০৭০. আমি দুর্বাসা

৭০.

আমি দুর্বাসা। তোমার বাড়িতে ভিক্ষা চাই।

এই কথাটাই সেকালের সমস্ত রাজা-মহারাজাকে সন্ত্রস্ত করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। দুর্বাসা, খ্যাপা দুর্বাসা এসেছেন কুন্তিভোজের কাছে। কয়েকদিন তিনি এই রাজভবনে অন্ন গ্রহণ করবেন। কুন্তিভোজ জানেন– এ বড় সৌভাগ্যের কথা, কিন্তু এই দুরূহ সৌভাগ্য তিনি শেষ পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা, সেই চিন্তায় তিনি এখন আকুল। দুর্বাসা যে সে মুনি-ঋষি নন। তার ক্রোধ-কোপ অত্যন্ত সুলভ, অভিশাপবাণী জিহ্বাগ্রে নৃত্য করছে সব সময়। তার এই আপাতমধুর ভাষণের মধ্যে, অথবা ব্রাহ্মণের মুখ-নিঃসৃত ভিক্ষা চাই–এই বহুশ্রুত যাচনার মধ্যে হয়ত কোনও ভয়ই নেই। কিন্তু যাচনার দ্বিতীয় পংক্তির মধ্যেই এমন একটা সাংঘাতিক শর্ত আছে, এবং সে শর্ত-পালনের সীমা ঠিক কত দূর তা ঠিক জানা নেই বলেই রাজরক্তও যেন হিম হয়ে যায় এবং তা হয় শুধু দুর্বাসা বলেই।

দুর্বাসা বললেন আমি কদিন থাকব তোমার ঘরে। তুমি বা তোমার সাঙ্গোপাঙ্গ কেউ যেন আমার অপ্রিয় আচরণ কোর নান মে ব্যলীকং কর্তব্যং ত্বয়া বা তব চানুগৈঃ। কেই বা সব জেনে-শুনে দুর্বাসা-মুনির অপ্রিয় আচরণ করবে? কুন্তিভোজও করবেন না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কুন্তিভোজ এও জানেন যে, দুর্বাসা মুনি অকারণের মধ্যেও কারণ খুঁজে বার করতে পারেন। সাধারণ চোখে যেটা কোনওভাবেই অপ্রিয় আচরণ নয়, দুর্বাসা সেখানেও অপ্রিয়তা তৈরি করতে পারেন। বলতে পারেন–এটাই আমার অপ্রিয় কাজ। কিসে কিসে তার অপ্রিয়তার কারণ ঘটতে পারে, তার এক আভাসও পাওয়া গেল দুর্বাসার কথায়।

দুর্বাসা বললেন–দেখুন মহারাজ আমার যখন ইচ্ছে বাইরে যাব। যখন ইচ্ছে আসব– যথাকামঞ্চ গচ্ছেয় আগচ্ছেয়ং তথৈব চ। আমি কোথায় থাকব, কোথায় বসব, কোথায় শোব– এসব নিয়ে যেন কোনও প্রশ্ন না ওঠে। আপনার লোকেরা কেউ যেন অন্যায়ভাবে এ সব ব্যাপারে মাথা গলিয়ে অপরাধ না করে বসে– নাপাধ্যত কশ্চন। অর্থাৎ দুর্বাসা বলেই দিলেন–অপরাধ করবার স্থান কোনগুলি। বোঝা গেল যেন, অশন-আসন, গমন-আগমন–এসব ব্যাপারে সাবধান থাকলেই আর কোনও ভয় নেই যেন। শেষে যেন একটু সতর্কিত করেই বললেন দুর্বাসা– যদি এইভাবে আমায় থাকতে দিতে পার তবেই আমি এখানে থাকতে পারি, ভেবে দেখ–এবং বৎস্যামি তে গেহে যদি তে রোচতে অনঘ। এর উত্তরে কুন্তিভোজ কী বলবেন? না, এরকমটি এখানে সম্ভব নয়? আপনি অন্যত্র যান। এ কথা বললে তক্ষুনি তো অভিশাপ। দুর্বাসা যখন থাকবেনই তখন নিজেদেরকেই দুর্বাসার রীতি-শ্রুতি অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হবে।

এই রকম একটা সঙ্কটকালে কুন্তিভোজ সমস্ত ব্যাপারটার মীমাংসা করলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। সারা জীবনের রাজ-অভিজ্ঞতার সঞ্চয় কাজে লাগিয়ে কুন্তিভোজ বুঝলেন দুর্বাসাকে প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র উপায় একটি যুবতী স্ত্রীলোক। না, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, শমপ্রধান মুনি-ঋষিরাও ইন্দ্রিয়পরবশতা ত্যাগ করতে পারেন না, অতএব সেই জন্যই কুন্তিভোজ একটি স্ত্রীলোককে ব্যবহার করতে চাইলেন। না, এটা ভাবার কারণ নেই। ইন্দ্রিয়পরবশতার সুযোগ নেবার জন্য নয়, বরং বলব, কারণটা আরও বেশি বাস্তব। কুন্তিভোজ জানেন– একটি পুরুষ, তিনি যত কঠোর বা হৃদয়হীনই হোন না কেন, তিনি একটি যুবতী স্ত্রীলোককে অনেক সহজে ক্ষমা কৰূতে পারেন। হৃদয়হীন হতেও তার একটু সংকোচ হবে ভিন্ন-লিঙ্গতার কারণে।

কুন্তিভোজ দুর্বাসার মুখে তার শেষ সাবধানবাণী শুনেছেন কেউ যেন কোনও অপরাধ না করে– নাপরাধ্যেত কশ্চন। এই সাবধান-বাণী যতটা না মুনির হৃদয়হীনতার ইঙ্গিত, তার থেকে অনেক বেশি সেই ভবিষ্যতের অপরাধীর প্রতি ক্ষমাহীনতার ইঙ্গিত। অন্তত এক সুন্দরী যুবতীর সরল স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে এই অপর্যাপ্ত অক্ষমা যদি প্রশমিত হয়, তাই একটি নামের কথাই তার মনে হল– পৃথা। কুন্তিভোজ বললেন– না, না, মুনিবর! আপনি এসব কী বলছেন। আপনার যেমন ইচ্ছে, তেমন করেই থাকবেন এবমস্তু। আপনার সমস্ত পরিচর্যার ভার থাকবে একটি মেয়ের ওপর। সে আমারই মেয়ে। ভারি বুদ্ধিমতী আর লক্ষ্মীমতী মেয়ে। যেমন তার স্বভাব–চরিত্র, তেমনই নিয়ন্ত্রিত তার ব্যবহার। ওর নাম পৃথা। আমার ধারণা ওর চরিত্র এবং ব্যবহার দেখলে আপনার সন্তুষ্টি হবে– তস্যাশ্চ শীলবৃত্তেন তুষ্টিং সমুপস্যতি।

রাজা কুন্তিভোজ যথানিয়মে অতিথিকে পাদ্য-অর্ঘ্য দান করে সুখাসনে বসালেন দুর্বাসাকে। দুর্বাসা একটু স্থিত হতেই কুন্তিভোজ ছুটলেন অন্দরমহলে। পৃথাকে তিনি এ বিষয়ে একটা কথাও এতক্ষণ বলেননি। তাঁর মতামতের অপেক্ষা না করেই তিনি দুর্বাসাকে কথা দিয়েছেন। অতএব সব তাকে জানানো দরকার। বিশেষত দুর্বাসার সমস্ত পরিচর্যার ভারই যখন কুন্তীর ওপর নির্ভর করছে, তাই আগে থেকে তাকে অবহিত করা দরকার। কুন্তিভোজ অন্তগৃহে পৌঁছে দেখলেন–ডাগর চোখে তার প্রতিপালিতা কন্যাটি চেয়ে রয়েছে একদিকে। সারাক্ষণ কী যে ভাবে এই মেয়েটা, কুন্তিভোজ বোঝেন না ভাল করে–উবাচ কন্যামভ্যেত্য পৃথাং পৃথুললোচনা।

কুন্তিভোজ বললেন–মা! এক বামুন ঠাকুর এসেছেন আমার ঘরে। তিনি কদিন থাকতে চান এখানে অয়ং বৎসে মহাভাগো ব্রাহ্মণো বস্তুমিচ্ছতি। তা আমি তার কথা শুনে বলেছি বেশ তো থাকুন এখানে, কোনও অসুবিধা নেই তথেত্যেবং প্রতিশ্রুত। কিন্তু জানিস মা! মুনির উপযুক্ত পরিচর্যা, এবং তার থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে যাতে কোনও অসুবিধে না হয় সে ব্যাপারে তাকে আমি চরম আশ্বাস দিয়েছি তোরই ভরসায়– ত্বয়ি বৎসে পরাশ্বস্য ব্রাহ্মণস্যাভিরাধন। এখন আমার কথা যাতে মিথ্যা না হয়, আমার দিক থেকে তাকে তুষ্ট করার আশ্বাস যাতে বিফল না হয়, তার জন্য তোকে একটু চেষ্টা করতে হবে মা।

কুন্তিভোজ এখনও পর্যন্ত কুন্তীর কাছে মুনির নাম করেননি। কারণ দুর্বাসার নামের মাহাত্ম্য এমনই যে তা শোনামাত্রই একজন তার কর্তব্য-কৰ্ম অস্বীকার করতে পারে, বিশেষত যখন তার মত না নিয়েই কথা দেওয়া হয়েছে। কুন্তিভোজ এখনও নাম করছেন না, তবে আকারে-প্রকারে বুঝিয়ে দিলেন যে, ইনি সাধারণ কোনও মুনি নন, ইনি দুর্বাসা। কুস্তিভোজ বললেন–এই তপস্বী মুনি নিয়ত বেদাধ্যায়ী এবং অসম্ভব তেজস্বী। যা যা তিনি বলেন, যা যা চান, সব তুই নির্বিবাদে যুগিয়ে চলবি, মা–যদ্য ক্ৰয়ান্মহাতেজা তত্তদ্দেয়মমৎসরাৎ।

কুন্তিভোজ এই কটা কথা বলেই থামতে পারতেন। কিন্তু দুর্বাসা মুনি আগেভাগেই তাকে যেভাবে সাবধান করে দিয়েছেন, তাতে ব্রাহ্মণদের পূজনীয়তা সম্বন্ধে একটা সামগ্রিক জ্ঞান দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না কুন্তিভোজ, তারা যে মাঝে মাঝে গৃহস্থের বিপন্নতাও তৈরি করতে পারেন–সেটা জানাতে ভুললেন না কুন্তিভোজ। ভুললেন না যে, তার কারণ একটাই–ইনি অন্য কেউ নন দুর্বাসা। সেকালে স্বাধ্যায়নিষ্ঠ ব্রাহ্মণের সম্মান ছিল বিশাল, অতএব সেইরকম এক ব্রাহ্মণের তুষ্টির জন্য পরিচর্যা-পরায়ণ গৃহস্থকে যে অনেক ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করতে হবে– সে কথা যেমন কুন্তিভোজ জানেন, তেমনই কুন্তীও জানেন। কিন্তু ব্রাহ্মণদের সেবা করা খুব ভাল, এই সাধারণ জ্ঞানদান করার পর–অমুক সময় বাতাপি ব্রাহ্মণকে অবজ্ঞা করে মুত্যুবরণ করেছিল, যদুবংশের তালজ রাজারা ব্রাহ্মণদের অবমাননা করে যমদণ্ড লাভ করেছিল– এইসব ঘোর ভীতিজনক উদাহরণ দিচ্ছেন কেন কুন্তিভোজ?

 অপ্রাসঙ্গিকভাবে এইসব উদাহরণ দিয়েই কুন্তিভোজ বললেন–এইরকম একজন মহাভাগ ব্রাহ্মণের পরিচর্যার সমস্ত ভার তোর ওপরেই দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি, মা–সোয়ং বৎসে মহাভাগ আহিতঃ ত্বয়ি সাম্প্রতম। ব্রাহ্মণের তীক্ষ্ণতা এবং সেইখানেই কুন্তীর নিযুক্তি থেকেই বোঝা যায় একজন তীক্ষ্ণতেজ, অভিশাপপ্রবণ মুনির পরিচর্যার ভারই কুন্তীর ওপর পড়েছে। আর কুন্তিভোজও ভালই জানতেন যে এক ব্রাহ্মণ আর দুর্বাসা মুনিতে তফাত আছে অনেক। দুর্বাসার যথেচ্ছ ব্যবহার, অপিচ তাঁর সাবধান-বাণী শোনা সত্ত্বেও কুন্তিভোজ যে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কুন্তীকে তার তুষ্টি-বিধানের জন্য নিয়োগ করলেন– এর মধ্যে তার নিজস্ব সচেতনতা এবং স্বার্থবোধও কাজ করেছে কিছু কিছু। একান্ত আপন ঔরসজাতা কন্যাকে তিনি কি এই ভয়ঙ্কর পরিচর্যা-কর্মে নিয়োগ করতে পারতেন? সন্দেহ হয়। আর ঠিক সেই জন্যই কুন্তিভোজকে তার মেয়ের কাছে সাফাই গাইতে হচ্ছে, টোক গিলে গিলে নানা কথা ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে, এমনকি চাটুকারিতাও করতে হচ্ছে। কুন্তীও বোধহয় সে কথা বুঝতে পারছেন এবং তার সারা জীবনের অশান্তির বীজ হয়ত বা এইসব সময়েই উপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

 কুন্তিভোজ বললেন– অতিথি ব্রাহ্মণদের সেবা-পরিচর্যার ব্যাপারে, তোর যে কত নিষ্ঠা, মা– সে তো আমি ছোটবেলা থেকেই জানি জানামি প্রণিধানং তে বাল্যাৎ প্রভৃতি নন্দিনি। গুরুজনদের প্রতি তোর যা ব্যবহার, আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবদের প্রতি তোর যে মমতা, এমনকি এই রাজবাড়ির কাজের লোক ঝি-চাকরদের ওপরেও তোর যে দয়া আছে, তাতে সব সময় মনে হয়–সমস্ত বাড়িটাতেই তুইই জুড়ে বসে আছিস মা ময়ি চৈব যথাবত্ত্বং সর্বৰ্মাবৃত্য বৰ্তসে। আমার এই রাজভবনে এবং অন্তঃপুরে এমন একটি মানুষও নেই, যে তোর ব্যবহারে অসন্তুষ্টন হ্যতুষ্টো জনোস্তীহ পুরে চান্তঃপুরে মম। লোক-ব্যবহারের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে সর্বত্রই তুই তোর উপস্থিতি প্রমাণ করছিস, মা। কিন্তু মা, এখনও তুই সেই ছোট্টটিই আছিস। বয়স তো খুব বেশি নয় তোর, তার ওপরে তুই যে আমার মেয়ে, পৃথা বালতি কৃত্বা বৈ সুতা চাসি মমেতি চ– তাই ব্রাহ্মণদের কোপের কথাটা একটু খেয়াল করতে বলছিলাম।

 কুন্তিভোজ এখানেও তার কথা শেষ করতে পারতেন। কিন্তু তা করলেন না। অপিচ বক্তব্য শেষ না করে, যেসব কথা তিনি এরপরে বলবেন, তার মধ্যে স্পষ্টত না হলেও, অতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে যা প্রকাশ পাবে, তার মধ্যে দত্তক পাওয়া কন্যার সম্পূর্ণ আত্মীকরণের সংবাদ তেমন করে মেলে না। কুন্তিভোজের কথার মধ্যে এমন এক মৌখিক আড়ম্বর ছিল, সেই আড়ম্বরের মধ্যেও এমন এক আপাত-মধুরতা ছিল, তার আড়াল থেকে তাঁর পিতৃত্বের কৃত্রিমতা সর্বাংশে যাচাই করা যায় না। কিন্তু যে রমণী মনস্বিনী এবং বিদগ্ধা যার পক্ষে যেমন কুন্তিভোজের যৎকিঞ্চিৎ সচেতনতা ধরে ফেলা অসম্ভব নয়, তেমনই তার পক্ষেও কুন্তিভোজের সরল কথা জটিল করে ধরা অসম্ভব নয়– যাকে জ্ঞান হওয়ার পর অন্য একটি গৃহে দত্তক দেওয়া হয়েছে।

 কুন্তিভোজের বক্তব্য নিবেদন করার আগে আমাদের ঘরের কথা বলে ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিই। ধরুন, একটি সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে পুত্রের কৃতিত্ব এবং অকৃতিত্ব নিয়ে কথা হচ্ছে। ধরুন, ছেলেটি একটি ভাল কাজ করেছে, এবং সেই ভাল কাজটা তার পক্ষে হয়ত যথেষ্টই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভাল কাজের মর্যাদার সামান্য একটু স্পর্শ পাবার জন্য মা স্বামীকে বললেন, আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম, ছেলে আমার এই করবে, সেই করবে… ইত্যদি। অর্থাৎ ছেলের গর্বে মা গরবিনী হলেন, তাঁর গলার শিরা ফুলে উঠল এবং পারলে সমস্ত জগতের কাছে যেন তিনি ঘোষণা করে দেন যে, ছেলেটি তারই স্বর্ণগর্ভজাত বলেই এই কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছে।

এবার ধরুন ছেলেটি একটি খারাপ কাজ করে এল এবং সেটাও তার পক্ষে স্বাভাবিক। তখন কিন্তু উপরিউক্ত জননী অন্য সুরে স্বামীকে বলবেন– আমি আগেই তোমাকে বহুবার বলেছি, তুমি তোমার ছেলে সামলাও। এইরকম হবে, আমি আগেই জানতাম। ইত্যাদি কথোপকথনের পর বংশের ধারা যাবে কোথায়, যেমন বাপ তেমন ছেলে– ইত্যাদি এবং নানান গার্হস্থ্য এবং দাম্পত্য বাদ-প্রতিবাদ এবং ঝগড়া-ঝাটি হতেই থাকবে এবং আমরা এইসব নৈমিত্তিক ঝগড়া-ঝাটির সঙ্গে অতি-পরিচিত। আমরা জানি, সংসার জীবনের গড্ডলিকা প্রবাহে বাবা-মায়েরা তাদের অতি প্রিয় সন্তানকে কখনও স্বসুখবাসনায় অঙ্গীকার করেন কখনও বা আপসে disown করেন। কিন্তু এই অঙ্গীকার বা অনঙ্গীকার সুস্থ-সরল সন্তানের মধ্যে অতিরিক্ত কোনও মনস্তাপ ঘটায় না। কিন্তু পুত্র-কন্যার জীবনের গতি যদি সরল না হয়, তা যদি বাঁধাধরা আহ্নিকগতির বাইরে কোনও জটিল পথ ধরে চলতে থাকে, তবে কিন্তু পিতা-মাতার অতি-সাধারণ তির্যক ভাষণও পুত্র-কন্যার মনে অনাত্মীয়করণের বীজ বপন করবে।

 কুন্তীকে আমরা জানি। তিনি কয়েক বছরের কিশোরী পৃথার জীবন মথুরায় কাটিয়ে এসে এখন কুন্তিরাষ্ট্রের রাজা কুন্তিভোজের ঘরে যৌবনবতী কুন্তী হয়েছেন। তাঁর কিশোর-মনের জটিলতা এমনই অস্ফুটচারে বয়ে চলেছিল, যা তাঁর নিজের কাছেও তত স্পষ্ট ছিল না হয়ত, পালক পিতা কুন্তিভোজের কাছে তো তা ধরা পড়বারই কথা নয়। কিন্তু নদীর গভীরস্থিত আবর্তের মতো কুন্তীর মনের গহনে কুন্তিভোজের আপাত-সরল কথাগুলি কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, তা আমরা এখন থেকেই ভাবতে থাকব।

 কুন্তিভোজ বললেন– বাছা! প্রসিদ্ধ বৃষ্ণিবংশে তুই জন্মেছিস। মহারাজ আর্যক শূরের তুই প্রথম মেয়ে– বৃষ্ণীনাং চ কুলে জাতা শূরস্য দয়িতা সুতা। তোর জন্মদাতা পিতা আর্যক আমার কাছে কথা দিয়েছিলেন যে, তাঁর প্রথম সন্তানকে তিনি আমার হাতে তুলে দেবেন। তিনি প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন। তিনি সানন্দে তাঁর অগ্রজাতা কন্যাটিকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন– দত্তা প্রীতিমতা মহং পিত্রা বালা পুরা স্বয়ম্। তিনি সপ্রতিজ্ঞ উচ্চারণে সানন্দে তার কথা রেখেছিলেন আজ তুই আমার মেয়ে তেনাসি দুহিতা মম।

 একজন পিতা, যিনি পূর্বে কোনওদিন সন্তানের মুখে বাবা ডাক শোনেননি, পত্নীর প্রথম গর্ভসঞ্চারে যিনি কুমারসম্ভবের গান শোনেন, সেই পিতা নিজের দয়িতা কন্যাকে তুলে দিয়েছেন অন্যের হাতে? এ কথা শুনে কুন্তীর কান কি জুড়িয়ে যাবার কথা। না হয়, কুন্তিভোজ তার পিতার ভাই এবং বন্ধুও, তবু সেই জন্মদাতা পিতা সানন্দে অন্যের হাতে দত্তক দিলেন তাঁর প্রথমজাতা কন্যাটিকে? কথাটা শুনলেই যেন সৃষ্টিলুপ্তির হাহাকার জাগে মনে, কুন্তীর মনেও কি সেই হাহাকার জাগল না? বাবা হয়ে অনেক্ট হাতে তুলে দিলাম– তাও না হয় বোঝা গেল–পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞার পীড়ন ছিল। কিন্তু সানন্দে দত্তা প্রীতিমতা মহ্যম? কুত্তীর হৃদয় চূর্ণ হল না?

কুত্তিভোজ বললেন– তুই তো যে সে মেয়ে নোস, মা। তুই আর্যক শূরের মেয়ে, বসুদেবের বোন তুই। যেমন প্রসিদ্ধ কুলে তুই জন্মেছিস তেমনই এক প্রসিদ্ধ কুলে প্রতিপালিত হয়েছিস। এ যেন এক সুখ থেকে আরেক সুখের মধ্যে এসে পড়েছিস, এক মহাহ্রদ থেকে আরেক মহাহুদে সুখাৎ সুখমনুপ্রাপ্তা হুদাদ হ্রদমিবাগতা।

আমরা জানি কুন্তী যখন কুন্তিরাষ্ট্রে যৌবনবতী হয়ে উঠেছেন, তখনই মহামতি বসুদেব মথুরার রাজনীতিতে কেউকেটা হয়ে উঠেছেন। কংসের মন্ত্রিসভার তিনি একজন বটে, কিন্তু যখন তখন কংসের বিরোধিতা করে রাজার বিরাগভাজন হয়ে ওঠায় এখন তিনি আরও বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। লোকে এখন তাঁকে কংসবিরোধী গোষ্ঠীর নেতা জানে। আর এত বড় নেতা বলেই কুন্তিভোজকে একবার সগৌরবে কুন্তীকে বলতে হয়–মহামতি বসুদেবের বোন তুই, আমার কন্যাস্থানীয়দের মধ্যে সবার ওপরে তোর স্থান– বসুদেবস্য ভগিনী সুতানাং প্রবরা মম।

 কুন্তিভোজ তার নিজের বাড়িতে কুন্তীকে যে আদরে মানুষ করেছেন, সেই আদর বা আগ্রহের মধ্যে স্নেহ–মমতার ফাঁক নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু ওই যে বললেন– এক সুখ থেকে আরেক সুখের মধ্যে এসে পড়েছিস, এক হ্রদ থেকে আরেক হ্রদে এই বক্তব্যটা কেমন শোনাল কুন্তীর কাছে? সুখ তো বটেই। রাজবাড়ির সুখ, সুখ নয়? কিন্তু কুন্তীর কাছে এ সুখের মূল্য কী? মহাভারতের কবি এইরকম একটা উপমা বহুত্র ব্যবহার করেছেন এক সুখ থেকে আরেক সুখ, এক হ্রদ থেকে আরেক হ্রদ। কিন্তু এই উপমাটি তিনি ব্যবহার করেছেন একটা ভিন্ন প্রসঙ্গে। যখন এক রাজবাড়ির মেয়ে আরেক রাজবাড়িতে বিবাহিতা হয়ে এলেন, তখনই সেই রাজকন্যা-রাজবধূর সম্বন্ধে মহাভারতের কবি প্রায়ই এই উপমাটি ব্যবহার করেছেন– এক সুখ থেকে আরেক সুখের মধ্যে তার আগমন ঘটল। এক হদ থেকে যেন আরেক হ্রদে। মহারাজ কুন্তিভোজ নিজের অজান্তেই যে উপমাটি ব্যবহার করলেন, সেটি কুন্তীর কানে কেমন শোনাল?

শৈশব-কৈশোরের পরিচিত বাবা-মায়ের কাছে একবার মানুষ হওয়ার স্বাদ পেয়ে, তাদের মা-বাবা বলে ডেকে তারপর অন্য এক বাড়িতে অন্য এক বাবা-মার কাছে মানুষ হওয়ার মধ্যে কী সুখ– তা কুন্তিভোজের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কুন্তী জানেন– সেই সুখ কী। পরের ঘরে অতিসুখে লালিত, প্রতিপালিত, প্রত্যেক পুত্র-কন্যাই জানেন সে সুখ কী। শুধুমাত্র রাজবাড়ির সাজাত্যে কুন্তিভোজ যা উচ্চারণ করলেন তা যে কুন্তীর সুখের হতে পারে না, তা পরিষ্কার বোঝা যায় এই অস্থান-পতিত উপমার ব্যবহারেই। কুন্তিভোজের বাড়ি কুন্তীর শ্বশুরবাড়ি নয়। যে বাড়িতে তিনি ছিলেন, সেখানে তিনি সুখেই ছিলেন যথেষ্ট। মহারাজ আর্যক শূরের আদরও কিছু কম ছিল না তার প্রতি। কুন্তিভোজ নিজেও সেকথা স্বীকার করেছেন– শূরস্য দয়িতা সুতা। সেখানে নতুন এক রাজবাড়িতে শুধুমাত্র প্রতিপালিত হওয়ার মধ্যে কুন্তীর কী সুখ থাকতে পারে?

কিন্তু এই সুখকে কুন্তী সুখ বলে না ভাবলেও কুন্তিভোজ ভাবছেন–বড় সুখ হয়েছে তার কন্যার। তা হোক। কিন্তু প্রসিদ্ধ বৃষ্ণিবংশের গৌরবের সঙ্গে নিজের বাড়ির রাজসুখের বাণী উপহার দিয়ে কুন্তিভোজ যে কুন্তীকে বড় মহিমান্বিত করে তুললেন,–এই মহিমাখ্যাপনের কারণ কিন্তু একেবারেই অন্য কিছু। কুন্তিভোজ জালেন–ওইরকম বিখ্যাত বৃষ্ণিকুলে যে জন্মেছে, আর এইরকম মহৎ কুলে যে বড় হয়ে উঠেছে–তাদৃশে হি কুলে জাতা কুলে চৈব বিবর্ধিতা– তাকে আমার জানাতে কোনও বাধা নেই যে, জান তো, মন্দ এবং নীচ বংশের মেয়েদের যদি খানিকটা আচার-নিয়মের মধ্যে রাখা যায়, তবে তারা চপলতাবশত যা করা উচিত নয় তাই করে ফেলে।

দৌধুলেয়া বিশেষেণ কথঞ্চিৎ প্রগ্রহং গতাঃ।
বালভাবাদ বিকুন্তি প্রায়শঃ প্রমদাঃ শুভে।

এই প্রসঙ্গে একটি কথা জানাই। আমি আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে দেখেছি। যাঁরা নিঃসন্তান, একটি শিশুপুত্রের জন্য তারা দুঃখে কাতর হন, তাদের আমি কখনও বলেছি–আপনারা অনাথ আশ্রম থেকে কাউকে দত্তক গ্রহণ করেন না কেন? তারা প্রথমে ইতি-উতি চেয়ে প্রথমে একটা উদাসীনতার ভাব দেখালেও, আমার সনির্বন্ধ আলোচনার বিস্তারে অনেকেই বলেছেন অনাথ-আশ্রম থেকে বাচ্চা আনব, কার না কার ছেলে, পরে কী রূপ ধরবে, বড় সন্দেহ হয় জানেন। আমাদের বক্তব্য– অনাথ আশ্রম তো অজানা জায়গা, কিন্তু পিতা-মাতার গুণদোষ যেখানে জানা থাকে, সেখানে দত্তক-নেওয়া সন্তানের চরিত্র-গুণ প্রকাশ পেলে সেটা প্রতিপালক পিতার গুণ হয়ে দাঁড়াবে; কিন্তু সেই দত্তক-গৃহীত সন্তানের দোয় দেখা গেলে সে দোষ বীজী পিতা এবং গর্ভধারিণী মাতার দোষ বলেই চিহ্নিত হবে। তাই হয়।

 কুন্তিভোজ এতক্ষণ যা বলছিলেন, তা ছিল সাধারণ উপদেশের মতো। কিন্তু এই এক্ষুনি যে কথাটা বললেন সেটা তো সাধারণ কোনও কথা নয়। মহাভারতের অন্যতম এক বিদগ্ধা নায়িকা এই মধুর উপদেশের মধ্যে কোনও ইঙ্গিত খুঁজে পাবেন না, এমনটি হয় নাকি? হঠাৎ এই মন্দ-নীচ বংশের কথাটা আসল কেন? কুন্তীকেই কি কুন্তিভোজের বাড়িতে অতিরিক্ত আচার-নিয়মের প্রগ্রহে রাখা হয়েছে? কুন্তিভোজের ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। অর্থাৎ নিয়ম-আচারের শৃঙ্খলের মধ্যে থেকেও দোষ বা চপলতা যদি কিছু ঘটে, তবে সেই দোষ অবশ্যই চেপে যাবে সেই বীজী বংশের ঘাড়ে! আরও পরিষ্কার করে বলা যায়– কুন্তিভোজ প্রসিদ্ধ বৃষ্ণিকুলকে এখন যতই ভাল-ভাল কথা বলে সাধুবাদ দিন, তেমন তেমন দোষের কিছু ঘটলে কুন্তিভোজ অনাত্মীকরণের সুযোগ ছাড়বেন না। তিনি disown করবেন এবং উপরি মন্তব্য সেই অনাত্মীকরণের গৌরচন্দ্রিকা। কুন্তী এসব কিছুই বোঝেন না।

কুন্তিভোজ তাঁর এই অদ্ভুত মন্তব্য ততোধিক অদ্ভুত তৎপরতায় মিশিয়ে দিয়েছেন চাটুকারিতার মধুভাষে। দুর্বাসার যথেচ্ছ ব্যবহার সহ্য করার ব্যাপারে যিনি সবচেয়ে কাজের হবেন, তাকে এক লহমার মধ্যে ভাবতে কুন্তিভোজের সময় লাগেনি। কিন্তু একটি যুবতী মেয়ে, যাঁকে তিনি নিজের মেয়ে বলেই মনে করেন, তার দিক থেকে এই কাজের সমস্যা কত তার সম্বন্ধে কুন্তিভোজ ওয়াকিবহাল আছেন যথেষ্টই। কিন্তু পৃথার অপূর্ব রূপ যে তার নিজেরই সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং সেই সমস্যা হলে কুন্তিভোজের প্রসিদ্ধ রাজকুলও যে এক ভয়ঙ্কর আবর্তের মধ্যে পতিত হবে সেই সম্বন্ধেও কুন্তিভোজের বক্তব্য, মন্তব্য দুইই আছে।

.

৭১.

মহারাজ কুন্তিভোজ তার যুবতী কন্যাকে দুর্বাসার সেবায় লাগালেন বটে, কিন্তু কন্যার যৌবন–=সন্ধির কারণে তার বিশেষ দুশ্চিন্তা রয়ে গেছে। কুন্তীর অলোকসাধারণ রূপলাবণ্য তাকে যে শমপ্রধান এক মহর্ষিরও অতি কাম্য করে তুলতে পারে, সে সম্বন্ধে কুস্তিভোজর সম্যক ধারণা আছে। কিন্তু অভ্যাগত মুনিকে তো আর গিয়ে বলা যায় না যে,–দেখবেন আপনি একটু সাবধানে চলবেন। যৌবনবতী কন্যা আমার, তার যেন কোনও ক্ষতি না হয়। এ কথা অতিথিকে বলা যায় না বলেই কুন্তিভোজ কন্যা কুন্তীকেই সাবধান করে বললেন–পৃথা! রাজবংশে তোর জন্ম মা! তোকে দেখতেও যে ভারি সুন্দর–পৃথে রাজকুলে জন্ম রূপঞ্চাপি বাদ্ভূতম্।

তিনি যে দেখতে সুন্দরী, সে কথা কুন্তীর অজানা নয়। পুরুষ মানুষের চোখ, সাধারণ জনের সপ্রশংস সম্ভাষণ এবং অন্য যুবতী-=-জনের ঈর্ষায় প্রত্যেক সুন্দরীই যেমন নিজের সৌন্দর্য সম্বন্ধে সচেতন হয়, কুন্তীও তেমনি নিজের সম্বন্ধে সচেতন। তিনি যে বৃষ্ণি রাজকুলের জাতিকা সে সম্বন্ধেও তাঁর সচেতনতা যথেষ্ট। কিন্তু এই সচেতনতা তো কুন্তিভোজের থাকবার কথা নয়। তিনি বৃষ্ণি–রাজকুলের এক বালিকাকে নিজের মায়ায় মানুষ করে যুবতীটি করে তুলেছেন। কিন্তু তাকে আজ এই আকালিক পৃথা সম্বোধন কেন? এই নামে তো তাকে চেনেন শুধু আর্যক শূরের বাড়ির লোকেরা। দুর্বাসাকে তুষ্ট করার প্রক্রিয়ায় এমন–সেমন যদি কিছু ঘটে, কুন্তিভোজ কি তার দায় গ্রহণ করবেন না বলেই পূর্বাহ্নেই তিনি কুন্তীর জন্ম–সম্বন্ধ স্মরণ করাচ্ছেন? তিনি একবারও বললেন না–অন্যথা কিছু ঘটলে–তুমি আমার মেয়ে–আমার সম্মান যাবে। বললেন–পৃথা! অর্থাৎ সেই শূর–=বংশের নাম–পৃথা! তোমার জন্ম রাজকুলে অর্থাৎ সেই বংশের মেয়ে হয়েও অন্য কিছু ঘটলে, আমার বংশের সম্মান যাবে–কৃৎস্নং দহ্যেত মে কুল–আমার বংশ ছারখার হয়ে যাবে।

 কুন্তিভোজের কথা থেকে বোঝা যায়–কুন্তীর অন্যায় যদি কিছু ঘটে–সে অন্যায় তাঁর রূপের জন্যই হোক, অথবা তার রাজবংশের সচেতনতায় দম্ভ-অহংকারের জন্যই সে অন্যায় ঘটুক–অন্যায় যদি কিছু ঘটে, তবে সে তার মূল বংশের দোষ, কিন্তু সে অন্যায়ের ফল যেহেতু কুন্তিভোজকেই ভুগতে হবে, অতএব তিনি সাবধানবাণী উচ্চারণ করছেন কুন্তীর পুরাতন বংশের নামেই–পৃথা! রাজকুলে তোর জন্ম, তোর রূপেরও কোনও অভাব নেই। তবে দুর্বাসাকে তুষ্ট করতে হলে তোকে তোর বংশের গৌরব ত্যাগ করে, রূপের অহংকার ত্যাগ করে–সা ত্বং দর্পং পরিত্যজ্য দম্ভং মানঞ্চ ভাবিনি–তার সেবা করতে হবে। তবেই তোর মঙ্গল হবে, মা! কিন্তু কোনওভাবে তিনি যদি অসন্তুষ্ট হন, তবে আমার বংশের যে সর্বনাশ হবে, মাকোপিতে চ দ্বিজশ্রেষ্ঠে কৃৎস্নং দহেত মে কুলম্।

কুন্তী সব বুঝলেন। যিনি মথুরার অন্যতম বৃষ্ণি গোষ্ঠীর নেতা আর্যক শূরের মেয়ে, যিনি কংস-রাজার বিরোধী গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ নেতা বসুদেবের ভগিনী, তিনি সমস্ত কথার ইঙ্গিতই বোঝেন। মহারাজ কুন্তিভোজের সমস্ত ইঙ্গিত অন্তরে রেখে মনস্বিনী কুন্তী এবার জবাব দিলেন। ভারি আশ্চর্য! কুন্তী পিতার সম্বোধনে কথা আরম্ভ করলেন না। বললেন–রাজন! রাজেন্দ্র! ভাবটা এই-দুর্বাসা মুনির মতো এক সুলভকোপ মহর্ষিকে সেবা করার জন্য যে শুষ্ক দায়িত্বভার কুন্তীর ওপর চাপালেন কুন্তিভোজ, সে দায়িত্ব প্রায় রাজকার্যের অঙ্গ। মুনির স্বভাব সম্পূর্ণ জেনেও এক পিতা তার দয়িতা কন্যার ওপরে এই দায়িত্ব চাপাতেন না। কিন্তু কুন্তিভোজ তার সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই যে দুর্বাসার কাছে কুন্তীর নাম উচ্চারণ করে তাকে ঋষির সেবায় নিযুক্ত করে দিলেন, এই ব্যবহার রাজার মতো। কুন্তীও তাই প্রথমে সাড়া দিলেন রাজকার্যের ইতিকর্তব্যতায়।

কুন্তী বললেন–আমি যথাসাধ্য নিয়ম-নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিজেকে বেঁধে নিয়েই অভ্যাগত ব্রাহ্মণ-ঋষির সেবা করব–ব্রাহ্মণং যন্ত্রিতা রাজন্ উপস্থাস্যামি সেবয়া। এই বাক্যে যন্ত্রিত শব্দের অর্থ নীলকণ্ঠের মতে নিয়ন্ত্রিতা। আমরা বলি–শব্দটাকে যন্ত্রের অনুষঙ্গে ধরলেই বা ক্ষতি কী? রাজার আদেশ, রাজার নিয়োগ–অতএব যন্ত্রের মতোই তো কাজ করতে হবে কুন্তীকে। কুন্তী ভাষা ব্যবহার করেছেন যন্ত্রের যন্ত্রণা দ্ব্যর্থকতার মধ্যে আবদ্ধ করে। কুন্তী বললেন–তুমি যেমনটি তাকে কথা দিয়েছ, সেইভাবেই তার সেবা করব। বামুন-ঠাকুরদের যত্ন-আত্তি করার ব্যাপারটা তো আমার স্বভাবের মধ্যেই পড়ে। আর সেই সেবার মাধ্যমে তোমার প্রিয় কর্ম করাও যেমন হবে, তেমনই আমারও তো মঙ্গল হবে–তব চৈব প্রিয়ং কার্যং শ্রেয়শ্চ পরমং মম।

দুর্বাসার জন্য কী কাজকর্ম করতে হতে পারে এবং গৃহস্থ বাড়িতে তার অবস্থানের রীতি-পদ্ধতি কুন্তীর পূর্বাহ্নেই জানা আছে। আর জানা আছে বলেই কুন্তিভোজকে তিনি সমস্ত দুর্ভাবনা থেকে নিশ্চিন্ত করে বলেছেন–তিনি যেখানে ইচ্ছে যান, যখন ইচ্ছে বাড়ি ফিরুন–সকাল, সন্ধে, রাত্রে, রাত-দুপুরে–যখন ইচ্ছে বাড়ি ফিরুন–যদেবৈষ্যতি সায়াহ্নে যদি প্রাতরথো নিশি–তবু আমার ওপরে রাগ করার কোনও সুযোগই পাবেন না তিনি। এতক্ষণ কুন্তিভোজের মুখে অনাত্মীকরণের যে সূক্ষ্ম ইঙ্গিতগুলি কানে শুনেছেন কুন্তী, এবার তিনি তা ফিরিয়ে দিচ্ছেন ততোধিক সূক্ষ্মতায়। কুন্তী বললেন–তোমার আদেশ যেমন পেয়েছি, রাজা। আমি সেই আদেশ অনুযায়ী তোমার হিত সাধন করব। তুমি একেবারে নিশ্চিন্ত থাক–বিশ্রক্কো ভব রাজেন্দ্র–তোমার বাড়িতে থাকাকালীন তার অন্তত এতটুকু অসুবিধেও হবে না। অন্তত আমার দিক থেকে আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব, যাতে ঋষিমশাইও খুশি হন, আর তোমারও যাতে ভাল হয়। তুমি নিশ্চিন্ত হও–আমি চেষ্টা করব–যতিষ্যামি তথা রাজন্ ব্যেতু তে মানসো জ্বরঃ।

মনে রাখা দরকার, কুন্তী বিদগ্ধা রমণী। তিনি জানেন যে, তার কালের সমাজে নমস্য ব্রাহ্মণ ঋষিদের সন্তুষ্টির ওপর যে কোনও রাজার মঙ্গলামঙ্গল নির্ভর করে। ব্রাহ্মণরা সন্তুষ্ট হলে অনুকূল জনমত তৈরি হয়, অনুকূল জনমত তৈরি হলে যে কোনও রাজার অস্তিত্ব এবং রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর যদি ব্রাহ্মণরা রাষ্ট্রের প্রতিকূল হন, তবে রাজার দিক থেকেও বিপরীত এক বিপ্লবের আশঙ্কা থাকবে। কুন্তী এই কথাগুলি জানেন–তারণায় সমর্থাঃ সু বিপরীতে বধায়। চ। বস্তুত তখনকার দিনের রাজারা যতই স্বৈরাচারী বলে পরিচিত হন না কেন তাদেরও একটা অ্যাকাউন্টেবিলিটি ছিল এবং সেই দায়বদ্ধতা সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে।

 আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন–রাজবাড়িতে ব্রাহ্মণরা অথবা ঋযিরা যেমন নানা সময়ে সদুপদেশ দেবার জন্য আসেন, তেমনি অনেক সময় তারা এসে এমন এমন সব অবাস্তব কাণ্ডকারখানা আরম্ভ করেন, কখনও বা অন্যায় অসভ্য ব্যবহার করে এমন সব ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে বসেন, যাতে মনে হবে ব্রাহ্মণ-ঋষিদের মতো অত্যাচারী জীব আর পৃথিবীতে নেই। আমাদের ব্যক্তিগত মতে এই অপব্যবহার-অত্যাচারের একটা অন্য তাৎপর্য আছে। আসলে স্বৈরাচারী রাজাকেও এঁরা সাময়িকভাবে অতি সাধারণ পরিশ্রমী মানুষের পর্যায়ে নামিয়ে এনে সাময়িকভাবেই তাদের ঐশ্বর্যের মোহমুক্তি ঘটান। একজন রাজা যখন ঋষি ব্রাহ্মণের জন্য চাকরের মতো খাটেন, একজন রাজপুত্র যখন তার ব্রাহ্মণ-গুরুর তুষ্টির জন্য তার অযৌক্তিক আদেশ শিরোধার্য করেন, একজন ঐশ্বর্যবান পুরুষ যখন তার অভিমান-মঞ্চ থেকে নেমে এসে ব্রাহ্মণের পাদজে আপন শির পবিত্র করেন, তখন রাজা, রাজপুত্র বা সমেশ্বর্যশালী পুরুষকে নেমে আসতে হয় মাটির ধুলোয়। তাকে প্রতিষ্ঠা পেতে হয় সাধারণ মানুষের সম-মাহাত্ম্যে। ব্রাহ্মণ-ঋষির অযৌক্তিক অপব্যবহার এবং অত্যাচারের তাৎপর্য এইখানেই। নইলে, দুর্বাসা, অগস্ত্য, বিশ্বামিত্রের খামখেয়ালিপনা গল্পকথা মাত্র।

 ব্রাহ্মণদের এই সামাজিক শিক্ষকতার ভূমিকা সম্বন্ধে কুন্তী সম্পূর্ণ অবহিত। কুন্তী বলেন–আমি তাদের যথেষ্ট চিনি বলেই তাকে তুষ্ট করব অবশ্যই–সাহমেদ বিজানী তোষয়িয্যে দ্বিজোত্তমম্। যেমনটি তুমি তাকে আশ্বাস দিয়েছ, আমি সেইভাবেই তাকে তুষ্ট করব। রাজা যদি অপরাধ করেন তবে ব্রাহ্মণরা তার অমঙ্গলের কারণ ঘটাবেন, সেটা আমি জানি বলেই, অন্তত আমার জন্য যাতে তোমার কোনও সমস্যা না হয়, সে ব্যাপারে আমি সযত্ন থাকবন মকৃতে ব্যথাং রাজ প্রাঙ্গ্যসি দ্বিজসত্তমা।

 মহারাজ কুন্তিভোজের কাছে এই সম্পূর্ণ বক্তব্য নিবেদন করার সময় কুন্তী একবারের জন্যও তাকে পিতা বলে ডাকেননি। কথারম্ভ থেকে কথা–শেষ পর্যন্ত সেই একই কৃত্রিম সম্বোধন–রাজ অথবা রাজেন্দ্র, অথবা নরেন্দ্র। কুত্তিভোজও নিজের এই কৃত্রিমতা বুঝেছেন বলেই কুন্তীর বক্তব্য শেষে তিনি তাকে জড়িয়ে ধরেছেন–পরিষজ্য সমর্থ চ। আসলে কুন্তিভোজকে কুন্তী একবারও বুঝতে দেননি–কোথায় তার লাগছে? কুন্তিভোজের কথা তিনি এমন সহমতে মেনে নিয়েছেন, কুন্তিভোজের শুভৈষণায় তারই প্রতিজ্ঞাত কর্তব্যকর্মগুলি এমনভাবেই তিনি সম্পূর্ণ করে দেবার আশ্বাস দিয়েছেন যে, তিনি একবারও বুঝতে পারলেন না–তার কোন্ অসচেতন আচরণ, কোন্ অসতর্ক শব্দ এই যুবতী-হৃদয়ের গভীরে ক্রিয়া করল।

কুন্তিভোজ কালবিলম্ব না করে পৃথা-কুন্তীকে সঁপে দিলেন দুর্বাসার হাতে–পৃথাং গরিদদৌ তস্মৈ দ্বিজায় দ্বিজবৎসলঃ। কুন্তিভোজ বললেন–এই আমার মেয়ে! বড় ছেলে-মানুষ! আর মানুষও হয়েছে বড় সুখে। যদি অন্যায় অথবা দোষ কিছু করে ফেলে, তবে মনে কিছু করবেন না–ন কাৰ্যং হৃদি তত্ত্বয়া। ও যথাসাধ্য আপনার সেবা করবে, আপনি সেই সেবা গ্রহণ করে কৃতার্থ করবেন ওকে। মুনি দুর্বাসা কুন্তিভোজের অনুরোধ আপাতত স্বীকার করে নিলেন সাধারণ ভঙ্গিতে–আচ্ছা সে দেখা যাবে। ঠিক আছে, ঠিক আছে–এইরকম কোনও উদাসীনতায়।

কুন্তিভোজ মুনির বসবাসের জন্য শ্বেতশুভ্র একটি গৃহের ব্যবস্থা করে দিলেন হংসচন্দ্রাংশুসঙ্কাশং গৃহমস্মৈ ন্যবেদয়ৎ। সেখানে থাকল একটি অগ্নিশরণ-গৃহ, যেখানে মুনির হোম-যজ্ঞের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। সঙ্গে থাকলেন পৃথা। তিনি রাজপুত্রীর সমস্ত দম্ভ-মান ছেড়ে, নিদ্রালস্য ত্যাগ করে মুনির সেবা করতে লাগলেন–নিক্ষিপ্য রাজপুত্রা! তন্দ্রীং মানং তথৈব চ। কথায় বলে–দেবতার আরাধনা করতে হলে শম-দমাদি সাধনের দ্বারা নিজের অন্তঃকরণবৃত্তিকে দেবতার পর্যায়ে উন্নীত করতে হয়–দেবো ভূত্বা দেবং যজেত। কুন্তী এক ঋষির সেবায় নিজেকে উপযুক্ত করে তোলার জন্য নিজেকে শৌচ-নিয়ম-ব্রতের বাঁধনে এমনভাবেই বেঁধে ফেললেন–পৃথা শৌচপরা সতী–যে, তাঁকেও এই সময় ঋষি-মুনির মতো শান্ত লাগছিল–তোয়ামাস শুদ্ধেন মনসা সংশিতব্রতা।)

ঋষি-মুনির শুচিতা নিয়ে কুন্তী তার প্রয়াস চালিয়ে গেলেও দুর্বাসা তাতে খুশি হবেন–এ কথা ভাবার কোনও কারণ নেই। দুর্বাসা যে-সে মুনি নন। তাঁর আচার-ব্যবহার, ব্রত-নিয়মের মধ্যেও এমন এক স্বেচ্ছাচারিতা আছে, যা অন্যের পক্ষে দুঃসহ। বাইরে যাবার সময় দুর্বাসা কুন্তীকে হয়ত বলে গেলেন–আমি সকালেই ফিরব; কিন্তু তিনি ফিরলেন সন্ধ্যাবেলা, অথবা রাত্রে–তত আয়াতি রাজেন্দ্র সায়ং রাত্রাবথো পুনঃ। কুন্তী না খেয়ে না দেয়ে বসে আছেন, নানারকম খাবার–দাবার সাজিয়ে, অথচ দুর্বাসার ফেরার নাম নেই। ভক্ষ-ভোজ্য পড়ে রইল, আসন-শয্যা সবই প্রস্তুত রইল, কিন্তু মুনি এলেন না। আবার যখন ফিরলেন, তখন তিনি অজস্র গালাগালিও দেবেন পৃথাকে। তিনি বলবেন–এখন কি ঘুমোনোর সময়, যে শয্যা প্রস্তুত করেছ? এখন কি খাবার সময়, যে খাবার নিয়ে বসে আছ? অথচ মুনি কখন খাবেন, কখন শোবেন, তারও কিন্তু কোনও ঠিক নেই। এমন অসময়ে বাড়ি ফিরে এমন অসম্ভব খাবার চাইবেন তিনি, যা ভাবা যায় না। কিন্তু পৃথার ভাণ্ডার এমনই যে মুনি তাকে কিছুতেই অপ্রস্তুত করতে পারেন না। পৃথা-কুন্তী সব সময়েই প্রস্তুত। কিন্তু তিনি প্রস্তুত থাকলেও গালাগালির বিরাম নেই, আর অপ্রস্তুতির কথা তো ভাবাই যায় না–নির্ভৎসনাপবাদৈশ্চ তথেবাপ্রিয়য়া গিরা। পৃথা কোনও কথা বলেন না, মুনির এই অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেন।

কিন্তু কারা সহ্য করেন এই ব্যবহার? গুরুর অত্যাচার শিষ্য বা শিষ্যা সহ্য করেন পিতার অমানবিক অত্যাচার পুত্র-কন্যারা সহ্য করেন, অথবা ভাইয়ের অত্যাচার সহ্য করে ভগিনী। অর্থাৎ রক্তের সম্বন্ধ আছে এমন জায়গায় অথবা বিদ্যালাভের প্রয়োজনে শিষ্য বা শিষ্যা যে অত্যাচার সহ্য করেন, পৃথা সেই অত্যাচার সহ্য করছিলেন বিনা কারণে। ঋষির কাছ থেকে পরম কোনও বিদ্যা লাভ করার বাসনা নেই তার। অথবা দুর্বাসা পিতা নন, ভাই নন, রক্তের সম্বন্ধের কেউ নন। কিন্তু সন্তোষণের বিধান এমনই দুরূহ কাজ, যেখানে পুত্র-কন্যার মমতা দিয়ে, শিষ্যের নম্রতা দিয়ে এবং ভাইয়ের জন্য ভগিনীর সহমর্মিতা দিয়ে পৃথা দুর্বাসার সমস্ত অত্যাচার হাসিমুখে মেনে নিচ্ছিলেন–শিষ্যবৎ পুত্ৰবচ্চৈব স্বস্বচ্চ সুসংযতা।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস স্তব্ধ হয়েও যে রমণী মমতা হারায় না, অতি বড় শত্রুও তার বশবর্তী হয়। দুর্বাসা আর যাই হোন, পৃথা-কুন্তীর শত্রু নন কোনও। নিস্তব্ধ আশ্রম ছেড়ে তিনি রাজবাড়িতে এসেছেন রাজার ধৈর্য পরীক্ষা করতে। কিন্তু রাজা যার মাধ্যমে এই ধৈর্যের পরীক্ষা দিলেন, তার কথা তিনিও তেমন করে ভাবেননি। তিনি ভীত–সন্ত্রস্ত হৃদয়ে তার কর্তব্য সেরেছেন সকাল-সন্ধ্যায় পৃথাকে সশঙ্কে জিজ্ঞাসা করে–পুত্রি! তোমার পরিচর্যায় ব্রাহ্মণ-ঋষি তুষ্ট হচ্ছেন তো–অপি তুষ্যতি তে পুত্রি ব্রাহ্মণঃ পরিচর্যয়া? পৃথা তাকে নিশ্চিত করে বলতেন–পরম সন্তুষ্ট। কোনও আশঙ্কার কারণ নেই। কিন্তু রাজবাড়ির সংস্রবচ্ছিন্ন সেই শ্বেতশুভ্র ভবনের মধ্যে যুবতী পৃথা কীভাবে মুনির সেবা-পরিচর্যা করে চলেছেন, তা শুধু তিনিই জানতেন। আর বোধহয় জানতেন সেই ঋষিও যিনি দিনের পর দিন এক অসামান্যা যুবতীকে শুধু ভৃত্যের পরিচর্যার মধ্যেই দেখেননি, দেখেছেন আরও সজীব কিছু।

 কুন্তী এই ভয়ংকর অতিথিকে দেবতার শ্রদ্ধাটুকু দিয়েছেন–দেববৎ পৰ্য্যতোষয়ৎ–কিন্তু তার পরিচর্যা করেছেন শিষ্যের মতো, পুত্রের মতে, ভগিনীর মতো। আমরা জানি–সেই শ্বেতশুভ্র ভবনের একাকী-পরিচর্যার মধ্যে সুমধুর কোনও স্বেচ্ছা সম্পর্কের অবকাশ ছিল। হয়ত বা স্বেচ্ছা-ব্যবহার কুন্তীর দিক থেকে অনীতিতম হলেও, শুষ্ক-রুক্ষ মুনির দিক থেকে তা ছিল অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া। কিন্তু সেইখানে কুন্তী ছিলেন স্থির। ব্রাহ্মণের পরিচর্যায় তার মমতা ছিল, কিন্তু অস্থিরতা ছিল না। মহাভারতের কবিকে তাই সেই অসাধারণ উপমাটি ব্যবহার করতে হয়েছে–স্বস্বচ্চ সুসংযতা। জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে কুন্তী যখন তার শ্বশুর ব্যাসদেবের কাছে নিজের পূর্ব-জীবনের সমস্ত স্বলন পতন ত্রুটির কথা উল্লেখ করবেন, তখন এই দুর্বাসার পরিচর্যা প্রসঙ্গও আসবে। কুন্তী তখন বলবেন–হৃদয়ের সমস্ত শুদ্ধতা এবং নিয়ম-ব্রতের শুচিতা দিয়ে আমি সেই মুনির সেবা করেছিলাম। মহর্ষি আমার সঙ্গে যে সব ব্যবহার করেছিলেন, তাতে আমার রাগ করবার অনেক কারণই ছিল, কিন্তু তবু আমি রাগ করিনি–কোপস্থানেপি মহৎসুকুপন্ন কদাচন।

আমরা জানি–কুন্তীর দিক থেকে এই কোপস্থানগুলি কী কী? অসময়ে আসা-যাওয়া, কিংবা ঋষির আসন-অশন-শয়নের উচ্ছঙ্খল আচরণ কুন্তীর ক্রোধ-ঘটনার কারণ নয়, অন্তত সে কথা আমরা বেশ জানি। সঙ্গে সঙ্গে এও জানি–কুন্তীর সৌন্দর্য ছিল অসামান্য। দুর্বাসার সেবাকাজে কুন্তীকে নিয়োগ করার আগে তার পালক পিতা কুন্তিভোজ পর্যন্ত তার রূপের জন্য তাকে সাবধান করেছিলেন। অথচ এই রূপ তিনি দুর্বাসার পরিচর্যা-তুষ্টিতে ব্যবহারও করেছিলেন। রূপ যেখানে সচেতনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে সেবা-পরিচর্যার কোনও অবসন্ন মুহূর্তে এই রূপের দিকে দুর্বাসা কখনও ফিরেও তাকাবেন না, অথবা শুষ্ক-রুক্ষ মুনিচিত্ত কখনই সে রূপের আতপ্ত ছোঁয়ায় দলিত মথিত হবে না, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং ধরে নিই, কোনও অসতর্ক মুহূর্তে অথবা কোনও অকারণের আনন্দে দুর্বাসা মুনির মন কুন্তীর প্রতি যদি কখনও সরস হয়েই থাকে অথবা ঘটে গিয়ে থাকে অশোভন চপলতা, তবে কুন্তীর দিক থেকে সেটা তাঁর রাগের কারণ হলেও সে রাগ তিনি সংযত করেছেন নিজের শৌচাচারের মহিমায়, সেই সরস চপলতা তিনি সযত্নে পরিহার করেছেন শিষ্যা, কন্যা এবং ভগিনীর ব্যবহারভূমিতে নিজেকে স্থাপন করে।

ঋষি দুর্বাসা সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হলেন। কুন্তীর চরিত্র এবং ব্যবহার-কৌশলেই তিনি ধীরে ধীরে সন্তুষ্ট হলেন কুন্তীর ওপরে–তস্যাস্তু শীলবৃত্তেন তুতোষ দ্বিজসত্তমঃ। সন্তুষ্ট তিনি ছিলেনই, কিন্তু পরীক্ষা আর নিরীক্ষার মাধ্যমে যখন তার ব্যবহার আর চরিত্রের মধ্যে কোনই ত্রুটি খুঁজে পেলেন না মহর্ষি,–নাপশ্য দুষ্কৃতং কিঞ্চিৎ পৃথায়াঃ সৌহৃদে রতঃ–তখন এই যুবতী রমণীকে তিনি স্নেহের চোখে দেখতে বাধ্য হলেন। ততদিনে এক বৎসর পার হয়ে গেছে। মহর্ষির বোধহয় এবার যাবার সময় হয়ে এল।

কুন্তীর সেবা-পরিচর্যায় সম্বৎসর কেটে গেলে একদিন দুর্বাসা ঋজু হয়ে দাঁড়ালেন কুম্ভীর সামনে। প্রণাম-নম্ৰা কুন্তীর কেশ থেকে ফুল ঝরে পড়েছিল দুর্বাসার পায়ে। দুর্বাসা বলেছিলেন–তোমার সেবা পরিচর্যায় আমি পরম সন্তুষ্ট হয়েছি, ভদ্রে!–প্রীতেস্মি পরমং ভদ্রে পরিচারেণ তে শুভে। তুমি বর চাও। এমন বর, যা মানুষ কখনও পায়নি। এমন বর, যাতে সমস্ত সীমন্তিনী বধূরা ঈর্ষায় কাতর হবে তোমাকে দেখে–যৈত্বং সীমন্তিনীঃ সর্বা যশসাভিভবিষ্যসি।

কুন্তী প্রার্থনা–কাতর মানুষের মতো লোভে চালিত হলেন না। দুর্বাসার কথা শুনে শান্ত মনে বললেন–কিছুই আমার চাইবার নেই। আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন, আপনার সন্তুষ্টিতেই সন্তুষ্ট হয়েছেন আমার পিতা, আমি আর কোনও বর চাই না–ত্বং প্রসন্নঃ পিতা চৈব কৃতং বিপ্র বরৈমর্ম। কতদিন পর আজ আবার কুন্তিভোজকে পিতা সম্বোধন করলেন কুন্তী। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে যে নির্মম আদেশ তার ওপরে নেমে এসেছিল, সেই আদেশ সম্পূর্ণ করার পরেই কুন্তিভোজকে পিতা সম্বোধন করার যুক্তি খুঁজে পেলেন কুন্তী। তাছাড়া ঋষি দুর্বাসার সামনে অন্তত কুন্তিভোজের পিতৃত্ব অস্বীকার না করে কুন্তী তার মর্যাদা রক্ষা করেছেন।

যাই হোক, কুন্তী যে দুর্বাসার কথা শোনামাত্রই লোভীর মতো বর চাইলেন না, তাতে দুর্বাসা বোধহয় খুশিই হলেন। বললেন–তুমি যদি একান্তই আমার কাছে কোনও বর নাই চাও, তবে আমি একটি মন্ত্র দিয়ে যাব তোমাকে। সেই মন্ত্রের বলে যে কোনও দেবতাকে আহ্বান করতে পারবে তুমি। শুধু তাই নয়, মন্ত্রের শক্তিতে যে দেবতাকেই আহ্বান করবে, তিনিই তোমার বশীভূত হবেন। তিনি তোমার প্রতি অকামই হোন বা সকামই হোন অর্থাং তোমাকে তিনি চান বা না চান, আমার মন্ত্রশক্তি তাকে তোমার ভৃত্যে পরিণত করবে—বিবুলো মন্ত্রসংশাতে ভবেদভৃত্য ইবানতঃ।

কী অদ্ভুত বরই না দিলেন দুর্বাসা! এক যৌবনবতী রমণীকে রাজেন্দ্রাণী হবার বর দেওয়া যেত, তাকে সসাগরা ধরিত্রীর ঐশ্বর্য-সম্পদে অভিষিক্ত করে রান করে দেওয়া যেত, কিন্তু ঋষি বর দিলেন–তুমি দেবতাকে বশীভূত করবে মন্ত্রবলে। তোমার প্রেমের ভৃত্য হবেন দেবতারা–তেন তেন বশে ভদ্রে স্থাব্যং তে ভবিষ্যতি। দুর্বাসার এই অতি মহান এবং অদ্ভুত বরের পিছনে এক অতি অদ্ভুত মনস্তত্ত্বও আছে বলে আমাদের মনে হয়। লোকচরিত্রের মহিমা এবং মনের গহন গতির সম্বন্ধে যদি সম্যক ধারণা থাকে, তবে বুঝবেন–যে সুন্দরী যুবতীকে দেখে আপনার ভীষণ পছন্দ হল, যাঁকে আপনি হৃদয়–প্রাণ দিয়ে ভালবাসবেন বলে ঠিক করলেন, দৈবক্রমে সেই যুবতী যদি আপনারই পরিচিত আরেকজনের কাম্য হয়ে ওঠেন, তিনি যদি তারই বধূ নির্বাচিত হন, তবে আপনার ভাল লাগবে না, হয়ত বা সহ্যও হবে না। অপরিচিত যারই সঙ্গে সেই রমণীর বিবাহ-সম্বন্ধ ঘটুক, আপনি তাতে অখুশি হবেন না, কিন্তু আপনার পরিচয়ের মধ্যে এই ঘটনা ঘটলে আপনার ভাল লাগবে না।

অন্তত এক বছর ধরে দুর্বাসা কুন্তীর কাছাকাছি ছিলেন একান্তে। তার সেবা-পরিচর্যা গ্রহণ করেছেন সাদর ঘনিষ্ঠতায়। আমরা দেখেছি–প্রথম দিকে দুর্বাসা যতই রাগ করুন, যতই ক্ষুব্ধ হোন, আস্তে আস্তে কুন্তীর গুণে নাকি রূপে?) তিনি মুগ্ধ হচ্ছিলেন। মহাভারতের কবির শব্দচয়ন লক্ষ্য করুন। তিনি বলেছেন–কন্যা-রমণীদের মধ্যে অনিন্দ্যসুন্দরী পৃথা মহামুনি দুর্বাসার প্রতি উৎপাদন করছিলেন–প্রীতিমুৎপাদয়ামাস কন্যারত্নমনিন্দিতা–এবং দুর্বাসাও আরও বেশি সময় কুন্তীর সাহচর্যে দিন কাটাচ্ছিলেন, যাতে কুন্তীর পরিচর্যা–স্পর্শ আরও বেশি করে পাওয়া যায় এবং সেদিকে মুনির আত্যন্তিক প্রয়াস তৈরি হচ্ছিল–অবধানে চ ভূয়োস্যাঃ পরং যত্নমথাকরো।

 হয়ত এইসব সময়েই, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো চপলতা কিছু ঘটে থাকবে। রুক্ষ-শুষ্ক ঋষি-হৃদয় কখনও হয়ত বিগলিত হয়ে কুন্তীর রাগের কারণ ঘটিয়ে থাকবে এইসব সময়েই। কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে কুন্তীকে পাওয়া এবং সেইরকম করে না পাওয়া, তার পরিচর্যা লাভ করার অফুরন্ত সুযোগ এবং একইসঙ্গে এক যুবতীর হৃদয়-লাভে নিজের অযোগ্যতা এবং অন্যায়-বোধ–এই সব কিছু মিলিয়ে দুর্বাসার মুনি-হৃদয়ে এক অদ্ভুত মিশ্র ক্রিয়া তৈরি করেছিল। তিনি নিজে যাকে পাননি কিংবা পাবার মধ্যে যদি তার হীনমন্যতা কাজ করে থাকে, তবে সেই মানসিকতা থেকেই তিনি কুন্তীকে এমন একটি মন্ত্র দিয়েছেন, যাতে চিরকাল তিনি মর্ত-মানুযের অপ্রাপ্য থেকে যাবেন। তারই মতো রক্তমাংসের কোনও মানুষ কুন্তীর শরীর এবং হৃদয়ের অধিকার পান–দুর্বাসা এমনটি চাননি বলেই, তিনি তাকে একান্তভাবে দেবভোগ্য করে রাখলেন। অকামই হোন আর সকামই হোন, দেবতার রমণ-বিলাসে মানুষের বিকার থাকে না বলেই মানুষের কাছে তা কাম্য নয়। দুর্বাসা কুন্তীকে অন্য সীমন্তিনী রমণীদের অপ্রাপ্য মন্ত্র দিয়ে যতখানি নিজের অপ্রাপ্যতার শোক মেটালেন, তেমনই মানুষের অপ্রাপ্য বর দিয়ে–বরং বৃণীঘ কল্যাণ দুরাপান্ মানুযৈরিহ–কুন্তীকেও বুঝি মানুষের সুখ থেকে বঞ্চিত করলেন কিছুটা।

দুর্বাসার দুরূহ মনস্তত্ত্ব মনস্বিনী কুন্তীও যে মনে মনে একটুও বোঝেননি, তা মোটেই নয়। বরং তাঁর বোঝাটা আমরা বুঝি তার ব্যবহার দেখেই। কুন্তী বর চাননি, দুর্বাসা বর দিয়েছেন। কিন্তু বর-গ্রহণের জন্য কুন্তীর আকুলতা নেই এখনও তিনি একবার দুর্বাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কিন্তু দ্বিতীয়বার আর তাকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস পেলেন না–ন শোক দ্বিতীয়ং সা প্রত্যাখ্যাতুনিন্দিতা। দুর্বাসার মুখে দুরন্ত অভিশাপের ভয় কুন্তীকে নুইয়ে দিল ব্রাহ্মণ মহর্যির চরণে–তদা শাপভয়ানূপ। কুন্তী বললেন–উপদেশ করুন, মুনিবর! সেই দেবতাত্মানের মন্ত্র উপদেশ করুন আপনি। দুর্বাসা তার দক্ষিণ হস্তের অভয় মুদ্রা প্রসারণ করে অথর্ববেদের শেষভাগে অবস্থিত দেবতার বশীকরণ মন্ত্রগুলি শিখিয়ে দিলেন সুন্দরী কুন্তীকে–ততস্তামনবদ্যাঙ্গীং গ্রাহয়ামাস স দ্বিজঃ মন্ত্রগ্রামং ভদা রাজন্ অথর্বশিরসি স্থিত।

মহাভারতের কবির কাছে ধন্যবাদ লাভ করবেন দুর্বাসা মুনি। তাঁর হাজার দোষ থাকতে পারে, তার হৃদয়ে জ্বলতে পারে অফুরন্ত ক্রোধ, অভিশাপ নৃত্য করতে পারে তার জিহ্বার অগ্রভূমিতে, কিন্তু দুর্বাসা, দুর্বাসার শাপ কবিকুলের একান্ত সহায়-সাধন। দুর্বাসার অভিশাপ অধ্যাহার করে কালিদাস তাঁর অভিজ্ঞানশকুন্তলে যেমন চরম নাটকীয়তা সৃষ্টি করলেন, তেমনই দুর্বাসার আশীর্বাদ-মস্ত্রও মহাভারতের কবিকে তার মহাকাব্য-প্রসারণের সুযোগ এনে দিল। দুর্বাসার মন্ত্রবলে আমরা এর পরে মহাভারতের বিপরীত-নায়ক সহায় কর্ণকে দেখতে পাব। দুর্বাসার মন্ত্রবলে পঞ্চ-পাণ্ডবের অমর সৃষ্টি ঘটবে। আবার দুর্বাসার মন্ত্রবলেই কুন্তীকে আমরা এক দেবভোগ্যা রমণীর বিষামৃতরসে পদে পদে কষায়িত এবং রসায়িত হতে দেখব।

কুন্তীকে দেবাহ্বানের অমন্দ মন্ত্রবর্ণ দান করে দুর্বাসা কুন্তিভোজকে বললেন–রাজা! বড় সুখেই আমার সংবৎসর কাল কেটে গেল তোমার গৃহে। তোমার মেয়ের সেবা-পরিচর্যায় আমি পরম সন্তুষ্ট হয়েছি–উষিতস্মি সুখং রাজ কন্যয়া পরিতোষিতঃ। এবার আমার যাবার সময় হল–সাধয়িষ্যামহে তাবৎ। দুর্বাসা চলে গেলেন, আর কুন্তীর গুণপনা দেখে মুগ্ধ-বিস্মিত হলেন রাজা কুন্তিভোজ। দুর্বাসার মতো মূর্তিমতী বিপন্নতা কুন্তীর মনস্বিতা আর পরিচর্যার গুণে এমন স্বচ্ছন্দে শান্ত হয়ে যাবে, এমনটি তিনি ভাবেননি। স্তব্ধ বিস্ময়ে বার বার তিনি কুন্তীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন–বভূব বিস্ময়াবিষ্টঃ পৃথাঞ্চ সমপূজয়ৎ। হয়ত তিনি বুঝলেন–পৃথা ছাড়া এ যাত্রায় তার বাঁচবার উপায়ই ছিল না।

.

৭২.

আগেই বলেছি, অশ্বনদী, যাকে আধুনিকেরা অশ্বথ-নদী বলে ডেকেছেন, ঠিক সেই নদীর ওপরেই কুন্তিভোজের রাজপ্রাসাদ। ভারতবর্ষের নদী-মানচিত্রে এই অশ্বনদীর কোনও আভিজাত্য নেই। ছোট্ট নদী কুলু-কুলু ধ্বনিতে চমতী নদীতে গিয়ে পড়েছে। চর্মতী গিয়ে পড়েছে যমুনায়। এমনিতে অশ্বনদীর জলে কোনও তরঙ্গ নেই। নেই উত্তাল আকুল কোনও চলোর্মির চাঞ্চল্য। কিন্তু যমুনার ভরা-জলে যখন জোয়ার-ভাটা খেলে, বর্ষার জলধারায় যখন যমুনা প্লাবিত হয়, তখন চমতীও ফুলে-ফেঁপে ওঠে, আর চমতীর সূত্র ধরে অশ্বনদীর মধ্যেও তখন ভীষণ চাঞ্চল্য দেখা যায়।

অশ্বনদীর ওপরে দাঁড়ানো কুন্তিভোজের রাজবাড়ির অলিন্দে আজ যে মেয়েটি একাকী দাঁড়িয়ে আছে, তার জীবনে কোনও তরঙ্গ ছিল না। এক রাজবাড়ি থেকে আরেক রাজবাড়িতে এসে তার জীবনে কোনও নতুন বৈচিত্র্য আসেনি। পিতা কুন্তিভোজ তাঁর দত্তক নেওয়া মেয়েকে যথেষ্টই ভালবাসেন, কিন্তু বৃষ্ণিরাজনন্দিনী তার পূর্ব জীবন এবং আধুনিক বয়ঃসন্ধির সমস্ত জটিলতার ঊর্ধ্বে উঠে এখনও এই রাজবাড়িকে সম্পূর্ণ অঙ্গীকার করে নিতে পারেননি। তার বৈচিত্র্যহীন জীবনে তার মনের গহনে পূর্ব-সঞ্চিত কতগুলি জটিল ভাবনাই শুধু বৈচিত্র্যের কাজ করে। কিন্তু আজকের দিনটি যেন একটু অন্যরকম। যমুনা-চমতীর উদ্বৃত্ত জল যেমন কোনও দিন অশ্বনদীর শান্ত জলের মধ্যে ঢুকে পড়ে তাকে চঞ্চল করে তোলে, তেমনি দুর্বাসা-মুনির মন্ত্র আজ তাকে উদ্বেলিত করে তুলেছে।

দুর্বাসা যুবতী পৃথার কানে দেব-সঙ্গমের রহস্য-মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন–এই সিদ্ধ-মন্ত্রে তুমি যে দেবতাকেই কাছে ডাকবে, সেই তোমার বশীভূত হবে। পৃথা-কুন্তীর যুবতী-হৃদয়ে দেব-সঙ্গমের এই মন্ত্র অদ্ভুত এক তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে। বারবার তার মনে হচ্ছে–সত্যি? এমনটি কি সত্যি হবে? আমি যে দেবতাকেই ডাকব, তিনিই আমার সামনে এসে দাঁড়াবেন? দুর্বাসামুনির মন্ত্রের এত শক্তি? পরক্ষণেই কুন্তী ভাবেন–লোকে তো আর মিথ্যে কথা বলে না। দুর্বাসার অভিশাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়, আর আশীর্বাদ ফলবে না? তিরস্কারের শব্দ কষ্টকর হলেও তা যেমন সত্য, তেমনই ঋষির আশীর্বাণী মধুর শোনালেও তা সত্য ভাবতে সন্দেহ জাগে মনে–এইটুকুই যা দ্বিধা।

কুন্তীর যুবতী-হৃদয় বলে–অত-শত ভাবনার কী? দুর্বাসার মন্ত্র পরীক্ষা করে দেখলেই হয়। কুন্তীর বুদ্ধি বলে–খবরদার! সমাজের বিধিতে তোমার বিয়ে হয়নি এখনও। বিবাহের পূর্বে দিব্য মন্ত্রের কৌশলে মুহূর্তমাত্র দেব-সঙ্গমে কী সুখ তোমার? তার মধ্যে ভালবাসা নেই, প্রেমের সদাচার নেই, রসতার অনুশীলন নেই, শুধু কাম–মন্ত্রের সাধনায় পুত্র প্রসব করে কী আনন্দ তোমার? তাছাড়া কুন্তিভোজ কী বলবেন? বিবাহের পূর্বেই পুত্র প্রসব করে তোমার পালক পিতার কী গৌরব বাড়াবে তুমি? কুন্তীর যুবতী-হৃদয় মানে না। হৃদয় বলে–এত ভাবনার কী আছে? এই উত্তাল যৌবন তোর শরীরে। চিরকালের বসন্ত-বাতাস দোলা দিচ্ছে। মনে। মানুষের সঙ্গম তো দৃষ্ট-শ্রুত, প্রচলিত। কিন্তু ঋষির আশীর্বাদে আজ যখন কল্প-লোকের দেবতাদের সঙ্গম-রহস্য তোর করতলগত, তবে পরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কী? ঋষি বলেছেন সকাম হোক আর অকাম হোক, দেবতা তোমার বশীভূত হবেন। তাহলে কুন্তিভোজকেই ভয় কী? দেবতা স্বর্গ থেকে খুঁয়ে নেমে আসেন কি না, এই পরীক্ষাটুকু সত্য হলেই যথেষ্ট। মন্ত্রগ্রামো বলং তস্য জ্ঞাস্যে নাতিচিরাদিব–তারপর ঐশীভূত দেবতাকে স্বর্গের পথে ফিরিয়ে দিলেই হবে।

কুমারী-যুবতীর হৃদয়ে দেব-সঙ্গমের অবিরল চিন্তা-ভাবনা, দ্বিধা দ্বন্দ্ব কুম্ভীর ঋতুভাব ত্বরান্বিত করল–এবং সঞ্চিন্তয়ী সা দদর্শর্তং যদৃচ্ছয়া। সামান্য একটু লজ্জাও হল কুন্তীর। বয়ঃসন্ধির প্রান্ত ভূমিতে এসে এতদিনও কুমারীর স্বচ্ছন্দতা উপভোগ করছিলেন তিনি। কিন্তু আজ এই কী মন্ত্র দিয়ে গেলেন ঋষি–অয়ং বৈ কীশনে মম দত্তো মহাত্মনা–কুত্তার মনের মধ্যে দেবপুরুষের কল্পিত সান্নিধ্য তার শরীরের মধ্যেও যে এক নতুন স্রোত বইয়ে দিল। কুন্তীর বড় লজ্জা হল–ব্রীড়িতা সাভবদবালা কন্যাভাবে রজস্বলা।

 দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-লজ্জা–সব কিছু মিলিয়ে সেই রাতটা কাটল। ঋতুর দিনও শেষ হল। পরের দিন সকালে তার ঘুম ভেঙে গেল খুব তাড়াতাড়ি। দেব-সঙ্গমের স্বাধীনতা এবং কৌতূহলে যে মন আকুল হয়ে আছে, সেই আকুলতা তাঁকে কোমল শয্যার মধ্যেই জাগরিত করে তুলল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রাতঃসূর্যের রক্তিম করস্পর্শ যুবতী কুন্তীর মুখে, গালে গণ্ডদেশে অনুভূত হল যেন। আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর। কুন্তী যেখানে শুয়ে থাকেন তার সামনেই বিশাল এক গবাক্ষপথ। রাত্রির দীর্ঘ-বিরহ অতিক্রম করে সূর্য যেমন আপন রক্তিম করস্পর্শে পূর্বদিবধূর গণ্ডদেশ রাঙিয়ে দেন, আজকে ঠিক তেমন করেই রাজভবনের দীর্ঘ গবাক্ষ-পথ দিয়ে প্রবেশ করে সূর্য তার প্রথম কিরণ-কর-স্পর্শে রাঙিয়ে দিলেন কুন্তীকে, তার কপালে এঁকে দিলেন রক্তিম চুম্বন।

 এমন তো প্রতিদিনই হয়। কুন্তী খেয়াল করেন না। কিন্তু আজ তাঁর কাছে দেব-সঙ্গমের সমস্ত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে যাওয়ায় মনুষ্য–কল্পনার প্রথম দেবতা সূর্য তার কাছে সম্পূর্ণ সজীব মূর্তিমান হয়ে ধরা দিলেন। আজ যেন বেদ–বেদান্তের সারাৎসার বহুশ্রুত সেই আলোক পুরুষটি, যাঁকে ধ্যানে জানতে হয়–ধ্যেয়ঃ সদা সবিতৃমণ্ডল-মধ্যবর্তী–তাকে যেন সম্পূর্ণ দেখতে পেলেন কুন্তী। মহার্ঘ্য শয্যায় শুয়ে-শুয়েই তিনি জ্যোতিষ্মন পুরুষের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন, তাঁর মন যেন সপুলকে অনুভব করল তাকে–তত্র বদ্ধমনোদৃষ্টিরভবৎ সা সুমধ্যমা।

 রাত্রি দিনের সন্ধিলগ্নে উপস্থিত স্তিমিত এই সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে তার এতটুকু কষ্ট হল না। কুন্তী দেখতে পেলেন–এই পুরুষের গায়ে সোনার বরণ বর্ম আঁটা আছে, সুবর্ণ কুণ্ডল জ্বল জ্বল করছে দুই কানে–আমুক্তকবচং দেবং কুণ্ডলাভ্যাং বিভূষিতম্। হাতে সোনার কেয়ুর। গায়ের রঙ মধুর মতো পিঙ্গল। কুন্তীর মনে হল–দেবতা যেন হাসছেন তার আসঙ্গ-লিপ্সা বুঝতে পেরে–মধুপিঙ্গো মহাবাহুঃ কম্বুগ্রীবো হসন্নিব।

মহাভারতের কবির এই বিদগ্ধ-বর্ণনা শুনতে শুনতেই আমাদের কিন্তু মাথায় রাখতে হবে–কবি কিন্তু তাঁর পূর্বযুগের পরম্পরা নষ্ট হতে দেননি এখনও। বেদের মধ্যে আমরা সূর্যের স্বরূপ যেমনটি দেখেছি, তাতেও সমস্ত অভিরাম বর্ণনার মধ্যে সূর্যের একটা নায়কোচিত বিলাস বেশ ভাল করেই চোখে পড়ে। বৈদিক কবি সূর্যকে সুন্দরী ঊযার বসনাঞ্চলের প্রান্ত ধরে তারই পিছন পিছন সানুরাগে অনুগমন করতে দেখেছেন এবং তা ঠিক মনুষ্যলোকের অনুরাগী যুবক-যুবতীরই অনুকরণে–সূর্যো দেবীমুষসং রোমানাং/মর্যো ন যোবা অভ্যেতি পশ্চাৎ। মহাভারতের কবি তার মহাকাব্যের অন্যতম নায়িকাকে প্রথমেই মর্ত মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে পারেননি। বৈদিক যুগের প্রাগ্রসর দেবতা-পুরুষ সূর্যের নায়কত্ব কল্পনা করে কবি এখানে বৈদিক যুগের ঐতিহ্য মেনে নিয়েছেন। কিন্তু সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁর মহাকাব্যের কবি-কল্পনা মিশে গেছে। ইতিহাস-পুরাণের যুগে সূর্যের বৈদিক কল্প নারায়ণ-বিষ্ণুতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা নারায়ণের ধ্যান করেছি সবিতৃমণ্ডলমধ্যবর্তী এক পুরুষ রূপে। তারও কানে সুবর্ণ-কুণ্ডল, মাথায় কিরীট, হাতে কেয়ূর–কেয়ূরবান্ কনককুণ্ডলবান কিরীটী/হারী হিরন্ময়বপুঃ।

কুন্তীও সূর্যের এই মূর্তি দেখতে পেয়েছেন–অঙ্গদী বদ্ধমুকুটো দিশঃ প্রজ্বালয়ন্নিব। আমরা মহাভারতের কবির বৈদিক রসবত্তা নষ্ট করে কখনই এই জ্যোতিমূর্তিকে নারায়ণ বলব না। বলব সূর্য। বলব এই কারণে যে, ঋগবেদে সূর্যের মতো কুলীন দেবতা আর কে আছেন? এমনকি অন্য সমস্ত বৈদিক দেবতাকেও সূর্যেরই বিভূতি বলে কল্পনা করা হয়। অধ্যাপক সীতারাম শাস্ত্রী সমস্ত বৈদিক মন্ত্রেরই সূর্যনিষ্ঠ ব্যাখ্যা করতে ভালবাসতেন। তাছাড়া সূর্য এমনই এক দেবতা, যিনি শুধু ভারতবর্ষ নয়, গ্রিস-রোম-মিশর এবং সমস্ত পুরাতন সভ্যতাতেই তার জয়কার সগৌরবে ঘোষিত। পরবর্তীকালের যে সমস্ত দেবতা প্রধান এবং কুলীন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন, মিথলজিস্টরা তাদের সৌরমূল (Solar origin) আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হন। আমরা তাই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, মহাভারতের কবি তাঁর সহস্র কল্পনায় বিকশিত মহাকাব্য রচনা করতে গিয়েও সমস্ত বৈদিক দেবতত্ত্বের মূল সূর্যকেই তাঁর প্রথমা নায়িকার নায়ক হিসেবে নির্বাচন করতে ভুল করেননি। এতে একদিকে যেমন তার পূর্বসূরি বৈদিক কবিদের প্রতি শ্রদ্ধা সূচিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি সূর্যকে পুরুবিধ কল্পনা করে, তিনি তার মহাকাব্যের নায়িকাকে নায়ক নির্বাচনের সুযোগ খুঁজে নিয়েছেন।

সূর্যের কবচী-কুণ্ডলী সর্বোদ্ভাসী রূপ দেখে কুন্তী মুগ্ধ হলেন। দুর্বাসার দেওয়া মন্ত্রের প্রথম পরীক্ষা যদি করতেই হয়, তবে এই অসাধারণ দেবতার ওপরেই তার প্রথম প্রয়োগ করতে হবে বলে কুন্তীর মনে হল। প্রণাম-আচমন করে শুদ্ধ হয়ে কুন্তী দুর্বাসার দত্তমন্ত্র উচ্চারণ করলেন, আর তার অন্তরে ভাবিত হল সোনার বর্ম পরা, সোনার মুকুট আর সোনার কুণ্ডল পরা সূর্যের সেই দৃপ্ত রূপ। কুন্তী সূর্যকে নিজের কাছে আসার জন্য আহ্বান-শব্দ উচ্চারণ করলেন দুর্বাসার মন্ত্রে–আহ্বানমকরোৎ সাথ তস্য দেবস্য ভাবিনী।

মন্ত্রের শক্তি সঙ্গে সঙ্গে অনুভূত হল। জ্যোতির্ময় সূর্য–পুরুষ নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করলেন–যোগাৎ কৃত্বা দ্বিধাত্মান। তার জ্যোতিঃস্বরূপে তিনি তাপ বিকিরণ করতে থাকলেন আগের মতোই, আর তার পুরুষ–স্বরূপে তিনি রাজভবনের গবাক্ষপথে নেমে এলেন কুন্তীর কাছে। হিরণ্যবর্ণ, কানে কুণ্ডল, গায়ে সোনার বর্ম আঁটা, মাথায় বদ্ধমুকুট।

 অবাক বিস্ময়ে কুন্তীর শরীর-মন মুকুলিত হয়ে উঠল। দুর্বাসার মন্ত্র এমন করে সত্যি হয়ে উঠবে, তিনি ভাবেননি। দেবপুরুষ সূর্য কুন্তীর সামনে এসে প্রথমে সম্ভাষণ করলেন–ভদ্রে। সম্বোধনটা অনেকখানি ফরাসিদের মাদামের মতো। প্রথম আলাপের দূরত্ব এবং ভদ্রতা দুই-ই এতে বজায় থাকে। সূর্য বললেন–ভদ্রে! আমি এসেছি তোমার কাছে। তোমার মন্ত্রের শক্তি আমাকে বাধ্য করেছে তোমার বশীভূত হতে–আগতোস্মি বশং ভদ্রে তব মন্ত্ৰবলাৎকৃতঃ। এই শব্দটা আমরা চিনি। বলাৎকার, বলাৎকৃত–এই সব শব্দের অর্থ এবং ভাবের মধ্যে ভালবাসার কোনও ব্যঞ্জনা নেই। ভাবটা এই–তোমার মন্ত্রই এই বলাৎকার ঘটিয়েছে, আমি স্বেচ্ছায় তোমার কাছে আসিনি। কী করতে হবে বল। যা বলবে, তাই করব–কিং করোমি বশশা রাজ্ঞি ব্রহি কর্তা তদস্মি তে।

কুন্তী কি এইরকমটি চেয়েছিলেন? প্রভাতসূর্যের রক্তিম কিরণ-কর-স্পর্শে যিনি রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন, তিনি শুধু মন্ত্রের সত্যরক্ষার জন্য তার সঙ্গে মিলিত হবেন, এ যে তার কাছেও বলাৎকার। প্রেমের স্পর্শহীন এক দৈহিক ব্যায়াম। এমনটি তিনি চাননি। অন্তত তাঁর উম্মত রোমাঞ্চের প্রত্যুত্তর হতে পারে না এই যান্ত্রিকতা। অতএব সঙ্গে সঙ্গে দেবতা-পুরুষের সমস্ত স্তুতি-নতি-বশ্যতা প্রত্যাখ্যান করে কুন্তী বললেন–ভগব। অর্থাৎ পরম শক্তিমানের প্রতি নিতান্ত দুর্বলের দূরত্বের সম্বোধন। ভগবন! আপনি চলে যান এখান থেকে। যেখান থেকে আপনি নেমে এসেছেন এইখানে, সেইখানেই প্রত্যাবর্তন করুন আপনি–গম্যতাং ভগবংস্তত্র যত এবাগতত হ্যসি।

 কুন্তী নিজের কুমারীত্বের কথাও স্মরণ করলেন বুঝি। অপরিচিত পুরুষ যদি প্রথম দর্শনেই রমণীকে বলে–আমি তোমার বশীভূত, যা বল, তাই করব, রমণী তখন নিজের লালিত কুমারীত্ব-হানির ভাবনা করে। হয়ত সেই ভাবনা মনে রেখেই কুন্তী বললেন–আমি নিতান্ত কৌতূহলে আপনাকে একবার শুধু ডেকেছিলাম। আপনি মনে কিছু করবেন না, ফিরে যান–কৌতূহলাৎ সমাহূতঃ প্রসীদ ভগবন্নিতি। এখানে সংস্কৃতের প্রসীদ শব্দটি বাংলা ভাষায় তর্জমা করলে ঈপ্সিত অর্থ পাই না। প্রসীদ শব্দটা বাংলার প্রসন্ন হোন-এর থেকে অনেক বেশি স্মার্ট। তাই কুন্তীর অনুরোধ বাংলায় সঠিক তর্জমা করলে দাঁড়ায়–প্লিজ! আপনি ফিরে যান, আমি শুধু একটু মজা করার জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম।

 যৌবনবতী এক সুন্দরী সানুরাগে এক পুরুষকে ডেকেছেন মজা দেখার জন্য। সে মজাও যেমন–তেমন মজা নয়, কুন্তীর সানুরাগ আহ্বানের মধ্যে দুর্বাসার দেওয়া সঙ্গম-মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল। কোনও একক পুরুষকে কোনও যুবতী যদি সঙ্গমের বাসনা নিয়ে ঘরে ডেকে, সে যদি বলে–প্লিজ! আপনি বাড়ি যান, তবে সে পুরুষ আর প্লিজড় হয়ে ঘরে ফেরে না। কথাটাকে যুবতী-সুলভ সামান্য লজ্জা-মাত্র ভেবে পুরুষ তখন ভদ্রতার সম্বোধন ত্যাগ করে এবং দৃষ্টি দেয় রমণীর উচ্চাবচ শরীরে। আর ঠিক তারপরেই সে সূর্যের মতো করে বলে–যাব। যাব। নিশ্চয়ই যাব। ক্ষীণ–কটি সুন্দরী আমার তুমি যখন বলছ, তখন যাব একসময় নিশ্চয়ই–গমিষ্যেহং যথা মা ত্বং ব্রবীষি তনুমধ্যমে। কিন্তু দেবতা-পুরুষকে এমনি করে সানুরাগে ডেকে তাকে কি আর ফিরিয়ে দিতে আছে। নিজের ইচ্ছেটাকে কি এমন করে বিফল করে দেবেন তু দেবং সমাহুয় ন্যায্যঃ প্রেষয়িতুং বৃথা।

কুন্তীর সমস্ত অনুরাগ এখন চলে গেছে। সমাজ-বহির্ভূত এই অসামাজিক মিলনের মধ্যে যে বিপন্নতা আছে, সেই বিপন্নতাই এখন তাকে পেয়ে বসেছে। ওদিকে আস্কারা-পাওয়া যুবকটির মতো সূর্য আরও পরিষ্কার করে বললেন–তুমি কী চাও, আমি জানি। তুমি চেয়েছিলে আমারই মতো একটি পুত্র হোক তোমার গর্ভে–তবাভিসন্ধিঃ সুভগে সূর্যাৎ পুত্রো ভবেদিতি। তুমি চেয়েছিলে–সেই ছেলের শক্তিমত্তা হবে দুনিয়ার সমস্ত বীর–পুরুষের চেয়ে বেশি। আর দেখতেও হবে ঠিক আমারই মতো, ঠিক এমনই সোনার বর্ম আঁটা তার গায়ে, এমনই দুটি সুবর্ণ-কুণ্ডল তার কানে–বীর্যেণাপ্রতিমো লোকে কবচী কুণ্ডলীতি চ। কিন্তু এমন একটা পুত্র পেতে হলে তোমার শরীরের মূল্যটুকু যে দিতেই হবে। তুমি আমার হাতে নিজেকে ছেড়ে দাও–সা ত্বম্ আত্মপ্রদানং বৈ কুরুধ গজগামিনি। তুমি যেমনটি চেয়েছিলে সেইরকমই পুত্র হবে তোমার। তবে এর জন্য তোমার সঙ্গে মিলন সম্পূর্ণ করেই যেতে হবে আমাকে–তথা গচ্ছাম্যহং ভদ্রে ত্বয়া সঙ্গম সুস্মিতে।

পুত্র! পুত্র! পুত্র! কুণ্ডলী কবচী সূর্য-পুরুষকে দেখার সময় একবারও কি পুত্রের কথা ভেবেছিলেন কুন্তী? অথচ তার প্রকোষ্ঠে উপস্থিত হওয়ার পর থেকেই সূর্য শুধু পুত্র-পুত্র করে যাচ্ছেন। এর অর্থ একটাই। শারীরিক মিলন। সেকথা এখন সূর্যদেব বেশ স্পষ্ট করেই বলছেন। তুমি নিজেকে আমার হাতে সমর্পণ করো অথবা তোমার সঙ্গে মিলিত হয়ে তবেই আমি যাব–এই কথাগুলি পুত্রলাভের প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে এবং সেই সব শব্দ এখন স্পষ্ট উচ্চারিত হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে সঙ্গম-সহায় চাটুকারিতা-গজগামিনি, সুস্মিতা–এইসব মনভোলানো সম্বোধন। সব কিছু মিলিয়ে সূর্য–পুরুষের অগোপন বক্তব্য একটাই–শারীরিক মিলন। কিন্তু দুর্বাসার মন্ত্র-পরীক্ষার মধ্যে কুন্তীর কৌতূহল ছিল নিশ্চয়ই। এমনকি রক্তিম পুরুষকে দেখে তার প্রথম ভাল লাগাটুকুও হয়ত মিথ্যে নয়। কিন্তু এই যে পুরুষের আগমন মাত্রেই সঙ্গম-চিৎকার ধ্বনিত হচ্ছে, বার–বার পুত্রদানের ব্যঞ্জনায় যে শারীরিক মিলনের কথা প্রকট হয়ে উঠছে, কুন্তী কি এই চেয়েছিলেন?

 সূর্যের অকপট সঙ্গমেচ্ছা প্রকট হয়ে উঠলেও কুন্তী যে এই বিষয়ে খুব আগ্রহ দেখালেন, তা মোটেই নয়। নিরুপায় সূর্যদেব এবার ভয় দেখালেন–তুমি যদি আমার কথা না শোন, আমার যা প্রিয় কার্য তা যদি না কর–যদি ত্বং বচনং নাদ্য করিষ্যসি মম প্রিয়–তবে তোমার পিতাকে এবং সেই ব্রাহ্মণের উদ্দেশে অভিশাপ উচ্চারণ করব আমি। তুমি নিজে আমাকে ডেকে এনেছ এখানে এবং তোমার এই অন্যায় আচরণের কথা তোমার পিতাঠাকুর জানেন না, অতএব তোমার এই অপরাধে তোমার পিতাকেই অভিশাপের আগুনে দগ্ধ করব আমি। তবে বাদ যাবেন না সেই ঋষি–ব্রাহ্মণও, যিনি তোমার স্বভাব–চরিত্র কিচ্ছুটি না জেনে তোমাকে এই দেব-সঙ্গমের রহস্য জানিয়েছেন–তস্য চ ব্রাহ্মণস্যাদ্য যোসৌ মন্ত্রমদাত্তব। ভাবটা এই–পুরুষের সম্বন্ধে রমণীর যে সাধারণ সংযমটুকু আকাঙ্ক্ষিত, সেই সংযম-স্বভাবের কথা না জেনে-বুঝে যিনি মন্ত্র দিয়েছেন তোমাকে, সেই ঋষিকে আজ আমি গুরুতর দণ্ড দেবশীলবৃত্তমবিজ্ঞায় স্যামি বিনয়ং পরম।

 আমরা জানি, কুন্তী অন্যায়ভাবে তিরস্কার লাভ করছেন। আমরা জানি, সূর্যকে ডাকার সময় মন্ত্র পরীক্ষার কৌতুক ছাড়া আর কিছুই ছিল না এবং এই কৌতুক অতি স্বাভাবিক। আজকের আধুনিক কোনও যুবক-যুবতীকেও যদি এমন স্ত্রী-পুরুষ-বশীকরণের সিদ্ধমন্ত্র দেওয়া যায়, তবে তাঁরাও আগে মন্ত্রের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য আকুলিত হবেন। কারণ মণি, মন্ত্র এবং ওষধির মধ্যে তথাকথিত চমৎকৃতির এমনই এক মন্ত্রণা আছে, যাতে লোকে মন্ত্রশক্তি পরীক্ষা করতে খুব তাড়াতাড়ি কৌতূহলী হয়। কুন্তীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু সূর্য যে কুন্তীর নিস্তব্ধতায় ক্রুদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত তার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে গালাগালি দিতে লাগলেন অথবা তার পিতা এবং মন্ত্রদাতা ঋষিকে অভিশাপ দিতে চাইলেন, তার পিছনে কুন্তীর স্বভাব-চরিত্র যত বড় কারণ, তার চেয়ে অনেক বড় কারণ হল নিজের ব্যক্তিগত অপমান।

 সাড়ম্বরে রমণীর দ্বারা আহত হয়ে নে পুরুষেরই বা প্রত্যাখ্যাত হতে ভাল লাগে? আসল কথাটা বলেই ফেললেন সূর্যদেব। বললেন–এই যে তুমি আমাকে ডেনে এনে, এখনই আবার। ফিরে যেতে বলছ, এতে কি আমার মান-সম্মান কিছু থাকছে? তাকিয়ে দেখ মুক্ত আকাশের দিকে। তোমাকে তো আমি দিব্যচক্ষু দিয়েছি, সেই চোখেই তো তুমি আমার স্বরূপ দেখেছ। এখন সেই চোখেই খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ! দেখতে পাবে–আমার স্বজন-বন্ধু দেবতারা, ইন্দ্র, যম, বরুণ–আমার সমানধর্মা এইসব দেবতা আমার প্রতি তোমার এই প্রত্যাখ্যান-ভাষণ শুনে মুখ লুকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন–ত্বয়া প্রলব্ধং পশ্যত্তি স্মরন্ত ইব ভাবিনি। একজন দেবপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও মনুয্যলোকের মরণধর্মা এক সাধারণ রমণীর কাছে। এই প্রত্যাখ্যানের অপমান কি কখনই সইবে? তার ওপরে এইসব দেবতা এখন চেয়ে চেয়ে মজা দেখছেন। আমার কি এতও সইবে?

কুন্তী চেয়ে দেখলেন আকাশের দিকে। দেখলেন–সত্যি দেবতারা আপন রূপে দীপ্যমান। কিন্তু তাঁরা দৃষ্টি রেখেছেন মর্ত্যলোকের এই ঘটনার দিকে। কুন্তী এবার সত্যিই লজ্জিত হলেন–সা তান দৃট্রা ব্রীড়মানের বালা। কিন্তু তাই বলে মনুষ্যলোকের সমস্ত সাবধানতা অতিক্রম করে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সূর্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন না। অভিশাপের সমস্ত ভীতি অন্তরে চেপে রেখে কুন্তী বললেন–দেবতা আমার! আপনি আপনার বিমানে আরোহণ করুন। আমি একটি কুমারী কন্যা। আমার পক্ষে কুমারীত্ব বিসর্জন দিয়ে আপনার ঈপ্সিত শারীরিক মিলনের মধ্যে যাওয়া সম্ভব নয়–কন্যাভাবা দুঃখ এবোপকারঃ।

কৌতুকপ্রবণ কুমারী কুন্তী সূর্যের উপরোধে এক মুহূর্তে যেন অতিশয় বুদ্ধিমতী এবং সচেতন হয়ে গেলেন। কুন্তী বললেন–আমার পিতা, মাতা এবং অন্যান্য গুরুজনেরা আছেন–তাদের অনীতি কাজ আমি করতে পারি না। পিতা-মাতা আমাকে এই শরীর দিয়েছেন, আমি নিজে এই শরীর তৈরি করতে পারি না। আমি হাজার চেষ্টা করলেও আমার দ্বিতীয় কুমারী–শরীর তৈরি করতে পারব না। অতএব যে পিতা-মাতা আমাকে শরীর দিয়েছেন–দেহস্যাস্য প্রভবন্তি প্রদানে–আমার এই শরীরের ওপর সমস্ত অধিকার তাদেরই। আমার মতো এক রমণী কী করতে পারে এখানে? আমার কাজ এবং কর্তব্য হল–তাদের দেওয়া এই কুমারী শরীরটি যাতে কোনও মতে রক্ষা করতে পারি–স্ত্রীণাং বৃত্তং পূজ্যতে দেহরক্ষা। আপনি ক্ষমা করুন আমাকে।

কুন্তী নিজের অক্ষমতা জানিয়ে সূর্যের কাছে সানুনয়ে আবার সেই পুরনো কথা বললেন। বললেন–আমি বালিকা বয়সে চপলতায় ঋষি-দত্ত মন্ত্রের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য আপনাকে কাছে ডেকেছি–ময়া মন্ত্রবলং জ্ঞাতুমাহূতত্ত্বং বিভাবসো। আমার অন্যায় হয়েছে আমি জানি। কিন্তু শুধু এক বালিকার চপলতা বলেই আপনি আমার এই দোষটুকু ক্ষমা করে দিতে পারেন–বাল্যালেতি তৎ কৃত্বা ক্ষমহসি মে বিভো।

সূর্য ঝটিতি প্রত্যুত্তর দিয়ে বললেন–বালিকা বলেই আমি এতক্ষণ ধরে তোমাকে অনেক সাধ সেধেছি–বালেতি কৃত্বানুনয়ং তবাহং–অন্য কেউ হলে তাকে কি এতক্ষণ ধরে আমি অনুনয় করে মিলন–প্রার্থনা করতাম–দদানি নান্যানুনয়ং লভেত? আমি আবারও তোমাকে বলছি–তুমি ছেড়ে দাও নিজেকে আমার হাতে। এতেই তোমার নিশ্চিন্ত, এতেই তোমার শান্তি। তুমি আমাকে সমন্ত্রে আহ্বান করেছ, অতএব তোমার সঙ্গে মিলন সম্পূর্ণ না করে আমি যাব না–অসমেত ত্বয়া ভীরু মাহুতেন ভাবিনি। সূর্য আবার ব্যক্তিগত সম্মানের প্রশ্ন তুললেন–তুমি তো তোমার বালিকার বয়স দেখিয়ে, বালিকার চপলতা দেখিয়ে অপরাধ ক্ষমা চাইলে। তুমি কি আমার কথা এতটুকু ভেবেছ। দেবতা-পুরুষ হয়েও, তোমার কাছে প্রত্যাখ্যানের সোপহাস বাক্য শুনেও আমি এতক্ষণ তোমাকে অনুনয় করে চলেছি। এরপরেও মিলনের বিফলতা নিয়ে আমি যদি এখান থেকে চলে যাই, তবে আমি যে সবার কাছে উপহাস্পদ হব। তুমি আমার এই করুণ অবস্থার কথা একটুও কি ভেবেছ? কাজেই যা বলছিলাম, তাই করো–সমস্ত ভয় অতিক্রম করে আমার সঙ্গে তুমি মিলিত হও। তাতে একদিকে যেমন তুমি আমারই মতো এক বীর পুত্র লাভ করবে, তেমনি অন্যদিকে, সমস্ত স্ত্রীলোকের মধ্যে অসাধারণী বলে পরিচিত হবে–বিশিষ্টা সর্বলোকে ভবিষ্যসি ন সংশয়ঃ। কেননা, মনুষ্য রমণীর গর্ভে কোনও দেবতা এমন সানুনয়ে পুত্র প্রদান করে?

.

৭৩.

দেবতা-পুরুষের অনুরোধ এবং উপরোধ এমন একটা চরম বিন্দুতে পৌঁছল যে, সহস্র বিনয় দেখিয়েও কুন্তী সূর্যকে বোঝাতে পারলেন না–অনুনেতুং সহস্রাশুং ন শোক মনস্বিনী। এদিকে রয়েছে অভিশাপের ভয়। সে শাপে যদি কুন্তী নিজে দগ্ধ হতেন, তাতেও দুঃখ ছিল না। সূর্য বলছেন–তার পিতা কুন্তিভোজ এবং সেই মুনি তার শাপের ফল ভোগ করবেন। নিজের ব্যক্তিগত অপরাধের জন্য তাঁর নিরপরাধ পিতা এবং তাঁর শুভদায়ী মন্ত্রদাতা মুনি–দুজনেই অভিশাপগ্রস্ত হবেন, এমনটি কুন্তী চান না। অন্যদিকে তার নিজের ভয়ও কিছু কম নয়। যে দেবতা-পুরুষকে তিনি কৌতুকের বশে কাছে ডেকেছিলেন, তিনি এখনও তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন–সাহমদ্য ভৃশং ভীতা গৃহীতা চ করে ভূশম্। সঙ্গমলিন্দু এক দীপ্তিমান পুরুষের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতে হবে–এ কথা ভাবতে কুন্তীর কৌলীন্যবোধ, সামাজিকতা এবং আত্মমর্যাদা সব একত্র পুঞ্জীভূত হল। তিনি কেবলই ভাবতে লাগলেন–এক মুহূর্তের এক কৌতুক এবং ভ্রমের কাছে কী করে এক কুমারী-শরীরকে আহুতি দেওয়া যায়–কথং ত্বকাৰ্যং কুৰ্যাং বৈ প্রদানং হ্যাত্মনঃ স্বয়ম্।

 একদিকে আত্মীয়স্বজন অন্যদিকে অভিশাপের ভয়–দুইই মাথায় রেখে কুন্তী তার এই সঙ্কট-মোচনের চেষ্টা করলেন প্রখর বাস্তব-বুদ্ধিতে, সূর্যের উপরোধে এতক্ষণে তিনি বুঝেছেন–দুর্বাসার মন্ত্র শুধু দেবসঙ্গমের মাধ্যমে তাকে কতগুলি অভীষ্ট পুত্র দান করতে পারে; কিন্তু মানব-জীবনের পরম অভীষ্ট একটি সংসার যদি তাকে লাভ করতে হয়, তবে কুমারীত্বই সবচেয়ে জরুরী এবং তার চেয়ে জরুরী তার ভবিষ্যৎ স্বামীর কাছে বিশ্বস্ত থাকা। হয়ত তাকেই সতীত্ব বলে।

কিন্তু তাঁর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্য-পুরুষের শুভবুদ্ধির কাছে আরও একবার নিজের অক্ষমতা নিবেদন করে বললেন–আমার আত্মীয়স্বজন, কুলজনেরা থাকতে আমার এই কাজে সমস্ত কুলাচার লঙ্ঘিত হবে–বিধিলোপো ভবেদয়। সমস্ত বিধি অতিক্রম করেও যদি বা এই অবৈধ মিলন ঘটেই যায়, তবে শুধু আমার জন্যই আমার পিতৃবংশের সমস্ত কীর্তি ধুলোয় মিশে যাবে–মন্নিমিত্তং কুলস্যাস্য লোকে কীর্তি-শেত্ততঃ। তবু সব কিছু বিসর্জন দিয়েও আমি আপনার অভীষ্ট সঙ্গমে লিপ্ত হব–যদি আপনি এই কাজটাকে ধর্ম মনে করেন–অথবা ধর্মমেতং ত্বং মনসে তপতাং বরঃ।

 কুন্তীর সম্বোধনগুলো বড়ই শানিত হয়ে উঠছে। সূর্যকে তিনি বলছেন–তপতাং বরঃ। সাধারণভাবে সমগ্র জগৎকে তাপিত করেন বলে সূর্য তপন নামে প্রসিদ্ধ। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি কুন্তীর হৃদয়কে তাপিত করছেন। এরপরেই কুন্তী তাকে ডাকলেন–দুর্ধর্ষ বলে–অর্থাৎ যিনি অত্যন্ত দুঃখকরভাবে ধর্ষণের আচারে লিপ্ত হয়েছেন এবং যাঁকে কোনওমতেই অন্যায্য সঙ্গমকার্য থেকে বিরত করা যাচ্ছে না। কুন্তী বললেন–দুর্ধর্ষ দেবতা আমার! তবু আমি নিজেকে সঁপে দিতে পারি আপনার কাছে, কিন্তু সব কিছুর পরেও আমি সতী থাকতে চাই–আত্মপ্রদানং দুর্ধর্ষ তব কৃত্বা সতী বৃহম্।

সতীত্বের জন্য কুন্তীর এই হাহাকার এক লহমার মধ্যে এক কৌতুকপ্রিয়া কিশোরীকে পূর্ণা যুবতী করে তুলেছে। সূর্য কুন্তীর মনের অবস্থা বুঝলেন এবং উত্তর দিলেন সমাজ-জীবনের সমস্ত উদারতা সোচ্চারে ঘোষণা করে। সূর্য বললেন–মিষ্টি হাসির সুন্দরী আমার! তোমার পিতা, মাতা বা অন্য কোনও গুরুজন তোমার প্রভু নন কেউ; একটি কুমারী কন্যার ব্যক্তিসত্তা যে একান্তভাবেই স্বতন্ত্র–তস্মাৎ কন্যেহ সুশ্রোণি স্বতন্ত্ৰা বরবৰ্ণিনি। কেন জান? কন্যা শব্দটার মধ্যেই সেই স্বতন্ত্রতার বীজ লুকানো আছে। ক ধাতুর অর্থ কামনা করা, আর কন্যা শব্দটাও আসছে ক ধাতু থেকেই। ধাতুর অর্থ সত্য করে একটি কন্যা যে কোনও পুরুষকেই কামনা করতে পারে–সর্বান্ কাময়তে যস্মাৎ কমেধাতোশ্চ ভাবিনি। তুমি কন্যা, তুমিও তোমার অভীষ্ট পুরুষকে পছন্দ করতে পার, কামনা করতে পার। এখানে তুমি স্বতন্ত্র।

 সূর্য একটি কুমারী কন্যার স্বাধীনতার কথা বলছেন এমন ভাষায়, যা এই আধুনিক সমাজেও কাম্য ছিল। আমরা একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় বসেও এতটা আধুনিক হতে পারিনি। আমরা আমাদের কৌলীন্য, আমাদের তথাকথিত মর্যাদাবোধ এবং আমাদের স্বার্থ-প্রণোদিত ধারণা একটি কুমারী কন্যার স্বতন্ত্রতার ওপরে আরোপ করি। একবারও ভাবি না যে আমাদের আদরের কন্যাটি তার একান্ত আপন কুমারী-মনের স্বতন্ত্রতায় একটি পুরুষকে কামনা করতেই পারে। অবশ্য একই সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে, মহাভারতের প্রথম যুগে সমাজের পক্ষে শ্রেয়স্কর বিধি-নিয়মগুলি উপস্থিত থাকলেও একটি কুমারী কন্যার স্বাধীনতা ছিল আধুনিক কালের চেয়েও বেশি। অপিচ এই স্বাধীনতা এসেছে বৈদিক যুগের পরম্পরায়।

সূর্য বলছেন–আমার সঙ্গে মিলিত হলে তোমার কোনও অধর্ম হবে বলে আমি মনে করি না। আর আমিই বা সামান্য লৌকিক সুখের ইচ্ছায় তোমার সঙ্গে মিলিত হব কেন? তাছাড়া স্ত্রী এবং পুরুষ স্বভাবতই একে অপরের মিলনকামী, বরঞ্চ বিবাহ ইত্যাদি নিয়ম মেনে একেকটি স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিকভাবে একত্র বিশ্বস্ত থাকার ঘটনাটাই বিকার বলে মনে করা যায়–স্বভাব এয লোকানাং বিকারোন্য ইতি স্মৃতঃ।

সূর্য যে সমাজের রীতি-নীতির কথা কুন্তীকে শোনাচ্ছেন, সেই সমাজ মহাভারতের সমাজ থেকে অনেক পুরনো। সেখানে স্ত্রী-পুরুষের মিলন-বন্ধনের নিয়ম অনেক শিথিল। বিবাহের মধ্যে দিয়ে স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মিলন নিয়ন্ত্রণ করার যে বিধি এবং প্রয়াস, তার সম্বন্ধে কুন্তী অবশ্যই অবহিত। সেই কারণেই তিনি বারবার আত্মীয়-স্বজন, বংশ এবং সমাজের নানা মর্যাদা তথা বৈধতার কথা তুলছেন। অথচ সূর্য সেই সামাজিক ধর্মাধর্মের কথা উড়িয়ে দিয়ে একটি কুমারী কন্যার অনন্ত স্বাধীনতার কথা বলছেন। সমাজে স্ত্রী-পুরুষের মিলন-বন্ধন যখন শিথিল ছিল, এই স্বাধীনতা সেই সময়ের। সূর্য দেবতা-পুরুষ এবং পুরাতন বৈদিক সমাজের প্রতিভূ বলেই তার মুখে এই কথা শোভা পাচ্ছে।

অথচ কুম্ভীর সময়ে আমরা কিন্তু তাকে এক যুগ-সন্ধির লগ্নে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। সতীত্বের জন্য, কুমারীত্ব-হানির জন্য তার হাহাকার আছে, অথচ এক তেজস্বী স্বেচ্ছাচারী পুরুষের মুখে একটি কন্যার স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণের কথাও তিনি শুনতে পাচ্ছেন। একটি পুরুষের সঙ্গে মিলিত হবার ব্যাপারে একটি কন্যার ইচ্ছাই যে সব, তার পিতা, মাতা বা গুরুজনের যে সেখানে কিছুই বলবার থাকতে পারে না–ন তে পিতা ন তে মাতা গুরবো বা শুচিস্মিতে। প্রভবন্তি বরারোহে–এই রকম একটি অনবরুদ্ধ ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের কথা কুন্তী শুনছেন, কিন্তু তা সর্বাংশে অস্বীকার বা আত্মসাৎ করতে পারছেন না। কুমারীত্বহানির সমস্যা তাঁকে যে অত্যন্ত বাস্তবভাবে জর্জরিত করবে, এটা বুঝেই কুন্তী তার হাহাকারটুকু প্রকট করে দিয়েছেন–আমার এই শরীর দিয়েও আমি কিন্তু আমার কুমারীত্ব, সতীত্ব বজায় রাখতে চাই। কুন্তীর এই বাস্তব দুশ্চিন্তা সূর্য বুঝেছেন। সূর্য তাঁকে চিন্তামুক্ত করেছেন দেবতার ঐশ্বর্যে। বলছেন–আমার সঙ্গে মিলিত হবার পরে আবারও তোমার কন্যাভাব ফিরে পাবে–সা ময়া সহ সঙ্গম পুনঃ কন্যা ভবিষ্যসি। সেই সঙ্গে এক মহা-যশস্বী পুত্রেরও জননী হবে তুমি।

এই নিশ্চিত্ততার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের মিলন-প্রস্তাবে সামান্য উৎসাহী দেখতে পাচ্ছি কুন্তীকে। মনস্তত্ত্ববিদেরা বলেন–অধিকাংশ ধর্ষণের ক্ষেত্রে সঙ্গমকারী পুরুষকে প্রাথমিকভাবে যথেষ্ট বাধা দিলেও রমণীও শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে। এসব ক্ষেত্রে পুরুষের শারীরিক বলের কাছেই রমণীর আত্মসমর্পণের তথ্য সবসময় প্রকট হলেও মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিতে রমণীর মনকে শেষের দিকে কথঞ্চিৎ দুর্বল হতে দেখা যায়। কুন্তীর ব্যাপারটা আরও বেশি চমকপ্রদ। তিনি নিজেই দেবপুরুষকে ডেকেছিলেন কৌতূহলভরে। সামাজিকতা এবং কুলমর্যাদা শেষ পর্যন্ত তাকে পুরুষ-সংসর্গ থেকে নিবৃত্ত করলেও যে মুহূর্তে তাঁর কুমারীত্বের সংকট মুক্ত হয়ে গেছে, সেই মুহূর্তেই আমরা কুন্তীর মুখে সামান্য উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করছি।

কুন্তী বলছেন–তমোনাশী দেবতা আমার! যদি তোমারই ঔরসে একটি পুত্র লাভ করি আমি,–যদি পুত্রো মম ভবের্তৃত্তঃ সর্বর্তমোনুদ–তবে সে যেন হয় ঠিক তোমারই মতো। তোমারই মতো সোনার বর্ম আঁটা গায়ে, তোমারই মতো সোনার কুণ্ডল-পরা। মহাবীর মহাযশস্বী। সূর্য বললেন–হবে হবে, তাই হবে। আমারই মতো কবচ-কুণ্ডলের অলংকার থাকবে তার গায়ে এবং সে দুটি তার মৃত্যু রোধ করবে চিরজীবন। কুন্তী সূর্যের কথা শুনে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বললেন–দেবতা আমার! যেমনটি বললেন, তেমনি যদি হয়, তবে সম্পূর্ণ হোক আমাদের মিলন। যেমনটি আপনি চেয়েছেন, সেই অভীপ্সিত মিলনের মুহূর্ত নেমে আসুক এখনই–অস্তু মে সঙ্গমো দেব যথাক্তং ভগবংস্বয়া।

দেবমাতা অদিতির কানের অমৃতময় কুও ছিল সূর্যদেবের কানে, দেব-দানবের অভেদ্য বর্ম ছিল সূর্যদেবের গায়ে। সূর্য প্রতিজ্ঞা করলেন–এই দুটিই তোমার গর্ভজাত সন্তানকে দিয়ে যাব–তস্মৈ দাস্যামি বামোরু। কুন্তী বোধহয় অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন। সমাজের নীতিবিরুদ্ধভাবে যে ছেলের জন্ম দিতে হবে তাকে ত্যাগ করার ব্যাপারে বুঝি পূর্বাহ্নেই প্রস্তুত ছিলেন কুন্তী। কিন্তু সেই ছেলের গায়ে যদি মৃত্যুর প্রতিষেধক বর্ম আঁটা থাকে, তবে সেই কারণে তার সম্বন্ধে অনেকটাই নিশ্চিন্ত থাকবেন তিনি। অতএব সূর্যের সমস্ত যুক্তি মেনে নিয়ে কুন্তী স্বীকৃত হলেন সুমধুর সঙ্গমেপরমং ভগবম্নেবং সঙ্গমিষ্যে ত্বয়া সহ।

দেবতার অলৌকিকতায় যিনি মানুষের দেহ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুন্তীর সামনে, যিনি সমলিঙ্গু হয়ে কুন্তীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এতক্ষণ, কুন্তীর সাগ্রহ অনুমতি পেয়ে সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ এবার কুন্তীর নাভিদেশ স্পর্শ করলেন–নাভ্যাং স্পর্শ চৈব তাম্। নাভিস্পর্শের ইঙ্গিত ব্যঞ্জনার মধ্যে অন্তরিত রেখেছেন মহাভারতের কবি। টীকাকার সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট করে দিয়েছেন মর্তের অভিধায়-বসন-মোচনায় ইত্যর্থ। চিন্ময় দেবপুরুষ প্রবেশ করলেন মৃন্ময়ী কুন্তীর শরীরে–তথেত্যুত্ত্বা তু তাং কুন্তীমাবিবেশ বিহঙ্গমঃ। দীপ্তিমান সূর্যের পৌরুযে অভিভূত হল কুন্তীর চেতনা। যৌবনের প্রথম উন্মাদনায়, ভয়ে, সমীহায় এবং অবশ্যই এক নষ্টচেতন আনন্দে কুন্তী বিলাস-ভবনের মহার্ঘ শয্যায় সম্পূর্ণ মিলিত হলেন সূর্যপুরুষের সঙ্গে–পপাত চাথ সা দেবী শয়নে মূঢ়চেতনা।

আপন তেজে কুন্তীকে অভিভূত করে সালিঙ্গনে কুন্তীর গর্ভাধান সম্পূর্ণ করলেন সূর্যদেব–তিগ্নাংশুস্তাং তেজসা মোহয়িত্বা/যোগেন বিশাত্মসংস্থাং চকার। আধো চেতনের মধ্যে কুন্তী সূর্যের সঙ্গম-শেষের সানন্দ আশীর্বাদ শুনতে পেলেন–চললাম সুন্দরী সাধয়িষ্যামি সুশ্রোণি, সমস্ত ধনুর্ধরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এক বীর পুত্র লাভ করবে তুমি। আর ঠিক তার পরেই তুমি তোমার কুমারীত্ব ফিরে পাবে–সর্বশস্ত্রভৃং শ্রেষ্ঠং কন্যা চৈব ভবিষ্যসি। এতক্ষণে কুন্তী লজ্জা পেলেন। নব-সঙ্গমের মধুর আবেশ তখনও তার শরীরে। মিলন-স্নিগ্ধ রমণীয় সূর্য চলে গেছেন তার অন্তরীক্ষলোকের ঠিকানায়। মধুর কোনও মোহে আবিষ্ট হয়ে কুন্তী তখনও শুয়ে আছেন দুগ্ধশুভ্র মহার্ঘ শয্যায়–মোহাবিষ্টা ভজামানা লবে।

কুন্তী গর্ভধারণ করলেন, যে কোনও গর্ভবতী রমণীর মতোই। তিনি যেখানে থাকতেন সেটা কুন্তিভোজের কন্যান্তঃপুর। রাজার অন্তঃপুরের অন্য এক ভাগ। সেকালে রাজার স্ত্রীরা যেখানে থাকতেন, তারই একটেরে অথবা অন্য একটি পৃথক ভবনে থাকতেন রাজার যুবতী কন্যারা। তাঁদের স্বাধীনতা ছিল! আপন সখী এবং পরিচারিকাদের নিয়ে তাঁদের পৃথক একটি জগৎ তৈরি হত। কুন্তিভোজের যেহেতু কোনও সন্তান ছিল না, তাই আপন ভবনে কুন্তী ছিলেন একাকিনী। এটা তার সুবিধে। তিনি যে কখনও বাইরে যেতেন না বা পিতা কুন্তিভোজের সঙ্গে দেখা করতেন না, তা মোটেই নয়। তবে গর্ভলক্ষণ প্রকট হবার পর, বিশেষত সেই গর্ভ শুক্লপক্ষের প্রতিপদচন্দ্রের আকার ধারণ করার পর তিনি একটু সাবধান হলেন।

সাধারণ ঘরে বিবাহিতা রমণীর গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পেলে তার মনের মধ্যে আনন্দের অন্তঃস্রোত যেমন করে তাকে লজ্জিত করে, মথিত এবং উদ্ভাসিত করে, এবং একসময় এই লজ্জামথিত উদ্ভাসই যেমন তার অন্তর্বর্তী প্রাণের সঞ্চারকে অন্যের সামনে প্রকাশিত করে দেয়, ঠিক তেমন করেই কুন্তী নিজেকে প্রকাশিত করতে পারতেন। কিন্তু সমাজের কঠিন সংস্কার এবং অবশ্যই লোকাঁচার তার এই নবতম প্রাণের উচ্ছ্বাসকে যদি স্তব্ধ করে দেয়, সেই ভয়ে কুত্তী কাউকে তার গর্ভসঞ্চারের কথা বললেন না।

 কুন্তী এখন আর বাইরে বেশি যান না; যদি বা যেতে হয়, যদি বা কুন্তিভোজের সঙ্গে কখনও কথা বলতে হয়, তবে গর্ভালক্ষণাক্রান্তা রমণী যেমন ঢিলেঢালা পোশাক পরে নানা বিভঙ্গে নিজেকে লুক্কায়িত করে, কুন্তীও সেইভাবে নিজের প্রকট গৰ্ভলক্ষণ লুকিয়ে রাখলেন–সা বান্ধবভয়া বালা গর্ভং তং বিনিগৃহতী। তার এই আকালিক গর্ভসঞ্চারের কথা কুন্তিরাষ্ট্রের একটি রমণীও জানতে পেল না। শুধু এক পরিচারিকা যে সেই ছোটবেলা থেকে কুন্তীর বড়ো কাছের মানুষ, সেই শুধু দিন-রাত কুন্তীকে দেখাশোনা করে গেল। যাতে কুন্তীর উদগত গর্ভলক্ষণ কুত্রাপি প্রকাশ না পায়, সেইজন্য সে তাকে অন্যরকমভাবে সাজিয়ে দিত, অন ভাবে জামা-কাপড় পরিয়ে দিত এবং সব সময় তাকে বাঁচিয়ে চলত–কন্যাপুরগতাং বালাং নিপুণা পরিরক্ষণে।

অবশেষে হরিষে–বিষাদমিশ্রিত সেই দিনটি এসে গেল। সূর্যের প্রসাদে সূর্যেরই মতো দেবতার তুল্য এক পুত্রের জন্ম দিলেন কুন্তী। ঠিক সেই রকম সোনার বর্ম আঁটা তার গায়ে, কানে আদিত্য কুণ্ডল। জন্মকালেই সিংহের মতো উজ্জ্বল তার চোখ, স্কন্ধদেশ দৃঢ় বৃষল। তার মুখের আদল ঠিক তার পিতার মতোই–হৰ্য্যক্ষং বৃষভস্কন্ধং যথাস্য পিতরং তথা।

রাজার বাড়িতে দেবতার দেবপ্রতিম পুত্র জন্মাল। অথচ বাজল না কোনও ভেরী, বেজে উঠল না বিশাল কোনও গোমুখ শঙ্খ। বৈদিকরা মঙ্গল-মন্ত্র উচ্চারণ করলেন না, চতুষ্পথে ভেসে আসল না রমণীকন্ঠের তীক্ষ্ণ জয়কার। অকূল স্তব্ধতার মধ্যে এই শিশুপুত্রকে কীভাবে অপ্রমাণ করা যায়, সেই আলোচনায় চিন্তিত হলেন দুটি নারী-কুন্তী এবং তার একান্ত পরিচারিকা–জামাত্রঞ্চ তং গর্ভং ধাত্রা সংম ভাবিনী। ঠিক হল–একটি বেতের পেটরার মধ্যে শিশুটিকে শায়িত করে অশ্বনদীর জলে ভাসিয়ে দেবেন কুন্তী।

আমরা জানি–ভবিষ্যতে কুন্তীর এই ক্রুর ব্যবহারের জন্য তাকে অনেক তিরস্কার শুনতে হবে। যে শিশুপুত্রকে তিনি চরম নিষ্ঠুরতায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন আজ–আমরা জানি–তার জন্য কুন্তী নিজেই ভবিষ্যতে অনুতাপগ্রস্ত হবেন। কিন্তু যারা সমালোচকের মঞ্চে বসে সমাজমুখ্যের সম্মার্জনী হাতে নিয়ে কুন্তীকে তিরস্কার করবেন এবং সাহিত্যরসের প্রচুরতর কারুণ্যে কুন্তীর শিশুপুত্রের ভাগ্যের জন্য যারা অধিক রবিষ্ট হবেন, তাঁরা কি কুন্তীর মনস্তত্ত্ব কখনও ভেবে দেখেছেন? জন্মলগ্নে জন্মদাতা পিতা-মাতার স্নেহ পেয়েও যাঁকে বালিকা বয়সেই পিতার বন্ধুর বাড়িতে চলে যেতে হয়েছে, এবং পালক পিতা যাঁকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করতে পারেননি, তাঁর মনের অবস্থাটা কি খুব স্বাভাবিক ছিল?

দুর্বাসা মুনির সেবায় নিয়োগ করার সময় কুন্তিভোজ বারবার তাকে বৃষ্ণিবংশের মর্যাদা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তার কথাবার্তা থেকে পরিষ্কার বোঝা গেছে যে, কুন্তীর দিক থেকে কোনও অন্যায়-অনাচার ঘটলে তার সমস্ত কলঙ্কের দায় বৃষ্ণিবংশকেই স্পর্শ করবে, রাজা কুন্তিভোজ তার কলঙ্কের দায় বহন করবেন না। জীবনের মৌলিক ক্ষেত্রগুলিতে কুন্তিভোজের এই অনাত্মীকরণ কুন্তীর মনে যে জটিল আবর্ত তৈরি করেছিল, তার মধ্যে এই সমাজ-বহির্ভূত প্রথায় পুত্রজন্ম কী ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে, তা অনুমানযোগ্য।

দ্বিতীয়ত, বিংশ শতাব্দীর পরিণত কাব্যরসে–যে ফিরাল মাতৃস্নেহপাশ–এই তির্যকবাক্যটি কুন্তীকে শুনতে হবে তাঁরই পুত্রের কাছে। আমাদের জিজ্ঞাসা-জীবনের প্রান্তভূমিতে পৌঁছে যিনি পুত্রের কাছে এই তিরস্কার লাভ করবেন, তিনি কতটুকু মাতৃস্নেহের স্বাদ পেয়েছেন? কুন্তিভোজের গৃহে কুন্তীকে যেমন সর্বেসর্বা এক কত্রীর ভূমিকায় দেখেছি আমরা, তাতে এই গৃহে কোনও জননীর স্নেহ তিনি পেয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে। কুন্তিভোজের গৃহে এসে পালক পিতার আদর তিনি যথেষ্টই পেয়েছেন, কিন্তু এই গৃহে কোনও স্নেহময়ী জননীকে আমরা দেখিনি কুন্তীকে সর্বক্ষণ আগলে রাখতে। সূর্যের সঙ্গে কথোপকথনের সময় কুন্তী যে দু-একবার বলেছেন–আমার পিতা, আমার মাতা কী ভাববেন, অথবা সূর্যও যে বলেছেন–তোমার পিতা কিংবা মাতা তোমার প্রভু নন–সেখানে এই কথাগুলি সাধারণ কথার মাত্রা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। বাস্তবে মাতা শব্দের কোনও অর্থ এখানে যদি থেকেও থাকে, তবে সে মাতা বৃষ্ণিকুলে আর্যক শূরের গৃহিণী, কুন্তীর গর্ভধারিণী মাতা।

আর্যক শূরের ঘরে কুন্তী কদিনই বা ছিলেন! কিন্তু যতদিন ছিলেন, ততদিনে জননীর বাৎসল্য-পরিপাক যথেষ্ট ঘটে যাবার কথা। জননীর সেই পরিপক্ক বাৎসল্য-রসে জলাঞ্জলি দিয়ে কুন্তীকে যখন কুন্তিভোজের বাড়িতে চলে আসতে হয়েছিল, তখন মুকুলিকা-বালিকার হৃদয়ে জননী শব্দটি কতটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল, তা কুন্তী যেমন জানেন, তেমনটি কে আর জানে? সেই বালিকা-বয়স থেকেই বাৎসল্যের স্নেহ-রসে বঞ্চিত এক দত্তক-কন্যার জীবনে যখন তাই অকাল-মাতৃত্ব নেমে এল, তখন সেখানে মাতৃত্বের মর্ম খুব বড় হয়ে উঠল না, বরঞ্চ পুত্রজন্মের আকালিকতাই সেখানে আরও এক জটিলতর আবর্ত তৈরি করল। এই আবর্ত থেকে সাময়িক মুক্তির একমাত্র উপায় ছিল শিশু পুত্রকে পরিত্যাগ করা।

 গৃহস্থের ঘরে কোনও সন্তান যদি জন্মমাত্রেই মারা যায়, তাতে যা দুঃখ হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখ যদি সে সন্তান খানিকটা বড় হয়ে মারা যায়। শৈশব থেকে কৈশোরে পৌঁছনোর মধ্যে যতটা সময় যায়, সেই সময়ের ক্রমপর্যায়ে একটি শিশুর যে আঙ্গিক, বাঁচিক এবং ভাবের পরিবর্তন ঘটে, তাতে পিতা-মাতার হৃদয়ে আরও গভীর থেকে গভীরতর মায়া তৈরি হয়। এই মায়া তৈরি হবার পর যদি পুত্র-কন্যাকে ছেড়ে দিতে হয় অথবা সে মারা যায়, তবে পিতা-মাতা জীবিত অবস্থাতেও জীবিত থাকেন না। তাই আরও কোনও গভীরতর মায়া তৈরি হবার আগেই কুন্তী তাঁর পরিচারিকার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন–পুত্রটিকে পরিত্যাগ করতে হবে। এতে যেমন সারা জীবন সামাজিক গঞ্জনা থেকে মুক্তি পাবেন কুন্তী, তেমনি মায়া তৈরির আগেই হঠাৎ করে মায়া কাটিয়ে দিয়ে খানিকটা যদি শান্তি পাওয়া যায়, আপাতত সেই ভাবনাতেই পুত্রকে পরিত্যাগ করে অতি-অযৌক্তিক এক মুক্তির স্বাদ পেতে চাইলেন কুন্তী।

কুন্তীর পরিচারিকা একটি পেটিকা নিয়ে এসে রাখল কুন্তীর সামনে। পেটিকাটি বেতের তৈরি। কুন্তী জানেন সূর্যের-অক্ষয় কবচ-কুণ্ডল যতক্ষণ এই শিশুর অঙ্গলগ্ন হয়ে থাকবে, ততক্ষণ এই শিশুর মৃত্যু নেই। অতএব বেতের পেটিকার মধ্যে শিশুটিকে রেখে, সেই পেটিকাটি নদীর জলে ভাসিয়ে দিলে কোনও না কোনওভাবে শিশুটির জীবনরক্ষা হবে হয়ত।

বেতের পেটিকাটির চারদিকে মোম লেপে দিল কুন্তীর পরিচারিকা। যাতে বেনির্মিত পেটিকাটির ভিতর জল না ঢোকে। কোমলতা এবং উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য পেটিকার ভিতর পেতে দেওয়া হল নরম নরম কতগুলি কাপড়–মধূচ্ছিষ্ঠস্থিতায়াং সা..স্বাস্তীৰ্ণায়াং সমন্ততঃ। সুরক্ষিত এই পেটিকাটির মধ্যে শিশুপুত্রটিকে সযত্নে শুইয়ে দিলেন কুন্তী।

দেব দিবাকর অনেকক্ষণ অস্তাচলে চলে গেছেন। রাত্রির আঁধার ঘনিয়ে আসছে একটু একটু করে। লোকের গতাগতি স্তব্ধ হয়ে এল রাজপথে। কুন্তীর প্রকোষ্ঠ থেকে পরিষ্কার দেখা গেল অশ্বনদীর উচ্চাবচ পথরেখা। এমনিতেই রাজার কন্যান্তঃপুরের আশেপাশে মানুষের গতাগতি কম। তার ওপর রাত ঘনিয়ে এসেছে। কুন্তীর বিশ্বস্ত পরিচারিকা একটি অস্পষ্ট দীপবর্তিকা হাতে নিয়ে কুন্তীকে তার পিছন পিছন যেতে বলল। বৈতসী-বেত্রময়ী পেটিকাটি সযত্নে ধারণ করে ত্ৰ-শঙ্কিত পদে অস্পষ্ট দীপালোকে অনুসরণ করে অশ্বনদীর পথে চললেন কুন্তী। গ্রহ-নক্ষত্রমালিনী রাত্রিতে কুন্তী দুঃখ-বিপদের সাক্ষী হয়ে রইল শুধু আকাশের চাঁদ!

অশ্বনদীর ধারে এসে পরিচারিকা দীপবর্তিকা হাতে দাঁড়াল। কুন্তী পেটিকাটি চেপে ধরলেন বুকে। এবার ভাসিয়ে দিতে হবে পরাণ-পুতলি শিশুটিকে। জীবনে প্রথম পুত্রজন্মের পর যে পরম আনন্দ লাভ করে জননী, কুন্তী সেই আনন্দের ভাগী হতে পারলেন না। সমাজের ক্রুরতায় আজ এক অসহায় শিশুকে ভাসিয়ে দিতে হবে জলে। কুন্তী অনেক কাদলেন। শিশুপুত্রকে কোলের মধ্যে চেপে ধরে কুত্তী অনেক কাঁদলেন–পুত্রস্নেহেন রাজেন্দ্র করুণং পৰ্য্যদেবয়ৎ। তারপর আবার তাকে শুইয়ে দিলেন পেটিকার মধ্যে। পেটিকার মুখখানি এঁটে দিলেন শক্ত করে।

আর দেরি করা যায় না। কুন্তী অশ্বনদীর জলে ওপরে পেটিকাটি অনেকক্ষণ স্থির রেখে আস্তে আস্তে ভাসিয়ে দিলেন জলেশ্লায়াং সুপিধানায়ামশ্বনদ্যামবাসৃজৎ।

.

৭৪.

সামান্য নির্মমতার মুহূর্তে যখনি বেতের পেটিকাটি অশ্বনদীর জলের ওপর ঠেলে দিলেন কুন্তী, সেই মুহূর্তেই কুন্তীর মাতৃহৃদয় একেবারে উথাল-পাতাল হয়ে উঠল। যে সন্তান তাকে প্রথম মা বলে ডাকত, যার কপালে তিনি প্রথম স্নেহের চুম্বনটি এঁকে দিয়েছিলেন, যার জন্য আপনিই তার স্তনদুগ্ধ ক্ষরিত হচ্ছিল, সেই সন্তানকে অশ্বনদী যখন তার শান্ত-তরঙ্গ ভঙ্গে দূর থেকে আরও দূরে নিয়ে যেতে লাগল, তখনই কুন্তী কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়লেন। প্রাণপ্রিয় পুত্রটি যাতে শুধু জীবনে বেঁচে থাকে তার জন্য অন্তরীক্ষ লোকের সমস্ত দেবতাকে তিনি মুহূর্তের মধ্যে বিচলিত করে তুললেন।

অশ্বনদীর পারে দাঁড়িয়ে সমাজ-সংসারের ভয়ভীত এক অভাগা জননী কাঁদতে কাঁদতে বললেন–বাছা আমার। জলের রাজা বরুণদেব এই অখণ্ড জলরাশির মধ্যে যেন বাঁচিয়ে রাখেন তোকে। তোর পিতা, যিনি অলৌকিকভাবে তোকে দিয়েছিলেন আমার কোলে, তিনি যেন বাঁচিয়ে রাখেন তোকে–পিতা ত্বাং পাতু সর্বত্র তপনস্তপতাং বরঃ সর্বত্রগামী পবনদেব যেন তোকে নিঃশ্বাস দেন সব সময়। বিপদে আপদে, সম্পদে তোকে বাঁচিয়ে রাখুন অন্তরীক্ষ লোকের সমস্ত দেবতারা, সিদ্ধ-সাধ্য, আদিত্য-বসুরা। বাছা আমার! ভয় নেই কোনও, তুই যেখানে থাকিস, তোর এই গায়ে আঁটা বর্ম দেখে আমি ঠিক চিনে নেব তোকে–বেৎস্যামি ত্বং বিদেশে পি কবচেনাভিসূচিতম্।

কুন্তী আশা রাখেন–তার এই প্রথম জন্ম পুত্রের সঙ্গে আবার দেখা হবে কোনওদিন। কিন্তু এই মুহূর্তে এক সদ্য-জননীর হৃদয় ছিঁড়ে যাকে জলে ভাসিয়ে দিলেন তিনি, সে নিশ্চয়ই মানুষ হতে থাকবে কারও সুগভীর অপত্য-স্নেহে। এমন দৈবপ্রেরিত কবচ-কুণ্ডল পরা একটি পুত্র লাভ করলে কোনও মানুষ তাকে ত্যাগ করবে না। কুন্তী বললেন–ভাগ্য বটে তোর পিতার, যিনি আকাশ থেকে সহস্র কিরণ-কর-সম্পাতে স্পর্শ করবেন তোকে। ধন্যি মানি সেই জননীকে, যিনি তোকে পুত্রের মতো মানুষ করবেন, যিনি তোর তৃষিত ওষ্ঠাধরে প্রথম স্তন্য দান করবেন–যস্যাজ্জ্বং তৃষিতঃ পুত্র স্তনং পাস্যতি দেবজ। কেমন মধুর স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই জননী, যিনি তোর মতো এমন সুন্দর একটি ছেলে কোনও শুভ স্বপ্নেও ছিল কি তার? এমন সুন্দর চেহারা, এমন পদ্মকলির মতো গায়ের রঙ, পদ্মের পাপড়ির মতো এমন চোখ, এমন ললাট, এমন চুল–এমন একটি পুত্রের মধুর স্বপ্ন কখনও কি সেই জননী দেখেছিলেন কো নু স্বপ্নস্তয়া দৃষ্টো যা ত্বমাদিত্যর্বচসম্?

কুন্তীর জননী-হৃদয় পেটিকার মধ্যে থাকা সেই শিশু পুত্রটির একটু একটু করে বেড়ে ওঠার কল্পনায় আপ্লুত হয়ে পড়ল বারেবারে। ভাসমান পেটিকাটির দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই তিনি বলে ওঠেন–তুই যখন ধুলোমাটির মধ্যে লুটোপুটি করে হামাগুড়ি দিবি, আধো-আধো কথা বলবি–তখন যারা তোক দেখবে, তাদের পুণ্যের কথা আর কী বলব–অব্যক্তকলবাক্যানি বদন্তং রেণুগুণ্ঠিত। তারপর যখন তোর শরীরে যৌবন আসবে, লোহার মতো হয়ে উঠবে তোর শরীর, তখন মনে হবে যেন হিমালয়ের বন থেকে দৃপ্ত সিংহটি বেরিয়ে এসেছে। ডুয়ে-হিমব বনসঙুতং সিংহং কেশরিণং যথা। কারা দেখবে তোর সেই চেহারা?

এইভাবে একটি শিশু পুত্রকে ছোট থেকে বড় হতে দেখার যে সুখ, সে সুখ কুন্তী জননী হওয়া সত্ত্বেও পেলেন না। তাই অনেক কাঁদলেন কুন্তী। মেক কাদলেন–এবং বহুবিধং রাজ বিলপ্য করুণং পৃথা। রাত্রি গভীর ঘন হয়ে এল (সমস্ত আশা নির্মূল হয়ে গেলেও কুন্তীর জননী-হৃদয় বার বার শুধু এক কথা উচ্চারণ করল–বাছা! ঠিক তোর দেখা পাব একদিন, তোর ওই জন্মলগ্ন কবচ-কুণ্ডল দেখে ঠিক তোকে চিনে নেব বাছা। অনেক কেঁদে, অনেক বাষ্প মোক্ষণ করে প্রায় অর্ধেক রাত্রে পরিচারিকার কাঁধে ভর দিয়ে নিশ্রুপে নিজ ভবনে ফিরে এলেন কুন্তী-ধাত্রা সহ পৃথা রাজ পুত্ৰদৰ্শন-লালসা। অশ্বনদীর জলে বেতসী পেটিকা একটু একটু করে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল চর্মগ্বতীর দিকে।

মথুরা নগরী ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে কুন্তি রাষ্ট্রের কন্যান্তঃপুরে আজ যে ঘটনা ঘটে গেল, সে ঘটনা কেউ জানল না। রাজা কুন্তিভোজ আগের দিনের মতোই সভায় গেলেন। রাত্রিশেষে একই সূর্য উঠল পূর্ব দিবধূর মিলন-রক্তিম আভাসে। শুধু এক রাত্রির মধ্যেই কন্যান্তঃপুরের সেই যুবতীটি এক পরিণতা ধীরা রমণীতে পরিণত হলেন।

মহারাজ আর্যক শূরের পুত্র-কন্যার ভাগ্যটাই বুঝি এইরকম। তার প্রথমা কন্যাটি কন্যা অবস্থায় অলৌকিকভাবে একটি পুত্র লাভ করেও তার একান্ত আপন পালক পিতার ভয়ে–সম্বোধনভয়াৎ পিতুঃ–তাকে জলে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। ওদিকে খোদ মথুরায় আর্যক শূরের প্রথম পুত্র বসুদেব সস্ত্রীক আবদ্ধ হয়ে আছেন কংসের কারাগারে। মথুরার সর্বাধিনায়ক মহারাজ কংস একে একে তাঁর ছয়টি পুত্রকে মাতৃক্রোড় থেকে টেনে এনে নৃশংসভাবে মেরে ফেলেছেন। দেবকীর সপ্তম পুত্র জন্মানোর আগেই পৌরাণিকেরা চরম অলৌকিকতার আশ্রয় নিলেন। অঘটনঘটনপটীয়সী যযাগমায়া দেবকীর সপ্তম গর্ভ আকর্ষণ করে স্থাপন করলেন বসুদেবের অন্য পত্নী রোহিণীর উদরে। পৌরজনেরা জানল দেবকীর গর্ভ নষ্ট হয়ে গেছে–অহহা বিংসিততা গর্ভ ইতি পৌরা বিচুকুসুঃ।

আমরা জানি–বসুদেবের পত্নী রোহিণী কুরুবংশের কন্যা। মহারাজ শান্তনুর মেজো দাদা বাহ্লীকের মেয়ে বলে তিনি পরিচিত। কংসের কাকা দেবকের সাত মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবার আগেই পুরু-ভরতবংশের পাঁচটি মেয়ের সঙ্গে বসুদেবের বিয়ে হয়েছিল। রোহিণী এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন। অলৌকিকতায় বিশ্বাস করলে মানতেই হবে যে, ভগবতী যোগমায়া দেবকীর সপ্তম গর্ভটি আকর্ষণ করে রোহিণীর উদরে সংস্থাপন করলেন এবং রোহিণীর গর্ভে বসুদেবের সপ্তম পুত্রটি বেঁচে বর্তে রইল। কংসের চরেরা কংসকে খবর দিল–দেবকীর গর্ভ নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এইখানে আমাদের একটি নিবেদন আছে, কেননা অলৌকিকতার আশ্রয় নিয়েও ঘটনাটা বোধহয় ব্যাখ্যা করা যায়। অবশ্য তার জন্য অন্যান্য পুরাণগুলিকে আমাদের প্রমাণ হিসেবে মানতেই হবে।

আমাদের ধারণা–দেবকীর ছয়টি সন্তান যেভাবে পর পর কংসের হাতে বিনষ্ট হয়, সেই পরম্পরার মধ্যে সরল পৌরাণিকের কিছু অতিশয়োক্তি থাকতে পারে। কেন, তা জানাই। অলৌকিকতায় বিশ্বাস না করলে আপনারা কতগুলি যুক্তি মাথায় রাখুন। প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, বসুদেব কংসেরই রাজভবনে তারই কাকা দেবকের মেয়ে বিয়ে করতে গিয়ে রাজরোষে কারাগারে আবদ্ধ হন। কংসের হাতে দেবকী-বসুদেবের ছয়টি সন্তান নিহত হবার ঘটনাকে আমরা কথঞ্চিৎ অতিশয়িত বিবরণ বলে মনে করি এইজন্য যে, মহাভারতের উত্তরভাগ খিল-হরিবংশে এই ছয়টি ছেলের পূর্বজন্মের একটা কাহিনী বলা আছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে দেবকীর এই শিশুপুত্রগুলি পূর্বজন্মে কালনেমির পুত্র ছিলেন। তারা সকলেই দানব। হরিবংশ এই দানবদের একত্রিতভাবে নাম দিয়েছে–ষড়গর্ভ বলে। এঁরা নাকি ব্রহ্মার তপস্যা করে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর মনে ব্যথা দেন এবং হিরণ্যকশিপু এঁদের শাপ দেন যে, তারা তপস্যায় যতই ভগবান ব্রহ্মাকে তুষ্ট করুন না কেন, তারা তাদের পিতার দ্বারাই নিহত হবেন–স এব বো গর্ভগতা পিতা সর্বান হনিষ্যতি। মহাভারত-পুরাণমতে কংস কালনেমির অবতার। এই ষড়গর্ভ নামক দানবেরা তাদের পিতা কংসের হাতেই নিহত হয়েছেন, অতএব হিরণ্যকশিপুর অভিশাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে।

আমাদের বক্তব্য কিন্তু এখানে নয়। আমাদের বক্তব্য হল–কালনেমির পুত্রদের একত্রিতভাবে ষড়গর্ভ নাম দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা সত্যি ছয় কিনা, সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট কথা হরিবংশে নেই। দ্বিতীয়ত দেবকীর পুত্রদের সংখ্যা ছয় বলেই পূর্বজন্মে। ষড়গর্ভ নামক দানবকে বহুবচনে ডাকা হয়েছে সর্বত্র। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন–এই ষড়গর্ভ দানবেরা যখন তপস্যার জোরে ভগবন্নারায়ণের ভবিষ্যৎ গর্ভাবাস দেবকীর জঠরে পুত্র হিসেবে জন্মাচ্ছেন, তখন কিন্তু ষড়গর্ভের ষট-সংখ্যা ভুলে পুরাণকার মুখ ফসকে একবচন ব্যবহার করেছেন। হরিবংশের কথকঠাকুর বললেন–ছয় দানবই তখন দেবকীর গর্ভে জন্ম নিয়ে ষড়গর্ভ হলেন–ষড়েব দেবকীগর্ভে ষড়গর্ভো বৈ মহাসুরাঃ।

 আমাদের বিশেষ ধারণা ষড়গর্ভ–এই নামটার মধ্যে ষড় অর্থাৎ ছয়-সংখ্যার অর্থ থাকার ফলেই দেবকীর গর্ভজাত সন্তানদের সংখ্যা ছয় হয়েছে। এতে পৌরাণিকের সুবিধে এই যে, পর পর ছয়টি শিশুকে পাথরে আছড়ে মারার ফলে একদিকে যেমন কংসের নৃশংসতা বেশি করে দেখানো গেছে, অন্যদিকে তেমনি বসুদেবের করুণ অবস্থাও এতে বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। আরও একটা ব্যাপার-বিশাল কোনও ব্যক্তিত্বের জন্ম হবার আগে তাঁর পূর্বজন্মাদের আকালিক এবং কষ্টকর মরণ দেখানোটা অনেকটাই মহাকাব্যের অঙ্গের মধ্যে পড়ে। এতে ক্ষণজন্মা বিরাট পুরুষের একটা heroic isolation তৈরি হয়। দেবব্রত ভীষ্ম জন্মানোর আগেও এইরকম অকালমৃত্যু আমরা দেখেছি–অষ্ট বসুর সাত বসুকেই জন্ম মাত্রেই জলে ডুবিয়ে মেরেছেন গঙ্গা। আপন মায়ের হাতের সেই মৃত্যুর মতোই এখানে কালনেমি-রূপী পিতা কংসের হাতে ষড়গর্ভের মৃত্যু হয়েছে।

পুত্রের এই সংখ্যাধিক্য অবশ্যই এক অতিশয়োক্তি ঘটনা এবং এখানে তো বড়গর্ভের মতো একটি অসাধারণ শব্দ মিলে যাওয়ায় দেবকীর পুত্র-সংখ্যা ছয় হাতে দেরি হয়নি। বাস্তবে আমরা বিশ্বাস করি যে, যড়গর্ভ আসলে একটিমাত্র দানবের নাম এবং দেবকীর একটি মাত্র সন্তানই হয়ত কংসের হাতে নিহত হয়েছে, যার নাম হয়ত যড়গর্ভ। এই যড়গর্ভের পর সপ্তম গর্ভাক আর রোহিণীর উদরে অলৌকিকভাবে সংস্থাপন করার প্রয়োজন পড়ে না। বসুদেব কংসের কারাগারে আবদ্ধ হবার অন্তত এক-দুই বছর আগেই রোহিণীর গর্ভাধান করে থাকবেন। এদিকে দেবকীর ষড়গর্ভ কংসের হাতে মৃত্যু বরণ করেছেন, ওদিকে বৃন্দাবনে রোহিণীর গর্ভে সংকর্ষণ বলরাম জন্মগ্রহণ করেছেন স্বাভাবিক ময্যের নিয়মেই আর সংকর্ষণ নামটির জন্য দেবকীর গর্ভ আকর্যণ না করলেও চলে। পুরাতত্ত্ববিদ মিথলজিস্টরা বলরামের সংকর্ণ নামের মধ্যে পুরাতন কৃষি-সভ্যতার সংযোগ দেখেছেন। তার অস্ত্র হল বা লাঙলও কর্ষণের প্রতীক।

আমরা জানি–বসুদেব কংসের প্রতিপয় নেতা ছিলেন। কংসের অত্যাচার যখন বসুদেবের ঘর পর্যন্ত এসে পৌঁছর, তখনই তিনি তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধ নন্দ-গোপের বাড়িতে রোহিণীকে রেখে এসেছিলেন তার নিরাপত্তার কারণে এবং হয়ত তিনি তখনই গর্ভবতী ছিলেন। বসুদেবের অন্য চার পৌরবী পত্নীর নাম কিন্তু এখানে শোনা যাচ্ছে না। একমাত্র পৌরবী রোহিণীই তাঁর বন্ধুর বাড়িতে আছেন বলেই আমরা মনে করি–তিনি তখনই গর্ভবতী ছিলেন এবং গর্ভবতী বলেই এমাত্র তারই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন বসুদেব।

ঠিক এই রকমটি না হলে–বসুদে সাত বছর বারে কংসের কারাগারে আবদ্ধ আছেন আর ওদিকে রোহিণীর গর্ভে তার পুত্র মোচ্ছে–এই কাহিনীর মধ্যে অলৌকিকতার আমদানী করতেই হবে। কিন্তু দেবকীর প্রথম পুত্রটির নামই যদি গর্ভ বলে বিশ্বাস করে। হরিবংশের প্রমাণে যা বিশ্বাস করাই উচিত, তাহলেই দেবকীর তথাকথিত সপ্তম গর্ভের সমান হয়ে যায়। সঙ্কর্ষণ বলরামকে তাহলে আর রোহিণীর উদরে প্রতিস্থাপন করতে হয় না। তার জন্ম স্বাভাবিকভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়।

সময়ের দিক থেকে যদি হিসেব করা যায়, তবে বলতে হবে, সঙ্কৰ্ষণ বলরাম ছিলেন কৃষ্ণের ঠিক এক বছরের বড় আর কৃষ্ণকে আমরা অর্জুনের সমবয়সী বলে জানি। ঠিক এইভাবে বিচার করলে দেখা যাবে–এই একটু আগে যে শিশু পুত্রটিকে আমরা এক বেতসী পেটির মাধ্যে শায়িত অবস্থায় দেখলাম, অশ্বনদীর শান্ত তরঙ্গ–ভঙ্গর মধ্যে যাকে একটু একটু করে চর্মর্ধতী নদীর দিকে ভেসে যেতে দেখলাম–এই শিশু-পুত্রটি মাথুর বসুদেবের প্রথম ভাগিনেয়। তার নিজের পুত্র বলরাম এবং কৃষ্ণের থেকে ইনি অন্তত চার-পাঁচ বছরের বড়।

কংসের অত্যাচার তখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, যাদবরা তখন একেকজন একেক জায়গায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভাগবত পুরাণের প্রমাণ দিয়ে আমরা আগেই জানিয়েছি যাদবরা তখন কুরু, পাঞ্চাল, কেকয়, শা, বিদর্ভ, নিষধ, বিদেহ কোশল–এইসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছেন–তে পীড়িত নির্বিবিশু কুরু-পাঞ্চাল-কেকয়া। কংসের কিছু জ্ঞাতিগোষ্ঠী, তবুও মথুরাতেই কেউ কেউ বাস করছিলেন। তাদের মধ্যে অর তো একজন বটেই, বসুদেবও একজন। বসুদেব ক্রমাগত কংসের প্রতিপক্ষতা করে সাময়িকভাবে বেশ বিপন্ন বোধ করতে থাকেন এবং হয়ত এই সময়েই তিনি রোহিণীকে রেখে আসেন বন্ধুর বাড়িতে বৃন্দাবনে। এরই মধ্যে কংসের সঙ্গে বসুদেবের সম্পর্কের কিছু উন্নতির সম্ভাবনা ঘটে, কারণ কংসের কাকা দেবক কোনও অজ্ঞাত কারণে–অথবা বলা যায় কংসের প্রতি প্রতিপক্ষতা করেই তার সাতটি মেয়ের সঙ্গে বসুদেবের বিয়ে ঠিক করে বসেন। কংস তার ছোট বোন দেবকীকে খুবই ভালবাসতেন। কিন্তু বিবাহের আসরেই এক দৈববাণী অথবা জনবাণীর ফলে বসুদেব রাজরোষে পড়ে যান। তিনি কারাগারে আবদ্ধ হন।

বসুদেব কারাগারে বন্দী হবার বেশ কিছু আগেই কিন্তু কুন্তীর কানীন পুত্র লাভের ঘটনাটি ঘটে যায়। বসুদেবের সঙ্গে তখনও দেবকীর বিয়ে হয়নি। ওদিকে, কুরুরাজ্যে বিচিত্রবীর্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র ধৃতরাষ্ট্র তখন সবে বিবাহ করতে চলেছেন গান্ধার রাজ্যে। গান্ধাররাজ সুবলের মনে সামান্য একটু দুঃখ ছিল। জামাইটি জন্মান্ধ, বয়োজ্যষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য পাননি, সেই রকম একটি পুরুষের হাতে মেয়ে তুলে দিতে হবে। সুর্বলের একটু খারাপই লাগছিল। শেষে কুবংশের মর্যাদা এবং পাণ্ডুর রাজা হওয়া সত্ত্বেও কুরুরাজ্যে ধৃতরাষ্ট্রের সম্মান মাথায় রেখে গান্ধার সুবল শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন।

খবরটা গান্ধারীর কানে যথাসময়ে আগেই চলে গেল। তিনি পরস্পর জানতে পারলেন–যাঁর সঙ্গে তার সারা জীবনের বন্ধন ঘটবে, তিনি চক্ষুহীন, জন্মান্ধ-গান্ধারী ত্বথ শুশ্রাব ধৃতরাষ্ট্রম অক্ষয়! গান্ধারীর সহচরী-পরিচারিকারা বলাবলি, কানাকানি করতে লাগল–ছেলে কানা, জন্ম থেকেই চক্ষুহীন। গান্ধারী সব শুনছেন। তিনি এও শুনেছেন–ভাবী জামাইকে জন্মান্ধ জোনেও তাঁর পিতা-মাতা দুজনেই রাজি হয়েছেন এই বিবাহে–আত্মানং দিৎসিতঞ্চাস্মৈ পিত্রা মাত্রা চ ভারত।

গান্ধারী এই মুহূর্তে কী করতে পারতেন। আমরা যে সময় এবং সমাজের কথা বলছি, সেখানে স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা যথেষ্টই ছিল। অর্থাৎ গান্ধারী ইচ্ছা করলে পিতার প্রস্তাব নস্যাৎ করে বলতে পারতেন–না, আমি এক জন্মান্ধ পুরুষের সঙ্গে নিজের জীবন এবং ভবিষ্যৎ জড়াব না। কিন্তু গান্ধারী তা বলেননি এবং এই না বলার মুহূর্ত থেকেই আমাদের গান্ধারীর চরিত্র খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমেই জানাই–এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে গান্ধারীর কোনও ব্যক্তিত্ব ছিল না। তার ব্যক্তিত্বের প্রমাণ আমরা সারা মহাভারত জুড়ে পাব। কিন্তু তারও আগে মহাভারতের কবির প্রতিজ্ঞাটি আমাদের জানাতে হবে। মহাভারতের আরম্ভেই ব্যাস বলেছিলেন–আমি কুরুবংশের বিস্তারিত বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে গান্ধারীর ধর্মশীলতার কথাও বলব–বিস্তরং কুরুবংশস্য গান্ধাৰ্য্যা ধর্মশালতাম্।

মহাভারতের কবি আরও কিছু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। বলেছিলেন–আমি বিদুরের প্রজ্ঞার কথা বলব, কুন্তীর ধৈর্যের কথা বলব। বলব বাসুদেব কৃষ্ণের মহনীয়তার কথা, পাণ্ডবদের সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাবার কথাও বলব–বাসুদেব মাহাত্মং পাণ্ডবানাঞ্চ সত্যতা। যে তালিকার মধ্যে কৃঃ বাসুদেবের মতো ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, তার কথা আগে না বলে প্রথমে গান্ধারীর ধর্মশীলতা সম্বন্ধে প্রতিজ্ঞার একটা আলাদা তাৎপর্য আছে।

আসলে এই ধর্মশীলতার মর্মও কিন্তু কখনই ফুল-নৈবেদ্য-বেলপাতা নয়। ধর্ম এখানে ন্যায়-নীতির বিশদ মাত্রায় ব্যবহৃত! গান্ধারী স্ত্রীলোক। সে যুগে স্ত্রীলোকেরও একটা বিশেষ ধর্ম ছিল, তবে এই ধর্ম যে পতির অনুগামিতায় সব কিছু মেনে নেবার ধর্ম নয়, তার প্রমাণ পাব মহাভারতের বিভিন্ন পর্যায়ে, কিন্তু এই মুহূর্তে একটি জন্মান্ধ পুরুষকেও যে স্বামী হিসেবে মেনে নিচ্ছেন, তার কারণ একটাই। কন্যাদায়গ্রস্ত এক পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে তিনি বোঝেন যে, তাঁর জন্য পিতা-মাতার চিন্তা কিছু কম নেই। তিনি জানেন যে, পিতা-মাতা যথাসাধ্য ভাল পাত্রের হাতেই তাকে ন্যস্ত করতে চান। কিন্তু নিতান্ত নিরুপায় হয়েই তারা এই অন্ধ পুরুষটিকে জামাতা হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। এই নিরুপায়তার কারণ এই নয় যে, সেকালে সুপাত্রের অভাব ছিল, অথবা সেকালে স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা ছিল না। এই নিরুপায়তার একমাত্র কারণ পুরু-ভরত-বংশের মর্যাদা, যা গান্ধারের মতো একটি ছোট রাজ্যের রাজাকে মোহিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল–কুলং খ্যাতিঞ্চ বৃত্তঞ্চ বুদ্ধ্যা তু প্রসমীক্ষ্য সঃ। তার মধ্যে কুরুবংশের প্রধান পুরুষ শান্তনুর পুত্র ভীষ্ম যেখানে নিজের পুত্রপ্রতিম ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহের জন্য গান্ধাররাজ সুবলের কাছে কন্যা যাচনা করে দূত পাঠিয়েছেন, সেখানে তার পক্ষে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা খুব কঠিন ছিল।

গান্ধারী এক ক্ষত্রিয়ের মেয়ে হিসেবে বুঝেছেন যে, তাঁর পিতা মহামতি ভীষ্মের যাচনায় যেমন মুগ্ধ হয়েছেন, তেমনি মুগ্ধ হয়েছেন কুরুবংশের মর্যাদায়। এই কারণে ভাবী জামাতাকে অন্ধ জেনেও তাঁর পিতা এই মহান বিবাহ-সম্বন্ধ অস্বীকার করতে পারছেন না। গান্ধারী পিতার দুঃখের কথাও জানেন এবং পিতার নিরুপায়তার কথাও জানেন। আর জানেন বলেই তার দুঃখের ওপরে মহান এক আবরণ বিছিয়ে দেন অভিনব এক উপায়ে। ভাবী স্বামীর অন্ধতা জেনে তিনি নিজের আয়ত দুটি চোখের ওপর বেঁধে নিলেন একটি পট্টবস্ত্র–ততঃ সা পট্টমাদায় কৃত্বা বহুগুণং শুভা। গান্ধারী বোঝাতে চাইলেন–যাঁর স্বামী জন্মান্ধ, তার অর্ধাঙ্গিনী স্ত্রী হিসেবে তার চক্ষু চেয়ে থাকা মানায় না। বস্তুত এই আচরণে এক দিকে তিনি যেমন পিতার দুঃখ ঢেকে দিলেন, তেমনি একটি অসহায় জন্মান্ধ পুরুষকে নিজের জীবনে স্বাগত জানালেন অসীম মায়ায়।

 গান্ধারী মনে মনে কল্পনা করেছিলেন–কোনও দোষই তার স্বামীর নেই। তিনি শুধু দেখতে পান না। যে চোখ দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখবার কথা ছিল তাঁর, যে চোখ দিয়ে এক যৌবনবতী রমণীর উদ্ভিন্ন যৌবন উপলব্ধি করবার কথা ছিল, সে চোখ তার নেই। গান্ধারী জানেন–দৃষ্টি যার থাকে না, সে জগতের রূপ-রস আস্বাদন করে আপন অনুভবে। অনুভবশক্তি এবং সংবেদনশীলতাই তাঁর ইন্দ্রিয়ের অক্ষমতাকে নিরস্ত করে। গান্ধারী বুঝেছিলেন–তিনি নিজে যদি চক্ষু থাকা সত্ত্বেও চক্ষু দুটি পট্টাবৃত করে রাখেন, তবেই তার প্রতিষ্ঠা ঘটবে ভাবী স্বামীর সম-অনুভবের ভূমিতে। স্বামীকে তিনি বুঝতে পারবেন, অনুভব করতে পারবেন সহমর্মিতায়।

স্বামীর জন্য এই সহমর্মিতাই গান্ধারীর ধর্মশীলতা। একজন অন্ধ স্বামীর স্ত্রী যদি চক্ষুষ্মতী হন, তবে বাস্তবে যে সুবিধা হয়, সে সুবিধা গান্ধারী চান না। তিনি চান না–স্বামী যা দেখতে পান না, তা দেখতে অথবা স্বামী যে রূপ-রসে বঞ্চিত, তার অংশভাগিনী হতে। নিজের চক্ষুদুটি পট্টবস্ত্রে বেঁধে গান্ধারী বললেন–আমি স্বামীকে কোনওভাবে অতিক্রম করব না–নাতিশিষ্যে পতিমহম্ ইত্যেবং কৃতনিশ্চয়। আমরা জানি–এই অনতিক্রমের মধ্যে তৎকালীন সমাজের সাধারণ পাতিব্রত্যের চেয়েও আরও গভীর এক মর্ম আছে, যে মর্ম বোঝা যায় শুধু অনুভবে, উপলব্ধিতে। ধৃতরাষ্ট্র বিবাহ করতে এসে নিজের চোখে যেমন তার একান্ত পরিণীতা স্ত্রীকে চোখে দেখতে পেলেন না, তেমনি গান্ধারীও তাকে দেখতে পেলেন না। অথবা বলা উচিত–দেখলেন না এক স্বেচ্ছাপ্রযুক্ত অন্ধতায়। দুই যুবক-যুবতীর প্রথম শুভদৃষ্টি হল মর্মে মর্মে, হৃদয়ে হৃদয়ে–যদস্তু হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম।

ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীকে বিবাহ করার জন্য গান্ধার রাজ্যে যাননি। প্রথাগত বিবাহ যাকে বলে, সেটাও বোধহয় সেখানে হয়নি। হস্তিনাপুরের দূত গান্ধারীকে হস্তিনাপুরীতে নিয়ে যাবার জন্যই গান্ধার রাজ্যে এসেছিলেন। নির্দিষ্ট দিনে গান্ধারী রওনা দিলেন হস্তিনাপুরের উদ্দেশে।

গান্ধার রাজ্যটা এখনকার ভারতবর্ষের উত্তরেরও উত্তরে একটি ছোট রাজ্য। এখানকার পথঘাট উচ্চাবচ, বন্ধুর সমস্ত জায়গাটাই প্রায় পার্বত্যভূমি। এইরকম একটা রাজ্য থেকে পার্বত্য পথ বেয়ে এক যৌবনবতী রমণীকে নিয়ে যাবার ঝুঁকি ছিল অনেক। তাছাড়া মূল বিবাহ পর্বের অনুষ্ঠান হবে হস্তিনাপুরে। গান্ধাররাজ সুবল কুরুবংশীয় জামাতার অনুরূপ যৌতুকও তো দেবেন। সেগুলিও বয়ে নিয়ে যেতে হবে হস্তিনায়। গান্ধাররাজ সুবল কিছু বৃদ্ধ হয়েছেন। তিনি এই পার্বত্য পথে যৌবনবতী কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিতে কিছু দ্বিধা করে থাকবেন হয়ত। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। গান্ধার দেশটা যতই ছোট হোক, তিনি তার রাজা। এইরকম একজন রাজা হস্তিনাপুরীর বিশাল রাজ্য খণ্ডে উপস্থিত হয়ে উপযুক্ত মর্যাদা এবং উপযুক্ত সৎকার লাভ করবেন কিনা, সে বিষয়েও হয়ত সন্দেহ ছিল। মহারাজ সুবল তাই তার পুত্র শকুনিকে মেয়েকে নিয়ে হস্তিনার পথে রওনা হতে বললেন।

 শকুনি গান্ধার রাজ্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ সৈন্য-সামন্তদের নিয়ে, কতগুলি ঘোড়া ও রথে হস্তিনাপুরের মর্যাদানুরূপ বসন-ভূষণ-যৌতুক সাজিয়ে রওনা হলেন কুরুদেশের দিকে। সঙ্গে গান্ধারী, বিবাহের মহার্ঘ্য বসন–ভূষণে সজ্জিতা, পুরু করে চোখ বাঁধা। গান্ধারী হস্তিনায় পৌঁছতেই বিবাহের উদ্যোগ আরম্ভ হল। নির্দিষ্ট দিনে শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলেন ভগিনী গান্ধারীকে–তাং ততো ধৃতরাষ্ট্রায় দদৗ পরমসকৃতাম্। চক্ষুষ্মতী গান্ধারী স্বামীর অনুগামিতায় স্বেচ্ছান্ধত্ব স্বীকার করায় মনে মনে বড়ই খুশি হয়েছিলেন সকলে। কুরুবংশের জ্যেষ্ঠা রাজবধূকে তারা পরম সমাদরে ঘরে তুলেছিলেন। সমস্ত বিবাহ অনুষ্ঠানটি তদারকি করলেন ভীষ্ম। যেখানে যা প্রয়োজন, বরপক্ষ-কন্যাপক্ষের যে সমস্ত জায়গায় দ্বিমত উপস্থিত হয় সেই সমস্ত জায়গায় শকুনি ভীষ্মের সঙ্গে একমত হয়ে বিবাহ কার্য সম্পন্ন করলেন– ভীষ্মস্যামুমতে চৈব বিবাহং সমকারয়ৎ। গান্ধার রাজ্যের সমস্ত যৌতুক তুলে দেওয়া হল ধৃতরাষ্ট্রের হাতে।

 বিবাহকার্য সমাধা হয়ে যাবার পর মহামতি ভীষ্ম গান্ধারের রাজপুত্রকে কুটুম্বের মর্যাদায় আদর–যত্ন করলেন। যে কারণে, যে দ্বিধায় মহারাজ সুবল হস্তিনাপুরে আসেননি, গান্ধারের রাজপুত্র শকুনিকে পরমাত্মীয়ের সম্মান দিয়ে ভীষ্ম বুঝিয়ে দিলেন–বিবাহের ক্ষেত্রে যে সম্বন্ধ ঘটে, তা ছোট রাজ্য বা বড় রাজ্যের তুলনা–প্রতি তুলনার বস্তু নয়, সে সম্বন্ধ আত্মীয়তার, সে সম্বন্ধ কুটুম্বিতার। শকুনি পরম সম্মানিত বোধ করে ফিরে গেলেন গান্ধারে–পুনরায়াৎ স্বনগরং ভীষ্মেণ প্রতিপূজিতঃ।

যাঁরা ভাবেন শকুনি দুরাত্মা এবং দুরাত্মার জন্যই তিনি গান্ধারীর বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে হস্তিনায় এসে দৌরাত্ম শুরু করেন, তাদের মনে রাখতে হবে–শকুনি হস্তিনায় এসেছিলেন এবং ফিরেও গিয়েছিলেন স্বদেশে। এর পর কবে এই গান্ধারের রাজপুত্র হস্তিনায় এসে ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় আপন দুর্বুদ্ধি চরিতার্থ করতে আরম্ভ করলেন, সে কথা সময়ে আসবে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *