০৪৫. রাজবধূ শকুন্তলা

৪৫.

রাজবধূ শকুন্তলা স্বামীর রাজসভায় প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, অথচ কেউ তাকে রানি বলে চিনল না। কোনও মঙ্গলশঙ্খ বেজে উঠল না তাঁর এতদিনের প্রতীক্ষিত আগমনে, দাসীরা কেউ রাজদ্বারে দাঁড়িয়ে নেই পুষ্পের থালি হাতে। তপস্বীরা রাজবাড়ির দৌবারিকের কাছে শকুন্তলা এবং তার পুত্রের প্রবেশ সুগম করার জন্য অনুমতি চাইলেন এবং রাজার অনুমতিক্রমে তাদের প্রবেশ করানো হল–বেদিতা চ প্রবেশিতা। শকুন্তলার সঙ্গে আসা কথাশ্রমের তপস্বীরা শকুন্তলা রাজসভায় ঢুকেছেন দেখেই সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেলেন–আশ্রমং পুনরাগতঃ। শকুন্তলা রাজসভায় প্রবেশ করলেন পুত্রের হাত ধরে, একা।

যে মহাকবি একটি মাত্র ঘটনার অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটকটি লিখে ফেললেন, সে ঘটনা মহাভারতে নেই। তপোবন থেকে ফিরে আসবার আগে নিজের নাম লেখা যে আংটিখানি দুষ্যন্ত পরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন শকুন্তলার হাতে, মহাকাব্যে তার। চিহ্নমাত্র নেই। মহাভারতের দুষ্যন্ত মহান পৌরব বংশের একান্ত অলক্ষ্য বীজ ব্যতীত আর কোনও স্মরণচিহ্ন রেখে আসেননি শকুন্তলার কাছে। কালিদাসে এই আংটির সূত্র ধরেই দুর্বাসার শাপও অনেক অর্থবহ হয়ে উঠেছে। কালিদাসের অভিজ্ঞানে দুর্বাসার অভিশাপ এমনই। এক অপূর্ব ঘটনা, যার মাধ্যমে নাটকের সমস্ত নাটকীয়তাই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন কালিদাস। তপোবনের মধ্যে দুষ্যন্ত-শকুন্তলার মধ্যে যে কামনার আবর্ত তৈরি হয়েছিল, তারই ফলস্বরূপ গ্রিক ট্র্যাজেডির নেমেসিস’ যেন দুর্বাসার শাপের আকার ধারণ করেছে অভিজ্ঞান শকুন্তলে।

দুর্বাসার শাপের তাৎপর্য নিয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে রবীন্দ্রনাথ–সকলেই ব্যাকুলিত হয়েছেন। আমরা তার মধ্যে যাচ্ছি না। শুধু বলে রাখি–দুর্বাসার শাপের একটা রাজনৈতিক সামাজিক তাৎপর্যও আছে, তবে সে কথা আসবে আমাদের কাহিনীর অনুক্রমেই। কালিদাসের বর্ণনায় দেখছি–রাজার কাছে শকুন্তলার প্রসঙ্গ প্রথম উত্থাপন করছেন কংশিষ্য শারব। তিনি মহর্ষি কন্থের নাম করে বলেছেন–আপনারা নিজে নিজে ঠিক করে যে বিবাহ করেছিলেন, সেটা মহর্ষি মেনে নিয়েছেন। এখন এই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তাকে আপনি আপনার গৃহস্থ ধর্ম আচরণের সহায় হিসেবে গ্রহণ করুন-তদিদানী আপন্নসত্ত্বা প্রতিগৃহ্যতাং সহধর্মচরণায়েতি। শার্সরবের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে আর‍্যা গৌতমী–একমাত্র বয়স্কা মহিলা যিনি শকুন্তলার সঙ্গে এসেছিলেন তিনিও একটু বাঁকা করে বলেছিলেন–আমাদের মেয়েও কোনও গুরুজনের অক্ষো করেনি, আর আপনিও আপনার আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে একটুও আলোচনা করেননি নাপেক্ষিত গুরুজনো’নয়া ন ত্বয়া পৃষ্টে বন্ধুঃ। আপনারা নিজেরাই যেহেতু স্বাধীনভাবে সব কিছু করেছেন, সেখানে একজনের জন্য আরেকজনের কাছে কী আর ওকালতি করব?

শার্ঙ্গরব, আর্যা গৌতমী–এঁদের কথা শুনে রাজার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল–এ সব আবার কী শুরু হল? উপন্যাস নাকি–কিমিদম উপন্যস্তম? আর লজ্জানম্রা অবগুণ্ঠনবতী শকুন্তলা রাজার প্রথম কথাটা শুনে মনে মনে বলেছিলেন-কথা তো নয়, যেন আগুন–পাবকঃ খলু বচনোপন্যাসঃ। শারব রাজার কথায় আমল দেননি। শকুন্তলাকে রাজার ঘরে প্রবেশ করানোর জন্য নতুন যুক্তির অবতারণা করেছেন। রাজা তাতে বলেছেন–আমি কি কখনও এই রমণীকে বিবাহ করেছি বলে আপনাদের মনে হচ্ছে–কিং ভবতী ময়া পরিণীতপূর্বা? শারব আকাশ থেকে পড়েছেন, আর‍্যা গৌতমী রাজার প্রত্যয়ের জন্য শকুন্তলার অবগুণ্ঠন খুলে তাকে চেনানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাজা চিনতে পারেননি। কিছুই তার মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে না, কারণ দুর্বাসা শাপ দিয়েছেন। শকুন্তলা তপোবনে বসে রাজার কথা ভাবতে ভাবতে সব ভুলে গিয়েছিলেন। দুর্বাসা অতিথি হয়ে এসে হাজার জানান দিয়েও শকুন্তলার ধ্যান ভাঙাতে পারেননি, তাই দুর্বাসা শাপ দিয়ে গেছেন–যার কথা তুই এমন করে ভাবছিস, তাকে হাজার বোঝালেও, হাজার চেনালেও সে তোকে চিনতে পারবে না–স্মরিষ্যতি ত্বং ন স বোধিতোপি সন।

প্রিয়ংবদা দুর্বাসা মুনিকে অনেক তুষ্ট করে মুনির কাছ থেকে কথা আদায় করেছিলেন যে, কোনও আভরণ-চিহ্ন রাজাকে দেখাতে পারলে রাজা তাকে চিনতে পারবেন। অনসূয়া সে কথা শুনে বলেছিলেন-বাঁচা গেল। রাজার দেওয়া আংটি তো শকুন্তলার কাছেই আছে। অতএব এ যাত্রায় বেঁচে যাবে শকুন্তলা। কিন্তু শকুন্তলা বাঁচেননি। অপূর্ব-নির্মাণ-নিপুণ কবি সেই রাজার নামাঙ্কিত আংটিটি শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার পথেই হারিয়ে দিয়েছেন। যাত্রাপথে শচীতীর্থের জলে স্নান-বন্দনা করতে নেমে শকুন্তলা আংটি হারিয়ে এসেছিলেন। অতএব দুর্বাসার শাপ ক্ষীণ হবার মতো কোনও উপকরণই রইল না শকুন্তলার অধীনে। রাজা কিছুই স্মরণ করতে পারলেন না। কালিদাসের নাটকে অপূর্ব করুণরসের যোজনা হল শৃঙ্গাররসের গৌণ বান্ধবের মতো।

মহাভারতের শকুন্তলার কাছে কোনও দুর্বাসা মুনি আসেননি। আংটি, অভিশাপ–কিছুই সেখানে নেই। তিনি পুত্রের হাত ধরে রাজসভায় ঢুকলেন এবং কোনও ভণিতা না করে রাজাকে বললেন–মহারাজ! এই নাও তোমার ছেলে। তুমিই এর জন্ম দিয়েছিলে। আমার সঙ্গে তোমার যেমন কথা হয়েছিল, সেই প্রতিজ্ঞা অনুসারে তোমার এই পুত্রকে এখন তোমার যুবরাজের সিংহাসনটি দেওয়ার কথা–অয়ং পুত্রঃ ত্বয়া রাজন্ যৌবরাজ্যেভিষিচ্যতাম্। এতদিন পরে রাজার যদি সামান্য সন্দেহ বা বিস্মৃতিও কাজ করে, তাই শকুন্তলা এখানেই থামেননি। অবশ্য অবগুণ্ঠন মোচন করা, অথবা সেই যে সেই হরিণ-শিশু আমার আঁচল ধরে টেনেছিল–এই সব কাব্যিক স্মারকচিহ্ন কিছু নয়; যে ঘটনা সবার মনে থাকে সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শকুন্তলা একেবারে গ্রাম্য ভাষায় বললেন–আমার সঙ্গে সঙ্গমের পূর্বে তুমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, মহারাজ!-যথা সমাগমে পূর্বং কৃতঃ স সময়ঃ ত্বয়া–তুমি শুধু সেই কথাটা স্মরণ করো–তং স্মরস্ব মহাভাগ কন্যাশ্রমপদং প্রতি।

মহাভারতের কবি এবার রাজার সম্বন্ধে নিরপেক্ষ মন্তব্য করছেন। তিনি বললেন শকুন্তলার কথা শুনে রাজার সব কথা মনে পড়া সত্ত্বেও–তস্যা রাজা স্মরম্নপি–রাজা মিথ্যে কথা বললেন। বললেন-তোমার কথা আমার কিছুই মনে পড়ছে না। তোমার বেশটা তপস্বিনীর মতো হলে কী হবে, আসলে তুমি বদমাশ মেয়েছেলে। ধর্ম বল, অর্থ বল, আর কামই বল–এই তিন বর্গের কোনওটার ব্যাপারেই আমার সঙ্গে তোমার কোনওদিন কোনও সম্বন্ধ ঘটেছিল বলে আমার তো মনে পড়ছে না–ধর্মার্থকামসম্বন্ধং ন স্মরামি ত্বয়া সহ। কাজেই তুমি এখানে থাক, বা চলে যাও, বা যা ইচ্ছে তাই করো, তাতে আমার কী আসে যায়–গচ্ছ বা তিষ্ঠ বা কামং যথেচ্ছসি তথা কুরু।

 পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, মহাভারতের দুষ্যন্ত জ্ঞানপাপী আর কালিদাসের দুষ্যন্ত দুর্বাসার শাপের ফলে পূর্বঘটনা বিস্মৃত। স্বভাবতই কালিদাসের দুষ্যন্ত অনেক মহনীয় স্বভাবের মানুষ। কিন্তু কেন, এই কেন’র মধ্যেই আমাদের মতে দুর্বাসার শাপের তাৎপর্য লুকিয়ে আছে। মনে রাখতে হবে–কালিদাস রাজসভার কবি। গুপ্তযুগের কোনও বিশালকীর্তি মহারাজার সভাকবি তিনি–সেকথা একেবারে নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও তার কাছে রাজার গৌরব অনেক বেশি। বিশেষত পৌরব-বংশের অধস্তন দুষ্যন্তের সম্বন্ধে বারবার তার নাটকে মর্যাদা ফুটে উঠেছে। তপোবনের প্রথম উপন্যাসে সেই যে–’জন্ম যস্য পুরোৰ্বংশে’–বলে পৌরব-বংশের মহিমা কীর্তন করেছেন কালিদাস, সেই মহিমা থেকে তার দুষ্যন্ত চ্যুত হননি কখনও। এমনকি অভিজ্ঞানের তৃতীয় অঙ্কে, যেখানে শকুন্তলা দুষ্যত্তের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছেন, সেখানেও দুষ্যন্তকে অতি-আগ্রহ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য শকুন্তলার মুখে সেই মর্যাদার অভিধান-পৌরব! শিষ্টাচার রক্ষা করো। কামনায় পীড়িত হলেও আমার নিজের ওপরে প্রভুত্ব নেই কোনও-পৌরব! রক্ষ বিনয়। মদনসন্তপ্তা অপি নহি আত্মনঃ প্ৰভবামি।

বস্তুত পৌরব-বংশীয় এক রাজার সম্বন্ধে কালিদাসের এই মর্যাদাবোধ তৈরি হয়েছে গুপ্ত-বংশীয় রাজাদের মর্যাদাবোধ থেকেই। পুরুংশের বংশকর পুরুষ দুষ্যন্ত নিজের পরিণীতা পত্নীকে সম্পূর্ণ চেনা সত্ত্বেও অস্বীকার করছেন–এই মিথ্যাচার এক স্বর্ণযুগীয় রাজার সভাকবির পক্ষে সহ্য করা কঠিন। সেই কারণেই, হয়তো বা গুপ্ত-রাজার মর্যাদায় প্রতিবিম্বিত পৌরব-রাজার মর্যাদা রক্ষার জন্যই কালিদাস দুর্বাসার শাপের অবতারণা করেছেন অভিজ্ঞানশকুন্তলে। বিস্মৃতির মতো এক অনিবার্য অভিশাপের নিয়তি তৈরি করে রাজসভায় কবি কালিদাস পৌরব দুষ্যন্তকে সমস্ত সামাজিক সঙ্কট এবং লোকাপবাদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। রাজা দুষ্যন্ত সেখানে এমনই এক রাজমহিমায় প্রতিষ্ঠিত, যেখানে তিনি পরিণীতা শকুন্তলার সম্বন্ধে কটু কথা কিংবা পূর্ব-পরিণয়ের অস্বীকৃতি জানালেও পাঠক-দর্শক তাকে বড় দোষ দিতে পারে না। দুর্বাসার শাপে যখন তার কিছুই মনে নেই, তখন যদি শকুন্তলা বলেন–ঠিক আছে আপনার দেওয়া স্মৃতিচিহ্ন দেখিয়ে আপনার সন্দেহ দূর করছি–সেই মুহূর্তে রাজা একান্ত রাজোচিতভাবে বলেন-উদারঃ কল্প-উত্তম প্রস্তাব।

পাঠক এখানেও রাজার বিচার-বুদ্ধি এবং স্বচ্ছ স্বভাবে সন্দেহ করতে পারে না। কোনও প্রমাণ পেলে রাজা নিশ্চয় মানবেন–এই নিরপেক্ষ রাজগুণে পাঠকের অন্তঃকরণ আশান্বিত হয়। কিন্তু শকুন্তলা তার আংটি হারিয়ে ফেলেছেন। ফলত রাজার কটুক্তি তাকে শুনতেই হবে–এই অবধারিত যুক্তিতে শকুন্তলার জন্য পাঠকের মন যতই বিষণ্ণ হোক, পূর্বানুরাগবিস্মৃত শাপগ্রস্ত দুষ্যন্তকে তারা ক্ষমা করে দেয়। কালিদাস আপন কবি-প্রতিভায় দুষ্যন্তকে যে এই অপূর্ব মর্যাদায় স্থাপন করেছেন, তার কারণ অন্য আর যা কিছুই হোক, অন্তত একটা কারণ তার নিজেরই পরিশীলিত বিদগ্ধ নাগরিক রুচি। সেই রুচিতে একজন পৌরব রাজাকে মিথ্যাচারী, কপট, হীন অবস্থায় রেখে দেওয়া যায় না। ফলত মহাভারতের আকরিক অবস্থা থেকে দুষ্যতকে তুলে এনে তিনি তাকে দুর্বাসার অভিশাপের মূছায় যতখানি বিস্মৃতমূৰ্ছিত করেছেন, তার থেকে অনেক বেশি, তিনি তাকে পৌরব রাজার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।

অন্যদিকে শকুন্তলার অবস্থাও তাই। রাজাকে তিনি যত কথা বলেছেন, তাতে শকুন্তলার দিক থেকে সবচেয়ে বড় গালাগালি হল–অনার্য। সেকালের নাগরিক শব্দকোষে অনার্য শব্দের চেয়ে বড় তিরস্কার কিছু নেই। আর এই শব্দটাই যদি আরও একটু বিশদভাবে বলা যায়, তবে কালিদাসের শকুন্তলার মুখে যা আসে, তা হল অনার্য। আপনি নিজের মন দিয়ে সবাইকে দেখছেন। এমন আর অন্য কে আছে যে ধর্মের পোশাক পরা, ঘাসে ঢাকা কূপের মতো আপনাকে অনুকরণ করবে?

মহাভারতের দুষ্যন্ত যখন শকুন্তলাকে চিনেও ইচ্ছে করে চিনলেন না–তস্যা রাজা স্মরপি–তখন প্রথম আঘাতে ক্ষণিকের তরে শকুন্তলা যেন লজ্জা পেয়েছিলেন, ক্ষণিকের তরে যেন তার সংজ্ঞা লুপ্ত হয়েছিস–নিঃসংজ্ঞেব চ দুঃখেন…ব্রীড়িতেব তপস্বিনী। অর্থাৎ সবটাই যেন। লজ্জায় ভেঙে পড়ে রাজসভায় সংজ্ঞালপ্ত হয়ে পড়ে যাবার মতো দুর্বল রমণী তিনি নন। আকস্মিক আঘাত কাটিয়ে উঠতেই রাগে-অধৈর্যে তার চোখ লাল হয়ে উঠল, ঠোঁট কাঁপতে থাকল আর বাঁকা চোখে এমন অর্থপূর্ণভাবে তিনি দুষ্যন্তের দিকে তাকাতে থাকলেন, যেন রাজাকে তিনি এক্ষুনি ভস্ম করে দেবেন–কটাক্ষৈনিহতীব তির্য রাজানমৈত।

কালিদাসের শকুন্তলার কি রাগ হয়নি? খুবই হয়েছিল, কিন্তু তা তাকে দমন করতে হয়েছে কালিদাসের হৃদয় অনুসারে বিদগ্ধা নায়িকার মতো। মহাভারতের শকুন্তলাও আপাতত এই ক্ষুরমাণ ক্রোধ দমন করলেন কাশ্রমবাসিনী তপস্বিনীর শমতায়, তেজে। ঝগড়াঝাটির স্বরগ্রামের প্রথম স্বর থেকে তিনি আরম্ভ করতে চান, কারণ তিনি এখানে একা এবং কোথায় এ বিবাদ শেষ হবে তিনি জানেন না। শকুন্তলা বললেন–মহারাজ! সব মনে থাকা সত্ত্বেও সাধারণ হেঁদো লোকের মতো তুমি এমন মিথ্যা কথা বলছ কেন–জানম্নপি মহারাজ কম্মাদেবং প্রভাষসে? তুমি মনে মনে খুব ভালই জান–কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে। কাজেই আদালতে ভদ্রলোক যেমন সত্যি কথা বলে, তুমিও তাই কর। তোমার মন জানে একরকম, আর তুমি বলছ আরেকরকম। তুমি তো নিজের কাছ থেকে নিজেকেই চুরি করছ চোরের মতো?

মহাভারতের শকুন্তলা মহর্ষি কণ্বের পরম্পরায় জ্ঞানীর মতো কথা বলেন। রাজাকে তিনি জীবাত্মা সাক্ষী-চৈতন্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন–মানুষ নির্জনে পাপ করে ভাবে–পাপ কিসের? কেউ তো জানতেই পারেনি–মন্যতে পাতকং কৃত্বা ন কশ্চিৎ বেত্তি মামিতি। কিন্তু মহারাজ! তোমার অন্তরপুরুষ জানে, তুমি কী করছ। আর জানেন অন্তরীক্ষ লোকের দেবতারা। তোমার হৃদি-স্থিত কর্মসাক্ষী জীবাত্মাকে তুমি কঁকি দিতে পার না। তুমি এই রাজসভার মধ্যে আমাকে এমনভাবে অপমান করছ যেন আমি ভীষণ খারাপ নীচ স্বভাবের মহিলা। অবশ্য আমি বোধহয় শূন্যে রোদন করছি কারণ, তুমি কিছুই শুনছ না।

শকুন্তলা এরপর ‘জায়া’ ‘পুত্র’, ‘ভার্যা’–-এই সমস্ত শব্দের ধর্মীয় এবং সামাজিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে রতি, প্রীতি এবং ধর্ম যে পত্নীরই অধীন–তা খুব সুন্দরভাবে বোঝালেন। তারপর ভাবলেন–এতদিন পর যদি কোনও পুরুষ পূর্বপরিচিত স্ত্রীকে পছন্দ নাই করে, তবু তার পুত্রের ওপর তো মায়া থাকবে? শকুন্তলা তাই এবার পুত্রের কথা পাড়লেন। বললেন–মহারাজ! আমার কথা নাই ভাবলে, অন্তত পুত্রসুখের কথাটা ভাব। ধুলোমাটি গায়ে মেখে পুত্র যখন পিতার কোলে ওঠে–পিতুরাশ্লিষ্যতে’ঙ্গানি…ধরণীরেণুগুষ্ঠিতঃ–তখন সেই আনন্দের কি সীমা আছে কোনও? তোমার পুত্র এই সামনে উপস্থিত, সে তোমার কাছে যাবার জন্য কেমন করুণ চোখে তাকাচ্ছে তোমার দিকে, তাকে এমন করে অবজ্ঞা করছ কী করে? আরে এই সাধারণ পিঁপড়েগুলো পর্যন্ত নিজের ডিম কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সযত্নে সেগুলিকে রক্ষা করে, –অণ্ডানি বিভ্রতি স্বানি ন ভিন্দন্তি পিপীলিকাঃ–সেখানে তুমি কোনওভাবেই এই স্বাঙ্গজাত পুত্রটিকে ফেলে দিতে পার না। তুমি যেদিন আশ্রম থেকে চলে এসেছিলে তখন থেকে এই পুত্রমুখ দেখেই আমি তোমার বিরহ-দুঃখ সহ্য করেছি। শান্ত সরোবরের মধ্যে মানুষ যেমন নিজের প্রতিবিম্ব দেখে, তেমনই পুত্রের মধ্যে পুরুষ-মানুষ তার নিজের ছায়াটাই দেখে, তোমার পুত্রও দেখ ঠিক তোমারই মতো–সরসীবামলে’ত্মানং দ্বিতীয়ং পশ্য বৈ সুতম।

শকুন্তলা পুত্রের উপযোগিতা সম্বন্ধেও অনেক শাস্ত্রবাণী শোনালেন রাজাকে। কিন্তু সেসবে যখন কিছু হল না, তখন বললেন–আমার কপালটাই খারাপ, রাজা! অঙ্গরাশ্রেষ্ঠা মেনকার গর্ভে আমার জন্ম। মুনিশ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র আমার জনক। কিন্তু হলে হবে কী? কী নিষ্ঠুর সেই অপ্সরা-জননী আমার! জন্মমাত্রেই হিমালয়ের এক সমভূমিতে আমাকে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন তিনি-যেন পরের ছেলে কোলে নিয়েছিলেন কোনওমতে–অবকীৰ্য্য চ মাং জাতা পরাত্মজমিবাসতী। আগের জন্মে কী পাপই না করেছিলাম, ঠাকুর! নইলে, সেই ছোটবেলায় বাপ-মা আমায় ছেড়ে চলে গেল, আর এখন তুমি আমায় অস্বীকার করছ–কিং নু কৰ্মশুভং পূর্বং কৃতবত্যন্যজন্মনি। তা বেশ, আমাকে না হয় তুমি চিনেও চিনলে না, না হয় ত্যাগই করলে আমাকে, আমি সেই আশ্রমেই আবার ফিরে যাব না হয়, কিন্তু এই ছেলেটি তোমার, একে তুমি নিশ্চয়ই ফেলে দিতে পার না-ইমন্তু বালং সন্ত্যকুং নাৰ্হস্যাত্মজমাত্মনা।

শকুন্তলা এতক্ষণ ভালয় ভালয় অনেক কথা বলেছেন। ঝগড়া করার জন্য এখনও সেরকম করে গলা তোলেননি। মনে ক্রোধ জমা হলেও তা প্রকাশ করেননি। যা বলেছেন, তা সমাজ, ধর্ম এবং নৈতিকতার যুক্তি দিয়েই বলেছেন। এমনকি যা বলেছেন, তার মধ্যে সরলতাও এত বেশি ছিল যে, মহারাজ দুষ্যন্ত এবার তার সুযোগ নেবেন। সেই তপোবনে শকুন্তলাকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার পরেই দুষ্যন্ত তার কাছে তার জন্মবৃত্তান্ত শুনতে চেয়েছিলেন। শকুন্তলা অকপটে সব বলেওছিলেন। কথায় বলে–অর্থনাশ, মনের কষ্ট আর ঘরের কলঙ্ক কোথাও বেশি বলতে যেও না–অর্থনাশং মনস্তাপং গৃহে দুশ্চরিতানি চ। কিন্তু কথাশ্রমে পালিতা শকুন্তলা রাজাকে আপনার সমব্যথী ভেবে হৃদয় উজাড় করে সব বলে দিয়েছেন। নিজের মায়ের কলঙ্কও গোপন করেননি। কিন্তু এখন একাকিনী পুত্রের হাত ধরে শকুন্তলা দাঁড়িয়ে আছেন রাজসভায় আর দুষ্যন্ত সরলা বালিকার সেই অকপট স্বীকারোক্তির সুযোগ নিচ্ছেন।

দুষ্যন্ত এতক্ষণ ধরে শকুন্তলার কথা শুনে পূর্বকালের বহুবিবাহিত কুলীন বামুনের মতো বললেন–তোমার গর্ভে আমার একটি পুত্র হয়েছে–এসব কথা আমার মোটেই স্মরণ হচ্ছে না। আর তোমার কাছে যেমন শুনছি, তাতে তোমার জননীটিকে তো একটি নির্দয়-হৃদয় বেশ্যা। ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না–মেনকা নিরনুক্রোশা বন্ধকী জননী তব। পুজোর প্রসাদী ফুল যেমন একসময় ফেলে দেয়, তেমনই তোমার মা মেনকা তোমাকে নির্মাল্যের মতো হিমালয়ের এক কোণে ফেলে দিয়ে গেছে। তোমার বাবা বিশ্বামিত্রও যে খুব দয়ালু মানুষ, তা মোটেই নয়। তার আবার একসময় বামুন হবার শখ হয়েছিল–বিশ্বামিত্রো ব্রাহ্মণত্বে লুব্ধ–কিন্তু এখন যা দেখছি তাতে ষড়রিপুর প্রথমটিই তো তার প্রধান অবলম্বন।

 দুষ্যন্ত বুঝলেন–একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মেনকাকে না হয় যা তা বলা গেল, কিন্তু স্বাধ্যায়-অধ্যবসায়ে ব্রাহ্মণত্ব লাভ-করা বিশ্বামিত্র মুনিকে কামী বলে ফেলাটা রাজার পক্ষে যেন একটু বাড়াবাড়ি। দুষ্যন্ত তাই একটু সামলে নিয়ে বললেন–তা না হয় বুঝলাম যে, মেনকা অপ্সরা-সুন্দরীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠা আর বিশ্বামিত্রও মুনিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তাদের মেয়ে হয়ে তোমার কথাগুলো এমন বেশ্যাদের মতো কেন–তয়োরপত্যং কস্মাৎ পুংলীব প্রভাষসে? যে সব কথা তুমি আমার কাছে বলছ, তাতে তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। খুব তো তপস্বিনী সাজ নিয়ে বেশ একটা সাধু-সাধু ভাব করে ঘুরে বেড়াচ্ছ। কিন্তু মনে রেখ-এটা রাজবাড়ি, তায় কথা বলছ রাজার সামনে। অতএব সাবধান। আমাকে জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। ভণ্ড কোথাকার, বেরোও এখান থেকে– বিশেষত মৎসাশে দুষ্ট তাপসী গম্যতাম্।

শকুন্তলাকে নিজের স্ত্রী বলে স্বীকার করা তো দূরের কথা, তাকে অস্বীকার করার জন্য দুষ্যন্ত এমনভাবেই তাকে কলঙ্কিত করলেন যেন, একজন রাজার তো নয়ই, একজন সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি পরিত্যাজ্য। দুষ্যন্ত স্ত্রীকে অস্বীকার করে এবার পুত্রকে অস্বীকার করার যুক্তি সাজাচ্ছেন। বলছেন–আর তোমার ছেলেটি তো বেশ বড়সড় ঢ্যাঙা হয়ে গেছে, অল্প। বয়স দেখতে লাগে বটে, কিন্তু গায়ে বেশ শক্তি আছে মনে হয়–অতিকায় তে পুত্রো বালোতবলবানয়ম। কোথা থেকে একটা শালখুঁটির মতো ঢ্যাঙা ছেলে নিয়ে এসে, বলে কিনা আমার ছেলে–শালস্তম্ভ ইবোৰ্গতঃ। পরিষ্কার বোঝা যায়–তোমার মা বেশ্যা বলেই তুমিও বেশ্যার মতোই কথা বলছ। একমাত্র বেশ্যারাই নিজের অবিধিজাত সন্তানকে হঠাৎ এক পুরুষের সামনে হাজির করে তাকে তারই পুত্র বলে প্রতীত করাতে চায়। তুমি যা যা বলছ, যা যা সত্য বলে প্রমাণ করতে চাইছ, আমি যেহেতু তার কিছুই স্মরণ করতে পারছি না, তাই আর তোমার দাঁড়িয়ে থাকা সাজে না। তোমাকে আমি চিনি না, তুমি যাও এখান থেকে–নাহং বামভিজানামি যথেষ্টং গম্যতাং ত্বয়া।

 রাজার বয়ান থেকে, ভাষা থেকে বোঝা যায়, তিনি সত্যিই নিজের কাছে নিজেকে লুকোতে চাইছেন। নইলে পুরুবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক রাজা তার নাগরিকবৃত্তি বিসর্জন দিয়ে নিজের পূর্বপরিণীতা স্ত্রীকে এইভাবে কলঙ্কিত করতে পারেন না; অস্বীকার করতে পারেন না ঔরসজাত পুত্রকে। বেশ বুঝতে পারি–একটা গভীর কারণ আছে, যে জন্য তাকে এই অত্যাভিনয় করতে হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা শকুন্তলার দিক থেকে কতখানি মর্মান্তিক ভাবুন যে, তাঁর নিজের বলা কথা তাঁকে এখন গিলতে হচ্ছে আপন বমন-নিষেবণের মতো। কিন্তু এও তো সত্যি যে নিজের বাবা-মা যত খারাপই হোন, অন্যের মুখ দিয়ে তা শুনতে মোটেই ভাল লাগে না। সরলা শকুন্তলা তাই নিজের মতো করেই তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন রাজাকে।

শকুন্তলা ভীষণ রেগে গেছেন। বিদগ্ধা নায়িকার মতো সুচতুর বাগভঙ্গি প্রকাশ করে তার পক্ষে দুষ্যন্তের প্রতিভাষণ দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ তিনি সেই নায়িকা নন। আর কেউ যদি–শালা, শুয়োরর বাচ্চা’ বলে গালাগালি দেয়, তবে তার উত্তরে-দেখুন, আপনি বোধহয় ঠিক বুঝতে পারছেন না–এমন ভদ্রভাষণও কোনও কাজের কথা নয়। শকুন্তলা তাই দুষ্যন্তকে বললেন–সরষের দানা দেখেছ, মহারাজ! অন্যের দোষটা যদি সরষের দানার মতোও হয়, তবে সেটা খুব তোমার চোখে পড়ে। কিন্তু তোমার নিজের ছিদ্রটা যে বেলের মতো এত বড়, সেটা তো নজরেই আসছে না–আত্মনো বিশ্বমাত্রাণি পশ্যপি ন পশ্যসি। শকুন্তলা এর আগে নিজের পিতা-মাতা সম্বন্ধে যা বলে ফেলেছেন, ফেলেছেন। এখন গলার জোরে তা ঠিক করার চেষ্টা করছেন। বেশ্যাপুত্রও অন্যের মুখে আপন জননীর বেশ্যা-পরিচয়ে ক্রুদ্ধ হয়। শকুন্তলা বললেন-আমার মাকে অত হেলাফেলা করো না, রাজা। মেনকা অঙ্গরা হলে কী হবে, তার চলা-ফেরা সব দেবতার মধ্যে, দেবতারা তার পেছন পেছন ঘোরেনমেনকা ত্রিশেষে ত্রিদশাশ্চানু মেনকাম্। সেদিক দেখতে গেলে তোমার জন্মের থেকে আমার জন্মের মর্যাদা অনেক বেশি–মমৈবোৎকৃষ্যতে জন্ম দুষ্যন্ত তব জম্মতঃ।

কথাটা শুনলে আপাতত মনে হতে পারে যেন শকুন্তলা একেবারে ছেলেমানুষি ঝগড়া করছেন। কিন্তু এই ছোট্ট একটি কথা–তোমার জন্ম আমার থেকে খারাপ–এই ছোট্ট একটি কথার মধ্যে কিছু ব্যঞ্জনা আছে বলে মনে হয়। শকুন্তলার জন্মবৃত্তান্ত দুষ্যন্ত তার মুখেই শুনে এসেছেন, কিন্তু এতদিন যখন দুষ্যন্ত তপোবন থেকে স্ত্রীকে আনবার জন্য কোনও চিন্তাই করেননি, তখন নিশ্চয়ই রাজার সমালোচনা কিছু হয়েছে। দুষ্যন্তর জন্মবৃত্তান্ত, পরের ঘরে মানুষ হওয়ার কথা, তখনই শকুন্তলার কানে এসে থাকবে। আমরা আগে বলেছিলাম-মরুত্ত রাজা যজ্ঞ সমাপন করে তাঁর মেয়ে সম্মতাকে দাসী হিসেবে দান করেছিলেন পুরোহিত সংবর্তকে। ‘দাসী’ শব্দে সেকালে ভোগ্যা স্ত্রীকেই বোঝানো হত। তার সামাজিক মর্যাদা অনেকটা বেশ্যার মতোই, বেশ্যা না হলেও অনেকটা রক্ষিতার মতো। আমরা অনুমান করেছিলাম–উচ্ছিন্ন পৌরববংশের কোনও অকুলীন পুরুষের সঙ্গে সম্মতার সঙ্গতি হওয়ার ফলেই দুষ্যত্তের জন্ম হয়েছিল এবং কন্যার প্রতি মমতাবশত মরুত্ত রাজা আর জামাইয়ের ওপর নির্ভর করেননি। তিনি নিজেই মানুষ করেছিলেন দুষ্যন্তকে।

আমাদের বিশ্বাস–দুষ্যন্তের এই অমর্যাদাকর জন্মের কাহিনী শকুন্তলাও নিশ্চয়ই জেনে ফেলেছিলেন। আর সেইজন্যই শকুন্তলার এত মেজাজ। অর্থাৎ সাধারণ এক রক্ষিতা বা বেশ্যার সংসর্গে যার জন্ম তার থেকে অন্তত স্বৰ্গবেশ্যা মেনকার মূল্য বেশি। কারণ, তিনি দেবকার্য সিদ্ধ করেন। শকুন্তলা তাই বললেন–স্বর্গলোকে আর অন্তরীক্ষলোকে আমাদের চলাফেরা, আর তুমি ঘুরে বেড়াও এই মরণশীল মর্ত্যভূমিতে, আমার জন্মের সঙ্গে তোমার জন্মের তুলনা? যেন পাহাড় আর সরষে।

জন্মের কথা তো গেল। শকুন্তলা আপন জন্মের মর্যাদায় এখন রীতিমতো গৌরবান্বিত। এখন তিনি রাজার অকথ্য তিরস্কারের প্রতিভাষণ দিচ্ছেন। শকুন্তলা বললেন–মানুষ যতক্ষণ না আয়নায় নিজের মুখখানা দেখে, ততক্ষণই সে নিজেকে সুন্দর দেখে। আয়নায় নিজের মুখখানা দেখলেই তবে না লোকে বুঝতে পারে নিজের সঙ্গে অন্যের ফারাক–তদান্তরং বিজানীতে আত্মানঞ্চেতরং জন। মানুষ যখন কথা বলে, তখন ভালমন্দ দুইই বলে। যেমন আমিও আগে বলেছি–আমার জন্ম এবং প্রতিপালনের সমস্ত বৃত্তান্তই তোমাকে অনুপুঙ্খভাবে। শুনিয়েছি। কিন্তু যে শুনছে সে যদি মুর্থ হয়, তবে ভাল কথাটা সে ধরে না, মন্দটাই ধরে, যেমন শুয়োর–ভাল জিনিসটা সে খায় না, তার নজর সব সময় বিষ্ঠার দিকে–অশুভং বাক্যমাদত্তে পুরীষমিব শূকরঃ।

শকুন্তলা বলতে চাইলেন–তুমিও ওই মন্দটাই ধরছ, রাজা। কেননা, ভাল মানুষ হলে সে নীর বর্জন করে ক্ষীরই গ্রহণ করত। দুর্জন লোকে অন্যের নিন্দা করে সুখ পায়, আমাকে নিন্দা করে তোমার তো সেই সুখই হচ্ছে, মহারাজ! শকুন্তলা দুষ্যন্তের তপোবনের সেই আচরণের সঙ্গে আজকের আচরণ মেলাতে পারছেন না। দুষ্যন্ত যেহেতু তাকে চিনেও চিনতে পারছেন না, তাই শকুন্তলা বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, জগতে এর চেয়ে হাসির ব্যাপার আর বুঝি হয় না, যখন একজন খারাপ লোক নিজেকে খারাপ জেনেও অন্য ভাল মানুষকে খারাপ বলে গালাগালি দেয়-যত্র দুর্জনমিত্যাহ দুর্জনঃ সজ্জনং স্বয়ম্। কী আশ্চর্য! তুমি নিজে আমার গর্ভে নিজেরই মতো একটি পুত্র উৎপাদন করে এখন সেই পুত্রের পিতৃত্ব অস্বীকার করছ কেমন। করে–তা আমার মাথায় আসছে না-স্বয়মুৎপাদ্য বৈ পুত্রং সদৃশং যো’বমন্যতে।

শকুন্তলা পুত্রের স্বার্থ ভেবে আবারও নিজেকে সংযত করলেন। বললেন-মহারাজ! আমার যা হয় হোক, তুমি ছেলেটিকে এমন করে অবজ্ঞা করো না। তুমি রাজা বটে, সত্য এবং ধর্মের রক্ষা করা তোমার স্বাভাবিক ধর্ম। সেই তুমি এমন কপটতা করো না আমার সঙ্গে। তুমি তোমার সত্যে প্রতিষ্ঠিত হও। আর যদি সব জেনে-বুঝে মিথ্যেটাকেই তুমি আঁকড়ে ধরে থাক, তবে আমি নিজেই চলে যাচ্ছি, তোমার মতো এক মিথ্যাচারী কপট মানুষের সঙ্গে বাস করা আমারই বা সইবে কেমন করে–আত্মনা হন্ত গচ্ছামি তাদৃশে নাস্তি সঙ্গত। তবে আমার যাবার আগে আমার সত্য প্রতিজ্ঞাও তুমি শুনে রাখ, মহারাজ। তোমাকে বাদ দিয়েও, তোমার কোনও সহায়তা ছাড়াই আমার এই পুত্র একদিন রাজরাজেশ্বর হবে–ঝতেপি তাঞ্চ দুষ্যন্ত…চতুরন্তামিমা উবং পুত্রো মে পালয়িষ্যতি।

কালিদাসের সভ্য-ভব্য পুষ্পঘাতভরা শকুন্তলাকে যদি এইরকম ঝগড়া করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে হত এবং তাও রাজার সামনে, তবে এতক্ষণ তিনি মৃত ঘোষিত হতেন। দুষ্যন্তকে সামান্য দু-চার কথা বলে একা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে অন্তরীক্ষলোকের সাহায্য এসে পৌঁছেছে অভিজ্ঞান-শকুন্তলে। কিন্তু মহাভারতের শকুন্তলা চিরন্তনী জননীর গৌরবে কপট স্বামীর মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে সপ্রত্যয়ে পুত্রের হাত ধরে বেরিয়ে চলে এসেছেন রাজসভা ছেড়ে–এতাবদুত্ত্বা রাজানং প্রাতিষ্ঠত শকুন্তলা।

.

৪৬.

 শকুন্তলা দুষ্যন্তের রাজসভা ছেড়ে গেলেন ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হয়ে। মহাভারতের সহজ সরল অনাড়ম্বর পরিবেশের মধ্যে রাজনামাঙ্কিত কোনও অঙ্গুরীয় রোহিত মৎস্যের পেট কেটে বার কতে হয়নি এখানে। শকুন্তলা বাইরে প্রস্থান করার সঙ্গে সঙ্গে এখানে মহাভারতী দৈববাণী হয়েছে এবং সে দৈববাণী হয়েছে কখন? না, রাজা তখন বসেছিলেন রাজসভার ঋত্বিক, পুরোহিত, মন্ত্রী-অমাত্যের দ্বারা বৃত হয়ে। আমরা অবশ্য দৈববাণী বলতে আকাশ-ফাটা কোনও অশরীরী শব্দস্ফোট বুঝি না। যা বুঝি, তা হল জনমত। দুষ্যন্তের সভার ঋত্বিক, পুরোহিত, মন্ত্রী-অমাত্যেরা কেউ নির্বোধ গর্দভ নন। তারা শকুন্তলার দাপট দেখে, সত্যের প্রত্যয় দেখে এবং সর্বোপরি একটি বালকের মধ্যে দুষ্যন্তের ছায়া দেখে নিশ্চয়ই দুষ্যন্তকে বলেছিলেন তার মত পুনর্বিবেচনা করতে এবং সেটাই হয়তো দৈববাণী।

দৈববাণী হল–দুষ্যন্ত এই পুত্রটিকে তুমি ভরণপোষণ করো। শকুন্তলার প্রতি এইভাবে অবজ্ঞা প্রদর্শন করো না–ভরস্ব পুত্ৰং দুষ্যন্ত মাবমংস্থাঃ শকুন্তলা। কোনও সন্দেহ নেই–তোমারই ঔরসে শকুন্তলার গর্ভে এই পুত্রের জন্ম হয়েছে–এবং শকুন্তলা সত্য কথা বলেছে–তৃঞ্চাস্য ধাতা গর্ভস্য সত্যমাহ শকুন্তলা। দৈববাণী শকুন্তলার বক্তব্যের সত্যতা প্রতিপন্ন করেই ক্ষান্ত হল না, দেবতাদের মুখ দিয়ে দুষ্যন্ত তার পুত্রের নামকরণও শুনতে পেলেন–আমাদের অনুরোধেই যখন তোমাকে এই পুত্রের ভরণ-পোষণ করতে হবে, তখন এই পুত্রের নাম হোক ভরত–তস্মাদ ভবত্বয়ং নাম্না ভরতো নাম তে সুতঃ।

এই কথাগুলি দৈববাণী না জনবাণী সে কথা আরও একবার পরে আসবে। তার আগে জানাই–আংশিকভাবে যে শ্লোকগুলি আমরা এখানে উদ্ধার করলাম, দুষ্যন্ত-শকুন্তলার সমগ্র কাহিনীর হাজারো শ্লোকের মধ্যে এই শ্লোক-দুটির পৃথক এক মূল্য আছে। মনে রাখতে হবে, মহাভারত ছাড়াও প্রায় সব প্রাচীন পুরাণে শকুন্তলা-দুষ্যতের কাহিনী সংক্ষেপে বা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। দুষ্যন্ত যখন ইচ্ছাকৃতভাবে শকুন্তলাকে স্মরণ করতে চাইলেন না, তখন প্রত্যেক পুরাণেই এই দৈববাণীর শ্লোক-তিনটি উল্লিখিত হয়েছে। সব পুরাণেই এই শ্লোকগুলি একই শব্দবিন্যাসে লিখিত এবং মহাভারতের শ্লোকগুলির সঙ্গে এই শ্লোকগুলির কোনও পার্থক্য নেই। শব্দেও নয়, অর্থেও নয়।

পুরাণকারেরা বলেছেন–এই শ্লোকগুলি নাকি দেবতারা গান করেন–দেবৈঃ শ্লোকো গীয়তে। পণ্ডিতেরা বলেন–পুরাণগুলির মধ্যে যখনই এইরকম—‘দেবতারা এই শ্লোকটি গান করেন’, অথবা ‘এমনটি শোনা যায়–ইতি শ্ৰয়তে’ অথবা এখানে ‘গাথা শোনা যায়–তথাহি গাথাঃ’–এইরকম উল্লেখ থাকে, তখনই বুঝতে হবে যে, এই দেবগান-গাথাগুলি হল– allu sions to matters that are handed down from very ancient times, long before the original Purana was compiled.

 যে দু-তিনটি শ্লোকের একেকটি কলি আমরা উল্লেখ করেছি, সেই শ্লোকগুলি হাজারো শ্লোকের মালায় হীরকখণ্ডের মতো। ওই শ্লোকগুলি শুনলেই শকুন্তলা-দুষ্যন্তের পূর্বাপর জীবন-কাহিনী এক ঝলকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বোঝা যায়–মহারাজ দুষ্যন্ত কোন কারণে তার আপন স্ত্রীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তাঁর ঔরসজাত শিশুপুত্রটিকেও অস্বীকার করেছিলেন। শ্লোক কটি দুষ্যন্তের এই অন্যায়ের জন্য তাঁকে সাবধান করছে এবং স্ত্রী-পুত্রের মর্যাদা সম্বন্ধে তাঁকে সচেতন করছে। আমরা এই বহু-উল্লিখিত শ্লোক-তিনটির প্রাচীনতা নির্ধারণ করে বলতে চাইছি যে, দুষ্যন্ত-শকুন্তলার কাহিনী মহাভারতের কালের আরও আগে রীতিমত লোকস্তরে প্রচলিত ছিল। লোকেরা দুষ্যন্ত-শকুন্তলার বিশদ প্রণয় কাহিনী নাই জানুক, কিন্তু বহুশ্রুত এই শ্লোক দুটি তারা জানত। এই শ্লোক কটিকে প্রত্যেক মুখ্য পুরাণের কথকঠাকুর সন্নিবেশ করেছেন রাজবংশের পরম্পরার মধ্যে। শকুন্তলা-দুষ্যন্তের প্রণয়কাহিনী কিচ্ছুটি আনুপূর্বিক না বলে, যেই না ভরতের নাম আসবে অমনই পৌরাণিক বলবেন–ভারতের নাম। ভরত কেন হল জান? দেবতারা আকাশ থেকে বলেছিলেন–ভরস্ব পুত্ৰং দুষ্যন্ত। এই ‘ভরস্ব’ শব্দের দুটি বর্ণ ‘ভর’ আর ‘দুষ্যন্তে’র শেষ বর্ণ ‘ত’-এই তিনটি ব্যঞ্জন বর্ণ নিয়ে ভরত। মৎস্যপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ, এবং হরিবংশ–এই প্রাচীন গ্রন্থগুলির মধ্যে সর্বত্র এই মহাভারতীয় শ্লোক-কটি অবিকৃত এবং প্রসঙ্গও সেই একই।

এই প্রাচীন অনুবংশ্য শ্লোক-কটিই হয়তো দুষ্যন্ত-শকুন্তলার প্রণয়কাহিনী এবং তাদের পুত্ৰনামের বীজস্বরূপ। এই শ্লোকগুলি পৌরাণিক-পরম্পরায় চলে আসছিল মহাভারতের পূর্বকাল থেকে এবং হয়তো দৈববাণীর চেয়েও এই কথাগুলির ব্যবহারিক এবং বাস্তব মূল্য ছিল অনেক বেশি। কালিদাসের অভিজ্ঞানে কুমার সর্বদমন অথবা ভরতের প্রসঙ্গ আসে তখনই যখন মর্তের কামনা শাশ্বত প্রেমে পরিণত হয়, ফুল থেকে ফলে পরিণতি ঘটে। পুত্র জন্মের আনন্দ সেখানে নাটকের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে এবং সে আনন্দ শৃঙ্গার রসের মহত্তর তাৎপর্যে বিশ্রান্তি লাভ করে। মহাভারতের কবির কাছে এই নাটক এবং নায়কোচিত পরিণতির কোনও মূল্য নেই। তার কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে–প্রসিদ্ধ ভরতবংশের মূল ভরতের ‘ভরণ’ কীভাবে সম্ভব হয়েছিল–সেটা প্রকাশ করা। যে ‘ভরত’ থেকে ‘ভারত’ নামের সৃষ্টি-ভরতা ভারতী কীর্তিঃ–যে নাম থেকে পরবর্তী পাণ্ডব-কৌরবরা নিজের কুলমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবেন, সেই ভরত কীভাবে পিতার দ্বারা বিপ্রলব্ধ হয়েও পুনরায় রাজার আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেন–একমাত্র সেইখানেই মহাভারতের কবির দুষ্যন্ত-শকুন্তলা কাহিনীর তাৎপর্য।

 আমরা আগে বলেছি, দৈববাণীর সময় রাজার পাশে ছিলেন মন্ত্রী, অমাত্য এবং ঋত্বিক-পুরোহিতেরা। দৈববাণী শুনেই রাজা তাদের বললেন–আপনারা এই দৈববাণী শুনুন ভাল করে। এই পুত্রটি যে আমারই, তা আমি ভাল করেই জানতাম–অহঞ্চাপি-এবমেবৈনং জানামি স্বয়মাত্মজ। কিন্তু আমি যদি শুধু শকুন্তলার কথায় এই বালকটিকে পুত্র হিসেবে স্বীকার করে নিতাম, তাহলে সাধারণ মানুষ আমাকে সন্দেহ করত এবং ভাবত–ছেলেটি ওর নিজের নয়, অথচ তাকে সিংহাসনে চাপিয়ে দিল শুধু রাজা বলে–ভবেদ্ধি শঙ্কা লোস্য নৈব শুদ্ধো ভবেদয়।

দেখুন, রাজসভায় শকুন্তলার যে হেনস্থা হয়েছে, তাতে আধুনিক পরিশীলিত বুদ্ধিতে সেকালে স্ত্রীলোকের মর্যাদা এবং তার সামাজিক অবস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। কিন্তু দেখুন, সেকালের রাজাদেরও আজকের দিনে স্বেচ্ছাচারী বলা হয়। স্বৈরাচার ছাড়া তারা নাকি জনগণের ধার ধারতেন না একটুও। কিন্তু এই কি তার নমুনা হল? আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস–অলৌকিক কোনও দৈববাণী নয়, দুষ্যতের রাজসভার মন্ত্রী-অমাত্য-পুরোহিতেরাই শকুন্তলার প্রত্যয় দেখে রাজাকে সাবধান করেন এবং রাজা তখন বলেন–পুত্রটি যে আমারই, তা আমিও জানতাম। কিন্তু শুধু শকুন্তলার কথায় তাকে স্বীকার করে নিয়ে লোকে আমাকে সন্দেহ করত। এখানে ‘লোকে’ মানে–আপনারাই সন্দেহ করতেন। সেকালের দিনের স্বৈরাচারী একনায়ক তথা রাজতন্ত্রের নিরিখে রাজার এই লোকাপেক্ষা আমাদের মুগ্ধ করে। অর্থাৎ রাজারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারতেন না, মন্ত্রী, অমাত্য, পুরোহিতকে অতিক্রম করে, সাধারণ লোককে বুদ্ধু বানিয়ে যা ইচ্ছে রাজারা তাই করতে পারতেন না।

যাই হোক, দৈববাণী অথবা পুরোহিত-অমাত্যের সংশোধনে রাজা দুষ্যন্ত ভরতকে নিজের পুত্র বলে প্রমাণ করিয়ে নিলেন রাজসংসদে। শকুন্তলা এবং ভরতকে ফিরিয়ে আনতে দেরি হল না। রাজসভায় দাঁড়িয়ে রাজা দুষ্যন্ত পুত্রের মস্তক আঘ্রাণ করলেন উজ্জীবিত বাৎসল্যে। ব্রাহ্মণদের স্বস্তিবাচনে, বন্দীর বন্দনা গানে রাজসভা মুখরিত হয়ে উঠল। শকুন্তলাকে পট্টমহিষীর সম্মান দিয়ে রাজা দুষ্যন্ত তার মৌখিক অভিনয়ের পাপ স্খলন করলেন। জনান্তিকে ডেকে বললেন-দেবি! তোমার সঙ্গে আমার মিলন হয়েছিল লোকের অসমক্ষে–কৃতো লোপরোক্ষো’য়ং সম্বন্ধো বৈ ত্বয়া সহ। এই ঘটনা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করে বার করেছি যে, লোক্সমক্ষে তোমার নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যই আমাকে এইরকম একটা অভিনয় এবং খারাপ ব্যবহার করতে হবে। নইলে লোকে ভাবত, একটি চপলা রমণীর দুরভিসন্ধিতে রাজা দুষ্যন্ত তার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। তারা ভাবত–তুমি স্ত্রীলোকের ছলাকলায় ভুলিয়ে আমায় বশ করেছিলে এবং এখন ছেলেটাকে চাপিয়ে দিলে রাজসিংহাসনে। তুমিই বোঝ, আমার পুত্রটিকেও তো ন্যায়সঙ্গতভাবে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে হবে–পুত্ৰশ্চায়ং বৃতো রাজ্যে ময়া তস্মাদ বিচারিত। সেই ভাবনা ভেবেই আমি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি।

দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে যে অপমান করেছিলেন, তা পুষিয়ে দিলেন দানে, মানে, তোষণে বাসোভিরশ্নপানৈশ পূজয়ামাস ভারত। পুত্র সর্বদমন এখন ভরতে পরিণত। দুষ্যন্ত তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অর্থাৎ তার পর ভরতের রাজা হওয়া সুনিশ্চিত হল। দুষ্যন্ত আরও বেশ কিছুকাল রাজত্ব করে বানপ্রস্থ অবলম্বন করলেন এবং তার মৃত্যু হয়। বনেই।

দুষ্যন্তের মৃত্যুর পর সর্বদমন-ভরত যথান্যায়ে পৈতৃক রাজ্য লাভ করলেন। একটা ব্যাপার। এখানে লক্ষ্য করার মত। ভরতের জীবনের কোনও বিশিষ্ট কাহিনী আমরা মহাভারতে পাব না। প্রণয় কাহিনী নয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়, এমনকি তার অপকীর্তিরও কোনও কাহিনী মহাভারতে ধরা নেই, যাতে করে মহারাজ ভরতের সম্বন্ধে আমরা উকৰ্শ হতে পারি। অথচ মহারাজ ভরতই চন্দ্রবংশের সেই বিশিষ্ট ব্যক্তি, যাঁর নামে এই ভারতবর্ষ, যার নামে প্রসিদ্ধ চন্দ্রবংশের ধারার অন্য নাম হয়ে গেল ভরত বংশ-ভরতা ভারতী কীর্তিযেনেদং ভারতং কুলম্। ভবিষ্যতে আমরা দেখব–কৌরব, পাণ্ডব সকলেই নিজেদের ভরতবংশীয় বলতে গৌরব বোধ করবেন। কিন্তু কেন এই গৌরব–তা ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে এক অতিসাধারণ ঘটনায়–মহাভারতের বিশাল বিশাল চরিত্রের মেলায়, বহু বিচিত্র কাহিনীর অন্তরালে সে ঘটনা প্রায় চোখেই পড়ে না।

 ভরত রাজা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাঁর রথচক্রের ঘর্ঘর শুনতে পাচ্ছি। কথাশ্রমের তপোবনে সর্বদমন ব্যাঘ্র-সিংহের পশুসমাজে রাজা হয়ে বসেছিলেন, এখন তার পৈতৃক রাজ্যে। অভিষেক সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রথচক্রের ধ্বনি আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলল–তস্য তৎ প্রথিতং চক্রং লোকসংনাদনং মহৎ। ভরত দিগবিজয়ে বেরলেন। কাছে-দূরে। সমস্ত রাজা-মহারাজ ভরতের বশ্যতা স্বীকার করে নিলেন। একদিকে রাজ্যজয় অন্যদিকে রাজার আদর্শ ধর্মে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা–এই দুয়ের মিশ্রণে ভরতের যশ ছড়িয়ে পড়ল দিগদিগন্তে। তিনি সার্বভৌম এবং চক্রবর্তী রাজা হলেন–স রাজা চক্রবর্ত্যাসীৎ সার্বভৌমঃ। প্রতাপবান্। সার্বভৌম রাজা মানে যেমন তেমন রাজা নন, সমুদ্র পর্যন্ত তার রাজ্যের সীমা ঐতরেয় ব্রাহ্মণ তাই বলেছে–অর্ধসমন্তপৰ্য্যায়ী স্যাৎ সার্বভৌমঃ…সমুদ্রপর্যন্তায়া একরা।

 ভরত যে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন, তা শুধু তাঁর রাজদণ্ডের বিস্তার থেকেই প্রমাণযোগ্য নয়। সেকালের রাজা-মহারাজারা রাজ্যজয়ের সিদ্ধি হিসেবে নানা যাগ-যজ্ঞ করতেন। সেই যজ্ঞের নাম এবং তার গুরুত্ব থেকেও রাজাদের রাজ্য-বিস্তারের পরিমাপ করা যায়। মহাভারতে দেখতে পাচ্ছি–মহারাজ ভরত অনেক যজ্ঞ করেছিলেন–ইজে চ বহুভির্যঃ–এবং তাকে যজন করিয়েছিলেন স্বয়ং তার মাতামহ মহর্ষি কণ্ব। ভরতের নামা যজ্ঞক্রিয়ার মধ্যে একটি খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, মহারাজ ভরত, ‘গোবিতত’ নামে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন এবং তাতে তিনি বহু দক্ষিণা দিয়েছিলেন মহর্ষি কণ্বকে।

এখন প্রশ্ন হল–অশ্বমেধ যজ্ঞ কারা করেন? সুপ্রাচীন ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি বলেছে–অশ্বমেধ যজ্ঞ হল সমস্ত যজ্ঞের রাজা-ঋষভঃ রাজা বা এষ যজ্ঞানাং যদশ্বমেধঃ। শতপথ ব্রাহ্মণ। বলেছে–রাজসূয় যজ্ঞ করে একজন রাজার পদবি লাভ করতে পারেন আর বাজপেয় যজ্ঞ করে সম্রাটের পদবি। কিন্তু আপস্তম্ব শ্ৰেীভসূত্রের মতে যিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন, তিনিই আসলে সার্বভৌম রাজা। অথবা সার্বভৌম রাজা যিনি হতে চান, তিনিই অশ্বমেধ যজ্ঞ করার উপযুক্ত পাত্র-রাজা বা সার্বভৌমঃ অশ্বমেধেন যজ্ঞে। সত্যি কথা বলতে কী, একজন অশ্বমেধযাজ্ঞী সার্বভৌম রাজার সংজ্ঞাই হল–যিনি চতুর্দিকে রাজ্যবিস্তার করেছেন। বিশাল সাম্রাজ্যের এক নিয়ন্তা এইভাবে সাম্রাজ্যের ধারকে পরিণত হন–অশ্বমেধযাজ্ঞী সর্বা দিশোভিজয়তি ভুব…যারমেবৈনং ধর্তারং করোতি।

ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির এই প্রমাণ এবং যজ্ঞের পরিধি থেকে আমরা বুঝতে পারি–সার্বভৌম ভরত রাজা চতুরস্তা পৃথিবী সমুদ্র পর্যন্ত নাই জয় করে থাকুন, কিন্তু তার আপন রাজ্যের চতুর্দিকে বেশ খানিকটা জায়গা পর্যন্ত নিজের অধিকার বিস্তার করেছিলেন। মনে রাখতে হবে–ইংরেজিতে যাকে আমরা imperial unity বলি, তা মহাভারতের এই যুগে আক্ষরিক অর্থে সম্ভব ছিল না। কিন্তু ভরতকে প্রথম সার্বভৌম নৃপতি বলার কারণ-তিনি চতুর্দিকে তার রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। কোনও সন্দেহ নেই, প্রাচীর সেই প্রতিষ্ঠানপুরের নাম আমরা আর শুনতে পাচ্ছি না। মহাভারতের বক্তা নিরপেক্ষ বৈশম্পায়ন মন্তব্য করছেন–আমরা এইরকম শুনেছি যে, মহারাজ রাজধানীটি ছিল সারা পৃথিবীর সেরা রাজধানী–বিষাণভূতং সর্ব্যাং পৃথিব্যামিতি নঃ শ্রুত। ভরতাধষিতং পূর্বং…।

অনুমান করা যায়–দুষ্যন্ত ছিলেন উচ্ছিন্ন পৌরবকুলের বংশকর রাজা। তিনি প্রতিষ্ঠানপুরের আশা ছেড়ে দিয়ে গঙ্গা-যমুনার অন্তর্বর্তী অঞ্চলেই রাজত্ব করতেন। ভরতের সময় তাঁর পৈতৃক রাজ্য আরও ছড়িয়ে যায় চতুর্দিকে এবং তার অশ্বমেধ যজ্ঞের স্থানগুলি থেকে তার রাজ্যের একটা স্থানস্থিতিও নির্ণয় করা যায়। সম্পূর্ণ নিষ্কন্টক না হলে সেই জায়গায় অশ্বমেধ যজ্ঞ করা সম্ভব নয় এবং ভরতের যজ্ঞস্থানগুলির পরিচয় মহাভারত ছাড়াও আরও প্রাচীনতর গ্রন্থে পাওয়া যায়। আশ্চর্য হল–অতিপ্রাচীন ব্রাহ্মণ-গ্রন্থগুলির মধ্যেও যখন ভরতের নাম করা হচ্ছে, তখন বলা হচ্ছে ভরতের কথা পূর্বে গান করা হয়েছে গাথায়– তদেতগাথয়াভিগীত। অর্থাৎ ভরতের সম্বন্ধে অন্তত পাঁচটি গাথা ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলি রচনার বহু পূর্ব থেকেই প্রচলিত। এই পাঁচটি অতি প্রাচীন গাঁথার ধ্রুবপদ হল–ভরতের মতো রাজা কখনও হয়নি, কখনও হবারও নয়। মানুষ যেমন হাত দিয়ে স্বর্গ ছুঁতে পারেন না, তেমনই মানুষের মধ্যে কেউ তার মহান কীর্তি স্পর্শ করতে পারবে না। তাই বলেছিলাম–তার মতো কেউ হয়নি, আর হবারও নয়–মহন্দ ভরতস্য ন পূর্বে নাপরে জনাঃ।

 কী তাঁর কীর্তিকাহিনী, একটু শুনি। শতপথ আর ঐতরেয় ব্রাহ্মণ একযোগে বললেন তাহলে প্রাচীন পদ্য শোনো, গাথা শোনো, যা আমরা উদ্ধার করেছি দুজনেই। প্রথম পদ্য হল–দৌষ্যন্তি ভরত যমুনার কাছে আটাত্তরটা আর গঙ্গার কাছে বৃত্ৰগ্ন নামে একটা জায়গায় পঞ্চান্নটা ঘোড়া অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য বেঁধে রেখেছিলেন–অষ্টাসপ্ততিং ভরতো দৌষন্তিমুনামনু। গঙ্গায়াং বৃত্ৰগ্নে’বধাৎ পঞ্চপঞ্চাশতং হয়া।

মহাভারতের কবি ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলির সমস্ত সংবাদ একটি শ্লোকের মধ্যে পরিবেশন করে আরও একটা অতিরিক্ত খবর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন–শুধু গঙ্গার তীরে আর যমুনার তীরেই নয় সরস্বতীর তীরেও ভরত-মহারাজের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া বাঁধা ছিল–ত্রিশতৈশ্চ সরস্বত্যাং গঙ্গামনু চতুঃশতৈঃ। গঙ্গা-যমুনা আর সরস্বতীর জল-ধোয়া এই অশ্বমেধ যজ্ঞগুলির খবর দিয়ে আমরা যেটা প্রমাণ করতে চাইছি তা হল দৌষ্যন্তি ভরতের রাজদণ্ড বিস্তৃত হয়েছিল গঙ্গা-যমুনার মিলনভূমি, প্রয়াগের কাছাকাছি জায়গা থেকে সরস্বতী নদীর তীর মানে পাঞ্জাব পর্যন্ত। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ একটি অতিরিক্ত খবর দিয়ে বলেছেন যে, মষ্ণার নামে একটা জায়গায় মহারাজ ভরত শয়ে শয়ে কালো দাঁতাল হাতির দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দান করেছিলেন।

মঞ্চার নামে যে জায়গাটা ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এক্ষুণি দেখলাম, সে জায়গাটার ভৌগোলিক অবস্থিতি নির্ণয় করা কঠিন, তবে তা করতে পারলে ভরতের রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে নতুন খবর পাওয়া যেত। তবে ঐতরেয় বাদ দিয়ে যদি শতপথ ব্রাহ্মণের একটা অতিরিক্ত খবর আপনাদের দিই, তবে নির্ঘাত তখনকার দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা আরও ভাল বোঝা যাবে। শতপথ বলেছেন-মহারাজ সাত্রাজিত শতানীক কাশীর রাজার যজ্ঞীয় অশ্ব হরণ করেছিলেন, ঠিক যেমন মহারাজ ভরত হরণ করেছিলেন সাতৃতবংশীয়দের যজ্ঞীয় অশ্ব–আদত্ত যজ্ঞং কাশীনা-ভরতঃ সত্ত্বতামিব। তারপর আবার সেই গান–ভরতের মতো কেউ নেই, আর কেউ হবারও নয়। কথাটা প্রণিধানযোগ্য। মহামতি পারজিটার সব সময় ভাবেন–সেকালের মানুষদের কোনও ঐতিহাসিক দৃষ্টি ছিল না এবং তারা সব গুলিয়ে ফেলতেন। যেমন শতপথ নাকি এখানে দৌষ্যন্তি ভরতকে রামের ভাই ভরতের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন–it has con fused Bharata, the famous Paurava king, with apparently Bharata, the brother of Rama of Ayodhya.

আমাদের ধারণা স্বয়ং পারজিটারই এখানে গুলিয়ে ফেলেছেন। এখানে শতানীক সাত্রাজিতের তুলনা হচ্ছে দৌষ্যন্তি ভরতের সঙ্গে। কোথা থেকে যে এখানে রামের ভাই ভরতের প্রসঙ্গ এল এবং ব্রাহ্মণরা এই ভরতের সঙ্গে সেই ভরতকে যে কী করে গুলিয়ে ফেললেন, কোথায় গুলিয়ে ফেললেন, তার কোনও বিন্দুবিসর্গ আমাদের বুদ্ধিতে এল না। ঐতিহাসিক দৃষ্টির অভাব প্রমাণ করতে গিয়ে এখন যদি শতপথের পংক্তির মধ্যে যে নামের ছায়ামাত্র নেই, তাই আমরা আমদানি করি, তাহলে তো বড়ই বিপদ। এই ধরনের শূন্যে কুসুমকল্পনা বাদ দিয়ে পারজিটার সাহেব যদি আপন ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ঐতরেয়-কথিত ‘মষ্ণার’ জায়গাটার ভৌগোলিক অবস্থিতি নির্ণয় করতেন, তবে আমাদের অনেক সুবিধে হত, মহারাজ ভরতের তো সুবিধে হতই।  

পারজিটারের যুক্তিটাও অদ্ভুত। তাঁর বক্তব্য–King Bharata was long prior to Satavants or Sastvatas, but Rama and Bharata of Ayodhya were their Contemporaries. সাহেব ব্যাপারটা মোটেই ঐতিহাসিক যুক্তিতে বোঝেননি। তার প্রথম বোঝা উচিত–দুষ্যপুত্র ভরতের সম্বন্ধে যে প্রাচীন গাথাটি শতপথ ব্রাহ্মণে সংকলিত হয়েছে, সেই গাথাটির রচনাকালে হয়তো সাদ্ভূতদের আবির্ভাব ঘটেছে। সাদ্ভূতরা মূলত যদুবংশীয়, যদুবংশেরই এক রাজার নাম সাদ্ভূত। কৃষ্ণকে পরবর্তীকালে অন্তত দুশ বার একাধারে যদুবংশীয় এবং সাদ্ভূতগণের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে–ভগবান্ সাত্ত্বতাং পতিঃ। ব্রাহ্মণ্য গাথাটির মধ্যে বরং ঐতিহাসিক দৃষ্টি বেশি আছে, কারণ ভরতের সময়ে যদুবংশীয়রা বিভিন্ন বংশে (যাদব, তালজঘ, হৈহয় ইত্যাদি) বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় নির্দিষ্ট কোনও যদুবংশীয় রাজার নাম না করে, পরবর্তীকালে যদুবংশীয়রা সকলেই যে নামে চিহ্নিত হতেন, সেই নামটি উল্লেখ করে গান বাঁধা হয়েছে–শতানীক সাত্রাজিত কাশীর রাজার যজ্ঞীয় অশ্ব হরণ করেছিলেন–ঠিক যেমন ভরত হরণ করেছিলেন সাদ্ভূতগণের অশ্বটি। আর ঠিক এর পরেই ভরতের সম্বন্ধে সেই ধ্রুবপদ থাকার ফলে কোনও সন্দেহই থাকে না যে-ইনি হলেন দৌষ্যন্তি ভরত।

আমরা জানি এবং পূর্বে বলেছি যে, এর আগে যাদব-হৈহয়দের তাড়নায় তথা ইস্ফাকুদের শক্তিতে গঙ্গা-যমুনার অন্তর্বর্তী অঞ্চল থেকে পুরুবংশীয়রাই সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বয়ং ভরতের বাবা দুষ্যন্ত পর্যন্ত নিজের পৈতৃক রাজ্য পাননি। প্রতিষ্ঠানপুরের রাজধানীটি অনেক আগেই খোয়া গেছে। অতএব এটাই স্বাভাবিক যে, সার্বভৌম রাজা হিসেবে দৌষ্যন্তি ভরত পূর্বশত্রুতার শোধ তুলবেন এখন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে শতপথের প্রমাণটা এতই বেশি যুক্তিযুক্ত যে, আমরা অনুমান করতে পারি যে, শুধু গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর বিস্তীর্ণ তীরাঞ্চলই নয়, মহারাজ ভরত যদুবংশীয়দের রাজ্যও বেশ খানিকটা অধিকার করে নিয়েছিলেন। পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ হিসেবে। এই রাজ্য যাদবাধ্যুষিত মথুরা-শৌরশেনী অঞ্চলেরই খানিকটা হবে হয়তো।

মনে রাখতে হবে–চন্দ্র-পৌরববংশীয় কোনও রাজার পক্ষে এই প্রথম এত বড় একটা রাজ্য দখল করে তাকে শাসন ব্রাও সম্ভব হল। এইজন্যই ভারত এক সার্বভৌম রাজা। তার নামেই এই ভারতবর্ষের প্রথম imperial unity এবং তাঁর নামেই ভারত বংশ, মহাভারত, ভারত-যুদ্ধ। রাজা হিসেবে ভরত যদি শুধু এক সাম্রাজ্যবাদী প্রজাশোষক রাজা হতেন, তাহলে এতক্ষণে তাঁর আলোচনা বৃথা হয়েছে। বস্তুত তাঁর মহত্তের এবং রাজকীয় প্রতিষ্ঠার আরও বিশাল এক কীৰ্তিভূমি আছে, যা আধুনিক রাজনৈতিক নেতাদের পর্যন্ত অতিশয় লজ্জা দেবে। পরবর্তীকালে দুর্যোধন-পিতা ধৃতরাষ্ট্র বা তাঁর পুত্রদের বারবার যে কথা বলা হয়েছে–দেখ, এটা ভরতবংশীয়দের উপযুক্ত নয়–এই নিন্দাবাদের সূত্র বোধহয় সার্বভৌম ভরতের অন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠায়।

.

৪৭.

সাতচল্লিশ কোনও রাজা-মহারাজা যদি বিখ্যাত হন, তবে তার খ্যাতির পিছনে একটি বৈশিষ্ট্য থাকে। মহারাজ ভরতের বহুকাল পরের উত্তরপুরুষ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করতে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন মহামতি কৃষ্ণ তাকে কতগুলি বিশিষ্ট রাজার নাম করে বলেছিলেন– ইক্ষ্বাকুবংশীয় মান্ধাতা শত্রুজয়ের মাধ্যমে নিজের কীর্তি স্থাপন করেছিলেন। প্রজাপালনের সাধনে ভগীরথ, তপস্যায় কার্তবীর্য অর্জুন, তুর্ক-বংশীয় মরুত্ত অতুল সম্পত্তি আহরণ করে। যশস্বী হয়েছিলেন। আর মহারাজ ভরত বলপ্রয়োগের নৈপুণ্যে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েছিলেন-কার্তবীর্যস্তপোবীর‍্যা বলান্তু ভরতঃ প্রভুঃ।

অতকাল পরে কৃষ্ণের এই স্মারক বক্তৃতায় বোঝা যায়–ভরত যে সার্বভৌম রাজা হয়েছিলেন, তার পিছনে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং বলপ্রয়োগের কৃতিত্ব। ‘বল’ মানে শুধু গায়ের জোর নয়, পারিভাষিক অর্থে ‘বল’ শব্দ রাজার সৈন্য-সামন্ত সেনাপতি এবং দণ্ড প্রয়োগের ক্ষমতা বোঝায়। ভরতের রাজ্য জয় এবং দণ্ডনীতির নৈপুণ্য বহুকাল পরে যদুবংশীয় কৃষ্ণের মুখ দিয়ে অনুস্মৃত হওয়ার ফলে বুঝতে পারি–যাদবদের একাংশ অবশ্যই। মহারাজ ভরতের দণ্ডনীতির বলি হয়েছিলেন এবং সে কথা কৃষ্ণের সময়ে প্রবাদে পরিণত হয়েছে–বলা ভরতঃ প্রভুঃ।

এমন বিশাল এক সাম্রাজ্যের সার্বভৌম অধিকার ভরতের পররাষ্ট্রনীতির প্রজ্ঞা বহন করে–স্বীকার করি; কিন্তু অন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে, বিশেষত প্রজাসাধারণের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর এতটাই চিন্তা ছিল যে, সে ক্ষেত্রেও তার ভাবনা প্রাবাদিক স্তরে পৌঁছেছিল। কেমন করে–তা বলি। মহারাজ ভরতের তিনটি স্ত্রী ছিলেন এবং এই প্রত্যেক স্ত্রীর গর্ভেই তার তিনটি করে পত্র হয়। সকলেই জানেন–ভারতবর্ষে রাজা বা মন্ত্রী হয়ে জন্মালে এক বিশাল সৃবিধে পাওয়া যায়। রাজারা বংশ-বংশ ধরে রাজত্ব চালিয়ে যান, মন্ত্রীরাও তাই। ভারতবর্ষে রাজতন্ত্রের বদলে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র যাই আসুক সেখানেও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ক্রমান্বয়ে প্রধানমন্ত্রী হন, এ আমরা চোখে দেখেছি। জনসাধারণের রাজনৈতিক চেতনার অভাব অথবা বীরপূজার তত্ত্ব, যাই এখানে খাটুক না কেন, রাজার পরে রাজপুত্র রাজা হবেন–এটাই সাধারণ ধারণা। অন্তত সেকালের জনসাধারণ সাধারণভাবে রাজপুত্রকেই পরবর্তী রাজা হিসেবে চাইত। ভরত মহারাজের নটি পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্রটিই যে রাজা হবেন–এটাই সবার ধারণা ছিল।

কিন্তু না, এই রুটিন-বাঁধা ব্যাপারটা ভরতের রাজত্বে ঘটল না। তিন রানীর গর্ভে জাত ন’টি পুত্রের চরিত্র এবং গতিবিধি লক্ষ্য করে ভরত তাঁদের একজনকেও ভরত-বংশের পরবর্তী রাজা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেন না। তিনি বার বার বলতে লাগলেন–একটি পুত্রও আমার মত হয়নি-নাভ্যনন্দত তান্ রাজা নানুরূপা মমত্যুত। ‘আমার মত হয়নি’–এই কথার মধ্যে ভরতের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা অহংকার যতই প্রকাশিত হোক, আসলে তিনি মনে করেছিলেন যে, তার বিশাল সাম্রাজ্য চালানোর মত চারিত্রিক বল তার পুত্রদের নেই। রাজার ভাব দেখে তার তিন রানী মোটেই খুশি হননি। মহাভারতের খবর অনুযায়ী তারা ক্রুদ্ধ হয়ে আপন পুত্রদেরই নাকি হত্যাই করেছিলেন–ততস্তান্ মাতরঃ ক্রুদ্ধাঃ পুত্রা নির্যমক্ষয়ম্।

তিন রানীর এই ক্রোধ তাঁদের স্বামীর ওপরে, না পুত্রদের ওপরে–সে খবর মহাভারতের কবি দেননি। তবে রাজপুত্র হয়েও পিতার রাজ্যের উত্তরাধিকার পেল না–এটা একরকম মৃত্যুরই সামিল। অথবা এতবড় সম্রাট পিতার পুত্র হওয়া সত্ত্বেও যে পুত্রদের রাজ্যপ্রাপ্তির যোগ্যতা বা চরিত্রবল নেই, বীরপ্রস ক্ষত্রিয়-মাতার কাছে সেই পুত্রেরা মৃতেরই সামিল। মায়েদের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডও হয়তো এইরকমই কোনও অর্থ বহন করে। যাই হোক, ভরত নিজ পুত্রদের কাউকেই প্রজাপালনের উপযুক্ত না মনে করায় তার বংশের উত্তরাধিকার নিয়ে একটা দারুণ ক্রাইসিস’ তৈরি হল। নিজের বংশে পুত্র জন্মানো সত্ত্বেও তার কার্যকারিতা যখন বৃথা। হয়ে গেল–ততস্তস্য নরেন্দ্রস্য বিতথং পুত্ৰজন্ম তৎ–মহারাজ ভরত তখন নানারকম যাগ যজ্ঞ করা আরম্ভ করলেন। মহাভারত খবর দিয়েছে–ভরত শেষ পর্যন্ত মহর্ষি ভরদ্বাজের কাছ থেকে ভূমন্য নামে একটি পুত্র লাভ করলেন-লেভে পুত্রং ভরদ্বাজাদ ভূমং নাম ভারত। ভরদ্বাজের কাছ থেকে সেই পুত্র লাভ করেই মহারাজ ভরত নিজেকে পুত্রবান মনে করলেন এবং ভূমকেই তিনি ভরতবংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করলেন।

মহাভারতের কবি ভরতবংশের উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি সেরে ফেললেন, ব্যাপারটা কিন্তু তত সহজ নয়। মহাভারতের বক্তব্য থেকে আপাতত যেন মনে হতে পারে মহারাজ ভরত নিয়োগপ্রথায় ভরদ্বাজের কাছ থেকে একটি পুত্র লাভ করলেন। কিন্তু তা যদি হত, তবে তার উল্লেখ থাকত। কারণ, নিয়োগের ঘটনা লুকোনোর প্রয়োজন নেই মহাভারতের কবির। কিন্তু তাহলে প্রশ্ন হয়–হলটা কী তাহলে? হঠাৎ করে ভরদ্বাজকেই বা তিনি পেলেন কোথায়? ঘটনার তো পরম্পরা থাকবে একটা। সত্যি কথা বলতে কী-মহাভারতের বক্তব্যের সঙ্গে যদি অন্যান্য পুরাণগুলির বক্তব্য এখানে মিলিয়ে নেওয়া যায়, তাহলেই হয়তো সত্য কথাটা বেরিয়ে আসতে পারে, এমনকি তাতে মহাভারতের আকস্মিক বক্তব্যটা ভুলও প্রমাণ হয়ে যেতে পারে।

পুরাণগুলি যেহেতু রাজবংশ এবং ঋষিবংশের তালিকা নথিবদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে প্রায় ঐতিহাসিকদের মতো কাজ করছে, তাই এ বিষয়ে পুরাণগুলির সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। মহাভারতের যে দুটি পংক্তি এখানে আমরা উদ্ধার করেছি, তার মধ্যে খুব খেয়াল করার মতো দুটি শব্দ আছে–একটি হল ‘বিতথ’, দ্বিতীয়টি হল ‘ভূমন্যু’। এই শব্দ দুটি পরে আসবে। এবারে মূল প্রস্তাবে আসি।

বংশানুক্রমে অনুপযুক্ত রাজার রাজত্ব প্রজাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয় বলেই ভরত তার উত্তরাধিকারী খুঁজে বেড়াতে আরম্ভ করলেন। এই উত্তরাধিকারী সন্ধানের চেষ্টাটাই মহাভারতে ভরতের অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞের প্রতিরূপে ধরা আছে–ততো মহদ্ভিঃ ক্রতুভিরিজানোনা ভরতস্তদা। যদি যজ্ঞের ফলে বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে বেশির ভাগ পুরাণে দেখা যাচ্ছে–দেবতারা সন্তুষ্ট হয়ে বৃহস্পতির পুত্র ভরদ্বাজকে ভরতের পুত্রত্বে স্থাপন করেন :

ততো মরুদ্ভূরানীয় পুত্ৰঃ স তু বৃহস্পতেঃ।
সংক্রামিতো ভরদ্বাজো মরুদ্ভিৰ্ভরতস্য তু৷৷

তার মানে মহাভারতের শূন্যতা খানিকটা পূরণ হল, অর্থাৎ ভূমনকে প্রথমেই পাওয়া যাবে না, ভরদ্বাজই ভরতের পুত্ররূপে কল্পিত হলেন। এখানে আমাদের একটু পৌরাণিক প্রসঙ্গের অবতারণা করতেই হবে–তবে বিনীত অনুরোধ, যেন খেই হারিয়ে না যায়।

প্রথম কথা হল ভরদ্বাজ কে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের একটু বিব্রতও হতে হবে। তবু না বললে পুরাণকাহিনীর পরম্পরা এবং রাজবংশের পরম্পরা–কোনওটাই বোঝ যাবে না। সমস্ত প্রধান পুরাণেই যে কাহিনী আছে তা মোটামুটি গবেষণা করলে এই দাঁড়ায়–দেবগুরু বৃহস্পতির এক ভাইয়ের নাম আমরা পূর্বে বলেছি। তিনি সংবর্ত, যিনি তুর্বসুবংশীয় মরুত্ত রাজাকে যজ্ঞ করিয়েছিলেন। এই বৃহস্পতির বড় ভাই ছিলেন উতথ্য বা উচথ্য–উতথ্যস্য যবীয়াংস্তু পুরোধাস্ত্রিদিবেকর্মা। পুরাণকারেরা এই উতথ্য নামটিকে উশিজ বানিয়ে দিয়েছেন এবং তার কারণ হল– বেদে উতথ্য এবং উশিজ–এই দুটি নামই পাওয়া যায় বৃহস্পতির পূর্বপুরুষ হিসেবে। উশিজ খুব সম্ভবত উতথ্য, বৃহস্পতি এবং সংবর্তেরও পিতা ছিলেন, কিন্তু পুরাণকারেরা ভুলবশত উশিজকে বৃহস্পতির বড় ভাই বানিয়ে দিয়েছেন। মহাভারতের কবির মাথা এ বাবদে ঠিক আছে। তার মতে উতথ্য বৃহস্পতির বড় ভাই এবং তার স্ত্রীর নাম মমতা-মমতা নাম তস্যাসী ভার‍্যা পরমসম্মতা।

সংবর্তের কথা, পুর্বে বলেছি যে, বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু নির্বাচিত হলে তিনি ছোট ভাই সংবর্তের জীবন দুর্বিষহ করে দিয়েছিলেন। তার স্ত্রীর সম্বন্ধেও বৃহস্পতির যে কিছু লালসা কাজ করেছে তারও প্রমাণ তখন আমরা পেয়েছি। লক্ষণীয় ব্যাপার হল–বৃহস্পতির ইন্দ্রিয়বৃত্তি কখনই খুব একটা সংযত ছিল না এবং তিনি বড় ভাইয়ের স্ত্রীর প্রতিও সমানভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অর্থাৎ বৃহস্পতির এই অভ্যাস ছিল। কোনও এক সময়ে–হয়তো উতথ্য তখন মারা গেছেন–বৃহস্পতি তার অগ্রজের পত্নী মমতাকে দেখে মোহিত হন এবং তাঁকে বলেন–তুমি বেশ ভাল করে সেজেগুজে এস তো দেখি, আমি তোমার সঙ্গে মিলন প্রার্থনা করি। মমতার গর্ভে সেই সময় তার প্রয়াত স্বামীর পুত্র রয়েছে। অতএব অবাক-বিস্ময়ে কাকুতি-মিনতি করে মমতা বৃহস্পতিকে বললেন–তোমার ভ্রাতার সন্তান আমার গর্ভে। তুমি বিরত হও বৃহস্পতি–অন্তর্বত্নী ত্বহং ভ্ৰাত্রা জ্যেষ্ঠেরম্যতামিতি।

মমতা আরও বললেন–যে ছেলে আমার গর্ভস্থ হয়ে আছে, সে গর্ভে থেকেই ষড়ঙ্গ বেদ উচ্চারণ করছে। এখন এই অবস্থায় যদি তুমিও আমার সঙ্গে মিলিত হও, তাহলে দুজনের সন্তান তো আর একই গর্ভে ধারণ করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে-দ্বয়োর্নাস্ত্যত্র সম্ভবঃ। মমতা অনুনয় করে বললেন–আমার এই সময়টা পার হয়ে যাক, তারপর তুমি যা বলবে, তাই করব–অস্মিবে গতে কালে যথা বা মন্যসে বিভো। বৃহস্পতি বললেন–তোমার কাছে আমি জ্ঞান শুনতে চাইনি–বিনয়া নোপদেষ্টব্যঃ–যা বলছি তাই কর। স্বামীহীনা অরক্ষিতা মমতাকে বৃহস্পতি কিছুতেই মুক্ত হতে দিলেন না। অকামা রমণীর প্রতি বলপ্রয়োগ করে তিনি উপগত হলেন সকামেস বভূব ততঃ কামী তয়া সার্ধম অকময়া।

বৃহস্পতি যখন কামনার চরম মুহূর্তে পৌঁছেছেন, সেই সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মমতার গর্ভস্থ সন্তান গর্ভ থেকেই বলে উঠল-মহাশয়! আপনি এইভাবে কামপ্রবল হয়ে উঠবেন না। আমি এই গর্ভে পূর্বাহ্নেই উপস্থিত, এখানে দুজনের স্থান হবে না–ভোস্তাত মা গমঃ কামং…পূর্বঞ্চাহমিহাগতঃ। মহাভারত জানিয়েছে–বৃহস্পতি তেজোমুক্ত হবার আগেই মমতার গর্ভস্থ মুনি-সন্তান নিজের পা দিয়ে বৃহস্পতির কামগতি রুদ্ধ করলেন পামারোধয় মার্গং শুক্ৰস্য চ বৃহস্পতেঃ। বৃহস্পতির তেজ অস্থানে পতিত হল এবং অভীষ্ট কামগতি রুদ্ধ হওয়ায় তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে মমতার গর্ভস্থ সন্তানকে অভিশাপ দিলেন–তুই যখন সমস্ত প্রাণীর পরমেপ্সিত এই রতিমুক্তির কালে আমাকে এইভাবে বাধা দিলি, অতএব তুই অন্ধ হয়ে জন্মাবি–প্রতিষেধসি তস্মাত্ত্বং তমো দীর্ঘং প্রবেক্ষ্যসি।

উতথ্য এবং মমতার সন্তান গভীর তমোময় দৃষ্টি নিয়ে জন্মালেন। তাঁর নাম হল দীর্ঘতমা। আর বৃহস্পতির রতিমুক্ত তেজ থেকে অন্য একটি শিশুর জন্ম হল; উতথ্যপত্নী মমতার কোনও মমতা সে পেল না। তার জন্মমাত্রেই মমতা বৃহস্পতিকে বললেন–এটি তোমার জারজ সন্তান (দ্বাজ) একে তুমিই ভরণ-পোষণ কর, ভর দ্বাজং বৃহস্পতে। মমতা তৎক্ষণাৎ বৃহস্পতির পুত্রকে রেখে চলে গেলেন। এবং বৃহস্পতিও সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন তিনিও। কিন্তু যাবার আগে মমতা যে কথাটি বলে গিয়েছিলেন—জারজকে তুমিই মানুষ কর–ভর দ্বাজম–শুধু সেই দুটি শব্দের অর্থ-স্মৃতি বহন করে সেই কুমার মাতা-পিতার মেহরসে বঞ্চিত হয়ে একা পড়ে রইল–তার নাম হল ভরদ্বাজ।

বায়ু-পুরাণ, মৎস্যপুরাণ খবর দিয়েছে–ঠিক এই সময়েই সার্বভৌম মহারাজ-ভরত পুত্রলাভের জন্য মরুৎসোম যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। মরুগণ এই যজ্ঞের প্রক্রিয়ায় খুশি হয়ে মাতা-পিতার ত্যাগ করা সেই শিশু ভরদ্বাজকে ভরত-মহারাজের হাতে তুলে দেন। উপহারের মতো–উপনির্ভরদ্বাজং পুত্ৰার্থং ভরতায় বৈ। মহর্ষি অঙ্গিরার বংশে জাত বৃহস্পতির ঔরস পুত্র ভরদ্বাজকে লাভ করে মহারাজ ভরত খুশি হয়ে কুমার ভরদ্বাজকে বললেন–আমার সব পুত্রের জন্মই যখন বিতথ অর্থাৎ বৃথা হয়ে গেছে, তখনই আমি তোমাকে লাভ করেছি। অতএব আজ থেকে তোমার নাম হোক ‘বিতথ ভরদ্বাজ’।

পাঠক। আপনাকে মহাভারতের সেই পুর্বোদ্ধৃত পংক্তিটিকে ‘বিতথ’ শব্দটি খেয়াল রাখতে বলেছিলাম। এতক্ষণে সেই বিতথ শব্দের সঙ্গে আরও একটি শব্দ জুড়ে যে নামটি পাওয়া গেল, তিনিই মহারাজ ভরতের নবলব্ধ পুত্র ‘বিতথ ভরদ্বাজ’। ভূমনুর প্রশ্ন এখনও আসেনি। কারণ তার আগে আরও দুটো কথা বলতে হবে। এবং এই ‘বিতথ ভরদ্বাজ’কে নিয়েও কিছু গবেষণা এখনও বাকি আছে।

প্রথমেই ভাবতে হবে–এই বৃহস্পতি, এই দীর্ঘতমা এবং এই ভরদ্বাজই মূল বৃহস্পতি, মূল দীর্ঘতমা এবং মূল ভরদ্বাজ কি না। হতেই পারে না। কারণ আমরা চন্দ্রবংশের উৎপত্তিকালে বৃহস্পতিকে পেয়েছি, আমাদের ভরত রাজা তখন কোথায়? বস্তুত এখানে বৃহস্পতি, দীর্ঘতমা বা ভরদ্বাজ বলতে তাঁদের বংশধর কাউকে বুঝতে হবে। ভেবে দেখুন, রামচন্দ্রের পূর্ব পিতামহ দিলীপ-রঘু–এঁদেরও পুরোহিত ছিলেন বশিষ্ঠ মুনি, আবার দশরথ-রামচন্দ্রের পুরোহিতও ছিলেন বশিষ্ঠ মুনি। এরা তো একই লোক হতে পারেন না। প্রাচীন ঋষিবংশে বশিষ্ঠর বংশজরা যেমন সবাই বশিষ্ঠ, তেমনি, বৃহস্পতি, দীর্ঘতমা বা ভরদ্বাজের বংশধরেরাও একেক জন বৃহস্পতি, দীর্ঘতমা এবং একেক জন ভরদ্বাজ। এখন ‘বিতথ ভরদ্বাজ’কে নিয়ে আরও দুটো কথা বলি।

কথা হল–মহারাজ ভরত যাকে দত্তক হিসেবে পেলেন-তার নামই ভরদ্বাজ? অথবা তার নাম বিতথ? নাকি এটা ভরদ্বাজের বিশেষণ অথবা অন্য কোনও নাম? প্রশ্ন আছে আরও। মহর্ষি ভরদ্বাজই কি এর পরে প্রসিদ্ধ ভরতবংশের রাজা হয়ে বসলেন, নাকি তার কোনও ছেলে? মহাভারতের কবি এখানে একটি ফাঁক রেখে বলেছেন–ভরদ্বাজের কাছ থেকে ভূমন্যুকে লাভ করলেন ভরত। অন্যদিকে মৎস্যপুরাণ বলেছে–ভরতের পর বিতথ নামে ভরদ্বাজই রাজা হলেন-ততন্তু বিতখো নাম ভরদ্বাজো নৃপো’ভবৎ। কিন্তু এর দুই পংক্তি পরেই মৎস্যপুরাণ বললেন–বিতথ জন্মগ্রহণ করলে মহারাজ ভরত স্বর্গারোহণ করেন–ততো জাতে হি বিতথে ভরতশ্চ দিবং যযৌ। আবার তারপরেই–ভরদ্বাজও পুত্রকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করে স্বর্গস্থ হলেন–ভরদ্বাজো দিবং জাতভিষিচ্য সুতং ঋষিঃ।

বায়ুপুরাণের শ্লোকগুলিও প্রায় মৎস্যপুরাণের মতোই। কিন্তু একটাই বাঁচোয়া–বায়ুপুরাণ মৎস্যপুরাণের মতো একবারও ওই কথাটি বলেনি যে–তারপর বিতথ নামে ভরদ্বাজ রাজা হলেন। আসলে এইখানেই মৎস্যপুরাণে একটি লিপিপ্রমাদ আছে। মৎস্যপুরাণের পংক্তিতে ‘ভরদ্বাজঃ’ শব্দটি হবে ‘ভারদ্বাজঃ’–যার অর্থ ভরদ্বাজের পুত্র রাজা হলেন–ততন্তু বিতথে নাম ভারদ্বাজো নৃপোবৎ। আমরা যে ঠিক বলছি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রয়ে গেছে হরিবংশে। সেখানে পরিষ্কার বলা আছে–মহারাজ ভরতের পুত্ৰজন্ম বৃথা হল এবং মহর্ষি ভরদ্বাজের এক পুত্র, যাঁর নাম বিতথ–সেই বিতথ জন্মালেই উপযুক্ত উত্তরাধিকারী লাভ করে ভরত স্বর্গারোহণ করলেন–ততন্তু বিতথো নাম ভরদ্বাজ তো’ভবৎ। অন্যদিকে ছেলে বিথকে সিংহাসনে বসিয়ে মহর্ষি ভরদ্বাজও বনের পথে পা বাড়ালেন।

এর পরে মৎস্যপুরাণেও আর কোনও ভুল নেই, বায়ুপুরাণেও আর কোনও ভুল নেই, হরিবংশে তো নেইই। দেখা যাচ্ছে-মৎস্য এবং বায়ু সমস্বরে বলছে-বিতথের ছেলের নাম হল ভুবমন যাকে মহাভারত বলেছে ভূমন–বিতথস্য তু দায়াদো ভুবমনর্বভূব হ (ভুবমহাযশাঃ)।

আমরা বেশ বুঝতে পারছি–বায়ু, মৎস্য, হরিবংশ, মহাভারত-একেক পুরাণের একেক কথা উদ্ধার করে আমরা সুকুমারমতি পাঠকের মাথাটা একেবারে গণ্ডগোল পাকিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এতে করে বোঝবার ব্যাপার আছে একটাই। মহারাজ ভরতের মরুৎসোম যজ্ঞে প্রীত হয়ে মরুগণ পিতৃমাতৃপরিত্যক্ত ভরদ্বাজকে ভরতের পুত্রত্বে স্থাপন করলেন–ততো মরুদ্ভিরানীয় পুত্ৰস্তু স বৃহস্পতেঃ। সংক্রামিতো ভরদ্বাজ। কিন্তু পুরাণগুলির নানা বয়ান থেকে যেহেতু বোঝা যায় যে, ভরদ্বাজ ভরতের সিংহাসনে বসেননি, তাতে বোধহয়, ভরত ভরদ্বাজকেও ভালরকম পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং তার পুত্র বিতথ জন্মালে–সেই বিতথকেই তিনি নিজের উত্তরাধিকারী বলে মনোনীত করেছেন।

ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু ক্ষত্রিয় ভরতের পিতৃত্ব স্বীকার করেছেন, তার ফলে ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ ক্ষত্রিয়ের সংজ্ঞা লাভ করেন–তস্মাদ দিব্যো ভরদ্বাজো ব্রাহ্মণ্যাৎ ক্ষত্রিয়ো ভবৎ। পৌরাণিকেরা অবশ্য ভরদ্বাজের ব্রাহ্মণত্বও পুরোপুরি হরণ করেননি। তারা বলেছেন- ভরদ্বাজ দ্বিপিতৃক–একদিকে বৃহস্পতিও তার পিতা, অন্যদিকে মহারাজ ভরতও তাঁর পিতা। আরও একটা বিশেষণ ভরদ্বাজের কপালে জুটেছে, সেটা হল–দ্ব্যামুয্যায়ণ –অর্থাৎ দো-আঁশলা। মৎস্যপুরাণ বলেছে–ভরদ্বাজের বংশে ক্ষত্রিয়রাও জন্মেছেন, ব্রাহ্মণেরাও জন্মেছেন-তস্মাদপি ভরদ্বাজা ব্রাহ্মণাঃ ক্ষত্রিয়া ভুবি। আমাদের ধারণা ভরতের। পিতৃত্ব স্বীকার করার ফলে ভরতবংশে জাত পুত্রগুলিই ভরদ্বাজের ক্ষত্রিয় বংশ। আর বিতথকে সিংহাসনে বসিয়ে বনগমন করার পর ভরদ্বাজের যে সব পুত্র জন্মেছেন, তারাই ব্রাহ্মণ। কিন্তু ভরদ্বাজের দুর্ভাগ্য, তিনি দ্বিপিতৃক হওয়ার ফলে তার পুত্রেরা ব্রাহ্মণই হোন, আর ক্ষত্রিয়ই হোন, তারা সবাই দো-আঁশলা–দ্ব্যামুয্যায়ণকৌলীনাঃ স্মৃতাস্তে দ্বিবিধেন চ।

আরও একটা কথা এখানে না বললে নয়। আমরা এতক্ষণ মহারাজ ভরতের মরুৎসোম যজ্ঞ, মরুগণের তুষ্টি এবং তার ফলে ঋষি ভরদ্বাজের ক্ষত্রিয় বংশে সংক্রমণের কথা বললাম পৌরাণিকদের যুক্তি মেনে। তাদের ঈঙ্গিত বক্তব্য আমরা একটু পরীক্ষা করে পেশ করেছি মাত্র। কিন্তু লৌকিক দৃষ্টিতেও ভরতের পুত্র-অন্বেষণের একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যায় এবং সেটা। পারজিটার সাহেবই কিন্তু ধরেছেন ভাল। অবশ্য আমাদের প্রাচীন ব্রাহ্মণ গ্রন্থ ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সাক্ষীটা এখানে খুব জরুরী। ঐতরেয় বলেছেন- মামতেয় দীর্ঘতমা, অর্থাৎ সেই উতথ্যের স্ত্রী মমতার ছেলে দীর্ঘতমা, যিনি বৃহস্পতিকে রতিক্রিয়ায় বাধা দিয়ে অভিশাপ কুড়িয়েছিলেন সেই দীর্ঘতমা ভরত দৌষ্যক্তির ঐন্দ্র মহাভিষেক সম্পন্ন করেন।

ঐন্দ্র মহাভিষেক এমনই এক অভিষেক যা হয়তো মহারাজ ভরতের সার্বভৌমত্ব লাভের পর সংঘটিত হয়েছিল। কারণ স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্রের সার্বভৌম প্রতিষ্ঠার প্রতিরূপেই মর্ত্যলোকের রাজার ঐন্দ্র মহাভিষেকের আচরণ অনুষ্ঠিত হয়। ধারণা করা যায়-ভরত কথঞ্চিৎ বৃদ্ধ হবার পর দীর্ঘতমা মামতেয় এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। এখন একটা সন্দেহ উপস্থিত হবে। কারণ পুরাণে দীর্ঘতমা এবং বৃহস্পতির পুত্র ভরদ্বাজ–দুজনকেই আমরা যখন জন্মাতে দেখেছি, তখন ভরত-মহারাজের বয়স হয়ে গেছে। তিনি তখন উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর সন্ধানে মরুৎসোম যজ্ঞ করছেন–তস্মিন্ কালে তু ভরতো মরুদ্ভিঃ ক্রতুর্ভিঃ ক্ৰমাৎ। এদিকে বৃদ্ধ দীর্ঘতমা, যিনি হয়তো মহারাজ ভরতের বংশগত পুরোহিত, তিনি বৃদ্ধ ভরতের মহাভিষেক সম্পন্ন করছেন–ঐতরেয় ব্রাহ্মণের এই সংবাদ কিন্তু পুরাণের সংবাদের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যাপারটাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় মূল দীর্ঘতমা এবং মূল ভরদ্বাজও ভরতের থেকে বয়সে অনেক বড় ছিলেন। পারজিটার লিখেছেন–The aged Dirghatamas, and Bhardvaja also, may thus have lived till the beginning of Bharata’s reign. Though that, the first Bharadvaja could not have been given in adoption to Bharata, yet his grandson (or perhaps great grandsons) may have been so given, and this…strongly suggests that it was Vidathin (আমাদের পৌরাণিক ভাষায় ‘বিতথ’) who was adopted.

পারজিটার সাহেবের আসল অনুমানের কথাটা এখনও বলিনি। কিন্তু সেটাই লৌকিকভাবে ভরতের এই পুত্রান্বেষণের ঘটনাটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত করে। পারজিটার অনুমান করেন যে, বৃহস্পতি, সংবর্ত–এঁরা সবাই ছিলেন তুর্ববংশীয় মরুত্ত রাজার দেশের লোক। বৃহস্পতি, সংবর্ত এবং মরুত্তের কাহিনী আমরা পূর্বে বলেছি–তাতে এই অনুমানটা যথেষ্ট সমর্থনযোগ্যই মনে হয়। বৃহস্পতিই মরুত্ত রাজার বংশানুক্রমিক গুরু ছিলেন-তাও আমরা পূর্বে বলেছি। স্বাভাবিকভাবেই ধারণা হয়, বৃহস্পতি যে অন্যায়ই করে থাকুন অথবা মমতার ব্যাপারে যাই। ঘটে থাকুক, ভরদ্বাজ এই মরুত্ত রাজার দেশেই জন্মগ্রহণ করেন এবং তার পুত্র বা প্রপৌত্র বিতথ ভরদ্বাজও জন্মান ওখানেই। ভরতের পুত্রজন্ম যখন বিফল হল, তখন বৃদ্ধ। দীর্ঘতমা–যিনি ভরতের ঐন্দ্র মহাভিষেক সম্পন্ন করেন–তিনি হয়তো তখন তার আত্মীয়কল্প যুবক ভরদ্বাজকে দত্তক নিতে বলেন। মহারাজ ভরত যেহেতু মরুত্ত রাজার দেশ থেকে ভরদ্বাজকে নিয়ে আসেন অতএব পৌরাণিকেরা ভুল করে অথবা সাধারণ ঘটনার দেবায়ন ঘটিয়ে বলেন-মরুণ ভরতের মরুৎসোম যজ্ঞের প্রক্রিয়ায় তুষ্ট হয়ে ভরদ্বাজকে ভরতের পুত্রত্বে সংক্রমিত করেন। মরুৎ আসলে মরু রাজা।

 পারজিটার সাহেবের এই অনুমান আমরা সমর্থন করি অন্য আরও একটা কারণে। আমাদের ধারণা–ভরতের পিতা দুষ্যন্ত মরুত্ত রাজার ঘরে মানুষ হয়েছিলেন। আজ এতদিন পরে মহারাজ ভরত যখন নিজের অযোগ্য পুত্রদের অসামর্থ্যে হতাশ বোধ করছিলেন, তখন সেই পালক পিতামহ মরুত্ত রাজার দেশ থেকে ভরদ্বাজ এবং তাঁর পুত্র বিতথকে নিয়ে এসে একভাবে পিতৃঋণ শোধ করলেন। হতেও বা পারে, এবং এই কারণেই সাহেবের অনুমানটা আমরা এখানে সমর্থনই করি।

 ভরতবংশের ঊর্ধ্বতন পরম্পরায় এতদিন যা ঘটেছে, তাতে স্ত্রীলোকের রক্তবিশুদ্ধি খুব একটা থাকেনি। ব্রাহ্মণীর রক্ত, স্বর্গসুন্দরী স্বৰ্গবেশ্যার রক্ত, এবং অবশ্যই ক্ষত্রিয়ার রক্ত–সব কিছু মিলেমিশে বেশ একটা কঠিন-কোমল ধাতুর বংশ-পরম্পরা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই প্রথম ঘটনা ঘটল যখন পুরুষের দিক থেকে একেবারে অন্য রক্ত-সংক্রমণ ঘটল ভরতবংশে এবং একে সংক্রমণ না বলে আহরণ বলাই ভাল। কারণ এক ঋষিপুত্রকে দত্তক নেওয়ার ফলে ভরতবংশে রীতিমত ব্রাহ্মণ্য সংক্রমণ ঘটে গেল। এর ফল হয়েছে সুদূরপ্রসারী। মহাভারতের মূল আখ্যানে মহামতি যুধিষ্ঠিরের ব্রাহ্মণোচিত আচার-ব্যবহার এবং ব্রাহ্মণ্য-ভাবনা দেখে পণ্ডিতেরা এই বংশ-সংক্রমণের ঘটনার কথা স্মরণ করেন এবং যুধিষ্ঠিরের ব্যবহারের তাৎপর্য খুঁজে পান। আমরা অবশ্য কথাটা বাড়াবাড়ি মনে করি। কেননা, যুধিষ্ঠিরের ব্রাহ্মণ-ভাবনার জন্য এত দূর না ছুটে, তার অতিপ্রিয় পিতামহ ব্যাসদেব পর্যন্ত গেলেই চলবে। তবুও এ ঘটনা উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে–প্রসিদ্ধ চন্দ্রবংশের পরম্পরার মধ্যে একটি ব্রাহ্মণ-পুরুষ তার ব্রাহ্মণ্যের মূল প্রোথিত করে দিলেন। ক্ষত্রিয়ের রাজবংশে ব্রাহ্মণের বিন্দু পতিত হল। এ ঘটনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আরও বোঝা যাবে–যখন ভরতবংশে আবারও উপযুক্ত বংশধরের ‘ক্রাইসিস’ তৈরি হবে। বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীদের গর্ভাধান করার জন্য যখন আবার ব্যাসদেবের ডাক পড়বে, তার আগে কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মদেব এই ব্রাহ্মণ-বংশ-সংক্রমণের কথাই স্মরণ করেছিলেন।

আমার সহৃদয় পাঠককুল। এবারে একটা সুখবর দিই। ভরতবংশে বিতথের পুত্র ভূমন্যু বা ভুবমনু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কিন্তু বহুত বহু-আলোচিত হস্তিনাপুরের কাছাকাছি চলে এসেছি। ভূমন্যুর সঙ্গে যে রমণীর বিয়ে হয়, তিনি যদুবংশীয় দাশাহের ধারায় জন্মেছিলেন। তার নাম বিজয়া। তাদের ছেলের নাম সুহোত্র। সুহোত্র যে খুব নামী রাজা ছিলেন তা নয়। তবে সার্বভৌম ভরতের সাম্রাজ্য তিনি সম্পূর্ণ দখলে রাখতে পেরেছিলেন। রাজসূয়-অশ্বমেধের মতো বড় বড় যজ্ঞ করে জনমনে ভরতবংশের ‘ইমেজ’টাও অটুট ধরে রেখেছিলেন সুহোত্র। চতুরঙ্গিনী সেনা এবং রাজকোষ–দুটোই সমৃদ্ধ থাকার ফলে তিনি একটু নগরায়ণ বা ‘আরবানাইজেশনে’র দিকে মন দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। কারণ মহাভারত মন্তব্য করেছে–তার আমলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় মনুষ্যকলিলা ভূশম–এবং সুহোত্র বহু জায়গায় পাষাণ-নির্মিত চৈত্যগৃহ তৈরি করান। জনসাধারণের চাহিদা অনুসারে এই চৈত্যগুলিকে পাষাণ-নির্মিত যজ্ঞ স্থানও মনে করা যেতে পারে কারণ, যজ্ঞপশুর বধ-বন্ধনের জন্য ঘূপ-কাও তৈরি করা হয়েছিল বহু জায়গায়–চৈত্যযুপাঙ্কিতা চাসীভূমিঃ শতসহস্রশঃ।

এখানে চৈত্য শব্দের সঙ্গে যুপ শব্দটি থাকায় ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা চৈত্য শব্দটাকে যজ্ঞস্থান বলেই মনে করেছেন, কিন্তু আমাদের সবিশেষ ধারণা–এখনকার দিনের মতো একেবারে ‘পার্মানেন্ট’ একটা বাঁধানো জায়গায় যজ্ঞ করতে সেকালের ঋষি-মুনিরা পছন্দ করতেন না। কিন্তু যজ্ঞীয় পশুর বধ-বন্ধনের ব্যাপারটা যেহেতু খুবই সমস্যা তৈরি করত, তাই ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃত সমাজে জায়গায় জায়গায় যুপ নির্মাণ করাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু চৈত্য শব্দটা আমরা যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতার নিয়মে জমির সীমা নির্ধারণ করার জন্য পাষাণ স্তূপ হিসেবেই মেনে নিতে চাই। ‘চৈত্য-য়ূপ’ শব্দের সঙ্গে ‘অঙ্কিত’ শব্দটিও আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ‘অঙ্কিত’ শব্দের অর্থ চিহ্নিত। সুহোত্র রাজার নগরায়ণের পদক্ষেপে শতসহস্র পাষাণ-ক্রুপের বন্ধনে চিহ্নিত ভূমির পরিমাপই যদি এখানে গ্রাহ্য হয়, তবেই কিন্তু তার পরবর্তী বংশধরের সবচেয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপটি সার্থক করে তুলবে।

সুহোত্র ইক্ষ্বাকু-বংশের কন্যা সুবর্ণাকে বিবাহ করেন এবং তাঁর গর্ভজাত পুত্রটির নামই হল হস্তী। হয়তো পিতার চৈত-যুপাঙ্কিত নগরায়ণের পথ ধরেই মহারাজ হস্তী হস্তিনাপুর-নগরীর প্রতিষ্ঠা করেন

সুহোস্যাপি দায়াদো হস্তী নাম বভূব হ।
তেনেদং নির্মিতং পূর্বং নাম্না বৈ হস্তিনাপুরম্।

ভরতবংশের ধারায় মহারাজ হস্তীকে লাভ করার পর আমরা এখন হস্তিনাপুরে দাঁড়িয়ে আছি।

.

৪৮.

 সেই কবে প্রতিষ্ঠানপুরে চন্দ্রবংশীয় রাজাদের ঠিকানা পেয়েছিলাম। তারপরে যযাতির কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর রাজত্ব শেষ হয়ে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানপুরের ঠিকানাও হারিয়ে গেল। এতদিন পরে পুরু-ভরতবংশীয়দের নতুন রাজধানীর পত্তন করলেন মহারাজ হস্তী। হস্তীর পূর্বপুরুষ মহারাজ ভরত রাজ্য বিস্তারেই ব্যস্ত ছিলেন। গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চল থেকে সরস্বতী নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জয় করে ভরত নিজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু, তাঁর রাজধানীটির নাম আমরা পাইনি। পিতা সুহোত্রের নগরায়ণের পথ ধরে মহারাজ হস্তী শেষ পর্যন্ত নিজের নামে ভরতবংশের একটি রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন। পণ্ডিতেরা বলেন–আধুনিক ‘মিরাট’ শহরের কাছাকাছি কোনও জায়গায় হস্তিনাপুরের ভৌগোলিক অবস্থান। স্থান নির্বাচনের মধ্যে যদি কোনও বুদ্ধি কৌশল কাজ করে থাকে, তবে রাজধানী হিসেবে হস্তিনাপুরের মতো একটা স্থান নির্বাচন করা যথেষ্ট রাজনৈতিক বোধের পরিচয়। কেননা, অতি আধুনিক কালেও আমাদের ভারতবর্ষের যে রাজধানী, সেই দিল্লি থেকে হস্তিনাপুর খুব দূরে নয়।

আমরা আগেও বলেছি এবং আবারও বলছি যে, হস্তিনাপুর প্রতিষ্ঠার আগে এই অঞ্চলে আর্যেতর নাগ জন-জাতির বসতি ছিল। নাগ অর্থ সর্প। তার মানে এই বিশেষ জনগোষ্ঠী সর্পের ‘টোটেম’ ব্যবহার করত। মহাভারতের অনেক জায়গায় হস্তিনাপুরকে সোজাসুজি নাগপুর’ বলা হয়েছে। মহারাজ পাণ্ডুর বিশেষণ ছিল ‘নাগপুরসিংহ’-তে নাগপুরসিংহেন পাণ্ডুনা করদীকৃতা। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায়–মহারাজ হস্তী ওই জায়গাটি অধিকার করার পর নিজের নামে তার নামকরণ করেন হস্তিনাপুর। নাগ অর্থে যেহেতু হস্তীও বোঝায় তাই সর্পার্থক নাগ শব্দ পরিত্যাগ করে গজ বা হস্তিবাচক নাগ শব্দ প্রচলিত হল মহারাজ হস্তীর সম্মানে। কিন্তু পুরনো নামটাও স্মারক হিসেবে থেকে গেল-নাগসাহয়, নাগপুর ইত্যাদি। আবার নতুন নামও চলল–হস্তিনাপুর গজসাহয়, বারণসাহয় ইত্যাদি।

অন্য কোনও কীর্তি না থাকলেও শুধুমাত্র হস্তিনাপুর নগরীর জন্যই হস্তী বিখ্যাত হয়ে রইলেন। মহাভারতের বংশলতিকায় পুরু-ভরতের বংশে বিকুণ্ঠন নামে এক রাজার নাম এসেছে, যদিও প্রাচীন পুরাণগুলির সঙ্গে এই নাম মেলে না। পুরাণের পুরু-বংশপরম্পরায় হস্তীর তিন পুত্র–অজমীঢ়, দ্বিমীঢ় এবং পুরুমীঢ়। জ্যেষ্ঠ অজমীঢ়ের বংশধারাতেই পুরু ভরতবংশের রাজপরম্পরা চলতে থাকে হস্তিনাপুরকে কেন্দ্র করে। অজমীঢ় বিখ্যাত রাজা ছিলেন। পাণ্ডু, ধৃতরাষ্ট্র, যুধিষ্ঠির এঁদের বহুবার ‘অজমীঢ়’ বলে সম্মান করা হয়েছে। তবে রাজ্যবিস্তার, রাজ্যশাসন অথবা প্রজাপালনের জন্য অজমীঢ় যতখানি বিখ্যাত, তার চেয়ে তিনি অনেক বেশি বিখ্যাত বোধহয় তার পুত্র-পৌত্রদের জন্য।

অজমীঢ়ের তিন স্ত্রী-নীলিনী, কেশিনী এবং ধুমিনী। এই তিন স্ত্রীর গর্ভে অজমীঢ়ের যে সব পুত্র হয়, তারাই ভারতবর্ষের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন। এদিক দিয়ে মহারাজ অজমীঢ় একমাত্র যযাতির সঙ্গে তুলনীয়। কেশিনীর গর্ভে অজমীঢ়ের যে পুত্রটি জন্মগ্রহণ করেন, তার বংশের সকলেই ব্রাহ্মণ হয়ে যান। এঁদের বলা হয় ‘ক্ষত্রোপেত দ্বিজ’ অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের বংশে জম্মেও এঁরা রাজদণ্ড গ্রহণ না করে ব্রাহ্মণের যজ্ঞ-হোম-তপস্যার পথ বেছে নেন। কেশিনীর গর্ভজাত ওই পুত্রের নাম ক ছিল বলে এঁর বংশধরেরা সবাই কাণ্বায়ন ব্রাহ্মণ বলে সমাজে পরিচিত হন।

অজমীঢ়ের দ্বিতীয় স্ত্রী কেশিনীর কথা আগে বলে নিলাম। কারণ তাঁর প্রথমা স্ত্রী নীলিনীর গর্ভজাত পুত্রেরা অন্যদিক দিয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এইজন্য গুরুত্বপুর্ণ যে, এই বংশ হস্তিনাপুরে রাজত্ব করতেন না। প্রথমেই বলা ভাল যে, অজমীঢ়ের ঔরসে নীলিনীর গর্ভজাত পুত্র নীল এবং তার পুত্রেরা হস্তিনাপুরে থাকতেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু তাদের দু-তিন পুরুষ পরেই এই বংশে পাঁচটি পুত্র জন্মায়। তাদের নাম মুদগল, সৃঞ্জয়, বৃহদিষু, যবীনর এবং কৃমিলা (অথবা কপিল অথবা কম্পিল্য)। এই পাঁচ ছেলের বাবা হর্য মুখে মুখে সবাইকে বলতেন–আমার এই পাঁচ ছেলে অন্তত পাঁচটা রাজ্য রক্ষা করতে সমর্থ হবে–পঞ্চানামেতেষাং বিষয়াণাং রক্ষণায় অলমেতে মৎপুত্রাঃ। হস্তিনাপুরে পৌরবংশের প্রধান ধারায় যেহেতু এঁরা কোনও রাজ্য পাননি, তাই রাজ্যবিস্তার বা অন্য রাজ্য স্থাপন করার একটা প্রবল প্রচেষ্টা এঁদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এঁরা প্রত্যেকেই যুদ্ধবীর ছিলেন এবং নিজেরা যুদ্ধ করে পাঁচটি ছোট ছোট রাজ্য অধিকার করেন। পাঁচজনই নিজেদের অধিকৃত ভূমি রক্ষা করতে সমর্থ (সংস্কৃতে অলং) ছিলেন বলে তাঁদের সম্পূর্ণ রাজ্যখণ্ডটির নাম পঞ্চাল (পঞ্চ+অলম)–অলং সংরক্ষণে তেষাং পঞ্চালা ইতিবিতাঃ।

ভবিষ্যতে পঞ্চ-পাণ্ডবের শ্বশুর এবং দ্রৌপদীর পিতা এই পঞ্চালের একতম সৃঞ্জয়ের বংশে জন্ম গ্রহণ করবেন বলেই পঞ্চাল বা পাঞ্চাল রাজ্যের প্রতিষ্ঠা আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। যে পাঁচজন পঞ্চাল রাজার নাম আমরা করলাম, তাদের মধ্যে প্রথম হলেন মুদগল। তার ছেলেরা সবাই ব্রাহ্মণ হয়ে যান। এবং তারা মৌদগল্য বা মৌদগল্যায়ন ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হন। অর্থাৎ কাম্বায়ন ব্রাহ্মণদের মতো এঁরাও ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রোপেতা দ্বিজাতয়ঃ। এই মুগলের বংশেই পরে কুরু-পাণ্ডবদের প্রথম অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য জন্মাবেন।

পাঞ্চাল-রাজ্যের প্রধান বংশটি চলতে থাকে সৃঞ্জয়ের ধারায়। মহাভারতে পাঞ্চালদের অন্তত একশবার সৃঞ্জয়ের বা সোমক নামে ডাকা হয়েছে। তার কারণ সৃঞ্জয়ের পুত্র ছিলেন চ্যবন পঞ্চজন অথবা চ্যবন পিজবন এবং তাঁর তিন পুরুষ পরেই সোমক। সৃঞ্জয় এবং সোমক পাঞ্চালদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা বলেই পরবর্তীকালে দ্রুপদ রাজার দেশবাসীকে কখনও পাঞ্চাল, কখনও সৃঞ্জয় আবার কখনও সোমক বলে ডাকা হয়েছে। ঠিক যেমন যুধিষ্ঠিরকে ভারত, পৌরব অথবা অজমী বলে ডাকা হয়েছে।

ভৌগোলিক দিক থেকে পঞ্চাল রাজ্যটার অবস্থিতি ছিল হস্তিনাপুরের দক্ষিণ-পূর্বে। এখনকার দিনে উত্তরপ্রদেশের বেরিলি, বুদাউন, ফুরুখাবাদের সঙ্গে যদি রোহিলখণ্ডের বেশ। খানিকটা জুড়ে দেওয়া যায় তবেই আমরা সেকালের পঞ্চাল দেশটি পেয়ে যাব। এর পুবদিকে গোমতী নদী বয়ে চলেছে কুলুকুলু করে, পশ্চিমে মথুরা-শূরসেনের দেশ। পাঞ্চালের দক্ষিণে অভিশপ্ত চম্বল–দক্ষিণাংশাপি পাঞ্চালান্ যাবচ্চমতী নদী। আর উত্তরে, অথবা বলা উচিত পঞ্চাল-রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমে বিখ্যাত সেই হস্তিনাপুর। যদিও বিশাল ঘন বনরাজির নিবিড় সন্নিবেশ পঞ্চাল রাজ্যটাকে যেন হস্তিনাপুর থেকে একটু আলাদা করে রেখেছে, তবে স্বীকার করতেই হবে ভরতবংশ অথবা অজমীঢ় বংশের হস্তিনাপুরী ধারা থেকে বেরিয়ে আসার ফলে এঁদের একটু স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং অহমিকাও ছিল।

বেদ এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলি ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যেদিন থেকে সৃঞ্জয় বৃহদিষুরা পঞ্চদেশ অধিকার করে পাঞ্চাল নামে পরিচিত হলেন, সেদিন থেকেই হস্তিনাপুরের রাজাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভাল ছিল না। শতপথ ব্রাহ্মণে দেখা যাচ্ছে–সৃঞ্জয়দের অধস্তন। স্থপতি বলে এক রাজাকে সৃঞ্জয়রাই সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন। পাঞ্চাল দেশের এই গোষ্ঠীদ্বন্দের খবর যায় কৌরব রাজা প্রাতিপীয় বাহ্লীকের কানে–তদুহ বাহিকঃ প্রাতিপীয়ঃ শুশ্রাব কৌরব্যো রাজা। তিনি এই পাঞ্চালের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন এবং সৃঞ্জয়দের বিরুদ্ধে অপরুদ্ধ’ বা সিংহাসনচ্যুত রাজা স্থপতির জন্য কিছু করারও চেষ্টা করেন। কিন্তু এ সব তো অনেক পরের কথা। সৃঞ্জয় যখন পাঞ্চালে এসে রাজা হন; তখন কুরু, কৌরব–এঁরা কোথায়?

সৃঞ্জয় উত্তর পঞ্চালের অধিপতি হলেন। আর তার রাজধানীর নাম হল অহিচ্ছত্র। অহি’ মানে সর্প। এখানেও কি নাগজনজাতির বসতি ছিল? যাই হোক উত্তর পঞ্চাল জায়গাটা গঙ্গার উত্তর দিকে। ঠিক সৃঞ্জয়ের সময় থেকেই হস্তিনাপুরের রাজাদের সঙ্গে পাঞ্চালদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল কিনা, সেটা সঠিক বলা না গেলেও তার ছেলে চ্যবন-পিজবনের সময় থেকেই এই দুই আর্যগোষ্ঠীর সম্পর্ক খারাপের দিকে যেতে থাকে। লক্ষণীয় ব্যাপার হল-ভগবান বলে চিহ্নিত কৃষ্ণ যে যদুবংশে জন্মেছিলেন সেই যদুবংশের যে মহান পুরুষেরা পাঞ্চাল সৃঞ্জয়ের সমসাময়িক ছিলেন তারা হলেন ভজিন, ভজমান, অন্ধক, দেবাবৃধ এবং বৃষ্ণি।

 এই পাঁচ পুরুষের পিতা ছিলেন মহারাজ সাত–যিনি রাজত্ব করতেন মথুরা অঞ্চলে। সাদ্ভূত নিজে যেমন বিখ্যাত ছিলেন, ঠিক তেমনই ছিলেন তার পাঁচ পুত্র। পরবর্তীকালে কৃষ্ণকে সাত্ত্বত, বৃষ্টি অথবা অন্ধক বংশের ধুরন্ধর পুরুষ বলেই লোকে ডাকবে। যাই হোক, সাত্ত্বতের দ্বিতীয় পুত্র ভজমানের সঙ্গে পাঞ্চালরাজ সৃঞ্জয়ের দুই মেয়ের বিয়ে হয়। সৃঞ্জয়ের দুই মেয়ের নাম বাহ্যকা এবং উপবাহকা–ভজমানস্য সৃঞ্জয়ৌ বাহ্যকাথোপবাহাকা। আমাদের ধারণা-সৃঞ্জয় এই বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন নিজের স্বার্থেই। এই বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে পিতৃপুরুষের গড়া নতুন রাজ্য পঞ্চাদেশকে তিনি অন্তত খানিকটা সুরক্ষিত রেখেছেন। যাদব-সাত্ত্বত-বৃষ্ণিদের সঙ্গে জোট বাঁধায় হস্তিনাপুরের ভরতবংশীয় রাজারা পঞ্চালদেশকে কোনওভাবে আঘাত করেননি বা করতে পারেননি।

সৃঞ্জয়ের পুত্র চ্যবন-পিজবন এবং তাঁর পুত্র সুদাস–দুজনেই কিন্তু রাজ্য বিস্তারে মন দেন। ঋগবেদে বলা হয়েছে–স্বয়ং ইন্দ্র সুদাস পৈজবনের জন্য নতুন জনপদ তৈরি করেন–কর্তা সুদাসে অহ বা উ লোক। পণ্ডিতেরা সন্দেহ করেন, পৈজবন সুদাস এতটাই শক্তিমান ছিলেন যে তিনি নিজের রাজ্য উত্তর পঞ্চাল অতিক্রম করে দক্ষিণ পঞ্চালও জিতে নিয়েছিলেন। ঋগবেদের খবর অনুযায়ী পৈজবন সুদাস অন্তত দুটি জনপদের একুশ জন লোককে হত্যা করেছিলেন। তার মধ্যে একটি জনপদ যদি দক্ষিণ পঞ্চাল হয় তবে আর একটি কোন জনপদ?

ঠিক এই জায়গা থেকেই আমাদের আবারও হস্তিনাপুরে ফিরে যেতে হবে। হস্তিনাপুরের রাজা হস্তীর পুত্র অজমীঢ়ের দুই পত্নী কেশিনী এবং নীলিনীর কথা বলতে বলতে আমরা পঞ্চালে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু অজমীঢ়ের তৃতীয়া পত্নী ধুমিনীর কথা আমরা বলিনি। হস্তিনাপুরের ভরতবংশ এই ধৃমিনীর বংশধারাতেই চলছিল–তস্মিন বংশঃ প্রতিষ্ঠিত। অজমীঢ়ের তৃতীয় পত্নী ধূমিনীর গর্ভজাত পুত্র হলেন ঋক্ষ। ঋক্ষর গায়ের রঙ ছিল ধোয়ার মতো। হস্তিনাপুরের রাজা হিসেবে ঋক্ষর তত সুখ্যাতি কিছু নেই। কিন্তু তার পুত্র সম্বরণ নানা কারণেই বিখ্যাত ছিলেন-ঋক্ষাৎ সংবরণো জজ্ঞে রাজ বংশকরঃ সুতঃ।

ঋক্ষপুত্র সংবরণ যখন হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসলেন, তখন তিনি ভরত এবং অজমীঢ়ের রাজ্যশাসনের গৌরবেই সম্পূর্ণ আপ্লুত ছিলেন। একবারও তিনি ভাবেননি যে, সার্বভৌম রাজা ভরতের পরম্পরাপ্রাপ্ত পৈতৃক রাজ্যের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ তৈরি হয়েছে পাশেই। পাঞ্চাল রাজ্যে পৈজবন সুদাসের ক্ষমতা তিনি একটুও পরিমাপ করতে পারেননি। মহাভারতের কবি আমাদের সংবাদ দিয়েছেন—ঋক্ষপুত্র সংবরণ যখন রাজা হলেন হস্তিনাপুরে, তখন বিরাট এক ধ্বংস নেমে এসেছিল হস্তিনাপুরে–সংক্ষয়ঃ সুমহানাসীৎ প্রজানা ইতি নঃ তম্। রাজ্যের সৈন্য-সামন্ত, রাজকোষ, মন্ত্রী-অমাত্য–সব কিছুর মধ্যেই এমন এক বিপর্যয় দেখা দিল যে, সংবরণ কোনওভাবেই রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেন না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও কিছু ছিল–দেশে অনাবৃষ্টির ফলে শস্য ছিল না। তার ফল যা হয়, ব্যাধি-মৃত্যু লেগেই রইল হস্তিনাপুরের রাজমণ্ডলে। সংবরণের এই বেহাল অন্তঃরাষ্ট্রীয় অবস্থার সুযোগ নিল শত্রুসেনারা। তারা দলে দলে এসে ভরতবংশীয়দের আক্রমণ করল–অভ্যন্ ভারতংশ্চৈব সপত্নানাং বলানি চ।

এই শত্রুদের মধ্যে প্রথম যে দেশের নাম করতে হবে, সেটি হল পঞ্চাল রাজ। ঋগবেদে ভরতবংশীয়দের সঙ্গে সুদাসের সংঘর্ষের উল্লেখ থাকায় পণ্ডিতেরা মনে করেন–তখন পাঞ্চালের রাজা ছিলেন ওই সুদাস পৈজবন। তিনি তার চতুরঙ্গিনী সেনাবাহিনী নিয়ে হস্তিনাপুর আক্রমণ করলেন–অভ্যয়াৎ তঞ্চ পাঞ্চালো বিজিত্য তরসা মহীম্। পাঞ্চালদের ভয়ংকর আক্রমণের মুখে সংবরণ হস্তিনাপুর রক্ষা করতে পারলেন না। দশ অক্ষৌহিনী সেনার তোড়ে সংবরণ ভেসে গেলেন পৈতৃক রাজধানী থেকে। স্ত্রী-পুত্র সঙ্গে নিয়ে তাকে পালিয়ে যেতে হল। তাঁর সঙ্গে রইলেন বিশ্বস্ত পুরাতন কিছু বন্ধু-বান্ধব আর রইলেন পুরাতন মন্ত্রীমশাইরা।

 শক্তপোক্ত একটা রাজ্যের উত্তরাধিকার বহন করে সংবরণ কী করে তার পৈতৃক রাজ্য খোয়ালেন, তার পিছনে আমাদের নিজস্ব একটা অনুমান আছে। আমাদের মহাকবি মহারাজ সংবরণের প্রেমের তপস্যায় মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন–

পত্নীবর মাগি
করেনি সম্বরণ তপতীর আশে
প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে
অনাহারে কঠোর সাধনা কত?

নিঃসন্দেহে এই কবি-কল্পনার মধ্যে কিছু ‘অ্যানাক্রনিজ’ আছে। কারণ এখানে সংবরণের কথা যিনি সবিস্ময়ে স্মরণ করাতে চাইছেন তিনি দেবযানী। বৃহস্পতিপুত্ৰ কচকে যদি সংবরণের কথা স্মরণ করিয়ে ধিক্কার দিতে হয় তবে ক্রান্তদশী কবিকে দেবযানীর পাঁচ-সাত পুরুষ পরের ভবিষ্যতে দৃষ্টি দিতে হয়। কবি-ঋষির ভুল ধরার জন্য আমার কোনও আকুলতা নেই। আকুলতা যতটুকু আছে, তা হল সংবরণের প্রেমের তপস্যা নিয়ে। মহাকবি তার প্রেমের ব্যাপ্তিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন বলেই, দেবযানীর মুখে তার অতি-কনিষ্ঠ প্রপৌত্রের উদাহরণটি সাজিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেননি।

আমরা আমাদের গদ্যজাতীয় বক্তব্য পেশ করার সময় এই কাব্যপংক্তি স্মরণ করলাম এই কারণে যে, আমাদের অনুমান–হয়তো এ কথা শুনে মহাকবি আরও খুশি হতেন–আমাদের অনুমান-প্রোমের মুগ্ধতার কারণেই হয়তো হস্তিনাপুরের সম্রাট সম্বরণ তার রাজ্য হারিয়ে বসেছিলেন। কেমন করে?–তা একটু বলতেই হয়। সম্বরণের বেশ কয়েক পুরুষ পরে। পাণ্ডবরা যখন জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে পাঞ্চালের পথে রওনা হয়েছেন, তখন গন্ধর্ব চিত্ররথের সঙ্গে তাদের দেখা হল। প্রধানত অর্জুনের সঙ্গেই তার কথাবার্তা হয়েছিল এবং বারবার তিনি অর্জুনকে ‘তাপত্য’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ‘তাপত্য’ মানে তপতীর বংশজ। অর্জুন স্বভাবতই এই সম্বোধনে আকৃষ্ট হলেন এবং এই মিষ্টি সম্বোধনের কারণ জানতে চাইলেন। অর্জুন বললেন–সবাই আমাদের কৌন্তেয় বলে ডাকে, তাই তো বেশ ভাল। এই তপতী আবার কে, যার নামে ‘তাপত্য’ হলাম আমরা–তপতী নাম কা চৈ তাপতা যকৃতে বয়ম? গন্ধর্ব চিত্ররথ তথন তপতীর কাহিনী বললেন অর্জুনকে এবং আমাদের ধারণা এই কাহিনীর মধ্যেই মহারাজ সম্বরণের রাজ্য হারানোর সংকেত লুকিয়ে আছে।

রাজ্য লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই যে সম্বরণের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, তেমন কোনও সমাচার আমরা পাইনি। বরং প্রথম দিকে তিনি বেশ ভাল রাজ্যশাসন করেছিলেন। সামন্ত রাজারা তার বশংবদ ছিলেন। বন্ধু সজ্জনের প্রতি তার ব্যবহার ছিল চাঁদের জ্যোৎস্নার মতো কোমল-কমনীয়, আর দুষ্ট জনের প্রতি সংবরণ ছিলেন সূর্যের মতো প্রতাপী–স সোম অতি-কাত্বা আদিত্যমিক্ তেজসা। মর্ত্যভূমির রাজার এই অসামান্য ক্ষমতা দেখেই নাকি ভগবান সূর্যদেব তার মেয়েকে সংবরণের সঙ্গে বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করেন।

সূর্যদেবের মেয়ের নাম তপতী। অপূর্ব তার রূপ, মোহন তার স্বভাব। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুচারু বর্ণনা করতে গেলে দেবতা, মানুষ, যক্ষ-রাক্ষস-কারও মধ্যে তার কোনও উপমান খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি প্রত্যঙ্গসুন্দরী–সুবিভক্তানবদ্যালী স্বসিতায়তলোচনা–এবং তার পিতা সূর্যদেব সারা দুনিয়ায় তার উপযুক্ত কোনও পাত্র খুঁজে পাননি। তিনি তাই মনে মনে সম্বরণকেই জামাতা হিসেবে ঠিক করে রেখেছিলেন, যদিও মুখে তাঁকে কিছু বলেননি।

 তপতীর পিতা এই সূর্যদেব সূর্যবংশীয় কোনও নৃপতি কিনা, সে সম্বন্ধে আমাদের লৌকিক বিশ্বাস প্রবল। মহাভারতের কবি অবশ্য সূর্যপুত্রী তপতীর সঙ্গে ভবিষ্যতে সম্বরণের মিলন ঘটাবেন বলে সম্বরণকে পূর্বাহ্নেই সূর্যের উপাসক বলে চিহ্নিত করেছেন। বৈদিক যুগের অব্যবহিত পরের যুগে কোনও ক্ষত্রিয় রাজা সূর্যের উপাসক ছিলেন–এটা কোন আশ্চর্য কথা নয়। যাই হোক, সম্বরণ প্রতিদিনই পুষ্প-গন্ধ-মাল্যের উপচারে সূর্যপূজা করতেন সূর্যমারাধয়ামাস নৃপঃ সম্বরণস্তদা। কিন্তু এই সূর্যপূজার সঙ্গে সূর্যকন্যা তপতীর কোনও সংস্রব আপাতত ছিল না। সূর্যদেব নিজের মেয়ের সৌম্যসুন্দর রূপ দেখে উপযুক্ত পাত্রের চিন্তায় ভাবিত ছিলেন–নোপলেভে ততঃ শান্তিং সম্প্রদানং বিচিন্তয়–এবং সংবরণের কথা তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, এই পর্যন্ত–তপত্যা সদৃশং মেনে সূর্যঃ সম্বরণং তদা–কিন্তু এদিকে অন্যরকম একটি ঘটনা ঘটল।

হস্তিনাপুরের সুযোগ্য শাসক সম্বরণ রাজা রাজ্যশাসনের ক্লান্তি কাটাতে মৃগয়ায় বেরলেন। মৃগয়া করতে করতে সম্বরণ পার্বত্য দেশের গভীর বনাঞ্চলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। এদিকে পাহাড়ী পথের ধকল সহ্য করতে না পেরে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত তার অশ্বটি হঠাৎই মারা গেল। সম্বরণ আর কী করেন? পায়ে হেঁটেই তিনি পার্বত্য প্রদেশের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন–পত্তামেব গিরৌ নৃপঃ–আর ঠিক এই সময়েই পাহাড়ের কোল আলো করা একটি রমণীকে দেখতে পেলেন সম্বরণ–যাঁর তুলনা তিনি নিজেই–দদশাসদৃশীং লোকে কন্যামায়ত লোচনা।

পাহাড়ের কোলে নির্জন বনভূমির মধ্যে একাকিনী সেই রমণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সরণের মনে হল যেন আকাশ থেকে সূর্যের প্রভা খানিকটা খসে পড়েছে ভূঁয়ে রবেষ্টামিব প্রভা। সম্বরণের মনে হল—সূর্যের মতো দীপ্তিময় ব্যক্তিত্বের মধ্যে যদি চাঁদের কমনীয়তা মিশিয়ে দেওয়া যায়, তবেই যেন এ রূপের তুলনা হয়। সম্বরণ মুগ্ধ হলেন। নিষ্পলক দৃষ্টিতে রমণীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় দেখলেন–সোনার বরণ রমণীর রূপে বৃক্ষলতা-পাহাড়ও যেন কখন সোনা হয়ে গেছে। এই রূপের তুলনায় দুনিয়ায় তাবৎ সুন্দরীকে সম্বরণের মনে হল যেন খেদি-পেঁচি-অবমেনে চ তাং দৃষ্টা সর্বলোকেষু যোষিতঃ। মানুষের চক্ষু থাকার যা ফল, সে ফল সম্পূর্ণ লাভ করে সম্বরণ শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়েই রইলেন। তার যেন কোনও কাজ নেই, রাজধানীতে ফেরবার কোনও তাড়া নেই, অশ্বটিও মারা গেছে–যেন ভাল হয়েছে। তিনি শুধু দাঁড়িয়েই রইলেন–ন চচাল ততো দেশা বুবুধে ন চ কিঞ্চন।

 অনেকক্ষণ চক্ষু সার্থক করে রাজা এবার রমণীকে জিজ্ঞাসা করলেন-তুমি কার মেয়ে, সুন্দরী? তুমি কারও স্ত্রী নও তো? কী জন্যই বা এই নির্জন অরণ্য দেশে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছ–কথঞ্চ নির্জনে’রণ্যে চরস্যেকা শুচিস্মিতে? সম্বরণ থাকতে পারলেন না। রমণীয় রূপ দেখে নিজের ভাবটুকুও তিনি আর গোপন করতে পারলেন না। সম্বরণ বললেন-তোমার মতো সুন্দরী আমি কোনওদিন দেখিনি। তোমার অঙ্গের এই মনোহর অলংকারগুলি আমার কাছে বাল্য মনে হচ্ছে, বস্তুত তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই এই আভূষণের যথার্থ অলংকার। তোমার এই মধুর মুখখানি দেখে আমার মন আকুল হয়ে উঠেছে ভালবাসায়–মাং মথুতীব মন্মথঃ।

সম্বরণ অনেক কথা বলে গেলেন প্রলাপের মতো। কিন্তু রমণী একটি কথারও উত্তর দিলেন না। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো হঠাৎই তিনি অদৃশ্য হলেন। সম্বরণ তার দেখা না পেয়ে চার দিকে খুঁজতে লাগলেন–তামম্বেং স নৃপতিঃ পরিচক্রাম সর্বতঃ। কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। পাগলের মতো খুঁজতে খুঁজতে একসময় সম্বরণের চেতনা লুপ্ত হল। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। যিনি এতকাল ভরতবংশের সমস্ত শত্ৰু নিপাত করে ভূতলে শায়িত করেছেন, তিনি এক রমণীর মোহে নিজেই লুটিয়ে পড়লেন ভূমিতে–পাতনঃ শসংঘানাং পপাত ধরনীতলে। রাজা যখন চেতনা-লুপ্ত হয়ে পড়ে আছেন, ঠিক তখনই সেই রমণী আবারও উপস্থিত হলেন রাজার সামনে–পুনঃ পীনায়তশ্রোণী দয়ামাস তং নৃপম। রমণী বললেন—আপনি ভূতলশয়ন ছেড়ে উঠুন রাজা। বিধাতা আপনাকে রাজা করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, আপনার কি এত অল্প কারণে মূৰ্ছিত হওয়া চলে–মোহং নৃপতিশার্দুল..ন মর্হস্যরিন্দম? পরিষ্কার বোঝা যায়, রমণী এতক্ষণ লুকোচুরি খেলছিলেন রাজার সঙ্গে।

সম্বরণ দেখলেন–সেই রূপ, সেই মনোহর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চার। এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনি বিবাহের প্রস্তাব করলেন রমণীর কাছে। বললেন তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না–ন হ্যহং ত্বতে ভীরু শ্যামি খলু জীবিতু। সম্বরণ এইটুকু কথা বলেই থামেননি। যত রকম স্তুতি-প্রশংসায় রমণীর মন জয় করা যায়, সেসব তো তিনি করলেনই, উপরন্তু শতরকম ভাবে রমণীর হৃদয়ে শত করুশার উদ্রেক করে তিনি শুধু বললেন–আমার প্রাণ বাঁচাতে হলে তোমাকে যে আমার কাছে আত্মদান করতেই হবে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না–প্রাণা হি প্রজহন্তি মা। সম্বরণ শেষ প্রস্তাব করলেন–এই মুহূর্তেই আমরা গান্ধর্ব বিবাহের নিয়মে মিলিত হতে পারি। তুমি রাজি তো?

 রমণীর কোমল হৃদয় আর কত সইতে পারে। এতক্ষণ রাজার অন্তরালে থেকে তার হৃদয়ের সমস্ত উচ্ছ্বাস আর আকুতি লক্ষ্য করেছেন তিনি। রাজার কথা শুনে এবারে তিনি আর নিরুত্তরে দাঁড়িয়ে থাকলেন না। একটু ঘনিষ্ঠভাভাবেই বললেন–বিবাহ? মহারাজ! আমি শুধু আমার ইচ্ছাতে এই কাজ করতে পারি না। আমার পিতা আছেন। আমাকে যদি সত্যিই তুমি ভালবেসে থাক, তবে আমার পিতার কাছে তুমি আমাকে যাচনা করে নাও-ময়ি চেদস্তি তে প্রীতির্যাচস্ব পিতরং মম। আমি স্বীকার করি–আমি যদি প্রথম দর্শনেই তোমার ভালবাসার পাত্র হয়ে থাকি, তবে তুমিও প্রথম ভালবাসবার মতো এক পুরুষ-রত্ন। তবু কী জান, এই শরীরটা আমার পিতার দেওয়া। এই শরীরের আমার অধিকার নেই কোনও। একবারটি তুমি আমার পিতাকে বল। তবে শুধু আমার কথা জানতে চাইলে বলি–পৃথিবীতে এমন কোন্ রমণী আছে যে তোমার মতো বিখ্যাত বংশের অভিজাত রাজাকে মনেপ্রাণে স্বামী হিসেবে না চাইবে, বিশেষত যে রাজা আমাকেই চান-কন্যা নাভিলষেন্নাথং ভর্তারং ভক্তবৎসল। তুমি তোমার তপস্যায়, প্রণিপাতে আমার পিতাকে তুষ্ট করা। তিনি অনুমতি দিলেই আমি তোমার হব–ভবিষ্যামথ তে রাজন্ সততং বশবর্তিনী। সম্বরণের সঙ্গে কথা শেষ করে রমণী নিজের পরিচয় দিলেন–আমি সূর্যের কন্যা। মনে রেখ রাজা–আমার নাম তপতী।

পরিচয়ের শেষে রমণী আবারও অন্তর্হিত হলেন এবং সম্বরণ তাকে না দেখে আবারও চেতনালুপ্ত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। এদিকে সম্বরণের অনুযাত্রী বৃদ্ধ মন্ত্রী সৈন্য-সামন্ত সঙ্গে নিয়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে আসছিলেন। সেই মহাবনের মধ্যে এসে অশ্বহীন লুপ্তচেতন রাজাকে দেখে বৃদ্ধ মন্ত্রীর বুক কেঁপে উঠল। তিনি ভাবলেন–নিশ্চয় ঘোড়া খুইয়ে শ্রান্ত পিপাসার্ত রাজা বনের পথে হাঁটতে হাঁটতে সংজ্ঞালুপ্ত হয়ে পড়ে গেছেন মাটিতে ক্ষুৎপিপাসাপরিশ্রান্তং তর্কয়ামাস বৈ নৃপম্। বৃদ্ধ মন্ত্রী পিতার মতো স্নেহে সম্বরণকে মাটি থেকে উঠালেন, পদ্মগন্ধী শীতল জল এনে ছিটিয়ে দিলেন তার মাথায়। রাজার সংজ্ঞা ফিরে এল অচিরেই। কিন্তু সংজ্ঞা ফিরে আসতেই রাজার মনে পড়ল তপতীর কথা। তপতী বলেছিলেন–তুমি তপস্যায় প্রণিপাতে সন্তুষ্ট কর আমার পিতাকে–আদিত্যং প্রণিপাতেন… যাচস্ব পিতরং মম–তবেই আমি তোমার হব।

বৃদ্ধ মন্ত্রীকে নিজের কাছে রেখে সৈন্য-সামন্ত সবাইকে রাজধানীতে ফিরে যেতে বললেন সম্বরণ। তারা চলে যেতেই রাজাও সূর্যের উপাসনার জন্য সেই পাহাড়ের সানুদেশে সূর্যের সন্তুষ্টির উদ্দেশে তপস্যা আরম্ভ করলেন; আর মনে মনে স্মরণ করতে লাগলেন ঋষি বশিষ্ঠকে, তার এই বিষণ্ণতায় তিনিই একমাত্র সাহায্য করতে পারেন তাকে–জগাম মনসা চৈব বশিষ্ঠ ঋষিসত্তমম্। বশিষ্ঠ সম্বরণ রাজার পুরোহিত। পুরো বার দিন উধ্বমুখে সূর্যের তপস্যায় সম্বরণের দিন কাটল। বশিষ্ঠ সম্বরণের অবস্থা জেনে উপস্থিত হলেন সেই পর্বতের সানুদেশে। সম্বরণ তপতাঁকে লাভ করার জন্য এই তপস্যা করছেন জেনে বশিষ্ঠ নিজেই গিয়ে দেখা করলেন সূর্যদেবের সঙ্গে। তিনি বললেন-মহারাজ সম্বরণ আমাদের রাজা। তিনি যশস্বী ধর্মজ্ঞ এবং উদারচেতা। আমি তার বিবাহের জন্য আপনার মেয়ে তপতাঁকে নিয়ে যেতে চাই। সুর্যদেব মনে মনে আগেই সম্বরণকে তপতীর উপযুক্ত স্বামী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। অতএব বশিষ্ঠের প্রস্তাবমাত্রই তিনি বললেন-সম্বরণ রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর মুণিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আপনি এবং রমনীকুলে মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আমার এই কন্যা তপতী। অতএব এই বিবাহের প্রস্তাবে আমার আপত্তি কোথায়–তপতী যোষিতাং শ্রেষ্ঠা কিমন্যদপসর্জনা।

সূর্যদেব সানন্দে নিজের কন্যা তপতাঁকে বশিষ্ঠের হাতে তুলে দিলেন। মহর্ষি তপতাঁকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন সেই পর্বতের সানুদেশে, যেখানে সম্বরণ তপস্যা করছিলেন তপতাঁকে পাবার জন্য। বশিষ্ঠের সঙ্গে তপতাঁকে আসতে দেখে রাজার মনে হল যেন–বিদ্যুতের ঝলক নেমে এল চারিদিক উদ্ভাসিত করে। ঋষি বশিষ্ঠের সাহায্যে সম্বরণ শেষ পর্যন্ত তপতাঁকে স্ত্রী হিসেবে পেলেন। রাজার সাধের সাধনা যেন আজ মূর্তি ধরে, নেমে এল। তাঁর আকুল বক্ষে, বাহুর ডোরে।

.

৪৯.

 মহর্ষি বশিষ্ঠের করুণায় মহারাজ সম্বরণ তপতাঁকে লাভ করলেন বটে, কিন্তু নবলব্ধ দাম্পত্য প্রেমে মোহিত হয়ে সম্বরণ কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজধানীতে আর ফিরে গেলেন না। তপতাঁকে সম্বরণ লাভ করেছিলেন সবুজ পার্বত্যভূমির ঘন বনাঞ্চলে। পর্বতের সানুপ্রদেশের শোভা এবং সঙ্গে হিরন্ময়ী প্রতিমা তপতী। মহারাজ রাজধানীতে তখনই ফিরে যেতে চাইলেন না। পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনির কাছে সম্বরণ অনুমতি চাইলেন সেই পার্বত্য ভূমিতেই আরও কিছুদিন থেকে যাবার জন্য। বশিষ্ঠের অনুমতি পেয়েই রাজা বৃদ্ধ মন্ত্রীকে আদেশ দিলেন হস্তিনাপুরের রাজ্যপাট সামলানোর জন্য–আদিদেশ মহীপালস্তমেব সচিবং তদা।

 বশিষ্ঠ রাজাকে পার্বত্যপ্রদেশের মধ্যে মধুচন্দ্রিমা যাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন, তিনি আর কি জানতেন–তপতীর সঙ্গলাভে মহারাজ সম্বরণের কোনও জ্ঞান থাকবে না। বৃদ্ধ মন্ত্রীকে রাজা রাজ্যপাট সামলানোর আদেশ দিয়েছিলেন, তিনি ধারণাও করতে পারেননি–রাজা সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ভোগে লিপ্ত থাকবেন। মহাভারতের কবি বলেছেন–বশিষ্ঠ চলে গেলে মহারাজ সম্বরণ দেবতার মতো বিহার করতে থাকলেন–বিজহারামরো যথা। এক দিন নয়, এক মাস নয়, এক বছরও নয়, সম্পূর্ণ বারো বছর ধরে দেবতার মতো উপভোগ বিহার-কাননে, বনে, পার্বত্যভূমিতে–ততো দ্বাদশ বর্ষাণি কাননেযু বনেষু চ–রাজার রাজ্যপাট চুলোয় গেল।

কবি লিখেছেন–রাজার শাসন নেই, সম্বরণের রাজ্যে ইন্দ্রদেব বৃষ্টি দিলেন না। বারো বচ্ছরের অনাবৃষ্টিতে খাঁ-খা করতে লাগল কর্ষণভূমি। একটি হিমবিন্দুও পতিত হল না, শস্য হল না একটুও। ক্ষুধার অন্ন জুটল না প্রজাদের। রোগ-শোক মহামারীতে হস্তিনাপুরীর শাসন-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল। মানুষ স্ত্রী-পুত্র পরিত্যাগ করে বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে লাগল। পুরু-দুষ্যন্ত-ভরতের রাজপুরী প্রেতপুরীতে পরিণত হল–অভবৎ প্রেতরাজস্য পুরং প্ৰেতৈরিবাবৃত।

মহাভারত-রামায়ণ এবং পুরাণগুলি পড়লেই দেখতে পাবেন–অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, মহামারী এবং রোগ-শোকের বর্ণনা তখনই শোনা যায় যখন কোনও রাজার শাসন-ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দেশের রাজা যদি রাজধর্মে প্রতিষ্ঠিত না থাকেন, যদি তাঁর ব্যক্তিগত ভোগ-সুখ আর বিলাস-ব্যসনে প্রজাদের দুঃখ উপস্থিত হয়, পুরাণ-ইতিহাসে তখনই উপরিউক্ত নিয়মে কনভেনশনালি’ একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বর্ণনা করা হয়। সোজা কথা হলহস্তিনাপুরের রাজা সম্বরণ বার বছর রাজ্যে উপস্থিত নেই। তিনি ভোগ-বিলাসে, স্ত্রীবিলাসে কাল কাটাচ্ছেন রাজ্যের বাইরে–রেমে তস্মিন্ গিরৌ রাজা তয়ৈব সব ভার্যয়। আমাদের ধারণা–হস্তিনাপুরে সম্বরণ রাজার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তার পার্শ্বরাষ্ট্রের শত্রুরা প্রবল হয়ে উঠেছিলেন এবং সেই পার্শ্বরাষ্ট্র হল পাঞ্চাল। হয়তো পাঞ্চালের রাজা তখন সুদাস।

মহাভারতের বর্ণনায় দেখতে পাচ্ছি–পাঞ্চালের রাজা শতশত সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। রাজা সম্বরণ হয়তো শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে পাঞ্চালদের সঙ্গে যুদ্ধ লড়তে এসেছিলেন। কিন্তু পাঞ্চালরা তাকে এমনভাবেই যুদ্ধে জয় করেন যে, সম্বরণকে স্ত্রী-পুত্র, অমাত্য-পরিজন নিয়ে পালিয়ে যেতে হয় দূরে–রাজ্য সম্বরণস্তসমাৎ পলায়ত মহাভয়াৎ। পণ্ডিতেরা মনে করেন–পাঞ্চালরাজ সুদাসই মহারাজ সম্বরণকে পরাজিত করেন এবং এই যুদ্ধ হয়েছিল যমুনা নদীর তীরে-Sudas drove the Paurava King Samvarana of Hastinapura out, defeating him on The Jamuna.

পরাজিত সম্বরণ তার রাজ্যের খুব কাছাকাছি থাকতে পারলেন না। তাঁকে পালিয়ে যেতে হল সিন্ধুনদের অববাহিকা অঞ্চলে– সিন্ধোর্নদস্য বিষয়ে নিকুঞ্জে ন্যবসত্তা। সঙ্গে বিশ্বস্ত মন্ত্রী-পরিজন আর স্ত্রী তপতী। কখনও পর্বতের কন্দরে, কখনও সিন্ধুনদের তটবর্তী জঙ্গলে, কখনও বা সিন্ধুনদের তীর ধরে আরও এগিয়ে গিয়ে সম্বরণ পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন– নদীবিষয়পর্যন্ত পর্বতস্য সমীপতঃ। মহাভারতের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার ধারণা করা যায় যে, পাঞ্চালরা সম্বরণকে হারিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, সম্বরণকে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। যার জন্য সিন্ধুনদের তীরবর্তী অঞ্চলে যেখানেই সম্বরণকে থাকতে হয়েছে, তাকে যথেষ্ট সুরক্ষা নিয়েই থাকতে হয়েছে। মহাভারত বলেছে–নদ-নদী, জঙ্গল কিংবা পর্বতে অথবা যেখানেই সম্বরণ বাস করেছেন, সেখানেই তাকে থাকতে হয়েছে দুর্গের সুরক্ষা নিয়ে এবং থাকতেও হয়েছে বহু বছর-তত্রাবস বহু কালান্ ভারতা দুর্গমাশ্রিতাঃ। দুর্গ বলতে এখানে ‘ফোর্ট’ বোঝাচ্ছে না, দুর্গ মানে এখানে–অন্যের পক্ষে দুর্গম জায়গা।

যাই হোক, অনেক কাল বাইরে বাইরে কাটানোর পর মহর্ষি বশিষ্ঠের সঙ্গে আবার তার দেখা হল। মহারাজ সম্বরণ তাকে পুরোহিত নিযুক্ত করলেন। বশিষ্ঠের এই পৌরোহিত্য অবশ্য চাল-কলার পৌরোহিত্য নয়, রাজার যাগ-যজ্ঞ সম্পাদনও নয়, এই পৌরোহিত্যের অর্থ রাজার প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টার ভূমিকা। কারণ, সম্বরণ তাকে পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে বলেছিলেন আপনি আমার পৌরোহিত্য স্বীকার করুন এবং আমরা একসঙ্গে হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করি–পুরোহিতো ভবান্নোত্ত রাজ্যায় প্রযতেমহি। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে চাণক্যের যে সম্পর্ক–আমরা ধারণা করি বশিষ্ঠের সঙ্গেও সম্বরণের সেই সম্পর্ক স্থাপিত হল।

বশিষ্ঠের সুপরামর্শ ছাড়াও সম্বরণ হয়তো তার রাজ্যে অন্য পার্শ্ববর্তী রাজাদেরও সাহায্য পান। মথুরার যাদবরা, গান্ধারদেশবাসী দ্রুহ্যুবংশীয়রা, উশীনর শিবিরা (যাঁরা অনু-বংশীয় আনব নামে পরিচিত ছিলেন) এবং রেওয়া-সাতনা অঞ্চলের তুসুবংশীয়দের মিলিত সাহায্যেই হয়তো মহারাজ সম্বরণ সার্বভৌম ভরতের রাজধানী পুনরুদ্ধার করছিলেন। কারণ বশিষ্ঠ যখন সম্বরণের রাজ্যোদ্ধার করার জন্য স্বীকার বাক্য উচ্চারণ করলেন, তখন সেখানে শুধু সম্বরণই ছিলেন না, ছিলেন ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়া যদু-অনু–তবুসুরা–যাঁরা সকলে ‘ভারতাঃ’ নামে পরিচিত–তে সর্বে ভারতস্তা। ভারতা প্রত্যপদ্যত। লক্ষণীয়, রাজ্যে প্রতিষ্ঠার সময় সম্বরণকে তার বহু পূর্ব পরিচয়ে সম্বরণ পৌরব বলে ডাকা হচ্ছে অথাভ্যষিঞ্চৎ সাম্রাজ্যে সর্বক্ষত্রস্য পৌরবম্। আরও, একটা কথা, আমরা পূর্ব ভারতের রাজধানীর ঠিকানা দিতে পারিনি, কিন্তু সম্বরণকে যেহেতু ভরতের অনুপমা রাজধানীটিই পুনদখল করে নিতে দেখছি, তখনই বুঝতে পারি যে, হস্তিনাপুর অঞ্চলটাই ভরতেরও রাজধানী ছিল–ভরতাধষিতং পূর্বং–যার নামকরণ শুধু সম্বরণের পিতা হস্তীর কৃতিত্ব।

রাজ্য দখল করার সঙ্গে সঙ্গেই সম্বরণ বিভিন্ন জায়গায় বেশ কতগুলি যাগযজ্ঞ সম্পন্ন করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন। সামন্ত রাজারাও আবার সম্বরণের প্রভুত্ব মেনে তাকে কর দিতে আরম্ভ করলেন-পুনর্বলিভৃতশ্চৈব চক্রে সর্বমহীক্ষিতঃ। তবে একটা কথা এখানে মনে রাখতে হবে যে, সম্বরণ নিজের কৃতিত্বে অথবা সম্মিলিত রাজাদের কৃতিত্বেই যে নিজের রাজ্য দখল করতে পেরেছিলেন তা বোধহয় নয়। কারণ পাঞ্চালরাজ সুদাস নিজের রাজত্বের শেষদিকে রাজার কর্তব্য ভুলে, রাজনীতির শিক্ষা ভুলে প্রজাপীড়নে মত্ত হয়েছিলেন। মনু মহারাজ তার সংহিতাগ্রন্থে বেশ কয়েকজন নামী রাজার নাম করেছেন যারা নিজেদের ইন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি এবং দুর্বিনীত স্বভাবের ফলে নিজেদের রাজ্য পর্যন্ত খুইয়েছেন। মনু মহারাজের সেই নামের লিস্টিতে পৈজবন সুদাসেরও নাম আছে–সুদা জৈবনশ্চৈব সুমুখো নিমিরেব চ।

 আমরা ধারণা করি–কোনও ইন্দ্রিয় পরতন্ত্রতার ফলেই সুদাসের রাজ্যভ্রংশ ঘটেছিল, এবং সেই সুযোগে সম্বরণ আবার রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন। পণ্ডিতেরা বলেন–সুদাস নয়, হয়তো তার ছেলে সহদেব অথবা নাতি পাঞ্চাল সোমকের সময় মহারাজ সম্বরণ তার হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। কারণ এরা সবাই ছিলেন দুর্বল রাজা। হতেও পারে। পুরাণগুলিতে দেখছি–সুদাসের পাঞ্চাল বংশ দুর্বল হয়ে যাওয়ার সময়েই সোমকের রাজত্ব চলছিল–কীণে বংশে তু সোমক। পাঞ্চালরা মহারাজ সম্বরণের সাধের হস্তিনাপুরী তচনচ করে দিয়ে যেভাবে তার ওপর অত্যাচার চালিয়েছিলেন, এতদিন পরে অজমী বংশের প্রধান সম্বরণ তার শোধ তুললেন। আর শোধ তোলার অর্থ কিন্তু নিজের রাজ্যটুকু উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হওয়া নয়; সেকালের সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে পাঞ্চালদের নিজ রাজ্যে পর্যদস্ত না করে সম্বরণের পক্ষে এই জয় লাভ করা সম্ভব হয়নি। ফলে সুদাসের উত্তর পাঞ্চাল তখনকার মতো হস্তিনাপুরের অধিকারেই চলে এল।

আরও একটা সম্ভাবনার কথা বলি–মহাভারতের তথ্য অনুযায়ী হস্তিনাপুর হারানোর পর সম্বরণকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল স্ত্রী এবং পুত্রকেও নিয়ে–ততঃ সদারঃ সামাত্যঃ সপুত্রঃ সসুহৃজ্জনঃ। অনুমান করি, সম্বরণের এই পুত্রের জন্ম হয়েছিল বার বছরের সেই বিলাস-বিহারের কালেই, যখন তিনি হস্তিনাপুরীতে অনুপস্থিত ছিলেন। সম্বরণের এই পুত্রের কথা আমাদের সাড়ম্বরে জানাতে হবে, কারণ ইনি সেই সেই ভারতবিখ্যাত মহারাজ কুরু, যার নামে ততোধিক বিখ্যাত কৌরব বংশ। পণ্ডিতদের অনুমান–পাঞ্চালরাজ সুদাস যখন হস্তিনাপুর আক্রমণ করেন, তখন তিনি বয়সে প্রবীণ এবং সম্বরণ তখন যুবক বয়সের রমণীর আমোদে প্রমত্ত। সম্বরণকে বহুকাল স্ত্রী-পুত্র নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে এবং হয়তো পাঞ্চালরাজ সুদাস পৈজবনের মৃত্যুর পর তার পুত্র-পৌত্রদের কাছ থেকে তিনি নিজ রাজ্যের সঙ্গে পাঞ্চালও অধিকার করেন। কিন্তু এই রাজ্যোদ্ধারের কৃতিত্ব বোধহয় তার একার নয়, এর মধ্যে তাঁর বীরপুত্র কুরুরাজের অবদান ছিল।

পাঞ্চালরাজ ‘সাহ দেব্য’ সোমক, যিনি সুদাসের নাতি ছিলেন তিনি একসময় যমুনার তীরে একটি যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। পাণ্ডবরা যখন বনপর্বে তীর্থযাত্রা করেছেন, তখন যমুনা নদীর একান্তস্থিত একটি পুণ্যস্থান দেখিয়ে লোমশ মুনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন-এই সেই যমুনা নদী, যেখানে যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন সূর্যবংশীয় মান্ধাতা, যেখানে যজ্ঞ করেছিলেন সহদেবের পুত্র পাঞ্চালরাজ সোমক–সাহসেবি কৌন্তেয় সোমকো দদতাং বরঃ। সন্দেহ নেই, সোমক এই যজ্ঞ করার সুযোগ পেয়েছিলেন সম্বরণ এবং তাঁর পুত্র কুরু পাঞ্চালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে। আমাদের ধারণা–সম্বরণ যে পুনরায় পাঞ্চালদের আক্রমণ করে পৈতৃক রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন, তা প্রধানত তার পুত্র কুরুর ভবসায়। তপতীর ঔরসজাত এই পুত্রটি যেমন বীর ছিলেন তেমনই উদ্যমী। হয়তো এই বীরপুত্রের উদ্যম লক্ষ্য করেই সম্বরণও নিজের প্রৌঢ় বয়সে পৈতৃক রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে উদ্যমী হন।

রাজ্যলাভের পর সম্বরণ কিছু কিছু যাগ-যজ্ঞ সম্পাদন করার সঙ্গে সঙ্গেই তার রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে প্রবল প্রতাপান্বিত কুরুর সম্বন্ধে অনুকূল আলোচনার পরিমণ্ডল তৈরি হতে থাকে। তারা বৃদ্ধ সম্বরণের পরিবর্তে কুরুকেই সিংহাসনের অধিকারী দেখতে চান। সম্বরণ প্রজাদের এই উৎসাহ দমিত করেননি। প্রজাদের ইচ্ছাতেই শেষ পর্যন্ত কুরু হস্তিনাপুরের রাজা হলেন–রাজত্বে তং প্রজাঃ সর্বা ধর্মজ্ঞ ইতি বব্রিরে। প্রসিদ্ধ ভরতবংশের গৌরব রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে মহারাজ কুরু প্রথমেই রাজত্ব বিস্তারে মন দিলেন। তিনি তার নিজের নামে একটি বসতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার নাম হয় কুরুজাঙ্গল’–তস্য নাম্নভিবিখ্যাতং পৃথিব্যাং কুরুজাঙ্গল।

 ‘জাঙ্গল’ শব্দটা শুনলে পরে মনে হয় যেন জায়গায় খুব জঙ্গল আছে। এমনকি হেমচন্দ্রের মতো প্রৌঢ়গৌড় ঐতিহাসিক লিখেছেন-Kurujangala, as its name implies, was probably the wild region of the Kuru realm that stretched from the Kamyaka forest on the banks of the Sarasvati to Khandava near (samipatah) the Jumna. তবে আমাদের ধারণা–কুরুজাঙ্গল-প্রদেশে জঙ্গল নিশ্চয় ছিল, এবং wild region বলতেও আমাদের তেমন কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু জাঙ্গল’ শব্দটা যেহেতু একটা পারিভাষিক অর্থ আছে, তাই কুরুজাঙ্গলকে আমরা সেই অর্থেই ধরতে চাই। জাঙ্গল’ শব্দের। অর্থ যে জায়গায় জল বেশি দাঁড়ায় না, আবার ভীষণ সবুজ কোনও তৃণভূমিও সেটা নয়, যেখানে প্রচুর হাওয়া এবং রোদও প্রচুর–স্বল্পোদকতৃণো যস্তু প্ৰবাতঃ প্রচুরাতপঃ। স জ্ঞেয়য়া জাঙ্গলো দেশঃ…।

এই পারিভাষিক অর্থ থেকে বুঝতে পারি, মহারাজ কুরু নিজের নামে অতিসুন্দর একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে প্রচুর হাওয়া এবং রোদ থাকায় একটি বিশাল বসতির পক্ষেও সে জায়গা খুব উপযুক্ত ছিল। মহাভারতে কুরুজাঙ্গল দেশটার সঙ্গে কুরুক্ষেত্র দেশটাও কুরুরই নামাঙ্কিত হয়ে আছে এবং কুরুক্ষেত্র বোধহয় কুরুজাঙ্গল থেকে আলাদা। কেন না, মহাভারতে বলা হচ্ছে–মহারাজ কুরু অনেক তপস্যা করে বিশাল একটা জায়গাকে কুরুক্ষেত্র বলে পরিচিতি দেন-কুরুক্ষেত্রং স তপসা পুণ্যং চক্রে মহাতপাঃ। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে কুরুক্ষেত্রের সীমানাগুলির উল্লেখ পাওয়া যায় এবং তা এইরকম–কুরুক্ষেত্রের দক্ষিণে খাণ্ডব বন, উত্তরদিকে তুর্ক্সবন আর পশ্চিমে পরীণ নদী (সিন্ধুনদের শাখা নদী)।

মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের বর্ণনা এত কাঠ-কাঠ নয়। সেখানে এক মুনি বলল–কুরুক্ষেত্রে যে বাস করতে পায়, সে মনে করে আমি স্বর্গে আছি–যে বসন্তি কুরুক্ষেত্রে তে বসন্তি ত্রিবিষ্ঠপে। জায়গাটা কোথায়? সরস্বতী নদীর দক্ষিণে আর দৃষদ্বতী নদীর উত্তরে–এই হল কুরুক্ষেত্র। কুরুক্ষেত্রের আরেক নাম সমন্তপঞ্চক। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, কুরুক্ষেত্রের পুরো জায়গাটা জুড়ে আছে এখনকার থানেশ্বর, দিল্লি এবং গঙ্গার ঊর্ধ্বসীমার দোয়াব অঞ্চল। কুরুক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যে ক্ষুদ্র নদীগুলি, সেগুলোর নাম হল অরুণা (পেহেয়ার কাছে সরস্বতী নদীর সঙ্গে মিলেছে) অংশুমতী, হিরতী, কৌশিকী (রক্ষীর শাখা নদী) ইত্যাদি।

মহারাজ কুরু নিজের নামে দুটি দেশ সৃষ্টি করেও কিন্তু পৈতৃক রাজধানী ছেড়ে যাননি। তিনি হস্তিনাপুরেই থাকতেন। লক্ষণীয় ঘটনা হল, মহারাজ ভরতের আমলে হস্তিনাপুরের। রাজা হিসেবে তিনি যে সার্বভৌমত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন, সে স্বাদ সম্বরণপুত্র কুরুরও অপ্রাপ্য রইল না। ওদিকে সরস্বতী দৃদ্বতীর মধ্যস্থান থেকে এদিকে প্রায় প্রয়াগ পর্যন্ত এক বিশাল দেশের অধিপতি হয়ে মহারাজ কুরু শুধু তার পূর্ববংশীয়দের মর্যাদাই রক্ষা করেননি, তার সময় থেকে তার রাজত্বাধীন সমগ্র দেশটার নাম হয়ে গেল কুরুরাষ্ট্র, এবং তার বংশের সবার নাম হয়ে গেল কৌরব এবং এই নাম আমরা মহাভারতের শেষ পর্ব পর্যন্ত শুনব।

মহারাজ কুরু অনেক গৌরবের কাজ করলেন, অনেক কিছুই খুব ভাল হল বটে, কিন্তু পিতার সঙ্গে একাধারে পাঞ্চাল আক্রমণ করার সূত্র ধরে সেই যে একটা শত্রুতা তৈরি হল সে শত্রুতা কোনওদিন মেটেনি। কুরুরাজ খুব সম্ভবত উত্তর পাঞ্চাল অধিকার করে নিয়েছিলেন বলেই মনে হয় এবং সেই থেকে কৌরবদের সঙ্গে পাঞ্চালদের শক্রতা এতটাই গভীরে চলে যায় যে–মহাভারতের মধ্যে এ কথা সদা-সর্বদা এই মর্মে উচ্চারিত হতে থাকে। কুরু আর পাঞ্চালদের কথা উঠলেই লোকে স্মরণ করে বলত-ওরে বাবা! ওদের তো আবার বিরাট ঝগড়া-বিবদমান দুই জাতি-গোষ্ঠীর নামই তো কৌরব আর পাঞ্চালরা-কুরূণাং সৃজয়ানাঞ্চ জিগীষুণাং পরম্পর।

আগেই বলেছিলাম–পিতার সঙ্গে কুরুরাজ যখন পাঞ্চালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন সৃঞ্জয়, সুদাস–এই সব বিখ্যাত পাঞ্চাল রাজার কীর্তি লুপ্ত হয়ে গেছে এবং সুদাসের নাতি সাহদেবি সোমক পাঞ্চালদের রাজা হয়ে কোনওমতে হয়তো রাজ্যের একাংশমাত্র টিকিয়ে রেখেছিলেন। সম্বরণের মতো তাকে পুরো রাজ্য হারিয়ে পালিয়ে যেতে হয়নি, এই যা। সোমক যে খুব বড় রাজা ছিলেন তা নয়, তবে পাঞ্চালদের জন্য তার ভাবনা ছিল যথেষ্ট। পাঞ্চালদের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তিনি পাঞ্চালদের জোয়াল কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বলেই সোমকের কথা প্রসঙ্গত বলতে গেলেই পৌরাণিকরা বলেন–পাঞ্চাল বংশের ক্ষীণ বা দুর্বল অবস্থায় সোমকের জন্ম–ক্ষীণে বংশে তু সোমকঃ।

নিজের জীবিত অবস্থায় নিজবংশের হীনবীর্য অবস্থা দেখে পাঞ্চাল সোমকের দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। সেকালের দিনে যা হত–বংশের প্রায় বিলুপ্তি অথবা ক্ষীণ অবস্থায় সংসারের পিতৃপুরুষেরা ভাবতেন–বাড়িতে যদি অনেক পুত্র জন্মায়, তবে কেউ না কেউ পুনরায় নিজের প্রযত্নে পূর্ব রাজমর্যাদা সমুদ্ধার করে বংশেরও পূর্বগৌরব ফিরিয়ে আনবে। পাঞ্চাল-মহারাজ সোমকও বোধহয় সেই ভাবনাতেই ছিলেন। লুপ্ত-গৌরব ফিরিয়ে আনার উপায় অবশ্য তার ঘরের মধ্যেই ছিল। প্রথম কথা হল–এক রাজ্যের রাজা হলেও সোমকের রাণী ছিল একশটি–তস্য ভার্যাশতং রাজন্ সদৃশীনামভূদা। পৌরাণিকের অতিবাদে তার স্ত্রীর সংখ্যা একশ নাই হোক, অন্তত বহু তো বটেই এবং তারা সকলে ছিলেন সৃঞ্জয়-পাঞ্চাল বংশের উপযুক্ত বধু।

সোমকের একশ রানী থাকা সত্ত্বেও তার কোনও পুত্র ছিল না। দেখতে দেখতে রাজার বয়সও হয়ে গেল অনেক, তবু ঘরে তার বংশধর কোনও পুত্র নেই। শেষ পর্যন্ত অনেক সাধ্য-সাধনা করে, অনেক ব্ৰত-হোম করে রাজার ঘরে-কদাচিৎ তস্য বৃদ্ধস্য ঘটমানস্য যতুতঃ-রানীদের কোল আলোকরা একটি পুত্রের জন্ম হল। তার নাম রাখা হল জন্তু। এই নাম অবশ্য আগেই দেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয় না, তার কারণ পরে জানাচ্ছি।

এতদিন পর রাজার ঘরে পুত্র জন্মাল বটে, কিন্তু সে আরেক জ্বালা হল। একশ রানীর কোলে এক ছেলে। ব্যক্তিগত বাৎসল্যের নিম্নগামিনী ধারা, যা সব সময় স্বকীয় সন্তানের মধ্যেই বিশ্রান্তি লাভ করে, তার কোনও পুষ্টি হল না ব্যক্তিগতভাবে। একটি মাত্র ছেলে পেয়ে একশ রানীর প্রত্যেকেই তাকে নিয়ে থাকতে চান। ছেলে যদি এক জায়গায় বসে থাকে তো একশ রানী তাকে ঘিরে বসে থাকেন–তং জাতং মাতরঃ সর্বাঃ পরিবাৰ্য সমাসতে। একশ রানীর সব আদর একজনের ওপর গিয়ে পড়ার ফলে, সেই শিশুর খাওয়া-দাওয়া, আহ্লাদ আর খেলার সরঞ্জাম নিয়ে একশ রানীই তার পিছনে ঘোড়াফেরা করেন সব সময়-সততং পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা কামড়োগা বিশাম্পতে।

 একটি শিশুকে যদি একশ রানীর উষ্ণ ক্রোড়ের মধ্যে রেখে সততই তাকে খাওয়ানো আর খেলানোর চেষ্টা করা হয়, তবে তারও জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আসলে একটি শিশুর ভাল লাগা-না-লাগা নিয়ে একশ রানীর কোনও মাথাব্যথা নেই, তাদের চিন্তা শুধু নিজেদের ভাললাগা নিয়েই। সাধে কি আর উপনিষদে বলেছেন বা অরে পুত্রস্য কামায় পুত্রঃ প্রিয়য়া ভবতি, আত্মনস্তু কামায় পুত্রঃ প্রিয়ো ভবতি। একপুত্রকে ঘিরে শতরানীর আশা-আকাঙ্ক্ষা যখন আবর্তিত হচ্ছে, তখনই এক উটকো বিপদ ঘটল। শিশুপুত্র একদিন মাটিতে বসে আছে হঠাৎই একটি পিঁপড়ে কামড়ে দিল তাকে। পিঁপড়ের কামড় খেয়েই আদুরে ছেলে তো চিৎকার করে কেঁদে উঠল, এবং সেটা বিচিত্র নয় কিছু। কচি চামড়ায় পিঁপড়ের কামড় তো শিশুর কাছে অসহ্যই বটে। কিন্তু তার চেয়েও অসহ্য হয়ে দাঁড়াল শিশুর কান্না ছাপিয়ে একশ রানীর চিৎকার–ততস্তা মাতরঃ সর্বাঃ প্রাক্ৰোশন্ ভূশদুঃখিতা। তারা শিশুপুত্রকে ঘিরে এমন ভাবে কাঁদতে থাকলেন যেন শিশুটির এমন-সেমন কিছু হয়ে গেছে।

একশ মায়ের আর্তনাদ এমন উচ্চগ্রামে পৌঁছল যে, সে শব্দ রাজবাড়ির অন্দরমহল অতিক্রম করে রাজসভায় রাজাসনে উপবিষ্ট, অমাত্য পরিষদ-পরিবৃত রাজা সোমকের কানে গিয়ে পৌঁছল–তমার্তনাদং সহসা শুশ্রাব স মহীপতিঃ। তিনি তাড়াতাড়ি সভা ভঙ্গ করে দিয়ে অন্দরমহলে এসে উপস্থিত হলেন–কী হল, কী হল–এই কথা বলতে বলতেকিমেতদিতি পার্থিবঃ। অন্দরমহলের রুক্ষশুষ্ক দৌবারিক রাজাকে জানাল–মহারাজ! আপনার প্রিয় পুত্রকে পিঁপড়ে কামড়েছে, তাই রানীমায়েরা সব আর্তনাদ করছেন। রাজা অন্দরমহলে প্রবেশ করে শিশুপুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করলেন। শান্ত, ছেলেকে রানীদের কোলে দিয়ে রাজা তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন সভাগৃহে।

রাজসভায় তখন মন্ত্রী-অমাত্যেরা উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন, বসে আছেন পাঞ্চালদের প্রধান পুরোহিত যিনি অন্যতম মন্ত্রীও বটে। ছেলেকে একটি পিঁপড়ে কামড়েছে বলে এই আর্তনাদ-খবরটা এরকম করে সভার মধ্যে বলতে তার সংকোচই লাগল। ক্ষত্রিয়ের ঘরের ছেলে, তাকে কত সুখদুঃখের মধ্য দিয়ে চলতে হয়। তাকে কিনা একটি পিঁপড়ে কামড়েছে বলে তার ক্ষত্রিয়াণী রানীরা সব মরণ-চিৎকার করছেন। প্রখর বাস্তববোধে প্রবীণ রাজা অমাত্য-পুরোহিত মহতী সভা আহ্বান করে বললেন–ধিকার দিচ্ছি মশাই! আমাকেই শত ধিক। এর থেকে আমার পুত্র না হওয়াও ভাল ছিল–ধিগস্ত একপুত্রত্ব অপুত্রত্বং বরং ভবেৎ–আমার এই এক ছেলে হওয়ার থেকে ছেলে না হওয়াও ভাল ছিল। পুত্র-লাভের জন্য দেখে দেখে কত পরীক্ষা করে আমি একটা বিয়ে করে এনেছি। অথচ তাদের কোলে একটিও ছেলে পেলাম না আমি। যদি বা ভাগ্যবলে একটি ছেলে হল আমার, তত একশ রানী সবাই মিলে এমন আদর-যত্ন করছে তাকে যে, আমারই পাগল হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে যতমনাসু সর্বাসু কিছু দুঃখমতঃ পর।

রাজা এবার দুঃখিত হয়ে অমাত্য-পুরোহিতকে উদ্দেশ করে বললেন–এদিকে আমার তো বয়স পেরিয়ে গেছে আর ওই একটি মাত্র ছেলে-সে যেন একশ রানীর প্রাণ। আপনারা এমন একটা ব্যবস্থা করুন যাতে এই এক পুত্রের দুঃখ ঘুচিয়ে আমি একশ ছেলে পেতে পারি। ক্ষীণ পাঞ্চাল বংশের উত্তরাধিকারী সোমক একটি পিঁপড়ের কামড় থেকে উপলব্ধি করলেন– পিঁপড়ের কামড়েই এই। যদি এমন-তেমন কিছু হয়, তবে তো পাঞ্চালরাজ্যের কোনও উত্তরাধিকারীই থাকবে না। পূর্বের গৌরব উদ্ধার করা তো দূরের কথা। একটি মাত্র পুত্র হলে এক ছেলের আদর বাবা-মাকে কোন সুখস্বর্গে নিয়ে যায়–তা এই আধুনিক জগতে আমরা প্রতিপলেই উপলব্ধি করছি। পাঞ্চালরাজ সোমক একপুত্রের আদরে ধৈর্য হারিয়ে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের কথার মাত্রা এক করে দিয়ে অমাত্য-পুরোহিতকে বলেছেন–এক ছেলে কোন পুণ্য নয়, সে শুধু শোকেরই কারণ–শোক এবৈকপুত্ৰতা–one child is sin.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *