১০০. অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষার ক্ষমতা এবং কৌশল

১০০.

অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষার ক্ষমতা এবং কৌশল প্রায় প্রাবাদিক পর্যায়ে পৌঁছল। দ্রোণাচার্যের অস্ত্র-পাঠশালায় এমন কোনও ছাত্র ছিল না, যে অর্জুনের ধারে-কাছে যেতে পারে। অর্জুন এই বিদ্যা শিখছিলেন প্রচণ্ড পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে। সমস্ত শিষ্যদের প্রতি দ্রোণাচার্যের একই ব্যবহার থাকলেও তার নিজের ছেলে অশ্বত্থামার প্রতি পিতা হিসেবে তার বেশি দুর্বলতা থাকার কথা। দ্রোণাচার্যের তা ছিলও। অশ্বত্থামা অন্যান্য কুরু-পাণ্ডব বালকদের সঙ্গেই দ্রোণের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতেন। কিন্তু নিজের ছেলেটিকে সবার মধ্যে ভাল দেখতে কার না ইচ্ছে করে। তাই দ্রোণ যখন দেখলেন যে, অর্জুন নিশ্চিতভাবে সবার থেকে এগিয়ে রয়েছেন, তখন তারও ইচ্ছে হল যে, তার ছেলেটি অন্তত কিছু বেশি কৌশল শিখুক। কিন্তু সবার মধ্যে তো আর সে সুযোগ পাওয়া যায় না, আর সারাদিনের অস্ত্রশিক্ষার পরে দ্রোণশিষ্যেরা কেউ বাড়িতেও ফিরে আসতেন না যে, সকলের আড়ালে দ্রোণ তার ছেলেকে কিছু গূঢ় কৌশল শিখিয়ে দেবেন।

 সেকালের দিনে যে কোনও শিক্ষা মানেই গুরু-গৃহে বাস করা। কাজেই গুরুগৃহের অন্তেবাসী অন্যান্য শিষ্যদের সামনে অশ্বত্থামাকে আলাদা শিক্ষা দেওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই পুত্রস্নেহের টানে দ্রোণ একটা সামান্য কৌশল করলেন। সকালবেলায় উঠে সন্ধ্যা-আহ্নিকের জন্য প্রত্যেক শিষ্যকেই নদী থেকে কমণ্ডলু ভরে জল আনতে হত। কমণ্ডলুর স্বল্প পরিসর মুখ দিয়ে জল ভরে আনতে বেশি সময় লাগে বলে–কমণ্ডলুঞ্চ সর্বেষাং প্রাচ্ছচ্চিরকারণা—দ্রোণাচার্য অশ্বত্থামাকে একটি বড়ো মুখের কলসী দিয়েছিলেন জল ভরে আনার জন্য। অশ্বত্থামা নদীতে গিয়ে স্নান করেই কলসী ঢলিয়ে জল ভরে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসতেন পিতার কাছে। অন্য বালকেরা তখন স্নান করছে, একটু একটু খেলা করছে, গ্লব-গ্লব করে কমণ্ডলু ভরছে অর্থাৎ কিছু সময় নষ্ট করছে। আর সময় নষ্ট করার ওইটুকুই যা সময় বালকদের। কিন্তু ওইটুকু সময়ের মধ্যেই যে অশ্বত্থামার যে কিছু অতিরিক্ত শিক্ষা হয়ে যাচ্ছে, সেটা অন্য বালকেরা খেয়ালই করল না। কিন্তু অর্জুন সেটা খেয়াল করলেন–দ্রোণ আচষ্ট পুত্রায় তৎ কর্ম জিষ্ণুরৌহত।

কিন্তু অর্জুন খেয়াল করলেন। অস্ত্র-শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ এবং সময় নষ্ট না করার সামগ্রিক ইচ্ছেটাই হয়তো অৰ্জুনকে এই খেয়াল করাল। অর্জুন বুঝলেন–কমণ্ডলু এবং কলসীর খেলায় তিনি অশ্বত্থামার চেয়ে পিছিয়ে পড়েছেন। এবার অর্জুন তাঁর নিজের কৌশল খাটালেন পূর্বশিক্ষিত বিদ্যার মাধ্যমেই। তিনি অশ্বত্থামাকে তাড়াতাড়ি আসতে দেখে নিজে আর নদীতে যাবার সময়টুকুও নিলেন না। বরুণ অস্ত্রের মাধ্যমে কমণ্ডলু ভর্তি করে তিনি চলে আসতেন গুরুর কাছে। ফলে অশ্বত্থামার প্রাপ্য অতিরিক্ত গূঢ় পাঠটুকু অর্জুনও পেতে আরম্ভ করলেন সঙ্গে সঙ্গে। ফলে অশ্বত্থামার আর অর্জুনের চেয়ে বড় হওয়া হল না। অর্জুন অশ্বত্থামা থেকে কোনও অংশে কম গেলেন না–-ন ব্যহীয়ত মেধাবী পার্থোস্ত্রবিদুষাং বরঃ।

এবারে বলুন এমন ছাত্রের প্রতি গুরুর পক্ষপাত হবে কিনা? ছাত্রের বিদ্যাশিক্ষার যে তীক্ষ্ণতা এবং অনুসন্ধিৎসার জন্য গুরু তার আপন পুত্রকে পর্যন্ত আলাদা করে রাখতে পারলেন না, এই ব্যাপ্তি থাকলে যে কোনও মেধাবী শিষ্য অর্জুনের মতোই গুরুর পক্ষপাত লাভ করবেন। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন–অর্জুন আরও বেশি করে গুরুসেবা করতে লাগলেন, আরও বেশি করে অস্ত্রশিক্ষা করতে লাগলেন এবং এই দুয়ের ফলে তিনি দ্রোণাচার্যের আরও বেশি প্রিয় হয়ে উঠলেন–অস্ত্রে চ পরমং যোগং প্রিয়ো দ্রোণস্য চাভবৎ।

 অর্জুন যখন বেশ ভাল যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন এবং দ্রোণাচার্যের সর্বাত্মক দৃষ্টি যখন একমাত্র অর্জুনের দিকে, ঠিক এই সময়েই একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটল। ঘটনাটা একেবারেই ছোট্ট কিনা, তা সুধীদের বিচার্য, তবে ঘটনাটা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। দ্রোণের পাঠশালায় অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে কর্ণই একমাত্র অর্জুনের প্রতিস্পর্ধী ছিলেন। তিনি সর্বদা অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চেষ্টা করতেন এবং যে কোনও উপায়ে অর্জুনকে কীভাবে পর্যদস্ত করা যায়, সেই চেষ্টা করে যেতেন নিরন্তর। হয়তো এই বিরোধিতার মধ্যে মহারাজ দুর্যোধনের প্রত্যক্ষ মদত ছিল এবং তা আমরা আগে কথঞ্চিৎ উল্লেখও করেছি। মহাভারতের পরবর্তী পর্ব থেকেও জানা যায় যে, সেই অস্ত্রপরীক্ষার সময় নয়, দুর্যোধনের সঙ্গে কর্ণের বন্ধুত্ব হয়েছিল একেবারে বাল্যকালেই–স সখ্যমকরো বাল্যে রাজ্ঞা দুর্যোধনেন বৈ। হয়তো দুর্যোধনের সঙ্গে কর্ণের এই বন্ধুত্বের দুর্দৈব এবং কর্ণের স্বভাব–দৈবাচ্চাপি স্বভাবতঃ–এই দুয়ের ফলে অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষার ক্ষমতা আরও বেশি করে বিধল কর্ণের বুকে।

 কর্ণ দেখলেন যে, অস্ত্রশিক্ষার সমস্ত বিষয়ে, বিশেষত ধনুর্বিদ্যার ক্ষেত্রে অর্জুন সবার চেয়ে বেশি এগিয়ে গেছেন–সর্বাধিকমথালক্ষ্য ধনুর্বেদে ধনঞ্জয়। ঈর্ষা এবং অসূয়ায় কর্ণের মন বিষিয়ে উঠল। কীভাবে, কোন সহজ উপায়ে অর্জুনকে অতিক্রম করা যাবে তার কোনও উপায় খুঁজে পেলেন না কর্ণ। ওদিকে মেধা এবং পরিশ্রম একত্র হওয়ায় গুরু দ্রোণাচার্যের পক্ষপাতও দিনকে দিন বেড়েই চলেছে অর্জুনের ওপর। কর্ণ আর সহ্য করতে না পেরে, সকালবেলায় সবাই যখন কমণ্ডলু ভরে নদীতে জল আনতে গেছে, একান্তে উপস্থিত হলেন দ্রোণাচার্যের কাছে। কর্ণ বললেন গুরুদেব! একটা কথা আছে।

–কী কথা, বৎস!

গুরুদেব! আমি ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের উপায় শিখতে চাই? কীভাবে এই অস্ত্র মোচন করতে হয়, কীভাবেই বা প্রযুক্ত ব্রহ্মাস্ত্রকে সম্বরণ করতে হয়, সব আমি জানতে চাই–ব্ৰহ্মাস্ত্রং বেমিচ্ছামি সরহস্য-নিবর্তনম্।

–কেন, কেন, হঠাৎ তুমি ব্রহ্মাস্ত্রলাভের জন্য এত ব্যগ্র হয়ে উঠলে কেন?

আজ্ঞে গুরুদেব! অন্য কিছু নয়। আমি শুধু ওই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই–অর্জুনেন সমং চাহং যুদ্ধেয়মিতি মে মতিঃ।

 কথাটা দ্রোণাচার্যের ভাল লাগল না। শুধু অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য–এই ছেলেটি যুদ্ধের সবচেয়ে মারণাস্ত্রটি শিখে নিতে চায়। বেশ বোঝা যায়–এ কোনও সুস্থ প্রতিযোগিতা নয়, অর্জুনকে হত্যা করাই শুধু এর উদ্দেশ্য। ছাত্রদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হোক–এটা যে কোনও গুরুর উদ্দেশ্য থাকে। আর কর্ণ যথেষ্ট ভাল ছাত্রও বটে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা হয়– মেধা যার বেশি থাকে সে কখনও বা ফাঁকি দিয়ে ফেলে। কর্ণ তাই করেন। কিন্তু মেধার সঙ্গে পরিশ্রম যুক্ত করার বাস্তব জ্ঞান যে ছাত্রের থাকে, তাকে রুখতে পারে এমন শক্তি দুনিয়ায় নেই। অর্জুনের প্রতি দ্রোণাচার্যের পক্ষপাত সেইজন্যই।

লক্ষণীয় যে গুরুর কোনও নির্দিষ্ট শিষ্যের প্রতি পক্ষপাত আছে, সেই পক্ষপাত যদি শিষ্যের মেধার কারণবর্জিত হয়, তাহলে গুরুকে তা স্মরণ করিয়ে দিলে তার লজ্জা উপস্থিত হয়। অর্জুনের প্রতি স্বাভাবিক বিদ্বেষে কর্ণ দ্রোণাচার্যের পক্ষপাত অযৌক্তিক মনে করেন বলেই তাকে লজ্জায় ফেলার জন্য বললেন–দেখুন গুরুদেব! সব শিষ্যই গুরুর কাছে সমান। আর আপনি তো পুত্রকে যেমন স্নেহ করেন তেমনই করেন শিষ্যকে–সমঃ শিষ্যেষু বঃ স্নেহঃ পুত্রে চৈব তথা ধ্রুব। তা আপনি আমার ওপর একটু খুশি হোন গুরুদেব। আমি আপনার কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছি। কাজেই বিচক্ষণ লোকেরা যাতে না বলতে পারে যে, আপনার কাছে বিদ্যা শিখেও আমার কিছুই হয়নি–ত্বপ্রসাদান্ন মাং ব্রযুরকৃতাস্ত্রং বিচক্ষণাঃ। আর সেইজন্যই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করার শিক্ষাটাই আমার একান্ত দরকার।

দ্রোণ বুঝলেন, সব বুঝলেন। কর্ণের এই মন-ভেজানো কথায় তিনি একটুও বিচলিত হলেন না। অর্জুনের প্রতি তার পক্ষপাত একদিনে তৈরি হয়নি বা এমনি-এমনিই হয়নি। দিনের পর দিন তিনি যাকে সদানত হয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে দেখেছেন, সেই অর্জুনের তুলনায় কর্ণও অতি বিচক্ষণ যোদ্ধা বটে। কিন্তু সে বড়ো তাড়াতাড়ি এবং পরিশ্রম ছাড়াই স্বার্থসাধনের উপযুক্ত অস্ত্রকৌশল শিখে নিতে চায়। তাছাড়া এ কী? অল্প বয়সেই সে তার এক সহপাঠীকেই ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের আধার হিসেবে বেছে নিয়েছে। দ্রোণের ভাল লাগল না। অর্জুনের প্রতি তার পক্ষপাত আছে, এ তিনি নিজেও মনে মনে স্বীকার করেন–সাপেক্ষঃ ফাল্গুনং প্রতি। কিন্তু কর্ণ যে রীতিমতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ব্রহ্মাস্ত্রের মতো সাংঘাতিক অস্ত্রের প্রয়োগ শিখতে চাইছেন, সে কথা দ্রোণ বেশ বুঝতে পারলেন। বুঝলেন যে, কর্ণের কু-মতলব আছে–দৌরাত্মঞ্চৈব কর্ণস্য বিদিত্বা তমুবাচ হ।

কর্ণ যেহেতু বেশ ইনিয়ে-বিনিয়ে দ্রোণের কাছে ব্রহ্মাস্ত্রের কৌশল শিখতে চাইছেন, তাই দ্রোণও কর্ণকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন একটু তির্যকভাবে। তার কথার মধ্যে যুক্তি এবং রাগ, দুটোই প্রকাশিত হল তির্যকভাবেই। দ্রোণ বললেন–দেখ বাপু! ব্রহ্মাস্ত্র যার তার জন্য নয়। ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ জানবেন ব্রাহ্মণ, জানবেন নীতি-নিয়মনিষ্ঠ ক্ষত্রিয়–ব্রহ্মাস্ত্রং ব্রাহ্মণো বিদ্যা যথাবচ্চরিতব্রতঃ। ব্রহ্মাস্ত্র জানবেন সত্তম তপস্বী, আর কেউ ব্রহ্মাস্ত্র জানবার অধিকারীই নয়–নানো বিদ্যাৎ কথঞ্চন।

 দ্রোণের কথাটার ভালরকম তাৎপর্য আছে। সে কালের দিনে অনেক ব্রাহ্মণই অস্ত্রবিদ্যার গূঢ় কৌশল জানতেন, জানতেন অনেক মুনি-ঋষি তপস্বীরাও। ব্রহ্মাস্ত্র হল এমন এক মারণাস্ত্র যা শত্রুর সমূহ এবং সার্বিক ক্ষতি করে। একে সেকালের দিনের বহুতর অস্ত্র-সম্ভারের নিরিখে ঠিক পরমাণু-অস্ত্র বলা যাবে কিনা সে সম্বন্ধে পণ্ডিত-জনের মধ্যে কিছু মতভেদ আছে। তবে মহাভারতে এবং রামায়ণে ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগকালীন যে অবস্থা বর্ণিত হয়েছে, তাতে অনেক পণ্ডিতই ব্রহ্মাস্ত্রকে পরমাণু-কল্প কোনও অস্ত্র বলেই ভাবেন।

মহাভারতে ভারত-যুদ্ধের অন্তকালে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার ব্রহ্মশিরা নামক মারণাস্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র-মোক্ষণ করেছিলেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে–ব্রহ্মাস্ত্র মোক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে যুগান্তকারী আগুন জ্বলে উঠেছিল–প্রজজ্বাল মহার্চিস্মদ যুগান্তানলসন্নিভ। চারদিকে মনে হল কে যেন ভীষণ আঘাতে সব কিছু ভেঙে ফেলছে, যেন উল্কাবৃষ্টি হচ্ছে সমস্ত দেশ জুড়ে–নির্ঘাতাঃ বহবশ্যাসন পেতুরুল্কা সহস্রশঃ। ব্রহ্মাস্ত্র-মোক্ষণের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল–ভয়ানক শব্দ এবং আগুন। এমনই কর্ণভেদী সেই শব্দ যাতে আকাশ ফেটে যাবার অনুভূতি হয়, এমনই সেই আগুন যাতে মনে হয় সর্বত্র আগুন ব্যাপ্ত হয়ে গেছে– সশব্দমভব ব্যোম জ্বালা–মালাকুলং ভৃশম্। সমস্ত পৃথিবী কাঁপতে লাগল থর-থর করে, পর্বত-বন একাকার প্রায়। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ ভয়েই স্রিয়মাণ হয়ে উঠল আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায়–মহ ভয়ঞ্চ ভূতানাং সর্বের্ষাং সমজায়ত।

রামায়ণে রাবণের ওপর যে ব্রহ্মাস্ত্র ক্ষেপণ করেছিলেন রামচন্দ্র, তারও বর্ণনা অনুরূপ ভয়ঙ্কর। সেই গগনভেদী শব্দ, সেই অগ্নিব্যাপ্ত দিমণ্ডল, সেই ভূমি–ভূধর প্রপতন। রামায়ণে ব্রহ্মাস্ত্রের বর্ণনা দেখে অনেক পণ্ডিতই এটাকে পারমাণবিক অস্ত্র হিসেবে কল্পনা করেছেন। আমরা শ্রুত আছি–জাপানে যখন অ্যাটম–বোমা ফেলা হয়, তখন সেই অগ্নিজ্বালাব্যাপ্ত দিঙুমণ্ডলের উদ্ভাস বর্ণনা করেছিলেন কুখ্যাত এবং বিখ্যাত বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার। শোনা যায়–অ্যাটম–বোমা ক্ষেপণের মুহূর্তে তিনি একটি মহাভারতীয় শ্লোকই উচ্চারণ করে বলেছিলেন–যদি আকাশে একই সঙ্গে সহস্র সূর্যের উদয় হয়, তবে যে তেজ নির্গত হবে, এই বিরাট মহান পুরুষের তেজও তেমনই–

 দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেৎ যুগপদুখিতাঃ।
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাৎ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ।

ওপেনহাইমার ভালই সংস্কৃত জানতেন শুনি। তার এই বর্ণনা যদি তার চক্ষু-কর্ণ এবং মনের অস্ত্রক্ষেপণের মৌর্তিক ভাব প্রকাশ করে থাকে, তবে রামায়ণ-মহাভারতে ব্রহ্মাস্ত্রের বর্ণনা পারমাণবিক সাম্যে কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না। আমরা জানি–আমাদের আধুনিক বৈজ্ঞানিক সংস্কার তথা তৎকালীন সমাজের ধাতু-পদার্থের বিচার আমাদের এতটাই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন করে তুলবে, যাতে সেই কালে পারমাণবিক অস্ত্র-ব্যবহারের কথা আমরা সত্য বলে মেনে নিতে পারব না। কিন্তু মূলত পারমাণবিক না হলেও, সেকালের খ্যাতকীর্তি যোদ্ধার হাতে যে সর্বনাশা অস্ত্রটি ছিল, সেটার নাম অবশ্যই ব্রহ্মাস্ত্র। ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের অধিকারী–বিচারের মধ্যেও একালের ছায়া আছে কিন্তু।

পারমাণবিক অস্ত্র-নির্মাণের ক্ষেত্রে আজও একটা অধিকারী বিচার চলে। রাজনৈতিক শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে যারা ধনে-মানে বৃহত্তম তারাই পরমাণু-শক্তিধরও বটে। তারা কিন্তু কখনও চায় না–ক্ষুদ্র এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভঙ্গুর দেশগুলির হাতে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র থাকুক অথবা ক্ষুদ্র কারণে সেই অস্ত্র ব্যবহৃত হোক। আমরা মনে করি–পরমাণু অস্ত্র কোনও শক্তির হাতেই থাকা উচিত নয়, কিন্তু রাজনৈতিক কারণ এমনই কুটিল এবং বিচিত্র যে, শত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও এই অস্ত্রের মোহ থেকে বড়ো-ছোট কোনও দেশই মুক্ত নয়। মহাভারতেও দেখা যাবে–দুটি বৃহৎশক্তির হাতে ব্রহ্মাস্ত্র গেছে। তার মধ্যে এক পক্ষের অস্ত্রের ওপর মানসিক নিয়ন্ত্রণ নেই, আরেক পক্ষের আছে।

ব্রহ্মাস্ত্রধর ব্যক্তির কাছে সবচেয়ে যেটা কাম্য সেটা হচ্ছে–ওই নিয়ন্ত্রণ। কাম-ক্রোধ লোভ–মোহ ইত্যাদিকে যিনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন তিনি ব্রহ্মাস্ত্র-ধারণের অধিকারী। যার জন্য দ্রোণাচার্য কর্ণকে বলেছেন–ব্রহ্মাস্ত্র ধারণ করতে পারেন শম-দমের গুণসম্পন্ন ব্রাহ্মণ, অথবা তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন তপস্বী অথবা ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ ক্ষত্রিয়। দ্রোণাচার্য কর্ণকে যা বলেছেন তার গভীর অর্থ আরও স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে ব্যাস-নারদের দ্বৈত-ভাষণে। তারা বলেছেন–ব্রহ্মাস্ত্র হল ব্রহ্মতেজোময়। যিনি ব্রহ্মচারীর ব্রতে স্থিত নন, যিনি ইন্দ্রিয় জয় করতে পারেননি, এমন অকৃতাত্মা পুরুষ এই অস্ত্র ধারণ, মোক্ষণ এবং সম্বরণের যোগ্য হতে পারেন না।

ঋষিদ্বয় যে ব্রহ্মচর্যের কথা বলেছেন তার তাৎপর্য নিহিত আছে ব্রহ্মাস্ত্রধারী যোদ্ধার সংযমে, আত্মনিয়ন্ত্রণে। এই সংযম এবং নিয়ন্ত্রণের দিকে ইঙ্গিত করেই অস্ত্রধারণের ব্যাপারে দ্রোণাচার্য একান্বয়ে ব্রাহ্মণ, তপস্বী বেং ন্যায়নীতিনিষ্ঠ ক্ষত্রিয়ের অধিকার নির্ণয় করেছেন। তিনি কর্ণকে বোঝাতে চেয়েছেন–যে মানুষ এই অস্ত্রশিক্ষার কালেই তার সহপাঠীকে হত্যা করার ভাবনায় অথবা শুধুমাত্র একজনকে অতিক্রম করার ভাবনায় এমন একান্তে এসে ব্ৰহ্মাস্ত্র চাইতে পারে, সে অন্তত ব্রহ্মাস্ত্র ধারণের যোগ্য নয়। যে মানুষ একজনের ওপর ব্যক্তিগত ক্রোধই এড়াতে পারছে না, সে তো নিজের সামান্য বিপদমাত্রেই অথবা নিজের অহংকারবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্যই যে কোনও সময় এই অস্ত্রমোক্ষণ করবে। অতএব আর যাই হোক, তাকে ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ শেখানো যায় না। দ্রোণ কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তিনিও দ্রোণের আশ্রম ছেড়ে চলে গেছেন ভার্গব পরশুরামের কাছে এবং তাও কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ শেখার জন্যই।

যাই হোক, কর্ণ দ্রোণের আশ্রম ছেড়ে চলে গেলেন এবং তার জন্য দ্রোণের অস্ত্র-পাঠশালার কোনও ক্ষতি-বৃদ্ধি হল না। শিক্ষার আসর চলতে লাগল আগের মতোই। দ্রোণের আশ্রমস্থ সেই মেধাবী শিষ্যটি আগের মতোই অনুসন্ধিৎসা, আগের মতোই বিনয় এবং সংযমের মাধ্যমে অস্ত্রশিক্ষা করে যেতে লাগলেন। শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর বহু ইচ্ছে কাজ করে। কারও কাছে যদি তিনি শোনেন যে, অমুক দেশের রাজা অসাধারণ একটি অস্ত্রবিদ্যা জানেন, তাহলেই তিনি সেই বিদ্যাটি শিখতে চাইবেন। যদি শোনেন–প্রাচীন কালে অমুক বংশের অমুক পুরুষ একটি বিশেষ অস্ত্রকৌশল জানতেন, অমনই অর্জুন চেষ্টা করে যাবেন সেই কৌশলটি শেখার জন্য এবং সেই চেষ্টাটা করবেন নিজেই, গুরু যদি তা না শেখান তো নিজেই।

 দ্রোণাচার্য বুঝে গিয়েছিলেন–এ এক সাংঘাতিক ছেলে। এর কাছে কিছুই লুকিয়ে রাখা যায় না। নিজপুত্র অশ্বত্থামাকে একটু আলাদা শিক্ষা দিচ্ছিলেন, তাও এই ছেলেটি শিখে ফেলেছে। তিনি না শিখিয়ে পারেননি। এখন তার প্রশিক্ষণের ভাণ্ডারে আর একটিমাত্র বস্তু বাকি আছে। সেটি হল শব্দভেদী বাণ-মোক্ষণের শিক্ষা। দূরের জিনিস চোখে না দেখে শুধু শব্দমাত্রে আন্দাজ করে নিয়ে লক্ষ্য ভেদ করতে হবে। ভীষণ রকমের অভ্যাস, মনঃসংযোগ এবং শব্দ চিনে নেবার কান থাকলে এই শব্দভেদ শেখা যায়। গুরু দ্রোণাচার্য জানেন–উপরি উক্ত কোনও গুণেরই অভাব তাঁর শিষ্যের মধ্যে নেই এবং যেভাবেই হোক এই বিচিত্র অস্ত্রকৌশলের নানা কাহিনী অর্জুন লোকমুখে শুনেছেন। বিশেষত ইক্ষাকুবংশীয় দশরথ রাজার শব্দভেদন ক্ষমতা মহাভারতের সমাজে প্রচারিত ছিল। অর্জুনের ইচ্ছা আছে ওই বিদ্যা শেখার কিন্তু গুরু দ্রোণাচার্যর শেখানোর ইচ্ছে নেই। হয়তো এই একটিমাত্র কৌশল তিনি নিজপুত্রের জন্য সঞ্চিত রেখে দিতে চান।

 কিন্তু বিদ্যাশিক্ষার ব্যাপারে অর্জুনকে দ্রোণাচার্যের বিশ্বাস নেই। অর্জুনকে এতদিন ধরে শিক্ষা দিতে দিতেই তিনি বুঝে গেছেন যে, সব কিছুই তাকে শিখিয়ে দিতে হয় না। শিক্ষার স্থল অনেক-বিদ্যালয়, মনুষ্য-সমাজ, বাহ্য জগৎ। কাজেই অর্জুন যে কোথা থেকে কোন ঘটনা থেকে নিজের নব-নবোন্মেষশালিনী প্রজ্ঞায় কী আবিষ্কার করে ফেলবেন, সেটা দ্রোণাচার্য আন্দাজ করতে পারতেন। সেই আন্দাজ করেই একদিন তিনি অর্জুনের অনুপস্থিতিতে তার ঘরে গেলেন।

হস্তিনাপুরের একান্তে দ্রোণাচার্যের বাসভবনের কাছাকাছি অনেকগুলি ছাত্রাবাস তৈরি হয়েছে। একেকটি আবাসে পাঁচ–ছজন করে ছাত্র থাকতে পারে। ছাত্ররা ব্রহ্মচর্য পালন করে, যথাসাধ্য লঘুপাচ্য খাবার খায় এবং কুশশয্যায় শয়ন করে। যেহেতু রাজপুত্রদের কায়িক পরিশ্রম অত্যন্ত বেশি তাই একেকটি আবাসের রন্ধন কর্ম সম্পন্ন করার জন্য একেক জন পাঁচক ছিল। দ্রোণাচার্য একদিন অর্জুনের আবাসে এসে পাচককে ডেকে পাঠালেন। গুরুর তলব পেয়ে পাঁচক তড়িঘড়ি এসে উপস্থিত হল দ্রোণাচার্যের কাছে। সে বলল–আজ্ঞে বলুন, কত্তা। কী আদেশ। দ্রোণাচার্য বললেন–এই আবাসেই তো অৰ্জুন থাকেন? পাঁচক সম্মতি জানাতেই দ্রোণ বললেন–দেখো বাছা! তোমাকে একটা কথা বলি–তুমি কখনও ওই অর্জুনকে অন্ধকারের সময় খাবার দেবে না–অন্ধকারেজুনায় অন্নং ন দেয়ং তে কদাচন।

হঠাৎ এই কথাটার কোনও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না পাঁচক। তবে নিম্নতন এক কর্মচারীর মানসিকতায় সে ভাবল যে, সে-ই কিছু অপরাধ করে থাকবে। সে বলল–না কত্তা! আমি তো কোনওদিন তেনাকে অন্ধকারে খাবার দিই নি। সন্ধে থেকেই আমি ঘরের কোণে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিই, মাঝে মাঝেই আমি সেই তৈলপূর প্রদীপের সলতে উসকে দিই। প্রদীপ জ্বলতে থাকে সেই তেনারা ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত। দ্রোণাচার্য বোকা সেজে বললেন–বেশ বেশ। প্রদীপ যেন জ্বলে। আরও একটা কথা। আমি যে তোমাকে এসব নির্দেশ দিয়ে গেলাম, সেটা যেন আবার অর্জুনকে বোলো না বাপুন চাখ্যেয়ম্ ইদঞ্চাপি মাক্যং বিজয়ে ত্বয়া। তাহলে তোমার বিপদ হবে।

রাঁধুনে বামুন ভাবল–প্রদীপিত আলোয় অর্জুনের অনুগ্রহণ করার সঙ্গে দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষার একটা গভীর সম্পর্ক আছে এবং অন্ধকারে খেলে বুঝি সে অস্ত্রজ্ঞান একেবারেই লুপ্ত হয়। এ কথা অর্জুনকে বলা-না-বলার সঙ্গেও অস্ত্রশিক্ষার যোগ থাকতে পারে। এত সব ভেবে সে বুঝি মনে মনে ঠিকই করে ফেলল যে, এখন থেকে সারা রাতই আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে অর্জুনের ঘরে। কোথা থেকে কী হবে আর তার রাঁধুনের চাকরিটি যাবে।

দ্রোণাচার্য যে নির্দেশ দিয়ে গেলেন, তার তাৎপর্য যে কত গভীর সে তো রাঁধুনে বামুন বুঝবে না। সে যা বোঝেন, দ্রোণাচার্যই বোঝেন। কিন্তু দুর্দৈব এমনই যে, দ্রোণাচার্য যা ভেবেছিলেন, অসংহতা প্রকৃতির চক্রান্তে তা বিপর্যস্ত হয়ে গেল। সে দিন কুমারেরা বাড়ি ফিরে এলেন সান্ধ্য-স্নান এবং আহ্নিক সেরে। সারা দিন আবহাওয়ায় কিছু উষ্ণতার প্রকোপ ছিল। এখন সন্ধ্যাবেলায় ভালরকম হাওয়া উঠল। পাঁচক ঠাকুর মোটা সলতে উসকে উসকে প্রদীপটি অনির্বাণ রেখে দিল এবং প্রদীপের সলতে ভাল করে উসকে দিয়ে আবাসিক পাণ্ডবদের সঙ্গে অর্জুনকেও খেতে দিল। কিন্তু সেদিনের আকুল প্রাকৃতিক পরিবেশে হাওয়ার এমনই দাপাদাপি শুরু হল যে তৈলপূর প্রদীপটি হঠাৎই নিভে গেল–তেন তত্র প্রদীপঃ স দীপ্যমাননা নিবাপিতঃ। প্রদীপ নিভিয়া গেল।

.

১০১.

 সেদিন রাত্রে দ্রোণাচার্যের বেশ ভাল ঘুম এসে গেছে। সারাদিন বালকদের অস্ত্র-প্রশিক্ষণ দেওয়া, নিজের ব্রাহ্মণোচিত সন্ধ্যা-আহ্নিক, অগ্নিষ্টোম ইত্যাদির ফলে পরিশ্রমও তার কম যায় না। অতএব নিদ্রাদেবী যেন মহৎ-সেবার মাধুর্যে প্রৌঢ়প্রায় মানুষটিকে আপন আলিঙ্গনে বদ্ধ করেছেন। কিন্তু ঘুম যত গভীরই হোক একজন যোদ্ধা পুরুষের ঘুমানোর নিয়ম প্রায় কুকুরের মতো। সংস্কৃতে একে বলে শনিদ্র। চেষ্টা করতে হবে কাকের মতো, ঘুমাতে হবে কুকুরের মতো। কাজেই ঘুম যত গভীরই হোক মাঝে মাঝেই দ্রোণাচার্যের ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙার কারণও আছে।

 হস্তিনাপুরের প্রত্যন্ত-প্রদেশে তমাল-বকুল আর নানা বৃক্ষের ছায়ায় দ্রোণাচার্যের কুটির নির্মিত হয়েছে। এখান থেকে বনাঞ্চল বেশি দূরে নয় বলে রাতের আঁধারে নানা পশুপক্ষীর বিচিত্র আওয়াজ কানে ভেসে আসে। বিশেষত যামঘোষ শৃগালগুলি যামঘোষণার সময় এমনই সঙ্গত এবং কর্কশ স্বরে ডাকতে আরম্ভ করে যে, নিদ্রায় অচেতন মানুষেরও ঘুম ভাঙবে। সেখানে দ্রোণাচার্যের মতো সদাজাগ্রত যুদ্ধবীর তো আপন যুদ্ধস্বার্থে নিজের ঘুম-ভাঙাটাকে অভ্যাসে পরিণত করেছেন।

সেদিন প্রথম দু-একবার দ্রোণাচার্যের ঘুম ভাঙেনি বটে, কিন্তু তার পরেই বিভিন্ন পশুপক্ষী এবং বিশেষত শৃগালের ডাকের মধ্যে একটা অন্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলেন তিনি। অন্যদিন কী হয়, এক শৃগালের স্বর শুনে অন্য শৃগালগুলিও ডাকতেই থাকে, ডাকতেই থাকে এবং সেই সমবেত এবং প্রলম্বিত চিৎকার-ধ্বনির একটানা সুরে আবারও ঘুম এসে যায় দ্রোণাচার্যের। কিন্তু আজকে তা হচ্ছে না। পশুর চিৎকারে ঘুম ভাঙছে বটে, কিন্তু তার পরেই হাওয়ার মধ্যে অতিদ্রুত এক শন-শন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এবং তার পরক্ষণেই পশুপক্ষীর সশব্দ পলায়ন এবং প্রপতন শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাদের আওয়াজটা কর্কশের বদলে খানিকটা আর্তও হয়ে উঠছে যেন এবং তাও দূর থেকে শোনা যাচ্ছে।

দ্রোণাচার্য প্রথমে ভাবলেন–সাধারণ চোর অথবা জনপদের শেষ সীমায় থাকা আটবিক অথবা নিষাদগণের উপদ্রব বা আনাগোনায় এমনতর পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু ওই একই ঘটনা বারবার ঘটতে লাগল এবং তাও বেশ অল্প সময়ের ব্যবধানে। দ্রোণাচার্য আরও আশ্চর্য হলেন মুহূর্মুহূ শন-শন্ আওয়াজ শুনে। এ আওয়াজ তার খুব চেনা–তস্য জ্যাতল-নির্ঘোষং দ্রোণঃ শুশ্রাব ভারত। নিষাদ কিংবা আটবিক হলে এমন মুহূর্মুহূ তীরের আওয়াজ শোনা যেত না। নানা ভাবনা-চিন্তা করে দ্রোণাচার্য কুটিরের কোণস্থিত প্রদীপখানি উসকে দিয়ে অর্গল মুক্ত করলেন।

ঘুম তার অনেকক্ষণই ভেঙে গেছে। কিন্তু বাইরে এসে তিনি যা দেখলেন তাতে তার চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে গেল। দেখলেন–অর্জুন। রাতের গভীর নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মতোই গভীর নিচ্ছিদ্র মনোযোগে তিনি বাণাভ্যাস করে যাচ্ছেন। এমন গভীর কষ্টকর চেষ্টা দেখেও এইরকম শিষ্যের প্রতি গুরুর পক্ষপাত আসবে না কি? রাতের অন্ধকারে যখন সকলে নিদ্রায় অচেতন, তখন এই কৈশোরগন্ধী যুবক শুধু অকারণের আনন্দে অস্ত্রশিক্ষাকে এক শিল্পে পরিণত করছেন।

দ্রোণ প্রথমে একটু আশাহত হলেও পরমুহূর্তেই শিষ্য-গৌরবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরলেন শিষ্যকে। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তা হয়নি বটে কিন্তু যা হয়েছে এবং তা যেহেতু অর্জুনের হয়েছে–অতএব তিনি পরম আনন্দে অর্জুনকে জড়িয়ে ধরে বললেন–আজ থেকে আমি এমন চেষ্টা করব, যাতে তোমার মতো আর দ্বিতীয় ধনুর্ধর এই পৃথিবীতে তৈরি না হয়–প্রতিষ্যে তথা কর্তৃং যথা নানন্যা ধনুর্ধরঃ।

আজকে যে রাতের অন্ধকারে অর্জুনকে দেখতে পাবেন দ্রোণ–এ আন্দাজ তার আগেই ছিল। অস্ত্রশিক্ষার ব্যাপারে এই শিষ্যটির নব-নবান্মেষশালিনী প্রজ্ঞার কথা তিনি মনে-প্রাণে অনুভব করেন, আর অনুভব করেন বলেই অর্জুনের অনুপস্থিতিতে তার আবাসস্থলে গিয়ে দ্রোণাচার্য রান্নার পাঁচকটিকে সাবধান করে দিয়ে এসেছিলেন–যাতে সে অন্ধকারে অর্জুনকে খাবার না দেয়। কিন্তু প্রকৃতি এবং দৈবের নীতি-নিয়ম মানুষের ইচ্ছেমতো চলে না। পাঁচক বামুন না চাইলেও অর্জুনকে খাবার দেবার পরে প্রদীপ নিভে গিয়েছিল। খাবার মাঝপথে প্রদীপ নিভে যাবার পর সে প্রদীপ জ্বালানোও আর সম্ভব হয়নি। খাবার যতটুকু বাকি ছিল অন্যেরা তা ঠিকঠাক মতো খেয়েই উঠে গেল। প্রদীপ নিভে যাবার বিরক্তি ছাড়া আর কারও মনে ভাবনা কিছু হল না।

কিন্তু এইখানেই অর্জুনের সঙ্গে অন্যের তফাত। তিনি বিরক্ত তো হলেনই না, উপরন্তু অন্ধকারে খেতে খেতে তার মনে হল–আরে! বেশ তো খাচ্ছি। অন্নযুক্ত হাতটি তত মুখ ছাড়া অন্য কোথাও যাচ্ছে না–হস্ত-স্তেজস্বিনস্তস্য…নাস্যা অন্যত্র বৰ্ততে। অর্জুন বুঝলেন অভ্যাসে সব হয়। অভ্যাসে যদি খাবার অসুবিধে না হয়, তবে অভ্যাস করলে অন্ধকারেও অস্ত্ৰচালনা সম্ভব। লক্ষ্যবস্তুর শব্দ শুনে তাকে না দেখেও অস্ত্রের দ্বারা লক্ষ্যভেদ সম্ভব, যদি অভ্যাস ঠিকমতো হয়।

অর্জুন আর দেরি করেননি। সেই রাত্রেই, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল, তখন তিনি ধনুক-বাণ হাতে বেরিয়ে পড়লেন অন্ধকারে শব্দ শুনে লক্ষ্যে আঘাত করার জন্য–তদভ্যাসকৃতং মত্বা রাত্রাবপি স পাণ্ডবঃ। রাত্রির অন্ধকারে হিংস্র শ্বাপদ এবং রাত্রিচর পশু-পক্ষীর শব্দ ছাড়া আর কীই বা শোনা যায়। অতএব শব্দভেদের প্রথম লক্ষ্য হল এরাই। অভ্যাস আরম্ভ হল। কখনও তার লক্ষ্য বিদ্ধ হল, কখনও বা নয়। প্রথম রাত্রির অভ্যাসে কতই বা তার কাছে আশা করা যেতে পারে। কিন্তু প্রত্যক্ষ বস্তু ভেদন করার শক্তিতে তিনি যেহেতু অতুলনীয়, অতএব অন্ধকারেও সে বিদ্যা কিছুটা কাজে লাগল। অতএব লক্ষ্য কিছু বিদ্ধও হল, কিছু বা হল না। কিন্তু অভ্যাস চলতে লাগল বীর যোদ্ধার একাগ্রতায়। বাণ চলতে লাগল শন-শন করে, আর ঠিক এই অবস্থাতেই দ্রোণ তার শয়ন-গৃহের শয্যা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। এসে দেখেছেন–তিনি যা চেয়েছিলেন, সেটা হয়নি বটে, কিন্তু যা হয়েছে, সেটা তিনি আগেই বুঝেছিলেন যে, একমাত্র অর্জুনের দ্বারাই এমনটা সম্ভব, অন্য কারও পক্ষে এটা সম্ভব নয়।

যে দ্রোণাচার্য আপন পুত্রের স্বার্থে অস্ত্রবিদ্যার গূঢ় একটি কৌশলমাত্র লুকিয়ে রাখবেন বলে ঠিক করেছিলেন, সেই দ্রোণাচার্য যখন দেখলেন যে, শিষ্য তার আপন উদ্ভাবনী শক্তিতে নিজেই নিজের গুরু হয়ে গেছেন, তখন তিনি শিষ্যকে জড়িয়ে না ধরে পারেননি। রাতের অন্ধকারে আপন প্রিয় শিষ্যকে এইভাবে অস্ত্রাভ্যাস করতে দেখে তিনি তার সমস্ত পক্ষপাত উজাড় করে দিলেন শিষ্যের প্রতি। এমন শিষ্যের ওপরেও মনুষ্যধর্মী গুরুর পক্ষপাত হবে না?

আমার এক বন্ধু বাজারে আনাজ বিক্রি করে। আরেক বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বাজারে আমার পূর্ব বন্ধুর কাছ থেকে আনাজ কেনেন। আনাজ–বিক্রেতা এবং ইঞ্জিনিয়ার–দুজনেই এক সময় একই স্কুলে পড়তেন ছোটবেলায়। সৌভাগ্যক্রমে আমিও। এই সূত্রেই একদিন আনাজ–বিক্রেতা ইঞ্জিনিয়ারকে বলল–সুখে আছিস ভাই, তোরা। চাকরি–বাকরি করছিস। মাঠের মধ্যে বসে আনাজ বিক্রির কষ্ট তো আর বুঝলি না? তুই যখন সন্ধ্যাবেলা বউ–ছেলে নিয়ে ঘুরতে বেরুবি, তখন আমি পরের দিন আনাজের ঝাঁকাটা তোলার চিন্তা করছি।

ইঞ্জিনিয়ার প্রথমে ভাবল, কিছু বলবে না। তারপর আনাজ ব্যাগে পুরতে পুরতে বলল–একটা কথা বলি ভাই, রাগ করিস না। তুই এখনকার সময় ছেড়ে দিয়ে আমাদের সেই ছোটবেলা আর প্রথম যৌবনের সময়টায় চলে যা। তুই যখন পাড়ায় পাড়ায় পকেট-ভর্তি গুলি নিয়ে খাটান আর জেত্তালের খেলা করছিস, তখন কিন্তু আমি বাড়িতে বসে ইতিহাস মুখস্থ করছি। সে কষ্ট কি তুই-ই বুঝেছিস? তুই যখন বিশ্বকর্মা পুজোর তিন মাস আগে থেকে ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে এক তাল ঘুড়ি নিয়ে আমারই বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে একশোবার ভোকাট্টা বলে নৃত্য-চিৎকার করছিস, তখন ওই একটা ঘুড়ি কাটার সঙ্গে সঙ্গে আমারও কিন্তু মন কেটে যেত। কিন্তু আমি জোর করে সেই বিদীর্ণ মনকে পড়ার টেবিলে এনে ফেলেছি। কৈশোর-যৌবনের প্রথম সন্ধিতে তুই যখন, ভাই-আই মিলন কি বেলা অথবা কাশ্মীর কি কলির পিছনে উদ্দাম উত্তেজনায় লাইন লাগাচ্ছিস, আমি কিন্তু তখন বাড়িতে বসে ভোদার মতো অঙ্ক করে যাচ্ছি। তুই কি সেই কষ্ট কখনও বুঝেছিলি? মানুষকে এক সময় কষ্ট করতেই হয়। হয় ছোটবেলায় নয় বড়বেলায়। তুই এখন কষ্ট করছিস, আর আমি আমার শৈশব-কৈশোর জলাঞ্জলি দিয়ে তখন কষ্ট করেছি।

আমরা দ্রোণাচার্যের পক্ষপাতের প্রসঙ্গে অন্য কথায় চলে এসেছিলাম। এসেছিলাম এই কারণে যে, অন্য বালকেরা যখন নিজেদের খেলাধুলা, নিজেদের শৈশব-কৈশোরের উপভোগটুকু বাদ দিচ্ছেন না, তখনও অর্জুন কিন্তু নিজের পরিশ্রম এবং অভ্যাস চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোগসুখহীন এই তীব্র পরিশ্রম দেখার পরেও এমন কোনও আচার্য বা গুরু থাকতে পারেন না, যিনি তাঁর শিষ্যের প্রতি পক্ষপাত আচরণ করবেন না। দ্রোণাচার্যও এই পক্ষপাত স্বীকার করেছেন এবং অর্জুনকে বলেছেন–আমি তোমার জন্য এমন চেষ্টা করব যাতে পৃথিবীতে কেউ তোমার সমান ধনুর্ধর না হতে পারে–ত্বৎসমো ভবিতা লোকে..যথা নানন্যা ধনুর্ধরঃ। দ্রোণাচার্য নিজের ছেলের কথা এবার ভুলে গেছেন। তিনি তাঁর সমস্ত ঐকান্তিকতা দিয়ে অর্জুনকে চরম অস্ত্রশিক্ষা দিতে লাগলেন। রথ, অশ্ব, হস্তী ইত্যাদি বাহনের ওপর থেকে যুদ্ধ করতে গেলে ধনুক-বাণ ধরার স্টান্স থেকে আরম্ভ করে বাহনশূন্য অবস্থায় মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকেও কীভাবে আবার আত্মলাভ করা যায়, সেইসব সূক্ষ্ম-গভীর কথাগুলি অর্জুনকে শিখিয়ে দিলেন দ্রোণাচার্য–রথেষু ভূমাবপি চ রণশিক্ষামশিক্ষয়ৎ।

দ্রোণাচার্যের কাছে অন্যান্য কুরু-কুমারেরা যে অবহেলিত হচ্ছিলেন তা মোটেই নয়। তারাও যথাসাধ্য যথামতি গুরুর কাছে বিদ্যা শিখছিলেন বটে, কিন্তু অর্জুনের প্রতি দ্রোণাচার্যের যে পক্ষপাত তৈরি হয়ে গেছে, তা আর লুপ্ত হবার ছিল না। দ্রোণাচার্যের এই পক্ষপাত কত তীব্র তার জন্য একটি অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ করেছেন মহাভারতের কবি। এ ঘটনা শুনে নানা জনের নানা মন্তব্য থাকবে এবং তার মধ্যে আমাদের বক্তব্যও আমরা পরিষ্কার করার চেষ্টা করব।

দ্রোণাচার্যের প্রশিক্ষণ-নৈপুণ্যের কথা তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নানাদেশ থেকে রাজপুত্রেরা আসছেন দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। ঠিক এইরকম রাজপুত্রদের আনাগোনার মধ্যেই একদিন দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষার পাঠভবনে এসে উপস্থিত হলেন নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য–একলব্যো মূয়াজ..হিরণ্যধনুষঃ সুতঃ। একলব্যের গায়ের রঙ কালো, একেবারে পেটাই করা শরীর মেদবাহুল্যবর্জিত। পরনে একখণ্ড পশুচর্ম। ঝাকড়া চুল তার মাথার চারদিকে ছড়িয়ে আছে। সে চুল আঁচড়ায় না ভাল করে। শরীরে একটু-আধটু ধুলো লেগে আছে, তাও সে পরিষ্কার করার চেষ্টা করে না। কিন্তু তার চক্ষুদুটি ভীষণ সরল এবং উজ্জ্বল–কৃষ্ণং মলদিগ্ধাঙ্গং কৃষ্ণাজিনজটাধরম্।

 দ্রোণাচার্যের কাছে একলব্য শিক্ষার্থী হয়ে এসেছে। সে তার পাঠশালায় শিষ্য হয়ে থাকতে চায়। দ্রোণাচার্য মহা ফাঁপরে পড়লেন। শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিতে হবে, এই তো সাধারণ নিয়ম, সেখানে তো অন্য বিচার চলে না। কিন্তু সমসাময়িক কালের জাতি-গোষ্ঠীর বিচারে নিষাদ-পুরুষদের পক্ষে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে ওঠা-বসা বা মেলামেশা করা মুশকিল ছিল। তার কাছে থাকা আবাসিক রাজপুত্রেরা যদি এ ব্যাপারে আপত্তি তোলে, তাহলে দ্রোণাচার্য কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে পড়বেন। তার চেয়ে নৈষাদি একলব্যকে প্রত্যাখ্যান করাটাই তিনি শ্রেয় মনে করলেন বৃহত্তর স্বার্থে।

মনে রাখার দরকার, জাতি বা গোষ্ঠী হিসেবে নিষাদরা কিন্তু সময়ের দিক থেকে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় বা আর্যসভ্যতার সমবয়সী। জন্মগতভাবে নিষাদরা হলেন চতুর্বর্ণের পরের বর্ণ; নিষাদরা সংকরজন্ম। মনু মহারাজ জানিয়েছেন–ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসে এবং শূদ্রা মাতার গর্ভে যে পুত্রের জন্ম হবে তাদের সংজ্ঞা হবে নিষাদ। ব্রাহ্মণরা যজ্ঞকার্যের প্রয়োজনে বা সামাজিক কারণে অবশ্যই একজন ব্রাহ্মণ-কন্যারই পাণি গ্রহণ করতেন। কিন্তু কামজ প্রয়োজন যখন ঘটত, তখন ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্রের ঘরের সুন্দরী রমণীটি ব্রাহ্মণের তৃপ্তির পরিসর থেকে বাদ পড়তেন না। কিন্তু সামাজিক নিয়মে ব্রাহ্মণ পিতার এই কামতৃপ্তির ফল ভোগ করতেন তাদের পুত্রেরা যাঁরা কেউ নিষাদ, কেউ পারশব ইত্যাদি সংজ্ঞায় চিহ্নিত হতেন।

আশ্চর্য ব্যাপার হল, সামাজিকতার বিচারে নিষাদরা হীনজাতির মধ্যে পরিগণিত হলেও বৈদিক যুগের শেষ কল্পেও তারা খুব তাড়াতাড়িই ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিভাগের একতম হয়ে গিয়েছিলেন। ঋগবেদের–পঞ্চজন মম হোত্রং জুষধ্ব–এই মন্ত্রবর্ণ ব্যাখ্যা করতে সুপ্রাচীন আভিধানিক নিরুক্তকার যাস্ক পঞ্চজন শব্দের অর্থ করলেন–ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং নিষাদ। বাজসনেয়ী সংহিতার মধ্যেও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ইত্যাদি চতুর্বর্ণের সঙ্গে পঞ্চম জাতি হিসেবে আমরা নিষাদদের নাম একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতে দেখি। সবচেয়ে বড় কথা কোনও প্রাচীন সংহিতা নিষাদদের অধিপতিকে বৈদিক ইষ্টি (যাগ) সম্পন্ন করারও নির্দেশ দিয়েছেন।

এমন হতেই পারে যে, ভারতবর্ষে আর্যায়গের প্রথম প্রক্রিয়ায় নিষাদরা সংখ্যায় অনেক ছিলেন এবং মনুষ্যজীবনের প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তাদের কর্ম এবং শিল্প–জ্ঞান অনেকের চেয়েই বেশি ছিল বলে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিভাগের অন্তরে শেষ স্থানটি দখল করে নিতে তাদের সময় লাগেনি। পৌরাণিকেরা অবশ্য নিষাদের জন্মকথা শুনিয়েছেন এই পৃথিবীর প্রথম রাজা মহারাজ পৃথুরও পূর্বকাল থেকে। অত্যাচারী বেনের এক হস্ত মন্থন করে নিষাদদের লাভ করেছিলেন ঋষি-ব্রাহ্মণেরা, আর অন্য হস্ত মন্থন করে নারায়ণ-সম পুমান্ পৃথুকে। কাজেই মহারাজ পৃথুর মতো এক পুরাণ–গুণসম্পন্ন ব্যক্তির বিপরীত কোটিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও মহারাজ পৃথুর পূর্বজত্ব তথা জন্মের সঙ্গে একাত্মতার নিরিখে ভারতবর্ষের অন্যান্য সংকর জাতির চেয়ে নিষাদদের মাহাত্ম বেশি। হয়তো এই মাহাত্ম রামায়ণের কালেও অটুট ছিল বলেই শৃঙ্গবেরপুরের নিষাদরাজ গুহকের সঙ্গে আর্য-সভ্যতার ধুরন্ধর পুরুষ রামচন্দ্রের পরম বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল।

 নিষাদদের থাকবার জন্য যে একটা নির্দিষ্ট জায়গা ছিল, তা মনে হয় না। কৌষিতকী ব্রাহ্মণ অথবা লাট্যায়ন শ্ৰেীতসূত্রের মতো প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থে দেখা যায় যে, যিনি বিশ্বজিৎ যজ্ঞ করবেন, তাঁকে নিষাদ-পুরীতে গিয়ে বসতি গ্রহণ করতে হবে সাময়িকভাবে। এতে বোঝা যায় যে, নিশ্চয়ই প্রত্যেক আর্য রাষ্ট্রেই কোনও একটা জায়গায় নিষাদদের পৃথক আবাসস্থল ছিল। তবে বেশিরভাগ প্রাচীন গ্রন্থের প্রমাণ একত্রিত করলে দেখা যাবে যে, সাধারণভাবে নিষাদরা থাকতেন বিন্ধ্যপর্বতের আশপাশের পার্বত্য উপত্যকায় এবং বনাঞ্চলে। মহাভারতের সভাপর্ব অনুযায়ী ভারতবর্ষের মধ্যদেশ এবং মালব অঞ্চলে আবার বনপর্ব অনুযায়ী সরস্বতী নদীর তীরভূমি এবং পশ্চিম ভারতেও নিষাদদের আবাস দেখা যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত মত হল এই যে, নিষাদরা ভারতবর্ষের মধ্যদেশে অথবা আরও একটু দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে থাকতেন। বাজসনেয়ী সংহিতার টীকাকার মহীধর যা ইঙ্গিত করেছেন, তাতে নিষাদদের ভিল-উপজাতির মানুষ বলে মনে করেছেন পণ্ডিতরা এবং তারাও ভারতের মধ্যদেশ এবং বিন্ধ্যপর্বতের বলয়ে থাকা মানুষ।

পুরোপুরি না হলেও মহাভারতের সময়কালে নিষাদদের মর্যাদার অবনতি ঘটেছে। অরণ্য এবং পার্বত্যভূমিতে প্রতিষ্ঠিত এই মানুষগুলিকে তখন এমন চোখে দেখা হচ্ছে যেন, তাঁরা মানুষখেকো জানোয়ার–নিষাদান্ পুরুষাদাংশ্চ। অথচ ব্রাহ্মণ্যের চরম হুংকার যে গ্রন্থে শোনা যায় সেই মনু পর্যন্ত লিখেছেন যে, নিষাদরা মাছ ধরে এবং বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। মহাভারতের পরিশিষ্ট হিসেবে পরিচিত হরিবংশে আবার দেখছি যে, নিষাদরা নদী থেকে মণি-রত্ন সংগ্রহ করে বিক্রি করত এবং তারই মূল্যে জীবন ধারণ করত। হরিবংশ-মনুতে এক রকম আর প্রাচীনতর সংহিতাগুলিতে আরেক রকম, হঠাৎ করে মাঝখানে এই মহাভারতের সময়ে নিষাদদের মর্যাদা এমন ভ্রষ্ট হল কেন, সেকথা ভাল করে বোঝা যায় না।

 যদি বা এমন হয় যে, মাছ-ধরা বা রত্ন সংগ্রহের দ্বারাই তাদের জীবিকা নির্বাহ হত এবং সত্যিই তারা এতটা অপোগতি প্রাপ্ত হননি যতটা ওই নরমাংসভোজিতার অতিশয়োক্তিতে আছে, তবু বলতে হবে তখনকার সামাজিক দৃষ্টিতে নিষাদদের সঙ্গে রাজপুত্রদের একসঙ্গে ওঠা-বসা এবং চলা-ফেরা করাটা দ্রোণাচার্য ঠিক মনে করেননি। অর্থাৎ সামাজিকতার দিক থেকে পারস্পরিক ভেদ এবং সংশয় মহাভারতের আমলে এতটাই তৈরি হয়ে গেছে যে, ক্ষত্রিয় রাজপুত্র এবং নিষাদ রাজপুত্র একই গুরুর কাছে শিক্ষা লাভ করতে চাইলে, ক্ষত্রিয় শিষ্যদের বিরক্তি হবে ভেবে স্বয়ং গুরু এই অবর জাতির নিরীহ কিশোরটিকে প্রত্যাখ্যান করলেন–ন স তং প্রতিজগ্রাহ নৈষাদিরিতি চিন্তয়। নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য গুরু দ্রোণাচার্যের এই প্রত্যাখ্যান শান্ত মনে মেনে নিয়েছেন। কারণ প্রত্যাখ্যাত হতে হতে অবর-জনের মধ্যেও এক বিপন্ন মনস্তত্ব ক্রিয়া করতে থাকে। তারা আগে থেকেই মনকে তৈরি করে রাখে যে, প্রত্যাখ্যাত হতে পারি। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একলব্য কোনও মন্তব্য করেননি। তিনি পরম শ্রদ্ধায় দ্রোণাচার্যের চরণ দুটি আপন মস্তকে ধারণ করে অরণ্যের দিকে পা বাড়িয়েছেন–স তু দ্রোণস্য শিরসা পাদৌ গৃহ্য পরন্তপ।

দ্রোণের কাছে একলব্যের এই যে প্রত্যাখ্যান সূচনা হল, সঙ্গে সঙ্গে কিছু অল্পত ব্যক্তি চেঁচিয়ে উঠবেন–দেখলেন তো ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কীরকম দাপট? সমাজের মাথায় দাঁড়িয়ে হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির প্রসাদ পেয়ে একটি ব্রাহ্মণ শুরু কীভাবে বড়লোক রাজা এবং রাজপুত্রের স্বার্থে একটি নিষাদকে প্রত্যাখ্যান করলেন। এরাই হচ্ছে সমাজের ভেস্টেড গ্রুপ। স্বার্থসিদ্ধির জন্যই এঁরা এইভাবে কতগুলি সাধারণ মানুষকে হীন করে রাখেন আর কতগুলি মানুষের স্বার্থরক্ষা করেন। আমাদের নিবেদন–ব্যাপারটা এইভাবে দেখলে মহাভারতকেই নেগেটিভলি দেখা হয়। আর যদি পজিটিভলি দেখেন, তাহলে বুঝবেন–আপনারা আজকে যে কথা সাড়ম্বরে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে বলতে পারছেন, স্বয়ং মহাভারতের কবিই তা সাড়ম্বরে বলে গেছেন এবং তিনি যা সোচ্চারে বলে গেছেন আপনারা তার পুনরাবৃত্তি করছেন মাত্র।

মনে রাখা দরকার, মহাভারতের কবি নিজে ব্রাহ্মণের ঔরস-পুত্র হলেও এক দাসরাজ বা নিষাদরাজের মেয়ে তার জননী। অতএব আজকে একলব্যের প্রত্যাখ্যানে যে ব্যথা তিনি পেলেন, তা এক কবিজনোচিত সহমর্মিতায় ব্যক্ত হয়েছে তাঁর লেখনীতে। প্রথম কথা হল–দ্রোণ যে একলব্যকে প্রত্যাখ্যান করলেন, তার কারণ মহাভারতের কবি পরিষ্কার জানিয়েছেন–রাজপুত্রদের স্বার্থ–তেষামেব অন্ববেক্ষয়া–রাজপুত্রদের সম্মানের কথা মাথায় রেখেই দ্রোণ এই প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেন করেছেন? কারণটা জলের মতো পরিষ্কার। দ্রোণ প্রথম জীবনে বহুল পরিমাণ অন্নকষ্ট পেয়েছেন। এখন তিনি কৌরব-রাজপুরীতে রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষকের মর্যাদা পেয়েছেন। তার জন্য তিনি মহামতি ভীষ্মের কাছে বৃত্তি পান। তার জন্য তিনি থাকবার জায়গা পেয়েছেন, অন্ন–পানীয়রও অভাব নেই কোনও। অতএব এই নিষাদপুত্রকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলে আজ যদি কুরুবৃদ্ধদের সামনে তাকে জবাবদিহি করতে হয়, তবে তার নিজের বিপদ বাড়বে বই কমবে না। অতএব এই নিষাদপুত্রের মূল্যে তিনি রাজপুত্রদের স্বার্থ দেখেছেন, সঙ্গে পরোক্ষভাবে নিজের স্বার্থও।

মহাভারতের কবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন যে তুমি ব্রাহ্মণ আর তুমি গুরু বলে তুমি যাকে কৃপা করবে, সেই শিখবে, আর যার দিক থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে, সে আর কিছুই শিখবে না–এমন ভাবা ব্রাহ্মণত্বের আহাম্মকি ছাড়া কিছুই নয়। যার ভিতরে মহাবস্তু আছে, আন্তর তেজ আছে, তা আপনার আনন্দে আপনিই প্রকাশিত হয়। স্বয়ং অর্জুনকে দিয়েই সে পরীক্ষা আগে হয়ে গেছে, এবার এক নিষাদপুত্র অর্থাৎ তথাকথিত ঘৃণিত এক অধমজাতির নিকৃষ্ট জাতকের মধ্যেও যে সেই সৃষ্টির আগুন থাকতে পারে, সে যে কোনও ব্রাহ্মণ-গুরু ছাড়াও আপনিই নিজের আন্তর গুণ জাগিয়ে তুলতে পারে তার জন্যই মহাভারতের কবির লেখনী এখন প্রসারিত।

হিরণ্যধনুর পুত্র নিষাদ একলব্য দ্রোণগুরুকে নিজের বিনতি-প্রণতি জানিয়ে অরণ্যের মধ্যে ফিরে গেল। সেইখানেই তার সাময়িক আবাস গড়ে উঠল। নিষাদদের মধ্যে শিল্পকলার চল ছিল ভালই। অতএব নিষাদ একলব্য প্রথমে মাটি দিয়ে দ্রোণাচার্যের একটি প্রতিকৃতি তৈরি করল। দ্রোণাচার্য তাকে শিষ্য বলে স্বীকার না করলে কী হবে, দুনিয়ার রাজপুত্রেরা যাঁর কাছে ধনুর্বিদ্যা শিখতে আসছে, সেই পরম গুরুটিকে সে যে এতকাল অন্তর থেকে গুরু বলে মেনে এসেছে। আজ তিনি মৌখিক প্রত্যাখ্যান করলেই তো আর অন্তরের গুরু অন্তর থেকে বেরিয়ে যাবেন না। অতএব দ্রোণাচার্যকেই আপন আচার্য বলে মেনে সে তার পরিশ্রম, অভ্যাস এবং চর্চার মাধ্যমে আপন অন্তরস্থিত ক্ষমতার অভিব্যক্তি ঘটাতে লাগল–

তস্মিন্ আচার্যবৃত্তিঞ্চ পরমামাস্থিতস্তদা।
ইম্বস্ত্রে যোগমাতস্থে পরং নিয়মমাস্থিতঃ।

.

১০২.

 দিনের পর দিন অস্ত্রাভ্যাস করতে করতে ক্লান্তি আসে, একঘেয়েমিও আসে। যে কোনও শিল্প-কলার ক্ষেত্রে শিক্ষারম্ভ এবং শিক্ষান্তিম প্রয়োগ যথেষ্ট উত্তেজনাময়। কিন্তু মাঝখানের যে সময়টুকু, যখন অভ্যাসের নৈরন্তর্যে শিক্ষিত বিদ্যাকে শাণিত করতে হয়, সেই সময় ধৈর্য দেখাতে দেখাতে অতি উত্তম শিক্ষার্থীও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পাণ্ডব-কৌরবদেরও এই ক্লান্তি এসেছিল। শেষে তারা একদিন দৈনন্দিন অস্ত্রাভ্যাসের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাবার জন্য গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে অনুমতি চাইল মৃগয়ায় যাবার জন্য।

দ্রোণাচার্য শিষ্যদের পরিশ্রম বোঝেন। অতএব তিনিও অনুমতি দিলেন। তাছাড়া মৃগয়ার মধ্যে তাঁর শিষ্যদের অস্ত্রাভ্যাসের একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে বলে দ্রোণাচার্য তাদের এক কথায় মৃগয়ার অনুমতি দিলেন। রাজকুমাররা রথে করে মৃগয়ায় বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গের আজ্ঞাবহ কর্মর্করটি শিকার ধরার জাল, দড়ি এবং শিকারের অন্যান্য উপকরণ নিয়ে রাজপুত্রদের সঙ্গে চলল। তাদের সঙ্গে একটি শিকার ধরার কুকুরও চলল–রাজনুনুজগামৈকঃ শ্বানমাদায় পাণ্ডবান।

শিকারী কুকুর নিয়ে মৃগয়ায় যাবার চল সে যুগে যথেষ্টই ছিল। আমরা, মহাকবি বাণভট্টের লেখায় এই শিকারী কুকুরদের স্বাস্থ এবং শক্তির কথা বেশ ভালভাবেই পেয়েছি। প্রশিক্ষণ পাওয়া এই কুকুরগুলির প্রধান কাজ ছিল শিকারের খোঁজ দেওয়া এবং শিকার আহত হয়ে তীব্র বেগে পালাতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া।

পাণ্ডব-কৌরব কুমারেরা বনের মধ্যে শিকার–যোগ্য পশুপক্ষী খোঁজা আরম্ভ করলেন। শিকারী কুকুরটিও তার নিজের কাজে লেগে গেল। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে করতে এক সময় সবার অলক্ষে কুকুরটি নিষাদ-পুত্র একলব্যের কাছাকাছি অঞ্চলে পৌঁছল–শ্বা চরন বনে গঢ়ো নৈষাদিং প্রতি জগ্নিবান। কুকুরটির এতকালের অভ্যাস ছিল শিকার দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে চেঁচিয়ে ওঠা। আজ একব্যকে দেখেও কুকুরটি তাই করল। এর কারণ হল–শিকার দেখে চেঁচিয়ে ওঠাটা যেমন কুকুরের অভ্যাস, তেমনই অদ্ভুত কোনও জিনিস বা চেহারা দেখলেও কুকুর স্বভাববশত চেঁচায়। এখানে একলব্যকে দেখে রাজকুমারদের কুকুর চেঁচিয়ে উঠল। একলব্যের ওই পাগলের মতো চেহারা, ধূলিধূসর দেহ, কালো গায়ের রঙ, তার মধ্যে কৃষ্ণাজিন পরিধানে। সব কিছু মিলে একলব্যকে অস্বাভাবিক এক ব্যক্তি বলে মনে করল কুকুরটি এবং ভয়ে চেঁচাতে লাগল–নৈষাদিং শ্বঃ সমালক্ষ্য ভয়ং তস্থৌ তদন্তিকে।

কুকুরটিকে চেঁচাতে দেখে একলব্য বিরক্ত হলেন এবং তার আকস্মিক চিৎকার বন্ধ করার জন্য একলব্য অন্তত সাত-সাতটি তীর ছুঁড়লেন কুকুরটির মুখে–শুনঃ সপ্ত শরা মুখে–এবং সেই তীর ছোঁড়ার মধ্যে এতটাই শীঘ্রতা ছিল, যাতে মনে হল যেন সাতটি শরই একবারে এসে কুকুরটির মুখে লাগল। কুকুরের চিৎকার এক লহমায় স্তব্ধ হল এবং বাণহত শরীর নিয়ে পোষা শিকারী কুকুর দৌড়ে এল পাণ্ডবদের কাছে–স তু শ্বঃ শরপূর্ণাস্যঃ পাণ্ডবানাজগাম হ।

কুকুরটির ওই অবস্থা দেখে পাণ্ডবরা একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। শুধু তাড়াতাড়ি তীর ছোঁড়াই নয়, একলব্য কুকুরের চিৎকার শুনেই বাণ-মোক্ষণ করেছিলেন। কুকুরটিকে তিনি চোখে দেখেননি। অর্থাৎ লক্ষ্যলব্ধতা এবং শব্দভেদ–এই দুটি বিদ্যাতেই একলব্য এতটাই পারদর্শী যে, পাণ্ডবরা শুধু অবাকই হলেন না, তারা লজ্জাও পেলেন এবং সেই অজ্ঞাতনামা ধনুর্ধরের প্রশংসাও করতে লাগলেন–প্রেক্ষ্য তং ব্রীড়িতাশ্চাস প্রশশংসুশ্চ সর্বশঃ। পাণ্ডবদের এবার মনে হল–মানুষটিকে একবার দেখা দরকার। তারা সকলে মিলে বনের ভিতর খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করলেন। অনেকক্ষণ পর এক জায়গায় শরক্ষেপের শন্ শন্ শব্দ ভেসে এল। পাণ্ডবদের কানে। অবাক হয়ে তারা দেখলেন–মানুষটির শরক্ষেপের কোনও বিরাম নেই। ক্লান্তিহীন অভ্যাসে একের পর এক শরক্ষেপ করে এই কুমার–পুরুষটি তার বিদ্যা শাণিত করে যাচ্ছেন–দদৃশুঃ পাণ্ডবা রাজন্ অস্যন্তমনিশং শরা।

পাণ্ডবরা দেখলেন–তাদেরই বয়সী একটি ছেলে, যদিও তার চেহারা রাজপুত্রের মতো মোটই নয়, বরঞ্চ বলা যায় চেহারাটা একটু বিকৃতই বটে–তদা বিকৃতদর্শন। পাণ্ডবরা জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কে, আপনার পিতৃ–পরিচয়ই বা কী? অস্ত্রধারী উত্তর দিলেন–আমি নিষাদ রাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য। আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়–আমি দ্রোণাচার্যের শিষ্য এবং আমি ধনুর্বিদ্যায় অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছি–দ্রোণশিষ্যঞ্চ মাং বিদ্ধি ধনুর্বেদকৃতশ্রম।

 জীবনে এই ছেলেটিকে দ্রোণাচার্যের আশপাশেও দেখেননি পাণ্ডবরা। আর সে বলে কিনা–আমি দ্রোণাচার্যের শিষ্য! পাণ্ডবরা ভাল করে একলব্যের খবর নিলেন এবং তার জীবনের সব কিছু খবরও জানার চেষ্টা করলেন সাধ্য মতো। তারপর দ্রোণাচার্যের কাছে এসে পাণ্ডবরা সমস্ত ঘটনা নিবেদন করলেন–যথাবৃত্তং বনে সর্বং দ্ৰোণায়াচষ্যরদ্ভুতম্।

নির্জন বনের মধ্যে দ্রোণাচার্যের মূর্তি স্থাপন করে একলব্য যে সাধনা করে যাচ্ছিলেন, তাতে সবচেয়ে বিব্রত হয়েছিলেন অর্জুন। অস্ত্র ক্ষেপণের শীঘ্রতা, শব্দ শ্রবণমাত্র লক্ষ্যভেদ ধনুর্বিদ্যার এইসব কৌশল বিপুল পরিশ্রমে শিখতে হয় এবং একলব্য তা অর্জুনের চেয়েও ভাল শিখেছেন। অন্তত অর্জুন সেটা ভাল করেই বুঝেছেন। নীতি শাস্ত্রের কথায় বলে–একজন বিদ্বান ব্যক্তিই শুধু অপর বিদ্বানের পরিশ্রম এবং যত্ন বুঝতে পারেন। একজন বন্ধ্যা রমণীর পক্ষে তো আর পুত্র–প্রসবিনী জননীর কষ্ট বোঝা সম্ভব নয়। অর্জুন নিজের অভিজ্ঞতাতেই জানেন যে, একলব্য ধনুর্বিদ্যার এমন একটি পর্যায় অধিগত করেছেন, যা হয়তো তার নিজের পক্ষেও সম্ভব নয়। মনে মনে অর্জুনের বড় কষ্ট হল। জীবনে এত কষ্ট করে, এত পরিশ্রম করে তিনি অস্ত্রবিদ্যার দুরূহ সাধনা চালিয়ে গেছেন। অথচ সেই সাধনা তাকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিল না, যাতে অর্জুনের নাম করলে অস্ত্রবিদ্যার ক্ষেত্রে আর দ্বিতীয় কোনও সংখ্যায় করাঙ্গুলি প্রসারিত হবে না।

অর্জুন সামান্য অভিমানে আহত হয়েও রইলেন। একদিন নিজেকে রুদ্ধ করতে না পেরে দ্রোণাচার্যের কাছে উপস্থিত হলেন। এখন দ্রোণের আশপাশে কেউ নেই। অর্জুন মনের কথা বলবেন পিতৃ-প্রতিম গুরুর কাছে। রাগ করে বলবেন না, সপ্রণয়ে বলবেন, সাভিমানে বলবেন–রহো দ্রোণং সমাসাদ্য প্রণয়দাদিদমব্রবীৎ। অর্জুন বললেন–গুরুদেব! আপনিই একদিন আমাকে সানন্দে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন–আমার শিষ্যদের মধ্যে তোমার থেকে ভাল কেউ থাকবে না–ভবতোক্তো ন মে শিষ্যবিশিষ্টো ভবিষ্যতি। কিন্তু আজকে দেখছি–শুধু আমি কেন, অন্য অনেক ধনুর্ধর বীরদের চেয়েও আপনার শিষ্য একলব্য ধনুর্বিদ্যায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে–অথ কস্মাবিশিষ্টো লোকাদপি চ বীর্যবান্। কেমন করে হল এই ঘটনা। আমার চেষ্টা এবং বিনয়ের তো অভাব ছিল না।

দ্রোণ বিব্রত হলেন। সত্যিই তো, তিনি অর্জুনকে কথা দিয়েছিলেন এবং এটাও ঠিক যে, হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্যকে তিনি তার পাঠশালায় স্থান দেননি। তাহলে কেমন করে এই ঘটনা ঘটল। অর্জুনের প্রতি দ্রোণাচার্যের পক্ষপাত সুবিদিত, তবু কেমন করে এই ঘটনা ঘটল? দ্রোণাচার্য অর্জুনকে বললেন–ঠিক আছে। চলো আমার সঙ্গে। একা অর্জুনকে নিয়ে দ্রোণাচার্য সেই নির্জন বনে উপস্থিত হলেন। সেখানে এসে দেখলেন–সেই ধূলিধূসরিত দেহ, কৃষ্ণাজিন পরিহিত বালকটি এক মনে শরমোক্ষণ করে যাচ্ছেন লক্ষ্যের দিকে–একলব্যং ধনুপাণি অস্যন্ত অনিশং শরা। দ্রোণ একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেলেন, তার শিক্ষা ছাড়াই শুধু নিজের অধ্যবসায়ে এই ছেলেটি কতদূর এগিয়েছেন। নিজের একটু লজ্জাও হল, অহংকারেও আঘাত লাগল একটু।

একলব্য শরক্ষেপণ করতে করতে এক সময় দ্রোণাচার্যকে দেখতে পেলেন। দেখা মাত্রই ধনুঃশর নামিয়ে রেখে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে গুরুর চরণ স্পর্শ করলেন একলব্য–জগাম শিরসা মহীম্। তারপর পাদ্য–অর্ঘ্য দিয়ে যথাবিধি দ্রোণ–গুরুর পূজা সমাপন করে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন একলব্য। বললেন–আমি আপনার শিষ্য। আদেশ করুন গুরুদেব। গুরুদেবের। মনে তখন অর্জুনের প্রতি পক্ষপাত কাজ করছে। অতএব আত্মলব্ধ আত্মশিক্ষিত এই বিদ্যাকে তিনি যে কোনও অজুহাতে দমিয়ে দিতে চাইলেন অদ্ভুত এক আচরণে। দ্রোণ বললেন–তুমি যখন নিজেকে আমার শিষ্য বলে ভাবছ, তাহলে তো আমাকে গুরু হিসেবে একটা বেতন দেওয়া উচিত–যদি শিষ্যোসি মে বীর বেতনং দীয়ং মম।

দ্রোণাচার্য শিষ্যের জন্য কিছুই করেননি। ধনুর্বিদ্যার একটি পাঠও তিনি একলব্যকে শেখাননি। অথচ একলব্য শুধু তাকে মনে মনে গুরু বলে মেনেছেন বলেই আজকে বেতন চাইছেন। এই বিপরীত ব্যবহারের অর্থ একলব্য খুব ভাল বুঝতে পারলেন না; উলটে তিনি বরং খুশি হলেন এই কথা ভেবে যে, তার অধ্যবসায় এবং পরিশ্রমে গুরুদেব খুশি হয়ে তাকে শিষ্য বলে বুঝি স্বীকার করে নিচ্ছেন আজকে। দেরিতে হলেও, না হওয়ার চেয়ে এই শিষ্যত্বের সংজ্ঞাও তার ভাল লাগবে। এটা তো সত্যি কথাই যে, মহান গুরুর শিষ্য–সংজ্ঞার মধ্যেও গৌরব আছে, ঠিক যেমন মহান শিষ্যের গুরু–সংজ্ঞার মধ্যেও আছে ওই একই গৌরব।

আজকে দ্রোণাচার্যের শিষ্য–গৌরব লাভ করে একলব্য রীতিমতো খুশি হয়ে বললেন–আজ্ঞা করুন গুরুদেব, কী-ই বা আমি দিতে পারি আপনাকে–কিং প্রযচ্ছামি ভগবন্ আজ্ঞাপয়তু মাং গুরুঃ। এই পার্থিব জগতে এমন কিছুই নেই, যা আপনাকে অদেয় হতে পারে আমার। আপনি আজ্ঞা করুন। শিষ্যের প্রতিজ্ঞাবাক্য শোনার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রোণাচার্য বললেন তবে তোমার ওই দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটিই আমার চাই–তমব্রবীৎ ত্বয়াঙ্গুষ্ঠো দক্ষিণে দীয়তামিতি।

দ্রোণের আদেশটি ছিল আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হতে চলেছে, তার কাছে শর-মোক্ষণের প্রধান সাধন বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি যে কতটা প্রয়োজন, ধনুর্বিদ মাত্রই তা জানবেন। বিশেষত শরমোক্ষণের শীঘ্রতা, যা একলব্যের শিক্ষার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেই শীঘ্রতা সম্পন্ন হয় দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সুচারু প্রয়োগেই। আর সেই অঙ্গুলীটিই দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে চাইছেন।

এই চাওয়ার মধ্যে যে ইচ্ছাকৃত অন্যায় আছে একলব্য তা জানেন। কিন্তু জানা সত্ত্বেও নিজের প্রতিজ্ঞা এবং সত্যরক্ষা থেকে মুহূর্তের জন্যও তিনি বিচলিত হলেন না– প্রতিজ্ঞামাত্মননা রক্ষন্ সত্যে চ নিয়তঃ সদা। সেই হাসিমুখটি তাঁর অবিচল রইল, মনের মধ্যে দেখা দিল না এতটুকু পঙ্কিল ভাব। গুরু বলেছেন, অতএব এতটুকুও ন্যায়–অন্যায় বিচার না করে একলব্য তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি কেটে দ্রোণের হাতে দিয়ে দিলেন ছিত্ত্বাবিচাৰ্য্য তং প্রাদা দ্রোণায়াঙ্গুষ্ঠমাত্মনঃ।

এই ঘটনার মাধ্যমে কী প্রমাণ হল? এই নিদারুণ ঘটনার সাক্ষী দিয়ে মহাভারতের কবি কী বোঝাতে চাইলেন? প্রথমেই জানাই–সভ্যতা এবং সময় পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন ঘটে গেলেও মানুষের মূল চরিত্র পালটায় না। বিশ্বাস করুন–আজকের দিনেও এইরকম ঘটনা যে কত দেখেছি! এইরকম কত ঘটনার শিকার যে আমরাই। বুদ্ধি আছে, বৈষয়িক শ্রেষ্ঠতা আছে অথচ একলব্যের মতো গুরুর সঙ্গে সেঁটে থাকল না বলে জায়গা মতো তার নির্বাচন হল না, অথবা জায়গা মতো তাকে হেনস্তা করে তার রূপক বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি কেটে নিয়ে অন্য জনকে বহাল করা হল–এরকম ঘটনা আমরা হামেশাই দেখছি। আজকের দিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তথাকথিত আচার্যদের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে–এঁরা কত মেধাবী ছাত্রের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কর্তন করেন। এই বাম আমলে যে কোনও মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহোদয়দের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে–কত উপযুক্ত ব্যক্তিকে পিছনে ফেলে এঁরা দলীয় নেতার সরসতায় সকলের মাথার ওপর এসে বসেছেন।

অতএব এ সব হয়। এ সব হত। অর্জুনের ক্ষেত্রে বরং কম হয়েছে। কারণ তিনিও কম মেধাবী নন। অতি-মেধাবী বলেই তার প্রতি পূর্বাহ্নেই দ্রোণাচার্যের পক্ষপাত ঘটে গেছে। এই পক্ষপাতের সরসতা থেকে দ্রোণ নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। এই সম্পূর্ণ ঘটনার মধ্যে যাঁরা দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিষাদ একলব্যের প্রত্যাখ্যানের ঘটনাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে জাত-পাতের কথা তোলেন, তাদের জানাই–জাত-পাতের ঘটনা এখানে তেমন করে দাগ কাটে না। মহাভারতের কবি নিজে একলব্যের প্রতি পক্ষপাতগ্রস্ত। একটি একটি করে করুণ শ্লোক লিখে একলব্যের প্রতি করুণা-কাতর কবি দেখিয়েছেন–কীভাবে পক্ষপাতগ্রস্ত গুরুর প্রণয়ে শ্রেষ্ঠতম ছাত্রটির ডানা হেঁটে দেওয়া হয় এবং তার চাইতে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীকে শ্রেষ্ঠতম করে রাখা হয়।

নৈষাদি একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কর্তিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাণ-মোক্ষণে আর সেই শক্তি, সেই তীব্রতা এবং সেই শীঘ্রতা থাকল না, যা তার আগে ছিল। অর্জুন খুব খুশি হলেন। এই মানুষটিকে আমরা অতটা দোষ দিই না, যতটা দিই আচার্য দ্রোণকে। দ্রোণ অর্জুনকে বলতেই পারতেন যে, আমি তো বাছা! একে অস্ত্রশিক্ষা দিইনি। তবু যদি সে এই বিদ্যা শিখে থাকে, তবে সে দোষ আমার নয় এবং শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তোমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু দ্রোণ এ কথা বলেননি। বললে অর্জুন হয়তো মানতেন। কারণ তিনি অর্জুন। অবশ্য দ্রোণাচার্য শুধু অর্জুনের জন্যই একলব্যকে এই শাস্তি দিয়েছেন কিনা, তাতে আমাদের সামান্য একটু সন্দেহ আছে। অর্জুনের প্রতি পক্ষপাত তো তাঁর ছিলই, কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর অহংকারে কি একটুও লাগেনি? তার কি একবারও মনে হয়নি–যাকে আমি শিষ্য বলেই স্বীকার করলাম না, সে আমার সাহায্য ছাড়াই এমন এক ধনুধরে পরিণত হল যে আমার হাতে গড়া শ্রেষ্ঠতম অর্জুনের চেয়েও বেশি? আমাদের মনে হয়–অর্জুনের প্রতি পক্ষপাতের সঙ্গে সঙ্গে তার এই সাহংকৃত মনস্তত্ত্বও কাজ করে থাকবে। অতি বড় গুরু হলেও তাঁর উদারতার অভাব থাকতেই পারে এবং তার ইগোতেও লাগতে পারে। এমন ব্যাপার এখনও আছে, আগেও ছিল–মনুষ্য চরিত্রের এই চিরন্তন বৈশিষ্ট্যটি দেখানোর জন্যই মহাভারতের কবিকে একলব্যের কাহিনী লিখতে হয়েছে। অর্জুনের প্রতি পক্ষপাত দেখানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জানাতে চেয়েছেন, ব্রাহ্মণ নয়, রাজপুত্র নয়, এমন অন্ত্যজ গোষ্ঠীর মধ্যেও সেই মেধা লুক্কায়িত থাকতে পারে যে মেধা তথাকথিত উচ্চবর্ণকে পীড়ন করে, লজ্জিত করে। কিন্তু বর্ণ-বিচারের চেয়েও এখানে বড় হয়ে উঠেছে পক্ষপাত, যে পক্ষপাত মহান গুরুদেবকে চিরকাল কলঙ্কিত করেছে এবং এখনও তা করে, হয়তো এটাকেই বলা যায় পেনাল্টি অফ গ্রেটনে।

একজন প্রোফেশনাল ব্যক্তির মতোই খুশি হলেন অর্জুন। তিনি শ্রেষ্ঠ থাকতে চান, অতএব একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ–ছেদনে অর্জুন খুশি হলেন–ততোজুনঃ প্রীতমনা বভূব বিগতজ্বরঃ। দ্রোণাচার্য অর্জুনকে কথা দিয়েছিলেন–আমি তোমাকেই সবচেয়ে বড় ধনুর্ধর বানাব, অতএব এমন সাংঘাতিক একটি অন্যায় করেও তিনি তার বাক্যে স্থিত রইলেন–দ্রোণস্য তস্য বাগাসীন্নানন্যা ভিভবিতাড়ুন। নির্জন বনের প্রান্তে সেই ছেলেটি আবারও নতুন উদ্যমে তার শরমোণ শুরু করল। সে ভাবল–বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ছাড়াই সেতার পূর্ব পারদর্শিতা লাভ করবে। সেই শন্ শন্ আওয়াজ উঠল বনের মধ্যে। কিন্তু অনেক অনেক ব্যবধান এসে গেছে। যে শীঘ্রতায় পূর্বে তার শরমোণ ঘটছিল, সেই শীঘ্রতা আর যে সম্ভব নয়, সে কথা একলব্যও বুঝলেন, দ্রোণও বুঝলেন, অর্জুনও বুঝলেন–ন তথা চ স শীঘ্ৰো ভূৎ যথা পূর্বং নরাধিপ।

 একলব্য জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত পেলেন, দ্রোণাচার্য নিজের সত্যরক্ষা করে বিব্রত হলেন আর অর্জুন খুশি হলেন উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর শূন্যতায়। আর মহাভারতের কবি এই করুণ উপাখ্যান বর্ণনা করে বোঝালেন–জগতে মেধাই সব নয়, তার চেয়েও বড় জিনিস হল–নেতা ব্যক্তিকে সেইভাবে ভিজিয়ে রাখতে পারলে তিনিই তার ভক্তের অভিলাষ পূর্ণ করেন। হরিদাস সিদ্ধান্ত বাগীশকে এখানে মন্তব্য করতে হয়েছে–হ্যায়! অর্জুন যে এইভাবে বড় হতে চেয়ে খুশি হলেন, এ তার লজ্জা, আর একজন গুরু হয়েও দ্রোণাচার্য যে এই ব্যবহার করলেন–এটা চিরন্তন গুরুকুলের অত্যাচার–হস্ত! অর্জুনস্যেদং মহদেব কার্পণ্য, গুরোরপি গরীয়ানেবাত্যাচারঃ।

মহাভারতের কোনও কোনও সংস্করণের একটি অতিরিক্ত শ্লোকে দেখা যায়–দ্রোণাচার্য একলব্যকে অঙ্গুষ্ঠ কর্তন করতে বলেননি। তিনি যখন একলব্যকে তিনি যা চান তাই দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেখলেন, তখন নাকি তিনি একলব্যকে বলেছিলেন–ওইরকম বুড়ো আঙুল দিয়ে নয়, তুমি শর আকর্ষণ করবে তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে। দ্রোণাচার্য নাকি নিজে ওইভাবে শরাকর্ষণ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, কীভাবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ছাড়াই তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে শরমোক্ষণ করতে হবে এবং দ্রোণাচার্যের চাওয়া গুরুদক্ষিণা ছিল এইটাই–তর্জনী-মধ্যমাভ্যাং শরং ধৃত্বা জ্যাকর্ষণং কর্তব্যমিতি অভিনীয় দৰ্শয়তি।

মহামতি নীলকণ্ঠ এই অতিরিক্ত শ্লোকটি আপন টীকার মধ্যে উদ্ধার করেছেন। তবে আমাদের মনে হয়–মহাভারতের মধ্যে স্থূলহস্তাবলেপী কোনও কবি দ্রোণাচার্যকে খানিকটা বাঁচানোর জন্য এই শ্লোক রচনা করেছেন। বস্তুত, দ্রোণাচার্য একলব্যের প্রতি যে ব্যবহার করেছেন এবং তাতে যে কলঙ্ক-রচিত হয়েছে, সেই কলঙ্ক-পঙ্ক দিয়ে দ্রোণাচার্যের কপালে তিলক-রচনার চেষ্টা হয়েছে এই শ্লোকে। সত্যিই এতে দ্রোণাচার্যের মহত্ত্ব কিছু বাড়ে না।

যাই হোক, নির্জন বনে এক নিরীহ ছাত্রের ওপর দ্রোণাচার্যের ওই অন্যায়–আচরণের জায়গা থেকে আমরা আবার হস্তিনাপুরের শিক্ষাশ্রমে ফিরে আসি। এতদিন অস্ত্রশিক্ষা যা হল, তাতে সকলকে একরকম শিক্ষা দিলেও কৌরব-পাণ্ডবদের মধ্যে একেক জন একেক শিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করলেন। ভীম কিংবা দুর্যোধনকে দিয়ে ধনুর্বেদ শিক্ষা হল না। এঁরা দুজনেই বিচক্ষণ হয়ে উঠলেন গদাযুদ্ধে। এই দুজনের পারস্পরিক হিংসাতেই দুজনের শিক্ষাটা আরও বেশি ভাল হল। নকুল এবং সহদেব তরবারি চালনা শিখলেন ভাল, গদাযুদ্ধ বা ধনুশ্চালনায় তাঁরা সুবিধে করতে পারলেন না। অর্জুন যেমন হাতি-ঘোড়া-রথ যে বাহনই হোক, তাতে চড়েই যুদ্ধে পারদর্শিতা অর্জন করলেন, অন্য কেউ তেমন হলেন না। পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির তো রথ ছাড়া অন্য কোনও বাহনে যুদ্ধই করতে পারতেন না।

যাই হোক, একটি নির্দিষ্ট সময়ের শেষে প্রত্যেক ব্যক্তিগত ছাত্রের নিজস্ব প্রতিভা যেমন বোঝা যায়, এখানে দ্রোণাচার্যের আশ্রমে অস্ত্র-প্রশিক্ষণের শেষ কল্পে কে কোন ধরনের অস্ত্র ভাল চালাতে পারছেন, কে কোন বাহনে অভ্যস্ত হয়েছেন, কে কতটা কুশল হয়েছেন অস্ত্রচালনায়, তার একটা হিসেব কষার দরকার হয়ে পড়ল এবার। দ্রোণাচার্য হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির বৃত্তি ভোগ করেন। অতএব কোন রাজকুমার কতটুকু অস্ত্রচালনা শিখেছেন, সেটা রাজবাড়ির সবার সামনে প্রদর্শন করার তগে দ্রোণাচার্য নিজে তার ছাত্রদের বিশেষভাবে একটু পরীক্ষা করে নিতে চাইলেন।

.

১০৩.

 যাঁরা চিত্রকলা শিক্ষা করেন, কোনও বিশিষ্ট শিল্প, অথবা সঙ্গীত শিক্ষা করেন, এমন অনেক মানুষকেই আমরা গুরুর তত্ত্বাবধান ছাড়াই অনেক দূর যেতে দেখেছি। জন্মগত প্রতিভা এমনই এক বস্তু যে সে কারও শিক্ষা-সদুপদেশের বালাই না রেখে নিজেই নিজের পথ করে নেয়। চিত্র, সঙ্গীত অথবা অস্ত্রচালনার মতো এক অসাধারণ শিল্পকেই ধরা যাক, নির্দিষ্ট প্রতিভা নিয়ে যে জন্মেছে, সে এইসব বিষয়ের যে কোনও একটির সংস্পর্শে আসা মাত্রেই কৌতূহলী হয়ে ওঠে। তারপর চলতে থাকে তার সাধনা, ইচ্ছাপূরণ অথবা স্বেচ্ছাচার। প্রতিভাবান ব্যক্তি এর যে কোনও একটাই অঙ্গীকার করতে পারেন, কেননা তিনি তো বিষয়কে ধরেন না, বিষয় তাকে অবলম্বন করে নিজে পরিস্ফুট হয়। রবীন্দ্রনাথকে কবিতা লেখা শিখিয়ে দিতে হয়নি, রাফায়েল-পিকাসোকেও আঁকা শেখাতে হয়নি, নেপোলিয়নকেও শেখাতে হয়নি যুদ্ধবিদ্যার কৌশল।

অতএব প্রখর দৃষ্টিশক্তি, অভীষ্ট সম্পাদনের তীব্রতা, এবং উন্মেষশালিনী প্রজ্ঞার জোরে অর্জুন যেমন বিশাল ধনুর্ধরে পরিণত হয়েছেন, হয়তো তার চেয়ে বেশি প্রতিভা ছিল একলব্যের। যার জন্য সামান্য তত্ত্বাবধান ছাড়াও তিনি শুধু আপন আত্মবিশ্বাস এবং একাগ্রতার জোবে–পরয়া শ্রদ্ধয়োপেতো যোগেন পরমেণ চ~~শর-গ্রহণ, শর-নিক্ষেপ এবং লক্ষ্যবস্তুকেই আঘাত করার সমস্ত কৌশল এবং শীঘ্রতা আয়ত্ত করে ফেললেন। সত্যি কথা বলতে কী, ধনুর্বিদ্যার ক্ষেত্রে শর–গ্রহণ, শর-মোক্ষণ এবং লক্ষ্যে আঘাত হানার সময় সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি যে যত তাড়াতাড়ি করতে পারবে এবং সেই তাড়াতাড়ির মধ্যেও লক্ষ। যত কম ভ্রষ্ট হবে, সেই তত বড় ধনুর্ধর হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। কোনও সন্দেহ নেই যে, একলব্য আপন প্রতিভায় অস্ত্রচালনার সেই চরম বিন্দুতে পৌঁছেছিলেন, যে বিন্দুতে অর্জুনও পৌঁছতে পারেননি এবং পারেননি বলেই তাকে অধম উপায় অবলম্বন করে একলব্যের পক্ষচ্ছেদন করতে হয়েছে।

তবু মহাভারতের কবি ব্যাস এসব কথা লুকোননি। পাণ্ডুর এই তৃতীয় পুত্রটি তার আপন বংশজাত সন্তান। তার প্রতি ব্যাসের মমতা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু মহাভারত যেহেতু শুধু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়েরই শৌর্যকাহিনী নয়, এবং তবু যে সেখানে এক নিষাদ পুত্রের সহজ প্রতিভা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের চক্রান্তে বিপর্যস্ত হয়–ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের সেই কলঙ্ক কাহিনী ব্যাস লুকিয়ে রাখেননি। সমস্ত জগতের সামনে উত্তম সামাজিকের এই চক্রান্ত তিনি প্রকাশ করে বুঝিয়েছেন যে, চিরকাল এই হয়, এই হয়েছে এবং এই হবে।

দ্রোণাচার্যের সমস্ত শিষ্যরাই একেকজন একেক ধরনের অস্ত্রচালনায় বিশেষত্ব অর্জন করলেন বটে, কিন্তু তাঁর পুত্রটি, যাকে তিনি বহুবার বহুরকমভাবে আলাদা করে শেখাতে চেয়েছেন, কিন্তু পারেননি বলে শুনেছি, সেই দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামাও কিন্তু একটি বিশেষ ব্যাপারে পারদর্শিতা অর্জন করলেন এবং সেটি হল গুপ্ত অস্ত্র, রহস্য–অস্ত্র। অর্থাৎ যেসব অস্ত্রচালনার শিক্ষা সচরাচর কেউ জানে না, সেই সব অস্ত্রক্ষেপণেই সবচেয়ে বেশি দক্ষতা অর্জন করলেন অশ্বত্থামা–অশ্বত্থামা রহস্যেষু সর্বেভ্যোধিকোভবৎ। ওই কথাটা আমরা বার বার শুনেছি, দ্রোণাচার্য সকলকেই একই রকম শিক্ষা দিতেন–তুল্যেম্বস্ত্রোপদেশে কিন্তু সকলেই একরকম ধারণ করতে পারত না। যার ধারণ ক্ষমতা অধিক এবং যার সহজ প্রতিভা আছে, সে তো বেশি শিখবেই। কিন্তু অন্যদিকে এও ঠিক দ্রোণাচার্য যত সমদৃষ্টিসম্পন্ন আচার্যই হোন না কেন, অর্জুনের প্রতি তিনি যেমন বিশেষ পক্ষপাতগ্রস্ত ছিলেন, নিজের পুত্রের প্রতিও কিন্তু তিনি কম পক্ষপাতগ্রস্ত ছিলেন না। আর এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঠিক সেই জন্যই শত সমদর্শিতার মধ্যেও তিনি পিতার কাছে অস্ত্রশিক্ষার গোপন পাঠ লাভ করেছেন এবং অন্যেরা যা জানতেন না, তিনি তা শিখে গিয়েছিলেন ওই গোপনীয়তার মধ্যেই।

যাই হোক, কৌরব এবং পাণ্ডব কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার পালা শেষ হয়ে গেছে। এবার রাজবাড়িতে প্রদর্শনীর আগেভাগে দ্রোণাচার্য শিষ্যদের একটু পরীক্ষা করে নিতে চাইলেন। দ্রোণাচার্য একদিন কাউকে না জানিয়ে হস্তিনাপুরের বণিকপথে, যেখানে পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়, সেইখানে উপস্থিত হলেন। এখান থেকে বিশেষ বিশেষ খবর নিয়ে তিনি চলে এলেন নগরের অন্য প্রান্তে। এখানে বড় বড় ঘরে কতগুলি লোক কাজ করছে। তারা শিশুদের ক্রীড়ানক তৈরি করে যাচ্ছে একের পর এক। একটি লোকের কাছে দ্রোণাচার্য নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বললেন–আমাকে একটি খেলনা পাখি তৈরি করে দিতে হবে, যেটি দেখতে লাগবে একেবারে সজীব পাখির মতো। পাখিটি একটু বড় অর্থাৎ একটি শকুনের মতো চেহারা হলেই ভাল হয়।

 নির্দিষ্ট দিনে দ্রোণাচার্য খেলনা পাখি পেয়ে গেলেন এবং রাজকুমাররা কেউই এই পাখির খবর জানতে পারলেন না–অবিজ্ঞতং কুমারাণা। দ্রোণাচার্য নিজের লোকজনের সাহায্যে পাখিটিকে একটি পত্রপুষ্পসমন্বিত বৃক্ষের ওপর স্থাপন করলেন। পাখিটিকে যেখানে বসানো হল, তার এদিক-ওদিক পেলব বৃক্ষপল্লব একটু-আধটু দুলতে লাগল, যাতে পাখিটি সম্পূর্ণ দেখতে অসুবিধে হয়, যাতে শরসন্ধান করার পরেও হঠাৎই একটা আবরণ তৈরি হতে পারে। শেষ মুহূর্তে হাওয়ায় দুলে একটি পুষ্পসমন্বিত বৃক্ষপল্লব পাখিটিব ওপর চলে আসতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র-চালনার সময়ে শত্রুপক্ষের রথী পুরুষ তো আর স্থির হয়ে বাণ খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন না। তার রথ চলবে উচ্চাবচ ভূমিতে। ঘোড়া দৌড়বে। অন্য পদাতিক, অশ্বারোহী রথী পুরুষের আবরণ তৈরি করতে পারে। এই সবরকম কথা মনে রেখেই দ্রোণাচার্য শকুনটিকে একটি পুষ্প-সমন্বিত বৃক্ষের চূড়ায় স্থাপন করলেন বেশ কায়দা করে। কৃত্রিমং ভাসামা রোপ্য বৃক্ষাগ্রে শিল্পিভিঃ কৃতম্।

দ্রোণাচার্য অস্ত্রচালনার প্রাথমিক পরীক্ষা নেবার জন্য প্রস্তুত হলেন। শিষ্যদের সবাইকে তিনি ডেকে নিয়ে এলেন বনভূমির সেই নির্দিষ্ট বৃক্ষটির তলায়। প্রত্যেক শিষ্যকে তিনি পাশাপাশি জায়গায় পরপর দাঁড় করিয়ে দিলেন একটি পংক্তিতে। দুই জনের মধ্যে অনেকটা করে ফঁক। দ্রোণাচার্য বললেন–তোমরা বৃক্ষের ওপরে ওই পাখিটিকে সকলেই দেখতে পাচ্ছ তো? সকলে সম্মতিসূচক শিরঃকম্পন করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন–তোমরা প্রত্যেকে খুব তাড়াতাড়ি ধনুক-বাণ হাতে নিয়ে ওই পাখির দিকে শর–সন্ধান করে লক্ষ্য স্থির করার চেষ্টা করো–শীঘ্রং ভবন্তঃ সর্বেপি…তিষ্ঠধ্বং সংহিতেষবঃ। এর পর আমি একেক জনের নাম করার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা শরচালনা করে ওই পাখিটির মাথা কেটে ফেলবে–শিরোস্য বিনিপাত্যতাম। তোমরা সকলে একসঙ্গে বাণ মোক্ষণের চেষ্টা করো না, তাতে কার বাণ লক্ষ্যভেদ করল বুঝতে পারব না। তোমাদের প্রত্যেককে আমি আলাদা করে ডাকব এবং তার পরেই যা করার তাই করবে–একৈকশো নিষোক্ষ্যামি তথা কুরুভ পুত্রকাঃ।

 দ্রোণাচার্যের কথামতো সকলেই ধনুক-বাণ হাতে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। দ্রোণাচার্য এবার কুমার–জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ করে বললেন–বাছা। তুমি শর স্থাপন করো ধনুকে এবং লক্ষ্য স্থির করো। এরপর আমি বললে, তবেই শরমোক্ষণ করবে–মধ্বাকান্তে বিমুঞ্চ চ। যুধিষ্ঠির গুরুবাক্য মেনে ধনুক তুলে নিলেন হাতে। তারপর ধনুকে শর-স্থাপন করে যথাসাধ্য লক্ষ্য স্থির করলেন সেই শকুনের দিকে তাকিয়ে। যুধিষ্ঠিরকে ধনুকের জ্যা-আকর্ষণ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রোণাচার্য তার মনোযোগ নষ্ট করার জন্যই যেন বললেন

–যুধিষ্ঠির! ওই গাছের ওপরে যে শকুনটা বসে আছে, ওটা দেখতে পাচ্ছ তো?

–আজ্ঞে আচার্য! পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি–পশ্যামীতি।

–পাখিটা যে দেখতে পাচ্ছ, এটা তো বেশ বুঝতে পাচ্ছি। আচ্ছা যুধিষ্ঠির? তুমি কি গাছটাও দেখতে পাচ্ছ?

–দেখতে পাব না? এই ফল-পুষ্প সমন্বিত মহা বনস্পতি, এও কি না দেখে থাকা যায়? পশ্যাম্যেনং বনস্পতিম্।

–আচ্ছা যুধিষ্ঠির! তুমি কি আমাকেও দেখতে পাচ্ছ?

–আচার্য! এই আপনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আদেশ করছেন, আপনাকে যদি আমি দেখেও না দেখি, তাহলে পূজনীয় ব্যক্তির অতিক্রম ঘটবে যে। আপনাকে তাই নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছি।

–আচ্ছা! এই যে তোমার ভাইরা দাঁড়িয়ে আছে, তুমি কি এদেরও দেখতে পাচ্ছ, যুধিষ্ঠির?

–আচার্য! আমার প্রাণাধিক ভাইদের দেখতে পাব না আমি? ওরা সব ধনুক তুলে শর-সন্ধান করে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি বলা মাত্রই শর-মোচন করবে। অবশ্য এই বৃক্ষ, এই আপনি এই আমার সব ভাইয়েরা এবং অবশ্যই ওই পাখিটিও–এ সবই আমি একাদিক্রমে দেখতে পাচ্ছি–ভবঞ্চ তথা ভ্রাতৃ ভাসঞ্চেতি পুনঃ পুনঃ।

যুধিষ্ঠিরের সমস্যা এটাই। তিনি সব দেখতে পান। জীবনের বিশাল ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ভাই, বন্ধু, শত্রু, মিত্র এমনকি সেই মুহূর্তে যে তার ক্ষতিসাধন করতে পারে, তার স্ত্রী-পুত্রের মুখও যুধিষ্ঠিরের মনে পড়ে। আমরা যখন মহাভারতের বিচিত্র উপাখ্যানের অন্তরে কৌরব–পাণ্ডবের জ্ঞাতি-শত্রুতার কথা বলতে থাকব, তখন দেখবেন–যা কেউ খেয়াল করে না, যার কথা কারও মনে থাকবার কথা নয়, সে কথা যুধিষ্ঠির মনে রাখেন। বিশ্ববাসী সকলের সঙ্গে তার সংবাদ ঘটেছে, তিনি কাউকে অবহেলা করতে পারেন না। বিশ্বজনের সকলের সঙ্গে যাঁর। সমান-হৃদয়তার সম্পর্ক, তিনি একটি পাখি থেকে আরম্ভ করে ভাই, বন্ধু, আচার্য সকলকেই দেখতে পান।

 কিন্তু এমন তাত্ত্বিক দৃষ্টি থাকলে আর যাই হোক তার দ্বারা অস্ত্রের মাধ্যমে লক্ষ্যভেদ সম্ভব নয়। লক্ষ্যভেদ করতে হলে যে এককেন্দ্রিক দৃষ্টি লাগে তা সারা জীবনেও যুধিষ্ঠির অর্জন করতে পারেননি, পারবেন না। অথচ দ্রোণাচার্য সেই পরীক্ষা নেবার জন্যই দাঁড়িয়ে আছেন। যুধিষ্ঠিরের প্রতি তিনি ভীষণ বিরক্ত হলেন। ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিকে মাস্টারমশাই যেমন গালাগালি দিয়ে বলেন–তোর দ্বারা কিছু হবে না। তুই বেরিয়ে যা এখান থেকে–ঠিক সেইভাবেই অখুশি দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে গালমন্দ করে বললেন–তুমি সরে যাও এই পংক্তি থেকে–তমুবাচ অপসপেতি। তুমি কোনওদিন একে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না–নৈতচ্ছক্যং ত্বয়া বেদ্ধৃং লক্ষ্যমিতেব কুৎসয়ম্।

 দ্রোণাচার্য এবার তার অপরাপর শিষ্য দুর্যোধন, ভীম, দুঃশাসন, নকুল–ইত্যাদিদের ওই একই প্রশ্ন করলেন একে একে। ক্লাসের প্রশ্নোত্তরে সবচেয়ে ভাল ছাত্রটি যে উত্তর দেয়, অন্যান্য মন্দবুদ্ধি ছাত্ররা তার পুনরাবৃত্তি করে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটল। অন্যেরা ভাবলেন–এ তো লক্ষ্যভেদ করা নয়। এ হল লক্ষ্যভেদের মানসিকতা পরীক্ষা যা একান্তই মৌখিক। অতএব যুধিষ্ঠিরের মতো জ্ঞানী ব্যক্তি–যুধিষ্ঠির যে জ্ঞানী, সে কথা কৌরব কুমাররাও মানতেন –অতএব যুধিষ্ঠির যে উত্তর দিয়েছে, তাছাড়া অন্য কোনও সদুত্তর হতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা–তারাও তো সবই দেখতে পাচ্ছেন। অবশ্য যুধিষ্ঠিরের দেখা আর তাদের দেখায় বিলক্ষণ তফাৎ আছে। একজনের দেখার মধ্যে তাত্ত্বিকতা আছে, আর অন্যজনের মনে আছে তাচ্ছিল্য। যাই হোক, যাঁরাই যুধিষ্ঠিরের বাক্য পুনরাবৃত্তি করে বললেন–সবই দেখতে পাচ্ছি, দ্রোণাচার্য তাদের সকলকে গালমন্দ করে প্রত্যেককে সরিয়ে দিলেন–তথা সর্বে তৎ সর্বং পশ্যাম ইতি কুৎসিতাঃ।

 দ্রোণাচার্য এবার সবাইকে ছেড়ে ঈষৎ হেসে অর্জুনকে বললেন–এবারে তোমার পালা অর্জুন, দেখো, ভাল করে পাখিটার দিকে তাকাও–ত্বয়েদানীং গ্রহৰ্তব্যং এতল্লক্ষাং বিলোক্যতাম্। আমি যখনই বলব, তখনই কিন্তু পাখিটার মাথা কেটে ফেলতে হবে। তুমি ধনুক আকর্ষণ করে একটু অপেক্ষা করবে শুধু–বিতত্য কামুকং পুত্র তিষ্ঠ তাবলুহূর্তকম্।

অর্জুন দ্রোণাচার্যের কথামতো ধনুকের ছিলা টেনে শর স্থাপন করে দাঁড়ালেন।–মণ্ডলীকৃত–কামুকঃ। তিনি দ্রোণাচার্যের আদেশের অপেক্ষা করছেন। দ্রোণ একটু পরেই সেই একই কায়দায় বললেন–আচ্ছা অর্জুন! তুমি কি পাখিটা গাছটা এবং আমাকেও দেখতে পাচ্ছ। অন্যান্যদের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে–দ্রোণাচার্যের প্রশ্ন শোনামাত্রই ধনুকের ছিলায় ঢিল দিয়ে, দ্রোণের দিকে তাকিয়ে সকলেই বেশ সম্মানজনকভাবে তার কথার উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু অর্জুনের বেলায় এমনটি হল না। শরাকর্ষণের অতিরেকে তার ধনুক এবং ধনুকের ছিলা প্রায় গোলাকার হয়ে গিয়েছিল–মণ্ডলীকৃতকামুকঃ। ঠিক সেই অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন অর্জুন। তার হাত–পা এতটুকু নড়ল না। দ্রোণাচার্যের দিকে তিনি ভ্রূক্ষেপও করলেন না। এক দৃষ্টিতে পাখির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তিনি জবাব দিলেন–আমি গাছ দেখতে পাচ্ছি না, আপনাকেও দেখতে পাচ্ছি না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে পাচ্ছি শুধু পাখিটাকে–পশ্যাম্যেকং ভাসমিতি দ্রোণং পার্থোভ্যভাষত।

 দ্রোণাচার্য বেশ খুশি হলেন। এই সময় তার দিকে তাকিয়ে আচার্যবং সসম্মানে কথা বলতে হবে–এটা যে সুশিক্ষিত শিষ্যের লক্ষণ নয়–এই বিলক্ষণ আচরণেই দ্রোণ খুশি হলেন। অর্জুন একই ভাবে স্থির লক্ষ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। দ্রোণাচার্য আবার বললেন–তুমি যে বললে পাখিটাই শুধু দেখতে পাচ্ছ, অর্জুন! তো পাখির কোন অঙ্গটা তুমি দেখতে পাচ্ছ? অর্জুন বললেন–শুধু মাথাটা। আর কোনও অঙ্গই দেখতে পাচ্ছি না–শিরঃ পশ্যামি ভাসস্য ন গাত্রমিতি সোব্রবীৎ।

 দ্রোণাচার্য পূর্বে নির্দেশ দিয়েছিলেন–আমি বলবার সঙ্গে সঙ্গে পাখিটার মাথা কেটে ফেলতে হবে–শিরোস্য বিনিপাত্যতা–অতএব অর্জুন শুধুই পাখির মাথাটা দেখতে পাচ্ছেন, আর কিছুই নয়। শিয্যের উপযুক্ত উত্তর শুনে দ্রোণাচার্যের গায়ে কাঁটা দিল–দ্রোণে হৃষ্টতরুহঃ। সরোমাঞ্চে তিনি বললেন–অর্জুন! শর ত্যাগ করো। এই আদেশের মুহূর্তটি পরের মুহূর্ত স্পর্শ করতে যে সময় নেয় তার মধ্যেই অর্জুনের শরক্ষেপণ হয়ে গেছে। পাখির মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে গেছে–শির উক্ত্য তরসা পাতয়ামাস পাণ্ডবঃ।

 দ্রোণাচার্য অর্জুনকে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন। বাল্যকালের যে বন্ধুটি তাঁকে অপমান করেছিল, তাকে পরাজিত করে অপমান করার পরিকল্পনা যেন এক্ষুনি সিদ্ধ হয়ে গেল। যেন উপযুক্ত শিষ্যের অসাধারণ অস্ত্র–প্রয়োগে সে কাজ তার হয়েই গেছে।

 ধনুঃশরের লক্ষ্যভেদের পরীক্ষা তো হয়েই গেল। এবারে আরও একটা পরীক্ষা দ্রোণাচার্যকে নিতে হবে। সে পরীক্ষা হতে হবে আকস্মিকতার মধ্যে। বিপন্ন মুহূর্তে কে কত তাড়াতাড়ি অস্ত্রচালনা করতে পারে সেই অস্ত্র-লঘুতা একবার পরীক্ষা করা দরকার। যখন তখন সাজিয়ে গুছিয়ে এই পরীক্ষা করা যাবে না, এই পরীক্ষার জন্য পরম বাস্তব এক বিপন্ন মুহূর্ত চাই। কিছুদিন অপেক্ষার পর সেই সুযোগও এসে গেল। দ্রোণ একদিন গঙ্গায় স্নান করতে গেছেন। তার সঙ্গে তাঁর শিষ্যবাহিনীও রয়েছে। তারা তীরভূমিতে দাঁড়িয়ে কেউ কথা বলছিলেন, কেউ গঙ্গার শোভা দেখছিলেন, কেউ বা আপন লক্ষ্যভেদশক্তি পশু-পাখির ওপর পরীক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎই সেই অলস ক্রীড়াপর কুমারদের কানে দ্রোণাচার্যের আর্ত চিৎকার ভেসে এল। জলচর কোনও হাঙর-কুমির অথবা অন্য কোনও প্রাণী দ্রোণাচার্যের পা কামড়ে ধরেছে–অবগাঢ়মধো দ্রোণং সলিলে সলিলেচরঃ।

দ্রোণাচার্যের কাছে সেই অস্ত্র ছিল, যাতে তিনি তক্ষুনিই বিপদ-মুক্ত হতে পারতেন, কিন্তু তিনি ভাবলেন যে, শিষ্যদের অস্ত্র-লঘুতা পরীক্ষা করার এই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। দ্রোণ চেঁচিয়ে উঠলেন–আরে শিগগির, শিগগির মার এটাকে, আমাকে কামড়ে নিয়ে যাচ্ছে–গ্রাহং হত্বা মোয়ধ্বম্। দ্রোণের সমস্ত শিয্যেরা গঙ্গা নদীর তীরভূমিতে দাঁড়িয়ে কেউ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কেউ বিশাল অস্ত্র-যোজনার চেষ্টা করল, কেউ অন্যকে অনুরোধ করল, কেউ বা ভাবল যে, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যদি তার অস্ত্র দ্রোণের গায়ে লাগে–ইত্যাদি নানা বিচিত্র চিন্তায় কেউই আর অস্ত্ৰমোক্ষণের প্রয়াসটুকু নিল না। সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল–ইতরে ত্বথ সংমূঢ়াস্তত্র তত্র প্রপেদিরে।

কিন্তু এরই মধ্যে যাঁর করার ছিল, তিনি কিন্তু কাজটি করে ফেলেছেন। দ্রোণের আর্ত চিৎকার এবং নির্দেশ ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গে অসম্ভব তীব্রতায় পাঁচ-পাঁচটি বাণ নিক্ষেপ করে জলচর জন্তুটিকে খণ্ড-খণ্ড করে ফেললেন অর্জুন। দ্রোণাচার্যের জঙ্ মুক্ত হল নিমেষেই এবং দ্রোণাচার্য আবারও বুঝলেন যে, তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অর্জুনই শ্রেষ্ঠতম। আরও একটা জিনিস খেয়াল করুন। একলব্য যখন সেই চিৎকার করা কুকুরকে বাণবিদ্ধ করেছিলেন, তখন তার অস্ত্রলঘু অর্থাৎ বাণ-মোক্ষণের শীঘ্রতা ছিল পরপর সাতটি বাণ। আর অর্জুন এই জলজন্তুটিকে বধ করলেন প্রায় একসঙ্গে পাঁচটি বাণ মেরে, কিন্তু একলব্যের ক্ষেত্রে বধ্য বস্তু দৃষ্টির বাইরে ছিল না, অর্জুনের ক্ষেত্রে জলজন্তু জলের ভিতরে ছিল–অবাৰ্য্যৈঃ পঞ্চভি-গ্রাহং মগ্নমম্ভস্যতাড়য়ৎ। এখনকার দিনের স্পিড় মাপার যন্ত্র তখন ছিল না, কিন্তু এই বাণ সংখ্যার নিরিখে বোঝা যায় অর্জুন প্রায় এক মুহূর্তে বা কিঞ্চিদধিক সময়ে পাঁচ-পাঁচটি শর মোচন করতে পারতেন, যে ক্ষমতা অন্য কারও ছিল না। একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে যাবার পর অর্জুনই রইলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি অস্ত্রমোক্ষণের তীব্রতায় সর্বশ্রেষ্ঠ।

 দ্রোণাচার্য এত খুশি হলেন যে, সেই রক্তাক্ত অবস্থাতেই গঙ্গার তীরভূমিতে উঠে এসে তিনি অর্জুনকে বললেন–অর্জুন! আমার কাছে একটি দিব্য অস্ত্র আছে। এর নাম ব্রহ্মশির। এই অস্ত্র কীভাবে ক্ষেপণ করতে হবে এবং কীভাবেই বা সম্বরণ করতে হবে–সব আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব–অস্ত্রং ব্রহ্মশিরা নাম সপ্রয়োগ-নিবর্তন। তবে এখানে একটাই কথা বলার আছে–এই অস্ত্র তুমি কখনও মানুষের ওপর প্রয়োগ করবে না। কেননা সাধারণ জনের ওপরে প্রয়োগ করলে এই অস্ত্র জগৎ বিনাশ করতে পারে–জগদ্ বিনির্দহেদেত অল্পতেজসি পাতিত।

এতকাল পর্যন্ত শিক্ষাজীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জুন লাভ করছেন গুরু-পরম্পরায়। দ্রোণাচার্য ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করেছিলেন তাঁর গুরু অগ্নিবেশ্যের কাছ থেকে। আজ অর্জুন সেই অস্ত্রের প্রয়োগ এবং সম্বরণের শিক্ষা লাভ করছেন তার গুরুর কাছ থেকে। আগেই বলেছি– যিনি এই অস্ত্রলাভের উপযুক্ত আধার বলে বিবেচিত হবেন, তার শম-দম এবং জিতেন্দ্রিয়তার শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়া দরকার। অর্জুনের সেই শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে বলেই আজ তিনি ব্রহ্মাস্ত্র–লাভের অধিকারী হচ্ছেন। দ্রোণাচার্য একবার নয়, দুবার অর্জুনকে সাবধান করে বলেছেন–মানুষ ছাড়া অন্য কোনও শত্রু যদি তোমাকে আক্রমণ করে, তবেই এই অস্ত্রের সাহায্যে তুমি তাকে বাধা দেবে–বাধেমানুষঃ শত্রু যদি ত্বং বীর কশ্চন। তদ্বাধায় প্রযুঞ্জীত…।

বাধা দেবে–তার মানে প্রয়োগ করবে কিন্তু অস্ত্র-সম্বরণের উপায়টি হাতে রেখে। আর মানুষ নয় এমন শত্রু বলতে দেবতা অসুর যাকেই বোঝানো হোক না কেন–এর আসল মানে হল–যদি কোনও অমানুষিক যুদ্ধ হয়–অর্থাৎ এমন অস্ত্র-যুদ্ধ যা অর্জুনের পক্ষেও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না, অথচ সে যুদ্ধে সাধারণের অনেক ক্ষতি হবে, তবে সেই অমানুষিক অস্ত্রকে বাধা দেবার জন্য এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করবে, নচেৎ নয়।

অর্জুন দ্রোণ-গুরুকে কথা দিলেন। তিনি এই অস্ত্র–প্রয়োগের সম্পূর্ণ ফলাফল বিচার করেই কথা দিলেন যে, যেমনটি তিনি বলছেন, তাই হবে। পরম এবং চরম সেই অস্ত্র অর্জুনের হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে দ্রোণাচার্য বললেন–আজ থেকে তোমার মতো ধনুর্ধর এই পৃথিবীতে আর কেউ রইল না। তুমি হবে সকলের অজেয় এবং পরম কীর্তিমান–অজেয়ঃ সর্বশত্রণাং কীর্তিমাংশ্চ ভবিষ্যসি। অর্থাৎ দ্রোণ অর্জুনকে যে কথা দিয়েছিলেন–তোমাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধরে পরিণত করব–সেই কথা তিনি রাখলেন অর্জুনের গুণে, অর্জুনের প্রতি পক্ষপাতে, একলব্যের পক্ষশাতন করে এবং পরিশেষে শ্রেষ্ঠ কোনও শিক্ষার্থীর পরম কাম্য ব্রহ্মাস্ত্র অর্জুনকে দান করে–ভবিতা ত্বৎসমো নান্যঃ পুমাল্লোকে ধনুর্ধরঃ।

.

১০৪.

দ্রোণাচার্য একদিন কৌরব-পাণ্ডব রাজকুমারদের ডেকে বললেন–তোমরা যেমন অস্ত্রাভ্যাস করে যাচ্ছ, তেমনই করে যাও। তোমাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। তোমাদের পিতা-মাতা গুরুজনেরা আমার হাতে তোমাদের তুলে দিয়েছিলেন। অতএব তাদের সামনে। অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শন করে আমার মান রাখতে হবে তোমাদের। অতএব তোমরা অভ্যাস চালিয়ে যাও। আমি একবার রাজধানীতে যাব। সমস্ত ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

দ্রোণাচার্য হস্তিনাপুরের বর্ধমান পুরদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে সোজাসুজি রাজসভায় এলেন। ধৃতরাষ্ট্র তখন সিংহাসনে বসে আছেন। তার চারপাশে বসে আছেন ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রীরা-কৃপাচার্য, সোমদত্ত, বাহ্বীক, ভীষ্ম, বিদুর এবং স্বয়ং সত্যবতীনন্দন ব্যাস। দ্রোণাচার্য সকলকে উদ্দেশ করে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন–মহারাজ আপনার কুমাররা সকলেই যথোচিত বিদ্যা-লাভ করেছে। এখন আপনি যদি অনুমতি করেন, তবে কুমারগণ তাদের শিক্ষা প্রদর্শন করতে পারে–তে দর্শয়েষুঃ স্বাং শিক্ষাং রাজনুনুমতে তব।

 ধৃতরাষ্ট্র খুব খুশি হয়ে বললেন–আপনি আমাদের খুব বড় একটা কাজ করে দিয়েছেন, ঠাকুর। অতএব আপনি যে সময়ে, যেভাবে ইচ্ছে যা কিছু করা ভাল মনে করেন, তাই আমাকে আদেশ করুন–যদানুমন্যতে কালং যস্মিন্ দেশে যথা যথা। কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার নৈপুণ্য দেখার জন্য আজকে আমার সেই মানুষগুলির ওপর ঈর্ষা হচ্ছে, যাঁরা এই প্রদর্শনী নিজের চোখে দেখবেন–ধৃতরাষ্ট্র অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনের মঞ্চ তৈরি করার জন্য বিদুরকে আদেশ দিয়ে বললেন–গুরু দ্রোণাচার্য যেমন যেমন আদেশ করেন তেমন তেমন ব্যবস্থা করে দাও। এমন ঘটনা সব সময় ঘটবে না। অতএব তুমি দেখ কী করতে হবে।

মহামতি বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে অভিবাদন জানিয়ে দ্রোণাচার্যের সঙ্গে বাইরে এলেন। রাজগৃহের বাইরেই একটি বড় জায়গা পছন্দ করলেন দ্রোণ এবং বিদুর। অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনের জন্য ঠিক কতখানি জায়গা লাগবে দ্রোণাচার্য সেটা নিজে মেপে দিলেন–ভারদ্বাজো মহাপ্রাজ্ঞো মাপয়ামাস মেদিনীম্। মনে রাখতে হবে–সেই বৈদিক কাল থেকেই ভারতবর্ষের তথাকথিত আর্যজাতি মাপজোকের নিয়ম-কানুন খুব ভালই জানতেন। বৈদিক যজ্ঞের জন্য বিভিন্ন বেদি নির্মাণের প্রয়োজনে জ্যামিতিক নকশা ব্যবহার হত। আর আজকের যুগে যাকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলি তার প্রাথমিক বোধটা যে কত ভাল ছিল, তা মহেঞ্জোদরো–হরপ্পার গৃহ ধ্বংসের অবশেষ দেখলেই বোঝা যাবে। ভাল রকম টাউন–প্ল্যানিং না জানলে মহেঞ্জোদরোর নাগরিক শৈলীর এত খ্যাতি হত না।

যাই হোক, এ তো বেদের যুগেরও আগের কথা। বেদের যুগেই মোটামুটি মাপজোকের জ্যামিতিক রূপায়ণ আরম্ভ হয়ে গেছে, আর কৌটিল্যের সময় বা মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতেই আমরা মাপজোকের বহু পারিভাষিক শব্দ ব্যবহৃত দেখছি। এবং এই পারিভাষিক শব্দগুলি মহাভারতের অন্যত্রও বেশ সুসংহতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। দ্রোণাচার্যের হয়তো এত বোধ ছিল না। কিন্তু তার প্রয়োজনটুকু তিনি জানতেন। যে নোক ধনুঃশরের শিক্ষা প্রদর্শন করছে, তার যে জায়গা লাগবে, তার চেয়ে বেশি জায়গা লাগবে গদাযুদ্ধের ক্ষেত্রে। আবার তার চেয়েও বেশি লাগবে বর্ষা-ক্ষেপণে বা অসি-যুদ্ধে। দ্রোণাচার্য সবগুলি অস্ত্রের চালন-চিত্র মাথায় রেখে বেশ বড়ো একটা জায়গা মেপে দিলেন বিদুরকে।

 দ্রোণাচার্য যে জায়গাটা বাছলেন, সেটা সমতলভূমি। কোনও গাছ নেই, এমনকি গাছ কাটা হয়ে গেছে তার কর্তিত মূল পড়ে আছে, এমনটিও দ্রোণাচার্যের প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে অসুবিধেজনক। অতএব গাছ নেই, বৃক্ষমূলের অবশেষ নেই এবং সেই জায়গাটা উত্তরদিকে খানিকটা ঢালু হয়ে গেছে–এইরকম একটা জায়গা পছন্দ করলেন দ্রোণাচার্য–সমা অবৃক্ষাং নিগুল্ম উদ প্রস্রবণান্বিতাম্। ঢালটা এইজন দরকার, যাতে বৃষ্টি হলে জল না দাঁড়ায়। জমির মাপজোক করে দিয়ে দ্রোণাচার্য বিদুরকে একটি শুভদিনের কথা জানিয়ে গেলেন, যেদিন রঙ্গভূমির সফলতার উদ্দেশে ভূমিপূজা করবেন অস্ত্রগুরু। দ্রোণাচার্য সেদিনকার মতো ফিরে চলে গেলেন, রাজধানীর একান্তে সেই কুটিরে, যেখানে কুমারগণ অস্ত্রাভ্যাস করে যাচ্ছেন।

যেদিন রঙ্গমঞ্চের ভিতপুজো করবেন বলে ঠিক করলেন দ্রোণাচার্য, সেইদিন সকাল থেকে এক বাজনাদার জমির সেই ঢালু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ডিণ্ডিম বাজাতে লাগল। মাঝে মাঝে বাজনা থামিয়ে সে ঘোষণা করতে লাগল–হস্তিনাপুরের নগরবাসী, জনবদবাসীরা সবাই শুনুন। এই জমির ওপর দাঁড়িয়ে কুরুবাড়ির রাজকুমাররা সব অস্ত্র-শিক্ষার কৌশল দেখাবেন। আজকে শুভযোগে শুভ নক্ষত্রে অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য ভূমিপূজা সম্পন্ন করবেন। আপনারা সকলে আসুন, বাজনাদার খুব বাজনা বাজাল আর খুব করে ঘোষণা করল–অবঘুষ্টে সমাজে চ তদর্থং বদতাং বরঃ।

দ্রোণাচার্য শুভ মুহূর্তে শাস্ত্রবিধি অনুসারে ভূমিপূজা সম্পন্ন করলেন। দেবতার পূজা বেশ ঘটা করেই হল। পূজা দেখতে আসা জনপদবাসীরা আগাম খবর পেয়ে গেল–কবে কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার প্রদর্শনী হবে। পূজা সেরে দ্রোণাচার্য আবারও ফিরে গেলেন সেই অরণ্যপ্রান্তে শিষ্যদের অস্ত্রাভ্যাস শেষ কদিন পরখ করে নেবার জন্য। একটি ছাত্র-শিষ্য, যে পড়া তৈরি করে পরীক্ষা দেয়, পরীক্ষায় ভাল ফল করার জন্য তার যেমন তাগিদ থাকে, তেমনই যিনি গুরু, যিনি এতদিন ধরে অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে এসেছেন, তারও তেমনই তাগিদ থাকে ছাত্রকে ভাল ফল করানোর জন্য। এই কারণে গুরু যেমন একদিকে রঙ্গমঞ্চের ভূমিপূজা সেরে দেবতাকে শিষ্যদের ওপর প্রসন্ন থাকতে বলছেন, তেমনই শিষ্যদের অস্ত্রাভ্যাসের শেষটুকু দেখে নেবার জন্যও তিনি ব্যস্ত থাকেন। দ্রোণাচার্য জানেন–শিক্ষার্থীকে যদি কৃতকার্য হতে হয়, তবে দৈবের সঙ্গে পুরুষকারের প্রয়োজন। আর ঠিক এইজন্যই একদিকে মঞ্চপূজা অন্যদিকে অস্ত্রাভ্যাস চলছে।

হস্তিনাপুরে এখন দিন-রাত মঞ্চ তৈরির কাজ চলছে। সমস্ত রাজকুমার নিজের নিজের অস্ত্র কৌশল দেখাবেন অতএব রাজবাড়ির প্রত্যেকটি সদস্যের মনে টান টান উত্তেজনা আছে। দ্রোণাচার্য যে সব শিল্পীকে নিয়োগ করে গেছেন, তারা বিভিন্ন পরিকল্পনায় মঞ্চ তৈরি করছেন। মঞ্চের উত্তর দিকটা ঢালু অতএব সেই দিকটাই সাধারণের প্রবেশ-পথ হিসেবে ছেড়ে দিয়ে মঞ্চের দু-দিকে রীতিমতো স্টেডিয়াম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য স্টেডিয়াম না বলে এটাকে গ্যালারি বলাই ভাল। মঞ্চের দক্ষিণ দিকে নির্মিত হয়েছে একটি অতি উচ্চ সুদর্শন প্রেক্ষাগার–প্রেক্ষাগারং সুবিহিতং চক্রুস্তে তস্য শিল্পিনঃ। এই প্রেক্ষাগারে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অন্যান্য রাজন্যবর্গ এবং কুরুবৃদ্ধদের সঙ্গে বসে থাকবেন। আর এখানেই এক পাশে বসবেন রাজবাড়ির স্ত্রীলোকেরা। যাতে রাজা, রাজন্যবর্গ এবং স্ত্রীলোকরা কোনও দুর্ঘটনা বা জন-কোপ থেকে মুক্ত থাকেন তার জন্য প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্রও মজুদ করা হয়েছে এই প্রেক্ষাগারে–রাজ্ঞঃ সৰ্বায়ুধোপেতং স্ত্রীণাঞ্চৈব নরর্যভূ।

মঞ্চের উত্তরদিকে সাধারণ প্রবেশপথ, দক্ষিণদিকে রাজদর্শন-মঞ্চ আর বাকি দুই দিকে পশ্চিমে এবং পূর্বে দুটি বিশাল মঞ্চ তৈরি করলেন হস্তিনাপুরের দেশীয় শিল্পীরা। মহাভারতের প্রমাণেই বলা যায় যে, এই মঞ্চ দুটি এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছিল, যাতে রাজকুমারদের দেখতে কোনও অসুবিধা না হয়–বিপুলা উচ্ছুয়োপেতা শিবিকাশ্চ মহাধনাঃ। অস্ত্রপরীক্ষার দিন রাজপুরনারীদের সসম্মানে নিয়ে আসার জন্য বহুতর এবং বিচিত্র শিবিকা তৈরি হল। এই শিবিকা পুরনারীদের পর্দার আড়ালে রাখার জন্য নয়, এগুলি তাদের সম্মান এবং আড়ম্বর ঘোষণার জন্যই, কারণ মহাভারতের যুগে পর্দা-প্রথার চল হয়নি। স্ত্রীলোকেরা যথেষ্ট স্বাধীনভাবেই চলা-ফেরা করতে পারতেন।

 অস্ত্র-পরীক্ষার নির্দিষ্ট দিনে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের দর্শনমঞ্চটিকে আরও দর্শনীয় করে তোলা হল। চারদিকে মুক্তার ঝালর দুলছে চন্দ্রাতপ থেকে–মুক্তাজাল-পরিক্ষিপ্তং। মঞ্চের নির্মাণ-স্তম্ভগুলি মুড়ে দেওয়া হয়েছে সোনার সুতোয় আর তার মাঝে মাঝে উৎকীর্ণ করা হয়েছে বৈদুর্যমণি–শাতকুম্ভময়ং দিব্যং বৈদুর্যমণিশোভিত। ধৃতরাষ্ট্র তার মন্ত্রীদের নিয়ে প্রেক্ষাগারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, তাঁর সামনে সামনে যাচ্ছেন কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম আর কুলগুরু কৃপাচার্য। রাজার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই সুদৃশ্য শিবিকাগুলিতে করে মঞ্চের একদিকে উপস্থিত হলেন ধৈর্যশীলা গান্ধারী এবং মনস্বিনী কুন্তী। তাঁদের সঙ্গে তাঁদের দাসীরা। সবার পরনে বিচিত্র সাজ, আভরণ–স্ত্রিয়শ্চ রাজ্ঞঃ সর্বাস্তা সপ্ৰেষ্যাঃ সপরিচ্ছদাঃ। হস্তিনাপুরের জনপদবাসী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র–সকল জাতির লোকেরা অনেক আগে থেকেই দুধারের মঞ্চে আসন সংরক্ষণ করছিল–চাতুর্বর্ণং পুরাদ দ্রুত। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র উপস্থিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুধারে প্রেক্ষামঞ্চগুলি একেবারে মুহূর্তের মধ্যে পূর্ণ হয়ে গেল। এরা সকলেই রাজকুমারদের শিক্ষা-কৌশল দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে এসেছে–ক্ষণেনৈকস্থতাং তত্র দর্শনেঙ্গুর্জগাম হ।

রাজা ধৃতরাষ্ট্র, কুরুবৃদ্ধগণ, অন্যান্য রাজন্যবর্গ এবং কুরুবাড়ির স্ত্রীলোকেরা আসন গ্রহণ করলেন, জনপদ-পুরবাসীরাও আসন গ্রহণ করলেন। একটু পরেই যে এই প্রদর্শনী-উৎসব শুরু হবে, তার ইঙ্গিত দেবার জন্য বাজনদারেরা এবার বাজনা শুরু করল। তাল-লয় সমন্বিত বাদ্যধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে দর্শকাসন থেকে তাল দিতে লাগল হস্তিনাপুরের জনপদবাসীরা। প্রবল কৌতূহল এবং উত্তেজনায় তারা উঠে-বসে নেচে-কুঁদে তাল দিতে লাগল বাজনদারের বাদ্যি–বাজনার সঙ্গে। তাদের দেখতে লাগছিল তরঙ্গ-ভঙ্গুর এক মহাসমুদ্রের মতো–মহার্ণব ইব ক্ষুব্ধঃ সমাজঃ সোভবত্তদা।

 এর পর মঞ্চের প্রবেশপথে একটি বৃদ্ধ মানুষকে আসতে দেখা গেল। তার যুবক পুত্রটি তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। বৃদ্ধের পরনে ধবধবে সাদা কাপড়। মাথায় পাকা চুল, কিঞ্চিদবিন্যস্ত। পাকা দাড়ি হাওয়ায় উড়ছে। কাঁধে সাদা পৈতে ঝুলছে। আর আজকের এই উৎসবমুখর দিনের কথা মাথায় রেখেই যেন বৃদ্ধ কিঞ্চিৎ শ্বেত চন্দনের অনুলেপন গ্রহণ করেছেন। তার গলায় একটি সাদা-ফুলের মালা। শ্বেত চন্দনের অলকা-তিলকার সঙ্গে সাদা মালাখানি গলায় দিয়ে বৃদ্ধ যখন যুবক পুত্রের সঙ্গে মঞ্চভূমিতে প্রবেশ করলেন তখন তাদের দেখে মনে হল যেন মঙ্গল গ্রহের সঙ্গে আকাশের স্নিগ্ধ চাঁদখানি নেমে এসেছে ডুয়ে–নভো জলধরৈ-ইনিং সাঙ্গারক ইবাংশুমান্।

 এই বৃদ্ধ হলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য এবং যুবকটি তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা। মঙ্গল গ্রহ লাল। রজগুণের অতি সাহসের তথা নির্ভীকতার প্রতীক। আর চাঁদ স্নিগ্ধকিরণসঞ্চারী বৃদ্ধত্বের প্রতীক এখানে। সপুত্র দ্রোণাচার্য রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাজনদাররা বাজনা থামাল। এই মুহূর্তে দর্শকাসনের জনসমূহ নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে পরিণত হল। রঙ্গমঞ্চের পরিবেশ হয়ে উঠল গম্ভীর।

দ্রোণাচার্য রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করে প্রথমে ইষ্টদেবতার উদ্দেশে পূজা নৈবেদ্য প্রদান করলেন। পূজা শেষের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণরা স্বস্তিবাচন করলেন–স্বস্তি ন ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র উঠে দাঁড়ালেন। প্ৰেষ্যজনের হস্তস্থিত স্থালী থেকে সুবর্ণ, মণি এবং বিচিত্র বর্ণের বহুমূল্য বস্ত্র গ্রহণ করে অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য এবং প্রথম গুরু কৃপাচার্যের পায়ে নিবেদন করলেন–প্রদদৌ দক্ষিণাং রাজা দ্রোণায় চ কৃপায় চ।

ধৃতরাষ্ট্রের দক্ষিণা-উপহার সম্পন্ন হওয়ার পর আবারও পুণ্যাহ ঘোষণা করলেন ব্রাহ্মণেরা–অথ পুণ্যাহঘোষস্য পুণ্যস্য সমনন্তর–আর ঠিক তার পরেই রাজকুমাররা তাদের অস্ত্র-শস্ত্রের সম্ভার নিয়ে প্রদর্শনী মঞ্চে প্রবেশ করলেন। কুমারগণ প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকাসন থেকে তুমুল হর্ষধ্বনি হল এবং কুমারেরা তাদের কৌশল প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। অস্ত্রভার নামিয়ে রেখে তাদের কেউ কটিদেশের বস্ত্র ভাল করে এঁটে নিলেন, কেউ কঁধ এবং উদরের বস্ত্রখণ্ড ঠিক-ঠাক করে নিলেন, অতিরিক্ত অস্ত্রঘর্ষণে আঙুল ফেটে যায় বলে অঙ্গুলি-ত্রাণ ধারণ করলেন কেউ–ততো বদ্ধাঙ্গুলিত্ৰাণা বদ্ধকক্ষা মহারথাঃ। যাঁরা তীর-ধনুকের কৌশল দেখাবেন, তারা স্কন্ধে তৃণ-সন্নিবেশ করে ধনুকের গুণ পরালেন টেনে টেনে, টংকার দিয়ে, এবং আবারও টেনে তীরমোক্ষণের একান্ত উপযোগী করে।

মহামতি বিদুর অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে কুমারদের অস্ত্রশিক্ষা-প্রদর্শনের ধারাভাষ্য শোনানোর জন্য প্রস্তুত হলেন। অন্যদিকে মনস্বিনী কুন্তী সমস্ত ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ শোনাতে লাগলেন আবৃত-নয়না গান্ধারীকে। মহাভারতের কবি যেমন বর্ণনা দিয়েছেন তাতে দেখছি–বয়সের অনুক্রমেই অস্ত্রপ্রদর্শনী আরম্ভ হয়েছিল কুমার যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে–অনুজ্যেষ্ঠন্তু তে তত্র যুধিষ্ঠির-পুরোগমাঃ। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে আরও অন্যান্য কুরু কুমাররাও ছিলেন বলেই মনে হয় এবং তাঁদের নাম এবং বীরত্বও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এঁরা প্রস্তুত হবার সঙ্গে সঙ্গে এদিক-ওদিক নানাভাবে বাণ ছুঁড়তে লাগলেন। কখনও ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটতে ছুটতে বাণ-চালনা করছেন, কখনও বা ছুটন্ত ঘোড়া হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে লক্ষ্যভেদ করছেন।

প্রত্যেকটি বাণেই কুমারদের নিজস্ব নাম লেখা ছিল। কাজেই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না কে কৃতিত্বের অধিকারী। দ্রোণাচার্যের শকুন-লক্ষ্যভেদে সকলেই প্রায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন। বলে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, রাজকুমাররা তেমন কিছু শেখেননি। আসলে সেই পরীক্ষার মধ্যে দ্রোণের আরও বড় পরীক্ষা ছিল। সেই পরীক্ষায় তারা ফেল করেছেন বটে, কিন্তু তাই বলে রঙ্গমঞ্চে সবার সামনে অস্ত্রবিদ্যার নানা কৌশল দেখাতে তাদের অসুবিধা হল না–চরস্ত্ৰং মহাবীর‍্যা কুমারাঃ পরমাদ্ভুত। কুমারদের শরচালনার ভয়ে দর্শকাসনে বসে থাকা হস্তিনাপুরের জনপদবাসীরা অনেকে মাথা নিচু করে নিজেদের প্রাণ-বাঁচানোর চেষ্টা করল, যেন নিক্ষিপ্ত শরগুলি তাদের গায়ে এসেই লাগবে, অতএব চাচা আপন বাঁচা শিরাংস্যবননামিরে। গ্রাম্য-স্বভাববশত সবাই খুব ঠাসাঠাসি করে বসে থাকল, যেন একসঙ্গে থাকলেই তারা অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু যে যাই করুক, যার যেমন ভাবই হোক কোনও অস্ত্-কৌশল দেখা থেকে তারা বিরত হচ্ছে না এবং বেশ মজাও পাচ্ছে তারা–মনুজা ধৃষ্টমপরে বীক্ষাঞ্চঃ সুবিস্মিতাঃ। সমস্ত আকাশ জুড়ে কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রোন্মাদনা দেখে সমস্ত দর্শক একদিকে যেমন অবাক হয়ে গেল, অন্যদিকে, তেমনই সাধুবাদ দিতে থাকল।

দ্রোণাচার্য এতটাই বড় করে রঙ্গমঞ্চের নকশা করেছিলেন যে, রথ, হাতি, ঘোড়া–সমস্ত বাহনে বসেই যেভাবে যুদ্ধাস্ত্র-চালনা করতে হবে সেটা যেন দেখানো যায়। আর অস্ত্রচালনার মধ্যে শুধু ধনুক-বাণই নয়, যাঁরা এতক্ষণ ধনুক-বাণের কৌশল শেষ করেছেন তারা আবার তরবারি চালানোর ক্ষমতাটুকুও ভালভাবে দেখিয়ে দিলেন। যুদ্ধে একটি যোদ্ধার সারথি, রথ, হাতি, ঘোড়া সব খোয়া যেতে পারে; অতএব সেই কথা মনে রেখে বাহনগুলি বাদ দিয়ে অসি-চালনার ক্ষিপ্রতা এবং দৃঢ়মুষ্টিতা দেখানো যেমন প্রয়োজন, সেইরকম শেষ অবলম্বন হিসেবে পরস্পর বাহুযুদ্ধের কৌশলও কুমারগণ একে একে সব দেখিয়ে দিল– গজপৃষ্ঠেশ্বপৃষ্ঠে চ নিযুদ্ধে চ মহাবলাঃ।

দ্রোণাচার্য সব আইটেমই একসঙ্গে ছেড়ে দেননি। এতক্ষণ যাঁরা অস্ত্র-কৌশল দেখালেন, তাদের মধ্যে যুধিষ্ঠির থেকে কৌরব-পাণ্ডব এবং অন্যান্য রাজকুমাররা সকলেই ছিলেন কিন্তু এঁদের মধ্যে অর্জুন তো ছিলেনই না। ছিলেন না ভীম এবং দুর্যোধনও। অর্জুনকে দ্রোণাচার্য প্রদর্শনীর শেষ আইটেম হিসেবে রেখেছেন। আর ভীম-দুর্যোধনের বিদ্যা হল বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্র। ধনুঃশর নয়, বর্শা-ভল্ল নয়, গদাযুদ্ধ। কুমারগণের সাধারণ প্রদর্শনী শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে দ্রোণাচার্য ভীম এবং দুর্যোধনকে ইঙ্গিত করলেন রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করার জন্য।

কৌরব-পাণ্ডবদের অন্যান্য ভাইরা তখন রঙ্গস্থলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। এক প্রান্তে কৌরবদের ছাউনি থেকে দুর্যোধন বেরিয়ে এলেন। অন্য প্রান্ত পাণ্ডবদের ছাউনি থেকে বেরিয়ে এলেন ভীম। দুজনের হাতে দুটি মস্ত আয়সী গদা অর্থাৎ লোহার গদা। প্রথমটা যেমন হয়, দ্বন্দ্বযুদ্ধটা প্রথমেই আরম্ভ হয়। সামান্য একটু ওয়র্ম-আপ করার জন্য দুজনেই তাদের নিজ নিজ গদা দুটি বামাবর্তে এবং দক্ষিণাবর্তে খানিকক্ষণ ঘুরিয়ে নিয়ে হাতের জড়তা ভেঙে  নিলেন–তৌ প্রদক্ষিণ-সব্যানি মণ্ডলানি মহাবলৌ। আস্তে আস্তে দুজনেই দুজনের দিকে এগোতে লাগলেন যেন দুই মত্ত কামুক হস্তী এক অদৃষ্টকায়া হস্তিনীর অধিকার লাভের জন্য এগোচ্ছে। মোটামুটি এঁদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা। তিনি এঁদেরই সমবয়সী যুবক হলেও গুরুপুত্র এবং ব্রাহ্মণ বলে উভয়েরই সম্মানিত ব্যক্তি দ্বন্দ্ব–যুদ্ধে, কুস্তি কিংবা মুষ্টিযুদ্ধে আমরা মাঝখানে যেমন একজন রেফারিকে দেখি অশ্বত্থামা প্রায় সেই ভূমিকাতেই দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ ভীম এবং দুর্যোধন–দুজনেই দুজনের জন্ম-প্রতিদ্বন্দ্বী এবং এঁদের মধ্যে সেই কিলার ইনস্টিংক্ট আছে যাতে যে কোনও সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

বিদুর এবং কুন্তী কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর কাছে তাদের নিপুণ ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছেন–ন্যবেদয়তাং তৎসর্বং কুমারাণাং বিচেষ্টিত।

এতক্ষণ কুমারগণ যে একক অস্ত্রকৌশল দেখাচ্ছিলেন, এখন দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের কারণে সেই কৌশল-সূক্ষ্মতা চাপা পড়ে গিয়ে দর্শকাসনে নতুন উন্মাদনার সৃষ্টি হল। ভীম অত্যন্ত দীর্ঘকায় এবং শারীরিকভাবে অতিবলশালী। গদাযুদ্ধে শরীরের এই ভার এক নতুন মাত্রা যোগ করে। অন্যদিকে দুর্যোধন ভীমের চেয়ে শারীরিকভাবে কম সম্পন্ন হলেও তার কৌশল-শিক্ষা অনেক বেশি, অভ্যাসও অনেক বেশি। দুর্যোধন যেটা কৌশল করেন, ভীম সেটা পূরণ করেন গায়ের জোরে। দুজনে দু-চারবার গদা-ঠোকাঠুকি করতেই উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে তুমুল চিৎকার আরম্ভ হল। সম্পূর্ণ রঙ্গস্থল মোটামুটি দুভাগ হয়ে গেল। একদল–ভীম জিতবেন, ভীম জিতবেনবলে চেঁচাচ্ছে, আরেক দল দুর্যোধন, দুর্যোধন বলে চেঁচাচ্ছে–জয় হে কুরুরাজেতি জয় হে ভীম ইত্যুত। দর্শকদের এই দ্বিধাকৃত চিৎকার-শব্দের সঙ্গে বাজনদারদের উৎসাহসূচক বাদ্যধ্বনি মিশে সম্পূর্ণ রঙ্গস্থল এক অতি বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের আকার ধারণ করল–ক্ষুব্ধার্ণবনিভঃ রঙ্গ।

ভীম এবং দুর্যোধন পরস্পর হানাহানি আরম্ভ করলেন। কেউ কিছু কম যান না। দুজনের লৌহগদার ঠোকাঠুকিতে উল্কাপাত ঘটতে আরম্ভ করল। দর্শকাসন থেকে জনপদবাসীরা মুষ্টি উত্তোলন করে দাঁড়িয়ে পড়ছে উত্তেজনায়। প্রলয় চিৎকার আরম্ভ হয়েছে–ভীম, ভীম! দুর্যোধন, দুর্যোধন–পুরুষাণাং সুবিপুলাঃ প্রণাদাঃ সহসোখিতাঃ।

 গুরু দ্রোণাচার্য দেখলেন–ভীম-দুর্যোধনের দ্বন্দ্বে জনপদবাসীরা যেভাবে পক্ষপাতগ্রস্ত হয়ে একেক জনের প্রতি আত্মীয়তাবোধ করছে–পক্ষপাতকৃতস্নেহঃ স দ্বিধবাভজ্জনঃ–তাতে উৎসাহিত হয়ে এই দুই বীর যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। দ্রোণাচার্য নিজপুত্র অশ্বত্থামাকে কাছে ডেকে বললেন–দেখ,ভীম এবং দুর্যোধন দুজনেই পরম বীর এবং দুজনেই গদাযুদ্ধে পরম সুশিক্ষিত। কিন্তু এঁদের দ্বন্দ্ব অবলম্বন করে দর্শকাসনে যে উন্মাদনা এবং উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে যে কোনও মুহূর্তে এই দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দর্শকাসনে ছড়িয়ে পড়বে। এরা চেঁচাচ্ছে, বাজি রাখছে এবং যেভাবে উত্তেজনা বাড়িয়ে চলেছে, তাতে যে কোনও সময় এদের নিজেদের মধ্যেই লড়াই লেগে যাবে। সেটা না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যোভূদ্রঙ্গে প্রকোপোয়ং ভীম–দুর্যোধনোবঃ! দ্রোণাচার্য অশ্বত্থামাকে বললেন–তুমি যাও। এখনই কোনও কিছু সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাবার আগেই, তুমি এই দুই বীরকে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ থেকে বিযুক্ত করবারয়ৈতৌ মহাবীর্যৌ কৃতযোগ্যাবুবপি।

অশ্বত্থামা নেমে এলেন রঙ্গস্থলে। এসে দেখলেন–প্রলয়কালীন সমুদ্রে হাওয়া লাগলে সমুদ্রের যেমন উথাল-পাথাল অবস্থা হয়, দর্শকদের চিৎকার-পক্ষপাত, বাদ্যধ্বনি এবং উত্তেজনার হাওয়ায় ভীম-দুর্যোধনেরও সেই অবস্থা হয়েছে–যুগান্তানিল-সংক্ষুক্কেী মহাবেলা বিবার্ণবৌ। অশ্বত্থামা, ভীম এবং দুর্যোধনের নাম করে চেঁচাতে লাগলেন। বারবার বলতে লাগলেন–গুরু দ্রোণাচার্য বারণ করছেন, তোমরা বিযুক্ত হও। এর পরেও পূর্ববেগের তাড়নায় আরও দু-একবার গদা হানাহানি করে ভীম এবং দুর্যোধন পরস্পর পরস্পরের দিকে ঘৃণার বাষ্প ছড়িয়ে অগ্নিচক্ষু হেনে অশ্বত্থামার মর্যাদা রক্ষা করলেন–ততস্থাবুদ্যতগদৌ গুরুপুত্রেণ বারিতৌ।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *