপ দিন দিন বাড়ছে। পাকিস্তানের রাজধানী হওয়া উচিত ছিল ঢাকায়, ওদিকে জনসংখ্যা বেশি,ওদের একটা ন্যায্য দাবি আছে। আর ভারতের রাজধানী কোথায় হওয়া উচিত ছিল জানো? আমার মতে, মাদ্রাজে। দিল্লি বহুকাল ধরেই রাজধানী ছিল, কলকাতাও ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল অনেকদিন, স্বাধীন ভারতের রাজধানী হওয়া উচিত ছিল নতুন কোনো জায়গায়, দক্ষিণ ভারতে হওয়াটাই ছিল বেশি স্বাভাবিক। ওদিককার লোকেরা নিজেদের বলে সাউথ ইণ্ডিয়ান, শুধু ইণ্ডিয়ান বলে না।
সুলেখা ওপরের দিকে তাকিয়ে গাছটার দিকে দেখলো। এটা কী গাছ ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অনেকটা কৃষ্ণচূড়ার মতন, ডালপালা বিস্তৃত, ছোট ছোট পাতা, কিন্তু কোনো ফুল নেই। আকাশ আজ মেঘলা, তাই ছায়া বেশি এবং ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা।
বাগানটিতে যত্ন নেই বিশেষ, এখানে ওখানে আগাছার ঝোঁপ। কাছেই একঝাড় টকটকে লাল রঙের কলাবতী ফুল ফুটে আছে। খানিকটা দূরে, আর একটা গাছের তলায় ছায়ায় সতরঞ্চি পেতে বসেছে পুরো একটি পরিবার। কতা-গিন্নি, ছেলে-মেয়ে, জামাই পুত্রবধূ ইত্যাদি নিয়ে দশ-এগারো জন। তারা একটি রেডিও বাজাচ্ছে তারস্বরে। এই ট্রানজিস্টার রেডিও নামে বিদ্যুৎবিহীন বেতার যন্ত্রটি নতুন উঠেছে বাজারে, অনেকে বিদেশ থেকে নিয়ে আসে, এবং যাদের এই যন্ত্রটি আছে, তারা এটা অন্যদের দেখাবার জন্য সর্বত্র সঙ্গে নিয়ে ঘোরাফেরা করে। এরকম একটা দুপুরবেলা বাড়িতে থাকলে ঐ দশ-এগারোজন লোক কি একসঙ্গে বসে রেডিও শুনতো?
সুলেখা ভাবলো, ঐ যান্ত্রিক আওয়াজ শুনে গাছপালাগুলোর কষ্ট হয় না? ওরা তো আগে এরকম আওয়াজ কখনো শোনেনি!
অফিসের পোশাকেই ত্রিদিব শুয়ে পড়েছেন ঘাসে। মুখে একটা চুরুট।
সুলেখা চমকে উঠে বললো, এই যাঃ, ভুলেই গিয়েছিলুম। তোমার জন্য তো আমি পাজামা-পাঞ্জাবী এনেছি!
সেইরকমই কথা। যেদিন ওদের এরকম বাইরে পিকনিক থাকে, সেদিন সুলেখা একটু বেশি সাজগোজ করে, ত্রিদিবও অফিসের পোশাক ছেড়ে নেয়। আজ সুলেখা পরে এসেছে একটা আকাশী রঙের শাড়ি, ত্রিদিবের জন্য সে লক্ষ্ণৌ-এর কাজ করা নতুন পাঞ্জাবী কিনে এনেছে।
এখানে যে-কোনো ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে পোশাক পাল্টে নেওয়া যায়, কিন্তু ত্রিদিবের আলস্য লেগে গেছে। তিনি ওঠবার উদ্যোগ না করে সামনের ঝোঁপের ওপর একটা লম্বাটে ধরনের পাখির দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কী পাখি জানো?
সুলেখা পাখি-টাখি বিশেষ চেনে না, এইরকম লম্বা ল্যাজওয়ালা ইঁট রঙের পাখি সে আগে দেখেনি।
ত্রিদিব বললেন, আমাদের যশোরের বাড়িতে একটা বড় পেয়ারা গাছে এইরকম একটা পাখি এসে বসতো মাঝে মাঝে। তখন আমরা শুনেছিলাম, এর নাম ইষ্টকুটুম পাখি। এখানে নিশ্চয়ই অন্য নাম। আমার ঠাকুমা বলতেন, ইষ্টকুটুম পাখি বাড়ির সামনে এসে ডাকলে, সেদিন বাড়িতে অতিথি আসে।
সুলেখা বললো, তোমার ঠাকুমাকে আমার বেশ লাগতো। একটাও দাঁত ছিল না, কিন্তু বেশ মিষ্টি করে কথা বলতেন।
ত্রিদিব হেসে ঠাকুমার প্রসঙ্গ সরিয়ে দিয়ে বললেন, আজ আমাদের বাড়িতে নিশ্চয়ই অতিথি আসবে, এই পাখিটাকে দেখলাম…
–আজ মাসের কত তারিখ?
–পাঁচ তারিখ, শনিবার…
সুলেখা আর কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল, এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ত্রিদিবের মুখের দিকে।
ত্রিদিব আবার বললেন, আমার সঙ্গে যদি বাজি ধরো, তুমি হেরে যাবে। বিশেষ বিশেষ অতিথি এলে আমার তো ভালোই লাগে। যাক গে, তুমি আজ কী বই এনেছো?
মৃদু সুপবন বইছে, অনেকরকম ফুল আর গাছ পাতা মিলিয়ে একটা আলাদা গন্ধ, মেঘ নেমে আসছে নিচের দিকে। গাছতলায় শুয়ে থাকার মতনই দুপুর। সুলেখা ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললো, ত্রিদিব ইয়েটসের কবিতা পড়ে শোনাতে লাগলেন। কিন্তু সুলেখার আজ মন বসলো না কবিতায়।
শাজাহান প্রত্যেক মাসেই একবার করে দিল্লিতে আসে। তার ব্যবসার সঙ্গে যে দিল্লির এতটা যোগাযোগ তা আগে জানা ছিল না ত্রিদিবদের। শাজাহান প্রায় নিয়ম করেই মাসের প্রথম সপ্তাহের শনিবার সন্ধের পর এসে হাজির হয় ত্রিদিবদের বাড়িতে। গল্পে গল্পে অনেক রাত হয়, এখন ধরেই নেওয়া হয়েছে সে রাত্তিরটা ওখানেই থেকে যাবে। শাজাহানের ব্যাগে তার রাত-পোশাক থাকে।
মানুষ হিসেবে শাজাহান অতি সজ্জন, বন্ধু হিসেবেও আকর্ষণীয়। কোনো ব্যাপারেই সে বেশি বাড়াবাড়ি করে না। ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান হলেও সে ইংরিজি সাহিত্য নিয়ে যথেষ্ট পড়াশুনো করেছে, সে একজন শেক্সপীয়ার-বিশেষজ্ঞ, ঐ বিষয় নিয়ে ত্রিদিবের সঙ্গে প্রায়ই তার তর্ক জমে। গত মাসেই একদিন তারা মালো ও শেক্সপীয়ারের তুলনামূলক আলোচনায় রাত প্রায় ভোর করে দিয়েছিল।
রাতুলের সঙ্গে শাজাহানের এখানেই তফাৎ, রাতুল সাহিত্যের বিশেষ ধার ধারে না। সে খেলাধুলো ভালোবাসে, ইংলণ্ডের কাউন্টি ক্রিকেটের স্কোর পর্যন্ত তার মুখস্থ থাকে। সে গান গাইতে পারে ভালো, কিন্তু কবিতা-টবিতা তার সহ্য হয় না। কলকাতায় ত্রিদিব আর শাজাহানের শেক্সপীয়ার আলোচনার সময় তাকে নীরবে বসে থাকতে হতো, তাতে সে কিছুটা অবহেলিত বোধ করতো। তার পক্ষে সমগ্র শেক্সপীয়ার পড়ে ফেলা এখন আর সম্ভব নয়, তাই সে কিছু কিছু কোটেশান মুখস্থ করে মাঝে মাঝে যোগ দেবার চেষ্টা করতো ত্রিদিবের আলোচনায়। অপ্রাসঙ্গিকভাবে সেই সব উদ্ধৃতি এক এক সময় অতি হাস্যকর মনে হয়।
যেমন, একদিন সুলেখা চা তৈরি করে দিচ্ছিল ওদের। কাজের লোকটি টি কোজিতে ঢাকা এক পট চা, ফাঁকা কাপ সসার, দুধ-চিনি আলাদা ভাবে এনে দেয়। সুলেখা প্রত্যেকের রুচি মতন কম বা বেশি চিনি মিশিয়ে হাতে হাতে কাপ তুলে দেয়, এটাই তাদের বাড়ির রীতি। সেদিন সন্ধেবেলা সুলেখাদের একটা থিয়েটার দেখতে যাওয়ার কথা, তাই সে একটু বেশি সাজগোজ করেছিল, একটা নতুন মারফিউম মেখেছিল।
শাজাহানের ঘ্রাণেন্দ্রিয় অতি প্রখর। সে নিশ্বাস টেনে বলেছিল, ভাবী,আজ জয় মেখেছেন মনে হচ্ছে? চায়ের ফ্লেভার আপনার এই পারফিউমের গন্ধে ঢেকে যাবে।
সুলেখা অবাক ভাবে বলেছিল, কী করে বুঝলেন জয়? বাবা, আপনার তো দারুণ নাক!
শাজাহান মুচকি হেসেছিলেন।
রাতুল সেই আলোচনায় ঢুকে পড়ার জন্য হঠাৎ সুলেখার হাত মুঠোয় ধরে বলে উঠেছিল “অল দা পারফিউমস অফ অ্যারাবিয়া উইলনট সুইটন দিস লিটল হ্যাণ্ড!”
ত্রিদিব আঁতকে উঠেছিলেন প্রায়। অতি ভদ্র তিনি, শুধু ভুরু তুলেছিলেন অনেকখানি, মুখে কিছু বলেননি। শাজাহান কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত থেকে তারপর হেসে উঠেছিল হো হো করে। সুলেখা সরিয়ে নিয়েছিল নিজের হাত।
শুধুমাত্র পারফিউম শব্দটির সূত্র ধরে রাতুল যে উদ্ধৃতিটি দিয়েছিল, তা যে শুধু অপ্রাসঙ্গিক বা ভুল অর্থেই তা নয়, রীতিমতন অপমানজনক। খুনের ষড়যন্ত্রকারিণী লেডি ম্যাকবেথের রক্তাক্ত হাতের সঙ্গে সুলেখার করতলের তুলনা?
রাতুল নিজের ভুলটা এর পরেও বুঝতে না পেরে শাজাহানের ওপর রেগে উঠে বলেছিল, তুমি হাসলে কেন? তুমি হাসলে কেন?
সুলেখার মায়া হয়েছিল। রাতুল শেক্সপীয়ার পড়েনি, তা বলে তার মুখের ওপর ওরকমভাবে হেসে ওঠা উচিত হয়নি শাজাহানের।
শাজাহান কিন্তু রাতুলের অজ্ঞতা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ বিদ্রূপ করতে ছাড়ে নি সেদিন। ত্রিদিব আর সুলেখা দু জনেই সূক্ষ্মভাবে বাধা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাতুল যে এই আড্ডায় যোগ দেবার যোগ্য নয় তা শাজাহান প্রায়ই বুঝিয়ে দিতে চায়।
শাজাহান আর রাতুলকে এক সঙ্গে দেখলেই শেষের দিকে ভয় ভয় করতো সুলেখার। দু’ জনে যেন হঠাৎ হঠাৎ হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। কী নিয়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা?
সুলেখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
ত্রিদিব জিজ্ঞেস করলেন, ইয়েটসের কবিতা তোমার ভালো লাগছে–?
সুলেখা বললো, কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লো, এবারে উঠতে হবে।
ত্রিদিব বললেন, আর একটু জোরে বৃষ্টি আসুক। তোমাকে আজ একদম অন্যরকম লাগছে, সুলেখা?
–কী রকম?
–যেন তুমি কোনো মন্দিরের গায়ে ভাস্কর্য হয়েছিলে, হঠাৎ এই মাত্র রক্তমাংসের নারী হয়ে নেমে এলে।
সুলেখা জিনিসপত্র গুছোতে গুছোতে হেসে বললো, ছত্রিশ বছর বয়েস হয়ে গেল আমার, বুড়ি হতে আর বাকি নেই, এখনও এইসব কথা!
জোরে বৃষ্টি নামলো, ওদের ফিরতেই হলো গাড়িতে। তখুনি সুলেখা আগামী শনিবারের জন্য ত্রিদিবকে হুমায়ুনস টুম-এ নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলো অগ্রিম।
বাড়ি ফেরার পর সুলেখাকে বেরুতে হলো আবার। সুলেখার পিসিমারা থাকেন দড়িয়াগঞ্জে। তার পিসেমশাই দিল্লিতে চাকরি থেকে অবসর নেবার পর এখানেই বাড়ি কিনে থেকে গেছেন। সুলেখা-ত্রিদিবের সন্ধান পেয়ে তিনি মাঝে মাঝে যাওয়া আসা করেন। তাঁর মাধ্যমে কিছু কিছু প্রবাসী বাঙালীদের সঙ্গেও আলাপ পরিচয় হয়েছে, কেউ কেউ নেমন্তন্ন করেন, অমিশুক ত্রিদিব কোথাও যেতে চান না, সুলেখাকেই ভদ্রতা রক্ষা করতে হয়।
আজ সেই পিসেমশাই এসে জানিয়ে গেলেন, তাঁর মেয়ের হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়েছে, পাত্রপক্ষ। আশীবাদ করতে আসবে সন্ধেবেলা, সুলেখা-ত্রিদিবকে যেতেই হবে একবার। ত্রিদিবের যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, বিশ্বস্ত ড্রাইভারের সঙ্গে তিনি পাঠিয়ে দিলেন সুলেখাকে। তারপর তিনি বইপত্র নিয়ে বসলেন।
ইস্টকুটুম পাখির বার্তা ভুল হয়নি, খানিকবাদেই এসে উপস্থিত হলো শাজাহান।
ত্রিদিব তাকে যথোচিত অভ্যর্থনা জানালেন, বাবুর্চিকে বলে দিলেন খানা বানাতে, কিন্তু আড্ডা জমলো না। সুলেখা বাড়িতে নেই শোনা মাত্র সে যেন কেমন চুপসে গেছে। তার দৃষ্টিতে জ্যোতি নেই, এমনকি খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পর সে প্রস্তাব দিল, আজ সে ফিরে যাবে, কাল সকালে তার জরুরি কাজ আছে।
ত্রিদিব বললেন, বসুন, আর একটু বসুন। সুলেখার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেলে সে দুঃখ পাবে।
সুলেখা ফিরলো রাত দশটার একটু পরে। তার চোখে মুখে অনেক গল্প। তার এম এ পাস পিসতুতো বোন শিখা একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করেছে। বাবা-মাকে আগে সে কিছু জানায়নি, কিন্তু গোপনে সে একটি পাঞ্জাবী যুবকের বাগদত্তা। শিখার বাবা-মা এলাহাবাদের এক বঙ্গ সন্তানের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেছেন, শিখা তার রাশভারি বাবার মুখের ওপর না বলতে পারে না, সেইজন্য সে এলাহাবাদের পাত্রটিকে চিঠি লিখে সব কথা জানিয়েছে। তাই নিয়ে আজ হুলুস্থুলু কাণ্ড। শিখার আজ আশীবাদ হবার কথা, কিন্তু এলাহাবাদ-পক্ষ বাড়িতে এসে। তর্জন-গর্জন শুরু করে দিল, তারা অপমানিত বোধ করেছে।
এই সব গল্পে রাত হয়ে গেল অনেক, শাজাহান থেকেই গেল শেষপর্যন্ত।
রবিবার সকালে দেরি করে উঠলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু ত্রিদিবকে যেতে হবে জাপানী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা চালাতে। ব্রেক ফাস্ট টেবিলেই কথা শুরু হবে।
ত্রিদিব উঠে পড়ায় সুলেখারও ঘুম ভেঙে গেছে। ত্রিদিব আলতো করে তার কপাল ছুঁয়ে বললেন, তুমি আরও একটু ঘুমিয়ে নাও না! আমাকে তো যেতেই হবে, উপায় নেই।
সুলেখা একটুখানি উঠে বসে বললো, তুমি তা হলে শাজাহানকে নিয়ে যাও। ওকে তোমার গাড়িতে লিফ্ট দিলে ওর সুবিধে হবে।
ত্রিদিব বললেন, শাজাহান ঘুমোচ্ছে, এখন ওকে জাগিয়ে লাভ কী? ও থাক। ওকে বরং আজ দুপুরে এখানে খেয়ে যেতে বলো।
–তুমি কখন ফিরবে?
–আশা করছি লাঞ্চের আগে ফিরতে পারবো। রবিবার আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না।
সুলেখার চোখে তখনও এক রাশ ঘুম। সে আর কথা না বাড়িয়ে বালিশে মুখ গুজলো।
সকাল থেকেই টিপটিপ করে আবার বৃষ্টি পড়ছে। বেশ একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। দিন-মজুর, খেলোয়াড় কিংবা জাপানীদের সঙ্গে যাদের ব্যবসার কথা চালাতে হয়, তারা ছাড়া আজ সকালে কারুর ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই।
সুলেখার দ্বিতীয়বার ঘুম ভাঙলো সাড়ে নটায়। বারান্দায় পাজামার সঙ্গে ড্রেসিং গাউন পরে শাজাহান চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছে। সুলেখাকে দেখে সে সহাস্যে বললো, গুড মর্নিং ভাবী। আপনার লোক যা চা বানিয়ে দিয়েছে, মুখে দেওয়া যায় না। আপনার হাতের তৈরি আসল এক কাপ চা এবার খেতে চাই।
সুলেখা বাবুর্চিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে শাজাহানের সামনে এসে বসে লজ্জিতভাবে বললো, ইস, আজ বড্ড বেশি ঘুমিয়েছি। আপনি অনেকক্ষণ উঠেছেন?
শাজাহান বললো, না, এই তো কিছুক্ষণ, দাদা বেরিয়ে গেছেন শুনলাম, কখন গেলেন টেরও পাইনি।
শাজাহান প্রায় ত্রিদিবেরই সমবয়েসী, তবু সে ত্রিদিব সুলেখাকে দাদা ও ভাবী বলে। সৌজন্য ও বিনয়ে সে ত্রিদিবের চেয়েও এক কাঠি ওপরে যায়। সুলেখার দিকে সে মাঝে মাঝেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে দৃষ্টিতে ঠিক লালসা নেই কিন্তু অন্য একটা কিছু আছে। শাজাহানের সামনে একলা বসতে সুলেখা বেশ অস্বস্তি বোধ করে, যদিও তার কারণটা সে এখনও বুঝতে পারে না।
সুলেখা জিজ্ঞেস করলো, রাত্তিরে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
এটা একটা অতি সাধারণ প্রশ্ন। নিছক কথা শুরু করার জন্যই বলা। এর উত্তরটাও মামুলি হয়। কিন্তু আজই প্রথম শাজাহান দুদিকে মাথা নেড়ে গাঢ় স্বরে বললো, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম! আপনার এখানে আসি, আপনি যতক্ষণ চোখের আড়ালে থাকেন, ততক্ষণ মনটা অস্থির অস্থির লাগে।
সুলেখা মুখ নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। এই সব কথা তার পছন্দ হয় না, যদিও মানুষ হিসেবে সে শাজাহানকে পছন্দ করে।
শাজাহান আবার বললো, ভাবী, প্রত্যেক মাসে দিল্লিতে ছুটে আসি শুধু আপনাকে একবার চোখের দেখা দেখবার জন্য। আমার ব্যবসা…অন্য লোক এলেও চলে, কিন্তু আমি না এসে পারি না।
সুলেখা তখনও মুখ নিচু করে আছে দেখে শাজাহান খানিকটা ব্যাকুলভাবে বললো, আপনি রাগ করলেন? আমি মনের কথাটা বললাম, আমি আপনার একজন দারুণ ভক্ত!
একটা কিছু বলা দরকার, তাই সুলেখা চোখ না তুলেই বললো, যাঃ, কী যে বলছেন! …আজকের সকালটা ভারি সুন্দর, না? আপনি সিমলা কিংবা নৈনীতাল গেছেন? বর্ষায় আমার পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে।
–যাবেন? আমি ব্যবস্থা করবো?
–ও যে এখন কাজে বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
–দাদাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবো। চলুন, সিমলায় তবে একটা হোটেল বুক করে ফেলি? আমার চেনা আছে।
বাবুর্চি চায়ের ট্রে এনে রাখলো সামনের গোল টেবিলে। আর তখনই একটা ট্যাক্সি থামলো গেটের সামনে। সেই ট্যাক্সি থেকে নামলো রাতুল। সুলেখার বুকটা ধক করে উঠলো! একপলক দেখলেই বোঝা যায় রাতুল সুস্থ, স্বাভাবিক নয়।
রাতুলের পোশাক সব সময় এমন পরিপাটি থাকে যে তার চেহারা থেকে তার পোশাককে কখনো আলাদাভাবে চোখে পড়ে না। এখন রাতুলের গায়ের জামাটা দোমড়ানো, যেন কাল সারা রাত সে ঐ জামা পরেই ট্রেনে শুয়েছিল। মুখে দু দিনের দাড়ি, মাথায় চুল এলোমেলো।
শাজাহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আরে, রাতুলবাবু, আসেন, আসেন! রাতুল যেন শাজাহানের কথা শুনতে পেল না, তাকে দেখতেও পেল না। সে সোজা এগিয়ে এসে বারান্দার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় সুলেখাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমার চিঠির উত্তর দাওনি কেন?
সুলেখা নিষ্প্রাণ গলায় বললো, আপনি এসে বসুন। চা খাবেন? আমি চা করছি। রাতুল আরও জোরে বললো, আগে আমার কথার উত্তর দাও, তুমি আমার চিঠির…তুমি কি আমার জন্যই কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছো?
শাজাহান বললো, আরে, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? এসে বসেন। কোন্ ট্রেনে এলেন?
রাতুল এবারে দেখলো শাজাহানকে। তার ঘরোয়া পোশাক, তার সাবলীল ভঙ্গি। গৃহস্বামীকে দেখা যাচ্ছে না, যেন তার ভূমিকাটাই নিয়েছে শাজাহান।
রাতুল একবার শাজাহান আর একবার সুলেখাকে দেখে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ত্রিদিব কোথায়?
সুলেখা উত্তর দিল না, শাজাহান বললো, দাদা এখন বাড়িতে নেই।
–আপনি কবে এসেছেন?
–আমি কাল এসেছি।
–রাত্তিরে এখানে ছিলেন?
–হ্যাঁ।
রাতুল এবারে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালো সুলেখার দিকে। ত্রিদিব বাড়িতে নেই। সদ্য বিছানা ছেড়ে আসা শরীর নিয়ে শাজাহান আর সুলেখা অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে চা খেতে বসেছে সকালে, এই দৃশ্যে তার মাথায় জ্বলে উঠলো ঈর্ষার আগুন। মাথার মধ্যে অন্য আগুনও ছিল, আগুনে আগুন যোগ হলো।
বাড়িতে যে কাজের লোকজন রয়েছে, তারা শুনবে, সেসব কিছু গ্রাহ্য না করে সে সুলেখাকে বললো, তোমরা আমার জন্য কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছো? আমি এমনই সাংঘাতিক প্রাণী? তুমি টেলিফোনে আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলে, আমি কি ছেলেমানুষ?
সুলেখা রাতুলকে কী বলবে তা ভেবে পাচ্ছে না। চিঠির উত্তর না দেওয়াটাই যে প্রত্যাখ্যান তা যে বোঝে না, তাকে আর কী ভাবে বোঝানো যাবে? রাতুলকে সে অপছন্দ করে না। কিন্তু তাকে আর বেশী প্রশ্রয়ও দেওয়া যায় না।
রাতুল আজ সব ভদ্রতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। পুরুষ মানুষের এই রূপের সঙ্গে পরিচিত নয় সুলেখা।
সে কাতর মিনতির সঙ্গে বললো, আপনি প্লিজ বসুন। রাতুল তবু কর্কশ ভাবে বললো, তুমি কেন আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলে? হোয়াই? হোয়াই?
–আমি তো কিছু মিথ্যে বলি নি। আপনি ভুল বুঝেছিলেন।
রাতুল সুলেখার কাঁধ ধরে আরও চেঁচিয়ে বললো, আমি ভুল বুঝেছি? ডিড্নড্ ইউ সিডিউস মি…।
শাজাহান উঠে এসে রাতুলের হাত ধরে বললো, এ কী করছেন? বসুন, বসুন, আগে একটু জিরিয়ে নিন। সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসেছেন।
রাতুল এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিয়ে বললো, আপনি সরে যান। আপনার সঙ্গে আমি কথা বলতে আসিনি। সুলেখার সঙ্গে আমার বোঝাঁপড়া আছে।
–তা বলে এত চ্যাঁচামেচি করবেন? এটা ঠিক হচ্ছে না। মাথা ঠাণ্ডা করুন!
রাতুল আরও গলা চড়িয়ে বললো, সুলেখা, তুমি এই মুসলমানটাকে তোমার বাড়িতে থাকতে দাও, আর আমার চিঠির জবাবও দাও না। এই তোমার সতীপনা। ত্রিদিব বুঝি কাল রাত্রেও বাড়িতে ছিল না?
সুলেখা এবার মুখ তুলে প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে বললো, ছিঃ!
শাজাহান বললো, রাতুলবাবু, ইউ আর ক্রসিং ইওর লিমিট!
রাতুল সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে ঠাস করে এক চড় কষালো শাজাহানের গালে। শাজাহান কয়েক পা পিছিয়ে গেল, দ্বিতীয়বার মারার জন্য হাত তুলে রইলো রাতুল।
আঘাতের চেয়েও অনেকখানি বিস্ময় ফুটে উঠলো শাজাহানের মুখে। ত্রিদিবের বাড়ির পরিবেশে চড় মারামারি যেন অকল্পনীয় ব্যাপার।
–আপনি, আপনি আমাকে মারলেন, রাতুলবাবু? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
–বেশ করেছি। আরও মারবো। তুই কোন্ সাহসে এ বাড়িতে আসিস। দূর হয়ে যা! শুয়োরের বাচ্চা পাকিস্তানী! যা, পাকিস্তানে চলে যা!
সুলেখা আর সহ্য করতে পারলো না। দু হাতে মুখ চাপা দিয়ে সে ছুটে চলে গেল নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
রাতুল আর শাজাহান মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। রাতুলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে, সে আরও মারামারি করার জন্য তৈরি। আঙুল তুলে হুকুমের সুরে বললো, যা, বেরিয়ে যা! কোনোদিন যেন তোকে আর এ বাড়িতে না দেখি!
শাজাহান মৃদু শক্ত গলায় বললো, আপনি আমাকে পাকিস্তানে পাঠাতে চাইছেন? না, আমি পাকিস্তানে যাবো না। দিল্লি জায়গাটা আপনার বাপের সম্পত্তি নয়। এ বাড়িতেও আপনাকে গুণ্ডামি করার অধিকার কেউ দেয়নি!
–দেখবি, অধিকার আছে কি না! তুই যে পাকিস্তানের স্পাই তা আমি জানি না ভেবেছিস?
শাজাহান দু চোখে তীব্র ঘৃণা ফুটিয়ে বললো, আপনি যে এত নিচে নেমে যেতে পারেন, তা আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি। পাকিস্তানের স্পাই, আমি? শুধু মুসলমান বলে? না, আমি পাকিস্তানে যাবো না। আপনি আমার গায়ে হাত তুলেছেন, তার শোধ আমি নেবোই। হিন্দুদের নরকে সবচেয়ে যে খারাপ জায়গাটা আছে, সেখানে আমি আপনাকে পাঠাবো। আমি মুসলমানের বাচ্চা, আমার কথার খেলাপ হয় না।