৩০.
একদৃষ্টি শুক্রাচার্য ধুম-তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে যেদিন সঞ্জীবনী মন্ত্র পেলেন মহাদেবের কাছে, সেদিন তার দৃষ্টি পড়ল ইন্দ্রকন্যা জয়ন্তীর ওপর। কতকাল ধরে এই রমণী তার ভোজন-শয়ন, জপ-যজ্ঞ-তপস্যার ওপর নির্বাক দৃষ্টি রেখেছে। একদিনের তরেও সে বলেনি–আমি ইন্দ্রকন্যা, আমি এই চাই আপনার প্রসন্নতার পরিবর্তে। শুধু প্রসন্নতাই যে চেয়েছে তার দিকে আজ ঘুরে দাঁড়ালেন শুক্রাচার্যকে তুমি রমণী? তুমি কি কারও পত্নী? কেনই বা তুমি আমার কষ্ট দেখে কষ্ট পাও–কস্য ত্বং সুভগে কা বা দুঃখিতে ময়ি দুঃখিতা? আমি কঠোর তপস্যায় মগ্ন, আর তুমি সব সময় আমাকে রক্ষা করে চলেছ। আমার প্রতি মমতায় আমাকে তুমি শুধু প্রশ্রয়ই দিয়েছ, আর তোমার দিক থেকে ছিল শুধু আত্মদমন, নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করা। আমি বড় খুশি হয়েছি। বল তুমি কী চাও, তোমার সমস্ত প্রার্থনা আমি পূরণ করব–কিমিচ্ছসি বরারোহে কস্তে কামঃ সমৃধ্যতাম্।
ইন্দ্রকন্যা জয়ন্তী নিজের পরিচয় দিলেন না। শুধু সলজ্জে বললেন–আমি কী চাই জানি না! আপনি আপনার মনের তপস্যায় জেনে নিন আমি কী চাই? শুক্রাচার্য তপস্যায় বসেন। স্মরণ করেন–প্রথম সেই দিনটির কথা, যেদিন মধ্যাহ্নের সূর্য-দন্ধ তার মাথার ওপর আঁচল বিছিয়ে ছায়া করে দাঁড়িয়েছিল এই রমণী। একে একে স্মরণ-তপস্যায় ভেসে আসে জয়তীর। নানা চিত্রপট–শয়নে বসনে আসনে অশনে, তার উৎকট তপশ্চরণে তপস্বিনী এক রমণীর সদা-জাগ্রত সুরক্ষার ছবি। কিন্তু কেন? কেন এই শুষ্ক-রুক্ষ মুনির জন্য রমণীর এই রমণীয় মমতা? শুক্রাচার্য বুঝলেন-রমণী কী চায়। তবু এই অভিনব সুন্দরীর আপন মুখে শুনতে ইচ্ছে হয় সেই কথা–যা বার বার উচ্চারণে লাঘবতা প্রাপ্ত হলেও চিরন্তন। শুক্রাচার্য বললেন-আমি আমার মনশ্চক্ষুতে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি তোমার মনের কী অভিলাষ। তবু তুমি একবার স্পষ্ট করে স্বকণ্ঠে বলো সে কথা, আমি শুনতে চাই।–আতং ময়া তথাপি ত্বং ব্ৰহি যন্মনসেঙ্গিত। তুমি যা বলবে আমি শুনব। করব।
জয়ন্তী বললেন আমি ইন্দ্রের কন্যা। জয়ন্তের কনিষ্ঠা ভগিনী। আমি আপনাকে ভালবাসি, আচার্য। আমি আপনার সঙ্গ কামনা করি। আপনার সঙ্গে মিলিত হতে চাই ধর্মের নিয়ম-বিধি অনুসারে-রহস্যে ত্বয়া মহাভাগ ধর্মতঃ প্রীতিপূর্বক শুক্রাচার্য সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন–দশ বছর। দশ বছর আমার সঙ্গে তুমি সুখে কালাতিপাত কর, সবার অগোচরে অদৃশ্যভাবে। শুক্রাচার্য সম্মতা জয়ন্তীকে গৃহে নিয়ে গেলেন। নিজগৃহে কিনা বলা যায় না, তবে কোনও গৃহে নিশ্চয়। তারপর বিধিসম্মতভাবে তার পাণিগ্রহণ করে শুক্রাচার্য ইন্দ্রকন্যা জয়ন্তীর সঙ্গসুখে মত্ত হলেন–এবমুক্তা গহং গত্বা জয়ত্যাঃ পাণিমুহ।
দৈত্য-দানবদের মধ্যে হই-হই পড়ে গেল। তারা শুনেছেন–তাদের গুরু তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে ফিরে এসেছেন। মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা এখন শুক্রাচার্যের করায়ত্ত। তারা সকলে ছুটে এলেন গুরুর বাড়িতে। কিন্তু কোথায় কী, গুরুকে তারা চোখের দেখাও দেখতে পেলেন না। সেই যে শুক্রাচার্য জয়ন্তীকে বলেছিলেন–তোমার সঙ্গসুখে থাকব দশ বছর, সকলের অগোচরে অদৃশ্য হয়ে–সর্বভূতৈরদৃশ্যা চ রমস্বেহ যদৃচ্ছয়া। অতএব মায়াবৃত শুক্রাচার্যকে অসুরেরা দেখতে পেলেন না। দৈত্য-দানবরা তাঁদের পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানতেন যে তাদের আচার্য অসম্ভব ‘মুডি’ মানুষ। কখন তার কী ইচ্ছে হয় কেউ বলতে পারে না। তারা যেমন গুরুর সিদ্ধিলাভ এবং ফিরে আসার সংবাদ পেয়েছিলে, তেমনই এও নিশ্চয়ই শুনেছিলেন যে, এক রমণীকে ভালবেসে শুক্রাচার্য তাকে নিয়ে এসেছেন নিজের বাড়িতে। মায়াবৃত’–কথাটার মধ্যে যতই অলৌকিকতা থাকুক, আমাদের ধারণা–অসুরেরা যখন শুক্রাচার্যের খবর পেয়ে দেখতে এসেছিলেন, তখন দেখাও নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। কিন্তু জয়ন্তীর সহবাসে শুক্রাচার্যের সরস অবস্থা দেখে তারা তাকে আর বিরক্ত করার সাহস পাননি। তারা পালিয়েছেন। পুরাণের কথা থেকেও তা বোঝা যায়। গুরুকে না দেখে অসুর-বীরেরা সিদ্ধান্ত নিলেন–তাদের গুরুর এখন এই রকমটাই ভাল লাগছে, তিনি যখন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে চাইছেন, অতএব তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না-দাক্ষিণ্যং তস্য ত বুধ্বা প্রতিজম্মু যথাগত। তারা ফিরে গেলেন।
আগেও দেখেছি–অসুরেরা নিজেদের সততায় ঠিক থাকেন। তারা যখন ঠিক করলেন– গুরুর বাড়ির কাছাকাছিও থাকবেন না। অতএব তারা থাকেননি। তারা যখন ভাবলেন–গুরু যেদিন নিজের ইচ্ছেয় আসবেন, সেদিনই তার সঙ্গে দেখা হবে; অতএব তারা বাড়িতেই গুরুর অপেক্ষায় বসে রইলেন। শুক্রাচার্যের ধারও মাড়ালেন না। ঠিক এই সুযোগেই ইন্দ্রের খেলা শুরু হল। দেবপক্ষপাতী পৌরাণিকেরা ছোট্ট করে জানিয়েছেন–ইন্দ্রকন্যা জয়ন্তী পিতার কার্যসাধনের জন্যই শুক্রাচার্যকে দশ বৎসর ব্যস্ত করে রেখেছিলেন ইন্দ্রিয়সুখের মোহজালে-পির্থে দশবর্ষানি জয়ন্ত্যা হিতকাম্যয়া। কিন্তু আমাদের ধারণা–এই মোহজালে শুক্রাচার্য নিজেই ধরা দিয়েছিলেন। দশ বৎসর সময়টিও তাঁরই দেওয়া। ইন্দ্রিয়ের সকল দ্বার রুদ্ধ করে অনেক বছর তপস্যা করার পর আচার্যের এই মুক্তি কামনাও কোনও অস্বাভাবিক কাণ্ড নয়। জয়ন্তীও কোনও জাল বিস্তার করেননি। তিনি শুক্রাচার্যের ছন্দচারিণী হয়েছেন তাঁরই ইচ্ছায়।
হ্যাঁ, এটা অবশ্যই ঠিক, ইন্দ্র তাঁকে যে কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন, সে কাজ সম্পন্ন হয়েছে অন্যভাবে। অর্থাৎ তিনি জয়ন্তীকে দিয়ে শুক্রাচার্যের তপস্যা ভাঙিয়ে সঞ্জীবনী মন্ত্র না পাওয়ার মতো ব্যাঘাত কিছু সৃষ্টি করতে পারেননি। কিন্তু আপাতত দশ বৎসর সময় পাওয়ায় ইন্দ্র অন্য খেলায় মন দিলেন। তিনি যখনই দেখলেন–দৈত্য-দানবরা জয়ন্তী আর শুক্রাচার্যকে রমমান অবস্থায় রেখে চলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে পরামর্শ করতে বসে গেলেন–রমমানং তথা আত্বা শক্রঃ প্রোবাচ তং গুরুম। ইন্দ্র বললেন–একটা ব্যবস্থা করুন গুরুদেব। ছলছুতো করে হোক, যেভাবে হোক, আমাদের কাজটা তো আপনাকে করে দিতে হবে–অস্মাকং কুরু কার্যং তং বুদ্ধ্যা সঞ্চিস্ত্য মানদ।
বৃহস্পতি নানা ভাবনা-চিন্তা করে শুক্রাচার্যের রূপ ধারণ করলেন। শুক্রাচার্যের যেমন জামা-কাপড়, যেমন দাড়ি, যেমন ভাবভঙ্গি এমনকি তিনি যেভাবে কথা বলেন-সেইভাবে সব। রপ্ত করে দেবগুরু বৃহস্পতি অসুর-গুরুর রূপ ধরে দৈত্য-দানবদের সামনে উপস্থিত হলেন। দৈত্য-দানবরা শুক্ররূপী বৃহস্পতিকে একটুও চিনতে পারল না। আর যেটুকু বা অন্যরকম দেখাচ্ছিল তা নিশ্চয়ই তারা মেনে নিলেন এই ভেবে যে, বহুদিন ব্যাপী তপস্যার ফলে হয়তো আচার্যের চেহারায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবে তারা এসব কিছু ভাবেনইনি, শুক্রাচার্যের রূপধারী বৃহস্পতির ছলাকলায় তারা এতটুকুও সন্দেহ প্রকাশ করেননিন বিদুস্তে গুরোমায়াং কাব্যরূপ-বিভাবিনীম। এতকাল পরে গুরুকে দেখে তারা সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করলেন। যথাবিধি অভিনন্দন করে একপাশে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালেন–প্রণম্য সংস্থিতাঃ সর্বে।
শুক্ৰবেশী গুরু বললেন–তোমরা সব ভাল তো? তোমাদের ভালর জন্যই আমি এতকাল দুশ্চর তপস্যা করে ভগবান শ্যুকে তুষ্ট করেছি। লাভ করেছি সঞ্জীবনী বিদ্যা। তোমাদের সে বিদ্যা একে একে শিখিয়ে দেব–অহং বোধরপয়িষ্যামি প্রাপ্ত বিদ্যা ময়া হি সা। অসুররা আনন্দে আত্মহারা হলেন–তাদের গুরু সফল হয়ে ফিরেছেন, আর তাদের কোনও চিন্তা নেই। দেবতাদের আক্রমণে আহত কিংবা হত হলেও বেঁচে ওঠার সমস্যা আর রইল না। তারা সব শুক্ৰবেশী বৃহস্পতির পিছন পিছন ঘুরঘুর করতে লাগলেন। কোনও কোনও পুরাণ জানিয়েছে যে, বৃহস্পতি মৃত-সঞ্জীবনী বিদ্যা জানতেনই না, তো শেখাবেন কী করে? তিনি নাকি ওই পুরো দশ বছর ধরে অসুরদের অহিংসাব্রত শিখিয়েছিলেন।
সে যাই হোক, এদিকে দশ বৎসর কেটে গেলে শুক্রাচার্যেরও জয়ন্তীর মোহ খানিকটা কেটে গেল। ইতোমধ্যে জয়ন্তীর গর্ভে তার অসাধারণ সুন্দরী একটি মেয়ে হয়েছে। কন্যার নাম দেবযানী-সময়ান্তে দেবযানী সদ্যোজাতা সুতা তদা। শুক্রাচার্য এবার তার অসুর-যজমানদের কথা স্মরণ করলেন। তিনি জানেন-কী অসীম ধৈর্য নিয়ে তার শিষ্যেরা তার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবেন–আশয়া মম মার্গং তে পশ্যন্তঃ সংস্থিতা কিল। জয়ন্তীকে ডেকে শুক্রাচার্য বললেন–একবার শিষ্যদের একটু দেখে আসি। তারা আমার ভক্ত, তাদের যাতে দেবতাদের থেকে ভয় না হয়, সেটা তো আমায় দেখতে হবে–মা দেবেভ্যো ভয়ং তেসাং মদ্ভক্তানাং ভবেদিতি। জয়ন্তী শুদ্ধমনে–পুরাণের ভাষায়, জয়ন্তী ধর্মবিত্তমা’, শুক্রাচার্যের কথায় সম্মতি দিয়ে বললেন–আপনি যজমানদের দেখতে যাবেন, অসুরদের যাজক হিসেবে সেই তো আপনার ধর্ম, আমি আপনার ধর্মলোপ করব না–এষ ব্ৰহ্মণ সতাং ধর্মো ন ধর্মং লোপয়ামি তে। আপনি স্বচ্ছন্দে যান।
শুক্রাচার্য জয়ন্তীর প্রতি মমতায় পুনরাগমনের অঙ্গীকার করে অসুরদের কাছে গেলেন। গিয়ে দেখলেন–অভাবিত কাণ্ড। দেবগুরু বৃহস্পতি তারই বেশ ধরে অসুরদের নানা উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। শুক্রাচার্য অসুরদের ডেকে বললেন-বাছারা! বৃহস্পতি তোমাদের প্রতারিত করেছেন। ইনি মোটেই শুক্র নন, ইনি বৃহস্পতি, অঙ্গিরার পুত্র বৃহস্পতি। আমি হলাম গিয়ে আসল শুক্র-কাব্যং মাং তাত জানীধ্বমেষ হ্যাঁঙ্গিরসো ভুবি। দৈত্য-দানবরা শুক্রের কথা শুনে অবাক বিস্ময়ে একবার শুক্রাচার্যকে, আরেকবার বৃহস্পতিকে দেখতে লাগলেন–প্রেক্ষন্তে স্ম ভৌ তত্র। কিন্তু কিছুতেই তারা ঠিক করতে পারলেন না–কোনটা আসল শুক্র। শুক্রাচার্য বিমূঢ় অসুরদের আবার বলেলন–ওরে বোকারা! এটা দেবতাদের গুরু। এঁকে ছাড়! তোরা আমাকে অনুসরণ কর, এটা বৃহস্পতি–অনুগচ্ছত মাং সর্বে ত্যজনৈং বৃহস্পতিম্।
শুক্রাচার্য যখন তারস্বরে আত্মঘোষণা করে যাচ্ছেন, তখন বিপদ বুঝে বৃহস্পতি পালটা চাল চাললেন। বৃহস্পতি বললেন–ঘোর চালাকি। একদম ফাঁকে পড়ো না বাছারা। ইনিই দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি। আমার ছদ্মবেশ ধরে তোমাদের ভোলাচ্ছে। এতদিন কোথায় ছিলেন উনি? তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ–আমিই শুক্র, ওটাই বৃহস্পতি-কাব্যোহং বো গুরুদৈত্যা মপোয়ং বৃহস্পতিঃ। দশ বছর ধরে শুক্ররূপী বৃহস্পতির কাছে থেকে, দশ বছর তার সমস্ত আদেশ-উপদেশ শোনার অভ্যাসে দৈত্য-দানবরা আসল শুক্রাচার্যকে গ্রহণ করলেন না। তারা বললেন–দশ বছর ধরে ইনি আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। ইনিই আমাদের গুরু। ইনি অঙ্গিরার পুত্রই হোন, আর ভৃগু-পুত্রই হোন এঁকেই আমরা আমাদের গুরু বলে মানি। আপনি এখন যেতে পারেন–অয়ং গুরুৰ্হিতোস্মাৈকং গচ্ছ ত্বং নাসি নো গুরুঃ–আপনি আমাদের গুরু নন।
অসুর-বীরেরা শুক্রাচার্যের দিকে অপছন্দের ভঙ্গিতে তাকিয়ে একটু চোখ গরমও করলেন–ক্রুদ্ধাঃ সংরক্তলোচনাঃ। শুক্রাচার্য রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অসুরদের ছেড়ে চলে গেলেন। যাবার আগে একটা অভিশাপও দিয়ে গেলেন। বললেন–তোরা যখন আমার কথা শুনলি না, তখন যুদ্ধে তোরা অবশ্যই হেরে যাবি। আমাকে অবজ্ঞা করার ফল তখন বুঝতে পারবি-মদবজ্ঞাফলং কামং স্বল্পে কালে হ্যবাঙ্যথ। শুক্রাচার্য অভিশাপ দিয়ে চলে যেতেই বৃহস্পতির কাজ শেষ হয়ে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে নিজের রূপ ধারণ করলেন এবং ইন্দ্রের কাছে গিয়ে বললেন-কাজ হয়ে গেছে। শুক্রাচার্য নিজে তার শিষ্যদের শাপ দিয়েছেন–যুদ্ধে তাদের হার হবে। অতএব কেল্লা ফতে–কৃতং কার্যং ময়া ধ্রুব।
দৈত্যদানবরা সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং লজ্জায় অধোবদনে শুরু শুক্রাচার্যের পা জড়িয়ে ধরলেন। শুক্রাচার্যের মায়া হল। তিনি অভিশাপ প্রত্যাহার করলেন না বটে, তবে ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
আমি যে এতক্ষণ ধরে শুক্রাচার্য–জয়ন্তী, ইন্দ্র-বৃহস্পতির সম্বন্ধে নানা কথা শোনালাম, তার কারণ দুটি। এক, কোন অবস্থায় শুক্রাচার্য সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে এসেছিলেন। দুই, শুক্রাচার্যের ঔরসে দেবযানীর জন্ম। কোনও কোনও পুরাণে শুক্রাচার্যের আরও দুটি স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়। এমনও একবার শোনা গেছে যে, এই দুয়েরই অন্যতমা উৰ্জস্বতীর গর্ভেই দেবযানীর জন্ম। কিন্তু জয়ন্তী এবং শুক্রাচার্যের সঙ্গে মৃত-সঞ্জীবনী বিদ্যা এবং দেবযানী দুটোই যেহেতু জড়িত, তাই অতি প্রাচীন বায়ুপুরাণের বিবরণ–দেবযানী জয়ন্তীর গর্ভজাতা–এই কথাটাই আমরা বেশি বিশ্বাস করি। আরও বিশ্বাস করি এই কারণে যে, দেবযানী পিতৃ-পালিতা এবং তার নয়নের মণি। দেবযানী ঊর্জস্বতীর মেয়ে হলে, দেবযানীর মায়ের নাম বারে বারে আমরা শুনতে পেতাম।
বৃহস্পতি যেমন শুক্রাচার্যের আগমন শুনেই স্বর্গলোকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তেমনই জয়ন্তীও হয়তো পিতার প্ররোচনায় অথবা শুক্রাচার্যের শাপভয়ে স্বর্গে ফিরে গিয়েছিলেন। কারণ শুক্রাচার্য অসুরদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর থেকে আর আমরা জয়ন্তীর সংবাদ পাচ্ছি না। ধরে নিতে পারি-কন্যা দেবযানীকে রেখে জয়ন্তী একা বিদায় নিয়েছিলেন স্বর্গের পথে। আর দেবযানী শুক্র-পিতার সমস্ত আদর এবং মমতা লাভ করে মানুষ হচ্ছিলেন শুক্রাচার্যের কাছে। জন্মের পর-পরই দেবযানীর মা চলে যাওয়ায় তার ওপরে শুক্রাচার্যের স্নেহ এতই মাত্রা-ছাড়া রকমের ছিল যে, অসুর-গুরু মেয়ের সামান্য আহ্বাদের জন্যও অনেক কিছু করতে পারতেন। এর প্রমাণ পাব পরে এবং পদে পদে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হবে–শুক্রাচার্য যখন অসুরদের অভিশাপ দিয়েছিলেন, তখন অসুরদের মুখপাত্র ছিলেন বুড়ো প্রহ্লাদ। শুক্র বলে দিয়েছিলেন–আমার কথা মিথ্যা হবার। নয়। তবে তোমার নাতি বলি রাজার রাজত্বে আবার তোমরা স্বর্গরাজ্য লাভ করবে। শুক্রাচার্য অবশ্য তাঁর শিষ্যদের উপকারে বিরত হননি। অসুরদের ওপর অত্যাচার হলেই তিনি তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন এবং দেবতাদের আঘাতে মৃত্যু হলে সঞ্জীবনী মন্ত্রে বাঁচিয়ে তোলার কাজটিও করতেন। মনে রাখতে হবে–প্রহাদ দিতির ছেলে, দৈত্য।
তিনি যখন দেখলেন–তার বংশে স্বর্গ-গৌরব আসতে দেরি আছে কিছু, তিনি তখন একটু থিতিয়ে গেলেন হয়তো। এই সুযোগে দনুর ছেলে, দানব-কুলের প্রধান পুরুষ বৃষপর্বা দানবদের নেতৃত্ব দিয়ে দেবতাদের সঙ্গে সংঘর্ষ লাগিয়ে দিলেন এবং দৈত্য-দানব–সবারই মুখ রাখলেন বলা যায়।
বলা বাহুল্য, সংঘর্ষের বিষয় সেই একটাই–তিনি ভুবনের অধিকার। দেবতারা বলেন স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের প্রভু হলাম আমরা। অসুররাও তাই বলেন। বলেন–তোরা নয়, আমরাই প্রভু-ঐশ্বর্যং প্রতি সংঘর্ষে স্ত্রৈলোক্যে সচরাচরে। আবারও সেই একই ব্যাপার। দেবতারা গিয়ে ধরলেন অঙ্গিরার পুত্র বৃহস্পতিকে। অসুররা ধরলেন শুক্রাচার্যকে। দেবতা এবং অসুরদের পরস্পর প্রতিপক্ষতা মানেই এই দুই ব্রাহ্মণের চিরন্তন মর্যাদার লড়াই–ব্রাহ্মণৌ তাবুভৌ নিত্যমন্যোন্যস্পর্ধিনৌ ভূশম। তবে এবারের লড়াইতে নতুন বৈশিষ্ট্যটা মহাভারতের কবি একান্তে লিপিবদ্ধ করেছেন। বলেছেন–দেবতারা যখন অসুর দানবদের ওপর মারণাস্ত্র ক্ষেপণ করে মেরে ফেলেছিলেন, তখন শুক্রাচার্য তার সঞ্জীবনী মন্ত্রে তাদের বাঁচিয়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছিলেন–তান্ পুনর্জীবয়ামাস কাব্যো বিদ্যাবলাশ্রয়া। তারা বেঁচে উঠে আবার যুদ্ধ। আরম্ভ করে দিচ্ছিলেন দেবতাদের সঙ্গে। কিন্তু বৃহস্পতির ক্ষমতা সীমিত। যে সমস্ত দেবতারা অসুরদের হাতে মারা পড়ছিলেন, তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষমতা বৃহস্পতির ছিল না, কারণ বৃহস্পতি সেই সঞ্জীবনী বিদ্যা জানেন না–ন হি বেদ স তাং বিদ্যাং যৎ কাব্যো বেত্তি বীর্যবান।
এ ঘটনায় প্রথমে দেবতাদের কষ্ট হচ্ছিল, পরে সেটা ভয়ের রূপ নিল। তারা বৃহস্পতির বড় ছেলে কচের কাছে গিয়ে বললেন-একটু সাহায্য করতে হবে, দাদা। ওই যে মানুষ বাঁচানোর বিদ্যে–মৃত সঞ্জীবনী ওই বিদ্যেটি তোমায় শিখে আসতে হবে, দাদা! সে বিদ্যে জানেন শুধু শুক্রাচার্য, যিনি এখন দানবরাজ বৃষপর্বার বুদ্ধিদাতা। একমাত্র তুমিই সেখানে যেতে পার। তোমার বয়স কম, শুক্রাচার্যের কাছে শিক্ষানবিশী করতে গেলে কেউ তোমায় সন্দেহ করবে না–তমারাধয়িতুং শক্তো ভবান্ পূর্ববয়াঃ কবি। দেবতারা শুক্রাচার্যের কাছে কচকে সোজাসুজি পাঠাতে চাইলেন না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। দেবতারা কচকে বললেন–জান তো ভাই, শুক্রাচার্যের একটি মেয়ে আছে। নাম দেবযানী। সে যেমন আহ্লাদী মেয়ে, তার ওপরে শুক্রাচার্যের প্রশ্রয়ও সেইরকম–দয়িতাং সুতাং তস্য মহাত্মনঃ। তুমি তাকে ধরেও তোমার কাজ আদায় করতে পার। সত্যি কথা বলতে কি, তুমি তোমার স্বভাব-চরিত্র, দয়া-দাক্ষিণ্য, মধুর ব্যবহার–সব কিছু দিয়ে যদি দেবযানীর হৃদয় বিগলিত করতে পার, তবে জেনে রেখ–সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখতে তোমার দেরি হবে না–দেবযান্যাং হি তুষ্টায়াং বিদ্যাং তাং প্রান্স্যসি ধ্রুবম্।
দেবতারা যে যে উপায়ে কচকে দেবযানীর হৃদয় হরণ করতে বলেছিলেন, তার মধ্যে একটি সাংঘাতিক কথা ছিল। সেটা হল–ইন্দ্রিয়সংযম–আচারেণ দমেন চ। তারা বুঝেছিলেন –দেবযানী যেমন সুন্দরী এবং পিতার প্রশ্রয় পাওয়া মেয়ে, তাতে কচ যদি দেবযানীকে বিমোহিত করতে গিয়ে নিজেই বিমোহিত হয়ে যান, তবে আর সঞ্জীবনী বিদ্যা কোনওদিন দেবলোকে আসবে না। তাই দাক্ষিণ্য অথবা মাধুর্যের মতো মনভোলানো গুণের সঙ্গে দেবতাদের সাবধান বাণী উচ্চারণ করতে হল–আচারেণ দমেন চ।
বৃহস্পতি-সুত কচ দেবতাদের কথা শুনে তাদের আশ্বস্ত করলেন। অবিলম্বে এসে পৌঁছলেন দানবরাজ বৃষপর্বার রাজ্যে, শুক্রাচার্যের আশ্রমে। কচ শুক্রাচার্যের সামনে আভূমি প্রণত হয়ে বললেন–আচাৰ্য। আমার নাম কচ। আমি দেবশুরু বৃহস্পতির পুত্র, মহর্ষি অঙ্গিরার নাতি। আমি আপনার শিষ্য হতে চাই, আপনি দয়া করে আমাকে আপনার শিষ্য হওয়ার সম্মান দান করুন-নামা কচমিতি খ্যাতং শিষ্যং গৃহ্নাতু মাং ভবান্। কচ অঙ্গীকার করলেন–আমি আপনার শিষ্য হবার জন্য হাজার বছর ব্রহ্মচর্য পালন করতে রাজি আছি–ব্রহ্মচর্যং চরিষ্যামি ত্বয়্যহংপরমং গুরৌ।
কচ বৃহস্পতির পুত্র হলেও তার মধ্যে শিক্ষার আগ্রহ এবং বিনয়ের ভাব দেখে শুক্রাচার্য খুশি হলেন। এরপরে যে ভাষা এবং যে শব্দে তিনি শত্রুসুতকে নিজগৃহে আমন্ত্রণ জানালেন, তা আজকের মাস্টারমশাইদের একটু খেয়াল করা দরকার। শুক্রাচার্য বললেন–আমার বাড়িতে তোমার শুভাগমন হোক। তুমি ব্রহ্মচর্যের অঙ্গীকারে আমাকে যেহেতু গুরু বলে মেনে। নিয়েছ, আমিও তোমাকে শিষ্য হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছিকচ সুস্বাগতং তে’স্তু প্রতিগৃহ্নামি তে বচঃ। আজকের দিনে যাঁরা ভাবেন-সেকালের দিনে গুরুগৃহে ছাত্রদের জন’ খাটতে হত, তাদের কোনও সম্মান ছিল না এবং ছাত্ররা ছিলেন গুরুর নিপীড়ন-অত্যাচারের শিকার, তাদের জানাই–আরুণি-উদ্দালকের উপাখ্যান গুরুভক্তির পারম্য খ্যাপনের জন্যই, গুরুর অত্যাচারের কোনও তাৎপর্য নেই সেখানে। কিন্তু একজন ভাল ছাত্রকে কতটা খাতির করতে হয় তার পরিষ্কার প্রমাণ পাবেন শুক্রাচার্যের উত্তরে। তিনি বললেন–কচ! আমি তোমার অনুরোধ মেনে নিচ্ছি এই কারণে যে, তুমি শিষ্য হিসেবে আমার আরাধনীয়। আমি এক অৰ্চনীয় ব্যক্তিকে আরাধনা করছি, তাতে তুমিও যেমন অর্চিত বোধ করবে, তেমনই অর্চিত হোন তোমার পিতা বৃহস্পতি–অৰ্চয়িষ্যেহম্ অর্চং মর্চিতো’স্তু বৃহস্পতিঃ।
এ ব্যাপারটা সেকালে ছিল। শত্রুপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও শুক্রাচার্যের কাছে শিক্ষার্থী হয়ে আসতে কচের কোনও অসুবিধে হয়নি। অনুরূপভাবে শুক্রেরও কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব হয়নি শত্রুপক্ষের কাউকে শিষ্যত্বে বরণ করতে। এমনকি যিনি চরম শত্রু সেই বৃহস্পতির বিদ্যাবত্তা সম্বন্ধে শুক্রাচার্যের মনে যথেষ্ট সম্মানবোধ আছে বলেই তার এই অসাধারণ প্রতিক্রিয়া–তোমাকে শিষ্য হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে আমি শুধু তোমাকেই সম্মান দিচ্ছি না, তোমার পিতা বৃহস্পতিরও মর্যাদা রাখছি-অর্চিতো’স্তু বৃহস্পতিঃ।
আজকের দিনে নানান বিশ্ববিদ্যালয়ে কতগুলি অপগণ্ড শিক্ষক দেখি–যাঁদের বিদ্যাবত্তা নেই বললেই চলে, কিন্তু ঢঙ আছে ষোলো আনা। এঁরা আবার গবেষণা করান। কাজ আরম্ভ হলে দেখা যায়–এঁর কাছে নাম লেখালে অন্য কেউ আর সাহায্য করতে চান না। আবার ওঁর কাছে নাম লেখালে ইনি কোনও সাহায্য করতে চান না। রাজনৈতিক কারণে দু’জনে দু’জনের মুখ দেখেন না। ছাত্র-গবেষক নিজের দলের লোক না হলে অথবা শত্রুপক্ষীয় শিক্ষকের ছন্দানুবর্তী হলে, তার আর রক্ষা নেই। সে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়, তবে একেকটি পরীক্ষাপত্রের একার্ধে সে আটত্রিশ পেলেও অন্যার্ধে পনেরো পাবে। আর সে যদি গবেষক হয়, তবে বাইরে যেখানে তার গবেষণাপত্র গিয়ে পৌঁছল, সেখান পর্যন্ত ইনি ছুটবেন বা অন্যকে ছোটাবেন। ফল অবশ্যম্ভাবী।
রাজ্যের ঊর্ধ্বতম শিক্ষাক্ষেত্রে এই নৈরাজ্যের মধ্যে মহাভারতে দেখা গুরুশিষ্যের এই মহান চিত্রটুকু আমাদের কাছে নানা কারণেই মূল্যবান। শুক্রাচার্যের আশ্রমের সমস্ত বিধি-নিয়ম বৃহস্পতির পুত্র কচ দু’দিনেই রপ্ত করে নিলেন। গুরুগৃহের বিধি-নিয়ম তো মানতেই হয়, সেই সঙ্গে মানতে হয় আরও কিছু যা আজকের অর্থকরী ভাষায় বলে অত্যাচার। এই তথাকথিত অত্যাচার আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও এ দেশে ছিল, তবে সেটা আপনি কীভাবে দেখছেন, তার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। আমার শিক্ষক-পিতার গৃহে আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেক ছাত্রই থাকতেন এবং খেতেন। খাবার-দাবার আমার পিতার জন্য যা বরাদ্দ ছিল, ছাত্র এবং পুত্রদের জন্যও তাই বরাদ্দ ছিল। শীতের দিনে যে সব ছেঁড়া কাথার তলায় তার শয়ন। নির্দিষ্ট ছিল, তার ছাত্র এবং পুত্ররাও ছিল সেই সব ছেঁড়া কাঁথারই অংশভাক। এই সব ছাত্রদের দূরের হাট থেকে নুন-লঙ্কা আনতে বললে শিক্ষক এবং ছাত্র কেউই দ্বিধাগ্রস্ত হতেন না। বর্ষাকালের পূর্বে কাঠ কাঠতে বললে এসব ছাত্রদের আনন্দের কোনও ব্যাঘাত হত না কিংবা তার জন্য ছাত্রের পিতা বা অভিভাবকদের কাছে জবাবদিহিরও কোনও প্রশ্ন ছিল না। কারণ, আত্মীয় কিংবা অনাত্মীয় ছাত্রের পিতৃত্বের কাজটি পুরোপুরি ছিল শিক্ষকের। ফলত ছাত্রকে চলতে হত পুত্রের দায় বহন করে। পরবর্তী জীবনে আমার পিতার অনেক ছাত্রকে আমাদের পারিবারিক জীবনে কর্তৃত্বও করতে দেখেছি। জানি না, আপনারা কী বলবেন–ছাত্র জীবনের সেই মধুর অত্যাচার তারা আরও মধুরতর পন্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। এ ছাড়া অত্যাচারের আর কোন অর্থই বা এখানে বিবেচ্য হতে পারে।
আমরা এত কথা বললাম এই কারণে, যে বৃহস্পতির পুত্র কচ গুরুগৃহে এসে শুধু আশ্রমের বিধি-নিয়মে আবদ্ধ হলেন না। তার সঙ্গে আরও কিছু উদবৃত্ত কাজ তার জুটে গেল। স্বর্গভূমি থেকে আসবার সময় দেবরাজ ইন্দ্র বলে দিয়েছিলেন-শুক্ৰসুতা দেবযানীকে তুষ্ট করলে শুক্রাচার্যের মন পাওয়া সহজ হবে। আর ঠিক সেই কারণেই বৃহস্পতির পুত্র কচ শুক্রাচার্যের মনস্তুষ্টির জন্য যেমন চেষ্টা করতে লাগলেন, ঠিক তেমনই চেষ্টা করতে লাগলেন দেবযানীর মন পাওয়ার জন্য–আরাধয়নুপাধ্যায়ং দেবযানীঞ্চ ভারত।
.
৩১.
মহাভারতের কবি এক নিঃশ্বাসে বলে দিলেন–গুরু এবং গুরুপুত্রী দুজনের তৃপ্তির জন্যই কচ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এ তো এক বিপরীত সাধন। শুক্রাচার্য যাতে খুশি হবেন সুন্দরী দেবযানী নিশ্চয়ই তাতে খুশি হবেন না। আবার যে ভাবে, যে কাজে দেবযানীর খুশি হওয়ার কথা, শুক্রাচার্য নিশ্চয়ই তাতে খুশি হবেন না। কচের সাধন তাই দুই রকম। একদিকে তিনি ব্রত-নিয়ম-ব্রহ্মচর্যে মুনিব্রত গ্রহণ করেছেন, যাতে গুরু শুক্রাচার্য তুষ্ট হন। অন্যদিকে এক যৌবনবতী সুন্দরীর হৃদয় হরণের জন্য এক উত্তাল যুবক যা করে কচ তাই করছেন। মহাভারতের কবিকে তাই একই পংক্তিতে ‘যুবা’ এবং মুনি’ শব্দটি আলাদা করে করে বিশেষণ হিসেবে উল্লেখ করতে হয়েছে–নিত্যমারাধয়িষ্যংস্তং যুবা যৌবনগাং মুনিঃ। শুক্রাচার্যের মন পাবার জন্য তিনি মুনি, যৌবনবতীর মন পাবার জন্য তিনি যুবা। তবে এই মুহূর্তেই স্মরণ করতে হবে যে, অসুরগুরু শুক্রাচার্যের উপাসনার থেকেও দেবযানীর মন পাবার তাড়না কচের কাছে বেশি জরুরি ছিল। ফলে ব্রতধারী মুনির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসত সেই যুবা, যাঁকে প্রাতঃকালের গুরু-শুশ্রূষার অন্তে এক যৌবনবতী প্রশ্ন করত।
বন্ধু আমার! তুমি না স্বর্গে ছিলে একদিন? স্বর্গসুন্দরী অপ্সরা আর নৃত্য-কুশল গন্ধর্বদের নৃত্য-গীত কতবার তুমি দেখেছ, শুনেছ। আজ এই ঋষির আশ্রমে তুমি নন্দনের গন্ধবহ। তুমি কি স্মরণ করতে পার–সেই নৃত্য-গীত বাদিত্রের ধ্বনি?
যুবা বলে–পারি। শুধু স্মরণ কেন, তুমি চাইলে সেই নন্দনের নৃত্য কিছু দেখাতেও পারি তোমাকে, শোনাতে পারি ইন্দ্রসভায় গাওয়া কোনও গান।
যুবতী বলে–তবে দেখাও সেই মনোমোহন নৃত্য, গাও সেই গান। বৃহস্পতি-পুত্র কচ গুরু শুক্রাচার্যের করণীয় যজ্ঞকর্মের সমস্ত আয়োজন সেরে রেখে নৃত্য-গীতে মেতে ওঠেন দেবযানীর সামনে। সস্মিত মুখে ভুজ-বিলাস আর কঠিন পাদন্যাসে ফুটে ওঠে সুর-নৃত্যের ছন্দ-লয়-তাল–গায়ন নৃত্য বাদয়ংশ্চ দেবযানীমতেষয়ৎ। দেবযানীর ভাল লাগে। বৃহস্পতিপুত্রের মেদবর্জিত শরীরে নৃত্যের নানা বিভঙ্গ নবীনা দেবযানীকে কেমন মোহগ্রস্ত করে তোলে। তিনি ভাল করে বোঝন না–মনের মধ্যে এ কীসের আলোড়ন, রমণী-শরীরে এ কীসের শিহরণ!
কচের প্রাণশক্তি অফুরন্ত। নৃত্য-গীতের পরিশ্রমে তার ক্লান্তি নেই। গুরুসেবার অনন্ত কর্মের মধ্যে তার আরও কিছু নিত্যকর্ম আছে। পূজার ফুল তুলতে গেলে দেবতার জন্য যতগুলি তুলতে হয়, তার চেয়ে বেশি ফুল তুলতে হয় দেবযানীর জন্য। তার কেশবন্ধে পুষ্পের অলংকরণ রচনা করা এখন কচের অন্যতম কাজ। দেবযানীর নিত্য-নতুন বায়না এবং ফরমাশের অন্ত নেই কোনও। বনের পথ চলতে চলতে কখনও এই যুবতী গাছের ফল কুড়িয়ে আনতে বলবে, কখন সেই পথ-সখার অঞ্জলিবদ্ধ কুসুমোচ্চয়ে শিঙার করতে বসবে, আর কখন বা প্রভুর মতো যথেচ্ছ আদেশে কচকে উচ্চকিত, তটস্থ করে তুলবে, তার কোনও ঠিক নেই। কচ সব করেন, দেবযানীর চোখের ইঙ্গিতে তিনি সব কাজ বুঝে নেন। কারণে অকারণে ফুল-ফল কুড়িয়ে আনাই শুধু নয়, আজ্ঞাপেক্ষী দাসের মতো তিনি সদা-সর্বদা দেবযানীর পাশে আছেন–পুষ্পেঃ ফলৈঃ প্রেষণেশ্চ তোষোমাস ভারত।
দেবযানীর জন্য কচের এই অফুরান প্রাণশক্তি বৃথা ব্যয়িত হয় না। তার অল্প-বয়সের কিশোরী-মনে শিহরণ জাগে। তিনি ভাবেন—শুধু তুষ্ট করা নয়। নিশ্চয়ই এই অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে সরসতা আছে, নইলে কেন, কেন এই সদ্যোযুবক শুক্রাচার্যের পাঠশালার কারাগৃহ থেকে বার বার তার কাছে পালিয়ে আসে। দিনান্তের সূর্য যখন বনভূমি আরক্ত করে তোলে তখন এই ক্লান্ত শ্রান্ত যুবককে দেখে তার মায়া হয়! সেই কোন সুদূরের স্বর্গ থেকে এখানে এসে কচ শুধুই মন্ত্রলাভের জন্য তার দাসত্ব বরণ করেছেন–এ কথা দেবযানীর বিশ্বাস হয় না। তার ধারণা কচ তাকে ভালবাসেন। ফলে সেই আরক্ত সন্ধ্যাবেলায় দেবযানী যখন নির্জন বনভূমিতে উদাস মনে বসে থাকেন, তখন গুরুগৃহে কর্মরত কচের জন্য তার মন কেমন করে। কচের উদ্দেশে তিনি কাছে আসার ডাক পাঠান গানের সুরে-গায়ন্তী চ ললন্তী চ রহঃ পৰ্য্যচরত্তথা।
গুরুগৃহের কাজ ফেলে কচ ছুটে আসেন দেবযানীর কাছে। দেবযানী আঁচল দিয়ে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দেন। মধুর কথায় অপনোদন করেন পরগৃহবাসের ক্লান্তি। দেবযানীর তাড়নায় কচকে যে নাচতে হয়, গাইতে হয়, কুড়িয়ে আনতে হয় ফল-ফুল-সেই সব পরিশ্রম আর কৃত্রিমতা লঘু হয়ে যায় দেবযানীর সহজ সরল চাওয়ায়, রমণীর নির্জন পরিচার-সুখে রহঃ পর্যচরত্তদা। দিন যায়। রাত যায়। দেবযানী আর কচের মধ্যে সাহচর্য ঘনীভূত হয়।
অসুরগুরু শুক্রাচার্য এখন দানবরাজ বৃষপর্বার রাজধানীর কাছেই আশ্রম বেঁধে আছেন–বৃষপর্বাসমীপে হি শক্যো দ্রষ্টুং ত্বয়া দ্বিজঃ। বৃষপর্বার দানব-পরিচারকরা সদা-সর্বদা অসুর শুরুর তত্ত্বাবধান করত এবং সময়ের নিয়মে তারা জেনেও গেল যে, শুক্রাচার্যের নতুন শিষ্যটি আসলে বৃহস্পতির পুত্র কচ। দেবযানীর সঙ্গে ওই যুবকের প্রীতি-সম্বন্ধ তথা শিষ্যের ওপর শুক্রাচার্যের স্নেহ-সম্বন্ধও বৃষপর্বার দানব-সমাজে অপরিচিত নেই। অসুর-গুরুকে তাদের কিছু বলবার সাহস নেই এবং বললেও তিনি শুনবেন না। এখনকার শিক্ষিত-সমাজ যেমন রাজনীতিকদের দয়া-মায়ার ওপর নির্ভর করেন এবং তাদের সুরে সুর মেলান, তখনকার দিনে সেটা তত সুলভ ছিল না। ফলে অসুর-দানবেরা শুক্রাচার্যকে একেবারেই ঘটানোর চেষ্টা করেননি। কিন্তু তাই বলে শত্রুশিবিরের এক প্রধান ব্যক্তির পুত্র তাদেরই গুরুর কাছে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে তাদেরই বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন–এ জিনিস তারা সইবেন কী করে? তারা তলায় তলায় কচকে মারবার পরিকল্পনা শুরু করে দিলেন।
শুক্রাচার্যের আশ্রমে কচের নিত্যদিনের অনেক কাজের মধ্যে একটি কাজ ছিল গুরুর হোমধেনুটিকে চরাতে নিয়ে যাওয়া। সেকালের গ্রামপ্রান্তে পশুদের তৃণক্ষেত্র থাকত। অন্যান্য দিনের মতো কচ সেইখানেই গরু নিয়ে গেছেন। হোমধেনুর সঙ্গে অন্য গরুগুলিও একসঙ্গে তৃণভোজনে ব্যাপৃত হলে কচ এক জায়গায় বসলেন। তারপর আবার উঠলেন। গুরু শুক্রাচার্যের হোম-যজ্ঞের জন্য সমি-কাঠ কুড়িয়ে জড়ো করলেন। কুশ কেটে গোছ বেঁধে নিলেন। চয়ন করলেন বন্য ফুল। সব এক জায়গায় পুটুলিতে বেঁধে তিনি আবার গিয়ে বসলেন। বটগাছের তলায়। হয়তো তার মনে সঞ্জীবনী মন্ত্রলাভের চিন্তা গম্ভীর হল, হয়তো বা উদাসী হাওয়ায় মনে পড়ল দেবযানীর কথা।
বৃষপর্বার দানব-পরিচারকরা কয়েকদিন ধরে কচের গতিবিধি নিপুণভাবে লক্ষ্য রেখে আজকে গোচারণ ক্ষেত্রে এসে পৌঁছল। তার সঙ্গে কিছু কথা আছে–এই বাহানায় দানবরা তাকে ডেকে নিয়ে গেল বনের একান্তে–গা রক্ষন্তং বনে দৃষ্টা রহস্যেনমমর্ষিতাঃ। কচের গোষ্ঠ-বিহার সুখের হল না। দানবরা তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলল। শুধু তাই নয়, তার দেহাবশেষ অস্থি-চিহ্ন দেখে যাতে তার মরণ-সূত্র আবিষ্কার করা না যায়, সেই জন্য তার শরীরের টুকরোগুলি শিকারী কুকুরদের খাইয়ে দিল–হত্বা শালাবৃকেভ্যশ্চ প্রাযচ্ছবশঃ কৃতম্। এর পেছনে তাদের চিন্তা একটাই–বৃহস্পতি দানবদের বার বার ঠকিয়েছেন, অতএব তিনি তাদের শত্রু। বৃহস্পতি বা তার সমর্থিত দৈবপক্ষ যাতে কোনওভাবেই সঞ্জীবনী-বিদ্যা না শিখতে পারে, সেইজন্যেই তারা গোপনে কচকে হত্যা করলেন–জয়ুবৃহস্পতেঘেঁষা বিদ্যারক্ষার্থমেব চ।
বনভূমি আরক্ত করে সেদিনও সূর্য অস্ত গেল। শুক্ৰাশ্রমের গরুগুলি পর্যাপ্ত তৃণ ভোজন করে অনেক শুয়ে থাকল, অনেক জাবর কাটল, অনেক ইতি-উতি চাইল।কচকে তারা দেখতে পেল না। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসবার আগেই পুরাতন অভ্যাসে গরুগুলি আশ্রমে ফিরে এল। অনেকক্ষণ পর এই ফেরার পথেই দেবযানীর সঙ্গে কচের দেখা হয়। সেদিনও তিনি অধীর আগ্রহে বসে আছেন পথ চেয়ে। কিন্তু কচ ফিরলেন না। রাখাল-বালককে কোথায় ফেলে রেখে গরুগুলি ফিরে এল। দেবযানী প্রমাদ গণলেন। এমন তো হবার কথা নয়।
চকিতের মধ্যে দেবযানী শুক্রাচার্যের কাছে গেলেন। বললেন–বাবা! তোমার সায়ন্তন হোম তো শেষ হয়ে গেল। সূর্য অস্ত গেছে কতক্ষণ, আশ্রমের গরুগুলিও ফিরে এল সব। কিন্তু কই, কচকে তো দেখছি না–কচস্তাত ন দৃশ্যতে। এতকাল দানব-সমাজের কাছাকাছি থেকে তিনি যে দানবদের স্বভাব আঁচ করতে পারেন না, তা মোটেই নয়। দেবযানী বললেন–নিশ্চয়ই কেউ তাকে মেরে ফেলেছে, বাবা! অথবা এমন কোনও কারণ ঘটেছে, যাতে নিজেই সে মারা পড়েছে। দেবযানী কেঁদে বললেন-বাবা! যা কিছুই হোক। কচের যদি এমন-সেমন কিছু হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে, সত্যি বলছি বাবা! আমি কিন্তু বাঁচব না-তং বিনা ন চ জীবেয়ম ইতি সত্যং ব্রবীমি তে।
শুক্রাচার্য খুব বেশি বিচলিত হলেন না। তিনি সঞ্জীবনী-বিদ্যা জানেন। তার শুধু কষ্ট হল মেয়েকে দেখে। জন্মলগ্ন থেকে মায়ের স্নেহ-বঞ্চিতা এই মেয়েটির এতটুকু কষ্টও তিনি সহ্য করতে পারেন না। দেবযানী যেন সেই ছোট্ট আদরের মেয়েটি। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে শুক্রাচার্য বললেন–তা ধর–কচ যদি কোনওভাবে মরেই গিয়ে থাকে, তাতেই বা ভয় কী মা! এই আমি এক্ষুনি সঞ্জীবনী মন্ত্র পড়ে জল ছিটিয়ে বলব–কচ এদিকে এস তো, আর অমনি সে বেঁচে উঠবে–এহেহি ইতি সংশব্দ্য মৃতং সঞ্জীবয়াম্যহম্।
মেয়ের অবস্থা দেখে শুক্রাচার্য আর দেরি করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে মৃত-সঞ্জীবনী মন্ত্র পড়ে ডাকলেন কচকে। আর অমনি পৌরাণিক কালের সমস্ত অলৌকিকতা নিয়ে কচের কর্তিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কুকুরের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এল সম্পূর্ণ কচের রূপ নিয়ে। কচকে বেশ হাসি-খুশি দেখাচ্ছিল। শুক্রাচার্য হয়তো একবারের তরে আদরিণী কন্যার দিকে প্রশ্রয়ের চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলেন, আর দেবযানী সেই মুহূর্তেই অন্য দিকে কচের মুখের পানে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন–তুমি এত দেরি করলে কেন, কচ! তুমি জান আমি কত ভাবছি–কস্মাচ্চিরায়িতো সীতি পৃষ্টামাহ ভার্গবী। কচ বললেন–ভাবিনী আমার! আমি গুরুদেবের জন্য সমি-কুশ কাষ্ঠভার বেঁধে নিয়ে কেবল বটের ছায়ায় গিয়ে বসেছি। বড় ক্লান্তও লাগছিল। আমাকে বসতে দেখে আশ্রমের গরুগুলিও ছায়ার লোভে আমার আশেপাশে এসে বসল। এমন সময় কতগুলি অসুর এসে আমায় জিজ্ঞাসা করল–তুমি কে বটে? তোমার নাম কী? আমি বললাম আমি বৃহস্পতির পুত্র। লোকে আমাকে কচ বলে ডাকে। যেই না বলা, অমনি আমায় ওরা মেরে ফেলল। তারপর গুরুদেব আমাকে সঞ্জীবনী-মন্ত্রে ডাকলেন, আর আমি কোনওমতে বেঁচে তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে পেরেছি–ত্বৎসমীপমিহায়াতঃ কঞ্চিৎ প্রাপ্তজীবিতঃ।
কচের ফাড়া একবারেই কাটেনি। শুক্রাচার্যও দানবদের কিছু বলেননি। তিনি যেহেতু মন্ত্র জানেন, অতএব দানবদের তিনি তোয়াক্কাও করেন না। তিনি এও চান না–বৃহস্পতির পুত্রকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে দানবদের সঙ্গে তার কোনও কথা হোক। তিনি যেমন মেজাজে ছিলেন, তেমন মেজাজেই আছেন। আরও একবার এমন হল–দেবযানী কচকে পাঠিয়েছিলেন বন থেকে ফুল তুলে আনতে। দানবরা তাকে আবার কুচি কুচি করে কেটে সমুদ্রে ফেলে দিল। দেবযানী আবার পিতাকে সব জানাতে, আবারও তিনি কচকে বাঁচিয়ে তুললেন দেবযানীর অনুরোধে। কচ বেঁচে ফিরে যথারীতি সব ঘটনা জানালেন দেবযানীকে।
কিন্তু তৃতীয়বার যেভাবে কচ দানবদের কবলে পড়লেন, তাতে তার পক্ষে বেঁচে ফেরাটাই খুব মুশকিল হয়ে গেল। মহামতি শুক্রাচার্যের একটু সুরাপানের অভ্যাস ছিল। সেকালের ব্রাহ্মণরা সুরাপান সম্বন্ধে ভাল কথা বলতেন না। যজ্ঞে সোমরস পানের ব্যবস্থা অবশ্যই চালু ছিল। কিন্তু সুরার বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য সুবিদিত। কিন্তু শুক্রাচার্যের ব্যাপার অন্য। তিনি ভৃগুবংশীয় ঋষি। যেমন তার তেজ তেমনই তার রাজকীয় সম্মান। বিশেষত তিনি অসুরদের উপাধ্যায়, আচার্য। হয়তো অসুরদের সঙ্গসুখেই তার সুরাপানের অভ্যাস হয়েছিল। দানবরা এই সুযোগটাই নিল। দানবরা এবার কচকে রাস্তা থেকেই তুলে নিয়ে গেল। তারপর তাকে মেরে পুড়িয়ে ফেলল। এতেও তাদের শান্তি হল না। তারা কচের সেই ছাই-ভস্ম সুরার সঙ্গে মিশিয়ে তাদের গুরুকেই খেতে দিল। শুক্রাচার্যও পরমানন্দে, এ বুঝি নতুন স্বাদের কোনও সুরা–এই ভেবে তার পানপাত্র শেষ করলেন–অপিবং সুরয়া সার্ধং কচভস্ম ভৃগদ্বহঃ। কচ তৃতীয়বার মারা গেলেন।
সেদিনও সন্ধ্যাবেলায় আবার সেই একই চিত্র। ব্রাহ্মণ-রাখাল কচ বাড়ি ফিরলেন না। অরক্ষিত গরুর দল নিজেরা পথ চিনে বাড়ি ফিরে এল। দেবযানী ভীত-গ্রস্ত হলেন আগের। মতোই। সন্ধ্যাবেলায় বন্য ফুলের সঞ্চয় হাতে নিয়ে কচের বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু কচ আসেননি। শঙ্কিতা দেবানী পিতার কাছে গিয়ে তৃতীয়বার কেঁদে পড়লেন–কচ ফিরে আসেনি, পিতা! সে গোচারণে গেলে আমি তাকে ফুল নিয়ে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ফুল নিয়ে সে ফেরেনি, পিতা-পুষ্পহারঃ প্রেষণকৃৎ কচস্তাত ন দৃশ্যতে। নিশ্চয় তাকে কেউ মেরে ফেলেছে, তাকে ছাড়া আমি কেমন করে বাঁচব-তং বিনা ন চ জীবেয়ং কচং সত্যং ব্রবীমিতে।
মেয়ের মনের অবস্থা বুঝে শুক্রাচার্য আবার সঞ্জীবনী মন্ত্রে কচকে আহ্বান করলেন। কিন্তু শুক্রাচার্য এটা বুঝলেন না যে, কচ বাইরে কোথাও নেই; সুরামিশ্রিত তার দেহাবশেষ যে তার নিজেরই উদরস্থ হয়ে আছে, সেটা ধারণা করতে পারলেন না শুক্রাচার্য–জ্ঞাত্বা বহিষ্ঠমজ্ঞাত্বা স্বকুক্ষিস্থং কচং নৃপ। সঞ্জীবনী-মন্ত্রের উচ্চারণ সত্তেও কচ এলেন না দেখে শুক্রাচার্যের ধারণা। হল–কচ মারা গেছেন–কচঃ প্রেতগতিং গতঃ। মেয়েকে তিনি বললেন–কচ বোধহয় সত্যিই মারা গেছে মা! কীই বা করব বল? আমার বিদ্যায় বার বার তাকে আমি বাঁচিয়ে তুলেছি; কিন্তু অসুর-দানবেরা আবার তাকে মেরে ফেলেছে। এ অবস্থায় আমি আর কীই বা করতে পারি–বিদ্যয়া জীবিতো’প্যেবং হন্যতে করবাম কিম?
শুক্রাচার্য দেবযানীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- তুমি আর কেঁদ না মা। মনুষ্য-দেহ চিরন্তন নয়, অতএব মানুষের এই অবস্থা জেনে কচের মতো এক ব্যক্তির জন্য তোমার কান্নাকাটি শোভা পায় না। তাছাড়া অসুর-দানবেরা যেভাবে এর পেছনে লেগেছে, তাতে সত্যিই এই ব্রাহ্মণ-যুবককে বাঁচিয়ে রাখা বোধহয় সম্ভব নয়–অশক্যো’সৌ জীবয়িতুং দ্বিজাতিঃ। দেবযানী বললেন–কী বলছ তুমি, বাবা? বৃদ্ধা মুনি অঙ্গিরা যাঁর পিতামহ, স্বয়ং বৃহস্পতি যাঁর পিতা, সেই কচের জন্য আমি না কেঁদে কেমন করে থাকব-কথং ন শোচেয়ম্ অহং ন রুদ্যাম্। দেবযানী কচের সঙ্গে তাঁর পূর্ব সম্বন্ধের ঘটনাগুলি স্মরণ করলেন। বললেন-কচ আমাদের। জন্য কী করেছে বল? নিয়মিত ব্রহ্মচর্য আর তপস্যার ক্লেশ তো আছেই। এর মধ্যেও তাকে যখন যা বলেছি, সে তা কত দক্ষতার সঙ্গেই না করেছে! মনে রেখ বাবা-কচ যে পথে গেছে, আমারও সেই পথ। আমি কচকে ছাড়া বাঁচতে চাই না। সেই বিদ্বান সুপুরুষ কচকে আমি ভালবাসি–প্রিয়ো হি মে তাত কচোভিরূপঃ।
মেয়ের কষ্ট আর কান্না দেখে শুক্রাচার্য এবার তার দানব শিষ্যদের ওপরেই রেগে উঠলেন। বললেন–অসুর-দানবেরা নিশ্চয় আমার ওপর বিদ্বেষ পোষণ করে। নইলে বার বার কেন তারা আমার নির্দোষ শিষ্যটিকে মেরে ফেলবে–অশংসয়ং মামসুরা দ্বিষন্তি/যে শিষ্যং মে’নাগসং সূদয়ন্তি। তারা যে এইভাবে আমার সঙ্গে প্রতিকূল ব্যবহার করছে, তার ফল তারা নিশ্চয় পা•ে শুক্রাচার্য এখন কচের ব্যাপারে আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বরং যারা তাকে মেরেছে, তাদের শাস্তি দিয়ে এখন তিনি নিজের মনে সান্ত্বনা পেতে চান। দেবযানীকে খানিকটা শান্ত করতে চান। অন্যদিকে অসুর-দানবদের ক্ষতিবৃদ্ধি নিয়ে দেবযানীর কোনও মাথাব্যথা নেই। তিনি করে জীবন চান, নিজে বাঁচার জন্য। দেবযানী বৃহস্পতির পুত্রকে ভালবেসে ফেলেছেন।
দেবযানী কোনও কথাই শুনছেন না দেখে শুক্রাচার্য আবার মন্ত্র পড়ে কচকে আহ্বান করলেন। বিদ্যার প্রভাবে কচ এবার শুক্রাচার্যের উদরের মধ্যেই সঞ্জীবিত হলেন। চৈতন্য লাভ করে তিনি গুরুর কথা শুনতে পেলেন বটে, কিন্তু গুরুর ক্ষতি হবে ভেবে–গুরোহি ভীততা বিদ্যয়া চোপহৃতঃ–তিনি উদরের মধ্যে থেকেই আস্তে আস্তে শুরুর উদ্দেশে বললেন গুরুদেব! প্রণাম। আমি কচ, আপনার উদরের মধ্যে থেকে কথা বলছি। লোকে নিজের পুত্রকে যেমন ভালবাসে, আপনি তেমন করেই আমাকে ভালবেসে ক্ষমা করুন। শুক্রাচার্য বললেন–তুমি কোন পথে আমার পেটের মধ্যে এসে ঢুকলে–তমব্রবীৎ কেন পোপনীতং চোদ্দরে তিষ্ঠসি ব্রহি বিপ্র? শুক্রাচার্য তার দানব-শিষ্যদের চক্রান্ত আশঙ্কা করে কুক্ষিগত কচকে বললেন–তুমি বল সব। এই অসুরদের মেরে আজ আমি দেবপক্ষে যোগ দেব–গচ্ছামি দেবান্ অহমদ বিপ্ন।
কচ বললেন–প্রভু! আপনার কৃপায় আমার স্মৃতিশক্তি এতটুকু নষ্ট হয়নি। সব বলছি। কচ আমূলান্ত সব বললেন-কীভাবে দানবরা তাকে মেরে পুড়িয়ে, গুঁড়ো করে-হত্বা দগ্ধ চয়িত্ব চ কাব্য-সুরার সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে খাইয়ে দিয়েছে–সব বললেন।কচের কথা শুনে, শুক্রাচার্য দেবযানীকে বললেন–কীভাবে তোমার প্রিয় সাধন করব, জানি না মা! আমি যদি মরি তবেই কক্ষ বেঁচে উঠতে পারে–কিং তে প্রিয়ং করবণ্যদ্য বৎসে/বধেন মে জীবিতং স্যাৎ কচস্য। কচকে যদি বাঁচতে হয়, তবে আমার পেট চিরেই তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেবযানী পিতার কথায় ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন–কচ যদি মারা যায়, তবে জীবনে আমার সুখ বলতে কিছু থাকবে না, আর তুমি মারা গেলে আমি বেঁচে থাকতেই পারব না।
একদিকে ভালবাসার মৃত্যু, অন্যদিকে পিতার মৃত্যু। যৌবনের সন্ধিলগ্নে দেবযানী যাকে ভালবাসলেন, তিনি যদি মারা যান, তবে দেবযানী মানসিকভাবে সুখ পাবেন না কোনওদিন কচস্য নাশে মম শৰ্ম নাস্তি। আর জম্মদাতা পিতা, যিনি অপার স্নেহে এক মাতৃহারা শিশুকে এত বড় করে তুলেছেন, তিনি যদি দেবযানীর যৌবন-সুখের জন্য মারা যান, তবে দেবযানী নিজের বেঁচে থাকাটা সমর্থন করবেন কী করে–তবোপঘাতে জীবিতুং নাস্মি শক্ত। দেবযানী জানেন–তার পিতা সব পারেন। পিতার তপস্যার শক্তি আছে, তিনি সব পারেন। দেবযানী জানেন–দেবযানীর করুণ ক্রন্দনেই পিতা বিগলিত হয়ে এমন একটা ব্যবস্থা করবেন, যাতে সবারই মঙ্গল হয়।
শুক্রাচার্য মেয়ের মনের অবস্থা সহজেই বুঝেছেন। বুঝেছেন–এক তরুণী-হৃদয় বাঁধা পড়েছে ভালবাসার বাঁধনে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন–কচকে বাঁচাবেন অভিনব এক উপায়ে। কচ তার শত্রুশিবিরের অন্যতম হলেও সে তার তপস্যায়, ব্রহ্মচর্যে এবং সেবায় শুক্রাচার্যকে এতটাই সন্তুষ্ট করতে পেরেছে যে, গুরু তাকে আর অবহেলা করতে পারছেন না। বিশেষত কচ এখন তার গুরুর উদরস্থ হয়ে আছেন; গুরুর ক্ষতি হবে জেনে তিনি নিজে বাঁচবার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি একবারের তরেও। অতএব এই সময়।
শুক্রাচার্য বললেন–তোমার তপস্যায় তুমি সিদ্ধিলাভ করেছ, কচ! তার ওপরে আমার মেয়ে দেবযানী তোমাকে ভালবাসে-যত্ত্বাং ভক্তং ভজতে দেবযানী। অতএব এই সেই উপযুক্ত সময়, তুমি সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ কর–বিদ্যামিমাং প্রাঙ্গুহি জীবনীং ত্ব।
বস্তুত শুক্রাচার্যের জীবন এখন কচের হাতে। মন্ত্র উচ্চারণের পূর্বে শুক্রাচার্য বললেন–তুমি নিজেকে আমার পুত্র বলে মেনে নিয়েছ। অতএব আমার দেহ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসার পর তুমি সেই সঞ্জীবনী মন্ত্রেই আমাকে আবার বাঁচিয়ে তুলবে-পুত্রো ভূত্ব ভাবয় ভাবিতো মাম/অস্মদ্দেহাদুপনিম্য তাত। গুরুর কাছে বিদ্যা শিখে তুমি বিদ্বান হবে বটে, কিন্তু তাই বলে শিষ্যের ধর্ম যেন বিস্মৃত হয়ো না। আসলে একটাই মাত্র সম্ভাবনা আছে। কচ শুক্রাচার্যের কুক্ষিভেদ করে বেরিয়ে আর শুক্রাচার্যকে না বাঁচিয়ে তুলতে পারেন। তাতেই তো দেবপক্ষের লাভ। সঞ্জীবনী বিদ্যার মন্ত্র কচের মাধ্যমে তাহলে শুধু দেবপক্ষেই থেকে যাবে।
কিন্তু গুরু হিসেবে শুক্রাচার্য যে ধাতুতে গড়া, শিষ্য হিসেবে কচও সেই ধাতুতে গড়া। শুক্রাচার্য তার চরম শত্রুর পুত্রকে শিষ্যত্বে বরণ করে যে উদারতা দেখিয়েছেন, আজ সেই উদারতা ফিরিয়ে দেবার সুযোগ এল। শুক্রাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কচ বেরিয়ে এলেন গুরুর কুক্ষি ভেদ করে। তিনি দেখলেন–তার গুরু শুক্রাচার্য মাটিতে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন অধ্যাত্ম-জ্ঞানের এক প্রতিমূর্তি ভূমিলগ্ন হয়ে আছে। কচ সঙ্গে সঙ্গে গুরুকে বাঁচিয়ে তুললেন নবলব্ধ সঞ্জীবনী-মন্ত্রে। বেঁচে ওঠা শুক্রাচার্যকে তিনি বললেন–আপনার মতো মানুষ যিনি, যিনি আমার মতো বিদ্যাশূন্য মানুষের কানে বিদ্যার অমৃত মন্ত্র জপ করেছেন, তাকে আমি আমার বাবা-মা–দুইই মনে করি–তং মন্যেহং পিতরং মাতরঞ্চ–আপনার সঙ্গে কোনওভাবেই আমি প্রতিকুল আচরণ করতে পারি না। কারণ, আমি জানি, আপনি আমার কত উপকার করেছেন–তস্মৈ ন দ্রুহ্য কৃতমস্য জান।
শুক্রাচার্যের প্রতিভাশালী শিষ্য ক জীবন ফিরে পেলেন। শুক্রাচার্য যৎপরোনাস্তি খুশি হলেন। মনে মনে নিজের ওপর একটু রাগও হল তাঁর। দানবদের তিনি যতই গালাগালি করুন, তার সুরাপানের অভ্যাসের সুযোগ নিয়েই তো দানবরা এই বিপত্তি ঘটিয়েছে। তাছাড়া তার প্রিয়শিষ্য কচ উদরস্থ অবস্থাতেও তাকে বলেছিলেন–অসুরেরা আমাকে মেরে, পুড়িয়ে আপনার পানীয় সুরার সঙ্গেই আমাকে মিশিয়ে দিয়েছে–অসুরৈঃ সুরায়াং ভবতোস্মি দত্তঃ–আমি কী করে সেই আসুরী মারা অতিক্রম করি? কথাটা শুক্রাচার্যের মনে লেগেছিল। আজ যখন কচ বেঁচে উঠেছেন, তখন সেই আনন্দে শুক্রাচার্য বিধান দিলেন–কোনও অল্পবুদ্ধি বামুন ভুল করেও যদি আজ থেকে মদ খায়, তবে সে ধর্মহীন মহাপাতকী বলে গণ্য হবে–কশ্চিন্ মোহাৎ সুরাং পাস্যতি মন্দবুদ্ধিঃ/অপেতধর্মা ব্ৰহ্মহা চৈব স স্যাৎ।
ব্রাহ্মণদের প্রতি শুক্রাচার্যের এই অভিশাপের সামাজিক তাৎপর্য একটাই। যজ্ঞাদিতে ব্রাহ্মণদের সোম-পানের ব্যবস্থা থাকলেও, সোমরস সুরা নয় বলেই, সেটা কোনও অপরাধ বলে গণ্য হত না। বৈদিক যজ্ঞরাশির মধ্যে একমাত্র সৌভ্রামণি যজ্ঞে সুরার আহুতি এবং সুরাপানের ব্যবস্থা ছিল। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন–”সৌভ্রামণি যজ্ঞে সুরা দেওয়া হইত; বিধিমতে সন্ধান বা fermentation দ্বারা সুরা প্রস্তুত করিয়া সেই সুরা দেওয়া হইত। এই যজ্ঞের দেবতা ছিলেন অশ্বিদয়, সরস্বতী, আর ইন্দ্র সুত্রামা। অধ্বর্য (যজুর্বেদীয় পুরোহিত) আগুনে দুধ ঢালিয়া দিতেন; তাঁহার সহকারী প্রতিস্থাতা সেই সঙ্গে সুরা ঢালিয়া দিতেন। সুরাহুতির মন্ত্র-যস্তে রসঃ সস্তৃত ওষধিষু, সোমস্য শুষ্মঃ সুরয়া সুতস্য, তেন জিম্ব যজমানং মদেন, সরস্বত্যশিনাবিন্দ্রমগিং স্বাহা’–এই মন্ত্রে সুরাকে স্পষ্টতই সোমস্থানীয় বলা হইয়াছে। কালক্রমে এই যজ্ঞেও সুরাপান অপ্রচলিত হইয়া পড়ে–আপস্তম্ব ব্যবস্থা দিয়াছেন, সুরার পরিবর্তে দুধ চলিবে। দ্বিজাতি-সমাজে–বিশেষত ব্রাহ্মণের পক্ষে সুরাপান নিষিদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। বৃহস্পতির পুত্র কচের হত্যাপরাধে শুক্রের অভিশাপে সুরা অপেয় হইয়াছে, এই পৌরাণিক কাহিনী প্রসিদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল।”
কচের বিপত্তি এবং শুক্রাচার্যের অভিশাপের ঘটনা বৈদিক যুগের সমসাময়িক কি না অথবা সৌত্ৰামণি যজ্ঞের সঙ্গে শুক্রাচার্যের অভিশাপের বিষয় মিলিয়ে দেওয়া যায় কি না, সেটা খুব বড় কথা নয়। বড় কথা হল, শুক্রাচার্যের অভিশাপের সামাজিক তাৎপর্য। বৈদিক যুগের সৌত্ৰামণি যজ্ঞের মতো এক মহাযজ্ঞে সুরাপানের বিধি থাকায় এক সময় ব্রাহ্মণদের মধ্যে সুরার প্রকোপ নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পায়। হয়তো এই সুরাপানের ফলে কোনও আচার্যস্থানীয় ব্রাহ্মণ-ঋষির মত্ততা দেখা গিয়েছিল এবং তা থেকে কোনও অভাবনীয় দুর্ঘটনাও ঘটে গিয়েছিল। এই রকম ঘটনা যাতে লোক-শিক্ষক ব্রাহ্মণদের মধ্যে না ঘটে সেইখানেই শুক্রাচার্যের অভিশাপের তাৎপর্য। মহাভারতের কবি লিখেছেন-সুরাপানের ফলে মহামতি শুক্রাচার্যের মতো ব্যক্তিত্ব যে রকম কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করে ফেলেছিলেন-সুরাপানা বঞ্চনাং প্রাপ্য বিদ্বান্–সেই রকম প্রমত্ত আচরণ যাতে অন্য কোনও ব্রাহ্মণ-সজ্জন না করেন, সেই হিতৈষণাতেই শুক্রাচার্যের অভিশাপ নেমে এসেছে সুরাপায়ী ব্রাহ্মণের ওপর–তদোশনা বিপ্রহিতং চিকীর্ষঃ/সুরাপানং প্রতি সঞ্জাতমণঃ। বস্তুত ব্রাহ্মণদের সুরাপানমত্ততা নিষেধ করার মধ্যেই শুক্রাচার্যের অভিশাপের তাৎপর্য। সুরামিশ্রিত করে দেহভস্ম পান করে ফেলাটা অনুরূপ কোনও অপেয়-পানের স্মারক উপাখ্যান-মাত্র।
.
৩২.
পূর্বে শুক্রাচার্য তার দানব-শিষ্যদের ওপর খুবই রেগে গিয়েছিলেন। বারংবার কচের ওপর আক্রমণ হতে দেখে ক্রোধাবেশে এক সময় তিনি হুমকি দিয়েছিলেন–দেব-পক্ষে যোগ দেবেন। কিন্তু ক যখন সম্পূর্ণ বেঁচেই উঠলেন, তখন দানবদের ওপর শুক্রাচার্যের আর সেই রাগ রইল না। শুধু একবার তাদের ডেকে বললেন-বাছারা! তোমরা বড়ই মূর্খ। তোমাদের বোকামিতে এই লাভ হল–কচ সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করেছেন। এখন তার ক্ষমতা আমার সমান। তাছাড়া কচ এখন আমার কাছে অনেকদিন থাকবেন–সিদ্ধঃ কচো বৎস্যতি মৎসকাশে। শুক্রের কথা শুনে দানবরা হতচকিত হয়ে বাড়ি ফিরে গেল। হয়তো মেয়ের মুখ চেয়েই শুক্রাচার্য নিজ ভবনে কচের দীর্ঘতর আবাস কল্পনা করেছিলেন। হয়তো বা সঞ্জীবনী মন্ত্রের প্রয়োগ এবং কৌশল আয়ত্ত করার জন্য কচও গুরুগৃহে রয়ে গেলেন আরও বহুদিন। তারপর সময় এল যখন বৃহস্পতির পুত্র কচ শুরু শুক্রাচার্যের কাছে স্বর্গে ফিরে যাবার অনুমতি চাইলেন। কচের ব্যবহারে, গুরু-শুশ্রূষায় তথা মন্ত্র গ্রহণের নিপুণতায় পরম সন্তুষ্ট গুরুদেব তাকে স্বর্গে ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন–অনুজ্ঞাতঃ কচো গন্তুমিয়েষ ত্রিদশালয়।
এইবার সবচেয়ে কঠিন কাজটি সারতে হবে কচকে। দেবযানীর কাছে বিদায় নিতে হবে। প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দিই, বঙ্গভাষার কবিগুরু যে ভাষায়, যে ভাবধ্বনিতে কচ ও দেবযানীর সংবাদ-সূক্ত রচনা করে বিদায়-অভিশাপ’ উপহার দিয়েছেন, সেই ভাষা, সেই ভাব যদি পাঠকের হৃদয়ে গম্ভীর হয়ে থাকে, তবে মহাভারতে বর্ণিত কচ ও দেবযানীর কথোপকথন। তাদের নিরাশ করবে। কবিগুরু মহাভারত থেকে বিদায়-অভিশাপে’র উপকরণ সংগ্রহ করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই কাহিনী কবিজনোচিত আত্মীকরণের পর নতুন এক মাত্রা লাভ করেছে। কচ ও দেবযানীর মিলন-বিরহ বঙ্গীয় কবির স্মরণে-মননে-পরিবর্তনে এতটাই মধুর হয়ে উঠেছে যে, সে বুঝি মহাভারতের কবির কল্পনাতেও ছিল না।
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, মহাভারতের কবি যে সমাজ থেকে কচ আর দেবযানীর চিত্র তুলে এনেছেন, সে সমাজে প্রেমের পথ বড়ই সরল, বড়ই সাধাসিধে। দেবযানীকে একবারও এখানে পরিপুষ্ট শুত্র তনু চিক্কণ পিচ্ছল’ হোমধেনুটির কথা কচকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় না। মনে করিয়ে দিতে হয় না গ্রাম্যবধূসম’ স্রোতস্বিনী বেণুমতীর কথা। অথবা পর্যায়ক্রমে ‘হোমধেনু’ আর ‘বেণুমতী’র কথা বলেই হঠাৎ করে শুধোতে হয় না নিজের কথা-হায় বন্ধু, এ প্রবাসে/আরো কোনো সহচরী ছিল তব পাশে,/পরগৃহবাসদুঃখ ভুলাবার তরে?’ মহাভারতে বিদ্যাশিক্ষার শেষ দিনে গুরু শুক্রাচার্যের কাছে স্বর্গে ফিরে যাবার অনুমতি লাভ করেই কচ স্বর্গের পথে পা বাড়িয়েছেন। ভূলেও তিনি নির্জন আশ্রমপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দেবযানীর কাছে এসে বলেননি–দেহ আজ্ঞা, দেবযানী, দেবলোকে দাস/করিবে প্রয়াণ।
আসলে, কবিগুরু তার পরিশীলিত রুচিতে দেবযানীর মতো এক অসামান্যা রমণীর এমন দুরবস্থা কল্পনাই করতে পারেন না, যেখানে রমণী স্বয়ং উপচিকা হয়ে প্রায় পলায়নোদ্যত কচকে পাকড়াও করে প্রেম নিবেদন করবেন। মহাভারতের কবির মনে ইউরোপীয় রোমান্সের কোনও জটিলতা না থাকায় তিনি সুন্দরী দেবযানীকে কচের সামনে উপস্থিত করেছেন সোজাসুজি–কোনও ভণিতা না করে মন্ত্রসিদ্ধ কচকে দেখতে পাচ্ছি–তিনি গুরুর অনুমতি নিয়ে–বিসৃষ্টং গুরুশা কম–স্বর্গের দিকে পা বাড়াচ্ছেন। আর ঠিক প্রস্থানোদ্যত অবস্থায়। দেবযানী এসে কচকে ধরে ফেলেছেন-প্ৰস্থিতং তিশাবাসং দেবযান্যব্রবীদিদ। দেবযানীর প্রথম বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের কবিকেই অনুসরণ করেছেন। দেবযানী বললেন–মহর্ষি অঙ্গিরার পুত্র তুমি। তোমার ব্যবহার, তোর বিদ্যা, তোমার তপস্যা এবং ইন্দ্রিয়-সংযম– সবই তোমার অলংকার–ভ্রাজসে বিদায় চেব তপসা চ দমেন চ।
দেবযানী এবার খুব সরলভাবে বিদ্যাবংশের কথা তুলে তার নিজের কাছে বৃহস্পতির মান্যতা স্থাপন করছেন। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও বিদ্যাবংশের একটা গুরুত্ব ছিল পণ্ডিত-সমাজে। ঔরসজাত পুত্র-পরম্পরার থেকে বিদ্যা সম্বন্ধে পরম্পরা-প্রাপ্ত শিষ্যদের মূল্য কিছু কম ছিল না। দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্য মহর্ষি অঙ্গিরার শিষ্য। আর দেবগুরু বৃহস্পতি অঙ্গিরার পুত্র। দেবযানী জানালেন–মহর্ষি অঙ্গিরা যেমন আমার পিতার মাননীয়, বৃহস্পতিও তেমনই আমার মাননীয়–যথা মান্যশ্চ, পূজ্যশ্চ মম ভূয়ো বৃহস্পতিঃ। দেবযানী বোঝাতে চাইলেন–ঠিক এই রকম একটা সমীকরণ বুঝে নিলে আমার কথাটাও তোমার শ্রবণযোগ্য হয়ে উঠবে। মহাভারতের মধ্যে ঠিক এই মুহূর্তে যেভাবে দেবযানী নিজের দীনতা প্রকাশ করেছেন তা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়
মনোরথ পুরিয়াছে,
পেয়েছ দুর্লভ বিদ্যা আচার্যের কাছে,
সহস্রবর্ষের তব দুঃসাধ্য সাধনা
সিদ্ধ আজি।
কিন্তু এর পরে রাবীন্দ্রিক দেবযানীর বাচন ভঙ্গিতে যে রমণীয় বিদগ্ধতা আছে–আর কিছু নাহি কি কামনা,/ভেবে দেখ মনে মনে–এই বিদগ্ধতার কোনও লেশও নেই মহাভারতের কবির জবানীতে। সেখানে শুক্রাচার্য আর বৃহস্পতির মান্যতা সমীকরণের সঙ্গে সঙ্গেই দেবযানীর পরিষ্কার ঘোষণা–আজ তোমার বিদ্যালাভ শেষ–স সমাবৃতবিদ্যঃ-কিন্তু যে সব দিনে ব্রত-নিয়মের কঠিন শৃঙ্খলে নিজেকে তুমি বেঁধে রেখেছিলে, সেই সব কঠোর সময়ে আমি তোমার কত সেবা করেছি! সে পরিচর্যার মধ্যে শুধুই কর্তব্যের অনুশাসন ছিল না, ছিল অনুরক্তি, ছিল ভালবাসা। তোমার বিদ্যাশিক্ষা, মন্ত্রলাভ আজ শেষ হয়েছে বটে কিন্তু আমার ভালবাসা তো সেই একই রকম রয়ে গেছে। আর আমি যখন তোমাকে ভালবাসি, তখন তোমারও উচিত আমাকে ভালবাসা। ভালবাসার অঙ্কে হিসাব কষে দুয়ে দুয়ে চার করে দিলেন দেবযানী। তার সিদ্ধান্তও প্রকাশ পেল সঙ্গে সঙ্গে–তাহলে আর দেরি নয়, তুমি বৈদিক বিধি অনুসারে আমার পাণি গ্রহণ করো–গৃহাণ পাণিং বিধিবম মন্ত্ৰপুরস্কৃত।
‘বিদায়-অভিশাপ’-এ বিন্ধা দেবযানীর শত প্রশ্নে, শত তর্ক-যুক্তিজালে কচ একেবারে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছেন। কচের অন্তরে দেবযানীর জন্য যেন গভীর ভালবাসা আছে সেখানে। শুধু তিনি ইন্দ্রের কাছে কথা দিয়েছেন বলেই যেন আজ দেবযানীকে প্রত্যাখ্যান করতে হচ্ছে–এমন একটা ভাব ফুটে ওঠে রাবীন্দ্রিক কচের ভাষণে। আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয়, সখী এমন অধরা-ধরা কোনও আবেশ মহাভারতীয় কচের নেই। মহাভারতের কচ-দেবানীর মনের কথা জানেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও জানেন দেবযানীকে ধরে তিনি আপন কার্যোদ্ধার করেছেন মাত্র। এর জন্য তার কৃতজ্ঞতা সামান্য কিছু থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সংকোচ নেই কোনও। আগে থেকে তিনি দেবযানীর মনের কথা বুঝেছিলেন বলেই তিনি তাড়াতাড়ি শুরুগৃহ ছেড়ে পালিয়ে যেতে চান। আর যদি বা দেবযানী তাকে শেষ মুহূর্তে ধরেও ফেলেন, তবে তাকে সযত্নে প্ৰত্যাখ্যান কার উত্তর তার সাজানোই আছে। অর্থাৎ মহাভারতের কচও অঙ্ক কষেই রেখেছেন।
দেবযানীর দিক থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসতেই মহাভারতের কচ বললেন-তোমার পিতা যেমন আমার পূজনীয় ব্যক্তি, তেমনই তুমিও তাই-তথা ত্বম্ অনবদ্যাঙ্গি পূজনীয়তরা মম। মহাত্মা শুক্রাচার্য নিজের প্রাধের চেয়েও তোমাকে ভালবাসেন, সে কথা জানি। কিন্তু গুরুর কন্যা যেহেতু গুরুত্বৎ মান্যা, তাই বিয়ে করার মতো একটা প্রস্তাব তোমার মুখ দিয়ে না। বেরলেই-ই ভাল,-দেবযানী তথৈব ত্বং নৈবং মাং বন্ধুমহসি। কচের কথায় শাস্ত্রীয় যুক্তি অবশ্যই আছে। এ কথা নিশ্চয়ই ঠিক যে, স্মার্ত পণ্ডিতেরা গুরুপুত্র এবং গুরুপুত্রীদের গুরুর মতই সম্মান করতে বলেছেন। কিন্তু দেবযানী সেই যুক্তির ধারে কাছে গেলেন না। তিনি একেবারে মহর্ষি অঙ্গিরার বিদ্যাবংশ টেনে এনে কচই যে তার আরাধ্যতম ব্যক্তি সে কথা প্রমাণ করে ছাড়লেন।
‘বিদায় অভিশাপে’ কচের ওপরে বারংবার দানবদের আক্রমণ এবং দেবযানীর করুণায় তার পুনরায় জীবন লাভের প্রসঙ্গটি কচ নিজেই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। স্ত্রীলোকের করুণায় বার বার প্রাণ পাওয়া একটি পুরুষের দিক থেকে এই বিনম্র আচরণই যে সবচেয়ে স্বাভাবিক, রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে তারই আভাস ফুটে ওঠে
ঈর্ষাভরে তিনবার দৈত্যগণ মোরে
করিয়াছে বধ, তুমি দেবী দয়া করে
ফিরায়ে দিয়াছ মোর প্রাণ; সেই কথা
হৃদয়ে জাগায়ে রবে চিরকৃতজ্ঞতা।
এ কথার উত্তরে রবীন্দ্রনাথের দেবযানী দীপ্র হয়ে ওঠেন। তার ভাষা হয়ে ওঠে নিশিত ক্ষুরধার–উপকার যা করেছি হয়ে যাক ছাই। কিন্তু মহাভারতে দেবযানীর করুণালব্ধ জীবনে কচের কৃতজ্ঞতা নেই কোনও। উলটে দেবযানী তির্যক ভঙ্গিতে নিজের উপকারের কথা কচকে স্মরণ করিয়ে দেন, যাতে অন্তত কৃতজ্ঞতার কারণেও কচ তার প্রেমজালে আবদ্ধ হন। দেবযানী বলেন–কচ! অসুররা যখন বার বার তোমাকে মেরে ফেলছিল, তখন বার বার আমি যে পিতার কাছে তোমার প্রাণ ভিক্ষা করে তোমাকে বাঁচিয়ে তুলতে চেয়েছি, তার পেছনে আমার ভালবাসাই ছিল একমাত্র কারণ। আজ কৃতজ্ঞতার কারণেই অন্তত সেই কথাগুলি স্মরণ। করো–তদা প্রভৃতি যা প্রীতিস্তাং মদ্য স্মরস্ব মে–কবির ভাষায় যার অনুবাদ–সুখস্মৃতি নাহি কিছু মনে? গুরু-গুরুপুত্রী, মহর্ষি অঙ্গিরার বিদ্যাবংশের সম্বন্ধ–এই সব কুট তর্কে এখন আর দেবযানী যেতে চান না। দেবযানীর বক্তব্য–অনুরাগ যদি থাকে, তবে বিবাহের পরিণতির জন্য সেই তো যথেষ্ট। ভালবাসার কাঙালকে তুমি এইভাবে ছেড়ে চলে যেতে পার না, কচন মামহসি ধর্মজ্ঞ ত্যংকুং ভক্তামনাগস।
কচ দেবযানীর প্রণয়-সূক্তিতে একটুও ভুললেন না। তিনি সেই একই যুক্তি দেখিয়ে বললেন,–যে কাজ করা উচিত নয়, তুমি সেই কাজটাই আমাকে দিয়ে জোর করে করাতে চাইছ। আমি বললাম না–তুমি আমার গুরুর মতো। আর যদি আমি শুক্রাচার্যের সঙ্গে শিষ্য সম্বন্ধটাই বড় করে দেখি, তবে তুমি আমার ভগিনী। কাজেই ওইসব বিয়ে-টিয়ের কথা আর মুখ দিয়ে উচ্চারণও কোরো না-ভগিনী ধর্মততা মে ত্বং মৈবং বোচঃ সুমধ্যমে।
যে সব কথা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘বিদায়-অভিশাপ’ আরম্ভ করেছিলেন, সেইসব কথা মহাভারতে আসছে কচের দ্বিধাহীন প্রত্যাখ্যানের পর। দেবযানীকে খুব খানিকটা ধমকে দেওয়ার পরই যেন কচের মনে হল–সামান্য একটু কৃতজ্ঞতা বোধহয় দেবযানীকে জানানো দরকার। কাজেই সামান্য মধুর এক সমাপনের জন্য একেবারে দায়সারা ভাবে কচ বললেন ভালই ছিলাম, দেবযানী! ভালই ছিলাম এখানে। কোনও দৈন্য, কোনও কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেনি–সুখমঘূষিতো ভদ্রে ন মনবিদ্যতে মম। তোমার কাছে যাবার অনুমতি চাই। যাবার পথ যাতে নির্বিঘ্ন হয় সেই মঙ্গলটুকু শুধু তুমি কামনা কর আজ। গুরু শুক্রাচার্য বা আর কারও সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যদি আমার কথা আসে, তবে স্মরণ করো আমাকে স্মর্তব্যোস্মি কথাত্তরে। শুরু শুক্রাচার্য তোমার পিতা, তার পরিচর্যা কোরো যথাসম্ভব।
কচের এই কটি কথার মধ্যে প্রেমের পরিপাটি যতটুকু আছে, তার চেয়ে বেশি আছে সান্ত্বনা। প্রত্যাখ্যানের পরবর্তী মধুর প্রলেপবাক্য। বিশ্বকবি এই কটি কথাকেই কবিতার প্রথমে নিয়ে এসে কচের অন্তরঙ্গতা স্থাপন করেছেন মোহময়ী ব্যঞ্জনায়। অথচ মহাভারতে কচের এই সান্ত্বনা-প্রলেপের বাক্য স্তব্ধ হয়ে গেছে দেবযানীর কঠোর অভিশাপে। দেবযানী বলেছেন–তুমি যখন আমার প্রেম এবং বিবাহের প্রস্তাব এইভাবে প্রত্যাখ্যান করলে, তখন তোমার নবলব্ধ সঞ্জীবনী বিদ্যাও সফল হবে না–ততঃ কচ ন তে বিদ্যা সিদ্ধিমে গমিষ্যতি। কচও এখানে এত মহানুভব নন যে অভিশাপ শুনেও নিঃস্বার্থ সাধুতায় বলে উঠবেন–আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে। ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে।
মহাভারতের দেবযানীর অভিশাপে ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ হয়ে বৃহস্পতিপুত্র কচ পালটা অভিশাপ উচ্চারণ করেন-তুমি ইচ্ছে করেই আমাকে এমন নিষ্ঠুর অভিশাপ দিলে দেবযানী। আমি তোমাকে ধর্মকথা বলেছিলাম। বলেছিলাম–গুরুপুত্ৰী তুমি, তাই বিয়ে করতে পারব না। অথচ ধর্মের কথা না শুনে শুধু কামে মত্ত হয়ে তুমি আমায় অভিশাপ দিলে। তা শুনে রাখ, আমিও তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি–তুমি যা চেয়েছিলে, তা কখনও হবে না। কোনওদিন কোনও ঋষিপুত্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে না-ঋষিপুত্রো ন তে কশ্চিজ্জাতু পাণিং গ্রহীষ্যতি। কচ আরও কথা শোনালেন দেবযানীকে। ব্যঙ্গ করে বললেন–খুব তো বললে আমার বিদ্যা ফলবে না। তা কী আসে যায় তাতে? আমি কোনও মৃতের প্রাণ সঞ্চার করতে নাই বা পারলাম। কিন্তু আমি যাকে বিদ্যা শেখাব সে তো আমার হয়ে কাজটা করতে পারবে। তার তো বিদ্যা ফলবে–অধ্যাপয়িষ্যামি তু যং তস্য বিদ্যা ফলিষ্যতি।
অভিশাপ লাভ করে অভিশাপ দিয়ে কচ শেষ পর্যন্ত স্বর্গে গিয়ে পৌঁছলেন। তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য স্বর্গে বিশাল আয়োজন ছিল। স্বয়ং ইন্দ্র অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কচকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন স্বর্গসভায়। এদিকে প্রত্যাখ্যান লজ্জিতা দেবযানী একাকিনী পড়ে রইলেন শুক্রাচার্যের আশ্রমে। তার সান্ধ্য শিঙ্গারের জন্য কেউ আর ফুল তুলে আনে না। কেউ তার অবসর সময় পূর্ণ করে তোলে না নৃত্য গীতে, বাদিত্রে।
দেবযানীর চরিত্র এখনও আমরা সম্পূর্ণ বুঝতে পারিনি। ঘটনা যতটুকু ঘটেছে তাতে নিঃসন্দেহে এইটুকু বলা চলে যে, দেবযানী মৃদুলা বনলতাটি নন। তার মন অনেক কঠিন ধাতুতে গড়া। মহাভারতের চিত্র থেকে যতটুকু বোঝা যায়, তাতে কচের দিক থেকে প্রেম-ভালবাসার কোনও আভাস আমরা দেখিনি। তিনি সুচতুর অভিনয় করেছেন এবং দেবযানীর জন্য কুসুম-চয়ন থেকে আরম্ভ করে নৃত্য-গীত-দাসত্ব, সবই ছিল এই অভিনয়ের অঙ্গ। দেবযানীকে তুষ্ট করে তিনি শুক্রাচার্যের হৃদয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছেন–”বিদায় অভিশাপ’-এ দেবযানীর এই বাস্তব আক্ষেপটুকুই সত্যি।
অন্যদিকে এও স্বীকার করতে হবে, দেবযানীর ব্যবহারও কিছু কৃত্রিমতা মুক্ত নয়। তিনি যে অসাধারণ সুন্দরী, তিনি যে অসুর-গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা এবং সর্বোপরি তিনি যে সকলের চেয়ে আলাদা–এই উদগ্র অনুভূতি দেবযানীর মন সদা-সর্বদা ব্যাপ্ত করে রেখেছিল। মহাভারতের কয়েকটি পংক্তি আমাদের মনে ক্রিয়া করতে থাকে। কচ তার স্বর্গীয় নৃত্যগীত দেখিয়ে দেবযানীর মন মাতানোর সঙ্গে সঙ্গে তার দাসত্বভাব বরণ করেছিলেন–প্রেধনৈশ্চ তোষয়ামাস ভারত। আরও লক্ষণীয়, তৃতীয়বার কচ দানবদের হাতে মারা পড়লে তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য যে সমস্ত কারণ দেবযানী দেখিয়েছিলেন, তার মধ্যে কচের জন্য তার প্রণয় এবং প্রিয়ত্ব প্রকাশ পেলেও সে প্রিয়ত্ব সর্বার্থে অহংবর্জিত নয়। প্রেমের মধ্যে প্রণয়ের সঙ্গে যে বিনতি থাকে, যে আত্মনিবেদন থাকে, দেবযানীর ব্যক্তিত্ব তাকে কোনওদিন সেই প্রণয়ের রসভাগিনী করেনি। পিতার কাছে যখন তিনি কচকে বাঁচানোর জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছেন, তখন কচের জন্য তাঁর প্রণয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আরও যেটা বড় হয়ে উঠেছে সেটা দেবযানীর ভাষায় প্রকাশ করলে দাঁড়ায়–শুধু ব্রহ্মচর্য আর তপশ্চর্যাই নয়, সব ব্যাপারে কচের উৎসাহ ছিল দেখার মতো। আর কাজ করতে বললে সে যেন সদা প্রস্তুত, যেন এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে। কাজের দক্ষতাও তার সেই রকম– সদোখিতঃ কর্মসু চৈব দক্ষঃ।
দেবযানী যাকে প্রিয় ভাবছেন, যাকে সুন্দর দেখে মোহিত হচ্ছেন, সেই প্রিয়ত্ব এবং মোহের সঙ্গে তার কর্মদক্ষতার হিসাবটুকু দেবযানীকে সম্পূর্ণ প্রেমিকার মর্যাদায় উত্তীর্ণ করে না। পরিশেষে কচের কাছে প্রেম নিবেদন করার সময়েও তিনি অন্য এক হিসাবের খাতা খুলে বসেছেন। সোজা কথায় তার ভাবটা দাঁড়ায়–আমি তিনবার তোকে দয়া করে বাঁচিয়েছি, তুই আমাকে বিয়ে করবি না কেন? দেবযানী জানেন না–প্রেমের রাজ্যে প্রাণ-দানের দয়ার চেয়েও মনের সরসতা এবং পারস্পরিক সমতা অনেক বেশি জরুরি। দেবযানী শুক্রাচার্যের আশ্রমে পুনরায় একাকিত্বের অবসরে জীবন কাটাতে লাগলেন বটে, কিন্তু সাময়িকভাবে কচের কাছে প্রেম নিবেদনের দীনতা ছাড়া তার একাকিত্বের সঙ্গী হল তার অহংকার, এবং তার একান্ত স্ব-আরোপিত এক মর্যাদাবোধ-যা একটা মানুষকে নিজের মনের মধ্যে যতই বড় করে তুলুক, তাকে শাস্তি দেয় না। সরসতা দেয় না।
কচ দেবযানীকে অভিশাপ দিয়ে গেছেন–কোনও ঋষিপুত্র তোমার পাণি গ্রহণ করবে না। আপাতদৃষ্টিতে এই অভিশাপের বড় একটা তাৎপর্য নাই থাকতে পারে! আমরা ভাবতেই পারি যে, একজন ঋষির ছেলে অথবা স্বয়ং কোনও ঋষির সঙ্গে বিয়ে না হলে ভারি বয়েই গেল দেবযানীর। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এই সামান্য অভিশাপেরও একটা গভীর সামাজিক তাৎপর্য আছে। না, আমরা একথা বলছি না যে, মহাভারতের যুগে একজন ঋষিকনার সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের বিবাহ হয়নি অথবা একজন ঋষি কোনও ক্ষত্রিয়া রমণীকে কণ্ঠলগ্না করেননি। এ রকম উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে এবং সে উদাহরণ বর্ণসঙ্কর্যের ক্ষেত্রেই স্মরণীয়। কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে একজন ঋষিকন্যা স্বামী হিসেবে কোনও ঋষিপুত্রের সন্ধান পেলেন না–এটা পিতামাতার পক্ষে কষ্টকর ছিল।
মনে রাখতে হবে–মহাভারতের সমাজ বৈদিক সমাজের উত্তর পর্যায় মাত্র। বৈদিক রীতি-নীতি এবং সামাজিকতা কোনও না কোনওভাবে মহাভারতের সমাজেও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। সে যুগে ঋষি এবং পুরোহিতেরা শুধু অধ্যাত্ম-বিদ্যার পথ-প্রদর্শকই ছিলেন না, শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের অধিকার এবং মর্যাদা ছিল সব চাইতে বেশি। ফলে একটি ঋষির ঘরের মেয়েকে যদি অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদার ক্ষত্রিয় ঘরে বা বৈশ্য ঘরে বন্ধু হয়ে যেতে হত, তবে সেটা সামাজিকভাবে খুব আদরণীয় হত না। এমনকি ব্রাহ্মণ যদি ক্ষত্রিয়ের ঘরের মেয়েকেও বিয়ে করতে চাইতেন তবে একটি ক্ষত্রিয় পিতা মাতা উদ্বিগ্ন হতেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা যাচাই করে দেখতেন–সেই ব্রাহ্মণের শিক্ষা দীক্ষা মান মর্যাদা কতটা? আরও ভাবতেন রাজার ঘরের মেয়েকে যখন রাজপুত্রের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়া গেল না তখন যে ব্রাহ্মণের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে তার অন্তত বিদ্যাবত্তা এবং পাণ্ডিত্যের মর্যাদাটুকু থাকুক। এই ভাবনা যে কত দৃঢ় প্রোথিত ছিল তা বোঝা যায় বৈদিক দেবতাবিষয়ক সুপ্রাচীন গ্রন্থ বৃহদ্দেবতার একটি কাহিনীর মধ্যে। কোনও ঋষিপুত্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে না–কচের এই অভিশাপের তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যাবে মহাভারত পূর্ব এই কাহিনীর মধ্যেই।
.
৩৩.
কচের অভিশাপের মধ্যে আমরা মহাভারতের সমাজের ওপর অব্যবহিত পূর্ববর্তী বৈদিক সমাজের উত্তরাধিকার দেখতে পাব। তার জন্যই বৃহদ্দেবতার একটি উপাখ্যান এখানে উল্লেখ করব।
ঘটনার ‘লোকেশন’ সেই হিমালয়ের উত্তরখণ্ড–রম্যে হিমবতঃ পৃষ্ঠে–যে জায়গাটাকে পর্বে আমরা স্বর্গভূমির আদলে চিহ্নিত করেছি। ঘটনা আরম্ভ হচ্ছে রাজা দার্ভ রথবীতিকে দিয়ে। রথবীতি দার্ভ শুধু রাজা নন, তিনি রাজর্ষি অর্থাৎ রাজাও বটে ঋষিও বটে; হয়তো এক্ষেত্রে রাজার চেয়ে ঋষির গুণ তার মধ্যে বেশি। রথবীতি একটি যজ্ঞ করবেন বলে মহর্ষি অত্রির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। ঋষিকে তার প্রয়োজনের কথা জানিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন রথবীতি দার্ভ। মহর্ষি অত্রি বৃদ্ধ হয়েছেন যথেষ্ট। তাই যজ্ঞকর্মে ঋত্বিকের কার্যভার সমাধা করার জন্য তিনি তার পুত্র অর্চনানাকে নিযুক্ত করলেন। রাজা রথবীতি আত্রেয় অর্চনানাকে ঋত্বিক হিসেবে বরণ করে ফিরে এলেন নিজের রাজ্যে।
আজ থেকে পঞ্চাশ/ষাট বছর আগেও যারা বংশপরম্পরায় পৌরোহিত্যের কাজ করতেন, তারা নান্দীমুখ, কুশণ্ডিকা, অশৌচান্ত শ্রাদ্ধ বা সপিণ্ডকরণের মতো বড় বড় স্মার্ট ক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় সপুত্ৰক যজ্ঞিবাড়িতে উপস্থিত হতেন। নবীন ব্রাহ্মণ এইভাবে পিতৃপুরুষের ধারায় স্মার্ত ক্রিয়াকর্মগুলি নিজে রপ্ত করার চেষ্টা করত আবার পিতাকে সাহায্যও করত। মহর্ষি অর্চনানাও রাজবাড়িতে যাবার সময় আপন পুত্র শ্যাবাশ্বকে নিয়ে গেলেন-স সপুত্রোভ্যগচ্ছত্তং রাজানং যজ্ঞসিদ্ধয়ে। শ্যাবাশ্ব নবীনবয়সী যুবা। পিতার কাছে এতদিন তিনি বেদ-বেদাঙ্গের সম্পূর্ণ পাঠ শিক্ষা করেছেন। এখন রথবীতির যজ্ঞকার্যে পিতার সঙ্গে তিনি রাজাকে যাজন করাতে এসেছেন।
যজ্ঞকার্য আরম্ভ হল। একেকটি যজ্ঞের প্রক্রিয়াতে বেশ কয়েক দিন সময় লেগে যায়। বাড়িতে দুর্গাপূজা হলে চার/পাঁচ দিনের ওঠাবসায় পুরোহিতের সঙ্গে যেমন সম্পূর্ণ পরিবারের আত্মীয়তা গড়ে ওঠে–তেমনই এক্ষেত্রেও তাই হল। যজ্ঞের বিস্তীর্ণ ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যেই মহর্ষি অর্চনানা একদিন রাজা রথবীতির কন্যাকে বড় কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলেন। মেয়েটিকে দেখে তার বড় ভাল লাগল। যেমন তার রূপ, তেমনই তার প্রকৃতি। মহর্ষি অর্চনানা ভাবলেন– মেয়েটিকে যদি আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে পারতাম তবে ভারি ভাল হত–সুষা মে রাজপুত্রী স্যা ইতি তস্য মনোভবৎ।
রথবীতির কন্যা হয়তো এমনিই এসেছে যজ্ঞগৃহে। কখনও সে যজ্ঞের প্রক্রিয়া দেখে কৌতূহলী হচ্ছে, কখনও কারও সঙ্গে গল্প করছে, কখনও বা অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুবক শ্যাবাশ্ব মাঝে মাঝেই তাকে লক্ষ করছেন। যজ্ঞকর্মের নানা কাজের মধ্যেও রাজপুত্রীর দিকে যেমন তার নজর আছে, তেমনই যজ্ঞকর্মের অবসরে তার হাত থেকে তৃষ্ণার জলপাত্র গ্রহণ করার সময়, আহারের পর তাম্বুল গ্রহণের সময় অথবা অন্যত্র কথোপকথনের অলস কোনও মুহূর্তে যুবক শ্যাবাশ্ব রাজপুত্রীকে যতবার দেখেছেন, ততবারই মোহিত হয়েছেন মনে মনে-শ্যাবাশস্য চ তস্যাং বৈ সমাসীদা মনঃ। দিন যায়, রাত যায়, শ্যাবাশ্ব রাজপুত্রীকে দেখেন, মুগ্ধ হন, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না। তবে সমস্ত কিছুর মধ্যে তার সান্ত্বনা রথবীতির পুত্রটি তার পিতা অর্চনানার অনুমোদিতা পাত্রী। অর্থাৎ বিবাহ করতে চাইলে পিতা তাকে না বলবেন না অন্তত।
মনে মনে ছটফট করতে করতে শ্যাবাশ্ব একদিন রাজা রথবীতিকে বলেই ফেললেন মহারাজ! আপনার কন্যাটিকে বিবাহের অনুমতি দিন আমাকে–সংযুজ্যস্ব ময়া রাজ। রাজা রথবীতি এমন কিছু চমকিত হননি। কোথায় কী ঘটছে, তিনি সবই খবর রাখেন। শ্যাবাশ্বের প্রস্তাবে রথবীতির খুব একটা আপত্তি কিছু ছিল না-শ্যাবাশ্বায় সুতাং দিসু। কিন্তু একেবারে শেষ কথা দেওয়ার আগে তিনি রাজমহিষীকে একবার জিজ্ঞাসা করা সঙ্গত মনে করলেন। নারীপ্রগতিবাদীরা বৃহদ্দেবতার এই অংশ শুনে খুশি হবেন কি না জানি না, কিন্তু সেই কালের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সম্বন্ধে যাঁদের ধারণা তত ভাল নয়, তারা অন্তত একটি কথা শুনে স্বস্তি পাবেন যে, রথবীতি রাজমহিষীর যুক্তি-তর্ক মেনে নিয়েছিলেন।
রাজমহিষীকে রাজা বললেন-বুঝলে রানি! এই শাবাশ্ব ছেলেটির হাতেই আমি আমার কন্যা সম্প্রদান করতে চাই। তা তুমি কী বল–কিং তে মতমহং কন্যাং শ্যাবাখায় দদামি হি? রথবীতি বিবাহকার্যের যৌক্তিকতা বোঝাতে চাইলেন পাত্রের যোগ্যতা এবং মর্যাদা দেখিয়ে। রথবীতি বললেন–শ্যাবাশ্ব ছেলেটি ভাল। মহর্ষি অত্রির বংশ বলে কথা। আমাদের জামাই হবার যথেষ্ট সামর্থ্য এই ছেলেটির আছে–অত্রিপুত্রোদুর্বলো হি জামাতা বয়োরিতি।
রাজমহিষী মহর্ষি অত্রির অথবা অত্রিপুত্র অর্চনানার অভিশাপের ভয় করলেন না। রাজার কথাও শুনলেন না। রাজর্ষি রথবীতির মহিষী হবার গৌরবের সঙ্গে নিজের পিতৃগৌরব মিশিয়ে তিনি বললেন-মহারাজ! আমি এক রাজর্ষি-ঘরের মেয়ে-নৃপর্ষিকুলজা হ্যহম্। আমিও এই গৌরব মাথায় নিয়ে তোমায় জানাচ্ছি–এখনও যে ব্রাহ্মণ-যুবক বেদের একটি মন্ত্রবর্ণও দর্শন করেননি, এখনও যিনি ঋষি-পদবাচ্য নন, সেই রকম এক অঋষির হাতে আমি আমার মেয়েকে দিতে পারি না। তাকে জামাই হিসেবেও মন থেকে মেনে নিতে পারি না–নানৃষি-নৌ তু জামাতা নৈষ মন্ত্রান্ হি দৃষ্টবান্। এবার রাজমহিষী তার নিজস্ব যুক্তি দেখিয়ে বললেন–মেয়ের যদি বিয়েই দিতে হয়, তবে তাকে দাও এক ঋষির হাতে। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষির হাতে পড়লে লোকে আমার মেয়েকে বলবে বেদমাতা। যেহেতু মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকে লোকে বেদপিতা বলেই মান দেয়—ঋষয়ে দিয়তাং কন্যা বেদস্যাম্বা ভবিষ্যতি।
লক্ষণীয় বিষয় হল–রাজমহিষী কোনও ব্রাহ্মনের কথা বলছেন না। তিনি একজন ঋষিকে জামাই হিসেবে দেখতে চান। তিনি ব্রাহ্মণ হবেন, কি ক্ষত্রিয় হবেন–এ সম্বন্ধে তাঁর কোনও বক্তব্য নেই। অনেকের ধারণা আবে–ঋষি মাত্রেই ব্রাহ্মণ। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। হ্যাঁ, একথা অবশ্যই মানতে হবে যে, বৈদিক সমাজে অধিকাংশ ঋষিই ছিলেন ব্রাহ্মণ। কিন্তু বিদ্যা জ্ঞানসম্পন্ন ক্ষত্রিয়রা অনেক ঋষি ছিলেন এবং অনেক ক্ষত্রিয় রাজর্ষিই ছিলেন পরবর্তী কালের অনেক ব্রাহ্মণ ঋষির গুরু। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো–শূদ্র কিংবা জারজ হওয়া সত্বেও বৈদিক সমাজে ঋষিত্ব আটকানো যায়নি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ কবষ ঐলূষ।
সেকালের বৈদিকদের কাছে সরস্বতী নদীর মাহাত্ম্য ছিল সবচেয়ে বেশি। এই সরস্বতী নদীর তীরে একসময় এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল। সেই পবিত্র যজ্ঞস্থলের মাঝখানে ঐলুষপুত্র কবষকে দেখতে পেয়ে অন্যান্য ঋষিরা বললেন–এ ব্যাটা দাসীপুত্র বেজন্মা কবষ এই যজ্ঞের দীক্ষা পেল কী করে? খুব তো এর সাহস দেখছি। ঋষিরা ঐলুষ কবষকে সেই পবিত্র সোমযোগের স্থান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে বললেন-এই চত্বরে যেন না দেখি। এই সরস্বতী নদীর জল পর্যন্ত তুই খাবি না, ছুঁবি না। কবষ ঐ্লুষ এক জলহীন দেশে বিতাড়িত হয়ে পিপাসায় আর্ত হলেন। মনে তাঁর ক্ষোভ–ঋষিরা তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে একত্র বসে পান-ভোজনও করবেন না বলেছেন। এই ক্ষোভ আর আকুতি থেকেই তাঁর জিহ্বায় জন্ম নিল অপূর্ব বৈদিক মন্ত্র। সরস্বতীর ঢেউ-তোলা জল বৈদিক ছন্দে বাঁধা পড়ল কবষ ঐলুষের কণ্ঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতী নদীর পবিত্র জলধারা তাঁর চারদিক দিয়ে বইয়ে দিতে লাগল কবষ ঐলুষের মনের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তাল রেখে।
ব্রাহ্মণ ঋষিরা সব দেখলেন। লজ্জায় তাঁদের মাথা নুয়ে গেল। যাঁকে তাঁরা এত হেলাফেলা করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যাঁকে পিপাসার্ত হয়ে মেরে ফেলার জন্য জলহীন দেশে তাঁর স্থান নির্দেশ করেছিলেন, সেই কবষ ঐলুষ, তাঁদের ভাষায় জারজ বেজন্মা দাসীপুত্র–সেই কবষ ঐলুষ নদীরূপা সরস্বতী মন্ত্র দর্শন করে তাঁদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ ঋষিরা সমবেত হয়ে ঐলুষের কাছে এসে ‘ঋষি’ সম্বোধন করে বললেন–প্রণাম ঋষি। রাগ করবেন না আমাদের ওপর অস্তে অস্তু মা নো হিংসী। আমাদের মধ্যে আপনিই শ্রেষ্ঠ, নইলে যে সরস্বতীর জলবাহিন৷ এর থেকে আপনাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, সেই সরস্বতী আপনারই অনুগমন করছে–ত্বং বৈ নঃ শ্রেষ্ঠোসি যং কেয়মন্ধেতি।
কবষ ঐলুষের উদাহরণ থেকে আমাদের আরও মনে হয় মন্ত্রদর্শন করা মানে নতুন কবিতার জন্ম–সে কবিতার জন্ম রামায়ণের বাল্মীকিকে ঋষি করেছে। শ্লোক উচ্চারণ করেই বাল্মীকি চমকে উঠেছিলেন–এ আমার মুখ দিয়ে কী বেরল! বাল্মীকি ঋষি হয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের ধারণা–রাজর্ষি রথবীতির মহিষী একজন কবি-ঋষিকে তার জামাই হিসেবে চান–যে মন্ত্র দর্শন করেছে, ছন্দোবদ্ধ কবিতা সুন্দরীকে দেখতে পেয়েছে।
মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি কাকে বলে? অধ্যাত্মবাদীরা বলেন–বহু তপস্যার ফলে কোনও জ্ঞানী ব্যক্তি বেদমন্ত্র দর্শনের পুণ্যলাভ করতেন। ঋগবেদে যত মন্ত্র আছে, তা সবই কোনও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের মন্ত্রদর্শনের ফল। তাদের মতে, বেদের মন্ত্র কেউ লেখেনি। অধ্যাত্মবিদ্যার চরম পর্যায়ে আরোহণ করে যারা মন্ত্র দর্শন করেছেন, তারাই ঋষিদর্শনা ঋষয়ে বভূবুঃ! সেই আর্যমন্ত্র শ্রুতিপরম্পরায় নেমে এসেছে আমাদের কাছে।
অধ্যাত্মবাদীদের কথা ঠেলে ফেলে দিয়ে কেউ যদি জড়ভাবেও কথাটা ব্যাখ্যা করেন, তবুও মন্ত্রদর্শনের মূল্যটা কম নয়। অলংকারশাস্ত্র মতে ঋষির এক নাম হল কবি। এঁদের মতে ক্ৰান্তদশী কবি তার গভীর দৃষ্টি আর বর্ণনার ক্ষমতাতেই কবি পদবি লাভ করেন-দর্শনা বর্ণনাচ্চৈব রূঢ়া লোকে কবিক্ৰতিঃ। হাজার হাজার বছর আগে অনেক আধুনিক সভ্যতার পূর্বতনেরা যখন কাঁচা মাংস খাচ্ছেন, তখন ভারতবর্ষে বেদের মতো কবিতার জন্ম হয়েছে। রাজমহিষীর কথার আলংকারিক ব্যাখ্যা করে যদি বলি–যে এখনও বেদের মন্ত্র দর্শন করেনি –নৈব মন্ত্রান্ হি দৃষ্টবান্–অর্থাৎ যে এখনও একখানি বৈদিক কবিতার সৃষ্টি করতে পারেনি, সেই রকম অকবি-অঋষির হাতে আমার মেয়ে দেব না। কবিতা যে লেখে, সেই কবিতার জনক, পিতা। বেদমন্ত্র দর্শন করে যে মানুষ ঋষি হলেন, সেই স্রষ্টা, দ্রষ্টা ঋষিকেই লোকে বেদের পিতা বলে মানে–রাজমহিষীর ভাষায়–ঋষিং মদৃশং বেদপিতরং মন্যতে যত। সেই বেদপিতা ঋষির সম্বন্ধেই একটি কুলবতী কন্যা বেদমাতা হবার সম্মান পায়। অন্তরে বুঝি আশা থাকে–এক মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিপত্নীর গর্ভ থেকেই আরও এক মন্ত্রদ্রষ্টা বেদপিতা ঋষির জন্ম হবে।
রাজা রথবীতি, রাজর্ষি রথবীতি রাজমহিষীর যুক্তি উড়িয়ে দিতে পারেননি। সত্যিও তো কবি, বিদ্বান, মন্ত্রদ্রষ্টা একজন ঋষিকেই তিনি জামাই হিসেবে পেতে চান। শ্যাবাশ্বকে তিনি জানিয়ে দিলেন–সম্ভব নয় বৎস! যিনি মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি নন, তিনি আমার জামাই হতে পারেন না–অনুষির্ণৈব জামাতা কশ্চিদ ভবিতুমহতি।
রথবীতির রাজ্যে তার প্রারব্ধ যজ্ঞক্রিয়া শেষ হয়ে গেল।
মহর্ষি অর্চনানা এবং শ্যাবাশ্ব দুঃখিত মনে আশ্রমে ফিরে যাবার উপক্রম করলেন। কিন্তু শ্যাবাশের মন পড়ে রইল রথবীতির রাজ্যে। সে মন জুড়ে রইল অদৃশ্য রাজকন্যার উপস্থিতি-শ্যাবাশ্বস্য তু কন্যায়াং মনো নৈব ন্যবর্তত। আশ্রমে ফিরে যাবার পথে আরও দুই রাজবাড়ি ঘুরে অনেক ধন-ধান্য, পশু-হিরণ্য দান লাভ করে মহর্ষি অত্রির কাছে ফিরে এলেন অর্চনানা এবং শ্যাবাশ্ব।
কিন্তু শ্যাবাশ্বের মনে কোনও শান্তি নেই। তিনি মন্ত্রদর্শন করে ঋষিপদবি লাভ করেননি বলেই তো আজ রথবীতির মতো যজমানের কাছে প্রত্যাখ্যাত হলেন। মনের দুঃখে তিনি বনবাসী হলেন। অন্তরে বার বার শুধু রাজকন্যার মুখটি জেগে ওঠে আর শ্যাবাশ্ব ধিক্কার দেন। নিজেকে–শুধু মন্ত্রদর্শন করে ঋষি হইনি বলেই না আজ অমন সুন্দরী রাজকন্যার হৃদয় থেকে আমি বঞ্চিতন লব্ধবানহং কন্যাং হন্ত সর্বাঙ্গশোভানা। আহা যদি আমি মন্ত্র দর্শন করতে পারতাম, তাহলে কী সুখই না হত।
প্রেমের এই অদ্ভুত আকৃতি থেকেই শ্যাবাশ্ব মরুক্ষণের সাক্ষাৎ পেলেন অরণ্যের মধ্যে। মরুণের বয়স এবং রূপ শ্যাবাশ্বের মতোই। সে দেবতার বুকে রুপোর বর্ম আঁটা। দিব্যতেজ সমন্বিত মরুগণকে দেখেই শ্যাবাশ্বের মন্ত্রোচ্চারণ আরম্ভ হল। নতুন ঋক মন্ত্র, নতুন কবিতা, মরুদগণের স্তুতি-সূক্ত। শ্যাবাশ্ব ঋষি হলেন অথবা আমাদের মতে কবি হলেন। মন্ত্র দর্শন। করার সঙ্গে সঙ্গে শ্যাবাশ্বের মন ছুটে গেল রথবীতির রাজ্যে–অগচ্ছন্মনসা তদা। ঋষি-কবি সশরীরে উপস্থিত হলেন রাজর্ষি দার্ভ রথবীতির রাজ্যের সীমানায়। দূতীর মাধ্যমে রাজার কাছে ঘোষণা করা হল ঋষিকবির নবীন ঋমন্ত্রোচ্চারণের কথা। রথবীতি সলজ্জে কন্যার হাত। ধরে উপস্থিত হলেন শ্যাবাশ্বের পিতা অর্চনানার কাছে। রাজা কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন–রাগ করবেন না মহর্ষি। একসময় আপনি আমার সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ ঘটানোর কথা নিজমুখে। বলেছিলেন। সেদিন আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। কিন্তু আজকে জেনেছি–ঋষির পুত্র স্বয়ং ঋষি হয়েছেন। আপনি এখন এক মদ্রষ্টা ঋষির পিতা-ঋষেঃ পুত্রঃ স্বয়ম্ঋষিঃ পিসি ভগবন্ ঋষেঃ। আপনি দয়া করে আমার কন্যাকে পুত্রবধূ হিসেবে অঙ্গীকার করুন। তরুণ কবি-ঋষি শ্যাবাশ্বের সঙ্গে এইবার রাজর্ষিকন্যার মিলন সম্পূর্ণ হল।
আমরা বৃহদ্দেবতার এই উপাখ্যানের অবতারণা করলাম শুধু ওই শেষ পংক্তিটির জন্য ঋষেঃ পুঃ স্বয়মঋষিঃ। দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র কচ শুক্রাচার্যের কাছে সঞ্জীবনী মন্ত্র লাভ করেছেন অথচ সে মন্ত্র প্রায় বিফল হয়ে গেল দেবযানীর অভিশাপে। কচ অভিশাপ দিলেন–কোনও ঋষিপুত্র তোমার পাণিগ্রহণ করবেন না। কী নির্মম এই অভিশাপ, অথবা এই অভিশাপের সামাজিক তাৎপর্য কত গভীর, তা খানিকটা বোঝা গেল বৃহদ্দেবতার উপাখ্যানে এবং এই উপাখ্যানেরই উত্তরাধিকার নেমে এসেছে মহাভারতের সমাজে। দেবযানী পরমর্ষি শুক্রাচার্যের কন্যা হয়েও কোনও ঋষিপুত্র বা স্বয়ং কোনও ঋষির পত্নী হবেন না–এই অভিশাপ দেবযানীকে যে কতটা উতলা করে তুলেছে, কতটা বেপরোয়া করে তুলেছে, তা বুঝতে হবে দেবযানীর জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলি দেখে।
অসুরগুরু শুক্রাচার্যের সঙ্গে অসুররাজ বৃষপর্বার সম্পর্কের অবনতি ঘটল আকস্মিকভাবে এবং তা ঘটল দেবযানীর কারণেই। কেন জানি না, মহাভারতের কবি এই ঘটনার মধ্যেও দেবতাদের ক্রুর অভিসন্ধি লক্ষ্য করেছেন। মহাভারত বলেছে বৃহস্পতির পুত্র কচ দেবলোকে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা নিয়ে গেলেন এবং তা শেখাতেও লাগলেন দেবতাদের। মন্ত্রলাভ করে দেবতারা ভাবলেন-দানবদের এবার উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। এই ভাবনা রূপায়ণের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র নিজে উদ্যোগী হলেন। তিনি ছদ্মবেশে তার শত্ৰুপুরী বৃষপর্বার রাজধানীতে এসে পৌঁছলেন। মহাভারতের কবি বলেছেন-ইন্দ্র হাওয়ার মতো অদৃশ্য হয়েছিলেন-বায়ুভূতঃ। কিন্তু আমাদের ধারণা, এই ‘বায়ুভূত’ শব্দটার মধ্যেই আসল সত্যটা লুকিয়ে আছে। কথাটা খুলে বলি।
অসুর-দানবদের ওপর আক্রমণ হানার আগে ইন্দ্র নাকি বৃষপর্বার গৃহসংলগ্ন বিশাল রাজোদ্যানের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেখতে পেলেন–রাজার ক্রীড়া সরোবরে অনেক রমণী জলক্রীড়া করছে। ইন্দ্র তখন বায়ুভূত হয়ে সরোবরের তীরে রাখা রমণীদের পরিত্যক্ত বসনগুলি এলোমেলো করে মিশিয়ে দিলেন–বায়ুভূতঃ স বস্ত্রাণি সর্বাণ্যের ব্যমিশ্রয়।
এর পরে যে ঘটনা ঘটবে, হয়তো তাতেই দেবকার্য সিদ্ধ হবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, বৃহস্পতি-পুত্র কচের কাছে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিক্ষা করা এবং দানবদের ওপর আঘাত হানা–এই দুয়ের সঙ্গে বায়ুভূত ইন্দ্রের উপরি উক্ত ক্রিয়ার কোনও সম্পর্কই নেই। এমন কী ঘটনা যা ঘটবে, তার সঙ্গেও সঞ্জীবনী মন্ত্র এবং দেবতাদের যুদ্ধোদ্যোগের কোনও সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে একমাত্র ঘটনা হল, রমণীদের বসনগুলি এলোমেলো হয়ে মিশে যাওয়া। কিন্তু তার জন্য সাধারণভাবে শুধু হাওয়াই যথেষ্ট, দেবরাজ ইন্দ্রের সুরদ্বিপাস্ফালন-কর্কশাঙ্গুলির কোনও ভূমিকাই এখানে নেই। বস্তুত এলোমেলো হাওয়ায় যে বিষম বিপত্তি ঘটল, তাতেই দেবকার্য সিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় মহাভারতের পৌরাণিক এখানে দেবরাজ ইন্দ্রের কারসাজি দেখতে পেয়েছেন। আসল ঘটনা কিন্তু সেই দেবযানীকে নিয়ে। কচের কাছে প্রত্যাখ্যাত দেবযানীকে নিয়ে। কচ যেহেতু স্বর্গে গিয়ে বিদ্যা বিতরণ করতে আরম্ভ করেছিলেন, অতএব নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে ইন্দ্রের বায়ুভূত অভিসন্ধির কথাটা এসেছে। মূল ঘটনা কিন্তু একেবারেই আলাদা।
প্রকৃত যা ঘটেছিল, তা হল–রাজধানীর বিশাল উদ্যানের মধ্যে মেয়েদের স্নান করবার জায়গা, ক্রীড়া-সরোবর। পৌরাণিকদের কথাবার্তা থেকে যা বুঝি, তাতে মনে হয়–সেকালের দিনের যুবতী মেয়েরা অন্তঃপুরের সুরক্ষিত ক্রীড়াসরোবরে স্নান করতে নামার সময় অঙ্গের মূল বসন পরিত্যাগ করেই জলে নামতেন। হয়তো বা কখনও কোনও স্বল্পবাসও ব্যবহার করতেন। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে বস্ত্রহরণ লীলাতেও এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় এবং এ বিশ্বাস নেমে এসেছে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত–
অচ্ছোদ সরসীনীরে রমণী যেদিন/ নামিলা স্নানের তরে…
তীরে শ্বেত শিলাতলে সুনীল বসন
লুটাইছে এক প্রান্তে স্খলিতগৌরব
অনাদৃত…
লুটায় মেখলাখানি যৌন অপমানে;
সেদিন কতগুলি যুবতী রমণী এইভাবেই উদ্যানবাটিকার ক্রীড়া-সরোবরে স্নান করতে নেমেছিল। ক্রীড়ারসের মত্ততায় কেউ অন্যের গায়ের জল ছেটাচ্ছিল, কেউ সাঁতার কাটছিল, কেউ হাবুডুবু খাচ্ছিল, আবার কেউ বা রঙ্গ-রসে নানা কথা বলছিল। স্নানরতা এই রমণীকুলের মধ্যে শুক্ৰদুহিতা দেবযানী যেমন আছেন, তেমনই আছেন দানবরাজ বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা। দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠার বয়স একই রকম। উভয়েই অসাধারণ সুন্দরী। কিন্তু দুজনের স্বভাবে কিছু পার্থক্য আছে। জলক্রীড়া করার সময়, একই জলভাগের অন্তরে দাঁড়িয়ে স্নান করবার সময় সমবয়সী এই দুই রমণীর মধ্যে কোনই বিসম্বাদ চোখে পড়েনি।
জলের শীতলতা, রঙ্গ-কৌতুকের মত্ততা এবং রমণীকুলের যৌবনের সরসতার সঙ্গে আরও যেটা ছিল, সেটা হল উতলা আকুল বাতাস। বাতাসের কাজ বাতাস করেছে। পুষ্করিণীর তীরে রাখা রমণীদের পরিত্যক্ত বসনগুলি বাতাসে এলোমেলো হয়ে একাকার হয়ে গেছে। স্নানকেলি সাঙ্গ হবার পর এত রমণী একই সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে উঠে এল আপন আপন বস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য। উদার আলোরাশির মধ্যে পরস্পর বিলোকনে তারা লজ্জায় অভিভূত হয়ে পড়েছিল। তাড়াতাড়ি বস্ত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে, অপিচ পরম্পর কথা কুহলে অন্যমনস্ক থাকায় অসুররাজ বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা বেখেয়ালে অসুরগুর মেয়ে দেবযানীর কাপড়খানি পরে ফেললেন।
দেবযানী সিক্তদেহে পুষ্করিণী থেকে উঠে এসে নিজের কাপড় খুঁজে পেলেন না এবং কোনওভাবে লজ্জামুক্ত হবার পর তিনি দেখতে পেলেন–শর্মিষ্ঠার গায়ে জড়ানো আছে তারই পূর্বপরিহিত বসনখানি। দেবযানীর মাথায় যেন খুন চেপে গেল। এমনিতেই অসুরগুরুর মেয়ে হওয়ার দরুন তিনি কিছু স্বাতন্ত্র নিয়ে থাকেন, তার মধ্যে কচের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর থেকে তার মেজাজটা একেবারেই ভাল থাকে না। শর্মিষ্ঠার পরিধানে নিজের বসনখানি দেখে দেবযানী ঝাড় দিয়ে বলে উঠলেন–হ্যাঁলা অসুরের ঝি! তোর ভাল হবে না মোটেই। কোনও আচার নেই, বিচার নেই, ভাল-মন্দবোধ নেই। ই আমার শিষ্যের মতো। তুই মাগী অসুরের মেয়ে হয়ে আমার কাপড়টা পরলি কোন বুদ্ধিতে শুনিকস্মা গৃহাসি মে বস্ত্রং শিষ্যা ভূত্ব মোসুরি।
এত সমবয়সী মেয়ের সামনে রাজার মেয়ে হিসেবে এই অপমান মেনে নিতে পারলেন না শর্মিষ্ঠা। এতক্ষণ জলের মধ্যে যার কোনও স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল না, সে জল থেকে উঠেই তার সমবয়সী সখীকে ‘শিষ্যা’ বলে অপমান করবে–এই বড়মানুষী ঢং কোন রাজার মেয়ের সহ্য হয়। অন্তত অনুচরীদের সামনে সম্মান বাঁচানোর জন্যই শর্মিষ্ঠা একেবারে দেবযানীর পিতার নাম তুলে বললেন–বেশি গুরুগিরি দেখাস না বামনী। তোর বাপ নত হয়ে বসে থাকে আমার বাবার সিংহাসনের নীচে–নীচৈঃ বি বিনীতবত। ওতে বসতে তোর বাবা আমার বাবার খিদমদগারি করে–শীন শয়ান পি তে পিতরং। তেীতি বন্দী চর্তিী..। শর্মিষ্ঠা আরও কেটে কেটে বললেন–তুই হলি সেই বাপের মেয়ে, যে বাপ দিনরাত চাটুকারিতা করে, ভিক্ষে চায়, আর দান নেয়—যাচতত্বং হি দুহিতা প্রতিপূঃ। আর আমি হলাম সেই বাপের মেয়ে, যে বাপ স্তুতি করে না, স্তুতি শোনে না; যে দান নেয় না, দান করে—সুতাহং স্তুয়মানস্য দদতো প্রতিগৃহ্নতঃ।
কথাটি সত্য নয় মিথ্যাও নয়। অথবা সত্যও বটে মিথ্যাও বটে। অসুরগুরু শুক্রাচার্য অসুররাজ বৃষপর্বার তত্বাবধানেই থাকেন। তাঁর ভরণ-পোষণের ভার বৃষপর্বার ওপরেই। তিনি অযাচক-বৃত্তি হলেও রাজার অর্থ সম্পত্তি তাঁকে ব্যবহার করতেই হয়। শুক্রাচার্য সোজাসুজি বৃষপর্বার স্তুতি না করলেও দেশের রাজা হিসেবে বৃষপর্বার তদারকি তাঁকে খানিকটা মেনে নিতেই হয়। সমস্ত কিছুর মধ্যে শুক্রাচার্যের অসীম স্বাতন্ত্র্য থাকা সত্ত্বেও বৃষপর্বার রাজ্যশাসনের নিয়ম-কানুন তাঁকে মেনে চলতেই হয়। বৃষপর্বা শুক্রাচার্যকে যত সম্মানই করুন, তাঁর মেয়ে শর্মিষ্ঠা এই ব্রাহ্মণ-গুরুকে যেহেতু রাজোপজীবী এক পুরোহিতমাত্র বলেই জানেন, তই শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানীর কর্তৃত্ব তিনি সেভাবে মেনে নিতে পারেননি। দেবযানীর প্রতি তাঁর ব্যবহার রাজকীয় মর্যাদা অতিক্রম করে এবদন্ত স্ত্রীসুলভ লঘুতায় পর্যবসিত হয়েছে।
শেষ করার আগে শর্মিষ্ঠা রীতিমত গালাগালি দিয়ে বললেন–ভিখারী মাগী। তুই কপাল কুটেই মর, অথবা মাটিতে গড়াগড়ি দে, তুই আমার অপকারের চেষ্টাই কর অথবা চিরকাল রাগ দেখিয়ে ঘুরে বেড়া–তুই আমার কিছুই হতে পারবি না। তুই বামনী ভিখারী, তোর যাতে অস্ত্রও নেই কোনও। আর আমি হলাম গিয়ে রাজকন্যা এবং তাও সশস্ত্রা। তুই জেনে রাখ, অন্তত আমি তোকে একটুও গ্রাহ্য করি না-ন হি ত্বং গণম্যৎ।
অসুরশক্তির কাছে যুক্তিতর্কের শক্তি খাটে না। দেবযানী নিজের মান্যতা বোঝানোর জন্য অনেক যুক্তি-তর্ক দেখিয়ে বিফল হলেন। শেষে অসুরকন্যা শর্মিষ্ঠার অঙ্গে জড়ানো আপন বসনখানি খুলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন দেবযানী। শর্মিষ্ঠার কোপ গাঢ়তর হল। উদ্যানবাটিকার মধ্যে একটি মজা কুয়ো হিল। কাপড় ধরে টানাটানি করতেই শর্মিষ্ঠা রাগের চোটে এমনই ধাক্কা দিলেন দেবযানীকে যে, তিনি সেই কুয়োর মধ্যে গিয়ে পড়লেন। শর্মিষ্ঠা বুঝেশুনেই দেবযানীকে ধাক্কা দিয়েছেন এবং সেটা এতটাই ইচ্ছাকৃত এবং সুপরিকল্পিত যে, তিনি জানতেন-দেবানী কুয়োয় পড়ে মারা যাবেন।
কুয়ো এতটাই গভীর যে সেখান থেকে একা একা উঠবার কোনও উপায় নেই। অসুরবাড়ির রাজকন্যা যাকে ইচ্ছাকৃতভাবে মারতে চেয়েছেন, তাকে অন্য কেউ, অন্তত ওই চত্বরের কেউ দয়া দেখিয়ে ওপরে তুলবে না। শর্মিষ্ঠা একবারের তরেও কুয়োয়-পড়া দেবযানীর দিকে ফিরেও তাকালেন না–অনবেক্ষ্য যযৌ বেশ। তিনি এই ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন যে, দেবযানী মারা গেছে–হতেয়মিতি বিজ্ঞায় শর্মিষ্ঠা পাপনিশ্চয়।
.
৩৪.
চৌত্রিশ আগেই বলেছিলাম-মহারাজ নহুষের অনেক পুত্র থাকা সত্ত্বেও যে দুটি পুত্রের সুবাদে তাকে যথার্থ পুত্রবান বলা যায়, সেই দুই পুত্র হলেন, যতি এবং যযাতি। যতি জ্যেষ্ঠ ছিলেন বটে, কিন্তু রাজ্যাকাক্ষী ছিলেন না। তিনি মুনিব্রত গ্রহণ করে বনবাসী হলেন আর পিতার রাজ্যে অভিষিক্ত হলেন যযাতি।
একটি বিশাল রাজ্যের রাজা হওয়ার জন্য যা যা গুণ থাকা দরকার, যযাতির তা ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং সত্যনিষ্ঠ–যযাতি নাহুষশ্চাসীৎ রাজা সত্যপরাক্রমঃ। মনে রাখা দরকার–ধর্ম বলতে যারা ফুল, বেলপাতা, নৈবেদ্য এবং পুরোহিত বোঝেন, সেই অর্থে যযাতিকে ধার্মিক বলা ঠিক হবে না। ধর্ম শব্দটা এখানে খুব বিশদর্থে প্রযোজ্য। বিশেষত সেকালের মনু-কথিত রাজধর্মের নিরিখে ধার্মিক রাজা বলতে অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ, যথোপযুক্ত দণ্ডদাতা এবং এক প্রজাপালক রাজাকেই নির্দিষ্ট করা যায়। সেকালে যে কোনও রাজার পক্ষে বহুবিধ যাগ-যজ্ঞ করাটা ছিল তাঁর জীবনের অঙ্গ। আধুনিকেরা এগুলিকে একধরনের রাজোচিত বিলাস বলেই মনে করেন। তবে যাগ-যজ্ঞের ব্যাপারটা আদতেই তা নয়।
রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালক হিসাবে রাজা ছিলেন চরম ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু যাগ-যজ্ঞের সময় একদিকে যেমন রাজাকে নিজের অভিমানমঞ্চ থেকে নেমে এসে ব্রাহ্মণের সর্বময় কর্তৃত্ব মেনে নিতে হত, তেমনই অন্যদিকে এই বিশেষ সময়গুলিতে তার পক্ষে দার্শনিকভাবে কিছু উন্নত হওয়ারও সুযোগ আসত অথবা সুযোগ ঘটত নিজেকে চেনার। যজ্ঞস্থলীর অগ্নিকুণ্ডে ক্রমাগত আহুতি দেওয়ার বহিরঙ্গে নিশ্চয়ই কিছু আড়ম্বর আছে, কিন্তু যজ্ঞকার্যের অন্তরঙ্গে যজ্ঞাধিষ্ঠিত দেবতা পুরুষের সঙ্গে একাত্মতাবধের ভাবনা থাকায় রাজা যাগ-যজ্ঞের মাধ্যমে নিজেকে দেবতার পর্যায়ে উন্নীত করতেন। বৈদিকেরা বলেছেন–দেবতারা যে সত্যি সত্যি দেবতা হয়েছেন, তা এই যাগযজ্ঞ করেই হয়েছেন–তেনোপাবৃত্তেন দেবা অজন্ত, তেনো, এতদভব যদিদং দেবাঃ। অর্থাৎ যাগ-যজ্ঞ করে যজমান ভাবে, ভাবনায়, মানসিক সিদ্ধিতে নিজেকে দেবতার পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা করতেন–যা বৈদিকাশ্য অশরীরা আহুতয়ঃ অমৃতত্বমেব তাভির্যজমানো জয়তি।
যাগ-যজ্ঞের মাধ্যমে দেবতার সঙ্গে রাজাদের এই একাত্মতার প্রয়াস যদি সত্যি হয়, তাহলে রাজার অভিষেকের সময় ধর্ম’ শব্দের প্রয়োগটিই আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় হবে। রাজসিংহাসনে উপবেশন করার আগে নানা যাগ-যজ্ঞের মধ্য দিয়ে রাজার অভিষেক সম্পন্ন করা হত। পাঁচ দিনের অভিষেক মহোৎসবের প্রথম দিনের যজ্ঞে অন্তত আটজন দেবতার উদ্দেশে আহুতি দেওয়া হত। রাজার সত্যনিষ্ঠার জন্য সবিতার উদ্দেশে, গার্হস্থ্য জীবনের জন্য অগ্নির উদ্দেশে–এই রকম আরও দেবতা আছেন–তারা কেউ সত্যপ্রসব, কেউ ‘গৃহপতি’ কেউ বা বনস্পতি। কিন্তু সবার শেষে যে দেবতার উদ্দেশে আহুতি দেওয়া হয় সেই বরুণ দেবতা কিন্তু ধর্মপতি’। এই ধর্ম শব্দের অর্থ ন্যায়; এই ধর্ম হল রাজদণ্ডের সুষ্ঠু প্রয়োগ। কারণ, বৈদিক দেবতার রাজ্যে বরুণই হলেন ন্যায়দণ্ডের অধিকর্তা। বরুণ তাই ধর্মপতি–বরুণো ধর্মপতীনা। যজ্ঞাহুতির একাত্মতায় রাজাকেও তাই ধর্মপতি হবার চেষ্টা করতে হয়, যে ধর্মের পতি’ হয়ে রাজা আইনের শাসন সূঠিকভাবে চালু করার চেষ্টা করবেন। ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় The Hindia theory regards Dharma or law, as the real sovereign, and the king as Danda or executive to support and enforce Dharma.
নহুষ যযাতিকে যদি ধার্মিক বলতে হয়, তবে এই অর্থে তাকে ধার্মিক বলতে হবে। নানা যাগ-যজ্ঞ করা অথবা নিত্য-নৈমিত্তিক দেবকার্য বা পিতৃকার্য সম্পন্ন করা–এইসব অর্থে যযাতি যত বড় ধার্মিক, তার থেকেও বেশি ধার্মিক তিনি রাজদণ্ডের পরিচালনায়। তাকে পরাজিত করেন এমন রাজা সোলে ছিলেন না। যাঁরা তাঁর প্রতিকূল ছিলেন, তাঁদের তিনি আপন শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন নিজে অপরাজিত থেকে। পররাষ্ট্রনীতির এই মাহাত্ম্য প্রভাব ফেলেছিল তার অন্তঃরাষ্ট্রীয় শাসনে। যযাতির ব্যক্তিত্ব এবং ভালবাসায় সমস্ত প্রজা তাঁর বশবর্তী হয়েছিল এবং সেই বশবর্তিতার নিরিখেই বলা যাবে যযাতি ধার্মিক রাজা, তিনি ধর্মানুসারে বঙ্কাল প্রজা-পালন করেছিলেন-স শাশ্বতীঃ সমাঃ রাজা প্রজা ধর্মেন পালয়।
যাঁরা ভাবেন–সেকালের রাজাদের জীবন খুব আয়েসে কাটত, তা সর্বার্থে ঠিক নয়। যিনি আদর্শ প্রজারঞ্জক রাজা তার জীবন মন্দাক্রান্তা তালে কাটত না। বরঞ্চ মন্দাক্রান্তা ছন্দের চেয়ে ত্বরিতগতি অথবা শার্দুলবিক্ৰীড়িত ছন্দের উপযোগই সেখানে বেশি। সকালে উঠে বন্দির বন্দনাগানের আয়েসটুকু মিটতে না মিটতেই বিদ্বান-বৃদ্ধ ব্রাহ্মণদের সম্ভাষণ-সৎকার দিয়ে রাজার দিন শুরু হত। তারপর সারাদিনই কাটত নানা ব্যস্ততার মধ্যে। দিনের পর দিন রাজকর্মের ব্যস্ততা রাজাদের এক সময় ক্লান্ত করে তুলত। আরও যেটা বড় সমস্যা রাজাদের নানারকম কর্মমন্ত্রণা এবং মানসিক ব্যস্ততার মধ্যে শারীরিক কায়ক্রেশ যেহেতু খুব কমই ঘটত, তাই শরীরে অস্বস্তিকরভাবে মেদের উপচয় ঘটত।
জীবনের ক্লান্তি এবং শারীরিক অস্বস্তি–এই দুটোই কাটানোর একমাত্র উপায় ছিল শিকারে চলে যাওয়া। বলা বাহুল্য, রাজাদের এই মৃগয়াপর্ব একদিনের মধ্যে সমাধা হত না। মৃগয়া মানেই দেড়/দুমাস বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, বাঘ-সিংহ, বন্য বরাহ এবং হরিণের পেছন পেছন ছোটা। খাওয়া-দাওয়ার সময়-অসময় নেই, নিদ্রার জন্য হস্তিপৃষ্ঠ এবং বৃক্ষশাখার সুব্যবস্থা। এতে শরীর ঝরে যেত দু চার দিনেই। আমাদের শাস্ত্রকারেরা মৃগয়াকে রাজাদের ‘ব্যসন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কারণ এই ব্যাপারটি কখনও কখনও রাজাদের মনে নেশার মতো চেপে বসত। এতে যেমন রাজকার্য নষ্ট হয়, তেমনই ঘটত বৃথা প্রাণিহত্যা। রাজনীতির নীতিনির্ধারকেরা তাই রাজাদের মৃগয়া একদমই পছন্দ করেননি।
কিন্তু নীতি-নিয়র বাঁধন-দণ্ডের মধ্যে আকাশের মুক্তি ছড়িয়ে দেবার মতো মানুষ ছিলেন আমাদের কবিরা। সুপ্রসিদ্ধ চন্দ্রবংশের অন্যতম অধস্তন পুরুষ মহারাজ দুষ্যন্ত যখন মৃগয়ায় যাবেন, তখন মহাকবি কালিদাস নীতিবাগীশদের মৃগয়া সম্বন্ধী প্রবচনগুলি মাথায় রেখে সেনাপতির মুখ দিয়ে গুণ গাইলেন মৃগয়ায়। রাজার বিদূষক মাধব্য দিনরাত রাজবাড়ির আরামে থেকে থেকে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, সে বিরলে বসে রাজাকে গালাগালি দিচ্ছিল। বলছিল, কী পাল্লাতেই না পড়েছি। এ শিকারী রাজার বন্ধু হয়ে আমার কী ঝামেলাই না হয়েছে।
তার ঝামেলাটা কী আমরা জানি। রাজবাড়ির রাজভোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্য হরিণ শুয়োরের মাংস পুড়িয়ে খেতে হচ্ছে। গাছের পাতা-পড়া এঁদো পুকুরের তিক্ত-কষায় জল পান করতে ধরে। গ্রীষ্মের রোদ্দুরে ঘুমিয়ে পড়ার মতো সুনিবিড় বৃক্ষছায়া পর্যন্ত নেই। দুষ্যন্তের সেনাপতি কিন্তু প্রাণোচ্ছ্বল ব্যক্তি। রাজার সঙ্গে বনেবাদাড়ে ঘুরতে তার বেশ লাগছে। রাজাকে দেখেই সে বলে ওঠে–আহা। কী চেহারা হয়েছে মহারাজের, যেন পাহাড়ি হাতি। অনবরত ধনুকের গুণ টানতে টানতে শরীরের ওপর দিকটা একেবারে পেটা লোহা হয়ে গেছে। রোদে গরমে কোনও কষ্টই হচ্ছে না রাজার। সেনাপতি রাজার বিদুষককে দুয়ো দিয়ে বলে ওঠে–মেদ ঝরে যাওয়ায় মহারাজের শরীরটা কেমন রোগা হয়ে গেছে দেখেছেন, একেবারে ঝরঝরে, যেন এই ডাকলে এই ওঠেন, কোনও আলস্য নেই। দুষ্যন্তের শরীর এবং মনে অসাধারণ উৎসাহ লক্ষ্য করে সেনাপতি শেষ সিদ্ধান্ত দেয়–মৃগয়ার মধ্যে শত শত দোষ খুঁজে শুধুশুধুই লোকে একে ‘ব্যসন’ বলে গালি দেয়, সত্যি সত্যি মৃগয়ার মতো এমন আনন্দ আর আছে নাকি-মিথ্যৰ বাসনং বদতি মৃগয়াশীগ বিনোদ কুতঃ।
আমরা মৃগয়ার কথাটা তুললাম এই জন্য যে, চন্দ্রবংশের কৃতী পুরুষ যতির ভাই যযাতি বহুদিন ধর্মানুসারে রাজত্ব করে পাত্রমিত্র সঙ্গে নিয়ে মৃগয়ায় বেরলেন। সেকালের দিনে মৃগয়ায় বেরলে অসুবিধে যেমন অনেক হিল, তেমনই সুবিধেও ছিল কিন্তু কিছু। মৃগয়ার জন্য দিন-রাত বনে-জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে যখন চরম ক্লান্তি আসত, তখন রাজাদের একমাত্র ভরসা ছিল ঋষিদের আশ্রম। ঋষি-মুনিরা লোকালয়ের বাইরে নির্জন অরণ্যভূমিতে পর্ণকুটির বেঁধে থাকতেন, ঋষিমুনিদের সঙ্গে দেখা করা এবং সৎসঙ্গ আলোচনায় এই হিল সুযোগ। মুনি। গৃহস্থ হলে ঋষিকন্যাও খুব দুর্লভ ছিল না। দুষ্যন্ত হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতেই কৰাশ্রমবাসিনী শকুন্তলার দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু তার বহু পূর্বপুরুষ যযাতির কাছে ব্যাপারটা এত সহজ হয়নি। সারাদিন মৃগ-বরাহের অনুবর্তী হয়ে তিনি অসম্ভব তৃষ্ণার্ত হয়ে বৃষপর্বার সেই বিশাল উদ্যানবাটিকায় প্রবেশ করলেন। তার মন আনন্দে নেচে উঠল। সামনেই বিশাল বাঁধানো ঘাট। উত্তাল সমীরণে পুষ্করিণীর জলে ঢেউ উঠছে, যেন তাকে হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছে জলপানের জন্য।
রাজা ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়াটি ছেড়ে দিলেন তৃণভোজনের জন্য। হরিণের পিছনে ছুটে ছুটে ঘোড়াটি পরিশ্রান্ত, রাজা যযাতি পিপাসার্ত। ধনুক-বাণ উষ্ণীধ রেখে রাজা যযাতি জল খেতে নামবেন, এমন সময় তাঁর কানে ভেসে এর রমণীকণ্ঠে ক্রন্দনের রোল। ক্রন্দনধ্বনি তত পরিষ্কার নয়, কেমন যেন গুমরানো, কোনও এক বন্ধ জায়গা থেকে যেন এ ক্রন্দন ভেসে আসছে। যযাতি ধনুক-বাণ-তরবারি পুণরায় হাতে নিলেন। মাথায় রাজোচিত পরিধান করে নিতে ভুললেন না। ক্রন্দনের স্বর লক্ষ্য করে এগোতে এগোতে রাজা বুঝলেন দূরে কোথাও নয়, কাছেই আছে এই ক্রন্দনের উৎস। একটু এগোতেই তাঁর ভারী আশ্চর্য লাগল। একটি পরিত্যক্ত মজা কুয়োর মধ্যে একটি রমণি আর্ত চিৎকার করছে বাঁচার আশায়। রমণী অতিশয় সুন্দরী। তাঁর রূপ আগুনের শিখার মতো, যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। পরিত্যক্ত মজা কুয়োর কথা পাঠকের স্মরণে আছে নিশ্চয়। সেই যেখানে বস্ত্রহরণের বিবাদে দানবরাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা দেবীকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন।
ক্ষণিকের জন্য মহারাজ যযাতি হতচকিত বোধ করলেন। মহাভারতের কবি একটিমাত্র উপমার অঙ্গুলিসংকেতে যযাতির মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন। সাধারণ অবস্থার একটি রমণীকে কুয়োয় পড়ে থাকতে দেখলে একটি পুরুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হত তাকে হাত বাড়িয়ে তুলে আনা। কিন্তু কবি বলেন–রমণী যেন আগুনের শিখার মতো– অগ্নিশিখামিব। আগুনে হাত দিতে যেমন মানুষের ভয় লাগে, তেমনই দেবযানীর চেহারার মধ্যে এমন এক আগুনপানা ব্যক্তিত্ব ছিল, এমন অহংকার ছিল, এমন এক দূরত্ব ছিল যেন তাঁকে দেখামাত্রই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলা যায় না—উঠে এস।। তাঁকে বিপদ থেকে ত্রাণ করার আগে ত্রাণকর্তাকেই যেন নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে হয়। তাঁকে স্পর্শ করার আগে মহারাজ যযাতির ভাষায় মধুর সান্ত্বনার স্বর যুক্ত হল—সান্না পরমবস্তুনা। যযাতি আগে তাঁর পরিচয় জানতে চান, আগুনে হাত দেওয়ার আগে তার দাহিকাশক্তি অথবা উষ্ণতার পরিমাণ করে নিতে চান যেন।
যযাতি বললেন–কে তুমি কন্যেও– ত্বং তানী শ্যামা মণিকুলা। সংস্কৃত শ্লোকের মধ্যে ‘শ্যামা’ শব্দটি লক্ষণীয়। কালিদাসের মেঘদূত-এ মন্দাক্তান্তায় উচ্চারিত ‘তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা’র ঝংকারে যারা যক্ষপ্রিয়াকে কালো মেয়ে ভাবেন, তারা অবশ্যই ভ্রান্ত। শ্যামা মেয়ে মানে, যে মেয়ের গায়ের রঙ গলিত সুবর্ণের মতো। এর ওপরে আছে মহামতি নীলকণ্ঠের টিপ্পনি–শ্যামা ষোড়ষবার্ষিকী যৌবনারূঢ়া। অর্থাৎ যযাতি যখন দেবযানীকে সম্বোধন করে বলেন–কে তুমি গো শ্যামা মেয়ে, তখন তার একটি শব্দচ্চারণের মধ্যেই যেন দেবযানীর সোনা-গলা গায়ের রং, আর তার ষোলো বছরের যৌবনটুকু ইঙ্গিতে বোঝানো আছে। অর্থাৎ আমার চোখ এড়ায়নি সুন্দরী, আমার খেয়াল আছে। যযাতি জিজ্ঞাসা করেন কে তুমি কন্যে? এমন তপ্ত-সোনার মতো গায়ের রং তোমার, ওপরে উঠবার জন্য যে। আঙুলগুলি তুমি বাড়িয়ে দিয়েছ, কেমন ঘষা তামার মতো লাল সেই আঙুলগুলি, কানে হিরে-পান্নার মাজা দুল–কিন্তু এসব তো সৌভাগ্যের লক্ষণ, সুন্দরী। এত সৌভাগ্য সত্ত্বেও তুমি বিপদাতুর মানুষের মতো কাঁদছ কেন–কস্মাচ্ছোচসি চাতুরা।
মহারাজ যযাতি আশ্চর্য হলেন। পরিষ্কার বুঝলেন, রমণী দূরে কোথাও থাকে না। ওই মাঠ, নদী, জঙ্গল, পুষ্করিণী–কোনওটাই যে এই রমণীর খুব অপরিচিত, তা মনে হচ্ছে না। যযাতি তাই অবাক হয়ে বললেন–এমন তো নয় যে, এই তৃণ-গুল্ম আচ্ছাদিত পরিত্যক্ত এই কুয়োটির কথা তুমি জানতে না, তবু তুমি কী করে এর মধ্যে পড়ে গেলে–কথঞ্চ পতিতাস্যস্মিন্ কুপে বীরুণাবৃতে? তার ওপরেও জরুরি কথাটা হল–তুমি কার মেয়ে? তোমার পরিচয় কী?
কুয়োর মধ্যে পড়ে থেকেও রমণী সগর্বে উত্তর দিল–যিনি সঞ্জীবনী বিদ্যার প্রভাবে দেবতাদের দ্বারা নিহত অসুরদেরও বাঁচিয়ে তুলতে পারেন, আমি সেই অসুরগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা। আমি যে এখনও এই নোংরা মজা কুয়োর মধ্যে পড়ে আছি, তার কারণ আমার এই আকস্মিক বিপন্নতার সংবাদ তার কানে পৌঁছয়নি–তস্য শুক্ৰস্য কন্যাহং স মাং নূনং ন বুধ্যতে। দেবযানী বুদ্ধিমতী এবং বিদগ্ধা। তিনি রাজাকে সেইটুকুমাত্র পরিচয় জানিয়েছেন, যেটুকু না জানালে নয়। এক অপরিচিতা সুন্দরীকে হাত ধরে টেনে তোলার আগে মহারাজ যযাতি সংকুচিত ছিলেন, অতএব আত্মপরিচয় দিয়ে দেবযানী রাজার সংকোচ অপনোদন করলেন মাত্র। কিন্তু কেন, কোথায়, কী হয়েছিল, কেনইবা তিনি কুয়োয় পড়ে গেলেন–এসব কথা তিনি কিছুই বললেন না, অনেক কথা বলে তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব লঘু করে দিলেন না যযাতির কাছে। বরঞ্চ কুয়ো থেকে তাড়াতাড়ি উঠে আসার জন্য তিনি তার নিজের রক্তলাল অঙ্গুলিগুলির কথা পুনরুল্লেখ করলেন, কেন না রাজা যযাতি একটু আগেই তার অঙ্গুলিগুলির প্রশংসা করেছেন।
দেবযানী বললেন–মহারাজ! এই আমার সেই দক্ষিণ হাতখানি, সেই তারক্ত অঙ্গুলি পঞ্চক–এষ মে দক্ষিণা রাজন্ পাণিস্তাম্রখালিঃ। আপনি এই হাতখানি ধরেই তুলে নিন আমাকে। দেবযানী নিজের মর্যাদা রক্ষার জন্যই রাজাকে মর্যাদা দিয়ে বললেন–নিশ্চয় মহান কোনও কুলেই আপনার জন্ম। আপনাকে দেখে শান্ত, বলবান এবং মনস্বী পুরুষ বলেই মনে হচ্ছে, আর ঠিক সেই কারণেই আমার হাত ধরে ওপরে তুলে নিয়ে যাবার জন্য আপনাকেই আমি যোগ্য লোক বলে মনে করছি তস্মান্মাং পতিতামস্মাৎ কৃপাদুদ্ধর্তুমহসি।
দেবযানী যে অবস্থায় পড়েছিলেন, তাতে যে কোনও লোকের হাত ধরেই তিনি ওপরে উঠে আসতেন। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে তিনি এতটাই সচেতন যে, রাজাকে দেখামাত্র তিনি নিজের অধীরতা প্রকাশ করেননি। কুয়ো থেকে বেরিয়ে আসার আকুলতা দেখিয়ে নিজেকে তিনি কোনও প্রার্থিনী প্রগলভা রমণীতে পরিণত করেননি। বিপমুক্তির জন্য তার কোনও অধীরতা বা আকুলতা ছিল না, তা মোটেই নয়। ছিল, কিন্তু বিদগ্ধা দেবযানী সে ব্যাকুলতা চেপে রেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যযাতির সমমর্যাদায়। বলেছেন–তুমি শান্ত, বীর্যবান এবং মনস্বী বলেই আমাকে উদ্ধার করার উপযুক্ত মনে করি তোমাকে।
মহারাজ যযাতি বুঝলেন-রমণী ব্রাহ্মণকন্যা। অতএব যথোচিত মর্যাদা প্রদর্শন করে তার দক্ষিণ হাতখানি বাড়িয়ে দিলেন দেবযানীকে তুলে আনার জন্য। মানবদেহের দুটি হাতই যথেষ্ট প্রয়োজনীয় হলেও ডান হাতটিই মর্যাদা এবং সভ্যতার প্রতীক। যযাতি তাই নিজের দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর দক্ষিণ হস্তখানি ধারণ করলেন–সেই হস্তখানি, যার আতা আভায় যযাতির ধনুর্ধারণ কর্কশ হস্তখানি যেন রঞ্জিত হল। দেবযানীকে তিনি কৃপগর্ত থেকে উদ্ধার করে আনলেন–গৃহীত্ব দক্ষিণে পাণাবুজ্জহার ততো’বটাৎ! কূপ থেকে দেবযানীকে তুলে আনবার পর মহারাজ আর এক মুহূর্তের জন্যও দেরি করেননি। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যযাতি নিজের রাজধানীতে ফিরে এলেন।
মহাভারতের কবি কিচ্ছুটি বললেন না। অথচ খটকা একটা রয়েই গেল। যে রাজা মৃগয়ায় মত্ত হয়ে বনে বনে ঘুরছিলেন, তৃষ্ণার্ত হয়ে উদ্যানবাটিকায় প্রবেশ করেছিলেন, তার শিকার বন্ধ হয়ে গেল, জল খাওয়া মাথায় উঠল। তিনি এক মুহূর্তের জন্য দেবানীকে দেখলেন, আর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। এ কেমন কথা হল? মহাভারতের কবি যযাতির বিদায়-যাত্রা বর্ণনা করেছেন একটি মাত্র পংক্তিতে এবং সেটি বড়ই অর্থবহ। বঙ্কিমি কায়দায় বলতে গেলে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায়–নির্জন জনপদে বিশাল উদ্যানবাটিকার মধ্যে সমীরণ যখন বড়ই ব্যাকুল, পাঠক! আপনি তখন তৃণাবৃত কুপের মধ্য হইতে এক সুন্দরী রমণীকে উদ্ধার করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। রমণীদেহের লঘুতা শাস্ত্রেকাব্যে যতই প্রশংসিত হউক, রমণীর কিশলয়পল্লববৎ কোমল অঙ্গুলিমাত্র, ধারণ করিয়া সম্পূর্ণ রমণীর শরীর কৃপের নিম্নতা হইতে সমভূমির উচ্চতায় তুলিয়া আনা কেবল দেবতার অলৌকিক স্পর্শেই সম্ভবে, মনুষ্যদেহে নহে।
মহাভারতের কবিকে তাই বলতে হল–যযাতি বলপূর্বক তাকে কুয়োর মধ্যে থেকে তুলে এনেই-উদ্ধৃত্য তরসা চৈনা-সুনিতম্বা দেবযানীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন–আমন্ত্ৰয়িত্ব সুশ্রোনীং যযাতিঃ স্বপুরং যযৌ। বলপূর্বক কুপ হইতে উদ্ধার করিতে গেলে রমণী শরীর কী পরিমাণে স্পর্শ করিতে হইবে, কতটুকুই বা বলপ্রয়োগ করিতে হইবে, পাঠক আন্দাজ করিতে পারেন। কিন্তু বিশাল বুদ্ধি ব্যাসের শব্দভাণ্ডারে দেবযানীর বিশেষণ হিসেবে আর কি কোনও শব্দ প্রযুক্ত হতে পারত না। সুশ্রোণী দেবযানীর কাছে বিদায় নিলেন যযাতি। ভাবে বুঝি– যযাতির দাঁড়াবার কোনও উপায় ছিল না। অপরিচিতা রমণীকে যে শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে তাকে তুলে আনতে হয়েছে, তাতে যযাতির আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রম্ভালাপ করার মুখ ছিল না। তিনি মুহূর্তের মধ্যে বিদায় নিলেন, কিন্তু যাঁর কাছে তিনি বিদায় নিলেন, তিনি ধীরা, স্নিগ্ধা, লজ্জিতা দেবযানী নন, তিনি সুনিতম্বা দেবযানী। যযাতির বিদায় মুহূর্তে রমণীশরীরের এই একটি মাত্র প্রত্যঙ্গ সন্ধির উল্লেখ করে মহাভারতের কবি বুঝিয়ে দিলেন–যযাতি মরিয়াছেন, তিনি পুনরায় মরিতে আসিবেন। দীপ্ত অগ্নিশিখাবৎ-কন্যামগ্নিশিখামিব–দেবযানীকে স্পর্শ করিয়া যে পতঙ্গ একবার হস্তপক্ষ পুড়াইয়াও কোনওমতে বাঁচিল, সে অগ্নির রূপে মুগ্ধ হইয়া আবার পুড়িতে আসিবে। পতঙ্গবন্ বহ্নিমুখং বিবিক্ষুঃ। পাঠক! ক্ষণকাল অপেক্ষা করো। রূপের আগুন মনুষ্যপতঙ্গকে মেনে পুড়ায়, বসিয়া দেখো।