সমান-সমান
পৃথিবীতে কোনও দুটো জিনিস সমান-সমান নয়। হাতের দুটো আঙুল এক সমান নয়। দুটো মানুষ, এমনকী যমজ দুই ভাইও কখনও একরকম হয় না। কোথাও কিছু পার্থক্য থাকেই।
শুধু মানুষ কেন একই গাছের একই ডালের দুটি পাতা যারা একই মুহূর্তে বিকশিত হয়েছে, একই রোদে হাওয়ায় একইরকম সবুজ হয়েছে, একটু খুঁটিয়ে দেখলেই দেখা যাবে সেই পাতা দুটির মধ্যেও বিস্তর না হোক সামান্য কিছু ফারাক রয়েছে। দুটি তুচ্ছ দুর্বাদল, দুটি ক্ষুদ্র পিঁপড়ে পরস্পরের সঙ্গে তাদের যত মিলই থাকুক, তবু কিছু ব্যতিক্রম থাকবেই।
উপকথার সেই বিখ্যাত বানর এই অসমানত্বের সুযোগ নিয়েছিল। কাহিনীটা সুবিদিত, বিস্তারিত লেখার কিছু নেই। একটা বানরকে দেওয়া হয়েছিল একটা পিঠে দুই সমান অংশে ভাগ করতে। সেই থেকে ‘বানরের পিঠে ভাগ’ প্রবাদটি চালু হয়েছে।
প্রথমবার বানর পিঠেটি ভাগ করল, এক অংশ একটু বড় অন্য অংশ একটু ছোট। এবার বড় অংশটা একটু কমিয়ে ছোট অংশটার সমান করার জন্য বানর বড় অংশটায় একটা কামড় বসাল।
বানরের কামড়, সুতরাং সেটা একটু বড় কামড় হয়ে গিয়েছিল। ফলে প্রথম অংশটা এবার দ্বিতীয় অংশের চেয়ে ছোট হয়ে গেল। ফলে বানরকে দ্বিতীয় অংশে কামড় বসাতে হল প্রথম অংশের সমান করার জন্যে।
অতঃপর যা হওয়া উচিত তাই হল। দ্বিতীয় অংশ প্রথম অংশের চেয়ে ছোট হয়ে গেল। ফলে আবার কামড়, এবার প্রথম অংশে, এবং পৌনঃপুনিকভাবে প্রথম এবং দ্বিতীয় অংশে কামড় দিতে দিতে বানর সম্পূর্ণ পিঠেটি উদরসাৎ করল। যারা বানরের কাছে পিঠে ভাগ করতে দিয়েছিল তারা শূন্যহাতে ফিরে গেল।
* * *
এবার সমান-সমানের দু’-একটা জাগতিক উদাহরণ দিই।
মার্কিন ধনকুবের এনড্রু কারনেগির কাছে একবার এক সমাজতন্ত্রী গিয়েছিলেন। সেই সমাজতন্ত্রী কারনেগিকে বোঝাতে লাগলেন যে একজন মানুষের এত বেশি ধনসম্পদ, অর্থ থাকা খুবই অন্যায়। সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বার্থে অবিলম্বে কারনেগির সমস্ত সম্পদ সমস্ত মানুষের মধ্যে বণ্টিত হওয়া উচিত।
লোকটির কথা শুনতে কারনেগির মূল্যবান সময় বেশ কিছু ব্যয় হল, তবে তিনি মনোযোগ দিয়ে এবং হাসিমুখে লোকটির কথা ভাল করে শুনলেন। তারপর তাঁর ব্যক্তিগত সচিবকে ডাকলেন, ডেকে বললেন, ‘দ্যাখো তো, আমার সমস্ত সম্পত্তি বাড়ি-ঘর জমিজমা, শেয়ার ডিবেঞ্চার, কল-কারখানা সেইসঙ্গে নগদ আর ব্যাঙ্কের টাকা পয়সা, বাজারে পাওনা সব মিলিয়ে কত টাকা হয়?’
কিছুক্ষণ হিসেব করে ব্যক্তিগত সচিব বললেন, ‘স্যার মোটামুটি অর্থের হিসেবে সমস্ত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় একশো কোটি ডলার।’
এটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগের কথা। তখনকার বাজারদরে এই টাকার মূল্য অপরিসীম! সে যা হোক, এরপরে কারনেগি সমাজতন্ত্রী ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, এখন পথিবীর লোকসংখ্যা কত?
কারনেগি কেন এসব প্রশ্ন করছেন সেসব ধরতে না পেরে ভদ্রলোক বললেন, ‘একশো দশ কোটি ছিল, তবে এখন বেড়ে প্রায় সোয়াশো কোটি হয়েছে।’
সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের ওপরে রাখা কাগজের প্যাডে একশো কোটি ডলারকে সোয়াশো কোটি দিয়ে ভাগ করলেন কারনেগি, ভাগফল পাওয়া গেল আশি সেন্ট।
কারনেগি তখন তাঁর সচিবকে বললেন, ‘এই ভদ্রলোককে ওঁর অংশের আশি সেন্ট দিয়ে দাও তো।’ তারপর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মিটল তো আপনার সমস্যা?’
* * *
সমীকরণের সমস্যা অবশ্য এত সহজে মেটানো সম্ভব নয়। জার্মান প্রবাদ আছে, একমাত্র গোরস্থানেই সবাই সমান। এ বিষয়ে স্কুলপাঠ্য বইতে সেই ইংরেজি কবিতা ‘ডেথ দা লেভেলার’ (Death the leveller) সেও তো প্রায় অনেকেরই পড়া।
মৃত্যুতে সবাই সমান, এই বহুস্বীকৃত এবং অতি প্রাচীন দর্শনতত্ত্ব নিয়ে হেঁদো আলোচনার সুযোগ এই তরল কলমকারকে পাঠক দেবেন না। তবে তরলতর প্রসঙ্গে প্রবেশের আগে কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানকেও একটু স্মরণ করি, কারণ তিনি বলেছিলেন জীবনেও সবাই সমান।
হুইটম্যানের সেই ‘মদীয় সঙ্গীত’ (Song of myself) কবিতার থেকে অন্তত এই কয়টি পঙ্ক্তি স্মরণ করা যেতে পারে—
আমি যা ভাবি,
তুমিও তাই ভাবো।
কারণ প্রতিটি অণুকণা
যা আমার মধ্যে রয়েছে,
তা তোমার মধ্যেও রয়েছে।
কাব্য ও দর্শনান্তে এবার সমান সমানের আসল কাহিনীটি বলি।
শুকদেব একজন নবীন যুবক। এলোমেলো চুল। কবিস্বভাব, বেকার। দু’-চারটে টিউশনি করে। বয়েস নিতান্ত একুশ। কিন্তু এই বয়েসেই সে প্রেমে পড়েছে। এবং সে সামান্য প্রেম নয়, সে প্রেমে পড়েছে পাড়ারই দিদিস্থানীয় এক পঞ্চবিংশ বর্ষীয়া যুবতীর সঙ্গে। যুবতীটির নাম অনু।
অনুকে সুযোগ পেলেই শুকদেব বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কখনও মুখে বলে, কখনও চিঠি লেখে। অনু কোনও জবাব দেয় না। কিন্তু শুকদেব নাছোড়বান্দা। অবশেষে বৃহৎ পীড়াপীড়ির পর অনু একদিন কবুল করল, ‘ঠিক আছে, বাবাকে বলো।’
অনুর বাবা একজন ছিমছাম সরল প্রকৃতির (অর্থাৎ সাদা কথায় গবেট) অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। সারা জীবন সরকারি কাজ করে কেবল ‘উইথ রেফারেন্স টু ইয়োর মেমমা নাম্বার…’ করে তাঁর স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি বহু আগেই লুপ্ত হয়েছে।
একদিন শুকদেব অনুর বাবার সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে গেল। অনু একটা মর্নিং স্কুলে পড়ায়, সকালে বাড়ি থাকে না। ওটাই প্রশস্ত সময়। সকালের দিকে অনুর বাবা বাইরের বৈঠকখানা ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, শুকদেব গিয়ে নমস্কার করে সামনে দাঁড়াল।
অনুর বাবা, ‘কী চাই’, জিজ্ঞাসা করাতে শুকদেব নিজের আত্মপরিচয় দিল। দিয়ে বলল, ‘মেসোমশাই, আমি এই পাড়াতেই থাকি। আপনার মেয়ে অনুদির সঙ্গে আমার লাভ হয়েছে। অনুদিকে আমি বিয়ে করতে চাই।’
এই সহজ প্রস্তাবে মেসোমশাই বিহ্বল বোধ করলেন, কিন্তু ওই ‘অনুদি’ শব্দটায় তাঁর কেমন খটকা লাগল, তিনি আর কিছু জানতে না চেয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবাজীবন, তোমার বয়স কত?’
শুকদেব গর্বিত হয়ে বলল, ‘একুশ’।
অনুর বাবা বললেন, ‘তোমাকে চার বছর অপেক্ষা করতে হবে।’
চার বছর অপেক্ষা করতে হবে শুনে শুকদেব রীতিমতো দমে গেল, তবু বলল, ‘চার বছর কেন মেসোমশায়?’
মেসোমশায় বললেন, ‘এখন অনুর বয়েস পঁচিশ। চার বছর পরে তোমাদের দু’জনের বয়েস সমান-সমান হলে তখন বিবেচনা করে দেখব। এখন এসো।’