০২০. একমাস পুরুষ আর একমাস স্ত্রী

২০.

পৌরাণিকেরা বলেছেন–একমাস পুরুষ আর একমাস স্ত্রী হয়ে থাকার ফলে সুদ্যুম্নের পক্ষে বেশিদিন রাজত্ব করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ এই নয় যে, তিনি রাজা হিসাবে অকৃতকার্য ছিলেন। আসলে পুংত্ত্ব এবং স্ত্রীত্বের বিপরিবর্তনে যেভাবে রাজ্য শাসন চলছিল তাতে প্রজারা সুদ্যুম্নের ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিল না এবং তারা তাকে তেমন করে আর অভিনন্দনও করত না–প্রজাস্তস্মিন্ সমুদ্বিগ্না নাভ্যনন্দ মহীপতিম্।

 আমি পূর্বে বলেছি–ইলা ছিলেন মনুর প্রথম কন্যা সন্তান। মনুপুত্রদের পরিচয় দেবার সময় মহাভারতও তাকে কন্যা বলেই স্ত্রীলিঙ্গ শব্দে এবং বিশেষণে চিহ্নিত করেছে–তথা চৈবাষ্টমীম্ ইলা। অর্থাৎ মহাভারতের মতে ইলা মনুর অষ্টম সন্তান এবং তিনি কন্যা। আগেই বলেছি, সম্ভবত সুদ্যুম্ন নামে এক রাজার সঙ্গে তার প্রথম মিলন সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু চন্দ্রপুত্র বুধের সঙ্গে সানন্দ মিলনে পুরূরবার জন্ম দেওয়ার পর আবারও যখন তিনি সুদ্যুম্নের কাছে ফিরে এলেন–সুদ্যুম্নং পুনরাগতা–তখন হয়তো রাজার বিষয়ে প্রজাদের অসন্তোষ ঘটে থাকবে। হয়তো সেই কারণেই প্রজারা রাজাকে আর অভিনন্দন করত না। সুদ্যুম্ন কিন্তু বুধের পুত্র পুরূরবাকে পুত্রের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং তাকে নিজের কাছেই রেখেছিলেন।

লক্ষণীয় বিষয় হল, প্রজাদের অসন্তোষ ঘটলে সুদ্যুম্ন কিন্তু নিজ-ভুক্ত রাজ্যখানিও পুত্র পুরূরবাকে দিয়ে যেতে পারেননি। চন্দ্রবংশাবতংশ বুধের পুত্র পুরূরবাকে তিনি নিজের ঘরে রেখে যতই যত্ন-আত্তি করুন, সুদ্যুম্ন ওরফে ইল রাজা কিন্তু তাকে নিজের রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারলেন না। কারণ হয়তো সেই প্রজাদের অসন্তোষ। প্রাচীন পুরাণ বলেছে–পুরুষাবস্থায় ইল রাজা (অর্থাৎ সুদ্যুম্ন) পুরূরবাকে প্রতিষ্ঠান নামে এক নতুন রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন–প্রতিষ্টানে ভিষিচ্যাথ স পুরূরবসং সুতম।

আমরা এতক্ষণ ধরে ইল রাজা বা ইলার কাহিনী শোনালাম শুধু এই তথ্যটুকুর জন্য। কারণ এই প্রতিষ্ঠানেই কুরু-পাণ্ডব বংশের পূর্ববর্তী রাজারা সকলেই রাজত্ব করতেন। নতুন নগরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলেই হয়তো এই নগরের নাম প্রতিষ্ঠান এবং এই সুযোগে জানানো দরকার যে এই প্রতিষ্ঠান হল এখনকার ইলাহাবাদের নিকটবর্তী একটি জনস্থান। পৌরাণিকেরা বলেছেন–পুরূরবাকে প্রতিষ্ঠান রাজ্যে বসিয়ে দিয়ে সুন্ন রাজা ইলাবৃতবর্ষে চলে গেলেন– জগামেলাবৃতং ভোক্তৃং বর্ষং দিব্যলাশন। কী রকম ইলাবৃতবর্ষ? না, যেখানে দেবতাদের উপযুক্ত ভোগ লাভ করা যায়।

 আমি পূর্বে বলেছি-ইলাবৃতবর্ষই মোটামুটি স্বর্গরাজ্যের ঠিকানা এবং আরও বলেছি ভারতবর্ষে মনুই হলেন দেবতাদের প্রথম প্রতিভূ। হরিবংশে দেখবেন–মনু লোকান্তরিত হয়ে সুর্যলোক প্রাপ্ত হবার পর তার দশ পুত্র পৃথিবী ভাগ করে নিলেন–দশ তদ্দৎ ক্ষত্রমকরোৎ পৃথিবীমিমা। অথচ প্রথমে মনুপুত্রদের কথা বলতে গিয়ে পৌরাণিক কিন্তু মনুর নটি পুত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। তাহলে দশম পুত্রটি কে? আমরা বলব–তিনি ইলা এবং তিনি পুত্র নন। কন্যা। অপিচ তিনিই মনুর প্রথম সন্তান।

মহাভারতে যেখানে প্রথমবার কৌরব-পাণ্ডবদের বংশ-পরিচয় দেওয়া হচ্ছে, সেখানে পিতার নাম না করে পরিষ্কার বলা হয়েছে পুরূরবা জন্মগ্রহণ করেন ইলার গর্ভে–পুরূরবাস্ততে বিদ্বান্ ইলায়াং সম্পদ্যত। এই কিছুদিন আগেও একটি বিবাহিতা রমণীর জীবনে একাধিক পুরুষের আনাগোনা ঘটলে তিনি আর স্বামীদের পদবি ব্যবহার না করে দেবী’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। একইভাবে ইলার জীবনেও সম্ভবত দুটি পুরুষের রতি-আসক্তি থাকায় পুরূরবা আর পিতার নামে বিখ্যাত হননি। মায়ের নামে তিনি ‘ঐল পুরূরবা’, ঠিক যেমন বৈদিক যুগে মামতেয় দীর্ঘতমা, জাবাল সত্যকাম। গর্ভধারণ এবং পালন একসঙ্গে চালিয়ে ইলাই তার মা এবং বাবা দুইই, মহাভারতের ভাষায়–সা বৈ তস্যাভবম্মাতা পিতা চৈববতি নঃ শ্রুত।

মহাভারত ইলাকে একসঙ্গে পুরূরবার বাবা এবং মা বলায় পর্তীকালে পৌরাণিকদের মহাদেবের অভিশাপ নামিয়ে এনে তাকে একবার পুরুষ একবার স্ত্রীতে রূপান্তরিত করতে হয়েছে। পুত্রের জন্ম দিয়েই বুধ যে-স্বর্গেই চলে যান না কেন, ইলার অন্যতর স্বামী বুধের ঔরসজাত পুত্রের রাজ্যের ব্যবস্থা করে দিয়ে হয়তো ইলাকে নিয়েই চলে গিয়েছিলেন সেই পরম রম্য স্থানে, যার নাম ইলার নামসাজাত্যে ইলাবৃতবর্ষ।

মৎস্য পুরাণ বলেছে–সূর্য বংশ এবং চন্দ্রবংশের আদিতে মনুর প্রথম পুত্র ইলই ছিলেন প্রথম রাজা-সোমার্কংশয়োরাদাবিলো’ভূ-মনুনন্দনঃ। আমার মতে ইল নয়, মনুর প্রথম কন্যা সন্তান ইলাই ছিলেন নামত রাজা এবং কার্যত তার প্রথম স্বামী সুদ্যুম্ন এই রাজ্য চালাতেন। তারপর এর মধ্যে ইলার গর্ভজাত পুত্রের পিতৃত্ব চন্দ্রপুত্র বুধের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে প্রজাদের অসন্তোষে সুদ্যুম্ন রাজ্যচ্যুত হন এবং মূল সূর্যবংশ বা মনুবংশের পরম্পরা চলতে থাকে মনুর প্রথম পুত্র সন্তান ইক্ষাকুর নামে। আর বুধপুত্র ঐল পুরূরবা ঠাকুরদাদা চন্দ্রের নাম নিয়ে রাজ্য আরম্ভ করলেন প্রতিষ্ঠানপুরে ইলাহাবাদের কাছে। হরিবংশ মন্তব্য করেছে–মনুর বংশ পরম্পরায় ইকু যেমন সুন্দর একটি রাজ্য পেলেন শাসন করার জন্য, সুদ্যুম্ন তা পেলেন না-সুদ্যুম্নে নৈনং গুণমবাপ্তবান্। আমাদের কল্পনায়–চন্দ্রবংশের সূত্রপাতেই এই যে প্রাপ্য রাজ্য না পাওয়ার ঘটনাটুকু ঘটে গেল, এই না পাওয়ার রাজনীতি নিয়তির মতো স্পর্শ করে রইল সেই পাণ্ডব-বংশ পর্যন্ত। কারণ ঐল পুরূরবার রাজধানী প্রতিষ্ঠানপুরই পরে হস্তিনাপুরে পরিণত হয়েছে এবং পাণ্ডবরা সেই রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। পরের কথা পরে আসবে, আমরা চন্দ্রবংশের পরম্পরায় এবার পুরূরবার কথা বলি।

শুধু পুরূরবা নয়, ঐল পুরূরবা, ইলার ছেলে পুরূরবা। চন্দ্রের নাতি পুরূরবা। বৈবস্বত মনুর সঙ্গে তার বংশ-পরম্পরা সংসৃষ্ট হলেও মূল পরম্পরা নেমে এল চন্দ্র থেকে। চন্দ্র, বুধ, পুরূরবা। এই প্রথম একটা নাম পেলাম যার মধ্যে তথাকথিত দেবতার তেজটুকু পেলাম, বুধ-নক্ষত্রের আলোটুকু পেলাম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিপূর্ণ মানুষও পেলাম–ঐল পুরূরবা, স্ত্রী-পুরুষের একাকার মানস থেকে জাত ইলার ছেলে পুরূরবা।

লক্ষণীয় বিষয় হল–এই একটি রাজনাম, যার মধ্যে বৈদিক যুগের শেষ স্বাক্ষরটুকু রয়েছে, আর মহাভারত পুরাণের আরম্ভও তাকে দিয়েই। তখনও স্বর্গবাসী দেবগণের সঙ্গে মনুষ্যলোকের গভীর যাতায়াত ছিল। বেদে আছে পুরূরবা যখন জন্মেছিলেন তখন নাকি স্বর্গমোহিনী অপ্সরারা তাকে দেখতে এসেছিলেন, তাঁর জন্মোৎসবে নৃত্য করেছিলেন সমস্মিন্ জায়মান আসত গা উতেমবর্ধদ্যঃ স্বতঃ। কে জানত এক মোহিনী অপ্সরার সঙ্গেই তার সমস্ত জীবন বাধা হয়ে যাবে! ঘটনাটা আনুপূর্বিক জানাই।

পৌরাণিকেরা জানিয়েছেন–পুরূরবা জন্ম লাভ করার পর তার জন্মদাতা পিতা বুধ তাকে মায়ের কাছে রেখে স্বর্গের পথে ফিরে গিয়েছিলেন। ঠিক যে জায়গাটায় পুরূরবা জন্মেছিলেন সে জায়গাটা অবশ্যই অরণ্যসঙ্কুল পার্বত্য অঞ্চল। তীর্থযাত্রাধ্যায়ে মহাভারতের কথা যদি ঠিক হয়, তবে বলতে হবে পুরূরবার সেই জন্মস্থান পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়েছিল পুরু-পর্বত নামে-পর্বতশ্চ পুরুর্নাম যত্ৰ জাতঃ পুরুরবাঃ। পিতৃবিরহিত পুরূরবাকে নিয়ে তাঁর মা ইলা মোটেই ভেঙে পড়েননি কারণ মানুষ নামে খ্যাত প্রথম পুরুষ মনুর তিনি বংশধর। তার আকৃতি প্রকৃতি সাহস একটু আলাদা। পিতার কাছে তিনি রাজ্যের অধিকার চাননি। সম্পূর্ণ নিজের ব্যক্তিত্বে এবং চেষ্টায়–সে চেষ্টার মধ্যে সুন্ন নামে কোনও অভিমত বশংবদ পুরুষের স্বেচ্ছাবদান থাকুক আর নাই থাকুক–তিনি পুত্র পুরূরবাকে প্রতিষ্ঠান রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এইজন্যই তিনি মহাভারতের শ্লোকে পুরূরবার মাতাও বটে পিতাও বটে। টীকাকারেরা প্রাচীন শ্লোক উদ্ধার করে বলেছেন–এ ব্যাপারে মা হয়েও তিনি পুরুষের স্বভাবে পুত্রকে রাজ্যদান করেছিলেন, সেই কারণেই তিনি একই দেহে পুরূরবার মাতা এবং পিতা দুইই–মাতৈব লব্ধপুংভাবা রাজ্যদানাৎ পিতাপ্যভূৎ মুখ্যঃ পিতা তু বুধ এব। সেই কারণে পুরূরবাও ঐল পুরূরবা।

মহাভারতে দেখতে পাচ্ছি–প্রতিষ্ঠানে রাজধানী স্থাপন করে যে ক্ষুদ্র রাজ্যটির প্রতিষ্ঠা হল, পুরূরবার রাজত্বকালে সেই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। পুরূরবা শুধু নবীন প্রতিষ্ঠানপুরের রাজা রইলেন না। এই ভারতবর্ষ যে বিশাল ভূখণ্ডের অন্তর্গত সেই জম্বুদ্বীপের অন্তত তেরোখানি উপদ্বীপের ওপর পুরূরবার অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল-ত্রয়োদশ সমুদ্রস্য দ্বীপান পুরূরবাঃ। এ কথার মধ্যে অতিশয়োক্তি একটু-আধটু থাকতেই পারে। প্রাচীনকালের স্বর্ণপ্রস্থ কি চন্দ্ৰশুকের মতো উপদ্বীপ পুরূরবার অধিকারে নাই থাকুক, কিন্তু এই তেরো দ্বীপের ভুক্তি দেখিয়ে একথা অবশ্যই প্রমাণ করা গেল যে, পুরূরবার ক্ষমতা এবং মর্যাদা ছড়িয়ে গিয়েছিল তার রাজ্যের সীমা অতিক্রম করে। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানপুরের আদলে দক্ষিণ-ভারতেও অন্য একটি রাজধানী তৈরি হয়েছিল। মহামান্য সাতবাহন বংশের গৌতমীপুত্র সাতকণী এবং অন্যান্য রাজারা এইখানেই রাজত্ব করতেন।

 দক্ষিণ ভারতের প্রতিষ্ঠান-পুরী যে উত্তর-ভারতের আদলে অথবা নাম-সাম্যেই তৈরি হয়েছিল, তার একটা বড় প্রমাণ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পতনের পরেই দাক্ষিণাত্যে যে সমস্ত রাজবংশ মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাদের অন্তত একটি ধারা দাক্ষিণাত্যের প্রতিষ্ঠান-পুরীকে মহিমান্বিত করে তোলে। গৌতমীপুত্র সাতকণীর ইতিহাস আরম্ভ হয়েছে আরও অনেক পরে। পুরাণমতে দাক্ষিণাত্যের প্রতিষ্ঠানে সাতবাহন বংশের প্রথম রাজা ছিলেন গৌতমীপুত্র পুলোমা, যাকে স্ট্রাবো বলেছেন ‘P(1)olemaios of Baithan’ অর্থাৎ স্ক্রাবোর বৈঠান’ অথবা দেশীয় উচ্চারণে যেটা পৈঠান, সেটাই সংস্কৃত পুরাণ-মহাভারতের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু উত্তরভারতে পুরূরবার রাজধানী প্রতিষ্ঠান, যেটাকে আমরা, আধুনিক ইলাহাবাদের কাছে স্থান দিয়েছি, আধুনিক অপভ্রংশে সেই প্রতিষ্ঠান একখানি গ্রাম নামের মধ্যে টিকে আছে। তার নাম পিহান। জয়চন্দ্র বিদ্যালংকার অনেক যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্মৃতি ধরার চেষ্টা করেছেন পিহান’ নামটির মধ্যে। অন্যদিকে কিছু পণ্ডিত মোটামুটিভাবে গঙ্গার তীরে প্রয়াগের কাছে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব দেখতে পেয়েছেন, স্পষ্ট করে পিহান’ নামটি আর তারা উল্লেখ করেননি।

 পুরূরবার প্রতিষ্ঠান পিহানই হোক অথবা অন্য কিছু, অন্তত এই প্রসঙ্গে আমরা ধরে নিতে পারি যে, আর্যরা ততদিনে কাশ্মীর-পাঞ্জাবের বাসভূমি ত্যাগ করে উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়েছেন এবং রাজত্বের জন্য নতুন একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত পূর্বতন দেবভূমির সঙ্গে পুরূরবার যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি। বরং বলা যায় দেবতা অথবা দেবকল্প ব্যক্তিরাই তখনও পুরূরবার সঙ্গী। মহাভারতে দেখতে পাচ্ছি–পুরূরবা মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সদা-সর্বদা দেবতা বা দেব-সদৃশ ব্যক্তিদের দ্বারাই পরিবৃত থাকতেন–অমানুষৈবৃতঃ সর্মৈানুষঃ সন্ মহাযশাঃ। পরিষ্কার বোঝা যায়, আর্যায়ণের প্রথম কল্পে যারা নতুন নগরীর প্রতিষ্ঠায় পুরূরবার সঙ্গী হয়েছিলেন তারা কেউই তখনও চলে যাননি।

 প্রতিষ্ঠান নগরীর রাজা হয়ে, জম্বুদ্বীপের অর্ন্তগত অন্তত তেরোটি বিশাল ভূখণ্ডের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে পুরূরবার মান মর্যাদা যেমন বেড়ে গেল, তেমনই তার মত্ততাও কিছু বেড়ে গেল। ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতা অতিরিক্ত হয়ে গেলে অতি বিচক্ষণ এবং ধীমান ব্যক্তিরও স্বলন ঘটে, পুরূরবার মধ্যেও সেই স্বলন দেখা দিল। যে সমস্ত দেবপ্রতিম ব্যক্তি পুরূরবার সঙ্গে ছিলেন, তারাও এই স্বলন রোধ করেননি অথবা তারা স্বার্থবশে পুরূরবার পতনের সঙ্গী হয়েছিলেন।

আমাকে দু-এক জনে বলেছেন–মহাভারতের মধ্যে পাণ্ডবদের প্রতি মহাভারতের বক্তার যেন পক্ষপাত আছে। পাণ্ডবদের সবই ভাল আর কৌরবদের সব খারাপ, এমন একটা ভাব যেন লক্ষ্য করা যায়। কথাটা আরও গাল-ভরা করে একই নোক বলেছিলেন–মহাভারতের কবি, বক্তা–এঁরা তো সব রয়্যাল প্যাট্রোনেজে দিন কাটাতেন, তাই চলমান রাজবংশের সুখ্যাতি তাদের করতেই হত। আমি বলি–এ সব ধারণা খানিকটা মহাভারত না পড়ার ফল, আর খানিকটা মহাভারতের গৌণ-গ্রন্থ পড়ার ফল। কতগুলি সাহেব এবং বাঙালি সাহেব আছেন, তারা আবার নানা রকম ইজ’ মিশ্রিত মহাভারতের ওপর লেখা গৌণ গবেষণাগ্রন্থ পাঠ করে নানা সিদ্ধান্ত দেন।

দিতেই পারেন। মহাভারত এতই বড় ব্যাপার যে সেটিকে নানা দিক থেকে বিচার করা যেতেই পারে এবং নানা মতামতও দেওয়া যেতে পারে। আমার কাছে সে সকলই শিরোধার্য। কিন্তু দুঃখ পাই, যা নয় তাই বললে। রাজা-রাজড়ার আনুগত্যে সৃত-মাগধদের পক্ষপাত নিশ্চয়ই ধরা পড়ত কিন্তু তাই বলে তারা ইতিহাস এড়িয়ে যেতেন না। পূর্বতন বংশধারায় কলঙ্ক থাকলে, হিংসা-অসুয়া থাকলে, তাও তারা লুকোতেন না। কোনও না কোনও জায়গায় ঠিক তাঁরা বলে দিতেন। এই কথাটা পাণ্ডবদের মূল পুরুষ পুরূরবা সম্বন্ধেও খাটে বলে এখনই কথাটা তুললাম এবং পরেও এসব কথা আসবে।

বেদের মধ্যে পুরূরবার কীর্তি কাহিনী কিছু আছে। ঋগবেদের মূল পর্বের নিরিখে পুরূরবার প্রসঙ্গ যতই অর্বাচীন হোক–কিছু পণ্ডিত ঋগবেদে পুরূরবার কথাবস্তুকে অর্বাচীনই বলে থাকেন–তবু মনে রাখতে হবে সেই বিখ্যাত উক্তিটি-ইতিহাস-পুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ–অর্থাৎ মহাভারত-পুরাণগুলি দিয়েই বেদের কথা পরিপূরণ করতে হবে, সাবানসিয়েট’ করতে হবে। আর এখানে সেই ‘সাবটানসিয়েশন’ খুব ভালভাবেই করা যায়।

দেখবেন–প্রায় প্রত্যেক পুরাণেই মর্ত্যভূমির রাজা পুরূরবার সঙ্গে স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর মিলন-বিরহের কথা সবিস্তারে বলা আছে। কিছু আছে মহাভারতেও। ইতিহাস পুরাণের এই সবিস্তার কাহিনীর মূল উৎস কিন্তু বেদ। বেদের মধ্যে পুরূরবা-উর্বশীর কাহিনীটি আছে কথোপকথনের আকারে, যাকে পরিভাষায় বলে সংবাদ-সূক্ত। দেবতা, যজ্ঞ, আহুতি আর প্রার্থনাই যেখানে বৈদিক সূক্তগুলির প্রধান অভিজ্ঞান–সেখানে উর্বশী-পুরূরবার এই কথোপকথনের অংশটুকু এতই মধুর এবং নাটকীয় যে, পণ্ডিতজনেরা অনেকেই এই সংবাদ-সূক্তটিকে পরবর্তী সংস্কৃত নাটকের বীজ বলে আখ্যা দিয়েছেন। উর্বশী-পুরূরবার মিলন-বিরহের কথায় আমি পরে আসছি। আমার বক্তব্য আপাতত অন্য কিছু। বেদে উর্বশী-পুরূরবার কথোপকথন অংশের শেষে দেখা যাবে–উর্বশী পুরূরবাকে বলছেন–এই দেবতারা বলছেন পুরূরবা তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী হবে, তোমার পুত্রেরা সকলেই হোমদ্রব্য দিয়ে দেবতাদের আহুতি রচনা করবে, তুমি স্বর্গে আমোদিত হবে-প্রজা তে দেবান্ হবিষ যজাতি স্বর্গ উ ত্বমপি মায়াসে।

বস্তুত সারা সংবাদ-সূক্তটিতে যাগ-যজ্ঞ দেবতাদের কথা কিছু নেই। একেবারে শেষ পংক্তিতে উর্বশীর এই হোম-যজ্ঞের উপদেশ পৌরাণিকদের ভাবিত করেছে। তারা পুরূরবা উর্বশী আখ্যানের শেষ পর্বে দেখিয়েছেন কীভাবে পুরূরবা বৈদিক অগ্নিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসছেন এবং কীভাবে শেষ পর্যন্ত অগ্নিসমিন্ধন করে পুরূরবা আপন অভিলাষ পূরণ করছেন।

আমি আসলে শেষ কথাটা আগে বলে ফেলেছি-পুরূরবা বৈদিক অগ্নিকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। মহাভারতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পড়ে যা মনে হয়, তা হল–প্রতিষ্ঠানপুরের রাজা হবার পর তার মর্যাদা যখন খুব বেড়ে গেল, তখন তার মধ্যে ঐশ্বর্যের মত্ততাও কিছু জন্ম নিল। মহাভারত বলেছে–রাজা হবার পর পুরূরবা ঐশ্বর্য এবং শক্তিতে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। এর প্রথম ফল হল–তিনি রাজ্যের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিবাদ-বিসম্বাদ আরম্ভ করলেন- বিঃৈ স বিগ্রহং চক্রে বীর্যোন্মত্তঃ পুরূরবাঃ। যজন-যাজন-অধ্যাপনে যতটুকু সম্পত্তি ব্রাহ্মণদের লাভ হত, পুরূরবা তা সবই জোর করে নিয়ে নিতেন। ব্রাহ্মণরা কান্নাকাটি কম করতেন না। তাদের সমস্ত অনুরোধ-উপরোধ ঠেলে ফেলে দিয়ে পুরূরবা তাদের ধন-রত্ন কেড়ে নিতেন-জহার চ স বিপ্রাণাং রত্নাব্যুৎক্রোশমপি।

ঠিক এই জায়গাটায় আমাদের টিপ্পনি দিতে হবে সামান্য।

মনে রাখতে হবে–পুরূরবা পিতৃপরম্পরায় কোনও বাধা রাজ্য পাননি। প্রধানত তার। মায়ের চেষ্টা অথবা তার পালক পিতার চেষ্টায় তিনি প্রতিষ্ঠানপুরে রাজ্য লাভ করেছিলেন। সে যুগে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের যে বিভাগ ছিল, তা শুধুই বর্ণের তর-তম। ব্রাহ্মণরা সাধারণ যাগ-যজ্ঞ নিয়ে থাকলেও রাজদরবারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল নিবিড়। বিশেষত ক্ষত্রিয় রাজার পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে, তাদের যাগ-যজ্ঞের কাজও খানিকটা ব্যাহত হত। আবার পদে পদে ব্রাহ্মণের অনুজ্ঞা না পেলে বা না মানলে ক্ষত্রিয় রাজাদেরও অসুবিধে হত।

আর্যায়ণের প্রথম কল্পে যখনই কোনও ক্ষত্রিয় রাজা অন্যত্র রাজ্য জয় করে তার অধিকার কায়েম করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণরাও তাদের সঙ্গে আসতেন। বঙ্গদেশেও ব্রাহ্মণ্য অধিকার এইভাবে ঘটেছে, দাক্ষিণাত্যেও তাই ঘটেছে। ধরে নিতে পারি কাশ্মীর-পাঞ্জাব থেকে উত্তরপ্রদেশে আসার সময় গঙ্গার স্রোতধৌত ভূমিখণ্ডেও ব্রাহ্মণ অধিকার একইভাবে জন্মেছে। ইতিহাস-পুরাণে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক যদি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে দেখা যাবে প্রায়ই এই দুই উচ্চ বর্ণের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। ক্কচিৎ কখনও যে গণ্ডগোল ঘটেছে–যেমন পরশুরাম, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের সময় (এবং এছাড়াও আরও কিছু উদাহরণ আছে), সেই ক্রাইসিস পিরিয়ড’গুলি ছাড়া ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা চিরকালই এক সুসংহত শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। যারা নিম্নবর্ণের ওপর উচ্চবর্ণের অত্যাচারের ইতিহাস রচনা করেছেন, তারাও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের এই মিলিত শক্তিকেই অত্যাচারের কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

কিন্তু মুশকিল হল, আর্যায়ণের প্রথম কল্পে এই সংহতি অত সম্পূর্ণ ছিল না। স্মরণ করা যেতে পারে বেণ রাজার কথা। প্রায় প্রত্যেক পুরাণে এবং অবশ্যই মহাভারতেও বেণের উপাখ্যান পাওয়া যাবে পৃথু রাজার প্রসঙ্গে। পৌরাণিক শ্রুতি অনুসারে পৃথু হলেন এই পৃথিবীর প্রথম রাজা। মহারাজ পৃথুর নাম থেকেই আমাদের এই বাসভূমির নাম পৃথ্বী অথবা সংযুক্ত বর্ণ ভেঙে পৃথিবী। পৃথিবীতে প্রথম আইনের শাসন নিয়ে আসা অথবা পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করার মর্যাদা দেওয়া হয় পৃথুকেই। কিন্তু যে পুরুষটি থেকে পৃথুর জন্ম হয়, সেই বেণই কিন্তু ছিলেন প্রথম রাজা। মহাভারতে যেখানে পুরূরবার কথা আছে, তার কিছু আগেই বেণের কথা আছে।

মহাভারত এবং পুরাণগুলিতে দেখা যাবে-বেণ রাজা হবার পরেই দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের অস্বীকার করে বসেন। ঐশ্বর্যে মদমত্ত হয়ে তিনি প্রচার করতে থাকেন–দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের মান্য করার কিছু নেই, পুজো যদি করতেই হয় তো আমাকে করো। আমি রাজা, আমিই এই সংসারে একমাত্র পূজনীয় ব্যক্তি–অহমিজ্যশ্চ পূজশ্চ। বেণ অত্যন্ত অত্যাচারী হয়ে পড়লেন, কাউকেই তিনি আর মানেন না। এই অবস্থায় ব্রাহ্মণ-ঋষিরা সংঘবদ্ধ হলেন এবং মন্ত্রপূত কুশের আঘাতে তাকে মেরে ফেলেন। অত্যাচারী বেণের মৃত্যুর পর সমবেত ঋষি-ব্রাহ্মণ মৃত বেণের দক্ষিণ ঊরু মন্থন করতে আরম্ভ করলেন-মমন্থ দক্ষিণং চোরু ঋষয়ে ব্রহ্মবাদিনঃ 1 সেই উরু-মন্থনের ফলে জন্ম নিল নিষাদেরা–দেখতে তারা হ্রস্বকায়, রক্তচক্ষু, কৃষ্ণকেশ। নিষাদেরা জন্মানো-মাত্রই ঋষিরা তাদের বললেন–ব্যাটারা বসে থাক চুপ করে–যার সংস্কৃত শব্দ হল ‘নিষীদ’। এই নিষীদ’ থেকেই নিষাদ শব্দ। নিষাদ- যাদের আমরা পরবর্তীকালে ম্লেচ্ছ বলে ডেকেছি, ব্যাধ বলে ডেকেছি অথবা অনার্য-অধম ক্রুর এক জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছি, সেই নিষাদেরা অতঃপর বিন্ধ্যপর্বতের প্রত্যন্তভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নিল–যে চান্যে বিন্ধ্যনিলয়া ম্লেচ্ছাঃ শতসহস্রশঃ।

নৃতত্ত্বের নিরিখে এই নিষাদ-মেচ্ছদের কথা আমরা পরে ভাবব, আপাতত জানাই–ঋষিরা এরপর বেশের দক্ষিণ বাহু মম্বন করা আরম্ভ করলেন এবং সেই মন্থনের ফলে জন্মালেন মহারাজ পৃথু-ইন্দ্রের মতো তাকে দেখতে, ইন্দ্রের মতোই তার প্রভাব প্রতিপত্তি। পৃথিবীর সেই প্রথম রাজা জন্মগ্রহণ করেই বুঝলেন তার মধ্যে রাজধর্মের শুদ্ধবুদ্ধিটুকু আছে। দেবতারা এবং ঋষিরা সমস্বরে তাকে বললেন–রাজা! তুমি তোমার নিজের পছন্দ-অপছন্দ বাদ দিয়ে সমস্ত মানুষের প্রতি সমান দৃষ্টি দাও–প্রিয়াপ্রিয়ে পরিত্যজ্য সমঃ সর্বেষু জন্তুষু।

উপদেশ আরও অনেক আছে; পৃথু মহারাজ সে সবই মেনে নিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তার প্রতিজ্ঞা হল-ব্রাহ্মণরা সকলেই আমার প্রথম মান্য পুরুষ, আমি তাদের বিরুদ্ধে যাব না–ব্রাহ্মণাঃ মে মহাভাগাঃ নমস্যাঃ পুরুষর্ষঃ। আমার কাছে এই প্রতিজ্ঞাটুকুই বড় কথা। মনে রাখতে হবে–আর্যায়ণের প্রথম কল্পে ব্রাহ্মণরাই ছিলেন সবচেয়ে শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষ। তারা সমাজের নীতি-নিয়ম যেমন তৈরি করতেন রাজনীতি, দণ্ডনীতিও তাদেরই তৈরি। বেণ সেই ব্রাহ্মণদের নীতি-নিয়ম অস্বীকার করে আপন বৃদ্ধিতে বলশালী হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু সংঘবদ্ধ ব্রাহ্মণ্য-শক্তির সঙ্গে তিনি এঁটে উঠতে পারেননি। তাকে মরতে হয়েছে।

 বেণও কিন্তু নিজে রাজা হননি। সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণদের অনুমতি ক্রমেই তিনি রাজা হয়েছিলেন। কিন্তু যাগ-যজ্ঞ, দেবতা এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মণদের আধিপত্য কথায় কথায় ব্রাহ্মণদের অনুজ্ঞা-উপদেশ তিনি মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গীয় পণ্ডিত-জনের মতে বেণই প্রথম পুরুষ, যিনি এতকালের পরিচিত দেবতা-শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রের অধিকার অস্বীকার করেন। আমার ধারণা–ওই নিষাদ-ম্লেচ্ছদের কথা বললাম– আর্যায়ণের প্রথম পর্যায়ে দেশজ ওই ব্যক্তিরাই ব্রাহ্মণ্য-শক্তির বিরুদ্ধে বেণের সহচারী ছিলেন। বেণের মৃত্যুতে এবং দেব-ঋষি-মনোনীত পৃথুর রাজত্বে তারা পিছু হঠে গিয়ে বিন্ধ্যপর্বতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আর্য-সভ্যতার বিকাশের প্রথম পর্বে দেশজ ব্যক্তিদের দক্ষিণে তাড়িত হওয়ার যে কল্পনা ঐতিহাসিকেরা সচরাচর করে থাকেন, তার ছায়া এই বেণের বাহু-মনের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায় বলে আমাদের বিশ্বাস।

বেণের ঘটনার সঙ্গে আমি পুরূরবার জীবনের সাদৃশ্য দেখাতে চাইছি। পুরূরবার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উত্তরপ্রদেশে গঙ্গানদীর তীরে। আর্যায়ণের দ্বিতীয় পর্যায় সেটা। নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা মানেই রাজার সেখানে একক প্রতিষ্ঠা। এরই মধ্যে ঋষি-ব্রাহ্মণেরা এসে যখন এই করো, সেই করো’ অথবা এটা ঠিক নয়, এটা অনুচিত’ বলে উপদেশ দিতে আরম্ভ করলেন, তখন সেই নীতি-নিয়মের শৃঙ্খল, আর আচার-বিচারের বিধি-নিষেধ কোনও এক-নায়ক রাজার মনোমত হয়? অতএব রাজা পুরূরবার দিক থেকে আরম্ভ হল সেই অত্যাচার উৎপীড়ন, ব্রাহ্মণ্যের মূল-উৎপাটনের সেই প্রচেষ্টা, যা আমরা বেণের আমলে দেখেছি। ব্রাহ্মণদের সঞ্চিত ধন-রত্ন লুষ্ঠিত হল, তাদের নীতি-নিয়মের বাক্য স্তব্ধ হল।

পুরূরবার রাজ্যে ব্রাহ্মণ্যের এই অপমান-উৎপীড়নে ব্যথিত হয়ে ব্রহ্মার মানসপুত্র সনৎকুমার ব্রহ্মলোক থেকে এলেন পুরূরবাকে বোঝাতে–সনৎকুমারস্তং রাজন্ ব্রহ্মলোকা উপেত্য হ। শ্রুতি-স্মৃতির নানা সদাচার উপদেশ করে সনকুমার পুরূরবাকে অনেক কথা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তার সমস্ত অনুরোধ বৃথা হল। রাজা কানেই নিলেন না সে সব কথা–প্রত্যগৃহ্নান্ন চাপ্যসৌ। উৎপীড়ন, উৎপাটন, লুণ্ঠন আগের মতোই চলতে লাগল। ব্রাহ্মণ ঋষি-মুনিরা আবার সংঘবদ্ধ হলেন। ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ মহর্ষিদের অভিশাপে রাজার রাজত্ব গেল। হিংসা লোভ আর শক্তিমত্তার জ্বালায় রাজার চেতনা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মহর্ষিরা লোভী বলোম্মত্ত রাজাকে অভিশাপে বিনষ্ট করলেন–ততো মহর্ষিভিঃ কুদ্ধৈ সদ্যঃ শতপ্তা বিনশ্যত।

আশ্চর্য হল, এর পরেই মহাভারতের বর্ণনায় দেখছি রাজা পুরুরবা গন্ধর্বলোকবাসিনী উর্বশীর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন এবং ব্রাহ্মণ্য ক্রিয়াকলাপের জন্য তিনি পবিত্র অগ্নি বহন করে। নিয়ে এসেছেন নিজের বাড়িতে-আনিনায় ক্ৰিয়ার্থে মীন যধাবদবিহিতংস্ত্রি। এই অংশটাই বড় ভাবনার। তাহলে কি পুরূরবা মরেননি? ব্রাহ্মণরা কি অভিশাপ দিয়ে পুরূরবার জীবন। বিনষ্ট করতে পারেননি?

.

২১.

 পুরূরবা মারা যাননি, ঠিক যেমন আমাদের ধারণা অত্যাচারী বেণও মারা যাননি। বেশের রাজত্ব এবং শাসন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেশের দক্ষিণ বাহু মন্থন করে পৃথুর জন্ম হল– আধুনিক দৃষ্টিতে এই ভাষ্যও তত আদরণীয় নয়। মন’ শব্দটার মধ্যে একটা অন্বেষণের ইঙ্গিত থাকে সব সময়। শাস্ত্র মম্বন করা অথবা মৌখিকভাবে আমরা যেমন বলি জায়গাটা মথে ফেলেছি’–অথবা সেই সমুদ্রমন্থন- সর্বত্রই এই মন্থন বা মথে ফেলার মধ্যে একটা অন্বেষণের ব্যাপার থাকে। বাহু’ জিনিসটা ক্ষাত্র-শক্তির প্রতীক। বেণকে সিংহাসনচ্যুত করে তারই দক্ষিণ বাহু মন করে যে পৃথু রাজাকে পাওয়া গেল, তা আসলে বেণেরই বংশধারায় কোনও বিশ্বস্ত ক্ষত্রিয়কে খুঁজে বার করার ব্যাপার। দক্ষিণ মানে অবশ্যই ফেভারেবল’। বেণের বংশধারায় ব্রাহ্মণ সমাজের প্রতি অনুগত ব্যক্তিটিই হলেন পৃথু। পৃথুকে লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই সমবেত ব্রাহ্মণরা তাকে বলেছেন- মনে-প্রাণে প্রতিজ্ঞা করো, পৃথু! প্রতিজ্ঞাধিরোহস্ব প্রতিজ্ঞা করো- ‘আমি এই ভূলোকবাসী ব্রাহ্মণদের সযত্নে পালন করব। তাদের আমি দণ্ড দেব না কোনওদিন–অদ্যা মে দ্বিজাশ্চেতি প্রতিজানীহি হে বিভো। পৃথু স্বীকার করে নিয়েছেন ব্রাহ্মণদের কথা–এবমস্তু।

কথা হল– বেণের মতো চন্দ্রবংশীয় পুরূরবারও একটা রূপক-মৃত্যু আছে। মনে রাখতে হবে, মহাভারতে গন্ধর্বলোক থেকে পুরূরবা যে উর্বশীকে নিয়ে এলেন, সে ঘটনাটা বর্ণিত হয়েছে ব্রাহ্মণদের হাতে পুরূরবার ধ্বংসের পর।

পুরূরবার সিংহাসনে আরোহণ, ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তার বিরোধ এবং তাঁর ধ্বংস নিয়ে যদি একটা ঘটনা-পরম্পরা সাজিয়ে তোলা যায়, তাহলে উর্বশীর সঙ্গে তার মিলন, বিরহ এবং পুনর্মিলনের ঘটনা-পরম্পরা সাজিয়ে পুরূরবা কাহিনীতে দ্বিতীয় একটি স্তরও তৈরি করে ফেলা যায়। যদিও এমনটি কখনও জোর করে বলা ঠিক হবে না যে, পুরূরবা জীবনের প্রথমাংশের মধ্যে উর্বশীর অস্তিত্ব নেই অথবা এমনও ঠিক নয় যে, পুরূরবা-উর্বশীর প্রেম-কাহিনীর মধ্যেও তার ব্রাহ্মণ্য-বিরোধের অংশটুকু নেই। মনুষ্য-জীবন বাঁধা গত্ মেনে চলে না, অতএব পুরূরবার জীবনেও ব্রাহ্মণ-বিরোধের অংশ শেষ হয়েছে, তারপর উর্বশীর কাহিনী আরম্ভ হয়েছে–এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই।

বায়ু-পুরাণে দেখতে পাচ্ছি–সমুদ্রমেখলা এই পৃথিবীর সমস্ত অধিকার ভোগ করেও পুরূরবার লোভ কিছু কমেনি। ধন-রত্নের তৃষ্ণাও কিছু কমেনি তার–তুতোষ নৈব রত্নানাং লোভাদিতি হি নঃ শ্রুত। পুরূরবা যখন রাজত্ব করছেন সেই সময়েই নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিরা এক বিশাল যজ্ঞ আরম্ভ করেন। দেব-কারিগর বিশ্বকর্মা এই মহান যজ্ঞের জন্য সোনা দিয়ে যজ্ঞভুমি বাঁধিয়ে দেন। যজ্ঞ আরম্ভ হল। স্বয়ং দেবগুরু বৃহস্পতি এই যজ্ঞেরক্রিয়াকলাপ দেখার জন্য উপস্থিত হলেন।

এদিকে মহারাজ পুরূরবা শিকারে বেরিয়েছেন। তার সঙ্গে লোক-লস্কর সৈন্য-সামন্ত ভিড় করে চলল এবং সেটা খুব বড় কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, তার সঙ্গে সঙ্গে চললেন স্বর্গসুন্দরী উর্বশী, যিনি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন পুরূরবার আসঙ্গলিপ্সায়-উর্বশী চকমে যজ্ঞং দেবহৃতিপ্রণোদিতা। মৃগয়ায় বেরিয়ে এ দেশ সে দেশ ঘুরে পুরূরবা উপস্থিত হলেন নৈমিষারণ্যে–যেখানে সোনায় বাঁধানো যজ্ঞভূমিতে ঋষিদের যজ্ঞ চলছে পুরোদমে।

 যজ্ঞস্থলীর পূণ্যমন্ত্র আর হবির্গন্ধে অতি-বড় অমানুষেরও হৃদয় দ্রবীভূত হয়, শ্রদ্ধায় চক্ষু নিমীলিত হয়। কিন্তু চন্দ্রবংশাবতংস বুধপুত্র ঐল পুরূরবার কানে মন্ত্র-গানের স্বরসঙ্গতি প্রবেশ করল না, তার মন আকুলিত হল না হবির্গন্ধে। যজ্ঞভূমিতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ পড়ল সুবর্ণময় যজ্ঞভূমির ওপর। লোভে তার হৃদয় আলোড়িত হল, কার্যাকার্য জ্ঞান লুপ্ত হল। তার ইচ্ছে হল সেই মুহূর্তে নৈমিবারণ্যের সুবর্ণময় যজ্ঞভূমি উৎখাত করে নিয়ে যান লোভেন হতবিজ্ঞান স্তদাদাতুং প্রচক্রমে। ইচ্ছা এবং প্রক্রিয়া একই সঙ্গে শুরু হল। যজ্ঞযাজী ঋষি-ব্রাহ্মণদের ধৈর্য বেশিক্ষণ থাকল না। তারা মন্ত্রপূত কুশের আঘাতে মেরে ফেললেন। পুরূরবাকে। ঋষিদের কুশাঘাত বস্ত্র হয়ে নেমে এল পুরূরবার ওপর। রাত্রির শেষে সূর্যোদয়ের আগেই মারা গেলেন পুরূরবা–ততো নিশান্তে… কুশবজৈ নিষ্পিষ্টঃ স রাজা ব্যাহরত্তনুম।

সেই একই কথা। বেণের যেমন হয়েছিল। ঋষিদের হাতে মারা গেলেন পুরূরবা। সবচেয়ে বড় কথা– পুরূরবার এই নৈমিষারণ্য অভিযানের সময়ে অর্থাৎ রাজা যখন সেই পুণ্যস্থানের সুবর্ণময় যজ্ঞভূমি লুণ্ঠনের চেষ্টা করছেন সেই সময়ে স্বর্গসুন্দরী উর্বশী কিন্তু পুরূরবার পাশেই আছেন– আজহার চ তৎসত্রং স্বর্বেশ্যাসহসঙ্গতঃ। তাহলে অন্তত বায়ুপুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী পুরূরবার জীবনে ব্রাহ্মণ-বিরোধিতার অংশটুকু উর্বশীর সঙ্গ-গন্ধ-বিরহিত নয়।

আশ্চর্যের বিষয় হল- পৌরাণিকেরা যে সব সূত্র থেকে পুরূরবার জীবন কাহিনী বিবৃত করেছেন, সেইসব সুত্রের মধ্যে একমাত্র মহাভারত বায়ু এবং ব্রহ্মান্ড পুরাণ ছাড়া আর কোথাও এই ব্রাহ্মণ-বিরোধিতার তথ্যটুকু তেমনভাবে ধরা নেই। উর্বশীর সঙ্গে পুরূরবা মিলন-বিরহের অধ্যায়টুকু আমরা না হয় আলদাভাবে একটা নতুন স্তরেই সাজিয়ে নেব। কিন্তু পুরূরবার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের বিরোধিতা যে একটা হয়েছিল এবং পুরোপুরি মারা না গেলেও তার যে সাময়িক রাজ্যচ্যুতি গোছের কিছু হয়েছিল, তা মহাভারতের অন্য অংশ থেকেও বোঝা যায়। না, স্পষ্ট করে রাজ্যচ্যুতির কথা কিছু বলা নেই মহাভারতে। কিন্তু যে ভাবেই হোক তেমন কোনও বিপাকে তাকে অবশ্যই পড়তে হয়েছিল, তা বোঝা যায় মহাভারতের শান্তিপর্বে এসে। রাজ্যশাসন চালাতে গেলে ব্রাহ্মণদের ভূমিকা যে কতটা জরুরি, অপিচ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের পারস্পরিক সমন্বয় যে কতটা প্রয়োজনীয়, সে কথা পুরূরবার নানা প্রশ্নে সাতঙ্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছে।

মহাভারতের শান্তিপর্বে পুরূরবার সঙ্গে একজন দেবতা এবং একজন ঋষির কথোপকথন সংকলিত হয়েছে। দেবতা এবং ঋষি-দুজনের কাছেই পুরূরবার প্রশ্ন ছিল একটাই–কিসে বড় ব্রাহ্মণরা? এবং কেনই বা পদে পদে মানিয়ে চলতে হবে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে? বেণের ক্ষেত্রে তার পরবর্তী বংশজ পৃথু মহারাজকে ব্রাহ্মণেরা রাজা করেছিলেন; কারণ বেণ ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তিনি কাউকে মানতেন না এবং তার অত্যাচার ছিল প্রাবাদিক পর্যায়ের। পুরূরবার অত্যাচার ব্যাপারটা সে রকম নয় বোধ হয়। তার নামে যে ব্রাহ্মণদের ধন-রত্ন লুণ্ঠনের দোষারোপ করা হয়েছে, আমাদের ধারণা–তার কারণ নিহিত আছে তার রাজ্য শাসনের পদ্ধতিতে। প্রাচীন নিয়ম অনুযায়ী ব্রাহ্মণরা যেহেতু যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা নিয়েই থাকতেন তাই রাজারা তাদের ওপর কোনও করের বোঝা চাপাতেন না। এই সাধারণ নীতির কথাটা কালিদাস তার নাটকের মধ্যেও বলে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। মহারাজ দুষ্যন্ত যখন শকুন্তলাকে প্রথমবার দেখে এসে বনের মধ্যে বিদূষকের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, তখন তার সমস্ত মন-প্রাণ আচ্ছন্ন। শকুন্তলা ছাড়া আর কিছু তিনি ভাবতেই পারছেন না। আরও একটিবার যাতে শকুন্তলার সঙ্গে দেখা করা যায়–তার জন্য যুক্তিবুদ্ধি, নানা ওজর এবং বাহানা তৈরি করতে লাগলেন। দুষ্যন্ত বললেন– তপস্বীরা যে আমাকে কেউ কেউ চিনেও ফেলেছে। এখন বলো তো কী করে আবার সেই কণ্ব-মুণির আশ্রমে ঢুকি? বিদূষক বললেন–তুমি দেশের রাজা। তোমার আবার অত ছুতো বার করার প্রয়োজন কী? বললেই হল- নীবার-ধানের একের ছয় ভাগ দেওয়ার কথা তোমাদের, সেই জন্য আবার এসেছি। রাজা বললেন–তুমি একটি মূর্ব। অন্য জাতিবর্ণের লোকেরা আমাদের যে কর দেয় তা বড়ই নম্বর। এঁদের রক্ষা করার জন্য আমরা অন্য জিনিস পেয়ে থাকি। ধনরত্বের চেয়ে তা অনেক বড়। ওঁরা ওঁদের তপস্যার এক ভাগ দেন রাজাকে। রাজার কাছে সেই তপস্যার পুণ্যধন অক্ষয়। অর্থাৎ করের কোনও প্রশ্নই নেই। ধর্মশাস্ত্রগুলিতেও ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ হয়েছে। চরম ভাষায়। কিন্তু পুরূরবা ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে কর নিতেন। কী খাতে সেই কর সংগ্রহ করা হত, তা স্পষ্ট করে না জানা গেলেও মহামতি কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের মধ্যে সেই খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শর্তাব্দীতেই জানিয়ে দিয়েছেন–পুরূরবার সর্বনাশ হয়েছে চতুর্বর্ণের সব মানুষের ওপর ট্যাকস চাপিয়ে—লোভাদ ঐলশ্চাতুবর্ণম অত্যাহারয়মাণঃ।

আমাদের ধারণা, এই কর গ্রহণের নীতিই সাময়িকভাবে পুরূরবার রাজ-সিংহাসন কন্টকিত করে তুলেছিল এবং ঠিক এই পর্যায়ে তার মনে অবধারিত প্রশ্ন জেগেছে–ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের চাইতে কিসে বড়–কস্মাচ্চ ভবতি শ্ৰেষ্ঠস্তন্মে ব্যাখাতুমহতি? বায়ুদেবতার সঙ্গে তার এই কথোপকথনের প্রসঙ্গে আরও একটা বড় প্রশ্ন জেগেছে পুরূরবার মনে। তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন–আপনি ঠিক করে বলুন তো আমাকে শাসন করার জন্য এই যে পৃথিবী ক্ষত্রিয়দের অধিকারে আসে, সেই পৃথিবী আসলে কার প্রশাসনে থাকবে? যে রাজা বাহুবলে এই পৃথিবীর অধিকার লাভ করেন, পৃথিবী কি সেই ক্ষত্রিয়ের ভোগ্য, নাকি ব্রাহ্মণের–দ্বিজস্য ক্ষত্রবন্ধো বা কস্যেয়ং পৃথিবী ভবেৎ?

বায়ু দেবতা জাতি-বর্ণের অণুক্রমে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব পুরূরবাকে বুঝিয়েছেন। ব্রাহ্মণ শুধু বর্ণ-শ্রেষ্ঠ নয়, বর্ণ-জ্যেষ্ঠও বটে। আর পৃথিবীর অধিকার? বায়ু উপমা দিয়ে বলেছেন- সে হল ঠিক স্বামী আর দেবরের মতো। সেকালের দিনে স্বামী মারা গেলে চিৎ কখনও স্বেচ্ছায় সহমরণের কথা শোনা যায় বটে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই বিধবা স্ত্রী স্বামীর ছোট ভাইকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতেন। ঋগবেদ থেকে আরম্ভ করে পুরাণ পর্যন্ত সর্বত্রই দেখা যাবে যে, অনেক স্ত্রীই স্বামীর মৃত্যুর পর দেবরকে বিবাহ করেছেন। বায়ু এই উপমাটি স্মরণ করে পুরূরবাকে বললেন-দেখ, এই সমস্ত ভূমিখন্ডের স্বত্ব ব্রাহ্মণেরই বটে। কোনও রাজার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ যে ভূমির অধিকার ভোগ করেন, যে শস্য-সম্পদ তিনি খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করেন, সে সবই কিন্তু তারই। অর্থাৎ তিনি কারও পাচ্ছেন-পরছেন না, তিনি নিজেরটাই নিজে ভোগ করছেন, নিজেরটাই খাচ্ছেন। এমন কি তিনি যদি কাউকে কিছু দেন–জমি-জায়গা যা কিছু– সেও তিনি নিজেরটাই দিচ্ছেন–স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুভক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।

অন্যদিকে কোনও ভূমিখণ্ডের শাসনকর্তা হিসেবে ক্ষত্রিয় যে রাজ্য ভোগ করছেন সেটা হল অনেকটা ওই মৃত-জ্যেষ্ঠের স্ত্রীর অধিকার-লাভের মতো। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ তার যজন-যাজনের বৃত্তিতে স্থিত থেকে রাজ্যের অধিকার ত্যাগ করেন স্বেচ্ছায়। তিনি রাজ্য শাসন করেন না, অতএব তাঁর পরিত্যক্ত রাজ্য ভোগ এবং শাসন করেন ক্ষত্রিয়। পৃথিবী যেন এক বিবাহিতা রমণী; তিনি যেন জ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ স্বামীর অভাবে ক্ষত্রিয়কেই অধিকারী হিসেবে নির্বাচন করেছেন–আনন্তৰ্য্যাত্তথা ক্ষত্রং পৃথিবী কুরুতে পতিম।

কথাটা আজকের সামাজিক পরিস্থিতিতে তেমন করে বোঝা যাবে না। ব্রাহ্মণরা ত্যাগ-বৈরাগ্য, পরোপকারের সমস্ত বৃত্তি আজই ভুলে গেছে, তা নয়। ব্রাহ্মণদের ভাঙন শুরু হয়েছে বহুঙ্কাল। খ্রিস্টিয় নবম-দশম শতাব্দীতেই অপক্ষীণ ব্রাহ্মণ্য নিয়ে সজ্জনদের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। সে প্রমাণ অন্যত্র দেব। কিন্তু মহাভারতের যুগে বিদ্যাবত্তা, ত্যাগ-বৈরাগ্য এবং পরোপকার বৃত্তি ব্রাহ্মণ-সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। লক্ষ্য করে দেখবেন–ব্রাহ্মণ ঋষি বাড়িতে এলে রাজারা শুধু আত্মনিবেদনই করতেন না, আপন ভোগ্য রাজ্যটিও তারা বিনা দ্বিধায় ব্রাহ্মণের হাতে তুলে দিতেন। ব্রাহ্মণরা এই আদর স্বীকার করতেন, কিন্তু তাই বলে রাজ্যের দিকে হাত বাড়াতেন না। উপস্থিত ব্রাহ্মণকে এই রাজ্য-নিবেদনের কথা মহাভারতে বহু জায়গায় আছে। উদাহরণ হিসেবে আপনারা সেই মুহূর্তটুকু পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যখন দ্রোণাচার্যকে ভীষ্ম ডেকে এনেছিলেন বাড়ির বালকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। ভীষ্ম তাকে বলেছিলেন- আপনি এসেছেন এই বড় অনুগ্রহ। কুরুদের যা আছে বিত্ত বৈভব রাষ্ট্র সবই আপনার। আপনিই এখানকার রাজা, আমরা আপনার ভৃত্য– ত্বমেব পরমো রাজা সর্বে চ কুরব স্তব।

সেকালে উপযুক্ত ব্রাহ্মণদের প্রতি রাজা-মহারাজাদের এই ভাবটুকুই ছিল। তবে এই সমন্বয় আসতেও কিছু সময় লেগেছে বলে মনে হয়। আর্যায়ণের প্রথম কল্পে বেণকে যেমন আমরা দেখেছি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে পুরূরবার ক্ষেত্রেও যা দেখলাম, তাতে মনে হয় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের পারস্পরিক বোঝাবুঝিতেও সময় লেগেছে কিছু। পুরূরবার প্রশ্ন থেকেই বোঝা গেছে ব্রাহ্মণদের সর্বময় কর্তৃত্বে তার সংশয় ছিল, উপেক্ষা ছিল। বায়ুদেবতার মুখ দিয়ে যে উপদেশ শুনতে পাচ্ছি, তাতে ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে পুরূরবার সংশয় এবং দ্বিধাটুকু পরিষ্কার বোঝা যায়। আরও বোঝা যায় কাশ্যপ মুনির সঙ্গে পুরূরবার কথোপকথনে।

ঐল পুরূরবা কাশ্যপ মুনিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন–ব্রাহ্মণ যদি ক্ষত্রিয়কে ত্যাগ করে অথবা উটোটা যদি হয়, ক্ষত্রিয় যদি ব্রাহ্মণকে ত্যাগ করে, তাহলে সাধারণ প্রজারা কাকে আশ্রয় করে, কার ওপরেই বা নির্ভর করে? কাশ্যপ বললেন- বিচক্ষণ লোকেরা জানেন যে, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় যদি নিজেরা নিজেরা বিবাদ-বিসংবাদ করে, তাহলে ক্ষত্রিয়ের রাজ্য থাকে না, রাজ্য চলে যায় দস্যুদের হাতে–ব্রাহ্ম-ক্ষত্রং যত্র বিরুধ্যতীহ/ অন্বগলং দস্যবস্ত ভজন্তে। এই প্রশ্নোত্তর থেকেই বোঝা যায় পুরূরবার জীবনে কী ঘটেছিল। আপন রাষ্ট্রে তিনি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বিরোধিতা করেছিলেন এবং তার রাজ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতোই হয়েছিল। হয়তো ধ্বংসসান্মুখ অবস্থায় এই কথোপকথন তাকে তখনকার সমাজের প্রচলিত পথে চলতে প্রেরণা জুগিয়ে থাকবে এবং হয়তো বা তিনি নিজেকে খানিকটা শুধরেও নিয়েছিলেন।

 কাশ্যপের উত্তরদানের মধ্যে বার বার একটা কথা উচ্চারিত হয়েছে–যদি ক্ষত্রিয়েরা ব্রাহ্মণকে ত্যাগ করেনদা ব্ৰহ্ম ক্ষত্রিয়াঃ সংত্যজন্তি। বার বার সেই একই আশঙ্কা, কেন না পুরূরবা সেই আশঙ্কা তৈরি করেছিলেন। মনে রাখা দরকার এখনকার দৃষ্টিতে এই ব্রাহ্মণ্য কিন্তু চাল-কলার ভিক্ষাসর্বস্ব পৌরোহিত্য নয়। এখানে ব্রাহ্মণ সেকালের সমস্ত বিদ্যাবত্ত এবং সংস্কৃতির প্রতীক আর রাজা বা ক্ষত্রিয় হলেন রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক। অন্যথায় আজকের জাতি-ব্রাহ্মণ্য নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বরঞ্চ ঘৃণা আছে। বিদ্যা-শিক্ষাহীন ক্ষাত্রশক্তি বা শাসন কোন পর্যায়ে চলে যেতে পারে এখনকার ভারতই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আমরা যেমন বলি-রাজনীতিকরা সব লুটে-পুটে খাচ্ছে, ওঁরা সেটাকেই বলেন–অম্বগবলং দস্যবস্ত ভজন্তে বিদ্যাব্রাহ্মণ আর ক্ষাত্রশক্তির বিরোধিতার সুযোগে দস্যুরা তাদের অধিকার কায়েম করে। এখনকার রাজনীতিকদের স্বার্থসর্বস্ব দস্যু ছাড়া কীই বা আর বলব?

রাজধর্ম নিয়ে পুরূরবার সঙ্গে বায়ুদেবতা এবং কাশ্যপ মুনির সঙ্গে এই কথোপকথন আমরা পুরূরবার জীবনের একটা অধ্যায় বলে মনে করি। তবে সনকুমার যখন ব্রহ্মলোক থেকে তাকে বোঝাতে এসেছিলেন এই কথোপকথন সেই সময়ে হয়নি বলেই মনে হয়। আমাদের ধারণা, ব্রাহ্মণরা যখন কুশবদ্রে পুরূরবাকে ধ্বংস করলেন অথবা তার রাজ্যচ্যুতি ঘটালেন, এই কথোপকথন এসেছে সেই সময়ে। কারণ পুরূরবা এখন অনেক শান্ত এবং জিজ্ঞাসু। ঋষিরা, দেবতারা তার সংশয় নিরসন করেছেন-ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মিলনের সমাধান দিয়ে। পুরূরবা এই সমাধান স্বীকার করেছেন নিশ্চয়।

আমরা এই রকমই একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছি, কেন না বেদ থেকে আরম্ভ করে পুরাণ পর্যন্ত সর্বত্রই পুরূরবার মাহাত্ম কীর্তিত হয়েছে ভূরি ভূরি। ব্রাহ্মণ্য-বিরোধের সঙ্কট থেকে মুক্ত হয়ে পুরূরবা আবারও নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন বলেই মনে হয় এবং তার অসংযমের ইতিহাসটুকু বেদ-পুরাণ আর মনে রেখে দেয়নি। মহাভারত এবং মহাভারতের অনুসরণে আরও দু-একটি পুরাণ পুরূরবার জীবনের এই কলঙ্কিত অংশটুকু বর্ণনা করেছে বটে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত পুরাতন গ্রন্থগুলি, যেমন শতপথ ব্রাহ্মণ বা বেদ-এইসব জায়গায় পুরূরবার সঙ্গে স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর মিলন কীভাবে হল–তারই হার্দিক বর্ণনা আছে শুধু। ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতার মতো গদ্যজাতীয় সাময়িক ইতিহাস নিয়ে এইসব গ্রন্থের লেখকরা বিব্রত হননি। কিন্তু মহাভারতের কবি যেহেতু ঐতিহাসিকের মতো বেশ বড়সড় একটা মন্তব্য করেছেন পুরূরবার ব্রাহ্মণ্য-বিরোধিতা নিয়ে, আমাদেরও তাই খানিকটা সময় দিতে হল ঐতিহাসিকদের সূত্র বজায় রেখে। তবে এবার আমরা কাব্যে চলে যাব। কারণ স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর সঙ্গে মর্ত্য রাজা পুরূরবার মিলনের ইতিহাসটুকু স্বাভাবিক কারণেই ব্রাহ্মণ্য-বিরোধিতার অংশ থেকে মধুরতর এবং আমাদের কাছে তা অন্য কারণে গুরুতরও বটে।

উর্বশী-পুরূরবার মিলন-কাহিনী অতি প্রাচীন এবং জটিল। এই কাহিনীর উপাদান আছে খোদ ঋগবেদে, শতপথ ব্রাহ্মণে, মহাভারতে তো বটেই এবং আছে বিভিন্ন পুরাণে। কাহিনীটি বেদে যেমন আছে, তা যেন আদি-অন্তহীন একটা মাঝখানের সংলাপের মতো। তা থেকে আগুপিছু বোঝা যায় না কিছুই। শতপথ ব্রাহ্মণের মতো প্রাচীন গ্রন্থ তাই বেদোক্ত এই সংবাদ-সূক্তের ভূমিকা রচনা করে দিয়েছে। অন্যদিকে প্রাচীন পুরাণগুলি উর্বশী-পুরূরবার মিলন কাহিনী গ্রন্থনা করেছে বেদ এবং শতপথ ব্রাহ্মণের উপাদান একত্রিত করে। বেদ-ব্রাহ্মণ এবং পুরাণের এই প্রিয় বিষয়টির জনপ্রিয়তা এতই বেশি ছিল মহাকবি কালিদাসও এই রোমাঞ্চকর কাহিনীর আবেদন ঠেলে ফেলতে পারেননি। তিনি ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নামে সেই বিখ্যাত নাটকটি লিখে আপন কালের কাছে ঋণমুক্ত হয়েছেন।

সবাই জানেন–উর্বশী স্বর্গের এক সুন্দরী অপ্সরা। পৌরাণিকেরা কেউ তার উৎপত্তি ঘোষণা করেছেন সমুদ্রমন্থনের অন্যতম ফল হিসেবে, কেউ বা তার উৎপত্তির কথা বলেননি। জন্ম-মরণের বাঁধা ছকে উর্বশীকে অনেকেই দেখতে চান না। তিনি শুধু সুন্দরী রূপসী নই মাতা নহ কন্যা গোছের। অনাদি অনন্ত কাল ধরে তিনি আছেন, শুধু যৌবনবতী উর্বশী। বেদের মধ্যে যেহেতু উর্বশীকে প্রথম পাই, তাই তার নাম নিয়ে অর্থচর্চা আরম্ভ হয়েছে প্রায় বেদের আমল থেকেই। পাশ্চাত্য পন্ডিতেরা যেহেতু বিভূতিযুক্ত সমস্ত মহাজনের মধ্যেই সূর্যের প্রতীক দেখতে পান, অতএব পুরূরবা তাদের কাছে Solar hero আর উর্বশী হলেন উষার প্রতীক। প্রভাতের আলো ফুটবার আগে উষার অরুণিমা চোখে দেখি মোহিনী মায়ার মতো। উর্বশী সেই উষা। ঋগবেদের সংবাদসূক্তে উবর্শীর সঙ্গে মিলনের জন্য পুরূরবার অনন্ত হাহাকার আছে। ক্ষণিকোদিতা উষার পেছন পেছন চলা সূর্যের মিলনেন্সার মধ্যেই আছে একই হাহাকার-ধ্বনি। পুরূরবা-উর্বশীর মিলন-বিরহ তাই পাশ্চাত্য বৈদিকের কাছে সূর্য আর উষার মিলন-বিরহের সুরে বাঁধা। ম্যাক্স মুলার অতি সরল ভাষায় বেদের কথা বলবেন–Urvasi loves pururavas মানে আর কিছুই নয়–the sun rises, আবার Urvasi sees pururavas naked sic the dawn is gone. Wasica Urvasi finds puruavas again gerte the sun is setting.

কে বলে বৈদিক কবিরা ইনটেলেকচুয়াল ছিলেন না। এত প্রতীকী কবিতা যাঁরা খ্রিস্টজন্মের অন্তত হাজার বছর আগে লিখতে পেরেছেন, তাদের ভাবনা-চিন্তা যে যথেষ্ট আধুনিক–সে কথা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কী জানেন, এসব প্রতীকী বিবরণে এখনই আমরা মন দেব না, কারণ পুরূরবা কিম্বা উর্বশীকে আমরা কল্পলোকের অধিবাসীও মনে করি না, রূপকও মনে করি না। চন্দ্রবংশের তৃতীয় পুরুষেই যদি রূপক এসে যায়, তবে মহাভারতের ইতিহাস আরম্ভেই স্থালিত হবে। আমাদের মতে পুরূরবা রীতিমতো ঐতিহাসিক পুরুষ এবং আর্যায়ণের দ্বিতীয় পর্যায়ে আর্যদের সভ্যতা যখন উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত প্রসারিত হল, তখনও পুরূরবার ব্যবহার ঐতিহাসকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এমন কি উর্বশীকেও এই সূত্রে বুঝে নেওয়া অসম্ভব নয়।

আমি আগেই জানিয়েছি–পুরূরবার পিতা বুধ পুত্রের জন্ম দিয়েই স্বর্গে ফিরে গেছেন, এমন কি তার পালক পিতা সুদ্যুম্নকেও আমরা ইলাবৃতবর্ষে ফিরে যেতে দেখেছি। অর্থাৎ তখনও পর্যন্ত স্বর্গভূমির সঙ্গে এই পৃথিবী বা ভারতবর্ষের যোগাযোগ যথেষ্ট রয়েছে। আরও লক্ষণীয় বিষয় হল–ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলে পুরূরবাকে আমরা স্বয়ং মনুর সঙ্গে উল্লিখিত হতে দেখেছি এবং সেই একই ঋক্‌মন্ত্রে তিনি অগ্নিদেবের বন্ধুত্বমগ্নে মনবে দ্যামবাশয়ঃ পুরূরবসে সুকৃতে সুকৃত্তরঃ। এই ঋকের অর্থ হল- অগ্নি! রাজা পুরূরবা ভাল কাজ করলে তুমি তাকে বেশি ফল দিয়েছ। পরিষ্কার বোঝা যায়, পুরূরবা আগে ভাল কাজ করেননি। যখন করেছেন, তখন ভাল ফলও পেয়েছেন দেবতার কাছে।

পুরূরবা অগ্নিদেবের বন্ধু কী করে হলেন সে কথা পরে আসবে। কিন্তু পূবোক্ত ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতার কথা মনে রেখেও ঋগবেদ তাকে উল্লেখ করেছে পরম উপকারী বলে ‘সুকৃত’ বলে। অন্যদিকে পুরাণগুলি খুললে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠিত ওঠা-বসার কথা এতই প্রকট হয়ে উঠবে যে, উর্বশীর মতো স্বর্গসুন্দরীকে মত মানুষ পুরূরবার স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করাটাও অলৌকিক ভাবনা বলে মনে হবে না।

উর্বশী স্বর্গের অপ্সরা বলে পরিচিত। সাধারণভাবে অপ্সরারা জলের সঙ্গে জড়িত বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। সংস্কৃত ‘অপ’ শব্দের অর্থ জল,আর সৃ’ ধাতুর অর্থ হল সরে সরে যাওয়া। এই দৃষ্টিতে পণ্ডিতদের ব্যাখ্যায় অপস্বিয়মান মেঘই হল অঙ্গরা। আবারও বলি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এই রূপকও আমাদের পছন্দ নয়। আমাদের ধারণা-সেকালের প্রাচীন জনপদগুলির মধ্যে উত্তর ভারতের বিভিন্ন নদ-নদী এবং পর্বতের সানুদেশে যে সমস্ত সুন্দরী রমণীর দেখা পাওয়া যেত, তারাই অপ্সরা। ইতিহাস-পুরাণে অপ্সরারা প্রধানত নৃত্যের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বেদের ভাষায় তারা দেবপত্নী’ও বটে।

 ‘দেবপত্নী’ শব্দটার মধ্যে যতই মর্যাদা থাকুক মূলত অপ্সরারা ছিলেন স্বৰ্গবেশ্যা। দেবতারা আপন রতিসুখ চরিতার্থ করতেন এদের দিয়েই এবং প্রয়োজনে এদের ব্যবহার করতেন তাদের ওপর, যারা স্বর্গ অধিকার করে নিতে চান। অর্থাৎ দেবতা নামক উন্নতবুদ্ধির মানুষরা উন্নতিকামী ব্যক্তিকে অপ্সরার ভোগসুখে মত্ত রেখে নিজের অধিকার মজবুত রাখতে চেষ্টা করতেন। পুরুষের ব্যাপারে অপ্সরারা ছিলেন অত্যন্ত খোলামেলা এবং তাদের লাজ-লজ্জাও ছিল কম। ফলে শারীরিক সৌন্দর্য এবং দৈহিক আকর্ষণ দুটিই তারা প্রকটভাবে ব্যবহার করতেন উন্নতিকামী পুরুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার জন্য।

সেকালের দিনে গণিকারাই ছিলেন যথাসম্ভব শিক্ষিত এবং বিদগ্ধা রমণী। সেদিক দিয়ে স্বৰ্গবেশ্যা অপ্সরা-সুন্দরীরা আরো এক কাঠি ওপরে। আর উর্বশীর তো কথাই নেই। তিনি অঙ্গরা সুন্দরীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতমা, নাগরিক বৃত্তির যোগ্যতম আধার। শুধুই স্বৰ্গবেশ্যামাত্র হলে স্বয়ং কবিগুরুর হাত দিয়ে অমন সুন্দর কবিতাটি উপহার পেতাম না, আর কবির কবি কালিদাসও তাকে তার নাটকের নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করতেন না। উর্বশীকে তাই একটু অন্য চোখে আমাদের দেখতে হবে এবং উর্বশীর সৃষ্টিও বড় সাধারণভাবে হয়নি।

.

২২.

 বাবা যদি বলতেই হয় তবে ব্যাকরণ-সম্মতভাবে নির্ভুল নর-নারায়ণ–এই যুগল ঋষিকেই সুন্দরীশ্রেষ্ঠা উর্বশীর বাবা বলে মেনে নিতে হবে। ঋষি নর-নারায়ণ এবং উর্বশী কেমন যেন বিপরীত শোনায়। মহাভারত পাঠের আগে একটি মঙ্গলাচরণ-শ্লোক উচ্চারণ করতে হয়। সেই শ্লোকের আরম্ভটা এইরকম–নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্। ভগবান নারায়ণ আর নরশ্রেষ্ঠ নর নামক পুরুষকে নমস্কার করে মহাভারত পাঠের নিয়ম। নর-নারায়ণ এই যুগল দেবতা বিষ্ণুর সাক্ষাৎ অংশ বলে পরিচিত। মহাভারতের পরবর্তী অংশে নর-নারায়ণকে অর্জুন এবং কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম করে দেখা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হল, নর-নারায়ণ নামে দুই যুগল ঋষির কল্পনাও আছে পুরাণে। তবে ঋষি হলেও পুরাণগুলিতে নর-নারায়ণ ঋষির মাহাত্ম্য বিষ্ণুর থেকে কোনও অংশে কম নয় এবং আপাতত তাদের ঋষি ধরে নিয়েই আমাদের কথা আরম্ভ করতে হবে; কারণ পুরূরবার প্রেয়সী উর্বশীর জনক এই যুগল ঋষির একজন।

নর-নারায়ণ হিমালয়ের বদরিকাশ্রমে গিয়ে কঠোর তপস্যায় মন দিলেন। অতি অদ্ভুত সেই তপস্যা। তাদের তপস্যার তেজে তিন ভুবন যেন তাপিত হয়ে উঠল। স্বর্গরাজ্যের অধীশ্বর ইন্দ্র প্রমাদ গণলেন। শেষপর্যন্ত হয়তো তার ইন্দ্র-পদটাই চলে যাবে। ইন্দ্র ঠিক করলেন যেভাবে যোক এই দুই মুনির তপস্যা নষ্ট করে দিতে হবে। তিনি নিজে ঐরাবতে চড়ে উপস্থিত হলেন ঋষিদের তপস্যা-ভূমিতে। ঋষিদের উদ্দেশে বললেন–আপনারা কী চান বলুন? আমি আপনাদের তপস্যা দেখে বড় খুশি হয়েছি। অতএব না দেওয়ার মতো জিনিস হলেও আপনারা চাইলে তা দেব–অদেয়মপি দাস্যামি তুষ্টোস্মি তপসা কিল।

ইন্দ্র অনেকবার একই কথা বললেন। কিন্তু মুনিরা এতই যোগযুক্ত হয়ে তপস্যায় ডুবে আছেন যে, ইন্দ্রের কথা তারা কানে শুনতেই পেলেন না। উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা। ইন্দ্র তখন ভয় দেখাতে আরম্ভ করলেন। দৈবী মায়া বিস্তার করে দুই ঋষিকে ভয় দেখানো শুরু করলেন। বাঘ-সিংহ থেকে আরম্ভ করে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত, আগুন লাগানো কিছুই বাদ গেল না। ঋষিদের ধ্যান ভাঙল না, তপস্যা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচলিত করা গেল না তাদের।

 ইন্দ্র এবার ভালবাসার দেবতা কামদেবকে স্মরণ করলেন। তার সঙ্গে এলেন ঋতুরাজ বসন্ত। যে কামদেবকে ইন্দ্র অন্য সময় খুব বেশি একটা আমল দেন না, প্রয়োজন বুঝে ইন্দ্র তাকে খুব তোয়াজ করলেন। বললেন- ভাই! তোমার মতো ক্ষমতাবান দেবতা আর কে আছে এই তিন ভুবনে? দেব, দানব, মানব–সবারই মন একেবারে উথাল-পাথাল করে দিতে পার তুমি। একমাত্র তুমি পারবে এই কাজটি করতে। বদরিকাশ্রমে কঠোর তপস্যা করছেন নর-নারায়ণ নামে দুই মুনি। ভালবাসার ঘায়ে মোহিত করে দিতে হবে তাদের মন, উচাটন করে দিতে হবে হৃদয়-বশীকুরু মহাভাগ মুনী ধর্মসূতাবপি।

ইন্দ্র দুই ঋষির অবিচল ভাবের কথাও কামদেবকে জানাতে ভুললেন না। তাদের যে তিনি বর দিয়ে মনস্কামনা পূরণ করার চেষ্টা করেছিলেন–তাও বললেন। বাঘ-সিংহের ভয়, দেখানোর কথাও বললেন। সব বললেন। তারপর কামদেবকে খুব খানিকটা মাথায় উঠিয়ে দিয়ে বললেন–সমস্ত স্বর্গসুন্দরী গণিকা আমি তোমার সাহায্যের জন্য প্রস্তুত রেখেছি। আমি জানি-একা তিলোত্তমা অথবা একা রম্ভা অথবা একা তুমিই এই সামান্য কাজ করে দিতে পার। সেখানে তোমরা যখন সকলে একসঙ্গে এই কাজে নামছ, সেখানে সাফল্যের প্রশ্নে আমার কোনও সন্দেহই নেই–ত্বমেবৈকঃ ক্ষমঃ কাম মিলিতৈঃ কস্তু সংশয়ঃ। কামদেব ইন্দ্রের স্তুতিবাদে মুগ্ধ হয়ে তাকে সবরকমভাবে আশ্বস্ত করে মেনকা-রম্ভা-তিলোত্তমাদের নিয়ে বদরিকাশ্রমে অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখলেন–ঋষিদ্বয় দুশ্চর তপস্যায় মগ্ন।

 অকাল বসন্তের উদয় হল বদরিকাশ্রমে। বসন্তের ফুল ফুটল বন আলো করে। সময় বুঝে রম্ভা-তিলোত্তমারা বসন্ত রাগে গান ধরলেন সুরে সুরে তালে তালে নাচও শুরু হল তাদের। কোকিলের কুজন আর অপ্সরাদের নৃত্যগীতের ছন্দে নর-নারায়ণ দুই ঋষির তপোযোগ ভঙ্গ হল। ক্ষণিকের জন্য তাদের মন উচ্চকিত হল। আকালিক বসন্তের শোভায় তাদের মন ভরে গেল বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তারা এই ঋতু পরিবর্তনের কারণও ভাবতে লাগলেন। নারায়ণ ঋষির মন অবশ্য এতই আপ্লুত ছিল যে তিনি সোচ্ছ্বাসে নর-ঋষিকে বসন্তের কাব্যও শুনিয়ে দিলেন খানিকক্ষণ ধরে। শেষ পর্যন্ত নৃত্যরতা অপ্সরাদের দিকে যখন নজর পড়ল, তখন দুই ঋষিই বুঝলেন–স্বর্গের রাজা ইন্দ্র বিব্রত হয়ে তাদের ধ্যানভঙ্গের ব্যবস্থা করেছেন। তারপর রম্ভা, তিলোত্তমা, মেনকা, ঘৃতাচী-প্রমুখ সুন্দরীশ্রেষ্ঠা অঙ্গরাদের সঙ্গে স্বয়ং কামদেবকে উপস্থিত দেখে তাদের সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হল। তারা সাভিনয়ে নির্বিকার চিত্তে অঙ্গরাদের গান শুনতে লাগলেন।

দুই ঋষির একতম নারায়ণের মনে কিন্তু একটু ক্ষোভের সঞ্চার হল। অপ্সরাদের সম্বোধন করে নারায়ণ ঋষি বললেন- হ্যাঁগো সুন্দরীরা। স্বর্গ থেকে এখানে অতিথি হয়ে এসেছ। তা বোসো আরাম করে। আমরা অতিথির যোগ্য সৎকার করব–আস্যতাং সুখমত্রৈব করোম্যাতিথ্যমদ্ভুত। নারায়ণ ঋষি মনে মনে ভাবলেন- ইন্দ্র যখন কাম-লোভহীন বৈরাগী ঋষিদের তপোবিঘ্ন করার জন্য এমন অসমীচীন পথ বেছে নিয়েছেন, অতএব তাকে একটু ক্ষমতা প্রদর্শন করা দরকার। নারায়ণ ঋষি সকৌতুকে নিজের উরুতে একটি চাঁটি মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার উরু থেকেই জন্ম নিল এক সর্বাঙ্গ সুন্দরী রমণী–করেপোড়ং প্রতাড্য বৈ। তরসোৎপাদয়ামাস নারীং সর্বাঙ্গসুন্দরী। নারায়ণের উরু থেকে জন্ম হওয়ার ফলেই সেই রমণীর নাম হল উর্বশী। শুধু উর্বশীই নন, ইন্দ্রদেব যত অপ্সরা পাঠিয়েছিলেন, ঋষি নারায়ণ তত অঙ্গরা সৃষ্টি করে ফেললেন চোখের নিমেষে।

ইন্দ্রের কাছ থেকে এসেছিলেন যাঁরা, কামদেব আর অপ্সররা–তারা সবাই নারায়ণ-ঋষির তপঃপ্রভাব দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলেন এবং নিজেদের দোষ স্বীকার করলেন। নর-নারায়ণ খুশি হলেন। ইন্দ্রের প্রতি অভিশাপ উচ্চারণ করে তারা তাদের তপস্যার শক্তিও ক্ষয় করলেন না। শান্ত মনে তারা অপ্সরাদের বললেন–দেবরাজ আমাদের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য তোমাদের পাঠিয়েছিলেন এখানে, তার উত্তরে আমরা এই উর্বশীর মতো অসাধারণ সুন্দরীকে উপহার দিলাম দেবরাজকে। সে তোমাদের সঙ্গে স্বর্গে যাক্ দেবরাজের প্রীতির জন্য- উপায়নমিয়ং বালা গচ্ছত্বদ্য মনোহরা।

সেই থেকে উর্বশী স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্রসভার অলংকার। অপ্সরা-সমাজে তার মতো বিদহ্মা এবং লোক-মোহিনী আর দ্বিতীয় কেউ নেই। অন্য অঙ্গরাদের মতো তত সাধারণী নন উর্বশী। অপ্সরাদের বৃত্তি খানিকটা গণিকাবৃত্তির পর্যায়ভুক্ত হলেও, উর্বশী তত সহজলভ্য নন। এমনই তার রূপ যে তাকে দেখামাত্র মানুষের মানসিক স্থিরতা নষ্ট হত, অতি বড় কঠিন তপস্বীরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেত।

 ভালই ছিলেন উর্বশী। ইন্দ্রের দেওয়া বাসভবনে অলস-শৃঙ্গার রচনা করে, বৈজয়ন্ত প্রাসাদের স্ফটিকসভায় নৃত্য-কৌশল প্রদর্শন করে, আর মাঝে-মধ্যে শুষ্ক-রুক্ষ মুনি-ঋষির হৃদয় বিভ্রান্ত করে উর্বশীর দিন কেটে যাচ্ছিল ভালই। এরই মধ্যে একদিন তিনি ধনপতি কুবেরের তলব পেয়ে কৈলাসে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। হয়তো নৃত্যগীতের কোনও উৎসব-রঙ্গে নন্দনবাসিনী উর্বশীর উপস্থিতি প্রার্থিত ছিল কৈলাসনাথ কুবেরের। সেই নৃত্যগীত শেষ করে পুনরায় ইন্দ্রসভায় ফিরে আসছিলেন উর্বশী। তার সঙ্গে স্বর্গসুন্দরী অন্য অপ্সরারাও ছিলেন। রম্ভা, মেনকা, সহজনা–এইসব স্বনামধন্যা স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর পথসঙ্গিনী ছিলেন এই দীর্ঘপথে, আর ছিলেন উর্বশীর প্রিয়সখী চিত্রলেখা।

 কৈলাস থেকে ইন্দ্রসভার অর্ধেক পথ আসতেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। হিরণ্যপুরে থাকতেন দানব কেশী। দেবরাজ ইন্দ্র তার অত্যাচার এবং হঠাৎ আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হচ্ছিলেন বারেবারেই। মনোমোহিনী স্বর্গসুন্দরীদের ওপর যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়াটাও এই অত্যাচারের একটা অঙ্গ ছিল। কেশী দানব সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন অঙ্গরাশ্রেষ্ঠা উর্বশীকে হরণ করার। কুবের-সভা থেকে উর্বশী ফিরে আসছিলেন–এ খবর কেশীর জানা ছিল। সময়মতো কেশী ঝাঁপিয়ে পড়লেন অপ্সরা-সুন্দরীদের ছোট্ট দলটির ওপরে।সবাইকে তিনি ধরলেন না। একমাত্র উর্বশী আর তার প্রিয়সখী চিত্রলেখাকে নিয়ে তিনি নিজের রথে উঠলেন এবং আকাশবাহী রথখানি চালিয়ে দিলেন সবেগে।

রম্ভা, মেনকা, সহজন্যা– যাঁরা উর্বশীর সহগামিনী ছিলেন, তাদের মধ্যে কান্নার রোল উঠল। সমস্বরে শব্দ শোনা গেল–বাঁচাও বাঁচাও। কে কোথায় আছ বাঁচাও। দেবরাজ ইন্দ্রের বন্ধু যদি কেউ থাকেন এখানে, অথবা এমন কেউ যদি থাকেন যাঁর চলাফেরা আছে আকাশমাগে, তাহলে তিনি দয়া করে শুনুন আমাদের কথা–পরিত্রায়তাং পরিত্রায়তাং যঃ সুরপক্ষপাতী যস্য বাম্বরতলে গতিরস্তি।

অপ্সরাদের আর্ত ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেয়ে মর্ত্যভূমির এক রাজা রথ চালিয়ে এসে থামলেন অপ্সরাদের সামনে। তিনি সূর্যের উপাসনা সেরে, নাকি সূর্যদেবের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসছিলেন নিজের রাজ্যে। রাজা অঙ্গরাদের সামনে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন- আমার নাম পুরূরবা। সূর্যদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই আমি ফিরছি। বলুন, কোন বিপদ থেকে আপনাদের বাঁচাতে হবে? সময় বুঝে কথা বলতে আরম্ভ করলেন রম্ভা। তিনি বললেন–অসুরের হাত থেকে বাঁচাতে হবে, রাজা। অবাক হয়ে পুরূরবা বললেন–অসুররা আবার আপনাদের কী ক্ষতি করল? রম্ভা বললেন–সে অনেক কথা। আমরা সবাই ফিরছিলাম কুবের-ভবন থেকে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন উর্বশী। তাকে চেনেন তো মহারাজ? তিনি স্বর্গসভার অলংকার। তার রূপে লক্ষ্মী পর্যন্ত লজ্জায় মুখ লুকোবেন। আর তপস্যার তেজে যারা ইন্দ্রের ইন্দ্ৰত্ব কেড়ে নেবার উপক্রম করেন, সেই তপস্বীদের উদ্দেশে প্রয়োগ করার জন্য আমাদের এই উর্বশী হলেন ইন্দ্রের সবচেয়ে কোমল মারণাস্ত্রটি–যা তপোবিশেষপরিশঙ্কিতস্য সুকুমারং প্রহরণং মহেন্দ্রস্য। সেই উর্বশীর সঙ্গে আমরা কুবের-ভবন থেকে ফিরছিলাম। এইসবে অর্ধেক পথ এসেছি। আর কোথা থেকে হঠাৎ সেই হিরণ্যপুরের দানবরাজ কেশী এসে তুলে নিয়ে গেল আমাদের উর্বশী আর চিত্রলেখাকে।

পুরুরবা বললেন–আচ্ছা, বলতে পারেন–কোন দিকটায় গেল সেই বদমাশ। অপ্সরা সহজন্যা বললেন–এই তো এই উত্তর-পুব বরাবর চলে গেল। রাজা বললেন- ঠিক আছে। একটু ঠান্ডা হয়ে বসুন, আমি চেষ্টা করছি। মহারাজ পুরূরবা অপ্সরাদের হেমকূট পর্বতের রম্যস্থানে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলে রথ নিয়ে ছুটলেন আকাশের নীল ছিন্ন করে পূর্বোক্স দিকে। রঙ-মেনকারা হেমকূট পর্বতের শিখরদেশ ছেড়ে সমভূমিতে এসে বসলেন উৎকণ্ঠিত চিত্তে। রম্ভা বললেন রাজা কি পারবেন আমাদের মনের কষ্ট দূর করতে? পারবেন কি উর্বশীকে এনে দিতে? অঙ্গরাদের সবচেয়ে অভিজ্ঞা হলেন মেনকা। তিনি বললেন- রাজা ঠিক পারবেন। সন্দেহ করিসনে ভাই-ইলা মা তে সংশয়ো ভবতু–ঠিক পারবেন তিনি। স্বর্গে যখন যুদ্ধ লাগে, তখন স্বয়ং ইন্দ্র কত মান্যি করে ভূলোক থেকে ডেকে আনেন এই রাজাকে। স্বর্গরাজ্যের সমস্ত বড় যোদ্ধাদের সামনে রাখেন তাকে–তমেব বিজয়সেনামুখে নিযুক্তে।

 বস্তুত সেকালে সূর্যবংশ কিংবা চন্দ্রবংশের রাজাদের এই সম্মান এবং প্রতিপত্তি ছিল। মৎস্যপুরাণ জানিয়েছে- একবার দুবার নয় ইন্দ্ৰশত্রু দানব কেশী পুরূরবার হাতে বহুবার পরাজয় বরণ করেছেন–কেশিপ্রভৃতয়ো দৈত্যাঃ কোটিশো যেন দারিতাঃ। এই পুরাণের অরেকটা খবর হল–ভয়বিহ্বল অপ্সরাদের মুখে জানা নয়, রাজা পুরূরবা নিজেই কেশীকে দেখতে পেয়েছিলেন উর্বশী আর চিত্রলেখাকে হরণ করে নিয়ে যেতে-সামর্কেণ সোপশ্যানীয়মানামথাম্বরে। রাজা প্রতিদিন রাজকর্মের শেষে ইন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন– অহনহনি দেবেন্দ্ৰং দ্রং যাতি স রাজরাট। সেই দেখা সেরে ফিরে আসবার সময়েই কেশীকে তিনি দেখতে পান এবং তার পিছু নেন।

আমরা উপরিউক্ত নাটকীয় বর্ণনা করেছি কালিদাসের নাটক থেকে, কেননা মৎস্যপুরাণ তার নাটকের অন্যতম উপাদান। আর এই বর্ণনা করলাম এইজন্য যে, আমার সহৃদয় পাঠকরা কালিদাসের রসসৃষ্টি থেকে বঞ্চিত থাকবেন কেন? বিশেষত সে বর্ণনা যখন মহাভারত বা পুরাণ-বিরোধী নয়।

রম্ভা-মেনকার শঙ্কা-বিশ্বাসের আন্দোলন শেষ হতে না হতেই রাজার রথের ধ্বজা দেখা গেল। স্বয়ং চন্দ্রদেবের দেওয়া হরিণকেতন রথ আকাশমার্গে দেখতে পেলেন অপ্সরারা। একটু পরেই রথ যখন এসে থামল সেই হেমকূট পর্বতের সানুদেশে তখন দেখা গেল উর্বশী প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছেন চিত্রলেখার কোলে। দানবিক ভয়ে তার শরীর বিহ্বল, চক্ষু নিমীলিত। চিত্রলেখা এবং রাজা পুরূরবা–দুজনেই উর্বশীকে প্রকৃতিস্থ করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। চিত্রলেখা খালি বলছেন– আর কোনও ভয় নেই ভাই, কোনও ভয় নেই। আর রাজার ভাবটা হল –শুন নলিনী খোল গো আঁখি, ঘুম এখনও ভাঙিল নাকি, দেখ তোমার দুয়ার পরে এসেছে তোমারই রবি–তদেত উন্মীলয় চক্ষুরায়তং/ মহোৎপলং প্রত্যুষসীব পদ্মিনী।

চিত্রলেখার উৎকণ্ঠা আর রাজার মধুর সান্ত্বনাবাক্যেই যেন উর্বশীর সংজ্ঞা ফিরে এল আস্তে আস্তে। চিত্রলেখা বললেন–আর ভয় নেই হতভাগা অসুরেরা পালিয়েছে। উর্বশী তখনও রাজাকে দেখতে পাননি। বললেন– কে তাদের তাড়াল রে? আমাদের ইন্দ্রদেব? চিত্রলেখা বললেন–হ্যাঁ, ইন্দ্রের মতোই তার ক্ষমতা বটে, তবে তিনি ইন্দ্র নন, তিনি হলেন আমাদের মত্যভূমির রাজা পুরূরবা। কথাটা শুনেই উর্বশী রাজার দিকে চাইলেন। নিমেষের মধ্যে তার মৌখিক প্রতিক্রিয়া শোনা গেল–তাহলে তো দানবরা আমার উপকার করছে, ব–উপকৃতং খলু দানবৈঃ।

বোঝা গেল– পুরূরবাকে উর্বশী পূর্বে দেখেছেন। হয়তো ইন্দ্রসভায়ই ইন্দ্রের সঙ্গে অলস বিশ্রম্ভালাপে, হয়তো পূর্বে কতবার দেবসেনার অগ্রভাগে যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত পুরূরবাকে দেখেছেন উর্বশী। মর্ত্যভূমির রাজাকে তার ভাল লেগেছিল। মনে মনে তার মুগ্ধতা ছিল প্রচ্ছন্ন, অপরিস্ফুট। মৎস্যপুরাণের বর্ণনায় পুরুরবা কেশী দানবের হাত থেকে উর্বশীকে উদ্ধার করে নিজে দিয়ে এসেছিলেন ইন্দ্রের কাছে ইন্দ্রলোকে। এই ঘটনায় সমস্ত দেবতার সঙ্গে পুরুরবার বন্ধুত্ব দৃঢ়তর হয়েছিল। স্বয়ং ইন্দ্ৰ মৰ্ত রাজার কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ হয়ে রাজাকে সর্বলোকের প্রভুত্ব এবং যশ দান করেছিলেন।

কিন্তু কালিদাসের নাটকীয়তায় রাজা অত সহজে ধরা দেন না। সেখানে গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ উর্বশীকে নিতে এসে রাজাকে স্বর্গে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালে রাজার সময় থাকে না। উর্বশীর সঙ্গ সেচ্ছায় নিজের কাছে দুর্লভ করে দিয়ে রাজা বলেন- এখন অবসর নেই দেবরাজের সঙ্গে মিলিত হবার। সলঙ্কে উর্বশী প্রিয়সখীকে জনান্তিকে জানান–ভাই! নিজমুখে তো আর রাজাকে যেতে বলতে পারি না আমার সঙ্গে। অন্তত তুই কিছু বল ভাই। চিত্রলেখা বলেন–আমার প্রিয়সখী উর্বশীকে স্বর্গে নিয়ে যাচ্ছি, তেমনই বহন করে নিয়ে যাচ্ছি আপনার যশ-কীর্তি–উর্বশীকে উদ্ধার করেছেন আপনি। রাজা, বিদায় দেন উর্বশীকে আর তখন উর্বশীর অবস্থা হল–ছল করে তার বাঁধত আচল সহকারের ডালে’ অথবা কাঁটা ফোটে পায়ে। ছল করেই স্বর্গ-লোকে যাবার পথে বিলম্ব ঘটান উর্বশী। উপোস করা চোখে রাজার দিকে তাকিয়ে থাকেন উর্বশী। তবু যেতেই হয়, ফিরে যেতেই হয় স্বর্গলোকে।

 নাটকের নাটকীয়তা থাক। উর্বশী স্বর্গলোকে ফিরে এসেছেন, ঠিক তার পর-পরই দুটি ঘটনা ঘটে গেল খুব তাড়াতাড়ি। শৌনকের বৃহদ্দেবতার মতো অতি প্রাচীন গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে মিত্রাবরুণ এসেছিলেন আদিত্যযজ্ঞে যোগ দিতে। মিত্রাবরুণ পূর্বোক্ত নর-নারায়ণের মতোই যুগল ঋষি। পূর্বে এঁরা দেবতা বলে পরিচিত ছিলেন। সেকালের বৃহৎ কোনও যজ্ঞে দেবর্ষি মহর্ষিরা সব সময়েই আমন্ত্রিত হতেন যজ্ঞের ক্রিয়াকলাপ পরিদর্শন করার জন্য। সেই কারণেই হয়তো মিত্রাবরুণের আগমন ঘটেছিল আদিত্যযজ্ঞে। অন্যদিকে স্বর্গসুন্দরী উর্বশীও উপস্থিত হয়েছিলেন ওই একই যজ্ঞে। হয়তো নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে, হয়তো বা অভিজাত রাজা বা দেবতাদের মনোরঞ্জনের জন্য।

কিন্তু উর্বশীর চলনে-বলনে সেদিন এমন কোনও প্ররোচনা ছিল না, যাতে বলা যায় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও অন্যায় করেছেন। সুক্ষ্ম চীনাংশুকের আবরণ এমন ছিল না, যাতে বলা। যায় শরীরে বিভঙ্গে তিনি উত্তেজনা সৃষ্টি করেছেন কোনও কথার মাত্রায় এমন কোনও মায়াবী স্পর্শ ছিল না যাতে বলা যায় তিনি সাগ্রহে মোহিত করছেন কাউকে। কিন্তু যে দোষে তিনি চরম দোষী হয়ে গেলেন, সে তার স্বাভাবিক রূপ। তার রূপের মধ্যেই সেই সাংঘাতিক আগুন ছিল যা মুহূর্তের মধ্যে পুরুষ-পতঙ্গ আকর্ষণ করে, কিন্তু তাতে আগুনের কী দোষ? বিধাতা তাকে যেহেতু শুধু শৃঙ্গাররসের উপাদান দিয়েই তৈরি করেছিলেন, তাই তিনি কিছু না করলেও পুরুষের স্নায়ুসুত্রের তন্তুগুলি সেখানে নিতান্তই বিবশ। যজ্ঞভূমির শান্ত নিস্তরঙ্গ ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যতই বিষয়-ব্যাবৃত্ত হয়ে বসে থাকুন মিত্রাবরুশ দুই মুনি, তাদের চক্ষু আধার খুঁজে পেল উর্বশীর মধ্যে। না বুঝে আগুনে হাত দিলে যেমন আপনিই হাত পুড়ে যায়, তেমনই ঋষিদ্বয়ের দৃষ্টি উর্বশীর ওপর পড়ায় তাদের শরীর কাজ করল নিজের ছন্দে। তাদের তেজ স্বলিত হল– তয়োস্ত পতিতং বীৰ্য্য।

উর্বশীর রূপ এবং মিত্রাবরুণ যুগল ঋষির তেজ– এর ফল কিছু খারাপ হয়নি। ফল স্বয়ং বশিষ্ঠ মুনি। পৌরাণিকেরা এই ঘটনা যতই শারীরিক সংলাপে বেঁধে ফেলুন, সহজ সরল ঋগ্বেদও এখানে মনের প্রাধান্য দিয়েছে। ঋষি হলেও তারাও তো মানুষ। অক্ষরা হলেও উর্বশী তো মানুষ। বেদের সরল কবি কোনও দোষ দেখেননি এতে। সুতি করার সময় তাঁরা বলেছেন- বশিষ্ঠ! তুমি মিত্রাবরুণের পুত্র। উর্বশীর মন থেকে তোমার জন্ম–উসি মৈত্রাবরুণো বসিষ্ঠোবশ্যা ব্ৰহ্মণ মনসোধ জাতঃ। আহা। সরল ভাষায় কত মধুর কথা–উর্বশীর মন থেকে তোমার জন্ম–উর্বশা মনসোধিতজাত। আমরাও এই কথাটাই বিশ্বাস করি–স্বর্গের সাধারণী গণিকা বলে পরিচিত হলেও উর্বশীর একটা মন আছে যে মন মিত্রাবরুণেরও আছে। বেদ বলেছে বিদ্যুতের মতো নিজের জ্যোতি ত্যাগ করার সময় মিত্রাবরুশ তোমায় দেখেছিলেন, বশিষ্ঠ–বিদ্যুতো জ্যোতিঃ পরিসঞ্জিহানং মিত্রাবরুণণা যদপশ্যতাং।

বস্তুত এই জ্যোতি-ত্যাগের ঘটনাই পরবর্তী আখ্যানভাগে বীর্যস্থলনে রূপান্তরিত হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু জ্যোতি-ত্যাগের সময় মনোজাত সেই পুত্রের রূপ দেখতে পাওয়া মানে তো আধুনিক অনুবাদে–তুই আমার ঠাকুরের সনে ছিলি পূজার সিংহাসনে। পৌরাণিকেরা কিন্তু বেদের সারল্য আরও বৃহত্তর সরসতায় ঢেকে দিয়েছেন। উর্বশীকে দেখে আপন শারীর-বৃত্তি স্খলিত হওয়ায় মিত্রাবরুণ ক্ষুব্ধ হলেন উর্বশীর উপরেই। রাগ করে বললেন তোমার জন্য যখন আমাদের এই দুর্গতি হল, অতএব স্বর্গে তোমার ঠাই হবে না। যেতে হবে মত্যলোকে, অনুভব করতে হবে মত্যভূমির দুঃখ-কষ্ট, রাগ-অনুরাগ, বিরহ। এই শাপের মধ্যেই বর আছে। আসছি সে কথায়।

.

২৩.

মহারাজ পুরূরবা উর্বশীকে কেশী দানবের হাত থেকে উদ্ধার করে দিয়েছেন–এই ঘটনা স্বর্গরাজ্যে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিল। ইন্দ্রসভায় উৎসবের আমেজ এসে গেল। স্বয়ং দেবরাজ নাট্যগুরু ভরত-মুনিকে খবর দিলেন নাটক পরিবেশন করার জন্য। নাট্যগুরু তার নাট্য-সম্প্রদায় নিয়ে এসে গেলেন। তার নাটকের নাম লক্ষ্মী-স্বয়ংবর। সম্ভবত সমুদ্রমন্থনের পর লক্ষ্মী যখন দেবী উঠে এলেন সমুদ্রের অন্তর থেকে, তখন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এবং সমস্ত দেবতাকে দেখে কাকে তিনি স্বামী হিসেবে বরণ করবেন এই সব ঘটনা নিয়েই ভরত মুনি তার নাটকের গ্রন্থনা করেছিলেন। এই নাটক আগেও ইন্দ্রসভায় অভিনীত হয়েছে এবং তাতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন উর্বশী। রম্ভা-মেনকা প্রমুখ অপ্সরারাও বিভিন্ন ভূমিকায় সার্থক অভিনয় করেছেন। আজ উর্বশীর প্রত্যাবর্তনের পর ভরতমুনি সেই নাটকটাই আবার অভিনয় করাবেন বলে ঠিক করলেন।

এদিকে উর্বশীর মনের অবস্থা খুব খারাপ। মত রাজা যখন নিজের ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখা দিলেন, সেই বিপন্ন মুহূর্ত থেকেই পুরূরবা উর্বশীর মনের মধ্যে প্রবেশ করেছেন। স্বর্গভূমিতে আর তার মন টেকে না, ভাল লাগে না কোনও কাজ, এমনকি ইন্দ্রসভার নৃত্য-গীতের আসরও বিরস হয়ে গেছে তার কাছে। প্রিয়সখী চিত্রলেখা তার মনের কথা জানেন। বন্ধুর প্রতি সহমর্মিতায় তিনি পুরূরবার খোঁজও নিয়েছেন দু-একবার। এ প্রেম শুধুই তার প্রিয়সখীর দিক থেকে একতরফা, নাকি মর্ত্য রাজা একেবারেই উদাসীন, সে খোঁজও চিত্রলেখা নিয়েছেন। একদিন তো স্বর্গীয় আকাশ-যানে চড়ে পুরূরবার রাজধানী প্রতিষ্ঠান নগরীর ওপর দিয়ে ঘোরাঘুরিও করেছেন উর্বশীকে সঙ্গে নিয়ে। উর্বশী রাজার সঙ্গে দেখা করেননি বটে, তবে কথা শুনেছেন। চিত্রলেখা অবশ্য দেখাই করে এসেছেন রাজার সঙ্গে। রাজা বলেছেন–গঙ্গা-যমুনার সঙ্গম একবার যে দেখেছে তার কি আর গঙ্গাপ্রাবহ-হীন যমুনা শুধু ভাল লাগে? তোমার সখী নেই তোমার সঙ্গে, একাকিনী তোমার সঙ্গ–যেন গঙ্গা ছাড়া যমুনা-সঙ্গমে পূর্বদৃষ্টে যমুনা গঙ্গয়া বিনা। কথাটা উর্বশীর ভাল লেগেছে। কিন্তু মনের এই প্রেম-মেদুর দোলার মধ্যে লক্ষ্মী-স্বয়ংবর নাটকের নামভূমিকায় লক্ষ্মীর অভিনয় করতে হবে তাকে। বুড়ো ভরতমুনি যুবতীর মন বোঝেন না। তিনি ভাবেন বুঝি অপ্সরা মানেই দেবজনের মনোরঞ্জনের যন্ত্রমাত্র। প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছ থেকে অপ্সরাদের তিনি চেয়েই নিয়েছিলেন অভিনয়ের জন্য। কিন্তু উর্বশী কি সেই সাধারণী অপ্সরাদের মতো? তার যে মন আছে। কিন্তু উপায় কী? ভরত-মুনির নাট্য সম্প্রদায়ে উর্বশী প্রধান নায়িকা। তাকে তো অভিনয় করতেই হবে।

নাটক আরম্ভ হল। লক্ষ্মীর ভূমিকায় উর্বশী নাটকের ‘পার্ট’ বলতে আরম্ভ করেছেন। তার প্রিয়বান্ধবী বারুণীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন অভিজ্ঞ মেনকা। লক্ষ্মীবেশে উর্বশী যেন দেব-দানবের সমুদ্রমন্থন থেকে এখনই উঠে এসেছেন আদিম বসন্তপ্রাতে, মন্থিত সাগরে। ডান হাতে সুধাপাত্র, বিষভান্ড লয়ে বাম করে। সমুদ্রের ধারে দেব-দানব এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মধ্যে একতম স্বামী-রূপে কাকে লক্ষ্মী বরণ করবেন–এই ছিল বারুণী-মেনকার প্রশ্ন-সখি সমাগতা এতে ত্রৈলোক্য-সুপুরুষাঃ সকেশবাশ্চ লোকাঁপালা। কমেস্মিংস্তে ভাবাবিনিবেশঃ। ঠিক এইখানে লক্ষ্মীদেবীর দ্বিধাহীন উত্তর আসবার কথা –পুরুষোত্তম বিষ্ণুর প্রতিই আমার একমাত্র নিষ্ঠা। কিন্তু ‘পুরুষোত্তম’ শব্দটি আর লক্ষ্মীর মুখে উচ্চারিত হল না। লক্ষ্মীর মধ্যে থেকে কথা কয়ে উঠলেন উর্বশী এবং পুরুষোত্তমের জায়গায়। লক্ষ্মী বলে উঠলেন আমি ভালবাসি পুরূরবকে– ততস্তয়া পুরুষোত্তম ইতি ভণিতব্যে পূরবসি ইতি নির্গত বাণী।

 সভাভর্তি দেব-দর্শকদের সামনে ‘পুরুষোত্তম’ শব্দের পরিবর্তে ভুল ‘পার্ট’ বলে পুরূরবার। নাম উচ্চরণ করার ফলে নাট্যগুরু ভরত মুনির রাগ হয়ে গেল খুব। তার মুখ দিয়ে কঠিন অভিশাপ নেমে এল উর্বশীর ওপর দেব স্থান স্বর্গভূমিতে তোমার স্থান হবে না কোনও, তোমায় যেতে হবে মর্ত্যভূমিতে। রবীন্দ্রনাথের কমলিকা-অরুণেশ্বরের কাহিনী যাদের মনে আছে, এই অভিশাপের মর্ম বুঝতে তাঁদের অসুবিধা হবে না। ঠিক ছন্দপতন অপরাধের সঙ্গে মিললেও স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর মর্ত্যভূমিতে অবতরণের মধ্যে সেখানে দুঃখ পাবে দুঃখ দেবে-এই মর্মান্তিক সত্যটুকু অভিশাপের সমস্ত তীক্ষ্ণতা নিয়ে উপস্থিত।

দুটি অভিশাপ। মিত্রাবরুণের অভিশাপ এবং ভরত মুনির অভিশাপ দুটির তাৎপর্যই এক। কালিদাসের রসচেতনায় ভরত মুনির অভিশাপের কাঠিন্য, দেবরাজ ইন্দ্রের করুণাধারায় কোমল হয়ে গেছে। দেবরাজ স্বর্গসুন্দরীর মনের খবর রাখেন। অতএব লক্ষ্মী-স্বয়ংবরের শেষ অঙ্কের যবনিকা-পাতের সঙ্গে সঙ্গে উর্বশী যখন নিজের ভ্রান্তিতে লজ্জায় আনত হলেন দেবরাজের। সামনে, দেবরাজ তখন উত্তম বিদগ্ধ পুরুষের মতো উর্বশীকে বললেন-ভয় পেয়ো না, সুন্দরী! যাকে তুমি ভালবাস, তোমার হৃদয় যেখানে বাঁধা পড়েছে সেই সমর-বিজয়ী রাজর্ষির। প্রিয়ত্ব সাধন করার এই তো সুযোগ। তুমি সেই পুরূরবার কাছে যাও। যতদিন তিনি তোমার কোল-আলো করে পুত্ৰমুখ না দেখেন, ততদিন অন্তত তুমি তাঁর সেবা করো–সা ত্বং যথাকামাং পুরূরবসমুপতিষ্ঠস্ব যাবৎ স ত্বয়ি দৃষ্টসন্তানো ভবেদিতি।

উর্বশীর মর্ত্যভূমিতে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও কালিদাসের নাটক থেকে পুনরায় পুরাণের উপাখ্যানে উত্তরণ করব। বস্তুত পৌরাণিকদের জবানীতেও পুরূরবা-উর্বশীর জীবন-বৃত্তান্ত বড় কম নাটকীয় নয়, আর সেই নাটকীয়তা নেমে আসছে একেবারে ঋগবেদ থেকে। তথাচ ঋগবেদের কাহিনী এবং শতপথ ব্রাহ্মণের প্রাচীন বর্ণনায় যথেষ্ট নাটকীয়তা আছে বলেই মহাভারতের বক্তব্য এখানে একেবারেই সংক্ষিপ্ত। তবুও সব মিলিয়ে সে কাহিনীর একটা পুনর্গঠিত রূপ দেবার চেষ্টা করা যেতেই পারে।

ভাগবত পুরাণ লক্ষ্য করেছে- ইন্দ্রসভায় উর্বশী যখন অভিনয় করছিলেন, তখন তার মনঃসংযোগের অভাব ঘটার একটা কারণও ছিল। দেবর্ষি নারদ-স্বর্গ থেকে মর্ত্য এবং মর্ত্য থেকে স্বর্গ পর্যন্ত যার বীণা বাজিয়ে ঘোরার অভ্যাস, সেই নারদ ইন্দ্রসভায় এসে বীণার ঝংকারে শুধু পুরূরবার গুণগান করছিলেন। এই গানই উর্বশীর কাল হল। গানের সুরে কীর্তিশালী পুরূরবার নামমন্ত্র উর্বশীর কানে ঢুকে পুরুষোত্তম বিষ্ণুর নাম ভুলিয়ে দিল। তার পরেই নেমে এল ভরত-মুনির শাপ।

অভিশাপের শব্দ শুনে উর্বশীর প্রাণে ভয় হয়নি অন্যত্র যেমনটা হয়– শাপদাতা কুদ্ধ ব্যক্তির পায়ে ধরে শাপমুক্তির উপায় ভিক্ষা–সেই ভিক্ষাও উর্বশী করেননি ভরতমুনির কাছে। দেবরাজের সান্ত্বনা শুধু নয়, তিনি জানতেন– মর্ত্যভূমিতে রাজা পুরূরবাই সেই উপযুক্ত বিদগ্ধ পুরুষ, যিনি স্বর্গসুন্দর উর্বশীর মর্যাদা বুঝবেন। রাজা পুরুরবার রূপ, গুণ, ঐশ্বর্য এবং মানসিক উদারতা কোনওটাই কম নয় এবং পূর্বাহ্নেই উর্বশী সেই সব গুণের বশীভূত হয়েই ছিলেন। স্বর্গভূমি ছেড়ে এসে উর্বশী যেদিন রাজার সামনে এলেন, সেদিন পুরূরবার বিস্ময় কিছু কম ছিল না। স্বর্গসুন্দরী উর্বশীকে তিনি এত সহজে পাবেন, এ তিনি কল্পনা করতে পারেননি।

উর্বশী স্বর্গভূমির উচ্চতা থেকে মাটিতে নেমে এলেন স্বর্গের সমস্ত মায়া ত্যাগ করে, শ্ৰেষ্ঠতার অভিমান বিসর্জন দিয়ে–অপহায় মানমশেষ অপাস্য স্বর্গসুখাভিলাষ। তার শরীর-মন জুড়ে রইল শুধু মর্ত্য রাজা পুরূরবা। আর পুরূরবার অবস্থা কী হল? পুরূরবা এবার ভাল করে দেখলেন। দেখলেন–পৃথিবীতে স্ত্রীলোকের সৌন্দর্য যে চরম বিটি স্পর্শ কতে পারে উর্বশীর সৌন্দর্য তার চেয়েও বেশি কিছু–তব স্তনভার হতে নভস্তলে খসি পড়ে তারা/অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা। সুকুমার লাবণ্যবিলাসের মধ্যে উর্বশীর মোহন হাসিটুকু ছিল এমনই যে, রাজা পুরুরবা সেই মুহূর্তেই উর্বশীর কাছে বিনা মূল্যে বিকিয়ে গেলেন তদায়ত্তচিত্তবৃত্তি। রাজা বললেন-বোসো তুমি। বলল তোমার কী প্রিয় সাধন করব? তুমি আমার সঙ্গে চিরকাল থাকবে, চিরকাল আমরা দুজনে দুজনকে ভালবাসব–সংরমস্ব ময়া সাকং রতিণে শাশ্বতীঃ সমা।

বিদগ্ধ সুন্দরী পুরুষের মধুর কথা দ্বিগুণ মধুরতায় ফিরিয়ে দিতে জানেন। উর্বশী বললেন সুন্দর আমার। তোমাকে দেখার পরেও কোন রমণী চোখ ফিরিয়ে নেবে অন্য দিকে? কেই বা মন না দিয়ে থাকবে তোমাকে কস্যায়ি ন সঙ্কেত মনো দৃষ্টি সুন্দর? পুরূরবা এবং উর্বশী–দুজনে দুজনের সামনে বসলেন। সেই মুহূর্তে তাদের একজনের আরেকজন ছাড়া অন্য কোনও বিষয় ছিল না চিন্তা করার মতো অন্য কোনও বিষয় ছিল না দৃষ্টি দেবার মতো। রাজা বললেন–আমি তোমাকে চাই, সুব্ধ। তোমার প্রসন্নতা আর অনুরাগ আমার একমাত্র কাম্য। রাজার কথা শুনে উর্বশী লজ্জায় খণ্ডিত হয়ে বললেন-আমাদের মিলনে অন্য কোনও বাধাই নেই। কিন্তু আমার দিক থেকে কয়েকটি শর্ত আছে, মহারাজ।

উর্বশী বললেন–আমার সঙ্গে দুটি মেষ শিশু আছে। মেষ দুটিকে আমি পুত্রস্নেহে পালন করি। সেই মেষ দুটি বাঁধা থাকবে আমার বিছানার পাশে। তুমি সে দুটিকে কখনও সরিয়ে নেবে না আমার কাছ থেকে–শয়ন-সমীপে মমোরণবয়ং পুত্রভূতং নাপনেয়। এই আমার প্রথম শর্ত। আমার দ্বিতীয় শর্ত–আমি যেন তোমাকে উলঙ্গ না দেখি, মহারাজ। তৃতীয় শর্ত–আমি শুধু মাত্র ঘি খেয়ে থাকব-ঘৃতামাত্রঞ্চ মমাহার ইতি। রাজা পুরূরবা সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে বললেন–তাই হবে-এবমস্তু।

 পুরূরবা-উর্বশী বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করার আগে আমরা একটা জরুরি কথা সেরে নিই। এখুনি যে উর্বশীর মুখে প্রাক্‌ বিবাহের শর্তাবলী শুনলাম–এই শর্তগুলি সমস্ত পুরাণে একই রকম। কিন্তু সবচেয়ে প্রাচীন যে গ্রন্থটি থেকে এই শর্তাবলীর কথা পুরাণগুলিতে এসেছে তার নাম শতপথ ব্রাহ্মণ, যা ঋগবেদের অব্যবহিত পরবর্তী কালেই রচিত। ঋগবেদে যে কাহিনীটুকু পাই তাতে মনে হয় উর্বশীর সঙ্গে পুরূরবার যেন পুর্বে মিলন হয়েছিল। সেই মিলনের পর উর্বশী রাজাকে ছেড়ে চলে গেছেন এবং কোনও ক্রমে আবারও দেখা হয়েছে অধিষ্যমান পুরূরবার সঙ্গে। পুরূরবা আকুল প্রেমিকের মতো তাকে ছেড়ে যেতে না করছেন এবং উর্বশী আপন তর্কযুক্তিতে রাজাকে নিরস্ত করে ফিরে যেতে বলছেন। এই হল ঋগবেদ।

 পণ্ডিতেরা অনুমান করেন– পুরূরবা-উর্বশী কাহিনীর দুটি স্তর আছে। সবচেয়ে পুরাতন স্তরটি– যা ঋগবেদে দেখতে পাই, তা অবশ্যই বিয়োগান্ত। কোশাম্বী (D.D.Kosambi) নানা জামান পণ্ডিতের মত আলোচনা তুলে দিয়ে বলেছেন-Her mann Oldenberg’s discussion postulates a lost prose shell for the Vedic hymn without attempting to explain its many intrinsic difficulties. The original suggestion was made by Windisch, on the model of Irish myth and legend. The argument is that the Satapatha Brahmana version is much more comprehensible than the bare Rgveda dialogue, hence some such explanatory padding must originally have existed.

ঠিক এই কারণেই আমাদের শতপথ ব্রাহ্মণের পুরূর-উর্বশী সংক্রান্ত উপাখ্যানটি উল্লেখ করতে হবে। করতে হবে, কারণ মহাভারত-পুরাণের কাহিনীর সঙ্গে শতপথের মিল সবচেয়ে বেশি। এমনকি গেলড়নারের মতো জামান পন্ডিত শতপথের কাহিনীটিকে বেশি গুরুত্ব না দিলেও পুরূরবা-উর্বশীর কাহিনীকে ইতিহাসের মর্যাদা দিয়েছেন–the whole episode was just one more of many such itihasa-puranas.

শতপথ ব্রাহ্মণে দেখছি–উর্বশীর সঙ্গে পুরূরবার যখন বিয়ে হয়, তখন উর্বশীর শর্তাবলীর মধ্যে মেষশিশু-দুটি রক্ষা করার শর্ত প্রথমেই ছিল না। শতপথের শর্তাবলীতে রীতিমতো আধুনিকা রমণীর পরিচ্ছন্নতা এবং বিদগ্ধতা আছে। উর্বশী বলেছেন– দিনের মধ্যে তিনবার তুমি আমার সঙ্গে আলিঙ্গন-রমণে মিলিত হতে পারবে রাজা! তবে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তুমি যেন কখনও আমার শয্যায় এসো না। আরও একটা কথা, আমি যেন কখনও তোমায় নগ্ন না দেখি। আমাদের মতো মেয়েদের সঙ্গে গভীরভাবে মেলামেশা করার এই নিয়ম–অকামা স্ম মা নিপদ্যাসৈ মো স্ম ত্বা নগ্নং দর্শমেষ বৈ ন স্ত্রীণামুপচার ইতি।

দেখুন, শতপথের বিবরণে প্রথমে মেষশিশুর শর্ত নেই কোথাও, তবে পরে মেষশিশুর প্রসঙ্গ এসেছে। আবার উর্বশীর ঘৃতাহারেরর প্রসঙ্গটি শতপথেও নেই, কিন্তু খোদ ঋগবেদেই তার উল্লেখ আছে যেহেতু, তাই পৌরাণিকেরা সেই সূত্র ধরেই একেবারে প্রথম মিলনের শর্তাবলীর মধ্যে ঘৃতাহারের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। পরের ঘটনাগুলি শতপথ ব্রাহ্মণ, পুরাণ এবং ঋগবেদ মিলিয়ে এইরকম দাঁড়াবে–

শতপথ বলেছে– তারপর উর্বশী বঙ্কাল বাস করলেন পুরূরবার সঙ্গে এবং এতকালই রইলেন যে, তিনি গর্ভিণীও হলেন–সা হাস্মিজ্যোণ্ডবাস। অপি হাস্মাগর্ভিণ্যাস।

শতপথের ভাষা প্রায় বেদের ভাষা, সাধারণ সংস্কৃতজ্ঞের বোধগম্য নয় তত। কিন্তু পৌরাণিকেরা ভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উর্বশীর মর্তবাসে বহুকাল থাকারও অর্থ খুঁজে পেয়েছেন আধুনিক স্বচ্ছতায়। স্বপ্নলোকের অভীষ্টতমা রমণীটিকে স্ত্রী হিসেবে লাভ করে পুরূরবার মন আর ঘরে টিকল না। কত সুন্দর সুন্দর জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়ালেন উর্বশীকে নিয়ে। এমন সব জায়গা নিসর্গসৌন্দর্য যেখানে স্বর্গের আভাস দেয়, মনে হয় দেবতাদের বিলাসভূমি যেন ভূলোকে নামিত। নন্দনবন, চৈত্ররথনবন, অলকাপুরী-এই সমস্ত স্থানে উর্বশীর সঙ্গসুখে দিন কাটাতে লাগলেন পুরূরবারেমে সূর-বিহারে কামং চৈত্ররথাদি। কতদিন কেটে গেল রাজার, উর্বশীর সুখামোদী মিলন-চুম্বনে।

ওদিকে নন্দনবাসিনীর অভাবে স্বর্গপুরী অন্ধকার। দেবরাজ ইন্দ্র দিনে দিনে বিষণ্ণ হয়ে উঠছেন। উর্বশীর পদছন্দোহীন নৃত্যগীত স্বর্গের ইন্দ্রসভায় আর তেমন জমে ওঠে না। নায়িকাশ্রেষ্ঠের অভাবে ভরত মুনির নাট্য সম্প্রদায় ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। নামভূমিকায় উর্বশীহীন রঙ্গমঞ্চ- সে যেন প্রাণহীন শবশরীরের উদবর্তন। দেবরাজ গন্ধর্বদের ডেকে বললেন- আর নয়, এবার উর্বশীকে স্বর্গে নিয়ে এসো পুনরায়। উর্বশী ছাড়া আমার এই দেবসভা নিতান্তই বেমানান–উর্বশী-রহিতং মহামাস্থানং নাতিশোভতে।

শতপথ ব্রাহ্মণে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে গন্ধবদের কোনও মন্ত্রণা নেই। সেখানে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন স্বয়ং গন্ধর্বরা। তার কারণও আছে। খোদ বেদের মধ্যে অপ্সরারা সর্বত্রই প্রায় গন্ধর্বপত্নী–তাভ্যো গন্ধর্বপত্নীভ্যোম্পায়া’করং নমঃ। বেদের মতো পুরাণে-ইতিহাসেও সর্বত্র অপ্সরাদের নাম উচ্চারিত হয় গন্ধর্বদের সঙ্গে এক নিঃশ্বসে। ভাগবতে কৃষ্ণের রাসনৃত্যের সময়ও অপ্সরা এবং গন্ধর্বদের একসঙ্গে নৃত্যের তালে তালে নাচ-গান করতে দেখছি–জগু-গন্ধর্বপতয়ো নতুশ্চাঙ্গরোগণাঃ। তবু যে পৌরাণিকেরা উর্বশীর যন্ত্রণায় দেবরাজের মন্ত্রণসভা বসালেন গন্ধর্বদের সঙ্গে, তারও একটা তাৎপর্য আছে। বেদের মধ্যে অপ্সরারা প্রধানত গন্ধর্বপত্নী বলে পরিচিত হলেও দেবতাদের সঙ্গে তাদের যে একটা ভোগ্যসম্বন্ধ আছে, সে কথাও বেদের মধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে। কুত্রাপি যেমন তাদের ‘দেবপত্নী’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে দেবপত্নীরাবধীত–তেমনই প্রকট হয়ে উঠেছে দেবতাদের সঙ্গে অপ্সরাদের প্রায় অবৈধ কোনও সম্পর্ক অঙ্গরাজার উপসিম্বিয়াণা। দেবতারা অপ্সরাদের ‘জার’ অর্থাৎ উপপতি প্রেমিক। কাজেই উর্বশীর অভাবে গন্ধর্বরা যেমন চিন্তিত হতে পারেন, তেমনই বিচলিত হতে পারেন দেবতারা, এমনকি দেবরাজও।

যাই হোক, পুরূরবার ভালবাসায় উর্বশী যখন আরও বেশি ভালবেসে ফেলেছেন তার মর্ত্যভূমির হৃদয়-রাজাকে এবং সেই ভালবাসায় যখন তিনি স্বর্গভূমির সুখস্মৃতিও ভুলতে বসেছেন–প্রতিদিন-প্রবর্ধমানানুরাগা অমরলোক-বাসেপি ন স্পৃহাং চকার–ঠিক তখনই বুঝি মন্ত্রণা-সভা বসল গন্ধর্বলোকে অথবা একেবারে ইন্দ্রসভায়। উর্বশীকে মর্ত্যভূমি থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে ঊর্ধ্বলোকে। ঠিক এই জায়গায় শতপথ ব্রাহ্মণে আমরা দুটি মেষ-শিশুর আবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি–যে মেষ-শিশু দুটিকে গন্ধর্বরা এই এক্ষুনি গিয়ে অলক্ষিতে বেঁধে দিয়ে এলেন উর্বশীর শয্যার দুই পাশে–তস্যৈ হাবিদ্বয়ুরণা শয়ন উপবদ্ধাস। পুরাণের বর্ণনায় অবশ্য মেষ-দুটি বহু আগে থেকেই আছে।

প্রতিষ্ঠান-পুরের চারপাশে তখন রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। রাজা অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে উর্বশীর আলিঙ্গনসুখে মত্ত আছেন। আবরণ-বস্ত্রের মর্যাদা নেই সামান্যতম। ঠিক এই সময় গন্ধর্ব বিশ্বাবসু অন্য গন্ধর্বদের সঙ্গে নিয়ে উর্বশীর অলক্ষে হরণ করে নিলেন একটি মেষশিশু। মেষের ডাক শুনে উর্বশীর প্রেমাচ্ছন্ন নিদ্রাসুখ ভগ্ন হল। তিনি হাহাকারে কেঁদে উঠলেন–আমার বীর স্বামী বেঁচে নেই নিশ্চয়, অথবা সহায় নেই সমব্যথী কোনও মানুষ, নইলে পুত্রস্নেহে লালিত আমার এই মেষশিশুটিকে হরণ করল কে–শতপথ ব্রাহ্মণের ভাষায়-অবীর ইব বত মে’জন ইব পুত্রং হরন্তীতি। গন্ধর্বরা ততক্ষণে দ্বিতীয় মেষ-শিশুটিকেও হরণ করেছেন। উর্বশীর আর্তি শোনা গেল আবার একই ভাষায়–আমার স্বামী নেই, সহায় নেই–সা হ তথৈবোবাচ।

প্রথম মেষশিশুটি হৃত হবার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা পুরূরবা টের পেয়েছেন। বিশেষত উর্বশীর আক্ষেপ-বচনও তার কানে গেছে। তিনি শুধু ইতস্তত করছিলেন। মেষচোর খুঁজবার জন্য ক্ষীণ দীপবর্তিকাটি জ্বালালেও যে উর্বশী তাকে নগ্ন অবস্থায় দেখতে পাবেন। আর তেমন দেখলে তো উর্বশী আর দ্বিতীয়বার লজ্জিত বাসর-সজ্জায় সজ্জিত হয়ে ধরা দেবেন না পুরূরবার বাহুবন্ধনে। কিন্তু দ্বিতীয় মেষ শিশুটি হরণের পরে উর্বশীর ধিক্কার যেন রাজার হৃদয়ে শেল বিধিয়ে দিল। সুরশত্রু কেশী-দমন বীর রাজার পক্ষে এই অপবাদ সহ্য করা কঠিন হল। আর সত্যিই তো উর্বশী রাজার সম্বন্ধে মোটেই ভাল কথা বলেননি। শতপথ ব্রাহ্মণের ক্ষুদ্র দুটি কথা–”অবীর, অজন’–পুরাণের শব্দে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-বীরের ব’ নেই, নিজেই নিজেকে শুধু বীর মনে করে এমন একটা ক্লীব অসভ্য লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে–হতাস্ম্যহং কুনাথেন নপুংসা বীরমানিনা। নইলে চোরে আমার ছেলে নিয়ে পালাচ্ছে আর উনি কিনা পুরুষ হয়েও মেয়েছেলের মতো দিনের বেলায় দরজা বন্ধ করে ভয়ে ঘরের মধ্যে সেধিয়ে আছেন-যঃ শেতে নিশি সন্ত্ৰস্তো যথা নারী দিবা পুমান।

 যে উর্বশী পুরূরবার হৃদয়হারিণী বলে কথা, আকস্মিক তার এই ভাব-পরিবর্তন রাজা পুরূরবাকে একবারে বিভ্রান্ত করে তুলল। তিনি যথাবৎ নগ্ন অবস্থাতেই উর্বশীর মেষ খুঁজতে যাবার উপক্রম করলেন। গন্ধর্বরা সময় বুঝে বিদ্যুতের জ্যোতির এক ঝলক সৃষ্টি করলেন নিমেষে। চল চপলার চকিত চমকে উর্বশী দেখলেন–রাজা উলঙ্গ। সঙ্গে সঙ্গে মর্ত্য রাজার এতদিনের ভালবাসা তুচ্ছ করে উর্বশী প্রতিষ্ঠান-পুরের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলেন চিরদিনের মতো–তৎপ্ৰভয়া চোৰ্বশী রাজান অপগতাম্বরং দৃষা অপবৃত্তসময় তৎক্ষণাদেব অপক্ৰান্তা। যে আকাক্ষার মধ্যে রাজার প্রতিজ্ঞা ধ্বনিত হয়েছিল–আমাদের ভালবাসা হোক চিরন্তনী–রতি ণৌ শাশ্বতীঃ সমাঃ–এক মুহূর্তে সেই ভালবাসার বাঁধন ভেঙে দিলেন উর্বশী।

 বিদগ্ধা স্ত্রীর কাছে আত্মগৌরব সাহংকারে প্রকাশ করার জন্য সেই মধ্যরাত্রেই রাজা নগ্ন অবস্থাতেই বেরলেন মেষ চোর ধরে আনতে। গন্ধর্বরা চকিত আলোর মায়া সৃষ্টি করেই বুঝেছেন–দেবকার্য সিদ্ধ হয়েছে। তারা মেষ শাবক দুটি ফেলে রেখে পালিয়ে চলে গেলেন। রাজাও উর্বশী খুশি হবেন ভেবে সানন্দে মেষ দুটি হাতে নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন। দেখলেন শুন্য শয্যা। প্রিয়তমা পত্নী কোথায় চলে গেছেন। উর্বশীর প্রেমে উন্মত্ত রাজা সেই নগ্ন অবস্থাতেই তাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লেন–তাঞ্চ অপশ্য অপগতাম্বর এব উন্মত্তরূপে বভ্রাম। সেই নন্দনবন, চৈত্ররথ, অলকা, গন্ধমাদন-সর্বত্র ঘুরেও রাজা উর্বশীর খোঁজ পেলেন না। বুঝলেন–প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়ে গেছে। গান্ধর্ব মায়ার চকিত আলোকে উর্বশী তাকে নগ্ন দেখেই তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। বুঝলেন—

 ফিরিবে না, ফিরিবে না, অস্ত গেছে সে গৌরবশশী,
অস্তাচলবাসিনী উর্বশী।

হলফ করে বলতে পারি-রবিঠাকুর যখন উর্বশীকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তখন তিনি উর্বশী-পুরূরবার সূর্যপর ব্যাখ্যাটুকু জানতেন। অর্থাৎ পাশ্চাত্যমতে এবং খানিকটা বৈদিক যুক্তিতেও পুরূরবা সূর্যের প্রতীক এবং উর্বশী ঊষার। তত্ত্বটুকু তার জানা ছিল বলেই উর্বশী কবিতায় অসম্ভব নিপুণতায় কবি অন্তত তিনটি পংক্তি প্রয়োগ করেছেন- (১) উষার উদয় সম অনবগুষ্ঠিতা, (২) স্বর্গের উদয়াচলে মূর্তিমতী তুমি হে উষসী, (৩) প্রথম সে তনুখানি দেখা দিবে প্রথম প্রভাতে। তবে এই সব তত্ত্বের ওপরেও বলতে হবে-”উর্বশী’ কবিতায় তার শব্দপ্রয়োগের সবচেয়ে বেশি সার্থকতা আছে ‘ক্রন্দসী’ শব্দটির মধ্যে–ওই শুন দিশে দিশে তোমা লাগি কাদিছে ক্রন্দসী। ক্রন্দসী’ শব্দটি একেবারে পাক্কা বৈদিক প্রয়োগ, যার মানে টীকাকার সায়নাচার্য করেছেন ‘দ্যাবাপৃথিবী’; আরও সহজ করলে দাঁড়ায় দ্যুলোক এবং ভূলোক। উর্বশী এমনই এক প্রার্থনীয়া রমনী যার জন্য স্বর্গ-মর্ত্যে কান্নার রোল ওঠে। উর্বশী স্বর্গভূমি ছেড়ে চলে এসেছিলেন মর্ত্যরাজার প্রেমে, তখন দেবতা-গন্ধর্বদের মধ্যে তাকে পাবার জন্য যে হাহাকার উঠেছিল, আজ সেই হাহাকার সংক্রমিত হয়েছে পুরূরবার হৃদয়ে। উর্বশীর জন্য মর্ত্যভূমির হাহাকার ভেসে বেড়াচ্ছে বনে বনান্তরে। রাজা পুরূরবা নগ্ন হয়ে উম্মত্তের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন যদি প্রিয়তমা পত্নীকে একবার চোখের দেখাও দেখতে পান–

ফিরিবে না, ফিরিবে না অস্ত গেছে সে গৌরবশশী,
অস্তাচলবাসিনী উর্বশী।
তাই আজি ধরাতলে, বসন্তের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে
কার চিরবিরহের দীর্ঘশ্বাস মিশে বহে আসে,
পূর্ণিমানিশীথে যবে দশ দিকে পরিপূর্ণ হাসি
 দূরস্মৃতি কোথা হতে বাজায় ব্যাকুল করা বাঁশি
ঝরে অশ্রুরাশি।
তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে,
অয়ি অবন্ধনে।

.

২৪.

পুরূরবার প্রাণের ক্রন্দনে যে আশা জেগে ছিল, সে আশা পূরণ হল একবার এবং ঠিক সেইখানেই ঋগবেদে উর্বশী-পুরূরবার সংলাপ সূক্ত আরম্ভ হয়েছে। উর্বশীর অন্বেষণে বনে বনান্তরে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মহাভারতের পূর্বকালের কুরুক্ষেত্রে এসে এক পদ্ম-সরোবরের মধ্যে অবগাহনরত উর্বশীকে দেখতে পেলেন রাজা বিকশিত বিশ্ববাসনার/ অরবিন্দ মাঝখানে পাদপদ্ম রেখেছ তোমার অতি লঘুভার। এই পদ্ম দিঘির নাম ‘অন্যতঃক্ষা। এ খবর আছে শতপথ ব্রাহ্মণে। স্বর্গসুন্দরী সেই শীতল দিঘির মধ্যে পা ভাসিয়ে স্নান করছিলেন অন্য অপ্সরাদের সঙ্গে। সরোবরের তীরে উদভ্রান্ত পুরূরবাকে উর্বশী প্রথমে দেখতে পেয়েছেন। রাজাকে দেখা মাত্রই তিনি বন্ধুদের জানিয়েছেন–এই হলেন সেই মর্ত্য রাজা। যার সঙ্গে আমি এতকাল সহবাস করেছি–অয়ং বৈ স মনুষ্যো যস্মিন্নহমবাৎস ইতি।

 অন্য অপ্সরা-সুন্দরীরা উর্বশীর কথা শুনে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন পুরূরবার দিকে। প্রায় ঈর্ষাকাতর ভাষায় বললেন- ইচ্ছে হয় যেন আমরাও এই মর্ত্য রাজার সঙ্গসুখ লাভ করি। উর্বশীকে তারা বললেন–চল, একবার দাঁড়াই গিয়ে রাজার সামনে–তা হোচতু স্তস্মৈ বা আবিরসামেতি। উর্বশী অপ্সরা সখীদের কথা শুনে রাজার দৃষ্টিপথে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরূরবা তাকে আবার বাহু-বন্ধনে বেঁধে ফেলেন আর কি! উর্বশী জানেন অথবা এতদিন পুরূরবার সহবাস-পরিচয়ের ফলে জেনেছেন যে, মর্তের বন্ধন দেবতার চেয়েও অনেক বেশি, হয়তো মধুরতরও বটে। সে বন্ধনে একবার জড়ালে দেবতাকেও মায়া সৃষ্টি করতে হয় বন্ধন-মুক্তির জন্য। উর্বশী দাঁড়ালেন না। প্রিয়তম স্বামীকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে তার অলস-গমন শুরু হল। কিন্তু অলস-গমনা রমণীর সেই ললিত গতি পুরূরবার মনে প্রাপ্তির। আকাক্ষা জাগিয়ে তুলল পুনর্বার। কথাটা ঝবেদের জবানীতে এইরকম–

পুরূরবা বললেন–এত তাড়াতাড়ি তুমি চলে যেও না উর্বশী। তোমার হৃদয় কি এতই নিষ্ঠুর, আমাদের দু’জনের কিছু কথাবার্তা এখনই যে হওয়া উচিত–হয়ে জায়ে মনসা তিষ্ঠ ঘরে বচাংসি মিশ্রা কৃণবাবহৈ নু। উর্বশী নিজের চারপাশে স্বর্গীয় উদাসীনতা সৃষ্টি করে বললেন–কী হবে তোমার সঙ্গে কথা বলে–কিমেতা বাঁচা কৃণবা তবাহং–আমি তো চলে এসেছি প্রথম উষার মতো। তুমি ফিরে যাও পুরূরবা। তুমি আমাকে ধরে রাখতে পারবে না। হাওয়াকে যেমন হাত দিয়ে ধরা যায় না, তেমনই আমাকেও তুমি ধরে রাখতে পারবে না–দুরাপনা বাত ইবাহমস্মি। পুরূরবা উর্বশীর সঙ্গলাভের জন্য আকুতি প্রকাশ করলেন। বললেন–এখন তুমি নেই, আর আমার তুণ থেকে বাণ নির্গত হয় না। তুমি আসার পর থেকে কোনও যুদ্ধে যাইনি। ললাটে অঙ্কিত হয়নি কোনও জয়টীকা। রাজকার্যে কোনও উৎসাহ নেই। আমার সৈন্যেরা পর্যন্ত সিংহনাদ করে না। পুরূরবা এইটুকু বলেই থামলেন না। স্মরণ করলেন পুরনো দিনের কথা। এমনকি দিনে-রাতে তার সোহ্লাস সম্ভোগ-স্মৃতিও পুনরুক্ত হলদিবানং থিতা বৈতসেন।

 স্বর্গসুন্দরী উর্বশী। কথা তিনি কিছু কম জানেন না। তিনি চলে এসেছেন, তাতে যে পুরূরবার কোনও দোষ ছিল না, রাজা যে তাকে যথেষ্ট মর্যাদায় প্রেমে এবং আদরে রেখে ছিলেন, সে কথা তিনি সাবেগে স্বীকার করে নিলেন। বললেন–দিনের মধ্যে তিনবার তুমি আমায় আলিঙ্গন করতে রাজা। আমার কোনও সতীন আমার সমান আদর পায়নি তোমার কাছে, আমাকেই তুমি প্রতিনিয়ত সন্তুষ্ট করেছ। তুমি আমার রাজা, আমার বীর।

সন্দেহ নেই পুরূরবার স্ত্রী ছিলেন আরও কয়েকজন–সুজুর্নি, শ্রেণি, আপি, গ্রন্থিনী প্রমুখ। কিন্তু উর্বশী চলে আসার পর তাদের কারও সাহস হয়নি বিরহে আকুল রাজাকে সঙ্গ দেওয়ার। উর্বশী সে সব কথা জানেন। রাজাকে তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন–পৃথিবী পালনের জন্য আমার গর্ভে পুত্র লাভ করেছ তুমি। কিন্তু তুমি তো আমার কথা শোেননি। আমি তো বারবার বলেছি, কী হলে আমি তোমার সঙ্গে থাকব। তুমি শোননি। এখন আর এত কথা বলে কী লাভ-অশাসং বা বিদুষী সস্মিন্নহঃ ম আশৃণোঃ কিমভুগবদাসি।

 উর্বশী পূর্বশর্তের কথা স্মরণ করিয়েও পুত্র জন্মের সান্ত্বনা দিয়ে পুরূরবার দর কয়ে সুখের কোমল প্রলেপ দিয়েছেন এবং শেষ কথা বলেছেন নির্দ্বিধায়–তুমি ঘরে ফিরে যাও। আর তুমি আমাকে পাবে না–পরে হ্যস্তং নহি মূঢ়মাপঃ। উর্বশীর কথা শুনে পুরূরবা মরতে চেয়েছেন। বলেছেন–তোমার প্রণয়ী দূর হয়ে যাক তোমার সামনে থেকে। সে যেন মরণের কোলে শয়ন করে, হিংস্র নেকড়েরা খেয়ে নিক তাকে–অধা শয়ীত নিয়তেরুপস্থে অধৈনং বৃকা রভসাসো, অদ্যুঃ। উর্বশী সপ্রণয়ে বলেছেন–এমন করে মরতে চেয়ো না পুরূরবা, এমন করে নষ্ট কোরো না নিজেকে। তুমি কি জান না মেয়েদের মন কেমন কঠিন। স্ত্রীলোকের হৃদয় এবং নেকড়ের হৃদয় একই রকম, স্ত্রীলোকের ভালবাসা কি স্থায়ী হয় কখনও-ন বৈ স্ত্রৈণানি। সখ্যানি সন্তি সালাবৃকাণাং হৃদয়ান্যেতাঃ। পুরূরবা তবু বলেছেন–তুমি ফিরে এস উর্বশী। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে তোমার বিরহে-নিবর্তস্ব হৃদয়ং তপ্যতে মে।

 কবিগুরুর উর্বশী কল্পনায় উর্বশীর যতই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অবন্ধনা’–ভাবটুকু থাক বেদ-পুরাণ-মহাভারতের উর্বশী কিন্তু পুরূরবার প্রেমেই পড়েছিলেন। খোদ বেদে পুরূরবার প্রতি উর্বশীর শেষ পরামর্শ হলদেবতারা বলছেন–তুমি তো এইভাবে মৃত্যুর দুয়ারে এসে পৌঁছেছ; তোমার পুত্র অবশ্যই দেবতাদের উদ্দেশ্যে আহুতি প্রদান করবে, আর তাতেই তুমি স্বর্গে গিয়ে পরমানন্দ লাভ করবে।

বেদের এই বিবরণের সঙ্গে শতপথ ব্রাহ্মণের কিছু তফাত আছে। শতপথের বিবরণ আরও মানবিক। শতপথ আর পুরাণগুলিতে দেখা যাবে– উর্বশী বলছেন–কেন এমন অবিবেক পাগলের মতো ব্যবহার করছ–অল অনেন অবিবেকচেষ্টিতেন। আমি গর্ভবতী, আমার গর্ভে তোমারই পুত্র আছে। ঠিক এক বৎসর পরে আবার ফিরে এসো এইখানে। তোমার ছেলেকে দেব তোমারই হাতে। আর ঠিক এক রাত্রির জন্য তোমার সঙ্গে মিলন হবে আবার–অব্দান্তে ভবতা অত্র আগন্তব্যম। কুমারন্তে ভবিষ্যতি। একাঞ্চ নিশাং ত্বয়া সহ বৎস্যামি। বিষ্ণুপুরাণের এই গদ্যাংশের সঙ্গে ঝগবেদের অব্যবহিত পরবর্তী শতপথ ব্রাহ্মণের প্রায় কোনও তফাত নেই। শতপথে দেবতার কথা বলেননি উর্বশী। বলেছেন–গন্ধর্বরা তোমাকে বর দেবেন রাজা। তাদের তুমি বোলো– আমিও একজন গন্ধর্ব হতে চাই। পরের দিন সকাল বেলায় পুরূরবা গন্ধর্বদের কাছে গন্ধর্ব হবার বর চাইলেন-যুস্মাকমেবৈকোসানীতি। কারণ গন্ধর্বদের সঙ্গে অপরাদের সম্বন্ধ চিরন্তনী। এরপর পুরূরবা গন্ধর্বদের কাছ থেকে যজ্ঞের অরণিকাষ্ঠ এবং অগ্নিস্থালী সাভ করলেন। দুটি অরণি মন্থন করে অগ্নি উৎপাদন করে পুরূরবা আহুতি দিলেন যয়ে আর সেই থেকে তিনি গন্ধর্ব হয়ে গেলেন–তেনেষ্টা, গন্ধর্বাণামেক আস। আর গন্ধর্ব হয়ে যাওয়া মানেই চিরকাল উর্বশীর সঙ্গে প্রেমালাপ আর সহবাস। পুরূরবা এই চেয়েছিলেন উর্বশীর সঙ্গে উর্বশী-লোকে চিরবাস।

পুরূরবার কাহিনী এখানেই বেশ শেষ করতে পারতাম। কিন্তু ওই যে বললাম– পুরূরবা একজন গন্ধর্ব হয়ে গেলেন-গন্ধর্বাণামেক আস– শতপথ ব্রাহ্মণের এই কথাটা অত সহজ নয়। অন্তত পন্ডিতেরা কথাটাকে অত সহজে ছেড়ে দেননি। পুরাণে-ইতিহাসে দেবতা এবং অসুরদের সবারই স্বরূপ-লক্ষণ খানিকটা বোঝা যায়, কিন্তু সেখানে গন্ধর্বদের যেন ভাল করে চেনা যায় না। মোটামুটিভাবে নৃত্য গীতের সঙ্গে গন্ধর্বদের আমরা জড়িত দেখেছি এবং তার স্মারক হিসাবে আধুনিক ভারতে গন্ধর্ব পুরস্কার পর্যন্ত চালু হয়েছে।

চেহারার কথা যদি বলেন, তাহলে গন্ধর্ব–এই নামটা যতই সুন্দর হোকনা কেন–গন্ধর্বরা। আমাদের কিছুটা নিরাশ করবেন। বেদ-পুরাণ-পড়া সাহেব পন্ডিতরা গন্ধর্বদের মানুষ আর পশুর মাঝামাঝি রাখতে চান-hasitating between the two. They are sometimes represented as half horse and half bird. কেউ বা আবার দার্শনিকভাবে গন্ধর্বদের জীবন-মৃত্যুর মধ্যম অবস্থায় রাখার কথাও চিন্তা করেছেন। এই দার্শনিকতার চরম বিন্দুতে আছেন জার্মান পন্ডিত হিলেব্রানড যিনি বৌদ্ধ সাহিত্যের উদাহরণে গন্ধর্বদের prefoetal being’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ওলডেনবার্গ কিন্তু গন্ধর্বদের অত দুর্বল মনে করেন না, কেন না গন্ধর্ব বলতে জ্বণ-পূর্ব কোনও সত্তার কথা পৌরাণিক সাহিত্যের নিরিখে একেবারেই ধোপে টেকে না।

অন্যদিকে আমাদের কোশকারদের চিন্তাধারাটাও সাহেবদের কাছে বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে কেন না অভিধানকারেরা গন্ধর্বদের বলেছেন- ‘অন্তরাভবসত্ত্ব’। টীকা করলে যার মানে দাঁড়ায় ‘মরণ-জন্মনোরন্তরালে স্থিতঃ।’ অর্থাৎ সেই ‘এক কথা আবার–মৃত্যু এবং জীবনের মাঝামাঝি কোনও ব্যক্তিসত্তা। আমাদের পৌরাণিক দৃষ্টিতে মৃত্যু এবং জীবনের মধ্যবর্তী অবস্থায় পিতৃলোকের কল্পনাটাই প্রধান হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু তাই বলে বায়ুভূত নিরালম্ব অবস্থার কোনও প্রেত-জীব হিসাবেও গন্ধর্বদের কল্পনা করা কঠিন।

একজন ইংরেজ পন্ডিত এই মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বলেছেন যে, অভিধানকারদের ‘অন্তরাডবসত্ত্ব’ শব্দটা কোনওভাবেই মানুষ বা পশুর মধ্যবর্তী অথবা মরণ-জীবনের অন্তরালবর্তী অবস্থাও কিছু নয় কেন না Gandharvas are not human beings statu nascendi, but beings intermediate between gods and men, of a higher order even than pitaras.

আমাদের সাংস্কারিক ধারণাটাও এই রকমই; গন্ধর্বদের আমরা আধা-দেবতা মনে করি এবং দেব-লোকের সঙ্গে তাঁদের দহরম-মহরম অনেক বেশি। গন্ধর্বদের সম্বন্ধে আরও খবর হল যে, গন্ধর্বরা অত্যন্ত স্ত্রী-প্রিয় একটি জনজাতি। আমদের প্রাচীন সমাজে অনেক আভিচারিক মন্ত্রও পাওয়া যাবে যেগুলি উচ্চারণ করে মেয়েদের ওপর গন্ধর্বদের আবেশ ছাড়ানো হত। ওলডেনবার্গ লিখেছেন–অনেক সময় নব বিবাহিত যুবক-যুবতীদের যৌন মিলনের প্রাথমিক দিনগুলিতে যজ্ঞভূমিতে রাখা একটি দন্ডের মতো বস্তু ন্যাকড়া বা সুতো দিয়ে প্যাঁচানো একটি ছোট্ট লাঠি নর-নারীর মাঝখানে রাখা হত। এই দন্ডটি নাকি গন্ধর্ব বিশ্বাবসুর প্রতীক। পুরূরবা যে অরণিকাষ্ঠ লাভ করেছিলেন, তাতেও এই গন্ধর্বের প্রতীক দণ্ডটিই অনুমান করেছেন পণ্ডিতেরা।

মহামতি কৌশাম্বী এই আলোচনা থেকে কিছু খোরাক পেয়েছেন মনে হয় এবং পুরূরবার গন্ধর্ব হয়ে যাবার ব্যাপারটা নিয়ে তিনি খুব বাস্তব সম্মত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন–What is the original meaning of ‘became a Gandharva’? This could not have happened while Pururavas was alive, for the Gandharva at the time of the Brahmanas is recognised as a spirit who could possess women, say the spirit that caused their hysteria. কৌশাম্বীর বক্তব্য থেকে আমরাও কিছু ধারণা করতে পারি। বস্তুত আমরা আগেই বলেছি পুরূরবা মরেননি মোটেই। এই না-মরার কথাটাই আরেকভাবে আমরা বলতে চাই।

 আমরা যেমন আজকের যুগেও বলি- ভূতে পেয়েছে, পেচোয় পেয়েছে, এও অনেকটা সেই রকম। বৃহদারণ্যক উপনিষদে ভুজু লাহায়নির কথা পড়েছি। তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে বলছেন–আমরা মদ্র-দেশীয় মানুষদের মধ্যে শিক্ষার্থী হয়ে ঘুরছিলাম। তারপর আমরা পতঞ্চল কাপ্যের বাড়িতে পৌঁছোলাম। তার একটি মেয়ে আছে, তাকে গন্ধর্বয় পেয়েছে–তস্যাসী দুহিতা গন্ধর্বগৃহীতা। আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম–তোমার নাম কী? সে বলল–আমার নাম সুধন্ব, অঙ্গিরাগোত্রীয় সুধন্থ।

ভাবুন একবার। ঠিক ভূতে পাওয়ার মতোই। প্ল্যাঞ্চেট করতে গেলে ‘মিডিয়াম’ কিন্তু নিজের নাম বলে না। জীবিত অবস্থায় প্রেত ব্যক্তির যে নাম ছিল অর্থাৎ যাকে আপনি ডাকছেন বা স্মরণ করছেন ‘মিডিয়াম’ তারই নাম লেখে। পতঞ্চল কাপ্যের মেয়ে একটি ব্রাহ্মণ-পুরুষের নাম করছে এবং উপনিষৎকার স্পষ্টতই বলছেন–মেয়েটাকে গন্ধর্বয় ধরেছে–গন্ধর্বগৃহীত। পতঞ্চল কাপ্যের ভাগ্য মোটেই ভাল নয়। একটি মাত্র মেয়ে তাকে গন্ধর্বয় ধরেছে, আবার খানিক পরে ওই বৃহদারণ্যক উপনিষদেই দেখতে পাচ্ছি তার বিবাহিত পত্নীও গন্ধর্বাক্রান্ত। উদ্দালক আরুণি ওই মদ্রদেশের উল্লেখ করেই যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন–আমরা ওই মদ্রদেশেই যজ্ঞবিদ্যা অধ্যয়ন করার জন্য পতঞ্চল কাপ্যের ঘরে কিছুদিন ছিলাম। দুঃখের বিষয় তার স্ত্রীটিকে গন্ধর্বয় ধরেছে–তস্যাসীদ ভার‍্যা গন্ধর্বগৃহীতা। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম–কে তুমি? গন্ধর্ব উত্তর দিল– আমি অথর্বণের পুত্র। আমার নাম কবন্ধ।

ওই একই ব্যাপার। গন্ধর্বক্রান্ত একটি বিবাহিতা রমণী এবং একটি গন্ধর্বাক্রান্ত কন্যা–এই দুই অস্বাভাবিক রমণী নিয়ে কপিবংশীয় পতঞ্চলের সংসার। উপনিষদের ভুজ্ঞ হ্যায়নি এবং উদ্দালক আরুণি–এই দুই ব্রহ্মজিজ্ঞাসু ঋষি উপরি-উক্ত দুই গন্ধর্বাক্রান্ত রমণীর কাছে ব্রহ্ম বিদ্যা শুনতে পেয়েছেন। কারণ গন্ধর্ব লোকাতীত জীব। তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি মানুষের চেয়ে বেশি। কিন্তু পুরূরবার গন্ধর্ব হয়ে যাওয়ার মধ্যে পণ্ডিতেরা এই দুটি উদাহরণের অন্য তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন। বৃহদারণ্যকের ভাষায় এ কথা যথেষ্টই পরিষ্কার যে, গন্ধর্বগৃহীতা রমণী মানেই সেই রমণীর ওপর কোনও অমানুষ সত্ত্বের আবেশ ঘটেছে।

আধুনিক যুগে ‘ভূতে পাওয়া’, ‘পেচোয় পাওয়ার মতো গন্ধর্ব-গৃহীতা’ শব্দটিকেও আমরা হয়তো বিশ্বাস করব না, কিন্তু কোশাম্বীর কথা মতো গন্ধর্ব ব্যাপারটাকে–the spirit that caused their hystera অর্থাৎ গন্ধর্বকে ‘হিস্টিরিয়ার’ অধিদেব ভাবতে কোনও ক্ষতি নেই। কোশাম্বীর ভাষায়-Hence, though the Gandharvas posses a separate minor heaven of their own, a human being can attain it only as a spirit. 7091401914, বায়ু পুরাণ এবং অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যিক প্রমণে থেকে কোশাম্বী বিশ্বাস করেন অর্থলোভ এবং স্বর্ণগৃধুতার জন্য পুরূরবা কোনও যজ্ঞভূমিতেই মারা যান অথবা তিনি স্পিরিট’ হয়ে যান, যাকে শতপথ বলেছে- তিনি গন্ধর্ব হয়ে গেলেন।

আমদের বক্তব্য গন্ধর্ব শব্দের অর্থে ‘হিস্টিরিয়ার কাছাকাছি গিয়েও কেন শেষ রাখতে পারলেন না কোশাম্বী? বস্তুত গন্ধর্বের আবেশ এখানে উর্বশীর ওপরে নয়। বরং পুরূরবার ওপরেই। পুরূরবা গন্ধর্ব হয়ে গেলেন মানে তাকে হিস্টিরিয়ার রোগীর মতো বিকারগ্রস্ত দেখা গেল। কালিদাসে উর্বশীর বিরহে পুরূরবার যা অবস্থা হয়েছে তা কাব্যিক দিক দিয়ে যথেষ্ট মূল্যবান হলেও বিকারের কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা বেদের মধ্যে দেখেছি পুরূরবা নিজেই বলছেন–আমিই যখন মানুষ হয়েও অমানুষী অপ্সরাদের আলিঙ্গন করেছিলাম, তখন তারা বস্ত্র উন্মোচন করে রেখে হরিণীর মতো, অশ্বের মতো আমার কাছ থেকে ছুটে পালাল- অপ স্ম মৎ তরসন্তি ন ভূস্তা অসান্ রথস্পৃশো নাশ্বাঃ।

অপ্সরাসুন্দরীদের পিছনে ছোটার এই বিকার পুরূরবার জীবনে পরিণত হয়েছে উর্বশীকে পাওয়ার পর। পুরূরবা উর্বশীর সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে তাকে বিবাহ করেছেন। পৃথিবীতে স্বীকামী ব্যক্তির বিকারের ইতিহাস কিছু অপ্রাপ্য নয়। কিন্তু উর্বশীকে পাওয়ার পর রাজার চিরাভীষ্ট সিদ্ধ হওয়ায় তার রাজকার্য মাথায় উঠেছিল, এবং স্বর্গসুন্দরীর তোষণে-পোষণে তার অর্থগৃধুতাও বেড়ে গিয়েছিল। হয়তো এই সময়েই কোনও যজ্ঞভূমিতে তিনি ব্রাহ্মণদের দ্বারা আক্রান্ত হন। আমরা জানি–উর্বশী রাজাকে ছেড়ে চলে যান এবং বেদ, শতপথ তথা অন্যান্য পুরাণের বিবরণ থেকে বোঝা যায় তার বিকার প্রায় পাগলামিতে পরিণত হয়েছিল। বেদের বিবরণে পুরূরবার নিজ-মুখের স্বীকারোক্তি–আমার তৃণীর থেকে আর বাণ নির্গত হয় না। রাজকার্য বীরশূন্য, তার কোনও শোভা নেই-অবরে ক্রতৌ বি দবিদ্যুতন্নোরা।

আমাদের ধারণা হয়–উর্বশীকে নিয়ে রাজার যে এই অসহায় বিকারগ্রস্ত (hysteria) অবস্থা, এই অবস্থা থেকেই তার অর্থগৃধুতা এবং ব্রাহ্মণ বিরোধিতারও চরম বিন্দু স্পর্শ করে। ব্রাহ্মণরা অথবা আরও সাধারণভাবে বললে প্রজারা তার এই বিকারগ্রস্ত অবস্থা মেনে নেননি। তাকে রাজ্যচ্যুত করেছেন। আগে যেমন অত্যাচারী বেণের ব্যাপারে দেখেছি, তার বাহুমন্থনের ফলে পৃথু জন্মালেন এবং পৃথুকে রাজপদে বসালেন ব্রাহ্মণেরা, এখানেও তেমনই পুরূরবাকে রাজ্যচ্যুত করে তার উর্বশীগর্ভজাত পুত্র আয়ুকে সিংহাসনে বসালেন ব্রাহ্মণেরা উর্বশেয়ং ততস্তস্য পুত্রং চক্রুপং ভুবি।

শতপথ ব্রাহ্মণ এবং বিষ্ণু পুরাণে আমরা দেখেছি–উর্বশী এক বছর পর এক রাত্রি পুরূরবার সঙ্গে মিলনে স্বীকৃত হন এবং ওই এক বছর পরেই উর্বশী তার প্রথম পুত্রকে পুরূরবার হাতে দেবেন বলে প্রস্তাব করেন। বস্তুত উর্বশী পূর্বাহ্নেই গর্ভবতী ছিলেন। এর পরেই গন্ধর্বদের দেওয়া সেই অরণিকাষ্ঠ এবং অগ্নিস্থালী নিয়ে পুরূরবা স্বগৃহে আসেন। অরণিমন্থনে যে পবিত্র অগ্নি জন্মায়, সেই অগ্নিই পরবর্তী পুরাণগুলিতে বেদ-বিখ্যাত অগ্নির তিন স্বরূপ- গার্হপত্য অগ্নি, দক্ষিণাগ্নি এবং আহবনীয় অগ্নি নামে বিখ্যাত হয়েছে। পুরূরবা এই অগ্নির প্রণেতা বলেই তিনি বেদে অগ্নিদেবের বন্ধু বলে প্রশংসিত হয়েছেন।

আমাদের বক্তব্য কিন্তু পুরূরবার অগ্নি আহরণের তাৎপযেই সীমাবদ্ধ নয়, আমাদের ধারণা যে ব্রাহ্মণ-বিরোধিতা পুরূরবার রাজ-জীবনে ভীষণ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল, উর্বশীর পরামর্শে এবং গন্ধর্বদের অনুকম্পায় ব্রাহ্মণ্যের প্রতীক অগ্নি আহরণ করে পুরূরবা সেই বিপর্যয় খানিকটা ঠেকাতে পেরেছেন। কাম-বিকারগ্রস্ত অর্থগৃধু পুরূরবা সাময়িকভাবে রাজ্যচ্যুত হলেও ব্রাহ্মণ্য-বিরোধিতা ত্যাগ করে অগ্নি-উপাসনার পথে তৎকালীন ব্রাহ্মণ-সমাজের সঙ্গে আপস করে নেন। মহাভারতের কবি তাই উর্বশী-পুরূরবার প্রেম-কাহিনীর বর্ণনায় মন দেননি। তিনি পুরূরবার উৎকট ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতার সামাজিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেই দুই পংক্তিতে। বলেছেন– পুরূরবা তারপর উর্বশীর সঙ্গে মিলিত হয়ে যজ্ঞাদি ক্রিয়া সম্পাদন করার জন্য গন্ধর্বলোক থেকে নিয়ে আসেন অগ্নিকে—যে অগ্নির তিন রূপ গার্হপত্য, দক্ষিণাগ্নি এবং আহবনীয়।

 স হি গন্ধর্বলোকস্থান উর্বশ্যা সহিতে বিরাট। আনিনায় ক্ৰিয়ার্ধেগীন যথাবদ বিহিতংস্ত্রিধা৷৷ এই অগ্নি আনয়নের পথ ধরেই হয়তো ব্রাহ্মণ সমাজের সঙ্গে যাঁর বিবাদ-বিসংবাদ মিটে যায়, এবং সেই কারণেই তার পুত্র আযুর রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয় বিনা বাধায়। আরও একটা কথা। উর্বশীর অন্তর্ধানের পর যেমন তার কাম-বিকার শান্ত হয় একই সঙ্গে তার ব্রাহ্মণ্য-বিরোধিতাও শেষ হয়। এরই ফলে হয়তো ঋগবেদে তিনি সুকৃতি’ বলে আখ্যা লাভ করেছেন, পরিচিত হয়েছেন অগ্নিদেবের বন্ধু বলেও।

উর্বশীর গর্ভে পুরূরবার প্রথম পুত্রের নাম আয়ু। এই জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্ম এবং রাজ্যাভিষেকের পরেও পুরূরবা হয়তো বেঁচেই ছিলেন নইলে অধিকাংশ পুরাণেই দেখা যাবে–পুরূরবা উর্বশীর গর্ভে দুটি পুত্র লাভ করেছিলেন। মহাভারতের বিবরণেও তাই। আয়ু, ধীমান, অমাবসু, দৃঢ়ায়ু, বনায়ু এবং শতায়ু–এই ছয় পুত্র। শেষ তিনটি নামের শেষে ‘আয়ু থাকায় পণ্ডিতেরা কেউ কেউ বলেছেন যে, it may be admitted that an Ayu’ tribe derived their descent from Urvasi and Pururavas. নামের অন্তে আয়ু-শব্দের প্রয়োগে কোনও আয়ু-গোষ্ঠীর জন-জাতির উদ্ভব অনুমান করা যায় কিনা জানি না। তবে প্রতি বৎসর এক রাত্রির যে মিলন-বাসর রচিত হত উর্বশী-পুরূরবার জীবনে, তাতে যে রাজার আরও পাঁচটি পুত্র হয়েছিল, সে খবর পৌরাণিকেরাও স্বীকার করেন, মহাভারতের কবিও তা মেনে নিয়েছেন।

প্রধানত চন্দ্রবংশের ধারাটি বোঝানোর জন্য মহাভারতের কবি আপাতত পুরূরবার প্রথম পুত্র আয়ুর বংশধরদের কথাই বলে গেছেন: কিন্তু তাই বলে অন্যেরাও খুব সামান্য নন। যেমন অমাবসুর বংশে স্বয়ং জন্তু মুনির জন্ম হয়, যার সাহচর্যে ভারতাত্মা জননী জাহ্নবী। পুরূরবার অন্য পুত্রদের ঔরসে বহুতর ব্রাহ্মণদের দেখা যাবে এবং এই ঘটনায় আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সেকালের ক্ষত্রিয় বংশে অনেকেই এরকম ব্রাহ্মণ হয়ে যেতেন কারণ, জন্মের দ্বারা তখন ব্রাহ্মণ্য নির্ধারিত হত না। এ সব কথা পরে আসবে। আমরা আয়ুর কথা বলি।

ঐল পুরূরবার পুত্র আয়ু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। পুরূরবার রাজত্বকালে যে ব্রাহ্মণ্য-বিরোধিতা আমরা লক্ষ্য করেছি, আযুর আমলে তা সম্পূর্ণ তিরোহিত। বায়ুপুরাণ জানিয়েছে–দ্বাদশ-বার্ষিক যে বিশাল যজ্ঞটি পুরূরবার রাজত্বকালে আরম্ভ হয়েছিল, পুরূরবার। মৃত্যুর পর আয়ুর তত্ত্বাবধানে সেই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়। পুরূরবার ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতার প্রতিক্রিয়ায় তার পুত্র আয়ু মুনি-ঋষি ব্রাহ্মণদের সম্পূর্ণ বশংবদ হন। ব্রাহ্মণরাও পিতৃহারা আয়ুকে যথোচিত সান্ত্বনা প্রদান করে যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। অন্যদিকে লক্ষণীয়, এই যজ্ঞে গন্ধর্বরাও দেবতা এবং পিতৃগণের সঙ্গে যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে পৃজিত হন–আর্নচুশ্চ যথাজাতি গন্ধর্বাদী যথাবিধি। এ ব্যাপারটা পুরূরবার গন্ধর্ব হয়ে যাওয়ার একটা ফল কি না কে জানে? মর্যাদা লাভ করে। গন্ধর্বরাও প্রতিদান দিয়েছেন তুল্যতায়। তারা এই বিশাল যন্ত্রে সামগান করেন, নৃত্য পরিবেশন করেন অপ্সরারা– জণ্ডঃ সামানি গন্ধর্বা নতুশ্চালরোগণাঃ। অবশ্য সেকালের কোনও বিশাল যজ্ঞ ভূমিতে গন্ধর্বদের গান এবং অপ্সরাদের নাচ কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এবং তা থেকে কিছু প্রমাণও করা যায় না। কিন্তু প্রমাণ করার মতো বড় কিছু ঘটনা না হলেও গন্ধর্ব-অপ্সরাদের বিশেষ অংশগ্রহণ এখানে খানিকটা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। অন্তত পুরূরবা-উর্বশীর জীবন-চর্চার নিরিখে বায়ুপুরাণে উল্লিখিত গন্ধর্ব-অপ্সরাদের মর্যাদা এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এখানে খানিকটা তাৎপর্যপূর্ণই বটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *