হায় কবি, তুমি শুধু কবি
ছন্দের খাতিরে এবং একটি ভাল চুরি করার লোভে এই নিবন্ধের নামকরণেই কেমন গোলমাল হয়ে গেল।
আসলে কোনও কবিই শুধু কবি নন। তিনি চাকুরিজীবী, সাংবাদিক বা অধ্যাপক, শখ করে কিংবা প্রাণের তাগিদে কিংবা তেমন তেমন ক্ষেত্রে সম্পাদকের তাগিদে মাঝে মধ্যে কবিতা রচনা করে থাকেন।
সবসময় কবিতা লেখা বা কবিতা আওড়ানো, কাব্যসাগরে নিমজ্জিত হয়ে থাকা অথবা সদাসর্বদা পদ্যের সৌরভে মশগুল হয়ে থাকা এসবই এক ধরনের পাগলামি, মোটেই কবিত্বের লক্ষণ নয়। এ ধরনের লেখককে সবাই যথাসাধ্য এড়িয়ে চলে।
শুধু কবি হওয়া কঠিন। অন্তত এদেশে কঠিন, কোনও জীবিকা হওয়া সম্ভব নয়। কবিতা লিখে জীবন ধারণ, সংসার প্রতিপালন, গ্রাসাচ্ছাদনের বন্দোবস্ত, শুধুমাত্র কবিতা লিখে অসম্ভব। একটা সাধারণ কবিতার বইয়ের দাম বড় জোর দশ টাকা। সবচেয়ে জনপ্রিয় বইটি যদি বছরে তিনটি সংস্করণও হয় তবে তার যা রয়ালটি প্রকাশক দেবেন (অবশ্য যদি দেন) সেটা যে কোনও অফিসের নিম্নতম কর্মচারীর বার্ষিক বেতনের এক তৃতীয়াংশ। যে কোনও নামকরা ডাক্তার বা উকিলের একবেলার আয়ের চেয়েও হয়তো কম।
কবির আলোচনায় টাকা-পয়সা ডেকে আনা মোটেই উচিত হল না। আর তা ছাড়া, এত উচ্চমার্গের আলোচনা সঠিক হচ্ছে না।
কবিতার ও কবির বিষয়ে আলোচনার সঠিক পটভূমিকা হল, লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ। অতঃপর আমরা সেই হাসি হাসি গন্ধের পৃথিবীতে প্রবেশ করছি।
একবার এক তরুণ কবি আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখুন, সম্পাদকেরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে।’ এ রকম কথা অনেকের কাছ থেকে অনেকদিন ধরেই শুনছি, তবু ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার এরকম মনে হচ্ছে কেন?’ তিনি বললেন, ‘ষড়যন্ত্র না হলে আমার একই কবিতা পরপর সাতজন সম্পাদক ফেরত দেন।’
অন্য এক কবির বিয়ের ব্যাপারে একটা অত্যন্ত জটিল গল্প শুনেছিলাম। ঠিক বিয়ে নয়, বিয়ের আগের ব্যাপার। বিয়ে তখন প্রায় ঠিক হওয়ার পর্যায়ে এসেছে, এই সময় তরুণ কবি তাঁর প্রেমিকাকে খুব আশা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, আমি যে কবিতা লিখি সে কথাটা তুমি তোমার বাড়ির লোকদের বলেছ?’
কবির ধারণা কন্যাপক্ষের অর্থাৎ তাঁর ভাবী শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁর কবিপ্রতিভার কথা জানলে নিশ্চয় গৌরব বোধ করবে। কিন্তু কবিপ্রেমিকা যা বললেন সে নিতান্ত ভয়াবহ। প্রেমিকা বললেন, ‘দ্যাখো আমি সব আস্তে আস্তে ভাঙছি। অল্প অল্প করে মা-বাবাকে সব বোঝাতে হচ্ছে। সব ধীরে ধীরে খুলে বলছি।’ কবি একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘কী ধীরে ধীরে খুলে বলছ? ব্যাপারটা কী?’
প্রেমিকাটি বললেন, ‘দ্যাখো রাগ করবে না। সব কথা একবারে বললে আমাদের বিয়েটা হয়তো ভেঙেও যেতে পারে। তুমি যে জুয়ো খেলো, তুমি যে মাঝে মধ্যে মদ খাও, তুমি যে এখনও বি. এ. পাশ করতে পারোনি এগুলো আস্তে আস্তে বলেছি। তবে তুমি যে কবিতাও লেখো একথাটা বলার সাহস পাইনি এখন পর্যন্ত। একদিন অবস্থা বুঝে সময়মতো বলব।’
এই প্রেমিকাটি শেষ পর্যন্ত তার বাড়িতে তার দয়িতের কাব্যচর্চার কথা বলেছিল কিনা এবং সত্যিই জুয়োখেলা কিংবা মদ্যপানের চেয়েও কবিতা লেখা খারাপ কিনা আমরা সে অগ্নিগর্ভ আলোচনায় প্রবেশ করব না।
তবে সেই ওমর খৈয়াম কিংবা তারও অনেক আগে শুরু হয়েছে; মাইকেল মধুসূদন থেকে ডিলান টমাস ছুঁয়ে এই কবিপ্রধান কলকাতা শহরের খালাসিটোলা-বারদুয়ারিতে কবিতার সঙ্গে মদিরা, মদিরার সঙ্গে কবিতা অনেকদিন একাকার হয়ে গেছে।
শুধু মদ্যপান নয়, যেন জীবনযাপনে বিশৃঙ্খলা কবিত্বের প্রধান উপাদান—এইরকম ধারণা অনেকের; অনেক কবি যশোপ্রার্থীর। বিট প্রজন্মের কবিদের উল্লেখ বা অনুসরণ করে অনেক আধাকবিই বিশৃঙ্খলতার সপক্ষে একটা যুক্তি খুঁজে নেন। এতে কারও কোনও ক্ষতি বা লাভ হয় না, শুধু ব্যক্তিগত জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হন সেই ব্যক্তি—যিনি কী চাইছেন বা কী করছেন সেটা জানেন না।
শুনেছি কোনও এক পাড়ার এক বড়দা এক নাবালক মাতাল আধাকবিকে ড্রেন থেকে তুলে মাঘ মাসের মধ্যরাতে টিউবওয়েলের নীচে শুইয়ে স্নান করাতে করাতে বলেছিলেন, ‘অমুকদার কাছে মদ খাওয়াটা শিখলি, কবিতা লেখাটা শিখতে পারলি না। কবিতা যা লিখিস তাতে তোর চা খাওয়ারও যোগ্যতা নেই।’
সকলেই কবি না, কেউ কেউ অকবি। যার কবিতা লেখা হবে, মদ খেলেও হবে, মদ না খেলেও হবে, ফুটপাথে বা ড্রেনে পড়ে থাকলেও হবে, ঘরে শুলেও হবে।
বোধহয় এসব গূঢ় চিন্তা করেই সেই বহু বিদিত গ্রিক দার্শনিক তাঁর আদর্শ কল্পরাজ্যের থেকে কবিদের নির্বাসনের চিন্তা করেছিলেন। এরও চারশো বছর পরে মহাকবি ভার্জিলের পরম সুহৃদ স্যাটায়ার রচনার জনক কবি হোরাস (হেরোটিয়াস) কবিদের এক বিরক্তিকর প্রজাতি বলে অভিহিত করেছিলেন।
আমি এ বিষয়ে এই হালকা রচনায় মাথা গলাব না। দু’-একজন বিপজ্জনক কবির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় আছে তাই ব্যাপারটা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। বরং দু’-একটা পুরনো গল্প স্মরণ করি।
বড় ভাই উঠতি কবি, তার বয়েস একুশ। রাত দিন পাতার পর পাতা ছাইভস্ম ইনিয়ে বিনিয়ে লিখে যাচ্ছে। তার লেখাপড়া চুলোয় গেছে, এমনকী নাওয়া-খাওয়ার পর্যন্ত ঠিক নেই। সারাদিন মনের আবেগে খাতা ভর্তি করে কবিতা লিখে যাচ্ছে আর নিজের কবিতা আওড়াচ্ছে।
দাদা, মানে এই কবি বড়ভাই বাথরুমে গেছে। তার নীচে আরও এক ভাই, এক বোন আছে। ভাইয়ের বয়েস বছর বারো আর বোন ছোট, চার-পাঁচ বছর বয়েস হবে।
ছোট বোনটি নাম ওই খুকু, একট চঞ্চলা স্বভাবের, এ বয়সের মেয়েরা যেমন হয়। হঠাৎ মেজো ভাই দেখল বোনটি দাদার কবিতার খাতাটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে রান্নাঘরে উনুনের মধ্যে ঢেলে দিয়ে এল। মা তখন রান্নাঘরের পাশে ভঁড়ার ঘরে কুটনো কাটছিলেন, ভাই ছুটে গিয়ে সেখানে নালিশ জানাল, ‘মা, তাড়াতাড়ি এসো, সর্বনাশ হয়েছে, খুকু এইমাত্র দাদার কবিতার খাতা উনুনে আগুনের মধ্যে ঢেলে দিয়েছে।’ মা-র মধ্যে কিন্তু ভাবান্তর দেখা গেল না, তিনি বললেন, ‘সেকী। খুকু এরই মধ্যে কি পড়তে শিখেছে?’
শেষ গল্পটি তিরিশ বছরের পুরনো। তখনকার এক দুর্দান্ত ও দুর্মদ কবিকে মধ্যরাতে পুলিশ রাস্তায় মাতলামি করার অজুহাতে থানায় নিয়ে এল। রাতটা থানার লকআপে কাটল। পরদিন সকালে, সেই থানায় যে বড়বাবু তিনি আবার পুলিশ হলেও খুব নীতিবাগীশ, কবিকে ছেড়ে দেবার আগে একচোট উপদেশ দিলেন। অবশেষে মদ্যপানের বিরুদ্ধে একটা উদাহরণ দিয়ে কবিকে বললেন, ‘আচ্ছা, এখানে যদি এক গামলা জল আর এক গামলা হুইস্কি রাখি, তারপর একটা গোরুকে নিয়ে আসি, সে কোনটা খাবে?’
এই অবান্তর প্রশ্নে কবি চুপ করে থাকায় বড়বাবু নিজেই প্রাঞ্জল হলেন, বললেন, ‘বুঝলেন মশায়, সে আপনার মতো ওই মদটা খেতে যাবে না, স্বাভাবিকভাবেই সে জলটা খাবে।’
এতক্ষণ চুপ করে তাকার পরে কবি এবারে মুখ খুললেন, দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘হ্যাঁ সেইজন্যেই সে গোরু, আর আমি কবি।’