০৭৫. চম্পা-নগরী

৭৫.

 চম্পা-নগরী। হস্তিনাপুর কিংবা মথুরার মতো এই নগরীর তত সুনাম নেই। ভারতবর্যের যে সব জায়গায় আর্যরা সুপ্রতিষ্ঠিত, সেই রকম কোনও প্রাদেশের মধ্যেও এই নগরীর নাম নেই। যে দেশের মধ্যে এই ছোট্ট নগরীটির অবস্থিতি, আর্য ভূখণ্ডের প্রাজ্ঞ পুরুষেরা সে দেশটিকে রীতিমতো ঘৃণার চোখে দেখেন। দেশটার নাম অঙ্গ। পারহিটার সাহেবের মতে অঙ্গ হল এখনকার মুঙ্গের এবং ভাগলপুর অঞ্চল। উত্তরদিকে এই দেশের সীমানা বড় জোর কোশী নদী পর্যন্ত এবং পূর্ণিয়া জেলার পশ্চিম দিকটাও ছিল অঙ্গ-ভূমির মধ্যে। এই অঙ্গরাজ্যের মধ্যেই একটা ছোট শহর হল চম্পা-নগরী।

জায়গাটা খুব সুন্দর। চম্পা নগরী গড়ে উঠেছে চম্পা নদীকে কেন্দ্র করে। ছোট্ট নদী চম্পা গিয়ে পড়েছে গঙ্গায়। আর গঙ্গার মাহাত্মের জন্যই চম্পা-নগরী আস্তে আস্তে আৰ্যায়িত হচ্ছিল। কানিংহাম সাহেব এখনকার ভাগলপুরের দুটি স্থান চম্পানগর আর চম্পাপুরকে পুরাতন চম্পার বিস্তার–ভূমি বলে মনে করেন এবং তাঁর মতে চম্পা নদীই ছিল অঙ্গ-দেশের সঙ্গে মগধ-দেশের বিভেদ রেখা আমরা যে সময়ের কথা বলছি, ঠিক সেই সময়েই চম্পা নগরীর মালিকানা ছিল হস্তিনাপুরের দখলে, গঙ্গা আর চম্পা নদী যেখানে মিলেছে, ঠিক তার ওপরেই চম্পা-নগরী, যাকে এখনকার লোকেরা বলে চান্দন।

গঙ্গা-চম্পার মিলনের স্থানটি বেশ বড়। লেও এখানে অনেক। আজকে এই মুহূর্তে আমরা প্রৌঢ় বয়সের দুটি পুরু-নারীকে গঙ্গ-চম্পার সঙ্গমস্থলের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। এঁরা চম্পায় থাকেন, কিন্তু গঙ্গার মাহাত্ম্যর কথা মনে রেখেই বুঝি সঙ্গমে স্নান করতে এসেছেন। এই নারী-পুরুষের মধ্যে পুরুষটি আগে হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে কাজ করতেন। অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রথ চালাতেন তিনি তখনকার দিনে যাঁরা ক্ষত্রিয় রাজার সারথি হতেন, তাদের সম্মান ছিল খুব। তারা এমনিতে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হতেন এবং অনেক সময় মন্ত্রিসভাতেও তাদের আসন জুটত।

এই মানুষটি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের রথ চালনাই শুধু করতেন না, একটি অন্ধ মানুষকে নিরন্তর সাহচর্য দিতে দিতে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের পরম বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন–ধৃতরাষ্ট্রস্য বৈ সখা। প্রৌঢ়ত্বের শেষ পর্যায়ে পৌঁছলে ধৃতরাষ্ট্র এই মানুষটিকে ভৃত্যের বন্ধন থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে থাকতে দেন চম্পা-নগরীতে। কিছু জমি-জায়গাও দেন অবসর কাটানোর জন্য। এই মানুষটির নাম অধিরথ। তার স্ত্রীর নাম রাধা। তার বয়স অধিরথের চাইতে অনেকটাই কম বলে মনে হয়। কারণ অধিরথের পাশে দাঁড়ালে তাকে দেখতে কমবয়সী লাগে। তাছাড়া তাকে দেখতেও খুব সুন্দর–তস্য ভার্যাভবদ রাজন্ রূপেণাসদৃশী ভুবি।

চম্পানগরীতে সুখাবাস লাভ করেও অধিরথের মনে খুব একটা সুখ নেই। কেন না এই প্রৌঢ় বয়সেও তার কোনও পুত্র সন্তান হয়নি, কন্যা সন্তানও নয়–ন সা পুত্ৰমবিন্দত। অধিরথ আজ তাঁর পরিবারের সঙ্গে গঙ্গা-চম্পার সঙ্গমে এসেছেন, বলা উচিত–গঙ্গায় স্নান করতে এসেছেন–সদাবরী জাহ্নবীং যৌ। হয়ত এই গঙ্গাস্নানও কোনও নবীন পুণ্য-লোভে, যে পুণ্য এই প্রৌঢ় দম্পতির কোলে একটি পুত্র এনে দেবে। অধিরথ–ভার‍্যা অনেক পূজার্চনা করেছেন, অনেক মন্দিরে অনেক দেবতার কাছে পুত্র চেয়েছেন–অপত্যার্থে পরং যত্নমকবরাচ্চ বিশেষতঃ–কিন্তু এখনও পুত্রের মুখ দেখতে পাননি তিনি। সংসার-কর্মে উদাসীন দম্পতি আজ তাই গঙ্গাস্নানে এসেছিলেন।

অধিরথ গঙ্গার পাড়ে বসেছিলেন, পাশে দয়িতা ভার‍্যা রাধা। হঠাৎই গঙ্গার স্রোতের মধ্যে লতাজালমণ্ডিত একটি অদ্ভুত বস্তু ভেসে আসছে দেখালেন রাধা–সা দদর্শাথ মজুম্ উহ্যমানাং যদৃচ্ছয়া। স্বামী অধিরথ তত গা করলেন না–কী না কী ভেসে আসছে। উত্তরভারতের অনার্যপুরুষেরা কখনও মৃত-শিশু পেটিকার মধ্যে পুরে জলে ভাসিয়ে দেয়। তার মধ্যে পেটিকাটির ওপরে একটু-আধটু লতা-জাল বিছানো থাকলেও পেটিকার গায়ে অনেক সিঁদুর মাখানো রয়েছে এবং তা দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। অধিরথ জানেন–সিঁদুর জিনিসটা আর্য জনগোষ্ঠীর কাছে তত পরিচিত নয়, সিঁদুরকে তারা খুব মঙ্গলের চিহ্ন বলেও পূর্বে মনে করতেন না। কিন্তু সেই বৈদিক সময় থেকেই আর্য-অনার্যের সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ঘটে যাবার ফলে অনেক অনার্য আচারও আর্যসংস্কৃতির মধ্যে অনায়াসে ঢুকে গেছে। অধিরথ হয়ত ভাবলেন–নিশ্চয়ই কোনও অনার্যগোষ্ঠীর মানুষ পেটিকার গায়ে সিঁদুর মাখিয়ে কী না কী ভাসিয়ে দিয়েছে গঙ্গায়। তিনি একটুও গা করলেন না, গঙ্গার মন্দ-গতি সমীরণ-মুখর পুলিন ছেড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন না।

 কিন্তু শক্তপোক্ত লতার বাঁধনে বাঁধা সিন্দুরলিপ্ত পেটিকাটি দেখে অধিরথ–ভার‍্যা রাধার মনে অন্য প্রতিক্রিয়া হল। একে তো কৌতূহল নারীজাতির বিশেষ গুণ, তার মধ্যে পেটিকার গায়ে সিঁদুর-মাখানো দেখে তার মনে হল–কোনও কিছু বিশেষভাবে রক্ষা করার জন্যই এমন শক্ত করে লতার জালে পেটিকাটি বাঁধা রয়েছে। তাছাড়া লোকে যে এমন করে সিঁদুর মাখায়– দত্তরাং প্রতিসরামম্বালম্ভন-শোভিতা–তার কারণ, জলে ভাসিয়ে দিয়েও কোনও মানুষ হয়ত পেটিকাবদ্ধ বস্তুটির সুরক্ষা কামনা করেছে। আর ভারি আশ্চর্য, গঙ্গার গভীর-নীর তরঙ্গ ভঙ্গে পেটিকাটি ভাসতে ভাসতে অধিরথ-ভার‍্যা রাধার দিকেই আসছে–সমানীতামুপহুরম্। অদম্য কৌতূহলে গঙ্গার কূলে স্বল্প জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে রাধা একটু একটু করে জল টানতে লাগলেন নিজের দিকে। পেটিকাটিও অনুকূল আকর্ষণে আস্তে আস্তে রাধার হাতের মধ্যে এসে পৌঁছল। রাধা সযত্নে পেটিকাটি ধরলেন–সা তাং কৌতূহলাৎ প্রাপ্তাং গ্রাহয়ামাস ভামিনী। এবার ইঙ্গিত করে তিনি অধিরথকে ডাকলেন পেটিকাটি খোলবার জন্য।

অধিরথ তবুও কিছু গা করলেন না। অপত্যহীনা এক রমণী জলের মধ্যে খলবল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, জল টানছে, এটা-সেটা ধরছে–এতে তার সময় কাটছে ভালই–হয়ত এমনটি ভেবেই তিনি বসে ছিলেন। কিন্তু পেটিকাটি হাতের মধ্যে পাওয়ামাত্রই কৌতূহলী রাধা চিৎকার-চেঁচামেচি করে গঙ্গার নিস্তব্ধ তীরভূমি মুখর করে তুললেন। অধিরথ আপন স্তব্ধতা ভেঙে উঠে পড়তে বাধ্য হলেন। তাছাড়া পেটিকার মধ্যে কী আছে, সেটাও তো ভাবনার কথা। যদি বিষদিগ্ধ সর্প থাকে, ধনরত্ন থাকে, যদি সিংহাসনচ্যুত কোনও রাজার গোপন নথি-পত্র থাকে, তবে দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে। অধিরথকে তাই উঠতেই হল।

 অধিরথ জল সরিয়ে পেটিকাটি তুলে পেটিকাটি গঙ্গার তীরভূমিতে নিয়ে এলেন। এরপর একটি লৌহশলাকা জোগাড় করে পেটিকার ঢাকনিটি খুলতেই দেখলেন সযত্নে শায়িত রয়েছে একটি জীবন্ত শিশু–যন্ত্রৈরুদঘাটয়ামাস সোপশ্যত্তত্র বালক। অধিরথ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন শিশুর দিকে। এমন সুন্দর একটি শিশুর ছবি তার কল্পনাতেও ছিল না। উদয়-সূর্যের আভাস শিশুটির গাত্রবর্ণে, বুকে সোনার বর্ম আঁটা, কানে সোনার কুণ্ডল জন্মলগ্ন। অধিরথ এবং তার স্ত্রী বিস্ফারিত চোখে হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন অপূর্ব শিশুটির দিকে–স সূতত ভাৰ্যয়া সার্ধং বিস্ময়োফুল্ললোচনঃ।

অধিরথ এবার আস্তে আস্তে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন। অনপত্যা দয়িতা পত্নীকে সাদরে বললেন–আমার জন্ম থেকে এমন আশ্চর্য ঘটনা কখনও চোখে দেখিনি–ইদম্ অত্যদ্ভুতং ভীরু যতো জাতোস্মি ভাবিনি। এই দেবশিশু আমাদের কোলে এসেছে, এ শিশু দেবতারা পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাদের কাছে। আমাদের কোনও সন্তান নেই, ভগবান তাই নিশ্চয় সদয় হয়ে পুত্র দিয়েছেন আমাদের–অনপত্যস্য পুত্রোয়ং দেবৈদত্তে ধ্রুবং মম।

দৈবপ্রেরিত পুত্র লাভ করে পরম আপ্লুত অধিরথ পুত্রটিকে তুলে দিলেন পুত্রহীনা রাধার কোলে। দিব্যরূপী সেই পুত্রকে রাধা মানুষ করতে লাগলেন আপন পুত্রের মমতায়। সেই অশ্বনদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যে রমণীর সৌভাগ্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন কুন্তী, সেই সৌভাগ্যবতী রমণী হলেন অধিরথ-ভার‍্যা রাধা। কুন্তীর বেতসী পেটিকা অশ্বনদী দিয়ে ভাসতে ভাসতে চমতী নদীতে এসে পড়েছিল। চমতী সেই পেটিকা বয়ে এনে ফেলেছিল যমুনায়। যমুনা থেকে সেই পেটিকা এসে পড়েছিল গঙ্গায়–চর্মর্থত্যাশ্চ যমুনাং ততো গঙ্গাং জগাম হ। কুন্তীর পুত্রটি এতকাল যে আপন গর্ভে ধারণ করে গঙ্গা তাকে মুক্ত করে দিলেন অনেক দূরে চম্পা নগরীতে, হস্তিনাপুরের এক পূর্ব অধিকৃত স্থানে। এইভাবে, কোনও এক সূত্রে আগেই যেন কুন্তীর যোগাযোগ ঘটে গেল হস্তিনাপুরের সঙ্গে।

সূর্যের ঔরসজাত পুত্রকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে কুন্তী তার কন্যাত্ব ফিরে পেলেন বটে, তবে কানীন গর্ভ পরিত্যাগ করার কারণেই হোক, অথবা গোপন মিলনের অপরাধবোধে, কুন্তী খুব ব্রত-ধর্মে মন দিলেন–সত্ত্বরূপগুণেপেতা ধর্মারামা মহাব্রতা। এখন তিনি সম্পূর্ণ যুবতী। তাঁর রূপ এবং গুণের কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তবে রূপ–গুণের থেকেও যে বস্তুটি তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল, সেটা এমনই এক মোহ তৈরি করে, যা বলে বোঝানো যায় না। মহাভারতের কবি এই মোহের নামকরণ করেছেন অদ্ভুত একটি শব্দে–অতীব স্ত্রীগুণৈর্যতা– অর্থাৎ অত্যন্ত স্ত্রী-গুণসমন্বিত। তার্কিকরা বলবেন–একটি স্ত্রীর মধ্যে স্ত্রীর গুণ থাকবে না, তো কি পুরুষের গুণ থাকবে? আমরা বলি–শুধু স্ত্রীগুণই হলে শব্দটা অন্তত মহাকাব্যের কবি ব্যবহার করতেন না। তবে সত্যি কথা বলি–এই শব্দের কোনও বাংলা হয় না, বরঞ্চ ইংরেজি ভাল হয়। ইংরেজিতে একে বলে ফেমিনিটি। অর্থাৎ শুধু স্ত্রীত্ব নয়, একটি রমণীর মধ্যে রূপ এবং গুণের সঙ্গে যদি যুগপৎ লজ্জা এবং তেজস্বিতা–দুইই থাকে–তাং তু তেজস্বিনীং কন্যাং রূপযৌবনশালিনীমূ–তবে যে অদ্ভুত মোহ তৈরি হয়, তার নামই ফেমিনিটি, মহাকাব্যের কবির ভাষায়–অতীব-স্ত্রীগুণৈর্যতা।

রাজ–রাজড়ারা যাঁরা কুন্তিরাষ্ট্রে এসেছেন, যাঁরা কুন্তীর সঙ্গে কথা বলেছেন, যাঁরা কেউ কুন্তীকে একবার চোখে দেখেছেন, তারা কেউই কুন্তীকে ভবিষ্যৎ বধূরূপে কল্পনা না করে পারেননি। মহারাজ কুন্তিভোজের কাছে কুন্তীর সর্বাঙ্গীন অধিকার লাভের জন্য তারা প্রার্থনা করেছেন–ব্যাবৃন্ পার্থিবাঃ কেচিদতীব–স্ত্রীগুণৈযুর্তা। রাজাদের এই অনুনয় এবং আগ্রহ দেখে কুন্তিভোজ বুঝলেন–মেয়ের বিয়ে দেবার সময় হয়েছে এবার। সুপাত্রের আধিক্য থাকলে স্বয়ংবর সভার আয়োজনই সবচেয়ে সুবিধেজনক–এই ভেবেই একটি স্বয়ংবর-সভাতে কুন্তীকে স্থাপন করার ইচ্ছে করলেন কুন্তিভোজ। এতে কুন্তী তার নিজের মনোমত পাত্র নির্বাচন করার সুযোগ পাবেন; কুন্তিভোজকে কোনও দোষ দেবার কিছু থাকবে না।

অন্যদিকে জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে হয়ে যাবার পূর্বেই কিন্তু কৌরব-ধুরন্ধর মহামতি ভীষ্ম যদুবংশীয়া কুন্তীর খবর পেয়ে গেছেন। মুনি-ঋষি, ব্রাহ্মণ-সজ্জনের কাছে ভীষ্ম এই কন্যার রূপ-গুণের খবর তত পেয়েছেনই, এমনকি পুত্রলাভের উপায়টি যে তার স্বাধীন, সে কথাও তিনি শুনে থাকবেন। আমরা জানি–শান্তনুর পুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্যকে নিয়ে তার যা সমস্যা গেছে, তারপর থেকে পুত্রলাভের ব্যাপারে তিনি আর কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। গান্ধারী মহাদেবের কাছে শত পুত্ৰ-লাভের বর পেয়েছেন, এটা যেমন ভীষ্মের কাছে একটা প্লাস পয়েন্ট, তেমনি কুন্তীর বর লাভের কথাটাও তার জানা ছিল বলেই মনে হয়। গান্ধারীর বরলাভের কথাটা যে ভীষ্ম জানতেন, সেটা মহাভারতের কবি স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু কুন্তীর বরলাভের কথাটাও যে ভীষ্ম জানতেন, সেটা কবি স্বকণ্ঠে বলেননি।

তবে আমাদের ধারণা ভীষ্ম জানতেন। ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর বিবাহের বিষয়ে বিদুরের সঙ্গে যখন আলোচনা হল, তখন যাদবী কন্যা কুন্তী এবং গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা গান্ধারীর কথা প্রস্তাব করেই তিনি নিজের মত জানিয়ে বলেছিলেন–আমার মনে হয় এঁদেরই বরণ করে নিয়ে আসা উচিত এবং তা উচিত কুরুবংশের সন্তানলাভের জন্য–সন্তানার্থং কুলস্যাস্য য বা বিদুর মন্যসে। শান্তনুর করুণ দৃষ্টান্তে একটি-দুটি সন্তানের জন্মে আর তুষ্ট হল না ভীষ্ম। তাই তিনি চেয়েছিলেন–শান্তনুর বংশের বৃদ্ধি হোক সাগরের মতো–তস্যৈত বর্ধতে ভূয়ঃ কুলং সাগর যথা।

আপন বংশের সাগরবৎ বৃদ্ধি কামনা করেই ভীষ্ম যখন কুন্তী এবং গান্ধারীকে কুরুবাড়ির পুত্রবধূ হিসেবে বরণ করার কথা ভেবেছেন, তখন এই ধারণাই প্রবল হয়ে ওঠে যে, গান্ধারীর মতো কুন্তীর মন্ত্রলাভের কথাও তিনি জানতেন। আর জানবেনই বা না কেন, দুর্বাসার কাছে কুন্তী পুত্রলাভের সিদ্ধমন্ত্র পেয়েছেন, একথা কি কুন্তিভোজ জানতেন না? তাছাড়া কেউই যদি জেনে থাকেন, তবে দুর্বাসাই সবাইকে জানাবেন। দুর্বাসার চরিত্রই সেইরকম। পুরাণ-ইতিহাসে দুর্বাসার চরিত্র সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে চৈতন্য-পার্ষদ রূপ গোস্বামী তার একটি নাটকের মধ্যে তাঁর এক নায়িকার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন–দুর্বাসা কি কখনও নিজের-করা উপকার না জানিয়ে থাকতে পারেন–কিং দুর্বাসা নিজোপকার অনাবেদ্য তিষ্ঠতি?

দুর্বাসার এই চারিত্রিক গঠনের নিরিখেই আমাদের মনে হয়–ঘটনাটা ভীষ্মেরও জানা ছিল। যে কারণে কন্যাদের বিবরণ দেবার সময় গান্ধারীর নাম করার আগেই তিনি কুন্তীর নাম করে বিদুরকে বলেছেন–যাদবদের মেয়ে কুন্তীর কথা আমরা শুনেছি, সে আমাদের বংশের উপযুক্ত হবে–শ্রয়তে যাদবী কন্যা স্বানুরূপা কুলস্য নঃ। অর্থাৎ এ কন্যাটি যে তার বংশের সাগরবদ-বৃদ্ধির সহায় হবে, সেটা ভীষ্মের জানা ছিল। হয়ত জানা ছিল আরও একটি কথাও। মহাভারতে পাণ্ডু এক মুনির শাপে প্রজনন ক্ষমতা হারান। কিন্তু এখানে অভিশাপের অলৌকিকতা ছেটে ফেললে দাঁড়ায়–পাণ্ডুর প্রজনন ক্ষমতা ছিল না। ভীষ্ম কি পাণ্ডুর এই অসামর্থ্যের কথাও জানতেন? আমাদের ধারণা জানতেন বলেই তিনি এমন একটি রমণীকে পুত্রবধূ করে ঘরে নিয়ে আসতে চেয়েছেন, পুত্রলাভের ক্ষমতা যাঁর নিজের অধীন–তিনি স্বাধীনোপায়া।

এবারে রাজনৈতিক তাৎপর্যের কথাতেও আসি। বেচারা কুন্তিভোজ! তিনি এত আড়ম্বর করে এত স্নেহে কুন্তীকে মানুষ করলেন, কিন্তু তার দেওয়া নামটি ছাড়া লোকে তাকে যাদবী কন্যা বলেই জানে। ঠিক সেই সময়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে রাজনীতির যে পালা বদল চলছিল, তাতে এই বিবাহের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকবে না, তা আমরা মনে করি না। মথুরায় তখন কংসের অত্যাচার চলছে। মহারাজ আর্যক শূরের প্রথম পুত্র বসুদেব তখনও কংসের কারাগারে বন্দি না হলেও তার ওপরে রাজরোষ দিনে দিনে বাড়ছিল। হস্তিনাপুরের কুরুরাজ্য তখন উদীয়মান শক্তি। মহামতি ভীষ্মের প্রত্যক্ষ শাসনে পূর্বেই হস্তিনাপুরের উন্নতি ঘটেছে। এখন নতুন রাজা পাণ্ডুর পরিচালনায় হস্তিনাপুরের আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে বলে বোঝা যাচ্ছিল।

সবচেয়ে বড় কথা, হস্তিনাপুর মোটামুটি মহারাজ জরাসন্ধের পার্শ্বরাজ্য। জরাসন্ধের অসাধারণ প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও এই রাজ্য তিনি আক্রমণ করেননি অথবা আক্রমণ করে দমিত করার সাহস পাননি। অথচ জরাসন্ধের জামাতা কংস তখন মথুরায় তাণ্ডব চালাচ্ছেন। আর্যক শূরের প্রথম পুত্র বসুদেব প্রায় ঘরছাড়া এবং তিনি কংসের বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা। কোনও সন্দেহ নেই–হস্তিনাপুরের উদীয়মান রাজশক্তির সঙ্গে প্রথমে গাঁটছড়া বাঁধবার চেষ্টা করেন বসুদেবই। মহারাজ শান্তনুর ভাই বাহ্লীকের পাঁচ মেয়েকে তিনি বিয়ে করলেন এবং হরিবংশ তাদের পরিচয় দিয়েছে পুরুবংশের মেয়ে পৌরবী বলে, যদিও বাহক কিন্তু হস্তিনাপুরে থাকতেন না। পুরু-কুরু-ভরতবংশের সুনাম জড়িত থাকায় পৌরবী কন্যা রোহিণীর নাম যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, একইভাবে কুন্তিভোজের ঘরে মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ভীষ্মের কাছে কুন্তীর যাদবী কন্যার পরিচয়টিও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা–এই যাদবী কন্যার খবর মথুরার বিরোধী নায়ক বসুদেবের মাধ্যমেও ভীষ্মের কাছে এসে থাকতে পারে।

সে যাই হোক, মহারাজ কুন্তিভোজ কৃতীর বিবাহের জন্য স্বয়ংবর-সভার আয়োজন করলেন। তবে মনে রাখতে হবে–এই স্বয়ম্বরের আয়োজনের মধ্যেও কিছু রাজনীতি থাকে, অনেক রাষ্ট্রের রাজা যখন একটি মেয়ের পেগুণে মোহিত হয়ে সকলেই তাঁকে একযোগে প্রার্থনা করতে থাকেন, তখন রাজনৈতিক কারণেই স্বয়ংবরের আয়োজন করতে হয়। পার্শ্ববর্তী বা ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের রাজাদের কেউই এতে ক্ষুণ্ণ বোধ করবেন না, কারণ মেয়ে নিজে একজনকে স্বামী হিসেবে মনোনীত করেছে। আমরা দেখেছি, কুন্তিভোজের এই সমস্যা হচ্ছিল এবং সেইজন্যেই তিনি স্বয়ম্বরের আয়োজন করেছেন–পিত্রা স্বয়ংবরে দত্তা দুহিতা রাজসত্তম।

কিন্তু এই স্বয়ংবরের নিয়মের মধ্যেই আবার একটি অলিখিত অনিয়মও থাকে। ধরুন, কন্যার পিতা, মাতা, অথবা স্বয়ং কন্যাই কোনও রাজপুত্রকে স্বামিত্বে বরণ করতে চান, অথচ অন্যান্য রাজা বা রাজপুত্র একই কন্যার পাণিপ্রার্থী, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমস্যা মেটানোর জন্য স্বয়ংবরের আয়োজন হয় ঠিকই, কিন্তু কাজটি হয়ে যায় অন্য চালে। অর্থাৎ কন্যার পিতা-মাতা অথবা স্বয়ং কন্যার পছন্দসই সেই যুবক স্বয়ংবরের নিয়মে স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হন–সবার সঙ্গে একই পংক্তিতে। কিন্তু সময়মতো কন্যা পরমশোভিতা হয়ে, হাতে ফুলের মালাটি নিয়ে এ রাজা, সে রাজপুত্রকে খানিক দেখে, খানিক ঘুরে নিজের অভীতি পুরুষটির গলায় মালা দিয়ে দেন। এতে অন্য রাজাদেরও কিছু বলবার থাকে না, আবার অভীষ্ট কাজটিও হয়ে যায়।

 হস্তিনাপুরের নতুন রাজা পাণ্ডুর বিবাহও এইভাবেই হল বলে মনে হয়। ভীষ্ম পূর্বাহ্নেই যাদবী কন্যা কুন্তীর খবর পেয়েছেন এবং যথাসময়ে স্বয়ংবর-সভার দিনে পাণ্ডু উপস্থিত হলেন কুন্তিরাষ্ট্রে কুন্তিভোজের সভায়। স্বয়ংবর-সভায় সারি সারি বসে আছেন রাজারা। পাণ্ডুও বসে আছেন তাদের সঙ্গে। মহাভারতের কবি প্রাপুর রাজমাহাত্ম্য ব্যক্ত করার জন্য এই মুহূর্তে পাণ্ডুর ঈষৎ রূপ বর্ণনা করেছেন। সিংহের ঐর্তে তার তেজ, বিশাল বক্ষঃস্থল–ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু হঠাৎ এই উপমাটি কেন? কবি বললেন–সূর্য যেমন আপন প্রভায় সমস্ত গ্রহতারার দ্যুতি তিরোহিত করেন, পাণ্ডুও তেমনই আপন রাজমহিমায় সমস্ত রাজার কান্তি আচ্ছাদন করলেন বেন–আদিত্যমিব সর্বের্যাং রাজাং প্রচ্ছদ্য বৈ প্রভাঃ।

 কুন্তীর পূর্বজন্মের স্মৃতির মতো এ কোন এক অবিস্মরণীয় শব্দ ব্যবহার করলেন মহাভারতের কবি-সূর্যের মতো, আদিত্যমিব সর্বের্যা। কুন্তীর প্রথম প্রেম, কৈশোর যৌবনের সন্ধিলগ্না সেই অবিস্মৃত ছায়া। সমস্ত রাজকুলের মধ্যে পাণ্ডুকে যখন দেখতে পেলেন কুন্তী–দদর্শ রঙ্গমধ্যস্থং তেযাং রাজ্ঞাং মনস্বিনী–তখন এই অপূর্বদেহী রাজপুত্রের মধ্যে তাঁর প্রথম প্রেমের ছায়া দেখতে পেলেন নাকি কুন্তী? সূর্যের দেওয়া কানীন পুত্রটিকে নিয়ে যে সমস্যায় তিনি আহত হয়েছিলেন, তারই প্রতিক্রিয়ায় যখন আচার-ব্রতপরায়ণা হয়ে উঠেছিলেন কুন্তী, সেই কুন্তী যে পাণ্ডুকে দেখে এমন আকুল হয়ে উঠলেন, তার একমাত্র কারণ এই সিংহদর্প পুরুষটির মধ্যে তাঁর প্রথম প্রেমের ছায়া দেখতে পেলেন কুন্তী। তাঁর মন চলে গেল সেই কন্যান্তঃপুরের হপ্রকোষ্ঠে, গবাক্ষপথে রক্তিম সূর্যের সন্নিধানে।

পাণ্ডুকে দেখামাত্রই কুন্তীকে দেখছি–তিনি কামনায় আকুল, তার মন চঞ্চল হচ্ছে কুমারীর প্রথম পুরুষ-দর্শনের বিহ্বলতায়–ততঃ কামপরীতাঙ্গী সকৃৎপ্রচলমান। সংস্কৃত শ্লোকে সকৃৎ শব্দটির অর্থ একবার। তারপরে আছে প্রচল-মানসা। এর অর্থ পণ্ডিতেরা করেছেন চঞ্চলচিত্তা। আমাদের তা মনে হয় না। আমাদের ধারণা–একবারের জন্য অন্তত তার মন চলে গেল অন্য কোনওখানে–সকৃৎপ্রচলমানসা। অন্য কোনওখানে? যেখানে বিশাল গবাক্ষপথে রক্তিম সূর্য এসে তার হস্ত ধারণ করেছিলেন, তার শরীর ভিক্ষা করেছিলেন? আর এইসব কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাণ্ডুর জন্য তার হৃদয়ে কামনা জেগেছে, লজ্জায় অধোমুখী হয়ে কোনওমতে তিনি স্বয়ংবরের মালা জড়িয়ে দিয়েছেন রাজশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুর গলায়–ব্রীড়মানা স্ৰজং কুন্তী রাজ্ঞঃ স্কন্ধে সমাসৃজৎ।

আমাদের আরও ধারণা–পাণ্ডুর কথা আগে সবিস্তারে শুনেছেন কুন্তী এবং আগে থেকে যেন ঠিক করাই ছিল–তিনি পাণ্ডুর গলায় মালা দেবেন। সেইজন্যই তার এত লজ্জাও বটে, হৃদয়ের এত আকুলতাও বটে। আপনারা মানবেন কিনা জানি না–একজন অপরিচিত যুবতী যদি বিবাহবাসরে অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে শুভদৃষ্টি করে, তবে সে যত লজ্জা বোধ করে, তার চেয়ে অনেক বেশি লজ্জা বোধ করে সেই যুবতী যে পূর্বাহ্নেই যুবকের পরিচিতা। কোনো আয়োজিত বিবাহ-বাসরে অপরিচিত যুবক-যুবতীরা এটা বুঝবেন না। আমাদের তাই ধারণা–ভীষ্ম যেভাবে যাদবী কন্যার কথা শুনে এই বিবাহে অগ্রসর হয়েছেন, তাতে এই যাদবী কন্যাটিও হস্তিনাপুরের এই নবযুবকের কথা পূর্বাহ্নেই শুনে থাকবেন এবং বিবাহ-বাসরে তাই তার এই আকুল মনের শোভা দেখছি আমরা–পাণ্ডুং নববরং রঙ্গে হৃদয়েনাকুলাভবৎ। পাণ্ডুর গলায় মালা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত রাজারা যেমন সুড়সুড় করে চলে গেলেন, তাতে আমাদের এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়–যথাগতং সমাজগুগজৈরশ্বৈ রথৈস্তথা।

.

৭৬.

কুন্তী পাণ্ডুর গলায় বরমাল্য পরিয়ে দেবার পরেই সাড়ম্বরে বিবাহের আয়োজন করলেন মহারাজ কুন্তিভোজ। অনুষ্ঠানের কোনও ত্রুটি রইল না। জামাতা পাণ্ডুকে হীরা-মণি-মাণিক্যের অলঙ্কার যৌতুক দিয়ে সালংকারা বধূকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন হস্তিনাপুর–স্বপুরং প্রেষয়ামাস স রাজা কুরুসত্তমম্। হাতি-ঘোড়া-পদাতিকের বিশাল সৈন্যবাহিনীর হাতে যুদ্ধাস্ত্রের বদলে ধ্বজ-পতাকার বাহার দেখা গেল। ব্রাহ্মণ-ঋষিরা পাণ্ডুকে দেখে মঙ্গল-মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। পাণ্ডু সাদরে প্রথমা কুলবধূকে নিজভবনে প্রবেশ করালেন–ন্যবেষয়ত তাং ভার্যাং কুন্তীং স্বভবনে প্রভুঃ।

 এই স্বয়ংবর বিবাহের রেশ কাটতে না কাটতেই পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহের জন্য প্রস্তুতি নিলেন মহামতি ভীষ্ম। মদ্ররাজকন্যা মাদ্রীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিবাহ দেবার জন্য তিনি নিজে উপস্থিত হলেন মদ্ররাজ্যে। আপাতত পাণ্ডুর এই দ্বিতীয় বিবাহের কারণ কিছু বোঝা না গেলেও, এর পিছনে ভীষ্মের কিছু তর্কও কাজ করেছে। আমরা আগেই বলেছি–পাণ্ডুর শারীরিক সমস্যা অথবা পুত্রোৎপাদনে তার অসামর্থ্যের কথা ভীষ্ম হয়ত কিছুটা জানতেন। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনও খবর তার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। এই কথঞ্চিৎ জানা থাকা এবং সম্পূর্ণ না-জানার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভীষ্ম পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহের পাত্রী ঠিক করতে গেলেন।

এখানে তার ঈপ্সিত সাধ্য দুটি। দুটি বিবাহিতা স্ত্রী থাকলে পুত্র-সন্তান লাভের সম্ভাবনা থাকে দ্বিগুণ। দ্বিতীয়ত স্বয়ংবরলব্ধা স্ত্রী পুরাতনীতে পরিণত হলে তার ব্যক্তিত্বে দ্বিতীয় বিবাহের সম্ভাবনা কথঞ্চিৎ যদি ক্ষীণ হয়ে যায়, তাই পাণ্ডু কুন্তীকে নিয়ে রাজভবনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তার দ্বিতীয় বিবাহের আড়ম্বর শুরু করেছেন স্বয়ং ভীষ্ম–বিবাহস্যাপরস্যার্থে চকার মতিমান মতি। ব্রাহ্মণ-পুরোহিত আর হস্তিনাপুরের কিছু মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভীষ্ম উপস্থিত হলেন মদ্রদেশে।

 মদ্র জায়গাটাকে কখনই যেন এখনকার ম্যাড্রাস বলে ভুল করবেন না। মাদ্রীর জন্মভূমি এই মদ্রদেশকে চিনতে হলে এখন আমাদের পাকিস্তানের মানচিত্র খেয়াল করতে হবে। পাকিস্তানে শিয়ালকোট বলে যে বিখ্যাত স্থানটি আছে, সেই শিয়ালকোটই ছিল তখনকার মদ্রদেশের রাজধানী। শিয়ালকোটের প্রাচীন নাম শকল! বৈয়াকরণ পাণিনি শকল-দেশের কথা উল্লেখ করেছেন সাঙ্কল বলে। কিন্তু খোদ মহাভারতেই শকল-দেশকে মদ্রদেশের কেন্দ্রীয় ভূমি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে–ততঃ শাকলমভ্যেত্য মদ্রাণাং পুটভেদন। মদ্রদেশের রাজধানীই যে শকল তার আরও একটা বড় প্রমাণ হল বৌদ্ধগ্রন্থ মিলিদপহ। গ্রীকো-ব্যাকট্রিয় রাজা মিনান্দার ছিলেন এই মদ্রদেশের (মদ্দদেশের) রাজা এবং তার রাজধানীর নাম সাগল। অর্থাৎ সেই শকল।

যা দাঁড়াল, তাতে মদ্রদেশ হল চিনাব এবং রাভি নদীর জল-ধোয়া দোয়াব অঞ্চল এবং সেটাই পাঞ্জাবের মধ্যভূমি। মহামতি ভীষ্ম তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হস্তিনাপুর থেকে এসে পৌঁছলেন এই মদ্রদেশে, সেখানকার রাজা হলেন শল্য। তিনি মাদ্রীর বড় ভাই। কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীষ্মের আগমনবার্তা শুনেই শল্য খানিক দূর এগিয়ে এসে তাকে আমন্ত্রণ অভিনন্দন জানালেন। পাদ্য-অর্ঘ্য, আসন, মধুপর্ক দিয়ে মদ্রদেশে বরণ করে নিলেন তাঁকে। ভীষ্ম জানালেন–আমি এসেছি তোমার বোনটিকে আমাদের ঘরের বধূর সম্মান জানাতে। তার কথা আমি অনেক শুনেছি। তার চরিত্র এবং অসামান্য রূপের কথাও আমার যথেষ্ট কানে। এসেছে–য়তে ভবতঃ সাধ্বী স্বসা মাদ্রী যশস্বিনী। আমি আমার পুত্ৰকল্প পাণ্ডুর জন্য তাকে বরণ করতে চাই।

একটি রাজবাড়ির সঙ্গে আরেকটি রাজবাড়ির পুত্র-কন্যার বিবাহে দুই রাজবংশের মান্যতা এবং সমতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। ভীষ্ম যখন পাণ্ডুর বিবাহ-সম্বন্ধ নিয়ে মদ্রদেশে গেছেন, তখন মদ্রদেশের রাজনৈতিক মান্যতা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ইংরেজিতে যাকে ইমপেরিয়াল ইউনিটি বলে তার সূত্রপাত তখনও ভারতবর্ষে ঘটেনি। কিন্তু আর্যরা কাশ্মীর-পাঞ্জাব ছেড়ে হস্তিনাপুর, মথুরা, এমনকি মগধেও তাদের শক্তি কেন্দ্রীভূত করবার সঙ্গে সঙ্গেই অতি-উত্তরের এক প্রান্তিক দেশগুলির সাংস্কৃতিক মর্যাদা কমতে থাকে। মদ্রদেশ একসময়ে বৈদিক সংস্কৃতি এবং আচার-নিষ্ঠার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে, বিশেষত মহাভারতের সময়েই মদ্রদেশের এই মর্যাদা নষ্ট হয়ে গেছে।

লক্ষণীয় বিষয় হল, মহাভারতের সময়েই মদ্রদেশের রাজনৈতিক স্থিতি আর্যভূখণ্ডের মতো রাজনির্ভর নয়। মদ্ররা একটি পৃথক জনজাতি, একটি গোষ্ঠী, যাঁদের মহাভারতীয় মতে গণ বলাই ভাল–যৌধেয়ান্ মালবান্ রাজ মদ্ৰকানাং গণা যুধি। মনে রাখতে হবে, হস্তিনাপুরের রাজজ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ে হল গান্ধারে। এই গান্ধার দেশের সংস্কৃতিও পুরাতন ঐতিহ্যবাহী এবং গান্ধারও আর্যদের প্রাচীন ভদ্রাসন। অন্যদিকে কুন্তী যে বংশের মেয়ে, সেই বংশ রাজনির্ভর নয়, সেটাও একটা বিশেষ জনগোষ্ঠী এবং তারাও গণ-শাসনে চলেন। অর্থাৎ পাণ্ডুর বিয়ে হল দুটি গণ-শাসিত রাজ্যের মেয়েদের সঙ্গে। মদ্র-জনজাতির দ্বারা অধ্যুষিত মদ্রদেশ কিন্তু পাঞ্জাব অঞ্চলের সামান্য অংশমাত্র। গোটা পাঞ্জাব অঞ্চলে অন্তত বেশ কয়েকটি জন-জাতির বাস ছিল–যেগুলির মধ্যে মদ্র জনগোষ্ঠী একটি এবং এদের সকলকে একসঙ্গে বাহ্লীক বলা হত–পঞ্চানাং সিন্ধুসংস্থানাং নদীনাং যেরাশ্রিতাঃ/… বাহীকান্ পরিবর্জয়েৎ। বাহ্লীকদের সম্বন্ধে মহাভারতে অজস্র গালাগালি আছে এবং সে গালাগালি বাহীকদেশের অন্তরাশ্রিত মদ্রদেশের গায়েও লাগে। আমরা সে কথায় পরে সময়মতো আসব। ভায় যখন মদ্রদেশে গেছেন, তখন কিন্তু তিনি তাদের পূর্বতন আর্য ঐতিহ্যের কথা মনে রেখেই গেছেন। অপিচ এই ঐতিহ্যের কথা মনে রেখেই ভীষ্ম বলেছেন–বিবাহ-সম্বন্ধ করার পক্ষে আপনি যেমন আমাদের যোগ্য, তেমনি আমরাও আপনার যোগ্য–যুক্তরূপো হি সম্বন্ধে ত্বং নৌ রাজ বয়ং তব। এই কথা মনে রেখেই আপনি আমাদের অভিলাষ সফল করুন। আপনার ভগিনীকে তুলে দিন মহারাজ পাণ্ডুর হাতে।

 মদ্ৰাধিপতি শল্য ভীষ্মের কথা শুনে সাদরে বললেন–আপনার বংশের একটি পাত্রের সঙ্গে আমার ভগিনীর বিবাহ হবে, এর চেয়ে ভাল সম্বন্ধ আর আমি কোথায় পাবন হি মেনন্যা বরঃ ত্বত্তঃ শ্রেয়ানিতি মতির্মম? মদ্ৰাধিপতি শল্য হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির সঙ্গে বিবাহ-সম্বন্ধ ঘটানোয় যথেষ্ট আগ্রহী, কিন্তু মদ্র রাজবাড়িতে বিবাহের ক্ষেত্রে এমন একটি কুলাচার প্রচলিত আছে, যাতে তিনি যথেষ্ট সংকোচ বোধ করছেন। এমনকি মদ্ৰাধিপতি সেই কুলাচারের কথা ভাষায় প্রকাশ করতেও সংকোচ বোধ করছেন। মদ্ররাজ বললেন–এমন ভাল বিবাহ-সম্বন্ধ, সত্যিই আমার কিছুই বলবার নেই। কিন্তু আমাদের বংশে বাপ-ঠাকুরদারা একটা নিয়ম চালু করে গিয়েছিলেন,–পূর্বং প্রবর্তিতং কিঞ্চিৎ কুলে স্মিন্ নৃপসত্তমৈঃ–সে নিয়ম ভাল হোক বা মন্দ হোক, আমি তাদের অধস্তন হয়ে সে নিয়ম অতিক্রম করি কী করে? তা ছাড়া সে নিয়মের কথা আপনিও ভালভাবে জানেন। আপনি জ্ঞানী ব্যক্তি, আপনি জানেন না, তা তো হতে পারে না–ব্যক্তং তদ্ভবতশ্চাপি বিদিতং নাত্র সংশয়ঃ। কাজেই এবার আমি যদি বলি–আমায় কিছু দিন–সেটা নিতান্তই অভদ্র শোনায়ন চ যুক্তস্তথা বক্তুং ভবান্ দেহীতি সত্তম।

আমায় কিছু দিন–কথাটা শুনতে আমাদের যেমন লাগছে, ভীষ্মেরও তেমনি লাগার কথা। আসলে আমরা সকলেই বর-পণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, কিন্তু কন্যাপণের কথা বেশি শোনা যায় না। বিবাহের সময় বরপক্ষ যৌতুক নিচ্ছে, এটা তত অশ্রুতপূর্ব কথা নয়, কিন্তু কন্যার বাপ-ভাইকে টাকা-পয়সা যৌতুক দিয়ে মেয়ে নিয়ে আসার ঘটনা তত প্রচলিত নয়। কন্যাপণের ঘটনাটা আর্যপুরুষদের মধ্যে খুব একটা প্রশংসনীয় দৃষ্টিতে দেখা হত না। তথাকথিত অবরজ জনজাতির মধ্যে এই প্রথা চালু ছিল এবং এখনও তা কোথাও কোথাও আছে। আধুনিক শিষ্ট সমাজের কোনও কোনও বাড়িতে কন্যাকে সাত পাক ঘোরানোর জন্য বিয়ের পিড়িতে ওঠানোর সময় দেখেছি–কন্যার পিতা সলজ্জে বলেন–একটি রৌপ্যমুদ্রা দিতে হবে, তবেই কন্যাকে নিয়ে যাওয়া যাবে বিবাহ-বাসরে। টাকার অঙ্ক বেশি নয় বলে বরপক্ষ বিনাবাক্যে এই প্রথা মেনে নেন বটে। কিন্তু মনে রাখতে হবে–এই প্রথা কন্যাপণের স্মারক।

আমাদের স্মৃতিশাস্ত্রমতে যে আটরকমের বিবাহ প্রচলিত আছে, তার মধ্যে আর্যবিবাহের মধ্যেও এই রকম একটা রীতি আছে। তাতে বরের কাছ থেকে একটি গোরু এবং একটি বৃষ অথবা দুই জোড়া যাঁড় নিয়ে কন্যার পিতা কন্যা-সম্প্রদান করতেন–একং গোমিথুনং দ্বে বা বরাদাদায় ধর্মতঃ। কিন্তু সেখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল–যুগ-যজ্ঞের সুবিধের জন্যই কন্যার পিতা গোরু-ষাঁড়গুলি নিচ্ছেন। অন্যদিকে কন্যার পিতা বা ভাইকে টাকা-পয়সা দিয়ে কন্যাগ্রহণ করাটা ছিল রীতিমতো আসুর বিবাহ। আসুর বিবাহের রীতি ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় এই দুই উচ্চবর্ণের মধ্যেই যথেষ্ট প্রচলিত ছিল–ষড়ানুপূৰ্য্যা বিপ্রস্য ক্ষত্রস্য চতুরোবরা। কিন্তু প্রচলন বা অধিকার যতই থাকুক এই বিবাহের মধ্যে নিন্দাও ছিল যথেষ্ট। শাস্ত্রকারেরা বলেছেন–যতই তোমার অধিকার থাকুক–আসুর বিবাহ এবং পৈশাচ বিবাহের মধ্যে খবরদার যেও না বাপু, বড় খারাপ জিনিস–পৈশাচশ্চাসুরশ্চৈব ন কর্তব্যৌ কদাচন।

মদ্ৰাধিপতির সংকোচও এই কারণেই। তিনি সসঙ্কোচেই ভীষ্মকে বলেছেন–কী করি? আমাদের বংশে এই প্রথা চালু আছে। কুলাচার বলে কথা। আমাকেও তাই মানতে হবে কুলধর্মঃ স নো বীর প্রমাণং পরমঞ্চ যৎ। এমন কথা শুনলে আধুনিককালেও আমরা যা করি, অর্থাৎ আরে মশাই, নিয়ম আছে কী করা যাবে–এই নিন আপনার রৌপ্যমুদ্রা, মেয়েকে নিয়ে আসুন, আর দেরি নয়–ঠিক সেই রকম একটা মেজাজেই সম্পূর্ণ ব্যাপারটা লঘু করে দিয়ে ভীষ্ম বললেন–আরে মশাই। কুলধর্ম যে সবচেয়ে বড় ধর্ম সে কথা যে পিতামহ ব্রহ্মই বলে দিয়েছেন–ধর্ম এষ পরো রাজন্ স্বয়মুক্তঃ স্বয়ম্ভুবা–এতে আপনার কোনও দোষই নেই। আপনার পূর্বপুরুষেরা একটা নিয়ম করে গেছেন, সেটা না মানলে চলে নাকি–নাত্র কশ্চন দোষোস্তি পূর্বৈ–বিধিরয়ং কৃতঃ। আপনাদের এই নিয়ম আমরা জানিও বটে, আর নিয়মটা অপ্রচলিতও কিছু নয়–মর্যাদা সাধুসম্মতা। আপনি কোনও সংকোচ করবেন না।

 ভীষ্ম আর বেশি কথা না বলে–সোনা দানা, মহার্ঘ বস্ত্র, অলংকার, মণিমাণিক্য– এসব তো দিলেনই, কারণ এগুলো দিয়েই মেয়ে সাজানো হবে, অন্যদিকে আপন ক্ষত্রোচিত মর্যাদায় হাতি, ঘোড়া, রথও অনেক তুলে দিলেন শল্যের হাতে–শল্যায়াদাৎ সহস্রশঃ। শল্য সব কিছু সানন্দে নিলেন, তারপর সালংকারা মাদ্রীকে তুলে দিলেন তার শ্বশুরকল্প ভীষ্মের হাতে দদৌ তাং সমলংকৃত্য স্বসারং কৌরবর্ষভে। ভীষ্ম মাদ্রীকে নিয়ে সাড়ম্বরে রওনা দিলেন হস্তিনায়। তারপর শুভদিন দেখে যথাবিধানে পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ করালেন মাদ্রীর।

কুন্তীর জন্যও যেমন ঘর ঠিক ছিল, তেমনি মাদ্রীর জন্যও একটি নতুন ভবন নির্মিত হল। দুই রূপবতী ভার্যার সঙ্গে শৃঙ্গার-সুখে দিন কাটাতে লাগলেন পাণ্ডু–কু্যা মাদ্র্যা চ রাজেন্দ্র যথাকামং যথাসুখম্।

ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার হল–নূতন বিবাহের পর পাণ্ডুর এই রতিসুখ মাত্র একমাসের–ততঃ স কৌরবো রাজা বিহৃত্য ত্রিদশা নিশাঃ। তিরিশ নি যাবার পরেই মহারাজ পাণ্ডু দিগবিজয়-যাত্রার ঘোষণা করেছেন। কোনও সন্দেহ নেই যে, হস্তিনাপুরের মতো এক উদীয়মান রাজশক্তির দিগ্বিজয়-যাত্রা রাজনৈতিক কারণেই অত্যন্ত জরুরী। মহারাজ শান্তনুর পর হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে এমন মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ এখনও আসেননি যিনি সমগ্র ভারতবর্ষের কাছে হস্তিনাপুরের মর্যাদা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। পাণ্ডু রাজা হয়েছেন, তাঁর বিবাহাদিও সম্পন্ন হয়েছে। অতএব রাজা হিসেবে এখন তাঁর প্রয়োজন–হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং তার একমাত্র উপায় দিগবিজয় যাত্রা।

 ঠিকই আছে। পাণ্ডু দিগবিজয়ে বেরচ্ছেন–সেটা যুক্তির দিক দিয়ে ঠিকই আছে। কিন্তু সেই মহাভারতের কবি–পাণ্ডু বিবাহের পরে মাত্র তিরিশটা রাত্রি রতিবিহারে কাটিয়েছেন–বিহৃত্য ত্রিদশা নিশাঃ–এই কথাটা এমন অঙ্গুলিসংকেত করে তিনি জানালেন, তাতে আমাদের মতো মানুষের মনে কিছু সন্দেহ জাগে। সন্দেহ জাগে–রতিবিহারের কালে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি তো যাতে দুই স্ত্রীর কাছে তার কোনও অসামর্থ্য ধরা পড়ে? মহাভারতের কবি পাণ্ডুকে দিবিজয়ে পাঠিয়ে ফিরিয়েও এনেছেন একসময়ে। কিন্তু তার পরেই পাণ্ডু যুদ্ধ-শ্রমের কারণেই বন্যাত্রা করবেন এবং সেইখানেই কিমিন্দম মুনির অভিশাপ নেমে আসবে পাণ্ডুর ওপর। তিনি প্রজনন-ক্ষমতা হারাবেন।

আমাদের সন্দেহ–মাত্র তিরিশ দিন নববিবাহিতা দুই অতি-সুন্দরী রমণীর সঙ্গে যথাকামে যথাসুখে বিহার করার পর পাণ্ডু যে দিবিজয়ে বেরিয়েছেন–এই দিগবিজয়ী রাজার প্রতিষ্ঠা-বাসনার অন্তরালে এমনই এক সূক্ষ্ম অক্ষমতার বিষয় কাজ করছিল না তো, যা তিনি আপাতত তাঁর পত্নীদের কাছে প্রচ্ছন্ন রাখতে চেয়েছেন। যাই হোক, পাণ্ডু ভীষ্ম প্রমুখ গুরুজনের অনুমতি নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণাম করে দিগবিজয়ে বেরলেন।

পাণ্ডুর দিগবিজয়-যাত্রার কাহিনী এবং বর্ণনা খুব বড় কিছু নয়। লক্ষণীয় বিষয় হল, পাণ্ডু দিগবিজয়ে বেরিয়ে যে সব দেশ জয় করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বড় বড় রাজ্য কিছু নেই। দশার্ণদেশ নাকি পূর্ব থেকে হস্তিনাপুরের বিরাগভাজন হয়েছিল, অতএব দশার্ণদেশকে তিনি বিধ্বস্ত করলেন সবার প্রথমে–পূর্বামাগস্কৃততা গত্বা দশার্ণা সমরে জিতাঃ। এর পরেই দেখছি পাণ্ডুর দিগবিজয়-যাত্রার গতি কিন্তু ভারতবর্ষের পূর্বদিকে। তিনি মগধে গেছেন হস্তিনাপুরের বিজয়কেতন উড়িয়ে। কিন্তু মগধের রাজা জরাসন্ধের সঙ্গে তার কোনও অস্ত্র-বিনিময় হতে দেখছি না। ঐতিহাসিক বিচারে পাণ্ডুর সময়েই জরাসন্ধ শুধুই মগধের রাজা নন, সমস্ত পূর্ব ভারতে তখন তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু হয়ে গেছে এবং পশ্চিম এবং উত্তর ভারতও মগধরাজ জরাসন্ধেরই অনুশাসন মেনে চলে।

আমরা দেখছি–পাণ্ডু মগধে গেছেন এবং জনৈক মগধরাজ দার্বকে তিনি বাড়ির মধ্যেই মেরে ফেলেন–গোপ্তা মগধরাষ্ট্রস্য দার্বো রাজা গৃহে হতঃ। এটা খুবই বীরত্বের কথা, কিন্তু মগধের রাজা হিসেবে দাৰ্ব খুব প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি নন। জরাসন্ধের আগে মগধরাজ্যের কর্ণধার হিসেবে তার নাম আমরা ইতিহাস-পুরাণে খুব একটা পাই না। হয়ত দার্ব মগধরাষ্ট্রের কোনও সামন্ত নৃপতি হবেন অথবা মগধের কোনও প্রান্তিক রাজ্যের ছোট্ট কোনও রাজা হবেন তিনি। মগধের নৈকট্যে মগধরাষ্ট্রের নায়কের অনুষঙ্গ জুটেছে দার্ব বলে অনামী এক রাজার ওপর। দিগবিজয়ের প্রথাগত বর্ণনায় মহারাজ পাণ্ডু মগধ থেকে প্রচুর ধন-রত্ন, হাতি-ঘোড়া নিয়ে বিদেহ, মিথিলা এবং আরও পূর্বে সুহ্ম, পুণ্ড্রবর্ধন জয় করে এসেছেন।

দেখা যাচ্ছে, এই দিগবিজয়ের ভৌগোলিক পথরেখা মোটামুটি পূর্ব দিকে, অবশ্য কাশী–রাজ্যের কথাও এখানে এসেছে। আমাদের ধারণা, মহারাজ শান্তনুর পরে হস্তিনাপুরে যে ধরনের অরাজকতা চলেছিল, তাতে ভারতের পূর্ব দেশের রাজারাই হস্তিনাপুরের কিছু ক্ষতিসাধন করে থাকবেন। এই দিবিজয়ের শেষের দিকে মহাভারতের কবি উল্লেখ করেছেন–যারাই আগে কুরুরাষ্ট্রের ক্ষতি করেছিল, কুরুরাষ্ট্রের ধন অপহরণ করেছিল, মহারাজ পাণ্ড তাদের সবাইকে হস্তিনাপুরের করদ রাজ্যে পরিণত করলেন–

যে পুরা কুরুরাষ্ট্রাণি জহুঃ কুরুধনানি চ।
তে নাগপুরসিংহেন পাণ্ডুনা করদীকৃতাঃ।

এতে বোঝা যায় শান্তনুর পর থেকে পাণ্ডুর সময় পর্যন্ত কুরুরাষ্ট্রে যে অরাজকতা চলেছে, তাতে অনেক ছোট ছোট রাজারাও কুরুরাষ্ট্রের প্রান্তিক দেশগুলির ওপর ছোটখাট আক্রমণ চালিয়েছিলেন এবং জমিজায়গাও কিছু বেদখল করে নিয়েছিলেন। পাণ্ডু দিগবিজয়ে যাত্রা করে বিশাল এক সাম্রাজ্য তৈরি করতে পারেননি নিশ্চয়ই। কিন্তু হৃতসম্পত্তি পুনরুদ্ধার করে তিনি মহারাজ শান্তনুর সুযোগ্য উত্তরাধিকারীতে পরিণত হয়েছেন মাত্র। মহাভারতের কবিও সেই মর্মে তার সমর্থন জানিয়ে বলেছেন যে,–রাজশ্রেষ্ঠ শান্তনু এবং মহারাজ ভরতের কীর্তিকাহিনী প্রায় লুপ্ত হতে বসেছিল–শান্তনোঃ রাজসিংহস্য ভরতস্য চ ধীমতঃ–মহারাজ পাণ্ডু সেই কীর্তি পুনরুদ্ধার করেছেন–প্রণষ্টঃ কীর্তিজঃ শব্দঃ পাণ্ডুনা পুনরাহৃতঃ।

 কতগুলি রাজ্য জয় করে প্রভূত ধন-রত্নের সঞ্চয় সঙ্গে নিয়ে পাণ্ডু হস্তিনাপুরে ফিরলেন। তুরী-ভেরী বেজে উঠল। দেশের রাজা ঘরে ফিরেছেন, পুরবাসী জনপদবাসীরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে পাণ্ডুকে সাভিবাদনে রাজধানীতে ফিরিয়ে আনলেন। পাণ্ডুর কৃতিত্বে ভীষ্মের বুঝি পিতা শান্তনুর কথা স্মরণ হল। তিনি আনন্দে অশ্রুমোচন করতে করতে জড়িয়ে ধরলেন পাণ্ডুকে–পুত্রমাশ্লিষ্য গাঙ্গেয়ো হর্ষাদণ্যবৰ্ষয়ৎ।

ঠিক এই রকম একটা প্রসন্ন মুহূর্তে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কী মানসিক অবসাদ ঘটতে পারে, তা পাণ্ডু জানেন। শুধুমাত্র চক্ষুহীনতার জন্য যিনি রাজা হতে পারেননি, আজ এই বিজয়-মুহূর্তে পাণ্ডু তার বিজয়লব্ধ ধনসম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করার জন্য প্রথমে ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি চেয়েছেন। এমনকি ভীষ্ম, সত্যবতী এবং দুই মাতা অম্বিকা এবং অম্বালিকাকে পাণ্ডু যা দিতে চান, তা তার একান্ত স্বোপার্জিত হলেও, তা দেবার জন্য পাণ্ড ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি চেয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রাভ্যনুজ্ঞাতঃ স্ববাহুবিজিতং ধনম্।

পাণ্ডুর বিজয়লব্ধ ধনসম্পত্তির ভাগ পেলেন সবাই। ভীষ্ম, সত্যবতী এবং দুই মা ছাড়াও পাণ্ডুর কাছ থেকে উপহার লাভ করলেন মহামতি বিদুর। আর ধৃতরাষ্ট্র তো ছোট ভাইয়ের আদরমাখা সম্পত্তি পেয়ে প্রায় অশ্বমেধযজ্ঞের মতো বিশাল বিশাল কতগুলি যজ্ঞকার্যই আরম্ভ করে দিলেন। দান-ধ্যান করলেন প্রচুর–অশ্বমেধশতৈরীজে ধৃতরাষ্ট্রো মহামখৈঃ।

পাণ্ডুর বিজয়-পর্ব এবং এত দানাদানের মধ্যে আমরা এখনও পর্যন্ত একবারও কুন্তী-মাদ্রীর নাম শুনিনি। মহাভারতের কবি যে মুহূর্তে তাদের নাম উচ্চারণ করছেন, তখনি দেখছি তিনি দুই ভার্যার সঙ্গে বনে চলে গেছেন–বভূব বনগোচরঃ। বনে যাবার পিছনে যুদ্ধের পরিশ্রম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আরও কোনও গভীর কারণও থাকতে পারে। তিরিশ রাত্রি ধরে যে স্ত্রীদের সঙ্গে তার যথাকামে যথাসুখে কেটেছে, সম্পূর্ণ দিগবিজয়ের সময় অতিবাহিত হবার পরেও সেই কাম-সুখের কোনও ফললাভ ঘটেনি। পাণ্ডু এর পরেই স্ত্রীদের নিয়ে বনে চলে গেছেন।

 এই অরণ্য-চারণার মধ্যে যুদ্ধশ্রমের অপনোদনের অজুহাত যতই থাকুক, এর মধ্যে পাণ্ডুর লুকিয়ে বেড়ানোর অজুহাতও ছিল বোধহয়, কিন্তু মহাভারতের কবি তা স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করেননি। কেন না পাণ্ডুর প্রজননের অক্ষমতা প্রকট করার জন্য তিনি তখন মহাকাব্যিক রীতিতেই নতুন এক অভিসন্ধি খুঁজে পেয়েছেন। নিজের অসামর্থ্য যাতে প্রকট না হয়ে ওঠে, তার জন্য পাণ্ডু যেই বনে গেছেন, ওমনি মহাকাব্যের কবি এক মুনিকুমারকে হরিণের রূপে উপস্থাপন করেছেন সেই বনেই।

লক্ষণীয়, অরণ্যের ফুল-ফল আর মদির হাওয়ার মধ্যে পাণ্ডু যে খুব রতিসুখে মত্ত ছিলেন, তা মোটেই নয়, কবি তার ক্রান্তদৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছেন–পাণ্ডু বনে গিয়েও সব সময়েই প্রায় মৃগয়া করে বেড়াচ্ছিলেন–অরণ্যনিত্যঃ সততং বভূব মৃগয়াপরঃ।

.

৭৭.

 হিমালয়ের দক্ষিণদিকে জায়গাটা এমনিতে খুব সুন্দর–স চর দক্ষিণং পার্শ্বং রম্যং হিমবতা গিরেঃ। পর্বতের পাদদেশে স্নিগ্ধ সবুজ বনভূমি! বিশাল বিশাল শাল গাছ আর পিয়াল গাছে পার্বত্য শোভা এমনি এক রমণীয় উদ্দীপন তৈরি করেছে যে, পাণ্ডুর মতো নবযুবক তার দুই সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে এইখানে ছাড়া অন্য কোথাও থাকার কথা ভাবতেও পারলেন না–উবাস গিরিপৃষ্ঠেযু মহাশালবনেষু চ। বনে গিয়েও পাণ্ডু যে সদাসর্বদা মৃগয়ায় লিপ্ত হলেন, এটা তার অভ্যাস হতে পারে, ব্যসনও হতে পারে। রাজধর্মজ্ঞ পণ্ডিতেরা মৃগয়া ব্যাপারটাকে ভাল চোখে দেখেননি। রাজার ইতিকর্তব্য বাদ দিয়ে মৃগয়ার মতো অনর্থক পশুহিংসার মধ্যে শরীরের মেদচ্ছেদী ব্যায়ামের অজুহাত যতই থাকুক, প্রাচীন পণ্ডিতেরা এটাকে গভীর অন্যায় বলেই মনে করেছেন। বিশেষত মহাভারতের কবি যে শব্দরাশিতে পাণ্ডুকে বিশেষিত করেছেন–সততং বভূব মৃগয়াপরঃ–তাতে খারাপ কথা না বলেও পাণ্ডুকে তিনি এই দোযে চিহ্নিত করেছেন।

 আমাদের ব্যক্তিগত ধারণার কথা অবশ্য আলাদা। আমরা বলেছি, পাণ্ডুর প্রজনন-ক্ষমতা ছিল না বলে দুই স্ত্রীর কাছে তিনি তার নিজের অসামর্থ্য চেপে রাখবার জন্যই এতটা মৃগয়াব্যসনী হয়ে উঠেছিলেন। তার দুই স্ত্রী অবশ্য পাণ্ডুর এই অসামর্থ্যের কথা জেনে থাকলেও বাইরে সে ভাব প্রকাশ করতেন না। এমনও হতে পারে–তার যৌবনবতী দুই স্ত্রী এখনও তাদের স্বামীর অক্ষমতা সম্বন্ধে ততটা অবহিত নন। মৃগয়ার কাল ছাড়া অন্যসময়ে পাণ্ডুর সঙ্গে তারা ঘুরে বেড়াতেন শৃঙ্গার-রসের সমস্ত পরিচর্যা বহন করেই। মহাভারতের কবি উপমাটিও দিয়েছেন চমৎকার। বলেছেন–দুই যৌবনবতী স্ত্রীর মাঝখানে পাণ্ডুকে দেখে মনে হত যেন দুটি হস্তিনীর মাঝখানে ইন্দ্রের ঐরাবত করেথোরিব মধ্যস্থঃ শ্রীমান্ পৌরন্দরো গজঃ।

আরণ্যক হস্তী এবং হস্তিনী প্রাচীন কবিদের কাছে গভীর শৃঙ্গারের সরসতায় চিহ্নিত। কুন্তী এবং মাদ্রীকে দুটি হস্তিনীর সঙ্গে তুলনা করে মহাকবি বুঝিয়ে দিলেন–তাদের দিক থেকে সরসতায় কোনও অভাব ছিল না। ঐরাবতের স্বাধিকার লাভ করার জন্য এই দুই যৌবনবতী রমণীর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না কোনও। বনচারী মানুষ এই দুই রাজরানীর সঙ্গে অস্ত্রে-শস্ত্রে সদাবৃত পাণ্ডুকে দেখে মনে করত–স্বর্গের দেবতা বুঝি নেমে এসেছে ভয়ে দেবোয়মিতমন্যন্ত চরন্তং বনবাসিনঃ।

ওদিকে পাণ্ডুর বনগমনের পর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রই তার কনিষ্ঠের রাজ্যভার বহন করে চলেছিলেন। জন্মান্ধ হওয়ার ফলে তিনি রাজ্য পাননি বটে, কিন্তু পাণ্ডুর অনুপস্থিতির কারণে হস্তিনাপুরের অমাত্য-সচিবরা তাঁরই আনুগত্যে রাজ্যশাসন চালাচ্ছিল। কনিষ্ঠ ভাই পাণ্ডু বনবিহার করছেন, তার যাতে কোনও কষ্ট না হয়, সেজন্য জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের সদিচ্ছার অন্ত ছিল না। তিনি শক্তিশালী এবং উৎসাহী লোকেদের দিয়ে পাণ্ডুর বিলাসদ্রব্য এবং রাজকীয় খাদ্যবস্তু বনে পাঠিয়ে দিতেন–উপাজহ্বর্নান্তে ধৃতরাষ্ট্রেণ চোদিতাঃ। অবশ্য পাণ্ডুর অনুপস্থিতিতে হস্তিনাপুরের রাজ্যশাসন মনে মনে তিনি আস্বাদন করছিলেন কি না অথবা আস্বাদন করছিলেন বলেই রাজকীয় বিলাসসম্ভার তিনি বনে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন কি না–সে কথা মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করেননি। তবে আমাদের এই সন্দেহ আছে।

 পাণ্ডু যখন বনে এবং ধৃতরাষ্ট্র যখন রাজ্য চালাচ্ছেন, তখন একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেল। মহাভারতের বিশাল মহাকাব্যিক গঠনের মধ্যে মহাভারতের বিচিত্র ঘটনার মধ্যে এই সামান্য ঘটনার কোনও মূল্যই নেই। তবু মহাভারতের কবি ঘটনাটাকে উপেক্ষা করেননি। ব্যাপারটা কিছুই নয়, মহামতি বিদুরের বিবাহ হয়ে গেল।

আপনাদের মনে আছে হয়ত যে, বিদুর হলেন জাতিতে পারশব। ব্রাহ্মণের ঔরসে শূদ্রার গর্ভজাত সন্তানের পারিভাষিক নাম পারশব। বিচিত্রবীর্যের শূদ্রা দাসীর গর্ভে ব্যাসের ঔরস সন্তান হলেন বিদুর। ভীষ্ম তার জন্য একটি পারশবী কন্যা ঘরে নিয়ে আসার কথাই ভাবলেন। স্মার্তরা বলেন–সদৃশীং ভার্যাং বিন্দেত–নিজের অনুরূপ ভার‍্যা সংগ্রহ করো। এই অনুরূপ সেকালের দিনে অবশ্যই খানিকটা জাতিগত; একালের দিনেও তা জাতিগতই বটে, তবে সে জাত পুরোপুরি অর্থনৈতিক। মহাভারতের কালে চাতুর্বর্ণের জাতি-ব্যবস্থায় কড়াকড়ি যেমন ছিল, তেমনি শিথিলতাও কিছু ছিল। এই শিথিলতার জন্যই একজন ব্রাহ্মণের শূদ্রা পত্নীও সামাজিক সম্মান পেতেন। তাদের পুত্রকন্যারাও সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতেন।

আজকের দিনে পুত্র-কন্যার বিবাহ দেবার সময় অনেকে ব্যক্তিগত কথায় বলেন আমাদের কোনও জাত-বিচারের ব্যাপার নেই, কাস্টের কোনও প্রেজুডিস্ নেই, সব চলবে। আমি একজন ব্রাহ্মণ সুপাত্রীর জন্য একটি শূদ্র সুপাত্রের ব্যবস্থা করেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কন্যাকর্তার মত পালটে গিয়েছিল। বলেছিলেন–ঠিক এতটা নয়, এই কায়স্থ-টায়স্থ একজন ভাল পাত্র পেলেই আর কোনও আপত্তি হয় না। আমি তাকে বলেছি এবং এটা অন্যত্রও বলে থাকি যে,–যদি ভালবাসার ঘটনা ঘটে, সেখানে জাতি–বিচারের ভাবনা ভাবার দরকার নেই একটুও। কিন্তু যদি নিজে সম্বন্ধ করে বিয়ে দেন, তাহলে যথাসম্ভব জাত মিলিয়েই দেবেন। কেন না আমাদের সমাজের সংস্কার এবং কুসংস্কার এতটাই বদ্ধমূল যে আপনা থেকেই জাত ভেঙে বিয়ে দিলে পরবর্তীকালে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন অসহ্য সব কথার আদান-প্রদান ঘটে, সামান্য ব্যবহারিক বিচ্যুতিতেই আত্মীয়-স্বজনেরা এমন কঠিন টিপ্পনী কাটেন, যা অনেক সময় ভালবাসাটাই উলটে দেয়। আমরা চাতুর্বর্ণের কোনও মাহাত্মে বিশ্বাস করি না। কিন্তু যা আছে, তা শোধরাতে হলে একটু একটু করেই এগোতে হবে।

মহামতি ভীষ্মও তাই পারশব বিদুরের সঙ্গে একটি পারশবী কন্যার বিবাহ ঠিক করলেন। এই পারশবী কন্যার খোঁজ পাওয়া গেল মহারাজ দেবকের বাড়িতে–অথ পারশবীং কন্যাং দেবকস্য মহীপতেঃ। এই দেবক কৃষ্ণপিতা বসুদেবের শ্বশুর হলেও হতে পারেন। এমনটি হতেই পারে যে,–এই কন্যাটি তার শূদ্রা পত্নীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেও কন্যাটি তার ঔরসজাতা নয় বলে পৌরাণিকেরা দেবকের মেয়েদের মধ্যে এই মেয়েটির গণনা করেননি। দেবকের শূদ্রা পত্নীর গর্ভে এটি এক অজানা অচেনা ব্রাহ্মণের কন্যা।

সেকালের দিনে এমন হতই। রাজার স্বীকৃত ক্ষত্রিয়া পত্নী ছাড়াও রাজরানীদের দাসীরাও রাজাদের ভোগ্যা হতেন। যেমন শর্মিষ্ঠা হয়েছিলেন যযাতির কিংবা বিচিত্রবীর্যের পত্নী অম্বিকার দাসীও বিচিত্রবীর্যের ভোগ্যা ছিলেন। দেবকের এই দাসী-পত্নীটি হয়ত কোনও এক ব্রাহ্মণ অথবা ঋষির শুশ্রূষাকার্যে লিপ্ত হয়ে একটি কন্যা সন্তান লাভ করেছিলেন। কিন্তু এই শূদ্রা দাসী যেহেতু দেবকের ভোগ্যা ছিলেন, অতএব দাসী কন্যাটি তারই মেয়ে বলে পরিচিত, ঠিক যেমন দ্বৈপায়ন ব্যাসের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও বিদুর বিচিত্রবীর্যের পুত্র বলেই পরিচিত।

আরও একটা কথা। এই পারশবী কন্যার পিতা যদি বসুদেবের শ্বশুর হন, তাহলে মথুরার যাদবদের সঙ্গে হস্তিনাপুরের আরও একটা বিবাহ-সম্বন্ধ ঘটল। মহাভারতের জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বৈবাহিক সম্বন্ধের অন্য তাৎপর্য আছে বলেই আমাদের মনে হয়। যাই হোক, দেবকের এই পারশবী কন্যাটি সুন্দরী এবং যৌবনবতী। ভীষ্ম তাকে তার আবাসস্থল থেকে আনিয়ে–রূপযৌবন-সম্পন্নাম… আনায্য পুরুষ–তাঁর সঙ্গে বিদুরের বিয়ে দিলেন।

 এই পারশবীর সঙ্গে কেমন সুখের সংসার রচনা করেছিলেন বিদুর, কোন মধুর আবেশে তার নববিবাহিত বাসরগুলি কাটত–মহাভারতের কবি সেকথা লেখেননি, লেখার প্রয়োজনও বোধ করেননি। এই পারশবী রমণীটি কাব্যে উপেক্ষিতা বলব কি না জানি না, তবে সারা মহাভারতের মধ্যে এই পারশবী রমণীর যৌবন, জীবন এবং মাতৃত্ব নিয়ে কোনও বিস্তার চোখে পড়ে না। কুন্তী এবং গান্ধারীর পুত্রজন্মের মধ্যে যে বৈচিত্র্য আছে, পারশবী বিদুর-পত্নীর পুত্রজন্মেও কোনও বৈচিত্র্য নেই, জীবনেও কোনও বৈচিত্র্য নেই। মহাভারতের কবি তার বিবাহ দিয়ে শুধু একটিবার বলে দিলেন বিদুরের কতগুলি গুণবান পুত্র হয়েছিল–পুত্ৰান্ বিনয়সম্পন্না আত্মনঃ সদৃশান্ গুণৈঃ। কেমন সে পুত্রগুলি, কী তাদের গুণ কিছুই আমরা জানি না। দ্বৈপায়ন ব্যাস নিজে ঋষি। তাই বুঝি তার এই প্রসন্নতালব্ধ পুত্র বিদুরের সাংসারিক বৈচিত্র্য কিছু নেই। এক গৃহস্থের ঘরে বাস করে, তিনি সন্ন্যাসীর মতোই থাকবেন। আর তার পারশবী স্ত্রীটি মহাভারতের বিশাল বিচিত্র চরিত্রের অন্তরালে একেবারেই হারিয়ে যাবেন।

অথচ এই পারশবীর প্রতিতুলনায় কুন্তীকে দেখুন, আর বিদুরের প্রতিতুলনায় দেখুন পাণ্ডুকে। তার স্বল্পস্থায়ী জীবনেও বৈচিত্র্য কত আর ততোধিক বৈচিত্র্য তার স্ত্রী কুন্তীর জীবনে। আমরা দেখেছি–অবসর সময়ে পাণ্ডু দেবতার মতো ঘুরে বেড়ান তার দুই স্ত্রীর সঙ্গে আর তার দিন কাটে মৃগয়া-ব্যসনে। এই রকম মৃগয়া করতে করতেই একদিন এক শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যের মধ্যে একটি বড় হরিণ দেখতে পেলেন। হরিণটি এক হরিণীর সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিল–চরন্ মৈথুনধর্মস্থং দদর্শ মৃগযূথপ। পাণ্ডু একবারও দ্বিধা না করে হরিণ এবং হরিণীটিকে শরের আঘাতে মেরে ফেললেন।

 শরাহত হরিণ এবার মনুষ্যের ভাষায় কথা বলে উঠল–মানুষীমীয় গির। আসলে এই হরিণটি ছিল এক ঋষিকুমার–স চ রাজন্ মহাতেজা ঋষিপুত্র-স্তপোধন। তার নাম কিমিন্দম। তিনি তপস্যা করেন, বন্য ফল-মূল আহার করেন, বৈরাগ্য সাধন করেন। কিন্তু তপস্বী হলেও তার রক্তমাংসের শরীর। এক সময় তার হৃদয়ে মৈথুনেচ্ছা জাগ্রত হল। কিন্তু যেখানে তিনি বাস করতেন, তার পাশেই লোকালয় আছে। ক্কচিৎ কখনও বন্য ফল-মূল আহরণের জন্য মানুষ-জন এসে পড়ে মুনির বসতি-স্থলে। স্ত্রীসংসর্গের সময় কোনও মানুষ তাকে দেখে ফেলবে এই লজ্জায় কিমিন্দম মুনি হরিণের রূপ ধারণ করেছিলেন এবং তার আপন স্ত্রীকেও তিনি এক হরিণীতে রূপান্তরিত করেছিলেন। পশুজগতের মৈথুনকর্মে কোনও লজ্জার স্থান নেই, মানুষ তাদের মৈথুনকর্মে লিপ্ত দেখলেও বাধা দেয় না–কিমিন্দম মুনি এই বুদ্ধিতেই আপন হরিণী পত্নীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিলেন–এপমাণো মনুষ্যানাং মৃগ্যাং মৈথুনমাচরম্।

এই অবস্থায় পাণ্ডু তীক্ষ্ণ শরাঘাতে মৃগমিথুনকে ধরাশায়ী করলে মৃগরূপী কিমিন্দম মনুষ্যের ভাষায় বললেন–দেখুন, কামার্ত, ক্রুদ্ধ এবং অতি পাপী লোকও এমন নৃশংস আচরণ করে না, যেমনটি আপনি করেছেন। আপনি যে বংশে জন্মেছেন, সে বংশে বড় বড় ধার্মিক পুরুষেরাই জন্মেছেন–শশদ্ধর্মাত্মনাং মুখ্যে কুলে জাতস্য ভারত[অথচ সেই বংশে জন্মে আপনার মন এমন মৃগমাংসের লোভে অভিভূত হল কেন, তা জাধগম্য হল না। কেনই বা আপনার বুদ্ধি ভদ্রজনের ঈঙ্গিত পথে চালিত হল না, তাও ভাল করে বুঝলাম না–কামলোভাভিভূতস্য কথং তে চলিতা মতিঃ।

 পাণ্ড হস্তিনাপুরের রাজা। মুনি ভাল তর্ক-যুক্তি দিলেন, ভাল কথা। কিন্তু একজন রাজা অত শীঘ্র বিচলিত হন না। তারও কিছু তর্কযুক্তি আছে। কিমিন্দমের তার্কিক আক্রমণ প্রতিহত করে পাণ্ডু বললেন–আমরা রাজারা যে বুদ্ধিতে শত্রু নিধন করি, সেই বুদ্ধিতেই মৃগয়া করি। তাছাড়া রাজারা তো একটু-আধটু মৃগয়া করেই থাকেন, তাতে দোষ ধরার কী আছে–রাজ্ঞাঞ্চ মৃগয়াং মোহান্ন ত্বং গর্হিতুমহসি?

 পাণ্ডু নিজেকে সমর্থন করার জন্য মুনিবর অগস্ত্যের উদাহরণ দিয়ে বললেন যে, তিনি যজ্ঞ করতে গিয়ে সমস্ত বন্য পশুকে মৃগয়া করেছিলেন এবং যজ্ঞকার্যে তাদের বধও করেছিলেন। পাণ্ডু কিমিন্দমকে বুঝিয়ে বললেন—তাহলেই বুঝতে পারছেন মৃগবধ করাটা কোনও অশাস্ত্রীয় ব্যাপার নয়। তাছাড়া মৃগবধ করার সময় আমরা কোনও কপট আচরণও করি না, কোনও মায়ারও আশ্রয় নিই না। শাস্ত্রকারেরা মৃগবধের এই নিয়ম যেখানে অনুমোদন করেছেন, সেখানে আপনিই বা আমার দোষ ধরছেন কেন–প্রমাণদৃষ্টধর্মের্ণ কথমস্মন্ বিগর্হসে?

 যিনি অস্ত্ৰক্ষেপ করছেন, তার দিক থেকে কোনও কপটতা নেই, মায়া নেই– অছদ্মনামায়য়া চ মৃগাণাং বধ ইষ্যতে–এই বক্তব্যের মাধ্যমে পাণ্ডু বুঝিয়ে দিলেন যে, কপটাচরণ বা ছদ্ম-ব্যবহার মুনির দিক থেকেই করা হয়েছে। রাজা যখন ধনুক-বাণ হাতে বন্য মৃগের প্রতি শর সন্ধান করেন, তখন তার কোনও ছদ্ম-ব্যবহার থাকে না বলেই হরিণ তার। জীবন-রক্ষার ব্যবস্থা নেয়। হয় সে পালায়, নয় অন্য কোনওভাবে সে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু মুনি কিমিন্দম নিজে হরিণের রূপ ধারণ করেও কেন, কোন ভরসায় তিনি ধনুর্ধারী রাজার সামনে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে রইলেন, সে কথা পাণ্ডু বুঝতে পারছেন না।

কিমিন্দম চিরকালের রণনীতি স্মরণ করিয়ে রাজাকে বললেন–ফাঁক পেলেই কি শত্রুর প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করা যায়? শত্রুর হাতে যদি অস্ত্র না থাকে, সে যদি বিলাস–ব্যসনে লিপ্ত থাকে, সে যদি এমনিই যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে তাকে তো আর অস্ত্রাঘাতে হত্যা করা যায় না, সেটা আদর্শ রণনীতি নয়।

 পাণ্ডু বললেন–একটি হরিণ আগে পালাবার জন্য প্রস্তুত হবে, তারপর তাকে পালানোর সুযোগ দিয়ে আমি তাকে মারব, এই কি আদর্শ রণনীতি? হরিণ নিজে সাবধান হবে কি না–এটা তার ব্যাপার। সে সাবধানই থাকুক অথবা অসাবধানই থাকুক, তাকে দেখামাত্রই রাজারা সুযোগ নেবেন, এটাই তো স্বাভাবিক–প্রমত্তমপ্রমত্তং বা বিবৃতং ঘুন্তি চৌজসা।

কিমিন্দম বললেন–নিশ্চয়ই। তাতে আমার কিছু বলারও নেই। আপনি আমাকে মৃগ ভেবে শরসন্ধান করেছেন, অতএব সেই মৃগের জীবনের জন্য আমি আপনাকে কিছু বলছি না। কিন্তু একটি প্রাণী মৈথুনকর্মে লিপ্ত হয়েছে, তার মৈথুন সমাপ্তির অপেক্ষাটুকু তো করবেন? সমস্ত প্রাণীরই অভীষ্ট এই মৈথুনকালে কোন শিষ্ট জন তাকে হত্যা করে? এমন নৃশংস মানুষ পৃথিবীতে কমই আছে যে সঙ্গমলিপ্ত প্রাণীকে হত্যা করে–কো হি বিদ্বান্ মৃগং হন্যাচ্চরন্তং মৈথুনং বনে। এই আমার অসহায় হরিণীটি যার সঙ্গে সহর্ষে সহবাসে লিপ্ত হয়েছিলাম আমি। আপনি বিখ্যাত পৌরবদের বংশে জন্মে সামান্য মৃগ-মাংসের লোভে এমন নৃশংস কাজ করবেন, আমি ভাবতে পারি না–বংশে জাতস্য কৌরব মানুরূপপমিদং তব।

 মুনি কিমিন্দম বোঝাতে চাইলেন–শুধুমাত্র কামনাই নয়, স্ত্রীসহবাসের মধ্যে যেমন রতিসুখের অভিসন্ধি থাকে, তেমনি থাকে পুত্রজন্মের সম্ভাবনা। কিমিন্দম বললেন–এই সহবাসের মধ্যে আমার প্রথম পুরুষার্থের ফল নিহিত ছিল, আপনি তা বিনষ্ট করে দিয়েছেন। আমি একটি পুত্র লাভ করতে পারতাম, আপনি তার সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট করে দিলেন–পুরুষার্থ ফলং কর্তৃং তত্তয়া বিফলীকৃত। কিমিন্দম মুনি এবার পাণ্ডুকে ভর্ৎসনা করলেন মৈথুনধর্মের সাধারণ সাযুজ্যের যুক্তি দেখিয়ে। তিনি বললেন–স্ত্রীসম্ভোগের সুখ কি আপনি জানেন না মহারাজ? ভালই জানেন। শাস্ত্রযুক্তি, ধর্মাধর্ম, সেও আপনি ভালই জানেন–স্ত্রীতোগানাং বিশেযজ্ঞঃ শাস্ত্রধর্মাক্তৃতত্ত্ববিৎ। সব জেনেশুনে এমন নৃশংস কাজ আপনি করলেন কী করে?

 দুটি নবযৌবনবতী স্ত্রীর সঙ্গে রাজা পাণ্ডুর বন্য-বিহার এই অঞ্চলে কারও অজানা ছিল না। মুনিও তা জানতেন। রাজা নিজে যেখানে নির্জন অরণ্যবাসে রতিসুখ ভোগ করার জন্যই হস্তিনাপুর ছেড়ে এসেছেন, সেখানে তিনি এক রতিলিঙ্গু মৃগমিথুনকে অতর্কিতে হত্যা করবেন–এই অপরাধ কিমিন্দম ক্ষমা করবেন না। তিনি অভিশাপ উচ্চারণ করলেন মহারাজ! আপনি নিজে কামমুগ্ধ এবং অসংযত-চিত্ত এবং আপনি আমাদের দুজনকেই মেরেছেন। অতএব আপনিও এই কাজের ফল পাবেন। আপনিও কামমুগ্ধ হয়ে যখন প্রিয়তমা পত্নীর সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হবেন–প্রিয়য়া সহ সংবাসং প্রাপ্য কামবিমোহিতঃ–তখন আপনিও আমারই মতো মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। আমি সুখভোগ করছিলাম–এই অবস্থায় আপনি আমায় যেমন দুঃখভোগ করালেন, তেমনি সুখভোগ করার সময়েই আপনারও চরম দুঃখ এসে পৌঁছবে–তথা ত্বাঞ্চ সুখং প্রাপ্তং দুঃখমভ্যাগমিষ্যতি।

অভিশাপ দিয়ে কিমিন্দম মুনি মারা গেলেন। পরম দুঃখিত অন্তঃকরণে পাণ্ডু ফিরে এলেন অরণ্য-কুটিরে। দুই স্ত্রীর সামনে তার চরম দুর্ভাগ্য বর্ণনা করে বিলাপ করতে আরম্ভ করলেন পাণ্ডু। ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের কিছু নিবেদন আছে। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, কিমিন্দম মুনির উপাখ্যানের মধ্যে কিছু অলৌকিকতা আছে। মুনি মৃগের রূপ ধারণ করে তার মৃগ-পত্নীর সঙ্গে বিহার করছিলেন–একথার লৌকিক বিশ্বাসযোগ্যতা খুব বেশি নেই। আমাদের ধারণা–ঐতিহাসিক কোনও চরিত্র যখন মহাকাব্যের বিরাট পরিকল্পনার বিষয়বস্তু হল, তখন মহাকাব্যের কবিকে কতগুলি উদ্ভাবন করতেই হয়। বিশেষত পাণ্ডুর মতো এক ব্যক্তি, যাঁর পুত্রেরা ভবিষ্যতে মহাভারতের নায়ক হবেন, তাঁর প্রজনন-ক্ষমতা নেই–একথা বলতে মহাকাব্যের কবির বাধে। আর ঠিক সেইজন্যই সমাজ-সংস্কারের সঙ্গে মিলিয়ে এই কিমিন্দম মুনির উপাখ্যান রচনা করতে হয়েছে কবিকে। অভিশাপের ইতিবৃত্তও সেই কারণেই।

তাই বলে এই মৃগয়ার ঘটনাটাকে আমরা মিথ্যা বলতে পারি না। মৈথুনলিপ্ত হরিণ-হরিণীকে হত্যা করার ঘটনা হয়ত একটা ঘটেছিল এবং সে ঘটনা ঘটেছিল পাণ্ডুর মানসিক কোনও বিকারেই। যে পুরুষ বারংবার মৈথুনে লিপ্ত হয়েও সন্তান উৎপাদনে ব্যর্থ হন, তার চরম–আক্রোশ থাকে অন্যের মৈথুন-কর্মের ওপর। এক্ষেত্রে এক অসহায় মৃগ-মিথুন তার আক্রোশের শিকার হয়েছে। পাণ্ডু মনে করেছেন–তার দুটি স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও যেখানে তিনি পুত্র উৎপাদন করতে পারছেন না, সেখানে অন্য কারও অধিকার নেই পুত্র লাভ করার। প্রধানত এইরকম এক রাজকীয় আক্রোশেই মৃগ-মিথুনের হত্যা সংঘটিত হয়েছে হয়ত। আর তারপরেই আমরা যেমন সানুতাপে বলি–অমুক পাপ করেছিলাম, তার ফলেই আমার এই দুর্ভাগ্য উপস্থিত হল। পাণ্ডুর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তিনি হয়ত এখন কিমিমের অভিশাপের অজুহাতে বিলাপ করছেন পত্নীদের সামনে। মহাকাব্যের কবিও কিমিন্দম মুনি এবং তার অভিশাপের বৃত্তান্ত নিয়ে এসেছেন অজুহাতের মতো করেই।

আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়–সঙ্গমকালে দ্বৈপায়ন ব্যাসের উগ্রমূর্তি সহ্য করতে না পেরে বিচিত্রবীর্যের দ্বিতীয়া পত্নী অম্বালিকার গাত্রবর্ণ পাণ্ডু অর্থাৎ সাদা ফ্যাসফেসে হয়ে গিয়েছিল। ফলে পাণ্ডুর গাত্রবর্ণও হয়েছিল সেইরকম অর্থাৎ পাণ্ডুবর্ণ। কিন্তু আধুনিক মনস্তত্ত্ব এবং শরীরবিজ্ঞানে বিশ্বাস করলে–সঙ্গমকালে ব্যাসের এই উগ্রমূর্তি অম্বালিকার কাছে হয়ত এতটাই শকিং এবং ধর্ষণের মাত্রায় ধরা দিয়েছিল যে, তারই ফলে হয়ত অম্বালিকার গর্ভজাত পুত্রটির ওই শারীরিক বিকার তৈরি হয়। অম্বালিকার দিদি অম্বিকা একটি জন্মান্ধ পুত্রের জন্ম দেন। কিন্তু অম্বালিকা যে পুত্রের জন্ম দেন তার কোনও শারীরিক বিকার আপাতত লক্ষিত না হলেও সে পুত্রটি প্রজনন-ক্ষমতা হারান জন্মলগ্নেই। নইলে একটি পুরুষ মানুষের শরীর সাদা ফ্যাসফেসে হল–এটা কোনও বিকার নয়। ধৃতরাষ্ট্রের জন্মান্ধতার নিরিখে পাণ্ডুর শারীরিক বিকারও ধরতে হবে জন্ম থেকেই এবং সেটা কোনওভাবেই পাণ্ডুবর্ণমাত্র নয়, বর্ণের অন্তরালে প্রজননের অসামর্থ্যই তার জন্ম-বিকার হিসেবে ধরতে হবে।

মৃগমিথুনের মৃত্যু অথবা মহাকাব্যিক সংস্কারে ঋষির অভিশাপের অভিসন্ধি সৃষ্টি করে মহাভারতের কবি এবং স্বয়ং পাণ্ডু দুজনেই এই সুবিধা পেলেন যে, এখন পাণ্ডুর দুই প্রিয়তমা পত্নীর সামনে প্রজননের অসামর্থ্য প্রকট করে দেবার কোনও লজ্জা থাকল না।

.

৭৮.

মুনির অভিশাপেই পাণ্ডু যে প্রজনন-ক্ষমতা হারিয়েছেন–এই কথা বারংবার বলেই তিনি বিলাপ করতে লাগলেন তার দুই স্ত্রীর সামনে। এই বিলাপের মধ্যে হাহাকার যা ছিল, তা নিয়ে আমাদের বক্তব্য নেই এবং তা বোঝারও কোনও অসুবিধে নেই। পাণ্ডু বলেছিলেন– আমার মতো অসংযতচিত্ত এবং কামমুগ্ধ ব্যক্তির দশা এমনই হয়–প্রাপুবন্ত্যকৃতাত্মানঃ কামজালবিমোহিতাঃ। আশ্চর্য কথা। মৈথুনরত মৃগমিথুনকে হত্যা করে তিনি অসংযমের পরিচয় দিয়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু এখানে তার কামমুগ্ধতা কী ছিল? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া শক্ত। কিন্তু পরোক্ষ বিচার করলে ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাবে।

আসলে তির্যক প্রাণীর মৈথুন-দর্শনে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কামনা উদ্ৰিক্ত হয়। পাণ্ডুরও তাই হয়েছে। কিন্তু শত-সম্ভোগেও পাণ্ডু কামনার ইষ্ট ফল-লাভ করেননি। তার ভ্রষ্ট প্রতিহত কামনা তাই ক্রোধের রূপ ধারণ করেছে। ভাবটা এই-শত সম্ভোগেও আমি যে ফল পাইনি, তুই নির্বোধ পশু হয়ে সেই ফল পাবি? তা হবে না। অতএব অস্ত্রাঘাতে নির্বোধ পশুকে তিনি শাস্তি দিয়েছেন।

এটা যদি ও–দেশ হত তাহলে ফ্রয়েড সাহেবের অনুগামী হয়ে পাণ্ডুর মৃগ-মিথুন-বধের মনস্তত্ত্ব অথবা পাণ্ডুর ক্রোধ ব্যাখ্যা করা মোটেই অসহজ হত না। কিন্তু ভারতীয় দার্শনিকের দৃষ্টিতেও পাণ্ডুর এই অসংযত নির্বিচার মৃগবধ যে পরোক্ষত কামমুগ্ধতারই–এই তত্ত্ব আমরা ফ্রয়েড সাহেবের চেয়েও অনেক কঠিনভাবে জানি।

যাই হোক, পাণ্ডু তার বিলাপের সময় আরও একটি দামী কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন আমার পিতা বিচিত্রবীর্য চিরধার্মিক শান্তনুর পুত্র হয়েও অতিরিক্ত কাম-সেবা করে অকালে যক্ষ্মায় মারা গেলেন–জীবিতান্তমনুপ্রাপ্তঃ কামাত্মৈবেতি নঃ শ্রুতম্। এখানে যে ভাষায়, অথবা অন্তঃকরণের যে দুঃখে পাণ্ডু পিতার কামুকতা বর্ণনা করেছেন, তাতে তার নিজের কামুকতার কথাই প্রকট হয়ে ওঠে। মহারাজ শান্তনুর ধার্মিকতা যাই থাকুক, তিনিও যে খানিকটা কামনার দাস ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যেভাবে তিনি গাঙ্গেয় ভীষ্মের মতো পুত্রকে রাজ্যের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, তাতে সেই মুহূর্তে তার অভীষ্টতমা সত্যবতীর জন্য তার উদগ্র কামনাই প্রকট হয়ে ওঠে।

পাণ্ডুর বিলাপের সোচ্চার অংশ থেকে বোঝা যায়–প্রসিদ্ধ কুরুবংশে অসংযত কামনার রাজত্ব চলছিল মহারাজ শান্তনুর সময় থেকেই। কামনার চরম প্রকাশ ঘটে বিচিত্রবীর্যের জীবন–চর্যায়। দুই স্ত্রীর সঙ্গে নব-নবতর বিলাসে তার দিন কেটে গেছে আদর্শ রাজধর্মের সমস্ত বিপরীত আচরণে। তার কামুকতা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে মহর্ষি ব্যাসের ঔরসজাত সন্তান হয়ে পাণ্ড তার পিতৃলক্ষণাক্রান্ত পিতা বিচিত্রবীর্যকে চিহ্নিত করেছেন বড় অদ্ভুতভাবে। তিনি বলেছেন–আমি সাক্ষাৎ নারায়ণের সমগুণ ঋষি ব্যাসের পুত্র হলেও আমি জন্মেছি সেই কামুক বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীর গর্ভে তস্য কামাত্মনঃ ক্ষেত্রে রাজ্ঞঃ সংযতবাগৃষিঃ।

পাণ্ডুর ভাব দেখে বোঝা যায় তিনি ব্যাসকে দোষ দিচ্ছেন না। দোষ দিচ্ছেন সেই নামে–মাত্র পিতা বিচিত্রবীর্যকে। যেন তার স্ত্রীর গর্ভে জন্মেই তার যত বিপত্তি হল, নইলে ব্যাসের ছেলে হয়ে তার এমন বিপরীত বুদ্ধি যেন হতেই পারে না–তস্যাদ্য ব্যসনে বুদ্ধি সঞ্জাতেয়ং মমাধমা। পাণ্ড বিলাপ করে বললেন–আমি মৃগয়া করতে গিয়ে মৈথুন-প্রবৃত্ত মৃগ-মিথুনকে বধ করে মৃগয়ার চিরন্তনী রীতি অতিক্রম করেছি। তাই দেবতারাও আমাকে ত্যাগ করেছেন।

মৃগ–মিথুনের হত্যা করেই হোক অথবা মুনির মুখের সেই কঠিন অভিশাপের কথা শুনেই হোক অথবা নিজের স্বাভাবিক প্রজনন-ক্ষমতা-রাহিত্যের কারণেই হোক, পাণ্ডু গভীর অনুতাপ–গ্রস্ত হলেন। তার বৈরাগ্য উপস্থিত হল। দুই সুন্দরী স্ত্রীর সামনে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন– সংসার-বন্ধন থেকে আমি মুক্তি চাই– মোক্ষমেব ব্যবস্যামি। আমার পিতা বেদব্যাসের যে সব সদগুণ আছে আমি সেই সদ্গুণ আশ্রয় করব। সংসারের সমস্ত সংসর্গ ছেড়ে আমি মুনি-বৃত্তি গ্রহণ করব। গায়ে আমার ধুলো লাগুক, আমার বাসস্থান হোক বৃক্ষমূল, বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে আমি দিন কাটাব চরণ ভৈক্ষ্যং মুনির্মুক্তশ্চরিষ্যামি মহীমিমা। আমার প্রিয় বা অপ্রিয় বলে কিছু থাকবে না। স্তুতি-নিন্দার জ্বর আমাকে স্পর্শ করবে না। শীত-গ্রীষ্ম, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় সব আমার কাছে সমান হয়ে উঠবে– ন শোচন্ন প্রহৃয্যংশ্চ তুল্যনিন্দাত্মসংস্তুতি।

পাণ্ডু যেভাবে বললেন, তার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব আছে, তা আমরা মনে করি না। তবে কিনা স্বাভাবিক বৈরাগ্যের সঙ্গে এই বৈরাগ্যের তফাত আছে। যিনি বিপন্ন হয়ে বৈরাগ্য অবলম্বন করেন, তার বৈরাগের মধ্যে ভাবাবেগ বেশি থাকে। পাণ্ডু আরও অনেক প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং সে প্রতিজ্ঞার ভাষা ভগবদ্গীতায় বলা উৎকৃষ্ট স্থিতধী জ্ঞানী পুরুষের লক্ষণ মনে করিয়ে দেয়। পূর্বের সাধন-সংস্কার ছাড়া অথবা ঈশ্বর-পুরুষের অহৈতুকী কৃপা ছাড়া তেমন বৈরাগ্য প্রায় অসম্ভব। কিন্তু পাণ্ডু প্রতিজ্ঞা করেছেন যোগী পুরুষের লক্ষণায় অথচ সে প্রতিজ্ঞা বড়ই সকারণ। সর্বত্র সমদর্শী মুনির প্রতিজ্ঞা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি এটাই বলেন গৃহস্থের ধর্মে থেকে আমার যখন পুত্র-কন্যা কিছুই হল না, মৃ-মুনির অভিশাপে আমার যখন প্রজনন-ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে গেছে, তখন কী লাভ আমার গৃহস্থ হয়ে থেকে স্বধর্মাৎ সততাপেতে চরেয়ং বীর্যবর্জিতঃ।

পরিষ্কার বোঝা যায় পাণ্ডুর এই নির্বিগ্নতা তৈরি হয়েছে পুত্রোৎপাদনের অসামর্থ্য থেকেই। আমরা প্রশ্ন করতে পারি– কেন বাপু! গৃহস্থ–ধর্মের ওপর এত রাগ কিসের? পাণ্ডুর সমকালে অন্য পুরুষের দ্বারা পুত্রোৎপাদন তো বিধিসম্মত ছিল। পাণ্ডু নিজেও তো সেইরকমই এক ক্ষেত্রজ পুত্র। আর ক্ষেত্রজ পুত্রের পরিচয় তো পিতার নামেই হয়। পাণ্ডু নিজে ব্যাসের ঔরসজাত পুত্র হলেও তিনি তো বিচিত্রবীর্যের পুত্র বলেই পরিচিত। কাজেই অসুবিধে কী? পাণ্ডুও তার দুই স্ত্রীর গর্ভে অন্য সম্পন্ন পুরুষের দ্বারা পুত্রলাভ করে পিতা বলে পরিচিত হতে পারেন। এতে তাঁর পক্ষে গৃহস্থের জীবন যাপন করাও সম্ভব হবে।

কিন্তু নিজে ক্ষেত্রজ পুত্র বলেই পাণ্ডুর বোধহয় এমনতর পুত্রলাভের প্রতি এক ধিক্কার আছে। সমস্ত বৈরাগ্যের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করার পরেও তিনি বলেছেন– এ হল কুকুরের ব্যবহার। এক কুকুরের সঙ্গে এক কুকুরীর ভাব হল, যৌন-সংসর্গও হল, অথচ সেই কুকুরীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার জন্য এখন যদি অন্য এক পুরুষের দিকে কাতর চোখে চেয়ে থাকতে হয়, তাহলে সে হল কুকুরের কায়দা–উপৈতি বৃত্তিং কামাত্মা স শুনাং বৰ্ততে পথি। অর্থাৎ পাণ্ডু এইভাবে পুত্র লাভ করতে চান না। তার চাইতে বৈরাগ্য-সাধনে মুক্তিও অনেক ভাল।

কুন্তী এবং মাদ্রী এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাণ্ডুর বিলাপ শুনছিলেন। এমন বিলাপোক্তির মধ্যে তাদের পক্ষে কিছু বলাটাও মুশকিল ছিল। প্রিয় স্বামীর বিলাপের উদ্বেল ধারা রুদ্ধ না করে দিয়ে তারা দাঁড়িয়েই ছিলেন। পাণ্ডু এবার তাদের উদ্দেশ করে বললেন– তোমরা দুজনেই ফিরে যাও হস্তিনাপুরে। সেখানে গিয়ে আমার মা অম্বালিকাকে জানাবে যে, তাঁর ছেলে পাণ্ডু প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছেন। একথা জানাবে আর‍্যা সত্যবতীকে, জানাবে বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র, সঞ্জয় এবং মহামতি ভীষ্মকে। জানাবে–পাণ্ডু বনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছেন। পৌর-জনপদবাসী এবং রাজপুরোহিতদের কাছেও আমার অনুনয় জানিয়ে বলবে– পাণ্ডু প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছেন– প্রসাদ্য সর্বে বক্তব্যাঃ পাণ্ডঃ প্রব্রজিতো বনম্।

কুন্তী এবং মাদ্রী বেশ খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে পাণ্ডুর উপদেশ শুনলেন। শোনার পর তারা দুজনেই একসঙ্গে বললেন– তৎসমং বচনং কুন্তী মাদ্রী চ সমভাষতাম। একসঙ্গে বললেন এই শব্দ মেনে নিয়েও বলি একসঙ্গে একই কথা বলা সম্ভব নয় বলেছেন একজনই এবং অন্যজন তা সমর্থন করেছেন। আমরা জানি এই বলার লোকটি হলেন কুন্তী। জীবনের অনেক আঘাত, অনেক জটিলতা এবং অভিজ্ঞতা তাকে অনেক বাস্তব-বুদ্ধিসম্পন্না করে তুলেছে। আর্যক শূরের ঘর থেকে তাকে দত্তক দেওয়া হয়েছিল কুন্তিভোজের বাড়িতে। পরের ঘরে সমস্ত স্বাধীনতা নিয়ে তিনি পালিত হননি। উপরন্তু কন্যাভাবে পুত্রজন্ম তার মধ্যে অন্য এক বিপন্নতা তৈরি করেছিল। স্বামীর ঘরে এসে স্বামীর ওপর অসীম নির্ভরতায় তিনি তার দুঃখ ভুলতে আরম্ভ করেছিলেন কেবলই। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘোষিত হল– পাণ্ডুর প্রজননের সামর্থ্য নেই অতএব তিনি মুনিবৃত্তি গ্রহণ করবেন।

 এই উদগ্র বৈরাগ্যের মুখে কুন্তী যদি তাকে বলতেন– না তোমার যাওয়া চলবে না। তুমি এই সংসারেই থাক– তাহলে ফল বিপরীত হত এবং পাণ্ডু হয়ত আরও উগ্র হয়ে উঠতেন। কুন্তী তাই বললেন–মহারাজ! আমরা তোমার ধর্মপত্নী। তুমি একা একা কেন তপস্যা করবে? গৃহস্থ-আশ্রম ছাড়াও অন্য কোনও আশ্রম তুমি অবলম্বন করতে পার, যেখানে আমরাও তোমার সহধর্মচারিণী হতে পারি, একই সঙ্গে আমরাও তোমার তপস্যার অংশীদার হতে পারি– আবাভ্যাং ধর্মপত্নীভ্যাং সহ তপুং তপো মহৎ।

কুন্তী বলতে চাইলেন–শম-দম-তপস্যার জন্য সংসার ত্যাগ করার কোনও প্রয়োজন নেই। বরঞ্চ পাণ্ডুর স্বার্থে তার গৃহিণীরাই ভোগ-সুখ পরিত্যাগ করে যোগিনী হবেন। তাছাড়া ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্যের অব্যবহিত পরে বানপ্রস্থ আশ্রমের নাম আসে, সন্ন্যাসের নাম আসে না। বানপ্রস্থে পুত্রদের কাছে স্ত্রীকে রেখেও যেমন বনে যাওয়া যায়, তেমনই সপত্নীক অবস্থাতেও বানপ্রস্থ আশ্রম শাস্ত্রকারদের অনুমোদিত পুত্রে দারা নিক্ষিপ্য বনং গচ্ছেৎ সহৈব বা। পাণ্ডুর বৈরাগ্য–বাসনা দেখে কুন্তী প্রতিজ্ঞা করলেন– আমরা আজ থেকে ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ। করে, কাম-সুখ ভোগ-বিলাস সমস্ত বাদ দিয়ে তোমারই সঙ্গে তপস্যা করব– ত্যক্তকামসুখে হ্যাঁবাং ত্যাবো বিপুলং তপঃ। এই বানপ্রস্থের তপস্যায় তোমার স্বর্গলাভ হলে আবারও আমরা তোমাকেই স্বামী হিসেবে পাব। আর তুমি যদি আমাদের ছেড়ে একা একা বনবাসী হও, তবে আজই আমাদের মরা ছাড়া গতি নেই–অদ্যৈবাবাং প্রহাস্যাবো জীবিতং নাত্র সংশয়ঃ।

কুন্তীর এই বক্তব্যের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল না কোনও। বাপের বাড়ি, পালক পিতার বাড়ির শত অস্বস্তি বহন করেও কানীন গর্ভের আকস্মিকতা ভুলে কুন্তী নতুন করে শুধু স্বামীর ঘর করতে চেয়েছিলেন। সেই স্বামীর শারীরিক অসামর্থ্য প্রকট হতেও তিনি ব্যথিত হননি, যতখানি ব্যথিত হলেন তার আকস্মিক বৈরাগ্যে এবং একাকী তপশ্চর্যার বিলাসে।

 পাণ্ডু কিন্তু কুন্তীর যুক্তি মেনে নিয়েছেন। মেনে নিয়েছেন কুন্তীর ঐকান্তিকতায়, তার ব্যক্তিত্বে এবং সাহচর্যের সরসতায়। পাণ্ডু বলেছেন–এই যদি তোমাদের একান্ত ইচ্ছে হয়, তাহলে তপস্যা, বৈরাগ্য, সাধন-ধ্যানে আমি দিনাতিপাত করব এখন থেকেই। বানপ্রস্থ আশ্রমের তীব্র–কঠিন সাধন অবলম্বন করব যতদিন আমার মৃত্যু না হয় এবমারণ্যশাস্ত্রাণা উগ্রমুগ্রতরং বিধিম্।

কুন্তী এবং মাদ্রীর সামনে উগ্র তপস্যার অঙ্গীকার করবার সঙ্গে সঙ্গেই পাণ্ডু তাঁর রাজমুকুটখানি খুলে ফেললেন। মণি-মুকুট, বক্ষের অলঙ্কার, শ্রবণের কুণ্ডল এবং রাজবস্ত্র পরিত্যাগ করে সব বিলিয়ে দিলেন ব্রাহ্মণদের। কুন্তী এবং মাদ্রীও তাঁদের মহামূল্য অলঙ্কার স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। সেগুলিরও সদগতি হল–বাসাংসি চ মহাহানি স্ত্রীণামাভরণানি চ। ব্রাহ্মণদের হাতে সব তুলে দেবার পর রাজভৃত্যদের ডেকে পাণ্ডু বললেন– পাণ্ডভৃত্যান্ অভাষত। বললেন– তোমরা হস্তিনাপুরে গিয়ে সবাইকে বলবে যে, অর্থ, বিষয়ভোগ, স্ত্রীসম্ভোগ– সব পরিত্যাগ করে দুই স্ত্রীর সঙ্গে পাণ্ডু বনবাসী হয়েছেন গত্বা নাগপুরং বাচ্যং পাণ্ডঃ প্রব্রজিতে বনম্।

পাণ্ডুর কথা শুনে এতকালের রাজভৃত্যদের চোখে জল এল। পাণ্ডুর সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে উষ্ণমং বিমুঞ্চতঃ– তারা হস্তিনাপুর রওনা হয়ে গেল। রাজধানীতে পৌঁছে তারা পাণ্ডুর সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করল অস্থায়ী রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। পাণ্ডুর দেওয়া বেশ কিছু ধনরত্ন-অলঙ্কারও তারা ধৃতরাষ্ট্রের হাতে দিল– কথয়াঞ্চক্রিরে রাজ্ঞস্তদ্ধনং বিবিধং দদুঃ। সর্বশেষ সংবাদ জানিয়ে দূতেরা বলল– পাণ্ডু আর দেশে ফিরছেন না। তিনি বানপ্রস্থ অবলম্বন করেছেন অকালে। কথাটা শুনে প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র মনে যথেষ্ট ব্যথা পেলেন। ছোট ভাই পাণ্ডুর জন্য তার শোকের অন্ত রইল না—ধৃতরাষ্ট্র নরশ্রেষ্ঠঃ পাণ্ডুমেন্বশোচত। ভাইয়ের কষ্ট অনুভব করে তার রাজভোগ তিক্ত মনে হল। রাজকীয় শয্যা, ভোজন এবং বিলাস তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল সাময়িকভাবেন শয্যাসন– ভোগেযু রতিং বিন্দতি কহিঁচিৎ।

ওদিকে রাজা পাণ্ডু রাজকীয় মর্যাদা এবং ভোগবিলাস ত্যাগ করে সহধর্মিণী দুই পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে নাগশত পর্বতে চলে গেলেন। শাস্ত্রে বলেছে– চলে বেড়াও, থেম না কখনও। চলার মধ্যেই অমৃতের স্বাদ লুক্কায়িত– চরৈবেতি, চর বৈ মধু বিন্দেত। পাণ্ডু বুঝি সেই শাস্ত্রের অনুশাসন মাথায় বহন করে নাগশত পর্বত থেকে চৈত্ররথ বন, চৈত্ররথ থেকে কালকূট পর্বত, কালকূট থেকে হিমালয়ের উত্তরে গন্ধমাদন পর্বতে গিয়ে পৌঁছলেন। বন্ধুর পার্বত্যভূমিতে কত তপস্বী মুনিঋষির সঙ্গে তার দেখা হল। তাদের মুখে নীতিনিয়ম-তপস্যার হাজারো অনুশাসন শুনে এক সময়ে তিনি ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর আর হংসকূট পর্বত পেরিয়ে শতশৃঙ্গ পর্বতে এসে পৌঁছলেন। শতশৃঙ্গ পাহাড় হিমালয়ের মধ্যে। অর্থাৎ পাণ্ডু যেখানে ছিলেন, তার চেয়ে আরও উত্তরে, অনেক উত্তরে একেবারে হিমালয়ের প্রত্যন্তদেশে চলে এসেছেন প্রায়। পাণ্ডু এই শতশৃঙ্গ পর্বতে এসে কঠোর তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন–শতশৃঙ্গে মহারাজ তাপসঃ সমপদ্যত।

শতশৃঙ্গের হিম-শীতল পরিবেশে আরও কঠোর স্বরাগ্য অবলম্বন করে পাণ্ডু তপস্যা আরম্ভ করলেন। বাগিন্দ্রিয়–মনোবুদ্ধি একত্র সংযতইয়ায় পাণ্ডুর চেহারার মধ্যে স্বর্গীয় দ্যুতি পরিস্ফুট হল। একে ওই কঁচা সোনার মতো পাণ্ডুবর্ণ, তার মধ্যে পূর্বতন রাজকীয় অভিব্যক্তি আবার তার মধ্যে জিতেন্দ্রিয় শুদ্ধাচার। সব মিলিয়ে পাণ্ডু সিদ্ধ-চারণদের থেকেও সুন্দর দেখতে হয়ে গেলেন–সিদ্ধ-চারণ সংঘানাং বভূব প্রিয়দর্শনঃ। বয়সের অনুপাতে পর্বতনিবাসী মুনিরা কেউ তাকে পুত্রের মতো দেখতেন, কেউ ভ্রাতার মতে, কেউ বা আপন সখার মতো কেঞ্চিদভব ভ্রাতা কেষাঞ্চিভবৎ সখা। সঙ্গগুণে এবং আপন তপস্যায় পাণ্ডুও হয়ে উঠলেন ব্রহ্মর্যির মতো–ব্রহ্মর্ষিসদৃশঃ পাণ্ডু-বর্ভূব ভরতর্যভ।

 পাণ্ডু মুনি-ঋষিদের সুখসঙ্গে ভালই আছেন। তার দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রী স্বামীর ব্রত অবলম্বন করে পাণ্ডুকে যথেষ্ট সন্তুষ্ট রেখেছিলেন। এরই মধ্যে একদিন। সেদিন অমাবস্যা তিথি। সন্ধ্যা নামলে আকাশে চাঁদ উঠবে না। অতএব সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে এমন একটা প্রয়াস নিয়েছিলেন মুনি-ঋষিরা। তপস্যার কঠোরতায় এই মুনি-ঋষিদের শরীর অত্যন্ত শক্ত। শীত-গ্রীষ্ম-রুক্ষতা ছাড়াও পথশ্রম এঁদের মোটেই ক্লান্ত করে না। এই মুনি-ঋষিরা ভগবান ব্রহ্মার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করে গমনে উদ্যত হলেন–ব্রহ্মাণং দ্রষ্ট্রকামাস্তে সম্প্রতমহর্ষয়ঃ।

গমনোদ্যত ঋষিদের দেখে পাণ্ডু বললেন–কোথায় যেতে চাইছেন। ঋষিরা বললেন– আজ ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার সভায় অনেক মহাত্মা পুরুষের সম্মেলন ঘটবে– সমাবায়ো মহানদ্য ব্রহ্মলোকে মহাত্মানা। দেবতারা আসবেন, ঋষিরা আসবেন, এমনকি স্বর্গস্থ পিতৃগণও আসবেন সেখানে। আমরা তাই ব্রহ্মার সভায় উপস্থিত হতে চাইছি আজই।

দেবতা বা ঋযিদের থেকেও পূর্বতন পিতৃগণ এই সভায় আসবেন–পিতৃণাঞ্চ মহাত্মানাম–শুনে পাণ্ডুর কিছু ভাববিকার হল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার দুই স্ত্রীকে ইঙ্গিত করে ঋষিদের কোনও কথা জিজ্ঞাসা না করে তাদের অনুগমন করলেন নিঃশব্দে–পাণ্ডুরুথায় সহসা গন্তুকামো মহর্ষিভিঃ। পাণ্ডুর সঙ্গে তার দুই স্ত্রীকে আসতে দেখে তপস্বীরা একটু চিন্তিত হলেন। লোকে যাকে স্বর্গ বলে এ যে তার চেয়েও দূরের পথ। হিমালয় ছেড়ে আরও উত্তরে দুর্গম পথে যেতে হবে ব্রহ্মলোকে স্বর্গপারং তিতীষুঃ স শতশৃঙ্গা উদঙমুখঃ।

মানুষের এই সুন্দর পৃথিবীর মধ্যেই যে স্বর্গের ঠিকানা আছে– সেকথা আমরা মহাভারত–কথা আরম্ভ-পর্বেই বলে এসেছি। ব্রহ্মলোক আরও উত্তরে। ঋষিরা পাণ্ডকে বললেন– আমরা এই পর্বতরাজ হিমালয় অতিক্রম করে আরও উত্তরে আরও ওপর দিকে বেশ কয়েকবার গিয়েছি– উপর্যুপরি গচ্ছন্তঃ শৈলরাজ উদমুখাঃ। সে দেশ অত্যন্ত মনোরম কিন্তু ভীষণ দুর্গম। সমতল, বিষমতল প্রদেশ দিয়ে যেতে যেতে বড় বড় নদী, দুর্গম পর্বতগুহাও পড়বে–মহানদীনিতম্বাংশ্চ গহনা গিরিগরা।

এই চলার পথ দেখে বুঝতে পারি–এগুলিকেই ইংরেজিতে পাস বলে। যে পথ দিয়ে আর্যরা উত্তরকুরু-দেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন, এ হল সেই সব পথ। মুনিরা বলেছেন যেতে যেতে অনেক দেশ পড়বে যেখানে সব সময়েই তুষারপাত ঘটছে, বৃক্ষ নেই, পশু নেই, পক্ষী নেই সন্তি নিত্যহিমা দেশা নিবৃক্ষ-মৃগ-পক্ষিণঃ। কোথাও ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও বা পথ এমনই দুর্গম যে আকাশগামী পক্ষীরাও সেখান দিয়ে উড়ে যেতে ভয় পায়।

 আমরা মহাভারত–কথার আরম্ভে স্বর্গ, ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক ইত্যাদি মহান স্থানের একটা ভৌগোলিক অবস্থান দেখাবার চেষ্টা করেছি এবং বলেছি–সেকালের দিনে বয়সকালে কাশী যাবার মতো আর্যরাও তাদের এই পুরাতন বসতিতে ফিরে যাবার চেষ্টা করতেন। এখানে দৃঢ়ব্রত মুনি-ঋষিরাই–ঋষয়ঃ সংশিতব্রতাঃ–এই ব্রহ্মলোক-যাত্রায় শামিল হয়েছেন। পাণ্ডুও তার দুই স্ত্রীকে নিয়ে এই যাত্রায় ঋষিদের অনুষঙ্গী হতে চান। কিন্তু বাস্তব অবস্থা বুঝে ঋষিরা বললেন–আপনি একা হলেও হত। এই দুই রাজকন্যা আপনার সহধর্মচারিণী হলেও এই দুর্গম পথে যাবার অযোগ্য। তারা পথেই অবসন্ন হয়ে পড়বেন। এই দুর্ঘটনা যাতে না হয়, তার জন্য আপনার সেখানে যাবার চেষ্টা করা উচিত নয়, মহারাজন সীদেতামদুঃখাহেঁ মা গমনী ভরতৰ্ষভ।

পাণ্ডু কথাটা শুনলেন বটে কিন্তু তিনি বড়ই দুঃখিত হয়ে পড়লেন। বিশেষত আগে তিনি শুনেছেন–পূজনীয় পিতৃগণ ব্রহ্মার সভায় মিলিত হলেন। প্রধানত এই শব্দটিই তাঁকে উৎসাহিত করেছে। আমরা মহাভারত-পুরাণের উদাহরণ দিয়ে পুর্বে দেখিয়েছি যে, বয়স পরিপক্ক হলে সেকালের আর্যরা তাদের পুরাতন দেশে ফিরে যেতে চাইতেন। পরবর্তীকালে স্বর্গের ঠিকানা পালটেছে এবং এক্কেবারে এই কলিকালে সেটা গয়া-কাশী-বৃন্দাবনে এসে ঠেকেছে। পাণ্ড অন্তত এই পিতৃলোকের অধ্যুষিত ভূমিতে একবার যেতে চান। কিন্তু মুনিরা যখন বারণ করলেন, তখন তার মনস্তত্ত্বের এক গোপন স্থানে তা কাটা হয়ে বিধল। যেখানে বিধল, সেটা সেকালের মানুষের অন্তহীন বিশ্বাসের জায়গা।

পাণ্ডু বললেন– আপনারাই বলেন যে, নিঃসন্তান লোকের স্বর্গে যাবার অধিকার নেই–অজস্য মহাভাগ ন দ্বারং পরিচক্ষতে। আমার শরীর নষ্ট হলেই আমার পূর্বতন পিতৃগণের পতন হবে। কারণ তাঁদের ঋণ আমি শোধ করতে পারিনি। পিতৃঋণ শোধ করা যায় সন্তানের পালন-পোষণের মাধ্যমে। কিন্তু আমার সন্তানই হয়নি, আমি তাহলে কী করে পিতৃঋণ শোধ করব?

ঋষিরা যতই পার্বত্যভূমি আর দুর্গম পথের কথা বলুন, পাণ্ডু এই স্বর্গ-যাত্রা বা ব্রহ্মলোকে যাত্রার নিষেধটা নিজের মতো করেই ব্যাখ্যা করলেন। পাণ্ডু বললেন–মনুষ্য-জন্ম লাভ করে চার রকমের ঋণশোধ করতে হয় মানুষকে (দেব-ঋণ, ঋষি-ঋণ, পিতৃ-ঋণ এবং মনুষ্য-ঋণ)। আমি নানাবিধ যজ্ঞ করে দেব-ঋণ থেকে মুক্ত হয়েছি। বেদপাঠ এবং তপস্যা করে ঋষি-ঋণ থেকেও মুক্ত হয়েছি। লোকের ওপর দয়া করে মনুষ্য-ঋণ থেকে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু পিতৃ-ঋণ থেকে আমি তো মুক্ত হতে পারিনি, কারণ, আমার সন্তানই নেই–পিৰ্যাদৃণা অনির্মুক্তঃ ইদানীমস্মি তাপসাঃ আমার কী হবে? আমি কি কোনওদিনই স্বর্গের পথে যেতে পারব না?

.

৭৯.

ওঁরা বলেন–এসকেটালজি (Eschatology) সোজা কথায় মৃত্যুর পরপারের ব্যাপার-স্যাপার স্বর্গ-নরক, পিতৃলোক ইত্যাদি। আমাদের পিতৃলোকের তত্ত্বও ওই এসকেটোলজির মধ্যেই পড়ে। তবে কিনা আমাদের শাস্ত্রে-দর্শনে পিতৃলোক বলে যে কথাটা আছে, সেটা ওই এসকেটোলজির চেয়ে অনেক গভীর এবং অনেক জটিল। যে কোনও পুরানো সভ্যতায় সে মিশরীয়ই বলুন, গ্রিক-রোমানই বলুন, অথবা চৈনিক-পিতৃপুরুষের অতিলৌকিক অস্তিত্ব নিয়ে নানা কথা, নানা আচার চালু আছে। পিতৃপুরুষকে সন্তুষ্ট করার নানা উপায়ও বাতলানো আছে শাস্ত্রে। ভারতবর্ষও এই পিতৃলোকের তত্ত্বে এখনও বিশ্বাসী, নইলে শ্রাদ্ধ-সপিণ্ডকরণ, পিতা-মাতার স্মরণ-তর্পণ এখনও চলে কেমন করে?

 মহাভারতের সমাজ বিশ্বাস করত যে, মানুষ চারটি ঋণ নিয়েই পৃথিবীতে জন্মায়। প্রাণিত হওয়ার কারণে সে দেবতার কাছে ঋণী। পালন এবং শিক্ষার জন্য সে ঋষির কাছে ঋণী। পিতা-মাতা একটি মানুষকে পৃথিবীতে আনেন, তার মূত্রপুরীষ ঘেঁটে তাকে বড় করে তোলেন, সেইজন্য মানুষের ঋণ থেকে যায় পিতা-মাতার কাছে। অন্যদিকে সামাজিক সম্পর্কের কারণেই একটি মানুষ অন্য মানুষের কাছে ঋণী হয়। এটাই মনুষ্য-ঋণ। এই চার রকমের ঋণই মানুষকে কোনও-না-কোনও ভাবে শোধ করতে হয়।

পাণ্ডু হস্তিনাপুরের রাজা। রাজা বলেই তাকে নানা যাগ–যজ্ঞ করতে হয়েছে এবং সেই কারণেই দেবতার আহ্বান-তর্পণে তথা দেবতার তুষ্টিতে তাঁর দেব-ঋণ শোধ হয়ে গেছে। ছোটবেলায় ব্রহ্মচর্য আশ্রমে ঋষিদের কাছে তিনি শিক্ষা নিয়েছেন, বেদপাঠ করেছেন, তপস্যা করেছেন এবং এখনও তিনি বানপ্রস্থ অবলম্বন করে যত স্বাধ্যায়-অধ্যয়ন করেছেন, যত তপস্যা করেছেন, তাতে তার ঋষি-ঋণও শোধ হয়ে গেছে বলে পাণ্ডু মনে করেন–যজ্ঞৈস্তু দেবান্ প্রণাতি স্বাধ্যায়–তপসা মুনী। আর মনুষ্য-ঋণ একজন প্রজারঞ্জক রাজার পক্ষে কখনই খুব গুরুভার নয়। কারণ পাণ্ডু প্রতিনিয়ত দান–ধ্যান করেছেন, প্রতিনিয়ত প্রজাদের সুখ-দুঃখ অনুভব করেছেন এবং রাজার আপন ক্ষেত্রে পারিবারিক এবং সামাজিক কর্তব্যগুলি তিনি এমনভাবেই পালন করেছেন যে, মনুষ্য-ঋণও তার শোধ হয়ে গেছে।

বাকি শুধু পিতৃ-ঋণ। শাস্ত্রকারেরা বলেন– সন্তান না জন্মানো পর্যন্ত পিতৃ-ঋণ শোধ হয় না। বস্তুত সন্তানকে গর্ভে ধারণ করা থেকে আরম্ভ করে তার মূত্রপুরীষ পরিষ্কার করা এবং পালন-পোষণ করার মধ্যে যে কষ্ট এবং যন্ত্রণা থাকে, সেই কষ্ট-যন্ত্রণা নিজে ভোগ না করা পর্যন্ত বোধহয় একজন নারী-পুরুষ জীবনের ঋণ থেকেই মুক্ত হন না। পিতা-মাতার ঋণ থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় তাই সন্তান সোয়ং লোকঃ পুত্রেনৈব জয্যো নান্যেন কণা। পাণ্ডুর সেই সন্তান না থাকায় তিনি আজ পরম ব্যথিত হয়ে ব্রহ্মলোকে প্রস্থান-উন্মুখ মুনিদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। পাণ্ডু আন্তরিকভাবে জিজ্ঞাসা করলেন– আমি যেমন আমার পিতার ক্ষেত্রে অর্থাৎ তার পত্নীর গর্ভে বেদব্যাসের ঔরসে জন্মলাভ করেছি, সেইরকম আমার পত্নীদের গর্ভে কীভাবে, কোন উপায়ে আমি পুত্রলাভ করতে পারি– তথৈবাস্মিন্ মম ক্ষেত্রে কথং বৈ সম্ভবেৎ প্রজাঃ।

পাণ্ডুর কথা শুনে বোঝা যায় যে, পূর্বে নিজের পুত্র উৎপাদনের শারীরিক অসামর্থ্যে তিনি যে বানপ্রস্থের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেই প্রতিজ্ঞা এখন শিথিল হয়ে আসছে। পুত্রহীনতার যে জ্বালা তাকে পীড়িত করত, সেই জ্বালা এতকাল স্বাধ্যায়-তপস্যার পরেও সমানই রয়ে গেছে। আরও বোঝা যাচ্ছে নিজের স্ত্রীর গর্ভে অন্যের দ্বারা সন্তান উৎপাদন করাটাকে তিনি যেমন ঘৃণা করতেন, এখন যেন আর সেই কঠিন আপত্তি নেই তার। পুত্রের জন্য আকুল দৃষ্টিতে অন্যের অপেক্ষা করার মধ্যে আগে তিনি কুকুরের সাযুজ্য দেখতে পেতেন, এখন এতদিন পুত্রহীনতার জ্বালায় সেই ঘৃণাবোধ তার চলে গেছে। যে কোনও উপায়ে পুত্র লাভ করার জন্য এখন তিনি চিন্তিত, ব্যস্ত।

তপস্যা-স্বাধ্যায়ে অনেকদিন ব্যস্ত থাকার পর পুত্রলাভ করার জন্য আবার পাণ্ডুর এই উচাটন ভাব আমাদের মতো পাঠকের সন্দেহের উদ্রেক করে। পুত্র-সন্তানের জন্য প্রাচীন পিতা-মাতাদের যে উৎকণ্ঠা আমরা দেখেছি, আধুনিকেরা সেই উৎকণ্ঠার মধ্যে অর্থনৈতিক অভিসন্ধি লক্ষ্য করেছেন। তাঁরা মনে করেন এ হল পরম্পরাগত পৈত্রিক সম্পত্তি নিজের আয়ত্তে রাখার অন্যতম প্রয়াস। পুত্র-সন্তান হলে মৃত্যুর পরেও সম্পত্তি অন্যের ভোগ-দখলে যাবে না, এই আকাঙ্ক্ষাতেই মানুষ পুত্র চায়।

আধুনিকদের এই যুক্তি পাণ্ডুর মনস্তত্ত্বে একেবারেই যে অপ্রযোজ্য, তা আমরা মনে করি না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ধৃতরাষ্ট্র পত্নী গান্ধারী যে, মহামতি ব্যাসের কাছে শত পুত্র লাভের বর লাভ করেছেন এবং তিনি যে ধৃতরাষ্ট্রের সন্তান গর্ভে ধারণ করেছেন– এ খবর পাণ্ডুর কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছেছিল, কারণ ধৃতরাষ্ট্রের লোকেরা যে মাঝে মাঝে পাণ্ডুর কাছে যেতেন, সে খবর আমরা আগেই পেয়েছি।

আগেই বলে রাখি, মহাভারতের কবি এ সব সন্দেহের কথা উচ্চারণও করেননি। সেখানে শুধু দেখেছি–গান্ধারী কুন্তীর আগেই ধৃতরাষ্ট্রের সন্তান ধারণ করেছিলেন– ততঃ কালেন সা গর্ভং ধৃতরাষ্ট্রাদথাগ্রহীৎ–কিন্তু নির্ধারিত প্রসবের সময় পার হয়ে যাওয়ায় কুন্তীর পুত্র জন্যে যায়। আমাদের সন্দেহ ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক গান্ধারীর গর্ভাধানের খবর পেয়েই পাণ্ডু বনে প্ৰব্ৰাজিত অবস্থাতেও পুনরায় পুত্র-সন্তানের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। নিজের দ্বারা না হলেও, এখন যে অন্য কোনওভাবে তিনি পুত্র লাভের পরামর্শ চাইছেন মুনিদের কাছে, সে মনে হয় সবটাই ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক গান্ধারীর গর্ভাধানের সংবাদের ফল। নইলে যে মানুষ অপত্যহীনতার কারণে বানপ্রস্থ অবলম্বন করলেন, অন্যের ঔরসে নিজের স্ত্রীদের গর্ভে পুত্রলাভ যার কাছে কুকুরের মতো অবাঞ্ছিত, সেই মানুষ এখন মহর্ষিদের ডেকে বলছেন– আমি যেভাবে আমার পিতার স্ত্রীর গর্ভে বেদব্যাসের ঔরসে জন্মেছিলাম–যথৈবাহং পিতুঃ ক্ষেত্রে জাতস্তেন মহর্ষিণা– সেইরকম এখন কোন উপায়ে আমি আমার স্ত্রীদের গর্ভে পুত্র লাভ করতে পারি– তথৈবাস্মিন্ মম ক্ষেত্রে কথং বৈ সম্ভবেৎ প্রজাঃ?

মুনিরা পাণ্ডুকে অভয় দিয়ে বললেন– আমরা দিব্য-চক্ষে দেখতে পাচ্ছি–আপনার পুত্রলাভ হয়েছে। আপনি এখন করণীয় কর্মটি করে ঘটনাটি ঘটান–দৈববাৰ্দিষ্টং নরব্যঘ্র কর্মেণেহোপোদয়। তপস্বীদের কথা শুনেই পাণ্ডু তথাকথিত মৃগ–মুনির দুঃখকর অভিশাপের কথা স্মরণ করলেন। প্রজনন-কর্মটি যে-তার দ্বারা সম্ভব হবে না–জানমুপহতাং ক্রিয়া সেটা জানতেন বলেই পাণ্ডু এবার পাকাপাকিভাবে বিকল্প চিন্তায় মন দিলেন। অর্থাৎ সেই নিয়োগ। স্বামী যদি চান তবে নিয়োগ-কর্ম সে যুগে খুব সহজেই হতে পারত। কিন্তু সেখানে সমস্যা একটাই–আপন স্ত্রীদের পুরুষান্তরের সংসর্গে রাজি করাতে হবে। সে খুব সহজ কথাও নয়।

অনেক ভাবনা-চিন্তা করে কথাটা একদিন বিজনে বসে কুন্তীর কাছে পাড়লেন পাণ্ডু। একেবারে প্রাথমিক ভণিতা। বললেন–আমাদের বড় আপদ-কাল চলছে, কুন্তী। আমার নিজের পুত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা নেই। এই বিপদে অন্য কোনওভাবে যদি আমি পুত্র-লাভ করতে চাই, তবে তুমি তা নিশ্চয়ই সমর্থন করবে, কুন্তী–অপত্যোৎপাদনে যত্নমাপদি ত্বং সমর্থয়। পাণ্ডু কুন্তীকে পুত্রহীনতার সমস্যা এবং দুঃখ– দুইই অনেক বুঝিয়ে নিজের অসামর্থ্যের কথাটাও বুঝিয়ে বললেন।

বস্তুত পাণ্ডু এই মুহূর্তে তার প্রজনন-শক্তি নষ্ট হওয়ার জন্য মৃগ মুনির অভিশাপকে যেমন দায়ী করলেন, তেমনই সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝি স্বীকার করে নিলেন যে, পূর্বেও এই বিষয়ে তার বেশ কিছু সমস্যা ছিল। কুন্তীকে তিনি বলেছেন–আমি অশিক্ষিতই রয়ে গেছি, তাই এমন নৃশংস কাজ করেছি। মৃগ মুনির অভিশাপে আমার প্রজনন-ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে, অবশ্য পূর্বেও আমার এই ক্ষমতা খানিকটা দুর্বলই ছিল– মৃগাভিশাপান্নষ্টং মে… যথৈবোপহতং পুরা। মহাভারতের টীকাকারেরা এই শ্লোকের অর্থ এমনভাবেই করার চেষ্টা করেছেন যাতে মনে হয়–মুনির অভিশাপেই পাণ্ডুর এই অবস্থা, আদতে তিনি ক্লীব ছিলেন না। যেটা খারাপই ছিল– যথৈব উপহতং পুরা– সেটা নষ্ট হয়ে গেছে– সোজাসুজি এই শ্লোকার্থ গ্রহণ না করে টীকাকারেরা বলেছেন– মৃগমুনির শাপে প্রজনন-ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে, তার মধ্যে এসে জুটেছে মরণের ভয়। সেই ভয়েই পাণ্ডুর দিক থেকে আর রতি ক্রিয়ার অবকাশ নেই। এটা শুধু অভিশাপের ভয়, পাণ্ডু নিশ্চয় ক্লীব ছিলেন না– নষ্ট অসদ্ৰপং জাতং জননং স্ত্রীসঙ্গাখ্যং রতিকর্ম, যত উপহত, যথা মৃগস্য তথৈবান্তরামৈথুনং মমাপি মরণপ্রাপ্তি–নিশ্চয়াৎ, ন তু ক্লীবত্বাৎ।

 এই শ্লোকার্থে পাণ্ডুকে কেউ যদি কোনওভাবে ক্লীব বলেন, সেই রকম একটা আশঙ্কা এবং নিজস্ব কিছু পূর্ব-সচেতনতা আছে বলেই নীলকণ্ঠের মতো টীকাকারও এই মুহূর্তে চিন্তিত। নইলে, মুনির অভিশাপে স্ত্রী সঙ্গ মাত্রেই পাণ্ডুর মৃত্যু নির্ধারিত হয়েছে। এখানে পূর্বোপহত জননশক্তি মুনির শাপে নষ্ট হয়েছে– এ কথা বলার মানেই হল– প্রজননের ক্ষেত্রে পাণ্ডুর সমস্যা ছিল এবং তা পূর্বেই ছিল–যথৈবোপহতং পুরা।

 পাণ্ডু সেই গোপন কথা স্ত্রীদের জানাননি। এখন তিনি সমাজ-সম্মত অন্য কোনও উপায়ে পুত্র লাভ করতে চাইছেন। পাণ্ডু মনু-কথিত ধর্ম শাস্ত্রের বচন অনুসারে ছয় রকমের পুত্রের কথা বলেছেন, যারা অনায়াসেই পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারী হতে পারে– ইমে বৈ বন্ধুদায়াদাঃ ষট পুত্রা ধর্মদর্শনে। পৃথে। বিবাহিতা স্ত্রীর গর্ভে ঔরসজাত সন্তান ছাড়াও যে সমস্ত পুত্র পিতৃ-সম্পত্তির অধিকারী হতে পারে– এই কথাটা এই মুহূর্তে কুন্তীর কাছে বলা মানেই রাজ্যপাটের উত্তরাধিকার নিয়ে পাণ্ডুর সচেতনতা আছে। অর্থাৎ আধুনিকেরা প্রাচীনদের পুত্রোৎপাদনের মর্ম নিয়ে যে অভিসন্ধির কথাটা বলেন– সেটা তাহলে মিথ্যে নয়।

 সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য একথাও জানাতে হবে যে, সে কালের প্রাচীনেরা আধুনিকের থেকেও বেশ খানিকটা আধুনিক ছিলেন। বিবাহিতা স্ত্রীর গর্ভে জাত ঔরস পুত্র ছাড়াও অন্য যে পুত্রেরা পিতার ধনের অধিকারী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় হলেন ক্ষেত্রজ। অর্থাৎ নিজের স্ত্রীর গর্ভে অন্য কোনও উত্তম পুরুষের দ্বারা উৎপাদিত নিয়োগজাত পুত্র। অন্য মাতা-পিতার কাছ থেকে ন্যায্য মূল্য দিয়ে পুত্রহীন পিতা-মাতা যদি পুত্র ক্রয় করেন, তবে সেই পরিক্রীত শিশুটিও পিতার পুত্র বলে পরিচিত হবে। পতি-পরিত্যক্ত বা অন্যের বিধবার গর্ভে যদি কেউ পুত্রলাভ করেন, তবে সেই পুত্রের বিশেষণ হল পৌনৰ্ভব পুত্র। পিতার ঘরে কন্যা-অবস্থায় যে মাতা পুত্র লাভ করেছিলেন, সেই কানীন পুত্রও শাস্ত্রের নিয়মে বিবাহিত পতির পুত্র বলে পরিচিত হবেন। এই তালিকার শেষে আছেন–গৃঢ়েৎপন্ন পুত্র। যিনি বিবাহ করেছেন সেই পুরুষের স্ত্রী যদি স্বৈরিণী হয়ে যান এবং আপন স্বেচ্ছাচারিতায় অন্য পুরুষের পুত্র গর্ভে ধারণ করেন তবে সেই পুত্রের ব্যাপারে বিবাহিত পুরুষটির কোনও জ্ঞান না থাকলেও সে যেহেতু তারই ঘরে জন্মেছে, অতএব তাকে পুত্র বলেই মেনে নিতে হবে এবং সেও পিতৃ ধনের অধিকারী হবে।

 সমাজ-স্বীকৃত পুত্রেরা কিন্তু মাত্র ছ-রকমের নয়, বার রকমের। অবশিষ্টরা হল– দত্তক পুত্র, অপবিদ্ধ, কৃত্রিম (যাকে পুত্রের মতো মানুষ করা হয়) স্বয়ংদত্ত, সহোঢ় ও শৌদ্র (পারশব)। এদের মধ্যে সবাই যে পিতার সম্পত্তি পাবে তা নয়। তবে ঔরস পুত্র ছাড়াও ক্ষেত্রজ, দত্তক, কৃত্রিম, অপবিদ্ধ (যাকে মূল্য দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে। এমনকি গূঢ়েৎপন্ন স্বৈরিণী-পুত্রও পিতার ধনে অধিকারী– যদিও সেই অধিকার প্রথম প্রকার পুত্রের অভাবে পর পর জনের–

ঔরসঃ ক্ষেত্ৰজশ্চৈব দত্তঃ কৃত্রিম এব চ।
গূঢ়োৎপন্নোপবিদ্ধশ্চ দায়দা বান্ধবাশ্চ ষট্‌।

 পাণ্ডু কুন্তীকে সমাজ-সম্মত পুত্রের তালিকা শোনালেন এবং সবার শেষে জানালেন আপৎকালে একটি স্ত্রীলোক অন্য কোনও বড় মানুষের কাছ থেকেও তো পুত্র লাভ করতে পারে, এমনকি এই সময়ে দেবরের কাছ থেকেও পুত্র লাভ করে–উত্তমা দেবরাৎ পুংসঃ কাক্ষন্তে পুত্রমাপদি। আপন বংশের ধারাটা তো তাতে বজায় থাকল। মুখ ফুটে আর বলা গেল না যে, সম্পত্তিটাও তো তাতে নিজের ঘরেই থাকল। এতক্ষণ তত্ত্ব নীতি, সামাজিক প্রচলনের কথা বলে পরিশেষে পাণ্ডু কুন্তীকে অনুরোধের সুরে বললেন– তুমি তোমার মর্যাদার অনুরূপ অথবা তোমার চেয়েও মর্যাদায় বড় মানুষের ঔরসেই না হয় পুত্র লাভ করার চেষ্টা। করো–সদৃশাচ্ছেয়সঃ বা ত্বং বিন্দাপত্যং যশস্বিনি।

পাণ্ডুর মুখে সমাজ-স্বীকৃত বার রকমের পুত্রের কথা শুনে এবং পাণ্ডুর মনোগত ইচ্ছা বুঝে এই মুহূর্তে কুন্তী কিন্তু হাত তুলে বলতে পারতেন–তোমার কোনও চিন্তা নেই। আমার কন্যাবস্থায় পিতৃগৃহে যে কানীন পুত্রের জন্ম দিয়েছিলাম, তাকেই তুমি নিজ পুত্রের মর্যাদায় প্রতিপালন করো। পাণ্ডু যখন সমাজ-স্বীকৃত পুত্রের তালিকায় কানীন শব্দটি উচ্চারণ করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে মহাভারতের টীকাকারেরা কিন্তু বলেছেন–কানীন পুত্র পরিণয় সম্বন্ধযুক্ত পুরুষটির পুত্র বলেই স্বীকার করতে হবে এবং সেই সম্বন্ধে ভবিষ্যতের কর্ণও পাণ্ডুরই পুত্র, তিনিও পাণ্ডব– কানীন–স্তকন্যা–পরিণেতুরেব পুত্রঃ। এবঞ্চ কর্ণঃ পাণ্ডোরেব পুত্র আসীদিতি বোধ্য।

 এই মুহূর্তে পাণ্ডুর মনের অবস্থা যা ছিল, তাতে কুন্তী যদি তার কন্যাবস্থার চপলতাটুকু বর্ণনা করে পাণ্ডুর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলতেন– কোনও উত্তম পুরুষ নয়, এক উত্তম দেবতা এই পুত্রের জনক, তাহলে কোনও সন্দেহ নেই পাণ্ডু সাগ্রহে কুন্তীর প্রস্তাব মেনে নিয়ে রাজরানীর প্রথম সন্তানটিকে খুঁজতে পাঠাতেন। কিন্তু কুন্তী তার কানীন পুত্রের সংবাদ তার প্রিয় স্বামীর কাছে নিবেদন করলেন না। সেটা আমাদের সৌভাগ্যও বটে, দুর্ভাগ্যও বটে।

 সৌভাগ্য এইজন্য যে, তাতে ভবিষ্যতে কর্ণকে নিয়ে মহাকাব্যের অনন্ত রস সৃষ্টি হত না। এই সামান্য এক অস্বীকৃতির ফলে কুন্তী এবং কর্ণের মধ্যে যে জটিল মনস্তত্ত্বের অবসর রয়ে গেল, বাৎসল্য, বীর এবং করুণ রসের যে বৈচিত্র্য ভবিষ্যতের উপকরণ হিসেবে ভোলা থাকল, তা মহাকাব্যের কবি হিসেবে দ্বৈপায়ন ব্যাস এখনই তরল করে দেন কী করে। কুন্তী যদি কর্ণের কথা বলতেন, তা হলে মহাকাব্যের বিষয় হত সোজা, সরল, বর্ণহীন। কর্ণ রাজা হতেন আর হস্তিনাপুরের রাজনীতি বয়ে চলত আর পাঁচটা রাজ্যের মতো সরল গড্ডলিকায়। ভবিষ্যতে মহামতি কর্ণের পরিণতিতে নিশ্চয়ই আমরা দুঃখ পাব, কিন্তু এই দুঃখটুকু না পেলে মহাকাব্যের অভীষ্ট থেকেই আমরা বঞ্চিত হতাম। সেটা কি ভাল হত?

 অবশ্য কুন্তী যে এই মুহূর্তে পাণ্ডুর কাছে তার সমস্ত অতীতকে প্রচ্ছন্ন রেখে দিলেন, তার দুটি কারণ আছে। প্রথম কারণ, শৈশব কাল থেকে তার বিবাহ পর্যন্ত নানা দুঃখে আকীর্ণ হয়ে আছে তার জীবন। পিতার ঘর ছেড়ে এসে অন্যের ঘরে পালিত হওয়ার দুঃখও তিনি ভুলতে পারতেন, কিন্তু বিবাহের পূর্বাধ্যায়ে তার প্রথম যৌবনেই যে সৌর কলঙ্ক নিজের শরীরে বহন করলেন, তিনি তা সামাজিক দৃষ্টিতে আদরণীয় নয় বলেই প্রিয় স্বামীর কাছে কুন্তী বলতে পারেননি। সব জায়গায় দুঃখ পেয়ে অন্তত স্বামীর ঘরে তিনি সুখ পেতে চেয়েছিলেন। স্বামীর কাছে সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত থাকার জন্যই তোক অথবা স্বামী যদি এতকাল পরে এই অবৈধ-প্রসূতির কথা শুনে দুঃখ পান, সেই ভয়েই কুন্তী পাণ্ডুকে কিছু বলেননি। আসলে কুন্তী নিজেই অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রকৃতির মানুষ। পাণ্ডু নিজেই যেখানে কানীন পুত্র অথবা গূঢ়েৎপন্ন স্বৈরিণী পুত্রকেও নিজের পুত্র হিসেবে মেনে নিতে চাইছেন, সেখানে কুন্তী তার কানীন পুত্রের কথা বললে পাণ্ড যে মেনে নিতেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কুন্তী নিজের মধ্যেই এত জটিলতা বহন করছেন, এতই তিনি সংবেদনশীল যে, কোনও কারণে তার প্রিয় স্বামী যদি তাকে অবিশ্বস্ত মনে করেন, তাহলে তো সে দুঃখ আর তর সইবার উপায় থাকবে না।

আরও একটা কারণ আছে এই না বলার পিছনে। যেটা উত্তরাধিকারের আইন সংক্রান্ত কথা। বার রকমের পুত্রের মধ্যে যে ছয় জন পিতার সম্পত্তিতে অধিকার লাভ করে তার মধ্যে কানীন পুত্রের স্থান নেই। মনু বলেছেন–পিতার ঘরে জন্মানো কন্যার পুত্র, মূল্যের দ্বারা লব্ধ পুত্র, অন্যের বিধবার পুত্র, গর্ভাবস্থায় বিবাহিতা রমণীর পুত্র এবং আরও এইরকম দুই ধরনের ছেলে পিতার সম্পত্তিতে অধিকার লাভ করে না।

কানীনশ্চ সহোঢ়শ্চ–ক্রীতঃ পৌনর্ভবস্ত থা।
স্বয়ংদত্তশ্চ শৌদ্রশ্চ ষডদায়াদবান্ধবাঃ।

সেকালের দিনে কুন্তীর মতো মনস্বিনী রমণীরা এই আইনের কথা জানতেন এবং হয়ত সেই কারণেই তিনি তার কানীন পুত্রটির কথা বলেননি। তিনি ভেবে থাকতে পারেন পুত্র লাভের সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডু তার রাজকীয় উত্তরাধিকারও তো সেই পুত্রের হাতে দিয়ে যেতে চান। নইলে বার কিসিমের পুত্র–কল্প বোঝানোর সময় কোন ধরনের পুত্রেরা রাজ্যের অধিকার পাবে এবংঙ্গারা পাবে না– ইমে বৈ বন্ধুদায়াদাঃ… যড়ে অবন্ধুদায়াদাঃ– এই বিভাজনটি প্রথমেই উল্লেখ করে নিতেন না পাণ্ডু। সমাজ-স্বীকৃত পুত্রের তালিকা দেবার আগেই ধনাধিকারীর বিভাজন উল্লেখ করার মধ্যেই যেন এক সতর্কবাণী আছে, যেটা কুন্তীর মতো পোড় খাওয়া মহিলার অবোধ্য থাকার কথা নয়। এই নিরিখে কুন্তী তার কানীন পুত্রের কথা উল্লেখ করেও যদি দেখতেন পাণ্ডু তাকে হস্তিনাপুরের, উত্তরাধিকারীর মর্যাদা দিতে পারছেন না, তবে কুন্তীর মানসিক অবস্থাটা আরও জটিল হয়ে উঠত–মানও যেত, কার্যসিদ্ধিও ঘটত না।

 কুন্তী-মাদ্রী পাণ্ডুর কথার উত্তরে কিছু বলেননি বলেই পাণ্ডু কোনও মহান পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কুন্তীকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে চাইলেন। পাণ্ডু বললেন– তুমি শারদণ্ডায়নীর নাম শুনেছ? তার গর্ভে সন্তান আসে না দেখে তাঁর স্বামী নিজের দোষ বুঝলেন এবং স্ত্রীকে বললেন তুমি ক্ষেত্রজ সন্তান লাভের চেষ্টা করো। স্বামীর আদেশ নিয়ে শারদণ্ডায়নী গর্ভধারণের উপযোগী উর্বর সময়ে রাস্তার চৌমাথায় গিয়ে এক যোগসিদ্ধ ব্রাহ্মণের সন্ধান পেলেন। শারদণ্ডায়নী পুত্রার্থিনী হয়ে তাকে বরণ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই যোগী পুরুষ হোম সমাপ্ত করে তার সঙ্গে মিলিত হলেন– কর্মণ্যবসিতে তস্মিন্ সা তেনৈব সহাবসৎ। এইভাবে শারদণ্ডায়নীর তিনটি বীর পুত্র জন্মলাভ করেছিল।

উপাখ্যান শেষ করে পাণ্ডু ক্ষেত্রজ পুত্রলাভে নিজের স্বীকৃতি জানিয়ে বললেন–আমার আদেশে তুমিও একজন উৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণ-সজ্জনের সঙ্গে মিলিত হয়ে পুত্র লাভের চেষ্টা করো–মন্নিয়োগা যত ক্ষিপ্রম্ অপত্যোৎপাদনং প্রতি। অর্থাৎ ক্ষেত্রজ পুত্র লাভ করার জন্য গুরুস্থানীয় ব্যক্তিদের যে সম্মতি লাগে, সেই সম্মতি দিয়ে দিলেন স্বয়ং স্বামী।

 কথাটা শুনে কুন্তীর যে খুব ভাববিকার হল তা নয়। পাণ্ডু যে পুত্রোৎপাদনে সত্যি সত্যিই অসমর্থতা তিনি জানতেনও না এবং মৃগমুনির অভিশাপেও যে তিনি খুব বিশ্বাস করেছেন, তাও বোধহয় নয়। অন্তত তার কথা শুনে পরিষ্কার বোঝা যায় পাণ্ডুর অসামর্থ্য সম্বন্ধে তার কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কুন্তী শীতলভাবে পাণ্ডুকে বললেন– এমন করে বোলোনা, রাজা– ন মামহসি ধর্ম বমেবং কথঞ্চন। ধর্মের তত্ত্ব, তুমি ভালই জান এবং আমরাও তোমার ধর্মপত্নী। তোমাকে ভালবাসার ক্ষেত্রেও কোনও ঘাটতি নেই আমাদের। সেখানে আমার কাছে এমন একটা প্রস্তাব তুমি করলে কেমন করে–ধর্মপত্নীমভিরতাং ত্বয়ি রাজীব-লোচন।

কুন্তী নিজের বাল্য চপলতায় সূর্যের শয্যা-সঙ্গিনী হয়েছিলেন, সে কথা মনে রেখেও স্বামীর প্রতি চিরন্তন প্রত্যয়ে তাকে উৎসাহিত করে বললেন– মহারাজ! আমার গর্ভে তুমিই তোমার পুত্রের জন্ম দেবে– ত্বমেব তু মহারাজ ময্যপত্যানি ভারত। তোমার শক্তিতেই আমার গর্ভে তোমার বীর পুত্রের জন্ম হবে– বীরবীর্যোপপন্নানি ধর্মততা জনয়িষ্যসি।

স্পষ্ট বোঝা যায়– মৃগ-মুনির শাপের কোনও বিশ্বস্ততা নেই কুন্তীর কাছে। শক্তিহীন স্বামী যেমন করে পুত্র লাভের চেষ্টা করে পাণ্ডু সেইভাবেই এতকাল চেষ্টা করেছেন। সন্তান-জন্ম বিফল হয়ে যাওয়ায় এখন আর তিনি নিজেকে বিশ্বাস করছেন না। কিন্তু কুন্তী সাধ্বী স্ত্রীর মতো স্বামীর প্রতি অনন্ত মায়ায় তাকে পুনরায় পুত্রলাভে উদযুক্ত করে বলছেন– সন্তানের জন্য আবারও তুমি আমাতে উপগত হও–অপত্যায় চ মাং গচ্ছ ত্বমেব কুরুপুঙ্গব আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে মনে মনেও সংসর্গ করতে রাজি নই। আর তাছাড়া আমার স্বামীর চেয়ে বড় মানুষ আর কে আছে এই পৃথিবীতে ত্বত্তঃ প্রতিবিশিষ্ট কোনো স্তি ভুবি মানবঃ।

কোনও উত্তম উৎকৃষ্ট পুরুষের সংসর্গে পুত্র লাভ করার জন্য পাণ্ডু উপদেশ দিয়েছিলেন কুন্তীকে। কুন্তী পাণ্ডুর চেয়ে অন্য কোনও উৎকৃষ্ট পুরুষে বিশ্বাস করেন না। এই মুহূর্তে মৃগমুনির শাপের কোনও জ্ঞানই কুন্তীর বাক্যে উল্লেখিত না থাকায় এই অভিশাপ একান্তই ভিত্তিহীন মনে হচ্ছে। শুধু যেটা হতে পারে– পাণ্ডু পুত্রোৎপাদনে অসমর্থ– সেটাও কুন্তীর কাছে এখনও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি, পাণ্ডু বললেও হয়নি। পুত্র লাভের ব্যাপারে এখনও তিনি স্বামীর ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *