০১৫. ভীষ্ম তখনও শরশয্যায়

১৫.

ভবিষ্যতের কথা এখনই প্রসঙ্গত এসে গেল। পিতামহ ভীষ্ম তখনও শরশয্যায় শুয়ে আছেন। আর যুধিষ্ঠির তার ভাইদের সঙ্গে কৃষ্ণের সঙ্গে ঘিরে বসে আছেন। শরশয্যায় শুয়ে শুয়েই ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। রাজনীতি, ধর্মনীতি, দেবতা, অসুর–কত কথাই না আসছে। প্রশ্নের পর যুধিষ্ঠির হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা ঠাকুরদাদা! তুমি তো সব শাস্ত্রই জান। তো আমার একটা কথার উত্তর দাও। আমার প্রশ্ন–এ জগতে দৈবই বড়, না, পুরুষকার বড়?

পিতামহ ভীষ্ম কষ্ট-ক্লমহীন নীরোগ মানুষটির মতো বলে উঠলেন–আরে! ঠিক এই প্রশ্নই তো স্বয়ং বশিষ্ঠমুনি করেছিলেন পিতামহ ব্রহ্মাকে। ব্রহ্মা জ্ঞানী-গুণী মানুষ। চতুর্বেদ তার কণ্ঠভূষণ। সেখানে ব্ৰহ্ম যেমন করে প্রশ্নটার উত্তর দিয়েছিলেন, সেটাই তুমি শোনো। ব্রহ্মা বলেছিলেন-বীজ ছাড়া শস্য হয় না, বীজ ছাড়া ফলও হয় না। বীজ থেকেই বীজ। বীজ থেকেই ফল। একজন কৃষক ক্ষেতে যে ধরনের বীজ ছড়ায়, সেই রকমই শস্য পায়। খুব খানিকটা হাল চালিয়ে ক্ষেতটাকে বীজ ছড়ানোর উপযুক্ত করা হল, তারপর ধর, বীজটাই বপন করলাম না। তার ফল কী? জমিটা নিষ্ফলা যাবে। ঠিক তেমনই পুরুষকার ছাড়া দৈবও কিছু করতে পারে না। ক্ষেত হল দৈব, বীজ হল পুরুষকার।

ব্রহ্মা ক্ষেত্র-বীজের কথা বলেই মানুষের জীবনে চলে এলেন। বললেন–যেমন কর্ম তেমন ফল। ভাল কাজ করো, ভাল ফল পাবে। পুণ্যের কাজ করো সুখ পাবে। পাপের কাজ করো, দুঃখ পাবে। যে লোক কাজ করে, খাটে, সে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে না, ভাগ্য তাকে সহায়তা করবে না–এ হতেই পারে না-কৃতী সর্বত্র লভতে প্রতিষ্ঠাং ভাগ্যসংযুতা। তুমি কাজ করো, সৌভাগ্য তোমার হাতের মুঠোয়, শুধু দৈব নিয়ে বসে থাকলে হবে না। পুরুষকার প্রয়োগ করো, ভোগ, সুখ স্বর্গ–তুমি যা চাও তাই পাবে–প্রাপ্যতে কর্মর্ণা সর্বং ন দৈবাদকৃতত্মনা।

ব্রহ্মা জীবনের কথা ছেড়ে এবার বাস্তব উদাহরণে আসছেন। তিনি বললেন–এই যে চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা, এত সব দেবতা, নাগ, যক্ষ–এরা সবাই মানুষ ছিলেন, কিন্তু শুধু পুরুষকারের দ্বারা এঁরা দেব-পদবি লাভ করেছেন-সর্বে পুরুষকারেণ মানুষ্যাদেবতাং গতাঃ।

দেখুন, দৈব কিংবা পুরুষকারের যে বিতণ্ডা, তাতে আমি একটুও আগ্রহী নই। আমার আগ্রহ শুধু একটা কথা নিয়ে–সবাই মনুষ্যভাব থেকে দেবত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন–মানুষ্যা দেবতাং গতাঃ–শুধু এই কথাটুকুই আমার দরকার। উপরের শ্লোকটিতে দেবতা, নাগ, যক্ষের কথা বলা আছে, কিন্তু দৈত্য-দানবের কথা বলা নেই। নেই যে, তার বড় কারণ কিছু নেই। আসলে দেবতা, দৈত্য, দানব, যক্ষ, রাক্ষস নাগ–এঁরা সব এক পিতার পুত্র। মহাভারতের কবির বাঁধা কথাটা যেটা প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়, তা হল

দেব-দানব-গন্ধর্বা দৈত্যাসুর-মহোরগাঃ।
যক্ষ-রাক্ষস-নাগাশ্চ পিশাচা মনুজা স্তথা।

মহাভারতের কবি যে মোটামুটি একটা ক্রম দিলেন, এই ক্রমটাই পরবর্তীকালে দার্শনিক বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।

সাংখ্য-দর্শনের প্রবক্তা ঈশ্বরকৃষ্ণ লিখেছেন–দেব-শরীর আট রকমের–অষ্টবিকল্লো দৈবঃ। তারা কারা? টীকাকার লিখলেন ব্রহ্মা, প্রজাপতি, ইন্দ্র, পিতৃগণ, গন্ধর্ব, নাগ, রাক্ষস এবং পিশাচ। পিশাচ থেকে ধরে একেবারে ব্রহ্মা পর্যন্ত– এঁরা পরপর উঁচু স্তরের জীব। এরা দেবযোনি, যেহেতু এঁদের মধ্যে সত্ত্বগুণ বেশি। কিন্তু এই সত্ত্বগুণটাও পিশাচের চেয়ে রাক্ষসের মধ্যে বেশি, রাক্ষসদের থেকে নাগদের মধ্যে বেশি। এইভাবে ব্রহ্মা পর্যন্ত,-যেটাকে শঙ্করাচার্য। বলেছেন–জ্ঞান এবং ঐশ্বর্যের প্রকাশটা এদের মধ্যে পরপর বেশি–পরেণ পরেণ ভূয়সী ভবতি।

কঠিন কথা বলে আরম্ভ করেছি, তাই বলে কঠিনভাবেই চালিয়ে যাব না। আমাদের কথাটা হল-ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতারা তথা অসুর-রাক্ষস-নাগ-গন্ধর্বরা–এদের জন্ম-পদবি এক –এরা সকলেই দেবতা, দেবযোনি। এঁদের কেউ বেশি ভাল, কেউ একটু মন্দ। কিন্তু দেবতা হওয়া সত্তেও এরা যে মনুষ্যধৰ্ম অতিক্রম করে গেছেন, তা মোটেই নয়, সাংখ্যের দার্শনিক লিখেছেন-জরা-মরণের কষ্ট দেবতাদেরও আছে। তবে তা একটু অন্যরকম। মানুষের যেমন–গায়ের রং পুড়ে গেল, দাঁত পড়ে গেল, লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারি না–ঠিক এমনটা না হলেও দেবতাদেরও বার্ধক্য কিংবা মরে যাবার কষ্ট আছে–সচ দেবভূমাবপি ভবতি।

আমরা বলি–সে আবার কী? সারা জীবন কত শুনেছি–এই মর্ত্যভূমিতে জন্মেই যত কষ্ট! সেই মাতৃগর্ভে জন্ম থেকে কষ্ট আরম্ভ হয়, তারপর কিছুদিন ভালয়-মন্দে যেতে না যেতেই বার্ধক্য শুরু হয়ে গেল, আরম্ভ হল রোগ-ভোগ, তারপর মৃত্যু তো আছেই। দার্শনিক বললেন–স্বর্গের দেবতাদের যত সুখ ভাবছ, তত সুখ মোটেই নয়। হ্যাঁ, জন্মের ব্যাপারটায় দেবতাদের অত কষ্ট নেই সত্যি, কারণ দেবতাদের জন্ম নাকি-তড়িদবিলসিতবৎ-চক্ষের নিমেষে তারা জন্ম নিতে পারেন, কিন্তু তাই বলে দেবভূমিতে রোগ-শোক নেই, জরা নেই, মৃত্যু নেই–এমনটি মোটেই নয়।

সাংখ্যের যুক্তিদীপিকার লেখক রীতিমতো বেদের প্রমাণ দিয়ে বলেছেন–জানেন, এই যে ইন্দ্র, তাঁর একবার প্রচণ্ড অনিদ্রা রোগ হয়েছিল। দিনে-রাতে কখনই তার ঘুম আসে না। তিন ভুবনে এমন বৈদ্য-চিকিৎসক ছিলেন না, যাঁরা ইন্দ্রের অনিদ্রা রোগ সারানোর জন্য চেষ্টা করেননি। দিন দিন তিনি রোগা হয়ে যেতে লাগলেন। শেষে ঋষিরা তাঁকে ‘ত্বাষ্ট্রীয়’ সামগান শোনাতে আরম্ভ করলেন। সামগানের মধুর শব্দের ইন্দ্রে অনিদ্রা রোগ সেরে গেল–ইং ক্ষামমপি ন সর্বভূতানি প্রস্বাপয়িতুং নাশকুব। তমেতেন সাম্না ত্বষ্ট্ৰীয়েণ অস্বাপয়ৎ।

আমরা বলব-বেদের প্রমাণ তো আর অস্বীকার করতে পারব না। কিন্তু ওই একটা উদাহরণ থেকে কীই বা বোঝা যায়? সাংখ্য-কারিকার টীকাকার বলবেন–শুধু কি ইন্দ্র! স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মর শরীর শুকিয়ে গিয়েছিল বায়ু-রোগে। আর চন্দ্র, তিন ভুবনকে স্নিগ্ধ আলোর জ্যোৎস্না-ধারায় স্নান করিয়ে দেন যিনি, তার যে কঠিন যক্ষ্মা হয়েছিল-প্রজাপতে বায়ু-রক্ষয়ীৎ, দক্ষাভিশাপাচ্চ সোমস্য ক্ষয়ঃ।

কথাটা শুনেই অবহিত হয়ে বসতে হবে আমাদের। দু’দণ্ড পরেই মহাভারতে শান্তনু, ভীষ্ম অথবা কুরু-পাণ্ডবের কত কাহিনী শুনব। কিন্তু কুরু-পাণ্ডবের বংশের নামই যে চন্দ্র-বংশ। মহামান্য দেবতাদের অন্যতম যে চন্দ্র, তিনিই তো কুরু-পাণ্ডবের বংশ-মূল, তার আবার যক্ষ্মা হল কবে? তিনি কি আমাদের মতো মানুষ নাকি, যে যক্ষ্মায় কাবু হবেন তিনি! দর্শনের টীকাকার বলবেন–আমাদের মতো সাধারণ মানুষ না হলেও স্বর্গভূমিতে বসে তার এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হয়নি। অর্থাৎ দেবতা হলেও রোগ-ভোগের কষ্ট থেকে তার পরিত্রাণ নেই। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, মানুষের তুলনায় তিনি কিছু বড়-মানুষ বটে, হ্যাঁ তার, জ্ঞান-ঐশ্বর্য মানুষের থেকে বেশ খানিকটা উঁচু স্তরের বটে, কিন্তু বোগ-শোক, জরা-মরণ তারও আছে।

আমরা চমকিত হয়ে বলব–কুরু-পাণ্ডব বংশের প্রথম জনক মহান চন্দ্র দেবতার এই গুরুতর অস্পৃশ্য অসুখের কথা কি মহাভারতের মধ্যে পাব? তাহলে তো আগে-ভাগে সেই অসুখের খবরটাই নেওয়া দরকার। একটি রোগগ্রস্ত অসুস্থ দেবতার খবর মহাভারতের মধ্যে পেলে একদিকে যেমন দেবতার মনুষ্য-ধর্মিতা জরা-মরণশীলতা আমাদের কাছে ব্যাখ্যাযোগ্য হয়ে উঠবে, তেমনই অন্যদিকে কুরু-পাণ্ডব বংশের প্রথম প্রতিষ্ঠাতার প্রতি কিছু সমবেদনাও জানানো সম্ভব হবে এই সুযোগে। ঘটনাটা ছিল এইরকম।

প্রজাপতি দক্ষের সাতাশটি মেয়ে ছিল। অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা–ইত্যাদি নামে যে সাতাশটি নক্ষত্রের নাম আমরা জানি, দক্ষের মেয়েরা হলেন এই সাতাশ নক্ষত্র-সুন্দরী। দক্ষ এই সাতাশটি মেয়েকে এক সঙ্গে চন্দ্রের হাতে সম্প্রদান করলেন- সপ্তবিংশতিং কন্যাং দক্ষঃ সোমায় বৈ দদৌ। দক্ষের সাতাশ মেয়ে সাতাশ জন নক্ষত্র সুন্দরীরূপে-গুণে তারা কেউ কম নন। কিন্তু এদের মধ্যে রোহিণী ছিলেন সবচেয়ে সুন্দরী–অত্যরিচ্যত তাসান্তু রোহিণী রূপ-সম্পদা। সে সৌন্দর্য এমনই অপ্রতিম যে, চন্দ্র তাঁর রূপের মোহে তার অন্য স্ত্রীদের অবহেলা করতে লাগলেন। সব সময় তিনি রোহিণীর ঘরেই পড়ে থাকেন, রোহিণীকেই ভালবাসেন, রোহিণী ছাড়া তিনি আর দ্বিতীয় কিছু জানেন না। চন্দ্রের এই আচরণে অন্য নক্ষত্র সুন্দরীরা সবাই ভীষণ রেগে গেলেন। নিজেদের সহোদরা বোনটি হলে কী হয়, স্বামীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হতে কার ভাল লাগে!

ছাব্বিশ নক্ষত্র-সুন্দরী স্বামীর ওপর অভিমান করে এক সঙ্গে দল বেঁধে বাপের বাড়ি চলে এলেন। পিতা দক্ষের কাছে সকলে মিলে নালিশ করলেন-দেখ বাবা এত তোড়জোড় করে তুমি চন্দ্রের সঙ্গে আমাদের বিয়ে দিলে, কিন্তু স্বামী আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। তারা যত সোহাগ সব ওই তোমার আদরের মেয়ে রূপেশ্বরী রোহিণীর ওপর। সব সময় তাঁর আঁচল ধরে ঘুরছে–সোমা বসতি নাস্পাসু রোহিণীং ভজতে সদা। দক্ষের ছাব্বিশটি মেয়ে বাপের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ল। বলল–কী হবে আর ওই স্বামীর বাড়ি থেকে। আমরা আজ থেকে এখানেই থাকব, নুন-ভাত যা জোটে খাব, দেখব–কবে তার সময় হয়-বৎস্যামো নিয়তাহারা স্তপশ্চরণতৎপরাঃ।

দক্ষ মনে মনে প্রমাদ গুণলেন। এত গুলি মেয়ে একসঙ্গে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে, এবং এসেছে তাদেরই এক ভগিনীর প্রতি নির্মম ঈর্ষায়। দক্ষ সোজা জামাই-বাড়ি গিয়ে চন্দ্রকে বললেন–এ তোমার কেমন ব্যবহার? আমার সাতাশটি মেয়েকে তুমি এক সঙ্গে বিয়ে করেছ অথচ সবার দিকে তুমি একরকম করে তাকাও না। এ তোমার কেমন ব্যবহার? সবাইকে তুমি সমানভাবে দেখ। সাতাশটি স্ত্রীর মধ্যে শুধু একতমার প্রতি এই নিদারুণ পক্ষপাত কি ধর্মে সইবে বলে মনে কর–সমং বর্তস্ব ভার্যাসু মা ত্বধর্মো মহান্ স্পৃশে। স্নেহময় পিতা ফিরে এসে মেয়েদের বললেন–এবার স্বামীর বাড়ি যাও, মা-জননীরা। আমি জামাইকে খুব শাসন করে এসেছি। সে এখন সবাইকে সমান দেখবে।

বাবার কথা শুনে দক্ষ-কন্যারা আবার হই-হই করে চন্দ্রের গৃহে উপস্থিত হল। কিন্তু কোথায় কী! চন্দ্র যেমন ছিলেন, তেমনই আছেন। সেই রোহিণী। সেই রোহিণী। তাকেই তিনি ভালবাসেন, তাঁকে নিয়েই তাঁর দিন-রাত কাটে। দক্ষকন্যারা আবার ফিরে এলেন বাপের বাড়ি। এবারে আর নতুন অভিমানে তারা কেঁদে বুক ভাসালেন না। বরং ঠান্ডা মাথায় তারা পিতা দক্ষকে বললেন-বাবা, তোমারও তো বয়স হয়েছে। জীবনের যে কটা দিন আছে, আমরা তোমার সেবা শুশ্রূষা করে কাটিয়ে দিতে চাই। আমরা এখানেই থাকব, বাবা–তব শুশ্রষণে যুক্তা বৎস্যামো হি তবাশ্রমে দক্ষ-কন্যারা এবার নিরুত্তেজিতভাবে বাবা দক্ষকে জানালেন–তুমি তো সেই এত করে বলে এলে। সে তোমার কথা শুনলে তো? সে যা হোক, আমরা আর ফিরে যাচ্ছি না।

মেয়েরা যাই বলুক। দক্ষের আত্মাভিমানে লাগল এসব কথা। তিনি আবারও গেলেন জামাই-বাড়ি এবং অভিশাপের ভয় দেখিয়ে সব মেয়েকে সমদৃষ্টিতে দেখার শাসন জারি করে ফিরে এলেন বাড়িতে। মেয়েরা তার কথায় আবার স্বামীর বাড়ি গেল এবং পুনরায় তার একই অপব্যবহার দেখে বাপের বাড়ি ফিরে এল। তাদের এবার রাগও হল খুব স্বামীর ওপরে তো বটেই, বাবার ওপরেও খানিকটা। বারবার স্বামীর ভালবাসা ভিক্ষা করে, বাপকে দিয়ে সালিশি করিয়ে এবং তাতেও বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে কোন রমণীর ভাল লাগে! দক্ষ-কন্যারা এবার পিতাকে বললেন-তোমার সোনার চাঁদ জামাই এখনও রোহিণীর ঘরেই বসে আছেন। তোমার কথা শুনতে তার বয়ে গেছে, আমাদের ভালবাসার কোনও দায়ই তার নেই–ন তদ্বচো গণয়তি নাস্পাসু স্নেহমিচ্ছতি। তা তোমার যদি আমাদের বাঁচানোর এতই তাগিদ থাকে, তবে সেই ব্যবস্থা করো, যাতে আমাদের স্বামী আমাদের ভালবাসে।

দক্ষ রাগে দিগবিদিক্‌-জ্ঞানশূন্য হয়ে পুনরায় জামাতার ঘরে এলেন এবং মুখে কঠিন অভিশাপ উচ্চারণ করলেন তার উদ্দেশে। মহাভারত বলেছে–চন্দ্রকে শাস্তি দেবার জন্য দক্ষ ভয়ঙ্কর যক্ষ্মা রোগের সৃষ্টি করলেন এবং যক্ষ্মা চন্দ্রের শরীরে প্রবেশ করল।

চন্দ্রের যক্ষ্মা রোগের কাহিনী এইটুকুই। হয়তো এই কাহিনীর মধ্যে অন্যতর দুটি বিশ্বাস লুকোনো আছে এবং সেই বিশ্বাসই প্রতিপন্ন হয়েছে রোগগ্রস্ত চন্দ্রমার কাহিনীতে। প্রাচীনরা বিশ্বাস করতেন–অতিরিক্ত স্ত্রী-সম্ভোগের ফলে যক্ষ্মা হয় এবং এই ধারণা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও চালু ছিল। আমাদের ধারণা, এই চিরন্তনী ধারণাই উপাখ্যানের আশ্রয় নিয়েছে রোহিণী-চন্দ্রের নিবিড় সম্ভোগে। আরও একটা বিশ্বাস যা আছে, তা শুধু বিশ্বাস নয়, মাহাত্ম-খ্যাপন। চন্দ্র এই সাংঘাতিক রোগ থেকে পূর্ণ মুক্তি পাননি, কিন্তু খানিকটা যে তিনি সেরে উঠেছিলেন, তা শুধু সরস্বতীর তীরে প্রভাস তীর্থে স্নান করে।

আমাদের পূর্ব প্রস্তাব অনুসারে চন্দ্রের যক্ষ্মা রোগটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল–দেবতাদেরও মানুষের মতোই রোগ-শোক আছে, এমনকি রোগ যে সারে না, তাও দেখা। গেল ওই চন্দ্রের ক্ষেত্রে। অমাবস্যা থেকে চন্দ্রের যে একেকটি কলা বৃদ্ধি হতে থাকে, তার কারণ সরস্বতী-প্রভাসে অমাবস্যার দিন নাকি চন্দ্র তার রোগ মুক্তির জন্য স্নান করেছিলেন এবং সেইদিন থেকে পনেরো দিন তিনি ভাল থাকেন, তার শরীরটিও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু পূর্ণিমার দিন তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখা গেলেও আবার তার শরীর শুকোতে থাকে। ফলে পরের অমাবস্যায় আবার তাকে তীর্থ-স্নান করতে হয়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি–সরস্বতীর তীর্থে স্নান করে চন্দ্র তার শরীরে দীপ্তি অর্থাৎ প্রভা ফিরে পেয়ে জগৎ আলো করেছিলেন বলেই ওই তীর্থের নাম প্রভাস।

যাই হোক, চন্দ্রের পুরো রোগ মুক্তি হল না। সাংখ্যকারিকার টীকাকার মন্তব্য করলেন–নৈনং যক্ষ্মাদমুঞ্চৎ–যক্ষ্মা চন্দ্রকে ছাড়েনি। ইন্দ্র, প্রজাপতি ব্রহ্মা, চন্দ্র–এই সমস্ত মহান দেবতা যেখানে সামান্য রোগ-শোকই এড়াতে পারছেন না, সেখানে মরণ যে তাদের হবেই সে কথা আর বেশি করে বলার কী আছে। দেবতাদের মরণকাল ঘনিয়ে এলে তাদের শরীরে কী কী দুর্লক্ষণ দেখা যায়–সাংখ্য দার্শনিকেরা তার একটা তালিকাও দিয়েছেন। বস্তুত, বিভিন্ন পুরাণেও আমরা দেখেছি যে, দেবলোক থেকে চ্যুত হওয়ার সময় দেবতাদের দিন বড় দুঃখে কাটে, এবং এই শেষের দিনটির কথা ভেবে তারা রীতিমতো ভয়ও পান।

দেবতাদের জরা-মরণ নিয়ে আর কোনও গভীর তত্ত্ব আমরা শোনাব না। কারণ আমাদের মতে তারা মানুষেরই নামান্তর। তবে একই সঙ্গে জানাই অসুর-রাক্ষস অথবা দৈত্য-দানবেরা কিন্তু দেবতাদেরই জাত ভাই। তারা একই বাপের ছেলে। বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে যেমন ছেলেদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি, মামলা চলে, দেবতা আর অসুরদের মধ্যে সম্বন্ধটাই ওই একইরকম। স্বর্গের সম্পত্তি নিয়ে দুই বৈমাত্রেয় ভাইদের ঝগড়া। মামলার দরকার হলে দুই পক্ষই ব্রহ্মাকে সাক্ষী মানতেন। এঁদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত। হার-জিৎ দুই পক্ষেই প্রায় সমান। আর যদি কালচারের কথা তোলেন, তো বলি–সে জিনিসটা অসুর-রাক্ষসদের বড় কম ছিল না। এরা প্রত্যেকে ভাল রকম সংস্কৃত জানতেন। সমুদ্রমন্থনের সময় বাসুকির পৃচ্ছদেশ ধরবার প্রস্তাবে দৈত্যরাজ বলির প্রতিক্রিয়া স্মরণ করুন। অপিচ বাল্মীকি রামায়ণে স্বয়ং রাক্ষসরাজ রাবণের সংস্কৃত এবং বেদে অধিকার লক্ষ্য করুন ভাল করে।

তবে মুশকিল একটা ছিল। প্রজাপতি কশাপের এই দৈত্য-রাক্ষস পুত্রেরা যেহেতু স্বর্গের অধিকার ভাল করে কোনও দিনই পাননি, তাই হঠাৎ হঠাৎ লুটপাট, নরহত্যা, নারীহরণ, ধর্ষণ–এইসব বদগুণ তাদের মধ্যে বেশি এসে গিয়েছিল। মহামতি গিরীন্দ্রশেখর বসু তাই কুত্রাপি অসুর রাক্ষসদের ‘গুণ্ডা’ বা ‘ডাকাত’ বলে সম্বোধন করেছেন। আজকাল রাষ্ট্রীয় নেতারা যেমন অনেক অসামাজিক কাজ নিজে করতে পারেন না বলে গুণ্ডা লাগান, সেকালেও তেমন ছিল। স্বয়ং বিশ্বামিত্র মুনি রাক্ষস লাগিয়ে ব্যাস পিতা পরাশরের বাবা শক্ট্রিকে হত্যা করিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মানতে হবে মহাভারত এবং পুরাণে অতি উৎকৃষ্ট গুণের অসুর-রাক্ষসেরও অভাব নেই কোনও।

অসুর-রাক্ষসেরা অবশ্য আগে মোর্টেই খারাপ ছিলেন না। প্রথম প্রথম এক বাপের দুই ছেলের যেমন ভাব-ভালবাসা থাকে, তেমনটি দেবতা এবং অসুরদের মধ্যেও ছিল-অসুরা যে পুরা হ্যাঁসন্ তেষাং দায়াদ-বান্ধবাঃ। তবে সমস্ত গোলমালের মূলে কিন্তু ওই পৃথিবীর অধিকার নিয়ে দুই পক্ষের বনিবনা না হওয়া। এমনকি অনেকে বলেন, অসুর-রাক্ষসেরা আগে দেবতাদের চেয়েও ভাল মানুষ ছিলেন এবং তারা খারাপ হয়েছেন দেবতাদের জন্যই। অবশ্য তারও কারণ কিন্তু সেই ভূমির অধিকার।

প্রায় বৈদিক যুগের অতি প্রামাণ্য গ্রন্থ শতপথ ব্রাহ্মণ, যেটিকে সকলে বেদ বলেই মানেন, সেই গ্রন্থে অসুর আর দেবতাদের সম্বন্ধে খুব প্রামাণিক একটা কথা পাওয়া যাবে। শতপথ বলছেন–প্রজাপতি যেমন দেবতাদের সৃষ্টি করেছেন, তেমনই অসুরদেরও সৃষ্টি করেছেন তিনিই–উভয়ে প্রাজাপত্যাঃ। তা এক সময় অসুররাই সমস্ত পৃথিবী দখল করে নিয়েছিলেন। অধিকার সম্পূর্ণ হবার পর অসুরেরা নিজেদের মধ্যে পৃথিবীটা ভাগাভাগি করে নেওয়ার কথাও ভাবলেন। নেতারা আপন আপন অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য মাপ-জোকও আরম্ভ করে দিলেন। বিতাড়িত দেবতারা আরও বিপন্ন হয়ে উপস্থিত হলেন যজ্ঞপতি বিষ্ণুর কাছে। তারা ঠিক করলেন–ভাগাভাগির সময়েই অসুরদের ধরতে হবে। নইলে একবার নিজেদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলে আর কিছুই মিলবে না। দেবতারা বিষ্ণুকে সঙ্গে নিয়ে অসুরদের কাছে গিয়ে দেখলেন–মাপজোক, নকশা চলছে জমির অধিকার নিয়ে। দেবতারা বললেন–সব যে নিজেরাই ভাগ করে নিচ্ছ, আমাদের কী হবে? আমরা কি কিছুই পাব না? আমাদের ধারণা–অসুররা যদি দেবতাদের কাছে এসে বলতেন–আমাদের কী হবে, তবে তারা বধির হয়ে থাকতেন।

 কিন্তু অসুরেরা কত ভাল মানুষ দেখুন। তারা বললেন–তাই তো তোমাদেরও কিছু পাওয়া উচিত বটে। তা বাপু, সবাইকে তো আর দিতে পারব না। বরং, তোমাদের নেতা ওই বিষ্ণুর শুতে যতটুকু জায়গা লাগে, সেটা দেব তোমাদের–যাব দেবৈষ বিষ্ণুরভিশেতে, তাববো দপ্ন ইতি। এরপরের কাহিনী পুরাণে বলি-রাজার উপাখ্যানে কীর্তিত হয়েছে। বিষ্ণু শুলেন। কিন্তু শুয়ে, ফুলে, ফেঁপে তিনি সমগ্র পৃথিবী দখল করে নিয়ে ফিরিয়ে দিলেন দেবতাদের।

এমন ঘটনা একবার নয়। বারবার ঘটেছে। অমৃত লাভের ক্ষেত্রেও ওই একই ঈর্ষা এবং ছলনা কাজ করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। একটি পুরাণে আমরা অতি অদ্ভুত ব্যাপারও একটা দেখেছি। সেখানে বলা হয়েছে–অসুরেরা ধন্বন্তরির হাত থেকে অমৃত-কলস ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন, কিন্তু দেবতাদের প্রাপ্য ভাগ তারা মিটিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও অমৃত পান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তার আগেই মোহিনী মায়ার জালে আবদ্ধ হয়েছেন অসুরেরা। মহাভারতের কথায় এই প্রসঙ্গে আগে আমি বলেছি যে, অমৃত এবং লক্ষ্মী–এই দুটি বিষয় নিয়েই দেবতা আর অসুরদের দ্বন্দ্ব চিরতরে শাশ্বতিক এক রূপ নিল-অমৃতার্থে চ লক্ষ্মর্থে মহান্তং বৈরমাশ্রিতাঃ।

তবে অমৃত আর লক্ষ্মীরও আগে যেটা, সেটা হল-ভূমির অধিকার। স্বর্গের অধিকার। আমাদের জিজ্ঞাসা–সেই স্বর্গভূমি কোথায়? আমরা সেই স্বর্গের ঠিকানা চাই।

.

১৬.

 খুব সামান্য কথা। দেবতাদের শরীর মানুষের মতোই। তাদের আচার-ব্যবহার ভাব-ভঙ্গিও মানুষের মতো। তাদের বাড়ি-ঘর, বাগান, দুর্গ, রাজসভাও মানুষের মতো। সব কিছুই যখন মানুষের মতো, সেখানে তাদের বাসস্থান স্বর্গভূমিও যে মানুষের থাকবার মতোই একটা জায়গা হবে, সেটা খানিকটা অনুমানযোগ্য।

দেখুন, আমরা এর আগে দার্শনিক তথ্য দিয়ে জানিয়েছিলাম যে, স্বর্গ বলে একটা জায়গার কল্পনা করা হয়েছে বটে, তবে অনেকের মতে মনের প্রীতিকর জায়গাটাই হল স্বর্গ আর তার বিপরীত হল নরক। এ বিষয়ে মহাভারতও একমত হয়েছে। স্বয়ং ভৃগুমুনি সেখানে সদুপদেশ দিয়ে বলেছেন–দেখ, শারীরিক, মানসিক কোনও দুঃখই যেখানে নেই, সেই জিনিসটাকে বলে সুখ। আর সেই সুখ শুধু স্বর্গেই আছে, অন্যত্র নেই–নিত্যমেব সুখং স্বর্গঃ। উপদেশকামী ভরদ্বাজ বললেন, আমরা তো জানি–সেই রকম সুখ-স্বর্গ লাভ করতে হলে তো পরলোকে যেতে হবে। এখানে সেই পরলোক পাব কোথায়? সে পরলোকের কথা যে কেবল শুনেইছি, চোখে তো দেখিনি–অম্মাল্লোকাৎ পরো লোকঃ শায়তে ন তু দৃশ্যতে।

 ভৃগুমুনি এবার জিজ্ঞাসু সুজনকে পরলোকের ঠিকানা বলছেন। তিনি বললেন–আছে, আছে। হিমালয় ছেড়ে আরও উত্তরে যাও, সেইখানে সেই পরলোকের সন্ধান পাবে–

 উত্তরে হিমবৎপার্শ্বে পুণ্যে সর্বগুণান্বিতে।
পুণ্যঃ ক্ষেম্যশ্চ কাম্যশ্চ স পরে তোক উচ্যতে।

মুনি বললেন–সেখানে পাপী লোকের জায়গা নেই, লোভ নেই কারও, রোগ-শোক ব্যাধির বালাই নেই এবং সেখানে থাকেন যারা তারাও কিন্তু মানুষই–মানবা নিরুপদ্রবাঃ। স স্বর্গসদৃশশা দেশ স্তত্র স্থ্যক্তা শুভা গুণাঃ।

উত্তরে হিমাবৎপার্শ্বে–এই জায়গাটার সম্বন্ধে প্রাচীন ঋষি-মুনি-পৌরাণিকদের একটা নস্টালজিয়া’ আছে। মহাভারতের বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনেকেই এই জায়গাটাকে মাঝে মাঝেই স্মরণে এনেছেন এবং তার কারণ নস্টালজিয়া। আমরা যখন এরপরে মহাভারতে মহারাজ পাণ্ডুর পুত্রলাভের প্রসঙ্গে পৌঁছব, তখন দেখব–পাণ্ডু অন্য পুরুষের সম্প্রয়োগে কুন্তীর গর্ভে পুত্রলাভ করতে চাইছেন। কুন্তী মানছেন না, পাণ্ডু তখন উদাহরণ দিয়ে বলছেন–উত্তর-কুরু দেশে এখনও এই নিয়ম আছে–উত্তরেষু চ রম্ভোরু কুরুযু অদ্যাপি পূজ্যতে।

পণ্ডিতেরা বলেন-মধ্য এশিয়ার পামির বা পূর্ব তুর্কিস্থানের মহাভারতীয় নাম হল ইলাবৃত-বর্ষ। এই উত্তর-কুরু সেই ইলাবৃত-বর্ষের আরও উত্তরে। গিরীন্দ্রশেখর বসু লিখেছেন–উত্তর-কুরু দেশেই ব্রহ্মলোক বা বিষ্ণুলোক। ঋকবেদে বিষ্ণুকে উন্নত’ অর্থাৎ উত্তরদেশবাসী বলা হয়েছে এবং সেই রাজ্যে প্রচুর শৃঙ্গী হরিণ পাওয়া যায়–ভূরিশঙ্গা গাবঃ। গিরীন্দ্রশেখরের নিজের ভাষায়–”পৌরাণিক নির্দেশ অনুসারে মনে হয় বিষ্ণুর রাজ্য ক্যাসপিয়ন সাগরের উত্তরে ছিল। হিন্দু তীর্থযাত্রী সন্ন্যাসী ক্যাসপিয়ন সাগরের তীরে যাইতেন তাহার প্রমাণ আছে। (দ্রষ্টব্য : বাকুতে হিন্দুমন্দির’ নামক প্রবন্ধ : নূতন পত্রিকা, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬)। উত্তর কুরু সাইবেরিয়া বা রাশিয়ার কোনও স্থান বলিয়া মনে হয়। উপনিষদে ব্রহ্মলোক যাইবার পথে আর’ হ্রদ ও বিজরা নদীর উল্লেখ আছে। আর হ্রদ ও Lake Aral বোধহয় একই। বিজরা ও আধুনিক Pachora একই বলিয়া মনে হয়।”

 ব্ৰহ্মলোক বা বিষ্ণুলোকের সামান্য একটা হদিশ পাওয়া গেল। এবারে স্বর্গ লোকের কথা বলি। বর্ষ মানে স্থান, জায়গা; যেমন ভারতবর্ষ– ভরত-বংশীয়দের জায়গা। এই রকমভাবে ভরত বংশীয়দেরও অতি-পূর্ব পুরুষ হলেন ‘ইল’। তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও একটি স্থান–যার নাম ইলাবৃত-বর্ষ। গিরীন্দ্রশেখর এই ইলাবৃত-বর্ষকেই স্বর্গভূমি বলে চিহ্নিত করেছেন এবং সে জায়গাটা মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। সম্ভবত পামির বা পূর্ব তুর্কীস্থান ইলাবৃতবর্ষের অন্তর্গত। গিরীন্দ্রশেখরের ধারণা–এই জায়গার নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এই ইলাবৃত-বর্ষের সভ্যতা লুপ্ত হয় এবং নিতান্ত অলাভাবের জন্যই ইলাবৃত-বর্ষ থেকে ভারতের দিকে তারা আসতে থাকেন। কালবশে তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। তখন একদলের নাম হয় দেব অন্য দলের নাম অসুর।

অসুর শব্দটা যথেষ্ট পুরনো। এক সময় ‘অসুর’ শব্দে লোকে দেবতাও বুঝত। ঋগবেদে বহু জায়গায় দেবতাদের অসুর বলা হয়েছে। অসুরদের মধ্যে যে অদেবত্ব কিছু ছিল না, তার সবচেয়ে বড় ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ আবেস্তার ‘আহুর’ শব্দে। ভাষাতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন সংস্কৃত ‘অসুর’ শব্দই আঁবেস্তার ‘আহুর’। এবং জে আবেস্তাতে আহুর মানেই দেবতা–যেমন আহুরা মাজদা। তাই ধরেই নেওয়া যায় যে, সুরাসুরে দ্বন্দ্ব যতই থাকুক, তাতে কারুরই মান্যতা নষ্ট হত না এবং পূর্বে তাদের ঠিকানাও ছিল এক–সেই ইলাবৃত-বর্ষ।

পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয় পর্বত। হিমালয়ের উত্তরে এবং হেমকূট পর্বতমালার দক্ষিণে হল কিম্পূরুষ-ব। হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ। হরিবর্ষের সীমা নিষধ পর্বত পর্যন্ত। আর ওই নিষধ পর্বতের উত্তরেই ইলাবৃত-বর্ষ। এটাই যে স্বর্গ তার কী প্রমাণ আছে? এবারে গিরীন্দ্রশেখর যা বলেননি, সে প্রমাণও দাখিল করছি। এক তো হল মহাভারতের সেই উত্তরে হিমবৎপার্শ্বের সেই সুখস্থানটি যাকে মহাভারত বলেছে–স স্বর্গসদৃশো দেশঃ। দ্বিতীয় প্রমাণ আছে পুরাণে। পুরাণ বলেছে-ইলাবৃত-বর্ষ জায়গাটা কী রকম? না, সেখানে দৈত্যরাজ বলির মহান যজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছিল–যে যজ্ঞে বিষ্ণু বামন হয়ে পৃথিবী ভিক্ষা করে বলির রাজ্যাধিকার নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন–সেটাই ইলাবৃত-বর্ষ। আমাদের পূর্বকথিত ত্রিপুর দুর্গও এইখানেই। জিজ্ঞাসা করতে পারি–জায়গাটার আর কোনও বিশেষত্ব আছে কি? আছে। দেবতারা যেখানে জম্মেছিলেন, দেবতারা যেখানে বিবাহাদি করেন, যেখানে দেবতাদের অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ-সব কাজ হয়, এমন কি কন্যা সম্প্রদান করতে গেলেও দেবতাদের যে জায়গাটা ব্যবহার করতে হয়–সেই জায়গাটাই হল ইলাবৃত বর্ষ–

দেবানাং জন্মভূমি র‍্যা ত্ৰিযু লোকেষু বিশ্রুতাঃ।
বিবাহাঃ কুতবশ্বৈব জাতকর্মাদিকাঃ ক্রিয়াঃ।

এবারে মহামতি গিরীন্দ্রশেখরের অনুমানটা জানাই–দেবতারা ইলাবৃত-বর্ষ অর্থাৎ আধুনিক তুর্কিস্থান থেকে কাশ্মীরের পথে প্রথম ভারতে আসেন। তারা কাশ্মীর থেকে পাঞ্জাব এবং পাঞ্জাব থেকে বিন্ধ্য পর্বতের উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত আস্তে আস্তে অধিকার করে নেন। তারপর বিন্ধ্যের দক্ষিণেও রাজ্যবিস্তার করেন। ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে কাশ্মীর বা অন্তরীক্ষে এসে বসবাস শুরু করেন বলেই অন্তরীক্ষের অন্য নাম পিতৃলোক। অন্তরীক্ষ মানে মধ্যবর্তী দেশ। দেবলোক, পিতৃলোক এবং মর্ত্যলোক যথাক্রমে ইলাবৃতবর্ষ, কাশ্মীর এবং উত্তর ভারত।

গিরীন্দ্রশেখরের আরও বক্তব্য হল–দেবতারা যখন প্রথম ভারতে আসেন, তখন প্রথমে তারা ইন্দ্রের অধীন ছিলেন। স্বর্গ বা ইলাবৃত বর্ষের অধিপতির সাধারণ নাম ইন্দ্র। ভারতে তখন রাজা বলে কেউ ছিল না। ভারতে নেমে আসার পর দেবতারা মানব নামে পরিচিত হন কারণ ইন্দ্রের প্রতিভূ হলেন প্রজাপতি মনু–যাঁর নামে এই মানব জাতি। ইলাবৃত-বর্ষ ভারতীয়দের আদি বাসস্থান বলেই অতি পবিত্র তীর্থ বলে গণ্য হত। যুধিষ্ঠিরের সময়েও লোকে স্বর্গে তীর্থ করতে যেত। ক্রমে স্বর্গের পথ দুর্গম হয়ে পড়ে। কাশ্মীর থেকে তুর্কিস্থান যাওয়ার যে বণিকপথ এখনও আছে, সেটাই স্বর্গে যাওয়ার আদিপথ বা দেবযান-পথ বলে মনে হয়। উত্তরপ্রদেশের উচ্চ ভূমি এবং পর্বতও পরবর্তী কালে স্বর্গ নাম লাভ করেছিল।

স্বর্গারোহণের কথাটা এখন এমনই শুনতে লাগে, যেন সে স্বর্গ বুঝি মৃত পুণ্যাত্মাদের মরণোত্তর আশ্রয়ভূমি। আমাদের দেশে এই সেদিনও লোকে বুড়ো হয়ে গেলে জীবনের শেষ কদিন বিশ্বেশ্বরের সান্নিধ্যে কাটানোর জন্য কাশী যেতেন। আমরা পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্ৰৌপদীকেও মৃত্যুর ঠিক আগে নিজের জায়গা ছেড়ে স্বর্গে আরোহণ করতে দেখেছি। যদিও যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ এবং তারও পূর্বে ইলাবৃত-বর্ষের স্বর্গ একেবারেই আলাদা। কিন্তু এই যে পুরাণে-ইতিহাসে সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার কথাটা শোনেন, সেটা ছিল ওই মৃত্যুর পূর্বে কাশী যাওয়ার মতো।

স্বর্গ বলে যে জায়গাটা ছিল, সেখানে যেতে হলে পাহাড়-নদী পেরিয়ে বন্ধুর পথ বেয়ে ওপরে উঠতে হত। সেই জন্যেই স্বর্গে যাওয়াটা যাত্রামাত্র নয়, সে ছিল স্বর্গারোহণ। সেইজন্যই উত্তর আরও উত্তর দেশের উচ্চ ভূমি বা পর্বতই ছিল স্বর্গ। আর্যরা যতদিন ইলাবৃত-বর্ষে ছিলেন তখন সেটাই ছিল স্বর্গ। কিন্তু কাশ্মীর হয়ে তারা যখন আরও নীচে উত্তর প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন, তখন ইলাবৃত-বর্ষের পথ তাদের কাছে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যুধিষ্ঠিরকে তাই বদরীনারায়ণ এবং মানস সরোবরের পথে স্বর্গারোহণ করতে হয়েছে। ইলাবৃত-বর্ষ যে দেবতাদের বাসভূমি সে তো আমরা পুরাণ থেকে শ্লোক উদ্ধার করে বলেইছি। গিরীন্দ্রশেখরের ধারণা–ইলাবৃত-বর্ষের মধ্যে যে মেরু-পর্বত (এই মেরু পৃথিবীর অক্ষপ্রান্ত মেরু নয়) সেইখানেই দেবতাদের বাস ছিল। বায়ুপুরাণে আছে–বেদ-বেদাঙ্গ জানা পণ্ডিতেরা নাকপৃষ্ঠ, দিব, স্বর্গ ইত্যাদি পর্যায়বাচক শব্দে মেরুমহিমা কীর্তন করেন। এই গিরিতেই দেবলোক বিরাজিত বলে সমস্ত শ্রুতি বা বেদে বলা আছে–দেবলোকে গিরৌ তস্মিন্ সর্বশ্রুতি গীয়তে।

ঠিক এই জায়গাটা থেকেই আবারও আমরা মহাভারতের অমৃত-মন্থনের প্রস্তাবে ফিরে যাব। আপনাদের মনে আছে কি–আমি সেই বলেছিলাম–অথবা আমার কথা মনে রাখার দরকার কী, আপনারা অমৃত-মন্থনের পূর্বে মহাভারতের সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করুন। সেই মেরুগিরি, যা উজ্জ্বল সুবর্ণপ্রভ, দেবতা-গন্ধর্বদের আনাগোনা যেখানে সব সময়। অধার্মিক লোকেরা যেখানে যেতে পারে না এবং যা নিজের উচ্চতায় স্বর্গকেও আবৃত করে রেখেছে-নামাবৃত্য তিষ্ঠতি। দেবতারা সেই মেরুপর্বতের শৃঙ্গে উঠে অমৃত আহরণ করার মন্ত্রণা আরম্ভ করলেন–তস্য শৃঙ্গমুপারুহ্য..তাসীনা দিবৌকসঃ।

এখানে এই পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করার মধ্যে একটা রহস্য আছে বলে আমাদের ধারণা। আগেকার দিনে দূরস্থান নির্ণয় করার জন্য লোকে গাছে উঠে দেখত। পাহাড়ে উঠেও দেখত। যদি বিশ্বাস করি–দেবতাদের স্বর্গে খাদ্য-পানীয়ের অকুলান হলে, নদ-নদী শুকিয়ে গেলে তারা নতুন দেশ আবিষ্কারের প্রয়োজনে মেরুপর্বতের শৃঙ্গে আরোহণ করে মন্ত্রণা আরম্ভ করেছিলেন–তে মন্ত্রিতুমারব্ধাস্তাসীনা দিবৌকসঃ– তাহলে ব্যাপারটা সুধীজনের কাছে সমর্থনযোগ্য যতটাই হোক, বিশ্বাসযোগ্য হয় বটেই। অমৃত-মন্থনের শ্রেষ্ঠ ফল যদি শুক্রাচার্যের মৃতসঞ্জীবনীর মতো কোনও পরম ঔষধ হয়, তাহলে হস্তী, অশ্ব, সুরভি ইত্যাদি গৌণ ফল আর্যদের নূতন দেশ আবিষ্কারের সূত্রেই এসেছে। অমৃত-মন্থনের বাস্তব তাৎপর্য সেইখানেই। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়া, গাছের ফল শেষ হয়ে যাওয়া অথবা স্থায়ী আবাস নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আর্যদের যে নতুন করে দেশ খুজতে বেরতে হয়েছে–সে কথা পুরাণগুলি থেকে যথোপযুক্ত স্থানে প্রমাণ দেব। হয়তো এই প্রবন্ধে নয়, অন্যত্র।

দেবতা, অসুর, রাক্ষস–এঁদের পারস্পরিক স্থিতি নিয়ে বহু আলোচনার অবসর আছে। আমি তার মধ্যে যাচ্ছি না। শুধু মনে রাখুন–মানুষের সঙ্গে এঁদের বড় তফাত নেই। পুরাণ-কথা এবং দর্শন গ্রন্থগুলি থেকে এঁদের পারস্পরিক স্থিতি বোঝাতে গেলে যে সময় এবং জায়গা লাগবে তাতে আপাতত আমাদের মহাভারত-কথার ছন্দ নষ্ট হতে পারে। আপাতত তাই বিরতি।

অমৃত-মন্থনই যখন হয়ে গেল, তখনই আমাদের দায় আসল সৌতি উগ্রশ্রবার কাছে ফিরে যাওয়ার। অমৃত-মন্থনের কাহিনী বলে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন–দেবতাদের মধ্যেও মানুষের মতোই লোভ, তৃষ্ণা, ছলনা এবং হিংসার বৃত্তিগুলিও আছে। বৈরোচন বলি এবং দেবরাজের কথোপকথনের অংশমাত্র দেখিয়ে দেবতাদের নশ্বরতার কথাও যে আমরা খানিকটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি, তার কারণ আর কিছুই নয়, এতে প্রমাণ হবে–দেবতারা কেউই মনুষ্যবৃত্তির উর্ধ্বে নন–আকারে ইঙ্গিতে এবং ব্যবহারে এই কথাটাও অমৃত-মন্থন কাহিনীর অন্যতম উদ্দেশ্য বলে আমরা মনে করি।

সৌতি উগ্রশ্রবার মুখে অমৃত-মন্থনের কাহিনী এসেছিল নাগদের প্রসঙ্গ থেকে। আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল–তক্ষকের প্রসঙ্গ থেকে। নাগরা রক্ষা পেলেন তাদেরই পরমাত্মীয় আস্তীক মুনির করুণায় এবং মধ্যস্থতায়। জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ শেষ হয়ে গেল নাগ জন-জাতির সঙ্গে তৎকালীন ক্ষত্রিয়দের মিলন-যজ্ঞে।

একই সঙ্গে সৌতি উগ্রশ্রবার কাজও কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। আধুনিক রাজার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও এবার জনমেজয়ের রাজসভার কাহিনীতে চলে যাবেন। জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের সানন্দ সমাপনে সভাস্থলে আনন্দের কলতান উঠল। সমবেত ঋষি-মুনি থেকে আরম্ভ করে শিল্পী-স্থপতি, সূত-মাগধ কেউ জনমেজয়ের দান-মান থেকে বঞ্চিত রইলেন না। এই দান-গ্রহীতার তালিকায় আরও একটি নামের কথা আমি পূর্বে বলেছিলাম। তিনি হলেন এই সৌতি উগ্রশ্রবার পিতা লোমহর্ষণ। জনমেজয়ের সভায় ব্যাস-বৈশম্পায়নের সান্নিধ্যে মহাভারত শুনে লোমহর্ষণ মহাভারতে কথক-ঠাকুর হয়ে উঠবেন পরে।

লোমহর্ষণ অবশ্য তখনও লোমহর্ষণ হননি, কারণ মহাভারত তখনও বলা হয়নি। এই যে জনমেজয়ের সর্প-যজ্ঞ মিটে গেল, সভাস্থ সকলের মন ভরে উঠল আনন্দে, তখনই সূচনা হল মহাভারত-কথার। জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের আরম্ভেই মহামতি ব্যাস এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।

জনমেজয়ের বড় ইচ্ছা ছিল–অতিবৃদ্ধ এই প্রপিতামহের কাছে নিজের পূর্বজদের রাজকাহিনী শুনবেন। কিন্তু সর্পযজ্ঞের ব্যস্ততা আর প্রতিহিংসার তাড়নার মধ্যে সে কাহিনী শোনার অবসর হয়নি। আজ যখন মিলন আর সংহতির সূচনা করে যজ্ঞ শেষ হল, তখন অপার আনন্দে জনমেজয় অতিবৃদ্ধ-প্রপিতামহের জন্য সোনার আসন তৈরি করালেন রাজসভায়। জনমেজয়ের তৈরি সেই আসন আজও আছে মানুষের মনে। আজও ভাগবত-পাঠের আসরে যে মান্য ব্যক্তিটি বক্তার আসনে বসেন, সেই আসনটির নাম ব্যাসাসন।

ব্যাসাসনে উপবিষ্ট ব্যাসের কাছে জনমেজয় হাত জোড় করে অনুরোধ জানালেন পাণ্ডব-কৌরবের সমস্ত ঘটনাই আপনি সামনে থেকে দেখেছেন–ভবান প্রত্যক্ষদর্শিবান আপনি আমাদের কাছে তাদের সমস্ত ঘটনা এবং তাদের চরিত্র বর্ণনা করুন। শুধু তাই নয়, এই যে বিরাট কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঘটে গেল, সেই যুদ্ধ কেন ঘটল, কেনই বা এত প্রাণ নষ্ট হয়ে গেল–আপনি শোনান আমাদের।

জনমেজয়ের প্রশ্নের মধ্যে কুরু-পাণ্ডবের রাজনৈতিক ইতিহাসের জিজ্ঞাসাই শুধু ছিল না, তার মধ্যে তৎকালীন ভারতবর্ষের সামগ্রিক রাজনীতির জিজ্ঞাসা ছিল। জনমেজয় শুধু কুরু-পাণ্ডবের জ্ঞাতিবিরোধটুকুই জেনে ক্ষান্ত হতে চান না, এই বিরাট যুদ্ধে রাজনৈতিক বিরোধ কত দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল, যাতে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেন দুই পক্ষে এবং মারা গেলেন-জনমেজয় এই রাজনৈতিক বৃত্তান্ত আমূলান্ত জানতে চান–তচ্চ যুদ্ধং কথং বৃত্তং ভূতান্তকরণং মহৎ?

হায়! যে বালক এই মুহূর্তে ঠাকুরদাদার কাছে নাতিটির মতো প্রশ্ন করে বসল পাণ্ডব-কৌরবের গল্প বলুন–সেই পাণ্ডব-কৌরবের গল্প বলা কি অতই সহজ! ব্যাসের বয়স এবং সম্বন্ধের তুলনায় জনমেজয় একটি বালকমাত্র। জনমেজয় অর্জুনের নাতি। অতএব তার কাছে পাণ্ডব-বীর অর্জুন অথবা ভীমের বীরত্ব কিংবা যুধিষ্ঠির-কৃষ্ণের বিশাল ব্যক্তিত্বময় কাহিনীটুকুই সব চাইতে বড়। কিন্তু ব্যাস! তিনি যে স্বয়ং এই পাণ্ডব-কৌরব বংশের জন্মদাতা। এই বংশের ওপর যে তার অশেষ মায়া। সেই মহান বংশের জাতকেরা পরস্পর হানাহানি করে মরল–এক পক্ষ জিতল, এক পক্ষ হারল–এসব কথা কেমন করে নিজ মুখে বলবেন ব্যাস। তিনিও যে পাণ্ডব-কৌরবের পিতামহ। বলতে পারেন–মুনি-ঋষিদের আবার অত মায়া কী? তারা তো সুখ-দুঃখে, লাভালাভে সমান দৃষ্টি। তাদের আবার কীসের মায়া? আমি বলি-মুনি-ঋষি হলেও তারা আগে মানুষ। মহাভারতের পরবর্তী অংশে আমি মাঝে-মাঝেই দেখাব–এই নিষ্কাম সমাধি-লগ্ন মানুষটি কোন মায়ায়, কোন সুতোর টানে পাণ্ডব-কৌরবের মর্ম-কথায় জড়িয়ে গেছেন। কিন্তু আজ এই বালক জনমেজয়ের সামনে সেই মায়া, সেই একান্ত মনুষ্যোচিত ব্যক্তিসত্তার প্রথম উন্মোচন ঘটল।

ব্যাস ব্যাসাসনে বসেও নিজ মুখে মহাভারতের কাহিনী বলতে পারলেন না। নিজে বললে নানা কথায়, বিভিন্ন প্রসঙ্গের উপক্রমে তার পক্ষপাত–একতরের প্রতি পক্ষপাত, অন্যতরের প্রতি দোষদৃষ্টি প্রকাশ পেতে পারে। অতএব যে নৈর্ব্যক্তিকতায় কবি তার মর্মশায়ী ঘটনা বিবৃত করেন, যে রসবত্তায় এক প্রেমিক তার না-পাওয়া প্রেমিকার সঙ্গে aesthetic distance বজায় রেখেও তাকে ভালবেসে যান, তার গল্প বলেন, ঠিক সেই নৈর্ব্যক্তিকতায় সেই রসবত্তায় মহামতি ব্যাস মহাভারতের কাহিনী লিখে রেখেছেন। কিন্তু সে কাহিনী তিনি নিজে বলতে পারছেন না। তাই আপন বংশের জাতক বালক জনমেজয়ের মুখে পাণ্ডব-কৌরবের গল্প বলার অনুরোধ শুনেই তিনি তাঁর প্রিয়-শিষ্য বৈশম্পায়নকে আদেশ করলেন তার স্বলিখিত মহাভারতের কাহিনী শোনানোর জন্য–শশাশ শিষ্যমাসীনং বৈশম্পায়নমন্তিকে। ব্যাস বললেন-কুরু-পাণ্ডবের বিরোধ কেমন করে ঘটেছিল- যেমনটি তুমি আমার কাছে শুনেছ সব খুলে বলতদস্মৈ সর্মচক্ষু যম্মত্তঃ শ্রুতবানসি। বৈশম্পায়ন গুরুর আদেশ পেয়ে মহাভারতের অমৃত-কথা আরম্ভ করলেন-বৈশম্পায়ন উবাচ।

বৈশম্পায়ন। কথক ঠাকুরদের মধ্যে তাঁর মতো বক্তা আর নেই। স্বয়ং ব্যাস নিজের হাতে তাকে তৈরি করেছেন বিচিত্র মহাভারত-কথা জনসমক্ষে শোনানোর জন্য। অন্য কথক-ঠাকুরদের মতো তিনি সূত-জাতীয় নন। তিনি ব্রাহ্মণ। গুরুর আদেশ পাওয়া মাত্র তার যেটা কর্তব্য অথবা ইচ্ছে ছিল তা কিন্তু তিনি করতে পারলেন না। এবং এইখানেই তার বুদ্ধি। যে গুরুদেব তাকে হাতে ধরে মহাভারত কথা শিখিয়েছেন, যিনি নিজ মুখে নিজের প্রশংসা করতে পারবেন না–এই ভয়ে নিজে মহাভারতের কথা বললেন না, বৈশম্পায়নের ইচ্ছে ছিল সেই গুরুর প্রসঙ্গটাই আগে তোলার। কিন্তু বুদ্ধিশালী এই কথক-ঠাকুর রাজা জনমেজয়ের আগ্রহটা কোথায়–তা খেয়াল করেছেন। রাজা চান–তার পিতৃ-পিতামহের বীরত্ব-কাহিনী শুনতে। আর বৈশম্পায়ন চান–বিদ্যাদায়ী গুরুর মহিমা কীর্তন করতে। কিন্তু দুয়ের দ্বৈরথে শ্রোতার আগ্রহই যেহেতু বড় কথা, তাই বুদ্ধিশালী বৈশম্পায়ন আগে গোটা মহাভারতের সংক্ষিপ্তসার শুনিয়ে দিলেন রাজা জনমেজয়কে। এতে রাজার জিজ্ঞাসা শান্ত হল বটে, কিন্তু বিস্তারিত বিবরণের জন্য তার আগ্রহ হয়ে উঠল দ্বিগুণ। বৈশম্পায়ন এইটাই চাইছিলেন। এরপর রাজা যেই বিস্তারিত কাহিনী শুনতে চাইলেন, সঙ্গে সঙ্গে বৈশম্পায়ন আপন গুরু বেদব্যাসের জীবন-কথা শুনিয়েছেন জনমেজয়কে কিন্তু তাও বড় সংক্ষেপে। আমার কথা হল–জনমেজয়ের আগ্রহ সত্ত্বেও মহাভারতের কথক-ঠাকুর যেমন শেষ পর্যন্ত নিজের মতো করেই মহাভারতের কাহিনী বর্ণনা করেছেন, তেমনই আজকের দিনে মহাভারত-কথা শোনাতে হলে তার জটিল জায়গাগুলি আমাকে যে যথাসম্ভব সহজ পদ্ধতিতে বলতে হবে, সেই অঙ্গীকার নিয়েই আমাদের উপাখ্যান-ভাগ আরম্ভ হবে আগামীতে। অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু।

.

১৭.

চন্দ্রবংশ। সুপ্রসিদ্ধ চন্দ্রবংশ। কৌরব, পাণ্ডব, ভীষ্ম, শান্তনু যে বংশের অধস্তন গৌরব-মূর্তি, সে বংশের প্রথম পুরুষ হলেন চন্দ্র। আমরা বংশমূল থেকেই মহাভারত-কথা আরম্ভ করব। তার কারণ, মহাভারত-কথা পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধকাহিনীই শুধু নয়, সে শুধু একটামাত্র বংশের ইতিহাসও নয়, ভারতের ইতিহাস। আরও মনে রাখতে হবে- মহাভারত-কথায় আমরা শুধু অতি সংক্ষিপ্তভাবে অর্জুন-কৰ্ণ, ভীম-দুর্যোধন অথবা ভীষ্ম-যুধিষ্ঠিরের বীরত্ব, সাহস এবং মর্যাদায় মোহিত হই। কিন্তু এই বংশে এত বড় বড় সব রাজপুরুষ আছেন, যে, তাদের শৌর্য-বীর্য অথবা মহানুভবতা তাদের অধস্তনদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। অপিচ তাঁদের কীর্তিকলাপ এবং বংশধারাগুলি পরিষ্কার ভাবে জানলে পরে দেখা যাবে–মহাভারতের যুদ্ধ মোটেই কুরু-পাণ্ডবের গৃহ-বিবাদমাত্র নয়, এই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু আগেকার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত বিবাদও। আমরা তাই প্রথম থেকে আরম্ভ করছি।

প্রথমে চন্দ্র। সেকালের দিনে অনেক প্রসিদ্ধ বংশেরই মূল পুরুষকে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতাঁকে কল্পনা করা হত। প্রাচীন চীন-দেশেও এই রীতি ছিল। আমাদের দেশেও চন্দ্র-সূর্যের প্রতাঁকে দুটি বিখ্যাত বংশধারার কল্পনা। রাম-রঘু ইক্ষাকু বংশের মূলে আছেন সূর্য আর পাণ্ডব-কৌরব, ভীষ্ম-শান্তনুর মূল পুরুষ হলেন চন্দ্র।

আদি মানব-মানবী বলতে ওদেশে যেমন শুধু অ্যাডাম এবং ইভ, আমাদের দেশে তেমন ‘প্রোজেনিটর’ অন্তত দশজন আছেন। মহাভারত-পুরাণের মতে ব্রহ্ম তাঁর মন থেকে অন্তত দশটি পুত্র উৎপাদন করেন এবং সেই দশজনকেই তিনি পুত্র-সৃষ্টির কাজে নিযুক্ত করেন। এঁদের বলা হয় প্রজাপতি। এই প্রজাপতিদের অন্যতম হলেন মহর্ষি অত্রি।

ব্রহ্মার দ্বারা আদিষ্ট হয়ে মহর্ষি অত্রি পুত্র-সৃষ্টির তপস্যায় বসলেন। পরম আনন্দ-স্বরূপ ব্ৰহ্ম-জ্যোতিকে তিনি তাঁর দুই নয়নের মধ্যবর্তী স্থানে উদ্ভাসিত দেখতে পেলেন। ঠিক এই সময়ে দেবদেব শঙ্কর প্রিয়া পার্বতাঁকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন অত্রির সামনে। তাদের দেখে তপস্যারত অত্রির নয়ন বেয়ে এক বিন্দু আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল; আর সেই আনন্দের অশ্রুবিন্দু থেকেই জন্ম হল শিশু চন্দ্রের তস্মাৎ সোমো’ ভবচ্ছিন্নঃ তার স্নিগ্ধ আলোয় তিন ভুবন আলোয় আলো হয়ে গেল। দিদ্বধূরা শিশু-চন্দ্রকে ধারণ করলেন আপন গর্ভে।

 বস্তুত, আকাশে চাঁদ ওঠে বলেই দিগবধূর কল্পনা। দিবধূদের গর্ভস্থ সন্তানকে ব্রহ্ম এক মনোহর যুবা-পুরুষে পরিণত করেন এবং সমস্ত ব্ৰহ্মর্ষি-দেবর্ষি তাঁকে বৈদিক সোম-মন্ত্রে অভিমন্ত্রিত করলেন। বেদে সোমরস কোনও ওষধির নির্যাসই হোক, অথবা লতার নির্যাস, ঋষিরা সোমের উদ্দেশে বহু স্তুতি-সূক্ত রচনা করেছেন। তাকে রাজা বলেও সম্বোধন করেছেন সোমং রাজানং হবামহে..ইত্যাদি। বেদে সোমের এই রাজকল্পনা থেকেই পুরাণে সোমকে দেবতা, পিতৃগণ এবং ওষধির আধিপত্য দেওয়া হয়েছে। ঋষিমুনিদের অহরহ স্তুতিতে তার শরীর আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল–স্তয়মানস্য তস্যাভূদ অধিকো ধামসম্ভব।

যুবা-পুরুষ চন্দ্রের চেহারাটি এমনই সুন্দর এবং কমনীয় হল যে অন্য আরেক প্রজাপতি দক্ষ তার সমস্ত নক্ষত্র-কন্যাকে সম্প্রদান করলেন চন্দ্রের হাতে। নক্ষত্রসুন্দরী রোহিণী এবং চন্দ্রের গভীর অনুরাগের কথা আমরা আগে বলেছি এবং সেই অনুরাগের ফলে দক্ষ-প্রজাপতির অন্য কন্যাগুলির কী দুরবস্থা হয়েছিল, তাও আমরা সবিশেষ কীর্তন করেছি। চান্দ্রের যক্ষ্মা-রোগের কাহিনীও আমরা মহাভারত থেকে শুনিয়েছি। শুধু যেটা বলিনি–সেটা হল চন্দ্রের একগুয়ে প্রকৃতির কথা, যদিও দক্ষ-প্রজাপতির সনির্বন্ধ অনুরোধ-উপরোধ প্রত্যাখ্যান করার ঘটনা থেকে চন্দ্রের স্ত্রৈণতা এবং একগুয়েমি–দুটোই বেশ ভালভাবেই প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করি।

 মুশকিল হল–চন্দ্রের জীবন-কাহিনীর সব অংশ মহাভারতে নেই। কোথাও বা অনেক বড় কাহিনী সূত্রাকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু পাণ্ডব-কৌরব-বংশের মূল পুরুষকে আমরা এত সহজে ছেড়ে দিতে পারি না। তাই প্রচুর-পুষ্পমোদী মধুকরের মতো অনেক কাহিনীই আমাকে বিভিন্ন পুরাণ থেকে সংগ্রহ করে এনে এই ভারত-কথার মধুকোষে সঞ্চয় করতে হচ্ছে।

মহাভারতের কবি একেবারে অন্যপ্রসঙ্গে বনপর্বে একবার বলেছিলেন–দেবগুরু বৃহস্পতির যিনি স্ত্রী ছিলেন, তাকে চন্দ্রের স্ত্রীও বলা যায়–বৃহস্পতেশ্চান্দ্রমসী ভার্যাসী যা যশস্বিনী। এই সংক্ষিপ্ত পরিচয়টুকুর মধ্যে যে ব্যঞ্জনা আছে, সে ব্যঞ্জনা আর ভাষার স্থূলতায়। ব্যক্ত করেননি কবি। হয়তো সে প্রসঙ্গও আসেনি। অথবা হয়তো সেই গভীর কথাটা তাঁরও মনে ছিল–যা তিনি মহামতি বিদুরের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন উদ্যোগ-পর্বে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন–মহা-মহা-ঋষি-মুনি আর বড় বড় কীর্তিশালী বংশের মূল খুঁজতে যেও না কখনও-কুলানাঞ্চ মহাত্মনাং… প্ৰভবো নাধিগন্তব্যঃ।

এই সাবধান-বাণী এই জন্য যে, মহৎ বংশের গায়ে কলঙ্কের চিহ্ন থাকলে অল্পস্বত্ত্ব লোকের মুখ বড় মুখর হয়ে ওঠে। যাদের ধারণ ক্ষমতা কম, তারা ওইটুকু দিয়েই বিশিষ্ট জনের বিচার করতে শুরু করে। মহাভারতের কবি তাই কুরু-পাণ্ডব বংশের মূল ব্যক্তিটির চরিত্র-চর্চার মধ্যে যাননি। আমরা অবশ্য সেই চর্চায় যাচ্ছি। যাচ্ছি পৌরাণিকদের হাত ধরে, যদিও খলস্বভাব দুর্মতিদের জন্য আমার দুর্ভাবনা এবং করুণা–দুইই রয়ে গেল।

পুরাণ বলেছে–দক্ষ-কন্যাদের সঙ্গে বিবাহাদি সম্পন্ন হওয়ার পর চন্দ্র ভগবান বিষ্ণুর তপস্যা আরম্ভ করলেন। উগ্র তপস্যায় তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু যখন বর দিতে চাইলেন–তখন চন্দ্র। বললেন–আমি যেন ইন্দ্রলোক জয় করতে পারি–ততো বরে বরা সোমঃ শত্রুলোকং জয়ামহ্যম। সমস্ত দেবতাকে আমি যেন আমার গৃহে প্রত্যক্ষ দেখতে পাই। তার মানে, আমরা যারা এতদিন ইন্দ্রকেই দেবরাজ্যের অন্যতম নায়ক ভাবতাম, তা কিন্তু ঠিক নয়। চন্দ্র ইন্দ্রলোকের অধিকার চান এবং দেবতাদেরও তিনি স্বভবনে চোখের সামনে দেখতে চান। তিনি চান–দেবতারা তাঁর বাড়িতে নিত্য আহার করেন–প্রত্যক্ষমেব ভোক্তারো ভবন্তু মম মন্দিরে। এ ভাব যেন সেই নতুন এবং উঠতি বড়লোকের মতো–তিনি বড় একটি এস্টেট চান এবং চান–বড় বড় লোকেরা তাঁর বাড়িতে থানাপিনা করুন–এতে তিনি নিজে মর্যাদাসম্পন্ন বোধ করেন। অর্থাৎ চন্দ্র তার মহান পুণ্যবলে জনার্দন বিষ্ণুর বরে স্বর্গলোকের অধিকার পেতে চলেছেন, এবং দেবতা বলে কথিত মহামানবদের সঙ্গে এখন থেকে তার নিত্য ওঠা-বসা চলবে।

শুধু এইটুকুই নয়। ভগবান বিষ্ণুকে তিনি বলেছেনএকটি রাজসূয় যজ্ঞ করতে চাই আমি, এবং সেই যজ্ঞে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের কাজ করবেন স্বয়ং দেবতারা, আর শূলী শম্ভু সদা নিযুক্ত থাকবেন আমার রক্ষাকার্যে। ভগবান বিষ্ণু চন্দ্রের সমস্ত প্রার্থনা পূরণ করলেন। তার রাজসূয় যজ্ঞে সামগান করলেন স্বয়ং লোকপিতামহ ব্রহ্মা। অন্যান্য দেবতা সমস্ত যজ্ঞকার্য সমাধা করলেন সানন্দে। রাজসূয় যজ্ঞের পর কমনীয়, সুন্দর চন্দ্র আপন উজ্জ্বলতায় কমনীয়তর, সুন্দরতর হলেন।

অভাবনীয় ঘটনাগুলো ঘটতে লাগল ঠিক এর পর থেকেই। স্বর্গের অধিকার, দেবতাদের পৌরোহিত্য, রাজসূয় যজ্ঞ–এই সব কিছু মিলে চন্দ্রের শারীরিক উজ্জ্বলতা শুধু নয়, এসব তার মান-মর্যাদা এবং রাজকীয়তাও অনেক বাড়িয়ে তুলল। পুরাণ বলেছে–চন্দ্রের এই অলোক সামান্য মাহাত্ম্য লক্ষ করে দেব-রমণীরা চন্দ্রকে দেখে মুগ্ধ হতে লাগলেন, শারীরিক এবং মানসিক ভাবে। অন্তত ন’জন সুন্দরী দেব-স্ত্রী, যাঁদের নাম শুনলে অবাক হতে হবে–তারা তাদের স্বামী ছেড়ে চন্দ্রের সেবা করতে চাইলেন দাসীর মতো–কামবাণাভিতপ্তাস্যো নব দেব্যঃ সিষেবিরে। এঁদের সবাইকে সাধারণ জনে চিনবেন না–যেমন প্রজাপতি কর্দমের স্ত্রী সিনীবালী, কিংবা বিভাবসুর স্ত্রী দ্যুতি, অথবা জয়ন্তের স্ত্রী কীর্তি। এঁরা না হয় অচেনা, অথবা এঁদের নামের মধ্যে হয়তো রূপকের প্রশ্রয় আছে, কিন্তু স্বয়ং নারায়ণের স্ত্রী লক্ষ্মীও তার স্বামীকে ছেড়ে চন্দ্রের প্রেমে পড়লেন–লক্ষ্মী নারায়ণং তত্বা সিনীবালী চ কদম। সব চেয়ে বড় কথা–এঁরা না হয় স্বামী ছেড়ে চলে এলেন, কিন্তু চন্দ্র? চন্দ্রও সেই দেব-রমণীদের সঙ্গে আপন স্ত্রীর মতোই ব্যবহার করতে লাগলেন-স্বকীয়া ইব সোমোপি কাময়ামাস তাস্তদা।

ধরে নিতে পারি–এই নয় জন দেবপত্নীর কথাটা পৌরাণিকের অতিশয়োক্তি। কেননা, দ্যুতি, কীর্তি, প্রভা, এমনকি লক্ষ্মী–এই স্ত্রীলিঙ্গ-নামগুলি পরিচিত দেবপত্নীদের নাম হিসেবে খুব যুৎসই নয়। প্রধানত চন্দ্রের শারীরিক সৌন্দর্য এবং দেবসমাজেও তার অতুল প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এই নামগুলি ব্যবহার করা হয়েছে-সোমঃ প্রাপ্যাথ দুষ্প্রাপ্য ঐশ্বর্যমৃষিসংস্কৃত-এবং তা করা হয়েছে একটু পরেই আসল সত্য ঘটনাটি বলার জন্য। রাজার প্রভাবে মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্মী নারায়ণকে ছেড়ে কৃতী রাজার আশ্রয় নিয়েছেন–এই রূপক পুরাণে এবং সংস্কৃত সাহিত্যে সহস্রবার লক্ষ্য করা গেছে।

লক্ষ্মী শব্দের অর্থ ঐশ্বর্য। রাজা ঐশ্বর্য এবং প্রতিপত্তিশালী হলেই কবিরা এই উৎপ্রেক্ষা করে, কবিত্ব করে বলেছেন যে, লক্ষ্মী নারায়ণকে ছেড়ে রাজার আশ্রয় নিয়েছেন। কাজেই দ্যুতি, কীর্তি, দ্যপ্রভা, লক্ষ্মীর মতো স্ত্রীরা চন্দ্রের সাহচর্য পাওয়ার জন্য অভিভূত হলেনল্গ–এ কথাটা খুব বড় কথা নয়। আসলে চন্দ্র যে আপন প্রভাবে রমণী-সমাজে কতটা কাম্য হয়ে উঠেছিলেন, এটা যেমন এই ঘটনায় প্রমাণিত হল, তেমনই স্ত্রৈণতার ব্যাপারে চন্দ্রেরও যে খুব গুরু-লঘু বোধ ছিল না, সেটাও একাধারে বলে দেওয়া গেল। মূল সত্যি ঘটনাটা কিন্তু এর পরে আসছে–যে ঘটনায় সাক্ষী শুধু পুরাণগুলি নয়, সাক্ষী আছে মহাভারতের সেই সংক্ষিপ্ত পংক্তিটি–বৃহস্পতির যিনি স্ত্রী, তিনি আসলে চন্দ্রেরই স্ত্রী-বৃহস্পশ্চান্দ্রমসী ভার্যাসী যা যশস্বিনী। ঘটনাটি এবার বলি।

 চন্দ্রের তখন বিশাল ঐশ্বর্য, অগাধ প্রতিপত্তি। ত্রিভুবন তার কাছে খুবই ছোট কথা, সপ্ত লোকের আধিপত্য তার করতলগত-সপ্তলোকৈকনাথত্ব অবাপ তপসা সদা। এই রকমই এক স্বাধিকার আর সুখের সময়ে চন্দ্র তার ভবন-সংলগ্ন উদ্যানের মধ্যে পাচারে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎই সেখানে দেখতে পেলেন এক সুন্দরী রমণী। উদ্যানের ফুলের আভরণ তাঁর গায়ে। স্তন-জঘনের সৌন্দর্যে পরম আকর্ষণীয়া। কোমল শরীর, যেন ফুল ছিঁড়তে গেলেও তার আঙুলে ব্যথা লাগবে–পুষ্পস্য ভঙ্গে’ প্যতিদুর্বলাঙ্গীম্।

 চন্দ্রে বিলাস-উদ্যানে যে রমণীটিকে এইমাত্র দেখা গেল ইনি দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী–তারা। নিসর্গ-সৌন্দর্যের মধ্যে সৌন্দর্যের আধারভূতা এই রমণীটিকে দেখে চন্দ্র মনের আবেগ রুদ্ধ করতে পারলেন না। নির্জন উদ্যানভূমির সমতলে দাঁড়িয়ে তিনি তারাকে আলিঙ্গন করলেন। তারার গ্রন্থিবদ্ধ কেশরাশি আলুলায়িত হল– কেশেষু জগ্রাহ বিবিক্তভূমৌ। বোঝ গেল, স্বয়ং দেবগুরুর পরিণীতা স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা চন্দ্রের রূপে এবং প্রতিপত্তিতে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন–তদরূপকাত্যা হৃতমানসেন–যে, এই বলাৎকারী রসিককে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, তিনি শরীরে ও মনে খুশি হলেন। অনেক দিন সেই উদ্যান-ভূমির মধ্যেই কেটে গেল রসে-রমণে। চন্দ্রের সঙ্গে তারার সাহচর্য ঘনীভূত হল।

বৃহস্পতির পত্নী বাড়ি ফেরার নামও করলেন না। উদ্যান-বিলাসের দিন শেষ হলে চন্দ্র তারাকে একেবারে নিজের বাড়িতে নিয়ে তুললেন। সুন্দরী তারার সাহচর্য-সুখ এমনই যে চন্দ্রের তৃপ্তি কখনও শান্তির পর্যায়ে আসে না-বিধুগৃহীত্বা স্বগৃহং ততোপিন তৃপ্তিরাসীচ্চ গৃহেপি তস্য।

 অন্য একটি পুরাণে দেখা যায়–চন্দ্রের বিলাসোদ্যানে তারার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। এখানে বৃহস্পতি স্বয়ং নিজের কপাল নিজে পুড়িয়েছিলেন। বৃহস্পতি দেবগুরু, ফলে দেবতারা সকলেই তার যজমান। চন্দ্রও তাই। কোনও কারণে সেদিন বৃহস্পতির স্ত্রী তারা যজমান শিষ্যের বাড়িতে এসেছিলেন–গতৈকদা বিধোধাম যজমানস্য ভামিনী। সেই প্রথম চারিচক্ষুর মিলন হল এবং দুজনেই দুজনকে দেখে রবিষ্ট হলেন। তারা আর শিষ্যবাড়ি থেকে ফিরে যাননি। চন্দ্রও তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও উদ্যোগ করেননি। এদিকে নিজের বাড়িতে বসে দিনরাত তারার চিন্তায় বৃহস্পতির দিন কাটতে লাগল। তিনি কিছু বলতেও পারছেন না, কিছু করতেও পারছেন না। ভাবলেন–বামুন-ঘরের বউ, কিছুদিন গেলেই সুমতি হবে, তারা ফিরে আসবেন। কিন্তু বৃহস্পতির গণনা মিথ্যা হল, তারা ফিরলেন না।

অনেক দিন চলে গেল। বৃহস্পতি এবার এক শিষ্যকে চন্দ্রের বাড়িতে পাঠালেন তারাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। তারা ফিরলেন না, চন্দ্রও তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার নামও করলেন না। একবার নয়, বৃহস্পতির শিষ্য বারবার গেলেন চন্দ্রের বাড়িতে বার্তাবহ হয়ে। বারবার বিফলতায় ক্রুদ্ধ হয়ে বৃহস্পতি নিজেই এবার উপস্থিত হলেন শিষ্যবাড়িতে। চন্দ্রের বাড়িতে। হুংকার দিয়ে চন্দ্রের উদ্দেশে বললেন–ব্যাপারটা কী হচ্ছে? আমার সুন্দরী স্ত্রীটিকে তুমি নিজের ঘরে আটকে রেখেছ? তুমি কি জান না–আমি দেবগুরু, আর তুমি আমার শিষ্য, যজমান?

 প্রথমে একটু ভালভাবেই বলেছিলেন বৃহস্পতি। একটু রেখে ঢেকে। কিন্তু চন্দ্রের মুখে অবহেলার হাসি দেখে বৃহস্পতি বললেন-লজ্জা করে না তোর? গুরুর স্ত্রীকে ভোগ করে যাচ্ছিস? তাকে আটকে রেখেছিস বাড়িতে? গুরুপত্নীগামী পুরুষ যে কত বড় মহাপাতকী–সে কি তুই জানিস না? তুই যদি সত্যিসত্যিই তাকে ভোগ করে থাকি, তাহলে তুই এই দেবস্থানে থাকার যোগ্য নোস একটুওন দেবদনাহাঁসি যদি ভূক্তেয়মঙ্গনা। বৃহস্পতি এবার আসল কথাটা বললেন। বললেন-কালো চোখের সুন্দরী আমার বউটি। আহা! তাকে তুই এই মুহূর্তে ছেড়ে দে, নইলে অভিশাপ দেব এবার। বৃহস্পতি বোঝাতে চাইলেন–তার স্ত্রীর কোনও দোষই নেই, যত দোষ তার শিষ্যের।

চন্দ্রের মাথা রাজার মতোই ঠান্ডা। বৃহস্পতির অনুযোগ একটুও গ্রাহ্য না করে তিনি ঠান্ডা মাথায় বলতে আরম্ভ করলেন–বামুন মানুষের অত কি রাগ করলে চলে, ঠাকুর! ক্রোধের মতো একটা রিপু থাকলে মানুষ কি ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে পারে সেই ব্রাহ্মণ-গুরুকে-ক্রোধাত্তে। তু দুরারাধ্যা ব্রাহ্মণা ক্রোধবর্জিতাঃ। সামান্য দুটো কথা বলার পরেই চন্দ্র এবার বৃহস্পতির তর্ক-যুক্তিতে এলেন। অর্থাৎ বৃহস্পতি যে এতক্ষণ—‘আটকে রেখেছিস’, ‘ভোগ করেছিস, ‘ছেড়ে দে’–এসব কথা বলে বোঝাতে চাইছেন– তার স্ত্রীর কোনও দোষ নেই, চন্দ্রই জোর করে তার স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই অনর্থ ঘটিয়েছেন–সেই ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে চন্দ্র এবার আইনি কায়দায় কথা বলতে আরম্ভ করলেন। চন্দ্র বললেন-সময় হলে তিনি নিজেই ফিরে যাবেন আপনার বাড়ি। এখানে ক’দিন সুখে আছেন, ভালই আছেন, তাতে আপনার কী ক্ষতিটা হল শুনিকা তে হানিরিহানঘ? আর আমি কি তাকে জোর করে আটকে রেখেছি নাকি? এখানে তিনি নিজের ইচ্ছেয় আছেন এবং এখানে থাকতে ভালও লাগছে তার-ইচ্ছয়া সংস্থিতা চাত্ৰ সুখকমার্থিনী হি সা।

 চন্দ্র একেবারে আধুনিক মতে ধর্ষণের দায় এড়িয়ে গেলেন। অর্থাৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়, বরং স্বেচ্ছায় তিনি সুখে আছেন। তার ভাল লাগছে–সুখকামার্থিনী হি সা। সবার শেষে গুরুকে তিনি আশ্বস্ত করে দিলেন–এই তো, আর কিছুদিন থেকে তিনি হয়তো স্বেচ্ছাতেই আপনার বাড়ি যাবেন–দিনানি কতিচিৎ স্থিত্ব, স্বেচ্ছয়া চাগমিষ্যতি। ভাবটা এই-’মনের মধ্যে ভাবনা কিন্তু রেখো সারাক্ষণ’–ইচ্ছা না হলে কিন্তু যাবেন না।

 ক্রুদ্ধ-ক্ষুব্ধ বৃহস্পতি বাড়ি ফিরলেন। পৌরাণিক বলেছেন–শুধু দুর্ভাবনায় চিন্তাতুর হয়ে নয়, কামাতুর হয়েও ফিরলেন বৃহস্পতি–জগাম স্বগৃহং তুর্ণং চিন্তাবিষ্টো স্মরাতুরঃ। পৌরাণিক বৃহস্পতির মনস্তত্ত্ব বুঝেই এই মন্তব্য করেছেন। ঘরে থাকতে দৈনন্দিন দাম্পত্য অবহেলায় যে স্ত্রীকে বৃহস্পতি প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করেননি, সেই স্ত্রীকেই পুরুষাস্তরের শঙ্গার-সংসর্গ-লিপ্ত অবস্থায় কল্পনা করে বৃহস্পতি হয়তো কামাতুর হলেন। ঘরে ফিরে বেশিদিন তার থাকা হল না। আবার এলেন চন্দ্রের বাড়িতে। এবারে বাড়ির দারোয়ানরাই তাকে বাধা দিল। দ্বারপালেরাও প্রভুর ইচ্ছা বোঝে। বৃহস্পতি বাইরে থেকেই তর্জন গর্জন করতে লাগলেন। বললেন–দেবতারা অধম! ঘরে শুয়ে আছিস কী করতে–কিং শেষে ভবনে মন্দ পাপাচার সুরাধম? ভাল চাস তো আমার বউ আমায় ফিরিয়ে দে, নইলে তোর কপালে আমার অভিশাপ নাচছে–দেহি মে কামিনীং শীঘ্র নোচেচ্ছাপং দদাম্যহম্।

চন্দ্র বেরিয়ে এলেন হাসিমুখে। বিজয়ীর হাসি। পরের বউ স্বেচ্ছায় তার বাড়িতে এসে রয়েছে। বাড়ি যাচ্ছে না। তাই বিজয়ীর হাসি হেসে চন্দ্র বাড়ির বাইরে এসে বললেন–মেলা বকছেন কেন, ঠাকুর-কিমিদং বহু ভাষসে? যে অসামান্যা রূপসীটিকে আপনি বউ-বউ’ বলে স্বাধিকার ব্যক্ত করছেন, সে অন্তত আপনার উপযুক্ত নয়। আপনার যদি একান্তই স্ত্রীলাভের এত ইচ্ছা থাকে, তবে নিজের মতো চেহারার একটি খেদি-পেঁচি জোগাড় করে আনুন না, কে আটকাচ্ছে–কুরূপাঞ্চ স্বসদৃশীং গৃহাণান্যাং স্ত্রিয়ং দ্বিজ। টাকা নেই, পয়সা নেই, বউকে ভাল করে আরামে রাখার মুরোদ নেই; আপনার মতো ভিখারির ঘরে কি আর এত সুন্দরী একটি রমণীর মন টেকেভিক্ষুকস্য গৃহে যোগ্যা নেদৃশী বরবর্ণিনী। মেয়েরা নিজের সমান যোগ্য পুরুষকেই পছন্দ করে–এই সরল সত্যটা সম্বন্ধে যদি আপনার একটুও বোধ থাকত তা হলেও হত। চন্দ্র এবার শেষ এবং চরম কথাটা শুনিয়ে দিলেন। বললেন–আপনি এখন যেতে পারেন, গুরুঠাকুর! তারাকে আমি ফিরিয়ে দেব না। আপনার যা ইচ্ছে এবং যা পারেন করুন–যচ্ছক্যং কুরু তৎ কামং ন দেয়া বরবৰ্ণিনী।

দেবগুরু বৃহস্পতি মহা বিপদে পড়লেন। শাপ দিয়ে ভস্ম করে দেবেন তারও উপায় নেই কোনও। অভিশাপ মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়েই আসছিল–কিন্তু চন্দ্র সে অভিশাপের ভয় পাচ্ছেন না একটুও। একে তো তিনি পূর্ব তপস্যার বলে বলীয়ান; দ্বিতীয়ত বৃহস্পতির স্ত্রী স্বয়ং তার অনুরক্তা। এই অবস্থায় বৃহস্পতি বারংবার তার স্ত্রীর অধিকার চাওয়ায় চন্দ্র তাকে শুনিয়ে দিয়েছেন–আপনি নিজেই কামার্ত গুরুদেব নইলে পালিয়ে যাওয়া একটি স্ত্রীলোকের জন্য কেউ আপনার মতো এরকম করে না, কামাৰ্ত্তস্য চ তে শাপো ন মাং বাধিতুমহসি-অতএব আপনার শাপে আমার কিছুই হবে না

বৃহস্পতি কোনও শাপ উচ্চারণ করতে পারলেন না। তার নিজের স্ত্রী তার সঙ্গে বঞ্চনা করেছে, চন্দ্রকে অভিশাপ দিয়ে কী লাভ হবে তার। রাগে কাঁপতে কাঁপতে এবার তিনি আর নিজের বাড়ি ফিরে এলেন না। সোজা উপস্থিত হলেন ইন্দ্রালয়ে, ইন্দ্রের কাছে। ইন্দ্রের কাছে নালিশ জানিয়ে বৃহস্পতি বললেন–আমার সুন্দরী স্ত্রীটিকে চন্দ্র হরণ করেছে। বারবার তাকে বলছি, কিন্তু সে আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিচ্ছে না। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে এ ব্যাপারে?

 ইন্দ্র দেবতাদের রাজার মতোই বৃহস্পতিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–আমি অবশ্যই আপনার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনব আপনার কাছে। দরকার হলে যুদ্ধ করব। ইন্দ্র প্রথমে একটি দূত পাঠালেন চন্দ্রের কাছে। দূত গিয়ে প্রথমে ইন্দ্রের সদুপদেশ অনেক শোনাল-পরের স্ত্রী, বিশেষত গুরুপত্নীকে কি তোমার মতো নীতিজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের ভোগ করা শোভা পায়? তাছাড়া ঘরে কি তোমার ভোগ্যা স্ত্রীর অভাব আছে? দক্ষের কন্যারা সকলেই তোমার স্ত্রী। এত নক্ষত্র-সুন্দরী থাকতে তোমার আবার গুরুপত্নীকে সম্ভোগ করার ইচ্ছে হল কেন–গুরুপত্নীং কথং ভোণ্ডুং ত্বমিচ্ছসি সুধানিধে?

ইন্দ্র দূতের মুখে এইটুকু জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। সুধাকর চন্দ্রের তৃপ্তির জন্য তিনি আরও কিছু ভাবনা-চিন্তাও করেছেন। দূতমুখে ইন্দ্র জানালেন–বেশ তো, তোমার নক্ষত্র-সুন্দরীদের যদি একান্তই ভাল না লাগে, তবে মনোহর এই স্বর্গভূমিতে সম্ভোগ-তৃপ্তির ব্যবস্থা কি কিছু কম আছে? অপ্সরা সুন্দরী মেনকা আছেন, রম্ভা আছেন, উর্বশী আছেন। তুমি ভোগ করো। কে না করেছে? গুরুপত্নী তারাকে তুমি ছেড়ে দাও বাপু-ভূঙ তাঃ স্বেচ্ছয়া কামং মুঞ্চ পত্নীং গুয়োরপি। তাছাড়া এই নিয়ে দেবতাদের মধ্যে অকারণ একটা ঝগড়াঝাটি পাকিয়ে উঠবে, সেটাও তত বাঞ্ছনীয় নয়। ইন্দ্র বোধহয় সামান্য যুদ্ধের ইঙ্গিত করলেন।

চন্দ্র অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে দূতের মুখে ইন্ত্রের কথা শুনলেন। এবার তার জবাব দেবার পালা। চন্দ্রের জবাবের মধ্যে শুরুর প্রতি ভক্তি বিশেষ প্রকাশ পেল না; কেঁচো খুঁড়তে সাপের মতো দেবগুরুর ব্যক্তিগত পূর্ব জীবনের এমন কতগুলি ঘটনা চন্দ্রের মুখে উচ্চারিত হল, যা ইন্দ্রদুতের কাছে তো বটেই, বৃহস্পতির কাছেও বড় কতিমধুর ছিল না। আসলে বৃহস্পতি নিজের জালে নিজেই ধরা পড়েছিলেন, অথবা বলা উচিত নিজের কপাল নিজেই পুড়িয়েছিলেন। কেমন করে তা বলি?

.

১৮.

ইন্দ্রের দূতকে শুনিয়ে স্বয়ং ইন্দ্রের উদ্দেশেই কথাটা বললেন চন্দ্র। চন্দ্র বললেন–যেমন দেবতাদের রাজা ইন্দ্র ঠাকুরটি, ঠিক তেমনই তার গুরুদেব এই বৃহস্পতি ঠাকুর। দুজনের বুদ্ধিই ঠিক এক রকম–পুরোধাপি চ তে তাক্‌ যুবয়োঃ সদৃশী মতিঃ। আরে, পরকে উপদেশ দেওয়ার সময় সবাই মস্ত বড় পণ্ডিত, কিন্তু কাজের বেলায় পণ্ডিতেরা নিজের উপদেশ নিজেই খেয়াল করতে পারেন না–পরাপদেশে কুশলা ভবন্তি বহুবো জনাঃ। এই যে বাক্যবাগীশ বৃহস্পতি, তোমাদের গুরু-ঠাকুর। তিনি না মানব-জাতির হিতের জন্য বিরাট শাস্ত্র লিখে ফেলেছেন! তো তার শাস্ত্রের বচন এখন কেমন লাগছে?

মনে রাখা দরকার সেকালের দিনে শুরু হয়ে বসাটা অত সহজ কাজ ছিল না। শুধু ব্রাহ্মণ্য নয়; বিদ্যা, শিক্ষা এবং তপস্যা–সব দিক দিয়েই শুরুদেবদের যথেষ্ট এলেম থাকার দরকার ছিল। বিশেষত যারা সম্পূর্ণ একটি সমাজের গুরু হতেন, অথবা বড় বড় রাজবংশের শুরু হতেন, তাদের রাজনীতির বোধও ছিল অতি উচ্চ মার্গের। বৃহস্পতি সমস্ত দেব-সমাজের গুরু। রাষ্ট্রনীতি এবং সমাজনীতি নিয়ে তিনি যে রীতিমতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ একখানি গ্রন্থ লিখে ফেলেছিলেন–সে প্রমাণ মহাভারতের মধ্যে বারংবার আছে। সেকালের দিনে রাষ্ট্রনীতি এবং সমাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলি অর্থশাস্ত্রের অন্তর্গত ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র খুললেই সেটা বোঝা যায়। স্বয়ং কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রের মধ্যে দেব-সমাজের নীতিনির্ধারক বৃহস্পতি এবং অসুর-সমাজের নীতিকার শুক্রাচার্যের নানা মন্তব্য উদ্ধার করেছেন রাষ্ট্র এবং সমাজ-নীতির বিষয়গুলি পরিষ্কার করার জন্য।

 এতে কোনও সন্দেহই নেই যে, বৃহস্পতির নীতি-নিয়মগুলি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী অর্থাৎ কৌটিল্যের আবির্ভাবের আগেই যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। মহাভারতীয় চরিত্রগুলির মধ্যে যাঁরা জ্ঞানী-গুণী এবং পণ্ডিত বলে পরিচিত, তারা বৃহস্পতির রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেমন জানতেন, ঠিক তেমনই জানতেন শুক্রনীতি। আসল কথা, বৃহস্পতির শাস্ত্রের সঙ্গে শুক্রাচার্যের নীতি নিয়মের পার্থক্য ছিল। ভাল পড়ুয়ারা দুটোই জেনে ক্ষেত্রবিশেষে নিজের মত ব্যক্ত করতেন। মহাভারতে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন পিতামহ ভীষ্ম। তিনি বৃহস্পতি এবং শুক্র–দুজনের লেখা অর্থশাস্ত্রই খুব ভালভাবে রপ্ত করেছিলেন।

কিন্তু অনেকেই আবার এমন ছিলেন, যারা রাষ্ট্রের মঙ্গল বিধানে বৃহস্পতি অথবা শুক্র–একজনের মত বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতেন। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখব–পাঞ্চাল-যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্নকে যখন বৃহস্পতি-নীতির পাঠ দিতেন অধ্যাপক, তখন সেই পাঠ শুনে-শুনেই বৃহস্পতির শাস্ত্র অধিগত করেছিলেন পাণ্ডব-ঘরণী দ্রৌপদী। রাষ্ট্র-বিষয়ক সেই সব চিন্তা সমস্ত জীবনে দ্রৌপদীর কত যে কাজে লেগেছে, সে সব আমরা পরে দেখব। এখন দেখতে হবে-বৃহস্পতি নিজে বই লিখে নিজের কী ক্ষতি করেছেন? কারণ, চন্দ্র বলেছেন–পরকে উপদেশ দেওয়ার সময় সবাই খুব দড়, কিন্তু নিজের বেলায় সে উপদেশ খাটে না মোটেই। অতএব সামান্য হলেও আমাদের জানতে হবে–কী সেই উপদেশ, যা পরকে দেওয়ার সময় বৃহস্পতির সমস্যা হয়নি, এবং যা কার্যক্ষেত্রে তার সমস্যা বাড়িয়েছে।

বস্তুত, রাষ্ট্র এবং সামাজিক নীতি নির্ধারণে বৃহস্পতির নির্দেশ খুব অল্প নয়। যুদ্ধের উদ্যোগ করা উচিত কিনা, অথবা যুদ্ধ আরম্ভ হলে কীভাবে কোন ব্যুহ অনুসারে সৈন্য সাজিয়ে রাজা যুদ্ধ করবেন–এইসব কূটনৈতিক বিষয়ে যেমন বৃহস্পতির সুস্পষ্ট মত আছে, তেমনই সামাজিক তর্কযুক্তির ক্ষেত্রেও বৃহস্পতির বহুত্তর বক্তব্য আছে এবং সেই বক্তব্যগুলিই এই মুহূর্তে চন্দ্রের অনুকূলে এসেছে।

 স্বর্গের মতো একটা রাজ্যে, দেবতাদের মতো ভোগী সমাজে শুরু হয়ে বসার ফলে মেয়েদের ব্যাপারে বৃহস্পতির অভিজ্ঞতা কিছু কম ছিল না। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি তার নীতিশাস্ত্রে বিধান দিয়েছিলেন যে, কোনও রমণী যদি স্বেচ্ছায় পুরুষের সম্ভোগবাসনায় সম্মতি দেয়, তবে তাকে ভোগ করায় পুরুষের তত দোষ লাগে না। চন্দ্র বললেন–আমি তো তাই করছি। গুরুর পত্নী স্বয়ং আমার আসঙ্গ-লিপ্সা করছেন, আমি তার বাসনা পূরণ করছি তারই সম্মতিক্রমে। তবে এই নিয়ে দেবতাদের সঙ্গে আমার বিরোধের কোনও কারণই ঘটতে পারে না–কো বিরোধোত্র দেবেশ কাময়ানাং ভজ স্ক্রিয়। তারা বৃহস্পতির ধর্মপত্নী হতে পারেন, কিন্তু তিনি ভালবাসেন আমাকে, বৃহস্পতিকে তিনি ভালবাসেন না একটুও। তো বৃহস্পতি নিজের লেখা ধর্ম-নীতি অনুসারে কী করে এই অনুরক্তা রমণীটিকে আমি জেনে-বুঝে তার কাছে যেতে দিই–অনুরক্তা কথং ত্যাজ্য ধর্মতো ন্যায়তস্তথা।

ইন্দ্রের দূত কথাপ্রসঙ্গে একসময় একটু যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছিল। চন্দ্র সেকথা ছাড়েননি। নিজের দাপট দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন–যান, যান। বড় বড় কথা না বলাই ভাল। নিজের স্ত্রী, পরের স্ত্রী–এত উপদেশের কিছু দরকার নেই। আমার ক্ষমতা আছে আমি ভোগ করছি। যার ক্ষমতা আছে, সব কিছুই তার নিজের স্বকীয়ং বলিনাং সর্বং দুর্বলানাং ন কিঞ্চন–দুর্বল লোকের কিছুই নিজের নয়। চন্দ্র এবার দেবগুরুর উদ্দেশে বড় কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন এবং সে কথাটার মধ্যে বৃহস্পতির নিজস্ব ব্যর্থতার কথাও বড় প্রকট হয়ে উঠল। চন্দ্র বললেন–অনুরাগিণী স্ত্রীর সঙ্গেই লোকে ঘর বাঁধে, নতুন জীবন শুরু করে। কিন্তু স্ত্রী যদি একজনকে ভালই না বাসতে পারেন, তার সঙ্গে তবে থাকবেন কী করে? তারা বৃহস্পতির ঘরে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু যেদিন তিনি দেখলেন যে তার স্বামী তাকে ছেড়ে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর সঙ্গে শৃঙ্গার-রমণে মত্ত হচ্ছেন, সেদিন থেকেই সুন্দরী তারা আর বৃহস্পতিকে ভালবাসেন না। তিনি বিরক্ত হয়ে গেছেন বৃহস্পতির ওপর–বিরক্তেয়ং তদা জাতা চকমেনুজকামিনীম্। অতএব যাও দূত! তারাকে আমি ফেরত দেব না। ইন্দ্রর যা ইচ্ছে হয় করতে পারেন।

এই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ল। অবধারিতভাবে প্রশ্ন আসে-বৃহস্পতির অনুজ ভ্রাতাটি কে? তার সঙ্গে বৃহস্পতির সম্পর্কই বা কী? এই কথাগুলো অল্প হলেও বলতে হবে আমায়। যদিও মনে ভয় আছে–আপনারা ভাবতে পারেন–মহাভারতের কথারম্ভেই এসব। কী আরম্ভ হল? এর বউ পালাচ্ছে। তার বউ কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রেমলিন্দু। এসব কী হচ্ছে? সবিনয়ে জানাই–এগুলি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কেন না প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে-বৃহস্পতি কিংবা চন্দ্র-এঁরা প্রত্যেকেই বিশাল ব্যক্তিত্ব। আমি একথা বলছি না যে, বিশাল ব্যক্তিত্ব মানেই সাত খুন মাপ। কিন্তু উলটো দিকে ভাবতে হবে–বিশাল ব্যক্তিত্ব হলে কিছু খুন তো মাপ হয় বটেই।

মনু রাজধর্মাধ্যায়ে বলেছিলেন-অন্যায়কারী ব্যক্তির শক্তি এবং বিদ্যা ভালমতো বিচার করে যতটুকু শাস্তি তার প্রাপ্য রাজা সেইটুকু দণ্ডই দেবেন-তং দেশকালৌ শক্তিঞ্চ বিদ্যাঞ্চাবেক্ষ্য তত্ত্বতঃ। আজ যদি মহামান্য সুনীতি চ্যাটার্জি এবং আমি চুরির দায়ে ধরা পড়ি, তাহলে একই অভিযোগে আমার যা শাস্তি হবার কথা সুনীতিবাবুরও তাই হবার কথা। কিন্তু শাস্তি দেবার সময় সুনীতিবাবুর মহতী বিদ্যাবত্তা তথা সাংস্কৃতিক জগতে তার মহান অবদানের কথা বিচার করে আদালত তাকে আমার চাইতে কম শাস্তি দেবেন, অথবা শাস্তি নাও দিতে পারেন। শুধু মৃদু তিরস্কার করেও ছেড়ে দিতে পারেন। একইভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মমতা ব্যানাজী বা মনমোহন সিং যদি আমার সঙ্গে একই অপরাধে অভিযুক্ত হন, তবে তাদের যা। শাস্তি হওয়া উচিত, আমারও তাই হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখবেন, একই শাস্তি হচ্ছে না। তার কারণ, এতদিন তারা যে জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাদের পিছনে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন আছে, সেটা আদালতের বিচার-চর্যার মধ্যে আসবে এবং স্বভাবতই তখন তার শাস্তি আমার তুলনায় অনেক হালকা হয়ে যাবে। ইচ্ছা করলে কিছুদিন পূর্বেই অযযাধ্যাকাণ্ডের মামলায় বি জে পি নেতা কল্যাণ সিংহের সামান্য শাস্তির কথা স্মরণ করতে পারেন।

বলতে পারেন–এও কি কোনও গণতান্ত্রিক বিচার হল? নাকি এটার মধ্যে বিচারব্যবস্থার কোনও সমদৃষ্টি লক্ষিত হল? আমি বলব–যে গণতান্ত্রিকতায় আমার বুদ্ধি এবং সুনীতিবাবুর বুদ্ধিকে এক মাত্রায় ফেলে বিচার করা হবে অথবা যে বিচারব্যবস্থায় আমাকে এবং জ্যোতি বসু-নরসিমা রাও-এর শক্তিকে সমদৃষ্টিতে দেখা হবে–সেই গণতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়াই ভাল, তাতে সমাজের বিপদ বাড়বে। বিদ্যা-বুদ্ধি, শক্তি, নিপুণতা তাতে ধুলোয় মিশে যাবে। মনে রাখতে হবে–মানুষের চারিত্রিক এবং ইন্দ্রিয়জ ক্রটিগুলি একান্তই মনুষ্যোচিত। তার জন্য জন-সমাজে একজন বিরাট পুরুষের অবদান তুচ্ছ হয়ে যায় না। আদালতের ন্যায়াধীশও সেই বিচারটা মাথায় রাখতে পারেন বলেই তিনি ন্যায়াধীশ। বিচার-ব্যবস্থা আমার-আপনার হাতে থাকলে উত্তম-অধমের তুল্যমূল্যতা হত এবং ঠিক সেই কারণেই আমি-আপনি বিচারপতি হবার উপযুক্ত নই।

আমি যে বেশ বড়সড়ো একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম তার কারণ একটাই, বৃহস্পতি কিংবা চন্দ্রকে আমরা যেন আমাদের সাধারণ বিচার-বুদ্ধিতে পরিমাপ না করি। তাছাড়া সমাজের বিধি-ব্যবস্থা তখন কেবল নতুন তৈরি হচ্ছে। ইন্দ্রিয়ের শিথিলতাকে মানুষ তখন কেবল সংযমের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে আরম্ভ করেছে। ফলত আমাদের আধুনিক পরিশীলিত বুদ্ধি দিয়ে যদি মহাভারতীয় চরিত্রগুলির বিচার করতে আরম্ভ করি, তাহলে সেটা সমীচীন তত হবেই না, বরং অন্যায় হবে।

মহাভারতে দেখবেন–দেবগুরু বৃহস্পতি চিত্রশিখণ্ডী’র শিষ্য। সৃষ্টির প্রথম কল্পে ব্রহ্মা যে মানস-পুত্রদের জন্ম দেন তাদের মধ্যে মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু এবং বশিষ্ঠ–এই সপ্তর্ষি চিত্রশিখণ্ডী’ নামে বিখ্যাত। এঁদের মধ্যে চন্দ্র অত্রির পুত্র। বৃহস্পতি আঙ্গিরার পুত্র। সমাজের ন্যায়-নীতি এবং রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন প্রথম তৈরি করেন ওই চিত্রশিখণ্ডী নামে পরিচিত সাতজন ঋষিই–আস্যৈঃ সপ্তভিরুগীর্ণং লোকধর্মমনুত্তমম্। এই সাত মুনির নিয়ম-কানুন এবং মনু মহারাজের ধর্মশাস্ত্র–যাঁরা প্রথম অধিগত করেন তারা হলেন বৃহস্পতি এবং শুক্রাচার্য। এক্ষেত্রে বৃহস্পতি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়সমাজে বৃহস্পতির মাধ্যমেই রাষ্ট্র এবং লোকধর্মের নীতিগুলি প্রথম প্রচারিত হয়–বৃহস্পতিসকাশাদ বৈ প্রান্সতে দ্বিজসত্তমাঃ। বৃহস্পতি তার সমস্ত বিদ্যা শিক্ষা চেদি বংশের রাজা উপরিচর বসুকে দান করেন, কিন্তু সে কথা পরে।

আমার বক্তব্য–বৃহস্পতি খুব কম লোক ছিলেন না। সমস্ত দেব সমাজের গুরু তো বটেই। এত বড় মর্যাদার জন্যই হোক, অথবা অন্য কোনও কারণে বৃহস্পতির চারিত্রিক শিথিলতা কিছু ছিল। তবে চন্দ্র যেমন বললেন–বৃহস্পতি তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর প্রতি আসক্ত ছিলেন, সেটা মহাভারতে তেমন করে পাই না। বরং উলটো কথা পাই যে, তিনি কোনও এক সময় তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উতথ্যের (কোনও মতে উশিজ) পত্নী মমতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে শারীরিক সংসর্গেও লিপ্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনার গতির ওপর বৃহস্পতির নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তিনি যেভাবে যা চেয়েছিলেন, ঘটনা সেভাবে ঘটেনি। বৃহস্পতির সেই চরিত্র-স্থলনের ফল ঋষি ভরদ্বাজ, এবং এর কথাও পরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে আমাদের কাছে।

কনিষ্ঠের স্ত্রীর সঙ্গে প্রণয়াসক্ত হওয়ার যে অবক্ষেপ আমরা চন্দ্রের মুখে শুনেছি, সে ব্যাপারে মহাভারত স্পষ্টভাবে কিছু না বললেও, কনিষ্ঠের সঙ্গে বৃহস্পতির সদ্ভাব ছিল না। মোটেই। বৃহস্পতির ছোট ভাই হলেন সংবর্ত। তিনিও ব্রাহ্মণ-প্রবর ঋষি ছিলেন, কিন্তু বৃহস্পতির সঙ্গে তার দুঃসম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তার পক্ষে বাড়িতে থাকাই সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, রাগে অভিমানে তিনি একদিন পরনের জামা-কাপড় পর্যন্ত খুলে রেখে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছিল, আমরা তা খানিকটা আন্দাজ করতে পারি।

একটি সম্পন্ন পরিবারে প্রায় সকলেই বিদ্যা-বলশালী হলেও যদি তাদের মধ্যে কেউ চরম সম্মানের পদবী লাভ করেন, তাহলে তার ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির সঙ্গে সঙ্গে মেজাজও কিছু চড়া হয়। বৃহস্পতিকে দেবতারা তাদের গুরু হিসেবে বরণ করে নেওয়ার পর, আমাদের ধারণা–তার মধ্যেও এক ধরনের স্ফীতবোধ কাজ করছিল। কারণ, ইন্দ্র অসুরদের হারিয়ে দেওয়ার পর নিজে বৃহস্পতিকে পৌরোহিত্যে বরণ করেছেন–ইন্দ্ৰত্বং প্রাপ্য লোকেষু ততো বব্রে বৃহস্পতিম্।

মহাভারতে দেখছি–কুরু-পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষ মরুত্ত রাজা একবার এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে কথা আরম্ভ হয়েছে বৃহস্পতি আর সংবর্তকে নিয়েই। দুজনেই মহর্ষি অঙ্গিরার পুত্র, তেজে-তপস্যায় দুজনেই পিতার তুল্য–পিতুস্তুল্যৌ বভূবতুঃ। দুজনের ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আধুনিক পরিবারের দুরবস্থার মতোই তাদের ভাতের হাঁড়ি আলাদা হল–তাবতি স্পর্ধিনৌ রাজন্ পৃথগাস্তাং পরস্পর। কিন্তু হাঁড়ি আলাদা হলেই সব সময় পারিবারিক শান্তি সর্বাংশে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বৃহস্পতির তখন বাড়-বাড়ন্ত হচ্ছে। পৃথগান্ন হয়েও তিনি ছোটভাই সংবর্তকে যথেষ্ট অত্যাচার উৎপীড়ন করতে থাকলেন। মানসিক অত্যাচার শেষ বিন্দুতে পৌঁছোলে সংবর্ত পৈত্রিক এবং নিজের ধন-সম্পত্তি সব ছেড়ে-ছুঁড়ে–আমাদের মতো এক কাপড়েও নয়–একেবারে উলঙ্গ হয়ে বনে চলে গেলেন

স বাধ্যমানঃ সততং জাত্রা জ্যেষ্ঠেন ভারত।
অর্থানুসৃজ্য দিবাসা বনবাসমবোয়ৎ।

এর মধ্যে বৃহস্পতির অবস্থার আরও উন্নতি হল। দেবগুরুর পদ পেলেন তিনি। ওদিকে মরু রাজার সঙ্গে স্বর্গের ইন্দ্রের তত ভাব-ভালবাসা ছিল না। ইন্দ্রের সঙ্গে স্পর্ধা করেই তিনি যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন এবং সেই যজ্ঞের পুরোহিত হবার জন্য তিনি বৃহস্পতিকেই গিয়ে ধরলেন। দেবরাজ মরুত্তের অভিসন্ধি পূর্বাহ্নেই বুঝেছিলেন এবং বৃহস্পতিকে তিনি আগেই সাবধান করে বলে দিয়েছিলেন–দেখুন ব্রাহ্মণ! আমি দেবরাজ আর আপনি হলেন সেই দেবরাজের পুরোহিত। যে হাতে আপনি দেবরাজের যজ্ঞে আহুতি দেন, সেই হাতে যেন কোনও মর্ত্যরাজার যন্ত্রে আহুতি দেবেন না। ইন্দ্র এবার পরিষ্কার জানালেন-দেখুন, রাজা মরুন্তু এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। আপনি যেন কোনওভাবেই তার পৌরোহিত্য করবেন না–বৃহস্পতে মরুত্তস্য মা কার্ষীঃ কথঞ্চন। এবার চরম সাবধানবাণী, হ্যাঁ, আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ, আপনার স্বাধীনতা নিশ্চয়ই আছে–তবে যদি মরুত্তের পৌরোহিত্য করতে হয় করুন; কিন্তু আমাকে বাদ দিতে হবে তাহলে। হয় আপনি মরুত্তকে স্বীকার করুন, নয় আমাকে, যে কোনও একটা–পরিত্যজ্য মরুং বা যথাযোষং ভজস্ব মাম্।

বৃহস্পতি কেমন যেন একটু থমকে গেলেন। একটু চুপ করেও গেলেন। ভেবে দেখলেন নিশ্চয়ই যে, দেবতাদের সামাজিক স্থিতি এবং আভিজাত্য মানুষের থেকে অনেক বড়। দেবতাদের সঙ্গে মিলে-মিশে চললে তারও মর্যাদা অনেক বাড়বে। আরও বুঝলেন যে, ব্রাহ্মণোচিত স্বাধীনতায় আজ যদি ইন্দ্রকে প্রত্যাখ্যান করার হঠকারিতা করেন, তাহলে ভবিষ্যতে তাঁকে মনুষ্যলোকের এ-রাজা-সে রাজার পৌরোহিত্য কুড়িয়ে দিন কাটাতে হবে। তার থেকে এই চিরকালের বাধা কাজ বৃহস্পতির মর্যাদা এবং সম্পত্তি–দুইই বাড়বে। ইন্দ্রকে তিনি সোজা বলেই দিলেন–আরে! কত অসুর-রাক্ষস বধ করে তুমি এই তিন ভুবনের অধিপতি হয়েছ, সমস্ত লোক তোমার ওপরেই নির্ভর করে আছে, সেই তোমার মতো বড় মানুষের পৌরোহিত্য করে আমি কি আর মানুষের পৌরোহিত্য করতে পারি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক দেবরাজ; যে-আমি এর দেবযজ্ঞে আহুতি দেওয়ার সময় ঘিয়ের হাত ধরেছি, সেই আমি কখনও মানুষের যজ্ঞে ঘিয়ের হাত ধরব না

সমাসিহি দেবেন্দ্র নাহং মর্তস্য কহিচিং।
গ্রহীষ্যামি সুবং যজ্ঞে শৃণু চেদং বচো মম।

এদিকে মরুত্ত-রাজা বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করে পুরোহিত-বরণের জন্য বৃহস্পতির কাছে উপস্থিত হলেন। বললেন–আপনাকে আগে যে যজ্ঞের কথা বলেছিলাম, সেই যজ্ঞের আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছে। আপনি আমাদের কুলগুরু। অতএব চলুন, সেই যজ্ঞের পৌরোহিত্য গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করুন। বৃহস্পতি বললেন–আমার পক্ষে এই পৌরোহিত্য করা সম্ভব নয় রাজা। দেবরাজ ইন্দ্র আমাকে পৌরোহিত্যে বরণ করেছেন। আমিও তার প্রার্থনা স্বীকার করেছি। কাজেই এ কাজ সম্ভব নয়।

পদবিতে উঠলে যা হয়। এখনকার দিনের বড় মানুষের মুখে যেমন শুনি–সম্ভব নয়, আমার সময়-টময় নেই, তাছাড়া ওই সময়টায় সি এম-এর একটা প্রোজেক্ট প্ল্যান আমাকে দিতে হবে-বৃহস্পতির অবস্থাও একই রকম। মরুত্ত রাজা কত করে বললেন-সে কি ঠাকুর? আমি আপনার কতকালের যজমান। সেই বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে আপনি আমাদের ক্রিয়া-কর্ম সবই করছেন। আমাকে অস্বীকার করলে চলে কী করে? বৃহস্পতি বড় মানুষের। মতোই বলে দিলেন–সম্ভব নয়। মরণহীন দেবতাদের যাজন করে দিন কাটছে আমার। আমি কীভাবে তোমার মতো মরণশীল মানুষের যাজন করি–অমর্ত্যং যাজয়িত্বাহং যাজয়িয্যে কথং নরম্?

মরুত্ত ফিরে এলেন। পথে বিপত্তারণ নারদের সঙ্গে দেখা। রাজা সব ঘটনা তাকে আনুপূর্বিক জানালেন। নারদ বৃহস্পতিকেও চেনেন, তার ছোট ভাই সংবর্তকেও চেনেন। কলহের মনস্তত্ত্ব ডাল জানা থাকায় নারদ এও বুঝতে পারলেন যে একমাত্র সংবর্তকে পৌরোহিত্যে বরণ করলেই বৃহস্পতি যেমন জব্দ হবেন তেমনই তার রাগ হবে। নারদ বললেন–মহারাজ আপনার চিন্তার কোনও কারণই নেই। আপনি সোজা চলে যান মহর্ষি অঙ্গিরারই অন্য পুত্র সংবর্তের কাছে। তিনি বৃহস্পতির ছোট ভাই। তিনিই আপনার যজ্ঞ-কর্ম সম্পন্ন করবেন। নারদ সংবর্তের ঠিকানাও দিলেন মরুত্ত-রাজাকে। রাজা কাশীতে গিয়ে সংবর্তের দেখা পেলেন এবং যথাবিধি তাকে যজ্ঞের আমন্ত্রণও জানালেন।

সংবর্ত এই বিশাল যজ্ঞ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। বৃহস্পতির উৎপীড়নে তিনি ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিগম্বর হয়ে কাশীতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। রাজার কাছে তিনি তার অক্ষমতার কথা লুকোলেন না। বললেন-দেখুন রাজা! মানসিক-শারীরিক নানা জ্বালা-যন্ত্রণায় আমার বায়ুরোগ ধরে গেছে, আর আমি চলি-ফিরিও নিজের ইচ্ছামতো-বাতপ্রধানেন ময়া স্বচিত্তবশবর্তিনা-স্বভাবটাও আমার বিকারগ্রস্ত। এ অবস্থায় আপনি আমায় যজ্ঞ সম্পাদনের। ভার দিয়ে ঠিক কাজ করছেন না বোধহয়। সংবর্ত এবার রাজাকে এড়ানোর জন্য তাকে বৃহস্পতির ঠিকানা দিয়ে বললেন–আমার দাদা হলেন বৃহস্পতি। এ সমস্ত বড় বড় যজ্ঞ তিনিই খুব ভাল করে করতে পারবেন। তাছাড়া তিনি স্বয়ং দেবরাজের পুরোহিত। তাকে দিয়ে। আপনার কাজ হবে ভাল–বর্ততে যাজনে চৈব তেন কর্মাণি কারয়।

বৃহস্পতিকে যজ্ঞ করানোর প্রস্তাব করার পর সংবর্ত কিন্তু নিজের ক্ষোভটুকু আর চেপে রাখতে পারলেন না। বলে ফেললেন–বৃহস্পতি আমার বড় ভাই হলে কী হয়, তিনি আমার ঘর-সংসার, গৃহস্থধর্ম সব নষ্ট করেছেন। আমার যজমান যাঁরা ছিলেন, তারা আমার দাদার চাপে কেউ আর আমাকে পৌরোহিত্যে বরণ করে না। এমন কি, জানেন–আমার ঘরের ঠাকুর-বিগ্রহগুলি পর্যন্ত আমার দাদা নিয়ে নিয়েছেন। তিনি আমার সব বরবাদ করে শুধু এই শরীরটা মাত্র ছেড়ে দিয়েছেন–পূর্বজেন মক্ষিপ্তং শরীরং বর্জিতং ত্বিদ। সংবর্ত আরও জানালেন–এখন যদি দাদা বৃহস্পতির অনুমতি ছাড়াই আমি আপনার যজ্ঞ করি, তাহলে আর দেখতে হবে না। আপনি মহারাজ আগে তার কাছে যান। মরুত্ত পূর্বের ঘটনা বিবৃত করলেন এবং বৃহস্পতির প্রত্যাখ্যানের খবরও তাকে জানালেন।

বৃহস্পতি এবং সংবর্তের দ্বন্দ্বের শেষ হয়নি। তবে এই উপাখ্যানের পরম্পরায় জানাই সংবর্ত মরুত্ত রাজার যজ্ঞে পৌরোহিত্য করেছিলেন এবং বৃহস্পতির অনিচ্ছা, বিদ্বেষ এবং বাধা সত্ত্বেও তিনি স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রকে মন্ত্রে বশীভূত করে মরুত্ত রাজার যজ্ঞে সোমপান করতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু আপাতত এই উপাখ্যানের পরম্পরা আমাদের কাছে তত জরুরি নয়। জরুরি শুধু সংবর্তের ক্ষোভটুকু। তিনি বলেছিলেন–আমার বড় ভাই হয়েও তিনি আমার ঘর-সংসার, গার্হস্থ্য ধর্ম ছারখার করে দিয়েছেন, আমার যজমান নষ্ট করেছেন, ঘরের দেবতাও তিনি নিয়ে নিয়েছেন–গার্হস্থ্যঞ্চৈব যাজ্যাশ্চ সর্বা গৃহ্যাশ্চ দেবতাঃ।

আমাদের জিজ্ঞাসা হয়–কী এমন ঘটেছিল, যাতে এই ব্রাহ্মণ ঋষির সোনার সংসার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? কী এমন ঘটেছিল, যাতে তাকে পরিধেয় বস্ত্র পর্যন্ত ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিলউন্মত্তবেশং বিভ্রং স চংক্রমীতি যথাসুখম্। ঠিক এই সময়ে আমাদের চন্দ্রের কথা স্মরণ করতে হবে। চন্দ্র ইন্দ্রের দূতকে বলেছিলেন–যান আর কথা বাড়াবেন না। সুন্দরী তারা সেইদিন থেকেই তার স্বামী বৃহস্পতির ওপর বিরক্ত হয়ে গেছেন, যেদিন তিনি দেখেছিলেন-তার ভালবাসার স্বামী তার নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত- বিরক্তেয়ং তদা জাতা চকমেনুজকামিনীম্।

এই জন্যই কি সংবর্তের ঘর-সংসার গার্হস্থ্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? যাকে নিয়ে গৃহস্থ-ধর্ম, সেই স্ত্রীই যদি অন্য পুরুষের দ্বারা লঙ্ঘিত হয়ে থাকে তবে তাকে সব ছেড়ে-ছুঁড়ে বিবাগী হয়েই বেরোতে হবে উন্মত্রে বেশে। চন্দ্র সংবর্তের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে পরিষ্কার বলে দিলেন-সুন্দরী তারাকে আমি ফিরে পাঠাব না। সে তার স্বামীকে ভালবাসে না। সে ভালবাসে আমাকে, আর আমিও তাকে ভালবাসি। তুমি ইন্দ্র আর বৃহস্পতি, দুজনকেই বোলো-যদি ঘর বাঁধতে হয় তো ভালবাসার রমণীটিকে নিয়েই ঘর বাঁধা ভাল, অপছন্দের বউকে নিয়ে ঘর বাঁধা যায় না–গৃহারম্ভন্তু রক্তায়াং বিরক্তায়াং কথং ভবেৎ। যাও তুমি দূত। গিয়ে বলো তোমার ইন্দ্রকে–তার তো অনেক ক্ষমতা, তিনি যা ইচ্ছে করুন। আমি তারাকে ফেরত পাঠাব না–ন দাস্যেহং বরারোহাং গচ্ছ দূত বদ স্বয়ম্।

.

১৯.

বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দিলেন না চন্দ্র। ইন্দ্রের দূত ইন্দ্রের কাছে ফিরে গেলেন। দেবসমাজে এই ঘটনা নিয়ে দারুণ হই-হই পড়ে গেল। দেবরাজ ইন্দ্র দেবগুরুর অবমাননায় অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন। তার নিজেরও অপমান কিছু কম হয়নি। তার সনির্বন্ধ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন চন্দ্র। অতএব আর সহ্য করা যায় না। ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির সম্মানে যুদ্ধের উদ্যোগ নিলেন। দেবসৈন্যদের মধ্যে সাজ-সাজ রব পড়ে গেল।

 বড় বড় যুদ্ধে যা হয়। কে কোন পক্ষ সমর্থন করবেন, কে কার পক্ষে যোগ দেবেন–এসব সিদ্ধান্ত খুব তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। দেবতাদের যুদ্ধোদ্যোগ দেখামাত্র অসুর-গুরু শুক্রাচার্য। চন্দ্রের কাছে এলেন। দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে তার চির শত্রুতা। সেই শত্রুতাবশতই যেন ব্যাপারটা অন্যায় হলেও তিনি চন্দ্রের পক্ষ সমর্থন করে তাকে বললেন-বৃহস্পতির বউকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও দরকার নেই তোমার-মা দদস্বেতি তং বাক্যমুবাচ শশিনং প্রতি–আমি তোমাকে সাহায্য করব। দেবদেব শঙ্কর শুক্রাচার্যকে চন্দ্রের পক্ষপাতী দেখে ইন্দ্রের পক্ষে যোগ দিলেন। তিনি তার মস্ত আজগব ধনুক দিয়ে চন্দ্রকে শায়েস্তা করবেন বলে ঠিক করলেন। বৃহস্পতির স্ত্রীর সঙ্গে চন্দ্রের আচরণে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। রুদ্র-শিব যেহেতু এক সময়ে বৃহস্পতির পিতার শিষ্য ছিলেন,–স হি শিষ্যো মহাতেজাঃ পিতৃঃ পূর্বে বৃহস্পতেঃ–অতএব বৃহস্পতিকে সমর্থন করলেন স্বয়ং মহাদেব। দৈত্য-দানবেরা শুক্রাচার্যের নেতৃত্বে চন্দ্রের পক্ষে যোগ দিলেন।

বিশাল যুদ্ধ পাকিয়ে উঠল। মহাদেব ব্রহ্মশির অস্ত্র ছুঁড়ে দৈত্য-দানবদের অনেককে মেরে ফেললেন বটে, তবে চন্দ্রকে তিনি কিছু করতে পারলেন না। চন্দ্র বিষ্ণুর বর-পুষ্ট। অতএব দেবপক্ষেরও ক্ষয়ক্ষতি কিছু কম হল না। অনেক দেবতাও চন্দ্রের হাতে মারা গেলেন এবং বাকি যারা থাকলেন, তত্র শিষ্টান্তু যে দেবাঃ–তারা প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে গিয়ে আর্জি জানালেন–এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। ব্রহ্মা এসে ইন্দ্র-পক্ষের রুদ্র-শিবকে এবং চন্দ্র-পক্ষের শুক্রাচার্যকে যুদ্ধের প্ররোচনা ছড়াতে নিষেধ করলেন–ততে নিবাৰ্য্যোশনসং রুদ্রং জ্যেষ্ঠঞ্চ শঙ্কর। শুক্রাচার্যকে তিনি ভর্ৎসনা করে বললেন–তোমার কি সঙ্গদোষে এমন অপকর্মে দুর্মতি হল–কিমন্যায়ে মতির্জাতা সঙ্গদোষান্মহামতে। আর চন্দ্রকে বললেন–গুরুর স্ত্রীকে এই মুহূর্তে ছেড়ে দাও, চন্দ্র! নইলে স্বয়ং বিষ্ণুকে ডেকে এনে তোমার সর্বনাশ করে ছাড়ব আমি–নো চেদ বিষ্ণুং সমাহয় করিষ্যামি তু সংক্ষয়ম।

অবস্থা বুঝে চন্দ্রের পক্ষপাতী শুক্রাচার্য পর্যন্ত চন্দ্রের পিতা মহর্ষি অত্রির নাম করে বললেন–আজকেই ছেড়ে দাও গুরুপত্নীকে। তোমার পিতারও এই ইচ্ছে জেনো-মুঞ্চ ভার্যাং গুয়োরদ্য পিত্রাহং প্রেষিতস্তব। ব্রহ্মা এবং শুক্রাচার্য–দুজনের কথায় চন্দ্র শেষ পর্যন্ত গুরুপত্নী তারাকে ছেড়ে দিলেন বটে, কিন্তু ততদিনে তারা গর্ভবতী হয়েছেন। তারা বৃহস্পতিকে পছন্দ করেন না, তবু বৃহস্পতি তার অধিমাত্র লাভেই পরম আনন্দে ফিরলেন। দেব, দানব, ব্রহ্মা, শিবও–সবাই যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন। সর্বত্র শান্তি ফিরে এল।

এইভাবে বেশ কিছুদিন গেল। গর্ভবতী তারা সযত্নে গর্ভ রক্ষা করলেন, এবং শুভদিনে শুভ নক্ষত্রে এক অসাধারণ পুত্র প্রসব করলেন। পুত্রের আকৃতি-প্রকৃতি চন্দ্রের মতো, জ্যোতিষ এবং সামুদ্রিক শাস্ত্রের সমস্ত সুলক্ষণ সেই পুত্রের সর্বাঙ্গে। বৃহস্পতি পুত্রমুখ দেখে বড় খুশি হলেন। এবং শাস্ত্র-বিধি অনুসারে পুত্রের জাতকর্মাদি ক্রিয়াও সম্পন্ন করলেন-জাতকর্মাদিকং সর্বং প্রহৃষ্টেনান্তরাত্মনা। চন্দ্রের কাছে তারার পুত্র জুন্মের সংবাদ এসে পৌঁছল লোকপরম্পরায়। সব শুনে চন্দ্র লোক পাঠালেন বৃহস্পতির কাছে। সে গিয়ে চন্দ্রের নাম করে বৃহস্পতিকে বলল–এত জাঁকজমক করে যে ছেলের জাতকর্মাদি ক্রিয়া করছ, সে মোটেই তোমার ছেলে নয়। সে আমার ছেলে। বৃহস্পতি জোর দিয়ে বললেন–এ ছেলে চন্দ্রের হতে যাবে কেন, এ আমারই ছেলে। দেখতেও তো হয়েছে আমারই মতো–উবাচ মম পুত্র মে সদৃশো নাত্র সংশয়ঃ।

আবার চন্দ্র আর বৃহস্পতির ঝগড়া-ঝাটি আরম্ভ হল। আবারও যুদ্ধ লাগে আর কি। দেবসমাজে যুদ্ধের স্ট্র্যাটিজি’ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হল, নানা ‘মিটিং’ চলল ঘন-ঘন যুদ্ধাৰ্থমাগতাস্তেষাং সমাজঃ সমজায়ত। প্রজাপতি ব্রহ্মা সব খবর শুনে আবারও এসে উপস্থিত হলেন। যুদ্ধ প্রায় লেগে গেল। প্রজাপতি ব্রহ্ম আগে দেব-দানব সকলকে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। তারপর তারার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমিই মা সত্যি করে বল তো-পুত্রটি কার? চন্দ্রের না বৃহস্পতির? তুমি সত্যি করে বললেই এই সাংঘাতিক যুদ্ধ আর লাগে না–সত্যং বদ বরারোহে যথা ক্লেশঃ প্রশামতি।

বস্তুত এ প্রশ্ন দেবতারা আগেই করেছিলেন তারাকে। অন্তত মহাভারতের পরিশিষ্ট-রূপী হরিবংশ তাই বলেছে। কিন্তু তারা এই প্রশ্নের কোনও জবাব দেননি। আমাদের ধারণা–দেবতারা বৃহস্পতির পক্ষ হয়ে পূর্বে চন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন বলেই চন্দ্রের অনুরাগিণী তারা হ্যাঁ বা না-কোনও জবাবই দেননি–পৃচ্ছ্যমানা যদা দেবৈৰ্নাহ সা সাধ্বসাধু বা। কিন্তু প্রজাপতি ব্রহ্মা যখন আসন্ন যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি-রক্ষার তাগিদে তারাকৈ ওই একই প্রশ্ন করলেন, তখন আর উত্তর না দিয়ে উপায় থাকল না তারার। ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা করলেন-বল মা! এ ছেলে কার–কস্যায়ং তনয়ঃ শুভে? শান্তির দূত পিতামহ ব্রহ্মার সামনে লজ্জায় মাথা নিচু করে তারা বললেন–এ পুত্র চন্দ্রের। বলেই তারা দ্রুত ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লেন–চন্দ্রস্যেতি শনৈরন্তর্জগাম বরবৰ্ণিনী। বিবাহিত স্বামীর ঘরে বসে অন্য পুরুষের পুত্র গর্ভ ধারণ করেছি–এ কথা বলতে কোন রমণীই বা লজ্জা না পাবে। তারাও তাই কথাটা বলেই লজ্জায় ঘরে ঢুকে পড়লেন তাড়াতাড়ি।

 হরিবংশে দেখছি–তারার কথা শোনামাত্রই প্রজাপতি ব্রহ্ম সেই নবজাতকের মস্তক আঘ্রাণ করে তার নাম রেখেছেন বুধ। অন্য মতে তারার কথাটা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চন্দ্র বৃহস্পতির বাড়ি থেকে তাঁর পুত্রটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান এবং তার নাম রাখেন বুধ।

যা দেখা গেল, তাতে চন্দ্রবংশে আরও একটি নক্ষত্রের জন্ম হল। বুধের জন্মলগ্নে চাঁদ, তারা বা বৃহস্পতির–ইত্যাদি নক্ষত্র-তারকার কলঙ্ক যাই থাকুক, এখনও পর্যন্ত এই বংশের জাতকের মধ্যে খুব একটা মানুষ-মানুষ ভাব দেখলাম না। দেখলাম, কেমন যেন একটা দৈবভাব। তবে তা শুধু দেবতাদের ঘটনা বলেই এই দৈবীভাব। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের। আনাগোনায় দেবতা, অতিদেবতা, দেবগুরুর ব্র্যহস্পর্শে ঘটনা যতই গম্ভীর হয়ে উঠুক, তবু কিন্তু এই ঘটনার বিন্যাসে মানুষের জীবনের স্পর্শ আছে। অর্থাৎ মানুষের জীবনেই এরকম ঘটে থাকে, ঘটে এবং ঘটবেও। কিন্তু যেহেতু চন্দ্র, তারা, বুধ, বৃহস্পতি ইত্যাদি শব্দে নক্ষত্রলোকের অভিসন্ধি মেশানো আছে, অতএব মহাভারতের কবি তাদের জীবন-বিস্তারে মন দেননি। নক্ষত্রলোকের প্রতাঁকে ধরা এইসব জীবনের কাহিনী আমাদের শুনতে হয়েছে পুরাণ থেকে, হরিবংশ থেকে।

কিন্তু যে মুহূর্তে কুরু-পাণ্ডবের বংশমূলে মানুষের শব্দ-স্পর্শ যোগ হয়েছে সেই মুহূর্তে মহাভারতে মনুর কথা এসেছে। মনু থেকেই এই মানব-জাতি, মহাভারত যাকে বলেছে–মনোর্বংশে মানবানাং ততো য়ং প্রথিতো’ভবৎ। বস্তুত মহাভারতের আদিপর্বে দুই জায়গায় কুরু-পাণ্ডবের পূর্বতন বংশ-পরস্পরা বর্ণিত আছে। এই দুই জায়গাতেই চন্দ্র, বৃহস্পতি কিংবা তারার কোনও হদিশ নেই। এমনকি বুধেরও জন্মের কোনও খবর ভাল করে পাওয়া যায় না। মহাভারতের এই দুই লিস্টিতেই বৈবস্বত মনু থেকে মানব-জাতির উৎপত্তি। মনুর নয়টি পুত্র এবং একটি কন্যা। এই কন্যাটি সত্যিই কন্যা না পুত্র, তা নিয়ে পৌরাণিকদের মধ্যে বিবাদ আছে এবং সে কথায় আমি পরে আসছি।

আপাতত জেনে রাখতে হবে যে-মনুর নয় পুত্রের মধ্যে অন্তত চার জন বড় গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অন্তত চারটি বিখ্যাত রাজবংশের মূল হলেন এই চারজন মনুপুত্র। অযযাধ্যায় যে বিখ্যাত ইস্ফাকু-রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং যার অধস্তন হলেন স্বয়ং নরচন্দ্রমা রামচন্দ্র, সেই ইস্ফাকু মনুর এক পুত্র। ইস্ফাকুর অন্যতম এক পুত্র থেকেই বৈদেহ-বংশের প্রতিষ্ঠা এবং এই বংশের অধস্তন হলেন সীতাপতি জনক, অর্থাৎ রামের শ্বশুর। অর্থাৎ বৈদেহ জনকও সূর্যবংশেরই বটে।

মনুর আরেক পুত্র নাভানেদিষ্ঠ। তিনি রাজত্ব করতেন বৈশালীতে। প্রতি এবং সুমতি এই বংশের নামী পুরুষ এবং তারা ছিলেন ইস্ফাকু-বংশজ দশরথের সমসাময়িক। মহারাজ শর্যাতি মনুর আরেক কীর্তিমান পুত্র। সম্ভবত তিনি রাজত্ব করতেন কুশস্থলীতে যা পরবর্তী কালের দ্বারকা বলা যায়। চতুর্থ মনুপুত্র নাভাগও যথেষ্ট বিখ্যাত তবে তিনি ঠিক কোথায় রাজত্ব করতেন বলা মুশকিল। এই বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ হলেন মহারাজ অম্বরীষ যিনি নানা কারণে কীর্তিশালী হয়েছেন।

লক্ষণীয় বিষয় হল–মনুপুত্রদের প্রত্যেককেই একভাবে সূর্যবংশীয় বলা যায়; কেননা, বৈবস্বত মনুর পিতা হলেন বিবস্বান্-সূর্য। কিন্তু অযযাধ্যার সম্রাট ইক্ষাকু এতটাই বিখ্যাত হয়েছিলেন যে সূর্যবংশের সমস্ত সুনামটুকু যেন তার ওপরেই বর্তেছিল। ফলত একমাত্র ইক্ষাকুর বংশই সূর্যবংশ বলে বিখ্যাত হয়েছে। এবারে সেই মেয়েটির কথায় আসি, যার নাম ইলা এবং যাঁর থেকে চন্দ্রবংশের পরম্পরা।

বেশির ভাগ পুরাণেই দেখা যাবে ইলা মেয়ে ছিলেন না, পুরুষই ছিলেন এবং তার নাম ইলা নয়, তার নাম ইল। একটি পুরাণ তো এমন কথাও বলেছে যে, মনু মহারাজ তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ইলকে রাজপদে অভিষিক্ত করে তপস্যা করার জন্য নন্দন বনে চলে গিয়েছিলেন

অভিষিচ্য মনুঃ পুত্রমিলং জ্যেষ্ঠং চ ধার্মিকঃ।
জগাম তপসে ভূয়ঃ স মহেন্দ্ৰবনালয়।

কিন্তু অন্যান্য পুরাণে ইল নামটি আসার সঙ্গে সঙ্গেই একটি মজার উপাখ্যান। ইল নাকি রাজা হয়েই দিগ্বিজয়ে যাত্রা করেন। পৃথিবীর নানা দেশ জয় করার পথে এক সময় তার অশ্বটি একটি বনে প্রবেশ করে। কোনও পুরাণে এই বনের নাম শরবন, কোথাও বা কুমারবন, আবার কোনও পুরাণে এটি উমাবন। যাই হোক এই বনে মহাদেবের আবাস ছিল এবং এই বনে প্রবেশের ব্যাপারে পূর্বেই একটি নিয়ম চালু হয়েছিল। অবশ্য সেই নিয়মের ব্যাপারেও অন্য একটি গল্প আছে। কথিত আছে-এক সময় সনক সনন্দ প্রমুখ ব্রহ্মবাদী ঋষিগণ মহাদেবের দর্শন লালসায় এই অসাধারণ বনভূমিতে প্রবেশ করেন। সেই সময় দেবদেব শঙ্কর পার্বতীর সঙ্গে ক্রীড়াসক্ত ছিলেন এবং শৈলদুহিতার বসন-ভূষণও কথঞ্চিৎ অসস্তৃত ছিল। এই অবস্থায় ব্রহ্মবাদী ঋষিদের দেখে পার্বতী বড় লজ্জা পেলেন এবং কোনও মতে বস্ত্র সম্বরণ করে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপতে থাকলেন–লজ্জাবিষ্ট স্থিতা তত্র বেপমানাতিমানিনী।

 ব্ৰহ্মবাদী ঋষিরা ব্রহ্মানন্দে মগ্ন। তাদের মনে স্ত্রী-পুরুষের ভেদাভেদ, রমণ-মৈথুন বড় একটা ক্রিয়া করে না। দেবদেব শঙ্করের উদাসীন ক্রীড়াকৌতুক এবং পার্বতীর বিপর্যস্ত অবস্থা দেখামাত্রই ব্ৰহ্মর্ষিরা স্থান ত্যাগ করে নর-নারায়ণ আশ্রমের দিকে রওনা দিয়েছেন। কিন্তু পার্বতাঁকে তখনও সংকুচিত আর অভিমানিনী দেখে ভগবান শিব নিয়ম করে দিলেন–যে পুরুষ এরপর ওই বিহার-বনে ঢুকবে সেই মেয়ে হয়ে যাবে। যারা এই নিয়মের কথা জানত, তারা সকলেই বনভূমির বহিঃসীমা অতিক্রম করত না। কিন্তু দিগ্বিজয়ে ভ্রাম্যমান ঘোড়াটি অথবা তার মালিক ইল রাজা–তাদের কারুরই এই শিবের নিয়ম জানা ছিল না। অত্যন্ত আকস্মিকভাবে ইল এক সুন্দরী নারীতে পরিণত হলেন, এমনকি তার ঘোড়াটিও ঘোটকীতে পরিণত হল। স্ত্রী স্বরূপে ইলর নাম হল ইলা।

স্ত্রীত্ব প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত শরীরে স্তন-জঘনাদির স্ত্রী লক্ষণগুলিও প্রকাশিত হল। তার গলার স্বর থেকে আরম্ভ করে গতি-স্মিত-কটাক্ষেও এল রমণীয় পরিবর্তন। বনের মধ্যে ভ্রমণ করতে করতে স্ত্রী রূপিণী ইলের মনে একটু উদাসীন ভাবও দেখা গেল। তিনি ভাবলেন–ছিলাম রাজপুরুষ, হলাম এক রমণী। এখন কেই বা আমার বাবা আর কেই বা মা। কার সঙ্গেই বা আমার বিয়ে হবে, কে জানে? হয়তো এইভাবে বিমনা হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় তিনি সেই শিবের বিহারভূমির বাইরে চলে এলেন। ঠিক এই সময়ে চন্দ্র-পুত্র বুধ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন সেই বনের বহিঃপ্রান্তে। ইলাকে তিনি দেখতে পেলেন এবং তার মনোহরণ রূপে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি শুধু উপায় খুঁজতে লাগলেন–কীভাবে এই রমণীকে আত্মসাৎ করা যায়-বুধস্তদাপ্তয়ে যত্নমকবরাং কামপীড়িতঃ।

চন্দ্রপুত্র বুধ ইলাকে লাভ করার আশায় ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করলেন। ইলাকে তিনি অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করেছেন এবং বুঝেছেন–এই রমণীর পূর্ব-স্মৃতি যথাযথ নেই। বুধ এও বুঝেছেন–ব্রাহ্মণের বাক্য জনসমাজে মান্যতা লাভ করে, অতএব ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করে। বেশ নাটকীয়ভাবে যদি ইলাকে প্রার্থনা করা যায়, তবে তার বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। বুধ হাতে দণ্ড-কমণ্ডলু ধারণ করে বিশ্বসনীয় ব্রাহ্মণ-উপাধ্যায়ের মতো একখানি পথিও ধরে। রাখলেন নিজের হাতে। কতিপয় ব্রাহ্মণবালক ফুল-জল, সমিৎকাঠ নিয়ে তাকে অনুসরণ করল এবং বুধের ব্রাহ্মণত্ব আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলল।

বুধ দূর থেকে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে সেই শিব-বিহার-ভূমির বহিঃপ্রান্তে এসে পৌঁছলেন, যেখানে বিহ্বল-বিভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন ইলা। বুধ অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে ইলাকে কয়েকটা কথা বললেন। বললেন এমনভাবে যেন ইলা তার কতকালের বিবাহিতা স্ত্রী। বুধ বললেন–এ কী হল? তুমি হঠাৎ করে বাড়ি ছেড়ে চলে এলে কেন? আমার অগ্নিহোত্রের কাজকর্ম সব ফেলে দিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছ তুমি–অগ্নিহোত্রশুশ্রুষাং ক গতা মন্দিরাৎ মম? একটু বকার মতো করে কথা কয়টি বলেই বুধ কিন্তু সুর পালটালেন। বললেন–আমাদের বিহার-বেলাও যে শেষ হতে চলল সুন্দরী! কেন এমন সময়ে এমন সন্ত্রস্ত হয়ে আছ? এমন একটি সন্ধ্যা কি নষ্ট করা চলে? ঘরে চলো। ঘর-দোর মুছে ফুলের সাজে আমাদের মিলন-গৃহ সুসজ্জিত করো-কৃত্বোপলেনং পুষ্পৈরলঙ্গুরু গৃহং মম।

ইলা বললেন–মহর্ষি! কারণ ব্রাহ্মণের সাজে বুধকে তিনি মহর্ষিই ভেবেছিলেন–ইলা বললেন–মহর্ষি! আমার কিছু মনে নেই। আমি কে, আপনি কে, আমি কোথায় জন্মেছি কিচ্ছুটি মনে নেই আমার। বুধ বললেন–কেন? তোমার নাম তো ইলা। আর আমি তো সেই বুধ, আমার পিতা মহামান্য এক ব্রাহ্মণ–পিতা মে ব্রাহ্মণাধিপঃ। কথাটার মধ্যে খুব একটা মিথ্যাও নেই। কারণ জননী তারা এবং বৃহস্পতির সম্বন্ধে নিজেকে ব্রাহ্মণের পুত্র বলে পরিচয় দিতে কোনও অসুবিধাই ছিল না বুধের।

ইলা বুধের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে তথাকথিত স্বামীর বাড়িতে গিয়ে উঠলেন এবং থাকতে লাগলেন বিশ্বস্তা বিবাহিতা বধুটির মতোই। অনেক পুরাণই বলেছে–ইলার এই স্ত্রীত্ব ছিল সাময়িক এবং মহাদেবের কাছে তিনি নাকি বর পেয়েছিলেন–একমাস তিনি স্ত্রী হয়ে থাকবেন এবং একমাস থাকবেন পুরুষ হয়ে। পুরুষ অবস্থায় তার নাম হবে সুদম আর স্ত্রী। অবস্থায় তার নাম হবে ইলা। মহাভারতের কবি যে একবারও এই ইলা-সুদ্যুম্নের কথা বলেননি, তা নয়। তবে তিনি অন্য পুরাণকারদের মতো এমন গল্প করে বলেননি। মহাভারতের প্রায় অন্তকালে অনুশাসনপর্বে একেবারে অন্য প্রসঙ্গে একবার বলা আছে–বৈবস্বত মনুর বংশজ হলেন ইলা-সুন্ন-মননশ্চ বংশজ ইলা সুদ্যুম্নশ্চ ভবিষ্যতি। কবির এক-পংক্তির উক্তি থেকেই মোটেই বোঝা যায় না যে, যিনি ইলা তিনি সুদ্যুম্ন।

এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে আমার যা মনে হয় নিবেদন করি। অধিকাংশ পৌরাণিকেরা বলেছেন যে স্ত্রী অবস্থায় ইলার সঙ্গে বুধের মিলনে পুরূরবার জন্ম হয় এবং বুধ যেহেতু চন্দ্রের পুত্র, তাই চন্দ্রের পুত্র-পরম্পরা চালু হয়ে গেল পুরূরবার জন্ম থেকেই। পুরূরবার জন্মের কথা বলেই পৌরাণিকেরা বলেছেন ইলার পুরূষাবস্থায় সুদ্যুম্নের পুত্র হলেন উৎকল এবং গয়–পৌরাণিকেরা যে যাই বলুন, আমাদের ধারণা সুদ্যুম্ন ইলার এক স্বামী এবং অন্য স্বামী হলেন বুধ। আসল কথা বৃহস্পতি এবং চন্দ্র–দুজনেই যদি তারার স্বামী হতে পারেন, তবে সুদুন্ন এবং বুধ–এই দুজনেও ইলার দুই স্বামী হতে পারেন। আমার ধারণা যে মিথ্যা নয়, কিংবা একেবারে অবাস্তব নয় সেটা অন্যান্য পুরাণের প্রমাণ দিয়েই বলি।

বায়ু পুরাণ বলেছে–প্রথম মানব মনুর নিজের সমান গুণের নয়টি পুত্র ছিল–মনোঃ প্রথমজস্যাসন্নব পুত্ৰাস্তু তৎসমাঃ। লক্ষণীয় বিষয় হল, এই নয় পুত্রের মধ্যে ইক্ষাকুই হলেন জ্যেষ্ঠ এবং এই লিস্টিতে ইল’ বলে কোনও পুত্রের নাম নেই। জ্যেষ্ঠও তিনি নন, রাজাও তিনি নন। বায়ু পুরাণে স্পষ্ট বলা আছে–ইক্ষাকু ইত্যাটি নটি পুত্রের জন্মের পর ব্রহ্মার আদেশে মনু পুত্রকাম হয়ে একটি যজ্ঞ আরম্ভ করেন। সেই যজ্ঞে তিনি মিত্রাবরুণ দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি দিতেই যজ্ঞবেদি থেকে দিব্যাম্বরধরা দিব্যাভরণভূষিতা’ ইড়াদেবীর সৃষ্টি হল। মনু সেই রমণীকে ইলা বলে সম্বোধন করলেন। ইড়া’ নামে বৈদিক-ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে একটি শব্দ পাওয়া যাবে। সেই শব্দের সঙ্গে এই ইড়ার কোনও সম্বন্ধ আছে কিনা সে আলোচনায় যাওয়ার কোনও কারণই নেই এই মুহূর্তে। আমার যেটুকু বলার তা হল–মনু ইলা নামে একটি কন্যাই লাভ করেছিলেন, পুত্র নয়।

জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলা মনুকে বললেন–আমি মিত্রাবরুণের অংশে জন্মেছি, অতএব তার কাছেই আমায় যেতে হবে। অর্থাৎ ইলা নিজেকে মোটেই মনুর কন্যা ভাবছেন না, মিত্রাবরুণের কন্যা হিসাবেই তিনি পরিচিত হতে চান। স্বয়ং মিত্রাবরুণও ইলাকে বলেছেন তুমি আমাদের কন্যা–আবায়োস্ত্বং মহাভাগে খ্যাতিং কন্যা গমিষ্যসি। বায়ু পুরাণ আরও বলেছে–ইলা যখন মিত্রাবরুণের আশীর্বাদ নিয়ে মনুর কাছে ফিরে আসছেন, সেই প্রত্যাবর্তন-কালীন সময়ে মাঝপথে চন্দ্রপুত্র বুধের সঙ্গে তার মিলন হয়–বুধেনান্তরমাসাদ্য মৈথুনায়োপমন্দ্রিতা।

কথাটা বিশ্বাস করতে অসুবিধা নেই কোনও। মিত্রাবরুণ এক যুগল বৈদিক দেবতা। আমি পূর্বেই জানিয়েছি দেবতাদের আকৃতি-প্রকৃতি মানুষের মতোই। যে কোনও কারণেই হোক দেব-পিতার গৃহ থেকে তিনি মনু-পিতার গৃহে ফিরছিলেন। পথে নির্জন অরণ্যভূমিতে– পুরাণারেরা অবৈধ কলঙ্ক এড়ানোর জন্য যে বনকে মহাদেবের বিহারভূমিরূপে কীর্তন করেছেন, সেই বনস্থলীর মধ্যেই বুধের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং কোনও ওজর ছাড়াই সাধারণভাবেই সে মিলন সম্পূর্ণ হয় এবং জন্ম হয় পুরুরবার। বায়ু পুরাণ বলেছে-পুরুরবার জন্ম দিয়েই ইলা পুনরায় সুদ্যুম্নের কাছে ফিরে আসেন-বুধাৎ সা জনয়িত্ব তু সুদ্যুম্নং পুনরাগতা। সংস্কৃতে যাদের সাধারণ জ্ঞান আছে তারা উপরিউক্ত সংস্কৃত পংক্তিটির অর্থ করবেন আমাদের মতো–অর্থাৎ ইলা সুদ্যুম্নের কাছে ফিরে আসেন-সুদ্যুম্নং পুনরাগতা।

বায়ু পুরাণ সত্য কথাটা একবার মাত্র বলে ফেলেছে। কিন্তু মজা হল, ইলাকে নিয়ে যে কল্পকাহিনী পূর্বেই তৈরি হয়ে গেছে, তা বায়ু পুরাণের কথকঠাকুরদের পক্ষে এড়ানো অসম্ভব ছিল। তাই বায়ু পুরাণ পূর্বে বলে নিয়েছে–ইলাই পরে মনুর পুত্র সুদ্যুম্ন নামে বিখ্যাত হন। অর্থাৎ সেই বাধা গত–ইলা মেয়েও ছিলেন আবার ছেলেও ছিলেন। কিন্তু শুধু বায়ু পুরাণ কেন, অধিকাংশ পুরাণই একই কথা বলেছে। এর মধ্যে শুধু দেবীভাগবত পুরাণ মনু বংশের সব কথা বাদ দিয়ে চন্দ্র-তারা বৃহস্পতির উপাখ্যানের পরম্পরায় পরের অধ্যায় আরম্ভ করেছে এইভাবে–সুদ্যুম্ন নামে এক অতীব যশস্বী রাজা ছিলেন। তিনি ঘোড়ায় চড়ে মৃগয়া করতে করতে সেই মহাদেবের বিহারভূমিতে ঢুকলেন আর স্ত্রীতে পরিণত হলেন। বস্তুত, সুদ্যুম্ন বলে সম্পূর্ণ পৃথক একটি পুরুষ মানুষের কথা অন্য কোনও পুরাণ বলেনি। দেবীভাগবতের প্রমাণে আমরা সুদ্যুম্ন নামে একটি পৃথক পুরুষকেই শুধু চিহ্নিত করতে চেয়েছি।

 ইলা অথবা সুদ্যুম্ন–কে আগে মেয়ে ছিলেন, কে পুরুষ ছিলেন, এই তর্কে আমরা যাচ্ছি না। পৌরাণিকদের এই কল্পনা আমার কাছে তত আদরণীয়ও নয়। বরং আমি যেটা বিশ্বাস করি, তারই পরম্পরা ধরে বলি-হরিবংশ, ব্রহ্মপুরাণের মতো নামী পুরাণগুলি থেকে জানা যায়–প্রথমজন্মা মনুর নয় মহান পুত্রের কেউই যখন জন্মাননি, তখনই মিত্রাবরুণের যজ্ঞ থেকে ইলা জন্মেছিলেন–অনুৎপন্নেষু নবসু পুত্রেম্বেতেষু ভারত। অর্থাৎ মনু যতই পুত্র কামনা করে যজ্ঞ করে থাকুন, তার প্রথম সন্তানটি কিন্তু পুত্র নয়, কন্যাই। তবে কন্যা হলেও তার মূল্য কম ছিল না। হয়তো সুদ্যুম্ন নামে কোনও রাজার সঙ্গে তার প্রথম বিবাহ বা মিলন কিছু হয়েছিল। কিন্তু চন্দ্রপুত্র বুধের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কোনও ভাবে তিনি সুদমকে ভুলেই ছিলেন। কেননা চন্দ্রপুত্র বুধের আকর্ষণ তার কাছে এতই বেশি ছিল যে, সুমকে ভোলা তার পক্ষে অসম্ভব হয়নি। কিন্তু সেই মিলন সম্পূর্ণ হওয়ার পর যখন বুধের ঔরসে পুরূরবার জন্ম। হল, তারপরেই হয়তো পুর্বতন স্বামীর সম্বন্ধটুকু তার মনে পড়েছে এবং তিনি ফিরেও এসেছেন সুদ্যুম্নের কাছে। এই প্রত্যাবর্তনের কথা যে যে পুরাণে আছে, সেই সেই পুরাণে এটা যে ভাবেই থাকুক, আমাকে বিশ্বাস করতে হবে সেই বায়ু পুরাণের কথা-সুদ্যুম্নং পুনরাগতা–অর্থাৎ তিনি আবার সুদৃশ্নের কাছে ফিরে এলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *