১১০. দ্রোণাচার্য আর দ্রুপদের হিংসা-প্রতিহিংসার কাহিনী

১১০.

মহাভারতের কবি বেশ ভারী বর্ণনা দিয়ে দ্রোণাচার্য আর দ্রুপদের হিংসা-প্রতিহিংসার কাহিনী শোনালেন বটে কিন্তু এই বর্ণনার পিছনে তার অন্তত তিনটি উদ্দেশ্য আছে। এক, দ্রোণাচার্য ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করেছেন এবং যেহেতু ক্ষত্রিয়োচিত সুখ–সমৃদ্ধি তথা রাজ্যলাভে তিনি যথেষ্টই আসক্ত ছিলেন, সেই আসক্তি তার ফলবতী হল বাল্যবন্ধুর রাজ্য গ্রাস করে। দ্রোণাচার্য রাজা হলেন এতদিনে। তার এতদিনের অন্নকষ্ট এবং অর্থকষ্ট নির্মল হল রাজকীয়তার পরিণতিতে।

দুই, দ্রোণ-দ্রুপদ দুজনেই কুরুবাড়ির বাইরের লোক। কিন্তু দ্রোণাচার্য হস্তিনাপুরের রাজপুত্রদের শিক্ষকতার ভার নিয়ে কুরুবাড়ির বৃদ্ধদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলেন এবং তার ফল হল এই কুরুবাড়ির মানুষেরা দ্রোণাচার্যের একান্ত নিজস্ব সমস্যাকে রাজনৈতিকতায় পর্যবসিত করলেন। দুটি বাইরের লোকের হিংসা-প্রতিহিংসার হল–কর্ষিত ভবিষ্যতের ভূমিতে ভারতযুদ্ধের বীজ প্রোথিত হল।

 তিন, দ্রোণ-দ্রুপদের আগন্তুক ঘটনার রাজনৈতিক গুরুত্ব নির্ণয় করেও মহাভারতের কবি তাঁর প্রিয় নায়ককে ভোলেননি। তিনি অর্জুন। কুরুবাড়ির রাজকুমারদের শিক্ষা প্রসঙ্গেই দ্রোণাচার্যের কথা এসেছিল, এবং সেই প্রসঙ্গে এসেছিল পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কথা। কিন্তু এই দুই আগন্তুকের কাহিনীর প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কবি একটি অসাধারণ মন্তব্য করেছেন। বলেছেন–এই যে রম্য জনপদযুক্ত অহিচ্ছত্রা নগরীতে দ্রোণাচার্য তাঁর রাজ্যাধিকার লাভ করলেন, সেই রাজ্যটা কিন্তু আসলে পাণ্ডব অর্জুনই জিতে নিয়ে দিয়েছে তার গুরুকে–যুধি নির্জিত্য পার্থেন দ্রোণায় প্রতিপাদিতা। অর্থাৎ দ্রোণাচার্য এতক্ষণ যে দ্রুপদের দর্পচূর্ণ করে–অর্ধেক রাজ্য তোমার থাক আর অর্ধেক আমার–অনেক বড় বড় কথা বললেন, সেই রাজ্য জেতার নায়ক কিন্তু তিনি নন, সেই রাজ্য জিতে দিয়েছেন মহাভারতের কবির নায়ক অর্জুন।

দ্রোণ-দ্রুপদের এই হিংসাহিংসি বন্ধ হবার পর ঠিক এক বছর সময় চলে গেল। পাণ্ডবরা যেভাবে অস্ত্র শিক্ষা পেয়েছেন এবং যেভাবে তাদের বিনয়-নীতির শিক্ষা ঘটেছে, তাতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন তাদের ওপর। বিশেষত জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের নীতি এবং ধর্মবোধ, বিনয় এবং নম্রতা তথা বুদ্ধি এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা ধৃতরাষ্ট্রকে মুগ্ধ করেছিল। তাই সব দিক বিবেচনা করে যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ পদে অভিষেক করলেন ধৃতরাষ্ট্র। যৌবরাজ্য লাভ করে যুধিষ্ঠির এমনভাবেই রাজকার্যে সহায়তা করতে লাগলেন, যাতে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে এবং সেই সুনাম তাঁর পিতা পাণ্ডুর খ্যাতিও ম্লান করে দিল–পিতুরন্তর্দধে কীর্তিং শীলবৃত্ত-সমন্বিতঃ।

 ভীম-অর্জুনও চুপ করে বসে ছিলেন না। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের ভবিষ্যৎ রাজ্যলাভ প্রায় স্বীকৃত হয়ে যাওয়ায় ভীম-অর্জুনের কিছু নিশ্চিন্ততাও ছিল। সেই নিশ্চিন্ততার সুযোগ নিয়ে তারা নিজেদের আরও সুশিক্ষিত করে তুললেন। ভীম যতখানি গদাযুদ্ধ শিখেছিলেন, তা নেহাত কম কিছু নয়, কিন্তু গদাবিদ্যার উচ্চতর পাঠ গ্রহণের জন্য তিনি চলে গেলেন কৃষ্ণ–জ্যেষ্ঠ বলরামের কাছে। সেকালের দিনে গদাযুদ্ধে যারা পরম পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন, তাদের মধ্যে বলরাম ছিলেন প্রধানতম। ভীম তার কাছে গদাযুদ্ধের বহুতর পাঠ নিয়ে এলেন।

অন্যদিকে অর্জুন, যিনি ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হিসেবে চিহ্নিত হবেন, তিনি চলে গেলেন যুদ্ধে। অর্জুনের আর কিছু শিক্ষণীয় ছিল না। যা তার প্রয়োজন ছিল, তা হল অভ্যাস। আর যুদ্ধ, নিরন্তর যুদ্ধই ছিল তাঁর শিক্ষা-সম্পূর্ণতার সোপান। হস্তিনাপুরের উত্তরদিকে যে সব রাজারা হস্তিনাপুরকে কর দিত না, অর্জুন তাদের শিক্ষা দিতে রওনা হলেন। উত্তর দিকের যোদ্ধা রাজাদের মধ্যে যবনরাজ সৌবীর ছিলেন ভয়ঙ্কর শক্তিশালী। মহারাজ পাণ্ডুও তাকে শায়েস্তা করতে পারেননিন শোক বশে কর্তৃং যং পাণ্ডুরপি বীর্যবান। অর্জুন সেই সৌবীর যবনরাজকে হত্যা করলেন অবলীলায়।

বস্তুত সৌবীর যে কোনও যবন-রাজার নাম তা মনে হয় না। সিদ্ধান্তবাগীশের অনুবাদ সৌবীর নামক যবনরাজকে–আমাদের কাছে যুক্তিসঙ্গত নয়। মহাভারতে সিন্ধুদেশের সঙ্গে সৌবীর শব্দটি এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়েছে বারবার। মহারাজ শা, তিনি কাশীরাজনন্দিনী অম্বার প্রণয়প্রার্থী ছিলেন, তিনি সিন্ধু-সৌবীর দেশের অধিপতি ছিলেন বলে মহাভারতে দেখি। অন্যদিকে দুর্যোধনের ভগিনী দুঃশলার সঙ্গে যাঁর বিবাহ হবে, সেই জয়দ্রথকেও সিন্ধু-সৌবীর দেশের অধিপতি বলা হবে মহাভারতে। অর্জুনের এই বিজয়-যাত্রার সময়ে কোনও এক যবনরাজকে সৌবীর বলা হয়েছে বটে, কিন্তু তিনি সৌবীর দেশের মানুষ–এই অর্থই এখানে করা যায়।

 আসলে সিন্ধু অঞ্চলের রাজারা চিরকাল অনেক বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন বলেই তারা হয়তো সুবীর নামে বিখ্যাত হয়েছেন। সেই সুবীরদের দেশই সৌবীর। অর্জুনের উত্তর-বিজয়ের সময় অন্তত তিনজন সৌবীর রাজার নাম করা হয়েছে–বিপুল, দামিত্র এবং সুমিত্র। এতে করে আরও মনে হয় সিন্ধু-অঞ্চলে একটি মাত্র রাজার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল না। সিন্ধুদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর্যায়নের বিভিন্ন কল্প শেষ হবার পর এখানে যে সব জনগোষ্ঠীর বীর নায়কেরা এসে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন, আর্যগোষ্ঠীর চোখে তারা যবন বলেই পরিচিত হয়েছেন, যার জন্য সিন্ধু-সৌবীর শব্দের পরিবর্তে কখনও বাহিক কখনও বা সিন্ধু-পুলিন্দকাঃ ইত্যাদি অধম জাতি গোষ্ঠীর নামও সিন্ধু অঞ্চলের রাজাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।

ভগবান বুদ্ধের সময়ে সৌবীর দেশের রাজধানী রোরুবক নামে বিখ্যাত হয়েছিল এবং রাজগৃহ-মগধের সঙ্গে সৌবীর দেশের ব্যবসাও চলত ভালভাবে। মহাভারতের সময়েও সিন্ধু-সৌবীর রাজারা তাদের শক্তি এবং পরাক্রমের জন্যই বিখ্যাত ছিলেন। হেউইট সাহেব আবার সৌবীরদের পশ্চিম-ভারতের বেশ পুরাতন এক বিস্তৃত জনগোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ঋগবেদের বাণিজ্য-গোষ্ঠীর প্রতীক পনিদের সঙ্গে যেমন সৌবীরদের একাত্মক করে দেখেছেন হেউইট, তেমনই আধুনিক শৌ বা সওদাগর শব্দ দুটির মধ্যেও সৌবীর শব্দের শেষ পরিণতি লক্ষ্য করেছেন পণ্ডিতেরা।

যাই হোক মহাভারতে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ–এই সবগুলি দিকেই মহাকাব্যের গৌরব অর্জুনের যুদ্ধ অভিযান সূচিত হয়েছে বটে, কিন্তু আসলে সিন্ধু-সৌবীর অঞ্চলেই যে তাঁর। যুদ্ধকৰ্ম প্রধানত কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, সে কথা বোঝা যায় চার-পাঁচটি সৌবীর রাজার সঙ্গে তার মুখোমুখি যুদ্ধের ঘটনা থেকে। দেশ জয় করে যে বিপুল পরিমাণ ধনরাশি অর্জুন কুরুরাষ্ট্রে নিয়ে এসেছিলেন এবং এতে তার যুদ্ধ–পরিচালনার ক্ষমতা এতটাই স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে–স্বভাবা অগমচ্ছব্দঃ–যে, পৃথিবীতে তাঁর আঁতো ধনুর্ধর দ্বিতীয় নেই–একথা লোক-প্রবাদে পরিণত হয়েছিল–অর্জুনস্য সমো লিকে নাস্তি কশ্চিদ্ ধনুর্ধরঃ। অন্যান্য পাণ্ডবভাইরাও, বিশেষত ভীম, যুধিষ্ঠিরের যৌবরাজ্যের সময়ে বেশ কিছু যুদ্ধজয় করেছিলেন এবং হস্তিনাপুরের রাজ্যসীমাও তাতে বেড়েছিল–পররাষ্ট্রনি নির্জিত স্বরাষ্ট্রং ববৃধুঃ-পুরা।

এ কথা অনেককেই বলতে শুনি যে, যুধিষ্ঠির একেবারেই বোকা-সোকা মানুষ। তাঁর রাজ্য পরিচালনার বুদ্ধি কিছুই নেই এবং শুধু ধর্মবুদ্ধির দ্বারাই তিনি রাজকার্য পরিচালনা করার চেষ্টা করতেন। হ্যাঁ এটা অবশ্যই ঠিক যে, রাজ্য চালনার মতো রাজনৈতিক তথা অর্থশাস্ত্রীয় ব্যাপারে ধর্মবুদ্ধিকে তিনি কখনই বিসর্জন দিতেন না। কিন্তু এই যে তার যৌবরাজ্যকালে তার ভাইরা যুদ্ধ-বিজয়ের মাধ্যমে কুরুরাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ঘটালেন, এতে যুধিষ্ঠিরের ধর্মবুদ্ধির সঙ্গে রাজনৈতিক বুদ্ধিও জড়িত ছিল। ধর্মবুদ্ধি এই জন্য যে, যুদ্ধযাত্রার মতো বিষয়ে, যেখানে প্রতি মুহূর্তে প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে যায়, সেখানে তিনি দুর্যোধন-দুঃশাসনের মতো ব্যক্তিকে নিয়োগ করেননি। তিনি যুদ্ধে পাঠিয়েছেন নিজের ভাইদের এবং হয়তো তারা যুদ্ধ যাত্রার অনুমতিও চেয়েছিলেন তারই কাছে।

আর রাজনৈতিক বুদ্ধি এইজন্য যে, তারই যৌবরাজ্যকালে যুদ্ধযাত্রা করে পাণ্ডব-ভাইরা হস্তিনাপুরে নিজেদের গৌরব বাড়িয়ে নিলেন। তারা দেখিয়ে দিলেন যে, প্রয়াত মহারাজ পাণ্ডুর উত্তরাধিকারী হিসেবে তারা যথেষ্টই উপযুক্ত এবং প্রয়োজনের সময় শত্রুর আক্রমণ রোধ করার মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াও অপ্রয়োজনেও তারা নিজেদের প্রয়োগ করতে পারেন। হস্তিনাপুরের সমৃদ্ধির জন্য তারা যুদ্ধে নিজেদের জীবনকেও তুচ্ছ করতে পারেন। এই আত্মত্যাগবৃত্তির সঙ্গে পাণ্ডব-ভাইদের শক্তি এবং ক্ষমতার একটা পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় পাণ্ডবদের বিশেষত মহামতি যুধিষ্ঠিরের রাজনৈতিক লাভ হল অনেকটাই। পৌর জনপদবাসীদের মধ্যে পাণ্ডবভাইদের শক্তি একেবারে বিখ্যাত হয়ে পড়ল–ততো বল অতিখ্যাত।

এই খ্যাতিলাভে পাণ্ডবদের রাজনৈতিক লাভ ঘটে গেল বলেই কিন্তু অন্যদিকে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের মন হঠাৎই বিষিয়ে গেল পাণ্ডবদের ওপর–দূষিতঃ সহসা ভাবো ধৃতরাষ্ট্রস্য পাণ্ডুযু। তার ভাবটা এই–যুধিষ্ঠির যৌবরাজ্য লাভ করেছেন এই যথেষ্ট, কিন্তু এত যুদ্ধ জয় করে নিজেদের খ্যাপন করার কী দরকার ছিল! পাণ্ডবদের এই রাজনৈতিক লাভে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র এতই দুর্ভাবনা করতে লাগলেন যে, রাত্রে আর তার ঘুম আসে না। নিজের ছেলেরা দুর্যোধন–দুঃশাসন কেন যুদ্ধজয় করে আসেননি, সে কথাও তিনি বলতে পারেন না। কেন না এঁরা যুদ্ধে গেলে ধৃতরাষ্ট্রের আশঙ্কা কিছু থেকেই যেত। কিন্তু পাণ্ডবরা যুদ্ধে জয় লাভ করে কেন এত তাড়াতাড়ি বিখ্যাত হয়ে পড়ল–সেই চিন্তা যেমন তাকে ঈর্ষান্বিত করে তুলল, তেমনি তিনি ভাবতে লাগলেন যে, পাণ্ডবদের এই শক্তি-পরাক্রম যদি উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে, তবে তার পুত্রদের সঙ্গে তাঁর নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। পুত্র এবং তাঁর নিজের স্বার্থে তার মন বিষিয়ে গেল পাণ্ডবদের ওপর। দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিল–স চিন্তাপরমো রাজা ন নিদ্ৰামলভন্নিশি।

অনেক ভেবে চিন্তে ধৃতরাষ্ট্র তার মন্ত্রিসভার এক কুটিলবুদ্ধি মন্ত্রীকে খবর দিলেন। এই মন্ত্রীর নাম কণিক। মহাভারতের কবি কণিকের প্রথম বিশেষণ দিয়েছেন মন্ত্রজ্ঞ অর্থাৎ যে বিষয়ে তার মত চাইছেন ধৃতরাষ্ট্র, সেই রাজনীতির মন্ত্রণায় তার জুড়ি নেই। কণিকের দ্বিতীয় বিশেষণ–রাজশাস্ত্ৰার্থবিত্তমম্। এখানে রাজশাস্ত্র শব্দের অর্থ নীলকণ্ঠ করেছেন দণ্ডনীতিশাস্ত্র আর সিদ্ধান্তবাগীশ করেছেন নীতিশাস্ত্র। নীলকণ্ঠ যথাসম্ভব ঠিক অর্থ বলেছেন এবং সেইজন্যই সিদ্ধান্তবাগীশকে অন্য শব্দ ব্যবহার করতে হবে–এই তাড়নায় সিদ্ধান্তবাগীশ অত্যন্ত কমজোরি শব্দ ব্যবহার করেছেন।

বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সায়েন্স অফ গভর্নমেন্ট বলতে যে সব শব্দ প্রাচীনকালে ব্যবহৃত হত, তার মধ্যে অন্যতম শব্দগুলি হল রাজধর্ম, দণ্ডনীতি এবং রাজশাস্ত্র। কণিকের প্রসঙ্গে রাজশাস্ত্র কথাটা মহাভারতের কবিই প্রথম ব্যবহার করেছেন বটে, তবে পরবর্তীকালে নীতিপ্রকাশিকা নামে যে গ্রন্থটি ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়নের নামে চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান অর্থে রাজশাস্ত্র শব্দটিই প্রযুক্ত হয়েছে। আর আছেন অশ্বঘোষ। তিনি কালিদাসের পূর্ববর্তী নাট্যকার এবং নিজকৃত বুদ্ধচরিত কাব্যে শুক্র-বৃহস্পতির লেখা রাজনীতি-বিজ্ঞানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে অশ্বঘোষও রাজশাস্ত্র কথাটিই প্রয়োগ করেছেন।

তার মানে, রাষ্ট্রের পালন-পোষণ-সমৃদ্ধি এবং রাজ্যবিস্তারের নীতি-যুক্তির ক্ষেত্রে কণিক একেবারে ওস্তাদ মানুষ। কণিক রাজশাস্ত্র জানেন তথা অর্থশাস্ত্রও জানেন। নতুন ভূখণ্ড লাভ এবং তার পালনের উপায়ই অর্থশাস্ত্র। কণিক সেটাও ভাল জানেন, সেইজন্য রাজশাস্ত্ৰার্থবিত্তমঃ। কণিক মানুষটিকে শুধুমাত্র ধৃতরাষ্ট্রের অন্যতম মন্ত্রী বলে পরিচয় দিলে ভুল বলা হবে, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রনীতির তাত্ত্বিকতা নিয়ে যদি কোনও বিচার করা যায়, তাহলে বলতে হবে–কণিক হলেন ভরদ্বাজ গোষ্ঠীর তাত্ত্বিক।

পুরাকালে যাঁরা রাষ্ট্রনীতি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে বৃহস্পতি হলেন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। বৃহস্পতির জ্যেষ্ঠ পুত্র ভরদ্বাজ। তিনি বৃহস্পতি-নীতি যেমন শিখেছিলেন তেমনই রাজনীতির বিষয়ে তার নিজস্ব ভাবনাও যথেষ্ট মূল্যবান ছিল, তার বলা রাজনীতি–বিজ্ঞান ভরদ্বাজ নীতি বলে প্রচারিত অর্থাৎ ভরদ্বাজ নীতি বাস্পত্য-নীতির একটি শাখা হলেও তার মধ্যে ভরদ্বাজের নিজস্ব অবদানও আছে। কণিক ভরদ্বাজ-নীতিই অনুসরণ করতেন, যদিও রাজনীতির ভাবনায় তারও নিজস্ব অবদান আছে। তবে ভরদ্বাজ–নীতির বহুলাংশ তার শাস্ত্রে পুনঃকথিত হওয়ায় কণিককে অনেকেই কণিক ভরদ্বাজ বলে ডাকেন অর্থাৎ কণিক ভরদ্বাজ স্কুলের তাত্ত্বিক।

কণিক জাতিতে ব্রাহ্মণ এবং ধৃতরাষ্ট্রের পরামর্শদাতা মন্ত্রী। ধৃতরাষ্ট্র তাকে নিজের বাড়িতে ডেকে এনে পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে সরলভাবে তার কাছে নিজের অন্তর উদঘাটিত করলেন। বললেন–বামুন–ঠাকুর বড় কষ্টে আছি আমি। আমারই ভ্রাতুস্পুত্র পাণ্ডবদের শক্তি-বুদ্ধির কথা সকলেই এক সুরে গেয়ে বেড়াচ্ছে। তারা এখন বিখ্যাত মানুষ। এদের এই বাড়বৃদ্ধি দেখে আমার কিন্তু মনে বড় অসূয়া জন্মাচ্ছে–উৎসক্তাঃ পাণ্ডবা নিত্যং তেভ্যো সূয়ে দ্বিজোত্তম।

অসূয়া কথাটা আমরা খুব ব্যবহার করি বটে, তবে অসূয়া শব্দের একটা গভীর অর্থ আছে। অসূয়া মানে হল হাজার গুণ থাকলেও তার মধ্যে দোষ আবিষ্কার করা–গুণবত্ত্বেপি দোষাবিষ্করণম্। এর খুব সোজা উদাহরণ দেখবেন ক্লাস-রুমে। একটি ছেলে দারুণ ফল করছে, পরীক্ষায় প্রথম হচ্ছে অথচ অন্য অল্পবুদ্ধি ছাত্র (কখনও বা তার মা-বাবাও) সেই প্রথম হওয়া ছাত্রের সম্বন্ধে বলছে–আরে! মুখস্থ করে মারছে, মাথায় কিছুই নেই। একে বলে সগুণে দোষ আবিষ্কার করা। আচ্ছা তোকে বা তোর ছেলেকে কি আমরা মুখস্থ করতে বারণ করেছি? তুই মুখস্থ করেই প্রথম হ না। কিন্তু বেশ জানি–অক্ষম অকর্মণ্যের দাম্ভিক ঈর্ষাই হল অসূয়া।

ধৃতরাষ্ট্র তার নিজের ছেলেদের ঠিকপথে চালিত না করে পাণ্ডবদের শক্তিমত্তা–বুদ্ধিমত্তার মধ্যে দোষ আবিষ্কার করছেন। ধৃতরাষ্ট্র কণিককে বললেন–যেভাবে এদের বাড়বৃদ্ধি ঘটছে, তাতে এদের সঙ্গে ভাব রেখে চলব নাকি এদের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদে যাব সে বিষয়ে রীতিমতো চিন্তার কারণ ঘটেছে আমার। তোমাকে তাই জিজ্ঞাসা করছি–কী করা যায় বলো তো। তুমি যা বলবে তাই করব–করিষ্যে বচনং তব।

কণিক বললেন–মহারাজ! আপনি পরামর্শ চাইছেন, সে পরামর্শ আমি নিশ্চয় দেব। রাজনীতির সমস্ত রহস্যই আপনাকে জানাব। কিন্তু মহারাজ রাজনীতিশাস্ত্রের উপদেশ মোটেই মধুর নয়। বরঞ্চ তীক্ষ্ণ। অতএব সেই তীক্ষ্মতার কথা শুনে আপনি যেন আমার ওপর আবার অসূয়া করবেন না। যদি বলেন–স্বভাব-কোমল ব্রাহ্মণ হয়েও এমন তীক্ষ্ণ উপদেশ শোনালে দোষ তো তাকে দেবই, তাহলে জানাই–আমি আপনাকে যা বলব তা আমার ব্যক্তিগত কোনও মত নয়। রাজনীতি শাস্ত্রের যা নির্দেশ, তাই আপনাকে জানাব এবং সে নির্দেশ দাঁড়িয়ে আছে। রাজনীতির দর্শনের ওপর। সে দর্শনাটাই তীক্ষ্ণ–উবাচ বচনং তীক্ষং রাজশাস্ত্রার্থদর্শনম। অতএব আপনি যেন আমার গুণে আবার দোষ আবিষ্কার না করেন–ন মেভ্যসূয়া কর্তব্য।

 কণিক ধৃতরাষ্ট্রকে যা বলেছেন, তা মহামতি মেকিয়াভেলির উপদেশের থেকে কম কিছু নয়। কণিক অনেক উপদেশ দিয়েছেন। তার মধ্যে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তার সঙ্গে যেগুলো মেলে, সেগুলোই শুধু উল্লেখ করলে এইরকম দাঁড়ায়। কণিক বললেন–দেখুন মহারাজ! আপনি যাকে শত্রু বলে মনে করছেন, বিশেষত যদি সে আপনার কোনও অপকার করে থাকে, তবে তাকে মেরে ফেলাটাই সবচেয়ে ভাল–বধমেব প্রশংসন্তি শত্ৰুণাম অপকারিনা। শত্রু যদি পরাক্রমশালী হয় তবে ফঁক খুঁজতে হবে–কখন তার বিপদ আসে এবং সেই বিপদের সময়ে আক্রমণ করে তাকে মেরে ফেলতে হবে। তখন যেন ভাই-বন্ধু এসব বিচার করতে যাবেন না। আবার শত্রু যদি রাজ্যের মধ্যেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে, সে যদি আবার তার মধ্যে যুদ্ধনিপুণ হয় তবে, তাকে নিজের রাজ্যের মধ্যে না রেখে নির্বাসন দেওয়াটাই উচিত। কারণ সে যে কোনও সময় বিপদ ঘটাবে।

কণিক উপমা দিয়ে বললেন–সামান্য একটু আগুন থেকেই একটা গোটা বন পুড়ে যায়, মহারাজ। কাঠ-ফাটের মতো দাহ্য বস্তুর সামান্য একটু আশ্রয় পেলেই এতটুকু আগুন এত বড় বন পুড়িয়ে দেবে। আরও একটা কথা বলি–শত্রুকে কাতর দেখে তার ওপর আবার মায়া-মমতা করতে যাবেন না। ওসব সময় একেবারে অন্ধ হয়ে থাকবেন, যেন কিছুই দেখতে পাননি। বিপদে পড়লে শত্রু অনেক কান্নাকাটি করবে, তখন এমন ভাব করবেন, যেন কিছুই শুনতে পাননি–অন্ধঃ স্যাৎ অন্ধবেলায়াং বাধিমপি চায়েৎ। ওসব শরণাগত–টরণাগত বুঝি না, সোজা মেরে ফেলুন।

রাজার সব সময়েই শত্রুবধের শক্তি-সামর্থ্য থাকে না, তার নিজের এমন অবস্থা থাকতেই পারে যাতে প্রবলের সঙ্গে তিনি পেরে উঠছেন না। সে অবস্থায় কণিকের উপদেশ হল–প্রবল শত্রু যদি আপনাকে আক্রমণ করে, তবে কোনও ভাবনা না করে ঘাস-পাতার মতো শুয়ে পড়বেন মহারাজ। কিন্তু আপনি সদা সতর্ক থাকবেন হরিণের মতো কানটি খাড়া করে। শত্রুকে মিষ্টি কথায় ভোলাবেন, দরকার হলে এটা-ওটা ভালরকম পেন্নামি দেবেন। তারপর যখন দেখবেন, সে ঠান্ডা হয়েছে, তখন ঝোঁপ বুঝে কোপ মারবেন। সব সময় মনে রাখবেন–মৃত শত্রুর কাছে আপনার কোনও ভয় নেই। যে ভাবেই হোক, শত্রু মরলেই আপনি নিশ্চিন্ত-নিরুদ্বিগ্নো হি ভবতি ন হতাজ্জায়তে ভয়। শরণাগত হয়েছে বলে তাকে দয়া করতে হবে–এসব বড় বড় কথা আমার রাজনীতিতে নেই মহারাজ–দয়া ন তস্মিন্ কর্তব্যা শরণাগত ইত্যুত।

কণিক বোধহয় পাণ্ডবদের দিকে ইঙ্গিত করেই কথাটা বললেন। বস্তুত রাজ্যলাভের ক্ষেত্রে ভাই কিংবা ভাইয়ের ছেলেরা হলেন সহজ শত্রু, কারণ তাদেরও রাজ্য পাওয়ার ইক থাকে। বিশেষত পিতার মৃত্যুর পর পাণ্ডবরা এখন ধৃতরাষ্ট্রের শরণাগত। কিন্তু কণিকের মতে তাদেরও শত্রুর মতোই মনে করা উচিত। কণিক বললেন–দেখুন মহারাজ! রাজনীতিতে দয়া-মায়ার কোনও স্থান নেই। আমি শত্রুর মুলোচ্ছেদে বিশ্বাসী। প্রথমে শত্রুর মূল, তারপর তার সহায়, তারপর শত্রুপক্ষের সবাইকে এমনকি শত্রুর ওপরে যারা ভরসা করে আছে, তাদেরও মেরে ফেলা দরকার। মুখে এমন একটা ভাব বজায় রাখুন যাতে কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে না পারে। বাইরে আপনি ঋষি-মুনির ভাব দেখিয়ে যজ্ঞ করুন, গেরুয়া কাপড় পরুন, এমনকি জটাও পাকাতে পারেন চুলে, দরকারে মৃগচর্মও পরিধান করুন, মহারাজ! এগুলোতে বেশ সুবিধে হয়। লোকে ধার্মিক বলে আপনাকে বিশ্বাস করুক এবং সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আপনি সময়মতো বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ুন শত্রুর ওপর–লোকান্ বিশ্বাসয়িত্বৈ ব ততো লুম্পেদ যথা বৃকঃ।

কণিকের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধ-চক্ষু ছানাবড়া হয়ে উঠছে। তিনি কথা বলার ফাঁক খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। কণিকও সেটা বুঝলেন, কিন্তু তাই বলে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে কথা বলার সুযোগ দিলেন না মোটেই। বরঞ্চ তার অন্তরের গভীর কথাটি কেড়ে নিয়ে বললেন–মহারাজ! একজন রাজা তো আর বসে বসে আঙুল চোষার জন্য রাজা হয় না, সে ফল চায়, রাজ্যের সমৃদ্ধি চায়, নিজে রাজা হিসেবে গদিতে থাকতে চায়, সমস্ত মানুষই তাই চায়, মহারাজ! আর তার জন্যই যত চেষ্টাফলার্থোয়ং সমারম্ভঃ লোকে পুংসাং বিপশ্চিতম্। সাধারণের অবস্থাই দেখুন না। গাছ থেকে ফল খাবে; তো লোকে গাছের ডাল টেনে টেনে নুইয়ে নিজের সামনে আনবে, তারপর পাকা ফলটি তুলে নেবে টুক করে–আনম ফলিনীং শাখাং পং পং প্রশাতয়েৎ। গাছের শাখাটি যদি ভাবে–আমাকে আদর করার জন্য কাছে নিয়ে যাচ্ছে, তো ভুল ভাবছে। সেইরকম জটা-চীর ধারণ করে আদরের ভাব করুন, মহারাজ কিন্তু ফলটি তুলে নিতে হবে। আপনার সময় যতক্ষণ পরিপক্ক না হচ্ছে, ততক্ষণ আপনি মাটির কলসীর মতো শত্রুকে কাঁধে করে বেয়ে নিয়ে বেড়ান, মহারাজ–বহেদমিত্রং স্কন্ধেন যাবৎ কালস্য পর্যয়ঃ। কিন্তু সময় যখন আসবে, তখন পাথরের ওপর কলসী যেমন আছাড় মেরে ভাঙে, তেমন করেই শত্রুকে আছাড় মারবেন–ততঃ প্রত্যাগতে কালে ভিন্দ্যা ঘটমিবাশ্মনি। সময় এসে গেলে আর কোনও মায়া-দয়া নেই। তখন সে ডাক ছেড়ে কাঁদুক, হাত জোড় করুক আর–শরণাগতই হোক, তাকে সোজা মেরে ফেলুন–অমিত্রো ন বিমোক্তব্যঃ কৃপণং বহুপি ব্রুবন্। এইভাবে কখনও ভাল কথা বলে, কখনও কিছু দিয়ে, কখনও বন্ধুজনের সঙ্গে তার ভেদ সৃষ্টি করে এবং সর্বশেষ উপায়ে তাকে মেরে ফেলে নিজের কাজটি গুছোতে হবে, মহারাজ!

.

১১১.

 শত্রু-শাতনের নির্দিষ্ট উপায়গুলি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কণিক ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন– সাম, দান, ভেদ এবং দণ্ড–এই চারটে উপায়ের প্রয়োগ করে শত্রুকে একেবারে উচ্ছেদ করে ছাড়তে হবে–সার্বোপায়ৈঃ প্রশাতয়েৎ। প্রাচীন রাজনীতিশাস্ত্রে সাম, দান, ভেদ, দণ্ড–এই চারটি উপায় যথেষ্ট বিখ্যাত শব্দ। সাম মানে মধুর-সান্ত্বনা বাক্যে শত্রুর মন জয় করা। সামে কাজ না হলে দান অর্থাৎ খানিকটা ছেড়ে দেওয়া। সে যেমন নিজকৃত পূর্বশর্ত ছেড়ে দেওয়াও হতে পারে, ধন-সম্পত্তি দানও হতে পারে আবার খানিকটা ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়াও হতে পারে। এই নীতির বশবর্তী হয়েই ভারত এক সময় পাকিস্তানকে বেরুবাড়ি অঞ্চল ছেড়ে দিয়েছিল, আবার সেদিন তিন বিঘা অঞ্চল মুক্ত করে দিল বাংলাদেশের কাছে। দান-নীতিতে কাজ না হলে ভেদ সৃষ্টি করতে হয়। গুপ্তচর বা বিশ্বস্ত পুরুষের সাহায্যে রাজার সঙ্গে মন্ত্রীর, মন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রীর, রাজার সঙ্গে প্রজার, প্রজার সঙ্গে মন্ত্রীর–এইভাবে নানা কথায় শত্রুরাজ্যের একের সঙ্গে অপরের মতভেদ তৈরি করে রাজ্যের মধ্যে বিশৃঙ্খলা বাধিয়ে দিতে হবে। সাম, দান, ভেদ-এই তিন উপায়ই বিফল হয়ে গেলে তখন দণ্ডের ব্যবস্থা অর্থাৎ আক্রমণ। সেজন্য অবশ্য নিজেকে আগে থেকেই তৈরি করতে হবে। সাম, দান, ভেদের প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ের মধ্যেই শত্রুরাজ্য আক্রমণ করার মতো শক্তি সঞ্চয় করে নিতে হবে।

ধৃতরাষ্ট্র যে এই চারটি মোক্ষম উপায়ের কথা জানেন না, তা মোটেই নয়। তিনি এতদিন সিংহাসনে বসে রাজ্য চালাচ্ছেন, বিশেষত অন্ধত্বের দরুন তার বাস্তববোধ কিছু কম হলেও তাত্ত্বিকতার ক্ষেত্রে তিনি কিছু কম পোক্ত নন। কিন্তু তিনি যা জানেন, অথবা রাজনীতি শাস্ত্রেও যা বলে, তা হল–সাম-দান ইত্যাদির ক্রমিক প্রয়োগ। অর্থাৎ প্রথমটায় কাজ না হলে দ্বিতীয়টা অথবা দ্বিতীয় উপায় সফল না হলে তৃতীয়টার প্রয়োগ। কিন্তু একই সঙ্গে চারটি উপায়ের প্রয়োগ–এ তত বড় সাংঘাতিক কথা। ধৃতরাষ্ট্র তাই লজ্জা না করে বলেই ফেললেন–বামুন ঠাকুর! সাম, দান, ভেদ, দণ্ডের মাধ্যমে কীভাবে শত্রু দমন করতে পারি, সেটা একটু পরিষ্কার করে বলো তো বাপু–তন্মে ব্ৰহি যথাতথ।

কণিক বললেন–দেখুন মহারাজ! এ জিনিস বোঝাতে গেলে আপনাকে একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হবে। আপনি বরং আমার কাছে একটা গল্প শুনুন। গল্পের মধ্যে কল্পনা আছে অবশ্যই, কিন্তু সেই কল্পনা শুধু গল্প বলার জন্যই। নইলে আসল রাজনীতির বিবরণ বাযথার্থতা এইরকমই। শুনুন তাহলে–এক বনে একটি শেয়াল থাকত। শেয়ালটি নীতিশাস্ত্র এবং অর্থশাস্ত্র দুইই খুব ভাল জানত। এ গল্প তার সম্বন্ধে জম্বুকস্য মহারাজ নীতিশাস্ত্রার্থদর্শিন৷ এই শৃগাল অবশ্যই রাজনৈতিক নেতার প্রতীক। অর্থদশী মানেই নিজের লাভ, নিজের সমৃদ্ধি তথা প্রতিপত্তি বিস্তারের উপায় যার জানা আছে। স্বার্থলাভের উপায়জ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শৃগালের বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা–কৃতপ্রজ্ঞঃ শৃগালঃ স্বার্থপণ্ডিতঃ। এই সব মিলেই একজন সার্থক রাজনীতিবিদের জীবন–চর‍্যা চলে।

কণিক বলে চললেন–এই বনবাসী শেয়ালের চারজন বন্ধু। এক বন্ধু বাঘ, দ্বিতীয় বন্ধু একটি ইঁদুর, তৃতীয় জন একটি নেকড়ে আর চতুর্থ বন্ধু হল একটি বেজি। চারজনকে নিয়ে শেয়াল ভালই আছে, ঠিক যেমন একজন ধূর্ত রাজা তার চারপাশে প্রবল, দুর্বল এবং নিজের সমান শক্তিসম্পন্ন রাজাদের সঙ্গে নিয়েই চলেন।

একদিন হল কী, সেই বনের মধ্যে একটি বিশাল এবং বলিষ্ঠ হরিণ দেখা গেল। নধরকান্তি হরিণটিকে দেখে সকলেরই মাংস খাবার লোভ হল বটে, কিন্তু শেয়াল অন্তত মুখে কিছু বলল না। বাঘ যেহেতু এই পাঁচ জনের মধ্যে অসীম শক্তিধর, অতএব সে কারও তোয়াক্কা না করেই দু–একবার হরিণটিকে ধরার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে ব্যর্থ হয়েছে। বাঘই যেখানে পারেননি সেখানে অন্যেরা তো কোন ছাড়।

হরিণটিকে মাঝে-মাঝেই দেখা যাচ্ছে, তাকে দেখে খাবার লোভও হচ্ছে, অথচ তাকে ধরা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় পাঁচজনের মন্ত্রণাসভা বসল আর মন্ত্রণাসভায়–কে না জানে, সবার আগে শেয়ালই কথা বলবে। কারণ তার বুদ্ধি বেশি। শেয়াল বলল–দেখ ভাই বাঘ! তুমি এই হরিণটাকে মারবার জন্য বার বার চেষ্টা করেছ–অসকৃ যতিততা হেষ হন্তুং ব্যাঘ্র বনে ত্বয়া। কিন্তু হরিণটা যেমন জোয়ান, যেমন বেগবান, তেমনই তার বুদ্ধি। তুমি তাই পারনি ধরতে। কিন্তু হরিণটা আমাদের চাইই চাই। তোমরা আমার বুদ্ধি শোনো। হরিণটা যখন ঘুমিয়ে থাকবে, তখন আমাদের এই ইঁদুর-বন্ধু নিঃশব্দে গিয়ে ওর চারখানা পায়ের গোড়ালির মাংস টুকিয়ে টুকিয়ে খেয়ে নেবে। পরের দিন দেখবে–ওর আর দৌড়বার অত ক্ষমতা থাকবে না। এর পর যে শক্তি এবং বেগে হরিণ দৌড়বে, তাতে আমাদের বাঘ-মশায়ের কোনও অসুবিধেই হবে না হরিণটাকে ধরতে। একবার ধরা পড়লে আমরা তখন সকলে মিলে প্রেমানন্দে হরিণটাকে খাব–ততৌ বৈ ভক্ষয়িষ্যামঃ সর্বে মুদিতমানসাঃ।

শেয়ালের বুদ্ধি সকলের বেশ পছন্দ হল। নির্দিষ্ট কর্তব্য অনুসারে ইঁদুর সময় বুঝে ঘুমন্ত হরিণের পায়ে এমন মৃদু-তীক্ষ্ণ কামড় লাগাল যে হরিণ বুঝতেও পারল না যে, তার চারখানি পা-ই ভীষণ রকমের কমজোরি হয়ে গেল। বাঘের কোনও অসুবিধেই হল না পরের দিন। সে সাবহেলে দু-চার লাফেই ধরে ফেলল হরিণটিকে–মূষিকাভক্ষিতৈঃ পাদৈগং ব্যাঘ্রোবধীত্তদা। হরিণটির বিশাল করুণ দেহখানি নিথর হয়ে যেতেই–অচেষ্টমানস্তু ভূমৌ মৃগকলেবর শেয়াল এবার চার বন্ধুকে বলল–এই হরিণটাকে আমি দেখে রাখছি। তোমার কোনও চিন্তা নেই। তোমরা নদীতে গিয়ে ভাল করে স্নান-টান করে এসো। তারপর শান্তিতে মাংস ভোজন করা যাবে–স্নাত্বাগচ্ছত ভদ্রং বো রক্ষামীত্যাহ জম্বুকঃ।

মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে বলেননি বটে, তবে বেশ বোঝা যায়–এ পর্যন্ত গল্প যতটুকু এগিয়েছে, তা হল সাম এবং দানের পরিসর। অর্থাৎ শেয়াল প্রথম দিকে যে মন্ত্রণা দিয়েছে, যেভাবে দুর্বলতর শক্তি ইঁদুরকে সে কাজে লাগিয়ে সকলের বিশ্বাস উৎপাদন করেছে, তার মধ্যে শেয়ালের মধুর ব্যবহার, সকলের জন্য ভাবনা দেখানো তো আছেই, উপরন্তু বন্ধুদের স্নান করে ফিরে না আসা পর্যন্ত মৃত পশুটিকে আগলে রাখার ভার নিয়ে সে তার বদান্যতা এবং দানের প্রবৃত্তিও ফুটিয়ে তুলেছে। সোজা কথায় এখানে সাম-দানের প্রয়োগ ঘটল প্রায় একই সঙ্গে, অবশ্য এটা কোনও রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয় নয়, বিষয়টি একটি মৃত পশুর আহার-সংক্রান্ত, কাজেই সাম এবং দানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান তত নেই। কিন্তু বিষয়টা রাষ্ট্রিক না হলেও রাজনৈতিক বটে। কাজেই রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান কিছু বাড়লেও বাড়তে পারে বটে, কিন্তু তাই বলে যুগপৎ সাম-দানের প্রয়োগ হতে পারবে না তা মোটেই নয়। বরঞ্চ প্রাচীন রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা সাম-দানের প্রক্রিয়াটি খুব তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নিতে বলেন, কারণ তাতে পরবর্তী উপায় দুটি নিঃসঙ্কোচে ব্যবহার করা যেতে পারে।

কণিকের বলা উপাখ্যান অনুযায়ী বাঘ খুব তাড়াতাড়িই নদীতে স্নান করে এল। পাঁচজনের মধ্যে সেই সবচেয়ে বলশালী, অতএব মাংসের ভাগটাও তার সবচেয়ে বেশি চাই বলেই হয়তো সে সবার আগে স্নান করে ফিরল–অথাজগাম পূর্বত্ত স্নাত্বা ব্যাঘ্রো মহাবলঃ। কিন্তু এইবার শুরু হল প্রাজ্ঞ শৃগালের আসল খেলা। সম্পূর্ণ হরিণটাকেই সে একা আত্মসাৎ করতে চায়। অতএব পাঁচজনে স্নান করতে যেতেই যে সময়টুকু সে পেল, তার মধ্যেই শেয়াল তার ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলল। সে ভয়ঙ্কর রকমের চিন্তার ভাণ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। বাঘ স্নান করে এসে শেয়ালের এই চিন্তাকুল অবসন্ন ভাব দেখে–চিন্তাকুলিতমানসম্ নিজেও চিন্তাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করল–কী এত ভাবছ, পণ্ডিত! আমাদের মধ্যে তুমিই হলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। সমস্যা হলে তোমার কাছে সমাধান নেই এমন তো হতেই পারে না–কাজেই চিন্তা কিসের? কিং শোচসি মহাপ্রাজ্ঞ ত্বং নো বুদ্ধিমতাং বরঃ। আজকে আমরা সবাই মিলে মহানন্দে মাংস খাব।

শেয়াল বলল–সে তো বেশ ভালই হত, ভাই! কিন্তু আমাদের ওই ইঁদুর–ভায়া এমন একটা কথা বলে গেল, যা তোমাকে বলতেও আমার সংকোচ হচ্ছে, অথচ না বলেও পারছি না। আমার এত চিন্তা তো সেই জন্যই। বাঘ বলল–আহা বলই না কী বলেছে। শেয়াল বলল–ওইটুকু পুঁচকে ইঁদুর! সে কি না এত বড় একটা কথা বলে গেল! শুনবে সে কথা? ইঁদুরটা এই একটু আগে এসে আমায় বলে গেল–ধিক্ তোমাদের বাঘ-মশাইকে, আর ধিক তার শক্তিকে? লজ্জা বলে যদি কোনও জিনিস থাকে ওই বাঘের? ওই হরিণটাকে মারল কে? আমি। আমি মেরেছি–ধিশ্বলং মৃগরাজস্য ময়াদ্যায়ং মৃগো হতঃ। ও তো কতবার চেষ্টা করেছে। পেরেছে? আমার শক্তির ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে যে, সে আজ গর্জন করে বলছে–মাংস খাবে। ছি ছি লজ্জাও করে না? তুমি তাকে বলে দিও, পণ্ডিত–অমন মাংস আমি ছুঁয়েও দেখি না। আমি হরিণ মেরে দিয়েছি, এখন ও মাংস তোমার বাঘই খাক, অত গর্জন করার দরকার নেই–গর্জমানস্য তস্যৈবমতো ভক্ষ্যং ন রোচতে।

শেয়াল তার প্রথম ভেদনীতি প্রয়োগ করল এবং সফল হল। সত্যিই তো হরিণ মারার ব্যাপারে ইঁদুরের অবদান আছে। আর বাঘের মতো প্রবল শক্তিশালীর পক্ষে ইঁদুরের এই সাহায্য গ্রহণ লজ্জারই বটে। বাঘ স্বীকারও করল সে কথা। তার নিজের শক্তির ব্যাপারে সে সর্বদাই সচেতন, একজন অতি প্রবল রাজার মতোই আত্মসচেতন। অথচ হরিণ মারার ব্যাপারে ক্ষুদ্র-ইঁদুরের সাহায্য সে নিয়েওছে। বাঘ অতএব একটু সলজ্জেই শেয়ালকে বলল–ইঁদুর যখন এ কথা বলেই গেছে, তখন তুমি আমাকে সে কথা সময়মতো জানিয়ে খুবই ভাল করেছ–কালে হ্যস্মিন্ প্রবোধিতঃ। তুমি আমাকে আমার আত্মসম্মান বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেছ। তোমার ইঁদুরকে বোলো–আর তার সাহায্যের দরকার হবে না। আমি আমার নিজের ক্ষমতাতেই বনের পশু মারতে পারব যথেষ্ট–স্ববাহুবলমাশ্ৰিত্য হনিষ্যেহং বনেচরা–এবং আমারও খাবার জুটবে, আমার মাংসের অভাব হবে না–খাদিষ্যে তত্র মাংসানি।

রাগের চেয়ে বাঘের অভিমান হল অনেক বেশি। ইঁদুরের কথায় তার মানে লেগেছে। সে আর বাক্য-ব্যয় না করে নিজের পুরুষকার প্রমাণ করার জন্য বনে চলে গেল–ইত্যুত্ত্বা প্রস্থিতো বনম। এই স্নান করে পরিপাটি হয়ে শেয়ালের সামনে উপস্থিত হল ছোট্ট ইঁদুর। ইঁদুরকে শেয়াল এমনিই মেরে ফেলতে পারত, কিন্তু তাতে বন্ধুদের মধ্যে নানা কথা উঠবে। ইঁদুরের উপকারের প্রসঙ্গও আসবে। রাজনীতিকরা দুর্বল শত্রুকেও রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করে–সেটা দেখানোর জন্য ইঁদুরের ওপরেও ভেদনীতি প্রয়োগ করল শেয়াল।

শেয়াল বলল–দেখ ভাই ইঁদুর! তুমি এসে গেছ ভালই হয়েছে। দেখ ভাই! একদিন মাংস খাওয়াটা খুব বড় কথা নয়। আমি চাই তোমার সর্বাঙ্গীণ সর্বকালীন মঙ্গল হোক এবং সেইজন্যই একটা কথা তোমায় না বলে পারছি না–শৃণু মূষিক ভদ্রং তে নকুলো যদিহাব্রবীৎ। ওই যে বেজি! হরিণ মারার ব্যাপারে সে কী করেছে? এতটুকু সাহায্যও তো করেনি। এদিকে সে কী বলছে জান? বলছে–ওই হরিণের মাংস আমি খাব না। ওতে বাঘের মুখ লেগেছে, ও মাংস বিষ হয়ে গেছে আমার কাছে–মৃগমাংসং ন ভক্ষেয়ং গরমেতন্ন রোচতে। আমি বরং নতুন অনুচ্ছিষ্ট মাংস খাব। আমি ওই ইঁদুরটাকে খেতে চাই, আপনি অনুমতি করুন–তদ ভবান্ অনুমন্যতা।

 শেয়াল বলল–আমি অনুমতি দিইনি। কিন্তু সে আমার কথা শুনবে বলে মনে হয় না। ইঁদুর শেয়ালের কথা শুনে ভয়ে লাফ দিয়ে গর্তে ঢুকে পড়ল। এর পরে উপস্থিত হল সেই নেকড়ে বাঘ। আমরা একে নেকড়ে বাঘ বলেছি বটে, তবে এ ঠিক নেকড়ে কি না সন্দেহ আছে। সংস্কৃতে আছে বৃক! সিদ্ধান্তবাগীশ অর্থ করেছেন কেন্দুয়া বাঘ অর্থাৎ বাংলায় যাকে–এক ছিল মোটা কেঁদো বাঘ–ইত্যাদি বলি সেই কেঁদো বাঘ। বস্তুত কেঁদো বাঘও ঠিক বৃক নয়। বরঞ্চ সিদ্ধান্তবাগীশ সংস্কৃত টীকায় বলেছেন–কুকুরের মতো দেখতে এক রকমের বাঘ-কুকুরাকারো ব্যাঘ্রঃ। প্রাণিতত্ত্ববিদেরা বলেন–আমরা যে অ্যালসেশিয়ান ইত্যাদি কুকুর দেখতে পাই এরা এককালে বন্য প্রাণী ছিল। এদের ডোমেস্টিকেট করা হয়েছে মাত্র। আমাদের ধারণা–বৈদিক যুগ থেকে যে বৃক শব্দটি নেমে আসছে–সেই বৃক বলতে কুকুর–জাতীয় বন্য তথা হিংস্র প্রাণীকেই বোঝায়।

 সেই বৃক বা কেঁদো বাঘ আসতেই শেয়াল বলল–দেখ ভাই। সামনে তোমার ভীষণ বিপদ। কী কারণে জানি না, বাঘ তোমার ওপর ভীষণ খেপে গেছেন। এর ফল খুব ভাল হবে বলেই মনে হচ্ছে। তিনি এইমাত্র আমায় বলে গেলেন–এই কেঁদোটাকে আমি দেখে নেব। তিনি আবার সস্ত্রীক আসছেন তোমার ওপর রাগ মেটানোর জন্য। এ কথা শোনার পর তোমার যা কর্তব্য মনে হয় করো–সকলত্রস্তু-ইহায়াতি কুরুষ যদনন্তরম্। শেয়ালের কথা শুনে কেঁদো বাঘ আর এক মুহূর্তও সেখানে থাকা ঠিক মনে করল না। সেও পালাল।

এইবার স্নান-পরিপাটি সেরে উপস্থিত হল বেজি। শেয়াল জানে–বড় বড় শত্রুরা তার রাজনৈতিক বুদ্ধির কাছে পরাজিত হয়েছে। বেজি হল শেষ শত্রু এবং সে তার চেয়ে অনেক দুর্বল। অতএব আর কাল বিলম্ব নয়। এবার সে নিজেই ভয় দেখাবে। বেজিকে সে বলল–দেখ! ওই সব বাঘ, কেঁদো বাঘ–এদের সবাইকে আমি যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছি। তারা এখন আমার ত্রিসীমানার মধ্যে নেই। সব পালিয়েছে–নির্জিতাস্তেন্যতো গতাঃ। তোমার যদি ইচ্ছে হয় তো আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো এবং আমাকে জয় করে যত ইচ্ছে মাংস খাও–মম দত্ত্বা নিযুদ্ধং ত্বং ভুঙক্ষ মাংসং যথেল্পিতম্। অর্থাৎ সময় বুঝে শেয়াল এখন দণ্ড প্রয়োগ করছে।

বেজি বুঝল সে শেয়ালের সঙ্গে পারবে না। অতএব যুদ্ধ না করেই সে বলল–বাঘ হল পশুদের রাজার সমান, তাকে তুমি হারিয়েছ, তারপর কেঁদো বাঘ, এমনকি ওই মহা-বুদ্ধিমান ইঁদুরটাকেও তুমি জয় করেছ। এরপর আমি আর তোমার সঙ্গে কোন মুখে যুদ্ধ করব। তুমি সবার চাইতে বড় বীর–নির্জিতা যৎ ত্বয়া বীরা স্তস্মাদ্বীরতরো ভবান্–আমার ক্ষমতা নেই বাপু তোমার সঙ্গে লড়ব। এই কথা বলে বেজিও পালাল। রাজনৈতিক বুদ্ধিতে সাম-দান ইত্যাদি উপায়ের মাধ্যমে সামান্য শেয়াল সবাইকে ঠকিয়ে দিয়ে নিজে একা সেই মৃগমাংস ভক্ষণ করল।

শেয়াল-বাঘের গল্প বলে এবার কণিক ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন–রাজনীতি করতে হলে এই শেয়ালের মতো ব্যবহার করতে হবে, মহারাজ! ভীরু লোকটাকে সরিয়ে দেবেন ভয় দেখিয়ে আর প্রবলতর শত্রুর কাছে হাত জোড় করবেন–ভয়েন ভেদয়ে ভীরুং শূরমঞ্জলিকর্মণা। লুব্ধ-লোভী শত্রুকে ধন-সম্পত্তি কিছু ছেড়ে দেবেন। আর দুর্বলের ওপর বলপ্রকাশ করবেন। আরও একটা কথা–এই রাজনীতির ব্যাপারে ভাই-বন্ধু, বাপ-ছেলে, গুরু-গুরুবৎ কিছু নেই। এঁরা শত্রু হয়ে দাঁড়ালে এঁদের ছাড়া নেই। মারতে হবে। উন্নতি করতে হলে এই নিয়ম জানবেন–রিপুস্থানেষু বর্তন্তো হন্তব্যা ভূতিমিচ্ছতা।

এত ক্রুর নৃশংস রাজনীতির প্রয়োগ করতে গিয়ে মানুষের মধ্যে যদি ভাবের এবং আচরণের বিকার ঘটে, অতএব সে ব্যাপারেও সাবধান করে দিলেন কণিক। বললেন–দেখুন মহারাজ! অন্তরে আপনার হাজার রাগ থাকুক, বাইরে সেটা প্রকাশ করবেন না। সব সময় কথা বলবেন হেসে। একজনের ওপর রাগ থাকলেও এমনভাবে তাকে গালাগালি দেবেন না যাতে তার গৌরব নষ্ট হয়–ক্রুদ্ধোপ্যক্রুদ্ধরূপঃ স্যাৎ স্মিত পূৰ্বাভিভাষিতা। মনে রাখবেন–প্রহার করার সময়েও হাসতে হবে।

কণিক আরও অনেক উপদেশ দিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে এবং এই সমস্ত উপদেশকেই ম্যাকিয়াভেলিয়ান তো বলা যায়ই, বরং আরও বলা যায়, সেগুলি নির্মম, নৃশংস এবং কূর। ধৃতরাষ্ট্র সব শুনলেন এবং শোনার পরে সে খুব খুশি হয়ে উঠলেন, তা নয়। কণিক বলেছিলেন–পাণ্ডবরা আপনার পরম আত্মীয় হলেও তারা আপনার ছেলেদের থেকে বেশি বলবান। কাজেই ছেলেদের সঙ্গে মিলে আপনি এমন উপায় বার করুন, যাতে পাণ্ডবদের কাছ থেকে আপনার কোনও ভয় না থাকে–যথা ভয়ং ন পাণ্ডভ্যস্তথা কুরু নরাধিপ।

অন্তত শেষ কথাটা ধৃতরাষ্ট্রের মনে ধরল বটে, কিন্তু পরম প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্রেরা, যারা আপাতত কোনও দোষই করেনি, তাদেরকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলতেও তার মন চাইল না। তিনি মনে মনে কষ্ট পেতে লাগলেন–শোকার্তঃ সমপদ্যত। কিন্তু যত দুঃখই তিনি পান, ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ছেলের স্বার্থ সবার আগে। যুবরাজের আসনে বসে যুধিষ্ঠির নাম কিনছেন, অন্যান্য পাণ্ডব-ভাইরা যুদ্ধ করে বিখ্যাত হচ্ছেন, আর নিজের ছেলেরা গৌণ হয়ে আছে–এই গৌণতা ধৃতরাষ্ট্রকে পীড়িত করে। এরই মধ্যে তার কাছে ঘটনা অনেক সহজ হয়ে গেল।

শকুনি, দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ–এই চারজনের সভা বসল। তারা সমস্ত পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার বুদ্ধি করলেন। জননী কুন্তীও এই মারণ–পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলেন– দহনে তু সপুত্ৰায়া কুত্যা বুদ্ধিমকারয়।

একটা কথা এই মুহূর্তে না ভেবে পারা যাচ্ছে না। আমরা শকুনির কথা বলছি। শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের শ্যালক, গান্ধারীর ভাই। এই মানুষটিকে আমরা প্রথম যখন দেখেছিলাম, তখন ইনি যুবক ছিলেন। চোখে পট্টবস্ত্র-বাঁধা গান্ধারীকে নিয়ে তিনি হস্তিনাপুরের রাজধানীতে এসেছিলেন কন্যাকর্তা হিসেবে। গান্ধারীর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে হবার পর ভীষ্মের দেওয়া দান-মান গ্রহণ করে ফিরে গিয়েছিলেন গান্ধারে। এর মধ্যে এত যে ঘটনা ঘটে গেল, মহাভারতের কবি একবারের তরেও নাম করেননি শকুনির। কবে যে তিনি কুরুবাড়িতে ফিরে এলেন আর কেনই বা এলেন–সে কথা মহাভারতের কবি একবারও বলেননি। সেই গান্ধারে ফিরে যাবার পর এই তাকে আবার দেখলাম দুষ্ট-চতুষ্টয়ের চক্রান্তে চক্রবর্তীর মতো।

তিনি কবে হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছেন, সে কথা স্পষ্ট করে বলা না গেলেও আন্দাজ করা যায়। আমাদের মনে হয়–পাণ্ডু যখন মারা গেছেন এবং ধৃতরাষ্ট্র যখন পাকাপাকিভাবে রাজ্যের শাসনভার লাভ করেছেন, তখন শকুনিও গান্ধার ছেড়ে চলে এসেছেন হস্তিনাপুরে। গান্ধার একটি ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য, সেখানে থেকে রাজনীতি করার শখ মেটে না। বিশেষত যাঁরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী তাঁদের কাছে উত্তর-ভারত তখন স্বর্গরাজ্য। উত্তরভারতে তখন আর্যায়ণের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। গান্ধারে আর্য রাজাদের আর সেই রমরমা নেই–এ কথা আগেই আমরা জানিয়েছি। হয়তো শকুনি আপন আশা–আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য হস্তিনাপুরে তার জামাইবাবু ধৃতরাষ্ট্রের বাড়িতে চলে আসেন তখনই, যখন তিনি দেখেছেন রাজ্য তার জামাইবাবুর হাতে এসে গেছে।

হয়তো দুর্যোধন-দুঃশাসনরাও তখন ছোট ছোট। শকুনি এই অবস্থায় তাদের সঙ্গে মিশে মিশে তাদের কাছের লোক হয়ে পড়েন খুব তাড়াতাড়ি। ধৃতরাষ্ট্র নিজে অন্ধ মানুষ, অন্ধত্বের কারণে রাজকার্যের নানান অসুবিধে হয় বলেই যে তাকে প্রথম রাজা করা হয়নি, সে কথাও তিনি ভালই মনে রেখেছেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের এই রাজা হবার মুহূর্তে শকুনি এসে পড়ায় তারও বোধহয় সুবিধেই হল। কিন্তু এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, শকুনি হলেন কণিক–বর্ণিত সেই শেয়াল, যিনি হস্তিনাপুরের রাজসভায় এসেছেন রাজনীতির ক্রুর খেলা খেলতে। রাজসভায় তিনি বসেন না। তিনি দুর্যোধনের মন্ত্রণাসভার শৃগাল-রাজনীতিক।

.

১১২.

 এ হল মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কিচেন-ক্যাবিনেট। ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রণা-সভায় ভীষ্ম-বিদুরের মতো মন্ত্রীরা রাজনীতিশাস্ত্রের প্রজ্ঞা দিয়ে বিষয় বিবেচনা করেন, আর তলায় তলায় এই যে মন্ত্রণা-সভা বসেছে, এর সদস্য মাত্র চারজন–শকুনি, দুর্যোধন, কর্ণ, দুঃশাসন। সর্বহিতৈষিণী বুদ্ধি দিয়ে এঁরা বিষয় বিচার করেন না। দুর্যোধনের স্বার্থলাভ কীভাবে হয় এবং সেই সঙ্গে অন্যেরাও সেই স্বার্থের ওপর কীভাবে নিজের স্বার্থ লাভ করতে পারেন–সেই ভাবনা সুদৃঢ় হয় এই ছোট্ট সভায়। ধৃতরাষ্ট্র নিজের প্রজ্ঞায় এঁদের মত অন্তর থেকে মানতে পারেন না, কিন্তু পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে তিনি এই মন্ত্রিসভার আপাতরম্য সিদ্ধান্তগুলি মেনে নেন। সাধারণভাবে প্রজাহিত তার আকাঙ্ক্ষিত বস্তু হলেও সেই হিত পাণ্ডবদের মাধ্যমে সম্পন্ন হোক এ তিনি চান না।

ধৃতরাষ্ট্রের পিছনে সমান্তরাল যে মন্ত্রিসভাটি চলে, তার চার সদস্য–যাঁদের আমরা নিঃসন্দেহে দুষ্ট-চতুষ্টয় বা Gang of four বলতে পারি, তারা কিন্তু এমনি-এমনিই আজ মন্ত্রণায় বসেননি। এর পিছনে সামান্য একটু ইতিহাস আছে। প্রথমত, ভীমের অনন্যসাধারণ শক্তি এবং অর্জুনের অসামান্য অস্ত্রজ্ঞান হস্তিনাপুরের জনপদ-পুরবাসী সকলকে গর্বিত করে তুললেও দুর্যোধন নিজে তাতে অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছিলেন। ঈর্ষা এবং অসূয়া তার অন্তর দগ্ধ করছিল নিরন্তর–দুর্যোধনো লক্ষয়িত্ব পৰ্য্যতপ্যত দুর্মনাঃ। পাণ্ডবরা এমনকি যুবরাজ যুধিষ্ঠিরও দুর্যোধনের এই অন্তর্বেদনা একটুও বুঝতে পারেননি। তারা প্রধানত মহামতি বিদুরের উপদেশ অনুসারে রাজ্য শাসন করতেন। আর কে না জানে, রাজনীতির প্রয়োগ–বিজ্ঞানে বিদুর এতটুকুও মেকিয়াভেলিয়ান নন। গাঢ় ধর্মবোধ, নীতি-নিয়ম এবং হিতৈষণা বিদুরের রাজনীতিকে প্রজারঞ্জনের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে। যুবরাজ যুধিষ্ঠির এই প্রজ্ঞাশালিনী বিদুর-নীতির বাহকমাত্র।

প্রজাদের জন্য এত ভাবনা আর ভালবাসাই শেষ পর্যন্ত কাল হল যুধিষ্ঠিরের। রাজা ভালবাসলে প্রজাও রাজাকে তেমনি ভালবাসে। যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের গুণপনায় তারা এতই মুগ্ধ যে, তারা মাঠে–ঘাটে সর্বত্র যুধিষ্ঠিরের গুণ গাইতে লাগল–কথয়ন্তি স্ম স্যুয় চত্বরেষু সভাসুচ। তারা যুবরাজ যুধিষ্ঠিরকে রাজা হিসেবে দেখতে চাইল। এ বিষয়ে তাদের সরল যুক্তি-তর্কের কোনও অভাব হল না। তারা একেক জায়গায় মিলিত হয়ে বলতে লাগল–আরে আমাদের ধৃতরাষ্ট্র তো জন্মান্ধ বলে আগেই রাজ্য পাননি। তো এখন আর তিনি রাজা হবেন কী করে–রাজ্যং ন প্রাপ্তবান পূর্বংস কথং নৃপতি–ভবেৎ? আর ওই যে চিরকুমার ভীষ্ম! তিনি তো সেই কবে প্রতিজ্ঞা করে রাজ্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি অন্তত কোনও দিনই আর রাজ্য গ্রহণ করবেন না–প্রত্যাখ্যায় পুরা রাজ্যং ন স জাতু গহীষ্যতি। তার থেকে এই আমাদের যুবরাজ যুধিষ্ঠিরই সবচেয়ে ভাল। বয়সটাও কম, আর এই বয়সেও যেমন তিনি সত্যবাদী, তেমনি তার দয়া। আমরা তাই যুধিষ্ঠিরকেই রাজা হিসেবে বরণ করব–অভিষিঞ্চামঃ সাধ্বদ্য… তরুণং বৃদ্ধশীলিন। যুধিষ্ঠির রাজা হলে আমাদের ভীষ্ম-ধৃতরাষ্ট্রেরও কোনও কষ্ট থাকবে না। আমাদের যুধিষ্ঠির বুড়ো মানুষদের দুঃখ খুব বোঝেন। সমস্ত রাজকীয় উপচারে সেবা করেই তিনি এঁদের সুখে রাখবেন।

যুধিষ্ঠিরের জন্য মাঠে-ময়দানে জনপদবাসীদের মধ্যে এই যে আবেগ-তুষ্ট কথাবার্তা চলছিল, তা দুর্যোধন শুনতে পেলেন বিনা কষ্টে। যুধিষ্ঠিরের এত প্রশংসা শুনে তার মন মাৎসর্য এবং ঈর্ষায় জ্বলে উঠল–যুধিষ্ঠিরানুরক্তানাং পতপত দুর্মতিঃ। সাধারণ লোকের সরল কথাবার্তাগুলি তিনি মোটেই সহ্য করতে পারলেন না। ক্ষোভে, দুঃখে, ঈর্ষায় তিনি উপস্থিত হলেন পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে।

 ধৃতরাষ্ট্র সেদিন একা-একাই বসেছিলেন। কিছুক্ষণ আগে কূটবুদ্ধি কণিক তাকে কঠিন মন্ত্রণা দিয়ে গেছেন। ধৃতরাষ্ট্র একা-একা বসে সেই সব কথাই ভাবছিলেন। এরই মধ্যে দুর্যোধন তার কাছে এসে উপস্থিত হলেন পাহাড়-প্রমাণ অভিমান নিয়ে। বললেন–বাবা! রাস্তাঘাটে সর্বত্র মানুষেরা কী বলছে জান? এই যে তুমি! ছোট-ভাইয়ের উচ্ছিষ্ট সিংহাসনে বসে আছ তোমাকে এবং পিতামহ ভীষ্মকে তারা গ্রাহ্য করে না। তারা পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে রাজা করতে চায় কামনাদৃত্য ভীষ্মঞ্চ পতিমিচ্ছন্তি পাণ্ডব। ওরা যে সব কথা বলছে আমি নিজের কানে শুনে এসেছি। ওরা বলছে–ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা আছে, তাঁর রাজ্য লাভ করার প্রশ্নই আসে না। আর পাণ্ডু নিজের গুণেই পৈতৃক রাজ্য পেয়েছেন, আর তুমি তো জন্মান্ধ! তুমি বড় ভাই বলে রাজ্য পেয়েও শুধু অন্ধ বলে রাজ্য পেলে না–ত্বমন্ধগুণসংযোগাৎ প্রাপ্তং রাজ্যং ন প্রাপ্তবান্। তাহলে রাজ্য পাবে কে? রাজ্য পাবে যুধিষ্ঠির।

দুর্যোধন পিতার মনের সেই দুর্বল জায়গাটিতে আঘাত করলেন, যেখানে তার ক্ষত আছে। দুর্যোধন জানেন–ধৃতরাষ্ট্র সব সহ্য করতে পারেন, কিন্তু বড় ভাই হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে শুধু অন্ধত্বের মতো এক উপসৃষ্ট দুর্দৈবের জন্য রাজত্ব পাননি–এই ক্ষোভ সদা-সর্বদা তার অন্তর জুড়ে আছে। জনপদবাসীদের চির-পুরাতন বক্তব্য জানিয়ে দুর্যোধন যেমন একদিকে ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষতে ক্ষার নিক্ষেপ করলেন, তেমনি নিজের জন্যও মায়া তৈরি করে দিলেন ধৃতরাষ্ট্রের অন্তরে। ধৃতরাষ্ট্রের মন তৈরি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দুর্যোধন বললেন–যদি পাণ্ডুর ছেলেই উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার রাজ্য পায়, তবে নিশ্চয় তার পুত্রই আবার রাজ্য পাবে। আবার তারও পুত্র পিতার রাজ্য পাবে, তারও পুত্র আবার–তস্য পুত্রো ধ্রুবং প্রাপ্তস্তস্য তস্যাপি চাপরঃ। এই যদি চলতে থাকে তবে আমরা কী দোষটা করলাম? রাজার বংশে জন্মেও পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে আমরা চিরকাল রাজ্যহারা হয়ে থাকব–তে বয়ং রাজবংশেন হীনা সহ সুতৈরপি।

ধৃতরাষ্ট্র নিজে রাজ্য পাননি এবং কোনওদিন তার পুত্র-পৌত্রেরাও রাজ্য পাবে না–সম্পূর্ণ একটা বংশের প্রতি এই বঞ্চনা তাকে অধীর করে তুলছে। দুর্যোধন আরও বললেন–লোকেরা চিরকাল আমাদের করুণা করবে, বাবা! শুধু রাজবংশে জন্মেছি বলে, শুধু আমাদের ফেলে দেওয়া যায় না বলে চিরকাল আমরা এই জ্ঞাতিগুষ্টির দেওয়া করুণার ভাত খেয়ে বেঁচে থাকব। এ দুঃখ যে নরক-ভোগ করার দুঃখ, বাবা–সততং নিরয়ং প্রাপ্তাঃ পরপিণ্ডোপজীবিনঃ! আপনি সত্যিই কি কোনও ব্যবস্থা করবেন না, যাতে এমন কষ্ট আমাদের না হয়। আমার শুধু একটাই কথা, বাবা–দুর্যোধন যুক্তি দিয়ে বললেন–বাবা! তুমি যদি আগেই রাজ্য পেতে–যদি ত্বং হি পুরা রাজন্ ইদং রাজ্যমবাপ্তবান্–তাহলে শুধু পিতার রাজ্য বলেই আমরা আজ সেই রাজ্য ভোগ করতাম। এমনকি পৌর-জনপদবাসীরা যদি আমাদের একটুও পছন্দ না করত, তবু আমরা রাজ্য পেতাম, কেন না সে রাজ্য হত আমাদের পিতৃ-পিতামহক্রমে আসা যুক্তিযুক্ত উত্তরাধিকার–ধ্রুবং প্রান্স্যাম চ বয়ং রাজ্যমপ্যবশে জনে।

দুর্যোধন এমন করুণভাবেই ধৃতরাষ্ট্রকে বোঝাতে পেরেছেন যে, পুত্রদের প্রতি এই বঞ্চনার জন্য ধৃতরাষ্ট্র নিজেকেই এখন দায়ী ভাবছেন। পুত্রের প্রতি মায়ায় তিনি এখন কণিকের পরামর্শ ঠিক বলে ভাবতে লাগলেন। ওদিকে নিজেরই ভ্রাতুস্পুত্রদের প্রতি তিনি কেমন করে অকরুণ হবেন এই দুশ্চিন্তায় তার মনে যেমন কষ্টও হল, তেমনি তার মনে জেগে উঠল দ্বৈধভাব–ধৃতরাষ্ট্রে দ্বিধাচিত্তঃ শোকার্তঃ সমপদ্যত। কাকে রাখবেন তিনি–দুর্যোধনকে না যুধিষ্ঠিরকে।

ওদিকে দুর্যোধন-শকুনি, কর্ণ-দুঃশাসনের কূট আলোচনা চলছেই–কীভাবে পাণ্ডবদের রাজ্যহীন, হতশ্রী করে দেওয়া যায়। তারা আজ ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভার একান্তে দাঁড়িয়েই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। দুর্যোধন তারপর ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে বললেন–তুমি একটা সুন্দর উপায় বার করো, বাবা! যাতে আমাদের পাণ্ডবদের দিক থেকে কোনও ভয় না থাকে। তুমি উপায় বার করে, এঁদের বারণাবত নগরে নির্বাসন দাও।

 ধৃতরাষ্ট্রের মনে সেই দ্বৈধভাব আরও প্রবল হল। দুর্যোধনের ভাব পরীক্ষা করার জন্য সামান্যভাবে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে বললেন–দেখ বাছা! আমার ছোট-ভাই পাণ্ডু সব সময় নীতি-নিয়ম, ধর্ম মেনে চলতেন। আবার আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতি-গুষ্টির ওপর তার সঠিক নজর ছিল সব সময়। তাদের যোগ্য মান-সম্মান দেওয়ার কথাটাও তিনি কখনও ভুলতেন না। বিশেষত আমার কথা যদি বল, তবে আমাকে যে তিনি কী চোখে দেখতেন তা ভাবা যায় না। নিজের খাওয়া-নাওয়া ভুলে যখন যে সমস্যা হয়েছে, সব কিছু তিনি আমাকে জানাতেন আগে। নিজে রাজা হলেও সম্পূর্ণ রাজ্যটাকেই তিনি আমার কাছেই নিবেদন করে রেখেছিলেন–নিবেদয়তি নিত্যং হি মম রাজ্যং ধৃতব্রতঃ।

 ধৃতরাষ্ট্র যে জন্মান্ধতার জন্য রাজা হতে পারেননি এবং এজন্য যে তার মনে গভীর দুঃখ আছে–এ কথা পাণ্ডু জানতেন বলেই তাকে এমন রাজসম্মান দিতেন যে, ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে তা ভোলা সম্ভব হয়নি। অপিচ যুধিষ্ঠির যুবরাজ হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের সম্মান যতখানি রেখে চলেন, তাতে ধৃতরাষ্ট্র ভাবতেও পারেন না যে, তাকে ঠান্ডা মাথায় রাজ্য থেকে নির্বাসন দেওয়া যেতে পারে। তিনি বললেন–পাণ্ডু যেমন ছিলেন, যুধিষ্ঠিরও তেমনি ধর্মপরায়ণ, তেমনি গুণবান। পৌর-জনপদবাসীরাও তাকে খুব ভালবাসে। এই অবস্থায় তাকে জোর করে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নাকি–স কথং শক্যতে স্মাভিরপার্তুং বলাদিতঃ।

মনে রাখা দরকার, ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহে অন্ধ হলেও মহাভারতের কবি তাকে হাজার-একবার প্রজ্ঞাচক্ষু বলে বর্ণনা করেছেন। রাজনীতি বিষয়ক পড়াশুনো থেকে আরম্ভ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা তাকে এই প্রজ্ঞাচক্ষু দান করেছিল। সময়কালে ঠিক জিনিসটা তিনি ঠিকভাবেই বোঝেন কিন্তু মানুষের অন্তর্গঢ় যে জটিলতা যাকে আধুনিক ভাষায় কমপ্লেক্স বলা যায়, সেই কমপ্লেক্সের সঙ্গে স্বার্থে আচ্ছন্ন স্নেহাতুরতা জুড়ে যাওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র প্রজ্ঞাচক্ষু হারিয়ে জন্মান্ধ হয়ে পড়েন। এখানেও তাই হবে। ধৃতরাষ্ট্র আপন প্রজ্ঞাচক্ষুতে যা দেখেছেন, তা আবারও বললেন দুর্যোধনকে। বললেন–মনে রেখ দুর্যোধন! যুধিষ্ঠির এখন একা নন। তিনি শুধু পিতৃ-পিতামহক্রমে রাজ্যই পাননি, তার সঙ্গে পেয়েছেন পিতৃ-পিতামহের পরম্পরায় নেমে আসা কতগুলি মন্ত্রী এবং এক বিশাল সৈন্যবাহিনী। এই মন্ত্রীবর্গ এবং সৈন্য-সামন্তদের মহারাজ পাণ্ডু যেহেতু দানে-মানে সন্তুষ্ট রেখেছিলেন, অতএব তারাও বংশ-পরম্পরায় যুধিষ্ঠিরের সহায় হবেন। পৌর-জনপদবাসীরাও কম কিছু আপ্যায়মপাননি পাণ্ডুর কাছে। অতএব সেই সব মন্ত্রী অমাত্য-সৈন্যরা, সেই সব পূর্ব-পুরস্কৃত বেহ্মরবাসী জনতারা কেন তাদের অভিমত যুবরাজের বিদায়-যাত্রা মেনে নেবে? তারা বরং এই অন্যায় সইতে না পেরে আমাদের সপরিবারে হত্যা করবে না, তাই বা কী করে জানছ–কথং যুধিষ্ঠিরস্যার্থে ন নো হনঃ সবান্ধবান্।

দুর্যোধন ধীরতার রাজনীতি করেন না, তার এমন কোনও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ নেই, যে রাজনীতি তার প্রযোক্তাকে স্ববিষয়ে টিকিয়ে রেখে তাকে স্থায়ী আসন দেয়। দুর্যোধনের রাজনীতি হল–এই এক্ষুনি চাই রাজনীতি। তিনি যেন-তেন উপায়ে আপাতরম্য বিষয়কে আঁকড়ে ধরেন। হয়তো সেই জন্যই তিনি ধৃতরাষ্ট্রের প্রজ্ঞাগর্ভ উপদেশ অথবা করণীয় বিষয়ের রাজনৈতিক ব্যাপ্তি গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না। তিনি বললেন–এসব কথা কি আমি আগে থাকতে ভাবিনি ভেবেছো? সব ভেবেই আমি যুধিষ্ঠির-সহায় পৌর-জনপদবাসীদের আগে থাকতেই টাকা-পয়সা খাইয়ে তুষ্ট রেখেছি–দৃষ্ট্ৰা প্রকৃতয়ঃ সর্বা অর্থমানেন পূজিতাঃ। প্রজারা তাই এখন আমারই সহায়তা করবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

যুধিষ্ঠির যুবরাজ হয়েছেন বটে, তবে রাজ্যর শাসন-সংক্রান্ত সব বিষয় তিনি নিজের হাতে রাখেননি। রাজকোষ এবং মন্ত্রীবর্গের ভরণ-পোষণের জন্য যা বিলি-ব্যবস্থা করতে হবে–এই সম্পূর্ণ বিষয়টা তিনি দুর্যোধনের হাতে ছেড়ে রেখেছিলেন। হয়তো এই ব্যবস্থাই ধৃতরাষ্ট্রের সম্মত ছিল। যুবরাজ না হতে পেরে যাতে ক্ষোভ না জন্মায় সেই জন্যই অর্থের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুর্যোধনের হাতেই ন্যস্ত ছিল। ভাবুন একবার–ভীম-অর্জুন বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ-যাত্রা করে যে বিশাল অর্থ এনে ফেলেছিলেন হস্তিনাপুরের রাজকোষে, সেই অর্থের অধিকার যুধিষ্ঠির নিজের হাতে রাখেননি। হয়তো অর্থের প্রকৃতিগত মালিন্য এবং অর্থের দানাদান সংক্রান্ত স্বাভাবিক দূষণের গ্রাস থেকে বাঁচতে চেয়েই যুধিষ্ঠির নিজে এই অর্থের ভার নেননি।  কিন্তু দুর্যোধন যে এই অর্থ-সম্পত্তি তাঁদেরই বিরুদ্ধে কাজে লাগাবেন, এটা যুধিষ্ঠিরের সর্বহিতৈষিণী রাজনৈতিক বুদ্ধিতে কুলোয় না।

 কিন্তু দুর্যোধন এই ব্যাপারে নিজের কাজটি ঠিক গুছিয়ে নিচ্ছেন। তিনি বলেছেন–তুমি ভেবো না, বাবা! মন্ত্রীবর্গ এবং অর্থভাণ্ডার এখন আমার অধীনে–অর্থবর্গঃ সহামাতো মৎসংস্থা দ্য মহীপতে। অতএব মন্ত্রীদের সহায়তা অথবা প্রকৃতি-সংক্ষোভের বিষয়ে তুমি কোনও চিন্তা করবে না। তুমি শুধু মিষ্টি করে মৃদুনৈব অভপায়েন–কোমলভাবে পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসিত করো–স ভবা পাণ্ডবানাশু বিবাসয়িতুমহসি। তার পরের সমস্ত ভাবনা আমার ওপর ছেড়ে দিন।

বস্তুত দুর্যোধন পরে কী করবেন, তার আভাসও বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে দিলেন না। বরঞ্চ আপাতত এমনভাবেই তিনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাণ্ডবদের ভবিষ্যৎ নিরূপণ করেছেন, যাতে স্নেহাতুর পিতার পুত্রস্বার্থ পুরোমাত্রায় বজায় থাকবে অন্যদিকে পাণ্ডবদেরও বধ-বন্ধনাদির মতো কঠিন বিপদ কিছু ঘটছে না। শুধুই যেন এক নির্বাসন। দুর্যোধন বলেছেন–দ্যাখো, আমি যখন হস্তিনাপুরে পুরোদস্তুর রাজা হয়ে যাব, তখন পাণ্ডবরা আবার তাদের মায়ের সঙ্গে হস্তিনাপুরে ফিরে আসুন, তাতে কোনও ক্ষতি নেই–তদা কুন্তী সহাপত্যা পুনরেষ্যতি ভারত।

এমনভাবেই ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এই উপস্থাপনা হল যাতে মনে হবে যেন দুর্যোধন জ্ঞাতি-ভাইদের রাজনৈতিক স্থিতিটা শুধু উলটে দিতে চাইছেন। একটু আগেই তিনি দুঃখ করে বলেছেন–এই প্রখ্যাত রাজবংশে জন্মেও, জ্যেষ্ঠ রাজাধিকারীর পুত্র হয়েও আমরা বংশ-বংশ ধরে পাণ্ডবদের ভাত খেয়ে যাব চিরকাল। দুর্যোধন যেন বলতে চাইলেন–রাজা থাকব আমি, আর পাণ্ডবরা আমার দেওয়া অন্ন খেয়ে বাঁচুক। আমার দুঃখটা কী সেটা তারা বুঝুক।

কথাটা ধৃতরাষ্ট্রের মনে ধরল শুধু নয়। জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও রাজা না হওয়ার যে কমপ্লেক্স তার অন্তর জুড়ে আছে, সেই কমপ্লেক্স যেন শান্ত হল এই পরিকল্পনায়। সত্যিই তো, কপালগুণে পাণ্ডু রাজা হয়েছিলেন বলেই তো তাকে বংশপরম্পরায় পরপিণ্ডোপজীবী হয়ে থাকতে হচ্ছে। তা এবার দুর্যোধনের রাজত্বে পাণ্ডবরা তার ছেলেদের মতোই থাকুক না কেন। তাঁদরে তো আর মারা-ধরা কিছু করা হচ্ছে না। ধৃতরাষ্ট্রের বেশ লাগল। বেশ লাগল এই মধুর পরিকল্পনাটি। ভাবলেন–ছেলের আমার বেশ বুদ্ধি হয়েছে। ধৃতরাষ্ট্রের প্রজ্ঞাচক্ষু পুত্রের স্বার্থান্বেষিতায় এই প্রথম ভালভাবে অন্ধ হয়ে গেল। তিনি বললেন– তুমি যেমনটা বললে, আমার মনেও ঠিক তেমনটিই ছিল–দুর্যোধন! মোপ্যেত হৃদি সম্পরিবর্ততে। কিন্তু পাণ্ডবদের তাড়ানোর এই ভাবনাটার মধ্যে কিছু পাপবুদ্ধি আছে বলেই আমি প্রকাশ করে বলিনি।

দুর্যোধনের সঙ্গে সহমত হয়ে যাবার সঙ্গে-সঙ্গেই ধৃতরাষ্ট্র তার আরও একটি দুর্ভাবনার কথা জানালেন। ধৃতরাষ্ট্র রাজার ভূমিকায় তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু পাণ্ডুর মৃত্যুর পর হস্তিনাপুরের রাজপরিবারের কুলজ্যেষ্ঠরা রাজ্যশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের মত প্রকাশ করতেন। এমনকি দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্যরা বহিরাগত হলেও বহুকাল এই রাজপরিবারের সঙ্গে থেকে থেকে নিজেদের এমন ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, তারাও হস্তিনাপুরের রাজনীতির অংশীভূত হয়ে গিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রের সামান্য দুর্ভাবনা যেটুকু আছে। তা এঁদের নিয়েই।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন–আমরা পিতা-পুত্রে পাণ্ডবদের নির্বাসন দেবার ব্যাপারে একমত হলাম বটে, কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ–এঁরা মোটেই পাণ্ডবদের নির্বাসন ব্যাপারটা মেনে নেবেন না। ভীষ্ম তথা কুরুবংশের অন্যান্য কুজ্যেষ্ঠরা পাণ্ডব এবং কৌরবদের এক চোখেই দেখেন। কাজেই তারা পাণ্ডবদের এই দুর্গতি সহ্য করবেন না; কৌরব-পাণ্ডবদের মধ্যে একতমের প্রতি এই বিষম আচরণ তাঁরা মোটেই অনুমোদন করবেন না–নৈতে বিষমমিচ্ছেয়ু-ধর্মযুক্তা মনস্বিনঃ। তো আমাদের এই কাজে কৌরবকুলের জ্যেষ্ঠ পুরুষেরা যদি আমাদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, তবে আমাদের বধ করার কথাও তারা ভাবতে পারেন।

অন্ধ বলেই হোক অথবা খানিকটা ভীতু প্রকৃতির মানুষ বলেই হোক ধৃতরাষ্ট্র তার মনের দুর্ভাবনা প্রকাশ করে ফেললেন। দুর্যোধন বললেন–অত ভাবনার কিছু নেই, পিতা! ভীষ্ম দাঁড়িয়ে আছেন পাণ্ডব-কৌরবদের মাঝখানে। তিনি এ পক্ষেও যাবেন না, ও পক্ষেও যাবেন না–মধ্যস্থঃ সততং ভীষ্মঃ। কিন্তু এটা মাথায় রাখো–অশ্বত্থামা তো আছেন আমাদের সঙ্গে। দ্রোণ নন, বিদুর নন, কৃপ নন। অশ্বত্থামা। এমন অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন আসল তা ভাববার আগেই দুর্যোধন বললেন–অশ্বত্থামা যেখানে আছেন, দ্রোণ তাঁরই পক্ষে থাকবেন। আর ভগিনীপতি আর ভাগনে যে দলে আছেন কৃপাচার্যও থাকবেন সেই দলে–কৃপঃ শারদ্বতশ্চৈব যত এতৌ ততো ভবেৎ। সোজা হিসেব। আর বাকি রইলেন বিদুর। দুর্যোধন বললেন–আমি জানি–তিনি আমাদেরই অন্নে প্রতিপালিত, তবু গোপনে তিনি আমাদের শত্রু পাণ্ডবদের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখেন–ক্ষার্থবদ্ধস্মাকং প্রচ্ছন্নং সঙ্গতঃ পরৈঃ। কিন্তু যতই তিনি পাণ্ডবদের সঙ্গে জোট বেঁধে চলুন না কেন, মনে রাখবেন–তিনি একা। পাণ্ডবদের ওপর সদয় হয়ে আমাদের ওপর কোনও নির্যাতন চালানো অন্তত একাকী বিদুরের পক্ষে সম্ভব হবে না–ন চৈকঃ স সমর্থোস্মন্ পাণ্ডবার্থে প্রবাধিতুম।

 দুর্যোধন এবার সযৌক্তিকভাবে শেষ প্রস্তাব করলেন–অতএব পিতা! কুরু-কুলীনদের নিয়ে দুর্ভাবনার আর কোনও কারণ নেই। কেউ কিছু করতে পারবেন না। তুমি নিশ্চিন্ত মনে একেবারে তাদের মায়ের সঙ্গে পাণ্ডবদের নির্বাসনে পাঠাও বারণাবতে এবং সেটা যাতে আজই হয় সেই চেষ্টা করো–সুবিশ্রদ্ধঃ পাণ্ডুপুত্রা সহ মাত্রা প্রবাসয়। আমি জানি–পাণ্ডবদের কারণে তোমার রাত্রে ঘুম আসে না। তোমার নিজের ছেলেরা এইভাবে রাজ্যহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর পাণ্ডুর ছেলেরা রাজ্যভোগ করছে। যুধিষ্ঠির যুবরাজ হয়েছে–আমি জানি এ সব ঘটনা তোমার বুকে কাটার মতো বেঁধে–-বিনিদ্রকরণং ঘোরং হৃদি শল্যমিবার্পিতম্। অতএব কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠিয়ে মনের সকল জ্বালা দূর করো তুমি।

সেই তখন থেকে শুনছি–শুধু পাণ্ডবদের নয়, কুন্তীর সঙ্গে তাদের বারণাবতে পাঠান। দুর্যোধন হঠাৎ কুন্তীকে ধরলেন কেন? তিনি তো রাজনীতির কোনও সাতে-পাঁচে নেই। তিনি পাণ্ডবজননী–এই তো তার পরিচয়। আর দুর্যোধনের রাজপদে তিনি আর কোনও বাধা সৃষ্টি করছেন না। তবুও তিনি কেন কুন্তীকে পাঠানোর জন্য প্রস্তাব করছেন, তার একটা যুক্তি অবশ্যই আছে। দুর্যোধন এই মনস্বিনী রমণীর অত্যদ্ভুত ক্ষমতা লক্ষ্য করেছেন। পাণ্ডু এবং মাদ্রীর মৃত্যুর পরে সেই শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে তিনি তার ছোট ছোট ছেলেপিলেকে হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন কতগুলি আরণ্যক মুনি-মাত্র সহায়ে। আসার পরে তাকে বেশি কথাও খরচা করতে হয়নি। মুনি–ঋযিদের ওকালতি এবং নিজের ব্যক্তিত্বে তিনি তার শ্বশুরবাড়িতে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। তাঁর পুত্রগুলি মহারাজ পাণ্ডুর ঔরসজন্মা না হলেও কুন্তী তাদের পাণ্ডব হিসেবে প্রতিষ্ঠাও করতে পেরেছেন। এবং এতদিনে বিদুরের মতো এক মহাপ্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে তিনি ব্যক্তিগত সহায় হিসেবে পেয়েছেন। কিন্তু এই মনস্বিতা বা ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে দুর্যোধনের ভয় নেই। তাঁর ভয়–যে কুন্তী পাণ্ডুর বীর্য গর্ভে ধারণ না করেও পাণ্ডব-জননী বলে খ্যাত, তিনি সব পারেন। পাণ্ডুপুত্রদের বারণাবতে ধ্বংস করে ফেললেও এই কুন্তী যদি আবারও তাঁর অলৌকিক মন্ত্রের সাধনে পুত্রোৎপত্তি ঘটিয়ে বলেন–এই পুত্রও পাণ্ডব, এই পাণ্ডুর উত্তরাধিকারী–দুর্যোধন হয়তো সেই ভয়েই পাণ্ডবদের সঙ্গে কুন্তীকেও শেষ করতে চান।

.

১১৩.

 দুর্যোধন মুখে যা বলেছিলেন, কাজেও বেশ করে সেটা করলেন। সাধারণ প্রজারা, সে হস্তিনাপুরের প্রজাই হোক অথবা অবন্তী-কোশলের প্রজাই হোক, তারা সব সময়েই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অভাবগ্রস্তই হয়। দুর্যোধন সেই ব্যাপারটা বুঝে প্রজাদের প্রচুর অর্থ আর সম্মান দিয়ে হাতের মুঠোয় এনে ফেললেন তাদের। এ ব্যাপারে দুর্যোধন একা নন, তাঁর। অন্যান্য ভাইরাও প্রজাদের টাকা-পয়সা খাইয়ে তাদের দুর্যোধনের অনুকূলে নিয়ে এলেন। দুর্যোধন যে সব মন্ত্রীদের কথা বলেছিলেন, তাঁরাও দুর্যোধনের দানে-মানে বশীভূত হয়ে তার হয়ে কাজ করতে লাগলেন–অর্থৰ্মানপ্রদানাভ্যাং সঞ্জহার সহানুজঃ। এইসব মন্ত্রীদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন যারা খুব ভাল কথা বলতে পারতেন। বিষয়-বর্ণনার ক্ষেত্রেও তারা খুব নিপুণ। এবারে এইরকম কয়েকজন অনুকূল মন্ত্রীকে ধৃতরাষ্ট্র ডেকে পাঠালেন নিজের কাছে। তাদের তিনি নির্দেশ দিলেন যাতে তারা বারণাবত নামে জায়গাটির একটা কাব্যিক বর্ণনা দেন পাণ্ডবদের কাছে। বর্ণনার ভাব এবং ভাষা হবে এমন, যাতে পাণ্ডবভাইরা বারণাবতে যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠবেন।

 মন্ত্রীরা ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে পাণ্ডব-ভাইদের কাছে গিয়ে বলল–এমন সুন্দর জায়গা সচরাচর দেখা যায় না। তাছাড়া জায়গাটাও খুব অভিজাত রুচিসম্পন্ন। এখানকার মানুষজনও খুব ভাল–সর্বরত্ন-সমাকীর্ণ পুংসাং দেশে মনোরমে। আর জান তো–বারণাবত এখন উৎসবের জন্য তৈরি হচ্ছে। এখানে মহাদেবের পূজা উৎসব উপলক্ষে কত যে মানুষ চারদিক থেকে এসে উপস্থিত হয়েছে, তার শেষ নেই–অয়ং সমাজঃ সুমহান্ রমণীয়তমা ভূবি। এক-দুজন নয়, অনেক মন্ত্রীই তাদের সাধ্যমতো বারণাবতের গুণ আখ্যাপন করল পাণ্ডব-ভাইদের সামনে। পাণ্ডবদের যথেষ্ট কৌতূহল হল–জাতকৌতূহলা ইতি। মনে মনে তারা ভাবতে আরম্ভ করলেন–গেলেই হয়। এত সুন্দর জায়গা! একবার ঘুরে আসলেই হয়।

ঠিক এইরকম একটা উন্মুখ অবস্থা দেখে ধৃতরাষ্ট্র এবার পাণ্ডবদের ডেকে পাঠালেন নিজের ঘরে। কূটবুদ্ধি কণিকের কাছে ধৃতরাষ্ট্র যে উপদেশ পেয়েছিলেন, তার প্রয়োগ বোধহয় এখনই আরম্ভ হয়ে গেল। মুখে মিষ্টি হাসি আর অভ্যর্থনার সুর বজায় রেখে অন্তরের সমস্ত ক্রুরতা নিয়ে তিনি বললেন–এই দেখ না বাছারা! প্রতিদিনই কতগুলো লোক এসে আমাকে বারংবার বলছে–বারণাবতের মতো এমন সুন্দর জায়গা নাকি আর হয় না–রমণীয়তমং লোকে নজরং বারণাবতম। এই লোকগুলোকে বোঝাতে পারি না যে, এসব কথা শুনলে আমার দুঃখই হয়। আরে আমি অন্ধ মানুষ, বুড়ো হয়েছি, তো বারণাবতের সৌন্দর্য–কাহিনী শুনে আমি কী করব! সে যাই হোক বাছারা–তোমরা যদি ইচ্ছে করো–তে তাতা যদি মন্যধ্ব–তবে তোমরা কিন্তু সবাই মিলে একবার দেখে আসতে পার জায়গাটা। সেখানে আবার এখন মহাদেবের উৎসব পালিত হবে। সেটাও একটা বাড়তি পাওনা। তবে হ্যাঁ, তোমরা যদি যাও, তবে কিন্তু। টাকা-পয়সার জন্য কোনও চিন্তা করো না। যাদের যাদের পছন্দ, তাদের সবাইকে নিয়ে যাবে–সগণাঃ সানুযাত্রাশ্চ বিহরধ্বং যথামরাঃ–সেখানে থাকবে একেবারে দেবতাদের মতো মর্যাদা নিয়ে। টাকা-পয়সা নিয়ে যাও, বামুনদের দান–ধ্যান কর। ভাল ভাল গান শোনো খুশি লাগলে তাদেরও টাকা দাও, বকশিস্ দাও–ব্রাহ্মণেভ্যেশ্চ রত্নানি গায়নেভ্যশ্চ সর্বশঃ। বেশ কিছুদিন সেখানে থেকে জায়গাকে ভাল করে অনুভব করো, আনন্দ করো, তারপর সুখী মনে আবার ফিরে এসো হস্তিনাপুরে–ইদং বৈ হস্তিনপুরং সুখিনঃ পুনরেষ্যথ।

অন্যান্য মানুষেরা যখন বারণাবতের প্রশংসা করছিলেন, তখন যুধিষ্ঠির সেটাকে সহজ-সরলভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র যখন একইভাবে বারণাবতের প্রশংসা করে সেখানে গিয়ে থাকতে বললেন, তখন যুধিষ্ঠির খুব সহজভাবে নিলেন না কথাটা। তিনি বেশ বুঝলেন–এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে একটা চক্রান্ত আছে। বস্তুত বারণাবতে যাবার খুব ইচ্ছে হলে তারা নিজেরাই ধৃতরাষ্ট্রের কাছে অনুমতি চাইতেন। কিন্তু হস্তিনাপুরের মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যখন আগ বাড়িয়ে তাদের বারণাবতে যেতে বলছেন, সেখানে ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। বিশেষত রাজারা আদেশ করেন মিষ্টি অনুরোধ করে। তোমরা যদি ইচ্ছে করো অথবা জায়গাটা ভাল–এ সবই কথার কথা। কিছুদিন তোমরা ঘুরে এসো–কঞ্চিৎ কালং বিহৃত্যৈবমনুভূয় পরাং সুখ–তাতে সুখ কী ঘটবে জানা নেই, তবে এখানে ঘুরে আসতে পার মানে যেতে হবে।

যুধিষ্ঠিরকে আমাদের কালের লোকেরা বোকাসোকা সরল মানুষ ভাবেন। তিনি সত্যিই সেইরকমই, কিন্তু তার কোনও বুদ্ধি নেই, কিংবা রাজনৈতিক সূক্ষ্মতার কোনও বোধ নেই তাঁর–এটা ভাবাই মূর্খতা। পাণ্ডব-ভাইরা অন্য কেউ ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য না বুঝলেও এমনকি ধৃতরাষ্ট্রের গভীর মনের কথাটা যুধিষ্ঠিরও না বুঝলেও তিনি এটা বুঝলেন যে, ধৃতরাষ্ট্রই চান যে, তারা বারণাবতে ঘুরে আসুন–ধৃতরাষ্ট্রস্য তং কামমনুবুধ্য যুধিষ্ঠিরঃ। অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের মুখে একই কথা শুনে নিজেকে একটু অসহায়ও মনে করলেন যুধিষ্ঠির। সামনাসামনি তিনিও ধৃতরাষ্ট্রের মতোই শুষ্ক হাসি হেসে বললেন–নিশ্চয়ই। আপনি যখন বলছেন নিশ্চয়ই আমরা বারণাবতে যাব। কিন্তু মনে মনে যুধিষ্ঠির অসহায়ের মতো ভাবতে লাগলেন–কী করা যায়–আত্মনশ্চাসহায়ত্বং তথেতি প্রত্যুবাচ তম্।

যুধিষ্ঠির এটা বুঝলেন–মন্ত্রীরা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে এককাট্টা হলেও কুরু বাড়ির কুলবৃদ্ধদের অন্তত জানাতে হবে যে, তারা নিজের ইচ্ছায় বারণাবতে বিলাস-ভ্রমণ করতে যাচ্ছেন না, তারা বারণাবতে যাচ্ছেন ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছায়। যুধিষ্ঠির যাঁদের সঙ্গে দেখা করলেন, তার একটা লিস্টি দিয়েছেন মহাভারতের কবি। এঁরা হলেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বাহ্বীক, সোমসও, ভূরিশ্রবা ইত্যাদি। এঁরা অনেকেই কুরুবাড়ির কুলপ্রধান এবং ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভার গণ্যমান্য মন্ত্রী। যুধিষ্ঠির এঁদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে আলাদা করে বললেন–আমরা পরিজনবর্গ সঙ্গে নিয়ে বারণাবতে যাচ্ছি ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে–সগণাস্তত্র যাস্যামো ধৃতরাষ্ট্রস্য শাসনাৎ।

 যুধিষ্ঠির অতিশয় বুদ্ধিমান। তিনি বারণাবতের স্থানমাধুর্য, স্থানীয় মানুষের মর্যাদা নষ্ট করলেন না, কারণ সে কথা সকলে বলছে–রমণীয়ে জনাকীর্ণ নগরে বারণাবতে। কিন্তু সেই রমণীয় স্থানে যে তিনি নিজের ইচ্ছেয় যাচ্ছেন না, এটা তিনি দেশ-বর্ণনার সঙ্গেই টুক করে বলে দিচ্ছেন। বলছেন–তিনি যাচ্ছেন–ধৃতরাষ্ট্রস্য শাসনাৎ। যুধিষ্ঠির একই সঙ্গে কুলবৃদ্ধদের আশীর্বাদ ভিক্ষা করছেন। কোনও পাপ যেন তাদের স্পর্শ না করে, কোনও বিপদ যেন না ঘটে, সে জন্য যুধিষ্ঠির সকলের আশীর্বাদ চাইছেন। চাইছেন–তারা যেন যুধিষ্ঠিরের মঙ্গল প্রার্থনা করে পুণ্য শব্দ উচ্চারণ করেন–প্রসন্নমনসঃ সর্বে পুণ্যা বাচো বিমুঞ্চত। যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণ-সজ্জন, তপস্বী-পুরোহিত এবং প্রজাদের কাছেও আশীর্বাদ চাইলেন একই কথা বলে। জননী গান্ধারীর কাছেও তিনি জানিয়ে এলেন যে, ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছাতে তিনি সকলকে নিয়ে বারণাবতে যাচ্ছেন।

যুধিষ্ঠিরের কথার মধ্যে বিশেষ অভিনিবেশের যে জায়গাটুকু ছিল, কুরুবাড়ির বৃদ্ধ–সজ্জনেরা সে কথা তেমন করে ধরতেই পারলেন না। বস্তুত ধৃতরাষ্ট্রের ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কুশল। যে সব মন্ত্রীদের তিনি বারণাবতের স্থান-সৌন্দর্য বর্ণনা করতে বলেছিলেন, তারা শুধু পাণ্ডবদের কাছেই নয়, তারা হয়তো নগরের সর্বত্রই ওই একই কথা বলে বেড়াচ্ছিল–কথয়াঞ্চক্রিয়ে রম্যং নগরং বারণাবত। কুরুবাড়ির অন্যান্যদের কাছেও বারণাবতের এই মহামহিম বৰ্ণনা পৌঁছেছে। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপরাও বারণাবতের এই বহু বহুশ্রুতি শুনে থাকবেন। ফলত ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছাতে পাণ্ডবরা বারণাবতে বেড়াতে যাচ্ছেন–এই কথা তাদের মনে কোনও সন্দেহের উদ্রেক করল না। তারা সানন্দে যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করে বললেন–তোমাদের মঙ্গল হোক বাছারা! পথে এবং অন্য কোথাও যেন তোমাদের কোনও অমঙ্গল না হয়–স্বস্ত্যস্তু বঃ পথি সদা ভূতেভ্যশ্চ সর্বশঃ।

পাণ্ডবরা আর দেরি করলেন না। বারণাবত থেকে ফিরে এসে আবার যাতে তারা রাজ্যলাভ করেন, সে জন্য শান্তি–স্বস্ত্যয়ন করে তারা মাকে নিয়ে বারণাবতের পথে যাত্রা করলেন।

দুর্যোধন আগেই বুঝে গিয়েছিলেন যে, এ যাত্রায় তার পরিকল্পনা সার্থক হবে। কারণ স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু এই পরিকল্পনার সমর্থক এবং তার কথা যেহেতু পাণ্ডবরা অমান্য করবেন না, অতএব তিনি আগে থাকতেই নিজের বুদ্ধিমতো ব্যবস্থা নিলেন। যে মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের বারণাবত যাত্রার কথা বলেছেন–ধৃতরাষ্ট্র-প্ৰযুক্তেযু পাণ্ডুপুত্রে ভারত–সেই মুহূর্তেই দুর্যোধন পুরোচন নামে এক বিশ্বস্ত মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। বলা বাহুল্য দুর্যোধনের অন্তর্মূঢ় ভবিষ্যৎ–পরিকল্পনার কথা ধৃতরাষ্ট্র জানতেন না, পাণ্ডবদের জীবন নিয়ে দুর্যোধন যে খেলা খেলবেন তাও তিনি জানতেন না। তিনি পাণ্ডবদের নির্বাসনেই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং ভেবেছিলেন–দুর্যোধন এর মধ্যে রাজা হয়ে গেলে পাণ্ডবরা ফিরে আসলেও আর কিছু করার থাকবে না। কিন্তু পাণ্ডবদের এই সুযোগে মেরে ফেলার কথাটা তিনি সত্যিই ভাবেননি।

পুরোচনকে মহাভারতের কবি সচিব পর্যায়ের ব্যক্তি বলে বর্ণনা করেছেন বলেই জোর দিয়ে বলতে পারি–পুরোচন কুরু-রাজসভার কোনও মন্ত্রী ছিলেন না। বাস্তবে তিনি কুরু রাজ্যের শাসন -কর্মে কোনও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন বলে মনে হয় এবং তিনি দুর্যোধনের ব্যক্তিগত সচিবতাও করতেন। দুর্যোধন গোপনে তাকে ডেকে আনলেন নিজের কাছে। আমাদের ধারণা পাণ্ডবরা তখনও রাজ্য ছেড়ে যাননি, কিন্তু দুর্যোধনের পরিকল্পনা পাণ্ডবদের বারণাবতে পৌঁছনোর আগেই সার্থক করতে হবে বলে, পুরোচনকে ডেকে দুর্যোধন তার ডান হাতখানি ধরে অত্যন্ত সৌহার্দের সঙ্গে তাঁর কাছে নিজের প্রস্তাব পেশ করলেন–গৃহীত্বা দক্ষিণে পাণৌ সচিবং বাক্যমব্রবীৎ।

 অধস্তনকে দিয়ে গর্হিত কাজ করানোর সময় উচ্চতর আধিকারিক এইভাবেই তার উচ্চাসন মঞ্চ থেকে নেমে আসেন। দুর্যোধন বললেন–পুরোচন-ভাই! তোমার থেকে বেশি বিশ্বাসী এবং পরম সহায় এমন আর কেউ নেই যার সঙ্গে বসে একটু নিজের মনের কথা বলতে পারি–সহায়ো যেন সন্ধায় মন্ত্রয়েয়ং যথা ত্বয়া। দেখো বন্ধু! যা তোমাকে বলতে যাচ্ছি, তার সবটুকুই গোপন রাখবে। বাইরে যেন ফাস না হয়ে যায়। আর এইভাবেই তুমি আমার ব্যক্তিগত শত্রুদের উচ্ছেদ করে দিতে পার।

অধস্তন ব্যক্তি, যার সঙ্গে এমন আদর করে কোনও রাজা-মহারাজা কথা বলেননি, সে এমন কথা শুনলে স্ফীত বোধ করবে এবং নিজের ক্ষমতার একশো ভাগ উজাড় করে দেবে। পুরোচন দুর্যোধনের প্রস্তাব শোনার জন্য উন্মুখ হতেই দুর্যোধন বললেন–মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার আদেশে পাণ্ডবরা বারণাবতে মহাদেবের উৎসবে যোগ দেবে। তোমার কাজ হল–তুমি খুব তাড়াতাড়ি রথে করে বারণাবতে চলে যাবে। রথে খুব উত্তম অশ্ব যোজনা কোরো না, লোকের সন্দেহ হবে। বড় বড় অশ্বতরচালিত রথে করেই যাবে তুমি–স ত্বং রাসভযুক্তেন স্যন্দনেনাশুগামিনা। এবং সেটা আজকেই।

দুর্যোধন এবার তাঁর আসল পরিকল্পনাটি খুলে বললেন–বারণাবতে পৌঁছে তুমি একটি চকমিলান বাড়ি তৈরি করবে। সে বাড়ির মধ্যে দান-ধ্যানের উপযুক্ত ধন–মণি-রত্ন রাখবে, আর ক্ষত্রিয়ের ব্যবহার করার মতো প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্রও রাখবে–আয়ুধাগারমাশ্ৰিত্য কারয়েথা মহাধন। মনে রেখো, সেখানেই পাণ্ডবরা থাকবেন, অতএব রাজবাড়ির আবরু যাতে বজায় থাকে সেইভাবে বাড়ির চারদিকে একটা প্রাচীরও তৈরি করে দিও। এইবারে আসল কথাটা বলি। বাড়িটা তৈরি করার সময়–শণ-গাছ, (বাংলাদেশে ব্যবহৃত ছোন) ধুনো এবং আর যত সব জিনিস আছে যাতে সহজে আগুন ধরে–শণ-সর্জরসাদীনি যানি দ্রব্যানি কানিচিৎ–সে সবই বাড়ি তৈরির মশলার সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। বাড়ির ভিতরে বাইরে প্রলেপ দেবার সময় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে অনেকটা করে ঘি, তেল, চর্বি এবং গালা–সর্পিস্তৈলবসাভিশ্চ লাক্ষয়া চাপ্যনল্লয়া। এতে বাড়ির রঙও সুন্দর হবে, চকচকেও হবে। বাড়ির চারদিকে উঁচু উঁচু বেদি তৈরি করাবে বসবার জন্য। তার ভিতরেও থাকবে শণ, তেল ঘি, গালা এবং সে বেদি বানানোর কাঠ দেবে এমন যাতে সহজে আগুন ধরবে।

 দুর্যোধন জানতেন যে, নতুন বাড়িতে ঢোকার সময় রাজরাজড়ারা সাধারণ বিশেষজ্ঞ দিয়ে বাড়ি পরীক্ষা করিয়ে নেন। এখানে হয়তো তেমন জোরদার কোনও পরীক্ষা করবেন না যুধিষ্ঠির। কিন্তু ওপর ওপর সামান্য পরীক্ষা করে যাতে বাড়ি তৈরির মশলাটি না বোঝা যায়, তার জন্য পুরোচনকে সাবধান হতে বললেন দুর্যোধন–যথা চ তন্ন পশ্যের পরীক্ষন্তোপি পাণ্ডবাঃ।

দুর্যোধনের কূট বুদ্ধি কিছু কম নয়। তিনি পুরোচনকে এমন একটা ভাবে থাকতে বলছেন, যেন তিনি বারণাবতে পাণ্ডবদের কেয়ারটেকার হিসেবে থাকবেন। দুর্যোধন বলেছেন–ওই বড় বাড়ির সঙ্গে তুমি নিজের জন্যও অমনই একটা ঘর বানাবে পাশেই এবং সে বাড়িটিও তৈরি করাবে ওই একই মশলা দিয়ে। তাতে পাণ্ডবদের কোনও সন্দেহ থাকবে না। তোমার বাড়ি এবং তাদের বাড়ির উপাদান এক হলে প্রাথমিকভাবে পাণ্ডবরা তাকে বিশ্বাস করার কারণ খুঁজে পাবেন অন্তত। দুর্যোধন বলেছেন–বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে তুমি পাণ্ডবদের তথা তাদের জননীকে অনেক আদর-যত্ন করে ওই বাড়িতে প্রবেশ করাবে। বাড়ির মধ্যে যেন ভাল বিছানা, ভাল বসার জায়গা এবং এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াবার ভাল যান প্রস্তুত থাকে। এতে ধৃতরাষ্ট্রও খুশি হবেন।

পাণ্ডবদের ঘর-বাড়ি, বিছানা-বালিশের আরামদায়ক ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়ে দুর্যোধন বললেন–এই বাড়িটিতেই আগুন লাগাতে হবে বন্ধু! কিন্তু যে পর্যন্ত এই আগুন লাগানোর সময় না হয়, ততদিন যেন বারণাবতের লোকেরা একটুও বুঝতে না পারে, তুমি কী করতে চলেছ–যথা চ তন্ন জানন্তি নগরে বারণাবতে। তারপর একদিন যখন বুঝবে–পাণ্ডবরা তোমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করছেন এবং যখন দেখবে–তারাও বিশ্বস্তভাবে নিরুদ্বেগে বাড়ির মধ্যে ঘুমোচ্ছেন, সেইরকম একটা দিনে–তুমি তোমার নিজের ঘরের দরজাটাতে শুধু আগুন লাগিয়ে দেবে। সেই আগুন মুহূর্তের মধ্যে গ্রাস করে ফেলবে পাণ্ডবদের সুদৃশ্য চকমিলানো বাড়ি। তোমার নিজের ঘরখানি পুড়ে গেছে দেখলেই–দহমানে স্বকে গেহে–বারণাবতের জনপদবাসীরা বুঝবে পাণ্ডবরাও মারা গেছেন। অন্তত তখন পাণ্ডবদের মৃত্যুর জন্য আমাদের কেউ দায়ী করতে পারবে না–ন গহঁয়েয়ুরস্মন্ বৈ পাণ্ডবার্থায় কহিঁচিৎ  

পুরোচন দুর্যোধনের সমস্ত কথা শুনে তার এই কাজ মাথায় পেতে নিলেন। কতগুলি অশ্বতর যোগাড় করে বাড়ি তৈরির টাকা-পয়সা নিয়ে তিনি বারণাবতে চলে গেলেন। দুর্যোধন পুরোচনকে বলেছিলেন–আমার টাকার কোনও অভাব নেই। এ রাজ্য যেমন আমারও তেমনই তোমারও–যথেয়ং মম তত্তে…পুরোচন বসুন্ধরা। কাজেই এই সাংঘাতিক কাজে যে দুর্যোধনের টাকার অভাব হবে না এবং এই কাজটি হয়ে গেলে পুরোচনও যে ধনে–মানে-সম্পত্তিতে যথেষ্ট পুরস্কৃত হবেন–সেটা বুঝেই তিনি দুর্যোধনের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ আরম্ভ করলেন পাণ্ডবরা পৌঁছনোর অনেক আগে থেকেই।

 এদিকে পাণ্ডবরাও বারণাবতে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে রাজবাড়ির ভাল ভাল আশুগামী রথের সঙ্গে কাম্বোজদেশজাত উত্তম অশ্ব যোজনা করা হয়েছে। কিন্তু বারণাবতে যেতে তাদের পা সরছে না মোটেই। কেমন করে যুধিষ্ঠির বুঝে গেছেন যে, আর বোধহয় হস্তিনাপুরে তাদের ফেরা হবে না। ভাল মনে বারণাবতে যেতে বললেও এর মধ্যে যেন নির্বাসনের চক্রান্ত আছে। যাবার বেলায় তারা আর্ত মানুষের মতো একবার ভীষ্মের পা জড়িয়ে ধরে বিদায় নিচ্ছেন–পাদৌ জগৃহুরাৰ্তবৎ–একবার দ্রোণ-কৃপের, একবার ধৃতরাষ্ট্রের, কখনও বা বিদুরের পা জড়িয়ে ধরে বিদায়-সম্ভাষণ জানাচ্ছেন।

এইভাবে বৃদ্ধরা যখন তাদের মঙ্গলাশংসা করছেন, সমবয়সীরা যখন বিদায়-আলিঙ্গন জানাচ্ছেন, অল্প বয়সীরা যখন পাণ্ডবদের প্রণাম জানাচ্ছেন, এবং সমস্ত জনপদবাসী যখন যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের জয়কার ঘোষণা করছেন, তখন পাণ্ডবরা কুরুবৃদ্ধা জননীদের প্রদক্ষিণ করে বারণাবতের পথে রওনা হলেন। সমবেত জনপদবাসী প্রশস্ত পথ করে দিলেও রথ চলতে লাগল আস্তে। মহামতি ভীষ্ম অন্যান্য কৌরব কুলীনদের সঙ্গে পাণ্ডবদের পিছন পিছন চললেন কিছুকাল। পিছন পিছন চললেন বিদুর এবং অবশ্যই হস্তিনাপুরের দুঃখিত পৌর-জনপদবাসীরা–পৌরাশ্চ পুরুষব্যাঘ্রান্ অন্বীয়ু শোককর্ষিতাঃ।

 পাণ্ডবরা বারণাবতে যাচ্ছেন বটে, তবে তারা যে বারণাবতের স্থান–মাহাত্মে বা দেব–মহোৎসবের মহিমায় বারণাবতে বেড়াতে যাচ্ছেন না, সেটা তাদের মুখ-চোখ দেখেই বোঝা গেল। পুরবাসী-জনপদবাসীদের অনেকাংশকেই দুর্যোধন টাকা খাইয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলেও পাবলিকের স্বভাবই এইরকম। তারা পাণ্ডবদের দুঃখক্লিষ্ট মুখ দেখে মোটেই আর খুশি রইল না–দীনা দৃষবা পাণ্ডুসুতা অতীব ভূশদুঃখিতা। স্বভাব সরল বলেই তারা তাদের অন্তর্গত ভাবও গোপন করল না মোটেই।

পাণ্ডবদের রথের পিছন-পিছন চলতে চলতে পুরবাসীদের একজন বলেই ফেলল–এই ধৃতরাষ্ট্রটা এক নম্বরের বদমাশ–সর্বথা স সুমন্দধীঃ. এ ব্যাটা নিজের ছেলেদের আর ভাইয়ের ছেলেদের মোটেই এক চোখে দেখে না–বিষমং পশ্যতে রাজা সর্বগ্ন চ সুমন্দধীঃ– নীতি-নিয়ম ধর্মের কোনও বালাই নেই বলেই ধার্মিক যুধিষ্ঠিরকে কেমন করে সে সহ্য করবে। তার মধ্যে ভীম আর অর্জুন যেহেতু শক্তিতেও সবাইকে টেক্কা দিয়েছে, তাই তারাও আর রুচছে না ধৃতরাষ্ট্রের কাছে–ন হি পাপমপাপাত্মা রোচয়িষ্যতি পাণ্ডবঃ। আর ওই নকুল-সহদেবকে তো দেখতেই পারে না পাপী ধৃতরাষ্ট্র।

পুরবাসীরা আইনের প্রশ্নও তুলল। চেঁচিয়ে বলল–কেন বাপু! পাণ্ডবরা তো তাদের বাপের রাজ্যই পেয়েছিল, তারা তো কারও দয়ায় রাজ্য পায়নি রে বাবা। তো ধৃতরাষ্ট্র এদের সহ্য করতে পারল না কেন–তা রাজ্যং পিতৃতঃ প্রাপ্তা ধৃতরাষ্ট্রে ন মৃষ্যতে। পুরবাসীদের মধ্যে অন্য একজন বলল–বেশ তো, ধৃতরাষ্ট্র না হয় এই পাঁচ পাণ্ডব ভাইকে তাড়িয়ে দিলেন, কিন্তু অন্য সব কুরু-কুলীনরা কী করছিলেন তখন? তারা কি ঘুমোচ্ছিলেন তখন? না ভাই, শুধু ধৃতরাষ্ট্র নয়, আমি ভাই কুরু বৃদ্ধ ভীষ্মকেও ভাল বলতে পারছি না। কেন, তিনি কেন বাধা দিলেন না? এমন একটা গভীরপাপ কম্মো হয়ে গেল আর ভীষ্ম সেটা বসে বসে সহ্য করলেন–অধৰ্ম্যম্ ইদমত্যন্তং কথং ভীমোনুমন্যতে। ধৃতরাষ্ট্র না হয় নিজের স্বার্থে ভাইয়ের ছেলেগুলোকে তাড়িয়েই দিলেন। কিন্তু ভীষ্ম! পাণ্ডবদের এই নির্বাসনে তিনি চুপ করে থাকলেন কী করে–বিবাস্যমানা অস্থানে নগরে যোভিমন্যতে।

পুরবাসীরা ভীষ্মকে খুব গালাগালি দিতে পারছে না। কারণ রাজ্যের ব্যাপারে তার কোনও স্বার্থ নেই। কিন্তু সত্যবাদী স্পষ্ট বক্তা বলে তাঁর যে ভূমিকাটা ছিল, সেটাই যেন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে পুরবাসীদের চোখে। একজন তাই বলেই ফেলল–আমরা ভাই সবচেয়ে ভাল ছিলাম ওই মৃত রাজা বিচিত্রবীর্যের সময়ে। বাপের মতন তিনি আমাদের সুখ-দুঃখ দেখেছেন–পিতেব হি নৃপোস্মাক অভূচ্ছান্তনবঃ পুরা। অন্য একজন চেঁচিয়ে বলল–সে কথা যদি বল দাদা, তাহলে বলব–মহারাজ পাণ্ডুর সময়েও আমরা বেশ ছিলাম। আমরা দুর্ভাগা, তিনি অকালে স্বর্গে চলে গেলেন–দেবভাবং গতে সতি–আর সেইজন্যেই তো আজকে এই সোনার পিতিমে ছোট ছোট রাজপুত্রদের ধৃতরাষ্ট্র সহ্যই করতে পারছে না–রাজপুত্ৰান্ ইমান্ বালান্ ধৃতরাষ্ট্রে ন মৃষ্যতে। তা আমরা বাপু এই যুবরাজ যুধিষ্ঠিরকে ছাড়ছি না। এমন বড় শহরে থাকব না সেও ভাল। ঘরবাড়ি ছেড়ে আমরাও বাপু সেইখেনেই চললাম, যেখানে আমাদের যুধিষ্ঠির–গৃহান বিহায় গচ্ছামো যত্র গন্তা যুধিষ্ঠিরঃ।

যুধিষ্ঠির মনে মনে খুশি হলেন নিশ্চয়ই। প্রজাদের আর্তি তাঁকে আবিষ্ট করল। কিন্তু তিনি এমন কিছু করতে পারেন না, বা করতে প্ররোচিত করতে পারেন না, যা রাজকীয় নীতিতে এবং রুচিতে অস্বস্তিকর। ক্ষিপ্ত প্রজাদের পিছন পিছন চলে আসতে দেখে তিনি তাদের সানুনয়ে বললেন–ধৃতরাষ্ট্র আমাদের পিতৃস্থানীয়, আমাদের মাননীয় গুরু। তিনি যা বলেছেন, তার মধ্যে আমরা সন্দেহ প্রকাশ করব না–এই আমাদের ব্রত–অশঙ্কমানৈস্তৎ কার্যমপ্যাভিরিতি নো ব্রত। আপনারা আমাদের পরম বন্ধু। অতএব এখন, যখন আমরা ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ মেনে বেরিয়েই পড়েছি, তখন আপনারা আমাদের প্রদক্ষিণ-আশীর্বাদ করে ঘরে ফিরে যান।

হস্তিনাপুরের প্রজাবৰ্গ যুধিষ্ঠিরের কথা অমান্য করলেন না। যুধিষ্ঠির অন্তত এটা বুঝে গেলেন যে, দুর্যোধন হাজার টাকা-পয়সা খরচা করেও তার প্রিয় প্রজাদের হৃদয় কিনতে পারেননি।

.

১১৪.

 পৌর-জনপদবাসীরা যুধিষ্ঠিরের আদেশ মান্য করে হস্তিনাপুরের দিকে এগোতে লাগলেন। তাদের সঙ্গে ভীষ্ম রওনা হলেন পাণ্ডবদের আশীর্বাদ করে। দু-চারজন লোক তখনও পাণ্ডবদের আশেপাশে চলছে। এই অবস্থায় পাণ্ডবদের পরম শুভার্থী বিদুর যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে খানিক কথা বলবার জন্য এগিয়ে এলেন। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার একজন প্রাজ্ঞ মন্ত্রী বটে, কিন্তু মহারাজ পাণ্ডুর এই অসহায় পুত্রগুলির ওপর তার অসম্ভব মায়া। কুরুবাড়ির জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র এবং তার পুত্রদের ভাবসাব যে পাণ্ডবদের প্রতি মোটেই অনুকূল নয়, সেটা তিনি প্রথম থেকে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই এই অসহায় পিতৃহীন বালকদের প্রতি তিনি পিতৃতুল্য আচরণ করতেন।

 দুর্যোধনের কাছে কয়েকদিন ধরেই একটি প্রায় অচেনা লোককে তিনি আসতে দেখেছেন। হঠাৎ এই লোকটির সঙ্গে দুর্যোধনকে একান্তে গভীর আলোচনা করতে দেখে, অপিচ তাকে অশ্বের বদলে অশ্বতরের পিঠে চেপে বারণাবতের পথ ধরতে দেখেই বিদুর সন্দেহ করেছেন কী ঘটতে যাচ্ছে, অন্তত এটা যে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র, সেটা বুঝতে তার দেরি হয়নি। মহাভারতের সময়কালীন একজন রাজমন্ত্রী বিদুর। সন্দেহ ঘটার পরেও তিনি চুপচাপ বসে থাকেননি। বিশ্বস্ত লোক দিয়ে তিনি দুর্যোধনের কাছে আসা আগন্তুকের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে বলেছিলেন নিশ্চয়।

মহাভারতের কবি লিখেছেন–দুষ্টবুদ্ধি মানুষগুলোর মুখচোখের ভঙ্গি, তাদের ক্রিয়া-কর্ম এবং নানান ব্যবহার প্রক্রিয়া দেখেই বিদুর বুঝে ফেললেন যে দুর্যোধন-পুরোচনরা কী করতে চাইছেন–

তেষামিঙ্গিত–ভাবজ্ঞো বিদুরস্তত্ত্বদর্শিবান্।
আকারেণৈব তং মন্ত্রং বুবুধে দুষ্টচেতসাম্।

 বস্তুত ইঙ্গিত, ভাব আকার এবং চেষ্টা–এই কয়টি শব্দ মোটামুটি তৎকালীন গুপ্তচরবৃত্তির পারিভাষিক শব্দ। মুখের ভাব, চোখের ভাব তো সাধারণ কথা, শত্রুর কথা-বার্তা, ব্যবহার এবং ক্রিয়াকর্ম লক্ষ্য করাটাই গুপ্তচরবৃত্তির প্রধান উপাদান। বিদুর যে লোকটিকে ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখলেন, সে খচ্চরে-টানা রথে করে চলে গেল কেন–প্রায়াদ্রাসভযুক্তেন স্যন্দনেন–যে লোকটি খচ্চরে-টানা রথে করে রওনা হল, সে হস্তিনাপুরের বর্ধমান-পুরদ্বার থেকে বেরিয়ে গিয়ে রথে শীঘ্রগামী ঘোড়া যুতল কিনা–এইসব খুঁটিনাটি খবর যোগাড় করতে বিদুরের দেরি হল না।

আরও একটা জিনিস বিদুর নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন। বারণাবত হস্তিনাপুরের মতো কোনও বড়ো শহর নয়; একটি গ্রাম মাত্র। সেখানে শীঘ্রদাহ্য শন-তৃণ পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই কিন্তু একটি অতিদাহ্য চকমিলানো বাড়ি তৈরি করতে যে পরিমাণ ঘি, লাক্ষা, চর্বি, ধুনো দরকার তা বারণাবতের সাধারণ বাজারে মিলবে না। বিদুর পুরোচনকে নিশ্চয়ই হস্তিনাপুরের বড় বাজারে যেতে দেখেছেন। গুপ্তচরের মুখে তিনি নিশ্চয়ই খবর পেয়েছেন যে প্রচুর ঘৃত-তৈলের বরাত মিলেছে দোকানদারদের, জতু–ধুনোর কণামাত্রও আর পাওয়া যাচ্ছে না হস্তিনাপুরের বিপণীগুলিতে।

সন্ধিগ্ন ব্যক্তির আকার, ইঙ্গিত চেষ্টা তথা ব্যবহার-ক্রিয়া থেকেই তার ভাব বা অভিপ্রায় বোঝা যায়। বিদুর তাই পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে, কুন্তী এবং পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারবার পরিকল্পনা পাকা হয়ে গেছে দুর্যোধনের। বিদুর যদি তার সন্দেহ প্রকাশ করে সোরগোল তুলতেন, তাহলে দুর্যোধন–ধৃতরাষ্ট্ররা সর্বতোভাবে বিদুরের কথা অস্বীকার করতেন এবং তাতে পাণ্ডবদের ওপর তাদের আক্রোশ আরও বাড়ত। অতএব সামনাসামনি কোনওরকম মাথাগরম না করে যে কূটবুদ্ধিতে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনেরা চলছেন সেই কূটবুদ্ধি দিয়েই তিনি উপস্থিত ঘটনার মোকাবিলা করবেন বলে ঠিক করলেন।

 যুধিষ্ঠিরের আশেপাশে তখনও যদি দু-একটি লোক ঘোরাফেরা করছিল, কিন্তু তাতে বিদুরের কোনও অসুবিধে হল না। তিনি ম্লেচ্ছ জনজাতির ভাষা জানতেন। ম্লেচ্ছরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন না, যদি বা বলতেন তাদের উচ্চারণ ছিল একেবারেই অন্যরকম। যেমন কেউ সংস্কৃতে আদাস্যে বলতে আহি বলেন। কেউ বা গৌঃ (গোরু) বলতে গাবী, গোণী, গোতা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন। ম্লেচ্ছ ধাতুর অর্থ-ভাবনায় মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি এই উচ্চারণ-অশুদ্ধির কথাই বলেছেন, কিন্তু অন্যত্র শ্লেচ্ছ বলতে ভারতবর্ষ বহির্ভূত জনজাতি–শক, হুন, পারদ ইত্যাদি জনজাতিকেও বোঝানো হয়েছে। বিদুরকে এখানে বলা হয়েছে প্রলাপজ্ঞ অর্থাৎ যে সব কথা শুনলে অন্যদের কাছে প্রলাপ–বক্য বলে মনে হবে, বিদুর সেই ভাষা জানেন। সত্যি কথা বলতে কি, উচ্চারণের অশুদ্ধিতে যে ভাষা উচ্চারিত হত, সে ভাষা হস্তিনাপুরের জনপদবাসীদের একটু-আধটু বোঝবারই কথা। কিন্তু ভারতবর্ষের বেদাচারহীন অন্যান্য যবন-ম্লেচ্ছদের ভাষা যদি বিদুর ব্যবহার করে থাকেন, তবে সে ভাষা অন্যদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।

 সুখের বিষয়, বিদুর যে ভাষা জানেন, যুধিষ্ঠিরও সেই ম্লেচ্ছ ভাষা জানেন, অতএব এক প্রাজ্ঞ এবং প্রলাপজ্ঞ হলেন বিদুর। অন্য প্রাজ্ঞ এবং প্রলাপজ্ঞ হলেন যুধিষ্ঠির। একজন আরেকজনকে বললেন অন্য ভাষায়, যা বুঝতে এবং বোঝতে কারুরই অসুবিধে হল না–প্রাজ্ঞঃ প্রাজ্ঞং প্রলাপজ্ঞঃ প্রলাপজ্ঞং বচোব্রবীৎ। বিদুর বললেন–কিন্তু ম্লেচ্ছ ভাষায় বললেও তিনি বেশ রেখেঢেকে বললেন, যদি ম্লেচ্ছ ভাষাও কেউ বুঝে নেয়। অতএব প্রলাপ-বকার মতোই বিদুর যুধিষ্ঠিরকে বললেন–এতদিন তো রাজনীতির বিষয় ভরদ্বাজ-নীতি, কণিক-নীতি অনেক পড়েছ। সেই নীতিশাস্ত্রের বুদ্ধিগুণে এবং অভিজ্ঞতায় শত্রুর উদ্ভাবিত কূটকৌশল যাঁরা বোঝেন, তারা কিন্তু বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার উপায়ও বার করে ফেলেন–বিজ্ঞায়েহ তথা কুর্যাদাপদং নিস্তরে যথা।

বিদুর এবার একটু ইঙ্গিত করে বোঝাতে চাইলেন যে, কী ধরনের বিপদ যুধিষ্ঠির এবং তার ভাই তথা জননীর জন্য অপেক্ষা করছে। বিদুর বললেন–দেখ বাপু! এমন অস্ত্রশস্ত্রও কিন্তু অনেক আছে, যা লোহা দিয়ে তৈরি করতে হয় না, অথচ সেসব শস্ত্র মানব-শরীর শেষ করে দিতে পারে–অলোহং নিশিতং শস্ত্রং শরীর-পরিকর্তন। যে মানুষ বিপদ প্রতিকারের জন্য ভাবনা করে, সে কিন্তু লোহার তৈরি নয়, এমন ধারালো অস্ত্রের কথাটাও মাথায় রাখবেন।

বিদুর ম্লেচ্ছ ভাষায় কথা বললেও, তিনি যা বলেছেন, মহাভারতের কবি তা আমাদের বোঝানোর জন্য সংস্কৃতে অনুবাদ করে দিয়েছেন। টীকাকার নীলকণ্ঠ বা আরও অন্য বিখ্যাত টীকাকারেরাও এই সংস্কৃত শ্লোকের মধ্যেও প্রকৃতি-প্রত্যয় এবং ব্যাকরণ জ্ঞানের মুন্সিয়ানা করে তার মধ্যে ভবিষ্যৎ অগ্নিকাণ্ডের ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করেছেন। যেমন অলোহং বলতে নীলকণ্ঠ বলেছেন–এটা আসলে অনল শব্দের মধ্য-বর্ণ লোপ করে অল বলা হল বটে কিন্তু তিনি বোঝাতে চাইলেন অনল। অল শব্দের সঙ্গে সন্ধি হয়েছে উহ শব্দের। উহ মানে সমূহ। তার মানে অলোহ মানে দাঁড়াল অনল-সমুহ।

নীলকণ্ঠ ব্যাকরণজ্ঞানের সক্ষমতায় ব্যাসলিখিত সংস্কৃত শব্দগুলি নিয়েই প্রচুর ব্যায়াম করেছেন বটে, তবে আমাদের মনে হয় লুপ্তবর্ণ বা অধিকবর্ণ সংযোগে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, তা থেকে বক্তার অভীষ্ট বুঝে নেওয়া যত কঠিন, অন্য যবনজাতি ব্যবহৃত ভাষা তার থেকে সহজ। আমাদের দুর্ভাগ্য, মহাভারতের কবি সেই ম্লেচ্ছ-যবনের ভাষার নমুনা কিছু দেননি। দিলে আমাদের জ্ঞানী ঐতিহাসিকেরা বলে দিতে পারতেন–মহাভারতের কালে কোন কোন বিদেশি মানুষ আমাদের অতিথি হয়েছিলেন এবং তাদের সঙ্গে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে বিদুর-যুধিষ্ঠিরের মতো মহামতি ব্যক্তিরা সেই ভাষায় জ্ঞানলাভ করা প্রয়োজন মনে করেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য মহাভারতের কবির মহাকাব্যের ইন্দ্রজালে ইতিহাসের এই পরম প্রিয় ভাবনাটুকু ধরা পড়ল না। অন্যদিকে এও ঠিক যে, ধরা যখন পড়লই না, তখন ব্যাকরণের ব্যায়ামে সহজবোধ্য সংস্কৃতের মধ্যে আর নতুন আবিষ্কার

করাই ভাল। কারণ মহাভারতের কবি যে ভাষায় এখানে তর্জমা করেছেন, বিদুর সে ভাষায় কথা বলেননি। নীলকণ্ঠ নিজেও তা স্বীকার করেছেন–যদ্যপি যুধিষ্ঠিরং প্রতি বিদুরেণ ম্লেচ্ছভাষায় উক্ত, তথাপি ব্যাসেন তৎ সংস্কৃতেনৈরোপনিবদ্ধমিতি।

অলৌহনির্মিত অস্ত্রশস্ত্রের বিপন্নতায় কীভাবে বাঁচতে হবে, তার উপায় বলবার সময়েই বিদুর আগুন-লাগার ইঙ্গিতটি করে দিয়েছেন। কাজেই সেই কারণেও আগের শ্লোকের অত ব্যবচ্ছেদের প্রয়োজন নেই। বিদুর বলেছেন–দেখ বাপু! শুকনো গাছের ছোট্ট বনে যখন আগুন লাগে, তখন সেই আগুনই বড় বনের শুকনো গাছে গিয়ে লাগে। বারণাবতের নির্মাতব্য চকমিলানের বাড়ি আর ছোট্ট পুরোচনের ঘরটির ইঙ্গিত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিদুর বললেন–এমন দাবানলেও কিন্তু জীবজন্তু কিছু বেঁচেই যায়। আগুন লাগলেও যাতে না মরি, এমন ভাবনা পরিষ্কার না থাকলেও পশুজগতে এমন প্রাণী আছে, যারা সেই ভাবেই থাকে যাতে তাদের মরার ভয় থাকে না। তারা ঠিক বাঁচেন দহেদিতি চাত্মানং যো রক্ষতি স জীবতি।

 এখানে ইঙ্গিতটা অবশ্য ইঁদুরের দিকে। বনের মধ্যে আগুন লাগলেও গর্তবাসী ইঁদুরের কোনও ভয় নেই। মাটির তলায় সুড়ঙ্গপথে তার রাজ্য। এধার দিয়ে ঢুকে অন্য জায়গা দিয়ে সে বেরবে, সেখানে আগুনের ভয় নেই। এখানে যুধিষ্ঠির যদি বুঝে নেন,–যে, বেশ তো তাহলে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে থাকব, মাটির তলায়! কিন্তু বিদুর জানেন তাতে শেষরক্ষা হবে না। আগুন থেকে বাঁচলেও মাটির তলায় দম বন্ধ হয়ে মরতে হবে সবাইকে। বিদুর তাই আরও একটু উপদেশ দিয়ে বললেন–দেখ যুধিষ্ঠির! যার চোখ নেই সে পথ দেখতে পায় না, দিক্-নির্ণয়ও করতে পারে না। অর্থাৎ বিদুর বলতে চাইছেন–মাটির তলায় গর্তে লুকোলেও আর তিনটি বস্তুর প্রয়োজন আছে সেখানে। অর্থাৎ মাটির তলাতেও পথ দেখতে হবে, দিক্-নির্ণয় করতে হবে এবং সেই পথ বানানোর ধৈর্যও রাখতে হবে।

 বিদুর আরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন বন্য প্রাণীর সাজাত্যে। বললেন–গর্তের ভিতরে আশ্রয় নেওয়া সত্ত্বেও মানুষ যদি শত্রুর দেওয়া আগুনের উত্তাপে কষ্ট পায়, তবে শজারুর মতো গর্তের অপর প্রান্তে গিয়ে সেই উত্তাপ থেকে মুক্তি পেতে হবে–শ্ববিচ্ছুরণমাসাদ প্রমুচ্যেত হুতাশনাৎ।  অর্থাৎ ইঁদুরের মতো থাকলে চলবে না, থাকতে হবে শজারুর মতো। ইঁদুর গর্তে লুকোয় বটে কিন্তু তার গর্তের মুখ একটাই। কিন্তু যে গর্তে শজারু থাকে তার প্রবেশদ্বার এবং নির্গমনদ্বার একটাই হয় না। দুটো তো বটেই এমনকি তার বেশিও হতে পারে। বস্তুত নিজের গায়ের কাঁটা এমনভাবেই শজারুর দেহে সাজানো থাকে যে, প্রতিলোম পথ চলতে তার অসুবিধে হয়। সেইজন্যই সে মাটির তলায় সুড়ঙ্গ খুঁড়ে অন্য জায়গায় বেরনোর পথ করে নেয়। বিদুর যুধিষ্ঠিরকে তাই করতে বলছেন। তাতে অন্তত গর্তের মধ্যে উত্তাপে দম বন্ধ হয়ে মরতে হবে না।

যদি এমন প্রশ্ন হয়। ঢোকার পথ, বেরনোর পথ, এসব খুঁজতে হবে কীভাবে? বিদুর বললেন–মানুষ আগে থেকেই ঘুরে-ফিরে দিনের বেলায় সব জায়গাগুলো দেখে রাখে। ক্ষত্রিয়ের মৃগয়ার ছলেই হোক, একাকী ভ্রমণের ছলেই হোক, জায়গাগুলো চিনে রাখতে হবে আগে থেকে এবং দিনের বেলায়। সুড়ঙ্গ কেটে যেখানে বেরনো গেল, সেখান থেকে পথ চিনে পালাতে হবে। দিনের বেলায় যদি জায়গা চিনে রাখা যায় তবে রাত্রিতে আকাশের তারা দেখেই বোঝা যাবে কোন দিকে গেলে সুরক্ষিত রাখা যাবে নিজেদের–চরন্ মার্গা বিজানাতি নক্ষত্রৈ-বিন্দতে দিশঃ। বিদুর বলে দিলেন–তোমরা সবাই মিলে ছজন, যেভাবে পালাতে হবে তার কষ্ট কম নয় কিছু; সবাইকেই কষ্ট সইতে হবে বটে, তবে এই উপায়ে মৃত্যুর কষ্ট থেকে অন্তত রেহাই পাওয়া যাবে।

 অন্যান্যদের সামনেই বিদুর এত সব কথা বললেন, তারা এই প্রলাপের বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারল না। কিন্তু যুধিষ্ঠির সব বুঝলেন–এবমুক্তঃ প্রত্যুবাচ তমিত্যেব পাণ্ডবঃ। তিনি বিদুরকে সন্দেহমুক্ত করে বলে দিলেন যে, আমি সব বুঝেছি। আশ্চর্য–বক্তা কুশলোস্য লব্ধা। দবিদুর আরও কিছুদূর পাণ্ডবদের পিছন পিছন গেলেন এবং শেষে সাদর-আশীর্বাদ করে বাড়ি ফিরে গেলেন। সবাই যখন চলে গেছেন, রথের গতি যখন কিঞ্চিৎ দ্রুততর হয়েছে, তখন জননী কুন্তী তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের সামনে এসে বললেন–বিদুর যে সবার সামনে কী আবোল-তাবোল বলে গেলেন, যা না বললেই বোধহয় ভাল ছিল, তিনি যেন পরিষ্কার করে কিছু বলতেই চাইলেন না।–ক্ষত্তা যদবী বাক্যং জনমধ্যে ব্রুবন্নিব। আবার তুমিও বাছা! সেই অদ্ভুত কথা শুনে বললে–সব বুঝেছি। কিন্তু বাছা! আমরা তো এসব কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না–ত্বয়া চ স তথেত্যুক্তো জানীমো ন চ তদ্বয়ম্। তা বাছা! যদি মনে করো সে সব কথা আমরাও বুঝব অথবা যদি মনে করো যে, সে সব কথা খুলে বললে অন্য কোনও দোষের সম্ভাবনা নেই, তবে–যদীদং শক্যমপ্যাভি–তুং ন চ সদোষবৎ–তাহলে বলো না বাছা তোমাদের মধ্যে কী কথা হল?

 যুধিষ্ঠির কথা লুকোলেন না। তিনি ভাবলেন–বিদুর যা বলেছেন তা যদি সত্যি হয়, তবে সেই দুর্ঘটনা আকস্মিকভাবে তার মা-ভাইদের ওপরে না নেমে আসাই ভাল। বরঞ্চ এ ব্যাপারে যদি সকলের মানসিক প্রস্তুতি থাকে তো সেটা ভালই হবে। যুধিষ্ঠির বললেন–বারণাবতে আমাদের ঘরে আগুন লাগানো হবে, মা! সেটা যেন আমাদের জানা থাকে। বিদুর তাই সাবধান করে দিলেন–গৃহাদগ্নিশ্চ বোদ্ধব্য ইতি মাং বিদুরোব্রবীৎ। তিনি আরও বলে দিলেন– সেখানকার কোনও পথ যেন আমাদের না অজানা থাকে। আমরা যদি আমাদের বিপন্ন অবস্থাতেও কাম-ক্রোধ জয় করে ইন্দ্রিয়গুলি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, তবে আবারও আমরা রাজ্য লাভ করব। বিদুর সে কথাও বলে দিলেন।

জননী কুন্তী কিছু কচিকাঁচা খুকী নন যে, ঘরে আগুন লাগবে শুনে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়বেন। তিনি রাজবাড়ির মেয়ে, রাজার ঘরে তিনি মানুষ হয়েছেন এবং হস্তিনাপুরের রাজবধূ হয়ে আসা ইস্তক তাকে যে সব পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলতে হয়েছে, অপি চ স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে অসহায় পুত্রদের নিয়ে তিনি যেভাবে কাল যাপন করছেন, তাতে এই আগুন লাগানোর কথায় কোনও ভাবান্তর হল না তার। অন্তত মহাভারতের কবি সে কথা বলেননি একবারও। যুধিষ্ঠির বললেন এবং কুন্তী শুনলেন এই পর্যন্ত।

এতক্ষণ বিদুরকে যেমনটি দেখলাম সেটাও বেশ ভাবনা করার মতো। আমি দেখেছি মহাভারতের প্রখ্যাত চরিত্র অর্জুনের কথা বলুন, কি ভীমের কথা বলুন তো সবার চোখ চকচক করে উঠবে। এমনকি কর্ণের কথা বলুন, কি দুর্যোধনের কথা বলুন তাতেও বেশ আগ্রহ আছে। কিন্তু যেই বিদুরের কথা বলবেন–অমনই দেখবেন আর শুনতে চাইছেন না কেউ। তারা বলেন–ও মশাই এক মিনমিনে চরিত্র, খালি ধর্মকথা বলেন, কেমন যেন ব্যক্তিত্ব নেই কোনও।

আমি আমার কথা বলি–সারা মহাভারত জুড়ে বিদুরের মতো এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর দ্বিতীয়টা চোখে পড়েনি আমার। রাজবাড়ির আয়-ব্যয়, সন্ধি-বিগ্রহ–ইত্যাদি রাজনৈতিক তাত্ত্বিকতায় যেমন তার কোনও জুড়ি নেই, তেমন প্রখর তার বাস্তববোধ। পাণ্ডু মারা যাবার পর হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে পাণ্ডবদের দুর্বল স্থিতি বুঝেই তিনি নিজে তাদের সুরক্ষার ভার নিয়েছেন। ভীমকে বিষ খাওয়ানোর পরেও তিনি দুর্যোধনের অন্যায় সেইভাবে প্রকাশ করতে দেননি পাণ্ডবদের এবং তিনি নিজেও কিছু বলেননি। কারণ তিনি জানতেন যে, দুর্যোধনের অন্যায় ধৃতরাষ্ট্র বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে দুর্যোধনকে চিনে নিয়েছেন তিনি। সদা-সর্বদা তার ওপরে নজর রেখে আজ তিনি এটাও বুঝেছেন যে, দুর্যোধন কী করতে চলেছেন। দুর্যোধনের এই দুর্মন্ত্রণাও তিনি ব্যক্ত করবেন না অথচ তার কাজগুলি একেবারে পাক্কা গোয়েন্দাদের মতো। বিদুর সময়ের অপেক্ষা করছেন যেদিন পাণ্ডবরা নিজের ক্ষমতা এবং নিজের গুণেই অধিষ্ঠিত হবেন হস্তিনাপুরের পিতৃরাজ্যে।

ফাল্গুন মাসের আট দিনের দিন পাণ্ডবরা পৌঁছলেন বারণাবতে। এখনকার দৃষ্টিতে বারণাবত জায়গাটা যে হস্তিনাপুর থেকে খুব দূরে তা নয়, বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাসুতসোম জাতকে হথিনীপুর বলে যে জায়গাটির নাম পাওয়া যায় তা অবশ্যই আমাদের মহাভারতের হস্তিনাপুর। কিন্তু এখানেই বলা আছে হখিনীপুর বা হস্তিনাপুরের চারপাশে কতগুলি ছোট্ট ছোট্ট টাউনশিপ এবং গ্রাম ছিল যেগুলিকে বলা হয়েছে নিগম! এই ছোট শহর বা গ্রাম-নামের মধ্যে আছে থুল্লকোটুঠিত, কস্মাসদম্ম, কুণ্ডি এবং অবশ্যই বারণাবত। আধুনিক পণ্ডিতেরা বর্তমান ভারতবর্ষের মিরাট জেলার অন্তর্গত বরনব নামের একটি জায়গার সঙ্গে বারণাবতকে একাত্মক করে দেখিয়েছেন। তারা বলেন, হিন্দোন আর কৃষ্ণা নদীর মিলন হয়েছে। যেখানে তার ওপরেই গড়ে উঠেছে বারণাবর্ত বা এখনকার বরনব জনপদ।

আমরা একথা মানি, কেন না হস্তিনাপুর অঞ্চলটি মিরাটের মধ্যেই পড়ে। হয়তো তার কাছাকাছি ছিল এই ছোট্ট জনপদ। আমরা পূর্বে হস্তিনাপুরের নামসাম্যে বলার চেষ্টা করেছি যে, এখানে পূর্বে নাগ জনজাতির বাস ছিল। বারণাবত শব্দের আগেও ওই হস্তীর পর্যায়বাচক বারণ শব্দটি থাকায় বারণাবত নামের জায়গাটিকে আমরা বারণসাহয়, নাগসাহুয় বা হস্তিনাপুরের স্যাটেলাইট টাউন বলে মনে করি।

যাই হোক বারণসায়ের যুবরাজ এসেছেন বারণাবতে। এসেছেন তার চার ভাই এবং জননীকে সঙ্গে নিয়ে। ছোট্ট জনপদের মধ্যে আনন্দের ধুম পড়ে গেল। দূর দূর জায়গা থেকে নানা শ্রেণীর লোকেরা কেউ রথে চড়ে, কেউ ঘোড়ায়, কেউ বা অশ্বতরের পিঠে চেপে, আবার কেউ বা হেঁটে চলে এল সমাতৃক পাণ্ডবদের অভ্যর্থনা জানাতে–শ্রুত্বাগতা পাণ্ডুপুত্ৰান্ নানাযানৈ সহস্রশঃ। জনপদবাসীদের হাতে মাঙ্গলিক দ্রব্য-দুই-দুব্বে-ধান। সমস্ত লোকের মুখে তাদের মনের যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের জয়কার শব্দ শোনা গেল। কেউ আশীর্বাদ করছেন যুধিষ্ঠিরকে, কেউ শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, কেউ বা শুধু কাছে যাবার চেষ্টা করছেন যুবরাজের। সমস্ত মানুষ যুধিষ্ঠিরকে ঘিরে ধরে অভ্যর্থনা জানাল–কৃত্বা জয়াশিষঃ সর্বে পরিবাৰ্য্যাবতস্থিরে।

 হায়! যুধিষ্ঠির তখন জানেনও না, অথবা খুব ভালভাবেই জানেন যে, তাঁর যুবরাজ পদ চলে গেছে। তবু বারণাবতের জনপদবাসীদের এই উদ্বেলিত আনন্দস্রোত তিনি স্তব্ধ করে দিলেন না। প্রকাশ করলেন না কুরুবাড়ির অন্তর-মন্ত্রণা। যুধিষ্ঠিরকে ভারি সুন্দর লাগছিল। জনগণের মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে দেখতে লাগছিল দেবতাদের মধ্যে দাঁড়ানো ইন্দ্রের মতো। পুরবাসীদের আপ্যায়ন-অভ্যর্থনা শেষ হলে যুধিষ্ঠির তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বারণাবতের মূল কেন্দ্রভূমিতে প্রবেশ করলেন।

একটি নতুন জায়গায় গেলে কীভাবে সেই অঞ্চলের মানুষদের মন পেতে হয়, সেই রাজনৈতিক বুদ্ধিটুকু যুধিষ্ঠিরের যথেষ্টই আছে। নগরে প্রবেশ করেই যুধিষ্ঠির আগে দেখা করতে গেলেন বারণাবত-নিবাসী ব্রাহ্মণ-সজ্জনদের বাড়িতে। ব্রাহ্মণরা সমাজমুখ্য এবং শিক্ষা-দীক্ষায় সমস্ত জাতির মধ্যে অগ্রগণ্য বলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন যুধিষ্ঠির। আপন বিনয়-শিক্ষা এবং বিনম্রভাবে তাদের মন পেতে দেরী হল না তার। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দেখা করে যুধিষ্ঠির দেখা করলেন নগরপাল ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে। তারা আপন ওজস্বিতায় নগর রক্ষা করছেন, বারণাবতবাসী প্রজাদের পালন করছেন। অতএব তাঁদের সঙ্গে মেলামেশা পরিচিতি দরকার–নগরাধিকৃতানাঞ্চ গৃহাণি রথিনাং তথা। বৈশ্য এবং শূদ্ররা-আধুনিকেরা যাঁদের মনে করেন সেকালের অপদস্থ দাসানুদাস–যুধিষ্ঠির কিন্তু ভাইদের সঙ্গে নিয়ে তাদেরও বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা করলেন–উপতভু-নরশ্রেষ্ঠা বৈশ্য-শূদ্রগৃহাণ্যপি।

 জনপদবাসী সকলের সঙ্গে ধুলো পায়ে দেখা করলেন যুধিষ্ঠির। হস্তিনাপুরের যুবরাজের পদ ছেড়ে এলেও যুবরাজের মর্যাদা এবং কর্তব্য কোনওটাই ভোলেননি তিনি। বারণাবতের পৌর-জনপদবাসী যেভাবে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, ঠিক তেমনি সাদরে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলের সঙ্গে দেখা করে তাঁদেরও নাগরিক মর্যাদা রক্ষা করলেন যুধিষ্ঠির।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *