১১৫. পুরোচন অতিশয় বুদ্ধিমান লোক

১১৫.

পুরোচন অতিশয় বুদ্ধিমান লোক। স্থানীয় মানুষ-জন সকলের সঙ্গে পাণ্ডবদের পরিচয় আপ্যায়ন শেষ হয়ে গেলে পুরোচন তাদের একটি অস্থায়ী আবাসে এনে তুলল। সে জানাল যে, পাণ্ডবদের স্বচ্ছন্দবাসের জন্যই নতুন একটি ভবন তৈরি হচ্ছে। কাজ এখনও কিছু বাকি আছে। নির্মাণ সম্পূর্ণ হলেই নতুন বাড়িতে পুরোচন তাদের নিয়ে যাবে। পুরোচনই যে দুর্যোধনের কার্যসাধক ব্যক্তি, সে কথা পাণ্ডবরা কেউই জানতেন না এবং মহামতি বিদুরও এ বিষয়ে কিছু বলেননি। রাজা-রাজড়াদের প্রোটোকল অনুযায়ী এটা অবশ্যই একটা নিয়ম যে, যেখানে তারা যাচ্ছেন, সেখানকার একজন মান্য ব্যক্তি তাদের দেখাশোনার ভার নেবেন। পুরোচন বারণাবতে এসেছে পাণ্ডবদের অনেক আগে এবং পুরবাসী সকলকে সে বোঝাতে পেরেছে যে, পাণ্ডবদের সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই তার আগমন।

অস্থায়ী আবাসে পাণ্ডবদের আবাসন-ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে পুরোচন খাদ্য-পেয়, শয্যা-আসনের ব্যবস্থাও করল ভালভাবে–তেভ্যো ভক্ষাণি পানানি শয়নানি শুভানি চ। পাণ্ডবরাও রাজকীয় চাল-চলনে দামি দামি জামা-কাপড়, ভূষণ-আভরণ পরে রাজকীয় মর্যাদায় সেই বাড়িতে বাস করতে লাগলেন। দুর্যোধনের কার্যসাধক পুরোচনও খুবই আদর করতে লাগল পাণ্ডবদের।

দশ-দশটা দিন এইভাবে কেটে গেল সেই অস্থায়ী আবাসে। এর মধ্যে পুরোচনের বাড়ি সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। সেই ঘৃত-জতুনির্মিত দাহ্য পদার্থের চকমিলানো বাড়ির নাম দেওয়া হয়েছে শিব-ভবন। শিব মানে মঙ্গল। বাড়ির উদ্দেশ্য অতএব মঙ্গল-সাধন। এই মঙ্গল অবশ্যই পাণ্ডবদের নয়, দুর্যোধনের মঙ্গল। পাণ্ডবদের পক্ষে এই নবনির্মিত ভবন অমঙ্গলকর বলেই কবি লিখেছেন–নামটা শিব-ভবন বটে তবে বাস্তবে তা বড়ই অমঙ্গলকর—শিবাখ্যমশিবং তদা।

 পাণ্ডবরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে মায়ের সঙ্গে উঠে এলেন তথাকথিত শিব-ভবনে। তাদের জন্যই এই বাড়ি তৈরি হয়েছে হস্তিনাপুরের নির্দেশে। অতএব না উঠে উপায় কী? কুমার যুধিষ্ঠির আগে থেকেই বিদুরের কথায় যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। অতএব নতুন বাড়িতে এসেই তিনি গৃহটিকে পরীক্ষা করে নেওয়ার তাড়না অনুভব করলেন। বাড়িতে ঢুকেই যুধিষ্ঠির একটা অতি অদ্ভুত গন্ধ পেলেন, যে গন্ধ সাধারণত নতুন বাড়িতে পাওয়া যায় না। ঘি, গালা আর চর্বি মিলিয়ে এমনই এক উগ্র গন্ধের সৃষ্টি করেছে যে, যুধিষ্ঠির শুঁকেই বুঝতে পারলেন–বাড়িটি সাধারণ নয়–জিন্ সোস্য বসাগন্ধং সর্পিজতুবিমিশ্রিত। তিনি ভীমকে বললেন–ভীম! এ বাড়ি এমনভাবেই তৈরি হয়েছে যাতে খুব সহজে আগুন লাগানো যায়। শণ, ধুলো, মুজা, কাঁচলা আর বাঁশ হল এই বাড়ি তৈরির উপকরণ। এই বস্তুগুলিকে ঘিয়ে চুবিয়ে এ বাড়ি তৈরি করেছে বিশ্বাসী শিল্পীদের দিয়ে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে পুরোচন আমাদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেছে। আমরা যখনই পুরোচনকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করব, পুরোচন তখনই তার দুর্বুদ্ধি ফলাবে–বিশ্বস্তং মাময়ং পাপো দখুকামঃ পুরোচনঃ।

যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের মন্দ উদ্দেশ্যের কথা বুঝিয়ে দিলেন ভীমকে। কারণ ভীম ভুক্তভোগী, তিনিই সবচেয়ে ভাল বোঝেন, দুর্যোধনের উদ্দেশ্য। যুধিষ্ঠির বললেন–পুরোচন নিজেই যথেষ্ট দুষ্ট লোক, তার মধ্যে সে এখন কাজ করছে দুর্যোধনের হয়ে–তথাহি বৰ্ততে মন্দো দুর্যোধন বশে স্থিতঃ। তবে হ্যাঁ সুখের কথা, আমাদের হিতৈষী বিদুর আগেভাগেই দুর্যোধন-পুরোনের এই উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছেন। বিদুর আমাদের পিতার ছোট ভাই। তিনি আমাদের যথেষ্ট স্নেহ করেন বলেই আমাকে সাবধান করে দিয়েছেন সম্ভাব্য বিপদের বিষয়ে–আপদং তেন মাং পার্থ স সংবোধিতবান্ পুরা। দুর্যোধনের কথা শুনে কতগুলি নীচ-ইতর লোক এ বাড়ি তৈরি করেছে।

ভীম সরল মানুষ। তার পক্ষে এইটাই স্বাভাবিক ছিল যে, মুহূর্তের মধ্যে পুরোচনকে ধরে, তুলে আছাড় মারেন মাটিতে। কিন্তু নতুন জায়গায় এসব করা উচিত কিনা, সে বিষয়ে ভীমের একটু সংশয় আছে। বিশেষত যুধিষ্ঠির খুব দুর্ভাবনার মধ্যে পড়ে গেছেন দেখে তিনি সরল মনে বললেন–এই বাড়িটাকে যদি তুমি খুব সহজ-দাহ্য মনে কর তবে ভালয় ভালয় আমরা আমাদের সেই পুরনো বাড়িটাতেই ফিরে যাই না কেন–তত্রৈব সাধু গচ্ছামো যত্ৰ পূৰ্বোষিতা বয়ম।

যুধিষ্ঠির বললেন–না ভাই! আমাদের এই বাড়িতেই থাকতে হবে। কিন্তু থাকতে হবে এমনভাবে যেন আমাদের মনে কোনও সংশয়-দ্বিধা নেই–ইহ যত্তৈর্নিরাকারৈ বক্তব্যমিতি রোচরে। আগুন লাগলে আমরা কোথায় যাব–সেটা সাবধানে খুঁজে দেখতে হবে, ভাই। আর সব সময় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে আমরা বিপদে না পড়ি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা–আমাদের সন্দেহটা যেন পুরোচন একটুও বুঝতে না পারে। কারণ আমাদের সন্দেহ বুঝে গেলে পুরোচন তার কাজ করবে তাড়াতাড়ি এবং জোর করেই হঠাৎ একটা অঘটন সে ঘটিয়ে ফেলতে পারে–ক্ষিপ্রকারী তত ভূত্বা প্রসহ্যাপি দহেত নঃ।

ভীম যা বলেছিলেন, তার উদ্দেশ্য ছিল সরল। কিন্তু যুধিষ্ঠির যা বলছেন, তা রাজনীতির অন্তৰ্গঢ় কথা। মনুসংহিতা থেকে মহাভারত সর্বত্রই এই নীতি এক রকম। মনু বলেছেন–শত্রুর ইঙ্গিত–আকার চেষ্টা সব সময় বুঝতে হবে, কিন্তু নিজের ইঙ্গিত-আকার যেন শত্রু একটুও না বোঝে। আশ্চর্য কথা হল, মহাভারতে কণিকের মতো শৃগালবুদ্ধি ব্যক্তি ধৃতরাষ্ট্রকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির এখন সেই নীতিতে চলছেন। সর্বদা মনের মধ্যে সশঙ্ক থেকেও অশঙ্কিত আকার প্রকাশ করাটা হল অসাধারণ রাজনৈতিক চাতুর্যের পরিচয়, যুধিষ্ঠির তাই করছেন। কে বলে যুধিষ্ঠির কূটনীতি বোঝেন না!

যুধিষ্ঠির বললেন–দেখ ভাই! পুরোচন লোকনিন্দারও ভয় করে না, পাপেরও ভয় করে না, তার মধ্যে সে এখন দুর্যোধনের মতে কাজ করে যাচ্ছে। কাজেই যে কোনও সময় ঘরে আগুন দিতে তার আটকাবে না। তার চেয়ে এটা কিন্তু অনেক ভাল হবে যে, আমাদের জন্য যে বাড়ি তৈরি হয়েছে, তাতে আমরাই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে চলে যাব। এরপর যদি পিতামহ ভীষ্ম এবং অন্যান্য কুরুবৃদ্ধদের বুঝিয়ে বলি যে, আমাদের জন্য এইরকম অগ্নি–গৃহ তৈরি করিয়েছিলেন দুর্যোধন, আমরা তাই নিজেরাই সে বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছি–তাতে তারা অন্তত আমাদের দুষবেন না, দুষবেন দুর্যোধনকেই। কিন্তু আমরা যদি গৃহদাহের ভয়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাই, তবু দুর্যোধন কিন্তু ছাড়বে না। সে অন্য গুপ্তচর লাগাবে আমাদের অন্যভাবে মারার জন্য। স্পশৈর্নো মারয়েৎ সর্বান্ রাজ্যলুব্ধঃ সুবোধনঃ।

যুধিষ্ঠির নিজে বুঝতে পারছেন যে, এখন আর তিনি যুবরাজ পদে নেই। হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক শক্তি এখন আর তাকে সাহায্য করবে না। কারণ তিনি পদে নেই। রাজনৈতিক শক্তি পিছনে নেই বলেই তাকে চলতে হবে আপন প্রজ্ঞায়, কূটপদ্ধতিতে। কারণ বেঁচে থাকাটাই এখন সবচেয়ে জরুরী কথা। যুধিষ্ঠির বললেন–দুর্যোধন নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত আছে সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি হাতে নিয়ে। হস্তিনাপুরের মন্ত্রী-অমাত্যরা তার সহায় আছে। কিন্তু নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার জমিটুকু আমাদের চলে গেছে। আমাদের না আছে। রাজনৈতিক শক্তি, না আছে মন্ত্রী-অমাত্যের সহায়। টাকা-পয়সা সে যথেচ্ছ খরচা করতে পারে, কিন্তু আমরা তা পারি না। হস্তিনাপুরের সৈন্য-সামন্তও তার হাতে আছে, আমাদের তা নেই। কাজেই আমাদের পিছনে লাগার কোনও অসুবিধেই নেই তার—

 অপদস্থান পদে তিন্নপক্ষান্ পক্ষসংস্থিতঃ।
হীনকোশান্ মহাকোশঃ প্রয়োগৈ–ঘাতয়েদ ধ্রুবম্।

যুধিষ্ঠির খুব সহজে কথা বলে দিলেন বটে, কিন্তু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে যে, প্রাচীন রাষ্ট্রনীতির মধ্যে যে সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রের কথা আছে, তার মধ্যে রাজা, অমাত্য, কোশ, পুর, দুর্গ, দণ্ড এবং মিত্র–এর কোনওটাই এখন যুধিষ্ঠিরের অনুকূলে নেই। অতএব যুধিষ্ঠিরকে এখন যা কিছু করতে হবে তা করতে হবে আত্মরক্ষার জন্য এবং তা করতে হবে কূটনীতির মাধ্যমেই। যুধিষ্ঠির বললেন–এই বদমাশ পুরোচন আর দুর্যোধনকে ঠকিয়ে দিতে হবে। আমরা দেখাব যেন এই বাড়িতেই থাকছি। কিন্তু থাকব এখানে ওখানে গোপনে বঞ্চয়দ্ভির্নিবস্তব্যং ছন্নাবাসং কচি ক্কচিৎ। আমরা সারাদিন মৃগয়া করে যাব এ বনে সে বনে এবং দেখাব যেন মৃগয়ার ব্যসন আমাদের পেয়ে বসেছে, কিন্তু সেই ফাঁকে আমরা, এই অঞ্চলের সমস্ত রাস্তা চিনে নেব। তাতে আমাদের পালানোর সুবিধে হবে–তথা নো বিদিতা মার্গা ভবিষ্যন্তি পলায়ম্। আর আরও একটা কাজ করতে হবে ভীম। আজকেই এই বাড়ির মধ্যে একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলব আমরা। আমাদের সেই গর্তের মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে হবে ইঁদুরের বুদ্ধিতে। তাতে অন্তত আগুন লাগলেই আমরা মরব না। অতএব গর্তটা খুঁড়তে হবে আজই–ভৌমঞ্চ বিলমদৈব্যং করবাম সুসংবৃত। সেই গর্তের মধ্যে আমরা এমনভাবেই থাকব, যাতে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসেও পুরোচন বা অন্যান্য পুরবাসীদের মালুম না হয় যে, আমরা কোথায় লুকিয়ে আছি–বসতোত্র যথা চাম্মা ন বুধ্যেত পুরোচনঃ।

 যুধিষ্ঠির সমস্ত পরামর্শটাই ভীমের সঙ্গে করলেন এইজন্য যে বিপদ-কালে তিনি যেমন ক্ষিপ্র তেমনই বলশালী। নিশ্চয়ই যুধিষ্ঠিরের কথা মতো সেই দিনই জতুগৃহের একান্তে একটি গর্ত খুঁড়ে দিয়েছিলেন ভীম। কিন্তু যুধিষ্ঠির বেশ বুঝতে পারছিলেন যে শুধু একটি গর্ত খুঁড়েই শেষ রক্ষা হবে না। কারণ বাড়িতে আগুন লাগলে গর্তের মধ্যে খানিকক্ষণ থেকে আত্মরক্ষা করা যেতে পারে বটে, কিন্তু আগুন জোরদার হলে নিমেষে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে পালানোর জন্য আর সেই জন্যই সকলকে বাদ দিয়ে ভীমকেই সব কথা সবিস্তারে বলে রাখলেন যুধিষ্ঠির। কারণ কালে ভীমের ক্ষিপ্রতা, শক্তি, উৎসাহ এতটাই কাজে লাগতে পারে যে, তাকে সব কিছু জানিয়ে রাখাটা ছিল অত্যন্ত জরুরী।

 তবে বারণাবতে পাণ্ডবদের সম্ভাব্য বিপদের কথা নিয়ে যুধিষ্ঠিরের চেয়েও যিনি বেশি চিন্তা করেছিলেন, তিনি হলেন বিদুর। তিনি জানতেন যে, খুব তাড়াতাড়ি অঘটন কিছু ঘটাবে না পুরোচন। সে নিজের ওপর যুধিষ্ঠিরের বিশ্বাস উৎপাদন করার জন্য সময় কিছু নেবেই। সামান্য সময়ের এই সুযোগটুকু অদ্ভুত সুন্দরভাবে ব্যবহার করলেন বিদুর। তিনি তার একটি অতি বিশ্বস্ত মানুষকে ডেকে পাঠালেন, মাটি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ প্রস্তুত করতে যার জুড়ি নেই। বিদুর তাকে আগেভাগেই সমস্ত কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়ে বাস্তব ক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে।

 এরই মধ্যে আরও একটা অতি গোপন খবর বিদুরের কাছে পৌঁছে গেছে। বারণাবতে জতুগৃহ-নির্মাণের সময় থেকেই বিদুর চারদিকে গুপ্তচর লাগিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি তৈরি হয়ে যাবার পর পুরোচন যখন দুর্যোধনের কাছে নতুন নির্দেশ নিতে এসেছিল, সেই সময়েই বিদুরের গুপ্তচর খবর নিয়ে আসল যে, কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর রাত্রে যখন বারণাবতের ছোট্ট গ্রাম-শহরটি অন্ধকারে ডুবে থাকবে তখনই জতুগৃহে আগুন লাগাতে বলা হয়েছে পুরোচনকে। বিদুর আর দেরি করলেন না। সময় এগিয়ে আসছে। তিনি চতুর-কুশল খনককে পাঠিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে।

 চতুর খনক বারণাবতে এসে গোপনে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করে বলল–মহারাজ। আমাকে বিদুর-মশায়ের বন্ধু বলে জানবেন। আমি একজন খক, আমি খুব ভাল সুড়ঙ্গ তৈরি করতে পারি। আমি যথাসাধ্য আপনাদের উপকার করতে চাই, বিদুর সেইজন্যই আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন–প্রহিতো বিদুরেনাস্মি খনকঃ কুশলঃ হ্যহম্। অন্য জায়গা থেকে কোনও উটকো লোক অন্য কোনও অসুদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে কিনা, লোকটা পুরোচন-দুর্যোধনের কোনও চর কিনা–সে সব চিন্তা করার আগেই খনক বলল–আমি আপনাদের হিতৈষী ব্যক্তি কিনা সেটা বোঝানোর জন্য বিদুর আমাকে কিছু নির্দেশ দিয়েছেন। আপনাকে প্রথম কথা জানাই–কৃষ্ণচতুর্দশী রাত্রে পুরোচন আপনার বাড়ির দরজাটিতে আগুন দিয়ে দেবে–কৃষ্ণপক্ষে চতুর্দশাং…প্রদাস্যতি হুতাশন। দুর্যোধনের আদেশ সেইরকমই। আমাকে বিশ্বাস করার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করব শুধু। বিদুর আপনাকে ম্লেচ্ছ ভাষায় কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন এবং আপনিও তার উত্তর দিয়েছিলেন ম্লেচ্ছ ভাষাতেই। আপনি তাকে বলে এসেছিলেন যে, আপনি সব বুঝেছেন। আশা করি, আমি যে এইভাবে আপনাদের গূঢ় কথোপকথনের ঘটনা উল্লেখ করলাম, সেইটুকুই আমাকে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে প্রমাণ বলে মেনে নিতে পারেন–ত্বয়া চ তত্তথে্যুক্ত এত বিশ্বাস কারণম্।

বিদুরের সঙ্গে যেসব কথা হয়েছিল, তা এই খনকের মুখে শুনে যুধিষ্ঠির তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন–তোমাকে আমি বিদুরের বিশ্বস্ত পুরুষ বলেই বুঝলাম। এই মুহূর্তে তোমাকে বিশেষ প্রয়োজন আমাদের। আর কী আশ্চর্য, প্রয়োজনীয় এমন কোনও বিষয়ই নেই যা মহামতি বিদুরের অজানা আছেন বিদ্যতে কবেঃ কিঞ্চিদবিজ্ঞাতং প্রয়োজন। সেই বিদুর তোমাকে পাঠিয়েছেন, অতএব তুমি আমাদের কাছে বিদুরের মতোই আদরণীয়। অতএব বিদুর যেভাবে আমাদের রক্ষা করেন, তুমিও সেইভাবেই আমাদের রক্ষা করবে।

যুধিষ্ঠির খনককে নিজের কঠিন অবস্থা বুঝিয়ে বললেন। বললেন–এই অগ্নিগৃহের মধ্যে পুরোচন আমাদের পুড়িয়ে মারতে চাইছে। দুর্যোধন এই অপকর্মটি করাচ্ছে তাকে দিয়ে। দুর্যোধনের অর্থ আছে, সৈন্য-সামন্ত আছে, সম্পূর্ণ রাজযন্ত্র তার পিছনে। সে সব সময়ই চেষ্টা করছে যাতে আমাদের সর্বনাশ হয়–অস্মৃনপি স পাপাত্মা নিত্যমেব প্রবাধতে। এই বাড়ির প্রাচীরের কাছে একটা বিশাল অস্ত্রাগারও তৈরি করে রেখেছে দুর্যোধন-পুরোচনেরা। সব দিক থেকেই দুর্যোধন চায় আমরা ধ্বংস হই। মহামতি বিদুর আমাদের বিপদ আগেই বুঝেছিলেন এবং সেই বিপদই এখন হয়েছে। তুমি এই বাড়ির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে আমাদের বাঁচাও, কিন্তু সাবধান! পুরোচন যেন একটুও টের না পায়–পুরোচনস্যাবিদিতা অস্মাংস্কৃং প্রতিমোচয়।

 বিদুর-নিযুক্ত খনক যুধিষ্ঠিরের যুক্তি মেনে নিয়ে খনন কাজ আরম্ভ করল। ঘি-চর্বি গালা দিয়ে তৈরি সেই বাড়ির মধ্যে সে একটি গর্ত তৈরি করল এবং সেই গর্ত থেকেই একটি সুড়ঙ্গও তৈরি করে ফেলল। সুচতুর খনক গৃহের মধ্যে তৈরি সেই গর্তের ওপর একটি ঢাকনা লাগিয়ে দিল এবং তার ওপরে মাটি দিয়ে সমান করে দিল–কপাটযুক্ত অজ্ঞাতং সমং ভূম্যাশ্চ ভারত। পুরোচন সদা-সর্বদা সেই জতুগৃহের দ্বারে বসে পাণ্ডবদের পাহারা দিত, কিন্তু খনকের কুশলতায় সে এই খননকার্যের বিন্দুবিসর্গও জানতে পারল না। পাণ্ডবরা রাত্রিবেলায় সেই গর্তের ভিতরেই থাকতেন। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রও কিছু তাদের সঙ্গে থাকত। দিনের বেলায় চলত মৃগয়া, এ বন থেকে সে বনে। পথ চেনার কাজটাও তাতে ভাল হত।

নয় নয় করেও এর মধ্যে জতুগৃহে ছয় মাস কাটানো হয়ে গেছে পাণ্ডবদের পরিসংবৎসরোষিন। ছয় মাস শেষ হওয়ার কিছু আগে বিদুরের খনক যুধিষ্ঠিরের অভীষ্ট কাজটুকু করে দিয়ে গেল। এদিকে পুরোচন ভাবল যে, পাণ্ডবরা তাকে কোনও সন্দেহই করছেন না, সে মনে মনে খুব খুশি হল–বিশ্বস্তানিব সংলক্ষ্য হর্ষচক্রে পুরোচন। পাণ্ডবরা কিন্তু মনে মনে পুরোচনকে ভীষণ সন্দেহ করেও বাইরে দেখাতে লাগলেন যেন পুরোচনকে তারা খুব বিশ্বাস করেছেন–বিশ্বস্তব অবিশ্বস্তা বঞ্চয়ন্তঃ পুরোচন। পুরোচন খুশি হয়ে ভাবছিল–এবার তার সময় হয়ে এসেছে, এবার আগুন লাগাবে জতুগৃহে।

পুরোচনকে এমন খুশি খুশি দেখে যুধিষ্ঠির ভাইদের বললেন–এই পুরোচন ব্যাটা আমাদের খুব বিশ্বাস করেছে। আমরা যে ব্যাটাকে কীরকম ঠকিয়েছি তা তো বুঝতে পারছে না। কিন্তু যাক এসব কথা। এবার আমাদের পালাতে হবে–বঞ্চিততায়ং নৃশংসাত্মা কালং মন্যে পলায়নে। যুধিষ্ঠির এবার পলায়নের পরিকল্পনা দিয়ে বললেন–ব্যাটা পুরোচন যখন ওই অস্ত্রাগারে থাকবে, তখন ওই বাড়িতেই আগুন দিয়ে আমরা ছয়টি প্রাণী এখান থেকে পালাব। কিন্তু একটাই ব্যাপার। আমাদের বদলে আর ছয়টি প্রাণী এখানে রেখে যেতে হবে এবং তাদের পুড়িয়েও মারতে হবে–য প্রাণিনো নিধায়েহ দ্ৰবামো নভিলক্ষিতাঃ।

যুধিষ্ঠিরের এই পরিকল্পনার মধ্যে নৃশংসতা এবং অধর্মের ছাপ দেখেছেন কেউ কেউ। এমনকি এই কারণে সিদ্ধান্তবাগীশ উপরিউক্ত শ্লোকাংশের অর্থ করেছেন একেবারেই অন্যরকম। তার মতে–নিজেদের বদলে ছয়টি অন্য মানুষকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা যদি যুধিষ্ঠিরই করে থাকেন, তবে যুধিষ্ঠিরের ধর্মরাজ-আখ্যায় কলঙ্ক লাগে, ধর্মরাজের পক্ষে এমন অধর্ম করা সম্ভবই নয়–কেচি অপরাণেব ষটপ্রাণিননা নিধায়েতি ব্যাচক্ষতে, তন্ন। তথাত্বে ধর্মরাজস্য গুরুতরাধর্মোৎপত্তাপত্তেঃ। যুধিষ্ঠিরের কলঙ্ক হবে বলে মহাকবির লেখা শ্লোকের সহজ অর্থ এখানে পরিত্যাগ করা উচিত হবে বলে মনে হয় না। তার সবচেয়ে বড় কারণ, এর পরে যে ঘটনা ঘটবে, তাতে যুধিষ্ঠিরের পরিকল্পনা কাজে পরিণত হবে। আর দ্বিতীয় কথা মনে রাখতে হবে–যুধিষ্ঠির কিংবা পাণ্ডব–ভাইদের কাছে তখন আত্মরক্ষাই সবচেয়ে জরুরী ছিল এবং সেই আত্মরক্ষাও করতে হবে দুর্যোধনকে ফাঁকি দিয়ে। নইলে বিপদ তাদের পিছু নেবে।

মহাভারতেই বহু জায়গায় দেখা যাবে যে, আত্মরক্ষার জন্য অন্যায় এবং হীন কাজ করলেও তাতে দোষ লাগে না। এখানে আবার এর মধ্যে রাজনীতির প্রবেশ ঘটেছে। রাজনীতিতে সিংহাসনচ্যুত যুবরাজ নিজের এবং আপনজনের প্রাণ বাঁচানোর জন্য অন্য প্রাণী বধ করছেন–এটা খুব বেশি অসহনীয় নয়। আসলে যুধিষ্ঠিরকে সদা-সর্বদা ধর্মের মোড়কে বাঁধা একটি পুরিয়ার মতো যারা দেখতে পান, তাদের সঙ্গে আমরা একমত নই। মনে রাখতে হবে, তিনি রাজার ঘরের ছেলে, তার ওপরে যুবরাজ হয়েছিলেন। তা তেমন মানুষকে পদচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে বিনা দোষে।

 সহায়-সম্পদহীন অবস্থায় এখন আত্মরক্ষাই তার কাছে এক দায় হয়ে উঠেছে। নিজের ছাড়াও তাঁর ভাইদের তথা গর্ভধারিণী জননীর প্রাণ বাঁচানোর দায়ও তো যুধিষ্ঠিরেরই। এই অবস্থায় অন্য মানুষকে পুড়িয়ে মেরে নিজেরা বাঁচতে চাওয়ার মধ্যে যুধিষ্ঠিরের দোষ না খোঁজাই ভাল। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলে জীবনের সমস্ত ধর্ম ত্যাগ করে মা-ভাইদের তিনি দগ্ধ হতে দেখবেন–এটা যুধিষ্ঠির যেমন চাননি, তেমনি মহাকাব্যের কবিও তা যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে করাননি। এখানে অন্যায় হলে হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের ধর্মরাজ-আখ্যা না হয় কলঙ্কিতই হল। কিন্তু তাই বলে যুধিষ্ঠির যা ভেবেছিলেন, সেটাকে অগ্রাহ্য করতে পারছেন না মহাকাব্যের কবি। অন্যদিকে রাজনৈতিক কূটদৃষ্টিতে বিচার করলেও এখানে যুধিষ্ঠিরকে দোষ দেওয়া খুব কঠিন। বরঞ্চ বাঁচবার জন্য তিনি যে পরিকল্পনা নিয়েছেন, তা প্রশংসাজনক না হলেও এতে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায় এবং সেইজন্যই ধর্মরাজের এই অধর্ম ব্যবহার সমর্থনও করা যায়।

 যুধিষ্ঠিরের এই পরিকল্পনার সঙ্গে মিলে গেল আরও একটি ঘটনা, যদিও সেটা আগে থেকেই ছক-কষা বলে মনে হয়। কারণ, মহাভারতের কবি লিখেছেন–পাণ্ডবজননী কুন্তী দান করার ছলে বারণাবতের বামুনদের নেমন্তন্ন করে পাঠালেও নেমন্তন্ন করলেন রাত্রিবেলায় খাবার জন্য–অথ দানাপদেশেন কুন্তী ব্রাহ্মণভোজন। চক্রে নিশি মহারাজ…। ব্রাহ্মণরা সাধারণত রাত্রিতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন না। কারণ তারা এক সূর্যে একবার খান। কিন্তু এখানে দানের অপদেশ বা ছল আছে বলে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা গৌণ হয়ে দাঁড়াল। বোঝা যাচ্ছে–এই রাত্রির প্রহরগুলি পাণ্ডবদের কাছে অতি প্রয়োজনীয় এবং কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এই দানের ছল প্রযুক্ত হয়েছে। সিদ্ধান্তবাগীশ ছটি প্রাণী পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনায় যুধিষ্ঠিরের দোষ দেখতে পেলেন, কিন্তু রাত্রিতে ব্রাহ্মণভোজন এবং দানের ছলে কোনও দোষ পেলেন না। বস্তুত মহাভারতের কবি এবং যুধিষ্ঠিরের অভীষ্ট এখানে একেবারেই অন্য চালে চলছে। সেটাই এখানে ঠিক ঠিক কবির অনুকূলে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে যুধিষ্ঠিরের অনুকূলে।

.

১১৬.

 কথায় বলে মচ্ছোব-বাড়ি। ব্রাহ্মণ-ভোজন করাবেন হস্তিনাপুরের যুবরাজের জননী কুন্তী। অতএব তার উপক্রম-আয়োজন কিছু কম নয়। এই উপলক্ষে বামুনদের সঙ্গে রবাহূত, অনাহূত অনেক মানুষই মচ্ছোব-বাড়িতে খেতে আসবে–এ ঘটনা পাণ্ডব ভাইদের জানা ছিল। মহাভারতের কবি অবশ্য বলেছেন–কুন্তী দান করার ছলে ব্রাহ্মণদের নেমন্তন্ন করলেন সেখানে অনেক মেয়েরাও খাবারের আশায় এসেছিল–আজগুস্তত্র যোষিতঃ, তারা সময়মতো খাওয়া-দাওয়া সেরে চলেও গেল। কিন্তু এক নিষাদী, মানে ব্যাধের বউ তার পাঁচ-পাঁচটি ছেলেকে নিয়ে কালপ্রেরিত হয়েই যেন ভাত পাবার আশায় সেই নেমন্তন্ন বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল–অন্নার্থিনী সমভ্যাগাৎ সপুত্ৰা কালচোদিতাঃ।

কালপ্রেরিত। অর্থাৎ যেন এখানে পাণ্ডব-ভাইদের বা কুন্তীর কোনও দোষ নেই। মহাকাল যেন আগে থেকেই তাদের মৃত্যু লিখে রেখেছিলেন, এবং মরবার জন্যই যেন তারা স্বয়ং অন্নার্থী হয়ে উপস্থিত হল। আমরা খুব আক্ষরিক অর্থে এ কথা বিশ্বাস করি না। তার কারণ আগেই বলেছি। বিপদ এগিয়ে আসছে বুঝে যুধিষ্ঠির নিজেই ভীমকে বলেছিলেন যে,–আমাদের পরিবর্তে ছয়টি মানুষকে এখানে রেখে ঘরে আগুন দিয়ে আমরা পালাব ষটপ্রাণিনো নিধায়েহ দ্ৰবামানভিলক্ষিতাঃ। বরঞ্চ বলা যায়–ব্যাধ-গিন্নি তার পাঁচ ছেলেকে নিয়ে হঠাৎ করে খাবার লোভে এখানে চলে এল বলেই যুধিষ্ঠিরের পূর্ব পরিকল্পনা রূপায়ণের সুযোগ এসে গেল।

মহাভারতের কবি লিখেছেন–ব্যাধ-গিন্নি তার পাঁচ ছেলেকে নিয়ে খুবসে মদ খেল এবং মাতাল হয়ে গেল–সা পীত্বা মদিরাং মত্তা সপুত্রা মদবিহ্বলা। অতিরিক্ত মদ খেয়ে তাদের এমন অবস্থা হল যে, তারা কেউ একটুও প্রকৃতিস্থ রইল না! সংজ্ঞা হারিয়ে মরা মানুষের মতো এখানে ওখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল–সুধাপ বিগতজ্ঞানা মৃতকল্পা নরাধিপ। এখানেও আমাদের একটু বক্তব্য আছে। আগে দেখেছি–ব্রাহ্মণদের এই নেমন্তন্নে আরও অনেকেই এসেছিলেন এমনকি অনেক মেয়েরাও–আজগুস্তত্র যোষিতঃ। তো তারা তো সব নিজের ইচ্ছে মতো পান-ভোজন করে কুন্তীর কাছে অনুমতি নিয়েই চলে গেল–তা বিহৃত্য যথাকামং ভুক্তা পীত্ব চ ভারত। কিন্তু এই ব্যাধের ঘরের মানুষগুলি, যারা অন্নের চেয়ে মদ বেশি ভালবাসে, তারা কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় যত মদ্যপান করেছে, তার চেয়ে বেশি মদ্যপান করেছে পাণ্ডব ভাইদের। পরিকল্পনা অনুসারে। অন্তত আমাদের তাই অনুমান। মদ পেলে যারা অন্য কিছুই চায় না, তাদের যদি হত্যা করার পরিকল্পনা থাকে, তবে তাদের আরও মদ সরবরাহ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানেও তাই করা হয়েছে। অন্যেরা স্বেচ্ছায় পান–ভোজন করে ফিরে গেলেও এই ব্যাধ-গিন্নির পরিবার মদের লোভে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে থাকল জতুগৃহের এখানে সেখানে। পাণ্ডব ভাইরা তাদের বার করে দিলেন না, লোক-জন ডেকে এনে তাদের সংজ্ঞানহীন দেহ সরিয়ে দেবারও ব্যবস্থা করলেন না।

রাত গাঢ় হচ্ছে। পাণ্ডবরা যে জতুগৃহে আছেন সেটি এমনিতে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তারা সকলেই জেগে আছেন। পাঁচ পুত্র নিয়ে ব্যাধের বউ নিশ্চিন্তে মরার মতো ঘুমোচ্ছ। আশেপাশে যে কয়েকটি বাড়ি আছে, রাত গম্ভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সব বাড়ি থেকে এতটুকু শব্দও আর ভেসে আসছে না। সারা সন্ধে নেমন্তন্নের ঝামেলা গেছে, পুরোচনকেও সে ঝামেলা কিছু সামাল দিতে হয়েছে বলে সেও আজ কিছু ক্লান্ত। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে সেও আজ ঘুমিয়ে পড়ল।

ব্রাহ্মণরা এবং অন্যান্য অতিথিরা যখন নিমন্ত্রণ খেতে এসেছিলেন, তখন সন্ধ্যাকাল। আবহাওয়া ছিল গুমট। বাড়তি কাজকর্ম এবং গরমে ক্লান্ত পুরোচন নিজের ঘরের দরজা এঁটে শুয়ে পড়েছিল। পাণ্ডবদের বিশ্বাস উৎপাদন করার জন্য সে নিজের ঘরখানাও বানিয়েছিল জতুগৃহের মাল–মশলা দিয়েই। ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য অতিথিরা চলে যাবার পরেও যে ছয়টি প্রাণী নিঃশব্দে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় জতুগৃহের মধ্যে পড়ে রইল–এই ছোট্ট ঘটনাটি পুরোচনের নজর এড়িয়ে গেল।

রাত বেশি হতে নিস্তব্ধতা বাড়ল, গুমট কেটে গিয়ে হাওয়াও ছাড়ল বেশ ভাল মতো–অথ প্রবাতে তুমুলে নিশি সুপ্তে জনে তদা। পাণ্ডব ভাইদের পূর্ব–পরিকল্পনা রূপায়ণের এই উপযুক্ত সময়। হাওয়ার সঙ্গে আগুন–সোনায় সোহাগা। মধ্যম পাণ্ডব ভীম চারদিক দেখে নিয়ে একটি মশাল জ্বালিয়ে নিলেন। সেই জ্বলন্ত মশাল ধরিয়ে দিলেন পুরোচনের ঘরের দরজায়–তদুপাদীপয় ভীমঃ শেতে যত্র পুরোচনঃ। তারপর জতুগৃহের ভিতরে এসে জতুগৃহের দ্বারে আগুন লাগালেন ভীমসেন। তারপর একে একে বাড়ির চারদিকে। যাতে আগুন ভাল করে ধরে–সমস্ততো দদৌ পশ্চাদগ্নিং তত্র নিবেশনে। বাড়ির সর্বত্র আগুন লেগে গেল।

ভীমকে চারদিকে আগুন লাগাতে দেখেই, চার পাণ্ডব ভাই কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে সেই সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকলেন। ভীম মশাল হাতে নিয়েই সবার শেষে এসে ঢুকলেন সুড়ঙ্গের ভেতর। দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল জতুগৃহে। খড়-শন বাঁশের চটপটা শব্দের সঙ্গে লাক্ষা চর্বি আর ঘিয়ের উৎকট গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই বারণাবতের জনপদবাসীরা সকলে জেগে উঠল। যুবরাজ যুধিষ্ঠিরকে এতদিনে তারা বেশ ভালবেসে ফেলেছে। তাছাড়া হস্তিনাপুরের সিংহাসন নিয়ে জ্ঞাতি-বিরোধের কথাও তাদের অজানা ছিল না। জতুগৃহের ভয়ঙ্কর আগুন দেখে তারা সকলে হায়-হায় করতে লাগল। ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনের ষড়যন্ত্র কোন জঘন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে সেই অনুমান করে তারা গালাগালি করে বলতে লাগল এতদিনে বুঝতে পারছি, এই নতুন বাড়িটা পুরোচন এমন সাত তাড়াতাড়ি তৈরি করল কেন। দুর্যোধনের বুদ্ধিতে পুরোচন ব্যাটা পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্যই এই বাড়ি তৈরি করেছে। বাড়িটাতে কীভাবে আগুন লাগিয়েছে দেখ–গৃহমাত্ৰবিনাশায় কারিতং দাহিতঞ্চ তৎ।

পুরবাসীরা যারা জেগে উঠেছিল তারা পুরোচনের ওপর সমূহ আক্রোশ প্রকাশ করে বলল–এখানে কাজের কাজ একটাই হয়েছে, পুরোচন ব্যাটা নিজেও পুড়ে মরেছে। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মানুষটা মোটেও ভাল নন। মানুষ অতি বড় শত্রুকেও এমন করে পুড়িয়ে মারে না। আর তিনি কিনা এইভাবে নির্দোষ, নিরীহ পাণ্ডব ভাইদের আগুনে পুড়িয়ে মারলেন! নিজের ছেলেদের সঙ্গে পাণ্ডবদের মোটেই এক দৃষ্টিতে দেখেন না ধৃতরাষ্ট্র, যার জন্য এমন শত্রুর মতো পুড়িয়ে মারলেন নিজের ভাইপোদের–যঃ শুচী পাণ্ডুদায়াদা দাহয়ামাস শত্রুবৎ।

 হস্তিনাপুরের যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি শ্রদ্ধায় সেই রাত্রে বারণাবতের পুরবাসীরা অনেকেই আর ঘুমতে পারল না। সারা রাত তারা প্রায় দগ্ধ জতুগৃহের চারপাশ ঘিরে বসে থাকল–পরিবাৰ্য গৃহং তচ্চ তন্তু রাত্রৌ সমন্ততঃ। সেই সঙ্গে একটিও গালাগালি না দিয়ে শুধু সব কথা কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বিদুর-প্রেরিত সেই খনক। পুরবাসীদের বিলাপে এবং অপলাপে রাত্রি ভোর হয়ে গেল! জনপদবাসীদের মধ্যে যারা রাতে উঠে আসেনি, তারা সবাই এবার এসে জড় হল রাত-জাগা পুরবাসীদের সঙ্গে–অথ রাত্ৰাং ব্যতীতায়মশেষো নাগরো জনঃ

জতুগৃহের লাক্ষা, চর্বি নিমেষে ছাই করে দিয়েছে অত সুন্দর চকমিলানো বাড়িটাকে। চতুর্দিকে শুধু ছাই-ভস্ম আর ছাইচাপা আগুন। বারণাবতবাসীরা সকলে জল নিয়ে এসে ছেটাতে লাগল সেই অগ্নিভম্মের ওপর। বিদুরের পাঠানো সেই খনক, যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরবাসীদের গালাগালি আর বিলাপ শুনছিল, সে সুযোগ বুঝে কাজে লেগে গেল। সেও জল আনছে, জল ছিটোচ্ছে, অনেক কিছু করছে। আগুন নেবানোর পরে যে কাজটা, সেটা হল কুদ্দালকের সাহায্যে ছাই-ভস্ম সরিয়ে দেখা–কারা ঠিক মরেছে। বিদুর-প্রেরিত খনকটি জতুগৃহের মাঝবরাবর কাজ করছিল।

বারণাবতবাসীরা প্রথমে পুরোচনের ঘরের দিকে নজর করে দেখল। ভস্ম আর দগ্ধ–শন-বংশের জঞ্জাল কোদাল দিয়ে সরাতে সরাতে তারা পুরোচনের দগ্ধ দেহাবশেষ আবিষ্কার করে ভীষণ খুশি হল। অন্তত এই বদমাশ মরেছে–তগৃহং দগ্ধম্ অমাত্যঞ্চ পুরোচন।

 বিদুরের সেই খনকটি কিন্তু অন্য কোনও দিকে তাকিয়ে দেখছে না। কোথায় সে খনন করে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিল, এটা তার বেশ খেয়াল আছে। কুদ্দাল–চালকদের দলে মিশে গিয়ে ছাই–ভস্ম সরিয়ে দেহাবশেষ আবিষ্কার করার চেয়েও তার কাছে অনেক বেশি যেটা প্রয়োজনীয়, তা হল সেই সুড়ঙ্গের মুখটা বুজিয়ে দেওয়া, যাতে বারণাবতবাসীদের কোপটা ধৃতরাষ্ট্র–দুর্যোধনের ওপরই সম্পূর্ণ পড়ে। জতুগৃহের দগ্ধাবশেষ পরিষ্কার করার ছলে সেই খনক ছাই–মাটি তুলে এনে সেই সুড়ঙ্গের দ্বারটুকু বুজিয়ে দিল। কেউ বুঝতেও পারল না–পাংশুভিঃ পিহিতং তচ্চ পুরুষেস্তৈ–ন লক্ষিতম্।

অন্যেরা ছাই-জঞ্জাল সরাতে সরাতে জতুগৃহের এখানে ওখানে পড়ে থাকা সেই ব্যাধ–পত্নী এবং তার পাঁচ ছেলের বিকৃত দেহাবশেষ দেখতে পেল। পাণ্ডবদের মৃত্যু সম্বন্ধে তাদের আর কোনও সন্দেহই থাকল না। আবারও পুরবাসীদের গালাগালির বাণ ছুটল। কেউ বলল–আরে ধৃতরাষ্ট্র-মশাই সব জানেন, দুর্যোধন তাকে না জানিয়ে এই এত বড় অপকম্মটি করেননি। সব জানেন ধৃতরাষ্ট্র–বিদিতে ধৃতরাষ্ট্রস্য ধার্তরাষ্ট্রোন সংশয়ঃ। দগ্ধবান্ পাণ্ডুদায়াদা। আরেকজন বলল–নিশ্চয়ই জানেন ধৃতরাষ্ট্র এবং জেনেও তিনি দুর্যোধনকে নিষেধ করেননি একবারও–ন হ্যেনং প্রতিষিদ্ধবান্। অন্য আরেকজন বলল–আর এই ভীষ্ম-দ্রোণেরাই বা কীরকম মানুষ? কেমন মানুষ ওই কৃপ আর বিদুরেরা। তাঁদেরও কি ধর্ম বলে কিছু নেই–ন ধর্মমনুবর্ততে। শেষে একজন মাতব্বর গোছের পুরবাসী সিদ্ধান্ত দিল–ভাই সব! আমরা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দূত পাঠাবতে বয়ং ধৃতরাষ্ট্রস্য প্ৰেষয়ামমা দুরাত্মনঃ। দূত পাঠিয়ে তাকে জানাব যে,–মহারাজ! আপনার মনের সেই উৎকট ইচ্ছেটা এতদিনে পূর্ণ হয়েছে। আপনি পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারতে পেরেছেন–সংবৃত্তস্তে পরঃ কামঃ পাণ্ডবান্ দগ্ধবাসি।

ঘটনাগুলো ঠিক এইভাবে ঘটুক, মহামতি বিদুর তাই চেয়েছিলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের চেয়ে অনেক বড় রাজনীতিবিদ। সমস্ত বিপন্নতা তিনি রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করেন। রাগ হলে তিনি ঢাল-তরোয়াল হাতে নেন, ক্রোধে ভ্রুকুটিও করেন না। কিন্তু এই যে জনরোষ তৈরি হল, বিদুর এইটাকে পাণ্ডবদের অনুকূলে এবং ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিকূলে ব্যবহার করবেন। ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধন-পুরোচনের যৌথ প্রয়াসে যে অঘটন সেদিন ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল, তাতে বারণাবতবাসীরা চিরকালের জন্য পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের অনুগত হয়ে যায়। হস্তিনাপুরের দূর প্রান্তে অবস্থিত এই গ্রাম-শহরের সমস্ত মানুষ ধৃতরাষ্ট্রের ওপর চিরকালের জন্য ক্ষিপ্ত হল। মনে রাখবেন–ভবিষ্যতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক আগে যুধিষ্ঠির পাঁচখানি গ্রাম দুর্যোধনের কাছে চাইবেন এবং সেই পঞ্চ গ্রামের মধ্যে বারণাবত একটি। যুধিষ্ঠির নিশ্চিতভাবে এই গ্রামখানি আপন শাসনের জন্য এই জন্যই চাইতে পারবেন যেহেতু জতুগৃহের দুর্ঘটনায় বারণাবতবাসীরা চিরকালের মতো যুধিষ্ঠিরের অনুগত হয়ে গেছে এবং চিরকালের মতো তারা ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনেরও বিরোধী হয়ে গেছে। বিদুরের রাজনৈতিক জয়টা এইখানেই।

 যাই হোক, ওদিকে জননী কুন্তীকে নিয়ে চার ভাই পাণ্ডব সুড়ঙ্গ-পথে চলতে লাগলেন। তাঁদের সঙ্গে পরে এসে যোগ দিলেন ভীম। তাঁর হাতে সেই আগুন-দেওয়া মশালটি তখনও ধরা আছে। গভীর রাত্রিতে অন্ধকার সুড়ঙ্গের পথ দেখিয়ে ভীমই নিয়ে চললেন সবাইকে। সুড়ঙ্গের পথ বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিদুরের খনক এমনভাবেই সুড়ঙ্গটি কেটেছে যাতে জতুগৃহ থেকে তা খুব দূরেও না হয়, আবার সে দিকটায় লোকালয়ও না থাকে। জতুগৃহের উলটো দিকে সুড়ঙ্গের যে মুখটি খনক তৈরি করেছিল, সেটি একটি বনের ভিতরে পড়ে। মানুষ-জন সেখানে যায় না, তাই খনন করার সময় কেউ তাকে দেখতেও পায়নি। পাণ্ডবরাও নিশ্চয়ই তাই চাইবেন, যাতে পালানোর সময় কেউ তাদের দেখতে না পায়।

পাণ্ডবরা সুড়ঙ্গের মুখ থেকে বেরিয়ে বনের মধ্যে এসে পৌঁছলেন, তখন রাত্রির তৃতীয় প্রহর শেষ প্রায়। চারদিক অন্ধকার, রাত্রির নক্ষত্র দেখে দিক নির্ণয় করতে হয়। সারা রাত ঘুম নেই, তার মধ্যে শতরকম ভয়–সকলের অলক্ষিতে জতুগৃহে আগুন দিয়ে, পুরোচনের ঘরে আগুন দিয়ে, নিমেষের মধ্যে পালাতে হবে। কম টেনশনের ব্যাপার নয়। অনিদ্রা, ভয় এবং পরিশ্রমে পাণ্ডবদের শরীর তখন ভেঙে আসছে। জননী কুন্তী আর পারছেন না। অথচ এই সুড়ঙ্গ-পথ থেকে বেরিয়ে বনের মধ্যে উত্তাল হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়বার উপায় নেই। বারণাবতের সীমান্ত অতিক্রম করে তাদের সবাইকে পালিয়ে যেতে হবে অন্যত্র। রাত ভোর হলেই দুর্যোধনের চরেরা চারদিকে খুঁজে দেখবে পাণ্ডবদের। যদিও ছয়টি প্রাণী জতুগৃহের মধ্যে দগ্ধ হয়ে পড়ে থাকার ফলে দুর্যোধনের চরেরা যথেষ্ট বিপ্রলব্ধ হবে, তবু রাজনীতিতে শত্রুপক্ষকে কোনও বিশ্বাস নেই। বিশেষত দুর্যোধনের মতো শক্ত, যিনি অনবরত পাণ্ডবদের ছিদ্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

অতএব এই অন্ধকার বনচ্ছায়ে বিশ্রাম নেবার উপায় নেই পাণ্ডবদের। রাত-জাগা নক্ষত্রলোক পাণ্ডবদের পথ নির্দেশ করল। অবশ্য এতদিন ধরে মৃগয়ার ছলে ঘুরে বেড়াবার সময়েই তারা যথেষ্ট পথ চিনে রেখেছিলেন। এখন এই উদার নীল আকাশের নক্ষত্র-স্থিতি দেখে পাণ্ডবরা বুঝতে পারলেন তাদের কোন দিকে যেতে হবে। কারণ অদূরেই গঙ্গা। গঙ্গার ওপারেই পাঞ্চাল দেশের সীমানা। আগে থেকেই তারা ঠিক করে রেখেছিলেন যে, যেভাবেই হোক রাত ভোর হবার আগেই গঙ্গা পার হয়ে যেতে হবে।

গঙ্গা পার হওয়ার পরিকল্পনাটা ঠিকই আছে। কিন্তু জননী কুন্তীর পা তো আর চলছে না। যুধিষ্ঠির-অর্জুন, নকুল-সহদেবের অবস্থাও তথৈবচ। একমাত্র ভীম, অসাধারণ তাঁর বল, অফুরন্ত তার প্রাণশক্তি। জননী কুন্তীকে তিনি পাঁজাকোলা করে কাঁধে তুলে নিলেন, নকুল-সহদেব দুটি ছোট-ভাইকে তুলে নিলেন কোলে–স্কন্ধমারোপ্য জননীং যমাবঙ্কেন বীর্যবান্। মহাভারতের কবি যেমন লিখেছেন–ভীম একই সময়ে মাকে কাঁধে, নকুল-সহদেবকে কোলে আর যুধিষ্ঠির-অর্জুনকে হাতে তুলে নিয়ে মহাবেগে গমন করতে লাগলেন, তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং বাস্তব বুদ্ধিতে যা বুঝি, তাতে মাকে একবার কাঁধে তুলে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে রেখে আসা এবং তারপরে নকুল-সহদেবকে কোলে নিয়ে আবার রেখে আসা এবং পুনরায় অর্জুন-যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে অন্যত্র রেখে আসাটাই স্বাভাবিক। মহাভারতের কবিও হয়তো এই কথাই লিখতেন। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর উদ্দেশ্য আছে ভীমের অতিমানবিক শক্তি পাঠককে বুঝিয়ে দেওয়া। অতএব ক্রমান্বয়ে যে ঘটনা ঘটেছিল, সেই ঘটনাকেই একই সময়ে কাঁধে, কোলে এবং বাহুর ব্যবহারে দেখিয়ে ভীমের অতিমানুষিক শক্তি-খ্যাপন করলেন কবি। মহাকাব্যের কবিরা এইভাবেই বিষয় বর্ণনা করেন।

 যা হোক, সকলেই ভীমের শরীরে ভর করে চলছিলেন পাণ্ডব-ভাইয়েরা। জননী কুন্তীও। ভীম বন–বাদাড় ভেঙে সহজে যাবার মতো জায়গা করে–তরসা পাদপান্ ভঞ্জ মহীং পদ্ভ্যাং বিদারয়–মা-ভাইদের পৌঁছে দিলেন গঙ্গার তীরে। রাতের আঁধারে স্বচ্ছতোয়া গঙ্গার কুলু–কুলু বয়ে যাবার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। নদীর ধারে ইতস্তত গজিয়ে ওঠা বৃক্ষরাজির তলায় বসে পড়লেন ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব। এতক্ষণ ভীমের গায়ে ভর দিয়ে পথ চলার ফলে সামান্য শক্তি সঞ্চয় হয়েছে সকলেরই। কাজেই যুধিষ্ঠির এবং কুন্তী আস্তে আস্তে এসে জাহ্নবীর জলস্পর্শ করলেন। ভোর হবার আগেই এই নদী পাড়ি দিয়ে চলে যেতে হবে। তবে মুক্তি। মুক্তিদায়িনী গঙ্গা বাস্তবতই জীবনের মুক্তির মতো বয়ে চলেছেন। তাঁকে পাড়ি দিতে হবে।

জননী কুন্তী যথেষ্টই অভিজ্ঞা। বাপের বাড়িতে যমুনার তীর-ঘেঁষা অঞ্চলে তার শৈশব কেটেছে। পালক পিতা কুন্তিভোজের রাজবাড়ির পাশ দিয়েই বয়ে চলত অশ্ব-নদী। অতএব জল আর জলের গভীরতা তিনি বেশ ভালই বোঝেন। তাঁর সঙ্গে এসেছেন যুধিষ্ঠির। রাজপুত্রদের সর্বব্যাপী শিক্ষায় নদ-নদী সম্বন্ধে তারও কিছু অভিজ্ঞতা আছে। যুধিষ্ঠিরকে মায়ের সঙ্গে জলে নামতে দেখে অন্যান্য পাণ্ডব-ভাইরাও এসে যোগ দিলেন জলের মধ্যে। তারা ডুবে ডুবে দেখার চেষ্টা করছিলেন–জলের গভীরতা কোথায় কেমন–জনন্যা সহ কৌরব্য মাপয়ানা নদী-জলম্।

 এদিকে একটি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি গঙ্গার তীরে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে যেন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। গঙ্গার তীরস্থিত বনস্থলীর মর্মর-পত্র-মোক্ষণের মধ্যে সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির পদশব্দ ভালই শোনা যাচ্ছিল বটে, কিন্তু পাণ্ডব ভাইরা জননী কুন্তীর সঙ্গে যেহেতু জলের মধ্যে একবার ডুবে একবার উঠে জলের গভীরতা ঠাহর করার চেষ্টা করছিলেন, তাতে প্রত্যেকের মুখ-চোখ-কান জলস্তব্ধ হওয়ায় অন্য কোনও শব্দ তাদের কানে ঢুকছিল না। ডুব দিয়ে জলের ওপরে উঠলেই গাত্রস্থিত জলপতন-শব্দ অন্য শব্দের প্রবেশ রুদ্ধ করে দিয়েছিল।

তীরস্থিত অজ্ঞাত ব্যক্তি এতক্ষণ ধরে পাণ্ডব-ভাইদের জলতুম্বির কেরামতি দেখে বুঝল–রাত্রির চতুর্থ প্রহরারম্ভে বিনা প্রয়োজনে কেউ এইভাবে জলে ডুবে ডুবে জলের গভীরতা পরিমাপ করে না। বুঝল–এঁরা জীবন বাঁচাতে গঙ্গার পরপারে যেতে চান এবং আরও বুঝল–এঁরাই পাণ্ডব-ভাই এবং জননী কুন্তী তাদের সঙ্গে আছেন।

গঙ্গার তীর থেকে সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি সু-উচ্চ কণ্ঠে বলল–আগুন ছোট শুকনো বনে প্রথমে লেগে তারপর বড় বনে গিয়ে লাগে, কিন্তু সেইখানে গর্ত করে যে ইঁদুরটি থাকে, আগুন তাকে কিছুই করতে পারে না। ইঁদুরের মতো আত্মরক্ষা করতে পারলে, সেই মানুষই বাঁচতে পারে।

 যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্য পাণ্ডব-ভাইরা ভূত দেখার মতো চমকে তাকালেন তীরভূমিস্থিত অজ্ঞাত পরিচয় মানুষটির দিকে। নিমেষের মধ্যে অন্তত সকলেই বুঝে ফেললেন যে, লোকটি পাণ্ডবদের হিতৈষী। কারণ এই যে কথাটি বলা হল, এটা বিদুরের কথা। তিনি ম্লেচ্ছভাষায় যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলে জতুগৃহের আগুনের সঙ্কেত দিয়েছিলেন। ঠিক এই কথাটির সঙ্কেত জানিয়ে বিদুরের পাঠানো সেই খনক পাণ্ডবদের কার্যোদ্ধার করেছেন। এখন আবারও সেই সঙ্কেত-শব্দ উচ্চারিত হওয়ায় পাণ্ডব-ভাইরা জননী কুন্তীকে নিয়ে জল থেকে উঠে এলেন। গায়ের ভিজে কাপড় গায়েই শুকোতে লাগল।

অপরিচিত ব্যক্তি জানাল–আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন মহামতি বিদুর। তারই দেওয়া সঙ্কেত আমি আপনাদের সামনে উচ্চারণ করেছি। অতএব আমাকে বিশ্বস্ত বলে জানবেন–তেন মাং প্রেষিতং বিদ্ধি বিশ্বস্তং সংজ্ঞমানয়া। পাণ্ডবদের অবিশ্বাস করার কোনও কারণই রইল না। অপরিচিত ততক্ষণে কথঞ্চিৎ দূরে বাঁধা একটি নৌকার দিকে পাণ্ডবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সে বলল–এই নৌকাখানির গতিবেগ অন্য সাধারণ নৌকার চেয়ে অনেক বেশি। ছেড়ে দিলে হাওয়ার মতো চলবে–পার্থান্ সন্দৰ্শয়ামাস মনোমারুত- গামিনীম্। আরও একটা কথানদীর মধ্যে জোরে হাওয়া উঠলেও কোনও ভয় নেই এই নৌকায়। এই নৌকার মধ্যে এক আজব কল লাগানো আছে। পাল তুলে দিলে সবরকম বেগ সহ্য করে নৌকো উড়ে চলবে মনের গতিতে–সর্বাতসহাং নাবং যন্ত্রযুক্তাং পতাকিনীম্।

যন্ত্রযুক্তাম–এই শব্দটি শুনে পণ্ডিত-সজ্জনেরা অনেকে মনে করেছেন যে, মহাভারতের কালে প্রায়াধুনিক একরকমের কলের নৌকা চালু ছিল। মহাভারতের কালের অন্যান্য যান্ত্রিক উন্নতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এই কলের নৌকাটির নির্মিতি প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হয়। তবে বিদুর এই নৌকাটিকে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মাণ করিয়েছিলেন; কাজেই পাণ্ডবদের বিপদ বুঝে নৌকার গতি বাড়ানোর জন্য জল-কাটার কোনও বিশেষ পদ্ধতি এই নৌকায় কাজে লাগানো হয়েছিল, কিন্তু এই যুগে যন্ত্র-চালিত নৌকার আধুনিক নির্মিতি সম্ভব ছিল না বলেই আমাদের ধারণা হয়।

বিদুর বিশেষ কারিগর দিয়ে এই নৌকা নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্ররা যাতে এই নির্মাণ-বৃত্তান্ত না জানতে পারেন, তার জন্য গঙ্গার তীরভূমিতেই এই নৌকা বানিয়ে ধীবর-চালক সহ একটি বিশ্বস্ত লোক দিয়ে বিদুর এই নৌকা আগেই পাঠিয়ে দেন সেই বনের মধ্যে যেখানে পাণ্ডবরা সুড়ঙ্গ-পথ থেকে বেরিয়ে গঙ্গা পার হবার চেষ্টা করবেন–শিবে ভাগীরথী তীরে নরৈর্বিশ্রম্ভিভিঃ কৃতাম্।

পাণ্ডবরা আর কোনও দ্বিধা করলেন না। যাঁরা এই রাত্রিকালে সাঁতরে নদী পার হবার জন্য জলে ডুব দিয়ে দেখছিলেন, তারা হাতের সামনে এমন একখানি অসাধারণ সুন্দর পাল-তোলা নৌকা দেখে আর দ্বিধা করলেন না। অপরিচিত ব্যক্তির সমস্ত কথা বিশ্বাস করে তারা নৌকায় উঠলেন। কল্যাণকারী বিদুরকে শতবার মনে মনে প্রণাম জানিয়ে পাণ্ডবরা জননী কুন্তীকে নিয়ে পতাকিনী নৌকায় আরোহণ করলেন। জাহ্নবীর অনুকূল স্রোত, ধীবর-চালকদের হাতের জোর–দশানাং ভুজবেগেন নদ্যাঃ স্রোতোবেগেন চ–আর অনুকূল বায়ুতে পাণ্ডবরা গঙ্গা পার হলেন খুব তাড়াতাড়ি। গঙ্গা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অজানা এক ভাগ্য নদীও যেন পার হয়ে এলেন পাণ্ডবরা।

তখনও রাতের আঁধার কাটেনি। সূর্য ওঠার দেরি আছে। পাণ্ডবরা এখন বারণাবত থেকে অনেক দূরে। পাণ্ডবরা যখন নৌকা থেকে নামলেন পরপারে, তখন বিদুরের পাঠানো সেই বিশ্বস্ত লোকটি হাত জোড় করে পাণ্ডবদের বলল–মহামতি বিদুর আপনাদের মস্তকাঘ্রাণ করে স্নেহালিঙ্গন জানিয়ে বলেছেন–তোমাদের যাবার পথ সুস্থ এবং নির্বিঘ্ন হোক–অরিষ্টং গচ্ছতাব্যগ্রা পন্থানমিতি চাব্রবীৎ। লোকটি নিজেও পাণ্ডবদের জয়ঘোষ উচ্চারণ করে আশীর্বাদ জানিয়ে সেই নৌকা নিয়ে রওনা দিল বিদুরের নির্দিষ্ট পথে।

রাতের আঁধারে নক্ষত্রের দিক্–সঙ্কেতে পাণ্ডব-ভাইরা জননী কুন্তীর সঙ্গে পথ চলতে লাগলেন। নক্ষত্রের ইশারায় বোঝা গেল তারাও দক্ষিণ দিকে চলেছেন–ততো নাবং পরিত্যজ্য প্রযযু-দক্ষিণাং দিশ। দক্ষিণ কথাটির সাধারণ অর্থ অনুকূল। এতদিন শত্ৰুপুরীতে জতুগৃহের মধ্যে ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে এক রাত্রির মধ্যে পাণ্ডবরা যেখানে এসে পড়লেন, সেটা গভীর অরণ্যানী হলেও এই জায়গাটি অন্তত তাদের অনুকূল চলার পথ বটে। অতএব সব দিক থেকেই পাণ্ডবদের যাত্রা–দিক্‌ সুদক্ষিণ–প্রযযু-দক্ষিণাং দিশম্।

.

১১৭.

 পাণ্ডবরা জতুগৃহের আগুনে দগ্ধ হয়ে গেছেন–এই খবর দাবানলের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বারণাবতের জনপদবাসীরা এই ঘটনায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েই ছিল। পৌর-জানপদের পদস্থ ব্যক্তিরা আগে যেমনটি বলেছিলেন, সেইরকম কড়াভাবে না হলেও হস্তিনাপুরে খবর পাঠিয়ে জানালেন–পাণ্ডবরা তাদের জননী কুন্তীর সঙ্গে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। মারা গেছেন অমাত্য পুরোচনও–ততস্তে জ্ঞাপয়ামাসু-ধৃতরাষ্ট্রস্য নাগরাঃ।

ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসিত করে রাখতে চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু এতটা তিনি আশঙ্কা করেননি। তার স্নেহ-লালিত দুর্যোধন যে এইভাবে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করবেন, এতটা তিনি আশঙ্কা করেননি। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটেছে। দুর্যোধন অমাত্য পুরোচনকে কাজে লাগিয়ে জতুগৃহ বানানোর ব্যবস্থা করেছেন এবং তাতেই এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে–এ কথা কারও অজানা রইল না। উচ্চস্তরের কূটনীতিকরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য যাকে কাজে লাগান, তাকেও তারা নির্দ্বিধায় মেরে ফেলেন। কারণ তাতে সাক্ষী-প্রমাণ লুপ্ত হয়ে যায় এবং কূটনীতিক নিজে তার অভীষ্ট রহস্য ভেদ করতে দেন না। অমাত্য পুরোচনের মৃত্যু রহস্যজনক হলেও এইভাবেই জনগণের হৃদয়ে ব্যাখ্যাত হয়েছে। বলে মনে করি।

ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের মৃত্যু চাননি। তিনি চাননি যে, তাঁর ছোট ভাই পাণ্ডুর বিধবা পত্নী কুন্তী এইভাবে অপমৃত্যু বরণ করুন। অতএব পাণ্ডবদের মৃত্যুতে ধৃতরাষ্ট্রের যথেষ্ট কষ্ট হল এবং তিনি বহুতর বিলাপ করলেন। তিনি এমনও বললেন–আজকেই আসলে আমার ভাই পাণ্ডু মারা গেলেন। তাঁর বংশগৌরব পাণ্ডবরা এবং তার বিধবা পত্নী কুন্তী মারা যাওয়ায় আজকেই বাস্তবে পাণ্ডু মারা গেলেন–অদ্য পাণ্ডুতো রাজা মম ভ্রাতা মহাযশাঃ।

পাণ্ডবদের এই কষ্টকর মৃত্যু-সংবাদ শ্রবণ করে ধৃতরাষ্ট্র বিশ্বস্ত পুরুষদের আদেশ দিলেন বারণাবতে যাবার জন্য–গচ্ছন্তু পুরুষাঃ শীঘ্র নগরং বারণাবত। কুলোচিত নিয়ম অনুসারে পাণ্ডবদের অন্তিম সংস্কার সম্পন্ন করার জন্যও আদেশ দিলেন ধৃতরাষ্ট্র। কুন্তী এবং পাণ্ডবদের শ্রাদ্ধ-শান্তির জন্য তথা কৌরবকুলের মঙ্গলের জন্যও যেসব মাঙ্গলিক কাজ তার নিজের তথা কৌরবদের সম্পন্ন করার কথা, তার জন্য বিশেষ অর্থও মঞ্জুর করা হল রাজকোষ থেকে–পাণ্ডবানাঞ্চ কুত্যাশ্চ তৎ সর্বং ক্রিয়তাং ধনৈঃ।

রাজাদেশের পর ধৃতরাষ্ট্র তার পুত্রদের নিয়ে পাণ্ডবদের উদ্দেশে তর্পণ করার জন্য গঙ্গার দিকে যাত্রা করলেন। তাদের বেশ-বাস অশৌচ পালনরত মানুষের মতো। মাথায় উষ্ণীষ নেই, গায়ে রাজোচিত অলঙ্কার নেই, পরনে একটি মাত্র বস্ত্র–একবস্ত্রা নিরানন্দা নিরাভরণ–বেষ্টনাঃ। ধৃতরাষ্ট্র এবং কৌরবদের সঙ্গে গঙ্গায় উপস্থিত হলেন আরও দুজন ভীষ্ম এবং বিদুর। গঙ্গায় জলতর্পণের পর কৌরবকুলের অনেকের মুখেই রোদন-বিকার শোনা গেল। হস্তিনাপুরের পুরবাসীরাও যথেষ্ট রোদন করতে লাগল। কেউ যুধিষ্ঠিরের নাম ধরে, কেউ ভীম-অর্জুনের, কেউ বা নকুল-সহদেবের নাম করেও কাঁদতে থাকল। কুন্তীর উদ্দেশেও তাঁদের অনেকের শোকাবেগ উচ্ছলিত হল। সকলে কাঁদলেন ধৃতরাষ্ট্র কাঁদলেন, ভীষ্ম কাদলেন, সকলেই কাঁদলেন, কিন্তু সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একজনই শুধু সাভিনয়ে অল্প-অল্প কাঁদলেন। তিনি বিদুর। কারণ তিনি সর্বশেষ খবরটি জানেন যে, পাণ্ডবরা জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে গঙ্গার পরপারে চলে গেছেন–বিদুরস্তু-অল্পশশ্চক্রে শোকং বেদ পরং হি সঃ।

 ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে যে সমস্ত বিশ্বস্ত পুরুষ বারণাবতে যাবার জন্য প্রস্তুত হল, তাদের পৌঁছনোর আগেই একটি দ্রুতগামী রথ এসে বারণাবতে এসে জতুগৃহের সামনে থামল। রথে দুজন আরোহী পুরুষ। বারণাবতের একে-তাকে জিজ্ঞাসা করে এই দুই পুরুষ জতুগৃহের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছেন। বারণাবতের জনপদবাসীরা এই দুই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে তেমন চেনে না। কিন্তু এই দুই পুরুষের মধ্যে একজনের ব্যবহার ব্যক্তিত্ব এমনই অসাধারণ যে, কেউ তাঁকে অবহেলা করতে পারছে না। তিনি যা বলছেন, তাই তারা করছে। তিনি যা জিজ্ঞাসা করছেন, বারণাবতবাসীরা তাদের বিশ্বাসমতো সব কথার জবাব দিচ্ছে।

পৌর-জনপদবাসীরা অগ্নিদগ্ধ যে মৃতদেহগুলিকে পাণ্ডব এবং কুন্তী বলে সন্দেহ করছিল, সেই মৃতদেহগুলিকে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করলেন। তার যে খুব বিশ্বাস হল, তা নয়। তবে পাণ্ডবদের মৃত্যু সম্বন্ধে অবিশ্বাসটাও তিনি প্রকাশ করলেন না। সব দেখাশোনা হয়ে গেলে এই মহাপ্রাজ্ঞ ব্যক্তি সহারোহীকে বললেন–পাণ্ডবদের অস্থি-সঞ্চয় করতে। তিনি নিজেই এ কাজ করতেন, কিন্তু তার হাতে এখন একটুও সময় নেই। তাকে এই মুহূর্তে চলে যেতে হবে ভারতবর্ষের পশ্চিমে এক প্রত্যন্ত প্রদেশে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে তার ব্যস্ততা এতটাই যে, তাঁর এখন এক মুহূর্তও অপেক্ষা করার সময় নেই। অথচ পাণ্ডবদের মৃত্যু-ঘটনা কতটা সত্যি আর কতটা রটনা–এটা তাঁর নিজে এসে দেখার প্রয়োজন ছিল। বস্তুত পাণ্ডব ভাইদের তাঁর বড় দরকারও।

কিন্তু মৃতদেহগুলি পরীক্ষা করার পর তিনি মনে মনে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেও লোক-দেখানোর জন্যই তিনি সহারোহী পুরুষকে পাণ্ডবদের অস্থি-সঞ্চয় করতে বললেন এবং নিজে ঘটনাস্থল থেকে চলে গেলেন।

বারণাবতে অকস্মাৎ আগত এই দুই পুরুষের সম্বন্ধে আমরা এতক্ষণ কিছু পরিচয় জানাইনি এই কারণে যে, মহাভারতের কবি পাণ্ডবদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এই ঘটনাটি জানাবার অবসর পাননি। আমরা মহাভারত পাঠকদের জানিয়ে দিতে চাই যে, মহাভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বারণাবতে এই দুই পুরুষের অকস্মাৎ আগমন অত্যন্ত জরুরী। আপনারা ভাবতেও পারবেন না যে, এই দুই পুরুষের একজন হলেন দ্বারকাবাসী কৃষ্ণ এবং অন্যজন তারই বংশের আরেক পুরুষ সাত্যকি। যাঁরা মনে করেন–মহাভারতের সভাপর্বে দ্রুপদের রাজবাড়ির স্বয়ংবর সভায় কৃষ্ণা-দ্রৌপদীর বিয়েতে যোগ দিতে আসার সময়েই প্রথম যদুসিংহ কৃষ্ণ মহাভারতের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেন, তাদের জানাই কৃষ্ণ পাণ্ডবদের খোঁজে প্রথম এসেছিলেন বারণাবতে এবং এই কাহিনী আমার স্বকপোলকল্পিত নয়। এ কাহিনী আছে খিল হরিবংশে।

কৃষ্ণ যখন বারণাবতে এসেছিলেন তখন সমগ্র উত্তর-পশ্চিমভারতে তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। কিন্তু এখানে তিনি না এসে পারেননি, কারণ, রাজনৈতিক দিক দিয়েই পাণ্ডব-ভাইদের তার বিশেষ প্রয়োজন। অন্যদিকে তিনি যেখানে থাকেন, সেখানে তার আপন স্বজন জ্ঞাতি-গুষ্টির মধ্যেই এক ভীষণ গণ্ডগোল বেধে গেছে। সে সব কথা আমরা সময়মতো বলব। আপাতত এইটুকু না বলে পারছি না যে, আমাদের এখন হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক পটভূমি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নজর দিতে হবে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে, বৃন্দাবনে এবং মথুরায়।

বৃন্দাবনে কৃষ্ণ যখন কংস-প্রেরিত তথাকথিত অসুর-রাক্ষসদের বধ করে আপন পরাক্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন, অঘাসুর-বকাসুর তৃণাবর্তেরা যখযমদ্বারে এক পংক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, নাগরাজ কালিয় যখন কৃষ্ণের আদেশ মেনে যমুনা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন, বৃন্দাবনে কৃষ্ণকে তখন সকলে এক ডাকে চেনে। শেষমেশ পূর্বতন বৈদিক দেবতাদের প্রতিভূ ইন্দ্রের অভিমানও যখন কৃষ্ণের প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধিশালিতায় বিপর্যস্ত হয়ে গেল, কৃষ্ণ তখন ব্রজের মানুষদের মধ্যে দেবতার মতো সম্মান পাচ্ছেন। ইন্দ্রের মেঘ-বিক্রমে বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণ যখন ব্রজবাসীদের গোবর্ধনের সুরক্ষিত আশ্রয় দান করে মেঘ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করলেন ব্রজবাসীদের, সেদিন তারা চমৎকৃত হয়েছিল। দেবতাদের প্রতিভূ ইন্দ্র সেদিন কৃষ্ণের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কৃষ্ণের ক্ষমতা এবং প্রজ্ঞার বিশালত্ব মেনে নিয়ে ইন্দ্র সেদিন সসম্মানে নবযুগের প্রতিভূ কৃষ্ণের মাহাত্ম্য স্বীকার করেছিলেন।

 দেবতাদের ইন্দ্রের সঙ্গে ব্রজবাসীদের গোবিন্দ যেদিন বন্ধুত্বের বন্ধন স্বীকার করে নিলেন, সেদিন ইন্দ্র কৃষ্ণকে অনুরোধ করেছিলেন–হস্তিনাপুরের রানী তোমার পিসি কুন্তীর গর্ভে আমার একটি পুত্র আছে। তার নাম অর্জুন। আমাকে তুমি যে দৃষ্টিতে দেখছ, তুমি তোমার পিসতুতো ভাই অর্জুনকেও সেই দৃষ্টিতে দেখবে–দ্রষ্টব্যশ্চ যথাহং বৈ ত্বয়া মান্যশ্চ নিত্যশঃ। তুমি সদা সর্বদা তার রক্ষা বিধান করো। তুমি জেনো যুদ্ধকালে সে তোমার বিশেষ সহায় হবে–স তে বন্ধুঃ সহায়শ্চ সংগ্রামে ভবিষ্যতি। এই কিছুক্ষণ আগে বারণাবতে জতুগৃহের ভস্মরাশির পাশে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণের এই কথা একবারও মনে হয়নি যে, তার সমবয়সী অর্জুনের মৃতদেহ এখানে পড়ে আছে। অবশ্য মৃতদেহ পরীক্ষা করার পরই তার সমস্ত ভয় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। তিনি নির্দ্বিধায় ফিরে গেছেন দ্বারকাপুরীতে।

বৃন্দাবনে কৃষ্ণের প্রতি ইন্দ্রের এই অনুরোধ-বাক্য শুনেই আমরা হস্তিনাপুরে চলে এসেছিলাম। সেখানে পিতার মৃত্যুর পর পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রয়ে আসা থেকে আরম্ভ করে, তাদের অস্ত্রশিক্ষা, তাদের প্রতি দুর্যোধনের ঈর্ষা-অসূয়ার বৃত্তান্ত এবং শেষ পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের চক্রান্তে পাণ্ডবদের জতুগৃহে আগমন তথা তাদের বেঁচে ফিরে যাওয়ার কাহিনীও আমরা বলেছি। ধৃতরাষ্ট্র যেমন পাণ্ডবদের বেঁচে ফিরে যাওয়ার রহস্য জানতেন না, তেমনই কৃষ্ণ সে খবর জানতেন না। জতুগৃহে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবদের তথাকথিত মৃত্যুর খবর হস্তিনাপুরে এবং দ্বারকায় পৌঁছেছিল। কৃষ্ণ তখন কংসবধের পর মথুরা–দ্বারকায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। অপিচ পাণ্ডবদের মৃত্যুর খবর পেয়ে বারণাবতে স্বয়ং উপস্থিত হয়েছিলেন সাত্যকিকে নিয়ে।

কৃষ্ণ কেন এসেছিলেন বারণাবতে, কী পরিস্থিতিতে এসেছিলেন অথবা তিনি আদৌ এসেছিলেন কিনা–সে খবর মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে দেননি। দেননি, কারণ তিনি পাণ্ডবদের গৌরব কাহিনী লিখতে বসেছেন, কৃষ্ণের জীবন তার কাছে আপাতত পার্শ্ব-কাহিনী মাত্র। আমরা যেহেতু মহাভারতের সমস্ত ঘটনাগুলিকে তৎকালীন ভারত-ইতিহাসের এক বিরাট অংশ মনে করি, তাই পরম্পরাসূত্রে আবদ্ধ কৃষ্ণের জীবন আমরা বাদ দিতে পারি না। কৃষ্ণ কোন অবস্থায় বারণাবতের দগ্ধ-ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন, এবং তার পিছনে রাজনৈতিক কারণ কী ছিল সে কথায় আমরা পরে আসব। কেননা যে পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ বারণাবতে এসেছিলেন, তার পিছনে তাঁর জীবনের আনুপূর্বিক পরম্পরা আছে। এবং সে পরম্পরা ধরা আছে অন্যান্য পুরাণে এবং মহাভারতের পরিশিষ্ট স্বরূপ খিল-হরিবংশে। আমাদের তাই আপাতত বৃন্দাবনে ফিরে যেতে হবে; ফিরে যেতে হবে কৃষ্ণের কাছে, ঠিক যেখানে তাঁকে আমরা রেখে এসেছিলাম।

আমরা পৌরাণিক মিথলজিস্টদের দৃষ্টি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছি যে, বৃন্দাবনে পূর্বে ইন্দ্র-যজ্ঞ করা হত। কৃষ্ণ সেই প্রাচীন রীতি স্তব্ধ করে দিয়ে গিরিযজ্ঞ প্রতিষ্ঠা করলেন। বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের পূজা–পার্বণ বন্ধ করে দিয়ে সমস্ত জনপদবাসীকে দিয়ে তাদের জীবিকা এবং আশ্রয় গোপূজা করালেন কৃষ্ণ। আমরা আগেই জানিয়েছি–একটি অঘাসুর অথবা একটি বকাসুর বধ করতে শারীরিক শক্তি লাগে বটে, কিন্তু একটি প্রাচীন রীতি বা প্রাচীন সংস্কার ভেঙে দিতে ব্যক্তিত্ব লাগে অনেক বেশি। ইন্দ্রপূজা বন্ধ করে গোপূজার ব্যবস্থা করা, অর্জুনবৃক্ষ উৎপাটন করে বৃক্ষ–পূজা করা নাগরাজ কালিয়কে স্থানান্তরিত করা এবং নিজের জীবিকার প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলে গোপূজার রীতি প্রবর্তন করা নিজেদের বসতিস্থান গিরি গোবর্ধনের গৌরব বৃদ্ধি করা–এ সবের পিছনে যে ব্যক্তিত্ব কাজ করে, সেই ব্যক্তিত্বের চরম পর্যায়ে কৃষ্ণ এখন উপনীত।

সাত দিনের অতিবৃষ্টির পরেও কৃষ্ণ ব্রজবাসীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে সমর্থ হলেন, ইন্দ্র তখন হার মানলেন এবং আকাশ-বাতাস পুনরায় নির্মল হল। এইরকম পরিস্থিতিতে বৃন্দাবনের গোপবৃদ্ধরা সকলকে নিয়ে কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হলেন তাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাতে। তাদের কৃতজ্ঞতার ভাষাটা এইরকম তোমাকে আমাদের মাঝখানে পেয়ে আমরা ধন্য বোধ করছি, কৃষ্ণ! তুমি তোমার ব্যবহার এবং নীতিকুশলতায় আমাদের সবাইকে বড় বাঁচিয়েছ– ধন্যা স্নোনুগৃহীতা স্মঃ তৃবৃত্তেন নয়েন চ।

দেখুন, আমি আগে অনেকবার বলেছি যে, দু-একটা অসুর-বধ অথবা আক্ষরিক অর্থে গোবর্ধন পাহাড়কে আঙুলে ধারণ করার কথাটা কাহিনী হিসেবেই থাকুক, আসল কিন্তু কৃষ্ণের নীতি-কুশলতা। নীতি বা নয় শব্দটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অর্থে প্রাচীনেরা ব্যবহার করেছেন। অত দুটি রাজনীতি-গ্রন্থ নীতি নামেই পরিচিত, যেমন কামন্দকীয় নীতি অথবা শুক্রনীতি। সে যাই হোক, ব্রজবাসীদের সুখ-দুঃখে কৃষ্ণের আন্তরিক ব্যবহার এবং তাঁর নীতিজ্ঞতা–যে দুটি তাকে ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞে পরিণত করবে–সেই ব্যবহার আর নীতিজ্ঞতাই বৃন্দাবনের সরল মাটিতে তাকে অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। আমরা আগেই বলেছি–কৃষ্ণ এখন সকলের ভরণ-পোষণ করেন এমন এক ভর্তা হিসেবে পরিচিত। মর্যাদা এবং প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে এখন তিনি সকলের কাছে ভর্তা দামোদর নামে পরিচিত।

গয়লাদের মোড়ল গোপবৃদ্ধেরা কৃষ্ণকে সামনে রেখে বলল–আমাদের গোরুগুলো সব ভীষণ বর্ষার ভয় থেকে বেঁচে গেছে, বেঁচে গেছি আমরা সকলেই–গাবো বর্ষভয়াত্তীর্ণা বয়ং তীর্ণা মহাভয়াৎ। তোমার সমস্ত কাজই আমাদের কাছে অলৌকিক ঠেকছে। গোবর্ধন পর্বতকে ধারণ করে যেভাবে তুমি আমাদের সুরক্ষা দিয়েছ, তাতে বারবার এটা মনে হচ্ছে তুমি মানুষ নও দেবতা–বিদ্মঃ ত্বাং কৃষ্ণ দৈবত। তুমি সাক্ষাৎ রুদ্রও হতে পার, হতে পার দেবপ্রতিম অষ্ট বসুর মধ্যে একজন, কিন্তু মানুষ বসুদেব তোমার বাবা হলেন কী করে, সে কথা ভেবে আমরা অবাক হচ্ছি–কিমর্থঞ্চ বসুদেবঃ পিতা তব।

গোপবৃদ্ধদের শেষ মন্তব্যটি ভীষণভাবে প্রণিধানযোগ্য। পণ্ডিতজনে কেউ কেউ বলেছেন যে, এখানে বসুদেব মানে কৃষ্ণের পালক-পিতা নন্দকে বুঝতে হবে। কেননা ব্রজবাসীরা তখন পর্যন্ত বসুদেবকে কৃষ্ণের পিতা বলে জানতেনই না। আমাদের মনে হয়, কথাটা মেনে নেওয়াই ভাল, কারণ সহজভাবে দেখতে গেলে সত্যিই ব্রজবাসীরা কৃষ্ণকে তো বসুদেবের পুত্র বলে জানতেন না। তাও না হয় মানা গেল যে, বসুদেব বলতে এখানে নন্দকে বুঝতে হবে। কিন্তু ব্রজবাসীদের ভাষা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, কৃষ্ণকে তাঁরা নন্দের পুত্র বলতে এখন শঙ্কিত হচ্ছেন। সহজ সরল গোপরাজ নন্দের ঘরে এমন কালজ্ঞ, ব্যবহারজ্ঞ তথা নীতিনিপুণ ব্যক্তির জন্ম যে অস্বাভাবিক, এটা কিন্তু ব্রজ-বৃদ্ধরা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছেন। তাঁরা বলেছেন–বাল্যকালেই তোমার এই অসম্ভব ক্রিয়া-কর্ম আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছে। তোমার এই অলৌকিক, অতিমানুষিক শক্তি-নিপুণতা দেখে আমাদের মনে বড় শঙ্কা হচ্ছে–শঙ্কিতানি মনাংসি নঃ। বারবার কেবলই মনে হচ্ছে–এমন অসম্ভব ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন তুমি আমাদের মধ্যে এমন গয়লার বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছ–কিমর্থং গোপবেশেন রমসেম্মাসু গর্হিত? এক গয়লার বাড়িতে তুমি গাই দুইয়ে বেড়াচ্ছ, গোরু চরাচ্ছ, গো-রক্ষণ করছ–এসব যে নিতান্ত গর্হিত কাজ। তোমার মতো এমন বিরাট মানুষের পক্ষে আমাদের বাড়িতে জন্ম নেওয়াটাই নিতান্ত অন্যায়-জন্ম চাম্মাসু গহিত।

আসলে কৃষ্ণের মতো এক বিরাট-ব্যক্তিত্ব যে সাধারণ গয়লার ঘরে জন্মাতে পারেন না–এ বিষয়টা এখন ব্রজবাসীদের হৃদয় আন্দোলিত করছে। অন্যদিকে এতকাল একত্র সহবাসের ফলে কৃষ্ণের প্রতি প্রত্যেক ব্রজবাসীর যে সহজ সম্বন্ধ গড়ে উঠেছে সে সম্বন্ধও তারা ভাঙতে চায় না। তারা বলে–তুমি দেবতা-দানব, যক্ষ-গন্ধর্ব যাই হও না কেন, তুমি আমাদের আত্মীয়-বন্ধু হয়ে জন্মেছ। আমাদের উপকার সাধন করার জন্য তুমি আমাদের নমস্কার গ্রহণ করো, কিন্তু সবার ওপরে তুমি আমাদের আত্মীয়-বন্ধু বটে–অস্মাকং বান্ধবো জাতো যোসি সোসি নমোস্তু তে।

আমরা জানি, এইরকম একটা মন্তব্যের পরিসরে চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবেরা কী অপূর্ব সরসতা সৃষ্টি করতে পারতেন। ব্রজবাসীজনে কৃষ্ণের সহজ পীরিতী–এই সরসতা দিয়ে শুরু করে রূপ-গোস্বামী কথিত বাৎসল্য-সখ্য-মধুরের দার্শনিক রসবত্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারত শুধু এই কটি মন্তব্যকে উপজীব্য করেই। কিন্তু আমরা এখানে দার্শনিক তর্ক-যুক্তি নিয়ে মাথা ঘামাব না। আমরা মহাভারতের কৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবনের কৃষ্ণাকে মিলিয়ে দিতে চাই এবং তা করতে গেলে কৃষ্ণকে মথুরাবাসী কংসের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে গোপবৃদ্ধদের মন্তব্যগুলি এইজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে কৃষ্ণ তাঁর আইডেনটিটি আর লুকিয়ে রাখতে পারছেন না। গোপজনেরা আর তাকে নন্দরাজার পুত্র বলে মেনে নিতে পারছে না। এমনকি পূর্বোক্ত শ্লোকে বসুদেব অর্থেই ধরি, তাহলে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে আমাদের আরও বেশি সুবিধে হয়। মনে রাখা দরকার, একের পুত্র যদি জন্ম থেকেও অন্যে পালন করে, তবে স্বাভাবিকভাবেই সেই পুত্রের পরিচয় গোপন রাখা কঠিন। তার ওপরে বসুদেব মথুরা নগরে এক অতি গণ্যমান্য ব্যক্তি। কৃষ্ণ যে বসুদেবের পুত্র সে কথা মথুরার অত্যাচারী রাজা কংস ভালভাবেই জানেন এবং কৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য তিনি নানা চক্রান্তও এর মধ্যে করেছেন। তার চক্রান্তগুলি ব্যর্থ হলেও মানতেই হবে যে, কৃষ্ণের পরিচয় আর এখন অজ্ঞাত নেই। কাজেই এমন হতেই পারে যে, ব্রজবাসীরা কৃষ্ণকে বসুদেবের পুত্র বলেই জেনে গেছে। কিন্তু কৃষ্ণের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং নীতিনিপুণতা এতটাই উচ্চস্তরের যে, কৃষ্ণকে এখন মানুষ-বসুদেবের পুত্র বলতেও ব্রজবাসীরা নারাজ। তারা এখন তাকে দেবতার মর্যাদায় দেখে–তবে প্রসাদাদ গোকিদ দেবতুল্যপরাক্রম।

বৃন্দাবনবাসীরা কৃষ্ণকে বসুদেবের পুত্র বলে জেনে গেলেও নীতিনিপুণ কৃষ্ণ কিন্তু এখনই তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। সকলের মর্যাদাময় প্রতিবচন শুনে তিনি সলঙ্কে হেসে জবাব দিলেন–আপনারা আমাকে যেমন ভয়ঙ্কর পরাক্রমশালী বলে ভাবছেন, সেই পরাক্রমশালিতার কথাটুকু মনে রেখেই আপনারা আমাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না, আমি আপনাদের স্বজাতির মানুষ, আমি আপনাদের আত্মীয়-বন্ধু–তথাইং নাবমন্তব্যঃ স্বজাতীয়য়াস্মি বান্ধবঃ।

কৃষ্ণ জানেন–তার সামনে এখন অনেক কাজ, তাতে বিপদও কিছু কম নয়। মথুরার রাজা কংস তার অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছেন মগধ রাজেশ্বর জরাসন্ধের প্ররোচনায়। জরাসন্ধের মতো অমন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তখন ভূভারতে নেই। মথুরা-রাজ কংস সেই জরাসন্ধের জামাই। জরাসন্ধের শক্তিতে শক্তিমান হায়ে সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারতকে তিনি পূর্বভারতের অধীশ্বর জরাসন্ধের কাছে আনত রাখার কাজ করছেন মথুরায় বসে। যদুবংশের যে সমস্ত শাখা-প্রশাখা–যাদব, বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজ, কুকুর ইত্যাদি সমস্ত বংশের বৃদ্ধ পুরুষেরা এখন কংসের ভয়ে গর্তে লুকিয়ে আছেন। যাঁরা বা কংসের মন্ত্রিসভায় কাজ করছেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তারাও তা করছেন কংসের ভয়েই, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নয়।

 এইরকম একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এখনও কৃষ্ণের সময় হয়নি আত্মপরিচয় সম্পূর্ণ প্রকাশ করার। এদিকে বৃন্দাবনের গোপবৃদ্ধেরা জেনে গেছেন যে, তাদের অতিপরিচিত এবং তাদেরই প্রেমাধীন কৃষ্ণ তাদের কেউ নন। ব্রজবাসীদের এই অতিমর্যাদাময় ব্যবহার কৃষ্ণ এখন চাপা দিতে চাইছেন নিজের কারণে এবং তা রাজনৈতিক কারণেই বটে। তিনি ব্রজবাসীদের বুঝিয়ে বললেন–আমার বিষয়ে আসল সত্য কথাগুলি যদি সত্যিই আপনাদের জানতে হয়, তবে আরও কিছু কাল অপেক্ষা করুন–যদি তৃবশ্যং শ্রোতব্যং কালঃ সম্প্রতিপাল্যতাম্। সময় আসলে আমার পরিচয়, আমার সমস্ত তথ্য আপনারা শুনতে পাবেন এবং বাস্তবে আমি লোকটা কেমন, তাও তখন জানতে পারবেন–ততো ভবন্তঃ শ্রেষ্যন্তি মাঞ্চ দ্রক্ষন্তি তত্ত্বতঃ।

কৃষ্ণ এবার সপ্রণয়ে গোপজনের সঙ্গে আপন আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠা করে বললেন–যদি এই বালক কৃষ্ণ আপনাদের কাছে সত্যিই আদরের পরিজন হয়, তবে আমার বিশেষ পরিচয় জেনেই বা আপনাদের লাভ কী, তার দরকারই বা কী আছে। বরঞ্চ এ বিষয়ে আপনারা যতটা চুপ করে থাকবেন, ততটাই আমাকে অনুগ্রহ করা হবে বলে জানবেন–পরিজ্ঞানেন কিং কাৰ্যং যদ্যেযোনুগ্রহো মম। কৃষ্ণের কথা শুনে ব্রজবাসীরা বুঝলেন যে তারা অতি-উৎসাহের বশে এবং অতি কৃতজ্ঞতাবোধে হয়তো কৃষ্ণের একটু ক্ষতিই করে ফেলেছেন। অতএব আর একটাও কথা না বাড়িয়ে সরল গোপবৃদ্ধরা সকলে সলজ্জে চোখ চেপে–যেন কৃষ্ণকে তারা দেখেইনি–এইভাবে চোখ বন্ধ করে মুখ বন্ধ করে যে যেখান থেকে এসেছিলেন চলে গেলেন–বদ্ধমৌনা দিশঃ সর্বে ভেজিরে পিহিতাননাঃ।

.

১১৮.

 বৃন্দাবনের গোপালক ব্রজবাসীরা যেহেতু কৃষ্ণের আসল পরিচয় প্রায় বুঝেই ফেলেছে এবং কৃষ্ণও যেহেতু তাদের কাছে আত্মপরিচয় লুকিয়ে রাখতে চাইছেন, তখন এই নিরিখে দু-চার কথা এখনই আমাদের বলে নেওয়া দরকার। আচ্ছা, আপনাদের একথা কি একবারও মনে হয় না যে, মথুরাবাসী কৃষ্ণপিতা বসুদেব, যিনি নিঃসন্দেহে ক্ষত্রিয়–কুলপতি বলে পরিচিত, তার সঙ্গে ওই গয়লা–মোড়ল নন্দরাজার এত ভাব কিসের? তৎকালীন দিনের বর্ণ ব্যবস্থার উচ্চাবচ মর্যাদা মাথায় রেখে একবার ভাবুন তো যে, অভিজাত যদুবংশীয় পুরুষ বসুদেবের সঙ্গে তথাকথিত নীচ আভীর–জাতীয় নন্দরাজের এত মাখামাখি কেমন করে সম্ভব? এতটাই মাখামাখি যে, বসুদেব তার পৌরবী গৃহিণী রোহিণীকে নন্দগোপের বাড়িতে রেখে দিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। কেন যদু-বৃষ্ণিদের বিরাট সংঘ-পরিবারে আর কি কোনও অভিজাত মানুষ ছিলেন না, যাঁর ঘরে বসুদেব তার স্ত্রীকে গচ্ছিত রাখতে পারতেন কংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য।

 শুধু স্ত্রীকে রেখে আসাই নয়, সেই নন্দ ঘোষের ঘরে বসুদেবের বড় ছেলে বলরাম জন্মেছেন এবং তারই ঘরে তিনি মানুষ হচ্ছেন; কৃষ্ণকেও মানুষ করার জন্য বসুদেব সেই নন্দ ঘোষকেই বেছে নিলেন। উচ্চ-নীচ জাতির এই প্রায় অসম্ভব মাখামাখি থেকেই আমাদের মতো সাধারণ জনের মনে সন্দেহ জাগে যে, ব্যাপারটা কী? এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়, তবে এবিষয়ে সম্ভাব্য কথাগুলি এখনই বলে নেওয়া ভাল।

প্রথম কথা হল–বৃন্দাবনের নন্দ ঘোষ গোপালন করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তার অবস্থা ভাল ছিল এবং তিনি ছোট-খাট সামন্ত রাজা বলেই তার একটা মর্যাদাও ছিল। অত্যাচারী কংসকে তিনি রাজকর দিতেন এবং তা দেবার জন্য তাকে মথুরায় আসতে হত। কৃষ্ণকে যখন নন্দ-রাজার বাড়িতে রেখে আসা হল, তারপরেও নন্দ একবার রাজকর দিতে মথুরায় এসেছিলেন। তার প্রমাণও আছে পুরাণগুলিতে। এই তথ্য থেকে আরও প্রমাণিত হয় যে, বৃন্দাবন কংসের করদ রাজ্যের একটি। অথবা এটাকে রাজ্য না বলাই ভাল, বলা উচিত বৃন্দাবন নামক গ্রামটি কংসের অধীনেই ছিল এবং ব্রজবাসীরা কংসের করদ প্রজা।

এখন দেখতে হবে তথাকথিত নীচ কুলের আভীর ঘোষদের সঙ্গে মথুরাবাসী অভিজাত বসুদেবের এত মাখামাখি কেন? লক্ষ্য করে দেখুন–হরিবংশ, ব্রহ্মপুরাণ এবং আর দু-একটি প্রাচীন পুরাণে যখন বসুদেবের বংশপ্রণালী বলা হচ্ছে, সেখানে অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে এবং অত্যন্ত আকস্মিকভাবে এক গর্গবংশীয় পুরুষের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে। এই উল্লেখের প্রসঙ্গটা এই রকম। গর্গবংশীয় পুরুষটির নাম করার আগে পর্যন্ত হরিবংশ ঠাকুর বসুদেবের অন্যান্য স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রদের নাম বলছিলেন। বলা হয়েছে–বসুদেব অন্য এক স্ত্রী বৃদেবীর গর্ভে মহাত্মা অনাবহকে প্রসব করলেন। ঠিক এই শ্লোকের পরেই অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলা হল—

 ত্রিগর্ত দেশের রাজার এক কন্যা ছিল। তার স্বামী হলেন গর্গ বংশীয় শৈশিরায়ণ-কন্যা ত্রিৰ্গতরাজস্য ভর্তা বৈ শৈশিরায়ণঃ। এই শ্লোকের পরে হরিবংশে গর্গবংশীয় শৈশিরায়ণের বংশ-বর্ণনা আছে।

আমাদের জিজ্ঞাসা হয়–পৌরাণিক কথক-ঠাকুররা বংশ-প্রতিবংশ বর্ণনার জন্য বিখ্যাত ছিলেন এবং তারা এত বোকা নন যে, বসুদেবের বংশপরম্পরা বলতে বলতে হঠাৎ ক্রম গুলিয়ে কোন এক গর্গবংশীয় ব্যক্তির নাম করতে যাবেন। আমাদের অনুমানের কথা বলি–বসুদেবের সঙ্গে এই গর্গগোত্রীয় শৈশিরায়ণের কোনও রক্তের সম্বন্ধ নেই বলেই আপাতত মনে হয়। কিন্তু একথা সকলেই জানেন যে, গর্গ ছিলেন যাদবদের কুল-পুরোহিত। লোকমুখে এমন পাঁচালিও শুনেছি যে–কৃষ্ণ নাম রাখে গর্গ ধ্যানেতে জানিয়া, অর্থাৎ কৃষ্ণের নামকরণও করেছেন ওই গর্গ। এই গর্গ মানুষটি কে? পুরাণগুলিতে আমরা একজন গর্গকে পাচ্ছি যিনি পাণ্ডব-কৌরবদের অতি পূর্ব পিতামহ পুরু-ভরতের বংশে জন্মেছিলেন।

আপনাদের মনে পড়ে কি–সেই যে মহারাজ ভরত তার কোনও পুত্রকে রাজ্য দিলেন না। শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজের পুত্র বিতথ ভরদ্বাজকে দিয়ে ভরতবংশের ধারা চলল। বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে–এই বিতথের নাতিদের মধ্যে একজন ছিলেন গর্গ। রাজধর্মে তার মন ছিল না। অতএব তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে যান। তার পুত্রেরাও সব ব্রাহ্মণ। ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্মেও ব্রাহ্মণের বৃত্তি গ্রহণ করেন বলে পৌরাণিকেরা তাদের ক্ষত্রিয়-বামুন বলত। বিষ্ণুপুরাণের ভাষায় গর্গাচ্ছিনি–স্ততো গার্গা শৈন্যাঃ ক্ষত্রোপেতা দ্বিজাতয়ো বর্ভূবুঃ। পারজিটার সাহেব গার্গ বা গর্গবংশীয়দের Ksatrian Brahman নামে অভিহিত করে মন্তব্য করেছেন–Even the Brahmnical Bhagavata says plainly that Gargya (Gargas) from a ksatriya became a brahman.

আমাদের ধারণা–এই ক্ষত্রিয়-বামুন গর্গ বা গার্গদেরই বংশের কোনও একজন যাদবদের কুল-পুরোহিত হয়েছেন পরবর্তী কালে। পূর্বে আমরা যে গর্গগোত্রীয় শৈশিরায়ণের নাম করেছি, তাকে তার পুত্রজন্মের প্রসঙ্গে একবার মাত্র হরিবংশে গর্গ শৈশিরায়ণ বলা হয়েছে বটে, তবে অন্য দুই জায়গায় ওই একই প্রসঙ্গে তাকে শুধুই গার্গ বলা হয়েছে, কিন্তু তার পুত্রের নাম তিন জায়গাতেই এক রকম। অর্থাৎ যদু বংশীয় বসুদেবের বংশ-পরম্পরা বলতে বলতে হঠাৎ গার্গ শৈশিরায়ণের পুত্রের যে নামটি পৌরাণিক বলেছেন, ঠিক সেই নামটিই অন্য দুই জায়গাতেও পাওয়া যাবে, যদিও পিতার নাম সেখানে শুধু গাৰ্গ অর্থাৎ গর্গবংশীয় কেউ একজন; শৈশিরায়ণের নাম যে দুজায়গায় নেই অথচ পুত্রের নাম একই আছে।

আমাদের স্থির বিশ্বাস গর্গ পুরু-ভরত বংশে জন্মালেও বংশগত আত্মীয়তা হেতু তথা ব্রাহ্মণ-তপস্বী হয়ে যাবার দরুন তাঁর ব্রাহ্মণ পুত্রেরা কোনও এক সময় যাদবদের কুল পুরোহিত হয়ে যান। আমাদের আরও বিশ্বাস–যাদবদের মধ্যে থাকতে থাকতে এবং তাদের পৌরোহিত্য করতে করতে তারা যাদবদের অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে যান এবং যদুবংশীয়দের মধ্যে তাদের বিবাহাদিও হতে থাকে। না হলে যদুবংশীয় বসুদেবের কথা প্রসঙ্গে গার্গ শৈশিরায়ণের কথা আসত না। এবারে শৈশিরায়ণের কথা বলি, তাতে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

হরিবংশ আগেই জানিয়েছে যে গাৰ্গ শৈশিরায়ণ ত্রিগর্ত-রাজার মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। এই গার্গ শৈশিরায়ণ যদু-বৃষ্ণিদের একটি সংঘের কুল পুরোহিত ছিলেন। অবশ্যই। দুর্ভাগ্যবশত গার্গ শৈশিরায়ণের একটি শারীরিক দোষ ছিল। লোকে বলত, এমনকি যাদবরাও হয়তো তাদের কুলগুরুর আড়ালে বলত যে, শৈশিরায়ণের নাকি বীর্য স্থলন হত না। আরও দুর্ভাগ্য তার স্ত্রী ত্রিগর্তরাজকন্যা এবং শৈশিরায়ণের শ্যালক অর্থাৎ ত্রিগর্ত রাজার ছেলেও গার্গ শৈশিরায়ণকে তেজোহীন নপুংসক বলতেন। তারা বলতেন–শৈশিরায়ণের তেজ মুক্ত হয় না–জিজ্ঞাসাং পৌরুষে চক্রে ন চস্কন্ধূপৌরুষ।

অন্য লোকে বলে বলুক, কিন্তু নিজের স্ত্রী যদি স্বামীর পৌরুযে সন্দেহ করে তো কোন পুরুষের ভাল লাগে! অন্যদিকে ঘটনাটা তথাকথিতভাবে সত্য যদি হয়ই তবে সেই স্ত্রী-শ্যালকেরই বা কেমন লাগে। অন্তত বার বছর এইভাবে কেটেছে, যাতে স্ত্রী-শ্যালকের সন্দেহ বেড়েছে–বর্যে দ্বাদশমে তথা। গার্গ শৈশিরায়ণের শ্যালক বোনের দুঃখ দেখে কথাটা আর চেপেও রাখতে পারলেন না। বার বছর সহ্য করার পর তিনি যদুবংশীয় রাজপুরুষদের সামনে একদিন জামাইবাবু শৈশিরায়ণের সম্বন্ধে কটাক্ষ করে বললেন–ব্যাটা পুরুষ তো নয়ই।–অপুমানিতি রাজনি (ব্রহ্মপুরাণ)। ব্যাটা নপুংসক–গার্গঃ গোষ্ঠে দ্বিজং শ্যালঃ ষঢ় ইত্যুক্তবান্ দ্বিজঃ (বিষ্ণুপুরাণ)।

 সমবেত যাদবদের সামনে এসব কথা বলায় তারাও খুবসে হা-হা করে হাসলেন–যদূনাং সন্নিধৌ সর্বে জহসুঃ সর্বর্যাদবাঃ। এ হাসির ফল ভাল হল না। গার্গ শৈশিরায়ণ শ্যালকের ওপর যতখানি ক্রুদ্ধ হলেন, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্রুদ্ধ হলেন যাদবদের ওপর। বিষ্ণুপুরাণ অথবা হরিবংশ অন্যত্র যেমন বলেছে, তাতে এই কথা শুনে গার্গ শৈশিরায়ণের শরীর ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল। তিনি দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে মহাদেবের তপস্যা করতে গেলেন মথুরাবাসী যাদবদের অবধ্য এক ভয়ঙ্কর পুত্র লাভের জন্য।

বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে–মহাদেবের কাছ থেকে বর লাভ করে গাৰ্গ শৈশিরায়ণ যখন ফিরছেন, তখন এক যবন রাজা তাকে খুব যত্ন-আত্তি করে বাড়ি নিয়ে যান। যবনরাজ অপুত্রক ছিলেন এবং তার মহিষীর গর্ভে নিয়োগ-প্রথায় শৈশিরায়ণের ঔরসে পুত্র লাভ করেন। আমরা কিন্তু বিষ্ণুপুরাণের চাইতে এব্যাপারে হরিবংশ-ঠাকুরকেই বেশি বিশ্বাস করি। হরিবংশের তথ্য একেবারেই আলাদা এবং সেটাই আমাদের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য।

আপনারা প্রথমে বিষ্ণুপুরাণের শ্লোকে একটি শব্দ লক্ষ্য করুন। দেখুন, আগে যে শ্লোকটি বিষ্ণুপুরাণ থেকে উল্লেখ করেছি, সেখানে শৈশিরায়ণের শ্যালক যেখানে দাঁড়িয়ে যাদবদের কাছে তার জামাইবাবুকে কটাক্ষ করছেন, সে জায়গাটা নাকি গোষ্ঠ। গোষ্ঠ মানে তা গো-চারণক্ষেত্র। কোনওভাবেই কি ভাবা যায় যে মথুরাবাসী যাদবরা গোচারণক্ষেত্রে বা তার কাছাকাছি থাকতেন? আমাদের বিশ্বাস–জায়গাটা বৃন্দাবন। মথুরা থেকে এক রাত্তিরে যেখানে বসুদেব কৃষ্ণকে রাখতে এসেছিলেন, যে জায়গাটা তো দূরে নয়, অতএব যাদবদের সেখানে যাতায়াত অথবা সেখানেই বেশ কিছু যাদবদের বসবাসও কিছু অসম্ভব নয়। ধরেই নিতে পারি বৃন্দাবনও যাদবদের অধ্যুষিত এলাকা ছিল এবং তা মাথুর কংসের করদ রাজ্য। এবার হরিবংশের তথ্য শুনুন।

 হরিবংশ এক জায়গায় এটা স্বীকার করেছে যে, গার্গ শৈশিরায়ণ বার বছর মহাদেবের তপস্যা করেছেন এবং মথুরাবাসী যাদবদের অবধ্য একটি পুত্রলাভের বরও পেয়েছেন মহাদেবের কাছ থেকে। কিন্তু এখানে তিনি কোনও যবন রাজার গৃহে অতিথি হননি। তিনি হয়তো ফিরে এসেছেন নিজের জায়গায় যাদবদের কাছেই। কিন্তু এই বারো বচ্ছর পরেও তিনি তার পূর্বাপবাদ থেকে মুক্ত হননি। তাকে আবারও শুনতে হল যে, তিনি নপুংসক তেজোহীন পুরুষ–মিথ্যাভিশপ্তো…গার্গস্তু…বর্ষে দ্বাদশমে তথা।

 হরিবংশ জানাচ্ছে–এই মিথ্যা অপবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেলেন এবং নিজেকে সপ্রমাণ করার জন্য ক্রোধের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তিনি এক গোপন্যাকে আলিঙ্গন করে রমণ করতে লাগলেন–গোপন্যাম্ উপাদায় মৈথুনায়োপচক্ৰমে। এই গোপ-কন্যার কথা শুনে জায়গাটাকে তো সেই বিষ্ণুপুরাণ-কথিত গোষ্ঠই মনে হচ্ছে। গোপন্যার নামটিও দেখুন হরিবংশে গোপালী, গোপীস্ত্রীবেশধারিণী, অর্থাৎ সে কন্যার বেশবাসও গোপস্ত্রীদের মতো। এই গোপকন্যা গোপালীই শৈশিরায়ণের তেজ ধারণ করে জন্ম দিলেন কাল-যবনকে। কাল-বনের সঙ্গে মথুরাবাসীদের বিবাদ তথা কৃষ্ণের সঙ্গে তার ঝগড়া-ঝাটির কথা পরে আসবে। হরিবংশে আছে–গোপালীর ঘরে এই শিশু পুত্রের জন্ম দিয়ে গার্গ শৈশিরায়ণ নিজের অপবাদ স্খলন করলেন বটে কিন্তু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মথুরায় এলেন না। সে মানুষ হতে লাগল এক যবন রাজার ঘরে। যবন রাজার পুত্র ছিল না, অতএব যবনরাজার জাতি নামেই সেই পুত্রের নাম হল কাল-যবন।

হরিবংশের জবানি আমাদের কাছে এইজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, মহাত্মা গার্গ শৈশিরায়ণ–তিনি ভরতবংশীয় ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণই হোন অথবা যাদবদের কুলপুরোহিতই হোন–তিনি যে মথুরাবাসী এবং যদু-বৃষ্ণি সংঘে তিনি যে এক অভিজাত মান্য পুরুষ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর ঠিক এইখানেই আমাদের প্রশ্ন হল যে, মাথুর যাদবদের মান্য পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে তেজস্কর প্রমাণ করার জন্য তিনি কি হাতের কাছে অন্য কোনও স্ত্রীলোক খুঁজে পেলেন না, একটি গোপকন্যাই শুধু খুঁজে পেলেন। পুরাণকারেরা অভিজাত গাৰ্গ পুরুষের মান বাঁচানোর জন্য গোপকন্যা গোপালীকে স্বর্গের অপ্সরা বলে জাতে তুলেছেন। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে–এই সম্মাননা যে কোনও বিরাট পুরুষের সাহচর্যেই সম্ভব। কোনও কোনও পুরাণের প্রমাণে অনেক দার্শনিকেরা পর্যন্ত ভগবান কৃষ্ণের নমসহচরী গোপ-রমণীদের স্বর্গের অপ্সরা বলেছেন, এমনকি স্ববেশ্যাও বলেছেন। কিন্তু আমাদের কথাটা এখানে নয়।

আমাদের বক্তব্য গার্গ শৈশিরায়ণ মাথুর যাদবদের ঘরের লোক হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু এক গোপকন্যাকেই সন্নিকটে পেয়েছেন, তাতে অনুমান হয় গোপালক বা গোপালিকারা যাদব-বৃষ্ণিদের নিকট-জন ছিলেন। গোপালক আভীর জাতির সঙ্গে যাদবদের দহরম–মহরম অনেক আগে থেকে ছিল বলেই একটি গোষ্ঠ-প্রস্থের মধ্যে যাদবরা যেমন গার্গ শৈশিরায়ণকে উপহাস করতে পেরেছেন, তেমনই গোপালক নদ-রাজার ঘরে যাদব বসুদেবের পুত্র কৃষ্ণের পালন-পোষণও কিছু আশ্চর্য নয়।

শক-জাতীয়রা যে সময়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের সমসাময়িক কালেই আভীর-জাতীয় পুরুষেরা পূর্ব ইরানের কোনও জায়গা থেকে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন বলে পণ্ডিতদের অনুমান। প্রতিবাদী পণ্ডিতেরা বলেন–অমন করে বৈদেশিকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করলে মহামানবের এই সাগরতীরের মানুষেরা সকলেই বৈদেশিক হয়ে যাবেন। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি খ্রিষ্টপূর্ব দেড়শ শতাব্দীতে যেহেতু আভীরদের শূদ্রবর্ণের শাখা হিসেবে গণ্য করেছেন, তার মানে আভীরজাতীয়রা তার বহু আগে থেকেই ভারতবর্ষের সমাজে থিতু হয়ে গেছেন, নইলে জাতি-বর্ণের সামাজিক ব্যবস্থায় নবাগতদের স্থান হওয়া অত সহজ নয়।

মহাভারত এবং পুরাণগুলি আভীরদের স্থায়ী বাসস্থান নির্ণয় করেছেন অপরান্ত–দেশে। বৃহৎসংহিতার মতো প্রাচীন তথ্যপূর্ণ গ্রন্থে অপরান্ত-দেশকে কোঙ্কন, উত্তর-গুজরাত, কাথিয়াওয়াড়, কচ্ছ এবং সিন্ধুর সঙ্গে যুক্ত করা হলেও পৌরাণিকেরা জানিয়েছেন অপরান্ত হল ভারতবর্ষের পশ্চাদ্দেশ অর্থাৎ পশ্চিম ভারত। যে সমস্ত জনপদ এই অপরান্ত দেশের অন্তর্গত তার একটা তালিকা দিয়েছেন পুরাণকারেরা। এই তালিকার মধ্যে আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হল, সুরাষ্ট্র, কচ্ছীয়, আনর্ত ইত্যাদি অর্থাৎ ভারতবর্ষের পশ্চিমে যে কোস্টাল রিজিয়ন সেইগুলি। আমাদের কাছে এগুলি এইজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, ভবিষ্যতে এই সব অঞ্চলে বিশেষত দ্বারকায় মহাভারতের প্রধান নায়ক কৃষ্ণকে নায়কত্ব করতে দেখা যাবে। তার মানে বৃন্দাবন-মথুরা ছেড়ে কৃষ্ণ যখন দ্বারকায়, তখনও তার সঙ্গে আভীর-ব্রজবাসীদের সম্পর্ক চুকে গেছে–এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।

একই সঙ্গে জানাই পুরাণের তালিকায় আরও যেসব নাম আছে, তাতে শুধু ওই পশ্চিম–ভারতের কোস্টাল রিজিয়নই নয়, সমগ্র পশ্চিম ভারত তো বটেই, উপরন্তু দক্ষিণ দেশের কেরল পর্যন্ত এবং উত্তরে রাজপুতানা পর্যন্ত অপরান্ত দেশ বিস্তৃত ছিল। মহাভারত এক জায়গায় যেমন আভীরদের অপরান্তের অধিবাসী বলে উল্লেখ করেছে, তেমনই আরেক জায়গায় বলেছে–আভীররা থাকতেন বিনশন নামে একটি জায়গায় যেখানে সরস্বতী নদী তার জলধারা হারিয়ে ফেলেছে। পণ্ডিতদের মতে জায়গাটা দক্ষিণ-পশ্চিম রাজপুতানা। আরও আশ্চর্য হবেন শুনে যে, কোযকার পুরুষোত্তম দেব তার ত্রিকাণ্ডশেষ নামক গ্রন্থে বিনশন নামের জায়গাটিকে কুরুক্ষেত্রের মধ্যে ফেলেছেন। সত্য কথা বলতে কি ইতিহাসের প্রমাণেই বলা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীগুলিতেই আভীররা ভারতবর্ষের জন-শরীরে মিশে গেছেন, নইলে পুরাণে সাতবাহন রাজাদের বংশধর হিসেবে পেতাম না। অন্যদিকে শক মহাক্ষত্রপদের মধ্যে অনেক আভীর রাজার নামও ইতিহাসেই পাওয়া যাবে।

 আভীরদের বাসস্থানের বিস্তৃতি, তাদের ক্ষমতাশালিতা এবং তাদের রাজার আভিজাত্য নির্ণয় করে আমরা শুধু একটা কথাই বোঝাতে চাইছি, তা হল যদু-বৃষ্ণি সংঘের অভিজাত পুরুষেরা যেসব জায়গায় থাকতেন তাদের সঙ্গে আভীরজাতীয়দের অতিনৈকট্য কোনও অসম্ভব ঘটনা নয়। এ কথাটা আরও পরিষ্কার করে বলতে চাই এইভাবে যে, মহামতি বসুদেব যাদবদের মধ্যে অন্যতম প্রধান পুরুষ হয়েও যেখানে তিনি তাঁর পুত্রকে মানুষ হবার জন্য রেখে এসেছিলেন, সেই আভীরজাতীয় গোপজনেরাও সমাজে যথেষ্ট আদরণীয় পুরুষ ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে যাদবদের নিত্য মেলামেশা এবং নিত্য যাতায়াত ছিল আত্মীয়-স্বজনের মতোই।

ইতিহাসের পাতায় শক-কুষাণ-আভীরদের তথাকথিত বৈদেশিকত্ব এবং এদেশে তাদের আভিজাত্যে উত্তরণের সূত্র ধরেই জানাই যে, ভারতবর্ষে কুষাণ যুগের প্রথম পর্বেই মথুরার স্থাপত্য-শিল্পে দেখতে পাচ্ছি–মহামতি বসুদেব নন্দগোপের হাতে তার প্রিয় পুত্রকে তুলে দিচ্ছেন। শেষ নাগের ছত্রছায়ায় বসুদেব যমুনা পার হয়ে বৃন্দাবনের দিকে যাচ্ছেন–এই দৃশ্যও কুষাণ যুগের পরিকল্পনা। স্থাপত্য-শিল্পের এই রীতি পরবর্তীকালে লিখিত ব্রাহ্মণ্য পুরাণের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। আমরা যদি এটা বুঝতে পারি যে, সাহিত্য এবং শিল্পের এই প্রেরণা কৃষ্ণ-জীবনের সত্য-ঘটনাগুলি থেকেই এসেছে, তাহলে ইতিহাসের প্রমাণে এটাও মেনে নিতে হবে যে, আভীর ব্রজবাসীদের সঙ্গে যাদবদের মেলামেশা এবং মাখামাখি ওই বসুদেবের সময়কালে এসেই সম্পন্ন হয়নি, এ সম্পর্ক অনেক দিনের।

এই নিকট সম্পর্কের কথায় আরও একটি তথ্য এখানেই নিবেদন করি। বৌদ্ধগ্রন্থ ঘটজাতকে দেখা যাবে–বাসুদেব (কৃষ্ণ) এবং তার ভাইরা সকলেই কংসের বোন দেবগভার ছেলে। দেবগ অবশ্যই পুরাণ-বর্ণিতা দেবকীর পরিবর্তিত রূপ। জাতক বলেছে–দেবগভার এই পুত্রগুলি পালনের জন্য যাঁর হাতে সঁপে দেওয়া হল, তিনি নাকি দেবকীর একজন পরিচারিকা। তার নাম নন্দগোপা। নন্দগোপা যে আমাদের পরম পরিচিত নন্দরাজার স্ত্রী যশোদা-মাই তাতেও কোনও সন্দেহের কারণ নেই। কিন্তু যশোদার নাম সরাসরি না করে জাতক তার নামের সঙ্গে নন্দ রাজার পূর্বপদটি জুড়ে দিলেও যশোদাকে আমাদের চিনতে অসুবিধে হয় না বটে কিন্তু নন্দগোপার স্বামীর নাম ঘট-জাতকে অন্ধক-বে। আমাদের বক্তব্য–জাতকের লেখক যদি ব্রাহ্মণ্য প্রভাবিত পৌরাণিক গাথাগুলির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে থাকেন, তবে এই নন্দগোপার স্বামীটির অন্ধক-বেহ্নু নামটি আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

ঘট-জাতকের অন্যান্য সব সংবাদ ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থরচনার তথ্য এবং ধারার সঙ্গে মেলে না বলে পণ্ডিতজনেরা অনেকেই এই তথ্যগুলি উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু আমাদের ধারণা–যেহেতু মেলে না, সেইজন্যই তথ্য হিসেবে এবং ঐতিহাসিকতার কারণে ঘটজাতকের এই সংবাদ ভীষণ রকমের জরুরী।

দেখুন, আমরা সবাই জানি–কৃষ্ণ অন্ধক-বৃষ্ণি কুলেরই অন্যতম প্রধান পুরুষ–বৃষ্ণীণাং পরদেবতেতি বিদিতঃ। অন্যদিকে ঘটজাতকে নন্দগোপার স্বামীর অন্ধক-বে নামটি অন্ধক বৃষ্ণি বা অন্ধক-বিষ্ণু শব্দেরই অপরিমার্জিত রূপ। নন্দগোপার স্বামী যদি অন্ধক-বৃষ্ণি বংশের কেউ না হন অথবা অন্ধক-বৃষ্ণিদের সঙ্গে তার যদি কোনও মাখামাখি সম্বন্ধ না থাকে, তবে তার এই নাম কোথা থেকে আসবে। অতএব এটা বেশ অনুমান করা যায় যে, অন্ধকবৃষ্ণিদের সঙ্গে ব্রজরাজনন্দের এতটাই সম্পর্ক ছিল যে, তারা তাকে অন্ধক–বৃষ্ণিদেরই একজন বলে জানতেন। অভিজাত বসুদেবের সঙ্গে যশোদা বা নন্দগোপার স্বামী অন্ধক–বে নন্দের গভীর সম্বন্ধও তাই অকল্পনীয় তো নয়ই, বরঞ্চ এই গভীর সম্পর্কের জন্য তাঁর নামই অন্ধক–বে অর্থাৎ অন্ধক–বৃষ্ণি।

আমরা এর আগেই জানিয়েছি যে, যদুবংশীয় পুরুষদের সঙ্গে গোপালক আভীরদের গভীর সম্পর্ক ছিল। ঘট-জাতকের মতো ব্রাহ্মণ্য-রচনা বহির্ভূত গ্রন্থেও সেই প্রমাণ থেকে যাওয়ায় আমাদের পক্ষে অনুমান করা সহজ হয় যে, এই গভীর সম্পর্কের কারণেই যদুবংশীয় অভিজাত পুরুষ বসুদেব তাঁর পরম বন্ধু গোপালক নন্দর হাতে তার শিশু পুত্রের ভার ন্যস্ত করে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন–দেখ বন্ধু! রৌহিণেয় বলরাম আমার বড় ছেলে, আর কৃষ্ণ হল তোমার ছোট ছেলেস চ পুত্রো মম জ্যায়ান্ কনীয়াংশ্চ তবাপ্যয়। তুমি এই দুজনকেই রক্ষা করো।

বলরামের মা বসুদেব-পত্নী রোহিণী গর্ভবতী অবস্থাতেই ব্রজে এসেছিলেন, আর বসুদেবের আরেক পুত্র রাতের অন্ধকারে চুপিসাড়ে ন্যস্ত হলেন নন্দ-রাজার ঘরে! আপনাদের কি মনে হয়–সহজ সরল ব্রজবাসীদের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে কোনও কৌতূহল ছিল না, কিংবা কোনও কথাবার্তাই হত না কখনও? নিশ্চয়ই হত এবং ব্রজবাসীদের চোখে এই দুটি ছেলের আলাদা মান–মর্যাদাও ছিল। সেই কারণেই গোবর্ধন পাহাড়ে আশ্রয় পাবার পর, ইন্দ্ৰযজ্ঞ স্তব্ধ হয়ে যাবার পর সহজ সরল ব্রজবাসীরা কৃষ্ণকে সহজভাবেই বলতে পেরেছিল–আজ তোমাকে তোমার পরিচয় বলতেই হবে। বলতেই হবে–কেমন করে বসুদেব তোমার পিতা হলেন–কিমর্থঞ্চ বসুদেবো পিতা তব?

.

১১৯.

 কৃষ্ণের কথা শুনে ব্রজ-বৃদ্ধরা যখন বিনা বাক্যে ঘরে ফিরে গেলেন, তখনই বোঝা গেল কৃষ্ণের পরিচয় তারা অল্প-বিস্তর বুঝেই গেছেন। হরিবংশ ঠাকুর জানিয়েছেন–সেই দিনটা ছিল শরৎ পূর্ণিমার রাত্রি। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে প্রেমন-নয়নের দীছায়াময় পল্লবের মত। শরতের চাঁদ তার শীতল করাঙ্গুলি দিয়ে প্রাচী দিগবন্ধুর মুখখানি একবার স্পর্শ করতেই সে মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। সমস্ত পূর্বাকাশে ছড়িয়ে পড়ল জ্যোৎস্নার লালিমা। মানুষ কৃষ্ণের মনে হল–এমন শারদ রজনীতে যদি সেই সুন্দরী গোপরমণীরা কাছে থাকতেন। কৃষ্ণের বড় ইচ্ছে হল সেই অতি পরিচিতা সরলা রমণীদের সুখ-সঙ্গ লাভ করার। ইচ্ছে হল মিলনের–শারদীঞ্চ নিশাং রম্যাং মনশ্চক্রে রতিং প্রতি।

সহৃদয় পাঠক আমার! আমরা কৃষ্ণের-জীবনের এক চরম লগ্নে উপস্থিত হয়েছি কোনও ভণিতা ছাড়াই। বৃন্দাবনে সমস্ত গোপকুলের মধ্যেও কৃষ্ণের সর্বাতিশায়ী স্বাতন্ত্র্য, অনন্য-সাধারণ বুদ্ধি এবং ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা করার পথে চলতে চলতে হরিবংশ-ঠাকুর হঠাৎ যে কেন কৃষ্ণকে এই শারদ রজনীর জ্যোৎস্না মাখিয়ে দিলেন, তাতে আমরা যথেষ্ট বিব্রত বোধ করছি। শুধু হরিবংশ কেন, কৃষ্ণ-সম্বন্ধী সমস্ত পুরাণ, বিশেষত ভাগবত পুরাণ তার অমৃতস্রবিনী ভাষায় কৃষ্ণকে অসুর-মারণ আর ব্যক্তিত্বময়তার কঠিন জগৎ থেকে তুলে এনে বৃন্দাবনের ফুল্ল-মল্লী-মালতী-যূথীর বনে প্রবেশ করালেন। আমরাও তাই বিনা ভণিতায়, বিনা গৌর-চন্দ্রিকায় কৃষ্ণের মনের ইচ্ছাটুকু আগেই ব্যক্ত করে ফেলেছি। কার্য-কারণ সম্বন্ধের কোনও বিচার না করে কৃষ্ণের মনঃস্থিত কতগুলি রমণীর কথা বলে ফেলেছি। দুঃখের বিষয়–এই রমণীদের সঙ্গে একবার পরিচয় করিয়ে দেবারও সুযোগ হয়নি আমাদের। অথচ হরিবংশ-ঠাকুরের কথার ফাঁদে পড়ে আমরা কৃষ্ণের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।

আমাদের বিপদ আছে আরও। আধুনিক সমালোচক পণ্ডিতেরা আছেন। তাদের কাছে কৃষ্ণ আবার অনন্ত-রূপে দেখা দেন। মহাভারতের প্রবল রাজনীতি-ধুরন্ধর কৃষ্ণের সঙ্গে তারা বৃন্দাবনের গোপ–বেশী বেণুকর কৃষ্ণকে মেলাতে পারেন না। তাদের মতে দ্বারকার কৃষ্ণ এক, মথুরার কংসধ্বংসী কৃষ্ণ আরেক আর বৃন্দাবনের কৃষ্ণ আরও এক অন্য ব্যক্তি। এক পণ্ডিত-সুধী সরসে আমাকে বলেছিলেন–ওঁরা যে সকালের কৃষ্ণ আর বিকালের কৃষ্ণ বলে কিছু বলেননি, তাই বড় রক্ষে।

এঁদের সবার মাথার ওপরে চড়ে বসে আছেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি অনবদ্য কূটযুক্তিতে এমন একখানি কৃষ্ণ-চরিত্র লিখে বসে আছেন, যা পড়লে মনে হবে–একেবারে অকাট্য যুক্তি। বেশির ভাগ পুরাণের কথাই সব গুল-গাপ্পায় ভরা। পুরাণগুলির মধ্যে এই অংশ প্রক্ষিপ্ত, ওই অংশ অসার, ওই পুরাণ আগে লেখা, অমুক পুরাণ পরে লেখা–এত সব বিদ্যাবত্তার প্রদর্শনী করতে গিয়ে মহামতি বঙ্কিম কৃষ্ণ-জীবনের অর্ধেকটাই বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁর কৃষ্ণ চরিত্র পড়লে মনে হবে কৃষ্ণ লোকটার কোনও বাল্যকালও ছিল না, আর যৌবন? আদর্শ পুরুষের কোনও যৌবন থাকতে নেই যেন।

আবার মুশকিল হল–আমি যেখানেই এসব তত্ত্ব-কথা বলতে যাই, সেখানে জায়গা থাকে। কম, আর সে জায়গাটা মনোমত গবেষণা করার উপযুক্ত আধার বলেও চিহ্নিত নয়। নইলে মহামান্য বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিপক্ষতার গৌরবটুকু অন্তত লাভ করতে বাসনা হয় বইকি। আসলে বঙ্কিমচন্দ্রের মনে কৃষ্ণ এক আদর্শ অবতার পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। সে আদর্শ এমনই যে, তার যদি যৌবন থেকেও থাকে, তাতে তার একটি মাত্র পত্নী ভিন্ন অন্য কোনও রমণীর কটাক্ষপাত পর্যন্ত থাকতে পারে না। অতবড় সাহিত্য-রসিক হওয়া সত্ত্বেও বঙ্কিম যে কেমন করে কৃষ্ণের মতো রসিক-চূড়ামণিকে রমণী-কটাক্ষ-বর্জিত এক পরুষ-পুরুষে পরিণত করতে পারলেন, তা ভাবলে আশ্চর্য হই।

এইরূপ শ্রুত আছি–কৃষ্ণকান্তের উইল লেখার পর কোনও এক পাঠক নাকি বঙ্কিমকে প্রশ্ন করেছিলেন–রোহিণীকে আপনি মেরে ফেললেন কেন? শুনি–বঙ্কিম নাকি এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন–ঘাট হইয়াছে। বস্তুত বঙ্কিম সাহিত্য-সৃষ্টির জন্য বিধবা রোহিণীর ওষ্ঠাধরে তাম্বুল রাগটিও এঁকে দেবেন, তার শরীরে আকর্ষণ-মন্ত্রও দেবেন, তাকে সৌন্দর্যও দেবেন এবং শেষে বিধবা বলেই আর কোনও অনাচার তিনি সহ্য করবেন না, তিনি বিধবাকে মেরে ফেলবেন। অপিচ মেরে ফেলে বলবেন–ঘাট হইয়াছে। আমরা মনে করি ওই একই আদর্শবাদ তার কৃষ্ণচরিত্রের মধ্যেও আছে, ফলে অভাগা গোপ-রমণীদের গলায় দড়ি-কলসী বেঁধে পৌরাণিক প্রক্ষেপ-পঙ্কে ডুবিয়ে মেরেছেন।

আর কী বলব! গোপ-রমণীদের কথা ছেড়েই দিলাম, কৃষ্ণের বিয়ে করা বউদের আটটির মধ্যে সাতটিকেও তিনি মানেন না। এমনকি আমাদের মতে সত্যভামা–জাম্ববতীর মতো ঐতিহাসিক-রমণীকেও তিনি কৃষ্ণ-জীবনের বাইরে রেখেছেন। বেচারা কৃষ্ণ! বঙ্কিমের জবানীতে স্বামীগতপ্রাণা রুক্মিণী ভিন্ন তার আর অন্য গতি নেই, যেমন ভ্রমর ছাড়া শেষ গতিটি নেই গোবিন্দলালের। আমরা বলি–সত্যিই তো, কৃষ্ণের মতো আদর্শ অবতার-পুরুষের পক্ষে অনন্যা রুক্মিণী ছাড়া আর কি কোনও স্ত্রী থাকা উচিত? ঔচিত্যের প্রশ্নে ঠিকই আছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কিন্তু মহাশয়! কৃষ্ণকান্তের উইল কীর্তনের সময় শুধু ভ্রমর আর গোবিন্দলালের আদর্শ প্রেমকাহিনীটুকু বর্ণনা করলেই তো পারতেন তিনি। শুধু শুধু এক কলঙ্কিনী বিধবা সুন্দরীকে কাহিনীর মধ্যে এনে আদর্শ কাহিনীর শুচিতা নষ্ট করা কেন!

বস্তুত জীবনের কাহিনী এমনটিই হয়, যেমনটি বঙ্কিম লিখেছেন। বিরাট ব্যক্তিত্ব আর আদর্শ পুরুষ বলেই কোনও মহান ব্যক্তির জীবনে কোনও পূর্ব-প্রণয় থাকবে না, এমনটি না ভাবাই ভাল। পূর্ব-প্রণয় যদি বা নাও থাকে, সেকালের আদর্শ পুরুষ প্রত্যেকেই রামচন্দ্রের মতো এক পত্নীব্রত হবেন, এমনটিই বঙ্কিম ভাবলেন কী করে। যেখানে যুধিষ্ঠির-নকুল-সহদেবেরও একাধিক পত্নী ছিলেন বলে শুনি, সেখানে কৃষ্ণের মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তির একাধিক পত্নী থাকবে না, এটাই বা কেমন কথা? আর সেকালে বহু বিবাহ আভিজাত্যের অঙ্গও তো ছিল বটে।

বঙ্কিমের যুক্তি কী রকম? না, রুক্মিণী ভিন্ন আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর পুত্র পৌত্র কাহাকেও কোনও কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় না। রুক্মিণী বংশই রাজা হইল। আর কাহারও বংশের কেহ কোথাও রহিল না। এই সকল কারণে আমার খুব সন্দেহ যে, কৃষ্ণের একাধিক মহিষী ছিল না।

 এ যে কী রকম যুক্তি, তার অন্ত খুঁজে পাই না। আমরা যদি বলি–সুভদ্রার বংশই হস্তিনাপুরে রাজা হল। আর কোনও বংশের কেউ কোথাও রইল না। অতএব সুভদ্রাই অর্জুনের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন, দ্রৌপদী মিথ্যে, চিত্রাঙ্গদা-উলুপীও মিথ্যে। তবে এটা কি কোনও যুক্তি হল? যাঁরা এমন কট্টরভাবে একমেবাদ্বিতীয়ের মত আঁকড়ে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে বৈষ্ণব রামানুজাচার্যের গুরু যামুনাচার্য ভারি সুন্দর একটা যুক্তি দিয়েছেন। স্পষ্টতই তিনি অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত ব্রহ্মের প্রস্তাব নিরসন করছিলেন। তিনি বলেছেন–এই চোল-দেশের রাজা পৃথিবীর অদ্বিতীয় সম্রাট, তাহলে বুঝতে হবে তার মতো খ্যাতকীর্তি রাজা আর দ্বিতীয় নেই জগতে। কিন্তু এ কথার মানে তো এই নয় যে, তাঁর পুত্র-পরিবার, ভৃত্য-নফর কেউ ছিল না–ন তু তৎ পুত্র-তভৃত্য-কলত্রাদি-নিবারণম্।

আমাদের যুক্তিও ঠিক একই রকম। কৃষ্ণের জীবনে রুক্মিণী তাঁর আত্মগুণে অদ্বিতীয়া পত্নী হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারেন। কিন্তু তাই বলে সত্যভামা, জাম্ববতী–এঁরা সব মিথ্যা হয়ে যাবেন, তা কী করে বলি। এঁদের ছেলে-পিলেরাও তো কম কাণ্ড করেননি, বিশেষত জাম্ববতী পুত্র শাম্ব। আসলে বঙ্কিমের যুক্তি বড়ই একপেশে। কৃষ্ণকে আদর্শস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি তার জীবনের অতি পরিচিত অংশগুলি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। বাদ দিয়েছেন এই ভয়ে যে, যদি তথাকথিত ন্যায়-নীতি-ভ্রষ্টতার অপরাধে তার আদর্শ অবতার-পুরুষটি কলঙ্কিত হন।

বঙ্কিমের দুর্ভাবনাটুকু বোঝা যায়। তিনি লিখেছেন–মনুষ্য কতটা নিজরক্ষা ও বৃত্তি সকলের বশীভূত হইয়া স্বতঃই কর্মে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু যে কর্মের দ্বারা সকল বৃত্তির সর্বাঙ্গীণ স্ফুর্তি ও পরিণতি, সামঞ্জস্য ও চরিতার্থতা ঘটে তাহা দুরূহ। যাহা দুরূহ, তাহার শিক্ষা কেবল উপদেশে হয় না–আদর্শ চাই। সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ ঈশ্বর ভিন্ন আর কেহ নাই।…

 অতএব যদি ঈশ্বর স্বয়ং সান্ত ও শরীরী হইয়া লোকালয়ে দর্শন দেন, তবে সেই আদর্শের আলোচনায় যথার্থ ধর্মের উন্নতি হইতে পারে। এই জন্যই ঈশ্বরাবরের প্রয়োজন। মনুষ্য কর্ম জানে না; কর্ম কিরূপে করিলে ধর্মে পরিণত হয় তাহা জানে না; ঈশ্বর স্বয়ং অবতার হইলে সে শিক্ষা হইবার বেশি সম্ভাবনা, এমত স্থলে ঈশ্বর জীবের প্রতি করুণা করিয়া শরীর ধারণ করিবেন, ইহার অসম্ভাবনা কি?

আমরা জানি–লোকশিক্ষার জন্য, শিষ্টের পালনের জন্য এবং দুষ্টের দমনের জন্য অবতার-পুরুষ কৃষ্ণের যথেষ্ট করুণা আছে। কিন্তু অনেক করুণা থাকা সত্ত্বেও তার নিজের জীবন-ব্যবহার অন্যের পক্ষে খুব আচরণীয় কর্তব্য বলে নির্দিষ্ট হয়নি। অন্যান্য পুরাণ কাহিনীগুলির মধ্যে কৃষ্ণের পূর্ব-জীবন যেভাবে অঙ্কিত হয়েছে, তার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, শুধু মহাভারতের মধ্যেই দ্রোণ-কর্ণ ইত্যাদি মহাবীরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কৃষ্ণ চরিত্র যেভাবে কলঙ্কিত হয়েছে, তাতে তিনি সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ হয়ে উঠেছেন কিনা, লোকে তাতে সন্দেহ করবে। বিশেষ সেই সব কূট আচরণের দ্বারা কর্ম ধর্মে পরিণত হবে কিনা, তা নিয়েও চিরন্তন প্রশ্ন আছে। বঙ্কিমের মতে কৃষ্ণ যতই মহাভারতের বিসমার্ক হন, বিসমার্কের রীতি-নীতি কি লোকশিক্ষার পক্ষে খুব উপযুক্ত।

আমরা তো বলি–বঙ্কিম যেমনটি চান, তাতে মহান রামচন্দ্রই একমাত্র ঈশ্বরাবরের আদর্শ হতে পারেন। দু-চারটে রাবণ-কুম্ভকর্ণ বধ করে অথবা কংস-শিশুপাল বধ করে অবতার পুরুষ যে ভূভার হরণ করেন, অবতার–গ্রহণের এই মুখ্য উদ্দেশ্যও মহামতি বঙ্কিমের মতে অতি অশ্রদ্ধেয় কথা। অবতারের কাজই নাকি শুধু আদর্শ স্থাপন। আমরা বলি–সেদিক দিয়ে রামচন্দ্রই হলেন সেই নরচন্দ্রমা, যিনি কথায় এবং কাজে সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। আর কৃষ্ণকে যদি এই ব্যাপারে বড় মানুষ মানতে হয় তবে তার জীবন থেকে খানিকটা খানিকটা খামচা খামচা তুলে এনে তবেই তাকে লোকশিক্ষার আদর্শ শিক্ষক হিসেবে মেনে নিতে হবে। নইলে তার সম্পূর্ণ জীবন ধরে প্রতিটি অভিব্যক্তির স্বরূপ বিচার করলে বঙ্কিমের বড়ই বিপদ হবে এবং এই বিপদ হবে বুঝেই তিনি পুরাণগুলির মধ্যে প্রক্ষেপ আর অধিক্ষেপের বন্যা বইয়ে দিলেন।

মহাভারত আর পুরাণের তথাকথিত প্রক্ষেপ-পঙ্ক থেকে কৃষ্ণকে উদ্ধার করে কৃষ্ণের কপালে যতই আদর্শ লোক-শিক্ষকতার তিলক টেনে দিন বঙ্কিমচন্দ্র, তাতে কৃষ্ণের থেকেও পুরাণ-ইতিহাসের লেখকদের প্রতি বড় অবিচার হয়ে গেছে। মহামতি বঙ্কিম কেন এই অদ্ভুত কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন আমরা জানি। পণ্ডিতজনে বলেন–১৮৯২ সালে কৃষ্ণচরিত্র প্রকাশিত হবার আগে রেভারেণ্ড হেস্টি নামে এক ভদ্রলোক কৃষ্ণের বৃন্দাবন-লীলা সম্বন্ধে নানা অকথা-কুকথা বলেছিলেন। কৃষ্ণ পূর্বজীবনে রাধা-চন্দ্রাবলীর সঙ্গে তার লাম্পট্য বিবৃত করে সাহেব-যাজক সাধারণ মানুষের মধ্যে কৃষ্ণ সম্বন্ধে বিরূপতা প্রচার করতে থাকেন। শোনা যায়, এই সাহেবের কুপ্রচার অপ্রমাণ করে কৃষ্ণকে এক মহান আদর্শ পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই বঙ্কিম কৃষ্ণচরিত্রের উপস্থাপনা করেন। যাজক-সাহেব এতে বিধ্বস্ত হলেন কিনা জানি না, কিন্তু বঙ্কিম এতে বড়ই তৃপ্ত বোধ করেছেন নিশ্চয়ই।

 সাহেবের বিরুদ্ধতা করে বঙ্কিম যা লিখলেন, তাতে তার দেশপ্রেম, স্বধর্মনিষ্ঠা বা বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা না করে কোনও উপায় নেই। কিন্তু একপেশে বিচার করতে গিয়ে তিনি যে একটু সাহেবদের তৈরি করা কলেই আটকে গেলেন, সেকথা বোঝাই কী করে। মনে রাখা দরকার, বঙ্কিম যখন কৃষ্ণ চরিত্র লিখছেন, তখন সাহেবরা এদেশের প্রাচ্যবিদ্যা নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন। কিন্তু এই শুরুর মধ্যে এশীয়–তথা ভারতবর্ষীয় সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা যতখানি ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ত্রুটি খুঁজে বার করার চেষ্টা। যে বিশাল শ্রবণ-মনন এবং চর্চার ওপর ভারতবর্ষের ধর্ম, দর্শন এবং সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত, সেদিকে না গিয়ে সাহেবরা নিজস্ব পদ্ধতিতে আমাদের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেন। তাতে সুফলও অনেক ফলেছে বটে, কিন্তু সেই তাদের নিজস্ব বিচার-পদ্ধতি আমাদের ভাগ্যে কিছু বিড়ম্বনাও এনে দিয়েছে।  

লক্ষণীয় বিষয় হল, বঙ্কিম রেভারেন্ড হেস্টির প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেভাবে কৃষ্ণচরিত্র প্রতিষ্ঠা করলেন, তাতে আদর্শের সুপ্রতিষ্ঠা হল বটে, কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠার জন্য যে বিচার-পদ্ধতি বেছে নিলেন, তা নিতান্তই বিদেশী। আপাতভাবে একটা ইংরেজ-বিরোধী মনোভাব সামনে রেখেও বঙ্কিম দেখাতে চাইলেন যে–দ্যাখ! যদি তোমার পদ্ধতিতেও বিচার করা যায়, তবু কৃষ্ণকে ধর্ম ও লোকশিক্ষার আদর্শ পুরুষ হিসেবে প্রমাণ করা যায়। বঙ্কিম সত্যিই তা করে দেখালেন এবং তার ফলেই অর্ধেক কৃষ্ণচরিত্রকে তিনি প্রক্ষিপ্তবাদের পাঁকে ডুবিয়ে দিলেন। বঙ্কিমের প্রতি আমাদের অসামান্য শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মনে হয়, এ কাজ বঙ্কিম না করে সাহেবসুবোরা করলেই ভাল করতেন।

কেন একথা বলছি শুনুন। আমরা ধরেই নিলাম মহাভারত পুরাণে পরবর্তী কবি-মহাকবিদের হস্তাবলেপ ঘটেছে। কিন্তু কোনও ক্রমেই সেগুলিকে মূল্যহীন বলতে পারি না অথবা ট্র্যাডিশন-বিরোধীও বলতে পারি না। তাছাড়া এই সমস্ত প্রক্ষেপের পৌর্বাপর্য-বিনিশ্চয় ক্ষমতা কার আছে? রামায়ণের বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ডকে পণ্ডিতজনেরা প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করেন, কিন্তু সেই প্রক্ষিপ্ত অংশ অবলম্বন করেই দ্বিতীয়-তৃতীয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই নাট্যকার ভাস তাঁর অভিষেক এবং প্রতিমা নাটক লিখেছেন। রামায়ণের তথাকথিত প্রক্ষিপ্ত অংশ অবলম্বন করেই কালিদাস তার রঘুবংশে মহাকাব্যের প্রতিভা বিকিরণ করেছেন এবং এই প্রক্ষিপ্ত অংশের উপাদানেই ভবভূতি তাঁর উত্তররামচরিত সৃষ্টি করেছেন।

মহাশয়! ভাস-কালিদাস-ভবভূতিরা গাধা-গোরু ছিলেন না, অন্তত সমালোচক সাহেব-সুবো এবং আধুনিক কিছু অনুপাসিত-গুরু ভারতবর্ষীয় গবেষকের চাইতে যে বেশি পণ্ডিত ছিলেন, সে কথা না বললেও চলে। তো এরা খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতে রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশের এত মূল্য দিয়ে থাকেন, তাহলে এই প্রক্ষেপগুলির প্রাচীনতা কত। কাজেই বঙ্কিম যতই প্রক্ষেপ-প্রক্ষেপ বলে গলা ফাটান, তাতে শাসক-সাহেবদের তৃপ্তি ঘটতে পারে, স্বদেশী পণ্ডিতজনের তাতে কিছু যায়-আসে না।

আরও একটা কথা বলি–কৃষ্ণ-চরিত্র লিখতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় বঙ্কিমচন্দ্র একবারও ভারতবর্ষীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের পরম্পরার কথা চিন্তা করলেন না। অবতার-পুরুষদের নিয়ে তারাও তো মাথা কম ঘামাননি। রামানুজ, নিম্বার্ক, বিষ্ণুস্বামী, মধ্বাচার্য, বল্লভাচার্য এবং পরিশেষে চৈতন্যদেব, রূপগোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, জীব গোস্বামী–এইসব বিশালবুদ্ধি পুরুষের বিচারও কি একেবারেই উপেক্ষণীয়? কৃষ্ণের পূর্বজীবনে যে বৃন্দাবনী সরসতা আছে, রাধারসমহিমা আছে, সেগুলিকে তো তারা লাম্পট্য বলেননি। তারা তো দর্শনের প্রতিষ্ঠায় কৃষ্ণের সরসতা প্রমাণ করেছেন। তাই সেগুলিকে একেবারে বিনা বিচারে উড়িয়ে দিই কী করে?

 বেশ বোঝা যায়, বঙ্কিম স্বেচ্ছায় সুপরিকল্পিতভাবে নিজ সিদ্ধান্ত সপ্রমাণ করার জন্যই কৃষ্ণচরিত্রের একাংশমাত্র উপস্থাপন করেছিলেন, কারণ তাতেই তার স্বমত প্রতিষ্ঠার সুবিধে হয়। অবশ্য কোনও গবেষক যদি স্বমত প্রতিষ্ঠার জন্য এমত একদশী নাও হন তবে তবুও তাতে খণ্ডাংশের সত্য-স্বীকৃতি থাকে, বঙ্কিমে তাও নেই।

আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই বঙ্কিমের নিজের সময়েই তার একদেশদর্শিতার জন্য প্রতিবাদ হয়েছিল। আপনারা ভাবতে পারেন কি, ব্রাহ্ম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থাতেও জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন–দ্যাখো, বঙ্কিম যে রকম করে কৃষ্ণচরিত্র আলোচনা করছে, তার একটা প্রতিবাদ হওয়া আবশ্যক। দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করেছিলেন এইভাবে

বঙ্কিমচন্দ্র শেষাশেষি যতই গীতাভক্ত হউন না কেন তিনি অনেকদিন ধরিয়া পাকা পজিটিভিস্ট ছিলেন। পজিটিভ ফিলসফি যাহাই হউক না কেন, শুধু মানুষকে লইয়া একটি পজিটিভ রিলিজন দাঁড় করাইবার চেষ্টা করিলে চলিবে কেন? রিলিজন কি অমনি গড়িয়া তুলিলেই হয়, পজিটিভিস্ট চাহিল একজন গ্র্যান্ড ম্যান, মহাপুরুষ। বঙ্কিমবাবু ভাবিলেন, এই তো আমাদের হাতের কাছে একজন গ্র্যান্ড ম্যান রহিয়াছেন; যেমন বিষয়বুদ্ধি, তেমনি পরমার্থজ্ঞান, এইরকম চৌকস মানুষ দরকার। অতএব আমাদের দেশে পজিটিভিস্ট রিলিজন দাঁড় করাইতে হইলে শ্রীকৃষ্ণকে গ্র্যান্ড ম্যান করিলেই সর্বাঙ্গসুন্দর হইবে। তবে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণকে আর মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণকে এক করিলে চলিবে না। ফলে দাঁড়াইল বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র।

 একবার ভেবে দেখুন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নিরাকার ব্রহ্মে বিশ্বাসী ব্রাহ্ম ছিলেন। পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথও তাই। দেবেন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রনাথের আত্মক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব অথবা পাণ্ডিত্য কিছু কম ছিল না। অন্তত পণ্ডিতজনেরা তাই বলেন। কিন্তু এঁরা ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণের পূর্বজীবনের প্রক্ষেপবাদিতাও স্বীকার করতে পারেননি, তাঁর বৃন্দাবনের জীবন এবং মহাভারতীয় জীবনের খণ্ডতাও মেনে নিতে পারেননি। এর কারণ কী? আমি নিজে একটা ধর্ম অবিশ্বাস করতেই পারি, আমি বৈষ্ণব না হতে পারি শাক্ত না হতে পারি, আমি নিরীশ্বরবাসী হতে পারি, আমি ব্রাহ্ম হতে পারি–কিন্তু কৃষ্ণ তো কোনও বৈষ্ণব, শাক্ত, বা ব্রাহ্ম নন। তিনি যে সমগ্র ভারতবর্ষের অন্তরাত্মার সঙ্গে জড়িত। তার বৃন্দাবনী সরসতা যে লীলার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। হঠাৎ করে এখন যদি তাকে বৃন্দাবন থেকে উচ্ছেদ করে দিয়ে, তার বাল্য, কৈশোর যৌবন বিসর্জন দিয়ে এক ধাক্কায় তাকে যদি মহাভারতের রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত করি, তাহলে কি সুবিচার হবে? না এতে তার সম্পূর্ণতা আসবে।

আমাদের তাই সেই শারদ রজনীটির কথা ভাবতেই হবে। সেই যেদিন সমস্ত গোপ–বৃদ্ধরা কৃষ্ণের আসল পরিচয় না পেয়ে দুঃখ নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। আর কৃষ্ণ বৃন্দাবনের শান্ত প্রকৃতির মধ্যে, তাল-তমালের বনের মধ্যে, উতলা হাওয়ার মধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন–গগনবিহারী চন্দ্রমা যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে। শারদ রাত্রির যুবক চাঁদ আর সুরম্য বনরাজি দেখে যুবক কৃষ্ণের হৃদয় আকুল হয়ে উঠল–

কৃষ্ণস্তু যৌবনং দৃষা নিশি চন্দ্রমসো বনম্।
শারদীঞ্চ নিশাং রম্যাং মনশ্চক্রে রতিং প্রতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *