০০৫. উগ্রশ্রবা সৌতির গল্প

০৫.

কাহিনী জমে উঠেছে। উগ্রশ্রবা সৌতির গল্পে সমবেত মুনি-ঋষিরা এখন রীতিমতো ‘সাসপেনস’ নিয়ে বসে আছেন। উতঙ্ক জনমেজয়কে ক্ষেপিয়ে তোলার পর তিনি কী করলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। সৌতি কিন্তু কিছু বললেন না, সাসপেনসটা ধরে রাখলেন। উতঙ্কও যে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের একটা কারণ–এইটুকু বলেই সৌতি বললেন, বলুন আর কী শুনতে চান? কীই বা আর বলব- কিং ভবন্তঃ শ্রোতুমিচ্ছত্তি, কিমহং ব্রুবাণি ইতি।

ঋষিরা অনেকক্ষণ গল্প শুনেছেন। কুলপতি শৌনক তখনও অগ্নিশরণগৃহে। ঋষিদের একটু লজ্জাই করল। এই বারো বছরের যজ্ঞ মহর্ষি শৌনকেরই ঘাড়ে। মূল দায়িত্ব তার বলে ব্যস্ততাও তার বেশি। ঋষিরা মজাসে গল্প শুনছেন, আর ওদিকে কুলপতি শৌনক–কোথায় যজ্ঞকাষ্ঠ, কোথায় সোম-রস, কোথায় কোন বৈদিক বসবেন–এ সব নিয়ে মরছেন। সমবেত ঋষিদের লজ্জা হল। তারা বললেন–সৌতি! কুলপতি শৌনক আসুন এখানে। আমাদের তো অনেক কিছুই শুনতে ইচ্ছা। কিন্তু কী জান, দেবতা-অসুর-গন্ধর্ব-মনুষ্য-নাগ–এঁদের খবর কুলপতি শৌনকও ভাল মতো রাখেন–মনুষ্যোরগ-গন্ধর্ব-কথা বেদ চ সর্বশঃ। কাজেই তিনি এলে আমাদের প্রশ্ন করারও যুত হবে।

অর্থাৎ সৌতি উগ্রশ্রবার ফাঁকি দেবার উপায় নেই। যারা জানেন অল্প, তাদের কাছে গল্প ফঁদা এক জিনিস, কিন্তু শৌনকের মতো বিদ্বান, বুদ্ধিমান প্রাধ্যাপকের সামনে কি চলবে না। কাহিনীকার এবং সহৃদয় রসিক শ্রোতা এক সঙ্গে বসবেন, তবেই না মহাকাব্যকথা আরম্ভ হবে। তা মহর্ষি শৌনক এসে গেলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। তিনি কিন্তু এসেই আগে কিছু শুনতে চাইলেন না। নতুন কথক-ঠাকুর কেমন কতখানি জানেন তিনি, সেসব খোঁজ-ভঁজ নিয়ে তবে তিনি আসল কথায় যাবেন। নতুন কথককে পরীক্ষা করার জন্য তিনি বললেন- তোমরা বাবা রোমহর্ষণ ছিলেন পুরাণ-বিজ্ঞ মানুষ; স্বয়ং ব্যাসের কাছে তাকে মহাভারতের কাহিনী পড়তে হয়েছে। তা বাপু, তুমিও কি সেইরকম পড়াশুনা করে এসেছ–ক্কচিৎ ত্বমপি তৎ সর্বমধীষে লৌমহর্ষণে–নাকি ফাঁকি আছে তোমার বিদ্যায়? আচ্ছা বেশ, থাক এসব কথা–তুমি বরং একটু ভূত-বংশের কাহিনী বলো দেখি, শুনি–শ্রোতুমিচ্ছামি ভার্গব। সৌতি উগ্রশ্রবার পরীক্ষা আরম্ভ হল। আসলে শৌনক যে সব ছেড়ে ভৃগুবংশের কথাটাই প্রথম শুনতে চাইলেন, তার কারণ–তিনি নিজেও ভৃগুবংশীয়। আত্মবংশের সব কিছুই তাঁর জানা। সৌতি উগ্রশ্রবার তাই বড় পরীক্ষা সামনে।

 ভৃগু-বংশের নাম শোনা মাত্রই পণ্ডিতরা কিন্তু টান-টান হয়ে বসেন। সুকৃথঙ্কর থেকে সুকুমারী ভট্টাচার্য–অনেক পণ্ডিতেরই ধারণা যে, মহাভারত-রচনা, বিশেষত মহাভারতের প্রক্ষিপ্তাংশে ভৃগুবংশীয়দের ভাল রকম হাত আছে। আমি সেই সব বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। মহাভারত যেমনটি আমাদের হাতে এসেছে, তাই নিয়েই আমাদের বিচার। তবে হ্যাঁ, পণ্ডিতরা যে সৌতি উগ্রশ্রবাকে মহাভারতের ‘থার্ড এডিটর’ বলেছেন, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। প্রসঙ্গত বলি- তাদের মতে মহাভারতের প্রথম সম্পাদক ব্যাসদেব, দ্বিতীয় সম্পাদক ব্যাস-শিষ্য বৈশম্পায়ন, যিনি জনমেজয়কে মহাভারত-কথা “শুনিয়েছেন। আর আমাদের থার্ড এডিটর’ সৌতি উগ্রশ্রবা–যেমনটি বৈশম্পায়ন এবং তাঁর পিতা রোমহর্ষণের কাছে পুরাণ-কথা, ভারতের ইতিহাস শিখেছেন, তেমনটি আমাদের বলেছেন। বেশির মধ্যে এই, তার কাহিনীতে আছে তার নিজের কালের হাওয়া, নিজের সময়ের সমস্যা এবং সংকট। সেও তো সামাজিক ইতিহাসই বটে, না হয় সেটা কিছু পরবর্তী সময়ের, তাতে আমাদের কী অসুবিধে? আমরা সেটাও জানতে চাই।

সৌতি উগ্রশ্রবা বলতে আরম্ভ করলেন। মহর্ষি ভৃগুর স্ত্রী ছিলেন পুলোমা। আগেই জানিয়ে দিই- প্রথম কল্পে ব্রহ্মা যাদের দিয়ে তার সৃষ্টিকার্য আরম্ভ করেছিলেন, ভৃগু তাদের অন্যতম। ওদেশে যাকে আমরা অ্যাডাম বলে ডেকেছি, আমাদের দেশে ওরকম অ্যাডাম’অন্তত দশজন আছেন। তাদের বলা হয় ব্রহ্মার মানসপুত্র। তাদের মধ্যে জনা পাঁচেক ব্রহ্মবাদী হয়ে ব্রহ্মসাধনে মন দিলেন, আর অন্য পাঁচজন বিবাহাদি করে সৃষ্টির প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলেন। আমাদের ভৃণ্ড এই দ্বিতীয় দলের। তার স্ত্রীর নাম পুলোমা। তিনি যথেষ্ট সুন্দরী, কিন্তু তার স্বভাবটা ভৃগুর মতোই অর্থাৎ এঁর সঙ্গে ওঁর মত মিলত খুব কথকঠাকুরের ভাষায়–সমশীলিনী। ঋষির সঙ্গে আনন্দে তার দিন কাটছে, এরই মধ্যে ভৃগুর সন্তান এল পুলোমার গর্ভে।

মহর্ষি ভৃগু একদিন গর্ভবতী স্ত্রীকে আশ্রমে একা রেখে বেরিয়েছেন নদীতে স্নান করার জন্য। ব্রাহ্মণ মানুষ; স্নানে একটু সময় লাগে–সন্ধ্যা আহ্নিক, সূর্য-প্রণাম আর অবগাহন করতে যে সময় লাগে, সে সময় খুব কম নয়। এরই মধ্যে একটি রাক্ষস এসে পৌঁছলেন ভৃগুর আশ্রমে। ভৃগুর সুন্দরী স্ত্রীটিকে দেখে রাক্ষসের মন বড় পুলক হল, বেশ কামাবেশও হল। লক্ষণীয় ব্যাপার হল–এই রাক্ষসের নামও পুলোমা।

দুই পুলোমা–অর্থাৎ ভৃগুর স্ত্রী পুলোমা এবং রাক্ষস পুলোমা–এই দুজনের দেখা হওয়ার আগেই একটা জ্ঞানের কথা শোনাই। মনে রাখতে হবে রাক্ষস’ শব্দটা শোনামাত্রই আপনারা যারা পুরুষ্টু গোঁফওয়ালা বিশাল দাঁতওয়ালা, হা-হা-ধ্বনিযুক্ত কতগুলি জীবের কল্পনা করেন, তাদের আমরা রীতিমতো নিরাশ করব। রাক্ষসেরা সকলেই দেবতাদের বৈমাত্রেয় ভাই এবং তাদের বাবা একজনই- মহর্ষি কাশ্যপ। পুরাণে-ইতিহাসে এবং দর্শনে যেমনটি আছে তার বিস্তৃত আলোচনায় গেলে আপনারা আবার আমাকে জ্ঞানদাতা ঠাকুরদাদাটি ভাববেন বলে তার মধ্যে যাচ্ছি না, যদিও গেলে ভাল হত। তবে জেনে রাখুন- তারা ভাল রকম সংস্কৃত জানতেন, বেদ-বেদাঙ্গ-ব্যাকরণের জ্ঞানও তাদের বেশ টনটনে। দেবতাদের থেকে তাদের গুণ কোথাও কোথাও বেশি। বস্তুত তাদের মতো ইঞ্জিনিয়ার এবং শিল্প-রসিক তো সে যুগে কমই ছিল। রাবণের স্বর্ণলঙ্কা অথবা ময়দানবের তৈরি ইন্দ্রপ্রস্থ অথবা ত্রিপুর দুর্গ স্মরণ করলেই রাক্ষসদের শিল্প-সত্তার পরিচয় পাবেন আপনারা। দেখতেও তারা কেউ খারাপ নন, রীতিমতো সুপুরুষ।

এত সব গুণ থাকা সত্ত্বেও কতগুলি দোষই এঁদের একেবারে রাক্ষস করে ছেড়েছে। দোষের মধ্যে প্রধান হল ছয় রিপু, বিশেষত কাম-ক্রোধ তাদের এতই বেশি প্রবল, অপিচ নিজের ওপর তাদের সংযমও এতই কম যে, শুধু ষড়রিপুই তাদের রাক্ষস বানিয়ে দিল। নইলে দেখুন, দেবতা-রাক্ষসে যতই শাশ্বতিক বিরোধ থাক, তাদের মধ্যে এমনিতে মিলটাই বেশি। বিয়ে-থাও কিছু কম চলত না। এই পুলোমা রাক্ষসের কথাই ধরুন। পুরাণে-ইতিহাসে পুলোমা’ নামে কিন্তু দু-তিন জন রাক্ষস আছেন। রাক্ষসদের পুরো একটা শুষ্টিকেও তাদের মায়ের নামে পুলোমার গুষ্টি বলা হয়েছে মহাভারতে। পুলোমা আর কালকা–একজন দৈত্য-সুন্দরী অন্যজন অসুর-সুন্দরী- পুলোমা নাম দৈতেয়ী কালকা চ মহাসুরী। এরা দুজনেই তপস্যা করে ব্রহ্মর কাছে নিজেদের ছেলেদের জন্য বর চেয়ে নিয়েছিলেন। এই পুলোমার ছেলেরাই পৌলোম গুষ্টির রাক্ষস–পৌলোমৈশ্চ মহাসুরৈঃ।

পুলোমা নামে এই রাক্ষস-সুন্দরীর কথা বলে নিলাম এইজন্য যে, রাক্ষসদের মধ্যে পুলোমা নামটা মেয়েদেরও চলত, ছেলেদেরও চলত। এই রকমটা ব্রাহ্মণ-ঋষিদের মধ্যেও চলত, যেমন আস্তীক-মুনির পিতা জরৎকারু মুনির পত্নীও জরৎকারু, যদিও এই স্ত্রী-জরৎকারু নাগ-বংশের মেয়ে। সেকথা পরে। কারণ দেবরাজ ইন্দ্র যাকে সপ্রেমে বিয়ে করেছিলেন, সেই শচী-দেবী কিন্তু এক রাক্ষসে পুলোমার মেয়ে। শচীদেবীকে অনেকেই আদর করে পৌলোমী বলে ডাকেন। এখনকার অনেক মা’ও সাদরে কন্যার নাম দেন পৌলোমী। এমন রাক্ষুসে নাম শুনে দুঃখ পাবার কিছু নেই। আমার বক্তব্য, দুটো আলাদা আলাদা উদাহরণ থেকে এটা কিন্তু বেশ প্রমাণ হল যে, পুলোমা নামটা রাক্ষস-দৈত্যদের মধ্যে বেশ চলত। আমার তো বেশ সন্দেহ হয়, মহর্ষি ভৃগু হয়তো এক রাক্ষসীকেই বিয়ে করেছিলেন, হয়তো রাক্ষস-ঘরেরই এক পরমা সুন্দরী কন্যা তিনি। এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ এই মুহূর্তে কিছু দিতে পারছি না বটে, তবে পুরাণে ইতিহাসে এ তাবৎ যত ‘পুলোমা পাওয়া গেছে, সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, তারা সবাই রাক্ষস-ঘরের সন্তান। ঠিক এই দৃষ্টিতে দেখলে ভৃগুর স্ত্রী পুলোমার সঙ্গে রাক্ষস পুলোমার পূর্ব-পরিচয় থাকাও অসম্ভব নয় এবং সত্যি বলতে কি পূর্ব-পরিচয় ছিলও।

যাই হোক, ভৃগুমুনি স্নান করতে গেছেন, আর এই অবসরে রাক্ষস পুলোমা ঢুকে পড়লেন ঠার আশ্রমে। তার বেশ-বাস বা চেহারার মধ্যে কোনও রাক্ষুসেপনা ছিল না। কেননা সুন্দরী পুলোমা তাকে দেখে ভয়ও পাননি, লজ্জাও পাননি। বরং সেকালের আতিথ্যের আদর্শে থালায় করে বেশ কিছু ফল-মূল খেতে দিয়ে ঘরে নেমন্তন্ন করলেন রাক্ষসকেন্যময়ত বন্যন ফল-মূলাদিনা তদা। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও অন্তত রাক্ষস ততটাই ভদ্র যে, বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও পুলোমার মনে কিন্তু ভৃগুপত্নীকে পাবার জন্য কামনা ছিল হৃচ্ছয়েনাভিপীড়িত। রাক্ষস পুলোমা ভাবলেন–এই সুযোগ। বাড়িতে ভৃণ্ড-মুনি নেই। এই অসামান্যা রূপবতী ভৃগুপত্নীকে হরণ করে নিয়ে যাবেন তিনি। আজ থেকে ভৃগুপত্নীকে আপন বাহুর ডোরে পাবেন তিনি–এই চিন্তায় বড় খুশি হয়ে উঠলেন রাক্ষস পুলোমা–হৃষ্টমভূদ রাজন জিহীর্যুস্তাম্ অনিন্দিতাম্।

মনে মনে তার খুশি হওয়ার একটা কারণও ছিল। রাক্ষস পুলোমা দেবীকে আগেই চিনতেন। হয়তো সেই পুতুল-খেলার বয়স থেকে, হয়তো বা পৌগণ্ডের দিনশেষে যেদিন যৌবনের উদভেদ দেখা দিল পুলোমার শরীরে, সেদিনই জনান্তিকে রাক্ষস বরণ করেছিল এই অনুপমা সুন্দরীকে–সা হি পূর্বং বৃতা তেন পুলোম্না তু শুচিস্মিতা। সুন্দরী পুলোমা হয়তো সে কথা জানতেন। হয়তো বা জানতেন না। কিন্তু পুলোমার বাবা অন্তত জানতেন যে, রাক্ষস পুলোমা তার মেয়েকে বিয়ে করতে চান। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক তার মেয়ের সম্বন্ধে রাক্ষসের এই মনন-বরণ পুলোমার বাবা পছন্দ করেননি।

মহাভারতের বিখ্যাত টীকাকার নীলকণ্ঠ যেভাবে এই দুই যুবক-যুবতীর হৃদয় ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে বেশ বুঝতে পারি–অতিরিক্ত বেদাভ্যাসের ফলে তার বুদ্ধি হয়তো খানিকটা কালিদাসীয় পদ্ধতিতে জড় হয়ে গিয়েছিল–বেদাভ্যাসজড়ঃ। নইলে ভাবুন একবার, নীলকণ্ঠ যখন মহাভারতের শ্লোকে দেখলেন–পুলোমা রাক্ষস ভৃগুর সঙ্গে বিয়ের আগেই সুন্দরী পুলোমাকে চেয়েছিলেন এবং পুলোমার বাবা সেটা জেনেও মেয়েকে তার হাতে দেননি, তখনই তিনি ব্যাখ্যা করলেন–ছোটবেলায় তার মেয়ে পুলোমা যখন কেঁদে কেঁদে একসা হত, তখন তার বাবা তাকে ভয় দেখিয়ে বলতেন—আর তো রাক্ষস। ধরে নিয়ে যা, এক্ষুনি ধরে নিয়ে যা এই মেয়েটাকে–বাল্য কিল রুদতীং কন্যাং রোদননিবৃত্ত্যর্থং ভীষয়িং পিত্রা উক্তং ‘রে রে রক্ষ! এনাং গৃহাণেতি। নীলকণ্ঠের ধারণা–এই রকম কোনও ভয় দেখানোর সময় পুলোমা রাক্ষস কথাগুলি শুনতে পায়-এক মেয়েটিকে মনে মনে বরণ করে।

বলা বাহুল্য, এ বিষয়ে আমার ভাবনা এতটা বাৎসল্যময়ী নয়। নির্দোষ তো নয়ই। আমি এই ঘটনার মধ্যে ক্রমে ক্রমে পরিচিত দুই মুগ্ধ হৃদয়ের স্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাই। সুন্দরী পুলোমার পিতা এই হৃৎস্পন্দন অস্বীকার করেছেন। তিনি এই যুবক-যুবতাঁকে মিলিত হতে দেননি। এবং তার কারণ দুটো হতে পারে। পুলোমা যদি রাক্ষস-ঘরের মেয়ে হন, তবে অধিকতর উৎকৃষ্ট পাত্রের জন্য তার পিতার অপেক্ষা থাকতে পারে। আর পুলোমা যদি আর্যগোষ্ঠীরই মেয়ে হয়ে থাকেন, তবে তথাকথিত অনার্য রাক্ষসের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ায় তার আর্যজনোচিত শুদ্ধতায় আঘাত লাগতে পারে।

যাই হোক, রাক্ষস পুলোমা এত-শত বোঝেন না। তিনি জানেন–তার সঙ্গে বঞ্চনা করা হয়েছে। সুন্দরী পুলোমার বাবা লুকিয়ে ভৃগুর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন মেয়ের। রাক্ষস তাতে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। এতদিন পরে তিনি তার পুরাতনী নায়িকাকে খুঁজে পেয়েছেন। রাক্ষসের ঘরে জন্মে এমন শুচিবাইও তার নেই, যাতে শুধু অন্যের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে পূর্ব-পরিচিতা অথবা যৌবন-মুখর দিনের প্রথম চাওয়া রমণীটিকে ছেড়ে দেবেন তিনি। রাক্ষস ভৃগুপত্নীকে অপহরণ করার মতলব করল।

 ভৃগু যখন স্নানে গেছেন, তখনও তার ঘরে পবিত্র হোমাগ্নি জ্বলছিল। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের ঘরে যজ্ঞের আগুন কখনও নির্বাপিত হয় না। ঘরের মধ্যে প্রতিনিয়ত যে গার্হপত্য অগ্নি জ্বলছে, সেই আগুন থেকে আগুন নিয়েই ব্রাহ্মণের অন্য যজ্ঞ-প্রক্রিয়া চলে। ভৃগুপত্নীকে হরণ করার আগে সেই পবিত্র আগুনের দিকে রাক্ষসের চোখ পড়ল। আর্য-গোষ্ঠীর চরম বিশ্বাসের প্রতীক এই আগুনকেই সাক্ষী মানলে রাক্ষস। বললেন,-সত্যি করে বলো তো তুমি, এই সুন্দরী পুলোমা কার বউ?

 রাক্ষস রীতিমতো বৈদিক পদ্ধতিতে অগ্নিকে স্তুতি করে বললন-তোমাকে না সবাই দেবতাদের মুখ বলে ডাকে? তা সেই মুখে সত্যি করে বলতো- পুলোমা আসলে কার বউ? আমিই তো তাকে প্রথম আমার স্ত্রীরূপে বরণ করেছিলাম–ময়া হীয়ং বৃতা পূর্বং ভার্যার্থে বরবর্ণিনী? কিন্তু তারপর? এই রমণীর পিতা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমাকে বঞ্চিত করে এঁকে ভৃগুর হাতে সম্প্রদান করেছেন। পুলোমা অগ্নিকে অনুনয় করে বললেন, আচ্ছা তুমিই বলো আগুন, কাজটা কি ঠিক হল? আচ্ছা, সে যদি বা লুকিয়ে চুরিয়ে কোনও চক্রান্তে ভৃগুর স্ত্রী হয়েও থাকে, সেয়ং যদি বরাবরাহা ভৃগোর্ভার‍্যা রহোগ, তথাপি ন্যায়ত সে আমারই স্ত্রী কি না–তুমিই সত্যি করে বল। সেই যেদিন থেকে এর বাবা অন্যের হাতে দিয়ে দিয়েছেন আমারই বরণ করা বধূকে, সেদিন থেকে মনে আমার আগুন জ্বলছে–প্ৰদহন্নিব তিষ্ঠতি।

পুলোমা অগ্নিকে এবার তার শেষ সিদ্ধান্ত জানালেন। বললেন–সুন্দরী পুলোমা আমারই স্ত্রী হবেন বলে সম্পূর্ণ নির্ধারিত ছিল। সেখানে মাঝখান থেকে ভূগু যে তাকে বিয়ে করে ফেলেছেন–এতে আমি নিশ্চয়ই খুব পুলকিত বোধ করছি না–অসম্মতমিদং মে’দ্য। তুমি জেনে রেখ, আগুন! আজ আর আমি ছাড়ব না, আজকে তারই আশ্রম থেকে তার স্ত্রীকে হরণ করব আমি।

ঠিক কথাটি বলবার জন্য অর্থাৎ সুন্দরী পুলোমা ন্যায়ত তারই স্ত্রী, নাকি ভৃগুর–এই শঙ্কা নিবারণের জন্য রাক্ষস পুলোমা অগ্নিকে যেভাবে বলেছিলেন তাতে মহাভারত যদি বেদ হত, তাহলে এতক্ষণ আমরা একটি অগ্নিসূক্ত শুনতে পেতাম। বৈদিকরা অগ্নিকে দেবতাদের মুখ বলেই কল্পনা করেছেন, কারণ মানুষের দেওয়া আহুতি-দ্রব্য দেবতারা অগ্নির মুখ দিয়েই গ্রহণ করেন–অগ্নির্বৈ দেবানাং মুখম্–এবং রাক্ষস পুলোমাও তাই বলেছে। অগ্নি মানুষের সমস্ত পাপ-পুণ্যের সাক্ষী, সর্বজ্ঞ এবং তিনি সমস্ত মানুষের প্রাণজ্যোতি–বৈদিকরা এই ভাবেই অগ্নির কল্পনা করেছেন যার শেষ পরিণতি–আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে এ জীবন পুণ্য কর। রাক্ষস পুলোমার মুখে বৈদিক ঋষির অগ্নি-স্তুতি শুনে মহাভারতের মধ্যে যেমন বেদের প্রতিষ্ঠা দেখতে পেলাম, তেমনই রাক্ষসদের সম্বন্ধে আমাদের চিরাচরিত ধারণাটাও বা কিছু ঠিক হল। অর্থাৎ বৈদিক রীতি-নীতি রাক্ষসদের কিছু অজানা ছিল না।

পুলোমা রাক্ষস যেভাবে অগ্নিকে সাক্ষী ঠাউরেছেন, তাতে এখন অগ্নি-দেবতাকে ভাবতে এবং দেখতে লাগছে ঠিক মানুষের মতোই। মহামতি যাস্ক, যিনি প্রথম বৈদিক অভিধানকার বলে চিহ্নিত, তিনি অবশ্য অনেকের মত সংকলন করে বলেছেন–দেবতাদের বুঝি বা মানুষের মতোই দেখতে–পুরুষবিধাঃ স্য। মানুষের হাত-পা, চোখ-মুখ, গায়ের রং–সবই বৈদিক দেবতাদের মধ্যেও দেখেছেন। এখানে তো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই নয় শুধু, আমরা অগ্নিকে রাক্ষস পুলোমার দুঃখে দুঃখিতও হতে দেখছি–তস্যৈত বচনং ত্বা সপ্তাৰ্চিদুঃখিতো শম্। রাক্ষস পুলোমা যে বঞ্চিত হয়েছেন, সে কথা অগ্নি মনে মনে মানেন ঠিকই, কিন্তু এই যে ভৃগুমুনি–আগুন থেকেই যাঁর জন্ম এবং যিনি স্বয়ং ভগবানের বুকেও পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন–সত্যি কথা বললে তাঁর ক্রোধ থেকে নিস্তার পাবেন কী করে?

এদিকে মিথ্যা কথা বলার ভয়, অন্যদিকে ভূণ্ডর অভিশাপের ভয়–অতএব দুই দিক রক্ষা করেই অগ্নি বললেন–দানব! তুমিই যে আগে এই সুন্দরী পুলোমাকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করেছিলে, সে কথা আমি জানি; কিন্তু বিধি অনুসারে মন্ত্রপাঠ করে তুমি তো এই মেয়েকে। বিয়ে করনি–কিং ত্বিয়ং বিধিনা পূর্বং মন্ত্রবন্ন বৃতা ত্বয়া। অন্যদিকে এই কন্যার পিতা পুলোমাকে বৈদিক বিধি অনুসারে মন্ত্রপাঠ করে ভৃগুর হাতে সম্প্রদান করেছেন। হ্যাঁ, জানি, পুলোমার পিতার এখানে স্বার্থ ছিল। তিনি ভেবেছিলেন–মেয়েকে ভৃগুর হাতে দিয়ে তিনি ভৃগুর কাছ থেকে বর-লাভ করবেন এবং সেই আশাতেই তোমার হাতে তিনি মেয়ে দেননি–দদাতি ন পিতা তুভ্যং বরলোভান্মহাযশাঃ।

জেনে রাখা ভাল, ভারতে বিবাহের বিধি চিরকাল, একরকম থাকেনি। পরবর্তী কালের স্মৃতিশাস্ত্রেও এই নিয়ে ঘোর বিবাদ আছে। কেউ বলেন–সম্প্রদান-মন্ত্রেই বিবাহ সম্পন্ন হয়, কেউ বলেন, পাণি গ্রহণ হলে তবেই বিবাহ সম্পন্ন হবে, আবার কেউ বা সপ্তপদী-গমনের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এখানে সেই তর্ক তোলার প্রয়োজন নেই। এবং তর্ক বাদ দিয়েও এটা বোঝা যাচ্ছে–পুলোমা সেকালের দিনের এক অতীব প্রার্থনীয়া রমণী। একদিকে এক রাক্ষস তাঁকে মনে মনে বরণ করেছেন, আর এক দিকে এক ঋষি-চূড়ামণি এই রমণীকে লাভ করার জন্য কন্যার পিতাকে বর দিতে চেয়েছেন। পুলোমার পিতা কী বর পেয়েছিলেন মহাভারতের কবি তা স্পষ্ট করে বলেননি, কিন্তু রাক্ষস পুলোমা অগ্নির কথায় তার আপন বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া মাত্রই ভৃগুপত্নীকে তুলে নিয়ে গেলেন আশ্রম থেকে। অপহরণ, পরের স্ত্রীকে নিজের ভেবেই অপহরণ করলেন।

ভৃগুপত্নী পুলোমা গর্ভবতী ছিলেন। রাক্ষসের দ্রুততা এবং নিজের ভয়–এই দুয়ে মিলে পথের মধ্যেই তার গর্ভচ্যুত হল। গর্ভচ্যুত হয়ে জন্মাবার ফলেই তার পুত্রের নাম হল চ্যবন। রাক্ষস পুলোমা চ্যবনের অদ্ভুত তেজে ভস্মীভূত হলেন–এই অলৌকিক কথা আপনারা বিশ্বাস করুন বা না করুন–সেটা মহাভারত-কথার বড় কোনও অঙ্গ নয়। এমনকি ভৃগুপত্নী সপুত্রক বাড়ি ফিরে এলে ভৃগুমুনি সব শুনে অগ্নিকে ‘সর্বভুক’ হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলেন সেটাও খুব বড় কথা নয়। বড় কথা হল–উগ্রশ্রবা সৌতি এর পর চ্যবন মুনির নাতি রুরুর যে কাহিনী বলবেন–তার মধ্যেও সেই সাপে কাটার ঘটনা আছে। রুরু এবং প্রমদ্বরার প্রেমকাহিনী নিয়ে সুবোধ ঘোষ মশাই ভারত-প্রেমকথায় অমর চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। কিন্তু তার মধ্যে সর্পদংশনের ব্যাপারটা ঐতিহাসিক কোনও গুরুত্ব লাভ করেনি। কিন্তু তারও একটা গুরুত্ব আছে। সে কথায় পরে আসছি।

মহাভারতে দেখা যাবে–রুরু-প্রমদ্বরার কাহিনীর শেষে নৈমিষারণ্যের কুলপতি শৌনক এবার সোজাসুজি রাজা জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের কাহিনী শুনতে চাইলেন। কিন্তু তার আগে ভৃগুবংশের কাহিনী শুনতে চেয়ে শৌনক যে শুধু সৌতি উগ্রশ্রবার বাচন-ক্ষমতা যাচাই করে নিলেন–তাই শুধু নয়, এর পিছনে অন্যতর এক উদ্দেশ্যও ছিল। জনমেজয়ের পিতা পরীক্ষিতের সর্পদংশনে মৃত্যু হয়েছে–এই কথার প্রসঙ্গেই তিনি ভৃগুবংশের কথা শুনতে চেয়েছেন এবং তার কারণ ভৃগুবংশের অধস্তনদের মধ্যেও এই সর্পদংশনের ঝামেলা গেছে। সর্পদ্রষ্টা প্রিয়া পত্নীকে নিজের অর্ধেক আয়ু দিয়ে ফিরে পাবার পরেও রুরুর ক্রোধ শান্ত হয়নি। তিনি যেখানেই সাপ দেখতেন, মেরে ফেলতেন। তার এই সর্পহত্যার আক্রোশ অবশেষে এক মুনির প্রযত্নে শান্ত হয়। জনমেজয়ের আক্রোশও শান্ত হয় আস্তীক-মুনির প্রযত্নে। ঘটনার এই সমতার জন্যই শৌনক ভৃগুবংশের পুরাতন আক্রোশ এবং দুঃখকে জনমেজয় রাজার সঙ্গে একাত্মতায় স্মরণ করেছেন।

কুলপতি শৌনক এই অনুরূপ ঘটনা পুনরায় স্মরণ করতে চেয়েছেন, তার কারণ, তিনি নিজে ভৃগুবংশের জাতক এবং অনেক পুরাণ-মতেই তিনি স্বয়ং রুরুর পৌত্র। রুরুর ছেলের নাম শুনক। তার ছেলে শৌনক। পণ্ডিতেরা মহাভারত-কথার মৌলাংশের পূর্বেই ভৃগুবংশের এই বিরাট আখ্যান-আখ্যাপনের মধ্যেই ভার্গবদের প্রক্ষেপের অভিসন্ধি খুঁজে পেয়েছেন এবং হয়তো কোনও কোনও জায়গায়, তাদের গবেষণা মিথ্যা নয়। শুধু ভারত-কথা কেন, ভারতের অন্য যে মহাকাব্য, সেই রামায়ণ-রচনার পেছনেও ভাগবদের অবদান আছে।

যাঁরা কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়েছেন, তাঁরা সেই বিখ্যাত গল্পটির প্রথম পয়ারটা খেয়াল করবেন–

চ্যবন মুনির পুত্র নাম রত্নাকর।
দস্যুবৃত্তি করে সেই বনের ভিতর।

একটু আগেই আপনারা শুনেছেন চ্যবন মুনি ভৃগুর পুত্র। তার পুত্র রত্নার বাল্মীকি—পুত্র না হলেও শিষ্য তো বটে। কৃত্তিবাস বাল্মীকির দস্যুস্বভাব এবং অনার্য প্রকৃতির খোঁজ পেয়েছেন স্কন্দপুরাণের বর্ণনা থেকে। কিন্তু অন্য কোনও প্রাদেশিক রামায়ণ যেখানে বাখীকিকে চ্যবন-মুনির পুত্র বলেনি, সেখানে কৃত্তিবাসের এই বক্তব্য বড় একটা পয়েন্টার। আরও আশ্চর্য সেই প্রথম/দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের কবি অশঘোষ তার বুদ্ধচরিত নাটকে লিখেছেন যে, চ্যবন-মুনিই নাকি রামায়ণ রচনার একটা প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, কিন্তু ওই কাজ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। ফলে বাল্মীকির হাতেই প্রথম জন্ম নিল রামায়ণের কাব্য-কথা– বাল্মীকিরাদৌ চ সসৰ্জ পদ্যং/জগ্রন্থ যন্ন চ্যবনো মহর্ষিঃ।

এত কথা বললাম এই কারণে যে, মহাকাব্য সংকলন বা রচনার ব্যাপারে ভার্গব-বংশীয়দের বিলক্ষণ হাত ছিল, তাতে বড় সন্দেহ নেই, কিন্তু যেখানে সেখানে প্রক্ষেপের ধুয়া তুলে তাদের কালের মৃদু-মন্দ স্বাদ-গন্ধটুকু বাদ দেওয়ায় আমাদের ভীষণ আপত্তি আছে। আমরা মহাভারতকে পূর্ণ প্রাণে পেতে চাই, বিশেষত সেই পূর্ণতা যখন ব্যাখ্যাযোগ্যও বটে।

.

০৬.

সেকালের ব্রাহ্মণ-বংশগুলি এবং ক্ষত্রিয় বংশগুলির মোটামুটি বোঝাপড়াটা একরকম ছিল। হস্তিনাপুরে পাণ্ডবদের রাজত্ব শেষ হয়ে গেলে পরীক্ষিত যেমন নাগবংশীয়দের অত্যাচার এড়াতে পারেননি, তেমনই ব্রাহ্মণ উতঙ্কও নাগদের অসভ্যতায় ক্ষুব্ধ। ভৃগুবংশীয়দের কাহিনী, বিশেষত রুরু-প্রমদ্বরার কাহিনী শুনতে চেয়ে মহর্ষি শৌনক শুধু আগুনে ঘি দিলেন। অর্থাৎ ভাবটা এই–এদের বড় বাড় বেড়েছে, উগ্রশ্রবা। আমাদের পূর্ববংশীয়রাও এদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাননি। শৌনকের এই ভাবটা যদি বা থেকেও থাকে, কিন্তু নিরপেক্ষ কথক-ঠাকুর সে কথায় তত আমল দেননি। জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞের আগে যত কাহিনী এসেছে, সবই নাগ-বংশীয়দেরই কাহিনী। ক, বিনতা, জরৎকারু, আস্তীক-মুনি–সকলেই নাগবংশের সঙ্গেই জড়িত। সত্যিই তো মহাভারতের মূল পর্বে যাবার আগে নাগবংশীয়দের এত কথা শুনব কেন? স্বাভাবিকভাবেই প্রবৃত্তি হয় বলতে–এগুলি সব প্রক্ষেপ। পণ্ডিতেরা অবশ্য তাইই বলেছেন। কিন্তু আমার কেবলই মনে হয় এই কাহিনীগুলির একটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্বও আছে।

রাজনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্বটা এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হয় নিম্নবর্গীয় একটি জাতি-গোষ্ঠী কিভাবে চরম শত্রুতা থেকে আর্যগোষ্ঠীর বন্ধুতে পরিণত হল এবং আর্যগোষ্ঠীর দিক থেকেও নবাগত এবং বশ্যতাপ্রাপ্ত বন্ধুকে কিভাবে উপাস্যতা দান করা হল–মহাভারতের মূল পর্বের প্রথমে সেই সামাজিক ইতিহাসটুকুই ধরা আছে।

 তবে এই সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস ধরবার জন্য আমরা মহাভারতের উপাখ্যান অংশকে আগেই ব্যাহত করব না। বরং উপাখ্যানের হাত ধরেই আমরা ইতিহাসে গিয়ে পৌঁছব। কথা হল, হস্তিনাপুরের বর্তমান রাজা জনমেজয় পরীক্ষিতের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সর্পষজ্ঞ করেছিলেন। কাজেই সর্পযজ্ঞের আগে আসে পরীক্ষিতের মৃত্যুর কথা।

পরীক্ষিত হলেন ক্ষীণ পাণ্ডব-বংশের প্রথম এবং শেষ অঙ্কুর। পুরাণের ভাষায় সন্তানবীজং কুরু-পাণ্ডবানা। যুধিষ্ঠির মহারাজ মৃত অভিমন্যুর এই পুত্রটিকে সিংহাসনে বসিয়ে মহাপ্রস্থানে চলে গেলেন ভাইদের নিয়ে। ভালই রাজত্ব করছিলেন পরীক্ষিত। প্রজারা খুশি, ব্রাহ্মণরা নির্বিঘ্নে যাগ-যজ্ঞ করছেন, রাজকোষ পূর্ণ, সমস্ত দেশ আনত-সামন্ত। কিন্তু তবু তার রাজত্বের দিনগুলোকে খুব মধুর বলা যাবে না। পৌরাণিরো খবর দিয়েছেন পরীক্ষিতের আমলে দ্বাপরযুগ শেষ হয়ে কলি-যুগ প্রবেশ করেছে। কলি’ বলতে আপনারা যদি শুধু যুগের পরিমাণ ধরেন তাতে আমার আপত্তি আছে। কলি শব্দের এক অর্থ হল বিবাদ। অর্থাৎ পরীক্ষিতের আমলেই ঝগড়া-ঝাটি, বিবাদের আমদানি হয়ে গেল ভাল রকম। ঘটনাটা ধর্মের ভাষাতেও সুন্দর বলা যায়।

আমাদের শাস্ত্রে যুগের পরিমাণ ব্যাপারটা এমনই বিশাল এক জিনিস যে, এখনকার ক্রিশ্চান ক্যালেন্ডারের নিয়মে সাল-তারিখ মেপে কখনওই বলা যাবে না যে–অমুক দিন কলিযুগ আরম্ভ হল। আসলে ঝগড়া-বিবাদ অথবা কলিযুগ পরীক্ষিতের রাজত্বের অনেক আগেই আরম্ভ হয়ে গেছে। দ্বারকায় কৃষ্ণের জ্ঞাতি-গুষ্টিরা যখন আকণ্ঠ মদ গিলে নিজেরাই মারামারি করে মরলেন, তখনই যুধিষ্ঠির-অর্জুনের মতো লোকেরা বুঝে গেলেন–ধরাধামে সুস্থভাবে আর বাঁচা যাবে না। পুরাণ বলেছে–যুধিষ্ঠির দেখলেন–শুধু দ্বারকায় নয়, ঘরে বাইরে, নগরে রাষ্ট্রে–সর্বত্র বাদ-বিসংবাদ, লোভ, হিংসা, কুটিলতা একেবারে ছেয়ে গেছে পুরে চ রাষ্ট্রে চ গৃহে তথাত্মনি/বিভাব্য লোভানত-জিহ্ম-হিংসনা। তিনি বুঝলেন–ঢুকে পড়েছে কলি, আর নয়–অভদ্ৰহেতুঃ কলিরবৰ্তত। তিনি ভাইদের নিয়ে মহাপ্রস্থানে চলে গেলেন। সিংহাসনে বসলেন পরীক্ষিত।

সমস্ত পুরাণ, এমনকি মহাভারতের থেকেও ভাগবত পুরাণ ব্যাপারটা ধরেছে খুব ভাল। এখানে দেখা যাচ্ছে–পরীক্ষিত রাজা হয়েই খেয়াল করলেন যে, তার রাজমণ্ডলের সর্বত্র কলি ঢুকে পড়েছে–যদা পরীক্ষিত কুরু-জাঙ্গলে বসন/কলিং প্রবিষ্টং নিজচক্রবর্তিতে। দেখুন, কলি একটা মানুষ নয় মোটেই, যে রাজ্যে ঢুকে পড়ল। কলি মানে সেই লোভ, হিংসা, মিথ্যা আর কুটিলতা। পুরাণকার সব অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিরূপে কলিকে একটা মানুষের চেহারা দিয়েছেন। পরীক্ষিত যেই খবর পেলেন–কলি ঢুকে পড়েছে, অমনই তিনি ধনুক-বাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন–কলিকে মারবার জন্য। পরীক্ষিতের দিগ-বিজয় শুরু হল।

তারপর ভদ্ৰাস্ব, কেতুমাল, উত্তর-কুরু-সব ঘুরে এসে পরীক্ষিত একটা আশ্চর্য ঘটনা লক্ষ্য করলেন। পরীক্ষিত দেখলেন–একটি ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে। তার তিনটে পা-ই ভাঙা আর তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটি গরু–এমন করুণ তার অবস্থা যেন সদ্য তার বাছুরটি মারা গেছে–বিবৎসামিব মাতরম্। ষণ্ড-বৃষ এবং গাভী দু’জনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।

ভারতের ভাবনা-রাজ্যে রূপকের একটা বিশাল জায়গা আছে। আধুনিকেরা যারা চলচ্চিত্রে, কবিতায়, স্থাপত্যে অথবা ছবিতে ‘সিমবলিজম’ নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করেন, আর অনেকটাই না বুঝে বিস্ময়মুকুলিত নেত্রে বক্তৃতা দেন, তাদের আগে নিজের দেশের সিমবলিজম’গুলো বুঝতে অনুরোধ করি, তারপর পিকাসোরদা, কামু-কাফকা নিয়ে যা বলবেন, শুনব। এই যে ষণ্ড-বৃষটিকে এইমাত্র দেখলেন পরীক্ষিত, ইনি আসলে ধর্ম। দেবদেব মহাদেবকে যে আপনারা বৃষ-বাহন দেখেন, তিনি আসলে ধর্মবাহন, জ্ঞান-বাহন। সত্য-ক্রেতা-দ্বাপর-কলি, এই চার যুগ ষাঁড়ের চার পা। সত্য-ক্রেতা-দ্বাপর-সত্যযুগে ধর্মের রমরমা অতএব ষাঁড়ের চার-পা’ও ঠিক-ঠাক। ত্রেতাতে ষাঁড়ের এক পা ভেঙে গেছে, সে তিনপায়ে দাঁড়িয়ে। দ্বাপরে অন্যায়-অধর্ম বেড়ে গেল। দুই পায়ে দাঁড়িয়ে রইল ষাঁড়। আর কলিতে তার তিন পাই ভেঙে গেছে, এক পায়ে নড়বড়ে হয়ে কোনওমতে দাঁড়িয়ে আছে, যাকে বলি ধর্মের ষাঁড়।

 আর ওই যে গাভীটিকে দেখলেন পরীক্ষিত, উনি হলেন পৃথিবী। গাভীকে আমরা দোহন করে দুগ্ধ বার করি, তেমনই পৃথিবীকেও আমরা দোহন করে শস্য বার করি, খনিজ-পদার্থ বার করি। সেইজন্য গাভী পৃথিবীর প্রতিরূপ। পরীক্ষিত দেখলেন বৃষরূপী ধর্ম আর গাভীরূপিণী পৃথিবীর মধ্যে নানা সুখ-দুঃখের কথা হচ্ছে। কৃষ্ণ যখন বেঁচেছিলেন, পাণ্ডবরা যখন রাজ্য শাসন করছিলেন, তখন কত সুসময় ছিল আর এখন কলি এসে কী দুরবস্থা করেছে–এই সব তারতম্যের আলোচনা চলছে। পরীক্ষিত দেখলেন; কিন্তু ওই গোমিথুনকে তিনি ধর্ম আর পৃথিবী বলে তখনও বোঝেননি।

তৃতীয় আরও একটি সত্তার উপস্থিতিও পরীক্ষিতের নজর এড়াল না। পরীক্ষিত দেখলেন– একটি লোকলোকটির আচার-আচরণ বর্বরের মতো–সে একবার নিস্তেজ ষণ্ডটিকে লাথি মারছে, আরেকবার গাভীটিকে লাথি মারছে। তার হাতে একটা লাঠি এবং সেই লাঠি দিয়ে দুটি প্রাণীকে সে মেরে ফেলার ভয়ও দেখাচ্ছে। ধর্মরূপী বৃষটি নিরুপায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে এবং লোকটির বিভীষিকায় সে প্রস্রাব করে ফেলেছে–মেহন্তমিব বিভ্যত। লোকটার ভাব-সাব রাজার মতো, আচরণ নির্ভীক, এবং তাকে দেখতে যেমনই হোক, সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হল, তার জামা-কাপড় আসল সোনার জরি দিয়ে মোড়ানো। পরীক্ষিত এই কম্পমান গোমিথুন এবং এই জঘন্য লোকটিকে দেখে তাদের সামনে রথ থামালেন। লোকটিকে বললেন, কে হে তুমি, আমার রাজত্বে বাস করে দুর্বল পশু দুটির ওপর জোর খাটাচ্ছ? দেখতে তো বেশ রাজার মতো, গায়ে এমন সোনার পিরান, অথচ কাজটা যে করছ–সেটা রাজোচিতও নয় ব্রাহ্মণোচিতও নয়– নরদেববাসি বেশেন নটবং কর্মণাদ্বিজঃ।

পরীক্ষিত বেশ রেগেই গেলেন। বললেন, কী ভেবেছ তুমি? আজকে কৃষ্ণ ধরাধামে নেই বলে, গাণ্ডীবধ অর্জুন নেই বলে তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে? নিরপরাধ প্রাণীকে তুমি এইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে পীড়ন করবে? আজ তোমার নিস্তার নেই, তোমার মৃত্যু নিশ্চিত জেনো। পরীক্ষিত এবার ধর্মরূপী বৃষ এবং গোরূপা পৃথিবীকেও চিনে ফেললেন এবং তাদের অবস্থা দেখে কলিকেও চিনতে তার দেরি হল না। সঙ্গে সঙ্গে শাণিত খঙ্গ হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কলিকে মারার জন্য-নিশাতমাদদে বঙ্গং কলয়ে’ধর্মহেতবে। কলি দেখল- মহা-বিপদ। প্রাণে মারা যাবার চেয়ে রাজার পায়ে পড়া ভাল। কলি রাজার পা জড়িয়ে ধরল।

পরীক্ষিত বললেন, ঠিক আছে, তুমি প্রাণে বাঁচলে বটে, কিন্তু আমার রাজ্যে তোমার জায়গা হবে না এক রত্তি।–ন বর্তিতব্যং ভবতা কথঞ্চন/ক্ষেত্রে মদীয়ে ত্বমধর্মবন্ধু। পরীক্ষিত পায়ে-পড়া কলিকে তার অকরুণার কারণ দেখিয়ে বললেন, তোমার মতো অধর্মের বন্ধু যদি আমার রাজ্যে থাকে, তাহলে আমাদের প্রজাদের মধ্যে হিংসা, লোভ, দম্ভ-অহঙ্কার, খুন, রাহাজানি, চুরি-বদমাশি–সবই অত্যন্ত বেড়ে যাবে।

এই যে শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন পরীক্ষিত, এইগুলোই কলির স্বরূপ। কবিরা দম্ভ-অহংকার আর নানা অসদ গুণের রূপ কল্পনা করে তার নাম দিয়েছেন কলি। পরীক্ষিত বললেন, তোমার সাহস তো কম নয় বাপু। এই ব্রহ্মাবর্ত কত পবিত্র স্থান! সরস্বতী আর দৃষদ্বতী নদীর মাঝখানের এই জায়গাটুকুতে ব্রাহ্মণ সমাজের কত পবিত্রতার স্মৃতি। ব্রাহ্মণরা এখানে কত মন্ত্রে যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুকে আবাহন করেন-যজ্ঞেশ্বরং যজ্ঞ-বিতানবিজ্ঞাঃ। আর তুমি কিনা সেইখানে দাঁড়িয়ে ব্রাহ্মণদের সমস্ত আন্তর ধর্মের প্রতীক একটি গোমিথুনকে মারতে চাইছ? বেরও, বেরিয়ে যাও তুমি আমার রাজ্য থেকে।

পরীক্ষিত রাজার ক্রোধাবেশ দেখে কলি ভয়ে কাঁপতে থাকল বটে, তবে হাল ছাড়ল না। বলল, আপনি আমাদের সার্বভৌম রাজা বটে। আমাকে তাড়িয়ে দিলে তো হবে না, থাকার জন্য আমাকেও একটা জায়গা দিতে হবে। তা আপনিই বলে দিন–কোথায় আমি থাকব স্থানং নির্দেন্ধুমহসি। পরীক্ষিত বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তবে কোনও ভাল জায়গায় তুমি থাকতে পাবে না। তোমার আবাস হোক-তাস-পাশার জুয়োচুরিতে, অঁড়িখানায়, স্ত্রীলোকের সুখসঙ্গে, আর থাক প্ৰাণীহত্যা, খুন, রাহাজানির মতো কুকর্মের মধ্যে। এই চার জায়গায় যত অধর্ম। তুমি থাকো এই অধর্মের মধ্যে, কিন্তু খবরদার! এই সব সৎ-সাধনের জায়গায় তোমায় যেন না দেখি।

 কলি বলল, এই চার জায়গায় মাত্র স্থান দিলেন, মহারাজ? আর একটু কৃপা হবে না? রাজা বললেন, যাও, যাও সোনা-চাদির জায়গাটাও না হয় তোমায় ছেড়ে দিলাম–পুনশ্চ যামানায় জাতরূপমদাৎ প্রভু। কলিকে পরীক্ষিত যেভাবে স্বীকৃতি দিলেন–তার ফলটা কী দাঁড়াল? জুয়েচুরির মধ্যে যে মিথ্যার বেসাতি আছে, পানশালায় যে হাম-বড়া ভাব আসে মনে, স্ত্রী-সঙ্গের মধ্যে যে কামনার প্রশ্রয় আছে, অকারণ প্রাণীহত্যার মধ্যে যে ক্রুরতা আছে, আর টাকা-পয়সা নিয়ে যে শক্রতা তৈরি হয়-এইসব জায়গাতে কলির স্থান একেবারে পাকা হয়ে গেল।

পুরাণ থেকে এই উপাখ্যানটুকু যে স্মরণ করতে হল, তার কারণ আছে। পরীক্ষিত মহারাজের আমলে কলি ঢুকে পড়ল–এই ধৰ্মীয় তথ্যের মধ্যে প্রধান ইঙ্গিত হল–তার আমলে আর সেই সুখ-শান্তি, সেই সত্য এবং ধর্মবোধ আর রইল না, যা তার পিতা পিতামহের আমলে ছিল। নীতি এবং ধর্মবোধ যে কতটা চলে গেছে পরীক্ষিত মহারাজের আপন উদাহরণই তার জন্য যথেষ্ট। সরস্বতীর তীরে দণ্ডপাণি কলির পদাঘাতে ক্লিষ্ট গোমিথুনকে দেখে কলির ওপরে তার যতই রাগ হোক, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অধস্তন পুরুষ হয়ে তিনি নিজে যে কাণ্ড করে বসলেন, তাতে বোঝা যায়-অন্যায় এবং অভব্যতা কী চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। আসলে তার রাজত্বকালে কলি-প্রবেশের প্রধান তাৎপর্যই হল–লোভ, হিংসা, দ্বেষ, অসত্য এবং দম্ভ সর্বত্র এমনভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল যে, পরীক্ষিতের পক্ষে তা রোধ করা সম্ভব হয়নি। বরং অন্যায়ের প্রতিরূপ কলি তার কাছে যা প্রার্থনা করেছে, তিনি তা মঞ্জুর করেছেন। যেখানেই হোক, যে পর্যায়েই হোক অন্যায়-অনীতি এবং অভব্যতাকে পরীক্ষিত মহারাজ প্রায় সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন–কলিকে তিনি স্যাংশন’ দিয়েছেন।

এই যে স্বীকৃতি, কলির প্রতি পরীক্ষিতের এই যে বিবশ আচরণ–এর কারণ দু’ধরনের সমাজিক পরিস্থিতি থেকে তৈরি হয়ে থাকতে পারে। এক, তিনি সব জেনে বুঝে অন্যায্য কলিকে মেনে নিয়েছেন এবং তার নিজের মানসিকতাও খানিকটা ওইরকমই ছিল। দুই, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যেহেতু কোনও অসামান্য ব্যক্তিত্বই আর জীবিত ছিলেন না এবং পরীক্ষিত–যাঁকে মহাভারতের কবিই ক্ষীয়মাণ কুরুবংশের শেষ অঙ্কুর বলে চিহ্নিত করেছেন –সেই পরীক্ষিতের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই তার রাজত্বে অন্যায়-অসভ্যতা, হিংসা-দ্বেষ এমন চরম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল যে, পরীক্ষিতের পক্ষে কলিকে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় ছিল না।

আমরা দ্বিতীয় কল্পটাকেই মেনে নিতে চাই, কারণ পরীক্ষিত তার স্বীকৃতিতে কলির আবাস নির্দিষ্ট কতগুলি স্থানে বেঁধে দিতে চাইছেন। তাঁর রাজত্বে কলি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, অতএব তাকে সর্বত্র ছড়াতে না দিয়ে খানিকটা নিয়ন্ত্রিত করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পৌরাণিকেরা যে শক্তিমত্তার আভাসটুকু দেখেছেন, সেটা যে তেমন কোনও সত্য নয়–সেটাও পৌরাণিকেরা জানেন এবং জানেন বলেই পরীক্ষিতের পরবর্তী ব্যবহার তারা উল্লেখ করতে ভোলেননি। অর্থাৎ পরীক্ষিত অন্যায়-অসত্যকে যতই নিয়ন্ত্রিত করুন, সেগুলি তার সময়ে সহজ হয়ে উঠেছিল, এবং সহজ বলেই দেশের রাজা হওয়া সত্ত্বেও, জনগণের ভাগ্য-নিয়ন্তা হওয়া সত্ত্বেও অন্যায় আচরণ করতে তারও বাধেনি। ঘটনাটা পরিষ্কার করে জানাই।

মহারাজ পরীক্ষিতের মধ্যে তার প্রপিতামহ পাণ্ডুর কিছু গুণ ছিল। মহারাজ পাণু শিকার করতে বড় ভালবাসতেন। এটাকে যদি আজকের ভাষায় হবি’ বলা যায়, তবে সেকালের ভাষায় এই হবির নাম হল মৃগয়া। মৃগয়াতে অকারণে পশুবধ করা হয় বলে পুরাতনেরা ব্যাপারটা বড় পছন্দ করতেন না। আরও পছন্দ করতেন না–মৃগয়া যখন হবি’র পর্যায়ে চলে যেত। পুরাতনেরা বলতেন, মৃগয়া হল এক ধরনের ব্যসন, কামজ ব্যসন, যা রাজাদের চারিত্রিক দোষ তৈরি করে। রাজারা পশুবধ করতে করতে প্রমত্ত হয়ে ওঠেন, তাদের আর সময়-অসময়, কাণ্ডাকাণ্ড-জ্ঞান থাকে না। পুরাতনেরা এই প্রমত্ততার জন্যই মৃগয়াকে কামজ-ব্যসনের মধ্যে গণ্য করেছেন এবং তারা রাজাদের সব সময় সাবধান করেছেন যেন এই প্রমত্ততা তাদের গ্রাস না করে।

পুরাতনেরা যাই ভাবুন, রাজারা রাজার মতোই চলেন। প্রপিতামহের দৃষ্টান্তে পরীক্ষিত মহারাজেরও মৃগয়ায় যাওয়াটা বেশ অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল। তিনি মৃগয়ায় বেরিয়ে বন্য শূকর, মহিষ, বাঘ মারতে মারতে চলেছেন। এমন সময় একটি সুন্দর হরিণ পরীক্ষিতের চোখে পড়ল। রাজা বাণ ছুড়লেন ঠিকই, কিন্তু বাণটি ভাল করে তার গায়ে বিদ্ধ হল না। বাণের আগায় বক্র ফলক ছিল, ফলে বাণটি হরিণের শরীরে লেগে ঝুলে রইল এবং বাণবিদ্ধ অবস্থাতেই হরিণ দ্রুত ছুটতে আরম্ভ করল। পরীক্ষিত হরিণের পিছনে ধাওয়া করলেন। গভীর বনের মধ্যে ধাবমান হরিণ এক সময় রাজার দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। পরীক্ষিত তার পেছনে ছুটতে ছুটতে বনরাজির প্রান্তে এক মুক্ত তৃণভূমির মধ্যে এসে পৌঁছলেন।

এটি একটি গো-চারণ ক্ষেত্র। অনেক গরু একসঙ্গে ঘাস খাচ্ছে, গোবৎসেরা রোমস্থায়মান গাভীর দুগ্ধ পান করে মুখে ফেনা উঠিয়ে ফেলেছে। বড় শান্ত, বড় অলস পরিবেশ। রাজা দেখলেন-এই মুক্ত তৃণভূমির বিজন প্রান্তে এক মুনি পদ্মাসনে বসে আছেন–ধ্যানমগ্ন মহাশান্তি। ভাবগত পুরাণ পরীক্ষিতকে যথাসম্ভব বাঁচানোর জন্য তাকে অতিশয় ক্লান্ত এবং পিপাসার্ত বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে পরীক্ষিত যত না ক্লান্ত ছিলেন, কারণ মহাভারতেও তার ক্লান্তি এবং পিপাসার কথা বলা আছে, কিন্তু সেই পিপাসার চেয়েও পরীক্ষিত বেশি ছিলেন মৃগয়া-ব্যসনী। ভাগবতে পরীক্ষিত মুনির কাছে বার বার পিপাসার জল চেয়ে সদুত্তর পাননি। কিন্তু মহাভারতে পরীক্ষিত-মহারাজ ধ্যানরত মুনিকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি অভিমন্যর পুত্র পরীক্ষিত। আমি একটি হরিণকে বাণ-বিদ্ধ করেছি। কিন্তু হরিণটা কোনওরকমে পালিয়েছে। আপনি কি হরিণটাকে দেখেছেন–ময়া বিদ্ধো মৃগো নষ্টঃ কচ্চিত্তং দৃষ্টবানসি?

 পরীক্ষিতের ভাব-ভঙ্গি ভাল ছিল না। তপস্যারত একটি মুনিকে দেখা মাত্রই ধনুক-বাণ নামিয়ে রেখে জুতো খুলে অতি বিনীতবেশে তার সামনে উপস্থিত হওয়ার কথা বিনীতবেশেন প্রবেষ্টব্যানি তপোবনানি নাম–তার পূর্বজরাও চিরকাল তাই করেছেন। কিন্তু রাজা ধনুবাণ তো ত্যাগ করেনইনি, বরং সেগুলি উদ্যত ছিল–লক্ষ্যের সন্ধান পাওয়া মাত্রই যাতে লক্ষ্য ভেদ করা যায়। এইভাবে ধনুক উঁচিয়ে একজন অহিংস ব্যক্তির সামনে প্রায় সহিংস আচরণ এবং পুনরায় তার প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার মধ্যেও এমন কোনও ভণিতা ছিল না–যা তখনকার দিনের প্রচলিত শিষ্টাচারের সঙ্গে মেলে–অপৃচ্ছদ্ধনুরুদ্যম্য তং মুনিং ক্ষুণ্ডুমান্বিতঃ।

ধ্যানরত মুনির সঙ্গে দেখা হলে তার সঙ্গে কথা বলার শিষ্টাচার ছিল এইরকম–আপনার তপস্যার কুশল তো–অপি তপো বর্ধতে! অথবা তাকে যদি বিরক্ত করছি বলে মনে হয় তাহলে ভাষাটা হওয়া উচিত–আপনার তপস্যার বিঘ্ন সৃষ্টি করছি না তো? মুনিবর প্রণাম। কিন্তু পরীক্ষিতকে দেখতে পাচ্ছি–তিনি মুনি দেখামাত্রই প্রশ্ন করলেন, এই যে ঠাকুর! আমি অভিমন্যর ছেলে রাজা পরীক্ষিত…. আমার বাণ-বিদ্ধ মৃগটিকে দেখেছেন– ভো ভো ব্ৰহ্মণ অহং রাজা পরীক্ষিদভিমন্যজঃ। শান্ত আশ্রমপদে-এই যে ঠাকুর! অহং রাজা–এই ভাবটুকু কোনও বিনীত শিষ্টাচারের পরিচয় দেয় না–যা অডিম, অর্জুন বা তার প্রপিতামহ পাণ্ডুরও পরিচয় বহন করে।

মুনি মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন। পরীক্ষিতের কথার কোনও উত্তর তিনি দিলেন না। হয়তো উত্তর দিতে ভালও লাগেনি। হয়তো মৌনতাও সেইজন্যই। রাজা পরীক্ষিত অপেক্ষা করেননি, সামান্য শিষ্টাচারে প্রণাম পর্যন্ত করলেন না। উপরন্তু ক্রুদ্ধ হয়ে কাছে পড়ে থাকা একটা মরা সাপ তার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। তাও হাত দিয়ে নয়, ধনুকের প্রান্তভাগ দিয়ে সাপটি মুনির গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে তিনি তাচ্ছিল্যভরে চলে গেলেন-সমুৎক্ষিপ্য ধনুষ্কোটা স চৈনং সমুপৈক্ষত। পরিষ্কার বোঝা যায়–মরা যে সাপটি তিনি নিজের হাতে তুলতে ঘৃণাবোধ করেছেন, সেই সাপটি মুনির গলায় ঝুলিয়ে দিতে তার কোনও দ্বিধা হল না। ঘটনাটা ঘটানোর পর পরীক্ষিতের ক্রোধ শান্ত হল বটে, গলায় সাপ ঝুলানো মুনিকে দেখে তার একটু খারাপও লাগল বটে, কিন্তু সাপটি গলা থেকে নামিয়ে দেওয়ারও কোনও প্রয়াস তিনি নিলেন না। তিনি চলে গেলেন নিজের নগরে। বিস্তীর্ণ আরণ্যক পরিবেশে উন্মুক্ত গোচারণ-ভূমিতে মৃত সাপ গলায় নিয়ে মুনি বসে রইলেন তেমনই–নিরপেক্ষ, উদাসীন।

এবারে সেই প্রশ্নটা আবার তুলি। পরীক্ষিতের রাজত্বকালে কলি-প্রবেশের তাৎপর্য এইখানেই। দেশের রাজা নিজেই যেখানে সদাচার-বিরোধী ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি অসদাচার প্রতিরোধ করবেন কী করে? মহাভারতের কবি ওজর দিয়ে বলেছেন–পরীক্ষিত মুনিকে ততখানি ধার্মিক বলে বুঝতে পারেননিন হি তং রাজশাদূর্লস্তথা ধর্ম পরায়ণ–অতএব সেইজন্যই তিনি এই অশালীন আচরণ করে ফেলেছেন। আমরা বলি–তপস্বী যদি ভণ্ডও হতেন, তবু দেশের রাজা, যিনি প্রখ্যাত যাদব-বৃষ্ণিকুল এবং কৌরব-কুলের পবিত্র শোণিত বহন করছেন আপন শরীরে, তার এই ব্যবহার কি শোভা পায়?

এই ক্রুর আচরণের প্রত্যুত্তরে মুনি কিন্তু কোনও শাপ দিলেন না। মহারাজ পরীক্ষিত রাজশ্রেষ্ঠ পাণ্ডব-বংশের ধুরন্ধর পুরুষ। হরিণ হারিয়ে কিছু ক্রোধাবেশ হয়ে থাকবে তার অথবা লক্ষ্যবস্তুতে যে কোনও রাজার এই আবেশই থাকা দরকার–এইরকম ভেবে রাজার দোষটুকুও গুণপক্ষে আরোপ করে মুনি তাঁকে মনে মনে মুক্তি দিলেন। যেমন তিনি বসে ছিলেন, তেমনই বসে রইলেন-ঋষিস্তু অসীৎ তথৈব সঃ। রাজার ক্রোধ অথবা মৃত সর্পের ঘৃণা শরীরে বহন করেও মুনির মনের প্রশান্তি নষ্ট হবে কেন–হয়তো এইরকম কোনও আধ্যাত্মিক তর্কেই মুনি যেমন ছিলেন, তেমনই বসে রইলেন। রাজা তখন হস্তিনানগরে।

.

০৭.

যে মুনির গলায় মহারাজ পরীক্ষিত মরা সাপ ঝুলিয়ে দিয়ে এলেন, এখনও আমরা তার নাম জানি না। মুনির নাম শমীক। শান্ত সমাহিত চিত্ত। পরীক্ষিত তাকে যে এত বড় অপমান করে গেলেন–তা তিনি মনেও রাখলেন না। কিন্তু শমীক মুনির একটি অল্পবয়স্ক পুত্র ছিল। তার নাম শৃঙ্গী। যেমন তিনি তেজস্বী তেমনই তার তপোবল। এই অল্প বয়স্ক মুনি বালক আপন সংযম এবং তপস্যার বলে ইতোমধ্যেই প্রজাপতি ব্রহ্মাকে তুষ্ট করেছেন। কিন্তু তপোবল বা ইন্দ্রিয়-সংযম তার যথেষ্ট থাকলেও বালকের স্বভাবে কিছু ক্রোধ ছিল। সে ক্রোধ এতটাই যে, তিনি একবার ক্রুদ্ধ হলে তাকে প্রসন্ন করা খুব কঠিন হতশৃঙ্গী নাম মহাক্রোধ দুম্প্রসাদো মহাব্রতঃ!

শমীক মুনির গলায় মরা সাপ ঝুলিয়ে দিয়ে পরীক্ষিত যখন চলে গেছেন, শৃঙ্গী তখন সদ্য বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ি ফেরার পরই তার এক বন্ধু-কৃশ তার নাম তিনিও ঋষিকুমার, তার সঙ্গে শৃঙ্গীর দেখা হল। বন্ধুর পিতা শমীককে দেখে কৃশর খারাপ লাগছিল। কাজেই শৃঙ্গীর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বললেন, ভাই! তুমি তো জপে তপে খুব তেজস্বী হয়েছ বলে শুনি। তোমার বাবাও যথেষ্ট তপস্বী এবং তেজস্বী। কিন্তু এরপর থেকে আমরা ঋষি বালকেরা যখন কথা বলব, তখন তুমি আর তেজ বেশি দেখিও না, বেশি কথাও যেন বোলো না– মাস্ম কিঞ্চিদ বচো বদ। এত তুমি ব্ৰহ্মর্ষির পৌরুষ দেখাও, এত বড় বড় কথা তুমি বল। তা আর একটু পরেই তুমি দেখতে পাবে-তোমার মৌনী পিতা কেমন একটি শব গলায় ঝুলিয়ে বসে আছেন।

শৃঙ্গী রাগে জ্বলে উঠলেন। কী! আমার পিতা শব ধারণ করে আছেন–শৃঙ্গী জ্বলে উঠলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন করে সম্ভব হল এই ঘটনা অপৃচ্ছত্তং কথং তাতঃ সমে’দ্য মৃতধারকঃ? কৃশ বললেন, কেমন করে আবার? মহারাজ পরীক্ষিত হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতে হরিণ না পেয়ে তোমার বাবাকে সেই হরিণের সংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন। আর তিনিও মৌনী হয়ে আছেন বলে কোনও জবাব দিলেন না। ব্যস্ যা হবার তাই হল। পরীক্ষিত ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে কোথা থেকে একটি মরা সাপ তুলে নিয়ে এসে ঝুলিয়ে দিলেন তার গলায়। সেই অবধি তোমার পিতা সেই সর্প-শব ধারণ করেই বসে আছেন আর মহারাজ পরীক্ষিত এখন হস্তিনাপুরে বসে আছেন।

 শৃঙ্গী মুনির চোখ দুটি রাগে লাল হয়ে উঠল, শরীর জ্বলে গেল ক্রোধে কোপ সংরক্তনয়নঃ প্রজ্বলম্নিব মনা। অসংবৃত ক্রোধে এক মুহূর্তে তিনি আচমন-শুদ্ধ অভিশাপের জল তুলে নিলেন হাতে। অভিশাপ দিলেন যে পাপিষ্ঠ আমার ব্রতক্লিষ্ট পিতার গলায় মৃত সর্প প্রদান করেছে, আজ থেকে সাতদিনের মাথায় তীক্ষ্ণবিয তক্ষক আমার কথায় কুরুকুলের গ্লানি ওই পাপিষ্ঠ রাজাকে যমালয়ে প্রেরণ করবে।

মহাভারতের অনুসরণে এই যে শেষ অনুচ্ছেদটি লিখে ফেললাম এর মধ্যে অন্তত দুটি জিনিস আছে লক্ষ্য করার মতো। এক, আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই যে আপনাদের ঋষি-মুনিরা আছেন, কী রকম লোক এরা? অ্যাঃ! কথায় কথায় এত রাগ? পান থেকে চুন খসলেই অভিশাপ? সবটাই যেন এঁদের খেয়াল খুশি!

এই প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনই দেব না। আরও দু-একটা জব্বর জব্বর অভিশাপের ঘটনা জমে উঠুক, কারণে নয় অকারণে দু-একবার ক্রোধাবেশ হোক মুনি ঋষিদের, তখন এর উত্তর দেব। বরং কথা প্রসঙ্গে এখন দ্বিতীয় বিষয়টাই বেশি করে মাথায় রাখা ভাল। সে বিষয়টা কিন্তু পুরনো–সেই নাগরাজ তক্ষকের বিষ। শৃঙ্গী মুনি রাগের মাথায় যে অভিশাপটা দিলেন তার ভাষাটা খেয়াল করেছেন কি? শৃঙ্গী বলেছেন, আমার কথায় চালিত হয়ে নাগরাজ তক্ষক ব্রাহ্মণকুলের অপমানকারী কুরুকুলের কলঙ্ক সেই পাপিষ্ঠ রাজাকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যাবে মদবাক্য-বলচোদিতঃ সপ্তরাত্রাদিতে নেতা যমস্য সদনং প্রতি।

আগেই বলেছি- নাগজাতীয়রা কেউ সাপ টাপ নন। তারা রীতিমতো মানুষ এবং এই মানুষদের সঙ্গে তৎকালীন ব্রাহ্মণ-সমাজের বনিবনাও দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। নইলে নাগরাজ তক্ষক, যিনি অবশ্যই নাগ গোষ্ঠীর এক প্রধান নেতা, তিনি ব্রাহ্মণের কথায় চালিত হবেন কেন? লক্ষণীয় বিষয় হল–আমরা এর আগে ব্রাহ্মণ উতষ্ককে দেখেছি। তিনি তক্ষকের ওপরে ভীষণ ক্রুদ্ধ। জনমেজয়কে তিনি তক্ষকের বিরুদ্ধে উত্তেজিতও করেছেন। আবার ব্রাহ্মণ-সমাজের অন্যাংশকেও এখন আমরা লক্ষ্য করছি। তারা ক্ষত্রিয় রাজার ওপরে বিরক্ত হয়ে নাগ-জন-জাতির পাশাপাশি দাঁড়াচ্ছেন। স্বয়ং নাগরাজ তক্ষক তাদের শাসনে চলেন। ব্যাপারটার মধ্যে যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক চোরাবালি কিছু লুকিয়ে আছে সেটা একটু বুঝে নিতেই হবে।

 শৃঙ্গী-মুনি পরীক্ষিতকে অভিশাপ দিয়ে পিতা শমীকের কাছে গেলেন। তিনি তখনও সেই অবস্থায় মরা সাপ গলায় নিয়ে বসে আছেন, যেমনটি তিনি আগে ছিলেন শৃঙ্গী রাগে কেঁদে ফেললেন। পিতার মৌনতা বিঘ্নিত হল। শৃঙ্গী সদর্পে বললেন, যে দুরাত্মা আপনার এই অবস্থা করেছে তার খবর শোনামাত্র আমি তাকে অভিশাপ দিয়েছি, বাবা।–হেমাং ধর্ষণাং তাত তব তেন দুরাত্মনা। আজ থেকে সাত দিনের মাথায় নাগরাজ তক্ষক তাকে মৃত্যুদন্ড দেবে।

শান্ত মহর্ষি শমীক পুত্রের অভিশাপ উচ্চারণে খুশি হলেন না। তিনি বললেন, কাজটা তুমি ভাল করনি, পুত্র! এতে আমার তো সুখ তো কিছু হলই না বরং তুমি তোমার তপস্বীর ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে- ন মে প্রিয়ং কৃতং তাত নৈষ ধর্মস্তপস্বিনাম। শমীক পুত্রকে বুঝিয়ে বললেন, পরীক্ষিত মহারাজ আমাদের রাজা বটে। সমস্ত সময় তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন, আমাদের তিনি রক্ষা করেন। আর তুমি তার এই বিপদ ঘটালে? ভাল নি, পুত্র! ভাল কাজ করনি।

পিতা-পুত্র, দুই মুনির ভাব চরিত্র দেখলেন নিশ্চয়। দুজনে দু’রকম। একজন রাজাকে অভিশাপে ধ্বংস করতে চাইছেন, অন্যজন তাকে রক্ষা করতে চাইছেন। শমীক পুত্রকে রীতিমতো তিরস্কার করে বললেন, তুমি সত্যব্রত। তোমার অভিশাপ মিথ্যা হবে না জানি। কিন্তু পুত্র যাতে গুণবান যশস্বী হয়ে ওঠে তার জন্য বয়স্ক পুত্রকেও পিতা শাসন করেন–পিত্রা পুত্রো বয়স্থ’পি সততং বাচ্য এব তু। আমি তাই করছি। তুমি যে অভিশাপই দিয়ে থাক, আমি কিন্তু মহারাজ পরীক্ষিতের কাছে তোমার এই আকস্মিক ক্রোধের খবর জানাব। আমি জানাব, যে আপনি আমাকে অপমান করেছেন জেনে আমার বদরাগী বুদ্ধিহীন, অশিক্ষিত ছেলে আপনাকে অভিশাপ দিয়েছে।–মম পুত্রেণ শপোসি বালেনাকৃতবুদ্ধিনা।

মহর্ষি শমীক পুত্রকে সম্পূর্ণ লজ্জা দিয়ে পরীক্ষিতকে সব জানানোর জন্য তার প্রিয় শিষ্য গৌরমুখ মুনিকে পাঠালেন, পরীক্ষিতের কাছে। শমীকের উদ্দেশ্য ছিল একটাই দেশের রাজা, যিনি এতকাল ধরে ব্রাহ্মণ-সজ্জনের প্রতিপালন করে এসেছেন, সেই তিনি যেন না ভাবেন যে, ব্রাহ্মণেরা তার বিপক্ষে চলে গেছেন। অপিচ ব্রাহ্মণদের পক্ষ থেকে যে আকস্মিক অভিশাপ নেমে এসেছে তার ওপর সে অভিশাপ যেন তার অজ্ঞাত না থাকে। অন্তত অভিশাপের সম্মুখীন হবার মতো মানসিক প্রস্তুতি যেন পরীক্ষিতের থাকে। শমীক সেই আশ্বস্ততাটুকু দিতে চেয়েছেন রাজাকে। এর মধ্যে যে অপমানটুকু রাজার পক্ষ থেকে মৃত সর্পের আকার নিয়ে এসেছিল তার কার্যকারণ সূত্র শমীক তাঁর অসীম ক্ষমায় ব্যাখ্যা করে নিতে পেরেছেন, কিন্তু সে ব্যাখ্যা তার পুত্রের কাছে অবোধ্য থেকে গেছে। মনে রাখতে হবে পরীক্ষিতের রাজত্বকালে কলিপ্রবেশ ঘটে গিয়েছিল। তার শেষ পরিণতিতে পরীক্ষিত স্বয়ং এক সচ্চরিত্র সজ্জন মুনিকে অপমান করে বসেছেন, সেই কলির প্রকোপ কিন্তু অন্যত্রও বেড়ে গিয়ে থাকবে। অর্থাৎ তার শাসনের মধ্যে সেই শক্তি বা সেই বাঁধন ছিল না, যা সমগ্র ব্রাহ্মণ সমাজকে ধরে রাখতে সক্ষম ছিল। শমীক নিজগুণে পরীক্ষিতের অপরাধ ক্ষমা করেছেন বটে, কিন্তু অন্যেরা তা পারছেন না। আর সেই সুযোগে অন্য জাতি-গোষ্ঠী যারা রাজার ওপর সন্তুষ্ট ছিল না অথবা পরীক্ষিতের দুর্বল শাসনে যারা মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে তারা এই বিক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ-গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে পরীক্ষিতকে সিংহাসন থেকে চ্যুত করার জন্য।

চলে আসুন এবার তক্ষকের কথায়। নাগরাজ তক্ষক নাগকুলের অন্যতম বিধ্বংসী ব্যক্তিত্ব। বিধ্বংসী তিনি একাই নন, আরও অনেকে আছেন তার সঙ্গে মহর্ষি শৌনক আমাদের মতোই জিজ্ঞাসা নিয়ে বসেছিলেন। নাগগোষ্ঠীর নানা কাহিনী শুনে আমাদের মতোই তার প্রশ্ন জেগেছে। কথক-ঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবার কাছে তিনি অনুযোগের সুরে বলেছেন, তুমি অনেক সর্প-কাহিনী শোনালে বটে, তবে তুমি কিছুতেই সর্পদের নাম বলছ না –পন্নগানাং তু নামানি নকীয়সি সূতজ। সাধারণদের কথা নাই বা বললে, অন্তত সর্প প্রধানদের নামগুলো বল তুমি। সৌতি বলতে আরম্ভ করলেন। সর্প প্রধানদের মধ্যে প্রথম নাম ইল শেষ নাগের, দ্বিতীয় নাম বাসুকির। তারপর ঐরাবত, তক্ষক, কালিয় ধনঞ্জয়, মণিনাগ, এলাপত্র, নহুষ, কৌরব্য, হস্তিপিণ্ড, ধৃতরাষ্ট্র, কুঞ্জর, হলিক ইত্যাদি।

সৌতি যত নাম করেছেন আমি তত করলাম না। আমার স্বার্থে আমি কতগুলি সর্প-নাম বেছে নিয়েছি যাঁদের সঙ্গে কুরু-পাণ্ডব বংশের অনেক রাজ-নামের মিল আছে। পন্ডিতেরা অনুমান করেন, যে ধৃতরাষ্ট্র-ধনঞ্জয় অথবা কৌরব্য-নহুষ–এই নামগুলি নাগ-গোষ্ঠীর প্রধানদেরই নাম বটে, কিন্তু এই নামগুলি এতটাই জনপ্রিয় বা সম্মানিত ছিল যে, কুরুকুলের অনেকেই সেই নামগুলি সচেতনভাবে এবং সসম্মানে গ্রহণ করেছেন। কথাটা একটু খুলেই বলি।

 অসভ্যতা হলেও আপনি যদি এখনও কোনও বীরেন বা শশধর নাগকে তাঁর জাতির কথা জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে বীরেনবাবু উত্তর দেবেন আমরা কায়স্থ; আর শশধরবাবু তার জাতির ইতিহাসটুকু আরও পূর্বে নিয়ে গিয়ে আপন পিতৃবংশের মাহাত্ম সূচনা করে বলবেন, আমরা বহু পূর্বে ক্ষত্রিয় ছিলাম, তবে এই শ্যাম বঙ্গ-দেশে আমরা কায়স্থ বলেই পরিচিত হয়েছি। বস্তুত বীরেন নাগ কি শশধর নাগ ‘শুদ্ধ-কৌলিক’ কায়স্থ, নাকি বাহাত্তুরে কায়স্থ’ –তা নিয়ে নানা বিবাদ বিসংবাদ আছে। এমনকি কায়স্থরা ক্ষত্রিয় জাতির অধস্তন কি না তা নিয়েও এক সময় বিশ্বকোষ রচয়িতা নগেন্দ্র নাথ বসু এবং বৈদ্য-কায়স্থ মোহমুদগরের লেখক উমেশচন্দ্র গুপ্তের উতোর চাপান বেশ ভাল রকম জমেছিল। আমি অবশ্য পরম সম্মানিত এই কায়স্থ জাতির মূল নিয়ে কোনও তর্কেই যাব না। কারণ আমি শুধু নাগ-বাবুদের নিয়ে চিন্তিত।

 বঙ্গজ নাগরা কায়স্থ বা ক্ষত্রিয় যাই হোন না কেন, প্রাচীন ভারতের উত্তর, পশ্চিম এমনকি দক্ষিণেও নাগরা কিন্তু নিজেদের বংশ-মূল হিসেবে মহাভারতীয় বিখ্যাত নাগদের পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। দিল্লির একটি লৌহ স্তম্ভ লিপিতে চন্দ্র নামে এক নাগ রাজার নাম পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে তার পুরো নাম হয়তো চন্দ্রাংশ। পৌরাণিকেরা এই নাগদের বংশ পরিচয় দেবার সময় বড় গর্বভরে বলেছেন বিদিশার ভাবী নাগ-বংশের রাজাদের কথা শুনুন। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন চন্দ্রাংশ। তিনি শেষ নাগের পুত্র-শেষস্য নাগরাজস্য পুত্রঃ পর-পুরঞ্জয়ঃ।

যদি বলেন, পুরাণের কথায় বিশ্বাস করি না, ঐতিহাসিকরা তার থেকে ভাল। তাহলে বলতে হবে–বিদিশা অর্থাৎ এখনকার ভিলসার কাছাকাছি বেশনগর, পদ্মবতী (পদম পাওয়া), কান্তিপুরি আর মথুরায় নাগেরাই ছিলেন রাজা। কুষাণ রাজত্বের পরের দিকে তৃতীয়-চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নাগরা উত্তর ভারত এবং মধ্য-ভারতে ভাল রকম আঁকিয়ে বসেছিলেন। সমুদ্রগুপ্ত থেকে স্কন্দগুপ্ত পর্যন্ত সবারই অনেক সময় গেছে এই নাগদের দাবিয়ে রাখতে। আর আমাদের বিখ্যাত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ইতিহাসের গৌরব যিনি বিক্রমাদিত্য বলে বিখ্যাত–তিনি বড় বুদ্ধিমান মানুষ। দাবিয়ে রাখার ঝামেলার থেকে এক নাগকন্যাকে বিবাহ করাটা তার কাছে অনেক বেশি শ্রেয় মনে হয়েছিল। এ বিষয়ে প্রমাণ চাইলে সময় মতো দেওয়া যাবে।

আমাদের জিজ্ঞাসা- ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ধারক বাহক মহারাজ বিক্রমাদিত্যের এই বুদ্ধি হল কোত্থেকে? আমরা বলব তার সামনে উদাহরণ ছিল অনেক। অর্জুন যে নাগকন্যা উলুপীকে বিবাহ করেছিলেন এই উদাহরণই শুধু নয়। আর্যসভ্যতার প্রথম কল্প থেকে নাগরা যে আর্যদের শত্রু অথবা আর্যদের শত্রুপক্ষকে যে অনেক সময়ই সর্পের কল্পনায় দেখা হত– এ কথা বিক্রমাদিত্য জানতেন। বেদের মধ্যে বৃত্র থেকে আরম্ভ করে অনেক শক্ৰকেই অহি’বা সর্পরূপেই কল্পনা করা হয়েছে। এঁদের সঙ্গে যুঝতে হলে হয় তাদের মারতে হবে, নয়তো তাঁদের সঙ্গে রফায় আসতে হবে। আযায়ণের প্রথম দিকে এই শত্রুতা বেশি ছিল, পরের দিকে মিল মিশ বিবাহ–সবই হয়েছে। অর্থাৎ রফা।

নাগদের মধ্যে দু’রকমের বৃত্তি দেখা যাবে ইতিহাস-পুরাণে। কোথাও তারা ভাল, কোথাও মন্দ। মহাভারতের ক আর বিনতার গল্পে এই ভাল মন্দর খবরটুকু দেওয়া আছে, কিন্তু সেই কাহিনীতে যেতে হলে সমুদ্রমন্থনের কথা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। আমি পরে আসছি সে কথায়। আগে জানাই–কদ্রুর ছেলেরা হলেন সাপ, আর বিনতার ছেলে হলেন গরুড়। এঁদের পিতা কিন্তু একজনই মহর্ষি কাশ্যপ। অর্থাৎ এঁদের বংশমূলে সাপ বা পাখির কোনও গন্ধ নেই। একই মুনির দুই পুত্র- এক পক্ষে সর্পকুল, অন্যপক্ষে পক্ষী সুপর্ণ। হাইনরিখ জিমারের। রূপকের ভাষায় একটা হল –darker aspects of God’s essence, আর অন্য দিকে রয়েছে তার conquering principle –গরুড়, সুপর্ণ।

ব্যাপারটা ইতিহাসেও একই রকম। পণ্ডিতরা বলেন কুরু পাণ্ডবদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মূল কেন্দ্র, যাকে আমরা হস্তিনাপুর বলি, সেই হস্তিনাপুরে আগে নাগদের বাসা ছিল। হস্তিনাপুরকে আগে নাগ পুরই বলা হত। মহাভারতের মহারাজ পাড়ুর বিশেষণ হল নাগপুর-সিংহ। বলতে পারেন-নাগ-মানে তো হাতিও বটে; বিশেষত হস্তিনাপুর গজসাহবয় –এইসব নাম থেকে হস্তিনাপুরের সঙ্গে হাতির সাযুজ্যটাই আসে বেশি অতএব সর্প নাগ নয়, হস্তিনাগ থেকেই হস্তিনাপুরের উৎপত্তি। আমরা কিন্তু এখানে সৌতির বলা সেই সৰ্পনামগুলি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে নামের সঙ্গে হাতির নাম মিশে গেছে। অর্থাৎ সেই ঐরাবত, হস্তিপদ, হস্তিপিন্ড, কুঞ্জর ইত্যাদি। সর্প-নাগদের সঙ্গে হস্তি নাগের ভিন্নতা এইভাবেই নষ্ট হয়ে গেছে। নাগপুর হয়ে গেছে হস্তিনাপুর। পণ্ডিতেরাও এসব কথার উত্তর দিয়েছেন। OST 166109a Later when the distinction between the Naga and serpent clans was forgotten, the elephant was also associated with them. ধরে নিতে পারি– পাণ্ড রাজার নাগপুরে সর্প নাগরাই থাকতেন।

আমি অবশ্য ব্যাপারটা আরও একটু পরিষ্কার করে দিতে চাই। মহাভারত বলেছে যেসব শত্রু আগে কুরুরাষ্ট্র দখল করে রেখেছিল, যার কুরুদের ধন-সম্পদ হরণ করেছিল, মহারাজ পান্ডু সেই সব দেশ পুনরায় অধিকার করে সেগুলিকে করদ রাজ্যে পরিণত করলেন-তে নাগপুর-সিংহেন পাণ্ডুনা করদীকৃতাঃ। যাঁদের রাজ্য পুনরায় দখল করলেন পাণ্ডু, আমাদের ধারণা–তারা সকলেই নাগ-গোষ্ঠীর রাজা। তাদের জয় করেছিলেন বলেই তিনি নাগপুর-সিংহ। পাণ্ডু থেকে আরম্ভ করে একেবারে যুধিষ্ঠিরের সময় পর্যন্ত নাগ রাজারা বেশ স্তিমিত হয়েই ছিলেন খাণ্ডব-বন দহনের সময় স্বয়ং নাগরাজ তক্ষককে নিজের জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হয়। যদিও তিনি প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হয়ে থাকলেও দুর্যোধন বা যুধিষ্ঠিরের দর্পিত এবং সংযত রাজত্বকালে তিনি মাথা উঁচু করেননি মোটেই। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পৃথিবী বীরশূন্যা হয়ে গেল। পরীক্ষিত রাজা হয়ে বসলেন বটে, কিন্তু তার দুর্বল রাজত্বের সুযোগ নিয়ে একদিকে যেমন (রূপকাকারে কল্পিত) কলির প্রবেশ ঘটল, তেমনই ঘটল নাগদের অভ্যুত্থান। নাগরাজ তক্ষক সেই অভ্যুত্থানের প্রতীক।

লক্ষণীয় বিষয় হল আমরা যে শেষ নাগ বা বাসুকি নাগের কথা বলেছি, এঁরা কিন্তু আপন নাগ-গোষ্ঠী ত্যাগ করে আর্য গোষ্ঠীতে যোগদান করেছিলেন। শেষ নাগ পরবর্তী সময়ে বিষ্ণুর অনন্তশয্যা। আর্যগোষ্ঠীর কাছে তিনি পরম সম্মানিত। স্বয়ং কৃষ্ণ জ্যেষ্ঠ বলরাম শেষাবতার রূপে চিহ্নিত। আর বাসুকি হলেন সেই অসামান্য ব্যক্তিত্ব, যিনি রাজা হয়ে আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে নাগ গোষ্ঠীর মিলন সেতু রচনা করেছিলেন এবং তিনিই সমস্ত নাগ গোষ্ঠীকে আর্যগোষ্ঠীর প্রকোপ থেকে মুক্ত করে আসন্ন উচ্ছেদ থেকে রক্ষা করেছিলেন। সে কথায় পরে আসছি। আপাতত শমীক পুত্র শৃঙ্গীর অভিশাপ নিজের কানে শুনে মহারাজ পরীক্ষিতের কী অবস্থা হল একটু দেখে নিই।

.

০৮.

 শমীক-মুনির সংবাদ নিয়ে তাঁর শিষ্য গৌরমুখ হস্তিনায় এসে পৌঁছলেন পরীক্ষিতের কাছে। পরীক্ষিত শমীককেও চেনেন না, তাঁর পুত্র শৃঙ্গীকেও চেনেন না, গৌরমুখকেও তার চেনার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তি যখন ভয়ংকর অভিশাপ বাক্যটি শোনাল, তখন অনুতাপে তার হৃদয় জর্জরিত হল। শমীক যে মৌনব্রত নিয়ে বসেছিলেন, সেইজন্য যে তিনি মহারাজ পরীক্ষিতের কথায় উত্তর দিতে পারেননি–এই অসম্ভব ভুলটুকু পরীক্ষিতকে পীড়িত। করে তুলল– ভূয় এবাভবদ্ৰাজা শোকসন্তপ্তমানসঃ।

হাজার হলেও কুরুকুলের অধস্তন পুরুষ। অন্যায় একবার করে ফেলেছেন বটে, কিন্তু সে অন্যায় অনুধাবন করার সঙ্গে সঙ্গে মর্মচ্ছেদ অনুতাপ আঁকে যত দগ্ধ করতে লাগল, তার মৃত্যুর অভিশাপ সেই অনুপাতে তাঁর কাছে অনেক বেশি সহনীয় ছিলন হি মৃত্যুং তথা রাজা শ্ৰুত্ব বৈ সোন্বতপ্যত। শমীক মুনি উপদেশ পাঠিয়েছিলেন রাজা যেন আত্মরক্ষার যথাযথ উপায় অবলম্বন করেন। রাজা পরীক্ষিত সেই উপদেশ মাথায় রেখে মন্ত্রীদের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে নিজের জন্য নিচ্ছিদ্র সুরক্ষার ব্যবস্থা নিলেন। একটি মাত্র স্তম্ভের ওপর একটি বাড়ি বানিয়ে চতুর্দিকে সর্প চিকিৎসক নিযুক্ত করে, চারদিকে বিষ-নাশক ওষুধ ছড়িয়ে, সর্পমন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণদের ওপর তদারকির ভার দিয়ে পরীক্ষিত মহারাজ সুরক্ষিত হয়ে রইলেন। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারে না, লোক জনের যাতায়াত বন্ধ, সর্বব্যাপ্ত বায়ুরও যেন সে বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ। এমনই এক নিচ্ছিদ্র ঘেরাটোপের মাঝখান থেকে পরীক্ষিতের রাজকার্য চলতে থাকল।

রাজা রাজার মতো সুরক্ষায় ঘেরা থাকলেন, ওদিকে নাগ-রাজ তক্ষকও তার সময় সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। শৃঙ্গী-মুনির চরম ঘোষণার দিনটি, অর্থাৎ ছ দিন পেরিয়ে সপ্তম দিনটি এসে গেল। বিষ-বৈদ্য অথবা সাপের ওঝা –এগুলির মধ্যে সত্যতা যতটুকু আছে, তা রূপকথার রসিকদের আনন্দ দিতে থাকুক, কিন্তু পরীক্ষিতের মৃত্যু যেভাবে ঘটল, তার মধ্যে ইতিহাসের রসটুকুও রীতিমতো ব্যাখ্যাযযাগ্য। নাগরাজ তক্ষক পরীক্ষিতের আত্মগুপ্তির সমস্ত উপায় এবং সম্ভাবনাগুলি পূর্বাহ্নেই জেনে গিয়েছিলেন। আমাদের অনুমান-সপ্তম দিন পর্যন্ত তিনি নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করে দেখেছেন-কারা পরীক্ষিতের কাছাকাছি ঘেঁষতে পারছেন, আর কারা পারছেন না। এই নিবিষ্ট পরীক্ষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সোজা পথে পরীক্ষিতকে মারা যাবে না, চোরাগোপ্তা বাঁকা পথে পরীক্ষিতকে শেষ করে দেবেন তিনি। মহাভারতের কবি লিখেছেন–তক্ষক লোম্মুখে শুনেছেন যে অনেক লোক বিষহর মন্ত্রে পরীক্ষিতকে রক্ষা করে চলেছেন অর্থাৎ জোরদার পাহারা চলছে সেখানে। অবস্থা বুঝে তক্ষক ঠিক করলেন–ছল করেই ঠকাতে হবে পরীক্ষিতকে, তাকে মারতেও হবে ছল করেই–ময়া বঞ্চয়িতব্যো’সৌ…. মায়াযোগেন পার্থিবঃ।

মনে রাখতে হবে–নাগ জনজাতির মানুষেরা কৌরব-পাণ্ডব বংশের হাতে নানাভাবে পর্যস্ত হয়ে পালাতে বাধ্য হলেও তাদের শত্রুতার মধ্যে অসুর-রাক্ষসদের শক্তিমত্তা ছিল না। তাদের সামরিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হওয়ায় সম্মুখযুদ্ধে তারা সব সময়েই খুব সহজভাবে আর্যগোষ্ঠীর নায়কদের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু নিজেদের জায়গা জমি ছেড়ে চলে যাওয়ার অপমান এবং পরাজয়ের গ্লানিটুকু তাদের মনের মধ্যে এতই দৃঢ়–নিবদ্ধ ছিল যে, শত্রুতার সুযোগ পেলেই তার শত্রুতা করতেন। কিন্তু সেই শত্রুতার মাধ্যম ছিল চোরাগোপ্তা আক্রমণ, পণ্ডিতদের ভাষায়– Yet they were very acute in accomplishing the wargild and often stabbed their enemy in the back.

 পরীক্ষিতের মৃত্যুর ক্ষেত্রেও এই ব্যাক-স্ট্যাবিং বা ছলনাটাই হয়েছে। মহাভারতে পরীক্ষিতের মৃত্যুকালীন অথবা মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বের সময়টুকু যদি বিচার করে দেখেন, তাহলে লক্ষ্য করে দেখবেন, শেষের দিনে পরীক্ষিত অনেক ভারমুক্ত। তার নিচ্ছিদ্র সুরক্ষা–ব্যবস্থার মধ্যে খানিকটা শিথিলতাও এসেছে বলে মনে হচ্ছে। দিনের পর দিন লক্ষ্য করে নাগরাজ তক্ষক বুঝেছেন যে, একমাত্র তপস্বী মুনি-ঋষিরাই পরীক্ষিতের দরবারে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন। কারণটা খুব পরিষ্কার। পরীক্ষিতের আয়ুঃশেষ নিধারিত হয়ে গেছে, অতএব তিনি যতটা পারেন মোক্ষ-সাধন সম্পন্ন পুণ্যশ্লোক ঋষি-মুনিদের সৎসঙ্গে ভগবৎ কথা শ্রবণ করে পুণ্যলাভের চেষ্টা করছেন। পুরাণ থেকে জানা যায় যে, ব্যাস-পুত্র শুকদেব শ্রীমদ্ভাগবতের মতো কৃষ্ণ-কথাশ্রয়ী মহাপুরাণ ওই সাতদিনের মধ্যেই পরীক্ষিতের কাছে কীর্তন করেন। ভাগবতের আপন বর্ণনা অনুযায়ী পরীক্ষিতের ভাগবত-সভায় ব্রহ্মর্ষি-মহর্ষির অভাব ছিল না।

সে যাই হোক, নাগরাজ তক্ষক যখন দেখলেন যে, পরীক্ষিতের সামনে পৌঁছনোর সবচেয়ে সোজা উপায় সাধুর বেশ ধারণ করা, তখন তিনি তার সাঙ্গোপাঙ্গ নাগ- অনুচরদের তপস্বীর ছদ্মবেশে ফুল-ফল, কুশ এবং জল উপহার নিয়ে পরীক্ষিতের কাছে যেতে বললেন। তারা আদেশ পালন করল এবং মহাভারতের লোকাত্তর বর্ণনা অনুযায়ী তক্ষক এই সময় একটি কৃমি কীটের আকার গ্রহণ করে লুকিয়ে রইলেন সুমিষ্ট ফলের অন্তর্দেশে। পরীক্ষিত বিচার করলেন না একটুও। সাধু-সজ্জনের উপহার দেওয়া আপাত নিদোষ সেই ফলটিতে কামড় লাগাতেই একটি সামান্য কীটমাত্র দেখা গেল। কীটের চেহারা মহাকাব্যের বর্ণনার খাতিরে ছোট এবং রোগা–অণুঃ হ্রস্বকঃ। কিন্তু এই বর্ণনায় আরও দুটো শব্দ আছে। ছোট হলেও তার গায়ের রঙ তামাটে আর তার চোখ দুটি ঘন কালো। আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে নাগ-জনজাতির শত্রুতা, সৌহাদ্য এবং বৈবাহিক মিশ্রণ দুই-ই এত বেশি গাঢ় ছিল, যে, এই চেহারায় ইঙ্গিতটুকু নৃতত্ত্বের সরসতায় ব্যাখ্যা করা মোটেই অসম্ভব নয়।

পরীক্ষিত কিন্তু বেশ রিলাক্সড়মুডে’ বসে আছেন। অভিশাপের শেষ সপ্তম দিনের সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পরীক্ষিতের মৃত্যুভয় অনেকটাই কেটে গেছে, তার বিষাদ অনেকটাই মন্দীভূত– অস্তমভ্যেতি সবিতা বিষাদশ্চ ন মে ভয়। বেশ লঘু চপল ভঙ্গিতে তিনি ফলের ভিতরে থাকা কীটটাকে হাত দিয়ে ধরলেন এবং সেটিকে গলার ওপর রেখে বলতে লাগলেন- আমি শমীক মুনির কাছে অপরাধ করেছি, সেই অপরাধের স্বালন হোক এবার। এই কীট তক্ষক হয়ে দংশন করুক আমাকে।

এই কথার মধ্যে অপরাধ স্বালনের অনুতাপ যত ছিল, তার চেয়ে লঘুতা ছিল অনেক বেশি। পরীক্ষিত হাসছিলেন, নিজের গলার ওপরে কৃমি-কীট এদিক ওদিক করে ফেলে তিনি হাসছিলেন। মহাভারত মন্তব্য করেছে–রাজার বোধ-বুদ্ধি, কর্তব্য–অকর্তব্যের অনুতাপ তত ক্রিয়া করছিল না। মরণোম্মুখ ব্যক্তির এই বোধ থাকে না, রাজারও এই সময় তা নেই। তাই তিনি হাসছিলেন- কৃমিকং প্ৰাহসক্তৃর্ণং মুমূর্য নষ্টচেতনঃ। মহাভারতে দেখা যাচ্ছে তক্ষক রাজার ওই হাস্যরত অবস্থাতেই স্বমূর্তি ধারণ করে দংশন করে এবং রাজা মারা যান।

বস্তুত নাগ-তপস্বীদের দেওয়া ফলের মধ্যে তক্ষক কৃমিকীট হয়ে লুকিয়ে ছিলেন– এ কথা তত আদরণীয় নয়। ঘটনার গতি প্রকৃতি দেখে অনুমান হয়–তপস্বী মুনি-ঋষির ভেকধারী অন্য অনুচর নাগদের মধ্যেই স্বয়ং তক্ষকই লুকিয়ে ছিলেন। একুট সুমিষ্ট ফলের বাইরের আকার দেখে ফলান্তগত কীটের যেমন সন্ধান পাওয়া যায় না, তেমনই সজ্জন সাধুর বেশধারী নাগ মুনি-ঋষিদের আপাত শান্ত আকৃতির মধ্যও তক্ষককে মোটেই চেনা যাচ্ছিল না। দিনের শেষবেলায় পরীক্ষিত উত্তেজিত; কিন্তু হয়নি, কেউ তাকে কিছু করতে পারেনি তাই তিনি হাসছেন-মৃত্যুর লক্ষণাঙ্কিত বোধ-বুদ্ধিহীন হাসি। মহাভারতের বর্ণনায় রূপক থেকে পুরাণকারেরা, বিশেষত ভাগবত-পুরাণের কবি আসল ঘটনাটা ঠিক ঠিক বার করে এনেছেন। সুমিষ্ট ফল অথবা ফলান্তৰ্গত কীটের কথা কবি উল্লেখও করেননি। তিনি একটি মাত্র দৃঢ় নিবদ্ধ পংক্তিতে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন–শৃঙ্গী মুনি তক্ষককে লাগিয়েছিলেন পরীক্ষিতকে মেরে ফেলার জন্য এবং তক্ষক সোজা ব্রাহ্মণ ঋষি মুনির ছদ্মবেশ ধারণ করে পরীক্ষিতের সামনে এসে তাকে দংশন করলেন–

তক্ষকঃ প্রহিতো বিপ্রাঃ ক্রুদ্ধেন দ্বিজ-সুনুনা।
 দ্বিজরূপ প্রতিচ্ছন্নঃ কামরূপো’দশনুপম।

এটা দংশন, না আকস্মিক অস্ত্রাঘাত, তা সুধীজনেরা বিচার করুন তবে আমার মত ইতিহাস এবং নৃতত্তের বিশ্বসে এটাকে অস্ত্রাঘাত বলেই মনে করে। মনে রাখবেন–ভারতের চিরন্তন নীতিশাস্ত্রে সর্পের সব সময় খল জনের তুলনা দেওয়া হয়েছে। সর্পঃ ক্রঃ সপাৎ ক্রুরতরঃ খলঃ–এ সব সাধারণ নীতি উপদেশের কথা ছেড়েই দিলাম, এখানে অন্তত পনেরো থেকে কুড়িটা সংস্কৃত সুক্তিরত্ন আমি সাজিয়ে দিতে পারি যেখানে খলজনের সাজাত্যে সর্পের তুলনা এসেছে। তক্ষকও এই রকম এক খল প্রকৃতির ক্র মানুষ। পাণ্ডব বংশের ওপর তার ক্রোধ ছিল বহুদিনের। সেই যেদিন খাণ্ডব বন দহন করে অর্জুন তাকে স্থান–ষ্ট করেছিলেন, ততদিনের ক্রোধ। যদিও অর্জুন বেঁচে থাকতে তিনি কিছুই করতে পারেননি, কিন্তু অর্জুন মহাপ্রস্থানে যেতেই, তিনি তার সময় সুযোগ খুঁজছিলেন। এই অবসরে শৃঙ্গী মুনির পিতার কাছে কোনও কারণে পরীক্ষিতের অপরাধ ঘটে যাওয়ায় তক্ষক সেই সুযোগ পান।

শৃঙ্গী নিশ্চয় তক্ষকের সঞ্চিত ক্রোধের কথা জানতেন এবং তিনি সোজাসুজি তাকে নিযুক্ত করেন পরীক্ষিতকে মেরে ফেলার জন্য। নইলে মহাভারতের অন্যত্রও আমরা অনেক অভিশাপ শুনতে পাব। তাতে দেখবেন–তুই এই করেছিস, তোর এই, হবে, সেই হবে ইত্যাদি এইরকমই অভিশাপের নমুনা। কিন্তু এখানে শৃঙ্গী মুনির কথা কত পরিষ্কার, সে কথার কত জোর–আজ থেকে সাতদিনের মাথায়. তক্ষক সেই রাজাকে যমের বাড়ি নিয়ে যাবে এবং তা আমার বাক্যে, আমার কথায় প্ররোচিত হয়ে মাক্যবলচোদিতঃ। পুরাণ কথায় ভাগবতে, তো শৃঙ্গী মুনির কাজটা আরও পরিষ্কার। ক্রুদ্ধ মুনির দ্বারা প্রেরিত হয়ে তক্ষক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধরে এলেন পরীক্ষিতকে দংশন করতে প্রহিতো দ্বিজসূনুনা। আরে! ব্রাহ্মণ কি আর দংশন করে? খল এবং কুরপ্রকৃতির লোকই সাধু সেজে এসে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে পরীক্ষিতকে। আজকের দিনে, নিজে যে পারে না, সে যেমন মাস্তান দিয়ে মার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে, মাডারের ব্যবস্থা করে, তেমনই এখানেও নাগরাজ তক্ষক তার পুরনো হিস্যা’ মিটিয়ে নিলেন, যদিও তার নিমিত্ত হয়ে রইলেন শৃঙ্গী মুনি।

শৃঙ্গীর পিতা শমীক পান্ডব বংশের রাজত্বের অনুগামী। তিনি একদিকে পুত্রের অভিশাপের অনিবার্যতা স্বীকার করছেন। (কারণ তক্ষক তখন কাজে লেগে গেছেন–) আবার অন্যদিকে পরীক্ষিতের কাছে শিষ্য পাঠিয়ে তাকে সাবধান করছেন; খল সর্পের আঘাত থেকে বাঁচবার জন্য তাকে আত্মরক্ষার উপায় অবলম্বন করতে বলছেন। অভিশাপ যদি অনিবার্য হয়, তবে আত্মরক্ষার উপায় বৃথা, অন্তত তৎকালীন দিনের অভিশাপের মনস্তত্ত্ব তাই বলে। অথচ শমীক পরীক্ষিতকে আত্মরক্ষা করতে বলছেন। তার মানে, পুত্রের অভিশাপের অনিবার্যতার থেকেও তক্ষকের চোরাগোপ্তা আক্রমণের বাস্তবটুকু এখানে বেশি বাস্তব এবং গুরুত্বপূর্ণ। শৃঙ্গী-পিতা শমীক-মুনির পরস্পরবিরোধী কথা দুটি এবং পরীক্ষিতের দিক থেকে আত্মরক্ষার প্রবল চেষ্টা –এই দুটি ব্যবহারই বিপরীত দিক থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, নাগ। জনজাতির অন্যতম নায়ক ব্রাহ্মণ-সমাজের একাংশের অনুমোদন লাভ করে নিজের প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করেছেন মাত্র। রূপক-প্রিয় মহাকবি পরীক্ষিতের অপরাধ, ব্রাহ্মণের অভিশাপ আর বিষবাহী তক্ষক–দংশনের উপন্যাসে যে অসাধারণ গল্পটি লিখেছেন, তার মধ্যে ঐতিহাসিকের টিপ্পনি শুধু এক জায়গাতেই। তা হল–এই মাত্র পরীক্ষিতের এক স্তম্ভলম্বী রাজসভায় যে রাজনৈতিক খুনটি হয়ে গেল, তাতে অর্জুনের একান্ত আত্মবংশ পরীক্ষিত মারা গেলেন, এবং তাতে নাগরাজ তক্ষকের ব্যক্তিগত ক্রোধও কিছুটা শান্ত হল বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে নাগ-গোষ্ঠী বা জনজাতির ওপর এই খুনের প্রভাব পড়ল অন্যরকমভাবে। রক্তের বদলে রক্ত- আর্যগোষ্ঠী রক্তের বদলায় মেতে উঠলেন।

পরীক্ষিত মারা যেতেই ব্রাহ্মণেরা পরীক্ষিতের মন্ত্রী এবং পুরবাসীদের সঙ্গে একজোট হয়ে তার উপযুক্ত পুত্র জনমেজয়কে সিংহাসন বসালেন। জনমেজয় যখন পিতার সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স অল্প। যদিও মহাভারতের কবি তাঁকে একেবারেই শিশু বলেছেন, তবে নিতান্ত শিশুটিই তিনি ছিলেন না। সিংহাসনে বসার কিছুকালের মধ্যেই তার বিয়ে হয়। তার স্ত্রীর নাম বপুষ্টমা। জনমেজয়ের এই অতীব স্পৃহণীয়া হৃদয়হারিণী পত্নীর সম্বন্ধে এখনই কোনও কথা বলছি না। যদি প্রসঙ্গ আসে, তবে সে আলোচনা পরে আসবে। আপাতত এইটুকুই জানাই–সিংহাসনে বসার সময়ে পিতার আকস্মিক মৃত্যু সম্বন্ধে তত সচেতন ছিলেন না এবং উপযুক্ত বয়স না হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রী-ব্রাহ্মণেরাও তাকে তেমন করে কিছুই অবহিত করেননি। তাই বলে মন্ত্রীরা পরীক্ষিত-হন্তা তক্ষকের কথা ভুলে বসেছিলেন, তা নয়। আমরা জানি যে, জনমেজয় রাজা হয়ে এক সময় তক্ষশিলা জয় করতে গিয়েছিলেন এবং তারও আগে-পাঠক। স্মরণ করুন সেই কুকুরীর অভিশাপের কথা। কুকুরীর অভিশাপ মোচনের জন্য জনমেজয়। যাকে পৌরোহিত্যে বরণ করেন, সেই সোমশ্র ব্রাহ্মণ ঋষি কতবার ঔরস পুত্র বটে তবে। তার মা ছিলেন নাগ জাতীয়া। জনমেজয় তক্ষক নাগের হাতে পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে থাকবেন। তাই কুকুরী যখন অভিশাপ দিল- তোমারও ওপর ভয় নেমে আসবে অতর্কিতে– তখন জনমেজয় আবারও সপঘাতের কথাই ভেবেছেন হয়তো। অন্তত পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে নাগ জনজাতির সঙ্গে যে রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শক্রতা আরম্ভ হয়েছিল তারই নিরিখে জনমেজয় এমন একজনকে চিরন্তন পৌরোহিত্যে নিয়োগ করলেন, যাঁর ঘনিষ্ঠ মেলা মেশা আছে নাগ জনজাতির সঙ্গে।

সোমশ্রবা এক সপীর পুত্র। জনমেজয় সোমশ্রকে হস্তিনাপুরে নিয়ে এসে ভাইদের বলেন। তার আজ্ঞাবহ হতে। আর ঠিক সোমশ্ৰবাকে নিযুক্ত করেই যে তিনি তক্ষশিলা জয় করতে বেরলেন তার পেছনে সোমশ্রবার পরামর্শ ছিল বলে আমরা অনুমান করি। হয়তো তিনিই বলেছিলেন যে, পরীক্ষিতের মৃত্যুর কারণ তক্ষককে সেইখানেই পাওয়া যাবে। তক্ষশিলা আর তক্ষক–এই তক্ষ’ নামের সাদৃশ্যটা খুব বড় কথা নয়, তক্ষক যে ওইখানেই থাকতেন, তার একটা বড় প্রমাণ মহাভারতের বনপর্বে। সেখানে দেখা যাবে পাণ্ডব মধ্যম অর্জুন অমোঘ অস্ত্র লাভ করার জন্য শিবের তপস্যা করতে গেছেন আর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী আর অন্য ভাইদের, নিয়ে বিমনা হয়ে বসে আছেন। এই অবস্থায় দেবর্ষি নারদের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। নারদ তাকে নানা তীর্থে ঘুরে বেড়াবার উপদেশ দিলেন। বেড়ানোও হবে, পুণ্যও হবে, সময় ও কেটে যাবে স্বচ্ছন্দে। এই নানা তীর্থের নাম এবং তাঁর মাহাত্মের মধ্যে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের কথা এল। শোনা। গেল– কাশ্মীরে বিতস্তা নদীর জল-ধোয়া কোনও এক অঞ্চলে নাগরাজ তক্ষকের বাসভূমি -–কাশ্মীরেম্বেব নাগস্য ভবনং তক্ষকস্য চ। বিতস্তাখ্যমিতি খ্যাতং সর্বপাপ-প্রমোচন।

সেকালে এমন ছিল। শুধু আর্যগোষ্ঠীর আর ব্রাহ্মণ্যের কেন্দ্রগুলিই শুধু তীর্থ হিসেবে পরিগণিত হত না। কোনও স্থানকে আপন তপস্যায় এবং মাহাত্মে তীৰ্থীকরণের ক্ষমতা আর্যদের যেমন ছিল, আর্য-বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীরও তেমন ছিল। বলতে পারেন এই কাশ্মীরদেশি নাগ ভবনের মালিক তক্ষক আর পরীক্ষিত-হস্তা তক্ষক একই ব্যক্তি কিনা? হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। এমন হতে পারে–খাণ্ডব দাহের সময় অর্জুনের তাড়া খেয়ে তক্ষক কাশ্মীরের প্রত্যন্ত দেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আবার এমনও হতে পারে–তক্ষক একটি বিখ্যাত নাগবংশের উপাধিমাত্র। কাশ্মীরে বিতস্তা নদীর তীরভূমিতে তক্ষক নাগবংশ এতটাই বিখ্যাত ছিল যে তাদের আবাসভূমি তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। যে কোনও কারণে এই বিখ্যাত বংশের সঙ্গে পাণ্ডবদের শত্রুতা হয় এবং মহারাজ পরীক্ষিত তার বলি হন।

জনমেজয় তক্ষশিলা, জয় করে ফিরে এলেন বটে, কিন্তু তক্ষককে তিনি সেখানে পাননি। মহাভারতে দেখবেন এই তক্ষশিলা জয়ের পর-পরই মহর্ষি বেদের শিষ্য উতঙ্ক উপস্থিত হন হস্তিনাপুরে জনমেজয়ের রাজসভায় এবং তিনি তক্ষকের সম্বন্ধে জনমেজয়কে উত্তেজিত করেন। ঠিক এইবার জনমেজয় পিতার মৃত্যু সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে প্রাচীন মন্ত্রীদের জিজ্ঞাসা করেন এবং মন্ত্রীরাও আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা জনমেজয়ের কাছে নিবেদন করেন। সে সব ঘটনা আমরা আগে বলেছি।

জনমেজয়ের রাজসভায় জরুরি বৈঠক বসল। মন্ত্রী এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সবার মত চেয়ে জনমেজয় বললেন, উতষ্কের হেনস্থা এবং পিতার মৃত্যু- এই দুয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমি তক্ষককেও পুড়িয়ে মারতে চাই। মন্ত্রী পুরোহিতেরা একযোগে সর্পযজ্ঞের আয়োজন করতে বললেন। যাজ্ঞিকেরা আভিচারিক বৃত্তির প্রতীক কালো কাপড় পরে ধূমাকুলিতনেত্রে আগুনে আহুতি দিতে থাকলেন আর সাপেরা যে যেখানে ছিল, সব এসে পড়তে লাগল যজ্ঞের আগুনে।

আসল কথা হল– জনমেজয় তক্ষকের ওপর রাগে সমস্ত নাগ-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। সর্পযন্ত্র একটা রূপকমাত্র। আমি পরে মহাভারত থেকে দেখাব বিশাল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকেও বেশ কয়েকবার যন্ত্রের রূপকে বেঁধে দিয়েছেন কবি। জনমেজয়ের সৰ্পর্সত্রে সেই রূপকটুকু পরিষ্কার করা নেই, যাতে বোঝা যায় জনমেজয় সমগ্র নাগ-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই তাঁর জেহাদ ঘোষণা করলেন! পণ্ডিতের ভাষায় –janamejaya …..chalked out a plan for a wholesale massacre of their race.

লক্ষণীয় বিষয় হল– নাগ-গোষ্ঠীর মধ্যে সকলেই একরকমের লোক নন। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁদের সঙ্গে আর্য-ব্রাহ্মণ্যের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মহর্ষি কাশ্যপের দুই স্ত্রী ক এবং বিনতার কাহিনী আমি এখানে বিস্তারিতভাবে বলছি না। কিন্তু কশ্যপের এই দুই স্ত্রীর মধ্যে দাসিবৃত্তির শপথ নিয়ে একটা বাজি ধরার ব্যাপার ছিল। সম্পূর্ণ শ্বেতবর্ণ উচ্চৈঃশ্রবার ল্যাজটি কালো না সাদা, এই নিয়ে দুই সতীনে বাজি ধরলেন। কদ্রু বললেন- উচ্চৈঃশ্রবার ল্যাজটি কালো, বিনতা বললেন সাদা। বাজি জিতবার জন্য কদ্রু তার সর্প-পুত্রদের আদেশ দিলেন উচ্চৈঃশ্রবার ল্যাজে গিয়ে আটকে থাকার জন্য। সর্পপুত্রদের বেশিরভাগই এই শঠতায় রাজি হলেন, কিন্তু অনেকে আবার রাজি হলেনও না, তারা মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে বেরিয়ে এলেন।

মা কদ্রু এই সাপদের অভিশাপ দিলেন বটে, কিন্তু সেই অভিশাপ শুনেও নাগ-জাতির মধ্যে সব থেকে প্রভাবশালী শেষনাগ চলে গেলেন তপস্যা করতে। কঠিন নিয়ম আর ব্রত আচরণে তার শরীরের চামড়া শিরা-শুকিয়ে গেল এবং স্বয়ং ব্রহ্ম তাকে একজন খাঁটি মুনির মতোই সম্মান দিলেন-তপ্যমানং তপো ঘোরং…জটাচীরধরং মুনি। শেষনাগ ধার্মিক মুনির সম্মানে ভূষিত হয়ে ব্রহ্মার বর লাভ করলেন। এটাই বড় কথা নয়, ব্রহ্মার ইচ্ছায় তিনি সমস্ত পৃথিবীকে আপন ফণাগ্রে ধারণ করে রইলেন। অর্থাৎ নাগ হওয়া সত্ত্বেও আর্যগোষ্ঠীর নিয়ম আচার পালন করে তিনি আর্য-অনার্য সকলের মধ্যেই পূজা-পদবি লাভ করলেন। পৃথিবীর স্থিতিশীলতার জন্য সকলেই তার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে রইল।

শেষ বা অনন্ত নাগের মতোই আরেক পুণ্যবান ধার্মিক হলেন নাগরাজ বাকি। সমুদ্র মন্থনের সময় দেবাসুর দুই পক্ষের মর্যাদা লাভ করে তিনি মন্থন-রজুর ভূমিকা গ্রহণ করে অমৃত-লাভে সহায়তা করেছিলেন। প্রধানত তারই করুণায় এবং পরামর্শে সমস্ত নাগগোষ্ঠী জনমেজয়ের ক্রোধ থেকে মুক্তি পায়। বাসুকির বোন হলেন জরৎকারু। তপস্বী মুনি জরৎকারুর সঙ্গে নাগিনী জরৎকারুর মিলনে মহামুনি আস্তীকের জন্ম হয় এবং এই আস্তীকের হস্তক্ষেপেই জনমেজয়ের সর্পসত্র বা wholesale massacre বন্ধ হয়ে যায়।

আগে যেমন ব্রাহ্মণী পুলোমা এবং রাক্ষস পুলোমার কথা বলেছি, তেমনই ব্রাহ্মণ ঋষি জরৎকারুর সঙ্গে নাগ-বংশীয় জরৎকারুর মিলন হল। এঁদের নাম-সাম্যেই বোঝা যায় যে, একদিকে আর্য এবং নাগ গোষ্ঠীর শ্রেণীগত মিলন এবং সংমিশ্রণ যেমন ঘটেছিল, তেমনই এঁদের পারস্পরিক কৃষ্টির সংমিশ্রণও ঘটেছিল। বাসুকি নাগ যে ব্রাহ্মণ জরৎকারুর সঙ্গে তার ভগিনী জরৎকারুর বিয়ে দিলেন তার পেছনে তার গোষ্ঠীস্বার্থের ব্যাপার ছিল পুরোপুরি। মহাভারতে এই স্বার্থের কথাটা বলা আছে ভবিষ্যদবাণীর মতো করে। বাসুকি-ভগিনী জরৎকারু যখন গর্ভবতী হয়ে বাসুকির কাছে ফিরে এলেন, তখন বাসুকি বলেছিলেন, তোমার গর্ভে যে পুত্র হবে, সেই নাগকুলের মঙ্গল বয়ে আনবে, জনমেজয়ের সর্পসত্র থেকে সেই আমাদের আমাদের বাঁচাবে —

 পন্নগানাং হিতাথায় পুত্রস্তে স্যাৎ ততো যদি।
 স সপসত্ৰাৎ কিল নো মোক্ষয়িষ্যতি বীর্যবান।।

 বাসুকি-ভগিনী দাদাকে স্বামীর আশ্বাস শুনিয়ে বলেছেন–নাগদের উদ্দেশ্যসিদ্ধি নিয়ে তুমি চিন্তা কোর না। সে আমার গর্ভে এসে গেছে।

বলা বাহুল্য–এটা ভবিষ্যদ্বাণী নয়। নাগদের মঙ্গল ঘটেছিল নাগিনীর মুনিপুত্র আস্তীকের মাধ্যমে। নাগিনীর গর্ভজাত হলেও ব্রাহ্মণের জাতি পেতে তার অসুবিধা হয়নি, কারণ মহর্ষি জরৎকারু তাকে স্বেচ্ছায় বিবাহ করেছিলেন। আস্তীকও নাগভবনে থেকেই তার ব্রাহ্মণ্যের তপশ্চর‍্যা চালিয়ে গেছেন- গৃহে পন্নগরাজস্য প্রযত্না পরিরক্ষিতঃ। জনমেজয় যখন তক্ষকের কারণে সর্পকুলের ওপর তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্রতিজ্ঞা নিলেন, তখন মাতুল বাকির পরামর্শে এগিয়ে এলেন সেই আস্তীক, যাঁর পিতার ঔরস সংস্কার ব্রাহ্মণ্য আর মাতার শোণিত–সংস্কার নাগজাতীয়। ব্রাহ্মণ্য এবং আর্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এই নাগিনীপুত্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলেই দেশের রাজার ওপরে তিনি সেই ব্যক্তিত্ব আরোপ করতে পেরেছিলেন, যাতে জনমেজয় সর্পযজ্ঞ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

 অন্যদিকে তক্ষককে দেখুন। জনমেজয় তাকে তক্ষশিলায় পাননি। পাবেন কী করে? পরীক্ষিতকে হত্যা করার পর জনমেজয়ের হাত থেকে বাঁচবার জন্য তাকে পালাতেই হয়নি শুধু, তিনি আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এমন এক দেবতার কাছে যিনি আর্য-সংস্কৃতি এবং ধর্মের প্রধান প্রতিভূ। তিনি ইন্দ্র। দেবরাজ ইন্দ্র অন্তরীক্ষে অথবা স্বর্গে, যেখানেই তিনি থাকুন, তক্ষককে আশ্রয় দিতে তার বাধেনি। এতটাই তাঁকে তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তার মুখ। দিয়ে বরদানের মতো এই শব্দগুলি বেরিয়েছিল –তুমি আমার ঘরে চুপটি করে বসে থাক তে দেখি। আমি দেখব–কোন সর্পত্রের আগুন তোমায় কী করে বসেহ ত্বং মসকাশে সুগুপ্তো/ ন পাবকত্ত্বাং প্রদহিষ্যতীতি।

 মুনি-ঋষি, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা আর্য সংস্কৃতির দ্বিতীয় স্তর। কেন না প্রথম স্তরে আছেন দেবতারা। আর ইনিও যে সে দেবতা নন। ঋকবেদে সর্বাপেক্ষা অধিক স্তব-স্ততি যাঁর উদ্দেশ্যে, নিবেদিত, সেই ইন্দ্র হলেন তক্ষকের বন্ধু-প্রতিম। তার মানে তক্ষক ছোড় টা ছেড়ে বড়-ডারে ধরেছেন। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উপাস্য বর্গের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব আছে। তিনি ইন্দ্রের আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত আছেন। কিন্তু মজা হল, উপাস্য যিনি, তার সমস্ত শক্তিমত্তা এবং জনপ্রিয়তাই উপাসক-নির্ভর। তক্ষক যখন কিছুতেই আসছেন না, তখন মুনিরা মন্ত্রের জোরে ইন্দ্রের সিংহাসন ধরেই টান দিলেন। যাতে কান টানলে মাথা আসে, ইন্দ্রের সঙ্গে তক্ষকও আসেন। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মনস্তত্ত্ব এই–যাঁকে এতকাল ধরে এত মন্ত্র পড়ে, এত ঘি পুড়িয়ে তুষ্ট করলাম, তিনি কিনা আমাদের রাজহস্তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আশ্রয় দিতে চাও দাও, কিন্তু মনে রেখ– তুমি আমাদের উপাস্য হলেও আমাদের স্বার্থবিরোধী জনকে আশ্রয় দিয়েছ বলে, তোমাকেও আমরা ছাড়ব না, তোমাকেও একসঙ্গে আগুনে পোড়াব- তমিন্দ্রেণৈব সহিতং পাতয়ধ্বং বিভাবসৗ।

ইষ্ট অনুগত ভক্তের আস্থা হারালে দেবতা যে আর উপাস্য থাকবেন না, তা দেবতারাও জানেন। মহাভারত বলেছে- ঋষিদের যজ্ঞের ক্ষমতা দেখে ইন্দ্রও ভয় পেয়ে তক্ষককেও ছেড়ে পালালেন- হিত্বা তু তক্ষকং ত্রস্তঃ স্বমেব ভবনং যযৌ। এ হল এখনকার দিনের রাজমন্ত্রীর ব্যবহার। কুখ্যাত মাস্তানকে রাজনৈতিক বুদ্ধিতে আশ্রয় দিয়েছেন হয়তো, কিন্তু যখন দেখা গেল জনগণ বেঁকে বসল, পাটি ভাল চোখে দেখছে না, তখনই আর নেতা তাকে চিনতে পারেন না– জনগণ চায় না, অতএব আমি তোমায় চিনি কী করে? ইন্দ্র তক্ষককে ত্যাগ করে নিজের ঘরে ঢুকলেন। তক্ষক মারা পড়েন আর কী!

ঠিক এই অবস্থায় এসেছে আস্তীক-মুনির মধ্যস্থতা। পিতৃকুলের লোকের সঙ্গে মাকুলের গোলমাল। তিনি জনমেজয়ের সভায় দাঁড়িয়ে দিব্য ভাষায় জনমেজয়ের যজ্ঞ-প্রশংসা করে জনমেজয়ের মন ভিজিয়ে দিলেন এবং নিজের ব্যক্তিত্বে সামরিক-শক্তিহীন নাগকুলের সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেন। তক্ষক তো বাঁচলেনই জনমেজয়ের রাজরোষ থেকে বাঁচল সমস্ত সর্পকুল। নিশ্চিন্ত হলেন বাসুকি, যিনি পূর্বাহ্নেই আর্য-সংস্কৃতির অঙ্গীভূত তথা নিজগোষ্ঠীর হঠকারিতায় সাময়িকভাবে বিব্রত, চিন্তিত।

মহাভারত জানিয়েছে–যে সমস্ত সাপের বিষ খুব বেশি ছিল, তারাই মারা পড়েছিল জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে দৰ্খাস্ত মহাসুট্রে…দীপ্তানল-বিষোণাঃ। আসল কথা-নাগ-গোষ্ঠীর যে সমস্ত ব্যক্তি তৎকালীন আর্য-ক্ষত্রির শক্তির বিরোধিতায় নেমেছিলেন, জনমেজয় তাদেরই মুলোৎপাটন করে ছেড়েছিলেন। বাকি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আগে থেকেই আর্যগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, বাদবাকি অন্যেরা আস্তীক-মুনির মধ্যস্থতায় আর্য-সংস্কৃতিতে আত্মীকৃত হলেন। এর ফলে প্রাচীনতর তথা সমসাময়িক নাগ-জনজাতির সঙ্গে জনমেজয়ের আর কোনও শত্রুতা রইল না। আস্তীকের ব্যক্তিত্ব এবং তর্কযুক্তি জনমেজয়ই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। জনমেজয়ের সভাস্থ অন্য ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিতেরা সকলেই একসময় বুঝেছেন যে, সর্পবংশবিনাশী ওই প্ৰধ্বংসী যজ্ঞ আর চলা উচিত নয়। তারা সকলে মিলে পরামর্শ দিয়েছেন যজ্ঞ বন্ধ হোক, আস্তীক বর লাভ করুন–

ততো বেদবিদস্তাত সদস্যাঃ সর্ব এব তু।
রাজানমূঢুঃ সহিতা লভতাং ব্রাহ্মণো বর৷৷

রাজা জনমেজয় মেনে নিলেন মন্ত্রী পুরোহিতের কথা। বললেন, আপনারা যেমন চাইছেন, আস্তীক যেমন চাইছেন, তেমনটিই হোক। যজ্ঞ বন্ধ হোক, সর্পকুলের ওপর সমস্ত উপদ্রব বন্ধ হোক–সমাপ্যতামিদং কর্ম পন্নগাঃ সন্তু অনাময়াঃ। সভাস্থলে আনন্দের কোলাহল উঠল। ব্রাহ্মণ সজ্জন যাঁরা যজ্ঞে উপস্থিত হয়েছিলেন, অতিথি, শিল্পী, কর্মকার যারা উপস্থিত–তাঁরা সবাই জনমেজয়ের দান-মান পেয়ে জনমেজয়কে আশীর্বাদ শুভেচ্ছা জানালেন। এই দান মানের প্রাপকদের মধ্যে আমার কাছে একজন বড় গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সূত-জাতীয় পুরাণবক্তা। তিনি গল্প বলেন। মহাভারতের কবি এই সূত জাতীয় ব্যক্তিটির নাম স্বকণ্ঠে বলেননি। তবে আমাদের অনুমান–তিনিই লোমহর্ষণ, আমাদের বর্তমান কথক ঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবার পিতা। মিলনের আনন্দে দান-মানের প্রগ্রহ যখন মুক্ত হয়েছিল, তখন এই সূত জাতীয় কথক-ঠাকুরটিও জনমেজয়ের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হননি- তেভ্যৎ প্রদদৌ বিত্ত শতশোধ সহষণঃ। লোহিতাকায় সূতায়……। নাম না বললেও পণ্ডিতেরা অর্থ করেছেন সূতায় লোমহর্ষণীয়। সৌতি উগ্রশ্রবা যাঁর কাছে মহাভারতের পাঠ নিয়েছেন, সেই লোমহর্ষণ কিন্তু একটু পরেই জনমেজয়ের এই সভাতেই সুযোগ পাবেন মহাভারত শোনার।

.

০৯.

 জনমেজয়ের রাজসভায় আস্তীক মুনির মধ্যস্থতায় যেভাবে নাগদের সঙ্গে শাসক ক্ষত্রিয়ের মিলন ঘটল, তাতে আমরা এখনই মহাভারতের মূল কাহিনীতে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু সেই পথে আমাদের বাধা হলেন স্বয়ং আমাদের কথক ঠাকুর সৌতি উগ্রশ্রবা। আমি আগে বলেছি–মহাভারতের তৃতীয় সম্পাদক হিসেবে উগ্রশ্রবাসৌতি আগে তাঁর নিজস্ব কালের হাওয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আমি বলেছি-নাগদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে –কীভাবে তারা শত্রু থেকে বন্ধু, এমনকি উপাস্যতার পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন সেটা দেখানো সৌতি উগ্রশ্রবার ভাবনার মধ্যে ছিল। এখন বলছি শুধু নাগ নয়, মানুষের মর্ত্যভূমিতে যাদের আমরা দেবতা বলি, রাক্ষস বলি অসুর বলি– তাদের প্রাথমিক পরিচয় উন্মোচন। করাটাও সৌতির ‘মেথডোলজি’র মধ্যে পড়ে।

মনে রাখতে হবে এর পরে মহাভারতে আমরা প্রধান প্রধান অনেক দেবতাকেই দেখতে পাব যাঁরা মনুষ্য রমণীর প্রেম-পাশে বদ্ধ হবেন। দেখতে পাব- শুধু প্রেম কেন মনুষ্য রমণীর গর্ভে দু-একটি পুত্র কন্যা লাভ করতেও তারা বেশ আগ্রহী। দেবতারা অলৌকিক শক্তি বশে মনুষ্য সমাজের ওপর এই অলৌকিক অধিকার বিস্তার করেছেন– ধর্মের যুক্তিতে একথা আদরণীয় মনে হলেও আমি যে সে পথে এতক্ষণ হাঁটিনি, তা বোধ করি বিলক্ষণ বুঝেছেন। আর আমাদের সৌতি উগ্রশ্রবার আধুনিক মননশীলতাও তো কিছু ভোলবার নয়। তিনি মূলত গল্প বলা কথক ঠাকুর হলেও তিনি মহাভারতের ইতিহাস শোনাতে বসেছেন, কাজেই গল্প বলা অথবা কথকতার অন্তরে তিনি তৎকালীন দিনের সামাজিক ইতিহাসটুকুও যে ইঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলবেন–সে কথা বলাই বাহুল্য।

কদ্রু বিনতা এবং অন্যান্য নাগদের পরিচয় দিতে দিতেই তিনি অমৃত মন্থনের প্রসঙ্গে চলে গেলেন। এর পিছনে অবশ্যই তার উদ্দেশ্য আছে। হঠাৎ করে এক গল্পের খেই হারিয়ে তিনি অন্যগয়ে যাননি। নাগদের প্রসঙ্গে দেবতা আর অসুরদের পারস্পরিক স্থিতি মহাভারতের আরম্ভেই তার জানানোর প্রয়োজন আছে এবং তা জানানোর সবচেয়ে সহজ এবং বড় উপায় হল সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যান। সৌতি উগ্রশ্রবা স্বকণ্ঠে এই উপাখ্যানের তাৎপর্য বলবেন না, কারণ তিনি মোহময়ী কথকতায় আবিষ্ট। বিশেষত এই তাৎপর্য জানাতে হলে তাকে পুরাণ কথাও বলতে হত বিস্তর, তাতে আধুনিক প্রক্ষেপবাদীদের আরও পোয়া বারো হত। কিন্তু সৌতি বলেননি বলেই আমাদের দায় আসে তার কথা ঠিক ঠিক বুঝিয়ে বলার।

দেখুন সমুদ্রমন্থনের কাহিনী এতটাই পুরনো এবং এতটাই তা গভীর যে ভারতের পুরাণগুলির অধিকাংশের মধ্যেই এই কাহিনীর আলাপ এবং বিস্তার শোনা যাবে। আর পুরাণ গুলি যেহেতু আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক ইতিহাস অতএব সৌতি উগ্রশ্রবার মহাভারতকে বুঝতে হলে পুরাণ কথা দিয়েই মহাভারতকে বুঝতে হবে, কারণ সেই প্রথমে আমরা উগ্রশ্রবার পরিচয় দিতে গিয়ে তার বিশেষণ দিয়েছি- ‘লোমহর্ষণ-পুত্র উগ্রশ্রবা সৌতিঃ পৌরাণিকঃ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই ‘পৌরাণিক যখন ভারত আখ্যান শোনাচ্ছেন তখন তো আর তিনি পুরাণের কথা বলবেন না, আখ্যানের অন্তরে তিনি শুধু ইঙ্গিত করবেন। সে ইঙ্গিত আমাদের বুঝতে হবে সমান হৃদয় দিয়ে পৌরাণিকের সমব্যথা নিয়ে।

 জানি, এখনই বলবেন– এই তো আবার আরম্ভ করলে ভ্যাজর ভ্যাজর। যে রকম প্রস্তুতি হয়েছিল তাতে এখনই বেশ পাণ্ডব-কৌরব আর চন্দ্রবংশের পরম্পরা শোনা যেত। তা না, যত সব উটকো প্রক্ষিপ্ত কাহিনী নিয়ে তোমার মাথা-ব্যথা। আমি বলব মাথা ব্যথা শুধু আমার নয়, আপনাদেরও মাথাতেও সেই ব্যথা আমি খানিকটা ধরিয়ে দিতে চাই। কেন না ব্যথা না। থাকলে–আইনস্টাইন-স্টিফেন হকিংও জলভাত, ব্যাস-বাল্মীকিও জলভাত। সেই জলভাতী বিদ্যায় ওপর-চালাকি করার সুবিধে হতে পারে, কাজের কাজ কিছু হয় না। তবু আপনাদের আকাক্ষা মতো আমি আগেই ঘটনার তাৎপর্যে প্রবেশ করব না, বরং ঘটনাটার সঙ্গে সঙ্গে মাথা–ব্যথার টিপ্পনিগুলি দিয়ে যাব।

সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যানে মহাভারতে কোনও ভণিতা নেই। সৌতি উগ্রশ্রবা বললেন, সুমেরু নামে একটি মহাপর্বত আছে। সে পর্বতের আকার যেমন সুন্দর, তেমনই তার চাকচিক্য। সোনার মতো সে পাহাড়ের রং আর সেখানে বিচরণ করেন শুধু দেবতারা আর গন্ধর্বরা-কনকাভরণং চিত্রং দেবগন্ধর্বসেবিত। এত উঁচু সেই পাহাড় যেন স্বর্গকেও আবরণ করে দেয় নাকমাবৃত্য তিষ্ঠতি। সেই সুমেরু পর্বতের সবচেয়ে উঁচু শিখরে উঠে স্বর্গবাসী। দেবতারা অমৃত আহরণ করার জন্য আলোচনা আরম্ভ করলেন। দেবতাদের অমৃত মন্ত্রণা আরম্ভ হতেই ভগবান নারায়ণ ব্রহ্মাকে ডেকে বললেন, দেবতারা অসুরাদের সঙ্গে নিয়ে সমুদ্র মন্থন করুক, তাতেই অমৃত পাওয়া যাবে দেবৈ রসুরসঘৈশ্চ মধ্যতাং কলশোদধিঃ। উদধি মানে সমুদ্র আর কলশ মানে কলসী।

 ছোটবেলায় যদি রূপক কর্মধারয় সমাস পড়ে থাকেন, তাহলে কলশ রূপ সমুদ্র বুঝতে কোনও অসুবিধেই নেই। সমুদ্র যার বৃহৎ রূপ, কলশ তারই ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। সেই সমুদ্র-কলশ মন্থন করে অমৃত তুলতে হবে। কিন্তু কেন, কী কারণ ঘটল অমৃত মন্থন করার? মহাভারত তা বলেনি, কারণ অন্যান্য পুরাণে তা বলা আছে। সমুদ্র মন্থনের কারণ নিয়ে পুরাণে পুরাণে মতভেদ আছে। কিন্তু ভেদ যাই থাকুক, কারণ একটা ছিলই। একটি পুরাণে অমৃত লাভ করা বা অমৃত পান করার পূর্বাবস্থা বর্ণিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে দেবতাদের অবস্থা খুবই খারাপ। অসুর-দানবদের সঙ্গে যুদ্ধে তারা মোটেই পেরে উঠছেন না। মাঝে মাঝে তাদের অস্ত্রাঘাত এমন কঠিন হয়ে বাধছে দেবতাদের বুকে যে, তাদের অনেকেই মারা যেতে আরম্ভ করলেন। তাদের আর উঠে দাঁড়াবার শক্তি রইল না–

তদা যুদ্ধে সুরৈর্দো বধ্যমানাঃ শিতায়ুধৈ।
গতাসবো নিপতিতা নোত্তিষ্ঠের স্ম ভূরিশঃ।

ধরে নিই, এই অবস্থায় তারা সুমেরু পর্বতের সু-উচ্চ শিখরে উঠে সমুদ্র মন্থন করার কথা ভাবতে আরম্ভ করলেন।

অন্যতর আরও একটি বিখ্যাত পুরাণে সমুদ্রমন্থনের কারণ একেবারেই ভিন্নতর। সেখানে দেখা যাচ্ছে ব্যাপা মুনি দুর্বাসা পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন –চচার পৃথিবীমিমা। ভ্রাম্যমাণ মুনির সঙ্গে এক বিদ্যাধর বধুর দেখা হয়ে গেল এক মুক্ত বনস্থলীর মধ্যে, একান্ত আকস্মিকভাবে। কোনও পুরাণ মতে ইনি হলেন অপ্সরা সুন্দরী মেনকা। যাই হোক মেনকাই হোন, আর বিদ্যাধরীই হোন তার হাতে জড়ানো ছিল গন্ধে উন্মাদ করে দেওয়া একটি মালা। মালাটি স্বর্গের সন্তানক পূষ্প দিয়ে তৈরি। এমন তার গন্ধ যে সমস্ত বন সেই গন্ধে মম করছিল; সেই বনের পথ বেয়ে যারা আসছিল তারা সবাই আকৃষ্ট হচ্ছিল এই উন্মাদিনী মালার গন্ধে। ওই বনের পথে সেই বিদ্যাধরীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল খ্যাপা দুর্বাসার।

পুরাণকার এই অধ্যায়ের প্রথমাংশে উন্মত্ত শব্দটা ব্যবহার করেছেন অন্তত পাঁচ পাঁচ বার। প্রথমত দুর্বাসার চেহারা ছিল ‘উম্মত্ত’ পাগলের মতো উন্মত্তরূপধূ। তিনি যে ব্রত পালন করেছিলেন তা এতই দুষ্কর যে, তার কষ্টে মানুষ পাগল হয়ে যায়–উন্মত্ততধৃগ বিপ্রঃ। সেই দুর্বাসা বনভূমির মধ্যে বিদ্যাধরীর হাতে জড়ানো সন্তানক-পুষ্পের উম্মদ গন্ধ পেয়ে তার কাছে মালাখানি চেয়েই বসলেন। খ্যাপা মুনিকে দেখে বিদ্যাধর বধূ দ্বিতীয় কোনও চিন্তা না করে সাদরে সপ্রণিপাতে সন্তানক-মালা দিলেন মুনির হাতে। মুনি অধিকতর মর্যাদায় সেই মালা জড়িয়ে নিলেন নিজের মাথায়। ফুলের গন্ধে মাতাল মৌমাছিরা উড়ে এসে বসতে থাকল দুর্বাসার মাথায় জড়ানো মালায়। শুষ্ক ব্রতক্লিষ্ট চেহারার মধ্যে রুক্ষ জটাজুটে কোমল মধুর মালা জড়িয়ে উন্মত্তের মতো মুনি পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন-তামাদায়াত্মননা মূর্ধি … পরিবভ্রাম মেদিনীম্।

ঠিক এই রকমভাবে ভ্রমণ করতে করতে হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে। মদমত্ত ঐরাবতে চড়ে তিনি হেলে-দুলে আসছেন। না, দুর্বাসা তাতে কোনও রাগ করেননি। মদোন্মত্ত হাতি, দুলে দুলেই তো আসবে। কিন্তু বহু পরিভ্রমণের পর দেবরাজ ইন্দ্রকে দেখে এতই আনন্দিত হলেন যে, তিনি তাঁর মস্তকলম্বী উন্মত্ত-পদা’ মালাখানি উন্মত্তের মতো ছুঁড়ে দিলেন দেবরাজের দিকে। দেবরাজ মালাটি ধরে নিলেন বটে, কিন্তু আধুনিক সভায়। সভাপতির মতো তিনি মালাখানি নিজে না পরে তা দুলিয়ে দিলেন গজরাজ ঐরাবতের মাথায়। দেখে মনে হল যেন কৈলাস-শিখর থেকে গঙ্গা নামছেন ভূঁয়ে।

যে মালা দুর্বাসার মাথায় ছিল সেই মালা সম্মান করে নিজের মস্তকে স্থাপন না করে ইন্দ্র যে হাতির মাথায় দুলিয়ে দিলেন, তাতেও দুর্বাসা ক্রোধ করেননি। কিন্তু সন্তানক-পুষ্পের উন্মাদ গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ঐরাবত হাতি তার শুড় দিয়ে টেনে নিল মালাটি। তারপর হাতির যেমন বুদ্ধি হয়। মালাটি শুড় দিয়ে খুব খানিকটা আঘ্রাণ করে সেটা পায়ের তলায় পিষে ফেলল গজরাজ ঐরাবত। ব্যস্। আর যায় কোথা। ব্রতক্লিষ্ট মুনি হয়েও যে দুর্বাসা বিদ্যাধরসুন্দরীর কাছ থেকে আগ্রহভরে চেয়ে নিয়েছেন, যে মালা একমাত্র দেবরাজের ইন্দ্রের হঠকারিতায় ভূমিতে নিষ্পিষ্ট হল–এই অমযাদা এবং অপরাধ দুর্বাসা সইতে পারলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দেবরাজকে অভিশাপ দিলেন–ওরে বদমাশ তুই ইন্দ্রের ঐশ্বর্য পেয়ে এতই গর্বিত এবং মত্ত হয়ে গিয়েছিস যে, আমার দেওয়া চিরলক্ষ্মীর প্রতীক সেই মালাটা তোর পছন্দ হল না। কোথায় মালাটা হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকাবি, কোথায় আমার পায়ে পেন্নাম করে বলবি–আমি আপনার প্রসাদ লাভ করে ধন্য হলাম, মুনিবর! তা না, মালাটা ফেলে দিলি মাটিতে–প্ৰসাদ ইতি নোক্তত্তে… ন চাপি শিরসা ধৃতা।

দুর্বাসা যথেষ্টই রেগে গেছেন। ক্রোধ এবং পরুষ ব্যবহার করার ব্যাপারে তিনি যে অন্য সহৃদয় মুনি-ঋষিদের সঙ্গে তুলনীয় নন, এ বিষয়ে তিনি নিজেও অত্যন্ত সচেতন। দেবরাজের অবমাননায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত অভিশাপ উচ্চারণ করলেন, তুই যখন লক্ষ্মীমতী মালাটাকে মাটিতে ফেলে দিলি তথন আজ থেকে তোর স্বর্গরাজ্য লক্ষ্মীহীন হয়ে যাবে তস্মাৎ প্রণষ্টলক্ষ্মীকং ত্রৈলোক্যং তে ভবিষ্যতি। অভিশাপ শুনে সঙ্গে সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্র হুড়মুড়িয়ে নামলেন ঐরাবতের গজ আসন থেকে। মুনিকে প্রণাম করে তখন দেবরাজ ইন্দ্র অনুনয় বিনয় আরম্ভ করলেন, যাতে অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন তাড়াতাড়ি। কিছুতেই কিছু হল না। দুর্বাসা বললেন, আমার দয়া-টয়া অত নেই বাছা– নাহং কৃপালু হৃদয়ো ন চ মাং ভজতে ক্ষমা। ওই সব দয়া-করুণা যাঁদের আছে, সেই গৌতম বশিষ্ঠ ইত্যাদি মুনিদের চিকৃত স্তবেই তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আমি হলাম গিয়ে দুর্বাসা। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে, আমার এই জটজুটধারী ভ্রূকুটি-কুটিল মুখখানি দেখে ভয় না পায়। আর তাছাড়া তুমি যে এই বারবার তখন থেকে অনুরোধ-উপরোধ করে যাচ্ছ, তার কোনও ফল হবে না। আমি ক্ষমা করব না- নাহং ক্ষমিষ্যে বহুন্য কিমুক্তেন শতক্রতো।

দুর্বাসা দুর্বার গতিতে চলে গেলেন। আহত মনে নানা আশঙ্কা নিয়ে দেবরাজও চলে গেলেন অমরাবতীতে। গিয়ে দেখলেন–সমস্ত স্বর্গভূমি তার নিসর্গ সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। গাছে পাতা নেই, ওষধি ফুল অপধ্বস্ত, শীর্ণ লতা-বল্লরী শীর্ণতরা–ততঃ প্রভৃতি নিঃশ্রীকং সশং ভুবন-ত্রয়। স্বর্গভূমির দেবতারা সব বিমনা হয়ে রইলেন, ঋষিদের মনে যজ্ঞে মন নেই, তপস্বীরা তপস্যা করেন না, মানুষেরা দান-ধ্যানে ভুলে গেল।

তৎকালীন দিনের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যজ্ঞ-দান-তপস্যার বহুতর বিঘ্ন ঘটেছে মানেই অবস্থা যথেষ্ট সংকটময়। কিন্তু আমার প্রস্তাব এবং প্রকরণের জন্য যে সমস্যাটা দরকার, সেই সমস্যাটার কথা এইবার আসবে। পুরাণকার বললেন– স্বর্গের এই বিধ্বস্ত অবস্থায় সমস্ত লোক লোভে এমন উন্মত্ত হয়ে উঠল যে, সবাই ছোট-খাট জিনিস নিয়েও ঝগড়া করতে লাগল-লোভাপহতেন্দ্রিয়াঃ। স্বল্পে’ পি হি বভূবুস্তে স্বাভিলাষা দ্বিজোত্তম। সমস্ত জগৎ নিঃশ্রীক। এবং সত্ত্ব গুণ বিরহিত হওয়ার ফলে দৈত্য-দানবেরা এবার দেবতাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করা আরম্ভ করলেন। দেবতাদের শক্তি হল সত্ত্বগুণ আর সত্ত্বহীনতাই দৈত্য দানবের। শক্তি। ফলে এই সময়ে অসুর-দানবদের তেজোবৃদ্ধি ঘটায় তারা এবার দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন এবং বলহীন দেবতাদের হারিয়ে দিলেন দেবান্ প্রতি বলোদ্যোগং চর্দৈতেয়-দানবাঃ। বিজিতান্ত্রিদশা দৈত্যৈঃ…

অসহায় বিপন্ন দেবতারা চিন্তিত মনে প্রজাপতিব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মা তাঁদের সবাইকে নিয়ে উপস্থিত হলেন তিন ভুবনের পালক ভগবান বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু দেবতাদের করুণ অবস্থা অনুভব করে বললেন, আমি তোমাদের সাহায্য করব, তোমরা সমুদ্র মন্থন করে অমৃত লাভ করার ব্যবস্থা করো-মথ্যতাম অমৃতং দেবাঃ সহায়ে ময্যবস্থিতে।

আমরা এতক্ষণে সেই প্রতিপাদ্য বিন্দুতে উপস্থিত হয়েছি, যেখানে পুরাণগুলি এবং মহাভারত একই কথা বলছে- দেবগণ তোমার অমৃত মন্থন করো। কিন্তু পুরাণগুলি ঘেঁটে মর্মকথা যেটা বেরিয়ে এল, সেটা হল-সমুদ্র মন্থনের কারণ, অর্থাৎ দেবভূমি স্বর্গরাজ্য নিঃশ্ৰীক, সৌন্দর্যহীন, বৃক্ষলতাহীন হয়ে গিয়েছিল, দেবতাদের কিছুই করণীয় ছিল না এবং অসুর দানবেরা স্বর্গরাজ্য দখল করে নিয়েছিল। ঠিক এই রকম একটা অবস্থায় মহাভারতের বর্ণনায় আমরা দেবতাদের সুমেরু পর্বতে আরোহণ করতে দেখেছি বস্তুত আমরাও একই সঙ্গে সেই সুমেরুর উচ্চ চুড়ে আরোহণ করে দেখতে পারতাম যে, জায়গাটা কেমন? কিন্তু সেই ভৌগোলিক বিবরণের আগে প্রয়োজনের প্রশ্নটা আছে–এই দেবতারা কারা? অসুর-দানবেরা কারা? অথবা আগে মানুষই বা কারা? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে দেবতাদের সমুদ্রমন্থনের। আগে আরও একবার আমাদের মহাভারত এবং পুরাণ সমুদ্র মন্থন করতে হবে। আরও একটা কথা হল সমুদ্রমন্থনের উপাখ্যান এমনই এক বিষয় যা শুধু উপাখ্যান বা আখ্যায়িকমাত্র নয়, সমুদ্র-মন্থনে যেহেতু ব্ৰহ্ম বিষ্ণু মহেশ্বর সহ সমস্ত অসুর-দানব নাগ এবং স্বর্গরাজ্যের দেবতা সকলেই ‘ইনভলভড’ সেই হেতু দেবতা, অসুর এবং অন্যান্যদের পরিচয় দেওয়া আমাদের। নিতান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আমরা চাই, এই আবশ্যক কাজটা মহাভারতের সমুদ্রমন্থনের সূত্র ধরেই আসুক। তাতে দেবতা এবং অসুরেরা পিচ পরমেশ্বর বিষ্ণুও ঠিক কী ‘পোজিশনে দাঁড়িয়ে আছেন–সেটা বোঝা যাবে। তার পরে আরম্ভ হবে পরিচয় করিয়ে দেবার কাজ–দেবতা, অসুর, মানুষ—সবার।

মহাভারতে বিষ্ণু ব্রহ্মাকে বলেছেন–দেবতা এবং অসুরেরা সবাই মিলে সমুদ্র মন্থন করুক, তাতেই অমৃত পাওয়া যাবে দেবৈরসুরসঘৈশ্চ মথ্যতাং কলশোদধিঃ। ভগবান বিষ্ণুর আদেশটা যথেষ্টই পরিষ্কার। কিন্তু এই আদেশের মধ্যে যে গুপ্ত কথাটা আছে, সেটা বলতে মহাভারতের কবির রুচিতে বেধেছে। কিন্তু আমাদের ঐতিহাসিক পুরাণকারেরা সেই গুপ্ত কথাটা ফাস করে দিয়েছেন। আমরা এর আগে বলেছি যে স্বর্গভূমি তার সৌন্দর্য হারিয়েছিল এবং দৈত্য দানবেরা দেবতাদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বর্গভূমি থেকে। তাদের যে লাভ খুব একটা হয়েছিল তা নয়, কারণ ধন-সম্পদহীন একটি গজভুক্ত কপিথবৎ ভূখণ্ড লাভ করে তাদের আর শ্রী বাড়বে কতটুকু। কিন্তু মনুষ্য-সমাজের চিরন্তন বিরোধিতার একটা মনস্তত্ত্ব এর মধ্যে আছে। একটি ভাঙা বাড়ি অথবা অনুর্বর ভূমি নিয়েও যদি জ্ঞাতিশত্রুতা বাধে, তবে জয়ী হলে সেই ভাঙা বাড়ি অথবা নিষ্ফলা ভূমির অধিকার বোধই কিন্তু পরম তৃপ্তি দেয়। হয়তো অসুরদেরও সেই তৃপ্তি হয়েছিল।

ভাগবত পুরাণে দেখা যাচ্ছে–অমৃত মন্থনের প্রস্তাব করেই প্রভু নারায়ণ দেবতাদের। পরামর্শ দিলেন–যাও তোমরা আপাতত শুক্রাচার্যের শিষ্য অসুরদের সঙ্গে সমস্ত ঝগড়া। মিটমাট করে নাও। মিটমাট করে ততদিন সামলে থাক, যতদিন না অমৃত ওঠে-যাও-দানব দৈতেয়ৈঃ তাবৎ সন্ধি বিধীয়তাম। যারা মেরে-কেটে পালিয়ে গেল, তাদের সঙ্গে সন্ধি? দেবতাদের মনে লজ্জা দ্বিধা দুই-ই হল। প্রভু নারায়ণ দেবতাদের অন্তর বুঝে বললেন বাপু হে! দরকার পড়লে শত্রুর সঙ্গেও মিটমাট করে কাজ গুছিয়ে নিতে হয়–অরয়োপি সন্ধেয়াঃ সতি কার্যার্থে গৌরবে। তারপর? তারপর সাপ আর ইঁদুরের গল্প। একই আধারে এক বস্তার মধ্যে সাপ আর ইঁদুর আটকা পড়েছে। এবার সেই আবদ্ধ স্থান থেকে পথ বার করবার জন্য সাপ প্রথমে ইঁদুরের সঙ্গে সন্ধি করে। তারপর যখন পথ তৈরি হয়ে যায়, তখন খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। সময়ে মূষিক সাপের পেটে যায়– অহি মূষিকবদদেবা হ্যর্থস্য পদবীং গতৈঃ। অর্থাৎ অমৃত ওঠা পর্যন্ত ভাব করবে অসুরদের সঙ্গে। তারপর দেখা যাবে।

বিষ্ণু পুরাণের মতো প্রাচীন পুরাণ এসব কথা না বললেও সমুদ্র মন্থনে অসুরদের প্রয়োজনটা বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রভু নারায়ণ বুঝতে পেরেছিলেন–সমুদ্র মন্থন করতে যে। অসম্ভব শক্তি লাগবে সেই অসম্ভব শক্তির জোগান দেওয়া একা দেবতাদের পক্ষে সম্ভব নয়। নারায়ণ তাই বলেছিলেন-তোমরা সাহায্যের জন্য অসুরদের কাছে যাও, কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলবে মিষ্টি করে। বলবে– সমুদ্র মন্থন করে অমৃত উঠলে আমরা-তোমরা দু’পক্ষই সমান ভাগ পাব। অমৃত পান করে তোমরাও যেমন বলশালী হবে, তেমনই আমরাও বল লাভ করব– তৎপনাৎ বলিনো যুয়মমরা ভবিষ্যথ। নারায়ণ এবার পরিষ্কার করেই বলে দিলেন যে, দেব-দানবের দ্বৈত সাধনায় শেষ পর্যন্ত অমৃত যখন উঠবে, তখন তিনি এমন ব্যবস্থা করবেন–তথা চাহং করিষ্যামি–যাতে দেবদ্বেষী অসুরেরা অমৃতের ভাগ একটুও না পায় এবং দেবতারাই পান সবটা। ভাগবত পুরাণ নারায়ণের জবানীতে বলেছে–শুধু কষ্ট করবে দৈত্যরা, কিন্তু ফল পাবে তোমরাক্লেশভাজো ভবিষ্যন্তি দৈত্য যুয়ং ফলগ্রহাঃ।

এইরকম মারাত্মক এক পরিকল্পনার পর স্বাভাবিকভাবেই দৈত্য-দানবদের সঙ্গে দেবতাদের সাময়িক সন্ধি হল। কিন্তু সন্ধির প্রস্তাবটা কোন দৈত্যরাজ মেনে নিলেন, সে প্রসঙ্গে মহাভারত যেমন নীরব, অধিকাংশ পুরাণও তেমনই নীরব। শুধু মৎস্য পুরাণ, ভাগবত পুরাণের মতো দু-একটি পুরাণ এব্যাপারে ঐতিহাসিকের কর্তব্য সেরে বলছে যে–দেবতারা পুরুষোত্তম বিষ্ণুর সঙ্গে পরামর্শ সেরেই চলে গেলেন দৈত্যরাজ বলির কাছে উপেয়ুবলিং সুরাঃ। মৎস্য পুরাণে এতটাই বলা হয়েছে যে, দেবতারা যেন অন্তত কিছুকাল দৈত্যরাজ বলিকেই নিজেদের প্রভু বা স্বামী বলে মানেন-দানবেন্দ্রা বলিঃ স্বামী স্তোককালং নিবেশ্যতাম্। অসুর দৈত্যদের তখন এমনই দেব বিদ্বেষ ছিল যে, দেবতাদের দেখলেই তারা যুদ্ধোদ্যোগ শুরু করে দিতেন। অতএব হঠাৎ করে অনেকগুলি দেবতাকে একসঙ্গে আসতে দেখেই তারা অস্ত্র হাতে সজ্জিত হলেন। দেবতাদের হাতে কোনও অস্ত্র ছিল না, অতএব নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করাটা যে নিতান্ত অন্যায় হবে, সে সম্বন্ধে আর কেউ না থোক, অন্তত দৈত্যরাজ বলি অবহিত ছিলেন।

মহারাজ বলি খুব কম লোক নন। বলির জন্ম এমনই এক বিখ্যাত বংশে, যে বংশে পরপর। কয়েকজন অসুর রাজা পরম বিখ্যাত হয়েছেন এবং তা এতটাই যে পরমেশ্বর বিষ্ণুকে অন্তত দু-তিনটি অবতার গ্রহণ করতে হয় অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে। তাছাড়া বলি মহারাজের ঠাকুরদাদা হলেন স্বয়ং প্রহ্লাদ।

আমাদের ধারণা দৈত্যকুলে এই প্রহ্লাদের পর থেকেই অসুরদের মধ্যে অন্তত অসুর রাজাদের মধ্যে অন্য ধরনের কিছু মূল্যবোধ তৈরি হয়। ফলে অসুরেরা দেবতাদের দেখে অস্ত্র হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৈত্যরাজ বলি তাদের নিষেধ করেন- নষেধ দৈত্যরা শ্লোক্যঃ সন্ধিবিগ্রহকালবিৎ। নিষেধ করেন, কেন না তিনি অশেষ কীর্তিমান (পুরাণের ভাষায় ‘শ্লোক্যঃ’) এবং কখন কার সঙ্গে সন্ধি করতে হবে অথবা কার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, সেটা তিনি ভালমতই জানেন। অন্তত এখন এই অসহায় নিরস্ত্র দেবতাদের ওপর অস্ত্রক্ষেপণ যে তার মতো বড় মানুষকে মানায় না এটা তিনি বোঝেন।

মৎস্য পুরাণ যেমন বলছে, তাতে দেবতারাও দৈত্যরাজ বলির কাছে কাছে প্রার্থনা জানাবার সময় যথেষ্ট নত হয়েই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন আমরা তোমার সঙ্গে কোনও বিরোধ চাই না, দৈত্যরাজ। আমরা তোমার কথাতেই চলব আমরা তোমার ভৃত্য–অলং বিরোধেন বয়ং ভৃত্যাস্তব বলে’ধুনা। চল, আমরা এই মহাসমুদ্র মন্থন করে অমৃত লাভ করি। বস্তুত তোমার দয়াতেই এই অমৃত লাভ সম্ভব হবে- ত্বপ্রসাদা সংশয়ঃ। হাজার হলেও প্রহ্লাদের। নাতি। বলি সঙ্গে সঙ্গে রাজিই শুধু হলেন না, দেবতাদের আপাত স্তুতি স্তাবকতায় তিনি এতই খুশি হলেন যে তাদের অভয় দিয়ে বললেন- আমি একাই এই সমুদ্র মন্থন করে তোমাদের অমৃত এনে দিতে পারতাম-শক্তো’হমেক এবাত্র মথিতুং ক্ষীরবারিধি। আরে! দূর থেকে এসে যদি শত্রুও প্রণত হয়ে আশ্রয় ভিক্ষা করে, তবে তার ব্যবস্থা না করলে পরলোকে যে আমার ঠাই হবে না কোনও।তা যাক গে, তোমরা যা বলছ, আমি তোমাদের প্রতি স্নেহবশত নিশ্চয়ই তা পালন করব –পালয়িষ্যামি তৎ সর্বান্ অধুনা স্নেহমাস্থিতঃ।

ভাগবত পুরাণের আরও একটা সংবাদ এই প্রসঙ্গে আমাদের দরকার।

ভাগবত বলেছে– দেবতাদের কথা বলি যেমন মেনে নিলেন, তেমনই মেনে নিলেন অন্য দৈত্য-দানবেরাও শম্বর, অরিষ্টনেমি ইত্যাদি দৈত্য নায়কেরাও যাঁরা সকলেই ত্রিপুরাবাসী শম্বরো’ বিষ্টনেমিশ্চ যে চ ত্রিপুরবাসিনঃ। এই ত্রিপুর’ নামের এই জায়গাটাকে আমাদের খুব নিবিষ্ট হয়ে মনে রাখতে হবে। আর সেখানকার অধিবাসী দৈত্যরাজ বলির সাঙ্গোপাঙ্গ অসুর পার্ষদদেরও মনে রাখতে হবে, কারণ একটু পরেই আমরা এই ত্রিপুরের কথায় আসব।

ওদিকে সমুদ্র মন্থনের জোগাড় যন্ত্র আরম্ভ হয়ে গেল। সোজা কথা তো নয়। সমুদ্র মন্থনের মন্থন দণ্ড নিবাচিত হল মন্দর পর্বত। সে পর্বতকে সমূলে উপড়ে নিয়ে আসা হল সমুদ্রের ওপর। নাগরাজ বাসুকি নাগদের পক্ষ থেকে দেব-দানব দুই দলেরই উপকারে শামিল হলেন। তিনি হলেন মন্থন রঞ্জু। স্বয়ং বিষ্ণু কর্ম-রূপ ধারণ করে স্থির কঠিন পৃষ্ঠের অবলম্বন। দিলেন সমুদ্রের তলায়, যাতে মন্দর পর্বতের মন্থন দণ্ডটি স্থান-ভ্রষ্ট না হয়। দেবতারা বিষ্ণুকে নিয়ে, আর দানবেরা বলি রাজাকে নিয়ে সদলবলে এসে পৌঁছলেন ক্ষীর সাগরের তীরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *