১০৫. ভীম-দুর্যোধনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা

১০৫.

ভীম-দুর্যোধনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমন তুঙ্গ মাত্রায় পৌঁছেছিল যে অশ্বত্থামা এই দুই মহাবীরকে বিযুক্ত করার পরেও বাজনদারেরা তাদের বাজনায় বিরাম দেয়নি। এবার গুরু দ্রোণাচার্য নিজে তাঁর দর্শন–মঞ্চ ত্যাগ করে নেমে এলেন রঙ্গভূমিতে এবং প্রথমেই তিনি হস্ত উত্তোলন করে বাদ্যকরকে থামতে বললেন। দর্শকাসনের জনপদবাসীরা স্তব্ধ হয়েছে, স্তব্ধ হয়েছে বাদ্যধ্বনি, দ্রোণাচার্য জলদগম্ভীর স্বরে তার শিষ্যদের প্রতিযোগিতা প্রদর্শনীর শেষ আকর্ষণ ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন–আমার পুত্রের চেয়েও যে আমার প্রিয় এবং সমস্ত অস্ত্র চালনার কৌশল যে নিপুণভাবে শিক্ষা করেছে–যো মে পুত্ৰাৎ প্রিয়তরঃ সর্বশস্ত্রবিশারদঃ–সেই অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষার কৌশল দেখুন আপনারা। ইনি স্বয়ং ইন্দ্রপুত্র, বিষ্ণুর মতো তার পরাক্রম।

 দ্রোণাচার্যের কথা শুনে অর্জুন বুঝলেন–এবার তার সময় হয়েছে। তিনি প্রস্তুতি নিলেন অস্ত্রের প্রদর্শনীর জন্য। শরনিক্ষেপের পর ধনুগুণের উলটো আঘাত যাতে হাতে না লাগে তার জন্য হাতে একটি চর্মময় আবরণ পরলেন অর্জুন। একে বলে গোধা। হাতের আঙুলে পরলেন অঙ্গুলিস্রাণ। পৃষ্ঠে বাণপূর্ণ তৃণ, দেহে সোনার বর্ম। সব মিলিয়ে অর্জুনের নিকষ-কালো গায়ের রঙের মধ্যে ঝকঝকে তৃণের জ্যোতি আর সোনার বর্ম এমন ঝলসাতে লাগল যেন মনে হল সন্ধ্যাকালের ঘন মেঘে বিদ্যুৎ খেলছে–সার্কঃ সোয়ুধতড়িৎ সসন্ধ্য ইব তোয়দঃ।

 দর্শকদের আসন থেকে কেউ মন্তব্য করল–আরে এটা সেই কুন্তীর ছেলে। মধ্যম পাণ্ডব বলে পরিচিত বটে, কিন্তু আসলে ইন্দ্রের পুত্র। অন্য জন বলল–অস্ত্র–শস্ত্রের কথাই বল আর ধর্মতত্ত্বের কথাই বল–সব জানে এই ছেলেটা। অন্যের স্বভাব যেমন বোঝে, তেমনই এর নিজের স্বভাবটাও খুব ভাল। দর্শকাসনের নানান প্রশংসাসূচক মন্তব্য ভেসে আসতে লাগল দক্ষিণ দিকের সুউচ্চ মঞ্চে বসা জননী কুন্তীর কানে। পুত্রের গর্বে এবং স্নেহে তার বুকের দুধ উৎলে উঠল যেন–কুন্ত্যাঃ প্রশ্নব-সংযুক্তৈরঃ ক্লিন্নমুরোভবৎ–আনন্দে তার চোখে জল এসে গেল।

 সুসজ্জিত অর্জুন রঙ্গ-প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত মানুষের উৎসাহ-ধ্বনি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কানে এসে পৌঁছল। তিনি সহর্ষে বিদুরকে জিজ্ঞাসা করলেন–এ কিসের শব্দ বিদুর! বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের গর্জনের মতো এই শব্দ কিসের? বিদুর বললেন–পাণ্ডব অর্জুন অস্ত্রসজ্জিত হয়ে রঙ্গস্থলে প্রবেশ করেছেন। তারই এই শব্দ। ধৃতরাষ্ট্র বললেন–কুন্তীর গর্ভ থেকে যে তিন পাণ্ডব জন্মেছে, তাদের জন্য আমার গর্ব হয়। আমার বিশ্বাস এই কুরুবংশকে তারা রক্ষা করবে।

রঙ্গমঞ্চের সমস্ত মানুষ একই সঙ্গে আনন্দিতও হল, স্তব্ধও হল। সকলে এখন অর্জুনের যুদ্ধ-কৌশল দেখতে চায়। অর্জুন দ্রোণাচার্যের দিকে তাকিয়ে তার অস্ত্রশিক্ষার কৌশল দেখাতে আরম্ভ করলেন। অর্জুন আগ্নেয় অস্ত্র দ্বারা আগুন সৃষ্টি করলেন, বরুণাস্ত্রে সৃষ্টি করলেন জল। রঙ্গমঞ্চে প্রবল হাওয়া উঠল। বোঝা গেল–এ হল অর্জুনের বায়ব্য অস্ত্রের কৌশল। রঙ্গমঞ্চে বৃষ্টি হল অর্জুনের পর্জন্য-অস্ত্রের সুনিপুণ প্রয়োগে। বস্তুত অর্জুনের এই অস্ত্র-কৌশল বর্ণনা করার সময় মহাভারতের কবি উপমার অঙ্গুলি–সংকেতে গৌণ বস্তুকে মুখ্য করে দেখানোর চেষ্টা করেননি। এ বর্ণনা এতই সরল, এতই সেটা সাদামাটা যে মনে হবে–মহাভারতের কবির পক্ষে সে একেবারেই অনুপযুক্ত। আসলে কবি জানেনএই অস্ত্রকৌশল বর্ণনা করার ভাষা হয় না। অতএব কতগুলি অলৌকিক মাত্রা যোগ করে ব্যাস লিখলেন–এই তিনি পর্বতাস্ত্রে পর্বত সৃষ্টি করলেন, এই ভৌম অস্ত্রে পাতাল প্রবেশ করলেন আবার কখনও বা অন্তর্ধান-অস্ত্রে অন্তর্হিত হলেন। এই সাধারণ বর্ণনার মধ্যে লৌকিক অতি বৈচিত্র্যের ঘটনা এইটুকুই যে, অর্জুন একটি লোহার তৈরি ঘুরন্ত শূকরছানার মুখে পরপর পাঁচটি বাণ গেঁথে দিলেন–ভ্রমতশ্চ বরাহস্য লৌহস্য প্রমুখে সম–অথবা দড়িতে বাঁধা একটি ঝুলন্ত গোরুর শিঙের মধ্যে গব্যে বিষাণকোষে চ চলে, রজ্জ্বাবলম্বিনি–একসঙ্গে একুশটা বাণ প্রবেশ করিয়ে দিলেন।

অর্জুন তার অসি যুদ্ধের কৌশলও দেখালেন, দেখালেন গদাযুদ্ধের কৌশলও। অর্থাৎ ধনুর্বেদে বিশেষজ্ঞ হলেও অন্যান্য অস্ত্রবিদ্যাও তাঁর করায়ত্ত বটে। অর্জুন তার অস্ত্রের নিপুণতায় সমস্ত রঙ্গমঞ্চ একেবারে মুখর করে দিয়েছেন। সকলের উৎসাহ-ধ্বনি আর বাদ্যধ্বনি মিশে সে এক আকুল অবস্থা। ধনুর্বেদের বিচিত্র কৌশল দেখে রঙ্গমঞ্চের আসনে বসা সমস্ত মানুষ যখন একেবারে অভিভূত হয়ে রয়েছেন, অর্জুনের প্রদর্শনীও যখন শেষ হয়ে আসছে, শব্দ-চিৎকারও যখন কিছু মন্দীভূত–মন্দীভূতে সমাজে চ বাদিত্ৰস্য নিঃস্বনে–ঠিক তখনই রঙ্গমঞ্চের দ্বারদেশে একটি একক হাততালি শোনা গেল। সে শব্দ বড় প্রখর, বড় কঠিন; সেই হাততালির মধ্যে কর্তা পুরুষের অহংকার আছে, আর আছে পরপক্ষের প্রতি অবজ্ঞা–দ্বারদ্বেশাৎ সমুদ্ভূত মাহাত্মবলসূচকঃ।

 হাততালির আওয়াজে এতটাই জোর ছিল যে রঙ্গমঞ্চে সকলের দৃষ্টি অর্জুনের দিক থেকে সরে গিয়ে সেই দ্বারদেশে পতিত হল। কেউ বলল–আরে পাথর ফাটাচ্ছে নাকি? কেউ বলল–ভূমিকম্প হচ্ছে যেন। রঙ্গমঞ্চের দর্শকাসন থেকে নানা বিস্ময়সূচক মন্তব্য ভেসে এল, কিন্তু সকলের চোখ কিন্তু একসঙ্গে সেই দ্বারপ্রান্তে দ্বারঞ্চাভিমুখো সর্বে বভূবুঃ প্রেক্ষকাস্তদা। অর্জুনের অস্ত্র-প্রদর্শনীর শেষ মুহূর্তে দ্রোণাচার্য তার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিলেন। দ্বারপ্রান্তে আগন্তুকের বাহু–স্ফোটন–শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ ভাই পাণ্ডব দ্রোণাচার্যকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদেরও সকলের চোখ দ্বারপ্রান্তে।

অর্জুনের অস্ত্র-প্রদর্শনীর কৌশলে রঙ্গমঞ্চের সমস্ত সাধারণ জনেরা যতই আমোদ লাভ করুন, ব্যাপারটা কুরু-ভাইদের জ্যেষ্ঠ দুর্যোধনের কাছে মোটেই সুখের ছিল না। মুহূর্তে মুহূর্তে তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল পরপক্ষের এই অসাধারণ উন্নতি। ঠিক এই রকম একটা সময়ে অর্জুনের প্রতি তাচ্ছিল্যসূচক হাততালি শুনে দুর্যোধন দর্শকাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ালেন তার একশো ভাই এবং গুরুপুত্র অশ্বত্থামা। দুর্যোধন সবাইকে নিয়ে সেই রঙ্গমঞ্চের দ্বারপ্রান্তে এসে মহাবীর আগন্তুককে স্বাগত জানালেন। দুর্যোধন তার পুরাতন বন্ধুকে চিনতে পেরেছেন। ছোটবেলায় অস্ত্রশিক্ষার সময় থেকেই দুর্যোধন এই আগন্তুককে পছন্দ করেন। পছন্দ করার একটাই হেতু। পাণ্ডব অর্জুনকে হেনস্থা করার ব্যাপারে তিনি দুর্যোধনের সঙ্গে একাত্মক ব্যবহার করেছেন চিরকাল। একশোভাই মিলে দুর্যোধন যখন আগন্তুককে ঘিরে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন, তখন তাকে দেখতে লাগছিল–দেবতাদের দ্বারা পরিবৃত ইন্দ্র যেন-পুরন্দরো দেবগণৈঃ সমাবৃতঃ।

মহাভারতের কবি প্রথমেই তার পরিচয় না দিলেও আমরা বুঝতে পারছি–ইনি কর্ণ। গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে ব্রহ্মাস্ত্রলাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি আশ্রম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন অন্যত্র। হয়তো শিক্ষার শেষে আজও তিনি তাঁর পূর্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলতে পারেননি। অতএব প্রথম সুযোগেই অর্জুনকে দমিয়ে দেবার জন্য আজ এই রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন কর্ণ। তবে কর্ণের এই উপস্থিতির একটা পূর্ব ইতিহাস আছে। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয় যে, কর্ণ অর্জুনকে হত্যা করার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র যাচনা করেছিলেন এবং প্রত্যাখ্যাতও হয়ে গেছেন।

আসলে কর্ণ এটাও বুঝে গিয়েছিলেন যে, যেখানে তিনিও আছেন এবং অর্জুনও আছেন, সেখানে অর্জুনকে অতিক্রম করে তার পক্ষে গুরু দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে কিছু বাগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তার এই মানসিক প্রস্তুতি ছিল বলেই তিনি দ্রোণাচার্যকে সঙ্গে সঙ্গে সেলাম ঠোকার মতো সামান্য অভিবাদন জানিয়েই–আমন্ত্র প্রতিপূজ্য চ–সোজা চলে গিয়েছিলেন মহেন্দ্র পর্বতে। মহেন্দ্র পর্বতে আছেন পরশুরাম। সেই পরশুরাম যিনি একুশবার ক্ষত্রিয় নিধন করেছেন নির্বিচারে। সেই পরশুরাম, যাঁর কাছে ভীষ্ম অস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন, যাঁর কাছে দ্রোণাচার্য লাভ করেছিলেন দিব্য অস্ত্রশস্ত্র। অবশ্য ভীষ্ম-দ্রোণের গুরু পরশুরাম আর কর্ণের গুরু পরশুরাম এক ব্যক্তি নাও হতে পারেন। কারণ আগেই বলেছি–পরশুরাম মানে একটি ইনস্টিটিউশন। শিষ্য-পরম্পরায় এই ইনস্টিটিউশন চলে আসছে এবং এঁদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ক্ষত্রিয় রাজশক্তির বিরুদ্ধতা। অর্থাৎ কোথাও কুত্রাপি যদি ক্ষত্রিয় রাজশক্তি ব্রাহ্মণ্যের বিরুদ্ধ আচরণ করে, তবে পরশুরামগণ পরম্পরাগতভাবে তাদের শাস্তি দেন।

অতএব এমনই এক পরশুরামের কাছে বিদ্যালাভ করতে এসে আমি ক্ষত্রিয়–এই পরিচয় দেওয়া কর্ণের পক্ষে কঠিন ছিল, ঠিক যতটা কঠিন ছিল কর্ণের পক্ষে বলা–আমি অধিরথ–সূতপুত্র রাধাগর্ভজাত। কারণ এই পরিচয় তৎকালীন সমাজের চাতুর্ণিক তারতম্যের নিরিখে পরশুরামের কাছে তত সম্মানজনক হত না; বিশেষত পরশুরাম ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কাউকে অস্ত্রশিক্ষা দেন না। অতএব মহেন্দ্র পর্বতে গিয়ে পরশুরামের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে কর্ণ বললেন–আমি ভার্গব গোত্রের ব্রাহ্মণ, আপনার কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে চাই–ব্রাহ্মণো ভার্গবোশ্মীতি গৌরবেনাভ্যগচ্ছত। ভরদ্বাজ নয়, কাশ্যপ নয়, একেবারে ভার্গব। পরশুরাম নিজে ভূগুবংশীয় জাতক। তিনি নিজে ভার্গব। অতএব এতদিন পর একটি ভার্গব ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে বিদ্যা শিখতে আসায় পরশুরাম বেশ খুশি–খুশি মনে কর্ণকে রীতিমতো স্বাগত জানালেন–স উক্তঃ স্বাগতঞ্চেতি প্রতিমাংশ্চভব শম্।

কর্ণ যে পরশুরামের কাছে মিথ্যা কথা বলে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন, তার কারণ। একটাই। তিনি সেই মারণাস্ত্র ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করতে চান অর্জুনের সমকক্ষ হবার জন্য। টীকাকার নীলকণ্ঠ কর্ণকে একটু বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন। আর করবেনই বা না কেন! শৈশবে পিতৃ-মাতৃহীন কর্ণের প্রতি আমাদের যেমন মায়া আছে, তেমনই নীলকণ্ঠেরও মায়া আছে। পরবর্তী সময়ে কর্ণের একটি মন্তব্য মনে রেখে নীলকণ্ঠ লিখেছেন–কর্ণ যে নিজেকে ভার্গব বলে নিজের পরিচয় দিলেন, তার কারণ তিনি ভেবেছিলেন–শিষ্য তো পিতার সমান। অতএব ভার্গব পরশুরামকে তিনি যখন গুরু বলে মেনেছেন, সেখানে নিজেকে ভার্গব বলে পরিচয় দিলে ক্ষতি কী–গুরুরেব পিতেতি অভিসন্ধায় আহ-ব্রাহ্মণো ভার্গবোস্মি।

কর্ণের প্রতি মায়ায় আমাদেরও এই যুক্তি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু অর্জুনের প্রতি কর্ণের অসম্ভব হিংসা লক্ষ্য করে আমরা প্রথম থেকেই কর্ণ-চরিত্রের নিরপেক্ষ বিচার করতে চাই। কর্ণ যে ছোটবেলা থেকেই পাণ্ডবদের প্রতি ভয়ঙ্কর রকমের বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠলেন, তার পিছনে নির্দিষ্ট কোনও কারণ থাকতে পারে না, একমাত্র দুর্যোধনের প্ররোচনা ছাড়া। মহাভারতের কবি এই বিদ্বেষের কারণ হিসেবে একটি অসাধারণ মন্তব্য করে বলেছেন–দৈবাচ্চাপি স্বভাবতঃ। অর্থাৎ এক পরম দুর্দৈব তো বটেই, কিন্তু এখানে কর্ণের স্বভাবও কিছুটা দায়ী। দুর্দৈব এইজন্য যে, কর্ণ কুন্তীর জ্যেষ্ঠ পুত্রের মর্যাদা পেতে পারতেন, অথচ তিনি তাঁর পাঁচ ভাইকে ভাই বলে জানেনই না। আর স্বভাবটার জন্য তিনি নিজে যত দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী তার পরম বন্ধু দুর্যোধন।

শৈশব থেকে পিতা-মাতার পরিত্যক্ত এবং অন্যের ঘরে লালিত বলে তিনি স্বভাবতই একটু আবেগপ্রবণ, আর দুর্যোধনের সঙ্গে দ্রোণের শিক্ষাশ্রমেই তার বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ায় এই আবেগ দুর্ব্যবহৃত হয়েছে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে, বিশেষত তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অর্জুনের বিরুদ্ধে। নইলে দেখুন, সেই বাল্যকালে–যখন অর্জুনের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি, কর্ণেরও নয়, তখনই কর্ণের মনে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধের প্রবৃত্তি আসবে কেন–অর্জুনেন সমং চাহং যুদ্ধেয়মিতি মে মতিঃ। শুধুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এই যুদ্ধবাসনা তৈরি হয়েছে, তা নয়। হয়েছে প্রতিহিংসায় এবং এই প্রতিহিংসা জাগিয়ে তুলেছেন স্বয়ং দুর্যোধন। মহাভারতের কবির মন্তব্য-স্বভাব শব্দটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টীকাকার নীলকণ্ঠ একটি শ্লোক তুলে কর্ণের সম্বন্ধে বলেছেন–একজন মানুষ যদি হীন কুলে জন্মগ্রহণ করে, তবে তার মধ্যে অনেক সামাজিক জটিলতা কাজ করতে থাকে এবং এই জটিলতার মধ্যে সে মানুষ আবার যদি অসাধারণ গুণসম্পন্ন বা অসামান্য শক্তিধর হয় এবং তার ওপরেও সে যদি খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে–বীর্যাধিকো নীচকুলো দুঃসঙ্গেন সমেধিতঃ–তবেই সে বড় মানুষদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে থাকে, তাদের তাচ্ছিল্যও করতে থাকে।

নীচকুল কথাটা যদি তৎকালীন চাতুর্বর্ণের নিরিখে খারাপ লাগে শুনতে, তবে আজকের নিরিখে শব্দটাকে অল্পসত্ত্বতা বা হীনসত্ত্বতায় রূপান্তরিত করুন। অর্জুন কর্ণের প্রতিস্পর্ধী হতেই পারেন, কিন্তু দুর্যোধনের সঙ্গে মিলে মিশে দুর্যোধনের পাণ্ডব-বিদ্বেষের ছায়া খুব সহজেই পড়েছিল তার আবেগপ্রবণ মনে আর সেই জন্যই সোজাসুজি অতি-পরিশ্রমে অতি  বিনয়-শিক্ষায় তিনি ব্রহ্মাস্ত্র লাভের কথা ভাবছেন না। ভাবছেন–যেন তেন প্রকারেণ ব্রহ্মাস্ত্র তার চাই। আর সেই জন্যই তার মহেন্দ্রপর্বতে পরশুরামের কাছে আসা এবং মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করাটা কর্ণ চরিত্রের সঙ্গে বেমানান হয়নি।

যাই হোক, মহেন্দ্র-পর্বতে কর্ণের অস্ত্রশিক্ষা আরম্ভ হল। অর্জুনের সঙ্গে তুলনায় যাই হোন, কর্ণ মানুষটিও তো আর কম বড় নন! অতএব সেখানে থাকতে থাকতে অনেক দেবতা, গন্ধর্ব, যক্ষ-রাক্ষসের সঙ্গে কর্ণের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কর্ণ ভৃশ্রেষ্ঠ পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যার পাঠ নিয়মিত নিয়ে যাচ্ছেন, এই সময়েই একটি অঘটন ঘটে গেল। দিন-রাত মুক্ত তরবারি আর ধনুক-বাণ ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এবং যেখানে সেখানে লক্ষ্যভেদ অনুশীলন করার ফলে একদিন নিজেরই অজ্ঞাতে কর্ণ এক গভীর অন্যায় করে ফেললেন।

জায়গাটা ছিল সমুদ্রের তীরঘেঁষা এক অরণ্যভূমি। প্রাকৃতিক পরিবেশ অতি মনোরম। আর ঠিক এইখানেই এক আরণ্যক মুনির আশ্রম। কর্ণ এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ধনুক-বাণ কাঁধে, হাতে খঙ্গস কদাচিৎ সমুদ্রান্তে বিচরন্নাশ্রমান্তিকে। ব্রাহ্মণ অগ্নিহোত্র করতে বসেছেন আশ্রমের বাইরে আর তার হোমধেনুটি কাছেই চরে বেড়াচ্ছিল বৃক্ষচ্ছায়াসমন্বিত বনভূমির এখানে ওখানে। কর্ণ অতশত খেয়াল করেননি। হোমধেনুটির নড়াচড়া দেখেই তিনি একটি বাণ মুক্ত করলেন অজ্ঞাত কোনও পশু মনে করে। ধেনুটি মারা পড়ল এবং কর্ণ প্রমাদ গণলেন অগ্নিহোত্রে নিযুক্ত ব্রাহ্মণের কথা মনে করে। কোনও উপায় না দেখে কর্ণ ব্রাহ্মণের পায়ে পড়ে বললেন–আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি বুঝতেই পারিনি এটি একটি হোমধনু। আমি অজ্ঞানতাবশত এই অন্যায় করে ফেলেছি–অবুদ্ধিপূর্বং ভগবন্ ধেনুরেষা হতা তব! আপনি প্রসন্ন হোন।

সেকালের দিনে এক অযাচিতবৃত্তি ব্রাহ্মণ, যিনি লোকালয় ছেড়ে সমুদ্রের তীরে অরণ্যভূমিতে বাসা বেঁধেছেন, তার কাছে একটি দুগ্ধবতী গাভাই তার জীবন-ধারণের একমাত্র উপায়। অতএব সে ক্ষতি তো আছেই, তার ওপরে আছে গোহত্যার পাপ। দুগ্ধবতী গাভী যেহেতু বৈদিক এবং বৈদিকোত্তর যুগেও জীবন ধারণের উপায় ছিল, অতএব গোহত্যা ভয়ঙ্কর পাপ বলেই গণ্য হত। ব্রাহ্মণ তাই মোটেই প্রসন্ন হলেন না। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণের প্রতি অভিশাপ–বাক্য উচ্চারণ করলেন–তুই যার সঙ্গে প্রতিস্পর্ধা করে দিনরাত এই অস্ত্রাভ্যাস করে যাচ্ছিস, তারই সঙ্গে শেষ যুদ্ধ করার সময় তোর রথের চাকা বসে যাবে মাটিতে–যুধ্যতস্তেন তে পাপ ভূমিশ্চক্রং গ্রসিষ্যতি। সেই মরণ-যুদ্ধে তোর শত্রুই তোকে বধ করবে, নরাধম! তুই এখন যা এখান থেকে। তুই যেমন পাগলের মতো এই হোমধেনুটিকে মেরেছিস, মেদিনী রথচক্র গ্রাস করলে তেমনই পাগল দশা হবে তোর। আর সেই অবস্থাতেই তোর শত্রু তোর শিরচ্ছেদ করবে।

 কর্ণ অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন ব্রাহ্মণের কাছে। অনেক টাকা-পয়সা ধন-রত্ন এমনকি অনেক গোরুও কিনে দিতে চাইলেন–গোভির্ধনৈশ্য রত্নেশ্চ। কিন্তু ব্রাহ্মণের মন গলল না তাতে। তিনি বললেন–তুই এখান থেকে চলেই যাস, আর এখানেই বসে থাক, অথবা যা ইচ্ছে কর, আমার কথা মিথ্যে হবে না–গচ্ছ বা তিষ্ঠ বা যদ্বা কার্যং তে তৎ সমাচর। আর কোনও উপায় নেই দেখে কর্ণ ভীতমনে ফিরে এলেন পরশুরামের আশ্রমে। কিন্তু এই ঘটনা সম্বন্ধে পরশুরামকে তিনি কিচ্ছুটি বললেন না।

আসলে কর্ণের ভাগ্যটাও খুব খারাপ। শুধুমাত্র পুরুষকারে একটি মানুষ বহুদূর যেতে পারে বটে, কিন্তু ভাগ্য সহায় থাকলে তার আরও উন্নতি ঘটে। কিন্তু কর্ণের ভাগ্য সব সময় তার সঙ্গে প্রতারণা করছে। এমনকি গুরু পরশুরামের আশ্রমেও তাঁর শেষ রক্ষা হল না। কর্ণের আপন বাহুবীর্যে, গুরুসেবায় এবং শম-দমের চেষ্টা দেখে গুরু পরশুরাম যথেষ্টই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি খুশি হয়ে কর্ণের বহু কামিত সেই ব্রহ্মাস্ত্র-ক্ষেপণের বিধি-নিয়ম এবং তা সম্বরণ করার উপায়–সবটাই শিখিয়ে দিলেন কর্ণকে–তস্মৈ স বিধিবৎ কৃৎস্নং ব্রহ্মাস্ত্রং সনিবর্তন। কর্ণের কতকালের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল। গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে চেষ্টা করে যা হয়নি, এখানে তা অনায়াসলভ্য হল পরশুরামের সন্তুষ্টিতে। তিনি ধনুর্বেদে আরও যত্ন নেওয়া আরম্ভ করলেন এবং এমনও হয়তো ভাবলেন যে পূর্বোক্ত ব্রাহ্মণের অভিশাপটুকু ফলবার আগেই তিনি অর্জুনকে শেষ করে ফেলবেন। এই ভেবেই কর্ণ ধনুর্বেদ অভ্যাস, ব্রহ্মাস্ত্র ক্ষেপণ-সম্বরণের অভ্যাস করে যাচ্ছিলেন যথাসাধ্য যথামতি। এই সময়ে আবারও একটি ঘটনা ঘটল যা তার চরম পুরুষকারের গতি রোধ করল।

সেদিন কোনও বিশেষ ব্রত-নিয়ম পালন করার জন্য বৃদ্ধ পরশুরাম উপবাস করে ছিলেন। সারাদিন ব্রত–নিয়ম উপবাসে তার বৃদ্ধ শরীর কিছু ক্লান্ত হয়েছে। তিনি কর্ণের সঙ্গে আশ্রমের কাছেই একটা ফাঁকা জায়গায় একটু হাঁটাহাঁটি করছিলেন–কর্ণেন সহিতো ধীমান্ উপবাসেন কর্শিতঃ। কিন্তু উপবাস–ক্লিষ্ট শরীরে এই হাঁটাহাঁটি তার পোযাচ্ছিল না তিনি এক জায়গায় বসে পড়লেন। মুক্ত প্রকৃতি এবং আরণ্যক সমীরণে তার নিদ্রাকর্ষণ হচ্ছিল। এক সময় তিনি কর্ণের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন–কর্ণস্যোৎসঙ্গ আধায় শিরঃ ক্লান্তমনা গুরুঃ।

ঘুমিয়ে আছেন গুরু–এই সময়ে একটি কাঁকড়া বিছে ধরনের একটি কীট অথবা মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী সেটি একটি জোঁকও হতে পারে–অথ কৃমি শ্লেষ্ম-মেদো-মাংস শোণিত-ভোজনঃ–সেই রকম একটি কীট কর্ণের উরুভেদ করে রক্ত খেতে লাগল। গুরু পরশুরামের ঘুম ভেঙে যাবে বলে কর্ণ একটুও নড়লেন না, কৃমিকীটটিকে দূরে নিক্ষেপ করারও চেষ্টা করলেন না অথবা সেটাকে মেরে ফেলারও চেষ্টা করলেন না–ন চৈনমশকৎ ক্ষেং হং বাপি গুরোর্ভয়াৎ! কীট কর্ণের উরুমাংস ভেদ করে যথেচ্ছ রক্তপান করতে লাগল, কর্ণের যন্ত্রণাও বাড়তে লাগল। অসহ্য বেদনা ভোগ করেও কর্ণ বীর স্থৈর্য নিশ্চল হয়ে রইলেন–কর্ণস্তু বেদনাং ধৈর্যাদসহ্যং বিনিগৃহ্য তাম্। অপেক্ষা করতে লাগলেন–কখন গুরুর ঘুম ভাঙে। নিষ্কম্প, ধীর, নিশ্চল কর্ণ গুরুর মাথাটি ধারণ করে রইলেন আপন মহিমায়–অকম্পয়ন্ অব্যথয়ন্ ধারয়ামাস ভার্গবম্।

কীটের রক্তপানের অনুষঙ্গে শীতল রক্তধারা বইতে লাগল কর্ণের ঊরু থেকে আর সেই শীতল স্পর্শেই পরশুরামের ঘুম ভেঙে গেল। তারও মুখে গায়ে রক্ত লেগে আছে। পরশুরাম বেশ বিরক্ত হলেন। ব্রত-নিয়মের দিনে এই রক্তের স্পর্শে তিনি বড়ো অশুচি বোধ করলেন। কর্ণকে বললেন–তুমি কী করছ বসে বসে, আজ আমি এই শোণিতস্পর্শে এইভাবে অশুচিতা লাভ করলাম–অহোস্মি অশুচিতাং প্রাপ্তঃ কিমিদং ক্রিয়তে ত্বয়া। তুমি নির্ভয়ে সব কথা খুলে বলো তো আমাকে, কী হয়েছে?

কর্ণ সবিনয়ে সেই কৃমিকীটের ভক্ষণ-যন্ত্রণা নিবেদন করলেন পরশুরামকে। মহাভারতের কবিকল্পে এই কীট পূর্বজন্মে এক অভিশাপগ্রস্ত রাক্ষস ছিল। তার নাম মেঘবাহন। সে পরশুরামের দর্শনে মুক্ত হবে এই ভবিতব্যে আজ তার পরম মুক্তিও ঘটল। কিন্তু নিজে মুক্ত হয়ে সে কর্ণকে যে যন্ত্রণা দিয়ে গেল, তাই শুধু নয়, সেও কর্ণের ভবিতব্য তৈরি করে গেল। পরশুরাম এই প্রথম সন্দেহ করলেন কর্ণকে।

পরশুরাম কর্ণের দিকে রক্তচক্ষু তাকিয়ে বললেন–ওরে মূর্খ! এই নিদারুণ কষ্ট কোনও ব্রাহ্মণের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। সামান্য কীট দংশনেই কোমল–প্রকৃতি ব্রাহ্মণ চেঁচিয়ে উঠবে–অতিদুঃখমিদং মূঢ় ন জাতু ব্রাহ্মণঃ সহে। এতক্ষণ ধরে এই ভয়ানক দংশন সহ্য করে তুই যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিস–এ শুধু ক্ষত্রিয়ের পক্ষেই সম্ভব। তুই ঠিক ঠিক বল তো তুই ব্রাহ্মণ না ক্ষত্রিয়? কর্ণ আবারও অভিশাপের ভয় পেলেন এবং সত্যি কথা বলতেও বাধ্য হলেন। বললেন–গুরুদেব। আমি ব্রাহ্মণও নই, ক্ষত্রিয়ও নই। আমার জন্ম হয়েছে সেই ঘরে, যে ঘরে এক ক্ষত্রিয় পুরুষ পরম প্রেমে এক ব্রাহ্মণীর পাণিগ্রহণ করেছিল। আমি সূত জাতীয়–ব্রহ্ম-ক্ষত্রান্তরে জাতং সূতং মাং বিদ্ধি ভার্গব। আমাকে লোকে রাধেয় কর্ণ-রাধার ছেলে বলে ডাকে।

আজকের এই বিপন্ন মুহূর্তে কর্ণ তার মিথ্যা শব্দ–আমি ভার্গব ব্রাহ্মণ–এই মিথ্যা পরিচয় মিথ্যা করে দিয়ে সত্যবাক্য উচ্চারণ করলেন–আমি অধিরথ সূতপুত্র রাধা-গর্ভজাত–রাধেয়ঃ কর্ণ ইতি মাং প্রবদন্তি জনা ভুবি।

.

১০৬.

 পুরুষকারের জয়ঘোষে কর্ণ চিরকাল নিজেকে রাধেয় কর্ণ বলে নিজের পরিচয় দিয়ে এসেছেন, আজকে গুরু পরশুরামের সামনে তিনি সেই আত্মপরিচয় দিলেন মিনমিন করে। কারণ তিনি মিথ্যা কথা বলে পরশুরামের শিষ্যত্ব লাভ করেছিলেন। আজকে যখন গুরুর সামনে ধরা পড়ে গেলেন, তখন নিরুপায় হয়ে নিজের পরিচয় দিয়েছেন, তবু কিন্তু পিতার নাম উচ্চারণ করেননি। আমি সূত-জাতীয় এই পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও সূত-জাতির মূল যেহেতু ক্ষত্রিয় পিতা এবং ব্রাহ্মণী মাতা তাই হয়তো উঁচু ঘরের মেয়ে রাধার পরিচয়ে কর্ণ বিখ্যাত হতে চেয়েছেন। অথবা একজন ব্রাহ্মণীর পরিচয়ে যদি পরশুরামের হৃদয় বিগলিত হয়, তাই কর্ণ সূত পরিচয় দিয়েই–লোকে আমাকে রাধার ছেলে রাধেয় বলেই ডাকে বলে পরশুরামকে জানিয়েছেন।

কর্ণ নিজের লোভাতুরতার কথাও গোপন করেননি। দ্রোণাচার্যের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র-লাভের আতুরতা ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি যে ব্রহ্মাস্ত্রের লোভেই পরশুরামের কাছে এসেছিলেন, সে কথা অকপটে স্বীকার করে তিনি বললেন–আমি অস্ত্রের লোভেই আমার মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলাম, আপনি ক্ষমা করুন ভগবন–প্রসাদং কুরু মে ব্ৰহ্মণ অস্ত্রলুব্ধস্য ভার্গব। বিপন্ন অবস্থায় নিজের তৈরি অজুহাতটুকুও ব্যক্ত করতে ভুললেন না কর্ণ। বললেন–দেখুন, গুরু মানেই তো পিতা। তো আমি যখন আপনার শিষ্য হলাম, তখন আমি তো আপনার পুত্ৰই হলাম। অতএব আপনার গোত্ৰনামেই আমি আমার নিজের পরিচয় দিয়েছি ভার্গব বলে–অতো ভার্গব ইত্যুক্তং ময়া গোত্রং তবান্তিকে।

লক্ষণীয়, গুরুপরম্পরায় শিষ্যের যে পুত্রত্ব সিদ্ধ হয়, সেটা খুবই পুরনো কথা। বৈয়াকরণ-পিতা পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে পুত্রের মতো একই তদ্ধিত প্রত্যয়ে শিষ্যের পুত্রত্ব সিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল গুরুর গোত্রে শিষ্যের পুত্র-পরিচয় সিদ্ধ হয় শিষ্যত্ব লাভের পর, শিষ্য হবার আগেই নয়। এতে আরও ভাল করে বোঝা যায় যে, ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের লোভেই কর্ণ ঈষৎ চাতুরী করেছিলেন পরশুরামের সঙ্গে। এখন সব ধরা পড়ে যাবার পর হাজার সত্য কথা বলেও পরশুরামকে তিনি বোঝাতে পারছেন না। গুরুর জন্য, গুরুভক্তির জন্য যে অসহ্য কীট-দংশন তিনি সহ্য করলেন, তাতেও যেমন পরশুরামের হৃদয় বিগলিত হল না, তেমনই তার এই মুহূর্তের সত্যভাষণের কোনও ফল হল না। আপন সত্য পরিচয় দিয়ে কর্ণ এখন ভয় পেয়েছেন। ভয়ে কম্পমান এখন তিনি হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন পরশুরামের পায়ের কাছে–ভূমৌ নিপতিতং দীনং বেপমানং কৃতাঞ্জলি।

পরশুরামের দয়া হল না। বেচারা কর্ণ, ভাগ্যের দোষে এবং নিজের দোযে বিড়ম্বিত কর্ণ। পরশুরাম অভিশাপ উচ্চারণ করে বললেন,–তুই যখন শুধুমাত্র অস্ত্রের লোভে আমার সঙ্গে মিথ্যাচারণ করেছিসযস্মান্মিথ্যোপচরিতো হ্যস্ত্রলোভাদিহ ত্বয়া–অতএব এই ব্রহ্মাস্ত্র তোর কাছে প্রতিভাত হবে না। যদি বা অন্য কোনও সময়ে এই ব্রহ্মাস্ত্রের শিক্ষা তোর মাথাতে আসেও, কিন্তু বিপন্ন মুহূর্তে যখন তোর বধকাল ঘনিয়ে আসবে, তখন এই ব্রহ্মাস্ত্র ক্ষেপণের কৌশল তোর মাথায় কাজ করবে না। তুই মিথ্যাবাদী, তুই অব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র কখনও থাকতে পারে না–অব্রাহ্মণে ন হি ব্ৰহ্ম ধ্রুবং তিষ্ঠেৎ কদাচন।

এই অব্রাহ্মণত্ব যে মিথ্যাভাষণের ফল, সে কথা পরশুরামের আক্ষেপ শুনলেই বোঝা যায়। নইলে ক্ষত্রিয় হওয়া সত্ত্বেও অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করতেন না। লাভ করতেন না রামায়ণের রামচন্দ্রও। শুধু সত্য কথা বলার জোরেই জাবালি সত্যকামের ব্রাহ্মণত্ব প্রতিপন্ন হয়েছিল। এখানেও প্রথম মিথ্যাবাদিতা এবং ছলনা কর্ণের অপরাধের মূল সে কথা আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় পরশুরামের পরবর্তী উক্তি থেকে। পরশুরাম বললেন–যুদ্ধে তোর মতো ক্ষত্রিয় এই পৃথিবীতে মিলবে না। কিন্তু তবু তুই এখনই এই আশ্রম ছেড়ে চলে যা, কারণ আমার এখানে তোর মতো মিথ্যাচারীর কোনও স্থান নেই–গচ্ছেদানীং ন তে স্থান অন্তস্যেহ বিদ্যতে।

অত ধৈর্য ধরে, অমন বিষম যন্ত্রণা সহ্য করে যে গুরুভক্তি কর্ণ দেখিয়েছিলেন, তার ফল তিনি পরশুরামের কাছে পেলেন এই মহান আশীর্বাদে–তোর মতো যুদ্ধবীর ক্ষত্রিয় পৃথিবীতে থাকবে না–ন ত্বয়া সদৃশো যুদ্ধে ভবিতা ক্ষত্রিয়ো ভুবি। বাস! এইটুকুই। কিন্তু এর বেশি তিনি যা চেয়েছিলেন পরের হত্যার আকাঙ্ক্ষায়, অস্ত্রলোভে এবং মিথ্যাচারিতায়, সেটুকু–সেই মারণাস্ত্রের ব্যবহার ক্ষমতা তার নিজেরই প্রবঞ্চনায় নিজের কাছে অধরা রয়ে গেল।

আমরা জানি–জন্ম থেকে কর্ণের দুর্ভাগ্যের জন্য তাঁর প্রতি আমাদের চরম মায়া আছে। সে মায়া আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন করুণরসাহূদী কবিরা–কাশীরাম থেকে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল পর্যন্ত। কিন্তু কর্ণ-চরিত্রের প্রতি সমস্ত মায়া সত্ত্বেও মহাভারতের কবি দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে কীভাবে একটি শৈশবে মাতৃ-পিতৃহারা বালকের জীবন পরিবেশগত কারণে বিকারগ্রস্ত হতে থাকে। অর্জুনের প্রতি তার অকারণ আক্রোশ তৈরি হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু শুধু দুর্যোধনের বন্ধুত্ববশত তারই মতো পাণ্ডব-বিদ্বেষ এই অসাধারণ বালকের মধ্যে অনুস্যুত হয়েছিল বলে কর্ণের মনস্তত্ত্বও সেইভাবে এক বিকৃত আকার ধারণ করতে থাকে।

লক্ষ্য করে দেখুন, মহাভারতের কবি জানিয়েছেন–মাহেন্দ্র পর্বত থেকে ফিরে এসেই কর্ণ প্রথম দেখা করলেন দুর্যোধনের সঙ্গে এবং তাঁর কাছে আবারও ফের একটি মিথ্যা কথা বললেন। বললেন–~দুর্যোধন আমি সমস্ত অস্ত্রে সিদ্ধ হয়ে ফিরেছি–দুর্যোধনমুপাগম্য কৃস্ত্রো স্মীতি চাব্রবীৎ। শাশ্বতিক বিরোধ–বশে যিনি পাণ্ডব–বিদ্বেষী হয়েছেন সেই দুর্যোধন যে পরশুরামের শিক্ষাগার–ফেরত কর্ণকে আরও বেশি পছন্দ করবেন, তাতে সন্দেহ কী? অতএব দুজনে দুজনকে পেয়ে পরম আহ্লাদিত হলেন–দুর্যোধনেন সহিতো মুমুদে ভারতৰ্ষভ।

আমরা আগে বলেছি–অতিশয় শক্তিমান মানুষ যদি কুসঙ্গে বর্ধিত এবং লালিত হয় তবে তা অন্যতর বিপদ ডেকে আনে। মহেন্দ্র পর্বত থেকে ফিরে এসে কর্ণ সেই মানুষটার সঙ্গে আবারও জুটে গেলেন, যার সঙ্গে অর্জুনের শত্রুতা আছে, যার সঙ্গে পাণ্ডবদের বৈরিতা আছে। পরশুরাম তার বীরোত্তমের সার্টিফিকেট দিয়েছেন সেই ভরসায় কর্ণ আবারও অর্জুন-বিরোধিতায় মন দিলেন।

যাঁরা ভাবেন–অস্ত্রপরীক্ষার দিনে কর্ণ ধূমকেতুর মতো রঙ্গস্থলে উদয় হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন, তাদের জানাই। তারা যেন মহাভারতের কবির সংবাদটুকু মাথায় রাখেন। যেন মনে রাখেন–কর্ণ মহেন্দ্র-পর্বত থেকে এসে সোজা দুর্যোধনের সঙ্গেই দেখা করেছিলেন। পিতা অধিরথের কাছেও তিনি যাননি, জননী রাধার কাছেও না। সুদূর চম্পানগরীতে বসে পিতা অধিরথ হয়তো শুধু এইটুকু খবর পেয়েছিলেন যে, কর্ণ হস্তিনাপুরে পৌঁছেছেন কুশলে। তিনি হয়তো পুত্ৰমুখ দেখার জন্য রওনা দিয়েছেন হস্তিনার পথে।

 আমাদের বিশ্বাস–এইমাত্র যে অসাধারণ যুবক উন্মুক্ত রঙ্গমঞ্চে বাহু-স্ফোটন করতে করতে প্রবেশ করলেন, তার প্রবেশ পূর্বেই পরিকল্পিত এবং হয়তো বা তা দুর্যোধনেরই পরিকল্পনা। আমরা জানি–দ্রোণাচার্যের প্রতি কর্ণের কিছু মানসিক আক্রোশ ছিলই, কেন না তিনি তাকে ব্রহ্মাস্ত্র-শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অন্যদিকে কর্ণ জানতেন যে, আজকের রঙ্গমঞ্চে কুরুবৃদ্ধদের সামনে এবং সমবেত পৌর-জনপদবাসীদের সামনে দ্রোণের প্রধান আকর্ষণ থাকবেন অর্জুন। তিনি তাঁর অস্ত্রের কৌশলে জনতার জয়কার লাভ করবেনই এবং দ্রোণ-গুরুর বক্ষ স্ফীত হবে তাতে। অতএব যে মুহূর্তে অর্জুনের ধনুর্বেদ কৌশল চরমে উঠবে তখন যদি কর্ণ রঙ্গমঞ্চে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে অর্জুনের সমস্ত ক্ষমতা নস্যাৎ করে দেন, তাতে যেমন অর্জুনের ধনুঃশরের ক্রীড়ারস খাটো হয়ে যাবে, তেমনই তাতে দ্রোণগুরুরও পরোক্ষ অপমান ঘটবে যথেষ্ট। কেন না দ্রোণের কাছে শিক্ষা গ্রহণ না করেও যদি অর্জুনের মতোই ধনুঃবেদকৌশল প্রমাণ করা যায়, তাতে অর্জুনের যত অপমান, দ্রোণেরও ততই অপমান।

আমরা তাই অনুমান করি–কর্ণ যে আজ এই মুহূর্তে হাততালি দিতে দিতে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন সে ঘটনা মোটেই কাকতালীয় নয়। দুর্যোধনের সঙ্গে পূর্বেই তিনি মিলিত হয়েছেন এবং হয়তো দুর্যোধনের পরিকল্পনামতোই আজ অর্জুনের অস্ত্র–প্রদর্শনীর শেষ মুহূর্তে তিনি উপস্থিত হয়েছেন রঙ্গমঞ্চে। কর্ণকে দেখে দুর্যোধনরা একশো ভাই ঘিরে ধরলেন তাকে। তাদের সাদর অভিবাদন গ্রহণ করতে করতে কর্ণ রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন। হাততালি বা বাহু-স্ফোটন করার সময় তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন দৌবারিকের পিছনে। কিন্তু কৌরব রাজপুত্রেরা কর্ণকে সাদর আলিঙ্গন করার সঙ্গে সঙ্গে দৌবারিকেরা সসম্ভ্রমে কে না কে এসেছেন ভেবে বিস্ময়ে চোখ বড় করে কর্ণকে পথ ছেড়ে দিল–দত্তেবকাশে পুরুষৈ-বিস্ময়োৎফুল্ললোচনৈঃ। শত্রুর নগর বিজয় করে এলে যে মর্যাদা এক মহাবীরকে স্পর্শ করে কর্ণ ঠিক সেই মর্যাদায় রঙ্গ-প্রবেশ করলেন।

 মহাভারতের কবি সমস্ত মহাকাব্য জুড়ে তার নায়ক অর্জুনের জয়কার ঘোষণা করেছেন বলে শত্রুপক্ষের ওই মহাবীরের ওপর তিনি মোটেই অকরুণ নন। রঙ্গ-প্রবেশের সময় কর্ণের স্বত-উদ্ভাসিত চেহারার বর্ণনা দিচ্ছেন মহাভারতের কবি। সেই জন্ম-লব্ধ সোনার বর্ম কর্ণের বুকে আঁটা রয়েছে, কানের কুন্তল–দ্যুতিতে তার মুখখানি স্বত-উদ্ভাসিত-সহজং কবচং বিভ্রৎ কুণ্ডলোদ্দ্যোতিতাননঃ। স্কন্ধে ধনুঃশর, কটিদেশে লম্বিত কৃপাণ। সিংহের মতো শক্তিমান লম্বা-চওড়া তার চেহারা, আগুনের মতো ব্যক্তিত্ব এবং তার মধ্যে তার গায়ের রঙ, মুখের সৌন্দর্য যেন আকাশের সূর্য–চন্দ্রকে এক দেহে নামিয়ে এনেছে–দীপ্তিকান্তি দ্যুতিগুণৈঃ সূর্যেজ্বলনোপমঃ।

 রঙ্গ-প্রবেশ দ্বারের অপর কোটিতে স্ত্রীলোকের মধ্যে বসা এক অসহায় জননী এই যুবক–পুরুষটিকে চিনলেন। সেই দীপ্তি, সেই তেজ সেই সোনার কবচ-কুণ্ডল। প্রথম যৌবনের প্রথম অপরাধ নিজের লজ্জা ঢাকবার জন্য এক কন্যা-জননী এই যুবক-পুরুষকে অতি শৈশবেই জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। রাজপ্রাসাদের বাইরে অশ্ব-নদীর পারে দাঁড়িয়ে সেই জননী কুন্তী সমস্ত দেবতার কাছে সকরুণ প্রার্থনা জানিয়েছিলেন–তার ছেলেটি যেন বেঁচে থাকে।

ছেলে তার বেঁচে আছে। কিন্তু এ কী হল আজ? পুত্রকে জীবিত দেখে তার জননী-হৃদয়ের সমস্ত বাৎসল্যের সঙ্গে এক অজানা ভয় তাকে যে প্রায় অবশ করে তুলছে। তার কন্যাবস্থার প্রথম পুত্রটি তারই গর্ভজাত আরেক সন্তানের প্রতিযোগী হয়ে রঙ্গ-মঞ্চে প্রবেশ করছে। ভাই ভাইকে চিনতে পারছে না, সূর্যের ঔরসজাত পুত্রটি ইন্দ্রের ঔরসজাতকে চিনতে পারছেন না ভ্রাতা ভ্রাতরম্ অজ্ঞাতঃ সাবিত্রঃ পাকশাসনিম। কিন্তু সূর্য আর ইন্দ্রের শক্তি-নিবেশের সেই সাধারণ আধার কুন্তী এ দুঃখ সইবেন কী করে? তিনি অবশ হয়ে পড়ছেন। এতকাল ধরে কর্ণের জন্য সঞ্চিত সেই মাতৃস্নেহের সহজ সুত ধারাটি ভয়ে স্তব্ধ হয়ে আসছে যেন। গান্ধারীকে এতক্ষণ যিনি ধারা-ভাষণ দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই ভাষণ এখন কোথায়? তিনি যে অবশ হয়ে পড়ছেন।

কর্ণ দ্বার ছেড়ে রঙ্গস্থলের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন একক বীরের মাহাত্ম্যে। সমস্ত রঙ্গস্থলের চারদিকে–সর্বততা রঙ্গমণ্ডল–একবার তাচ্ছিল্যভরে তাকালেন। যেন একটু ঠাহর করে নিলেন রঙ্গের পরিবেশটুকু। দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্যের দিকে এক সেলাম ঠোকার মতো করে প্রণাম জানালেন চরম অনাদরে, অবহেলায়–প্রণামং দ্রোণ-কৃপয়ো-নাত্যাদৃতমিবাকরোৎ! ভাবটা এই–তোরা আবার গুরু! যা শিখতে চাইলাম, শেখালি না। কিন্তু কী করতে পেরেছিস আমার। যা শেখার তা আমি শিখে এসেছি।

কর্ণ অর্জুনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন সামনা-সামনি। বললেন–অনেক তো খেলা দেখালে বাপু! দেখালে যেন কত বিশেষ বিলক্ষণ অস্ত্রযোজনা তুমি জান। তুমি যা ক্ষমতা দেখিয়েছ, তাতে নিজেকে নিয়ে অত অবাক হয়ো না কিছু। কারণ যা যা তুমি করে দেখিয়েছ, তার চেয়ে অনেক বেশি কায়দা-কেতা আমি সবার সামনে করে দেখাব–করিষ্যে পশ্যতা নৃণাং মাত্মনা বিস্ময়ং গমঃ।

কর্ণের কথা শুনে রঙ্গস্থলের সমবেত জনতা একেবারে লাফ দিয়ে দাঁড়াল। স্প্রিং ছেড়ে দিলে তার ওপরে থাকা বস্তুপিণ্ড যেমন হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে, সমবেত জনতা তেমন করেই অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল–বলে কি লোকটা! অর্জুনের থেকেও বেশি করবে? অর্জুনের অস্ত্রচালনার কৌশল দেখে তাদের মনে যে ঘোর লেগেছিল, সে ঘোর এক মুহূর্তে কেটে গেল। তারা কর্ণের কৌশলে পুনরায় বেঘোর হতে চায়–যন্ত্ৰোক্ষিপ্ত ইবাতস্থৌ ক্ষিপ্রং বৈ সর্বতো জনঃ। দর্শকদের এই ভাব-পরিবর্তনে দুর্যোধন ভারি খুশি হলেন। পাণ্ডব অর্জুন এতক্ষণ ধরে দর্শকদের মনে যে সাড়া জাগিয়েছিলেন, তা হঠাৎ গতি পরিবর্তন করায় পাণ্ডব-বিদ্বেষী দুর্যোধন পরম আহ্লাদিত হলেন। আর অন্যদিকে সবার সামনে, আচার্যের সামনে, কৌরবদের সামনে এইভাবে নস্যাৎ শব্দ শুনে যুগপৎ লজ্জা এবং ক্রোধে আরক্ত হয়ে উঠলেন–হ্রীশ্চ ক্রোধশ্চ বীভৎসুং ক্ষণেনাম্বাবিবেশ হ।

 রঙ্গস্থলে ঢুকে কৌশল দেখাব বললেই কৌশল দেখানো যায় না। রঙ্গস্থলের একটা শৃঙ্খলা আছে। এই অস্ত্র-রঙ্গ প্রদর্শনীর মূল হোতা যেহেতু দ্রোণাচার্য, কাজেই তিনি এখানে সব। তার অনুমতি ছাড়া এখানে কিচ্ছুটি করা যাবে না। কর্ণকে অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হলেও এখানে দ্রোণের অনুমতি চাই। অর্জুনের প্রতি পূর্ব-পক্ষপাতে এবং আপাতত কর্ণের তাচ্ছিল্যে দ্রোণাচার্য এই অনুমতি নাও দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি দিলেন, অনুমতি দিলেন। দিলেন কেন? হয়তো এর পিছনে দ্রোণের এমন এক কৌতূহল কাজ করেছে যে, তার কাছে বিশেষ কিছু না শিখেও কেমন অস্ত্রবিদ্যা শিখেছে কর্ণ। দ্বিতীয় কারণ হয়তো দ্রোণও জানেন না। যেহেতু সে কারণ মহাভারতের কবির অন্তরশায়িত এক মহাকাব্যিক কারণ।

কবি যে মহাকাব্য লিখতে বসেছেন! এখানে সামান্য তাচ্ছিল্য বা ব্যক্তিগত ক্রোধ খুব ছোট ব্যাপার। মহাকাব্যের পরিসরে–যে গুরু দ্রোণাচার্য তার একতম শিষ্যকে চরম অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে আপন মনেই সন্তুষ্ট হয়ে ভাবলেন–এই সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, এবং আমার চাইতে বেশি শিক্ষা কেউ দিতে পারে না, মহাকাব্যের কবি তাকে বাস্তব জগৎ চিনিয়ে দিয়ে বোঝান–তুমি ছাড়াও আরও গুরু আছেন, দ্রোণাচার্য! তারাও অনেক কিছু পারেন, তাঁদের ক্ষমতাও দেখো। আপনাতে আপনিই সন্তুষ্ট হয়ো না।

 আর এতাবৎ পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, অর্জুনকে যে এমন লজ্জায় ফেললেন মহাকাব্যের কবি, তারও কারণ হল–তিনি অর্জুনকেও বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। যে মহাবীর তার ভবিষ্যতের নায়ক হবেন, সেই যুবক পুরুষ কতগুলি অল্পশিক্ষিত যোদ্ধার মধ্যে নিজের বিদ্যা দেখিয়েই নায়কে পরিণত হবেন, সেটি হতে দেবেন না মহাকাব্যের কবি। কর্ণের মুখ দিয়ে তাই অর্জুনকে শুনতে হয়েছে–নিজের কর্ম-ক্রিয়াকে অসাধারণ মনে করে আপনাতে আপনিই বিস্মিত হয়ো না–মাত্মনা বিস্ময়ং গমঃ! এই কৌরব-পাণ্ডব ভাইরা ছাড়াও আরও এক বৃহৎ জগৎ আছে। সেখানে তোমার প্রতি কেউ পক্ষপাত দেখাবে না কোনও দ্রোণ-কৃপ সেখানে তোমাকে রক্ষা করবেন না, সেই জগতের সম্মুখীন হতে হবে তোমার নিজেকেই। এবং দেখো, এই মুহূর্তেই দেখো–দ্রোণ–গুরু কর্ণের মুখ স্তব্ধ করে দিলেন না, তিনি অনুমতি দিলেন কর্ণকে তার কৌশল দেখাবার জন্য–ততো দ্রোণাভ্যনুজ্ঞাতঃ কর্ণঃ প্রিয়রনঃ সদা।

কর্ণ যা বলেছিলেন, তাই করলেন। সমবেত জনতার সামনে, মান্য কুরুবৃদ্ধদের সামনে অর্জুন যা যা আশ্চর্য কর্ম করে দেখিয়েছিলেন, একে একে সে সবই করে দেখালেন কর্ণ–যৎ কৃতং তত্র পার্থেন চ্চকার মহাবলঃ। অর্জুন লজ্জায় মাটিতে মিশে গেলেন। আর সেই প্রায় বিবশা জননী কুন্তী! তার কী হল? তার প্রথমজন্মা অনাদৃত পুত্রের কৃতিত্বে একদিকে তিনি স্ফীত বোধ করলেন, আরেক দিকে তার স্বীকৃত পুত্রের মুখ চেয়ে বিমনা হলেন। এ কীরকম হর্ষ এবং বিষাদ। দুটিই এত চরম যে তার বিবশতা ছাড়া কীই উপায় থাকতে পারে নিজের কাছে লুকোবার।

কর্ণের স্পর্ধা এবং নিপুণতা দেখে পরম পুলকিত দুর্যোধন ভাইদের সঙ্গে আসন থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে–কর্ণং পরিঘজ্য মুদা ততো বচনমব্রবীৎ। বললেন– ভাগ্যিস আজ তুমি এখানে এসেছিলে–তুমি যে কত আমার মান বাড়িয়েছ, সে তুমি নিজেও জান না–স্বাগতং তে মহাবাহো দিষ্টা প্রাপ্তোসি মানদ। এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে এবং এই কুরুরাজ্যের সমস্ত ভোগও তোমার প্রাপ্য–যথেষ্ঠমুপভুজ্যতাম্। দুর্যোধনের সমাদরে কর্ণ একেবারে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। বললেন–অন্য কোনও ভোগই আমি চাই না, আমার প্রয়োজনও নেই তাতে। আমি শুধু তোমার বন্ধুত্ব চাই–কৃতং সর্বেন তেন্যেন সখিত্বত্ত ত্বয়া বৃণে। আরও একটা জিনিস আমি চাই তা হল–এই মুহূর্তেই আমি অর্জুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে চাই।

 কর্ণ একটু বেশি আপ্লুত হয়ে পড়েছেন। দুর্যোধনের বন্ধুত্ব তিনি চান–সে বেশ কথা। কিন্তু তিনি তার হৃদয়টি পড়ে ফেলে তাকে একেবারে ভিজিয়ে তুলেছেন স্তাবকতায়। দুর্যোধনকে তিনি প্রভু বলে সম্বোধন করে বলছেন–আমি অর্জুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে চাই প্রভু। দুর্যোধন পাকা বুদ্ধিমান লোক। তিনি তো আর সবার সামনে হৃদয় উজাড় করে বলতে পারেন না যে,–হ্যাঁ অর্জুনকে একটু উচিত শিক্ষা দাও তো ভাই। তিনি তাই কৌশল করে বললেন–আমার সমস্ত ভোগে তোমারও অধিকার আছে বন্ধু। তুমি সব সময়েই এই বন্ধুটির প্রিয় কার্য সাধন করো। আর যারা তোমার শত্রু তাদের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো তুমি–দু হৃদাং কুরু সর্বেষাং মূর্মি পাদমরিন্দম।

 দুর্যোধনের এই বক্রোক্তি অর্জুনের কাছে মোটেই সহনযোগ্য নয়, আর কর্ণের কথাটা তো নয়ই। কর্ণ অর্জুনকে সোজাসুজি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, সে চ্যালেঞ্জ অর্জুন ছেড়ে দিতে পারেন না। তবু অর্জুন বড় ভদ্র। তিনি হঠাৎ মাথা গরম করে এক মানসিক প্রস্তুতিহীন যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে পারেন না। যিনি ভবিষ্যতে এক উদাত্ত নায়কে পরিণত হবেন, তার কথাবার্তার ধরন–ধারণ সাধারণের মতো হবে না। অর্জুন একটু যেন অভিমানীর মতো বলে উঠলেন–যাদের কেউ ডাকেনি, তারা যদি এসে উপস্থিত হয়, যাদের বলতে বলা হয়নি, তারা যদি এসে মেলা বকতে থাকে–অনাহুতোপসৃষ্টানা অনাহূপেজল্পিনাম–তাদের জন্য পরলোকে যে জায়গাটা ঠিক করা আছে আগে থেকেই, আমি তোমাকে হত্যা করলে তোমার যে সেই অধম লোকে গতি হবে, কর্ণ!

এর উত্তরে দুর্যোধনের মদতপুষ্ট কর্ণ কোনও মহান, মধুর, সভ্য কথা বলেননি এবং ঠিক এইখানেই মহাশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির কুসঙ্গে থাকার কুমহিমাটুকু ব্যক্ত হয়েছে। তার আশৈশব-লালিত মানসিক জটিলতার সঙ্গে দুর্যোধনের তাচ্ছিল্যের স্বভাব পশ্চাদযুক্ত হওয়ায় অর্জুনের প্রতি তাঁর ভাষাটা হল এইরকম–আরে যাঃ! এই রঙ্গস্থলটা শুধু তোর একার জায়গা নাকি রে, অর্জুন! এখানে সবার অধিকার সমান। আমাকে কেউ ডেকেছে কি না ডেকেছে, সে কথা একেবারেই অবান্তর। তাছাড়া না ডাকতেই না হয় আমি এসেছি, তাতে তোর কী–রঙ্গোয়ং সর্বসামান্যঃ কিমত্র তব ফানঃ? এখানে বড় বড় রাজারা অনেকেই আছেন, তারা বলুন কিছু? কই তারা তো কিছু বলছেন না, কারণ ধর্ম বা নীতি-নিয়ম শক্তিমানকেই অনুসরণ করে–বলং ধর্মোনুবর্ততে।

আসলে এইটাই কর্ণের ফিলজফি। কর্ণ জানেন–শক্তি যদি থাকে, পুরুষকার যদি থাকে, তবে নীতি-নিয়ম-শৃঙ্খলা তারই মতে তৈরি হবে নতুন করে। ধর্ম শক্তিমানকে অনুসরণ করবে, শক্তিমান ধর্মের অনুসরণ করেন না–বীর্যশ্রেষ্ঠা হি রাজানঃ বলং ধর্মোনুবর্ততে। কর্ণের এই কথাগুলির মধ্যে যত শক্তিই থাকুক, যত পৌরুষই থাকুক, ভারতবর্ষের মাটিতে শক্তি কিংবা পুরুষকার যদি ধর্ম-শৃঙ্খলার অনুবর্তী না হয় তবে পরিণামে সে শক্তি জয়ী হয় না। কর্ণের বীর্যোৎসিক্ত কথাগুলির মধ্য দিয়েই মহাভারতের কবি তার দুর্ভাগ্য রচনা করছেন। তাঁর শতগুণ-বর্ণনা করেও সেই গুণের বিপদটুকুও তিনি দেখিয়ে দিলেন।

.

১০৭.

 কর্ণ অর্জুনকে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়ে বললেন–ওরে তুই যে আমায় গালমন্দ করলিনা ডাকতে এসেছি–ইত্যাদি ইত্যাদি–এসব কথা মানায় কাদের জানিস। দুর্বল লোকেরাই নানা কথা বলে আসল বস্তু থেকে সরে যাবার চেষ্টা করে। তুই ধনুকে শর-যোজনা করে বাণের আগায় কথা বল–কিং ক্ষেপৈঃ দুর্বয়াসৈঃ শরৈঃ কথয় ভারত। এই যে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তোর গুরুদেব দ্রোণাচার্য, তার সামনেই তোর মাথাটা ধড় থেকে নামিয়ে দেব–গুরোঃ সমক্ষং যাবত্তে হরাম্যদ্য শিরঃ শরৈঃ।

কর্ণের দম্ভোক্তি কোন চূড়োয় পৌঁছেছে! সাধারণ প্রাকৃত জন যেমন অতিক্রাধে দম্ভোক্তি করে বলে–তোর বাপ এলেও আমার কিছু করতে পারবে না–এই উক্তি প্রায় সেই রকম। সর্বজনমান্য দ্রোণগুরুর সামনে তার সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্যকে এইভাবে অপমান করা মানে পরোক্ষে সেই দ্রোণকেই অপমান করা–যে দ্রোণকে কর্ণ শুধু অর্জুনের শিক্ষাগুরু বলেই হীন মনে করেন। এবং তার কাছে তিনি ব্রহ্মাস্ত্রের সাহায্য পাননি বলে তাকে ঘৃণাও করেন। এই কথা বলে কর্ণ আরও দেখাতে চাইলেন যে–তুই তোর গুরুর কাছে কী শিখেছিস আর আমি বা আমার গুরুর কাছে কী শিখেছি, তার পরীক্ষা হয়ে যাক এখনই।

দ্রোণাচার্য কর্ণের ইঙ্গিত-অপমান যথেষ্ট বুঝলেন–আর তো দেরি করা যায় না। তিনি অর্জুনকে অনুমতি দিলেন যুদ্ধ করবার জন্য। চার পাণ্ডব ভাই অর্জুনকে আলিঙ্গন করে উৎসাহ জানালেন। অন্যদিকে কৌরব ভাইরা আলিঙ্গন করলেন কর্ণকে। ভাবটা এই–হয়ে যাক এপার-ওপার। সুসজ্জিত ধনুক-বাণ হাতে নিয়ে অর্জুন এসে দাঁড়ালেন এক পাশে, আরেক পাশে শরাসন হাতে কর্ণ–স্থিতঃ কর্ণঃ প্রগৃহ্য সশরং ধনুঃ।

মহাকাব্যের কবি আর লোভ সম্বরণ করতে পারেননি। দুই দেবপুত্র-ইন্দ্রপুত্র অর্জুন আর সূর্যপুত্র কর্ণ পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছেন–অতএব মর্ত্যলোকের মর্ত বর্ণনার মধ্যে মহাকাব্যের কবি এখন স্বর্গের ছোঁয়া লাগাবেন। নিজের ঔরসজাত পুত্র আজ প্রথম যুদ্ধ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছেন দেখে দেবরাজ ইন্দ্র আকাশ-মার্গে উপস্থিত হলেন রঙ্গ দেখার জন্য। ইন্দ্র এলেন মানেই, তার সঙ্গে রাশি রাশি মেঘ এসে জমা হল আকাশে, রামধনুর শোভার সঙ্গে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের গর্জন উৎসাহিত করল অর্জুনকে। নীল মেঘের তলায় বকপংক্তির উল্লাস যেন মঙ্গল উচ্চারণ করল অর্জুনের জন্য। সুনীল গগন মণ্ডলে বলাকার হাসি উপহার দিয়ে ইন্দ্রদেব যেন মেঘের ছাতা বিছিয়ে দিলেন অর্জুনের মাথায়–আবৃতং গগনং মেঘৈ-বলাকা পংক্তিহাসিভিঃ।

 দেবরাজ ইন্দ্রের এমনতর পুত্র-পক্ষপাত দেখে সূর্যদেবও উপস্থিত হলেন রণাঙ্গনে। তিনি আপন তেজে যথাসম্ভব মেঘরাশি দূরীভূত করে নিজের প্রসন্ন দক্ষিণ মুখখানি প্রকাশ করে রাখলেন। কর্ণের মধ্যে নিহিত করলেন আপনার সহস্র কিরণ করাঙ্গুলির স্পর্শ। কেমন দেখাল? ইন্দ্রও কম যান না, সূর্যও কম যান না। কেউ কাউকে ফেড়ে দেবেন না। মর্ত্যলোকে কর্ণার্জুনের যুদ্ধের ইঙ্গিতে দেবলোকেও এক অলৌকিক প্রতিদ্বন্দিতা শুরু হল আকাশপথে। রঙ্গস্থলের অর্ধেকটায়–যেখানে অর্জুন দাঁড়িয়ে আছেন–সেই অর্ধেকটা মেঘাচ্ছন্ন করে রাখলেন ইন্দ্র–মেঘচ্ছায়োপগূঢ়স্তু ততোদৃশ্যত ফাল্গুনঃ। আর অর্ধেকটা যেখানে কর্ণ দাঁড়িয়ে আছেন–সেই অর্ধেকটা আলোকিত করে রাখলেন সূর্যদেব, আলোকিত করে রাখলেন কর্ণকে –সূর্যতাপ-পরিক্ষিপ্তঃ কর্ণোপি সমদৃশ্যত।  

আকাশমার্গের এই দ্বিধা ভিন্ন অভিসন্ধি মর্তের মনেও কাজ করল। কৌরবরা একশো ভাই দাঁড়ালেন কর্ণের পিছনে। আর দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, ভীষ্মের মতো কুরুবৃদ্ধরা দাঁড়িয়ে রইলেন যেদিকে অর্জুন আছেন।

ভীম এবং দুর্যোধনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময়ে যেমন হয়েছিল, আবারও সেইরকম রোল উঠল দর্শকাসনে বসা মানুষগুলির মধ্যে। তারা দুই ভাগ হয়ে গেল। কেউ অর্জুনের হয়ে চিৎকার করতে লাগল, কেউ বা কর্ণের আগাম জয় ঘোষণা করতে লাগল। সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল রঙ্গ–দর্শনোৎসুকা রমণীকুলের মধ্যে। হস্তিনাপুরের পুর-রমণীরা যারা সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যেও এক দ্বৈধভাব দেখা গেল। যাঁরা প্রধানত কৌরব ভাইদের পরিচারিকা, বা জননী গান্ধারীর কাছাকাছি থাকা মানুষ তারা কর্ণকে সমর্থন করতে লাগলেন। আর যারা জননী কুন্তীর পক্ষপাতিনী, তাঁরা সমর্থন করতে লাগলেন অর্জুনকে।

কিন্তু এই অদ্ভুত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবচেয়ে বেশি যিনি বিমূঢ়া হলেন, তিনি জননী কুন্তী। তিনি যে কর্ণকে চিনতে পেরেছেন। আপন গর্ভজাত দুই পুত্র দুজনে দুজনের দিকে শরসন্ধান করছে–এই সাংঘাতিক ঘটনা দেখে কুন্তী ক্ষণিকের মধ্যে জ্ঞান হারালেন–কুন্তীভোজসুতা মোহং বিজ্ঞার্থা জগাম হ। কুন্তীকে এইভাবে নিজাসনে সংজ্ঞাহীন হতে দেখে মহামতি বিদুর তাড়াতাড়ি করে এলেন কুন্তীর কাছে। পরিচারিকারা বিদুরের ইঙ্গিতে চন্দনের গন্ধ দেওয়া সুবাসিত জল এনে ঝাঁপটা দিল কুন্তীর চোখে-মুখে–কুন্তীমাশ্বাসয়ামাস প্ৰেষ্যাভিশ্চন্দ নোদকৈঃ। কুন্তীর জ্ঞান তাতে ফিরে এল বটে, কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন–তার দুই ছেলেই রাগে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। কুন্তী যে কী করবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না। একবার ভাবলেন–এক্ষুণি ছুটে গিয়ে সব রহস্য মোচন করবেন সবার সামনে, আবার ভাবলেন–এতদিন পর, বিশেষত কর্ণের জন্ম–যন্ত্রণা, মনের অবস্থার নিরিখে তিনি যদি সকলের সামনে প্রত্যাখ্যাত হন, তবে সে কষ্টই বা তিনি সহ্য করবেন কী করে? ঠিক এই অবস্থায় এক অসাধারণ আপতিক সৌভাগ্য কুন্তীর জননী-হৃদয়কে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করল।

ভীম-দুর্যোধনের গদাযুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বিতা যখন দ্বন্দ্বযুদ্ধের আকার গ্রহণ করল তখন দ্রোণাচার্য নিজ-পুত্র অশ্বত্থামার মাধ্যমে তা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু কর্ণ যেহেতু অর্জুনের সঙ্গে তাঁর আচার্যকেও ছাড়েননি, তাকেও কর্ণ যেহেতু যথেষ্ট কটুকথা বলেছেন, অতএব দ্রোণাচার্য এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্বয়ং ইনভলভড হয়ে গেছেন। তিনি যুদ্ধ বারণ করছেন না, তিনি চাইছেন–তার শিক্ষা কীরকম–প্রমাণ হয়ে যাক এখনই। এই অবস্থায় কুলগুরু কৃপাচার্য এগিয়ে এলেন এই দুই ভয়ঙ্কর উন্মুখ প্রতিদ্বন্দ্বীর যুদ্ধ নিবারণ করার জন্য। কৃপাচার্য জানেন বা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছেন যে, এঁরা দুজনেই বড় মাপের যোদ্ধা। কিন্তু দুজনের উক্তি–প্রত্যুক্তি থেকে যা বোঝা গেছে–তাতে অর্জুনকে থামালে তিনি থামবেন, কিন্তু কর্ণ যে ভাষায় যে তীক্ষ্ণতায় কথা বলেছেন, তাতে যুদ্ধ লাগলে তাঁকে থামানো মুশকিল হবে এবং এই দুইজনের একজন সমূহ বিপদগ্রস্ত হতে পারেন। কৃপাচার্য একটু কৌশল অবলম্বন করলেন।

কৃপাচার্যের এই কৌশল আধুনিকমনা প্রগতিবাদীর কাছে অত্যন্ত হীন প্রতিপন্ন হয়েছে এবং সত্যিই তা হীনও বটে, কিন্তু তৎকালীন সমাজের নিরিখে তথা যে কোনও উপায়ে যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যাপারটা যদি ভাল করে বোঝা যায় তবে কৃপায়ের দিকেও কিছু যুক্তি অবশ্য আছে। কৃপাচার্য অর্জুনকে ধনুক তুলতে দেখে কর্ণকে বললেন–এই অর্জুন পৃথা-কুন্তীর গর্ভজাত কনিষ্ঠ পুত্র। প্রসিদ্ধ কুরুবংশে এঁর জন্ম এবং প্রয়াত মহারাজ পাণ্ডুর তৃতীয় পুত্র। ইনি অবশ্যই তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন–কৌরবো ভবতা সার্ধং দ্বন্দ্বযুদ্ধং করিষ্যতি। এবারে কর্ণ! তুমিও তোমার মাতা-পিতার পরিচয় দাও এবং কোন রাজবংশে তোমার জন্ম তাও আমাদের জানাও। তোমার সব কথা জানার পর এই পার্থ অর্জুন তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতেও পারেন, আবার নাও পারেন–প্রতিযোৎস্যতি বা ন বা। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখ–একজন রাজপুত্র কখনও এক হীনবংশ হীনাচার ব্যক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করেন না–বৃথা কুলসমাচারে- যুধ্যন্তে নৃপাত্মজাঃ।

কথাগুলি ভয়ঙ্কর কটু, বিশেষত আধুনিক শিক্ষা এবং রুচিতে কারও হীনজাতিত্ব প্রমাণ করে তার প্রতিভা অস্বীকার করাটা আমাদের মতে দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়া উচিত। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে কৃপাচার্যকে সমর্থন করা যায় না। কিন্তু কৃপাচার্য বৃদ্ধ এবং জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি কুরুবংশে লালিত হচ্ছেন মহারাজ শান্তনুর সময় থেকে। বিশেষত তিনি আচার্য, তার সামনেই তার পরম আত্মীয় এবং আচার্য দ্রোণ কর্ণের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন। সে কালের সমাজ-নীতি, রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধনীতি এবং নীতিযুক্তিও কৃপাচার্যের নখদর্পণে–দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ-সমাচারে কুশলঃ সর্বধর্মবিৎ।

সেকালের যুদ্ধনীতির মধ্যে কতগুলি কর্তব্য-অকর্তব্যের বাঁধন ছিল। কোন কোন অস্ত্র প্রয়োগ করা যাবে এবং যাবে না, কোন অবস্থায় করা যাবে এবং যাবে না, কার ওপরে প্রয়োগ করা যাবে এবং যাবে না–সে বিষয়ে যেমন কিছু সুস্পষ্ট নীতি ছিল তেমনই দ্বন্দ্বযুদ্ধেরও কতকগুলি নিয়ম ছিল। সেই নিয়মে একজন রাজা বা রাজপুত্র যেমন অসমান বা হীনবর্ণ মানুষের সঙ্গে যুদ্ধে নামতেন না তেমনই একজন উচ্চবর্ণের মানুষের সঙ্গেও দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন না। এই মহাভারতের মধ্যেই কখনও কখনও এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের উদ্যোগ ঘটেছে। দেখবেন–ক্ষত্রিয় অনেক হম্বিতম্বি করছেন, মেরে ফেলব বলে ভয় দেখাচ্ছেন, কিন্তু বারবারই তার মুখ দিয়ে শোনা যাবে–ব্যাটা! তুই যদি ব্রাহ্মণ না হতি, তবে এই মুহূর্তে তোকে..ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কখনই এইসব দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিণতি ঘটেনি।

উচ্চবর্ণের সঙ্গে যেমন, নিম্নবর্ণের ক্ষেত্রেও তাই। আধুনিক সমাজের মানসিকতায় হীনবর্ণের কথা উচ্চারণ করলে আমাদের খারাপ লাগে, কিন্তু উচ্চবর্ণের ঘটনায় এসব আমাদের মনে থাকে না। কিন্তু নিয়ম-নীতি একই রকম এবং কৃপাচার্য যে নিয়ম যথেষ্টই জানেন–দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ-সমাচারে কুশলঃ। অতএব একজন রাজা রাজপুত্র অন্তত দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় হীনবর্ণের মানুষ এমনকি হীনচেতার সঙ্গেও সমানে সমানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন না। ক্ল্যাসিক্যাল যুগের কোনও নাইট বা ব্যারন একজন কৃষকের সঙ্গে ডুয়েল লড়তেন না কখনই। এখানেও সেই ভাবনাটা তৎকালীন যুগের বিবেচনায় অসভ্য নয়।

দ্বিতীয় কথা হল–কৃপাচার্য বুঝেছেন–যেভাবেই হোক যুদ্ধটা থামাতে হবে। শিক্ষাবিজ্ঞানের অভিজ্ঞ পণ্ডিতদের কাছে শুনেছি–একটি ক্লাসরুমে সমবয়সী ছাত্রদের মধ্যে যে একটু বেশি জানে এবং সেই জানার দরুন সচেতনভাবে সে যদি বেশি ফটর-ফটর করে, তবে নাকি মাস্টারমশাইয়ের উচিত সেই অত্যুৎসাহী ছাত্রকে একটু দমিয়ে দেওয়া। এখানে কর্ণ যেভাবে আচার্য দ্রোণকেও প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বীর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন এবং তাও সেটা যে ভাষায়, তাতে কর্ণকে অন্যভাবে আঘাত না করলে তার বাড় আরও বেড়ে যেত। তাছাড়া কর্ণের দুর্বল জায়গায় আঘাত না করলে তিনি থামতেন বলেও মনে হয় না। অথচ যেভাবে হোক এই সমুদ্যত দ্বন্দ্বযুদ্ধ থামাতেই হবে। অতএব কৃপাচার্য অত্যন্ত কঠিনভাবে কর্ণের দুর্বল জায়গায় আঘাত করলেন–তোমার পিতা-মাতা, রাজবংশের পরিচয় বল–কথয়স্ব নরেন্দ্রাণাং যেষাং ত্বং কুলভূষণম্।

যেখানে দুই মহাবীরের যুদ্ধাত্মান ঘোষিত হচ্ছে, যেখানে এই মানসিক আঘাতে একতম মহাবীরের হৃদয় কতটা ক্ষত-বিক্ষত হয়, সে ব্যাপারে কর্ণের সমদুঃখভাব ব্যক্ত করেছেন মহাভারতের কবি। এত বড় বীর যে কৃপাচার্যের কথায় এক্কেবারে চুপ মেরে গেলেন, এতে মহাকাব্যের কবিরও আঘাত লেগেছে মনে। তিনি বলেছেন–কৃপের প্রশ্ন শুনে কর্ণের মুখ লজ্জায় অবনত হল–ব্রীড়াবনত আনন। কর্ণ যখন অর্জুনের সঙ্গে প্রতিস্পর্ধা করে যুদ্ধাহ্বান করছিলেন তখন তাঁর মুখটি লাগছিল প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো। এই মুহূর্তে সে ফুল্ল-বিকশিত পদ্মের ওপর কৃপের প্রশ্ন যেন বর্ষার জল ঢেলে দিল–বভৌ ব্যাম্বুবিক্লিন্নং পদ্মমাগলিতং যথা। পদ্মের উপমা কেন? পদ্ম যে পাঁকেও ফোটে। কর্ণও তত সূত–জাতির পঙ্কে পঙ্কজ। যদি বা পাঁকে কর্ণের মতো পদ্মফুল ফুটল, তার ওপরে বর্যার প্রবল জলধারা নামল। সূতজাতির কোমলমৃণাল–মেরুদণ্ডে পদ্মফুল আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। তার মুখ–পদ্ম আনমিত হল–বর্ষাম্বুবিক্লিন্নং পদ্মমাগলিতং যথা।

ঠিক এই মুহূর্তে এই উপমা দেওয়ার একটা স্বর্গীয় কারণও আছে। সূর্যের তেজে পদ্মফুল ফোটে। সূর্যপুত্র কর্ণ, সূর্যের তেজেই তার জন্ম। কিন্তু বর্ষার মেঘ সূর্য-তেজ আচ্ছন্ন করে। কৃপাচার্যের প্রশ্ন হল বর্ষার ধারাসার। তাতেও বেগও আছে এবং তাতে ক্লেদেরও সৃষ্টি হয়েছে। তাই বর্ষাঘুবিক্লিন্ন পদ্মের মতো কর্ণের মুখ অবনত হল–পদ্মমাগলিতং যথা।

এই মুহূর্তে কর্ণের অসহায় অবস্থা দেখে জননী কুন্তীর হৃদয়ে কত ব্যথা লেগেছিল, তা মহাভারতের কবি বর্ণনা না করলেও আরেক মহাকবি তা লিখেছেন কর্ণকুন্তী সংবাদে। কিন্তু মহাভারতের কবির কাছে জননী-হৃদয়ের এই কারুণ্যের যথেষ্ট মূল্য থাকলেও, এখন তিনি কর্ণের সম্মান-ভাবনায় ভাবিত আছেন। ঠিক যেমন কুন্তীও এই মুহূর্তে ভাবিত আছেন তার কন্যাগৰ্ভজাত পুত্রের সম্মান-ভাবনায়। কর্ণের সম্মান রক্ষায় এগিয়ে আসছেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি পাণ্ডব–বিদ্বেষী, যাঁর সঙ্গে কুন্তীর গর্ভ-সম্বন্ধ নেই এবং যিনি মহাকাব্যের প্রতিনায়ক দুর্যোধন।

দুর্যোধন কৃপাচার্যের ক্লিন্ন কথার প্রবল প্রতিবাদ করলেন। বললেন–আচার্য! আপনি রাজপুত্রের মাহাত্ম খ্যাপন করছেন কোন প্রমাণে? শাস্ত্রের নিয়ম-নীতিতে তিন রকমের মানুষ হলেন রাজা নামের উপযুক্ত। এক তো যিনি বংশ-পরম্পরায় রাজা। দ্বিতীয়, যিনি মহাবীর, তিনি আপন শক্তিবলে রাজশক্তির অধিকারী হন। আর তিন, যিনি নিজের বুদ্ধি-শক্তিতে সেনা পরিচালনা করতে পারেন। স্বীকার করা গেল কর্ণ বংশের কৌলীন্যে রাজা বা ক্ষত্রিয় নন। কিন্তু বীরত্বের নিরিখে, সেনা পরিচালনার নিরিখে কর্ণের রাজোপাধির বাধা কোথায়?

 দুর্যোধনের কথার যুক্তি অবশ্যই আছে। ধর্মশাস্ত্রের নিয়মে যিনি আপন ভুজবলে রাজ্যখণ্ড অধিকার করেছেন, তিনি হীনবর্ণের মানুষ হলেও তার ক্ষত্রিয়ত্ব বা রাজ-পদবি সিদ্ধ হয়। দুর্যোধনও সেই কথাই বলেছেন। কিন্তু তাতেও যদি বলা হয়–কই কর্ণের এই শাসিত ভূখণ্ডটি কোথায়–সেই অপমান-নিবৃত্তির জন্য দুর্যোধন বললেন–এমন যদি হয় যে, অর্জুন রাজা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না, তো ঠিক আছে, এই মুহূর্তে আমি কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের রাজপদে অভিষিক্ত করছি–তস্মদেষোঙ্গবিষয়ে ময়া রাজ্যেভিষিচ্যতে।

সেই মুহূর্তেই দুর্যোধনের আদেশে হস্তিনাপুরের পুররমণীরা স্বর্ণঘটে জল নিয়ে এল। কর্ণকে দাঁড় করানো হল স্বর্ণময় পাদপীঠে। মেয়েরা কর্ণের জয়কার দিতে দিতে মঙ্গল উচ্চারণ করল। ব্রাহ্মণরা অভিষেক মন্ত্রে আপ্যায়িত করলেন কর্ণকে–কাঞ্চনৈঃ কাঞ্চনে পীঠে মন্ত্রবিদ্ভি-মহারথঃ। কর্ণ অঙ্গরাজ্যের অধিপতি হলেন। এই আধিপত্য-লাভের সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের নির্দেশে একজন কর্ণের মাথার ওপর রাজছত্র ধারণ করল, কেউ বা ডুলাতে লাগল চামর। বৈতালিকেরা জয়কার দিলেন কর্ণের–সছত্র-বালব্যজননী জয়শব্দোত্তরেণ চ।

সেই শৈশব কাল থেকে পালক পিতা অধিরথ এবং স্নেহময়ী রাধার ভালবাসা কর্ণ কিছু কম পাননি। কিন্তু এই সম্মান, এই রাজসম্মান তার আর কে দিয়েছে? নিজের সূতজাতির হীনত্ব অতিক্রম করে এই রাজকীয় মর্যাদা কর্ণকে যতখানি আহ্লাদিত করল, ঠিক ততখানি কৃতজ্ঞ করে তুলল দুর্যোধনের প্রতি। আপ্লুত, গদগদ কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন–তোমার এই রাজ্যদানের কী প্রতিদান আমি দিতে পারি–অস্য রাজ্যপ্রদানস্য সদৃশং কিং দদানি তে? তুমি বলো দুর্যোধন! আমি কী দিতে পারি তোমাকে? দুর্যোধন কিছু চাইলেন না। আজীবন পাণ্ডববিদ্বেষী দুর্যোধন তাঁর আপন বিদ্বেষ আরও ভালভাবে চরিতার্থ করার জন্য তিনি শুধু কর্ণকে পাশে পেতে চান সব সময়। বললেন–আমি তোমার চরম বন্ধুত্বটুকুই শুধু চাই, আর কিছু নয়–অত্যন্তং সখ্যমিচ্ছামি ইত্যাহ তং সুযোধনঃ। কর্ণ স্বীকার করলেন–সম্পদে-বিপদে সদা সর্বদা তিনি দুর্যোধনের বন্ধু থাকবেন। কর্ণ-দুর্যোধনের গাঢ় আলিঙ্গনে এই বন্ধুত্ব সকলের সামনে স্বীকৃত হয়ে গেল।

 এই বন্ধুত্বে পাণ্ডব-পক্ষের কেউই খুশি হলেন না। খুশি হলেন না কুরুবৃদ্ধরাও। শুধু কৌরবপক্ষ ছাড়াও আর একজন যদি এই বন্ধুত্বে আপাতত খুশি হয়ে থাকেন, তিনি জননী কুন্তী। কর্ণ তাঁর প্রথম পুত্র, তিনি আজ রাজমর্যাদা লাভ করেছেন। বিশেষত তার দুই পুত্রের দ্বন্দ্বযুদ্ধ আপাতত শান্ত হয়েছে। কুন্তী তাই আশ্বস্ত বোধ করছে এখন।

কর্ণ-দুর্যোধনের পারস্পরিক দানাদান যখন শেষের মুখে, তখনই আরও একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটল, যুদ্ধ–প্রদর্শনীর রঙ্গস্থলে। আমরা পূর্বেই জানিয়েছি–মহেন্দ্র পর্বত থেকে ফিরে কর্ণ সোজা চলে এসেছিলেন দুর্যোধনের কাছে। কর্ণের পালক পিতা অধিরথ পুত্রের ফিরে আসার সংবাদ শুনেই হস্তিনাপুরের দিকে রওনা হয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন, লাঠিতে ভর দিয়ে তাকে পথ চলতে হয়। সেই চম্পা নগরী থেকে হস্তিনাপুর। পথ তত কম নয়। রথে চড়ে আসতে গেলেও একটি বৃদ্ধ মানুষের ক্লান্তি কিছু কম হয় না। বিশেষত মগধ-বিহারের সীমান্ত–ভূমি চম্পা থেকে হস্তিনাপুর–অর্থাৎ দিল্লির কাছাকাছি জায়গায় আসতে গেলে যে রাজপথ বেয়ে রথ চালাতে হয়, তার ভূমি সমতল নয়। সূত্রবৃদ্ধ অধিরথ তবু খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন হস্তিনাপুরে।

সূত অধিরথ জানেন যে, তার ছেলেটি ভয়ঙ্কর আবেগপ্রবণ এবং অর্জুনের ব্যাপারে তার চিরাচরিত প্রতিহিংসা-বৃত্তির কথাও তিনি জানেন। কর্ণ যেহেতু চম্পায় না ফিরে হস্তিনাপুরেই আস্তানা গেড়েছেন, তাই অধিরথের অনুমান–দ্রোণাচার্যের রঙ্গ-প্রদর্শনীর দিন তাঁর পুত্রটি সেখানে যাবেই। তিনি তাই তড়িঘড়ি আসছেন হস্তিনাপুরে।

যে মুহূর্তে রঙ্গস্থলের প্রবেশদ্বারে সূত অধিরথকে দেখা গেল, তখন অপরাহ্নের বেলা। অধিরথ রঙ্গমঞ্চে ঢুকলেন; তাঁর সমস্ত গা ঘামে ভিজে গেছে। স্কন্ধস্থিত উত্তরীয় বাস খানিকটা গলায় আর খানিকটা মাটিতে লুটোচ্ছে–ততঃ স্তোত্তরপটঃ সপ্রস্বেদঃ সবেপথুঃ। পথশ্রমের সঙ্গে এক দুরন্ত ভয় তাকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে তার সারা শরীর কাঁপছে। লাঠিতে ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেই বিহ্বলভাবে এদিক–ওদিক তাকিয়ে তার প্রিয় পুত্রটির নাম ধরে ডাকতে লাগলেন–কর্ণ! কর্ণ রাধেয়! তার গলার স্বরে ভয় মিশ্রিত ছিল। তিনি ভাবছিলেন–দ্রোণাচার্যের উপযুক্ত শিষ্য অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কর্ণ যদি কোনওভাবে মারা পড়েন, তবে এই বৃদ্ধ বয়সে তার সারা জীবনের বাৎসল্য-সম্পদ, তার প্রিয়া পত্নী রাধার জীবনধারা সর্বস্ব হারিয়ে যাবে। আর ঠিক এই ভাবনাতেই তার ঘাম হচ্ছে, সারা শরীর কাঁপছে এবং প্রবেশদ্বার থেকেই তিনি বিহ্বলভাবে ডাকছেন–কর্ণ! রাধার ছেলে আমার রাধেয়–বিবেশাধিরথথা রঙ্গং যষ্টিপ্রাণো হয়ন্নিব।

 দুর্যোধনের হাত ধরা কর্ণের কানে এই বিহ্বল ডাক পৌঁছল। রঙ্গস্থলের মধ্যভূমি থেকে কর্ণের দৃষ্টি পড়ল সূতবৃদ্ধ অধিরথের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কাঁধ থেকে ধনুক ছুঁড়ে ফেললেন মাটিতে, নামিয়ে ফেললেন সশর তৃণীর। তখনও তার মাথা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে অভিষেক বারি-বিন্দু। পিতা অধিরথ সেই সুদূর চম্পা থেকে এতদূর এসেছেন তাকে দেখতে। পিতার গৌরবে কর্ণ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন তার কাছে। দুই হাত দিয়ে সুস্থির করার চেষ্টা করলেন তার কম্পমান শরীর। তারপর সকলের সামনে, পাণ্ডব-কৌরব এবং সমবেত জনতার সামনে সগৌরবে তার অভিযেক-বারি সিঞ্চিত মস্তকখানি স্থাপন করলেন পিতা অধিরথের পায়ে–কণোভিষেকাম্ৰাশিরাঃ শিরসা সমবন্দত। এতটুকু লজ্জা নেই, এতটুকু সংকোচ নেই, কর্ণের এই বিনতির মধ্যে সবটাই তাঁর পালক পিতার জন্য গৌরব নিহিত। সম্ভ্রম আর পুরুষকারের অভিব্যক্তি এমনই গৌরবময় হয় বুঝি।

এতকাল ধরে এই পূত্রটিকে লালন-পালন করছেন অধিরথ। কিন্তু তার মনে মনে বিশেষ বারণা আছে–ছেলেটি অবশ্যই কোনও বড় ঘরের ছেলে হবে। ছেলের চেহারা, গায়ের রঙ, তাঁর ব্যক্তিত্ব, ক্ষমতা এবং উচ্চাশা সব কিছু মিলিয়ে কেবলই তার মনে হয়–এই ছেলেটি এক বড় বংশের ছেলে এবং ঈশ্বরের করুণায় ছেলেটি এই সূত মাতা-পিতার পুত্রত্ব স্বীকার করেছে যেন। অধিরথ তাঁর ছেলেটিকে খুব ভালবাসেন, খুব আদর করেন, কিন্তু মনে মনে এই ছেলেটির উচ্চকুলের জন্ম-সম্ভাব্যতার কথা মনে রেখে এই আদরণীয় পুত্রটির প্রণাম নিতে সংকোচ বোধ করেন একটু। বাৎসল্যভরে মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু একটু সংকোচ আছে তাঁর। কাজেই কর্ণ যখন সগৌরবে সূতবৃদ্ধের চরণে মাথা নোয়ালেন, তখন অধিরথ তাঁর আলুথালু লুটিয়ে পড়া বস্ত্রাঞ্চল দিয়ে নিজের পা-দুটি ঢাকার চেষ্টা করলেন–ততঃ পাদাববচ্ছাদ্য পটান্তেন সসম্রমঃ। কিন্তু সসম্ভ্রম মুহূর্তটুকু কেটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই–অর্থাৎ কর্ণও তাঁর পদস্পর্শ করলেন আর অধিরথও পা লুকোনোর চেষ্টা করলেন–এই ত্বরমান পারস্পরিক শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সূত অধিরথের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল সেই শৈশব-স্মৃতি-বিজড়িত সস্নেহ মধুর আহ্বান–পুত্র! পুত্র আমার-পুত্রেতি পরিপূর্ণার্থামব্রবীদ্রথ সারথিঃ।

.

১০৮.

 সূতবৃদ্ধ অধিরথ কর্ণের অভিষেক-জলসিক্ত মস্তক চুম্বন করে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। আর বারবার তাঁকে সস্নেহ মধুর স্বরে ডাকতে লাগলেন–পুত্র! পুত্র আমার।

সূত অধিরথের মুখে পুত্র-সম্বোধন শোনা মাত্রই পাণ্ডব-পংক্তির মধ্যে এক নতুন প্রতিক্রিয়া হল। মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনের মুখে এক অদ্ভুত হাসি দেখা গেল। এতক্ষণ কর্ণ অনেক কথা বলেছেন, অনেক হম্বিতম্বি করেছেন। তারপর কৃপাচার্য তাঁর বংশের সম্বন্ধে প্রশ্ন তুললে দুর্যোধন তাকে যেভাবে অঙ্গ রাজ্যের রাজত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করলেন, তাতে পাণ্ডবদের কারও মুখে আর একটি কথাও সরছিল না। কিন্তু যেই না সূতবৃদ্ধ অধিরথ কর্ণকে পুত্র বলে সম্বোধন করলেন, তখনই যেন ভীমের কাছে এক অপূর্ব সুযোগ এসে গেল কর্ণকে প্রতি-অপমান করার।

এমনিতেই মধ্যম পাণ্ডব ভীম বড় জ্বর-প্রকৃতির মানুষ। কোনও কিছুই তার মুখে আটকায় এবং নিজে অসাধারণ দৈহিক বলের অধিকারী বলে কাউকে তিনি তেমন আমলও দেন না, কারও সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা হলে রেখে-ঢেকেও কিছু বলেন না। সূতবৃদ্ধের মুখে পুত্র সম্বোধন শুনেই সর্বত্র ব্যঙ্গের হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললেন–ওরে ব্যাটা! সারথির পো! একটা যুদ্ধে অর্জুন যে তোকে বধ করবে, সে যোগ্যতাও তোর নেই। তুই বরং এক কাজ কর। ধনুক-বাণ ছেড়ে ঘোড়া-দৌড় করানোর জন্য এক গাছি চাবুক জোগাড় কর তাড়াতাড়ি–কুলস্য সদৃশস্থূৰ্ণং প্রতোদো গৃহং ত্বয়া। তোর বংশে সবাই ওটাই ভাল চালায়। আবার ওই যে আরেক জন! খুব বাড়াবাড়ি করে তোকে অঙ্গ–রাজ্য দিলেন। এও ঠিক হল না। তুই অন্তত রাজপদের যোগ্য নোস। যজ্ঞে যে পুরোডাশ দেবতাকে আহুতি দেওয়া হয়, একটা কুকুর কি সেই যজ্ঞ-বলি ভক্ষণের যোগ্য হয় কখনও–শ্বা হুতাশ-সমীপস্থং পুরোডাশমিবাধ্বরে।

বড্ড কড়া কথা। ভীম বড্ড কড়া কথা বললেন সবার সামনে। রাগে কর্ণের গা জ্বলে গেল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল থর-থর করে–কিঞ্চিৎ প্রস্ফুরিতাধরঃ। একটি জ্বলন্ত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তিনি আকাশের সূর্যের দিকে একবার তাকালেন–গগনস্থং বিনিশ্বস্য দিবাকরমুদৈক্ষত। একবারও বোঝাতে পারলেন না তার অসহায় অবস্থা। কুকুরের যজ্ঞাহুতি ভক্ষণের কথা বলছেন ভীম, অথচ কর্ণ জানেন–যে দেবতার উদ্দেশে ব্রাহ্মণরা প্রতিদিন সাবিত্রী–মন্ত্র জপ করেন–তৎ সবিতুর্বরেণ্য ভর্গদেবস্য ধীমহি–সেই সূর্যদেবের ঔরসে তার জন্ম। কিন্তু শুধু মায়ের নাম উচ্চারণ করলে সেই কন্যা জননীর সঙ্গে তিনিও কলঙ্কিত হবেন বলে কর্ণের কোনও উপায় নেই স্পষ্ট কথা বলার।

কিন্তু কর্ণ কোনও কথা না বললেও তাঁর হয়ে বলার লোক তখন কৌরব-পক্ষের সবাই। ভীমের রুক্ষ-কঠিন অপমানে দুর্যোধন চুপ করে থাকলেন না। তিনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রতিপক্ষের আসন থেকে–উৎপপাত মহাবলঃ। দুর্যোধনের একশ ভাই, তারা কেউই দুর্যোধনের মতন নন। তারা নরম–সরম সাধারণ। মহাভারতের কবি তাই উপমা দিয়ে বললেন–ভাইদের মাঝখানে দুর্যোধনকে সক্রোধে উঠে দাঁড়াতে দেখে মনে হচ্ছে যেন পদ্মবন থেকে ক্রুদ্ধ হাতি বেরল একটি–ভ্রাতৃপদ্মবনা তস্মান্মদোকট ইব দ্বিপঃ।

দুর্যোধন ভীমকে উদ্দেশ করে বললেন–ওরে! এমন বাজে কথা বলিস না দ্বিতীয়বার। ক্ষত্রিয়ের জীবনে বলই সব, বংশ নয়। কর্ণকে যদি ক্ষত্রিয় নাই বলিস, কিন্তু আমার মতো ক্ষত্রিয়ের বন্ধু বটে। কাজেই ক্ষত্রিয়ের শক্তির কথা মাথায় রেখে যুদ্ধের মাঠে নেমে আয়। আরও একটা কথা বলি শোন–বলবান পুরুষ আর নদীর উৎস খুঁজতে যাস না, বাপু! কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে–শূরাণাঞ্চ নদীনাঞ্চ দুর্বিদা প্রভাবাঃ কিল। এই যে এত বড় বিশ্বামিত্র মুনির কথা শুনি, তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয়, অথচ হয়েছেন ব্রাহ্মণ। মহামতি দ্রোণাচার্যের জন্ম দ্রোণ-কলসে, কৃপাচার্যের জন্ম নল-খাগড়ার বনে। এঁদেরও জননী এবং জন্মবিন্দুর রহস্য আমার জানি না। আর তোরাই বা কম কিসে? তোদের নিজেদের জন্ম কেমন করে হয়েছে, তাও কি আমার জানতে বাকি আছে ভেবেছিস–ভবতাঞ্চ যথা জন্ম এতদপ্যাগমিং ময়া।

 দুর্যোধন পঞ্চ-পাণ্ডবের জন্মের তথাকথিত অনৈতিকতার স্মরণ করিয়ে দিয়ে কর্ণের জন্ম–মাহাত্ম্য স্থাপন করতে চাইলেন অনুমান প্রমাণে। বললেন–তাছাড়া এই চেহারাটার দিকে একটু তাকিয়ে দেখ। গায়ে অলৌকিক সোনার বর্ম আঁটা কানে অভেদ্য কুণ্ডল। পুরুষ মানুষের যত সুলক্ষণ তাও সবই আছে কর্ণের চেহারায়। সাধারণ বা অধম কোনও ঘরে দীপ্ত সূর্যের মতো এমন চেহারার মানুষ একটাও পাবি না। একটা হরিণীর পেট থেকে কি একটা বাঘের জন্ম হয়–কথমাদিত্যসদৃশং মৃগী ব্যাঘ্রং জনিষতি?

দুর্যোধন শেষ কথায় নিজেকে সপ্রমাণ করে বললেন–আরে শুধু অঙ্গ রাজ্য কেন, আমার কথায় এবং নিজের বাহুবলে এ মানুষটা সমগ্র পৃথিবীর রাজা হবার উপযুক্ত। তাছাড়া এত সব কথা বলে লাভ কী? কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের রাজা করে দিয়েছি, বেশ করেছি। আমার এই কাজটা যদি কারও অপছন্দ হয়ে থাকে, তোত সে বাপু একটু পায়ে হেঁটে কষ্ট করে রথে উঠুক এবং ধনুকের ছিলা ধরে একটু টান দিক। তারপর দেখা যাক কার কত ক্ষমতা–রথমারুহ্য পদ্ভ্যাং স বিনাময়তু কামূকম্।

দুর্যোধনের মুখে সোজাসুজি এই যুদ্ধাহ্বান শুনে সমস্ত রঙ্গভূমিতে হাহাকার শব্দ উঠল। দর্শকাসনে বসা মানুষরা বুঝল–এবার আর ব্যাপারটা নির্দোষ প্রদর্শনী বা প্রতিযোগিতার স্তরে নেই। যা ঘটতে যাচ্ছে তা হল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে দুই বীরের যা গতি হয় তোক, কিন্তু শরবর্ষণ আরম্ভ হলে কাছে বসা মানুষজনের জীবনহানির আশঙ্কা থেকেই যাবে। ফলে তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর চেঁচামেচি আরম্ভ হল–ততঃ সর্বস্য রঙ্গস্য হাহাকারো মহানভৃৎ। অতিরিক্ত সাহসী জনতার কেউ কেউ অবশ্য সাহসী কথাবার্তা বলবার জন্য, ক্ষত্রিয়োচিত তেজ প্রকাশ করার জন্য দুর্যোধন–কর্ণের প্রশংসাও করতে লাগল।

 দুর্যোধনের সাহংকার ঘোষণায় একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিলই, কিন্তু যুদ্ধের সমস্ত সম্ভাবনা নির্মূল করে দিয়ে সূর্যদেব অস্ত গেলেন। সেকালের যুদ্ধনীতিতে এই নিয়ম ছিল–সূর্য অস্ত গেলে আর যুদ্ধ করা চলবে না। অতএব সকলেই বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। সেদিনকার রঙ্গ-প্রদর্শনীর নায়ক হয়ে রইলেন কর্ণ এবং অর্জুন। সূর্যাস্ত ঘোষণার সঙ্গে রঙ্গ-যুদ্ধের অন্ত-ঘোষণাও হয়ে যাওয়ায় উৎসাহী জনতা মশাল জ্বালিয়ে পথ চলতে আরম্ভ করল। অস্তাচলগামী স্তিমিত সূর্যের আলোক আবৃত হল মানুষের হাতে হাতে ধরা দীপিকাগ্নির আলোকে। সমস্ত জনতা আবারও দুই ভাগ হয়েই চলতে আরম্ভ করল। তারা কেউ অর্জুনের জয় ঘোষণা করছে, কেউ বা জয় ঘোষণা করছে কর্ণের, কেউ বা দুর্যোধনেরও–অর্জুনেতি জনঃ কশ্চিৎ কশ্চিৎ কর্ণেতি ভারত। কশ্চিদ্ দুর্যোধনেত্যেবং ব্রুবন্তঃ প্রস্থিতাস্তদা।

একশো ভাই কৌরবরা গাত্রোখান করার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্যোধন কর্ণের হাত ধরলেন। হাত ধরেই পথ চলতে আরম্ভ করলেন অনুগামী এবং পুরোগামী স্বপক্ষপাতী জনতার সঙ্গে। তারা মশাল জ্বালিয়ে দুর্যোধন–কর্ণকে পথ দেখাতে লাগল–দীপিকাগ্নিকৃতালোক-স্তস্মাদ রঙ্গা বিনির্যযৌ। পাণ্ডব পক্ষপাতী জনতা এবং পাণ্ডবদের সঙ্গে চলতে লাগলেন দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য এবং ভীষ্ম। সকলেই হাঁটতে হাঁটতে নিজের নিজের বাড়ি পৌঁছলেন।

আজকের সারা দিনের রঙ্গ-প্রদর্শনীর মধ্যে অর্জুনের অস্ত্র-কৌশল যেমন একটা বিলক্ষণ দর্শনীয় বস্তু ছিল, সেই দর্শনীয়তার মধ্যে কর্ণের আকস্মিক আবির্ভাব, তার ক্ষমতার অভিব্যক্তি এবং সর্বোপরি তার রাজ্যাভিষেকের রাজনৈতিক তাৎপর্য মিশে যাওয়ায় বিভিন্ন জনের মনে বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া হল। পরশুরামের শিষ্য এবং অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্ণকে বন্ধু হিসেবে পাবার পর থেকেই দুর্যোধন মনে মনে পরম নিশ্চিন্ত হলেন। অতিবলশালী ভীমকে তিনি সুকৌশলে যুদ্ধে হারাবেন–এ বিষয়ে তাঁর নিশ্চিত ধারণা ছিল, কিন্তু অর্জুনের সম্বন্ধে তার ভয় ছিল অসম্ভব। কর্ণের সঙ্গে পুনর্মিলনের আগে পর্যন্ত অর্জুনই যেহেতু ছিলেন সবচেয়ে অস্ত্রশিক্ষিত পুরুষ, অতএব অর্জুনকে তিনি কীভাবে প্রতিহত করবেন, সে বিষয়ে তার দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু অর্জুনের সমান অথবা আরও বড় প্রতিযোগী হিসেবে কর্ণকে নিজের অনুগামী হিসেবে পেয়ে যাওয়ায় দুর্যোধন অর্জুনের ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন–ভয়মৰ্জুন-সঞ্জাতং ক্ষিপ্রমন্তরধীয়ত। কর্ণও দুর্যোধনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় একেবারেই বশংবদ হয়ে গেলেন।

পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির যুদ্ধ-বিগ্রহ ভালবাসেন না, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বও তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু দুর্যোধন এবং কর্ণের বন্ধুত্ব যে সুরে বাঁধা হল, তা যেহেতু একান্তভাবেই প্রতিহিংসার সুর এবং যেহেতু কর্ণ একেবারেই অনন্যসাধারণ এক যোদ্ধা, তাই যুধিষ্ঠিরের মনে হল–কর্ণের মতো অত বড় যোদ্ধা তিন ভুবনে আর কোথাও নেই–ন কর্ণতুল্যোস্তি ধনুর্ধরঃ ক্ষিতৌ। যুধিষ্ঠিরের বিনয়-শিক্ষা এতটাই বেশি যে, স্বপক্ষীয়, বিশেষত নিজের ভাই বলেই অর্জুনের দক্ষতাকে তিনি ছোট করে দেখতে লাগলেন।

এই রঙ্গ প্রদর্শনীতে যদি সবচেয়ে আনন্দিত ব্যক্তি কেউ থাকেন তবে তিনি অবশ্যই দুর্যোধন। কিন্তু তার চেয়েও যিনি আনন্দিত হলেন তার উচ্ছ্বাসটুকু সবটাই চাপা রইল বুকের মধ্যে। তিনি জননী কুন্তী। কন্যা অবস্থায় নিজের কলঙ্ক-মোচনের জন্য যে শিশু পুত্রটিকে তিনি প্রথম স্নেহচুম্বন দিয়েই জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, তাকে যে কোনও দিন তিনি এইভাবে আবিষ্কার করবেন–এ তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। শুধু তাই নয় দুর্যোধনের বদান্যতায় তার সেই অসহায় শিশু পুত্রটি আজ অঙ্গরাজ্যের রাজা হল–এও কি এক জননীর পক্ষে কম বড় প্রাপ্তি। তিনি জানেন–অনেকেই তাকে দোষ দেবে–কেন তিনি নিজের স্বার্থে এক শিশু পুত্রকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তারা তো আর বুঝবে না যে, তিনি নিজের কাছেই নিজে এক করুণার পাত্র, তিনি অপরকে দয়া দেখাবেন কী করে। বিশেষত যে পুত্রের জন্মে কন্যা-জননীর কলঙ্ক রয়েছে। যিনি নিজের পিতা-মাতার কাছে স্বচ্ছন্দে মানুষ হতে পারেননি, যিনি বালিকা বয়সে কুন্তিভোজের বাড়িতে এসেছিলেন দত্তক দেওয়া এক কন্যা হিসেবে, তার কন্যা-অবস্থার পুত্রটিকে কি পালক পিতা ভাল মনে মেনে নিতেন? তাই তাকে নির্মমভাবে সেদিন ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল। কিন্তু সমাজ-সংস্কার মেনে, হাজারো নির্মম ব্যবহার করেও কি কোনও জননী তার প্রথমজাত পুত্রমুখ ভুলতে পারেন?

 আজ এতদিন পরে সেই সোনার বর্ম-আঁটা, সেই সুবর্ণ-কুণ্ডল পরিহিত শিশুটিকে এক অমিতবলশালী যোদ্ধার মতো রঙ্গভূমি কাঁপিয়ে দিতে দেখে কুন্তীর জননী–হৃদয় আহ্লাদে গর্বে ভরে উঠল। সেই অসহায়, ভাগ্যনদীতে ভাসমান শিশুটি আজ রাজা হয়েছে–এত আনন্দ কুন্তী কোথায় রাখবেন। তবু তাকে লুকোতেই হবে। নিজের কাছে নিজেকে লুকোতে হবে। লুকোতে হবে উত্তরজন্মা পুত্রদের কাছে। লুকোতে হবে সমস্ত সমাজের কাছে। কিন্তু সব কিছুর পরেও তিনি এখন সব সময় সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলের খবর পাবেন, তার প্রতিপত্তি–ক্ষমতার খবর পাবেন, তাঁর সমৃদ্ধির সংবাদ পাবেন–এই বিচিত্র অনুভূতি কুন্তীর সমস্ত হৃদয়ের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আনন্দ ছড়িয়ে দিল–পুত্রমঙ্গেশ্বরং জ্ঞাত্বা ছন্না প্রীতিরজায়ত।

কৌরব-পাণ্ডব সকলের অস্ত্রশিক্ষা এখন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র গুরু দ্রোণাচার্যকে যে গুরু দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সে দায়িত্ব দ্রোণাচার্য অত্যন্ত সফলভাবে সাঙ্গ করায় তিনিও এখন ভারমুক্ত। তিনি এখন হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতেই থাকেন। কিন্তু রাজবাড়িতে রাজার মতো সম্মান এবং ভীষ্মের দেওয়া বৃত্তি লাভ করলেও, তার এই বোধটি অটুট আছে যে, তিনি একজন আশ্রিত ব্যক্তি, জীবনে তিনি এক জায়গায় হেরে আছেন। তাঁর বাল্যবন্ধু পাঞ্চাল দ্রুপদ তাকে কথা দিয়েও কথা রাখেননি এবং উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে তাঁকে সেদিন যে অপমান তিনি কারেছিলেন, সে অপমান তিনি ভোলেননি। সেই অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্যই তিনি হস্তিনাপুরের রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। রাজপুত্রদের শিক্ষার প্রারম্ভেই তিনি তাদের বলে দিয়েছিলেন–বাছারা! আমার কিন্তু একটা কাজ করে দিতে হবে। আমি মনে মনে একটা বিষয় ভেবে রেখেছি, তোমাদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ হলে সেই জিনিসটা তোমাদের দিতে হবে–কাৰ্য্যং মে কাঙ্ক্ষিতং কিঞ্চি হৃদি সম্পরিবর্ততে।

আজ সেই অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। দ্রোণের আকাঙ্ক্ষিত কাল এখন উপস্থিত। তিনি এবার গুরুদক্ষিণা চাইবেন। দ্রোণাচার্য দ্রুপদের অপমানের কথা মাথায় রেখে একদিন তার সমস্ত শিষ্যকে ডেকে পাঠালেন। পাণ্ডব-কৌরব সমস্ত ভাইরা এবং তার কাছে শিক্ষা লাভ করতেন এমন অন্যান্য শিষ্যরাও গুরুর ডাক পেয়ে দ্রোণাচার্যের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। এমনকি কর্ণও এসেছেন দুর্যোধনের সঙ্গে। বন্ধুত্বের জন্যই হোক অথবা যুদ্ধ-সরসতায়, কর্ণও উপস্থিত হয়েছেন এই দ্রোণাচার্যের এই শিষ্য-সম্মেলনে। দ্রোণাচার্য শিষ্যদের বললেন এতদিন তোমাদের অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছি এইবার তোমাদের গুরুদক্ষিণা দিতে হবে। শিষ্যরা গুরুর আজ্ঞার জন্য উন্মুখ হতেই দ্রোণাচার্য বললেন–আমার অর্থ চাই না, সম্পদ চাই না, কিচ্ছু চাই না। তোমাদের কাজ একটাই–পাঞ্চালদেশের রাজা দ্রুপদকে যুদ্ধে হারিয়ে তাকে জীবিত ধরে আনতে হবে আমার কাছে, সেইটাই তোমাদের সবচেয়ে বড় দক্ষিণা দেওয়া হবে পাঞ্চালরাজং দ্রুপদং গৃহীত্ব রণমূধনি। পৰ্য্যায়ত ভদ্রং বঃ সা স্যাৎ পরম দক্ষিণা। যাও। তোমাদের মঙ্গল হোক।

দ্রোণাচার্য এতদিন কুরুবাড়িতে আছেন, রাজপুত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন, অতএব তার শিষ্যদের জানতে বাকি নেই যে, দ্রোণাচার্য কেন এই দক্ষিণা চাইছেন। বিশেষত ভীমের সঙ্গে দেখা হবার মুহূর্তেই পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে নিজের অপমানের কথা সবিস্তারে জানিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। সেইসব সূত্র থেইে হোক অথবা নিজেরা জেনে যাবার ফলেই হোক, হস্তিনাপুরের রাজপুত্রেরা কোনও দ্বিরুক্তি না করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে আরম্ভ করলেন।

দ্রোণাচার্য এইটাই চেয়েছিলেন। দ্রুপদের কাছে অপমানিত হবার পর তিনি যে দ্রুপদকে আক্রমণ করেননি তার একটাই কারণ। তিনি একা, কিন্তু দ্রুপদ বহু সৈন্য-সামন্ত বেষ্টিত এক রাজা। দ্রোণাচার্য চেয়েছিলেন–দ্রুপদের সঙ্গে রীতিমতো একটা যুদ্ধ হোক, যাতে সৈন্য সামন্ত, হাতি-ঘোড়া সবই লাগবে। পাঞ্চালদের সঙ্গে কৌরব-গোষ্ঠীর আনুপূর্বিক শত্রুতা থাকায় মহামতি ভীষ্ম যেমন দ্রুপদের ক্রোধ হবে জেনেও দ্রোণাচার্যকে আশ্রয় দিতে দ্বিধা করেননি, তেমনই আজকে হস্তিনাপুরের রাজপুত্রেরা সৈন্য-সামন্ত নিয়ে দ্রুপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেও বৃদ্ধরা তার মধ্যে কোনও দোষ খুঁজে পেলেন না। তারা বরং পরোক্ষে দ্রোণাচার্যকে মদত জুগিয়ে গেলেন। দ্রুপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার যে একটি গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে এবং সে কথা যে কুরুবৃদ্ধেরা জানতেন না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু সেই তাৎপর্য আছে জেনেও রাজপুত্রদের তারা বাধা দিলেন না। দ্রোণাচার্যও এইটাই চেয়েছিলেন যে, একটি সুগঠিত সৈন্যবাহিনীর দশ-বারোটি অধিনায়ক তার হয়ে যুদ্ধ করে আসুক এবং দ্রুপদকে ধরে নিয়ে আসুক জীবন্ত। লক্ষণীয় বিষয় হল, দ্রোণাচার্য এই যুদ্ধযাত্রায় কৌরবদের সঙ্গী হয়েছেন। কিন্তু তিনি অস্ত্রে হাত লাগাবেন না বলেই ঠিক করেছেন। দ্রুপদকে শায়েস্তা করার জন্য তার শিষ্যরাই যথেষ্ট–এটা বোঝানোর জন্যই দ্রোণ অস্ত্রচালনা করবেন না। কিন্তু তিনি তাদের সঙ্গে যাচ্ছেন।

 কুরুবাড়ির যুবক রাজপুত্রদের কাছে এই প্রথম যুদ্ধ। এই প্রথম তারা রাজ্য ছেড়ে গিয়ে অন্য রাজ্যে আক্রমণ চালাবেন। স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত রাজপুত্রদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা দেখা গেল। দুর্যোধন, কর্ণ, যুযুৎসু, দুঃশাসন, জলসন্ধ, সুলোচন ইত্যাদি কুরুকুমাররা–বিশেষত যাঁরা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র–তারা নতুন উন্মাদনায়–আমি আগে যাচ্ছি! আরে তুই থাক, আমি আগে যাচ্ছি–এইভাবে পাঞ্চাল দেশে এসে উপস্থিত হলেন–অহং পূর্বমহং পূর্ব ইত্যেবং ক্ষত্রিয়ভাঃ।

পাঞ্চাল দেশের নগর যথেষ্ট সুরক্ষিত। নগরের দ্বারে দাঁড়িয়ে ছিলেন নগররক্ষী বীরপালেরা। তাঁদের কারও কাছে কোনও যুদ্ধ লাগার খবর নেই, কোনও প্রতিবেশী রাজা আকস্মিকভাবে পাঞ্চাল আক্রমণ করবেন, গুপ্তচরের মুখে এমন খবরও তাদের কাছে আসেনি। কৌরব-কুমাররা হঠাৎ পাঞ্চালে উপস্থিত হয়ে নগরে প্রবেশ করার প্রথম বাধা দ্বারপালদের হত্যা করলেন। তারপর টগবগে ঘোড়ায় চড়ে অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে সদর্পে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন–প্রবিশ্য নগরং সর্বে রাজমার্গম্ উপাযযুঃ! কুরু সৈন্য এবং রাজপুত্রদের আকস্মিক আক্রমণে সমস্ত পাঞ্চাল নগরের মধ্যে এক গভীর আলোড়ন সৃষ্টি হল।

 মহারাজ দ্রুপদের কাছে এই আকস্মিক আক্রমণের সংবাদ পৌঁছল যথেষ্টই তাড়াতাড়ি। তিনি শুনলেন–বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কৌরব-রাজপুত্রেরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেছে। দ্রুপদ সঙ্গে সঙ্গে তার ভাইদের নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করলেন কৌরবদের বিরুদ্ধে। মনে রাখার দরকার মহারাজ দ্রুপদ গুরু দ্রোণাচার্যের সহপাঠী। একই গুরুর কাছে তিনিও অস্ত্রশিক্ষা করেছেন। কাজেই সাদা ঘোড়ায় সুসজ্জিত একটি সুন্দর রথে চড়ে দ্রুপদ যখন কৌরব–সৈন্য এবং কৌরব–ভাইদের ওপর বাণ বর্ষণ আরম্ভ করলেন, তখন কৌরব-রাজপুত্রদের টনক নড়ল। দ্রুপদ যে এতখানি অস্ত্রনিপুণ ব্যক্তি, এ তারা ভাবতেও পারেননি।

দ্রুপদ এক জায়গায় স্থির হয়ে যুদ্ধ করছেন না। যুদ্ধক্ষেত্রের একদিক থেকে আরেক দিক ক্রমাগত রথ নিয়ে বিচরণ করতে করতে শরবর্ষণ করতে লাগলেন দ্রুপদ। কৌরব রাজপুত্রেরা একেবারে বোকা বনে গেলেন–শরজালেন মহতা মোহন্ কৌরবীং চমূম। তারা বেশ ভয়ও পেলেন। দ্রুপদের বাণ–মোণ এত ক্ষিপ্র, এবং তা সংখ্যায় এতই বেশি যে, একাকী একরথে বিচরণকারী দ্রুপদকে অনেক দ্রুপদ বলে মনে হল কৌরব-রাজপুত্রদের–অনেকমিব সন্ত্রাসা মেনিরে তত্র কৌরবাঃ।

এতক্ষণ ধরে মহামতি দ্রোণাচার্য তার শিষ্য-রাজপুত্রদের সঙ্গে আসছেন, কিন্তু যুদ্ধের বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করছেন না। কীভাবে সৈন্য পরিচালনা করতে হবে, কীভাবে আক্রমণ করতে হবে, অথবা যুদ্ধের কী স্ট্র্যাটেজি হবে–এসব নিয়ে একটি মন্তব্যও তার মুখ দিয়ে বেরচ্ছে না। অর্থাৎ এটাও তার দেখার যে, তাঁর শিষ্যরা কীভাবে তাদের জীবনের এই প্রথম যুদ্ধটির সম্মুখীন হয়। কৌরব রাজপুত্রেরা হই-হই করে যখন অহং পূর্ব অহং পূর্বং রবে আগে-ভাগে বেরিয়ে গেল, তখনও তিনি বাধা দেননি বা বলেননি যে, সবাই একসঙ্গে চল। দ্রোণাচার্য সঙ্গে চলেছেন এইমাত্র, কিন্তু তিনি কোনও নির্দেশ দিচ্ছেন না।

আসলে কৌরব এবং পাণ্ডব রাজপুত্রেরা একই সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। কিন্তু পাঞ্চাল রাজ্যের কাছাকাছি এসে কৌরব রাজপূত্রদের আর ধৈর্য থাকল না। কে আগে দ্রুপদকে জীবন্ত বেঁধে এনে গুরুর পায়ে নিবেদন করতে পারে–বিশেষত পাণ্ডব-ভাইরা যেন দ্রুপদের নাগাল না পায় এবং তাদের পৌঁছনোর আগেই যাতে দ্রুপদকে ধরে নিয়ে আসা যায়–এই চিন্তায় দুর্যোধন-দুঃশাসন-কৰ্ণরা সকলকে পিছনে রেখে আগেই পৌঁছেছিলেন পাঞ্চাল-নগরের দ্বারদেশে।

জায়গাটা নগরের বাইরে আধ ক্রোশটাক হবে। পাণ্ডব-ভাইরা গুরু দ্রোণাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে পাঞ্চাল–নগরের প্রান্তে এসে যখন দেখলেন–কৌরবরা তাদের জন্য কোনও অপেক্ষা করেননি, এবং তারা নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করার জন্য ব্যস্ত, তখন অর্জুন আর কৌরবদের ভিড়ে মিশে যেতে চাইলেন না। তিনি বুঝলেন–যদি কোনওভাবে এই যুদ্ধে জিত হয়, তবে পাণ্ডবদের আলাদা কোনও নামও হবে না এবং যুদ্ধ-জয়ের সমস্ত সাফল্যই দাবি করবেন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা। অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে অর্জুন তার পরিশ্রমের সমস্ত ভাগটুকু উজাড় করে দেবেন না, তা তো হতে পারে না। কিন্তু কৌরবদের অত্যুন্মুখ সাহংকার আচরণ দেখে অর্জুন দ্রোণাচার্যকে বললেন–আচার্য! এঁদের যত ক্ষমতা, কলা-কৌশল আছে, তার প্রদর্শনী আগে হয়ে যাক, তারপর আমরা যাব। আমার বিশেষ ধারণা–এঁরা দ্রুপদকে যুদ্ধে জয় করতে পারবেন না–এতৈরশকঃ পাঞ্চাল্যো গ্রহীতুং রণমূর্ধনি।

অর্জুন জানেন–পাঞ্চাল দ্রুপদ খুব কম বড় যোদ্ধা নন। হই হই করে তাকে জিতে আসা যাবে না। তিনি তাই ভাইদের নিয়ে নগরের বাইরে আধ ক্রোশটাক দূরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। হয়তো ভাবলেন–কৌরবদের আক্রমণে জয় নাই আসুক, এতক্ষণ যুদ্ধশ্রমে দ্রুপদ খানিক ক্লান্ত হবেন অবশ্যই। তখন নতুন উদ্যমে আক্রমণ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। দ্রোণাচার্য বুঝলেন–অন্তত এটা একটা স্ট্রাটেজি। তিনি অর্জুনের কথার কোনও উত্তর দিলেন না বটে, কিন্তু তিনিও পাণ্ডব–ভাইদের সঙ্গে ফিরে গেলেন অর্ধ-ক্রোশ পথ–অর্ধক্রোশে তু নগরাদতিষ্ঠ বহিরেব সঃ। পাণ্ডব অর্জুন অপেক্ষা করতে লাগলেন–কতক্ষণে কৌরব রাজপুত্রদের দম ফুরিয়ে আসে।

 ভবিষ্যতে যিনি মহাযুদ্ধের নায়ক হবেন, সেই অর্জুন এমনই ঠান্ডা মাথায় কাজ করেন। কৌরব–জ্ঞাতিদের তিনি পছন্দ করেন না বলে তিনি ভীমের মতো রুক্ষ ভাষায় ঝগড়া করেন না। তিনি ঠান্ডা মাথায় প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। রঙ্গ যুদ্ধের প্রদর্শনীকালে কর্ণ-দুর্যোধন তাকে যে অপমান করেছিলেন, সেই অপমানের বদলা নেবার এই তো শীতল সময়। তাকে চেঁচাতে হয় না, কথা-কাটাকাটি করতে হয় না, নায়কোচিত গাম্ভীর্যে তিনি সময়ের অপেক্ষা করেন। অন্তত যুদ্ধের ব্যাপারে তিনি কারও অনুগামী নন। তাঁর নিজের ভাবনা আছে, অতএব তার বীরোচিত পৃথত্ব আছে, ইংরেজিতে যাকে বলি Heroic isolation.

.

১০৯.

 ওদিকে পাঞ্চাল-কৌরবদের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ যুদ্ধক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন জ্বলন্ত অঙ্গার-চক্রের মতো। কৌরব রাজকুমাররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে দেখলেন প্রত্যেকেই তারা দ্রুপদের শরবর্ষণের আস্বাদ পাচ্ছেন–অলাতচক্রবৎ সর্বং চরন বাণৈরতপয়ৎ–এবং সে আস্বাদ বড় তীক্ষ্ণ, বড়ই মর্মন্তুদ। দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণ-কৰ্ণরাও চেষ্টা কম করলেন না। এক সময় তাঁরাও দ্রুপদকে বেশ বিপন্ন করে ফেলেছিলেন। এতগুলি মহাবীরের অকৃপণ বাণবর্ষণে একা দ্রুপদ বেশ কাতরই হয়ে উঠেছিলেন–সোতিবিদ্ধো মহেষাসঃ পাৰ্ষতো যুধি দুর্জয়ঃ। কিন্তু তাই বলে তাকে জয় করা গেল না মোটেই। বাণবিদ্ধ দ্রুপদ দ্বিগুণ ক্রোধে প্রতি-আক্রমণ করলেন কর্ণ-দুর্যোধন দুঃশাসনদের। বাণে বাণে প্রতিবিদ্ধ করলেন নায়ক রাজপুত্রদের।

দ্রুপদের উচ্ছ্বাস দেখে পাঞ্চাল নগরের বাজনদাররা যুদ্ধক্ষেত্রের পাশ থেকে শঙ্খ, ভেরী, মৃদঙ্গের তুমুল আওয়াজ তুলল আর অন্যেরা পাঞ্চালরাজের জয়কার ঘোষণা করল সিংহনাদশ্চ সংজজ্ঞে পাঞ্চালানাং মহাত্মনাম। পাঞ্চাল-দেশের মানুষ-জনেরা একটু অন্যরকম। রাজার দুঃখ-সুখের সঙ্গে তাদের দুঃখ-সুখ একরকম। কৌরব রাজপুত্রদের প্রথম এবং অকস্মাৎ আক্রমণে তারা একটু বিভ্রান্ত হয়েছিল বটে, কিন্তু যে মুহূর্তে তারা দেখল–তাদের রাজা দ্রুপদ চালকের ভূমিকায় আরূঢ়, সেই মুহূর্তেই পাঞ্চালদেশের বালক-বৃদ্ধ সবাই কৌরবদের ধাওয়া করল একযোগে–সবালবৃদ্ধান্তে পৌরাঃ কৌরবান অভ্যয়ুস্তদা। নগরবাসী পাঞ্চালেরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রত্যেকেই বাড়িতে একাধিক মুষল রাখতেন। কারণ বিপদে পড়লে খুব তাড়াতাড়ি মুষল ছোঁড়াটাই সবচেয়ে সুবিধের। যারা লোহার মুষল রাখতে পারত না, তারা অন্তত লাঠি রাখত। আজ দ্রুপদের বিপন্নতায় তারা সব মুষল আর লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে এল যুদ্ধক্ষেত্রে। রাজার প্রতি সমব্যথায় তারা বৃষ্টির ধারার মতো মুষল আর লাঠি ছুঁড়ে আঘাত করতে লাগল কৌরব রাজপুত্র এবং তাদের সৈন্যদের ওপর–ততস্থ নাগরাঃ সর্বে মুষলৈৰ্যষ্টিভিস্তদা।

 রাজরোষের সঙ্গে জনরোষ মিশে যাওয়ায় কৌরব রাজপুত্ররা প্রমাদ গণলেন। কৌরব সৈন্যদের মধ্যে আর্ত চিৎকার শোনা গেল। কেউ কেউ বা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়েও যাচ্ছিল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আধ ক্রোশ দূরে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের যুদ্ধনায়ক অর্জুন বুঝলেন–সময় হয়েছে। বুঝলেন–দুর্যোধন-দুঃশাসনরা পারেননি কিছু করতে, পারেননি কর্ণ। তাদের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, পাঞ্চাল নগরবাসীরা পর্যন্ত তাদের পিছনে ধাওয়া করেছে, এবং প্রায় চেঁচিয়ে তাড়াচ্ছে তাদের। ধাওয়া করতে করতে তারা মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আধ ক্রোশ পথও চলে এসেছে এবং সেখানে পাণ্ডবদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা বেশ খানিকটা গালাগালিও দিয়ে গেল পাণ্ডবদের। নেহাত পাণ্ডবরা কোনও অস্ত্রচালনা করেননি বলে তারাও বেশি কিছু না করে শুধু কৌরবদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পাণ্ডবদের গালাগালি দিয়ে চলে গেল–দ্রবন্তি সম নদন্তি স্ম ক্রোশন্তঃ পাণ্ডবান্ প্রতি।

কৌরবদের আর্ত চিৎকারে অর্জুন সচেতন হলেন। বুঝলেন–এইবার যাবার সময় হয়েছে। তিনি গুরু দ্রোণাচার্যকে অভিবাদন জানালেন। দাদা যুধিষ্ঠিরের পায়ে হাত দিয়ে বললেন—আপনাকে আর যেতে হবে না, দাদা! আপনি এখানেই থাকুন। আমরা যা করার করছি।

কথাটা নতুন কিছু নয়। যুধিষ্ঠিকে সারা জীবনই এইরকম তোলা-তোলা করে রেখেছেন অর্জুন। রাশভারী তত্ত্বজ্ঞ জ্যেষ্ঠকে তিনি চিরকাল বৃদ্ধ পিতাটির মতো দেখেছেন এবং জীবনের এই প্রথম যুদ্ধ থেকেই যুধিষ্ঠিরকে সেইভাবেই অভ্যস্ত করেছেন অর্জুন। অতএব এই মুহূর্তে প্রায় আদেশের মতো করে–আপনাকে যুদ্ধে যেতে হবে না–মা যুধ্যস্ব–এমনটি বলে পাঞ্চালদেশের যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা হলেন অর্জুন। কুরুবাড়ির জ্ঞাতি–গোষ্ঠীর মধ্যে তখনও অখণ্ডতা ছিল বলে পালিয়ে যাওয়া সৈন্য-সামন্তরা আরও একবার নতুন নায়কের সঙ্গে জড় হয়ে গেল। অর্জুন নকুল এবং সহদেবকে রাখলেন নিজের দুই পাশে, যাতে তিনি ভয়ঙ্কর যুদ্ধে ব্যস্ত থাকলে দুই ভাই তার রথ-অশ্ব এবং সারথিকে পরপক্ষের আকস্মিক আক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারে। সমস্ত সৈন্য-সামন্তকে পিছনে নিয়ে আগে আগে চললেন মহাবীর ভীমসেন। তার হাতে বিশাল আয়সী গদা-সেনাগ্রগো ভীমসেনঃ সদা ভূদয়া সহ। সমস্ত সেনার সামনে এই মহাবীর থাকলে অনুগামী সৈন্য-সামন্তের যেমন মনোবল বাড়ে, তেমনি শত্রুপক্ষের বাহিনীর মনোবল ক্ষুণ্ণ হয়।

পাঞ্চাল-রাজের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় যুধিষ্ঠিরকে যেভাবে স্থির রেখে অর্জুন তিন ভাইকে নিয়ে চললেন–এর মধ্যে মহাভারতের নায়কের চিত্র পাওয়া যায়। সেই ফরাসি বিদূষী মাদাম বিয়ার্দোর কথা মনে আছে তো? তাঁর গবেষণা মাথায় রাখলে এই যুদ্ধ-গমনের চিত্রকে রীতিমতো দার্শনিক দৃষ্টিতে তথা চাতুর্বর্ণের ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যা করা যায়। ধর্মের প্রতীক যুধিষ্ঠির কখনও যুদ্ধ করেন না। তিনি ব্রাহ্ম-শক্তি। অর্জুন তাকে সিংহাসনে স্থির বসিয়ে রাখেন, আর তারই নীতিজ্ঞতা অনুসরণ করে পরিশীলিত ক্ষাত্র-শক্তির প্রতীক অর্জুন যুদ্ধে চললেন নায়কের মতে, রাজার মতো। শুধু পরিশীলিত ক্ষাত্র-শক্তি দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না। তার জন্য চাই ক্রুডআনরিফাইনড় রঅর্থাৎ নির্মম ক্ষাত্র-শক্তি। ভীমসেন তারই প্রতীক। অপরিশীলিত ক্ষাত্র শক্তি সকারণে ব্যবহৃত হলেও তার নিয়ন্ত্রণ থাকে পরিশীলিত ক্ষাত্র শক্তির হাতে। অর্জুন সেই নিয়ন্তা। বয়সে বড় হলেও নিয়ন্তা অর্জুন ভীমের রাশ টেনে ধরবেন। সময়মতো আবার প্রয়োজনে ব্যবহারও করবেন তাঁকে। আর নকুল-সহদেব বৈশ্য-শূদ্রের প্রতীকী আচরণে পরিশীলিত রাজশক্তিধর নায়কের সেবায় রত হন। তারা তাই পাশাপাশি চলেছেন, তারা অর্জুনের চক্ররক্ষক–মাদ্রেয়ৌ চক্ররক্ষৌ তু ফাল্গুনশ্চ তদাকবরা। কিন্তু কে কোথায়, কী করবে, তার নির্দেশ দেবেন অর্জুন। তিনি নায়ক, নকুল-সহদেবকেও তিনি নিযুক্ত করেন, ভীমকেও তিনি নিযুক্ত এবং নিয়ন্ত্রিত করেন এবং ধর্মকে তিনি বলেন–তুমি স্থির থাকো আমরা আছি। তোমার স্থাপনের জন্যই আমরা।

তত্ত্বকথা থাক, বাস্তব যুদ্ধ-কথায় আসি। শত্রুদের গর্জন-সিংহনাদ স্তব্ধ করে দিয়ে অর্জুনের রথ সবেগে চলল দিঙমণ্ডল নিনাদিত করে। গদা হাতে ভীম যমের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাঞ্চাল সৈন্যদের ওপর। তিনি যুদ্ধবিশারদ ব্যক্তি এবং ভীমের যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য হল তার আকস্মিকতা এবং ক্ষিপ্রতা। তিনি প্রথমে গদার আঘাতে বেশ কিছু পদাতিক সৈন্যকে ভূপতিত করে পাঞ্চালদের হস্তিসৈন্যের দিকে ধাওয়া করে গেলেন–স্বয়মভ্যদ্রব ভীমো নাগানীকং গদাধরঃ। ভীম যে সব ছেড়ে আগে পাঞ্চালদের হস্তিসৈন্যের দিকে ধাবিত হলেন, তার একটা কারণ আছে। তখনকার দিনের যে কোনও সেনাবাহিনীতে হস্তিসৈন্যের মর্যাদা ছিল সবচেয়ে বেশি। যে কোনও সময়ে শত্রুসৈন্য বিমর্দন করার পক্ষে গজারোহী বাহিনী ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। ভীম চাইলেন–তাঁর লৌহ-গদার আঘাতে তিনি যদি বেশ কিছু হস্তীর, মস্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে পারেন তবে শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙে যেতে বাধ্য।

ভীম এই পরিকল্পনাতেই এগোলেন এবং বজ্রাঘাতে পর্বতশিখরের মতো পাঞ্চাল-সৈন্যের হাতিগুলি মারা পড়তে লাগল–পতন্তি দ্বিরা ভূমৌ…ভিন্ন-মস্তক-পিণ্ডকাঃ। অশ্বারোহী এবং রথী পুরুষেরাও বাদ গেল না। ভীমের আক্রমণ আসুরিক এবং ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্র গোপালক রাখাল যেমন অনেকগুলি গোরু একসঙ্গে তাড়িয়ে নিয়ে যায় ভীম সেইরকম তাড়িয়ে নিয়ে চললেন পাঞ্চালদের। একইসঙ্গে তিনি নিজেদের রথী এবং হস্তিসেনার পথ করে দিলেন পাঞ্চালদের পিছনে।

ঠিক এই সময়েই অর্জুনের কাজ আরম্ভ হল। তার একমাত্র লক্ষ্য দ্রুপদ রাজা এবং তাও জীবিত অবস্থায়। প্রচুর বাণবর্ষণে তিনি একদিকে পাঞ্চালদের হস্তিসৈন্য হ্রাস করতে আরম্ভ করলেন অন্যদিকে দ্রুপদকেও বিদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। সৃঞ্জয়-পাঞ্চালরাও কিছু কম যান না। তাদের যুদ্ধ-নায়কেরাও সিংহনাদ করে অর্জুনকে প্রতিবিদ্ধ করল। অর্জুন আবার সব সহ্য করতে পারেন কিন্তু কারণহীন সিংহনাদ সহ্য করতে পারেন না। সহ্য করলেনও না–সিংহনাদস্বনং ত্বা নামৃষ্যৎ পাকশাসনিঃ। ঘোর যুদ্ধ আরম্ভ হল। অর্জুনের বিশাল বাণজালে সমস্ত পাঞ্চাল–সৈন্য আচ্ছন্ন হল।

অর্জুন দ্রুপদরাজকে জীবিত ধরার প্রয়াসে তার খুব কাছাকাছি চলে এলেন। সিংহ যেমন হাতি ধরে সেই কৌশলে অর্জুন দ্রুপদকে ধরার জন্য এগোতেই সমস্ত পাঞ্চাল সৈন্যমধ্যে হাহাকার রব উঠল–তত হলাহল–শব্দ আসীৎ পাঞ্চালকে বলে। দ্রুপদের ভাই সত্যজিৎ তৈরিই ছিলেন। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন অর্জুনের ওপর। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হল বটে, তবে তিনি শেষরক্ষা করতে পারলেন না, শেষ পর্যন্ত অর্জুনের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে পালিয়ে গেলেন অন্যত্র। এবার আরম্ভ হল আসল যুদ্ধ দ্রুপদের সঙ্গে অর্জুনের।

দ্রুপদ নিজে যত বড় যোদ্ধাই হোন, অর্জুনের তুলনায় তার বয়স বেশি এবং এতক্ষণ যুদ্ধ করে তিনি ক্লান্ত হওয়ায় অর্জুনের যুদ্ধবেগ তিনি স্তব্ধ করে দিতে পারলেন না। অর্জুন সুতীক্ষ্ণ শরক্ষেপে তার ধনুক কেটে ফেললেন এবং তার সারথি এবং ঘোড়াগুলিকে বিদ্ধ করলেন প্রায় একই সঙ্গে। দ্রুপদের নড়বার পথ রইল না। ধনুক-বাণ ফেলে দিয়ে উন্মুক্ত তরবারি হাতে লাফ দিয়ে নিজের রথ থেকে নেমে পড়লেন অর্জুন এবং এক মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন দ্রুপদের রথে। দ্রুপদ রথে নিরস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন আর অর্জুন তার রথের মাঝখানে তরবারি উঁচিয়ে দাঁড়ালেন রথের ঈষাটি ধরে। রথের ঈষা হল রথের চাকা দুটি যে বৃহৎ কাষ্ঠটির সঙ্গে আটকানো থাকে সেটা। অর্থাৎ নিজে রথ চালিয়ে পালানোর একমাত্র পথটিও দ্রুপদের বন্ধ হয়ে গেল। রথের ঈষা ধরে থাকলে রথ চলবেই না। এই প্রথম উন্মুক্ত কৃপাণ হাতে একবার বীরোচিত সিংহনাদ করলেন অর্জুন।

দেশের রাজা তথা প্রধান যোদ্ধা এইভাবে বাঁধা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুপদের সৈন্যেরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে লাগল। পুরাকালে গরুড় যেমন মহাসমুদ্র আলোড়িত করে সর্পরাজকে ধরেছিলেন, অর্জুনও তেমনি পাঞ্চালদের সৈন্য-সমুদ্র বিক্ষুব্ধ করে দ্রুপদকে ধরে ফেললেন–বিক্ষোভ্যাম্ভোনিধিং তাéস্তং নাগমিব সোগ্রহীৎ। অর্জুন এবার জীবিত দ্রুপদকে নিয়ে খঙ্গ হাতে বেরিয়ে চললেন রণক্ষেত্র থেকে। বেরিয়ে যেতে যেতে দেখলেন–মহাবীর ভীমসেন তখনও সৈন্য বিতাড়ণে রত এবং তিনি দ্রুপদ রাজার রাজধানী একেবারে তছনছ করে দিচ্ছেন। তার এই ধ্বংস–প্রয়াসে তার সহায় হয়েছেন অন্যান্য রাজকুমারেরা–মমৃদুস্তস্য নগরং দ্রুপদস্য মহাত্মনঃ।

দ্রোণাচার্যের প্রথম অস্ত্র পরীক্ষাকালে যে মহাবীর শুধু বৃক্ষস্থিত পক্ষীটির মাথাটুকুই দেখতে পাচ্ছিলেন, আর কিছু নয়, এখানে এই বিরাট রণক্ষেত্রেও তার নীতি–নিয়ম একই রকম আছে। তার লক্ষ্য ছিল শুধু দ্রুপদকে জীবিত ধরা, আর কিছু নয়। দ্রুপদকে জীবিত ধরার পর তার সৈন্য–শাতন করা বা তার নগর বিমর্দন করা তার লক্ষ্যও নয়, উপলক্ষ্যও নয়। কিন্তু ভীম এমনই একজন উত্তেজনাপ্রবণ ব্যক্তি যিনি যুদ্ধ আরম্ভ করে ফল পেলে আর থামতে পারেন না। ক্রমাগত তার আক্রোশ বেড়েই চলে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দ্রুপদকে নিয়ে যেতে যেতে অর্জুন যখন দেখলেন–ভীম ভয়ঙ্করভাবে পাঞ্চাল–নগর ধ্বংস করতে উদ্যত তখন তিনি হাত তুলে ভীমকে বারণ করে বললেন–দাদা আমার! আপনি মনে রাখবেন–ভারতবর্ষীয় রাজকুলের মধ্যে অতিমান্য দ্রুপদ রাজা কিন্তু কুরুবাড়ির রাজাদের পরম আত্মীয়-সম্বন্ধী কুরুবীরাণাং দ্রুপদো রাজসত্তমঃ গুরু আমাদের কাছে দক্ষিণা চেয়েছেন, সে কাজ আমাজের সম্পূর্ণ। আপনি শুধু শুধু দ্রুপদের সৈন্য–ধ্বংস করবেন না–মা বধীস্তদবলং ভীম গুরুদানং প্রদীয়তাম।

পরিশীলিত ক্ষাত্র রাজশক্তি অপরিশীলিত ক্ষাত্র শক্তির রাশ টেনে ধরল, কারণ তার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। মহাবীর ভীমের অন্তরে যুদ্ধের বেগ এসে গিয়েছিল। তিনি নিজে সে বেগ সংযত করতে পারছিলেন না; কিন্তু ছোট ভাই হলেও অর্জুনের এই অনুরোধের মধ্যে এমনই এক ব্যক্তিত্বময় আদেশ লুকিয়ে আছে, যা না মেনে পারা যায় না। ভীম তার প্রারব্ধ যুদ্ধ-সরসতায় অতৃপ্ত থেকে গেলেন কিন্তু অর্জুনের মেঘগম্ভীর স্বল্পবাক্য অনুরোধ মেনে তাকে ফিরে আসতেই হল–অতৃপ্তে যুদ্ধ-ধর্মেযু ন্যবৰ্তত মহাবলঃ।

অর্জুনের মিত-সার বাক্যের মধ্যে শুধু ভীমের প্রতি গম্ভীর এক নির্দেশ ছিল, তাই শুধু নয়, ওই অল্প কটি কথা বলে তিনি বিজিত এবং নিজের হাতে আবদ্ধ শত্রুর প্রতি চরম সম্মান জানিয়েছেন। দ্রুপদের সামনে খঙ্গ উঁচিয়ে রেখেও তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, হঠাৎ এই আকস্মিক আক্রমণের দায় তার নিজের নয়। দ্রুপদকে তিনি শত্রু তো মনে করেনই না, বরঞ্চ কুরুবীরদের পরম সম্মানিত আত্মীয় বলে মনে করেন। তবু যে তাকে যুদ্ধ জয় করতে হয়েছে। এর মধ্যে তার আপন শত্রুতার কোনও চরিতার্থতা নেই, তিনি তার গুরুর আজ্ঞাবাহীমাত্র। গুরুর শত্রুতা মেটানোর জন্যই যে তিনি নিজে থেকে যুদ্ধে নেমেছেন, তাও নয় তাঁকে গুরুদক্ষিণা দেবার জন্য এই অদ্ভুত অভিযানে প্রবৃত্ত হতে হয়েছে। একটি মাত্র পংক্তি, তাও ভীমের উদ্দেশে ব্যবহার করে, অর্জুন বুঝিয়ে দিতে চাইলেন যে, জীবনের প্রথম গুরুদক্ষিণার দায় এমনই যে, তার অনিচ্ছা থাকলেও গুরুর কারণেই তাকে যুদ্ধে নামতে হয়েছে। নইলে তিনি কুরুবংশের ইতিহাস-বিস্মৃত কোনও অধম ব্যক্তি নন। অর্জুন জানেন–পাঞ্চাল-সৃঞ্জয়রা প্রসিদ্ধ কুরুবংশেরই এক শাখা। নানা কারণে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সামাজিক বিরোধ ঘটলেও তাঁদের প্রতি আত্মীয়তা ভুলে যাননি অর্জুন। দ্রুপদকে তিনি হারিয়ে দিয়েও তাঁকে মর্যাদা দিয়েছেন রাজসত্তম বলে, পরম আত্মীয় বলে।

মহারাজ দ্রুপদ এই বিপন্ন অবস্থায় শত্রুর রথে তরবারি উঁচিয়ে থাকা এক বীর যুবকের কথা শুনে মনে মনে আপ্লুত হলেন নিশ্চয়। এই অসাধারণ বীরকে তিনি হৃদয়ে ধারণ করে রাখলেন। বীর যুবকের কাছে পরাজিত হওয়ার লাঞ্ছনা ভুলে একবারের তরে অন্তত ওই কৃষ্ণবর্ণ যোদ্ধার দিকে আপ্লুত চক্ষু প্রসারণ করলেন মহারাজ দ্রুপদ। এই ছেলেটিকে তিনি মনে রেখে দিলেন।

অর্জুন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে জীবিত ধরে নিয়ে আসছেন দেখে দ্রুপদের প্রধানমন্ত্রীও তার সঙ্গে সঙ্গে এলেন। রাজার অস্তিত্ব না থাকলে তার মন্ত্রী-অমাত্যের অস্তিত্ব থাকে না। অতএব রাজা ধরা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সপ্তাঙ্গ রাজ্যের দ্বিতীয় অঙ্গ মন্ত্রীও স্বেচ্ছায় এলেন দ্রুপদের সঙ্গে। অর্জুন সেই অমাত্য-সহ দ্রুপদকে জীবিত অবস্থায় নিবেদন করলেন গুরু দ্রোণাচার্যের পায়ে–উপাজহঃ সহামাত্যং দ্রোণায় ভারতৰ্ষভ।

দ্রুপদের রাজ-অহংকারের সামান্যও অবশিষ্ট নেই এখন, রাজ্য-সম্পত্তি এই মুহূর্তেই হৃত হতে পারে, তার মধ্যে তিনি শত্রুর হাতে ধরা পড়েছেন। যিনি এককালে বাল্যবন্ধু দ্রোণাচার্যকে বন্ধু বলতে রাজি হননি, এখন তিনি অত্যন্ত হীন অবস্থায় সেই বন্ধুর পায়ে নিবেদিত। তার সমস্ত কিছু নির্ভর করছে বৃদ্ধ দ্রোণাচার্যের ওপর। দ্রোণাচার্য কিছু ভোলননি। যে অপমান সহ্য করে পুত্র–পরিবার সহ পাঞ্চাল রাজ্য থেকে চলে এসেছিলেন, সেই অপমান মাথায় রেখেই তিনি বললেন–আমি আমার শক্তিতে তোমার রাজ্য বিধ্বস্ত করে তোমার রাজধানীও দখল করে নিয়েছি। তোমার জীবন থাকবে কি না থাকবে, তাও এখন নির্ভর করছে আমার ইচ্ছের ওপর। ভেবে দেখ তো–অন্তত এখন তুমি আমাকে বন্ধু বলে স্বীকার করতে পার কিনা–প্রাপ্য জীবং রিপুবশং সখিপূর্বং কিমিষ্যতে।

দ্রোণাচার্য এবার একটু নাটুকে হাসি হেসে বললেন–প্রাণের ভয়ে ভীত হয়ো না, দ্রুপদ! আমরা বামুন মানুষ। ক্ষমাই আমাদের ধর্ম–মা ভৈঃ প্রাণভয়াদ বীর ক্ষমিণণা ব্রাহ্মণা বয়ম্। ছোটবেলায় পিতার আশ্রমে একসঙ্গে খেলা করেছি তোমার সঙ্গে, কাজেই তোমার ওপর স্নেহ-প্রীতি কিছু কম নেই আমার। দ্রোণাচার্য এবার দ্রুপদের পূর্ব-অপমান ফিরিয়ে দিয়ে বললেন–তবে কিনা তুমি বলেছিলে–রাজা ছাড়া রাজার বন্ধু হতে পারে না। তাই আমাকে একটু রাজা হওয়ার ব্যবস্থা করতেই হল–তস্মাৎ প্রযতিতং রাজ্যে–এখন মুশকিল হল, তোমারও তো কোনও রাজ্য নেই এখন। তো তুমিই যদি রাজা না হও, তাহলে তোমার সঙ্গেই বা আমার বন্ধুত্ব থাকে কী করে? আর ঠিক সেই জন্যই আমি তোমাকে তোমার অর্ধেক রাজ্য ফিরিয়ে দেব–রাজ্যস্যামবাপ্লহি। হাজার হোক, তুমি আমার বন্ধু ছিলে, তোমার সঙ্গে সেই বন্ধুত্বই আমি ফিরে পেতে চাই–প্রার্থয়েয়ং ত্বয়া সখ্যং পুনরেব জনাধিপ।

পাঞ্চাল রাজ্যের কোন অর্ধেক দ্রুপদ পাবেন আর কোন অর্ধেক দ্রোণাচার্য নিজের জন্য রাখবেন সে সম্বন্ধেও নিজের টার্ম ডিকটেটকরলেন দ্রোণাচার্য। বললেন–গঙ্গার দক্ষিণ দিকে রাজা থাকবে তুমি, আর গঙ্গার উত্তরাঞ্চলে রাজা হব আমি–রাজাসি দক্ষিণে কূলে ভাগীরথ্যাহমুত্তরে। এইভাবেই আমার বন্ধু হলে তুমি। দ্রুপদ একেবারে নিরুপায়। শত্রুর হাতে তিনি বন্দী হয়েছেন। অতএব তার হৃদয় ক্রোবজর্জর হলেও দ্রোণকে দু-চার কথা শুনিয়ে দেবার উপায় নেই তার। সবিনয়ে, নিতান্ত মৌখিকতা বজায় রাখার জন্যই দ্রুপদ বললেন–আপনি মহান ব্যক্তি এবং আপনার অসীম পরাক্রম। আপনি আমাকে আমার রাজ্যের অর্ধেক ফেরত দিয়েছেন, তাতেই আমার সন্তুষ্টি ঘটেছে। আপনার সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব হোক আমার–প্ৰীয়ে ত্বয়াহং ত্বত্তশ্চ প্রীতিমিচ্ছামি শাশ্বতীম্।

দুই পরাক্রমশালী মহাবীরের মধ্যে যদি বিরোধ বাধে এবং তার মধ্যে যদি আবার মর্যাদা, মান, অপমান যুক্ত হয় তবে সেই বিরোধ কখনও মেটে না। চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব তো দূরের কথা। দ্রোণ এই মুহূর্তে দ্রুপদের মৌখিক আচরণেই সন্তুষ্ট হলেন এবং সাদরে তাকে রাজ্যের অর্ধেক ফিরিয়ে দিলেন মহান দাতার মতো।

সুপ্রসিদ্ধ পাঞ্চাল নগরী ভাগ হয়ে গেল। কৌরব বংশের মহারাজ অজমীদের পুত্র পরম্পরায় পাঞ্চাল নগরে যে সুপ্রসিদ্ধ রাজারা রাজত্ব করে গেছেন–সৃঞ্জয়-সোমক ইত্যাদি তারা কিন্তু দক্ষিণ এবং উত্তর পাঞ্চাল দুই-ই ভোগ করেছেন। অজমীঢ়ের দুই ছেলে যে রাজ্য প্রথমে অধিকার করেছিলেন, তার নাম কৃবি, যা পাঞ্চাল-নগরের পূর্ব-নামা কৃবি অধিকার করে ভাগীরথীর দুই কূলে অজমীঢ়ের দুই ছেলে রাজা হন দক্ষিণ এবং উত্তর পাঞ্চালের। দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজধানী ছিল কাস্পিল্য এবং তার সঙ্গে আরেক বড় শহর হল মাকন্দী। আর উত্তর পাঞ্চালের রাজধানী হল অহিচ্ছত্র।

দ্রোণ নিজের জন্য রাখলেন অহিচ্ছত্রের অধিকার–অহিচ্ছত্রঞ্চ বিষয়ং দ্রোণঃ সমভিদ্যত। অহিচ্ছত্র উত্তরপ্রদেশের বেরিলি জেলায় অনোলার কাছে এখনকার রামনগর। একটু পৌরাণিক নামে এঁকে ছত্রবতীও বলা হয়। দ্রুপদ রাজা হলেন দক্ষিণ পাঞ্চালে এবং তার রাজধানীর নাম কাস্পিল্য, যা মোটামুটি এখনকার বুদায়ুন এবং ফরুকখাবাদ। মাকন্দী দ্রুপদের অধিকারে ছিল বলে তাঁর রাজত্ব দক্ষিণে চম্বল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল–দক্ষিণাংশ্চাপি পাঞ্চালা যাবচ্চমতী নদী। পাঞ্চালের উত্তরেই কুরুদেশ।

হৃত রাজ্যের অর্ধেকটা উদ্ধার হল বটে, কিন্তু সেটা দ্রোণাচার্যের দয়ায় উদ্ধার হওয়ায় দ্রুপদের মনে কোনও সুখ রইল না। তিনি কাম্পিল্যে ফিরে গিয়ে পাঞ্চাল শাসন করতে আরম্ভ করলেন বটে, কিন্তু তার অন্তরে জেগে রইল গভীর দুঃখ–সোধ্যাবস দীনমনাঃ কাস্পিল্যঞ্চ পুরোত্তমম্। এক নতুন জটিলতাও তার হৃদয় অধিকার করল। বারবারই তার মনে হতে লাগল–দ্রোণাচার্য শুধু বামুন বলে তার ব্রাহ্মশক্তিতে দ্রুপদকে পরাভূত করেছেন। ক্ষত্রিয়ের পরাক্রম কোনও কাজে লাগল না এবং হয়তো ক্ষত্রিয়ের ভুজবলে তাকে পরাভূত করা যাবে না–ক্ষাত্রেণ চ বলেনাস্য নাপশ্যৎ স পরাজয়। তিনি ভাবলেন–অলৌকিক ব্রাহ্মশক্তিতেই দ্রোণাচার্যকে শেষ করবেন তিনি। দ্রুপদ এখন একটি পুত্র চান, যে পুত্র জন্মাবে যাগ-যজ্ঞের অলৌকিক সাধনে। দ্রুপদ রাজধানী থেকে বেরিয়ে পড়লেন একজন উপযুক্ত যাজকের সন্ধানে–পুত্রজন্ম পরীহ্মন্ বৈ পৃথ্বীমনুচচার হ। এমন একজন যাজক, যিনি মন্ত্রবলে দেবতার আহ্বান করবেন এবং সেই যজ্ঞের শক্তিতেই জন্ম নেবে দ্রোণ-ঘাতক পুত্র। দ্রুপদ মনে মনে দ্রোণকে হত্যা করে ফেলেছেন, এখন তিনি কার্যক্ষেত্রে দ্রোণ-হত্যার জন্য একটি অলৌকিক শক্তিধর পুত্র চান।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *