০৯০. ব্রজভূমি বৃন্দাবনে ইন্দ্ৰযজ্ঞের তোড়জোড়

৯০.

ব্রজভূমি বৃন্দাবনে যখন ইন্দ্ৰযজ্ঞের তোড়জোড় চলছে, ঠিক সেই মুহূর্তে কৃষ্ণ-বলরাম বোধহয় বাড়িতে ছিলেন না। বর্ষাকালের দুমাস ধরেই তারা এ-বন সে-বন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাল-বন, ভাণ্ডীর-বনের মতো জায়গায় ধেনুক-প্রলম্ব ইত্যাদির অধিকার চলে যাবার কারণেই হোক, অথবা এইসব নতুন জায়গায় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই হোক, অথবা ক্লান্তি অপনোদনের জন্যই হোক, বর্ষার দুমাস কৃষ্ণ-বলরাম বাড়ি ছিলেন না–বনে বিচরতোমাসৌ ব্যতিযাতৌ স্ম বার্ষিকৌ।

 কৃষ্ণ-বলরাম বাড়ি ফিরতেই দেখলেন–ইন্দোৎসবের জোগাড় হচ্ছে। ধূমধাম ভালই হবে, তার মধ্যে ব্রজভূমিতে নানান উৎপাতের অবসান ঘটায় এবার সকলের মনে ফুর্তিও খুব। কৃষ্ণ দেখলেন–এই উৎসবের জন্য সকলে উদ্গ্রীব, লালায়িত–গোপাংশ্চোৎসবলালসান। সময় বুঝে মানুষ দেখে কৃষ্ণ এক গয়লা-বুড়োকে জিজ্ঞাসা করলেন–আচ্ছা। এই ইন্দ্র-যজ্ঞ ব্যাপারটা কী, যার জন্য তোমাদের মনে এত ফুর্তি আসছে–কোয়ং শমখো নাম যেন বো হর্ষ আগতঃ?

 বুড়ো গয়লা বললেন–আমরা এখানে ইন্দ্রের ধ্বজা বসিয়ে পুজো করি, এবং কেন করি, তার কারণ বলি শোনো। ইন্দ্র হলেন দেবতাদের রাজা আর তিনি হলেন মেঘ-বৃষ্টির দেবতা। তিনি আমাদের চিরকালের রক্ষক। অতএব সেই রক্ষাকর্তার পুজোর জন্যই বহুদিন ধরে ওই উৎসব চলে আসছে–তস্য চায়ং মখঃ কৃষ্ণ লোকনাথস্য শাশ্বতঃ। আকাশের মেঘরাশি সেই ইন্দ্রের শাসন মেনে বর্ষার নতুন জলধারা বর্ষণ করেন আর তার ফলেই মাঠে মাঠে শস্য ফলে। ইন্দ্র যে শস্য নিষ্পন্ন করেন, সেই শস্য খেয়েই আমরা বাঁচি; মানুষ বাঁচে, আমাদের গোরু, বলদ, ষাঁড়, সব হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে, গোরুরা ভাল দুধ দেয়। আর সত্যিই তো, যেখানে বর্ষণমুখর মেঘরাশি আছে–বৃষ্টিমন্তো বলাহকাসেখানে শস্যের অভাব নেই, তৃণের অভাব নেই, ক্ষুধা বলেও সেখানে কিছু নেই–নাশস্যা নাতৃণা ভূমি-ন বুভুক্ষার্দিতো জনঃ।

 গয়লারা মেঘস্তুতির মাধ্যমে যেভাবে ইন্দ্ৰস্তুতি করল, তাতে বেশ বোঝা যায় যে, জমির উর্বরতা বা ফার্টিলিটির কারণেই এই ইন্দ্র-যজ্ঞের ব্যবস্থা। কাল্ট ফ্যাকটরটা না হয় বেশ বোঝা গেল, কিন্তু এর মধ্যে লক্ষণীয় আছে আরও কিছু। বুড়ো গয়লা যেভাবে ইন্দ্ৰস্তুতি করল এবং পরবর্তী কয়েকটি শ্লোকে সেই স্তুতির ভাষা যেমনটি হরিবংশ ঠাকুর বুড়ো গয়লার মুখে বসিয়ে দিয়েছেন, তা প্রায় বৈদিক ইন্দ্রস্তুতির ধ্রুপদী অনুবাদ। বুড়ো বলেছেন–সূর্যদেবের দিব্য কিরণ-সমূহই পৃথিবীর জল শোষণ করে পয়স্বিনী মেঘরাশিতে পরিণত হয়। ভগবান ইন্দ্র সেই পয়স্বিনী কিরণ-ধেনু দোহন করেন। সেই কিরণ-ধেনুই নতুন পবিত্র জলরূপী দুগ্ধ ক্ষরণ করে পৃথিবীর বুকে, পৃথিবী শস্যে ভরে ওঠে।

মেঘ, বৃষ্টি, জল, শস্য-বুড়ো গয়লার মুখে কৃষি সম্পর্কিত এই সব শব্দ এবং সেই সঙ্গে আর্যসভ্যতার অন্যতম প্রধান দেবতা ইন্দ্রের জয়কার শুনে বোঝা যায় তখনও পর্যন্ত বৈদিক দেবতার উত্তরাধিকার হ্রাস পায়নি। বুড়ো গয়লা বলেছে–সমস্ত প্রাণীর শ্রীবৃদ্ধির জন্যই ইন্দ্র এই জল বর্ষণ করেন–পর্জন্যঃ সর্বভূতানাং ভবায় ভুবি বৰ্ষতি। সেইজন্যই এই বর্ষাকালেই রাজাদের ইন্দ্রপূজার সময়। আমরাও এই সময়ে নানা উৎসবে ইন্দ্রযজ্ঞ পালন করি।

কৃষ্ণ ধৈর্য ধরে গয়লা-বুড়োর সব কথা শুনলে মানুষের ওপর বৈদিক ইন্দ্রের প্রভাব যে কত, তাও তিনি ভাল জানেন। সব শুনে, সব বুঝেও কৃষ্ণ কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে উদ্যত হলেন। ব্রজবাসীদের বিপদে, আপদে, ভূবিস্তারে কৃষ্ণ পূর্বাহ্নেই তাঁদের নায়ক হয়ে উঠেছেন। সকলে এখন তাকে এমনই এক আশ্রয়স্থল বলে মনে করে যে, কৃষ্ণ এটা বুঝে গেছেন–তার কথা লোকে শুনবে।

কৃষ্ণ বুড়ো গয়লাকে বললেন–আমরা হলাম গিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়ানো বনচারী গয়লা জাতের মানুষ। গোরু-বাছুর নিয়ে আমরা জীবিকা নির্বাহ করি–বয়ং বনচরা গোপাঃ সদা গোধনজীবিনঃ। আপনারও এটা জানা উচিত যে,–যা আমাদের জীবিকা, সেই গোরু, যা আমাদের চতুর্দিক থেকে রক্ষা করে, সেই পর্বত, আর যেখানে আমরা থাকি, সেই বন এইগুলোই আমাদের দেবতা–গাবোস্মদ্দৈবতং বিদ্ধি গিরয়শ্চ বনানি চ।

কৃষ্ণ এবার বেশ অর্থশাস্ত্রীয় কায়দায় ব্রজভূমির মানুষদের বুঝিয়ে বললেন–কৃষকরা জীবিকা নির্বাহ করে কৃষিকর্ম করে, ব্যবসায়ী দোকানদাররা জীবিকা নির্বাহ করে ক্রয়-বিক্রয়, বিপণন করে, কিন্তু আমাদের বৃত্তি হল গোপালন–গাবোস্মাকং পরা বৃত্তিঃ। যে মানুষ যে বিদ্যা বা বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত, সেই বিদ্যাই তার দেবতা, পূজা যদি করতে হয় তবে সেই বিদ্যাষ্ঠাত্রী দেবতার পূজা করা উচিত। যে মানুষ একজনের কাছ থেকে ফল পেয়ে, সেই ফল ভোগ করে, তারপর অন্য জনের আদর-আপ্যায়ন করে–যোন্যস্য ফলমানঃ করোত্যন্যস্য সৎক্রিয়া তার মতো কৃতঘ্ন মানুষের ইহলোকে, পরলোকে কোথাও ঠাই হবে না।

কথাগুলি বলে কৃষ্ণ বুঝিয়ে দিলেন–এতদিন যা করা হয়েছে, তা ঠিক হয়নি। কিন্তু এখন যা করতে হবে, সেটা প্রতিষ্ঠা করতে হলে, তার জন্য তাঁকে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। একটি পুরাতন সামাজিক প্রথা বাতিল করে যদি নতুন সামাজিক প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তবে প্রখর ব্যক্তিত্বকেও তর্ক-যুক্তির অবতারণা করতে হয়। কৃষ্ণ তাই করছেন এবং সেই অসাধারণ প্রক্রিয়ার মধ্যে কৃষ্ণের মধ্যে এক পাক্কা এনভিরনমেন্টালিস্টকে খুঁজে পাব আমরা। কৃষ্ণ বলেছেন–যে পর্যন্ত আমাদের কৃষি-জমি, সেই পর্যন্তই ব্রজভূমির সীমা। সীমার শেষে আছে বন, সেই বনের শেষে পর্বত। সেই পর্বতই আমাদের একমাত্র আশ্রয়–বনান্তা গিরিয়ঃ সর্বে সা চাস্মাকং গতিধ্রুবা।

 বস্তুত, সেকালের মানুষের কাছে পাহাড় ছিল এক অবাক বিস্ময়। তাকে আশ্রয় বলতেও কেউ দ্বিধা করত না। শত্রুপক্ষের আক্রমণের পথে পাহাড় ছিল নিদারুণ বাধা। পণ্ডিতজনেরা বলেছেন–পাহাড় হল দেবতাদের আবাস এবং তারা রাজা-মহারাজাদের এমন জায়গায় থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন, যেখানে চারপাশে পাহাড় আছে। পাহাড় সেখানে দুর্গের কাজ করে। বৃন্দাবনের এই গোবর্ধন পাহাড়টি অন্যান্য গিরিদুর্গের তুলনায় কিছুই নয়, তবু এই পাহাড়কেই কৃষ্ণ এক সুরক্ষার স্থল বলে মনে করেছেন। এই গোবর্ধন পাহাড় সংলগ্ন বৃন্দাবন এক বনভূমি। এই বনভূমির জন্যও কৃষ্ণের দুশ্চিন্তা আছে। তিনি মনে করেন–পাহাড় বনভূমিকেও সুরক্ষিত রাখে। তিনি বলেছেন–পাহাড়ে বাঘ-সিংহের মতো যেসব হিংস্র জন্তু আছে, তারা সেইসব মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়–যারা বন কাটতে চায়। এইভাবে পাহাড়-সংলগ্ন বনকে পাহাড় নিজেই রক্ষা করে–বনানি স্বানি রক্ষন্তি ত্রাসয়ন্তো বনচ্ছিদঃ। যে মানুষ বনের আশ্রয়ে থেকে জীবিকা নির্বাহের জন্য সেই বনেরই ক্ষতি করে–যদা চৈষাং বিকুন্তি তে বনালয়জীবিনঃ–সেই সব মানুষেরা তাদের রাক্ষুসে কাজের জন্য নিজেরাই মারা পড়ে।

 কৃষ্ণ যে কথাগুলি বলেছেন, তা যদি খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়/তৃতীয় শতাব্দীতেও পৌরাণিকেরা সংকলিত করে রেখে থাকেন, তবে বলতে হবে–এ অত্যন্ত আধুনিক ভাবনা। আজকে যারা অরণ্য-সংরক্ষণ বা পশু সংরক্ষণের কথা ভাবছেন, তারা জানবেন আজ থেকে প্রায় দুহাজার বছর আগেও এই দুর্ভাবনা ছিল। কৃষ্ণ তার বৃক্ষ-লতা সংকুল অরণ্যভূমির আবাস বৃন্দাবন এবং তার সুরক্ষা-বলয় গোবর্ধন পাহাড়কে বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের চেয়েও বেশি মূল্য দিয়েছেন। বৃন্দাবনের বন আর গোবর্ধন পাহাড়ই তাঁর কাছে দেবতার মতো। তিনি বলেছেন–ব্রাহ্মণরা মন্ত্রযজ্ঞ করেন, আর কৃষকরা পুজো করেন হল–লাঙলের। কিন্তু আমরা গোপজনেরা করব গিরিযজ্ঞ-গিরিযজ্ঞস্তথা গোপা ইজ্যোস্মাভিগিরির্বনে।

কৃষ্ণ প্রধানত গিরিযজ্ঞের কথা বললেও বৃক্ষ-সমন্বিত বন এবং গোপজনের পালনীয় পশুদের পুজোও তার গিরিযজ্ঞের অঙ্গ। তিনি বলেছেন–আমরা স্বস্তিবাচন করে কোনও বড় গাছের তলায় অথবা কোনও ভাল জায়গায় আমাদের পাল্য পশুদের একত্র করব। তারপর সাড়ম্বরে আমাদের পূজা আরম্ভ হবে। কৃষ্ণ যে আড়ম্বরের কথা বলেছেন, তাতে অর্থসম্পত্তির প্রয়োজন হয় না তত। গোপজনের আর্থিক অবস্থা তিনি জানেন, অতএব সেই অনুযায়ী তার নির্দেশ হল–গোরুগুলোর শিঙ মুড়ে দিতে হবে শারদ ফুলের রাশিতে, আর তাতে বাঁধা থাকবে ময়ূরের পালক। ঘণ্টা ঝুলিয়ে দিতে হবে প্রত্যেকটি গোরুর গলদেশে। অঞ্জলি ভরে আনতে হবে শরৎকালের ফুল। পুজোর জন্য। গোপূজার সঙ্গে সঙ্গেই আরম্ভ হবে গিরিযজ্ঞ। স্বর্গের দেবতারা দেবরাজ ইন্দ্রের পূজা করুন, আমরা গিরিরাজ গোবর্ধনের পূজা করব।

বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের মতোই কৃষ্ণ তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত আগে জানিয়ে পরে অন্যদের মত চাইছেন। তিনি বললেন–যদি আমার ওপর আপনাদের একটুও ভালবাসা থাকে, যদি আমি একবারের তরেও আপনাদের বন্ধু হয়ে কি–যদ্যন্তি ময়ি বঃ প্রীতির্যদি বা সুহৃদো বয়ম্ তাহলে আপনাদের এই গোযজ্ঞই করতে হবে–গাবো হি পূজ্যাঃ সততং–যদি আমার কথায় আপনাদের বিশ্বাস থাকে, তবে বিনা বিচারে আপনারা আমার কথা শুনবেন–এতন্মম বচস্তথ্যং ক্রিয়তাম অবিচারিতম্।

কৃষ্ণ এখন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত আছেন, সেই মর্যাদা অতিক্রম করে কেউ অন্য কথা বলবে, এমন যে হতে পারে না, তা কৃষ্ণ জানতেন। গোপজনেরা বললেন–তোমার এই বুদ্ধি এবং বিচার আমাদের মনে খুব ধরেছে, সত্যিই আমাদের গোরুগুলির মঙ্গল হবে তাতে–প্রণয়ত্যেব নঃ সর্বান্ বুদ্ধিবৃদ্ধিকরী গবা। ব্রজবাসীরা কৃষ্ণের কাছে তাদের ঋণ স্বীকার করে বললেন–আজ তোমার জন্যই আমরা এই বিশাল গোচারণভূমি আর গোরু নিয়ে সুখে আছি, নিরুপদ্রবে আছি–ত্বকৃতে কৃষ্ণ গোষ্ঠোয়ং ক্ষেমী মুদিতগোকুলঃ। কোনও শত্রু আজ এমুখো হয় না–এসব তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে। জন্ম থেকেই তুমি যেসব কাজ করেছ, তা দেবতারাও পারবেন না। সেই তোমার মতো মানুষের কথা শুনে–হতে পারে তোমার কথার মধ্যে অহংকার আছে, কারণ তুমি বলেছ–গোযজ্ঞই করতে হবে–কিন্তু তোমার সাহংকার কথা শুনে আমাদের আশ্চর্য লাগছে–বোদ্ধব্যাচ্চাভিমানাচ্চ বিস্মিতানি মনাংসি নঃ।

আশ্চর্য লাগবারই কথা। কারণ কৃষ্ণ এক অতি সচল সামাজিক প্রথা রদ করে অন্য এক নতুন প্রথা প্রবর্তন করছেন। প্রবল ব্যক্তিত্বের এমন সাহংকার প্রতিষ্ঠা মানুষকে স্তব্ধ করে, বিস্মিত করে। মানুষ তার মধ্যে শক্তি, দীপ্তি, আর মাধুর্যের সমহিম প্রকাশ দেখতে পেয়ে এক মুহূর্তের মধ্যে ইন্দ্র, সূর্য অথবা চন্দ্রের সঙ্গে তার একাত্মতা স্থাপন করে–দেবেম্বিব পুরন্দরঃ, দেবেবি দিবাকরঃ, দেবেধিব নিশাকরঃ। তারা বলতে থাকে–তোমার শক্তি, তোমার এই শরীর এবং তুমি পূর্বে যা করে দেখিয়েছ–তাতে তোমার কথা অতিক্রম করবে এমন শক্তি কারও নেই। মহাসাগর কি কখনও নিজের বেলাভূমি অতিক্রম করে? অতএব গিরিযজ্ঞ সম্বন্ধে তুমি যা বললে, তাই হবে–কল্লঙ্ঘয়িতুং শক্তো বেলামিব মহোদধেঃ। আজ থেকেই বন্ধ হয়ে যাক ইন্দ্ৰযজ্ঞ, আর তুমি যা বললে সেই তোমার কথামতো গোপজনের মঙ্গলজনক গিরিযজ্ঞ সাড়ম্বরে আরম্ভ হয়ে যাক–

স্থিতঃ শক্রমহস্তাত শ্ৰীমান গিরিমহত্বয়ম্।
ত্বৎপ্রণীতোদ্য গোপানাং গবাং হেতোঃ প্রবর্ততা।

বুড়ো গয়লা কৃষ্ণের অসাধারণ ক্ষমতা, তাঁর বাক্য-বল-পৌরুষ এবং ব্যক্তিত্বের কথা বারবার উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিল যে, এরপর ভাল-মন্দ যাই হোক, তার দায়িত্ব কিন্তু কৃষ্ণের। কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে চিৎকার করে উঠল–বড় বড় হাঁড়ি-কলসী যা আছে নিয়ে এসো সবাই। অন্তত তিনদিনের দুধ ভরে রাখতে হবে–ভাজনানি উপকল্পস্তাং পয়সঃ পেশলানি চ। ভাল রকম খাবার-দাবার জোগাড় করো–ভক্ষ্য, ভোজ্য, পানীয়। ভাল চালের ভাত রাঁধতে হবে, তার সঙ্গে থাকবে মাংস। তার জন্যও পাত্র চাই অনেক–ভাজনানি চ মাংসস্য ন্যস্যামোদনস্য চ। মোষ–বলি অথবা যেসব পশুমাংস আমরা খাই সেসব পশুর বলি হবে–বিশস্যতাঞ্চ পশবো ভোজ্যা যে মহিষাদয়ঃ।

আমাকে অনেকে জনান্তিকে জিজ্ঞাসা করেন–আচ্ছা! কৃষ্ণ কি মাছ-মাংস খেতেন আপনার মনে হয়? আমি বহুবার তাদের সন্দেহ নিরসন করে বলেছি–খেতেন বইকি, অবশ্যই খেতেন। তিনি সেকালের ক্ষত্রিয়বংশের ছেলে, আমিযান্ন তার পুষ্টি এবং সুখাদ্যের অন্যতম। এমনকি এখন তো দেখা গেল–যে গয়লা–ঘরে তিনি মানুষ হচ্ছিলেন, সেখানেও মাংসের স্বাদু এবং পরিমাণ কিছু কম নয়। যত বড় বড় পাত্রের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাতে কৃষ্ণের ভাগে মাংস কিছু কম পড়বে বলে মনে হয় না। তবে কৃষ্ণের সঙ্গে এই যে নিরামিষ ভাবনার অনুষঙ্গ জুটেছে, সেটা পরবর্তীকালের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রভাব এবং তা নিছকই ভক্তজনের পালনীয়।

 যাই হোক, গয়লা বুড়োর হুংকারের সঙ্গে সঙ্গে ব্রজবাসীরা আনন্দে মেতে উঠল– আনন্দজননো ঘোষো মহান্ মুদিতগোকুলঃ। ঢাক-ঢোল, বাদ্যি-বাজনা বাজতে আরম্ভ করল। গোরু-বাছুর-ষাঁড় চেঁচাতে লাগল এক সঙ্গে। দুধ-দই-ঘি-ঘোলের পাত্রগুলি হ্রদের মতো দেখতে হল। মাংস আর সুসংস্কৃত অন্নের পাহাড় তৈরি হল–মাংসরাশিঃ প্রভৃঢ্যঃ প্রকাশৌদনপর্বতঃ। গন্ধ-মাল্য-ফুলের স্তূপ রাশীকৃত হল। হৃষ্টপুষ্ট এবং সন্তুষ্ট গোপজনের সঙ্গে দেখা গেল বিচিত্রবেশিনী গোপললনাদের–তুষ্ট গোপজনাকীর্ণো গোপনারীমনোহরঃ। গিরিযজ্ঞ আরম্ভ হল কৃষ্ণের কথায়।

 যজ্ঞ আরম্ভ হল একেবারে বৈদিক কায়দায়। আজ্যস্থালী, চরুস্থালী এবং ব্রাহ্মণদের স্বস্তি-বাচনে যজ্ঞস্থল মুখরিত হল। অন্ন-পান আর দক্ষিণায় তুষ্ট হয়ে–তুষ্টাঃ সম্পূর্ণমনসাঃ ব্রাহ্মণরা প্রভূত আশীর্বাদ করে আসন ছেড়ে উঠলেন। গয়লাদের আনা দই, দুধ, ঘৃত, মাংস কৃষ্ণই আস্বাদন করার সুযোগ পেলেন সবার আগে। তার আদেশ সিদ্ধ হয়েছে, অতএব সন্তুষ্টমনে তিনি গয়লাদের উপহার গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষ্ণ গোবর্ধন পাহাড়ের সঙ্গে একাত্ম হলেন যেন। বস্তুত, গোবর্ধন নামটি বোধহয় আগে ছিল না। আজ এই অনুষ্ঠানে গোপজনের জীবিকা-গো-বৃদ্ধি বা বর্ধনের জন্যই যেহেতু যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেই যজ্ঞ যেহেতু এই পাহাড়ের পাশেই বিস্তৃত প্রদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল অতএব সেই গো-বর্ধন বা গো-মঙ্গল উৎসবই–বুদ্ধিবৃদ্ধিকরী গবাম–গোবর্ধনপূজার সঙ্গে একাত্মক হয়ে গেল।

 যজ্ঞান্তে কৃষ্ণ যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তখন কিন্তু তিনি গোপজনদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন–আমার প্রতি যদি তোমাদের দয়া থাকে, তবে এই গোরুগুলির মধ্যেই তোমরা আমার পূজা কোরো–অদ্য প্রভৃতি চেজোহং গোযু যদ্যস্ত মে দয়া। এরপরে কৃষ্ণের মুখ দিয়ে যেসব কথা বেরিয়েছে, তাতে গোরু এবং গোবর্ধন পাহাড়–দুইই একাত্ম হয়ে গেছে কৃষ্ণের সঙ্গে। কৃষ্ণের কথাগুলোর মধ্যে এখানে পৌরাণিকদের অবতারবাদের আবেশ জড়িয়ে গেছে, কিন্তু একটি বৃহৎ এবং মহান ব্যক্তিত্বের দেবতত্ত্বে আরোহণ সম্পূর্ণ হয় এইভাবেই। ইন্দ্ৰযজ্ঞের প্রচলিত প্রথা রদ করে এখন তিনি Final Messiah, গো-পূজা এবং গিরিপূজার অলক্ষ্যে যা ঘটল তা হল–নবীন কৃষ্ণ পুরাতন বৈদিক ইন্দ্রের স্থলাভিষিক্ত হলেন। সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন–

Thus the account of Krishna fighting the Indra–cult, instructing the cowherds to abandon the old ritual and to worship the mountain and cattle, is only a record of the superimposition of the new Vasudeva-Krishna cult on the old, worn-out Indra–cult.

পুরাতন প্রথা রদ হয়ে গিয়ে যখন নতুন প্রথা নতুন দেবতার প্রতিষ্ঠা হয়, তার মধ্যে ঝুট-ঝামেলা কিছু থাকে। পুরাতন দেবতা নির্দ্বিধায় বিনা দ্বন্দ্বে তার আসন ছেড়ে দেন না। এখানেও তা হল না। গোপূজা এবং গিরিযজ্ঞ সম্পূর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ইন্দ্রদেব তার। মেঘমণ্ডলকে আদেশ করলেন ব্রজভূমি ভাসিয়ে দিতে। মেঘ-ভৃত্যদের নানা নাম আছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হল সংবর্তক। বজ্র-বিদ্যুৎ আর বর্ষণ ক্ষমতায় সে অতুলনীয়। ইন্দ্র তাকেই আদেশ করলেন–সাতদিন নিরন্তর বর্ষণ করার। তিনি কথা দিলেন বজ্র আর বিদ্যুতের সহায়তা নিয়ে তিনি নিজে উপস্থিত থাকবেন এই প্রলয় মহোৎসবে। হুংকার দিয়ে বললেন–যারা আজ এত জীবিকা চিনেছে, গোরুর গৌরবে আজকে যারা নিজেদের গোপত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত, সেই গোরুগুলিকেই ভাসিয়ে দাও সাতদিনের মধ্যে–তা গাবঃ সপ্তরাত্রেণ পীড্যাং বৰ্ষমারুতৈঃ।

ইন্দ্রের আদেশ শুনে যুগান্তকারী মেঘের দল বেরিয়ে পড়ল আকাশ ছেয়ে। সঙ্গে আরম্ভ হল মেঘের গর্জন, ইন্দ্রের বজ্রপাত। ইন্দ্র আজ দেখে নেবেন সবাইকে। তার সবচেয়ে বেশি রাগ নন্দগোপের পুত্র দামোদর কৃষ্ণের ওপর। কৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত নন্দ ইত্যাদি প্রধান প্রধান গোপজনদেরও তিনি ভাসিয়ে দিতে চান, কেননা তারা ইন্দ্রের বিদ্বেষী। ইন্দ্র বলেই দিয়েছেন–আজকে যারা আমার আশ্রয় ত্যাগ করে ওই সেদিনের ছেলে দামোদরের আশ্রয় নিয়েছে–এতে বৃন্দাবনগতা দামোদর-পরায়ণাঃ–তাদের আমি ছাড়ব না।

মিথলজিস্টদের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে কৃষ্ণ নিজের ব্যক্তিত্বে এতদিন বৈদিক বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। গোপা শব্দটা রক্ষাকর্তা অথবা ত্রাণকর্তা হিসেবে বেদেই ব্যবহৃত হয়েছে, হয়তো সেই জন্যই কৃষ্ণ একজন গোপ। অন্যদিকে দামোদর শব্দটাও আছে বৌধায়নের শ্ৰেীতসূত্রে। কাজেই ইন্দ্রযজ্ঞের প্রতিরোধ মানেই কৃষ্ণ-বিষ্ণুর প্রতিষ্ঠা ঘটছে পুরাতন ইন্দ্রপূজার ওপর।

যাই হোক, একটু আগেই যেখানে শারদ ফুলের অর্ঘ্য সাজিয়ে গিরিযজ্ঞের ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখানে বর্ষার এই ঘন-ঘটা ব্রজবাসীর মনে ভয় জাগিয়ে তুলল–খ্যাপা মেঘ ছুটে এল আশ্বিনেরই আঙিনায়। পৌরাণিকেরা খুব যুৎসই করে এই বর্ষণের ভয়ঙ্কর বর্ণনা দিয়েছেন। ব্রজের সর্বত্র জলে জলাকার হয়ে গেল। ব্রজবাসীদের জীবন কিছু গোরু মারাও পড়ল। সকলে কাতর চোখে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি কী করেন সেটাই এখন দেখার।

হয়তো এমন হয়েছিল–ইন্দ্রের রাগ-টাগ কিছুই নয়। কিন্তু ইন্দ্ৰযজ্ঞ স্তব্ধ হবার পরেই দারুণ বর্ষণ হয়েছিল ব্রজভূমিতে আর সেটাকেই ইন্দ্রের রাগ বলে ধরে নিয়েছিলেন ব্রজবাসীরা। সমস্ত ব্রজবাসীদের করুণ অবস্থা দেখে কৃষ্ণ তাদের সবাইকে জড় হতে বললেন গোবর্ধন পাহাড়ের কোলে। কৃষ্ণ তার বাম হস্তের কনিষ্ঠিকায় গোবর্ধন পাহাড় উপড়ে তুলেছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু এটা ঠিক যে, পাহাড় মানেই উঁচু জায়গা, সেখানে খাদ আছে, গুহা আছে, পাহাড়ী গাছের ছত্র আছে। কৃষ্ণ সকলকে নিয়ে গোবর্ধন পাহাড়ে এলেন আশ্রয়ের জন্য। পৌরাণিক এক মুহূর্তের ভুলে বলে ফেলেছেন–যে, পাহাড়টিকে পৃথিবীতে নির্মিত গৃহের মতোই লাগছিল–পৃথ্বীগৃহনিভোপমঃ–অথবা ব্রজবাসীরা সেখানে আশ্রয় নেবার ফলেই পাহাড়ও গৃহের সমতা লাভ করেছিল–গৃহভাবং গতাস্তত্র গৃহাকারেণ বচসা।

পর্বতকন্দরে, গিরিগুহায় আশ্রয় নিয়ে ব্রজবাসীরা সেদিন মেঘ-বৃষ্টি-বজ্রপাত কোনওটাই টের পায়নি। তারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। কৃষ্ণের বুদ্ধি এবং পর্বতের আশ্রয় সেই ভীষণ দুর্দিনে এতটাই বোধহয় প্রয়োজনীয় ছিল যে, এই প্রয়োজনের সিদ্ধিতেই গোবর্ধন পর্বত আজও কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রয়েছেন। এক টুকরো গোবর্ধন পাহাড় এখনও চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবের কাছে কৃষ্ণের স্বরূপ। আর এই পরম আশ্রয়ের ব্যবস্থা যিনি করেছিলেন তার উদ্দেশে লোকে নিজের স্বামীপুত্র ত্যাগ করে গীত রচনা করে–মুঝে তো গিরিধারী-গোপালা দুসরা ন কোই।

 .

৯০.

 বর্যার প্রবল ধারাপাতে ব্রজভূমি অবরুদ্ধ হল বটে, তবে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রদেব ব্রজবাসী গোপজনের কোনও ক্ষতি সাধন করতে পারলেন না। কৃষ্ণ তাঁর পরমপ্রিয় আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের রক্ষা করলেন গোবর্ধন পর্বতের আশ্রয়! সাতদিন অবিরাম বৃষ্টিপাত করে ক্লান্ত শ্রান্ত ইন্দ্রদেব স্বর্গে ফিরে গেলেন! বৃন্দাবানর রাখাল গোপজানেরাও তাদের গোরু-বাছুর নিয়ে নিজের নিজের জায়গায় ফিরে এল–স্বঞ্চ স্থানং তত ঘোষঃ প্রত্যয়াং পুনরব সং! গোবর্ধন পর্বতও হিত হল নিজের জায়গায়।

সব কিছুই যখন মিটে গেল, তখনই ইন্দ্রদেবের গভীর চিন্তা হল মনে। এত অত্যাচার, এত কষ্ট দিয়েও যখন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারলেন না ইন্দ্রদেব, তখন তিনি কৃষ্ণের অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন হলেন। স্বর্গের ইন্দ্রসভা ছেড়ে তিনি এলেন ডুয়ে। সামান্য অহংকার তখনও বুঝি ছিল, তাই ঐরাবতের আরোহণ-মঞ্চটি তিনি ত্যাগ করেননি আরুহ্যেরাবতং নাগমাজগাম মহীতল। ইন্দ্র এসে দেখলেন–কৃষ্ণ সেই গোবর্ধন পাহাড়ের একটি পাথরের ওপর বসে আছেন। এত যে ঝড়-ঝাপটা গেল, এত যে ঝুট-ঝামেলা গেল, তাতে কৃষ্ণের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সেই ময়ূরপুচ্ছটি মাথায় এখনও লাগানো আছে, সেই গোপবেশ, সেই রাখাল-রাজার মাধুর্য–গোপবেশধরং বিষ্ণুং প্রীতিং লেভে পুরন্দরঃ। অর্থাৎ কৃষ্ণের মনুষ্যস্বভাব একটুও স্থলিত হয়নি।

কৃষ্ণকে এমন অবস্থায় দেখে ইন্দ্র বেশ খুশি হলেন। কৃষ্ণের উপযুক্ত সম্ভ্রম রক্ষা করে ইন্দ্রদেব নেমে এলেন ঐরাবত থেকে। হরিবংশের বর্ণনায় এই মুহূর্তে ইন্দ্রের মুখে অসংখ্য প্রশংসা-বাক্য বেরিয়েছে কৃষ্ণের উদ্দেশে। কৃষ্ণ এখানে পরম ঈশ্বরের মাহাত্ম্য লাভ করেছেন এবং কৃষ্ণের সঙ্গে বৈদিক বিষ্ণুর একাত্মতাও স্থাপিত হয়েছে এই সুযোগে। পণ্ডিতেরা এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলেন। বলেন–ভারতবর্ষে কৃষ্ণের মাহাত্ম্য এতই প্রাচীনকাল থেকে কীর্তিত হয়েছে যে, শুদ্ধ কৃষ্ণ–পূজার ধারা থেকে শুদ্ধ বিষ্ণু-পূজার ধারাকে আলাদা করাই কঠিন। বিষ্ণুর-ক্রিয়া-কর্ম সবই বহু প্রাচীনকাল থেকে চেপে গেছে কৃষ্ণের ওপর। আবার কৃষ্ণের ক্রিয়া-কর্মও সব চেপে গেছে বিষ্ণুর ওপর। এই অবস্থায় সর্বশুদ্ধ বিষ্ণু-তত্ত্ব অথবা সর্বশুদ্ধ কৃষ্ণ-তত্ত্বের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য-রেখাও টানা যাবে বলে মনে হয় না। বার্থ সাহেব তো আবার এমন কথাও বলেছেন–Visnu himself assumed importance through his identification with Krishna.

আমাদের সুশীল দে মশায় অবশ্য এ মত মানেন না। তিনি বলেন যে, সম্পূর্ণ মহাভারত জুড়ে বিষ্ণু এবং বাসুদেব কৃষ্ণের একাত্মতা এমন সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বিষ্ণু-কৃষ্ণের পুরাতন ইতিহাস কিছুই জানা যায় না। আমরা অবশ্য এই বিষ্ণু-কৃষ্ণের একাত্মতার তত্ত্ব একটু অন্যভাবে দেখি। আমাদের ধারণা–বিষ্ণু-কৃষ্ণের একাত্মতার ফলে বৈদিক বিষ্ণু যেমন নিজেকে বেশ খানিকটা মানবায়িত করতে পেরেছেন, তেমনি ওই একই একাত্মতার ফলে মনুষ্য কৃষ্ণও নিজেকে বেশ খানিকটা দেবায়িত করতে পেরেছেন।

এসব তত্ত্বকথা থাক। আমরা ইন্দ্রের কথায় আসি। ইন্দ্র নিজের পরাভবের পর আমাদের গোপবেশী কিশোরটিকে একেবারে ভগবান বলেই মেনে নিলেন প্রায়। এমনকি নতুন লোকের সঙ্গে কথা আরম্ভ করতে গেলে আমরা যেমন পূর্বের আত্মীয়তার সম্বন্ধ খুঁজে বার করবার চেষ্টা করি, সেই রকম ইন্দ্রও কৃষ্ণকে বললেন–পুরাকালে তুমি আমারই মা অদিতির গর্ভে আমার ছোটভাই হয়ে জন্মেছিলে, আমাকে তুমি তখন দাদা বলে মেনেছিলে–অদিতে-গর্ভ-পৰ্য্যায়ে পূর্বজস্তে পুরাকৃতঃ। আমরা বুঝতে পারি এখানে অবতারবাদের প্রতিষ্ঠা আছে। বামন অবতারে ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের সহায়তা করার জন্য অদিতির গর্ভে ইন্দ্রের ছোটভাই উপেন্দ্র হয়ে জন্মেছিলেন। দৈত্যরাজ বলিকে ছলনা করে অদ্ভুত বামন-বিষ্ণু ইন্দ্রকে স্বর্গরাজ্যের অধিকার জুগিয়ে দিয়েছিলেন পুনর্বার।

ইন্দ্র সেই উপেন্দ্রের ভ্রাতৃ-সম্পর্কে আজকে গৌরবান্বিত বোধ করছেন। কৃষ্ণাকে অনেক প্রশংসা করার পর তিনি নিজের অধিকার খানিকটা ছেড়ে দিতেও রাজি হলেন। বড় মানুষের সঙ্গে ভাই-ভাই সম্পর্ক পাতিয়ে অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট লোকেরা যেমন গৌরবান্বিত বোধ করেন, তেমনি ইন্দ্র কৃষ্ণকে বললেন–আমি দেবতাদের ইন্দ্র বটে, তবে তুমি এই ব্রজের গোরুগুলিকে যেভাবে রক্ষা করেছ, তাতে তোমাকে এই গোকুলের ইন্দ্র বলতেই হবে–অহং কিলেন্দ্রো দেবানাং ত্বং গবামিতাং গতঃ। আজ থেকে মর্ত্যের মানুষ তোমাকে গোবিন্দ বলে ডাকবে।

 ইন্দ্র কৃষ্ণকে রীতিমতো স্বর্গ-মর্ত্যের অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সোনার কলসের দিব্য বারি সেচন করে কৃষ্ণের একটা অভিষেকও করলেন তিনি। প্রশংসা-স্তুতিবাক্যের বান ডাকল, মুনি-ঋষিরা মন্ত্র পড়লেন কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে। সব কিছু হয়ে যাবার পর ইন্দ্রকে আমরা একটা অদ্ভুত অনুরোধ করতে দেখছি কৃষ্ণের কাছে এবং এটা অনুরোধ নয়, বলা উচিত ইন্দ্র এক আগাম সাহায্য চাইছেন কৃষ্ণের কাছে।

এই মুহূর্তটির জন্য মিথলজিস্টরা একেবারে মুখিয়ে থাকবেন প্যাটার্ন মিলিয়ে নেবার জন্য। তারা বলতে পারেন–বেদের মধ্যে চিরকাল দেখা গেছে ৰিয় সব সময় ইন্দ্রের সহায় হিসেবে কাজ করেন। বিভিন্ন শকে তা করার সময় বৈকি বিষ্ণু ইন্দ্রের সাহায্যকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। অতএব প্যাটার্ন মিলিয়ে নিলে ইন্দ্রের এই সাহায্য-প্রার্থনার মধ্যে আশ্চর্য কিছু নেই। কিন্তু আমাদের কাছে আপাতত এই প্রার্থনাটাই আশ্চর্য।

ইন্দ্র বললেন–তুমি কংস-বধ করো, কি কেশী দানবকে বধ করো, অথবা অরিষ্টাসুরকেও তুমি না হয় মেরে ফেলো। কিন্তু আমার একটা আর্জি আছে। তোমার পিসিমা কুন্তীর গর্ভে আমার একটি ছেলে হয়েছে–পিতৃম্বসরি জাতস্তে মমাংশোহমিব স্থিতঃ। আমারই মতো তার তেজ, সে আমার দ্বিতীয় সত্তা। তুমি সেই পিসিমার ছেলেটিকে সদা-সর্বদা আগলে রাখবে, তাকে আদর করবে, এক কথায় তুমি তাকে তোমার বন্ধু করে নিও–স তে রক্ষ্যশ্চ মান্যশ্চ সখ্যে চ বিনিযুজ্যতা।

দেবতা হওয়ার দরুন ইন্দ্র বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণীও করে দিলেন, যেগুলিকে আমরা পৌরাণিক কথকঠাকুরের অভ্যাস-চর্চা মনে করি। কারণ তা না হলে, কবে সেই মহাভারতের বিরাট যুদ্ধ বাধবে, আর সেই সময় পর্যন্ত কৃষ্ণ এবং তাঁর পিসিমার ছেলেটির মধ্যে যে সুসম্পর্ক থাকবে, তার সম্বন্ধে আগাম বলা যায় কী করে! অবশ্য দেবতা বলে মানলে সবই বলা সম্ভব। কিন্তু আমরা আপাতত দেবতার বিশ্বাসে না প্রবেশ করেও মহাভারতের কাহিনীর ঐতিহাসিকতা বিচার করার চেষ্টা করছি। সেই চেষ্টা যদি সফল করতে হয় তবে একটিমাত্র সংবাদই এখান থেকে সংগ্রহ করার যোগ্য। তা হল–ইন্দ্র তার আত্মজ পুত্র অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার কথা বলছেন।

ইন্দ্র অর্জুনের খবর দিতে কোনও দ্বিধাবোধ করেননি। পরিষ্কার জানিয়েছেন–কুন্তীর গর্ভে ভরতবংশের কুলগৌরব যে পুত্রটি জন্মেছে, সে আসলে আমারই পুত্র, তার নাম অর্জুন–ময়া পুত্রোর্জুনো নাম সৃষ্টঃ কুন্ত্যাং কুলোহঃ। ইতিহাসের দিক থেকে যেটা আরও জরুরী কথা, সেটা হল–ইন্দ্র অর্জুনের যতটুকু পরিচয় দিচ্ছেন, তাতে দেখছি অর্জুনের তখন অস্ত্রশিক্ষার পর্ব সমাপ্ত হয়ে গেছে। ইন্দ্র বলেছেন–দেবতাই বল, আর রাজাই বল, তুমি ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই, যে আমার অর্জুনের অস্ত্ৰগতি বুঝতে পারবে। সত্যিই সে ধনুর্বিদ্যায় অসাধারণ নৈপুণ্য লাভ করেছে–তস্যাস্ত্ৰচরিতং মার্গং ধনুষো লাঘবেন চ। নানুযাস্যন্তি রাজানো দেবা বা ত্বাং বিনা প্রভো।

 ইন্দ্র অর্জুনের কথা অনেক বলেছেন, যা পরে ঘটবে, সে সব আগাম কথাও অনেক বলেছেন। কিন্তু পৌরাণিকের কল্পবৃক্ষ থেকে যে ঈপ্সিত ফলটি আমাদের ইতিহাসের তথ্য হিসেবে তুলে নিতে হবে, তা হল–কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবনে ইন্দোৎসবের প্রথা রুদ্ধ করে নিজের প্রভুত্ব স্থাপন করে ফেলেছেন, তখন ওদিকে হস্তিনাপুরে অর্জুনের অস্ত্রবিদ্যা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। ততদিনে তিনি এক বিরাট ধনুর্ধর বীরে পরিণত হয়েছেন।

আমার সহৃদয় পাঠককুলের স্মরণ থাকবে যে, আমরা পাণ্ডুর দ্বিতীয় পুত্র ভীমের জন্ম–মাত্র কীর্তন করেই হঠাৎ হস্তিনাপুর থেকে মথুরায় চলে এসেছিলাম। চলে এসেছিলাম এই কারণে যে, বসুদেবের এই মহাপ্রভাব পুত্রটি পাণ্ডব ভীমের চেয়ে বয়সে ছোট। জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের অগ্রগণ্য পুরুষেরা মহাভারতের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে কালের গণ্ডী পেরনোর চেষ্টা করেছেন। এফিমেরিস ঘেঁটে তারা মহাভারতের কালে পৌঁছে গিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের সংস্থান বিচার করেছেন পঞ্চপাণ্ডব এবং কৃষ্ণের জন্মকালে। তাদের মতে পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের চেয়ে এক বছর দু মাস আট দিনের বড়। দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম কৃষ্ণের চেয়ে চারমাস দশ দিনের বড়। আর এইমাত্র ইন্দ্রের মুখে তার পরম প্রিয় যে আত্মজ সন্তানটির খবর পেলাম, সেই অর্জুন কিন্তু কৃষ্ণের চেয়ে ছমাসের ছোট।

কৃষ্ণ অর্জুনের চেয়ে বড় এবং ভীমের চেয়ে ছোট বলেই আমরা ভীমের জন্ম-কথা বলেই মথুরায় কৃষ্ণ-জন্মের আসরে চলে গিয়েছিলাম। তবে আমরা প্রতিনিয়তই অপেক্ষা করছিলাম–কখন পৌরাণিক কথক ঠাকুর অর্জুনের প্রসঙ্গে আসেন। কৃষ্ণের জন্ম এবং কৈশোর কথা যৎসামান্য বলেছি, কিন্তু তার যৌবনের সন্ধিলগ্নেই অর্জুনের সম্বন্ধে একটা টিপ্পনী যেই পেলাম, তখনই আমাদের দায় আসে হস্তিনাপুরে ফিরে যাবার। কিন্তু হস্তিনাপুরে আমাদের এই মুহূর্তেই ফেরার উপায় নেই। কারণ হস্তিনাপুরের স্বীকৃত রাজা পাণ্ডু এখনও শতশৃঙ্গ পর্বতেই আছেন। তিনি তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ভীমকে লাভ করার পর দুর্বাসার মন্ত্রশক্তি এবং কুন্তীর অসামান্য ক্ষমতা সম্বন্ধে পরম নিশ্চিন্ত হয়েছেন। স্মার্ত ধর্মশাস্ত্রকারেরা বলেন মানুষের প্রথম পুত্রটিই হল ধর্মজ, অন্য পুত্র-কন্যারা কামজ। ধর্মজ এই কারণে যে, পুত্রহীনতার মধ্যে যে শূন্যতা থাকে পিণ্ড-লুপ্তি তথা বংশলুপ্তির যে আশঙ্কা থাকে প্রথম পুত্র জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই সে আশঙ্কা চলে যায়। পাণ্ডুর সে সব আশঙ্কা চলে গেছে। তিনি কুন্তীকে স্বয়ং ধর্মরাজকে আহ্বানের পরামর্শ দিয়ে সব আক্ষরিক অর্থে একটি ধর্মজ সন্তান লাভ করেছেন। দ্বিতীয় পুত্র ভীমকে তিনি কামনা করেছিলেন আপন ক্ষত্রশক্তির প্রতীক হিসেবে প্ৰাহু ক্ষত্রং বলজ্যেষ্ঠ–ইত্যাদি।

 কিন্তু ক্ষত্রশক্তি অধিরাজ হবার যোগ্য নয়। এই শক্তির মধ্যে শুধু উন্মাদনা আছে। ভীম জন্মাবার পর পাণ্ডু এমন একটি পুত্র চাইলেন কুন্তীর কাছে, যিনি মর্তবাসীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ পুরুষ হবেন–কথং নু মে বরঃ পুত্রো লোকশ্রেষ্ঠো ভবেদিতি। এমন একটি পুত্র, যার মধ্যে দৈব এবং পুরুষকার একাকার হয়ে যাবে। অর্থাৎ দেবতার পরম আশীর্বাদ নিয়ে সে জন্মাবে, অথচ পুরুষকার প্রতি পদক্ষেপে তাকে মহিমান্বিত করবে। পাণ্ডু বলেছেন–দৈব এবং পুরুষকার, এই দুয়ের ওপর ভিত্তি করেই এই লোকযাত্রা চলে। পুরুষকার এমনই এক বস্তু যার সঙ্গে দৈব যুক্ত হয় সময়কালে–তত্র দৈবন্তু বিধিনা কালযুক্তেন লভ্যতে।

 পাণ্ডু এই কথাগুলি কেন বলেছেন, তা আমরা জানি। দৈব এবং পুরুষকার–এই দুটির মধ্যে পুরুষকারের প্রাধান্য, আবার দৈবও কিন্তু ফেলনা নয়। এই পৃথিবীতে পুরুষকারহীন অবস্থায় যে শুধু দৈববলে বিশাল সাফল্য লাভ করে, মানুষ তাকে বলে–লোকটা ফাপা শুধু কপাল ওকে তুলে দিল। আর যে শুধু পুরুষকারের দ্বারাই সম্পদলাভের চেষ্টা করে, এবং দৈব যদি তাকে একটুও সহায়তা না করে সে শুধু সংসারে খেটে যায়, খেটেই যায়, আমরা তখন সেই মানুষটার ওপর মায়া করি–আহা বেচারা, এত খাটে তবু ওর ভাগ্য ফিরল না। নীতিশাস্ত্র তাই বলে–লোকাত্রার প্রতীক একটি অশ্ববাহিত রথের যদি একটি মাত্র চাকা থাকে, তাহলে যেমন সে রথে গতি আসে না, তেমনি দৈব কিংবা পুরুষকার যে কোনও একটিকে বাদ দিয়ে মানুষের জীবন-রথ চলতে পারে না।

পাণ্ডু এই তত্ত্বটা খুব ভালই বোঝেন। তাই তিনি এমন একটি পুত্র লাভ করতে চান যার মধ্যে ভাগ্য এবং পুরুষকারের মেলবন্ধন ঘটবে। তার মনে হল দেবরাজ ইন্দ্রের কথা। বৈদিক দেবকুলে যাঁরা প্রধান দেবতা ছিলেন–বায়ু, সূর্য, মিত্র, বরুণ তাদের কারও প্রভাবই কম নয়, কিন্তু সমস্ত দেবতারা ইন্দ্রকে রাজা হিসেবে বরণ করেছিলেন। এটাই তার ভাগ্য, তার দৈব। কিন্তু ইন্দ্রের নিজের গুণ হল অধ্যাবসায়, সাহস, শক্তি এবং উদ্যম। এইগুলিই তাকে অসুর-শক্তি নিধন করার ক্ষমতা জুগিয়ে দেবরাজ্য নিষ্কণ্টক করার সুযোগ দিয়েছে। পাণ্ডু তাই দেবরাজ ইন্দ্রের মতো একটি পুত্র চান। সেই পুত্রের মধ্যে ইন্দ্রের রাজকীয় প্রাধান্য তো থাকতেই হবে, আর থাকবে তার শক্তি, ক্ষমতা উৎসাহ।

পাণ্ডু জানেন–এমন একটি পুত্রের জন্য তাকে সাধনা করতে হবে। গুণবান পুত্রের জন্য ভাবনা এবং সাধনার কথা আমাদের প্রাচীনরা সদা সর্বদা বলে এসেছেন। শুধু কামনার মাধ্যমে উত্তম পুত্রের জনক হওয়া যায় না, উত্তম লোকপ্রিয় পুত্রের জন্য তপস্যা চাই, মনে মনে তার জন্য আসন পেতে রাখা চাই, তবে সুপুত্র জন্মাবে–এই ছিল তখনকার মানুষের বিশ্বাস। পুরাণ কাহিনীতে বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে, যাতে দেখব পিতা-মাতা তপস্যা করছেন উত্তম পুত্র লাভের জন্য। লক্ষ্য করে দেখবেন–পুরাণ কাহিনীর অনেক পুত্র-কন্যারা অযযানি-সম্ভব। তারা সব হৃদয় থেকে জন্মাচ্ছেন। এমনকি এই পাঁচশো বছর আগে মহাপ্রভু চৈতন্যের জন্ম প্রসঙ্গেও এই হৃদয় থেকে পুত্র-জন্মানোর কথা বলেছেন চরিতকারেরা। আমাদের মতে–এই হৃদয় হল সুপুত্র-লাভের ভাবনার আসন, যেখানে মনের ঈপ্সিততম প্রথম স্থান লাভ করে।

পাণ্ডু আজ সেই বরপুত্র লাভের জন্য তপস্যায় বসছেন। বলতে পারা যায়–পাণ্ডু তার প্রথমজ পুত্রের জন্য তপস্যা করলেন না, দ্বিতীয় পুত্রটির জন্য তপস্যা করলেন না। হঠাৎ আজকে এই তৃতীয় পুত্রের জন্ম-সময়ে তার চেতনা হল? উত্তরে বলতে পারি–প্রথম পুত্রের পরামর্শে দুর্বাসার মন্ত্রের ঘোর লেগেছিল তার চোখে। কুন্তী যেমন অবিশ্বাসী হয়ে মন্ত্রপরীক্ষার জন্য সূর্যকে ডেকে এনেছিলেন, তেমনি পাণ্ডুর মনেও সংশয় ছিল। যার জন্য তিনি কোনও রিস্ক নেননি। ধর্মকে ডাকার পরামর্শ দিয়ে ধর্মজ সন্তানের আশ মিটিয়েছেন। দ্বিতীয় পুত্রের বেলায় তাঁর আশ্চর্যভাব মোটেই কাটেনি। ভেবেছেন–কুন্তী যা বলেছেন, তাই তো হল রে। এমন অনায়াসে এমন সুপুত্র লাভ! তাই তো, তাই তো, তাহলে একটি শক্তিমান পুত্র চেয়ে দেখি তো, হয় কিনা? তাও হয়েছে। এখন তিনি পুত্রলাভের পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চিত। মনে যেই স্থিরতা এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে চিরন্তন সংস্কারও তার মনের মধ্যে কাজ করেছে। পুত্রলাভের জন্য এই প্রথম তিনি কুন্তীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে ইম্ভলবঙ হচ্ছেন। বলছেন–সেই অমিতপ্রভাবশালী দেবরাজকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করে আমি পুত্র লাভ করতে চাইতং তোষয়িত্ব তপসা পুত্রং লন্স্যে মহাবলম্। তিনি স্বর্গের দেবরাজ, তিনি আমাকে যে পুত্র দেবেন, সেই হবে আমার বীরশ্রেষ্ঠ পুত্র। আমি আজ থেকে কায়–মনো-বাক্যে সেই মহান পুত্র লাভের তপস্যা করবকর্মা মনসা বাঁচা তস্মাত্ তন্স্যে মহত্তপঃ।

পাণ্ডু শতশৃঙ্গবাসী মহর্ষিদের সঙ্গে পরামর্শ করে কুন্তীকে এক বৎসর ধরে এক কল্যাণকর ব্রত করার নির্দেশ দিলেন। পাণ্ডু নিজেও কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলেন উপযুক্ত পুত্রলাভের জন্য–ভার্যয়া সহ ধর্মাত্মা পৰ্য্যতপ্যত ভারত। বীরপুত্রকামী দুই তাপস-তপস্বিনীর কষ্টকর প্রয়াসে সন্তুষ্ট হয়ে দেবরাজ দেখা দিলেন। পাণ্ডুকে তিনি আশ্বস্ত করলেন–গো-ব্রাহ্মণের রক্ষক এবং শত্রুদের দুঃখকারী এক উৎকৃষ্ট পুত্র লাভ করবে তুমি–দুহৃদাং শোকজননং সর্বান্ধব-নন্দন।

ইন্দ্রের কথা শুনে পাণ্ডু বড় খুশি হলেন। কুন্তীকে ডেকে বললেন–যেমনটি চেয়েছিলাম তেমনি হবে–যথা সংকল্পিতং হৃদা। তুমি এখন সেই পুত্রলাভের যত্ন করো। অলৌকিক শক্তিধর, সূর্যের সমান তার তেজ, অতি উদার এবং ক্ষত্রিয় তেজের একমাত্র আশ্রয় সেই পুত্র আমি লাভ করব বলে দেবরাজ অঙ্গীকার করেছেন। তুমি সেই পুত্রলাভের জন্য দেবরাজ ইন্দ্রকেই আহ্বান করো–লব্ধঃ প্রসাদো দেবেন্দ্রাত্তমায়ূয় শুচিস্মিতে।

আমরা আগেও একথা বলেছি যে, মহাভারতীয় যুগের প্রথম কল্পেও বৈদিক দেবতা–কুলের প্রভাব মোটেই চলে যায়নি। ইন্দ্র হলেন বৈদিক দেবতাদের মধ্যে ক্ষত্রিয়, যোদ্ধা এবং রাজা। মহাভারতের পরিক্ষীণ বৈদিকতার কালে পাণ্ডু তাঁর এই তৃতীয় পুত্রটির মধ্যে বৈদিক ইন্দ্রের আর্কিটাইপ (archetype) দেখার চেষ্টা করছেন। সেই বৈদিক রাজার প্রভাব এখনও ক্ষুণ্ণ হয়নি।

আমরা পূর্বে দেখাবার চেষ্টা করেছি–এই যে ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র ইত্যাদি দেবতা–এঁরা উত্তমশ্রেণীর মানুষই। এটা নিশ্চয়ই বলা ঠিক হবে না যে, বৈদিকেরা তাদের যে নেতাটিকে ইন্দ্র বলে সম্বোধন করেছিলেন, সেই ইন্দ্র মহাভারতের যুগেও বেঁচে আছেন। পণ্ডিতেরা বলেন–বৈদিক আর্যরা বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন এবং ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, সূর্য এঁরা একেকজন গোষ্ঠী-নেতা। ইন্দ্র অবশ্য নেতারও নেতা। বৈদিক যুগের যখন অবসান হয়ে আসছে, তখন সেই দেবোত্তম ইন্দ্রটি না থাকলেও ইন্দ্র-গোষ্ঠীর মানুযের। ছিলেন নিশ্চয়। তাদের আমরা ঐন্দ্রও বলতে পারি। তবে এ সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়, বলাটা ঠিকও হবে না। শুধু এইটুকু বলতে পারি–ইন্দ্রকুলের যে ব্যক্তিটি মহাভারতের যুগেও ছিলেন, অথবা যাঁকে ইন্দ্র বলে তখন নির্বাচন করা হয়েছিল, সেই ইন্দ্রকেই আহ্বান করার কথা পাণ্ডু জানিয়েছেন কুন্তীকে। নিয়োগ-প্রথার নিয়ম হল–কোনও উত্তম পুরুষকে দিয়ে পুত্রোৎপাদন করানো। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনও ব্রাহ্মণ বা অন্য কোনও উত্তম পুরুষের বদলে পাণ্ডু বৈদিক বর্গের দেব-পুরুষদের বেছে নিয়েছেন। আর সেই তৃতীয় পুত্রটির বেলায় একেবারে স্বয়ং দেবরাজকেই পাণ্ডুর পছন্দ হয়েছে!

পাণ্ডুর ইচ্ছামতো কুন্তী দেবরাজ ইন্দ্রাকে সাদর আহ্বান জানালেন মিলনের জন্য। মিলন সম্পূর্ণ হল এবং গর্ভকাল পরিপক্ক হল ফান মাসের এক দিনের বেলায় পূর্বফাল্গুনী আর উত্তরফান্থনী নক্ষত্রের সন্ধিক্ষণে কুন্তীর তৃতীয় পুত্র জন্মাল। ফাল্গুন মাস আর দুই ফাল্গুনী নক্ষত্রের একত্র সমারোহে এই পুত্রের নামই হয়ে গেল ফাল্গুন অথবা ফানী–জাতস্তু ফাল্গুনে মাসি তেনাসৌ ফানঃ স্মৃতঃ। বালকের জন্মমাত্রেই আকাশ থেকে দৈববাণী হল–এ ছেলে কার্তবীর্য অর্জুনের মতো শক্তিধর হবে, শিবের মতো পরাক্রম হবে, এ করবে, সে করবে–এরকম শত কিসিমের ভবিষ্যদ–বাণী হল, যা মহাভারতের ঘটনা চলাকালীন ঘটবে।

ভবিষ্যদ-বাণীতে বিশ্বাস নাই করলাম। ধরে নেওয়া যাক অর্জুনের জন্মকালে শতশৃঙ্গবাসী মানুষ-জনেরা অনেক শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। এই শুভেচ্ছা জানানোর পৌরাণিক কল্পটি একটু বেশি মাত্রায় স্বর্গীয়। সেখানে স্বর্গে দুন্দুভি বাজাবে, পুষ্পবৃষ্টি হবে, লোকপিতারা আকাশ থেকে বীরপুত্রের মঙ্গল কামনা করবেন। গন্ধর্বরা গান গাইবেন, সেই গানের তালে তালে নৃত্য করবেন আয়তনোচনা অপ্সরারা। অর্জুনের জন্মলগ্নেও এই সমস্ত উত্সব ক্রমান্বয়ে ঘটল। আমাদের মতে এর মধ্যে লক্ষণীয় শুধু একটি অসাধারণী রমণী। মেনকা-সহজন্যা অথবা তিলোত্তমা-প্রমাথিনীর বিশাল বিশাল দলের মধ্যে তাকে বড় চেনা যায় না। কিন্তু ভবিষ্যতে এই রমণীর মোহন রূপের আলো ছড়িয়ে পড়ার অর্জুনের মুখে। তার নাম উর্বশী। পরে যখন অর্জুনের সঙ্গে উর্বশীর দেখা হবে, তিনি এই উর্বশী কিনা তাতে আমাদের সন্দেহ থাকবে এবং সন্দেহের নিরসনও ঘটবে সেই সময়েই এখন শুধু মনে রাখতে হবে যে, উর্বশী অর্জুনের জন্মোৎসবে নৃত্য করে গেলেন।

.

৯২.

 অর্জুনের জন্মের সময়ে বেশ একটা অলৌকিক পরিবেশ সৃষ্টি হল। স্বর্গীয় নৃত্য, গান, আর স্তব-স্তুতিতে অর্জুনের জন্ম যেন উৎসবে পরিণত হল। আমাদের ধারণা–অর্জুনের জন্মে পাণ্ডু যে মহা–মহোৎসবে মেতে উঠেছিলেন, তারই যেন প্রতিরূপক এই স্বর্গীয় উৎসব। অর্জুনের জন্মে পাণ্ডু বেশ একটু উৎসাহিতও হয়ে উঠলেন। দুর্বাসার বশীকরণ মন্ত্র এবং কুন্তীর উর্বরতায় তিনি এতই খুশি হয়ে উঠলেন যে, তিনি আবারও কুন্তীর কাছে পুত্রলাভের জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন।

কুন্তী এবার বিরক্ত বোধ করলেন। না হয় তিনি দেবসঙ্গমের বশীকরণ মন্ত্র জানেন, না হয় যাঁদের সঙ্গে তিনি পাণ্ডুর অনুরোধে সঙ্গত হয়েছেন, তাঁরা দেবতা, কিন্তু দেবতা হলেও তো তারা পুরুষ বটে। অক্ষম স্বামীর অনুরোধে কুন্তী তিন-তিনবার সাগ্রহ অভিনয়ের স্মিতহাস্যে তিন দেবতার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। কিন্তু এই মিলনের মধ্যেও পর-পুরুষের চেতনাটুকু তাঁর সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়নি। স্বামীর অনুরোধে এবার তিনি তাই বিরক্ত হয়ে বললেন–খুব বিপদের সময়েও এই নিয়োগের পদ্ধতিতে চতুর্থ পুত্র উৎপাদনের কথা ভদ্রজনে অনুমোদন করেন না। তিন-তিনটি পুত্রলাভের পর এবার যদি ওই একই উপায়ে আমি চতুর্থ পুত্র লাভ করি, তবে লোকে আমাকে স্বৈরিণী বলবে, আর তারপরে যদি আরও একটি, মানে পঞ্চম পুত্র চাই, তবে আমাকে বেশ্যা বলবে লোকে–অতঃপরং স্বৈরিণী স্যাৎ পঞ্চমে বন্ধকী ভবেৎ। কুন্তী সানুনয়ে পাণ্ডুকে বললেন–তুমি ভদ্রজনের আচার–আচরণ জান। কাজেই সব জেনেও যেহেতু এমন অনুরোধ তুমি করছ, তাতে বুঝি তুমি কোনও ভাবনা বিচার না করেই বেখেয়ালে এ–সব কথা বলছ–অপত্যার্থং সমুক্রম্য প্রমাদাদিব ভাষসে।

পাণ্ডু আর কথা বাড়াননি। তিনটি পুত্র লাভ করে তিনি যথেষ্টই আনন্দ লাভ করেছেন এবং এর পরে কুন্তীর কাছে আর কীই বা তিনি চাইতে পারেন। ভরতবংশের পরম্পরা রক্ষার জন্য কুন্তীর কাছে তিনি ঋণী হয়ে গেছেন। পাণ্ডুর খুশি হবার আরও কারণ ছিল। ওদিকে ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্র লাভ করেছেন, কিন্তু ভাইতে ভাইতে অসম্ভব শ্রদ্ধাভাব থাকা সত্ত্বেও যতটুকু রেষারেষি থাকে, সেই রেষারেষিতে পা জিতে গেছেন। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্রের চেয়ে বয়সে বড়। রাজবংশে এই বয়সাধিক্যের মূল্য আছে। পাণ্ডু এখানে জিতে আছেন।

কিন্তু কুন্তীরও পুত্র হল, গান্ধারীরও পুত্র হল। প্রসিদ্ধ ভরতবংশের দুই কুলবধূ পুত্রলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মর্যাদাও অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে যে পুত্রহীনা রমণীটি আপন দুর্ভাগ্য বহন করে স্বামী এবং সপত্নীর উদ্ভাসিত মুখ সদা-সর্বদা দেখে যাচ্ছিলেন, তিনি আর কেউ নন পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী। মাদ্রী অসাধারণ রূপবতী এবং যৌবনবতী। পুত্রলাভের ব্যাপারে তার নিজের কোনও দোষও নেই। এমন যদি হত যে, কুন্তীরও পুত্র নেই, তারও পুত্র নেই, তখন একই সু-সমতায় স্বামীর কাছে ধরা দিতেন তারা। কিন্তু কুন্তীর পুত্রলাভের পর থেকেই মাদ্রীর মনে একটি মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে, তার মনের মধ্যে জটিলতাও কিছু বেড়েছে।

সেদিন শতশৃঙ্গ পর্বতের এক বিজন স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাণ্ডু। কুন্তী তাঁর তিন পুত্রকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। কাছেপিঠে তপস্বী সজ্জনেরাও কেউ নেই। মাদ্রী আস্তে আস্তে পাণ্ডুর কাছে এগিয়ে এসে কিছু গোপন কথা বলার জন্য প্রস্তুত হলেন যেন–মদ্ররাজসুতা পাণ্ডুং রহো বচনমব্রবীৎ। মাদ্রী বললেন–তোমার পুত্র উৎপাদনের ক্ষমতা নেই, সে কথা আমি জানি এবং তাতে আমার দুঃখও নেই। কিন্তু আমি রাজকন্যা, আমার গর্ভধারণের যোগ্যতাও আছে, অবশ্য তাতেও আমি দুঃখ পাই না। ওদিকে গান্ধারীর শত পুত্র জন্মেছে, জেনেছি। তাতেও আমি এমন কিছু দুঃখ পাই না। কিন্তু তোমার বড় রানী কুন্তীর সঙ্গে আমার কিসের তফাত আছে? না রূপে, না গুণে। সব ব্যাপারেই আমরা সমান, কিন্তু সমান হওয়া সত্ত্বেও কুন্তীর পুত্র আছে, আমার নেই–এই দুঃখই আমাকে বিধে মারছে–ইদন্তু মে মহ দুঃখং তুল্যতায়ামপুত্রতা।

নিজের দুঃখ জানিয়ে এবার তার দুঃখের নিরসন কীভাবে হতে পারে, তারই উপায় বলছেন মাদ্রী। সেকালের দিনে সপত্নীর ব্যাপারে অনেক ধরনের জটিলতা ছিল। পুরুষের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই বহুবিবাহের চল থাকায় সপত্নীদের মধ্যে জটিলতাও ছিল অনেক। খোদ ঋগবেদে আমরা ইন্দ্রপত্নী পৌলমী শচীকে দেখেছি–স্বামীর চোখে সবসময় মধুরা থাকার জন্য অন্য সপত্নীদের ওপর তিনি প্রভুত্ব চেয়ে মন্ত্র পড়ছেন। যাতে তাঁর নিজের পুত্র-কন্যারা সপত্নী-গর্ভজাত সন্তানদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় এবং যাতে সপত্নীরা তার স্বামীকে আপন প্রভাবে প্রভাবিত করতে না পারে, সে জন্য পৌলমী শচী মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। পরিশেষে তার অভীষ্ট সিদ্ধি ঘটেছে এবং তখন তিনি সোচ্চারে বলছেন–আমি পেরেছি, পেরেছি, আমার সমস্ত সতীনদের আমি হটিয়ে দিতে পেরেছি, এখন আমার স্বামীর ওপরে এবং এই রাজ্যের ওপরেও আমি আমার একার প্রভুত্ব চালাতে পারব–

সমজৈষমিমা অহং সপত্নীরভিভূবরী।
 যথাহমস্য বিরাজানি জনস্য চ।

ঋগবেদ ছেড়ে অথর্ববেদে আসলে দেখবেন, সেখানে সতীন-কাঁটা তোলার জন্য মারণ-উচাটন সব কিছুরই ব্যবস্থা আছে। মহাভারতের যুগে সমাজ অনেক পরিশীলিত। এখানে কুন্তীর সঙ্গে মাদ্রীর সুসম্পর্ক আছে। একে অন্যের জন্য যথেষ্ট ভাবেন। কিন্তু ভাবনা-চিন্তা, যুক্তি-তর্ক আছে বলেই মানসিক জটিলতাও আছে। মাদ্রী কুন্তীকে সোজাসুজি তাঁর মনের বাসনা জানালে আরও সুফল ঘটত বলে মনে করি। কিন্তু বড় রানী হিসেবে কুন্তীর ওপরে মাদ্রীর যতই শ্রদ্ধা থাকুক, তিনি কুন্তীর কাছে কোনওভাবেই নত হবেন না। তিনি কুন্তীর সঙ্গে নিজের তুল্যতার হিসেব কষে স্বামীকে দিয়েই আপন ইষ্টসিদ্ধি ঘটাতে চান।

মাদ্রী বললেন–কুন্তী যদি আমাকে একবার গর্ভধারণের সুযোগ দেয়, তবে আমার প্রতিও তার যথেষ্ট অনুগ্রহ প্রকাশ করা হবে, আর তোমারও সেটা ভালই হবে। তোমার বংশ বাড়বে। কিন্তু হাজার হোক কুত্তী আমার সতীন, তাকে আমি নিজের মুখে এ কথা বলতে পারব না–সংস্তম্ভো মে সপত্নীত্ব বক্তং কুন্তিসুতাং প্রতি। তবে হ্যাঁ, আমার ওপর যদি তোমার কোনও ভালবাসা থাকে, তবে তুমি তাকে এ কথা জানাতে পার। কিন্তু আমি বলব না।

 পাণ্ডু মাদ্রীকে যথেষ্টই ভালবাসতেন, হয়তো কুন্তীর চেয়ে একটু বেশিই। ছোটবেলা থেকে নানান জটিলতার মধ্যে মানুষ হওয়ায় বিবাহিতা কুন্তীর মধ্যে যুবতীসুলভ চঞ্চল রমণীয়তার চেয়ে গৃহিণীসুলভ প্রবীণতা বেশি ছিল। এদিক দিয়ে ছোট রানী মাদ্রীর বিলাস-বৈদগ্ধ্য অনেক বেশি। তার বয়স কম, কিন্তু সরসতা বেশি। আর নিজের স্বামীর সঙ্গে সম্বন্ধে এই বিলাস-বৈদগ্ধীর সচেতনতাও তার যথেষ্ট। ফলে মাদ্রী তার প্রস্তাব পেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই পাণ্ডু তাকে বলেছেন–আমিও এই একই কথা ভাবছি, মাদ্রী! কিন্তু আমি তোমায় বলতে পারছি না। তুমি আবার আমার কথায় কী মনে কর না কর, সেই ভেবেই কিছু বলিনি, মাদ্রীন তু ত্বং প্রসহে ব ইষ্টানিষ্ট–বিবক্ষয়া। আমার ভাবনার সঙ্গে তোমার ভাবনা যখন মিলে গেছে, অতএব আমি এ বিষয়ে চেষ্টা করব। কেননা আমার ধারণা–আমি যদি কুন্তীকে বলি, তবে তিনি অবশ্যই রাজি হবেন।

পাণ্ডু অবশ্য সোজাসুজি কথাটা বলতে পারলেন না কুন্তীকে। আমরা যাকে ভণিত করা বলি, পাণ্ডু প্রথমে সেইরকম ভণিতা করা আরম্ভ করলেন। বললেন–তুমি আমার বংশের বিস্তার ঘটাও আর লোকের একটু উপকারও করো। তাছাড়া যশ, নাম, খ্যাতি বলে একটা জিনিস আছে না? এই যে দেখো দেবরাজ ইন্দ্র, তিনি তোত শত যজ্ঞ করে শতক্রতু হয়েছেন, কিন্তু তার পরেও তিনি যজ্ঞ করে গেছেন। কিসের জন্য? যশের জন্য–যজ্ঞেরিষ্টং যশোর্থিনা। এই যে দেখ, ব্রাহ্মণ ঋষি মুনিরা, তারা কত তপস্যা করেছেন, কত তত্ত্বজ্ঞান দান করেছেন, তবুও তারা আবারও গুরুর কাছে যান, গুরুসেবা করেন। কেন জান? যশের জন্য যশসোর্থায় ভাবিনি। আমি তাই বলছিলাম–তুমিও তোমার কীর্তি, যশ বৃদ্ধি করতে পারো। তুমি একজনের দুঃখ-সাগরের ভেলা হতে পারো। তুমি তো জানোনা মাত্রীর কোনও পুত্র নেই। তুমি তাকে একটি সন্তানের জননী করে তার অপার দুঃখ দূর করতে পারো; তাতে সকলে তোমার সুখ্যাতি করবে–সা ত্বং মাদ্রীং প্লবেনৈব তারয়ৈনাম্ অনিন্দিতে।

পাণ্ডুর কথা শুনে কুন্তী তাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন–তুমি যা বলেছ ধর্মশাস্ত্রের নিয়ম তাই বটে। তুমি নিশ্চিন্তে থাক, এই অনুগ্রহটুকু আমি মাদ্রীকে করব। কুন্তী মাদ্রীকে ডেকে দুর্বাসার বশীকরণ মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বললেন–তুমি একবার মাত্র যে কোনও দেবতাকে এই মন্ত্রে আহ্বান করতে পারোসকৃচ্চিন্তয় দৈবত। আর তাতেই তোমার উপযুক্ত পুত্র হবে।

মাদ্রী কুন্তীর ইঙ্গিতটুকু ঠিকই বুঝেছেন। তিনি ভাবলেন–স্বর্গভূমিতে যমজ দেবতা হলেন অশ্বিনীকুমার। তাদের একক কোনও সত্তা নেই। অতএব তাদের আহ্বান করলে একই আহ্বানে দুটি পুত্র হবে। যে ভাবনা সেই কাজ। মাদ্রীর দুই পুত্র জন্মাল। রূপে গুণে অতুলনীয়, কারণ অশ্বিনীকুমারদ্বয় নিজেরাও খুব রূপবান বলে দেবতামহলে পরিচিত। সব মিলিয়ে পাণ্ডুর পুত্রসংখ্যা দাঁড়াল পাঁচ।

তদানীন্তন সমাজের সংস্কার অনুযায়ী শতশৃঙ্গবাসী ঋষিরা পাণ্ডুর ছেলেদের নামকরণ করলেন। বয়সের অনুক্রমে সে নামগুলি যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল এবং সহদেব। পাণ্ডুর ছেলেদের বয়স যথেষ্টই কম, কিন্তু তাদের বাড়-বৃদ্ধি বেশ ভাল, দেখতে বেশ বড় বড় লাগে। পাঁচটি ছেলে যখন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, তখন পাণ্ডুর মনে হয় যেন পাঁচ দেবশিশু তার প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছে–দেবরূপান্ মহৌজসঃ। পর পর কয়েকটি দেবোপম পুত্র লাভ করে অপিচ এই পুত্রজন্মের মধ্যে তার সমস্ত সঙ্কোচ ঘুচে যাওয়ায় পাণ্ডুর মনের মধ্যে বোধহয় এক ধরনের বিকার কাজ করছিল। কিন্তু কুন্তীকে আবার অনুরোধ করলেন, যাতে মাদ্রী আরও দুয়েকটি পুত্র লাভ করতে পারেন।

কুন্তীর আর ধৈর্য রইল না। একেতেই তিনি মাদ্রীর ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়েই ছিলেন। কারণ তাঁর পুত্রলাভের ব্যাপারে কুন্তী যে সাহায্য করেছেন, সে সাহায্যের জন্য মাদ্রী নিজে কোনও অনুরোধ করেননি। রাজপত্নীর সমস্ত সচেতনতা বজায় রেখে, স্বামী-সোহাগিনীর সমস্ত অহমিকা বজায় রেখে স্বামীকে দিয়ে তিনি নিজের কাজ করিয়ে নিয়েছেন। কুম্ভী তাই ক্রুদ্ধ হয়েই ছিলেন। অতএব পাণ্ডু যেই না কুন্তীর কাছে মাদ্রীর বিষয়ে সামান্য প্রস্তাব করেছেন, অমনই ঝংকার দিয়ে কথা শোনালেন কুন্তী–আমি বলেছিলাম–একবার। একবারের জন্য তুই কোনও দেবতাকে আহ্বান কর, তুই পুত্রলাভ করবি। তা, সে কিনা আমাকে বঞ্চনা করে যমজ দেবতাকে ডেকে একেবারেই দুটি পুত্র লাভ করল–উক্ত সকৃদ দ্বধূমে লেভে তেনাশ্মি বঞ্চিত। ওর ওই কুবুদ্ধি দেখে সব সময়েই আমার মনে হয় ও আমাকে টেক্কা দিতে চাইছে আর ওর মতো দুষ্টা মহিলা এরকম করতেই পারে–কুস্ত্ৰীণাং গতিরীদৃশী।

 কুন্তী মাদ্রীর ব্যাপারে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছেন। সপত্নী হিসেবে মাদ্রীই এই জটিলতা তৈরি করেছেন কুন্তীর মধ্যে। কুন্তী বললেন–আমি মহা-বোকা বলেই বুঝতে পারিনি যে, জোড়া-দেবতাকে একবার ডাকলেও জোড়া ছেলে হবে–নাসিষমহং মূঢ়া দ্বন্দ্বাহ্বানে ফুলদ্বয়ম্। অতএব তুমি আমাকে আর একটুও অনুরোধ করো না এবং এই অনুরোধটুকু না করলেই আমি মনে করব–তুমি আমায় বরদান করেছ।

 পাণ্ডু বিরত হলেন। সত্যিই তো কুন্তী অনেক করেছেন এবং যা যা তিনি করেছেন সব পাণ্ডুর মত নিয়েই করেছেন। পুত্রহীনতার জন্য পাণ্ডুর যত দুঃখ ছিল, সে সব দুঃখ কুন্তী মুছে দিয়েছেন আপন ক্ষমতায়। অতএব পাঁচটি দেবোপম পুত্র নিয়েই তিনি পরম আনন্দে শতশৃঙ্গবাসী ঋষিদের সাহচর্যে দিন কাটাতে লাগলেন। পুত্রেরা বড় হতে লাগল।

এর পরে বেশ কিছুদিন গেছে। পাণ্ডু তবু হস্তিনাপুরে ফিরছেন না। এই না ফেরার কারণ কী, সে সম্বন্ধে মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে কিছু বলেননি। এমনকি ভরতবংশের গৌরবে পাঁচটি উপযুক্ত পুত্র লাভ করেও কেন তিনি হস্তিনায় ফিরছেন না, এটা খুব প্রাসঙ্গিক এবং সন্দেহ করার মতো প্রশ্ন। এতকাল রাজবাড়ি ছেড়ে এসে শতশৃঙ্গ পর্বতের আরণ্যক পরিবেশই তার খুব ভাল লেগে গেছে, অতএব রাজ্যে ফিরছেন না–এই যুক্তি মোটেই আদরণীয় নয়। আমাদের ধারণা–ধৃতরাষ্ট্র চক্ষুহীনতার জন্য রাজা হতে না পেরে যে গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন, এ কথা পাণ্ডু ভালই জানতেন। তিনি এটাও জানতেন–ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যশাসন করতে খুব ভালবাসেন। পাণ্ডু তার হাতে রাজ্যভার ছেড়ে দিয়ে এলে তিনি অসীম মমতায় রাজ্য রক্ষা করছিলেন, তাই শুধু নয়, এই রাজ্য চালানোর অধিকার এবং ক্ষমতাটুকু তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন।

সিংহাসন-লিপ্সু এই প্রার্থীর উপভোগে পাণ্ডু বাধা দিতে চাননি, বিশেষত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মনে এই ব্যাপারে দুঃখ আছে বলেই তিনি নির্লিপ্ত মনে বসেছিলেন শতশৃঙ্গের শান্ত আশ্রয়ে। এমনকি তার পাঁচটি পুত্রই যেহেতু গার্হস্থ নিয়মে জন্মায়নি, অতএব তার পুত্রগুলিকে পরিচয়। করিয়ে দেবারও একটা দায়িত্ব ছিল পাণ্ডুর। কিন্তু কেন জানি না, ক্ষোভেই হোক, করুণাতেই হোক অথবা মমতায়, পাণ্ডু ফিরে গেলেন না হস্তিনাপুরে।

এইভাবে দিন চলতে চলতে শতশৃঙ্গ পর্বতে বসন্তকাল এল। সমস্ত পাহাড় যেন ফুলে ভরে উঠল। পলাশ ফুল, তিল ফুল, চম্পক আর স্থলপদ্মের হাসিতে, কোকিলের কুহুতে। মধুকরের মন্ত্র-গুঞ্জরনে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হল, যাতে সমস্ত প্রাণীর মনের মধ্যে ভর করল। সম্মোহনের আবেশ–ভূতসম্মোহনে কালে কদাচিন্মধুমাধবে। শতশৃঙ্গবাসী পাণ্ডুও এই সম্মোহন এড়াতে পারেননি। তিনি তাঁর প্রিয়া পত্নীর সঙ্গে এ বনে সে বনে ঘুরে বেড়িয়ে বসন্তের শোভা দেখতে লাগলেন। কিন্তু নির্জন স্থানে যৌবনবতী রমণীর সাহচর্য লাভ করলে বাসন্তিক আবেশের সঙ্গে দেহাবেশও কিছু ঘটে। পাণ্ডুরও তা ঘটল–পাণ্ডো–বর্নং তৎ সম্প্রেক্ষ্য প্রজজ্ঞে হৃদি মন্মথঃ।

পাণ্ডু তার পত্নীর সঙ্গেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বটে, কিন্তু সে পত্নী কুন্তী নন। তিনি মাদ্রী। পাণ্ডুকে একা একা ঘুরতে দেখে তিনিই তার বসন্ত-ভ্রমণের সহচরী হয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও দোষ ছিল না। মাদ্রী যৌবনবতী, কুন্তীর মতো তিনি গিন্নি-বান্নি নন। পাণ্ডুর কাছে তিনি এসেছেন বসন্তের আভরণে সজ্জিত হয়ে। তার গায়ের সুসূক্ষ্ম পরিধান ফুটাস্ফুট ব্যঞ্জনায় তার বয়স এবং যৌবন দুটোই প্রকাশিত করছিল। পাণ্ডু তাকে দেখে ধৈর্য রাখতে পারলেন নান শোক নিয়ন্তং তং কামং কামবলার্দিতঃ। কামনার বশীভূত হয়ে শূন্য বিজন বনচ্ছায়ায় মাদ্রীকে জড়িয়ে ধরলেন পাণ্ডু।

মৃগমুনির মরণান্তক অভিশাপের কথা তার একটুও মনে পড়ল না–তং শাপং নাম্ববুধ্যত। এই মুহূর্তে তিনি মাদ্রীর শরীর ছাড়া আর কিছু স্মরণ করতে পারলেন না। মাদ্রী অনেক বাধা দিলেন, অনেক অনুনয় করলেন; কিন্তু রাজার গায়ে তখন পশুশক্তি ভর করেছে। তিনি কোনও বাধা মানলেন না। আপন শক্তিতে তিনি মাদ্রীকে বশীভূত করলেন–বাৰ্যমানস্তয়া দেব্যা…সোন্বগচ্ছদ বলাদিব। মৃগমুনির অভিশাপ ছিল–মৈথুনে লিপ্ত হলেই পাণ্ডুর মৃত্যু হবে। সেই মৃত্যুর জন্যই যেন তিনি কামনার বশীভূত হলেন। রাজার ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি এবং বিবেক সব কিছু আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মাদ্রীর সঙ্গে মৈথুনে লিপ্ত হবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হলেন।

মৃগমুনির শাপের অন্তরে মহাভারতের কবির কী অভিপ্রায় লুকানো ছিল জানি না, তবে কবিত্বের সারমর্ম এই বুঝি–স্ত্রী-সহবাস রাজার বারণ ছিল। তাঁর মৃত্যু স্ত্রী-সহবাসের অব্যবহিত পরে সংঘটিত হওয়াতেই অভিশাপের অবতারণা করা হয়েছে হয়তো, এবং এই মৃত্যুকে বরণ করা হয়েছে জেনেশুনে।

 মাদ্রী এখন খুবই বিস্রস্ত অবস্থায় আছেন। বসন্তের আভরণের সঙ্গে পাণ্ডুর মৈথুন-পূরাক্রম মিশ্রিত হওয়ায় তার পরিধেয় বাস এখন বিপর্যস্ত। রাজার আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি এখন কী করবেন কিছুই বুঝতে না পেরে শুধু কুন্তীর উদ্দেশে চিৎকার করতে লাগলেন। কুন্তী তার পাঁচ পুত্রকে নিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাদ্রীর করুণ চিৎকার শুনে তিনি তার কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হলে মাদ্রী নিজেই নিজের বিস্রস্ত অবস্থা বুঝে কুন্তীকে বললেন–তুমি একা একবার এখানে এসো দিদি, ছেলেরা ওখানেই থাক–একৈব ত্বমিহাগচ্ছ তিষ্ঠত্রৈব দারকাঃ।

কুন্তী অজানা ভয়ে বালকদের এক জায়গায় রেখে নিজে এলেন মাদ্রীর কাছে। রাজাকে দেখে তার বুক কেঁপে উঠল। রাজা মৃত, ভূতলশায়িত। তার পাশে বিস্ৰস্তবাসে মাদ্রী। রাজাকে তদবস্থায় দেখে কুন্তীর যত না দুঃখ হল, তার চেয়েও বেশি রাগ হল মাদ্রীর ওপর। মাদ্রীর উদ্দেশে তিনি চেঁচিয়ে উঠে বললেন–সদাসর্বদা আমি রাজাকে রক্ষা করে চলতাম, যাতে স্ত্রী-মৈথুনে তার প্রবৃত্তিই না হয়। তিনি নিজেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন–রক্ষ্যমানো ময়া নিত্যং বনে সততমাত্মবান্। কিন্তু কেমন করে তারপরও এই ঘটনা ঘটল? কেন এবং কেমন করে হঠাৎ তিনি এইভাবে তোর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন–কথং ত্বম্ অভ্যতিক্রান্ত? মৃগমুনির অভিশাপের কথাও কি কিছুই মনে ছিল না। যেখানে তোরই উচিত ছিল রাজাকে বাঁচিয়ে চলা, সেখানে কেন এইভাবে তুই একা নির্জনে এসে রাজাকে ভোলালি–সা কথং লোভিবতী বিজনে ত্বং নরাধিপ? রাজাকে তো আমিও দেখেছি নাকি? শাপের কথা মনে করে বারবার তিনি দুঃখ করতেন আমার কাছে। আমি আমল দিতাম না। কিন্তু আজ কী এমন ঘটল যে, সব দুঃখ ভুলে গিয়ে তাঁর এত আনন্দের কারণ ঘটল? এত আনন্দ কি তোকে দেখে?

কুন্তী অনেক বকাবকি করলেন মাদ্রীকে কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার চেতনা হল যে, যিনি গেছেন, তিনি আর ফিরবেন না। দুঃখে কষ্টে তার হৃদয় মথিত হল। বুঝলেন যে, এখানে মাদ্রীর যত দোষ, রাজারও ঠিক ততটাই। করুণাঘন স্বরে তখন তিনি মাদ্রীর হাত ধরে বললেন–তবু তোর কত ভাগ্য বোন। তুই তাঁর সানন্দচিত্ত পরিহৃষ্ট মুখখানি শেষবারের মতো দেখেছিস–দৃষ্টবত্যসি যদবং প্রহৃষ্টস্য মহীপতেঃ। আমি তো তাও দেখিনি। মাদ্রী এতক্ষণে একটু সাহস পেলেন। বললেন–দিদি! আমি বহুবার তাকে বারণ করেছি, কিন্তু তিনি বাধা মানেননি। শোনেননি আমার কথা–আত্মা ন বারিতোনেন সত্যং দিষ্টং চিকীর্ষণ।

কুন্তী মাদ্রীর কথা বুঝলেন। তারপর তাকে বুঝিয়ে বললেন–যাক, যা হবার তা হয়েই গেছে। কিন্তু আমি তার জ্যেষ্ঠা ধর্মপত্নী। অন্তত ধর্মের ফল তো আমারই প্রাপ্য। কাজেই আমাকে যেন তুই সহমরণে যাবার পথ থেকে নিবৃত্ত করিস না–অহং জ্যেষ্ঠা ধর্মপত্নী জ্যেষ্ঠং ধর্মফলং মম।

কথাটার মধ্যে সামান্য একটু কথা আছে। আসলে যাঁকে প্রথম বিবাহ করা হত, সেই রমণী পুত্রবতী হলে, সেই রমণী এবং পুত্রের মাধ্যমে ধর্মফল লাভ করতেন বলে মনে করতেন আগেকার মানুষ। সেই জন্যই মাদ্রীর প্রতি কুন্তীর এই কুটিল ইঙ্গিতটুকু আছে। ভাবটা এই আমি রাজার ধর্মবাসনা পূরণ করেছি, আর তুই তার কামনা পূরণ করেছিস। এখন তুই আমার মৃত স্বামীকে রেখে উঠে আয়। আমাদের ছেলেগুলিকে মানুষ করার দায়িত্ব নে–উত্তিষ্ঠ ত্বং বিস্জ্যৈনমিমা পালয় দারকা।

মাদ্রী সানুনয়ে কেঁদে বললেন–আমার এই যৌবন এই বয়স। রাজার সঙ্গে কাম উপভোগ করে মোটেই আমার তৃপ্তি শেষ হয়ে যায়নি। এই আমার স্বামী আমার সঙ্গে মিলিত হতে গিয়েই মারা গেলেন। আমার ইচ্ছে, আমি অন্তত পরলোকে গিয়েও তার বাসনা পূরণ করব–তমুচ্ছিন্দ্যামস্য কামং কথং ন যমসাদনে। আরও একটা কথা এবং এর চেয়ে বড় সত্যি আর নেই। আমি তোমার ছেলেদের সঙ্গে নিজের ছেলের মতো ব্যবহার হয়তো করতে পারব na। হয়তো কেন পারবই না–ন চাপ্যহং বর্তয়ন্তী নির্বিশেষং সুতেষু তে। কিন্তু তোমাকে দেখেই বুঝি–আমার পুত্রদের প্রতি তুমি নিজের পুত্রের মতোই ব্যবহার করতে পারবে। অতএব সেই জন্যই তুমি আমাকে সহমরণে যাবার অনুমতি দাও–জ্যেষ্ঠে মাম্ অনুমন্যতা।

.

৯৩.

 মরণকালে মানুষ যা চায়, পরলোকে তাই পায় বলে মানুষের একটা সংস্কার ছিল। মহারাজ পাণ্ডু যেহেতু রমণকালেই মৃত্যুমুখে পতিত হলেন তাই মাদ্রী ভেবেছিলেন–তিনি অনুমৃতা হলে পাণ্ডু মাদ্রীর মাধ্যমেই সেই সুখাভিলাষ পূরণ করতে পারবেন–মাং হি কাময়মানোয়ং রাজা প্রেতবশং গতঃ। মাদ্রী কুন্তীকে আবারও অনুনয় করে বললেন–তুমি আমার ছেলে দুটিকে নিজের ছেলের মতো মানুষ কোরো। আর আমার শরীরটিকে রাজার মৃত-শরীরের একত্র আবৃত করে দাহ কোরো। আমার এই আর্জিটা যদি রাখো, তবে বুঝব তুমি আমার প্রিয় কাজটিই করেছ–দগ্ধব্যং সুপ্রতিচ্ছন্নমতদর্থে প্রিয়ং কুরু। তুমি চিরকালই আমার ভাল চেয়েছ, কাজেই এবারও তুমি তাই করবে, দিদি।

মাদ্রী সহমরণে গেলেন মানে, তিনি স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিলেন, তা নয় কিন্তু। মাদ্রী যোগবলে আপন মৃত্যুবরণ করলেন। সেকালের দিনে মুনি-ঋষি থেকে আরম্ভ করে রাজা এবং অন্যান্য মহাসত্ত্ব ব্যক্তিরাই যোগ-সাধনা জানতেন। যোগ-সাধনার দ্বারা প্রাণবায়ু নিরোধ করার কৌশল যাঁরা জানতেন, তাদের মরণ ছিল অনায়াম। মাদ্রী সেই যোগজ মৃত্যু ঘটালেন নিজের।

অল্প ব্যবধানে মহারাজ পাণ্ডু এবং তার প্রিয়া পত্নী মাদ্রীর মৃত্যুর পর শতশৃঙ্গবাসী মুনি-ঋষিদের মধ্যে এক প্রস্থ আলোচনা হল। তপস্বীরা বললেন–মহাত্মা পাণ্ডু রাজ্য এবং রাজত্ব ত্যাগ করে এই জায়গায় এসে তপস্যা করেছিলেন এবং আমরা তপস্বীরাই ছিলাম তার পরম আশ্রয়। তিনি তার শিশু পুত্রদের এবং জ্যেষ্ঠা মহিষী কুন্তীকে আমাদের কাছেই গচ্ছিত রেখে স্বর্গে গেছেন–প্রদায়োপনিধিং রাজা পাণ্ডুঃ স্বর্গমিতো গতঃ। এই অবস্থায় আমাদের একটা কর্তব্য আছে। রাজার মৃত শরীর, তাঁর স্ত্রীর শব-দেহ এবং তার জীবিত পুত্র-পরিবারবর্গকে নিয়ে আমাদের উচিত হস্তিনাপুরে যাওয়া। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত কাজ হবে।

ঋষি-মুনি-তপস্বীরা পরস্পর আলোচনা করে রাজা-রানীর শব-দেহ এবং সপুত্ৰক কুন্তীকে নিয়ে রওনা দিলেন হস্তিনাপুরের পথে। স্বামী এবং ছোট সতীন মারা গেছেন বলে কুন্তীর মনে দুঃখ কিছু কম ছিল না, কিন্তু এতদিন পরে তিনি হস্তিনাপুরে যাচ্ছেন, পুরাতন আত্মীয়-স্বজন সবার সঙ্গে দেখা হবে–এসব ভেবে তার কিছু আনন্দও হচ্ছিল। বস্তুত প্রিয়জনের বিয়োগ ঘটলে মানুষ স্বজনকেই কাছে পেতে চায়। স্বজনের কাছে শোক প্রকাশ করতে পারলে প্রাণে কিছু শান্তি আসে। সে জন্যও বটে, আবার হস্তিনাপুরের সকলের সঙ্গে এতদিন পর দেখা হবে, সে জন্যও কুন্তীর মনে কিছু সুখ আছে। সকলের সঙ্গে দেখা হবার ঔৎসুক্যেই শতশৃঙ্গ থেকে হস্তিনাপুরের দীর্ঘ পথ কুন্তীর কাছে অনেক সংক্ষিপ্ত মনে হল–প্রপন্না দীর্ঘমধ্বানং সংক্ষিপ্তং তদমন্যত।

মনস্বিনী কুন্তী ঋষিদের তত্ত্বাবধানে কুরু-রাজধানীর বিশাল দ্বারদেশে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে যুধিষ্ঠির। তার বয়স তখন ষোলো। পনেরো বছরের ভীম এবং অর্জুনের বয়স চোদ্দো এবং নকুল-সহদেবের বয়স তেরো। পাঁচ ছেলেকে পাশে নিয়ে কুন্তী যখন রাজদ্বারে এসে পৌঁছলেন, তখন ঋষিরা দ্বাররক্ষীকে বললেন–রাজাকে জানাও আমরা তাঁর দর্শনপ্রার্থী দ্বারিনং তাপসা ঊচু রাজানঞ্চ প্রকাশয়।

দ্বাররক্ষীরা যখন হস্তিনাপুরের কার্যনির্বাহী রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে মুনিদের আগমন নিবেদন করল, তখন সবেমাত্র সকাল হয়েছে–মুহূর্তোদিত আদিত্যে। সঙ্গে সঙ্গে খবর ছড়িয়ে পড়ল রাজধানীর সর্বত্র। সমস্ত দিক থেকে কুরুদেশবাসী মানুষ ছুটে আসতে লাগলেন। অভিজাত সম্প্রদায় যানবাহনে চড়ে আসতে লাগলেন, নিম্নস্তরের মানুষ এলেন পায়ে হেঁটে। তপস্বীরা কুরুদেশের রানী এবং পাঁচটি ছেলেকে নিয়ে রাজদ্বারে প্রতীক্ষা করছেন–এই খবর এক অদ্ভুত কৌতূহল সৃষ্টি করল জনপদবাসীর মনে। অল্প সময়ের মধ্যেই রাজবাড়িতে ভিড় জমে গেল–মহান্ ব্যতিকরো ভবৎ।

বাইরে ঋষি-মুনিরা দাঁড়িয়ে আছেন শুনে কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম এবং মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়-বিদুরকে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়ির বাইরে এলেন অভিবাদন জানাতে। ওদিকে বৃদ্ধা রানী সত্যবতী, অম্বিকা-অম্বালিকা এবং গান্ধারীও বেরিয়ে এলেন অন্তঃপুরের মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে।

এগুলো হল সেকালের দিনের প্রোটোকল। ঋষি মুনিরা এলে এইরকম ঠাটে-বাটেই তাদের অভিনন্দন জানাতে হবে। সঙ্গে থাকতে হবে রাজবাড়ির পুরোহিতকেও। কৌরব-কুলের প্রধান পুরুষেরা সপুরোহিত রাজদ্বারে এসে অভিবাদন জানিয়ে সেইখানেই বসে পড়লেন। তাঁদের দেখাদেখি পৌ-জনপদবাসীরাও সকলেই বসে পড়লেন মাটিতে। কুন্তীর সঙ্গে যে মুনি-ঋষিরা এসেছিলেন, তারা রাজবাড়ির ভিতরে ঢুকতে চান না বোধহয়। তারা কুন্তীর কথা বলতে এসেছেন বটে, কিন্তু মহারাজ পাণ্ডুর অবর্তমানে যে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে এই রাজবাড়িতে যদি কুন্তী এবং তাঁর পুত্রদের জায়গা না হয়, তাহলে মুনি-ঋষিরাই তার আবাসনের ব্যবস্থা করবেন–এইরকম একটা ধারণা থেকেই তারা রাজবাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেননি হয়তো।

যাই হোক, পাণ্ডুর জ্যৈষ্ঠা পত্নী ফিরে এসেছেন, অথচ তার সঙ্গে পাণ্ডু নেই, তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী মাদ্রী নেই অথচ এঁদের সঙ্গে কতগুলি পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে–এত সব দেখে পৌর-জনপদবাসীদের আলাপ, সংশয় এবং বিচিত্র সিদ্ধান্তের অন্ত রইল না। কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম এবার হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন তিনি কিছু বলতে চান। নিমেষের মধ্যে জনতার মুখ স্তব্ধ হল। ভীষ্ম মুনি-ঋষিদের পায়ে পাদ্য-অর্ঘ্য নিবেদন যথানিয়মে অভিবাদন শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই জটাধারী এক বৃদ্ধ মুনি ভীষ্মকে উদ্দেশ্য করেই বলতে আরম্ভ করলেন–আপনাদের কুরুরাজ্যের উত্তরাধিকারী মহারাজ পাণ্ডু স্বেচ্ছায় তার রাজসুখ ত্যাগ করে আমাদের নিবাস শতশৃঙ্গ পর্বতে গিয়েছিলেন। সেখানে অলৌকিক উপায়ে ধর্মদেবের কাছ থেকে এই জ্যেষ্ঠ পুত্র লাভ করেছেন। এঁর নাম যুধিষ্ঠির–সাক্ষাদ্ধৰ্মাদয়ং পুত্ৰস্তত্র জাতত যুধিষ্ঠিরঃ।

বৃদ্ধ ঋষি একে একে ভীম, অর্জুন এবং মাদ্রীর দুই পুত্রকেও পরিচয় করিয়ে দিলেন ভীষ্ম এবং অন্যান্যদের সঙ্গে। পাণ্ডু যে বহুকাল অপুত্রক ছিলেন এবং সে জন্য হস্তিনা-নিবাসী রাজ-পরিবারের সংশয় জন্মাতে পারে ভেবেই বৃদ্ধ ঋষি তদানীন্তন সংস্কারের কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন–মহারাজ পাণ্ডু বনে থেকেও পৈতৃক বংশ স্থাপন করে গেছেন–এষ পৈতামহো বংশঃ পাণ্ডুনা পুনরুদ্ধৃতঃ। তাছাড়া পুত্রেরা যথেষ্ট গুণবান, আপনারা তাদের দেখে খুশি হবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যথেষ্ট সৎপথে থেকেও এতগুলি গুণবান পুত্র লাভ করেও আজ থেকে ঠিক সতেরো দিন আগে পাণ্ডু পরলোক গমন করেছেন–পিতৃলোকং গতঃ পাণ্ডুরিতঃ সপ্তদশেহনি। পাণ্ডুর মৃত্যু দেখে তাঁর সহধর্মচারিণী মাদ্রী-দেবীও স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হয়ে পতিলোক গমন করেছেন। এই দুটি তাদের শব-দেহ আর এই তাঁদের পাঁচটি পুত্র। যাঁরা বেঁচে আছেন–অর্থাৎ এই কুন্তী এবং পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র–আপনারা তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন বলে আশা করি–ক্রিয়াভিরনুগৃহ্যাং সহ মাত্রা পরন্তপাঃ।

মুনিদের অভিপ্রেত ছিল–পাণ্ডুর প্রথম পত্নী এবং তাঁর পুত্রেরা যাতে হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে পুনর্বাসিত হন। সেই কাজের কথাটুকু শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তারা চলে গেছেন। যাতে প্রতিবাদ বা সংশয়ের সুযোগই না আসে, সেই কারণেই তড়িঘড়ি চলে গেলেন মুনিরা–ক্ষণেনান্তৰ্হিতাঃ সর্বে তাপসাঃ গুহ্যকেঃ সহ।

হস্তিনাপুরের কার্যনির্বাহী রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ঘাড়েই সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল। তিনি ছোট ভাই বিদুরকে ডেকে বললেন–মহারাজ পাণ্ডু এবং তার স্ত্রীর সকারের ব্যবস্থা করো রাজকীয় মর্যাদায়। রাজা এবং রানীর অনন্তকাল স্বর্গবাসের জন্য দান-ধ্যানের ব্যবস্থা করো। পণ্ড, বস্ত্র, স্বর্ণ–যে যা চায় তাই দাও। পাণ্ডু এবং মাদ্রীর দেহ একত্রে আবৃত করে দাহের ব্যবস্থা করো, যাতে বায়ু এবং সূর্যও মাদ্রীর দেহটি দেখতে না পান–যথা চ বায়ু-নাদিত্যঃ পশ্যেতাং তাং সুসংবৃতাম্।

এই প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলে নেওয়া ভাল। প্রথম কথা হল–সতেরো দিন আগে পাণ্ডু এবং মাদ্রী মারা গেছেন এবং তাদের দেহদুটি যথাসম্ভব অবিকৃত অবস্থায় হস্তিনাপুরে যেভাবে নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে, মহাভারতের প্রাচীনেরা তেমন কিছু প্রলেপন-অনুলেপনের কথা জানতেন যাতে মৃতদেহ অন্তত কিছুদিন অবিকৃত থাকে। দ্বিতীয়ত মাত্রা যে পাণ্ডুর সঙ্গে সহমৃতা হলেন, এটাতে যেন কখনই সতী-প্রথার কথা স্মরণে না আসে। মাদ্রীকে কেউ স্বামার চিতায় আরোহণ করতে বলেননি, তিনি নিজেও স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দেননি। স্ব-সহবাসে স্বামীর মৃত্যু ঘটায় তার মনে যে অনুতাপ জন্মেছিল, তাতে তিনি স্বেচ্ছায় আপন সহজাত সংস্কারে যোগজ মৃত্যু বরণ করেছিলেন। এর সঙ্গে সতীদাহ প্রথার কোনও সম্বন্ধ নেই। তৃতীয়ত ধৃতরাষ্ট্র যে মাদ্রীকে অসূর্যম্পশ্যা অবস্থায় দাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে এটা মনে করার কারণ নেই যে, তিনি পর্দা-প্রথা পছন্দ করতেন। মহাভারতের রমণীরা অনেক বিষয়েই খুব স্বাধীন ছিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের এই আদেশও মাদ্রীর স্বাধীন ইচ্ছার মূল্যই সূচনা করে।

যাইহোক, ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ অনুসারে বিদুর পাণ্ডুর সৎকারের বিধি-ব্যবস্থায় মন দিলেন। রাজপুরোহিতরা ঘৃতপূর অগ্নিপাত্র নিয়ে নগরের বাইরে গেলেন। পাণ্ডুর জ্ঞাতি, বন্ধু এবং অমাত্যরা পাণ্ডু এবং মাদ্রীকে একটি শিবিকায় স্থাপন করে বস্ত্রের দ্বারা তাদের মৃতদেহ আবৃত করলেন। সময়োপযুক্ত রাশি রাশি ফুল-মালা, গন্ধ সেই আবৃত শরীর দুটিকে মৃত্যুর সহনীয়তা প্রদান করল–তাং তথা শোভিতাং মাল্যৈবাসোভিশ্চ মহাধনৈঃ। পৌর-জনপদবাসীরা কেউ শব-শরীরের ওপর ছাতা ধরে রইল, কেউ চামর দোলাতে লাগল, অনেকে এই রাজকীয় শবযাত্রায় বাদ্যধ্বনি করতে করতে এগিয়ে চলল। প্রিয় রাজার মৃত্যুতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সকলেই শোক-সন্তপ্ত হয়ে মৃতদেহের পিছন পিছন চলল।

এরপর গঙ্গার তীরে একটি বনের মধ্যে যথাসম্ভব সমতল ভূমির ওপর শবদেহবাহী শিবিকাটিকে রাখলেন পঞ্চপাণ্ডব ভীষ্ম এবং বিদুর। তারপর দাহকার্যের প্রক্রিয়ায় একবার শবদেহ-দুটি অগুরু-চন্দনে লেপন করানো হল, একবার স্বর্ণকুম্ভের জলে স্নান করানো হল, আবার পুন্নাগ ফুলের নির্যাস মাখিয়ে সাদা কাপড় দিয়ে তাদের মুড়ে দেওয়া হল। সেই সময় পাণ্ডুকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। মাদ্রী তেমনি আবৃতা অবস্থায় পুষ্পে গন্ধে মাল্য সুশোভনা হয়েই আছেন। এবার পুরোহিতদের অনুমতি নিয়ে সুগন্ধী চন্দন কাঠ, স্থলপদ্মের কাঠ এবং আরও সব সুগন্ধী কাঠ দিয়ে পাণ্ডু এবং মাদ্রীর দাহকার্য সম্পন্ন করা হল।

পঞ্চপাণ্ডব, ভীষ্ম, বিদুর এঁরা সব আগে থেকেই কাঁদছিলেন। কিন্তু পাণ্ডুর দেহটি ভস্মীভূত হবার পর পাণ্ডুর স্নেহময়ী জননী অম্বালিকা মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়লেন। যে শরীর তিনি গর্ভে ধারণ করেছিলেন, যে শরীরকে তিনি স্নেহ-মমতায় বড় করেছেন, সেই শরীরের এতটুকু অবশেষও রইল না। অম্বালিকা মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। ওদিকে পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠা মহিষী কুন্তীকে আর বাগ মানানো যাচ্ছিল না। তার করুণ আর্তনাদে গঙ্গার তীরভূমি, বন-বনান্তের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। পৌর-জনপদবাসীরা তার দুঃখে সমদুঃখিত হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন–কুন্ত্যাশ্চৈবার্তনাদেন সর্বাণি চ বিচুশুঃ। কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র এবং কুরুকুলের বিধবা রমণীরা পঞ্চ পাণ্ডব এবং কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে পুণ্যবাহিনী গঙ্গায় স্নান-তর্পণ করলেন।

গঙ্গার তীরে একটি অস্থায়ী আবাস নির্মিত হল। সেখানে কুরুবংশীয় জ্ঞাতি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মাটিতে শুলেন। পৌর-জনপদবাসীরাও রাজভক্তিতে পাণ্ডব এবং অন্যান্য কুরুবীরদের সঙ্গে বারোদিন সমস্ত আমোদ ত্যাগ করে একই অশৌচব্রত পালন করলেন। তেরো দিনের দিন পাণ্ডু এবং মাদ্রীর শ্রাদ্ধ-কার্য, দান-ধ্যান এবং মহাগুরু নিপাতের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল।

এই ঘটনার পর আমরা পাণ্ডবদের হস্তিনায় ফিরে আসতে দেখছি। কিন্তু ভারি আশ্চর্য, পিতৃহীন পঞ্চপাণ্ডবদের সহযাত্রী হিসেবে এখানে ধৃতরাষ্ট্র বা অন্য কোনও মহান কুরুবংশীয়দের কথা একবারও উল্লেখ করলেন না মহাভারতের কবি। আমরা দেখছি–পাণ্ডবদের অশৌচান্তে হস্তিনাপুরের পুরবাসীরাই পাণ্ডবদের সঙ্গে নিয়ে হস্তিনায় ফিরছে–পাণ্ডবান ভরতভা। আদায় বিবিশুঃ সর্বে পুরং জানপদস্তুদা। এই একটি মাত্র পংক্তিতেই মহাভারতের কবি বুঝিয়ে দিলেন, হস্তিনাপুরের কার্যনির্বাহী রাজশক্তি নয় পাণ্ডবদের পিছনে রইল মানুষের শক্তি। তাদের শক্তিই তাদের মৃত রাজার পুত্রদের পুনর্বাসন ঘটাবে।

পাণ্ডুর মৃত্যুর পর পৌর-জনপদবাসীদের মনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। হস্তিনায় ফিরেও তারা পাণ্ডুর জন্য কান্নাকাটি করছে, যেন এই মুহূর্তে তাদেরও স্বজন-বিয়োগ উপস্থিত হয়েছে। হস্তিনার রাজবাড়িতে এ এক ভয়ঙ্কর সন্ধিলগ্ন। পাণ্ডু মারা গেছেন, তার জ্যেষ্ঠা পত্নী কুন্তী পিতৃহীন পঞ্চপুত্রের হাত ধরে রাজধানীতে পৌঁছেছেন রাজকীয় পুনর্বাসনের আশায়, কিন্তু রাজধানীতে ফিরেও পঞ্চ পাণ্ডব এবং জননী কুন্তী বোধহয় তাদের পূর্বমর্যাদা ফিরে পাননি। মহাভারতের কবিও এ সম্বন্ধে স্পষ্টত কিছুই লেখেননি, কিন্তু এই করুণ সন্ধিলগ্নে, এক সাংঘাতিক ক্রাইসিসের মুহূর্তে তাকে আমরা স্বয়ং উপস্থিত হতে দেখছি।

 মনে রাখতে হবে, কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন ব্যাস শুধু মহাভারতের কবি নন, তিনি পাণ্ডব-কৌরবদের পিতামহ। ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর জন্মদাতা পিতা তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি স্থিতধী মুনি হলেও তিনিও মানুষ। আজীবন তপশ্চর্যার ফলে দুঃখ-সুখ, লাভ-অলাভ ইত্যাদি দ্বন্দ্ব তাকে দুঃখিতও করে না, সুখিতও করে না। কিন্তু তিনি যেহেতু একই সঙ্গে মহাভারতের কবি এবং সর্বোপরি এক মানুষ, তাই একটি মানুষের শূন্যতা তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দ্বীপজন্মা হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনও নির্জনে দ্বীপের মতো নন। সমস্ত মানুষের মধ্যে তাঁর কবিসত্তা জড়িয়ে আছে। তাই আজকে তার মহাকাব্যের অন্যতম এক নায়কের যখন মৃত্যু হল, তখন তিনি শুধু তার পুত্র বলেই নয়, একটি মনুষ্যের মৃত্যু হল বলেই তার কবির অন্তরে এক অতি অদ্ভুত কষ্টবোধ হয়েছে। অন্য কবির ভাষায়–any mans death diminishes me, because I am involved in mankind.

মহাভারতের ভারত-সত্তা যেহেতু ব্যাসের অন্তরে বিরাজিত, তাই আজ এই করুণ মুহূর্তে তিনি হস্তিনাপুরে উপস্থিত হয়েছেন। সেই দিনটির কথা তার আজও মনে পড়ে? যেদিন তার বীভৎস অসুন্দর রমণেচ্ছু মূর্তি দেখে অম্বালিকা ম্লান পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। তার সেই অঙ্গজাত পুত্র মারা গেছেন অকালে। নিজের আত্মজ্ঞান এবং যোগোপলব্ধির দ্বারা সেই পুত্রশোক দমন করেছেন ব্যাস, কিন্তু একান্ত মানুষোচিত এবং কবিজনোচিত বেদনাবোধ ত্যাগ করতে পারেননি বলেই আজকে তিনি রাজপুরীতে উপস্থিত হয়েছেন তৃতীয় ব্যক্তির মতো।

তারই অঙ্গজাত প্রথম পুত্র ধৃতরাষ্ট্র এখন হস্তিনাপুরের কার্যনির্বাহী রাজা। পাণ্ডুর মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীর কী গতি হবে, তার পঞ্চ পুত্র এই রাজ্যে কী মর্যাদায় থাকবে–এসব কূট প্রশ্নের মধ্যে তিনি যাননি অথবা এসব প্রশ্নের সমাধানও তিনি চাননি। ধৃতরাষ্ট্রের প্রশাসনে একবারও তিনি মাথা গলাননি। কিন্তু পূর্বাপর সমস্ত ঘটনার ওপর তার সজাগ দৃষ্টি আছে। দীর্ঘ পনেরো-কুড়ি বছর পাণ্ডু হস্তিনাপুরের রাজত্ব ছেড়ে শতশৃঙ্গবাসী হয়েছেন, কেন তিনি গেলেন, কেন তিনি ফেরেননি অথবা কেনই বা তাকে ফেরানো হয়নি–এসব প্রশ্ন তিনি করেননি। করেননি, কেননা, তিনি যতখানি ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর জন্মদাতা পিতা, তার থেকেও বেশি তিনি ঋষি, তার থেকেও বেশি তিনি কবি।

এক ঋষি-কবি যখন আপন বংশজের মৃত্যুর পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন, তখন ওই সব রাজনৈতিক কূটের মধ্যে না গিয়ে তিনি ইঙ্গিতে কথা বলেন। সবচেয়ে বড়ো কথা–এই হস্তিনাপুরে তার জন্মদাত্রী মা রয়ে গেছেন, এবং তিনি যথেষ্ট ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। যে সব প্রশ্ন তিনি করেননি, সে সব প্রশ্ন যে কোনও মুহূর্তে তার মুখ দিয়ে বেরতে পারে। জননী সত্যবতী ছাড়াও এখানেই রয়ে গেছেন ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর মা অম্বিকা এবং অম্বালিকা। তাদের একজন এখনও পুত্রবতী, অন্যজন পুত্রহীনা। জননী সত্যবতী তো বটেই, অম্বিকা-অম্বালিকাও এখন যথেষ্ট বয়স্কা মহিলা।

 এঁদের সবার কথা মনে করে, কুরুবাড়ির বিশাল দুর্ঘটনার কথাটাও যথেষ্ট খেয়াল করে কবি-ঋষি তার জননী সত্যবতীর কাছে উপস্থিত হলেন। মহারাজ শান্তনুর যে বংশ সত্যবতীর চেষ্টায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, অন্যের ঔরসজাত হলেও যে পৌত্রের মাধ্যমে তিনি হস্তিনাপুরের রাজাকে পেয়েছিলেন, সেই পৌত্রের মৃত্যুতে বৃদ্ধা সত্যবতী প্রায় অচেতন অবস্থায় শোকাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন নিজের ঘরে। ব্যাস সেই ঘরে উপস্থিত হলেন স্থিতধী ঋষির গাম্ভীর্যে। ডাকলেন–মা! ওঠো। মনে রেখো–তোমার সুখের দিন চলে গেছে। এখন যে দিন আসবে তা হবে ভীষণ থেকে ভীষণতর–অতিক্রান্তসুখাঃ কালা পর্যপস্থিত দারুণাঃ। কাল, আগামিকাল বলে যে সময়টাকে তুমি সুখের ভাবছ, সেই কাল আরও কষ্ট বয়ে নিয়ে আসবে দিন, দিন। কেন জান, পৃথিবী আজ তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে–শঃ স্বঃ পাপিষ্ঠদিবসঃ পৃথিবী গতযৌবনা।

মানুষের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে এর থেকে দামী উপদেশ বুঝি আর কিছু হতে পারে না। পৃথিবী তার যৌবন হারিয়েছে–এই কথাটি প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে এমন ধ্রুব সত্য যে, আমরা ইচ্ছে করেই এই হৃতযৌবনা পৃথিবীর কথা ভুলে যাই। মানুষের যতদিন কর্মদক্ষতা থাকে, যতদিন সংসার–পরিবারের ওপর তার আধিপত্য থাকে, পৃথিবীর যৌবনও তার কাছে ততদিনই। তারপর পুত্র-কন্যা যখন বড় হয়, সংসার যখন আপনি নিয়মে পুত্র-পুত্রবধূর হাতে চলে যায়, তখনি পিতা-মাতার কাছে পৃথিবী গতযৌবনা। কিন্তু মানুষ সংসারের ওপর তার পূৰ্বাধিকার ভুলতে পারে না বলেই গতযৌবনা পৃথিবীকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে বারংবার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠা আর আসে না, কারণ ততদিনে যৌবনবতী পৃথিবী ধরা দিয়েছে তারই পুত্র-পুত্রবধূর কাছে।

হয়তো এই কারণেই আমাদের শাস্ত্রে পঞ্চাশোৰ্ব্বে বনে যাবার বিধান। পঞ্চাশে নাই হোক, মানুষ যেদিন তার কর্মস্থল থেকে অব্যাহতি পায় সেদিনও যদি বুড়ি গিন্নিটির হাত ধরে কাশী-বৃন্দাবনে নতুন সংসার পাততেন, তাহলে তার বার্ধক্যের মধুরতাটুকু পুত্র-পুত্রবধূর যৌবনের কাছে পদে পদে বিপর্যস্ত হত না অন্তত। কাশী-বৃন্দাবনের বদলে শালবনী, মধুবনী কি পুরী-ডায়মন্ডহারবারেও আপত্তি নেই, অন্তত আজকের পরিবর্তিত সমাজের নিরিখে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের নিরিখে সে আপত্তি নেই, কিন্তু সত্যিই বেরিয়ে পড়াটা দরকার। যে। মায়াটুকু আছে, সে শুধু পুত্র-কন্যার ওপর নিক্সের মায়া, কারণ পুত্র-কন্যার আপন মায়ার স্থান তৈরি হয়ে যায়। আপনিই তার আধার তৈরি হয়। আমার–তোমার যৌবনগত অবস্থার সময়টা বিচার করলেই তা নিরপেক্ষভাবে বেরিয়ে আসবে! আমার-তোমার ওপর পিতা-মাতার যে মায়া ছিল, পিতা-মাতার ওপর আমার তোমার কি তাইই আছে?

সংসারে যখন অধিকার থাকে না, প্রাধান্য থাকে না, তখন শুধু বয়সের ভার চাপিয়ে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না বলেই পদে পদে বিপর্যস্ত হতে হয়–ব্যাসের ভাষায় সেই দিনগুলি হল কষ্টের দিন, যা আমাদের মনোমত নয়, তাই যেন পাপের দিন বলে মনে হয়– শঃ পাপিষ্ঠদিবসঃ। স্তব্ধ-স্তম্ভিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সেদিন শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলে–কালে কালে কী হল? কী দেখেছি আর কী হল?

 ব্যাস চান না তার জননী তার জীবনের সমস্ত সাহংকার পূর্বচেতনা নিয়ে হস্তিনার রাজবাড়িতে বসে মনোকষ্ট পান। প্রত্যেক বৃদ্ধ বৃদ্ধাই যেমন মনে করেন–তাদের পূর্বকালই ভাল ছিল, যে কাল চলছে বা যে কাল আসছে, তা ভয়ঙ্কর, ঠিক তেমন করেই ব্যাস জননী সত্যবতীকে বললেন–মা ভয়ঙ্কর সময় আসছে, মা! ভয়ঙ্কর সময় আসছে, সমাজে দোযের অন্ত থাকবে না। ধর্ম, সদাচার সব লুপ্ত হয়ে যাবে। সে এক ভয়ঙ্কর সময়–ঘোরঃ কালঃ ভবিষ্যতি। এই যে আজকে তোমার কুরুদের দেখছ–এদের অন্যায়ে পৃথিবী সুস্থ থাকবে না–কুরূণামনয়াচ্চাপি পৃথিবী ন ভবিষ্যতি। তাই বলছিলাম তুমি আমার সঙ্গে চলো। তপোবনে গিয়ে যোগ অবলম্বন করো। কুরুবংশের এই ধ্বংস তুমি নিজের চোখে দেখো না।

জননী সত্যবতী তখন অতিশয় বৃদ্ধা। কুরুবাড়ির পুত্র-পৌত্রদের মায়ায় এতকাল তিনি তবু পড়েছিলেন। কিন্তু আর নয়। আজ তার ঋষির ঔরসজন্মা কন্যাকালের পুত্রটি তাঁকে নিতে এসেছেন। অতএব একটুও আপত্তি করলেন না তিনি। শুধু একবার পুরাতন অভ্যাসে অন্দরমহলের ভিতরে গিয়ে পুত্রবধূ অম্বিকার সামনে গিয়ে বললেন–হ্যাঁগা বউ! কী শুনলাম আজকে। শুনলাম–তোমার ছেলে ধৃতরাষ্ট্রের দুর্ব্যবহারে এই ভরতবংশ উচ্ছন্নে যাবে। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পুরবাসীদেরও ধ্বংস অনিবার্য। আমার ছেলের ইচ্ছে, আমি বানপ্রস্থ যাই। তো তোমারও যদি তেমন ইচ্ছে থাকে, তবে পুত্রশোকাতুরা অম্বালিকাকে নিয়ে আমার সঙ্গে চলো।

হয়তো ব্যাসের সঙ্গে জননী সত্যবতীর কথার কিছু তফাত হল। হয়তো ব্যাসের সাধারণ মন্তব্য সত্যবতীর মুখে আরও নির্দিষ্ট হল। হয়তো পনেরো বছরের ছেলে দুর্যোধনের জন্য ধৃতরাষ্ট্রের ব্যবহারে এমন কিছু ছিল, যা সত্যবতীর চোখে ভাল লাগেনি। কিন্তু ব্যাসের ঋষি-মনে তা সাধারণ কালের ছায়ামাত্র, দুর্যোধনের একক ব্যক্তিত্ব সেখানে কিছুই নয়। যা কিছুই হোক ব্যাস যা বোঝাতে চেয়েছেন, মনস্বিনী সত্যবতী তা বুঝেছেন। দুই পুত্রবধূর হাত ধরে বনে চলে গেলেন সত্যবতী।

মহাভারতের কবি তার নিজের জননীর অস্তকালের কথা সবিস্তারে লেখেননি। লেখেননি সেই দুটি ভয়ত্ৰস্তা রমণীর শেষ জীবনের কথাও, যাঁরা তাঁর সন্তান ধারণ করেছিলেন। এই তিন রমণীই ব্যাসের ব্যক্তিগত জীবনে ছায়া ফেলেছিলেন বলেই ঋষি এবং কবি এক মুহূর্তে এক কলমের খোঁচায় তাদের আয়ুঃশেষের বর্ণনা দিলেন–অতঃপর ঘোর তপস্যা করিয়া তাহারা। দেহত্যাগপূর্বক অভীষ্ট স্বর্গ লাভ করলেন–দেহং তত্ত্বা মহারাজ গতিমিষ্টাং যযুস্তদা।

.

৯৪.

পাণ্ডুর শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়ে যাবার পর কুন্তী এবং পাণ্ডবরা যখন হস্তিনাপুরে আশ্রয় পেলেন, তখন নীতি-নিয়মমতো পাণ্ডবদের রাজপুত্রের মর্যাদা পাবার কথা। এই মর্যাদা যে পাণ্ডবরা পেতেনও না, তাও নয়। কিন্তু মহাভারতের কবি একটা অদ্ভুত মন্তব্য করেছেন এই জায়গায়। তিনি লিখেছেন–পাণ্ডবরা বেদোক্ত উপনয়ন-সংস্কার লাভ করেছিলেন যথাযথভাবেই, কিন্তু তারা শুধু খেয়ে-পরে বড় হচ্ছিলেন হস্তিনার রাজবাড়িতে–সংব্যবৰ্ধন্ত ভোগাংস্তে ভুঞ্জানাঃ পিতৃবেশ্মনি। অবশ্য এতকাল শতশৃঙ্গ পর্বতের মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা পাণ্ডবদের এসব ব্যাপারে যে খুব নজর ছিল অথবা তারা কিছু মনে করছিলেন, তা নয়। তবে একটা ঘটনা। তাদের চোখে কিছু খারাপ লেগে থাকবে।

হয়তো তাদের মনে আছে–যেদিন পিতৃহীন পাণ্ডবরা তাদের বিধবা মায়ের হাত ধরে শতশৃঙ্গবাসী মুনি-ঋষিদের সঙ্গে হস্তিনার রাজদ্বারে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেদিন রাজবাড়ির সকলে তাদের দেখবার জন্য ভিড় করেছিল, শত উৎসাহ, ত্বরা এবং কৌতূহলের মধ্যে অন্য কেউ সেদিন, তেমন পরিপাটিভাবে বেরতে পারেননি। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্র দুর্যোধনরা একশো ভাই কিন্তু এই ত্বরিত-কৌতূহলের মধ্যেও সোনার গয়না পরে নানা সাজে সেজে হতশ্রী পিতৃহীন পাণ্ডবদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন–ভূষিতা ভূষণৈশ্চিত্রৈঃ শতসংখ্যা বিনিযুঃ। অর্থাৎ তারা যে রাজপুত্র, তারা যে রাজপুত্রের যোগ্য ভোগ লাভ করেন–এ ব্যাপারে দুর্যোধনেরা নিজেরাও যতটা সচেতন, ততটাই সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে চান অন্য লোকের মনে। এই ঘটনায় কুন্তী বা পাণ্ডবদের মনে কী একটুও লাগেনি? যুধিষ্ঠিরের মতো নরম মানুষের কিছু কিছু বোধ না হলেও, ভীম-অর্জুনের চোয়াল কি একটুও শক্ত হয়ে ওঠেনি এ ঘটনায়!

সে যাক গে, পাণ্ডবরা কুরুবাড়িতে এমনিতে ভালই ছিলেন। সর্বক্ষণ অলস অবসরে খেলাধুলো করে বেড়ানোটাই তাদের প্রধান কাজ ছিল। সেকালের দিনে পাঁচ বছর বয়স থেকে পড়াশুনো আরম্ভ করেই খেলাধুলো সব ভুলে গেলাম–এমনটি হত না। মানুষের জীবনে অনন্ত অবসর ছিল, অনন্ত কৌতুক ছিল, লোক-ব্যবহার ছিল সহজ সরল। ফলে এই ষোলো-সতেরো বছর বয়সেও পাণ্ডবদের আমরা খেলাধুলোয় মত্ত হতে দেখছি। এই খেলাধুলোর প্রধান দোসর অবশ্যই কৌরবরা একশো ভাই। সংখ্যায় অধিক, এতগুলি বন্ধুপ্রতিম ভাইয়ের সঙ্গে পাণ্ডবদের খেলাধুলো ভালই জমে উঠত–ধার্তরাষ্ট্রৈস্ট সহিতাঃ ক্রীড়ন্তো মুদিতাঃ স্বয়ম্।

পাণ্ডবদের শারীরিক শক্তি এবং বাড় বোধহয় কৌরবদের থেকে বেশি ছিল। আমরা শতশৃঙ্গ পর্বতেই দেখেছি–পাণ্ডবদের শারীরিক শক্তি এবং বৃদ্ধি লক্ষ্য করে শতশৃঙ্গবাসী মুনি-ঋষিরা একেবারে অবাক হয়ে যেতেন–বিস্ময়ং জনয়ামাসুমহর্ষীনাং সমীয়ুষা। হয়তো তথাকথিত ইন্দ্র, বায়ু ইত্যাদি দেবতা বা প্রাচীন আর্য-প্রতিভূ প্রধানদের ঔরসজাত বলে অথবা শতশৃঙ্গের পাহাড়ী এলাকায় বেড়ে ওঠার ফলে পাণ্ডবদের শক্তি কৌরবদের চেয়ে কথঞ্চিৎ বেশি ছিল এবং হয়তো তার ফলেই খেলাধুলোয় কৌরবরা তাঁদের সঙ্গে খুব পেরে উঠতেন না–বালক্রীড়াসু সর্বাসু বিশিষ্টাস্তে তদাভব।

বিশেষত মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন। তখনকার দিনে খেলাধুলোর যে নানা বৈচিত্র্য ছিল, তা তো নয়। গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতায় আমরাও যেমনটি দেখেছি–ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়াটাও যেমন খেলার মধ্যে ছিল, পথে-ঘাটে গ্রাম্য মাঠে দৌড়নোটাও তেমন খেলার মধ্যে ছিল। দূরে একটি লক্ষ্যবস্তু রেখে দৌড়ে সেটা আহরণ করা অথবা বড় জোর বন্দুক-ক্রীড়া বা বল খেলাটাই সেকালের বালকক্রীড়ার চরম। সেই কন্দুক বা বলটিও আমাদের ছোটবেলার মতো বাতাবি লেবুর বল কিনা কে জানে। কিন্তু ঢিল ছুঁড়তেই বলা হোক, অথবা দৌড়ের প্রতিযোগিতা, ধুলো ছোঁড়াই হোক অথবা লক্ষ্য-আহরণ–এই সমস্ত খেলাতেই ভীমের সঙ্গে কেউ পেরে উঠতেন না। এমনকি খাবার খাওয়াটা যদি কমপিটিশনে খেলার মর্যাদা লাভ করে, তাতেও ভীমের সঙ্গে কৌরব-ভাইদের কেউই জেতার আশা রাখতেন না–ধার্তরাষ্ট্রান্ ভীমসেনঃ সর্বান্ স পরিমর্দতি।

 খেলার ব্যাপারে ভীমের প্রকৃতিটাও ছিল একটু স্যাডিস্ট ধরনের। অন্যকে কথঞ্চিৎ কষ্ট দিয়ে আনন্দ লাভ করাটা তার ক্রীড়া-সরসতার অঙ্গ ছিল। ধরুন, কৌরবভাইদের খেলা বেশ জমে উঠেছে, এই অবস্থায় কৌরবদের কয়েকটি শক্তি-বলহীন ভাইদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে ভীম তাঁদের লুকিয়ে রাখলেন দূরে গাছের আড়ালে এবং তাও জোর করে, ভয় দেখিয়ে–হর্ষাৎ প্রক্রীড়মানাংস্তান্ গৃহ্য রাজন্ বিলীয়তে। দূরে তাদের লুকিয়ে রেখেই যে ভীম নিশ্চিন্তে বসে রইলেন, তা নয়। মাঝে মাঝে তাদের মাথায় গাঁট্টা মারা, দুজনের মাথা ধরে ঠোকাঠুকি করা, এগুলি ছিল ভীমের ক্রীড়া-ব্যসনের অঙ্গ–শিরঃসু বিনিগৃহ্যৈতা যোধয়ামাস পাণ্ডবঃ।

প্রতিদিনের একঘেয়ে ঢিল ছোঁড়া আর দৌড়নো ভীমের বেশি পছন্দ হয় না। একটু বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে গেলেই সেটা আবার অন্যের পক্ষে অসহনীয় হয়ে যায়। গায়ে যার অতিরিক্ত শক্তি, সে আবার তেমন করে অন্যের কষ্ট বোঝেও না। ভীমেরও তাই হয়েছে। তিনি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগুলিকে মাঝেমাঝেই মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে ফেলেন তারপর তাঁদের চেপে ধরে হাত-পা ধরে টানেন। তারা যখন কষ্ট পেয়ে কাঁদতে থাকেন, তখন তাদের মাথাটা ঘষে দেন মাটিতে–চকর্ষ ক্রোশতোং ভূমৌ ঘৃষ্টজানুশিরোংসকান্। গ্রাম্য-ক্রীড়ার লিস্টিতে অন্যতম মজার খেলার উৎস হল নদীর জল। কিন্তু এখানেও ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের রক্ষে নেই। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা জলে নেমে জলক্রীড়া করছে–এমনটি দেখলেই ভীমও জলে নামবেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের কয়েকটি ছেলেকে তিনি বেশ কিছুক্ষণ জলের তলায় চুবিয়ে রাখবেন জোর করে। এরপরে যখন তাদের দম ফাটার জোগাড় হবে, তখন তিনি ছেড়ে দেবেন তাদের আস্তে স্ম সলিলে মগ্নো মৃতকল্পান্ বিমুঞ্চতি। মজার জন্য ধৃতরাষ্ট্রের যেসব ছেলে গাছে উঠেছেন, তাঁদের ভীম একবার দেখতে পেলে সেই গাছ ধরে এমনই নাড়া দেবেন যে, ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেগুলি ঝুপ ঝুপ করে পড়ে যাবেন ফলের সঙ্গে–সফলা প্রপতন্তি স্ম দ্রুতং এস্তা কুমারকাঃ।

 ভীমের এই ক্রীড়াবেগ অন্য কারও সহ্য না হবারই কথা। তার অতুলনীয় শারীরিক শক্তি আছে, তাঁর শক্তির উদ্বৃত্তটুকু এই ধরনের কষ্টকর ক্রীড়াবেগে পরিণত হয়। কিন্তু মুশকিল সেই শক্তির ভার ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা সইবেন কেন! মহাভারতের কবি ভীমের একটু সাফাই গেয়েছেন এই সময়ে। বলেছেন ভীম যে এই ধরনের ছোট-খাট অত্যাচার করতেন খেলার সময়, সেগুলি কোনও দ্রোহ-চেতনা থেকে করতেন না। তার বয়সটা কম ছিল, অতএব সেই বয়সের চাপল্যেই এইসব দুষ্টবুদ্ধি তাঁর মাথায় চাপড়–বাল্যাৎ, ন দ্রোহচেতসা। কিন্তু বালকোচিত চপলতার জন্যই হোক অথবা শারীরিক শক্তির অতিরেকের ফলেই হোক, ভীমের এই খেলার অত্যাচারে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের কাছে ভীম যারপরনাই অপ্রিয় হয়ে উঠলেন–অপ্রিয়েতিষ্ঠদত্যন্ত।

বস্তুত ভীম যে কেন এই ধরনের অত্যাচার করতেন, তার কারণ মহাভারতের কবি যত সরলভাবেই ব্যাখ্যা করুন, এই অত্যাচারের মূলে ছিল কৌরব-পাণ্ডবের বিষম স্থিতি। অন্য জায়গা থেকে এসে পাণ্ডবরা ধৃতরাষ্ট্রের রাজবাড়িতে জায়গা পেয়েছিলেন। এতকাল যে রাজকুমাররা স্বচ্ছন্দ স্বাধীন ছিলেন। এখন তাদের সমমর্যাদার প্রতিযোগী হয়ে এসেছেন পাণ্ডবরা। এটা যেমন কৌরব-ভাইদের মন ভাল লাগছিল না, তেমনি পাণ্ডবদের অবচেতন মনেও এই ঘটনা ক্রিয়া করছিল। তারা যতই রাজপুত্র হোন, দীর্ঘকাল পরে রাজবাড়িতে এসে নিজেদের মর্যাদা তারা লাভ করছিলেন না নিশ্চয়। কৌরব-ভাইরা অত্যন্ত সচেতনভাবে সাহংকারে যেভাবে রাজপুত্রের চাল-চলন প্রকাশ করতেন, জন্ম থেকে রাজবাড়িতে না থাকার ফলে সে চাল-চলন পাণ্ডবদের রপ্ত ছিল না। কিন্তু নীতিগতভাবে সেই রাজপুত্রের মর্যাদা নিশ্চয়ই তাদের আকাঙ্ক্ষার বস্তু ছিল এবং সেইজন্যই তা পাণ্ডবদের অবচেতনে ছিল।

অন্য পাণ্ডব ভাইরা অন্তরের ভাবটুকু অনেকটাই গোপন করতে পারতেন, কিন্তু ভীম পারতেন না; আর পারতেন না বলেই নিজের অজান্তেই তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের ওপর অত্যাচার করে সুখী হতেন। কিন্তু তার অবদমিত দুঃখের প্রকাশ শক্তি এবং সুখের মাধ্যমে ঘটায় স্পষ্টতই কৌরবদের ওপরে এর প্রতিক্রিয়া হল। বিশেষ করে কৌরব-জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন ভীমের সমস্ত আচরণটাকেই বাড়াবাড়ি বলে মনে করতে লাগলেন। ভীমের অতিরিক্ত শক্তি তার ক্ষতি করতে পারে–এইরকম একটা কুবুদ্ধি দুর্যোধনের অন্তরে ক্রিয়া করতে লাগল সেই সতেরো-আঠারো বছর বয়সেইভীমসেনস্য তজজ্ঞাত্বা দুষ্টং ভাবমদর্শরৎ।

সেই অল্প বয়সেই দুর্যোধনের ন্যায়-নীতি বোধ খুব প্রখর ছিল না। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন–ক্ষমতার মোহ এবং ঐশ্বর্যলোভ–এই দুটো কারণেই দুর্যোধন ভাবতে আরম্ভ করলেন কীভাবে ভীমের ক্ষতি করা যায়–মোহাঐশ্বর্যলোভাচ্চ পাপা মতি-রজায়ত। এতকাল দুর্যোধনই ছিলেন কুরুবাড়ির একচ্ছত্র রাজপুত্র। তিনি তার অধিকার প্রকাশ করতে কখন কুণ্ঠিত হতেন না। কুরুবাড়ির এই অধিকার এবং ঐশ্বর্য যখন দুর্যোধনের মনের আকাশে চাঁদের কলার মতো বেড়ে চলেছে, ঠিক তখনই তার মধ্যে ভীমসেনের রাহুচ্ছায়া দেখা দিল। দুর্যোধন ভাবলেন–ভীমের গায়ে শক্তি যথেষ্ট। কাজেই শক্তি দিয়ে তাকে কিছু করা যাবে না। ছলচাতুরী এমন একটা করতে হবে যাতে চিরদিনের মতো এটাকে ঠান্ডা করে দেওয়া যায়নিকৃত্যা সংনিগৃহ্যতাম্। দুর্যোধন ভাবলেন–আমরা যদি সকলে মিলে একদিকে থাকি, তবু একা ভীমই আমাদের সবাইকে বিপর্যস্ত করে দেয়স্পর্ধতে চাপি সহিতা অস্মানেকো বৃকোদরঃ।

ভীমকে কৌশলে কীভাবে বিপদে ফেলা যায় তার উপায় দুর্যোধনের চিন্তা করা হয়ে গেছে। মনে রাখা দরকার, দুঃশাসন, শকুনি, কর্ণ–এঁরা কেউই এখনও দুর্যোধনের পরামর্শদাতার ভূমিকায় আসেনি। ভীমের ব্যাপারে যে কুটিল সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা দুর্যোধন একাই নিচ্ছেন। তার মানে, সতেরো-আঠারো বছরের এক সদ্য-যুবকের মধ্যে কতখানি ঐশ্বর্যলিঙ্গা এবং প্রতিহিংসাবৃত্তি থাকলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। দুর্যোধন ঠিক করলেন-ঘুমন্ত অবস্থায় ভীমসেনকে ফেলে দেব গঙ্গায়–তন্তু সুপ্তং পুরোদ্যানে গঙ্গায়াং প্রক্ষিপামহে। তারপর ওই ছোটভাই অর্জুন আর বড়ভাই যুধিষ্ঠিরকে বেঁধে রাখব বন্দিশালে।

দুর্যোধন ওই বয়সেই রাজা হবার স্বপ্ন দেখছিলেন। হয়তো সেইভাবে তার মনটাও গড়ে উঠেছিল। কারণ তাঁর পিতা দুর্যোধনের জন্মলগ্নেই তাকে রাজা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। নিজে রাজ্য পাননি বলে এই ভাবনাটা তার মধ্যে গেড়ে বসেছিল। তারপর বহুকাল পাণ্ডু এবং তাঁর পুত্রদের অনাগমনে ধৃতরাষ্ট্র তার নিজের রাজ্যলাভের স্বপ্ন দুর্যোধনের অন্তরে প্রোথিত করতে পেরেছিলেন। দুর্যোধনও তাই এই কচি বয়সেই এমন সর্বনেশে কথা ভাবতে পারছেন। ভীমকে মেরে যুধিষ্ঠির-অর্জুনকে কারাগারে বন্দী করে তিনি যে সিদ্ধি চান, তা হল নিঃশত্রুক রাজ্যলাভ–প্ৰসহ্য বন্ধনে বধ্ব প্রশাসিয্যে বসুন্ধরাম্।

ভীমসেনের ব্যাপারে কী করবেন, সেটা সিদ্ধান্ত নেবার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধন ভীমের ছিদ্র খুজতে লাগলেন। অন্যদিকে ভীমকে নিজের জালে ফেলার জন্য তার নিজের পরিকল্পনাটি ছকতে লাগলেন নিচ্ছিদ্রভাবে। এই পরিকল্পনা করবার সময়ে তার একটুও ভাবান্তর হল না, কাক-পক্ষীও তাঁর অন্তর-কূট জানতে পারল না। পাকা খুনীর মতো ঠান্ডা মাথায় তিনি কার্যসিদ্ধির পথে এগোতে লাগলেন। আগে তিনি সবার মধ্যে বেশ রটিয়ে দিলেন–অমুক দিন অমুক জায়গায় আমরা সবাই জলক্রীড়া করতে যাব। সবাই তাতে মনে মনে খুশি। ভীমও বোধহয় প্রতিযোগিতা-জয়ের আগাম আনন্দে খুশিই ছিলেন মনে মনে।

 দুর্যোধন যে রকম পরিকল্পনা করেছেন, তাতে মনে হবে যেন এক বিরাট পিকনিকের পরিকল্পনা হয়েছে দূরে কোনও রম্যস্থানে। জায়গাটার নাম প্রমাণকোটি। হস্তিনাপুর ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা গেলে গঙ্গার তীরে এক ছায়াসুনিবিড় স্থানে পিকনিক-স্পট ঠিক হয়ে গেল দুর্যোধনের নির্দেশে। রাজবাড়ির জলক্রীড়া, তার ঠাটবাটও সেইরকম। গঙ্গার তীরে অস্থায়ী কতগুলি ঘর তৈরি করা হল, কিন্তু সে ঘরগুলিও ভারি সুন্দর, বাসযোগ্য তো বটেই। এখনকার দিনে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলির চতুর্দিকে যেমন ক্যাম্বিসের কাপড় দেওয়া হয়, তেমনি তখনকার দিনের এমনি সাধারণ কাপড়ের সঙ্গে কম্বল, ভেড়ার লোমের তৈরি কাপড় এগুলি দিয়ে বিচিত্র সব ঘর তৈরি হল–চেল-কম্বলবেশ্মানি বিচিত্রানি মহান্তি চ। এই অস্থায়ী আবাসের শিল্পশৈলীও অসাধারণ। গঙ্গার তীর থেকে খুঁটি পুঁতে পুঁতে সেই আবাসের অর্ধেকটা তুলে দেওয়া হল জলের ওপর, অপর অর্ধেক রইল স্থলে-স্থলং কিঞ্চিদুপেত্য হ।

 ঘরের মধ্যে এখানে সেখানে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সাজিয়ে রাখা হল। স্নানের আগে, পরে, মাঝখানে যখন তখন খাবার ব্যবস্থা। শিল্পীরা সমস্ত ঘর-বাড়ি সাজিয়ে দিল বিশাল বিশাল চিত্রকর্ম টাঙিয়ে দিয়ে, ধ্বজ-পতাকা উড়িয়ে দিয়ে। দুর্যোধন এই অস্থায়ী আবাসের নাম দিলেন উদক-ক্রীড়ন।–উদক-ক্রীড়নং নাম কারয়ামাস ভারত।

সব কাজ শেষ হলে দুর্যোধন পাণ্ডবদের বললেন–চলো ভাইসব। গঙ্গাতীরে চলো। সেখানে পরমানন্দে জলবিহার করা যাবে। কথাটা সরল যুধিষ্ঠিরের কানে বেশ ভালই লাগল। ভাইদের নিয়ে তিনি কৌরবদের সঙ্গে চললেন প্রমাণকোটিতে। রথ চলল, হাতি চলল, রাজপুত্রেরা যথোপযুক্ত বাহনে চড়ে রাজধানী হস্তিনাপুর ছেড়ে প্রমাণকোটিতে, যেখানে কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম নেই, কুরুরাজবংশের বিশ্বস্ত প্রাচীনেরা নেই, সোজা কথায়, দুর্যোধনের কোনও ঝামেলা নেই।

রাজপুত্রেরা মহানন্দে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগলেন। অস্থায়ী আবাসের কাছাকাছি পদ্মদিঘির ধারে, ফুলের বাগানে, গঙ্গার হাওয়ায়। খাওয়া-দাওয়াও চলল নিজের ইচ্ছামতো। এ ওকে খাইয়ে দিচ্ছে, এ ওর সঙ্গে কথা বলছে–এরই মধ্যে দুর্যোধন পরম বন্ধুর মতো ভীমকে নিজে হাতে খাইয়ে দিলেন কত কিছু–স্বয়ং প্রক্ষিপতে ভক্ষ্যং বন্ধ্রে ভীমস্য পাপকৃৎ। দুর্যোধন ঠান্ডা মাথায় আগে থেকেই ভীমের খাদ্যে বিষ মাখিয়ে রেখেছিলেন। তার মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা, ভীমকে খাওয়াবার জন্য তিনি কতই যেন ব্যগ্র। সকলের মধ্যে যখন সকলেই এ-ওকে খাওয়াচ্ছে–পরস্পরস্য বন্ধ্রেভ্যো দদুর্ভক্ষ্যাংস্ততস্ততঃ–সেখানে দুর্যোধনকে সন্দেহ করারও কিছু রইল না। কিন্তু দুর্যোধনের হৃদয়েও বিষ, খাবারেও তিনি বিষ মাখিয়েছেন, পাকা অভিনেতার মতো মুখে তিনি অমৃতের ধারা ছুটিয়ে দিলেন–ভাই এটা একটু খেয়ে দেখ, আরে এটা খেলে না–বাচামৃতকপ্পোথ ভ্রাতৃবচ্চ সুহৃদ যথা।

 ভীমসেন নিজে এমনিতে পেটুক মানুষ। তার আর ভাইরা সকলে মিলে যা খান, তিনি নিজে একা তাই খান। ভাল-মন্দ খাবার পেলে আর কোনও জ্ঞান থাকে না তার। এখানে এই প্রমোদ কুটীরে তার জন্য এত আয়োজন করে রেখেছেন দুর্যোধন! ভীম বড় খুশি হলেন। দুর্যোধনের মনে যে পাপ থাকতে পারে–সে কথা তিনি ভাবতেই পারলেন না। তিনি খুব খেলেন, মনের আনন্দে খেলেন–প্রতীচ্ছিতঞ্চ ভীমেন তং বৈ দোষমজানতা। দুর্যোধন ভীমের কাণ্ড দেখে মনে মনে খুব হাসলেন–হৃদয়েন হসন্নিব। শুধু তাই নয়, মনে মনে ভবিষ্যতের নিঃসঙ্কট রাজসুখ কল্পনা করে নিজেকে সম্পূর্ণ কৃতকৃত্য মনে করলেন।

এবারে জলক্রীড়া। একবার হুল্লোড় তোলার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডব-কৌরব বালকেরা সকলেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ ওর গায়ে জল ছিটোচ্ছে, এ ডুব-সাঁতার কাটছে, ও লুকোচ্ছে, এ ধরছে–এরকম করে যত বিচিত্র পদ্ধতিতে খেলা যায়, তেমনি খেলা হল। খেলার হুল্লোড়ে দিন গড়িয়ে বিকেল হল। সকলেই পরিশ্রান্ত। জল থেকে উঠে ভাল ভাল জামা-কাপড় পরে অনেকেই বললেন–আজকে এই অস্থায়ী আবাসেই কাটিয়ে দেব। নিঃসন্দেহে এই জনা কয়েকের মধ্যে দুর্যোধন এবং তাঁর আরও দু-একটি ভাই ছিলেন।

কেমন বিষ দিয়েছেন দুর্যোধন যার ক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। কারণ খাবারের সঙ্গে মেশানো বিষ খেয়েও ভীম জলক্রীড়া করেছেন অন্যদের সঙ্গে সমানতালে। শরীরের ব্যায়ামও তার যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু শেষে যেন আর তিনি পেরে উঠছেন না। যেখানে জল-ক্রীড়ায় মত্ত ছিলেন তিনি, সে জায়গাটা অস্থায়ী আবাস থেকে একটু দূরেই হবে। ভীম তার ক্রীড়া সহচরদের সঙ্গে একই সময় পারে উঠলেন, কিন্তু বিষক্লান্ত শরীরটাকে আর যেন তিনি বইতে পারছেন না। প্রমাণকোটিরই এক জায়গায়, যেখানে শীতল বাতাস বয়ে আসছে গঙ্গা থেকে, ভীম সেখানে শুয়ে পড়লেন কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে। শ্রান্ত-ক্লান্ত দেহে শীতল বাতাস লাগতেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়লেন তিনি। বিষের ক্রিয়া অনেকক্ষণ আগেই শুরু হয়েছে, আর তার জেগে থাকবার উপায় নেই–বিষেণ চ পরীতাঙ্গঃ সুস্বাপা বাপ্য তৎস্থল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *