০৬৭. ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর

কথা অমৃতসমান ২ — নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী 

প্রারম্ভিক

বড়ো মানুষ গবেষকদের কাছে এটা একটা বড়ো রিডল বটে, বিশেষত যাঁরা মহাভারতের পঙ্কোদ্ধারে নিমগ্ন আছেন, তারা মহাভারতের রঙ্গমঞ্চে কৃষ্ণের প্রবেশটাকে একেবারে নাটকীয়ভাবেই এক নাটকীয় সত্য মনে করেন। মহাভারতের এই সত্যটা তাদের বেশ পছন্দ হয় বলেই কৃষ্ণের পূর্বজীবনের ঘটনা যা কিছুই অন্যত্র বর্ণিত, সেগুলিকে তারা সব সময়েই অসত্য মনে করেন। যদি বা খানিক দয়াপরবশ হয়ে কৃষ্ণের আযৌবন ক্রিয়া কর্মগুলিকে সাহিত্যরসিকতায় তারা মেনেও নেন। তাহলেও মহাভারতের কৃষ্ণের সঙ্গে তার কোনো সঙ্গতি হয় না বলে তাকে নতুন এক রাখাল, কৃষ্ণ বানিয়ে দিয়েছেন। তারা বলে দিয়েছেন–এটা বৃন্দাবনের কৃষ্ণ, ইনি ‘গোপবেশ বেণুকর, নবকিশোর নটবর’, আর উনি দ্বারকার কৃষ্ণ, মহাভারত সূত্রধার।

আমি দেখেছি, এঁরা খুবই উর্বর–মস্তিষ্কের মানুষ এবং এঁদের ঐকদেশিক গবেষণা-মুখর পাণ্ডিত্যের প্রতি আমার আভূমি দণ্ডবৎ রইল। তবে কিনা আমার এই প্রাণারাম পুরুষটি আমার আরাধ্য বলেই নয় শুধু, আযৌবন সেই ‘বয়ঃ কৈশোরসন্ধি’ থেকে তার যে লীলায়িত হওয়ার ইতিহাস আছে তাতে যতখানি বিদগ্ধতা ছিল, ততখানিই চতুরতা ছিল, তা নইলে অতগুলি গোপরমণী–তাঁরা প্রত্যেকেই ভেবেছিলেন–কৃষ্ণ আমারই–এই ভাবনার মধ্যে একদিকে যেমন তার আকর্ষণের চরমত্ব প্রকাশ পায়, অন্যদিকে তেমনই প্রক্রিয়াগত দিক থেকে এই বহু-কান্তা-বিলাসের মধ্যে তার চতুর-চাতুরীরও পরিসর তৈরি হয়ে যায়। আমরা তাই বিশ্বাস করি, বৃন্দাবনে যিনি সর্বতোভাবে ‘অখিলরসামৃত মূর্তি’ কৃষ্ণ, সেই রসের চাতুর্যটুকু-মাত্র তাকে ‘মহাভারত সূত্রধার’ বানিয়ে দিয়েছে। লক্ষণীয়, মহাভারতে কৃষ্ণ যতখানি বীর যোদ্ধা, তার চাইতে হাজার গুণ বেশি তিনি ডিপ্লোম্যাট।

কিন্তু উত্তর জীবনের এই বিশাল কূটনীতিকের যে পূর্বজীবন তা, মহাভারতে ধরা নেই। আমরা মনে করি, মহাভারতকে পুরোপুরি বুঝতে হলে, বিশেষত কৃষ্ণ যেখানে মহাভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছেন, সেটা বুঝতে হলে কৃষ্ণের পূর্বজীবনবৃত্তটুকুও রিকনস্ট্রাক্ট করা দরকার মহাভারতের অনুসারী গ্রন্থ থেকে। আমরা মনে করি, কৃষ্ণের পূর্বজীবন-স্মৃতি মহাভারতের মধ্যেই সূত্রাকারে আছে, কিন্তু সেই সূত্র বিশদে আছে মহাভারতেরই পরিশিষ্ট নামে কীর্তিত খিল হরিবংশের মধ্যে এবং অন্যতম প্রাচীন পুরাণ বিষ্ণুপুরাণের মধ্যে। কৃষ্ণের জীবন-ইতিহাস তৈরি করার ক্ষেত্রে এই দুটি উপাদান অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে এবং আমরা মহাভারতকে পূর্ণরূপে পেতে চাইলে এই দুটি গ্রন্থের প্রতিপূরণী বৃত্তিটাকে গৌণভাবে দেখা যাবে না।

 মনে আছে, থিয়োডর রোজাক তার বিখ্যাত ‘হোয়ার দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড এনডস’ গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছিলেন—‘মিথ বা পুরাণ হল স্বপ্নের এক মোটিফ’–এর মতো, সে ন্যায়ের বিরোধগুলিকে একেবারে বিভ্রান্ত করে দেয়, এখানকার ঘটনা সবই ইতিহাসোত্তীর্ণ ঘটনা, সেগুলি কালের ওপর ছাপ ফেলতে পারে না। এই ঘটনাগুলি সম্বন্ধে কেউ এমন প্রশ্ন তোলে না যে, কখন কোথায় এই ঘটনাগুলি ঘটেছিল, কেননা সেই মিথিক্যাল ঘটনাগুলি নিত্য-বর্তমান। মিথের আখ্যানভাগের যে উপরিতল, তা যেমন গৌণ, তেমনই পৌরাণিক সত্য ঘটনাও সেই অর্থে মোটেই তথ্যনির্ভর নয়, বরং তা সময়হীন অন্তদৃষ্টির অপেক্ষা রাখে, সহস্রভাবে তাকে রূপান্তরিত করা যায়। অতএব পৌরাণিক প্রবণতা একের থেকে অন্যকে বিচ্ছিন্ন করে না, বরঞ্চ তা বিভিন্ন ঘটনারাশি একত্রীকরণ এবং আত্মস্থীকরণের দিকে মন দেয় বেশি। ঐতিহাসিকেরা যা পারেন না পৌরাণিকেরা তা পারেন। পৌরাণিকেরা একে অপরকে বলতে পারেন– কাহিনিটা তুমি এইভাবে বলেছো কিংবা বলল, কিন্তু আমি এইভাবে এটা বলবো। কিন্তু দুরকমের বলাই সত্যি– The meaning of myth lies in the vision of life and nature they hold at their core.

মহাভারত এবং হরিবংশ–বিষ্ণুপুরাণের কৃষ্ণ-কাহিনিকেও আমরা একই জীবন এবং প্রকৃতির দুই ভাবে বলা কাহিনির একত্রীকরণ এবং আত্মীকরণ মনে করি এবং রোজাক বলেছেন– fact is not the truth of myth; myth is the truth of fact. আমরা এই দৃষ্টিতেই মহাভারতের কাহিনি তৈরি করছি বলেই কুলীন কেশকৃন্তক গবেষকদের মতো আদি-মধ্য-অন্ত্য বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মহাভারতের মৌল আকার তুলে আনার দায় নেই আমাদের। আমাদের পৌরাণিক সংবেদনশীলতা আছে বলেই মহাভারতের কবির হৃদয় বুঝে তারই কালের ভৌগোলিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং ব্যবহারিক নিত্য বর্তমানগুলিকে মিশিয়ে দিয়ে মহাভারত পড়ার এবং বোঝার সৌকর্য তৈরি করার চেষ্টা করছি।

আমরা এটাও মনে করি যে, মহাভারত এমনই এক চলমান সত্যের কথা বলে, যেখানে পৌরাণিক সত্যের মধ্যে আধুনিক জীবনের ভাব এবং ভালবাসার বীজন্যাস হয়ে রয়েছে সময়বিহীন অতীত এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার মধ্যে। আমাদের লজ্জা-ভয়, মান-অপমান, ঘৃণা-ভালবাসা অন্য নামে, অন্য রূপে আবর্তিত হচ্ছে মাত্র, কিন্তু সেটা অতীতের বাসনালোক থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আমরা সেই মহাভারতের পাঠ নিতে বসেছি, যাকে পৌরাণিক আধারে একত্র আত্মস্থ করেছি আমরা!

 ‘কথা অমৃতসমান’ একটা চলমান লেখার প্রক্রিয়া, যার প্রথম খণ্ড আপনারা হাতে পেয়েছেন, এবার দ্বিতীয় খণ্ড। লেখাগুলি অনেক কাল আগের। সেগুলিকে পর্যায়ক্রমে একত্র করে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ করার মধ্যে আমার আলস্য এবং অবহেলার সঙ্গে নতুন লেখার যন্ত্রণাও ছিল অপরিসীম। দুটি মানুষ এখানে অন্তরালের নায়ক। এক আমার ছেলে অনির্বাণ, যে এই লেখাগুলিকে একত্র করার দায় নিয়েছিল দিনপঞ্জি মিলিয়ে। দ্বিতীয় জন দে’জ পাবলিশার্স-এর অপু। সে পুঞ্জীভূত লেখাগুলি একত্রে প্রকাশ করার দায়িত্ব নিয়ে দ্বিতীয় খণ্ড অমৃতসমান মহাভারতের প্রকট রূপ তৈরি করেছে। দু-জনের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ।

এই লেখাগুলি যখন লিখেছিলাম, সেই সময়টা আমি বিস্মৃত হইনি। তবে সময়টাতে আমার কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক ব্যস্ত কাল গেছে অধ্যয়নের পরিশ্রমে। সময় তখনও কমই পেতাম, কিন্তু বিভিন্নভাবে সহায়তাও করেছেন অনেকে। তাদের সকলের নামোচ্চারণ করছি না, কিন্তু তারাও আমার মহাভারত-ভাবনার নর্মসহায়। তাদের প্রতি আমার স্নেহ-ভালবাসা রইল।

–নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

.

৬৭.

ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর–এই তিনজনেই ব্যাসের ঔরসে জন্মালেন বটে, কিন্তু এই তিনজনের মধ্যে তরতম আছে। হস্তিনার রাজবংশ লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছিল, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই বংশের শাসন-সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠল বটে, কিন্তু সেই ক্ষত্রিয়-শাসনের প্রগ্রহ টেনে রাখবার জন্য রাজনীতি, দণ্ডনীতি এবং ধর্মনীতির প্রয়োজন আছে। এই সমস্ত নীতিজ্ঞতার আধার হিসেবেই জন্মালেন বিদুর। বস্তুত ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুরের মধ্যে শূদ্ৰাগৰ্ভজাত বিদুরের গুরুত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব যে অন্য ভাইদের তুলনায় অনেক বেশি, সেটা বোঝানোর জন্য মহাভারতের কবি দুটি রাস্তা নিয়েছেন।

এক, বিদুরের মাহাত্ম্য-খ্যাপনের জন্য তাকে বিদুরের পূর্বজন্মের কাহিনী বিবৃত করে প্রায় অবতারবাদের মতো কিছু একটা প্রতিপাদন করতে হয়েছে। দুই, এরপর থেকেই দেখব–তিন ভাইয়ের মধ্যে রাজা কে হবেন, অথবা কোথায় তাদের বিয়ে হবে, অথবা রাজ্যের মধ্যে যখন ‘ক্রাইসিস তৈরি হবে–তখন কী করতে হবে–এই সমস্ত অলোচ্য বিষয়ে এখন থেকে ভীষ্মের পাশে বিদুরকে দেখতে পাব। ক্ষত্রিয়ের শাসন যাতে উদ্দণ্ড না হয়ে ন্যায়ের পথে চালিত হয়, সেটা দেখার জন্য তপস্বী ব্যাস তার একান্ত আপন আত্মজ প্রতিনিধিটি রেখে গেলেন মহামতি ভীষ্মের পাশে।

বিদুরের মতো এত বড় মহানুভব এক ব্যক্তি কেন তথাকথিত হীনযোনি এক শূদ্রার গর্ভে জন্মালেন, সমাজের দৃষ্টিতে সেই হীনজন্মের মাহাত্ম যদি খ্যাপন করতে হয়, তবেও পুরাণের কথক-ঠাকুরকে একটি উপাখ্যান সাজাতে হবেই। হয়ত মহাভারতের মূল কাঠামোর সঙ্গে এই কাহিনী খাপ খায় না, হয়ত এই কাহিনীর ওপর প্রক্ষেপবাদীর দণ্ড নেমে আসবে। কিন্তু তবু এই কাহিনীর প্রয়োজন একটাই। কথকঠাকুরকে জানাতে হবে–কির বড় সাধারণ মানুষ নন, এমনকি ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুরও লাগামটি তিনিই, তিনি ন্যায়-নীতির-ধর্মের আধার। এত কথা বোঝানোর জন্যই হয়ত এই অতিশয়োক্ত উপাখ্যানের আয়োজন।

 বৈশম্পায়ন বললেন–মাণ্ডব্য নামে এক ধর্মজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি ধীর, সত্যপরায়ণ, ধর্মজ্ঞ তপস্বী। তিনি একদিন তার আশ্রমের সামনে একটি গাছের তলায় ঊর্ধ্ববাহু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঊর্ধ্ববাহুর এই সাধনটি অবশ্যই কৃচ্ছসাধনের প্রতীক। মাণ্ডব্য মৌন অবলম্বন করে দীর্ঘকাল ব্রতী ছিলেন–ঊর্ধ্ববাহু-মহাযোগী তস্থৌ মৌনব্রতে স্থিতঃ। এই সময় কতগুলি চোর চুরি করা ধন-সম্পত্তি নিয়ে তার আশ্রমে উপস্থিত হল–দস্যবো লোহারিণঃ। চোরদের এই কাণ্ড-কারখানার খবর রাজ্যের রাজপুরুষদের কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। তারা সময়মতো ধাওয়াও করেছিল চোরদের পিছনে।

চোরেরা মাণ্ডব্য মুনির আশ্রমের আনাচ-কানাচ খুঁজে চুরি করা টাকা পয়সা, গয়নাগাটি সব লুকিয়ে রাখল, আর মুনির আশ্রমে রাজপুরুষের হামলার আশঙ্কা নেই ভেবে সেইখানেই লুকিয়ে রইল। রক্ষী–পুরুষেরাও ওদিকে চোরদের নিশানা খুঁজতে খুঁজতে মাণ্ডব্য মুনির আশ্রমেই এসে উপস্থিত হল এবং মাণ্ডব্যকেও তারা তপস্যারত অবস্থায় দেখতে পেল–আজগাম ততোপশ্যংশুমৃষিং তস্করানুগাঃ। রাজপুরুষেরা প্রথমে বেশ সমীহ করেই কাল-বামুনঠাকুর! কতগুলো চোর বড় মানুষের টাকা-পয়সা চুরি করে এই দিকেই এসেছে। তারা সব কোথায় গেল বলতে পারেন–কলমে পথ যাতা দস্যবো দ্বিজসত্তম।

রাজপুরুষদের কথা মাণ্ডব্য শুনতে পেলেন বটে, তবে একে তিনি মৌনী, তার ওপরে রাজপুরুষদের হাতে চোরেরা মারা পড়বে ভেবে মাণ্ডব্য তাদের কথার কোনও উত্তরও দিলেন না অথবা ভাল-মন্দ, হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না– ন কিঞ্চিচনং রাজন্নব্রবীৎ সাধ্বসাধু বা। রাজপুরুষেরা মুনিকে প্রথমে কিছুই বলল না। কিন্তু নিরুত্তর মুনিকে দেখে তাদের কী মনে হল। ভাবল–মুনির আশ্রমটা একটু খুঁজে পেতে দেখাই যাক না। খুঁজতে গিয়ে তারা একেবারে বামাল চোরদের ধরে ফেলল। চোরদের চুরি-করা ধনসম্পত্তি যদি চোরদের কাছেই খুঁজে পাওয়া যেত তাহলে অত চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু রাজপুরুষদের তাড়নায় সে সব জিনিস যেহেতু মাণ্ডব্য মুনির আশ্রমের আনাচ-কানাচ এবং মাটির তলা থেকেই পাওয়া গেল, অতএব রাজপুরুষদের ঘোরতর সন্দেহ হল যে, মাণ্ডব্য–মুনি নিজেও এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত–ততঃ শঙ্কা সমভব রক্ষিণাং তং মুনিং প্রতি।

রাজপুরুষেরা চোরদের সঙ্গে মাণ্ডব্যমুনিকেও বেঁধে নিয়ে গিয়ে রাজার কাছে নিবেদন করল। এই রাজার দেশের আইন ছিল ভীষণ কড়া। রাজা চোরদের দেখে তৎক্ষণাৎ আদেশ দিলেন–এদের শূলে চড়িয়ে মার। রক্ষী পুরুষরাও রাজার বচন মান্যি করে চোরদের সঙ্গে মাণ্ডব্য মুনিকেও শূলে চড়িয়ে দিল এবং চোরদের অপহৃত ধনসম্পত্তি রাজকোষে জমা দিল।

 মাণ্ডব্য ছিলেন মহাযোগী মুনি। শূলে চড়িয়ে দিলেও তপস্যার প্রভাবে তিনি বেঁচে রইলেন এবং ক্ষুৎপিপাসার জন্যও তার মৃত্যু হল না। তিনি শূলে-বসানো অবস্থাতেও তপস্যায় রত রইলেন এবং আপন যোগ-প্রভাবে অন্যান্য মুনিদেরও তিনি স্মরণ করে কাছে ডাকতে সমর্থ হলেন। অন্যান্য মুনিরা মাণ্ডব্যকে এমন কষ্টকর অবস্থায় দেখে খুব দুঃখ পেলেন এবং বারবার তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন–আপনি কী পাপ করেছিলেন, যার ফলে এই অসম্ভব কষ্ট ভোগ করছেন আপনি–কিংপাপং কৃতবানসি? মাণ্ডব্য বললেন–আমি কাকে দোষ দেব, কেউই আমার কাছে কোনও অন্যায় করেনি, কারও কোনও অপরাধ নেই এই বিষয়ে–দোষতঃ কং গমিষ্যামি নহি মে’নন্যা’পরাধ্যতি।

মাণ্ডব্য তার এই কষ্টের জন্য রাজাকেও দোষ দেন না, রক্ষী-পুরুষদেরও কোনও দোষ দেন না। তারা দেশের আইন অনুসারে যেমনটি যেভাবে বুঝেছে, সেভাবে বিচার করেছে, তাতে তিনি দোষের কিছু দেখেন না। কারও ওপরে তার কোনও বিদ্বেষ নেই। নিজের এই কষ্টের জন্য তিনি রাজার কাছে আত্মখ্যাপন করতেও রাজি নন। কিন্তু সময়ে ঘটনা-প্রবাহ অন্য খাতে বইল। রাজপুরুষেরা হয়ত অন্য কাউকে শূলে চড়াতে এসেছিল অথবা এমনই কোনও কারণে রাজ্যের সেই নির্দিষ্ট বধ্যস্থানে উপস্থিত হয়েছিল। তারা দেখতে পেল–মাণ্ডব্য মুনি যেমনটি ছিলেন তেমনটিই আছেন। তার শরীর কিছু শীর্ণ হলেও শূলের যন্ত্রণা তাকে মোটেই বিচলিত করতে পারেনি। তিনি তপস্যা করে যাচ্ছেন।

রাজপুরুষেরা এই অভাবিত ঘটনা রাজাকে এসে জানাল। রাজাও মাণ্ডব্যমুনির এই অবিচলিত অবস্থার কথা শুনে আত্মীয়-স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই বধ্যস্থানে এসে উপস্থিত হলেন এবং নানা স্তোকবাক্যে মুনিকে তুষ্ট করার চেষ্টা করতে লাগলেন। রাজা বললেন–আমি না জেনে এতবড় ভুল করে ফেলেছি, আপনার সঙ্গে এই সাংঘাতিক দুর্ব্যবহার করার আগে আমি কোনও বিচারই করিনি–যন্ময়াপকৃতং মোহাদজ্ঞানাদ ঋষিসত্তম–আপনি ক্রুদ্ধ হবেন না, মহর্ষি! আমাকে নিজগুণে ক্ষমা করুন।

মহর্ষি অদোষদশী নির্বিন্ন মানুষ। ক্ষমা পেতে রাজার দেরি হল না। রাজা শশব্যস্তে মুনিকে শূলের ওপর থেকে নীচে নামালেন। তারপর শূলের ভগ্ন খন্ড বার করবার চেষ্টা করলেন মহর্ষির শরীর থেকে। গেঁথে যাওয়া শূল বেরুল না। রাজা তখন শূলের বহির্ভাগ কেটে দিলেন। কিন্তু শূলের সেই অন্তর্গত ভগ্নাংশ নিয়েই মাণ্ডব্য নানা দেশে, নানা তীর্থে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। সকলে তার এই প্রভাব দেখে অবাক হয়ে গেল এবং তার নতুন নামকরণ হল অণীমাণ্ডব্য। ‘অণী’ শব্দের অর্থ শূলের অগ্রভাগ। শূলের অগ্রভাগযুক্ত মাণ্ডব্য, অণীমাণ্ডব্য –অণী শূলাগ্রং তদযুক্তো মাণ্ডব্যঃ।

অণীমাণ্ডব্য নানা দেশ পরিভ্রমণ করতে করতে একদিন ধর্মরাজের গৃহে উপস্থিত হলেন। ধর্মরাজ মানুষের ন্যায়-অন্যায় বিচার করেন, মানুষের শুভাশুভ কর্ম তিনি লক্ষ্য করেন। ধর্মরাজ অথবা ধর্ম নামে এই দেবতাটি যে কে, তা নিয়ে রীতিমতো একটা তর্ক হতে পারে। পৌরাণিক দৃষ্টিতে ধর্মরাজকে অনেকেই যমরাজ ভাবেন। কারণ যমও মানুষের ন্যায়-অন্যায় বিচার করে দণ্ডবিধান করেন। কিন্তু মহাভারতের এই ধর্ম বা ধর্মরাজকে কোনওভাবেই পৌরাণিক যমের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলা যায় না। তার কারণ প্রধানত মহাভারতের এই ধর্মদেব বা ধর্মরাজের প্রকৃতির সঙ্গে যমের প্রকৃতি খুব মেলে না, যম দেবতা হিসেবে ধর্ম কোথাও উল্লিখিতও হননি। মহাভারতের যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র বলে পরিচিত, কখনও বা স্বয়ং ধর্মরাজ নামেও তিনি বিশেষভাবে উল্লিখিত। কিন্তু সেই ধর্মের সঙ্গে যমের কোনও সম্বন্ধ আছে বলে মনে হয় না।

পণ্ডিতেরা মনে করেন–মহাভারত যেহেতু বৈদিক যুগের অব্যবহিত পরের যুগে লেখা, তাই বৈদিক দেবতাদের কিছু কিছু প্রতিচ্ছবিও মহাভারতীয় দেব চরিত্রের মধ্যে রয়ে গেছে। যদি তাই হয় তবে ধর্ম বলতে এমন কিছু বোঝাতে পারে যা বৈদিক ঋত শব্দার্থের কাছাকাছি। কিন্তু বৈদিক ঋত শব্দটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এই ধর্ম ঠিক ঋত নয়। বরং বলা ভাল ধর্ম হল সেই সর্বাশ্লেষী মূল্যবোধ যা সকলের ভাল করে। আরও পরিষ্কার করে তাই বলা যায়– এই ধর্ম ঠিক কোনও দেবতা নন, এই ধর্ম এক অনির্দিষ্ট নিরাকার সামাজিক শুদ্ধি, যা সমাজের ভাল করে। মহামতি বিদুর এই ধর্মের প্রতিরূপ, পরবর্তী সময়ে মহারাজ যুধিষ্ঠিরও এই ধর্মেরই আত্মজ।

 আমাদের ধারণা–মাণ্ডব্য এইরকম এক ধর্মরাজের কাছে উপস্থিত হয়েছেন বিচারের আশায়। ধর্মরাজকে তিনি প্রশ্ন করলেন–আমি কী এমন পাপ করেছি যার জন্য এই কষ্টকর শূলের যাতনা ভোগ করলাম–কিং নু তদ্ দুষ্কৃতং কর্ম ময়া কৃতমজানতা। ধর্মরাজ বললেন–আপনি পূর্ব জন্মে একটি ফড়িং-এর পুচ্ছদেশে নলখাগড়ার শিষ প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন, যার জন্য এই যম-যন্ত্রণা ভোগ করতে হল আপনাকে। ধর্মরাজ সুযোগ পেয়ে একটু জ্ঞানও দিয়ে দিলেন মুনিকে। বললেন–ব্রহ্মর্ষি! দান যদি অল্প একটুও করা যায় তবু তা ফল দেয় অনেক। আর পাপ যদি অল্পও হয় তবু তা দুঃখ দেয় অনেক।

 অণীমাণ্ডব্য এবার ঠাণ্ডা মাথায় ধর্মরাজকে প্রশ্ন করলেন–আচ্ছা ধর্মরাজ! আমি কোন বয়সে এই ফড়িং-এর পাপটি করেছিলোম, ঠিক ঠিক বলুন তো দেখি–কস্মিন্ কালে ময়া তত্ত্ব কৃতং ব্ৰহি যথাতথ। ধর্মরাজ বললেন–আপনি আপনার বালক বয়সেই এই কাজটি করেছিলেন–বালভাবে ত্বয়া কৃতম্। অণীমাণ্ডব্য বললেন–জন্ম থেকে বার বছর পর্যন্ত বালকেরা যে অন্যায় অপরাধ করে, তাতে কি কোনও পাপ হয়। দেবতারা পর্যন্ত এই বাল্য-চপলতাকে খুব একটা আমল দেন নান ভবিষ্যত্যধর্মো ন প্রজ্ঞাস্যত্তি বৈ দিশঃ। অণীমাণ্ডব্য এবার ধর্মরাজকে রীতিমতো দোষী সাব্যস্ত করে যুক্তি দিয়ে বললেন–আপনি অতি লঘু পাপে গুরুদণ্ড বিধান করেছেন–অল্পেপরাধেপি মহান মম দণ্ডঃ ত্বয়া কৃতঃ।

অণীমাণ্ডব্য ধর্মরাজকে অভিশাপ দিলেন–ধর্মরাজ! আপনি অন্যায়ভাবে আমাকে যে যন্ত্রণা দিয়েছেন তার জন্য আপনি মানুষ হয়ে শূদ্রযানিতে জন্মাবেন–শূদ্রযোনাবতো ধর্ম মানুষঃ সম্ভবিষ্যসি। এই অভিশাপের সঙ্গে সঙ্গে অণীমাণ্ডব্য একটি আইনও তৈরি করে দিলেন। বললেন–আজ থেকে আমি নিয়ম করে দিলাম–চোদ্দ বছরের কম যাদের বয়স, তারা যদি কোনও অন্যায় করে, তাহলে তাদের কোনও পাপ হবে না–আচতুদর্শকাদ বান্ন ভবিষ্যতি পাতকম। চোদ্দ বছরের ওপর বয়স হলে নিশ্চয় তার অন্যায় কাজটা অন্যায় বলেই গণ্য হবে।

মহাভারতের কবি এবার মন্তব্য করেছেন–অণীমাণ্ডব্যের অভিশাপে ধর্মরাজ স্বয়ং বিদুররূপে শূদ্রের গর্ভে জন্ম নিলেন–ধর্মো বিদুররূপেণ শূদ্রযোনবজায়ত। আমরা জানি–শূদ্রাণীর গর্ভে জন্ম নিয়েও বিদুর যেহেতু ক্রোধলোভ বিবর্জিত এক মহান দীর্ঘদশী, ধর্মজ্ঞ পুরুষ হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন, তাই এই উপাখ্যানের অভিশাপের অবতারণা। অন্যথায় ন্যায়দণ্ডের অধিষ্ঠাত্রী স্বয়ং ধর্ম মানুষের মধ্যে জন্মাবেন কী করে? চোদ্দ বছরের বালক যদি অন্যায় করে, তবে তার অন্যায়কে শাস্তির পর্যায়ে আনা উচিত নয়–এইরকম একটা আইন, যা সে কালের জুভেনাইল কোর্টের আওতায় আনলে এই উপাখ্যানের তাৎপর্য নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু অণীমাণ্ডব্যের শাপে স্বয়ং ধর্মরাজ বিদুররূপে জন্মালেন, নাকি বিদুরের অমানুষী স্বভাব এবং অসম্ভব ধর্মজ্ঞতার পরিচয় পেয়েই মহাভারতের কথকঠাকুর এক শূদ্রাণীর গর্ভকে উপাখ্যানের সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখলেন–তা সহৃদয় পুরুষের অনুভববেদ্য –আমাদের নিবেদন এইটুকুই।

ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর জন্ম এবং বিদুরের পূর্ব-জন্মের উপাখ্যান বিবৃত হওয়ার পরপরই মহাভারতের মধ্যে একটা স্বস্তির পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। আরও লক্ষণীয়, শান্তনুর তিনটি বংশধর জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে মহামতি ভীষ্ম আরও প্রবল হয়ে উঠলেন। তার অস্ত্র এবং শাসনের প্রভাব এমনিতেই সর্বত্র বিরাজমান ছিল, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুদের জন্মে ভরতবংশের ধারা অব্যাহত রইল–শুধু এই স্বস্তিতেই যেন কিছু শত্রুরাষ্ট্র ভীষ্মের বাহুবলে হস্তিনার সঙ্গে সংযুক্ত হল–স দেশঃ পররাষ্ট্রাণি বিমৃদ্যাভিপ্রবর্ধিতঃ।

রাজতন্ত্রের শাসনে যদি খোদ রাজবাড়ির মধ্যেই সমস্যা থাকে এবং সে সমস্যা যদি উত্তরাধিকারীর সমস্যা হয়, তবে পররাষ্ট্রীয় তো বটেই, অন্তঃরাষ্ট্রীয় শাসনেও একটা সার্বিক অকর্মণ্যতা, তথা হচ্ছে-হবে গোছের গড়িমসি তৈরি হয়। শান্তনুর দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর ক্রমান্বয় হস্তিনার রাজশাসনে যে নিস্তরঙ্গ অবসাদ তৈরি করেছিল, ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুদের জন্মে সেই অবসাদ ঘুচে গেল। অবসাদ ঘুচল ভীষ্মেরও, যিনি এতদিন হয়ত বা খানিকটা দার্শনিক নির্বিন্নতায় ভুগছিলেন। হস্তিনার রাজবংশে তিন পুত্রের জন্মে ভীষ্ম পরম উৎসাহ বোধ করছেন। পররাষ্ট্র জয়ের মধ্যে দিয়ে যে উৎসাহের সূচনা হল, সে উৎসাহ ক্ষান্ত হল রাজ্যের সর্বত্র যজ্ঞগৃহ এবং পশুযাগের জন্য পশুবন্ধন স্তম্ভ স্থাপন করে –বভূব রমণীশ্চ চৈত্যযুপশঙ্কিত। আমাদের বিশেষ ধারণা–রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বৈদিক ব্রাহ্মণদের যজ্ঞকার্যে যেমন সুবিধে করে দিতেন রাজারা, তেমনি ওই গৃহগুলি জমির সীমা-নির্ধারণের কাজেও ব্যবহৃত হত।

দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে এই সব অন্তঃরাষ্ট্রীয় কাজকর্মে এতদিন কারও মন ছিল না, এমনকি সদা-উৎসাহী ভীষ্মও বোধহয় অবসাদে ভুগছিলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুদের জন্মলগ্ন থেকেই ভীষ্ম হস্তিনার সর্বত্র তার মহান প্রভাব ছড়িয়ে দিলেন এবং প্রজাবর্গের সার্বিক সুরক্ষায় মন দিলেন। মহাভারতের কবি লক্ষ্য করেছেন–ভীষ্ম কর্তৃক এই পররাষ্ট্রজয়ের নীতি এবং অন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে প্রজাগণের সার্বিক সুরক্ষার নীতির মধ্যে তার সাম্রাজ্যবাদী জয়ৈষণা যতখানি ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল ন্যায় এবং ধর্মের নীতি–ভীষ্মেণ ধর্মতো রাজন সর্বতঃ পরিরক্ষিতে।

আমরা একটু আগেই একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে বলেছি–স দেশঃ পররাষ্ট্রাণি বিমৃদ্যাভিপ্রবর্ধিতঃ–অর্থাৎ শত্রুরাষ্ট্রগুলি বিমর্দন করার পর সেগুলি হস্তিনার সঙ্গে যুক্ত হল এবং হস্তিনাপুরের সীমানা বাড়ল। এখানে এই বিমৃদ্য (বিমর্দন করে) শব্দটির অন্য একটি পাঠ আছে। সেটা হল বিসৃজ্য এবং টীকাকার নীলকন্ঠের ধৃত পাঠ এইটিই। বিসৃজ্য মানে ছেড়ে দিয়ে। অর্থাৎ পররাষ্ট্রগুলি ছেড়ে দিয়েও হস্তিনাপুরীর সীমানা বেড়ে গেল। পররাষ্ট্রগুলি ছেড়ে দিলে অথবা হস্তিনার সঙ্গে সেগুলি সংযুক্ত না হলে যে সে দেশের সীমানা বাড়ে না, তা মূখেও বোঝে। নীলকণ্ঠ তাই বলেছেন–পররাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ভীষ্ম যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে না গেলেও, সেগুলি নিজের উন্নতির জন্যই স্বেচ্ছায় হস্তিনার সঙ্গে সংযুক্ত হল–বিসৃজ্য পররাষ্ট্র অপি সুখার্থিনোত্রৈব প্রবিষ্টা ইত্যর্থঃ।

 নীলকণ্ঠ কেন এই পাঠ ধরেছেন তার একটা বড় কারণ হল ওই উদ্ধৃত শ্লোকাংশের দ্বিতীয় পংক্তিটি। বস্তুত পররাষ্ট্রের রাজারাও যে আপন সুখৈষণায় হস্তিনার রাজ্যমণ্ডলে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তার কারণ, ভীষ্ম তার রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্মচক্রের প্রবর্তন করেছিলেন–ভীষ্মেণ বিহিতং রাষ্ট্রে ধর্মচক্র অবর্তত।

 ধর্মচক্র–শব্দটা শোনা-শোনা লাগছে না? এই অসাধারণ শব্দটির উপপাদনের জন্য আমাদের দুটি নিবেদন আছে। প্রথমত এই পংক্তির বঙ্গানুবাদ সিদ্ধান্তবাগীশ মহোদয় যেভাবে করেছেন, আমরা তার সঙ্গে একমত নই। ধর্মচক্রের প্রবর্তন প্রসঙ্গে হরিদাস লিখেছেন –ভীষ্মের বিধান অনুসারে সেই রাজ্যে সর্বদাই ধর্মকার্যের অনুষ্ঠান চলিয়াছিল। আমাদের নিবেদন–ধর্মচক্রের অর্থ ধর্মকার্য হতে পারে না। একটি সাধারণ মানুষও জানে যে ধর্মচক্র শব্দটি খুব কম হলেও সম্রাট অশোকের সমবয়সী। তিনিই তার রাজ্যে ধর্মচক্রের প্রবর্তন করেছিলেন, যে ধর্মচক্র এখনও অত্যন্ত বাস্তবভাবে ব্যবহৃত। সম্ভবত ধর্মচক্রের ব্যাপারে এই বৌদ্ধ সংস্ৰবই হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের অনুবাদ-চেতনাকে বিপ্রতীপভাবে অন্য পথে প্রবাহিত করেছে; তিনি ধর্মচক্র বলতে ধর্মকার্য বুঝেছেন।

আমাদের ধারণাধর্মচক্র শব্দটি সম্রাট অশোকের চেয়েও পুরনো। ভীষ্মের শাসন প্রধানত ব্রাহ্মণ্য-ভাবনায় চিহ্নিত হলেও তৎকালীন ব্রাহ্মণ-সমাজ বা ক্ষত্রিয়-সমাজকে এতটা অনুদার ভাবার কোনও কারণ নেই। এ কথাও ভাবার কারণ নেই যে, মহামতি ভীষ্ম কোনও আকালিক বৈরাগ্যে চণ্ডভীষ্ম থেকে ধর্মভীষ্মে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি যে কোনও ক্ষত্রিয় রাজার মতো ভীষ্মকেও জর্জরিত করত। কিন্তু এই মুহূর্তে, বিশেষত কিছুদিন ধরেই কুরু-রাজবংশের উত্তরাধিকারে বিপন্নতা তৈরি হওয়ার জন্যই হোক, অথবা এই মুহূর্তে তিনটি রাজকুমারের জন্মের আনন্দেই হোক, ভীষ্ম যখন পুনরায় হস্তিনানগরীকে তার পুরাতন বৈশিষ্ট্য বা মাহাত্ম্যে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন, তখন প্রথম কল্প হিসেবে তিনি ধর্মচক্রের প্রবর্তন করেছিলেন। ধর্মচক্র মানে যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে না গিয়ে পররাষ্ট্রের রাজার কাছে হয়ত দূত পাঠানো হত, হয়ত বলা হত–দেখ! আমরা যুদ্ধ-বিগ্রহ চাই না, তোমরা তোমাদের ছোট্ট দেশের বৃহত্তর উন্নতির জন্য হস্তিনার সঙ্গে যুক্ত হও এবং এই সংযুক্তির প্রতীক হিসেবে হস্তিনার নামাঙ্কিত একটি যজ্ঞগৃহ তৈরি করো তোমাদের রাজ্যপ্রান্তে, যাতে লোকে বুঝতে পারে হস্তিনার প্রভাব কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত।

পরবর্তী সময়ে মহাভারতের অন্য প্রসঙ্গের অলোচনায় আমরা এইটুকু দেখানোর সুযোগ পাব যে, বৌদ্ধ ধর্ম এবং দর্শনের অনেক ভাবনা-চিন্তা যেমন ব্রাহ্মণ্য-ভাবনার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বেড়ে উঠেছে, তেমনি অনেক ব্রাহ্মণ্য-ভাবনাও বৌদ্ধ প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। আপাতত এবং অন্তত এই ধর্মচক্রের ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত যে, ধর্মচক্র প্রবর্তনের ঘটনাটি সম্রাট অশোকের মস্তিষ্কজাত কোনও নতুন উদ্ভাবন নয়, তার অনেক আগেই ধর্মচক্রের প্রবর্তন ঘটেছিল এবং তা ঘটেছিল অনেক ব্রাহ্মণ্য প্রভাবিত রাজাদের আমলেই, যেমন ভীষ্মের আমলে, যুধিষ্ঠিরের আমলে। মহাভারতে এই শব্দ বারংবার ব্যবহৃত বলেই আরও সন্দেহ হয় যে, ধর্মচক্র শব্দটি বৌদ্ধ অশোকের বয়োজ্যষ্ঠ অন্তত।

ভীষ্ম প্রবর্তিত ধর্মচক্রের প্রকৃতি অশোকের ধর্মচক্রের সমগোত্রীয় কিনা, সে তর্কে না গিয়েও বলা যায় সেই সময়ে মহামতি ভীষ্ম এক সার্বিক প্রজা-মঙ্গলের কার্যে ব্রতী হয়েছিলেন। ভূমি শস্যপূর্ণা অথবা লোকের মনে পাপ নেই বলে সর্বত্র যেন সত্যযুগের আবহাওয়া ফিরে এসেছে। এ ঘটনা খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয়– প্রদেশেপি রাষ্ট্রানাং কৃতং যুগমবর্তত। কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কুয়ো খোঁড়া, দিঘি কাটা, উপবন, সভা বা ব্রাহ্মণ ভবনের প্রতিষ্ঠা–কৃপারাম সভা–বাপ্যো ব্রাহ্মণাবসথাস্তদা– এগুলি জন কল্যাণের তাৎপর্য বহন করে বলেই সম্রাট অশোকের কার্যপ্রণালীর সঙ্গে তা মিলে যায়। ধর্মচক্রের সমগোত্রীয়তা সেইখানেই।

পৌর-জনপদবাসীদের মধ্যে এক অনির্বচনীয় আনন্দের পরিবেশ ফিরে এল এবং সর্বত্রই দাও-দাও আর খাও-খাও শব্দের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি–দীয়তাং ভুজ্যতাঞ্চেতি ভীষ্মের শাসনকেই মহিমান্বিত করে তুলল। মহাভারতের কবিকে তাই অধ্যায়ের প্রথমেই মন্তব্য করতে হল–শান্তনুর বংশে তিনটি কুমার জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে কুরুজাঙ্গল, কুরু এবং কুরুক্ষেত্র এই তিনটি প্রদেশেরই সার্বিক উন্নতি ঘটল–ত্রয়মেত অবর্ধত–এবং উন্নতি এখনও পর্যন্ত ভীষ্মের তত্ত্ববধানেই সংঘটিত–ভীষ্মেণ ধর্মতো রাজ সর্বতঃ পরিরক্ষিতে।

.

৬৮.

নিজের তত্ত্বাবধানে ভীষ্ম যেমন কুরুরাষ্ট্রের সামগ্রিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন, তেমনই কুরুবংশের ধারায় যে তিনটি বালককে তিনি বিচিত্রবীর্যের পুত্র হিসেবে পেয়েছিলেন তাদের তিনি মানুষ করতে লাগলেন পিতার মমতায় জন্ম প্রভৃতি ভীষ্মেণ পুত্রবৎ প্রতিপালিতাঃ। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদ্যুরের জাতকর্মাদি থেকে আরম্ভ করে উপনয়ন সংস্কার পর্যন্ত সবই একে একে সম্পন্ন করালেন ভীষ্ম। মনে রাখতে হবে, সে যুগের নিয়মে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য–এই তিন বর্ণের মানুষেরই উপনয়ন হত। ক্ষত্রিয় যাঁরা, যারা ভবিষ্যতে রাজ্যরক্ষা, প্রজাপিলনের মতো গুরুদায়িত্ব বহন করবেন, তারা শুধু রাজার ছেলে বা শাসক-সম্প্রদায়ের প্রতিভূ বলে নিরন্তর সুখভোগ করে যাবেন, এমনটি হত না সেকালে। পড়াশুনো, ব্রহ্মচর্য, অস্ত্রশিক্ষার জন্য একজন ক্ষত্রিয়কে যথাসম্ভব কৃচ্ছসাধন করতে হত এবং এই কৃচ্ছসাধনের প্রথম সোপান ছিল–গুরুকুলে গিয়ে বেদাধ্যয়নের আরম্ভ।

ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুদের উপনয়ন সংস্কার হয়ে গেলে ভীষ্ম তাদের গুরুকুলে বেদ পড়তে পাঠালেন। তাঁরা ব্রহ্মচারী হয়ে মুনি-ঋষির অরণ্য-আশ্রমে বেদ-পাঠ শেষ করে আরও অনেক পড়াশুনা করলেন। বেদের সঙ্গে বেদের ছন্দ, শিক্ষা, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ–এই সব বেদাঙ্গও তাঁদের জানতে হল। কারণ রাজারা সেকালে যজ্ঞ করতেন এবং যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণদের রীতি-নীতি নিয়ম সম্বন্ধে তাদের অবহিত থাকতে হত। ইতিহাস-পুরাণও কিছু পড়তে হল।

অবশ্য ইতিহাস বলতে পরবর্তীকালে যেমন রামায়ণ-মহাভারত বোঝাত, ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুরা নিশ্চয়ই তা পড়েননি। তবে ব্রাহ্মণ-গ্রন্থগুলির মধ্যে রাজাদের কথাবার্তা যা কিছু আছে অথবা তাঁদের অতীত সময়ের যে সমস্ত পুরাকাহিনী আছে–সেগুলি তাদের জানতে হত। আপনারা মহাভারতের মধ্যে নানা প্রসঙ্গে নানা বিশিষ্ট রাজকাহিনী শুনতে পাবেন, যা কখনও ধৃতরাষ্ট্রকে শোনানো হচ্ছে, অথবা তারা নিজেরাও কখনও পুরাকাহিনী অন্যের কাছে বলছেন। এগুলিকে যাঁরা প্রক্ষিপ্ত মনে করেন, করুন; আমাদের ধারণা–এই পুরাতন পুরাণ-কাহিনী রাজাদের শোনানো হত এই কারণে, যাতে কাহিনী শুনে শ্রোতা রাজা নিজের শাসন-পথ ঠিক করতে পারেন।

পাঠক্রমের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শারীরশিক্ষা এবং অস্ত্রশিক্ষা ছিল আবশ্যিক বিষয়। শারীরশিক্ষার শুরু দৌড়ানো দিয়ে এবং মল্লযুদ্ধের অভ্যাসটা ছিল মাধ্যমিক পাঠ। কারণ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাজাকে পালাতেও হতে পারে, সেজন্য দৌড়ানোটা শেখা চাই। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রভার সব শেষ হয়ে গেলে পরস্পর মল্লযুদ্ধই সেখানে রীতিমতো ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। অতএব এগুলো শেখা চাই। ধনুর্বেদ, অশ্বযুদ্ধ, গদাযুদ্ধ, অসি-যুদ্ধ এবং হস্তিযুদ্ধ–এই সমস্ত শিক্ষাই তিন কুরুরাজকুমারকে দেওয়া হল, যেমন অন্যান্য ক্ষত্রিয় রাজকুমারকে দেওয়া হয়। ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু অন্ধ ছিলেন, তাই অন্য কোনও যুদ্ধই তার পক্ষে সুবিধেজনক হল না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের শারীরিক শক্তি ছিল অসীম এবং সে শক্তি অন্য সবার চাইতেই তার বেশি ছিল–অন্যেভ্যো বলবানাসী ধৃতরাষ্ট্রো মহামতিঃ।

স্বাভাবিকভাবেই পাণ্ডু ধনুক-চালনায় সব থেকে কৃতী হয়ে উঠলেন। কিন্তু ধনুর্বেদ, অসিযুদ্ধ অথবা মল্লযুদ্ধ কোনওটাই যিনি ভাল করে শিখতে পারলেন না, তিনি হলেন বিদুর। তার স্বভাবটা যেহেতু অনেকটাই ছিল ব্রাহ্মণের মতো, তাই তিনি খুব ভাল করে শিখলেন ধর্মনীতি, রাজনীতি এবং সাধারণ নীতি। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন–তিন ভুবনে বিদুরের মতো ধর্মজ্ঞ এবং নীতিনিষ্ঠ ব্যক্তি তখন আর কেউ ছিলেন না–ধর্মনিত্যস্তথা রাজন ধর্মে চ পরমং গতঃ। বলা বাহুল্য–এ ধর্ম পুষ্প কিংবা বিপত্রের ধর্ম নয়, এই ধর্ম রাজ্যশাসনের আইন থেকে আরম্ভ করে জনহিতকর সমস্ত নীতিশাস্ত্রকেই বোঝায়।

ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর–এই তিনটি পুত্ৰই যখন বিদ্যালাভের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন, তখন তারা পূর্ণ যুবক। তিনজনকে দেখেই তখন হস্তিনার লোকেরা ভরসা পেতে শুরু করল। তারা নিজেরা নিজেরা বলাবলি করতে লাগল–হ্যাঁ, শান্তনুর বংশ একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি, রাজা ভাগ্য করেছিলেন বটে তাই এমন তিনটি ছেলে জন্মেছে এই বংশে। সত্যবতী এবং ভীষ্মের চেষ্টায় হস্তিনার রাজবংশ পুনরুখিত হয়েছে দেখে পৌর জনপদবাসীরা এই তিন পুত্রের জন্ম-সম্বন্ধ নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। তারা বলেছে–ধন্যি জননী বটে এই অম্বিকা আর অম্বালিকা, যাঁদের ঘরে এমন বীর পুত্র জন্ম নিয়েছে। আর দেশ বটে আমাদের এই হস্তিনাপুরী যেখানে ভীষ্মের মতো এমন মহামতি মানুষ রয়েছেন–সর্বধর্মবিদাং ভীষ্মঃ পুরাণাং গজসাধ্বয়ম্।

 ব্রাহ্ম-সংস্কার, অস্ত্রশিক্ষা এবং পৌর-জনপদবাসীদের প্রশংসায় রঞ্জিত হওয়ার পর রাজবাড়ির যুবকদের সামনে একটিই মাত্র লক্ষ্য বাকি থাকে–রাজ সিংহাসন। মহাভারতের কবি এমন অনাড়ম্বর ব্যঞ্জনায় রাজসিংহাসনে অন্যতম এক রাজকুমারের অভিষেক বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের ভারি আশ্চর্য লাগে। শান্তনুর বংশ প্রায় লুপ্ত হতে বসেছিল, অধিষ্ঠিত রাজা মারা গেছেন, এতদিন পরে রাজসিংহাসন পূর্ণ হতে চলেছে, অথচ সেই অভিষেকের কোনও আড়ম্বর নেই। বিশেষত মহাকাব্যের বর্ণনায় যেখানে অতি সাধারণ বস্তুও বর্ণময় হয়ে ওঠে, সেখানে এই নিরাভরণ তথ্য-বর্ণনা আমাদের যেমন পীড়া দেয়, তেমনই সন্দেহের উদ্রেক করে।

সংক্ষেপে কবি লিখলেন–ধৃতরাষ্ট্রের চক্ষু না থাকায় তিনি পৈতৃক রাজ্যে অধিকার পেলেন না– ধৃতরাষ্ট্রস্তু অচক্ষুট্টা রাজ্যং ন প্রতিপদ্যত। অন্যদিকে বিদুর যেহেতু ব্রাহ্মণের ঔরসে শূদ্রার গর্ভজাত সন্তান, তাই তিনিও কোনওভাবেই রাজ্যের অধিকারী হতে পারেন না। বাকি থাকেন পাণ্ডু, তিনি রাজা হলেন–পারশবত্বা বিদুরো রাজা পাণ্ডুবর্ভূব হ।

মহাভারতের কবির এই আকস্মিক এবং অনাড়ম্বর ভাষণে ভীষণভাবে মনে হয়–এই নিয়ে রাজপরিবারের মধ্যে এবং বাইরে অনেক কথা হয়েছিল, কিন্তু কথাগুলি যেহেতু কারও কাছেই সুখকর নয় তাই সেসব কথার মধ্যে তিনি যাননি। কথাগুলি কেন সুখকর নয়, তার কারণ জানাই একটু। প্রথম কথা হল সেকালের আইন। সবাই জানেন সেকালে রাজতন্ত্র বংশ-পরম্পরায় চলত এবং রাজবংশের জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজা হতেন। এই নিয়মের ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রম যখন ঘটত, তা আইন অনুসারেই ঘটত।

 এখন এই আইনটা কী? সেকালের আইনের বই বলতে বোঝায় ধর্মশাস্ত্রগুলিকে যেমন মানব ধর্মশাস্ত্র, বৃহস্পতি-নীতি, শুক্রনীতি ইত্যাদি। মানব-ধর্মশাস্ত্র বলতে মনুসংহিতা বুঝায়। সত্যি কথা বলতে কি, সংসার, সমাজ এবং রাজনীতি সম্বন্ধে মনু যত কথা বলেছিলেন সবই এই সংহিতাতে ধরা আছে কি না, তাতে সন্দেহ আছে। কারণ সংহিতা মানে মোটামুটি সংকলন। হয়ত মনু যত কথা বলেছিলেন তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশগুলি এই সংহিতা গ্রন্থে ধরা আছে। মহাভারতের মধ্যে ভীষ্ম, বিদুর, যুধিষ্ঠিরের মুখে মনুর নীতি-কথা আমরা অনেক শুনতে পাব। এই সব কথার সবই যে মনুসংহিতায় ধরা আছে, তা নয়। আবার মনুসংহিতায় যা আছে তাও সব মহাভারতে পাওয়া সম্ভব নয়।

একটা কথা মনে রাখতে হবে। মনুর লেখায় ব্রাহ্মণ্য প্রভাব সাংঘাতিক এবং শূদ্র ইত্যাদি বর্ণের সম্বন্ধে তার মানসিকতা খুব যে মানবিক, তা মোটেই নয়। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য সমাজের ভাবধারার সম্বন্ধে মনুসংহিতায় যা খবর পাওয়া যাবে, এমনটিও কোথাও নয়। তাছাড়া রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিবাহ-সম্বন্ধ, এমনকি পশুপক্ষী-প্রতিপালন এবং পরিবেশ-সংরক্ষণ সম্বন্ধেও মনুর এতখানি ভাবনা-চিন্তা আছে, যা এখনকার দৃষ্টিতেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল কিছু কিছু দুলালী ধরনের প্রাজ্ঞম্মন্য প্রগতিবাদীর সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁরা ভারতবর্ষের ইতিহাস, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র কিছুই পড়েননি, অথচ বড় বড় মন্তব্য করতে বড়ই দড়। এঁরা মনুর নাম শুনলেই মনে করেন। তিনি জ্যান্ত একটি নরপশু ছিলেন এবং দলিত তথা পিছড়ে বর্গের প্রতি তিনি ছিলেন ভীষণ অকরুণ।

 আবারও বলি– সমাজের নিম্নবর্গের সম্বন্ধে মনুর একান্ত বিদ্বেষ সর্বজনবিদিত, কিন্তু অল্পত ব্যক্তিরা এই বিদ্বেষটুকুর ওপরেই শুধু মনুর বিচার করেন, মনুর আর কিছু তারা দেখতে পান না। এটা ঠিক নয়। আরও একটা কথা আজকের পরিশীলিত নাগরিক মনন নিয়ে দুহাজার বছর আগের মনন যদি বিচার করতেই হয়, তবে নিরপেক্ষ সমাজতাত্ত্বিকের সম-ব্যথা নিয়েই তা করতে হবে, নইলে সুশিক্ষিত মানুষও মনুর মতো একই দোষে দুষ্ট হবেন। অর্থাৎ মনুর ব্যাপারে তারাও একপেশে।

বংশ-পরম্পরায় রাজার আসনে যিনি অধিষ্ঠিত হবেন, তিনি অবশ্যই জ্যেষ্ঠ পুত্র। অর্থাৎ এই নিয়মে ধৃতরাষ্ট্রই রাজ্যলাভের অধিকারী। কিন্তু মনু লিখেছেন– তৎকালীন দিনে নিয়ম ছিল– কেউ যদি নপুংসক হন, সমাজে পতিত হন, কেউ যদি কানে কালা বা জন্মান্ধ হন, তার পক্ষে রাজা হওয়া সম্ভব নয়– অনংশৌ ক্লীব-পতিতৌ জাত্যন্ধবধিরৌ তথা। এই নিষেধের মধ্যে একটা বাস্তব কারণ অবশ্যই আছে। একজন অন্ধ বা বধির যদি রাজা হন, তবে তার আঙ্গিক প্রতিবন্ধকতার জন্যই তিনি সুষ্ঠুভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন না। মন্ত্রী, সেনাপতি আর গুপ্তচর দিয়েই যদি সুষ্ঠুভাবে রাজ্য চালানো সম্ভব হত, তাহলে আর রাজার প্রয়োজন হত না। কিন্তু মন্ত্রী, অমাত্য, সেনাপতিদের যদি সত্যিই সাধারণ প্রজাবর্গের মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করতে হয়, তাহলে এমন একজন রাজার প্রয়োজন, যিনি সদা সতর্ক এবং শারীরিক দিক দিয়েও অত্যন্ত নীরোগ এবং বিকারহীন।

 শুধু মনুই নয়, ধর্মশাস্ত্রকারদের মধ্যে অনেকেই আঙ্গিক বিকারযুক্ত একজন ক্ষত্রিয়কে রাজা। হিসেবে দেখতে চাননি। শুক্রাচার্য যে নীতি-নিয়ম তৈরি করেছিলেন, সেইগুলিই শুক্ৰনীতিসারে সংকলিত হয়েছে কি না, সে সম্বন্ধে সন্দেহ থাকলেও এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, রাজবংশের জ্যেষ্ঠপুত্রটি যদি মূক, বধির, অন্ধ অথবা কুষ্ঠরোগী হন তবে হয় তার পরের ছোট ভাই রাজ্য পাবেন, নয়তো সেই বিকারী রাজার বড় ছেলে রাজ্য পাবেন–রাজ্যার্যে ন ভবেন্নৈব ভ্রাতা তৎপুত্র এব হি। ঠিক এই কারণেই ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য পেলেন না। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন তার ছোট ভাই পাণ্ডু।

এখানে বিদুরের রাজা হওয়ার প্রশ্ন আসেই না, কারণ তিনি জাতিতে পারশব। ব্রাহ্মণের ঔরসে কামনাবশত যে পুত্রটি শূদ্রার গর্ভে জন্মেছে, আইনের পরিভাষায় তার নাম হল পারশব–যং ব্রাহ্মণস্তু শূদ্রায়াং কামাদুৎপাদয়েৎ সুতম্। বিদুর হলেন পারশব। কিন্তু মহাভারতের কবি পাণ্ডুর রাজ্যপ্রাপ্তির প্রসঙ্গে বিদুরের নাম উচ্চারণ করলেন কেন, তা ভাল করে বোঝা যায় না। বিদুর পারশব বলে তিনিও রাজ্য পেলেন না–পারশবত্বা বিদুরঃ–এই অজুহাতটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা য়ায়–পাণ্ডুর রাজ্যলাভের সময় নানা কথাই হয়েছে। বড় ভাই অন্ধ হলে তার ছোট ভাই রাজা হবেন– এই যেখানে আইন সেখানে পাণ্ডুর রাজা হবার মধ্যে তো কোনই প্রশ্নচিহ্ন থাকে না। তবু কেন বিদুরের নাম উচ্চারণ করা হল তিনি তো একে সর্বকনিষ্ঠ এবং তার ওপরে পারশব।

এই সামান্য অতিশয়োক্তি থেকেই বোঝা যায়– ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য থেকে বঞ্চিত হবার সময় নিশ্চয় নানা কথা, নানা তর্ক হয়েছিল। হয়তো এমন কথাও হয়েছিল যে, অম্বিকা এবং অম্বালিকা– এই দুই রানীর গর্ভজাত দুটি ছেলেই তাহলে রাজসিংহাসন থেকে বঞ্চিত হোন আর রাজা হোন বিদুর। হয়তো তর্কের খাতিরেই তখন বিদুরের জন্মসম্বন্ধের সমস্যাটি বড় হয়ে দেখা দেয়। তিনি যে পারশব, তিনি রাজা হবেন কী করে? অতএব মধ্যম ভাই পাণ্ডুই রাজা হোন। সর্বসম্মতভাবে তাই পাণ্ডুই রাজা হলেন– রাজা পাণ্ডু-বভূব হ।

পাণ্ডু রাজা হবার পরেই আমরা একটি ছোট্ট আলোচনাসভার আয়োজন দেখতে পাচ্ছি। এই আলোচনা হচ্ছে দুটি মানুষের মধ্যে একজন রাজবাড়ির জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি ভীষ্ম, অন্যজন কনিষ্ঠতম বিদুর। ধর্মশাস্ত্রের আইন অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজপদে নিযুক্ত হয়ে গেলে তার অন্যান্য ছোট ভাইদের রাজ্যশাসন–সংক্রান্ত বড় বড় পদে নিযুক্ত করা হত। কেউ প্রাদেশিক রাজ্যের শাসনভার পেতেন, কেউ কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হতেন, কেউ বা শাসনসংক্রান্ত কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিদুর যে পাণ্ডুর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আজকের এই আলোচনা-সভায় তিনি মন্ত্রী হিসেবে ভীষ্মের সঙ্গে আলোচনা করতে বসেননি। ভীষ্ম এই রাজবংশের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিদুরের মত যাচনা করছেন এবং সে বিষয়টা এমনই যে সেখানে অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে বিদুরের মত গ্রহণ করাটা সত্যিই আশ্চর্যের। তবে যত আশ্চর্যেরই হোক, এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় বিদুর কতটা অসাধারণ এবং কতটাই বা তিনি পণ্ডিত, যার জন্য স্বয়ং রাজাকে বাদ দিয়ে সংসারের কনিষ্ঠতম ব্যক্তিটির সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন ভীষ্ম।

ভীষ্ম বললেন–বিদুর! আমাদের এই কুরুরাজ বংশ সমকালীন সমস্ত রাজবংশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ এবং তেমনই এর গুণ গুণৈঃ সমুদিতং সর্বৈরিদং নঃ প্রথিতং কুলম্। আমার পূর্ব-পুরুষ যাঁরা, তার যেমন উদারহৃদয় রাজা ছিলেন, তেমনই ছিল তাদের ধর্মবোধ আর নীতিবোধ। তারা এতকাল এই রাজ্য রক্ষা করছিলেন বলেই এই বিশাল বংশ এখনও লুপ্ত হয়ে যায়নি– নোসাদমগমচ্চেদং কদাচিদিহ নঃ কুলম্।

অনুমান করা যায়– যৌবনপ্রাপ্ত ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর তাদের অনন্যসদৃশ জন্মবৃত্তান্ত জেনে গেছেন এতদিনে এবং একথা লুকিয়ে রাখার নিয়ম কিংবা অস্বাচ্ছন্দ্য কোনওটাই ছিল না সেকালে। কিন্তু লুপ্তপ্রায় শান্তনুবংশ রক্ষায় ভীষ্ম নিজে এবং জননী সত্যবতী কত চেষ্টা করেছেন, সে কথাটা ভীষ্ম একবার খ্যাপন না করে পারলেন না। বললেন–জান বিদুর! এই আমি, জননী সত্যবতী এবং অবশ্যই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস– এই তিনজনে মিলে কী চেষ্টাই না করেছি এই লুপ্তপ্রায় শান্তনুর বংশকে পুনঃস্থাপন করার জন্য ময়া চ সত্যবত্যা চ কৃষ্ণেন চ মহাত্মনা। তা এখন সেই বংশের তিনটি অঙ্কুর হলে তোমরা তিনজন, যাঁরা এই কুলতন্তুকে অচ্ছিন্ন রেখে দিয়েছ এবং তোমাদের ওপর আমরা নির্ভর করি।

ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুরের গৌরবে ভীষ্ম এতক্ষণ গৌরবে বহুবচন ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এবার বিদুরের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলোচনার সূচনা হচ্ছে। ভীষ্ম বললেন– তোমার এবং আমার দুজনকেই একটা কাজ করতে হবে–তথা ময়া বিধাতব্যং ত্বয়া চৈব বিশেষতঃ। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে আমাদের এই বংশ সাগরের মতো বৃদ্ধি পায়।

ভীষ্ম যে এই বংশের সাগরোপম বৃদ্ধি চান, তার একটা কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। তিনি চিত্রাঙ্গদের মৃত্যু দেখেছেন, তাঁর ছোট ভাই বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুও দেখেছেন। এ দু-দুটি মৃত্যুর পর শান্তনুর বংশ যেভাবে লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছিল, তাতে তিনি শঙ্কিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বেদব্যাসের করুণায় এই বংশ কোনও মতে রক্ষা পেয়েছে বটে, কিন্তু শঙ্কা এখনও যায়নি। তিনি নিশ্চয় ভাবতেন– মূল রাজবংশে একটি-দুটি সন্তান কোনও কাজের কথা নয়। শান্তনুর রাজবাড়ি যদি আরও কয়টি পুত্র-কন্যায় ভরা থাকত, তাহলে, তার সঙ্কট হত অনেক কম। এখন তিনি আর ঝুঁকি নিতে চান না। তিনি চান–সংসারে এমন বউ আসুক যার অনেক পুত্র হবে। তাতে আর কিছু না হোক রাজবংশের ভবিষ্যৎ হবে নিরাপদ, নিঃসঙ্কট।

ভীষ্ম তিন কুরুকুমারকে এতদিন ধরে মানুষ করেছেন। তাদের বিবাহ দিয়ে কুলের অনুরূপ কয়েকটি বউ আনতে পারলেই তার আপাতত মুক্তি। সেই পিতার আমল থেকে তিনি শুধু ছেলে মানুষ করে আসছেন, কিন্তু রাজবংশের স্থিতিশীলতা তবুও আসেনি। এখন তিনি চান রাজকুমারেরা এমন এমন জায়গায় বিবাহ করুন, যেখানে বংশের বৃদ্ধি সুনিশ্চিত এং সে বৃদ্ধি ঘটবে সাগরের মতো তস্যৈত বর্ধতে ভূয়ঃ কুলং সাগরব যথা। কিন্তু বংশবৃদ্ধির ব্যাপারে ভীষ্মের এই নিশ্চয়তার কারণও ঘটেছে ইতোমধ্যেই।

মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণরা যাঁরা তীর্থ করতে বেরন, তাঁরা নিজেদের ধর্মীয় কাজ-কর্ম শেষ হয়ে গেলে তীর্থ–নিকটের রাজবাড়িতে অতিথি হতেন। রাজারা ব্রাহ্মণ মুনি-ঋষির কাছে কিছু লুকোতেন না। কার ঘরে বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে, তার স্বভাব-চরিত্র কীরকম, দেবতা এবং অতিথির ব্যাপারে তাদের ব্যবহার কী রকম– এই সমস্ত খবর ব্রাহ্মণেরা পেয়ে যেতেন। এই সমস্ত ব্রাহ্মণ-ঋষির কাছেই ভীষ্ম কিছু খবর পেয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর বিবাহ দেবার জন্য তিনি পূর্বাহ্নেই ব্যস্ত হয়েছেন এবং কোথায় কোন রাজবাড়িতে সুলক্ষণা সুন্দরী মেয়ে আছে– সে খবরও তিনি পাচ্ছিলেন।

 ব্রাহ্মণরা ভীষ্মকে জানিয়েছিলেন গান্ধাররাজ্যের রাজা সুবলের একটি পরমা সুন্দরী মেয়ে আছে। গান্ধারের মেয়ে বলে তার নামও গান্ধারী অথ শুশ্রাব বিপ্রেভ্যো গান্ধারীং সুবলাত্মজা। ভীষ্ম আরও শুনলেন–গান্ধারী নাকি ভগবান মহাদেবের আরাধনা করে বর লাভ করেছেন যে, তিনি শত পুত্রের জননী হবেন– গান্ধারী কিল পুত্রানাং শতং লেভে বরংশুভা।

ভীষ্মের কাছে এই খবরটা অত্যন্ত জরুরী ছিল। শান্তনুর অবক্ষীণ বংশের তিক্ত অভিজ্ঞতায় তিনি এখন এই বংশের সাগরোপম বৃদ্ধি চান, তার কাছে এই সংবাদ অত্যন্ত জরুরী। কুরুবংশের জ্যেষ্ঠ পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের ধারায় যদি এক শত পুত্রের জন্ম হয়, তাহলে অন্তত রাজা হবার জন্য মানুষের অভাব হবে না–আপাতত ভীষ্মের এইটাই শান্তি। গান্ধারী ছাড়া তিনি কুন্তীর কথাও শুনেছেন। শুনেছেন যে, সন্তানলাভের ব্যাপারে তিনিও স্বাধীনোপায়া, তিনি ঋষির আশীর্বাদধন্যা।

 ভীষ্ম এই সমস্ত সংবাদ বিদুরকে জানালেন। বললেন–আমাদের কুলমর্যাদার উপযুক্ত একটি কন্যার কথা শুনেছি। তিনি যাদবদের মেয়ে– শ্রূয়তে যাদবী কন্যা স্বানুরূপা কুলস্য নঃ। আবার গান্ধাররাজ সুবলেরও একটি মেয়ে আছে বলে ব্রাহ্মণরা আমাকে জানিয়ে গেছেন। মদ্রদেশের রাজার মেয়েটিও বিবাহযোগ্যা। সব মেয়েই সুন্দরী, বংশ ভাল, শিক্ষা ভাল, এঁদের বাপ-মা ভাইরাও এই মেয়েদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। কাজেই আমাদের ঘরে এই সম্বন্ধগুলি উপযুক্ত হবে– উচিতাশ্চৈব সম্বন্ধে তেস্মাকং ক্ষত্রিয়ভাঃ।

পুত্রলাভের বিষয়ে গান্ধারী এবং কুন্তী যে বর লাভ করেছেন, সে কথাও বিদুরকে তিনি নিশ্চয় সবিস্তারে জানিয়েছিলেন। কারণ ভীষ্ম তার পূর্ব অভিজ্ঞতায় ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর ধারায় যে অনেক পুত্রসন্তান কামনা করেন সে কথা বিদুরের কাছে প্রকাশ করতে দ্বিধা করলেন না। বিদুরকে তিনি বললেন আমি এই বংশের সন্তানবৃদ্ধি কামনা করে এই বিবাহ সম্বন্ধগুলিই মোটামুটি পছন্দ করেছি। এ ব্যাপারে তোমার মত কী বিদুর– সন্তানার্থং কুলস্যাস্য যদ্বা বিদুর মন্যসে?

সংসারের সর্বকনিষ্ঠ ধর্মজ্ঞ বিদুর এ বিষয়ে ভীষ্মের ওপরে আর কী কথা বলবেন? বিশেষত তাঁর দাদাদের বিবাহ-সম্বন্ধ ঘটছে– এ তার কাছে অতি আনন্দের কথা। তাছাড়া কনিষ্ঠ ব্যক্তিকে গুরুতর সম্মান দিলে গুরুজনের সামনে স্ফীত না হয়ে নিজের মাত্রা কীভাবে রাখতে হয়, সেই শিক্ষাটাও পাওয়া যাবে বিদুরের জবাবে। ভীষ্ম বলেছিলেন– আমি এই ঠিক করেছি, তুমি এ ব্যাপারে কী মনে কর, বিদুর-যদ্বা বিদুরো মন্যসে? বিদুর উত্তর দিলেন– আপনি আমাদের পিতা, আপনিই আমাদের মা, আপনিই আমাদের গুরু-বান্ পিতা ভবান্ মাতা ভবা নঃ পরমো গুরুঃ।

বিদুর জানেন– মহামুনি বেদব্যাস তাদের জন্মদাতামাত্র, কিন্তু জন্মাবধি এই ভীষ্ম তাদের সমস্ত সঙ্কট থেকে রক্ষা করেছেন, তাই তিনিই তাদের পিতা। ভীষ্মই তাদের পালন-পোযণ করেছেন, তাই তিনি মাতাও। আবার তিন ভাইকে ধর্মনীতি, রাজনীতি এবং অস্ত্রশিক্ষার মূল পাঠগুলি ভীষ্মই শিখিয়ে দিয়েছেন বলে, তিনিই তাদের পরম গুরু। বিদুর তাই উত্তর দিলেন– এই বংশের কল্যাণ এবং মঙ্গলের প্রয়োজন বুঝে আপনি যা ভাল মনে করেন, তাই করবেন, সেটাই আমার মত– তস্মাৎ স্বয়ং কুলস্যাস্য বিচাৰ্য কুরু যদ্ধিতম।

বিদুরের সম্মতি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই মহামতি ভীষ্ম গান্ধাররাজ সুবলের কাছে দূত পাঠালেন। তিনি জানালেন– হস্তিনাপুরের রাজজ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র বিবাহ করবেন। আপনার কন্যাটিকে হস্তিনাপুরের বধূ হিসেবে আমরা যাচনা করছি। ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের অঙ্গ-বিকার মোটেই লুকোলেন না। কারণ বিয়ে না দেবার পক্ষে গান্ধাররাজ সুবলের এই একটিই মাত্র যুক্তি ছিল– অচক্ষুরিতি তত্রাসীৎ সুবলস্য বিচারণা।

এই করুণ বিচারটুকু সুবলকে পীড়া দিলেও হস্তিনাপুরের রাজবংশের খ্যাতি, রাজজ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের সম্মান এবং চরিত্র মাথায় রেখে ধৃতরাষ্ট্রের হাতেই দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারীকে তুলে দেবেন বলে ঠিক করলেন–দদৌ তাং ধৃতরাষ্ট্রায় গান্ধারীং ধর্মচারিণীম্।

.

৬৯.

হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু-বিদুরদের জন্ম, রাজ্যলাভ এবং বিবাহের পর আমাদের তাকাতে হবে ভারতবর্ষের আরো একটু উত্তর-পশ্চিমে। কেননা এই রাজ্যের সঙ্গে সেই রাজ্যের সামাজিক, বৈবাহিক এবং রাজনৈতিক যোগাযোগ ঘটবে। আগেই বলেছি– মথুরা শূরসেন অঞ্চলে যারা রাজত্ব করতেন, তাঁরা একনায়ক রাজতন্ত্রে খুব একটা বিশ্বাস করতেন না। তাদের রাজ্যগুলি ছোট ছোট রিপাবলিক বা সংঘে বিভক্ত ছিল। অবশ্য সংঘগুলির নেতা যাঁরা ছিলেন, তারা সবাই যদুবংশের অধস্তন বৃষ্ণি, ভোজ, অন্ধক অথবা কুকুর-গোষ্ঠীর মুখ্য পুরুষ। আবার এই বৃষি, অন্ধক, ভোজদের মধ্যেও ছোট ছোট উপগোষ্ঠী ছিল। তাদের নিজেদের জমি-জায়গা ছিল, দলও ছিল, যদিও বৃহত্তর রাজনৈতিক সামাজিক সমস্যায় এঁরা সব সময়েই গোষ্ঠী-প্রধানদের অনুগামী ছিলেন।

 ভোজ–বংশের কুলাঙ্গার কংস যখন আপন শ্বশুর মগধরাজ জরাসন্ধের গৌরবে গর্বিত হয়ে মথুরা-শূরসেনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন কিন্তু অন্ধক, কুকুর, বৃষ্ণিবংশীয়রা সকলেই, এমনকি ভোজবংশীয়রাও কেউ কেউ কংসের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে যেহেতু এমন কোনও বিশিষ্ট পুরুষ ছিলেন না, যিনি নিজের এবং নিজের গোষ্ঠীর স্বার্থ অতিক্রম করে সমস্ত ভোজ-অন্ধক-কুকুরের সমস্ত দল-উপদল একত্রিত করতে পারেন, তাই কংস বড় সুবিধের মধ্যে ছিলেন। তাঁর অত্যাচারও বেড়ে চলছিল দিন দিন।

কৃষ্ণের পিতা বসুদেব ছিলেন বৃষ্ণি-কুলের জাতক এবং বসুদেবের পিতা আর্যক শূরও ছিলেন অবশ্যই সেই বৃষ্ণি-কুলেরই অলঙ্কার। মহাভারতে না পেলেও আমরা হরিবংশের প্রমাণে জানি আর্যক শূর বিয়ে করেছিলেন তাদের পালটি ঘর ভোজবংশের মেয়েকেই। প্রধান রাজবংশ বলে কথা, সেই ঘরের মেয়ের সম্বন্ধে সবারই স্বপ্ন থাকে। তা ছাড়া তিনি যখন বিয়ে করেছেন তখনও কংস হয়তো সিংহাসনে বসেননি, অথবা বসলেও তেমন অত্যাচারী হয়ে ওঠেননি।

 নিজে বৃষ্ণি বংশে জন্মালেও আর্যক শূরের একটা আলাদা টান ছিল এই ভোজবংশের প্রতি। তিনি নিজে তো ভোজবংশের মেয়েকে বিয়ে করেছেন আবার তার পিসিরও (পিতা দেবমীঢুষের বোন) বিয়ে হয়েছিল ওই ভোজবংশেই। আর্যক শূরের পিসেমশাই যে ভোজবংশের খুব নামী-দামী লোক ছিলেন তা মোটেই নয়, তবে একটি উপগোষ্ঠীর নেতা অবশ্যই ছিলেন এবং তার একটি রাজ্যও ছিল। আর্যক শূরের পিসির কোলে যে ছেলেটি হয়, তিনি ছিলেন শূরের চেয়ে অনেক বড়। তার নাম ছিল কুন্তিভোজ। আমাদের ঘরে মামাতো-পিসতুতো ভাইয়ে ভাইয়ে যেমন ভ্রাতৃত্ব ছাড়াও এক গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তেমনই বন্ধুত্ব ছিল কুন্তিভেজের সঙ্গে আর্যক শূরের। বয়সে অনেক বড় হলেও কুন্তিভোজ তার মামাতো ভাইটিকে এতই ভালবাসতেন যে, তাঁর সঙ্গে ভাইয়ের সম্বন্ধ থেকেও বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই বড় হয়ে উঠেছিল।

মথুরার কংস-রাজ্য থেকে কুন্তিভোজের ছোট্ট শাসন-ভূমি যে খুব দূরে তা মনে হয় না। মহাভারতে অবশ্য কুন্তিভোজ নামে একটি রাজ্যের নাম পাব। পাণ্ডব-কনিষ্ঠ সহদেব যখন রাজসূয় যজ্ঞের জন্য দিগবিজয়ে বেরোবেন, তখন তিনি কোনও এক কুন্তিরাষ্ট্র জয় করবেন। কুন্তিরাষ্ট্রের নাম উল্লিখিত হয়েছে নবরাষ্ট্র এবং কুমার দেশের সঙ্গে। পণ্ডিতেরা অনেকে কুমারদেশকে উত্তরপ্রদেশের গাজিপুরের সঙ্গে একাত্ম মনে করেন, আবার কেউ বা এটাকে ফেলেছেন দক্ষিণ কানাড়ায়। তবে ওড়িশার রাজা নেওভঞ্জদেবের জুরাদা দানলিপিতে একটি কুমারপুরের নাম পাওয়া যায়, যার অবস্থিতি ওড়িশার গঞ্জাম জেলার বহরমপুর তালুকে। এই কুমারপুরের সঙ্গে মহাভারতে উল্লিখিত কুমার-বিষয়ের তফাৎ নেই খুব। আর কুমার শব্দের সঙ্গে বিষয় শব্দটি থাকায় পণ্ডিতরা মনে করেন, এটি কুন্তিভোজেরই একটি অঙ্গরাজ্য ছিল। কুস্তিভোজের পাশেই হল নবরাষ্ট্র যেটা সহদেব জয় করেছিলেন কুন্তিরাষ্ট্রের সঙ্গেই।

মহাভারতে পাণ্ডবরা যখন বনবাস শেষ করে অজ্ঞাতবাসের কথা চিন্তা করছেন, তখন কোন রাজ্যে সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে থাকা যাবে, সেই নিয়ে কুরুরাজ্যের আশেপাশেই কয়েকটা দেশের নাম করেছিলেন অর্জুন–সন্তি রম্যা জনপদ বন্নাঃ পরিতঃ কুরূন্। সেখানে পাঞ্চাল-চেদি-মৎস্যের সঙ্গে কুন্তিরাষ্ট্রেরও নাম আছে–কুন্তিরাষ্ট্রং সুবিস্তীর্ণং সূরাষ্ট্রাবন্তয়স্তথা। এখানে যে সুবিস্তীর্ণ কুন্তিরাষ্ট্রের কথা আছে সেটা অর্জুনের মুখে গৌরবে অতিশয়োক্ত বলে মনে হয়, কারণ কুন্তিরাষ্ট্রের রাজা কুন্তিভোজ সম্পর্কে তাঁর মাতামহ।

 আমাদের ধারণায় কুন্তিরাষ্ট্র কুরুরাজ্যের পরবর্তী রাজ্যগুলির অন্যতম হলেও এ রাজ্য ছিল মথুরার কাছেই এবং রাজ্যটা বোধহয় খুব বড়ও নয়। আমরা যে পূর্বে ভোজগোষ্ঠীর মধ্যে নানা উপগোষ্ঠীর কথা বলেছি, সেটাকে মহাভারতের ভাষায় আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলা যায়– ভোজরা সবাই মিলে অন্তত আঠারোটা উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন উদীচ্যাশ্চ তথা ভোজা কুলান্যষ্টাদশ প্রভো। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আগে মহামতি কৃষ্ণ আঠারোটি ভোজ-গুষ্টির উল্লেখ করে বলেছিলেন তারা সবাই জরাসন্ধের ভয়ে পুব দিক ছেড়ে পশ্চিম দিকে চলে এসেছেন। এই আঠারো ঘর ভোজদের মধ্যে কুন্তিরাষ্ট্রও আছে– সুস্থলাশ্চ মুকুটাশ্চ কুলিন্দাঃ কুন্তিভিঃ সহ।

কৃষ্ণ আরও একটা কুন্তিরাষ্ট্রের নাম করেছেন– পূর্বাঃ কুস্তিষু কোশলাঃ। তাতে বোঝা যায়– কুন্তিদেশের লোকেরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন পূর্বকুন্তি এবং অপর-কুন্তি। সন্দেহ নেই যে, এই অপর-কুন্তির মানুষরাই জরাসন্ধের ভয়ে অপেক্ষাকৃত পশ্চিমে এসে থানা গেড়েছিলেন, এবং তাদের রাজা ছিলেন কুন্তিভোজ। বরেন্দ্রভূমির লোকেরা গোষ্ঠী পরিচয়ের সময় সেকালে জিজ্ঞাসা করতেন– আপনারা কোথাকার ভাদুড়ী, কোন জায়গার সান্যাল বা লাহিড়ী। উত্তর আসত– পাবনার বা রাজশাহীর অথবা ফরিদপুরের। একইভাবে আর্যক শুরের এই পিসতুতো ভাইটি ছিলেন কুন্তিদেশের ভোজ, অতএব তার নামই হয়ে গেল কুন্তিভোজ। তিনিও জরাসন্ধের ভয়েই অন্যত্র পলায়িত।

 কুন্তিভোজের বয়স অনেক হয়ে গেছে। কিন্তু তার কোনও সন্তান হয়নি এখনও। ওদিকে বৃষ্ণি-কুলের রাজপুরুষ আর্যক শূরের বিয়ে হয়ে গেছে কবেই। তার কয়েকটি সন্তানও হয়ে গেছে। সকলেই অবশ্য ছোট ছোট। খিল-হরিবংশ থেকে জানতে পারছি–আর্যক শূরের প্রথম পুত্র নাকি কৃষ্ণপিতা বসুদেব-বসুদেবো মহাবাহুঃ পূর্বমানকদুন্দুভিঃ। বসুদেবের জন্মের পর নাকি দেবভাগ, দেবশ্রবা, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি আরও নয়টি পুত্র জন্মায় আর্যক শূরের ঘরে। আর এই দশটি পুত্র জন্মের পরে তার ভোজরানীর গর্ভে আরও পাঁচটি কন্যা-সন্তানের জন্ম হয়। পঞ্চ চাস্য বরাঙ্গনাঃ।

সাধারণ মানুষের ঘরে এমন সুশৃঙ্খলভাবে পুত্র-কন্যা জন্মায় না। প্রথমে সবচেয়ে গুণবান পুত্রটি জন্মাল, তারপর গোটা নয়েক এলেবেলের জন্ম হল এবং সবার শেষে লাইন দিয়ে পাঁচটি মেয়ে জন্মাল–এইরকম সুশৃঙ্খল জন্ম-প্রক্রিয়া একান্তই অসম্ভব বলে মনে হয়। স্পষ্টতই বোঝা যায় হরিবংশের কথকঠাকুর-কৃষ্ণপিতা, অর্থাৎ ভগবত্তার চিহ্নে চিহ্নিত কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের মাহাত্মে আপ্লুত হয়ে তাকে আর্যক শূরের জ্যেষ্ঠপুত্রের মর্যাদা দিয়েছেন এবং শূরের অন্যান্য পুত্র-কন্যাদের বসুদেবের অনুজম্ম করে রেখেছেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে মহাভারতের সূত্রগুলি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়–বাস্তবে ঘটনা ঘটেছিল অন্যরকম।

আমাদের ধারণা– আর্যক শূরের তখন কয়েকটি ছেলেপিলে হয়ে গেছে। সন্তান জন্মের আহ্লাদে তার গৃহ এবং মন দুইই ভরে উঠছে দিন-দিন। হয়তো এইরকম একটা সময়ে নিঃসন্তান অধিকবয়স্ক কুন্তিভোজ আর্যক শূরের হাত ধরে বললেন– তোমার তো ভাই অনেক পুত্র-কন্যা। তা আমাকে একটি দাও না ভাই। একটি সন্তান মানুষ করে পিতৃত্বের কিছু স্বাদ পাই অন্তত। ভাই এবং বন্ধু কুন্তিভোজের করুণ কথা শুনে আর্যক শূরের মনে বড় মায়া হল। তিনি বলে বসলেন–ঠিক আছে, আমার প্রথম সন্তানটিকেই তুলে দেব তোমার হাতে–অগ্রমগ্রে প্রতিজ্ঞায় স্বস্যাপতং তু সত্যবা।

টাকাকার নীলকণ্ঠ মহাভারতের এই পংক্তিটি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে মনে হবে যেন কোনও পুত্র-কন্যার জন্মের আগেই আর্যক শূর তাঁর এই নিঃসন্তান বন্ধুকে কথা দিয়ে বলেছিলেন যে, আমার প্রথম সন্তানটিকেই তোমার হাতে তুলে দেব। মহাভারতের এই বচন অনুযায়ী প্রথম সন্তানটিকেই যে তিনি তাঁর পিসতুতো ভাই কুন্তিভোজের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই–পিতৃস্বসৃয়ায় স মনপত্যায় ভারত এবং সেই কন্যার নাম অবশ্যই পৃথা। এতে আরও প্রমাণ হয়ে যায় যে কৃষ্ণপিতা বসুদেব আর্যক শূরের প্রথম সন্তান ছিলেন না মোটেই। আর্যক শূরের প্রথম সন্তান একটি কন্যা এবং তাঁর নাম পৃথা। প্রতিজ্ঞার সময় যে কথা বলেছিলেন– অমগ্রে– অর্থাৎ প্রথম সন্তানটি দেব, তাতে যদি ভাল বোঝা না যায়, কিছু যদি অস্পষ্ট থাকে, তাই দ্বিতীয়বার মহাভারতের কবি বললেন প্রথমজাতা কন্যাটিকে আর্যক শূর দত্তক হিসেবে সমর্পণ করলেন সন্তানার্থী কুন্তিভোজের হাতে অগ্ৰজামথ তাং কন্যাং শূরোনুগ্রহকাক্ষিণে। কুন্তী অগ্রজা, আর্যক শূরের সমস্ত সন্তানের মধ্যে তিনি বড়।

 পৃথার জ্যেষ্ঠতা প্রমাণ হল। এখন দেখার তাঁর জন্মের আগেই আর্যক শূর এই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নাকি ওই সময়ের মধ্যে তাঁর আরও কয়েকটি পুত্র-কন্যা জন্মে গিয়েছিল এবং তাদের সবার বড়টিকেই তিনি তুলে দিয়েছিলেন কিনা কুন্তিভোজের হাতে। নীলকণ্ঠ যতই বলুন, আমাদের ধারণা আর্যক শূর তার পুত্র-কন্যার জন্মের আগেই কুন্তিভোজের কাছে। কোনও প্রতিজ্ঞা করেননি। মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে, কৃষ্ণ যখন যুদ্ধশান্তির জন্য কৌরব সভায় গেলেন, ঠিক তার আগে কুন্তির সঙ্গে দেখা করেছিলেন কৃষ্ণ কুন্তি তখন তার অসংখ্য দুঃখের কথা জানাতে গিয়ে কৃষ্ণকে বলেছিলেন– দুর্যোধনকে দোষ দিয়ে কী করব, বাবা! দোষ দিলে, দিতে হয় আমার পিতাকে পিতরবে গহেঁয়ং নাত্মানং ন সুযোধন। তুমি চিন্তা করতে পার, তখনও আমার পুতুল খেলার বয়স যায়নি, আমি তখনও কন্দুক নিয়ে খেলা করি। আর সেই অবস্থায় আমার পিতা, মানে তোমার পিতামহ আর্যক শুর তার বন্ধু কুন্তিভোজের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আমাকে বালাং মামার্যকস্তভ্যং ক্রীড়ন্তীং কন্দুকহস্তিকা।

কন্দুক শব্দের অর্থ গুলিও হতে পারে, বলও হতে পারে। সেকালের দিনে এই খেলা ছোটদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই খেলার চল ছিল। আমাদের জিজ্ঞাস্য– যে ছোট্ট মেয়েটি গুলি কিংবা বল নিয়ে খেলছে, তার বয়স কোনও অবস্থাতেই পাঁচ থেকে দশের কম ছিল না। কুন্তীর নিজের মুখের কথাটাই যেহেতু সত্য বলে ধরে নেওয়া উচিত, তাই নিঃসন্দেহে বলতে পারি–আর্যক শূরের বাড়িতে বেশ কয়েক বছর প্রতিপালিত হওয়ার পর পৃথাকে কুন্তিভোজের পিতৃত্বের আস্বাদ পূরণের জন্য দত্তক নেওয়া হয়।

আর্যক শূরের বাড়িতে কিছুদিন মানুষ হওয়ার পর যখন তার প্রথমজাতা কন্যাটির বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হয়েছে, যখন তার বালিকা কন্যাটি শূরগৃহের নায়ক আর্যক শূরকে পিতা বলে চিনেও নিয়েছে, হয়তো তখনই তাকে কুন্তিভোজের কাছে দত্তক দেওয়া হয়েছে বলেই পৃথার মনে এই ঘটনা এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার রূপ নিয়েছিল। আজ এই বৃদ্ধ বয়সেও সে ঘটনা তার স্পষ্ট মনে আছে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যদি আর্যক শূর তাঁর অবোধ শিশুকন্যাকে বন্ধুর কাছে দিয়ে দিতেন, তাহলে এই ধরনের কথা আমরা কুন্তীর মুখে শুনতাম না। কুন্তীর এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার নিরিখে স্পষ্টতই মনে হয় আর্যক শূরের ঘরে যখন আরও কয়েকটি ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে এবং পৃথা যখন মুকুলিকা বালিকা-বয়সী–বালাং কন্দুকহস্তিকা– তখনই মথুরার রাজভবন ছেড়ে পৃথা কুন্তিরাজের রাজভবনে উপস্থিত হন। হরিবংশের বয়ান থেকে একথা আরও স্পষ্ট বোঝা যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে–আর্যক শূরের পুত্র-কন্যাগুলির মধ্যে থেকে কুন্তিভোজ পৃথাকেই দত্তক নেবার জন্য বরণ করেছেন পৃথাং দুহিতরং বরে কুস্তিস্তাং কুরুনন্দন। এই দত্তক-গ্রহণের মধ্যে সেকালের আইন-কানুনও হয়তো মানা হয়েছিল।

 পরিষ্কার বোঝা যায়– কৃষ্ণপিতা বসুদেব তার বাবা আর্যক শূরের প্রথম পুত্র যদিও বা হন, কিন্তু প্রথম সন্তান কখনও নন। কুন্তীই সবার বড় এবং তাকে যেহেতু যজ্ঞাদি সম্পন্ন করেই দত্তক দেওয়া হয়েছে এবং যেহেতু আর্যক শূরের কোনও স্বত্ব ছিল না এই কন্যার ওপর, অতএব হরিবংশে বসুদেবই প্রথম সন্তান হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন।

গবেষণা এবং তর্ক ছেড়ে এবারে চলে আসি সেই ছোট্ট বালিকাটির কাছে, যে তার পিতা  আর্যক শূরের রাজভবনের বালক্রীড়া ত্যাগ করে কুন্তিরাষ্ট্রের রাজা কুন্তিভোজের বাড়িতে এলেন। এ ঘটনা যদি বিবাহ সূত্রে শ্বশুরবাড়ি আসার মতো কোনও ঘটনা হত, তাহলে বলতাম, সেকালের দিনে এমন ঘটনা অনেক ঘটত, কাজেই নিয়তির মতো সে ঘটনা মেনেও নিতে হত। কিন্তু এ তো তা নয়, এ তো বাপের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর ঘরে আসা নয়। এ যে এক বাবা ছেড়ে আরেক বাবার কাছে আসা। তাছাড়া পৃথার তখন বুদ্ধি হয়েছে। জন্ম থেকে এক পরিচিত বাবা-মাকে বাবা-মা ডেকে আরেক বাড়িতে যেখানে নবযৌবনের আধার স্বামী-সুখের মতোও কিছু নেই– সেইরকম একটি বাড়িতে আরেক জনকে বাবা-মা বলতে কেমন লেগেছিল পৃথার, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে মহাভারতের একান্তে এক কোণে।

এ প্রমাণ পেলে নারী-প্রগতিবাদীদের মনে বিস্ময় জাগবে। প্রগতিবাদীরা বলেন সেকালের দিনে স্ত্রীলোকের কোনও সম্মান ছিল না। পুরুষশাসিত সমাজে তাদের ধন-সম্পত্তি, গয়না-গাটির সাযুজ্যে ভাবনা করা হত। তাদের স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। আমরা এসব কথা মানি। কিন্তু মনে করবেন না– এই যে প্রতিবাদ প্রগতিবাদীদের মুখে শাণিত হচ্ছে, তা এই বিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা–মণ্ডিত নব যুগের অবদান। কুন্তী দুঃখ করে বলেছিলেন–আমি নিজেকেও দোষ দিই না, দুর্যোধনকেও দোষ দিই না, আমি দোষ দিই আমার বাবাকে যিনি নাম কেনার জন্য তাঁর বন্ধুর কাছে দান-ছত্তর করেছিলেন আমারই মাধ্যমে যেনাহং কুন্তিভোজায় ধনং বৃত্তৈরিবার্পিতা।

এটা কিন্তু দুঃখ বললে ভুল হবে। একালের দিনেও এমন কথা বলে কজন রমণী প্রতিবাদ করতে পারেন সন্দেহ আছে। কুন্তীর কথাটা টীকাকার নীলকণ্ঠ বুঝিয়ে বলেছেন এইভাবে ধনী মানুষ যেমন অজস্র টাকা-পয়সা দান-ছত্তর করে মহাদানী বলে নাম কেনেন–কুন্তী বলেছেন– আমার পিতাও তেমনি আমাকে তার বন্ধুর কাছে দান করে খুব মান পেলেন– বৃত্তৈবদান্যত্নেন খ্যাতৈর্ধনং যথা অক্লেশেন অর্পতে, তবৎ যেনাহ অর্পিতা।

পরিষ্কার বোঝা যায়–বৃদ্ধ বয়সে যাঁর মুখ দিয়ে আপন পিতার বিরুদ্ধে এই ধরনের আধুনিক প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে, তাঁর বালিকা বয়সে পূর্বকথিত ওই দত্তকের ঘটনা কী মর্মান্তিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল! আর্যক শূরের ঘরের শিশুকন্যাটি কন্দুক ক্রীড়া ছেড়ে যেন পরিণত রমণীর মতোই কুন্তিভোজের ভবনে প্রবেশ করলেন। বালিকা বয়সে এই পিত্রান্তরের ঘটনা তাকে যেন একদিনের মধ্যে অভিজ্ঞা মহিলাতে পরিণত করল। আর্যক শূরের জাতিকার নাম পালটে কুন্তী হয়ে গেল কুন্তিভোজের বাড়িতে।

পৃথা অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন– তস্য কন্যা পৃথা নাম রূপেণাপ্রতিমা ভুবি। নিঃসন্তান কুন্তিভোজের ঘরে তার আদরেরও কোনও অভাব ছিল না। রাজা কুন্তিভোজ পিতার মমতায় পরম আহ্লাদে তাকে মানুষ করছিলেন। কুন্তীরও বোধহয় এই মানুষটার ওপরে রাগ কিছু ছিল না। সেই বালিকা বয়সেও তিনি বুঝি বুঝতে পারতেন যে সন্তানহীনতার কারণে হাহাকারী এই সরল মানুষটার পিতৃত্বের সাধনায় কোনও দোষই থাকতে পারে না। রাজবাড়ির ঐশ্বর্য সে আর্যক শূরের বাড়িতে যেমন এখানেও সেইরকমই। বরঞ্চ বেশি। সেখানে আর্যক শূরের অন্যান্য পুত্র-সন্তানদের মেলায় তাঁর যত সম্মান ছিল, এখানে তাঁর সম্মান এবং আদর তারচেয়ে অনেক বেশি। এখানে তিনি একা, একেশ্বরী, কুন্তিভোজের সমস্ত যত্ন এবং স্নেহের আধারভূতা তিনি একা। তিনি আর পৃথা নেই, কুন্তিরাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীন ঐশ্চর্যচিহ্ন বহন করে তিনি এখন কুন্তী, কুন্তিভোজ রাজনন্দিনী।

কুন্তিভোজের রাজবাড়িতে এসে তাদের আচার-নিয়ম এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কুন্তীর দেরি হয়নি। মেয়েরাই বোধহয় এটা পারেন। তাঁদের যেহেতু শ্বশুরবাড়িতে ঘর করতে যেতে হয়, তাই পরিবর্তনের স্বাভাবিক বীজ থাকে তাদের মনে। কুন্তী যদি কিশোরী-বয়সের আরম্ভে এই রাজবাড়িতে এসে থাকেন, তবে তাঁর কৈশোর-শেষের যৌবনের সন্ধিলগ্নেই কুন্তী প্রায় এই বাড়ির কর্তী হয়ে উঠেছেন। রাজা কুন্তিভোজ এই কৈশোরগন্ধী প্রায় যুবতী মেয়েটির ওপর এখন অনেক নির্ভর করেন। শৈশব অথবা কৈশোরের প্রারম্ভেই যাঁকে ঘর বদলে নতুন ঘরে আসতে হয়েছে তার চরিত্রের দৃঢ়তা অনুমান করা যায় অতি সহজেই। কুন্তীর চরিত্র দৃঢ়, কুন্তিভোজের সংসারের সব খবর তিনি রাখেন। রাজবাড়ির সবার সঙ্গে আচার-ব্যবহারের শৃঙ্খলা তার সহজাত শীলবৃত্তান্বিতা সাধ্বী নিয়তা চৈব ভাবিনী।

সব কিছু তার এত ভাল বলেই আমাদের মনে হয়–এর মধ্যে কোনও কৃত্রিমতা নেই তো? বৃদ্ধ বয়সে যে অভিমান, দুঃখ বা রাগ তিনি দেখিয়েছেন তাতে বোধহয়–অবসর সময়ে নিশ্চয়ই তার মন চলে যেত সেই মথুরায়, যেখানে তিনি তার পিতা-মাতাকে ফেলে এসেছেন, ফেলে এসেছেন পুতুল খেলার সমস্ত সরঞ্জাম, আরও কত শত খেলনা, যেখানে তার কৈশোর মাখানো আছে। আজ এই কৃত্রিম পিতা কুন্তিভোজের রাজবাড়ির অলিন্দে দাঁড়িয়ে যখন বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে-যাওয়া অশ্বনদীর দিকে তাকান, তখন নিশ্চয়ই তার মনে জেগে ওঠে এক অকারণ বিষণ্ণতা– যার হেতু বোধহয় তিনি নিজেও ভাল করে বোঝেন না।

 কুন্তিভোজের বাড়ির পাশ দিয়ে অশ্বনদী বয়ে চলেছে, তা মিলবে গিয়ে চর্মতী নদীর সঙ্গে, আবার চমতী গিয়ে পড়বে যমুনায়। কুন্তীর মনও অশ্বনদীর পথ ধরে, চর্মগ্বতীর পথ ধরে যমুনায় গিয়ে পৌঁছয়– যমুনার ওপরেই সে সেই মথুরা, আর্যক শূরের রাজবাড়ি অবশ্য এত ভাবার অবসর কোথায়? কুন্তিভোজের অন্তর্গহের দায়িত্বভার যে সমস্তই প্রায় তার হাতে। মহাভারতের কবি একবারও কুন্তিভোজের স্ত্রীর নাম উচ্চারণ করেননি এই বাড়িতে কুন্তীকেও আমরা এমনভাবে মানুষ হতে দেখছি– যেন তার মা নেই কোনও। হয়তো তিনি ছিলেন, হয়তো বা ছিলেন না। মহাভারতের কবি কুন্তীকে মা বলে ডাকবার কোনও সুযোগ দেননি। যাই হোক, পিতা কুন্তিভোজের অপার স্নেহে মায়ের স্নেহ হয়তো পূরণ হয়ে গেছে তাঁর। কুন্তিভোজও এই কন্যাটিকে পেয়ে স্নেহরসে সিক্ত হয়ে আছেন পিতৃত্বের সম্পূর্ণতায়।

 সেকালের আর্যসমাজের ক্ষত্রিয় রাজারা যেমন হতেন, কুন্তিভোজও সেইরকমই একজন রাজা। তাঁর বাড়িতে দিন-রাত ব্রাহ্মণ-সজ্জনের গতায়াত, মুনি-ঋষির আবাহন-বিসর্জন লেগেই আছে। দিনরাতই চলছে দীয়তাং–ভুজ্যতাম্। মুনি-ঋষিরা আসেন, কে কী খাবেন, কাকে কী দক্ষিণা দেওয়া হবে– অন্ন-বস্ত্র, গাভী-সুবর্ণ– এসব দেখার জন্য রাজবাড়ির পুরোহিত আছেন, মন্ত্রী আছেন। তারাই সব দেখেন। মুনি-ঋষি যেই আসুন যার যেমন সম্মান, তা বুঝে রাজবাড়ির নিযুক্ত পুরোহিত বলে দেবেন কার কত সম্মান-দক্ষিণা! সেই বুঝে রাজমন্ত্রী দানের ব্যবস্থা করবেন। এসব ব্যাপারে রাজার সঙ্গে অন্যেরাও মাথা ঘামান যথেষ্টই।

 কিন্তু কুন্তিভোজের রাজবাড়িতে আজ এক বিশেষ অতিথি এসেছেন। তিনি ব্রাহ্মণ এবং ঋষিকুন্তিভোজং পুরা রাজন্ ব্রাহ্মণঃ প্যুপস্থিত। এই ঋষির চেহারা দেখলে মনে যত সম্ভ্রম জাগে, তার থেকে ভয়ই জাগে বেশি। চেহারার দিক দিয়ে তিনি অন্য ঋষি-মুনির চেয়ে অনেক বেশি লম্বা এবং তার চোখ-মুখ দিয়ে যেন জ্যোতি বেরুচ্ছে। মুখে এক গাল দাড়ি, মাথায় বিশাল জটাভার, হাতে একটা লাঠি– তিগতেজা মহাপ্রাংশু শ্মশ্রুদণ্ডজটাধরঃ। ঘন বন্য মধুর রঙ যেমন, তার জটার রঙও তেমনই। তপস্যার তেজ ফুটে উঠেছে তাঁর সর্ব অঙ্গে। প্রাথমিক ভাবে তার কথা-বার্তা মধুর বলেই মনে হয়–মধুপিঙ্গো মধুরবা। কিন্তু পরে কী ঘটবে কিছুই যেন বলা যায় না। মহাপ্রাংশু মহাতেজা মুনি তার দণ্ডটি রাজসভায় ঠুকে কুন্তিভোজকে বললেন–ভিক্ষা চাই গো রাজা! ভেবেছি কদিন তোমার এখানেই ভিক্ষা গ্রহণ করব– ভিক্ষা মিচ্ছামি বৈ ভোং তব গেহে বিমৎসর।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *