একটা ভিড়ের বাসে চেপে ওরা দু’জনে চলে এলো বর্ধমান। ট্রেন আর আসবে না বোঝাই গেছে। সকালের দিকে দু’একখানা ট্রেন শুধু কলকাতার দিকে গিয়েছিল, তারপর দু দিকেই বন্ধ।
বর্ধমান থেকে আবার অন্য একটি বাসে নবদ্বীপ যাওয়া যায়। তবে ট্রেনের যাত্রীরা আজ সবাই হুড়মুড়িয়ে বাসে উঠছে, প্রথম বাসে অতীনরা জায়গা পেল না। পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, সে বাসের জন্যও আরও অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের ব্যথার জন্য অতীনের পক্ষে ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করা সম্ভব নয়।
অতীনের খুব খিদে পেয়েছে। আগের রাত্রে তার জ্বর ছিল বলে ভালো করে খেতে পারে নি, সকালেও খানিকটা মুড়ি-পাঁপরভাজা ছাড়া আর কিছু খাওয়া হয়নি, এখন জঠরের আগুনটা বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। অতীন খিদে সহ্য করতে পারে না। অন্যান্য দিন বাড়িতে স্নান করার পর তাকে ভাত দিতে একটু দেরি হলেই সে চাচামেচি করে, চুল আঁচড়াবার সময়টুকুও সে বাদ দিয়ে দেয়।
অলিকে একটা গাছতলায় দাঁড় করিয়ে অতীন দেখতে গেল অন্য কোনো রুটে নবদ্বীপ পৌঁছোনো যায় কিনা। এখান থেকে অনেক জায়গার বাস ছাড়ে। বোলপুর, কালনা, দুর্গাপুর, মাসানজোড়, রামপুরহাট, নানুর-উদ্ধারণপুর…এর কোনো জায়গাতেই যায় নি অতীন। অচেনা নামের জায়গাগুলি যেন হাতছানি দেয়, কৃষ্ণনগরে অলিদের বাড়ি, সেই জন্যই খানিকটা চেনা চেনা, কিন্তু যেখানে একজনও চেনা মানুষ নেই, সেইসব জায়গা কেমন যেন রহস্যময়।
ফিরে এসে অতীন বললো, আজই নবদ্বীপ হয়ে কৃষ্ণনগর যেতে হবে, তার কি কোনো মানে আছে? অন্য যে-কোনো একটা জায়গাতেও তো যাওয়া যেতে পারে।
দু’দিকে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে অলি বললো, না।
অতীন ভুরু দুটো বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেন, যাবি না কেন?
–কেন যাবো আগে সেটা বলো! তোমাকে তো তখনই বলেছি, আমি নিরুদ্দেশটিরুদ্দেশে যেতে চাই না।
–ঠিক, আছে, এটা তো নিরুদ্দেশ হচ্ছে না। ধর রামপুরহাট কিংবা কালনায় গেলাম, সেখানে একটা হোটেলে ঘর ভাড়া করে থাকবো, বিকেলবেলা বেড়াবো, সন্ধেবেলা তুই নদীর ধারে বসে গুনগুন করে গান গাইবি, তারপর কাল চলে যাবো নবদ্বীপে। আমাদের তো মেমারিতেই আরও দু’একদিন থেকে যাওয়ার কথা ছিল। সুতরাং একদিন দেরি হলেও ক্ষতি নেই।
–বাড়িতে গিয়ে বুঝি আমি মিথ্যে কথা বলবো?
–মাঝে মাঝে দু’একটা ছোটখাটো মিথ্যে কথা বলা এমন কিছু দোষের না। ঠিক আছে, মিথ্যে কথা বলতে হবে না, তুই কিছুই বলবি না, তোর বাবা-মা ভাববেন আমরা মেমারি থেকেই এসেছি।
–কিন্তু তোমার সঙ্গে একটা হোটেলে গিয়ে থাকবো কেন, সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি।
–এত কেন-র কী আছে। থাকতে ভালো লাগবে, কেউ আমাদের চিনবে না, আমরা কারু সঙ্গে কথাই বলবো না!
অতীনের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অলি ভর্ৎসনার সুরে বললো, বাবলুদা, তুমি বড্ড অসভ্য হয়েছে। আজকাল প্রায়ই খারাপ কথা বলো।
–আরে, এর মধ্যে খারাপের কী আছে?
–আমি কোথাও যাবো না। নবদ্বীপের বাস এলে তাতে উঠবো, তুমি যদি না যেতে চাও, আমি একাই চলে যেতে পারবো!
–তোর কাছে কত টাকা আছে রে অলি?
–সত্তর-আশী টাকা আছে এখনো।
-–ওরে বাবা, সে তো অনেক টাকা। আমার কাছেও গোটা পনেরো আছে। রামপুরহাটের ভাড়া মাত্র এক টাকা বারো আনা। হোটেলের ঘর ভাড়া আর কত হবে, বড় জোর দশ টাকা?
–আবার ঐ কথা বলছো? তোমাকে আমার সঙ্গে নবদ্বীপেও যেতে হবে না, যাও! তুমি একলা চলে যাও! টাকা চাই, দেবো?
অলিদের বাড়িতে অলি অতীনের প্রতি সামান্যতম রূঢ়তা দেখালে অতীন আর এক মুহূর্ত দেরি করে না। তারপর মাসের পর মাস আর সে ও বাড়িতে যায় না। প্রত্যেকবার অলিই নিজে থেকে এসে তার অভিমান ভাঙায়। আজ কিন্তু অতীন একটুও রাগ করছে না, তার ঠোঁটে খানিকটা দুষ্টুমির হাসি লেগেই আছে।
সে বললো, দারুণ খিদে পেয়েছে রে, দাঁড়াতে পারছি না। ভিড় একটু কমুক না, খানিকটা পরের বাসে যাবো। রাস্তার উল্টোদিকে কয়েকটা ভাতের হোটেল আছে, চল না কিছু খেয়ে নিই।
অলি এই প্রস্তাবে আপত্তি করলো না। হোটেলটা পথচলতি মানুষদের জন্য, অতিশয় শস্তা। নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চ, ভন করছে অসংখ্য মাছি, কঞ্চির বেড়ায় বহু পুরোনো ক্যালেন্ডারের ছবি, কাছেই হাত ধোওয়ার জায়গাটায় থিকথিকে কাদা হয়ে আছে।
ওরা বসতেই একটি অল্প বয়েসী নাদুশনুদুশ চেহারার ছেলে ওদের সামনে কলাপাতা রেখে তাতে নুন আর লেবুর টুকরো দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী লেবেন?
অতীন জিজ্ঞেস করলো, কী কী আছে?
ছেলেটি গড়গড়িয়ে বললো, রুটি, ডাল, ঢাড়োশের শবজি, আলু-ফুলকপি, মাছের কালিয়া, মাছের ঝোল…
–ভাত নেই?
–আছে, দাম বেশি পড়ে যাবে।
–তুমি ভাতই দাও, আর ডাল, একটা তরকারি আর মাছ। আর ইয়ে, বেগুন ভাজা দেবে দুটো করে।
–বেগুন ভাজা হবে না, মাছ ভাজা লিতে পারেন।
–মাছ ভাজা চাই না। তুমি চটপট নিয়ে এসে যা বললুম।
–হাফ না ফুল?
অতীন এ প্রশ্নের মর্ম না বুঝে অলির দিকে তাকালো। অলিও কিছু জানে না। অতীন বললো, আগে তুমি হাফই নিয়ে এসো।
বেগুন ভাজা অতীনের প্রিয়, সেটা না পেয়ে সে একটু ক্ষুণ্ণ হলো। হোটেলে পয়সা দিয়ে খেতে এসেও যদি ইচ্ছে মতন জিনিস না পাওয়া যায়… সে ছেলেটিকে ডেকে বললো, এই, কাঁচা লঙ্কা নিয়ে আসবে!
একটু পরেই সে আবার অধৈর্যভাবে চেঁচিয়ে উঠলো, কী হলো, খোকা, ভাত দিয়ে গেলে না?
অলি এরকম হোটেলে কোনোদিন ঢোকে নি। বাইরে খাওয়ার ব্যাপারেই তাদের পরিবারের একটু পিটপিটিনি আছে। কলকাতার বাইরে কোথাও গেলে তারা সঙ্গে পর্যাপ্ত বাড়ির খাবার নিয়ে যায়, সাধারণ হোটেল যায় না। অলির আবার পরিষ্কার বাতিক আছে, নোংরা দেখলেই তার গা ঘিনঘিন করে। তার হিসেবে এই হোটেলটি এতই নোংরা যে সহ্য করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবু অতীনকে অম্লান বদনে খেয়ে যেতে দেখে সে মুখে একটুও বিকৃতি ফোঁটালো না। তার শাড়ীর আঁচলটা একেবারে ঠেকে গেছে মাটিতে, ডায়িং ক্লিনিং-এ না পাঠিয়ে এ শাড়ি সে আর পরবে না।
হাফ প্লেট ভাতে পেট ভরে নি অতীনের, সে দ্বিতীয়বার ভাত নিল। মাছটা তার পছন্দ হয়নি, সে ডাল তরকারি নিল আবার।
অলি জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী করে কাঁচা লঙ্কাটা খাচ্ছো, ঝাল নেই?
অতীন বললো, হ্যাঁ, বেশ চমৎকার ঝাল। এই একটাই বাঙালত্ব টিকে আছে আমার, ঝাল ছাড়া খেতে পারি না।
–বাবলুদা, পাশের টেবিলটায় দ্যাখো।
অতীন একবার পাশ ফিরে তাকালো। লুঙ্গি পরা দু’জন মুসলমান হাটুরে শ্রেণীর লোক শুধু দু’বাটি ডাল আর এক গোছা করে রুটি নিয়ে বসেছে, দু’জনেরই হাতে কাঁচা লঙ্কা, তারা টিয়া পাখির মতন কচ কচ করে সেই লঙ্কা দাঁতে কাটছে।
অলি জিজ্ঞেস করলো, ওরাও বুঝি বাঙাল?
অতীন হেসে বললো, নাঃ, বাঙাল মুসলমান হলে নিশ্চয়ই বর্ধমানের এই হোটেলে খেতে আসতো না।
–তোমার বাঙালত্বর আর একটা প্রমাণ আছে, বাবলুদা, তুমি ভাত ছাড়া খেতে পারো না।
–এখন মনে পড়লো, আজকাল হোটেলে রোজ ভাত বিক্রি করা বে-আইনী, কাগজে। পড়েছিলুম। এ কী, তুই কিছুই খেলি না যে?
–আমার খিদে পায় নি।
–বুঝেছি, কেষ্টনগরের দুধ-ভাত ছাড়া তোর মুখে আর কিছুই রুচবে না।
এই হোটেলে একটি চালু রেডিও-ও রয়েছে। তাতে সেতারের দুঃখের সুর বাজছে, লালবাহাদুরের জন্য এখন রাষ্ট্রীয় শোক চলবে বেশ কয়েকদিন। রাস্তায় অনেক মানুষ, তীব্র স্বরে হর্ন বাজিয়ে ও ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে বাস, সাইকেল রিকশা ও ঠেলাগাড়ির জটলা, একটি কমলালেবুওয়ালার সঙ্গে জোরে জোরে বচসা করছে একজন খদ্দের। এসবই প্রতিদিনকার রুটিন বাঁধা দৃশ্য। দেখলে বোঝার উপায় নেই যে ভারতের ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ চলছে, যে-কোনো মুহূর্তে একটা বড়রকম রদবদল হয়ে যেতে পারে।
সেতারের বাজনাটা শুনেই অতীন একবার ভাবলো, এদেশেও কি সামরিক শাসন এসে যাবে? পর মুহূর্তেই সে এই চিন্তাটা উড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
হোটেলের বাইরে এসে সে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, এবারে কি নিরুদ্দেশে যাওয়া হবে? রাজকুমারীর মত বদলেছে?
অলি বললো, তোমার ইচ্ছে হলে তুমি একা যেতে পারো। আমি সোজা নবদ্বীপ যেতে চাই।
অতীন বললো, কী সুন্দর রোদ উঠেছে, এরকম একটা গ্লোরিয়াস দিনে টপ করে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না…উঃ মাগো, উঃ উঃ। গেলাম রে।
একজন লোক ট্যালার মতন কাবলিজুতো-পরা পায়ে ধাক্কা মেরেছে অতীনের ব্যথার পা-টিতেই। লোকটি পেছন ফিরে তাকালোও না, চলে গেল হনহনিয়ে। অতীন যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেও অলির হাসি পেয়ে গেল। অতীন বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না বলার সঙ্গে সঙ্গে উঃ মাগো বলে ফেলেছে। অলির ইচ্ছে হলো অতীনের পিঠে একটা কিল মারতে।
এর পর অতীনের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না। অলি জিজ্ঞেস করলো, ঐ দিকে একটা ওষুধের দোকান আছে, ওখানে নিশ্চয়ই ডাক্তার পাওয়া যাবে। একবার দেখিয়ে নেবে পা-টা?
অতীন বললো, বর্ধমানে ডাক্তার দেখাই আর সে আমার পাখানা কুচ করে কেটে বাদ দিক। আর কি? সেপটিক হয়ে গেছে, তাতো বুঝতেই পারছি। যা হবার কলকাতায় গিয়ে হবে! হারে, তোদের বাড়িতে কারু সামান্য একটু জ্বর হলেই অমনি ডাক্তার ডাকা হয়, তাই না? তোদের নিশ্চয়ই ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান আছে?
–বাঃ, থাকবে না?
–আমাদের বাড়ির সিস্টেম কী জানিস, তিন-চারদিন ধরে জ্বর চললেও ডাক্তারের কাছে। যাওয়া চলবে না। অসুখের কথা লুকিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদের কাছে বীরত্বের পরিচয়। আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বলে কিছু নেই, আমার বাবা জীবনে একবারও কোনো ডাক্তারের কাছে গেছেন কি না সন্দেহ।
–এখন তোমাদের বাড়িতেই তো তুতুলদি ডাক্তার।
–হ্যাঁ, কিন্তু ফুলদির নিজের দারুণ শরীর খারাপ হলেও কোনো ওষুধ খাবে না। সব ওষুধই নাকি একটু একটু বিষ। ভেবে দ্যাখ, একজন ডাক্তার হতে চলেছে অথচ কোনো ওষুধেই তার বিশ্বাস নেই। আমাদের বাড়িটাই একটা পাগলের বাড়ি।
–এই বাবলুদা, ওরকমভাবে কথা বলে না।
–আমার মায়ের যে আলসার আছে, তা আমি এই সেদিনমাত্র জানলাম। অথচ সাত-আট বছর ধরে নাকি হয়েছে!
-তুমি তো বাড়ির কোনো খবরই রাখে না।
–ঠিক বলেছিস, অলি, আমি একটা অপদার্থ। আমার দাদা যদি আমার বদলে বেঁচে থাকতো, তা হলে আমার বাবা-মা কত ভালোভাবে থাকতে পারতো, আমাদের সংসারের চেহারাটাই বদলে যেত।
–ছিঃ বাবলুদা।
চল্লিশ মিনিট পরে নবদ্বীপের একটা বাসে জায়গা পাওয়া গেল কোনোক্রমে। ভিড় প্রচুর। অলি একটা লেডিজ সীটে বসতে পারলেও অতীনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো হাতল ধরে। অনেকখানি জার্নি। বাসটা জোরে যেতেই পারছে না, মাঝে-মাঝেই রাস্তায় বিফল ট্রেনযাত্রীরা জোর করে বাস থামিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, অনেকেই বসেছে. বাসের ছাদে।
এত ভিড়ের মধ্যে কথা বলারও উপায় নেই, অতীন আর অলি চোখাচোখি করছে শুধু। দু’জনের দৃষ্টির মধ্যে যেন একটা সেতু। অলি তবু জানলা দিয়ে মাঝে মাঝে বাইরে তাকাতে পারে কিন্তু অতীন একদৃষ্টিতে দেখছে শুধু অলিকে। বাসের অন্যান্য যাত্রীদের গায়ের স্পর্শ সে পেলেও তাদের অস্তিত্ব সে ভুলে গেছে।
প্রায় দু’ঘণ্টা বাদে অলির পাশের বৃদ্ধা মহিলাটি নেমে গেলেন। অতীন তবু সেখানে বসলো, দাঁড়িয়েই রইলো। অলি মৃদুভাবে তাকে ডাকলো কয়েকবার। অতীন যেন শুনতেই পাচ্ছে। না। অলি একটু ঝুঁকে অতীনের হাত ধরে টানলো, তখন অতীন বসলো, কিন্তু বললো, দাঁড়িয়েই। তো ভালো ছিলাম, পাশাপাশি বসলে ভালো করে মুখ দেখা যায় না।
অলি প্রগাঢ়ভাবে অবাক হলো। এরকম একটা কথা বলার পক্ষে বাবলুদা যেন পৃথিবীর শেষতম ব্যক্তি। আজ বাবলুদার সব কিছুই অন্যরকম।
অতীনকে ছুঁয়ে অলি তার শরীরের উত্তাপ টের পেয়েছে, সে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, বাবলুদা, তোমার আবার জ্বর এসেছে।
অতীন বললো, ও কিছু না। তোকে বললাম তো, আমাদের ফ্যামিলিতে দুতিনদিনের জ্বরটা কোনো ব্যাপারই না। ও আমরা হজম করে ফেলতে পারি।
–কিন্তু তোমার এই জ্বরটা হচ্ছে পায়ের ব্যথার জন্য।
–তুই-ও বুঝি ডাক্তারি জানিস? গোপাল ভাঁড়ের গল্পে পড়েছি, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক যে জিনিসটা জানে তা হলো ডাক্তারি। ও, তোরাও তো গোপাল ভাঁড়ের দেশের লোক!
আরও বেশ কিছুক্ষণ চলার পর বাসটা হঠাৎ থেমে গেল এক জায়গায়। ইঞ্জিনে ঘটাং ঘটাং শব্দ, একটুখানি চলার চেষ্টা করতেই ম্যালেরিয়ার রুগীর মতন কাঁপুনি। অনেক যাত্রী হইহই করে উঠলো, কেউ কেউ নেমে গেল ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে। শীতের সন্ধে নেমে এসেছে তাড়াতাড়ি, তার মধ্যে বাসটি অনড়।
প্রায় আধঘণ্টা বসে থাকার পর অতীন বেশ উফুল্ল গলায় বললো, আর যাবে না মনে হচ্ছে। এবারে আর উপায় নেই, নেমে হোটেল খুঁজতে হবে। তাহলে রাতটা আমার সঙ্গেই কাটাতে হচ্ছে, রাজকুমারী!
অলি বললো, মোটেই না। আমি জায়গাটা চিনতে পারছি, এখান থেকে নবদ্বীপের ঘাট বেশি দূর না। হেঁটেই যাওয়া যায়! চলো, তাই যাবে?
দু’জনে নেমে পড়ে কয়েক পা হাঁটার পরই অলি খুব অনুতপ্তভাবে বলে উঠলো, ইস, ছি ছি ছি ছি, আমি কী ভুল করতে যাচ্ছিলুম। চলো, বাসেই গিয়ে বসি। একসময় না একসময় তো চলবেই।
অতীন বললো, কেন, কী হলো?
–তোমার পায়ে ব্যথা। তুমি হাঁটবে কী করে?
–আমি ঠিক হাঁটতে পারবো। মনে কর, কোনো কারণে আমাদের পুলিশে তাড়া করলো.। তা হলে আমি পাঁই পাঁই করে ছুটতেও পারতাম।
–না, চলো। ফিরে চলো।
–বলছি তো, আমার কষ্ট হবে না। তোর কাঁধটা একটু ধরবো, তা হলে সুবিধে হবে?
অলি এদিক ওদিক তাকালো। এখনও অন্ধকার তেমন জমে নি। আরও অনেক লোক। হাঁটছে। অলি লজ্জিত ভাবে বললো, এখানে …মানে…লোকে দেখে কী ভাববে!
–লোকে দেখে কী ভাববে এই জন্য আমরা অনেক কিছুই করতে পারি না, তাই না? খেয়াঘাটে কিন্তু ভিড় বেশি নেই। দু’তিনটি নৌকো যাত্রীদের ডাকাডাকি করছে, অতীনরা যে-নৌকোয় উঠলো, সে নৌকোটি আর দু’তিনজন মানুষ পেয়েই ছেড়ে দিল।
শীতকালের পরিষ্কার আকাশ, অসংখ্য তারা। গঙ্গায় অবশ্য জল বেশি নেই। এ বছর বৃষ্টিও তেমন হয়নি। একজন যাত্রী মাঝি দু’জনের সঙ্গে এবছরের ধানের ফলন বিষয়ে এমন জোরে জোরে আলোচনা শুরু করে দিল যে নৌকোযাত্রাটা তেমন সুখকর হলো না। অতীন অলিকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, অমনি সেই যাত্রীটি তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, কী বললেন ভাই? যেন, ধানের ফলন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলা এ যাত্রায় নিষিদ্ধ।
ওপারে কয়েকটি সাইকেলরিকশা অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু অলি নৌকো থেকে নেমেই কোনো রিকশায় উঠতে রাজি হলো না। সে বললো, বাবলুদা, একটু দাঁড়াও, এই জায়গাটা বেশ ফাঁকা, এখানে একটু বসে যাই না!
অতীন বললো, ও, বাড়ির কাছে এসে গিয়ে এখন রোমান্টিসিজম হচ্ছে! এই শীতের মধ্যে বসতে ভালো লাগবে?
অলি তীরভূমি দিয়ে খানিকটা হেঁটে গিয়ে পায়ের চটি খুলে ফেলে জলে নামলো একটু। তারপর পেছন ফিরে ডেকে বললো, বাবলুদা, এখানে এসো, জলে হাত দিয়ে দেখো, জল কিন্তু বেশি ঠাণ্ডা নয়।
অতীন কাছে এসে বললো, নদীর জল বেশি ঠাণ্ডা হবে কী করে? সব সময়ই তো দৌড়োচ্ছে!
অলি চাপা গলায় গান ধরলো। পর পর দুটি গান, ‘অমন ধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া…’ তারপর, ‘ঘাটে বসে আছি আনমনা, যেতেছে বহিয়া সময়…’।
গান দুটি শেষ করার পর বেশ কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে অলি বললো, তুমি বলেছিলে নদীর ধারে গান গাইবার কথা…আচ্ছা, বাবলুদা, তুমি রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ করো না, তাই না? সেদিন ট্রেনে আসবার সময় বলছিলে…কিন্তু আমি তো অন্য কোনো গান জানি না…তুমিই তো আমায় গান শিখতে দিলে না।
অতীন কোনো মন্তব্য করলো না।
অলি আবার বললো, আজকের সারা দিনটা, এটাই তো আমাদের নিরুদ্দেশ। বর্ধমানের ঐ হোটেলে খাওয়া, তুমি আর আমি একসঙ্গে, আর কেউ চেনা নেই, এরকম তো আগে কখনো হয়নি। তারপর বাসে এতখানি পথ আসা, সেই ছেলেবেলায় তুমি আমাদের বাড়িতে খেলতে আসতে, তারপর তো বহুদিন আমরা সারাদিন এক সঙ্গে থাকিনি… বাসে আমার পাশে বসার পর তুমি বললে, পাশাপাশি বসলে মুখ দেখা যায় না, তখন আমার মনে হলো, সত্যিই আমি তোমার সঙ্গে নিরুদ্দেশে চলে যাচ্ছি, কী ভালো যে আজ লাগছে বাবলুদা, তোমার পায়ে ব্যথা, তবু তুমি আজ আমাকে একবারও বকুনি দাওনি…
কাছাকাছি একজন মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে অতীন চট করে ঘুরে দাঁড়ালো। কালো রঙের চাঁদর মুড়ি দিয়ে সত্যিই একজন মানুষ এসে সেখানে কখন দাঁড়িয়েছে। অলিকে আড়াল করে অতীন কাঁপা-রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলো, কে? কী চাই?
লোকটি বললো, আপনারা কি রিকশা যাবেন? আমার রিকশাই লাস্ট যাচ্ছে, এরপর আর পাবেন না। খেয়া বন্ধ হয়ে গেছে!
অগত্যা নদী-তীর ছেড়ে ওদের রিকশাতেই এসে উঠতে হলো। ধারালো ছুরির মতন ফিনফিনে বাতাস বইছে। অতীন তার গায়ের শালটার খানিকটা অংশ জড়িয়ে দিল অলির শরীরে। এখন রাস্তা একেবারে নিকষ অন্ধকার। রিকশাওয়ালাকেও দেখা যাচ্ছে না, ওদেরও দেখা যাচ্ছে না। যেন ওরা চলন্ত অলীক।
অতীনতার ডান হাতে অলির কোমর বেষ্টন করে তারপর পায়রার বুকের মসৃণতার মতন, অর্ধ তরল পাথরের মতন, উষ্ণ স্তনে করতল রাখলো। তার হাতটি যেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কাজ পেয়েছে।
অলি অতীনের সেই হাত চেপে ধরে খুব মৃদু, কাতর গলায় বললো, না বাবলুদা, প্লীজ…
চলন্ত রিকশাতে অলি জোরে প্রতিবাদ করতে পারবে না, রিকশাওয়ালা কিছু টের পাবার বদলে অলি. সব সহ্য করবে, একথা জেনেও অতীন সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল নিজের হাত, বললো, আচ্ছা, আর বিরক্ত করবো না।
অলি নিজেই ধরে রইলো অতীনের হাত, সে কোনো শোক গাথা বলার মতন সুরে বললো, বাবলুদা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? এবারে তুমি সর্বক্ষণ আমার ওপরে রেগে ছিলে কেন? আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে নি, আসবার সময় ট্রেনে, পমপমদের বাড়িতে…আমি কি কোনো দোষ করেছি?
অতীন বললো, সত্যি কথাটা বলবো?
তুমি আজকাল প্রায়ই মিথ্যে কথা বলো, আমি জানি। এবারে আমাকে সত্যি কথা বলো, প্লীজ, ফর এ চেইঞ্জ।
–আমি তোর কাছে মিথ্যে কথা বলি না। তবে কোনো কোনো ব্যাপার গোপন করে যাই। তুই এত নরম, অলি, অনেক সত্যি কথা শুনলে তুই আঘাত পাবি, সেইজন্য সেগুলো বলি না। কোনো কিছু গোপন করা আর মিথ্যে কথা বলা কি এক?
–এখন কিছু গোপন করো না। আমার ওপরে কী কারণে তোমার রাগ হয়েছে সেটা সত্যি করে বলল!
–তোর নাম অলি কে রেখেছিল?
–তুমি কথা ঘোরাচ্ছো!
–কিছুদিন ধরে আমার মনের মধ্যে সাঙ্ঘাতিক একটা লড়াই চলছে। একদিকে মানিকদা, কৌশিকরা, আর একদিকে তুই। একটা দারুণ ঝঞ্জাট চলছে এই নিয়ে, অন্য কাউকে কিছু বলতে পারছি না, এমনকি তোকেও না!
–আমাকেও বলতে পারো না? আমি কি তোমার কোনো কাজের বাধা হয়ে উঠেছি?
–তুই যে অলি, তুই আমার একেবারে নিজস্ব অলি, তোকে অন্য কেউ ছোঁবার চেষ্টা করলেও তাকে আমি শেষ করে দেবো, অথচ, আমি যেন তোকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছি, আমি তোর দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিই…
–বাবলুদা, তুমি কী বলতে চাইছো, আমি এখনো বুঝতে পারছি না!
–তবে বলি শোন। ঘাবড়ে যাস নি কিন্তু। দিন দশেক আগে থেকেই আমার কী যেন হয়েছে, আমি প্রায় সর্বক্ষণ মনে মনে একটা কথাই বলছি, এরকম আগে কখনো হয়নি। এখন আমি মনে মনে বলছি, আমার অলিকে চাই, আমার অলিকে চাই! সমস্ত শরীর দিয়ে চাই, সর্বস্ব দিয়ে চাই, এক্ষুনি চাই, সর্বক্ষণ চাই, ঠিক যেন পাগলামির মতন। তোর দিকে তাকালে, মাঝে মাঝে সত্যি আমার মনে হচ্ছিল, পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো, এক মুহূর্তও তোর কথা মন থেকে সরাতে পারছি না, শুধু চাই চাই, অলিকে চাই, অলিকে চাই বলে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। আর কারুকে ভালো লাগছিল না। কৌশিকের কথাও শুনতে ইচ্ছে করছিল না। আমি তবু অতি কষ্টে নিজেকে দমন করে, তোর সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করে…আজ তুই আমার সঙ্গে কোনো হোটেলে যেতে চাস নি, খুব ভালো হয়েছে, যদি যেতাম, আমি বোধহয় তোকে খেয়েই ফেলতাম, অলি, আমার সংযম নেই, আমি তোকে এরকম পাগলের মতন কেন যে চাইছি…
অতীনের হাতে একটা চাপড় মেরে অলি বললো, বাবলুদা, আমি তোমার কাছে কী চাই, তা তোমার জানতে ইচ্ছে করে না?
অলির এরকম প্রশ্ন শুনেও অতীন কিছু জানতে চাইলো না। সে নিজের মুখটা ঝুঁকিয়ে এনে অলির একটি কানের লতি আলতোভাবে কামড়ে ধরলো।