স্বেচ্ছাসেবক
‘স্বেচ্ছা’শব্দটির যথেচ্ছ ব্যবহার সম্পর্কে আমার সামান্য আপত্তি আছে। আগেও আপত্তি জানিয়েছি, আজও আপত্তি জানাচ্ছি।
যেখানে ইচ্ছা বললেই হয়ে যায় সেখানে স্বেচ্ছা কেন? খবরের কাগজে দেখি, বেতারে শুনি, দূরদর্শনে দেখি এবং শুনি স্বেচ্ছায় রক্তদান। স্বেচ্ছা কথাটা কোথা থেকে এল? কেউ যদি স্বেচ্ছায় রক্তদান না করে সে তো মারাত্মক, রীতিমতো ভয়াবহ ব্যাপার।
এরপরে হয়তো দেখা যাবে শ্রীযুক্ত অমুক স্বেচ্ছায় নেতৃত্বদান করেন তমুক মিছিলে, শ্রীমান অ এবং শ্রীমতী আ স্বেচ্ছায় পরিণয়জালে আবদ্ধ হয়েছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সে যা হোক আমাদের বিষয়বস্তু স্বেচ্ছা নয়, স্বেচ্ছাসেবক ইংরেজিতে যাকে বলে ভলানটিয়ার।
আজকাল স্বেচ্ছাসেবকের অভাব নেই। যে কোনও সভায় বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গেলে দেখা যাবে বুকে ব্যাজ লাগিয়ে দলে দলে ভলানটিয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ গেটে দাঁড়িয়ে, কেউ হল বা সভার মধ্যে, কেউ মঞ্চে উঠে তত্ত্বাবধান করছে। তার মধ্যে পাড়ার-বেকার যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মাননীয় বিচারপতি বা বিখ্যাত চিত্রতারকা। প্রত্যেকেরই বুকে সেফটিফিন বা ক্লিপ দিয়ে রঙিন বিচিত্র বর্ণ ব্যাজ লাগানো, তাতে লেখা ‘গ্যান্ডেরিয়া বান্ধব সমিতি ১৯৮৭ হীরক জয়ন্তী উৎসব’, অথবা ‘সারা ভারত খো খো সম্মেলন রামপুরহাট’, নিদেনপক্ষে ‘ভারতীয় আরতিতে সন্ধ্যা সঙ্ঘ!’
সবাই অত্যন্ত পরিতৃপ্ত এবং গর্বিতভাবে জামা, পাঞ্জাবি বা কোটের বুকপকেটে ব্যাজ ঝুলিয়ে তদ্বির-তদারকি, মাতব্বরি করে যান। এই ব্যাজ হল সর্দারির পাসপোর্ট। তবে অনেক সময় বিশেষ করে অনুষ্ঠানাদিতে এমন প্রায় দেখা যায় যে, ব্যাজধারী ভলানটিয়ারের তুলনায় দর্শকের সংখ্যা অনেক কম।
যে কোনও পুজো সুভেনির খুললেই তৃতীয় কিংবা চতুর্থ পৃষ্ঠায় কর্মকর্তা এবং পৃষ্ঠপোষকদের তালিকার পরেই দেখা যায় দীর্ঘ এক-দেড় পৃষ্ঠাব্যাপী স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকা। এইসব তালিকা যথেষ্ট পরিমাণে বিস্তৃত, এতে কাউকেই বাদ দেওয়া হয় না। এক পাড়ায় হয়তো সাতজন বাচ্চু এবং পাঁচজন খোকন আছে, পরপর সাতবার বাচ্চু এবং পাঁচবার খোকন লেখা হয়েছে, যাতে কেউই এই ভেবে দুঃখিত না হয় যে, তার নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাতে ভয়াবহ কাণ্ড হতে পারে। কারণ, তার বাবাই হয়তো প্রতিমা নিয়ে আসার এবং বিসর্জনের লরিটা সরবরাহ করেন কিংবা তার কাকা এনে দেয় পুজো সুভেনিরের জন্য নামী সিগারেট কোম্পানির ব্যাক পেজ বিজ্ঞাপন।
এই স্বেচ্ছাসেবক বা ভলানটিয়ারদের তালিকায় যাদের নাম আছে, তার মধ্যে ছেলেমেয়ে উভয়ই আছে, তবে অধিকাংশই বালখিল্য, এখনও এরা ডাকনামেই পরিচিত এবং উপাধি ব্যবহারের যোগ্য হয়নি। কোনও বিশেষ কারণ না থাকলে পাড়ায় প্রায় এ রকম সবারই নাম ছাপা হয়ে যায় এই তালিকায়। সুতরাং, পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত বা বিখ্যাত হয়েছে এমন বহু ব্যক্তির নাম প্রথম ছাপার অক্ষরে পাড়ার পুজো সুভেনিরে বেরিয়েছিল, এ রকম ঘটা বিশেষ বিচিত্র নয়।
সে যা হোক, এ তথাকথিত স্বেচ্ছাসেবকরা, এই মুনাই, বুবাই, টুপাই ইত্যাদিরা এদের নাম স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মুদ্রিত হলেও এরা গণ্যের মধ্যে আসে না। এদের বড়জোর পুজোর দিনগুলোতে অথবা বিসর্জনের দিনে একটা ব্যাজ পরতে দেওয়া হয়, অনেকের ভাগ্যে তাও জোটে না। পুজো বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বাইরেও রাজনৈতিক মঞ্চে বা মিছিলেও বহু স্বেচ্ছাসেবক। তবে এদের বিষয়ে পরিহাস করার সাহস আমার নেই। পুরনো ফটোগ্রাফে প্রাচীন দিনের কংগ্রেস অধিবেশনের গান্ধী টুপি মাথায় দেওয়া, ঋজু, শক্ত চিবুক ভলানটিয়ারদের ছবি দেখা যায়। তাদের মুখচোখে একটা নম্র দৃঢ়তা, একটা প্রতিজ্ঞার ছাপ ছিল। একালের রাস্তা আটকানো, ভোলা আদায়কারী, চাঁদাবাজ স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে তাঁদের তুলনা করা অবশ্যই অসংগত হবে।
রাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবকদের কথায় কাজ নেই। বরং চাঁদার প্রসঙ্গে যখন এসে গেছি সেখানেই যাই।
একটি ঘটনার কথা জানি। কোনও এক এলাকায় কিছুদিন হল নতুন একটি পরিবার এসেছে। সেই পরিবারের কর্তা ঠিক কী যে করেন সেটা ভাল করে কেউ এখনও জানতে পারেনি। তবে জিনিসপত্র, ফার্নিচার, পর্দা, দৈনিক বাজার সেই সঙ্গে বাড়ির লোকের সাজপোশাক, জামাজুতো দেখে রীতিমতো সচ্ছল মনে হয়।
পাড়ায় পুজোর ভলানটিয়ার মহোদয়েরা বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলতে বেরিয়েছেন। অবশেষে এই নতুন পরিবারটির বাড়িতেও তাঁরা এলেন। তখন সন্ধ্যাবেলা, দরজায় কড়া নাড়তে বাড়ির ভিতর থেকে একটি বালক বেরিয়ে এল। এসে চাঁদার খাতা হাতে ভলানটিয়ারদের দেখে বলল, ‘বাবা বাড়ি নেই।’
পরের দিন সন্ধ্যাবেলায়ও ওই একই ব্যাপার ঘটল, অর্থাৎ, ‘বাবা বাড়ি নেই।’ ভলানটিয়ার দল একটু ঘুরে ফেরার পথে আবার এলেন, তখনও ‘বাবা বাড়ি নেই।’
এইরকম দু’-চারদিন রাত দশটা, সাড়ে দশটা পর্যন্ত চেষ্টা করেও গৃহস্বামীকে ধরা গেল না। ভলানটিয়ারদের সন্দেহ হল, মিথ্যে কথা বলছে না তো চাঁদা এড়ানোর জন্যে। কারণ, এ রকম হামেশাই হয়। ভলানটিয়ারদের মনোভাব অনুমান করেই বোধহয় অবশেষে একদিন বালকটি বলল, ‘খালি খালি সন্ধ্যাবেলায় আসেন কেন? বাবাকে সন্ধ্যাবেলা পাওয়া যাবে না। সকালের দিকে সময় করে আসবেন, ঠিক পেয়ে যাবেন।’
সত্যিই তাই, পরের দিন সকালে যেতেই বাড়ির কর্তাকে পাওয়া গেল। কিন্তু চাঁদার বলতেই কর্তা যা বললেন অভিজ্ঞ চাঁদা আদায়কারীরা পর্যন্ত সে রকম কথা জন্মেও শোনেনি।
গৃহস্বামী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ও, আপনারা পাড়ার পুজোর জন্যে চাঁদা তুলতে এসেছেন? তা একটা কথা জানতে চাই, আপনারা কি বখশিস নেন?’
সাতসন্ধ্যা ঘুরে যাওয়া ভলানটিয়ার মহোদয়েরা এইরকম কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, সবচেয়ে তিরিক্ষে মেজাজের যিনি দলনেতা তিনি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, ‘পাড়ায় নতুন এসেছেন একটু ভেবেচিন্তে, সাবধানে কথা বলবেন। আপনার কাছে বখশিস কে চাইছে মশায়, আমরা চাঁদা, পুজোর চাঁদা চাইতে এসেছি।’
গৃহস্বামী হাত জোড় করে বললেন, ‘আমি তো সেই জন্যেই জানতে চাইছি আপনারা বখশিস নেন কিনা?’
নবাগতের এইরকম ঔদ্ধত্য দেখে চাঁদা আদায়কারীরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, পেটানো দরকার না ‘পেটো’ দরকার এই সিদ্ধান্তে আসার আগেই গৃহস্বামী বললেন, ‘আপনারা শুধু শুধু রাগ করবেন না, আগে আমার কথাটা শুনুন।’
ভলানটিয়ারদের একজন একটু ঠান্ডা মেজাজের তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনার কথাটা কী শুনি?’
ভদ্রলোক তখন বললেন, ‘দেখুন আমি চৌরঙ্গিতে একটা বারে বেয়ারার কাজ করি। আমার যা কিছু উপার্জন, সবই ওই বখশিস। তাই চাঁদা দেওয়ার আগে জানতে চাই, বলুন জানা উচিত কিনা, আপনাদেরও মানসম্ভ্রম আছে আপনাদের চাঁদা যাই দিই, সে তো ওই বখশিস, সেটা কি আপনারা নেবেন?’
চাঁদা আদায়কারী স্বেচ্ছাসেবকদের মানসম্ভ্রম বিষয়ে অন্য একটি পুরনো গল্প আছে।
কাহিনীটি সেই আমলের যখন পুজোর স্বেচ্ছাসেবক মানে চাঁদা আদায়কারীরা আজকের মতো এতটা বেপরোয়া বা মারমুখী ছিলেন না। তখন গৃহস্থকে তাঁরা সমীহ করে চলতেন এবং চাঁদা নিয়ে নিরীহ নাগরিকের উপর অহেতুক জুলুমবাজি চলত না।
সেই সময় পুজো কমিটির এক ঘরোয়া সভায় ভলানটিয়ারদের চাঁদার খাতা বিলি করা হচ্ছে, কে কোন অঞ্চলে চাঁদা আদায় করবে সেই এলাকা ভাগ করে দিচ্ছেন সম্পাদক।
সম্পাদক রীতিমতো ভারিক্কি, বয়েস প্রায় বছর পঞ্চাশ। হঠাৎ একজন ভলানটিয়ার চাঁদার খাতা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি ওই রামলাল রোডে চাঁদা তুলতে পারব না। ওখানকার লোকগুলো ভীষণ তেরিয়া, চাঁদা চাইলেই মারতে আসে। গত তিন বছর ওখানে আমি চাঁদা তুলতে গিয়ে ঢের অপমান হয়েছি।’ ভলানটিয়ারটির নাম প্রবোধ, তার মুখে এই কথা শুনে বিস্মিত হয়ে সম্পাদক চোখ থেকে চশমা নাকের উপর নামিয়ে তাকে বললেন, ‘দেখ, প্রবোধ চাঁদা তুলতে গিয়ে অপমান আবার কী? আজ ছত্রিশ বছর ধরে পুজো করছি। চাঁদা তুলতে গিয়ে লোকের বাড়িতে কত গালাগাল খেয়েছি, ঘাড় ধাক্কা খেয়েছি, কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, দোতলা থেকে নোংরা জল, আবর্জনা মাথায় ঢেলে দিয়েছে, কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি যে আজ পর্যন্ত কেউ কোনওদিন আমাকে অপমান করতে পারেনি।’
স্বেচ্ছাসেবকদের চাঁদা আদায় নিয়ে আর একটা গল্প মনে পড়ছে, সেটা দিয়ে এই রচনা শেষ করা যাবে। তার আগে একটা আসল গল্প বলে নিই।
আসল গল্প মানে মদ খাওয়ার গল্প।
আগের বছর পুজোমণ্ডপে মদ খেয়ে ভলানটিয়ারেরা একটু বেলেল্লাপনা করেছিলেন। এ বছর সিদ্ধান্ত হয়েছে, না পুজোয় কোনও মদ খাওয়া মোটেই নয়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরে ভলানটিয়ারদের মূল কর্তা দু’জন নিজেদের মধ্যে গোপনে ঠিক করলেন যে, এক বোতল ব্রান্ডি কিনে রাখা হবে, রাতবিরেতে কোনও স্বেচ্ছাসেবক কখনও যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাকে চাঙা করে তুলতে হবে তো। তাই এক বোতল মদ কিনে সিংহের ফাঁপানো কেশরের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হল।
কোনওরকমে সপ্তমীর দিনটা গেল। অষ্টমীর রাতে আর থাকতে পারলেন না এক নম্বর কর্তা, দুই নম্বরকে বললেন, ‘ওরে, শরীরটা বড় খারাপ লাগছে, বুক ধড়ফড় করছে, সিংহের কেশর থেকে বোতলটা বার করে আন তো।’ দুইনম্বর অম্লান বদনে বললেন, ‘বোতলটা আর নেই তো। এক নম্বর হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘সে কী?’ দুই নম্বর বললেন, ‘হ্যাঁ কী আর করব, কাল যে আমারও শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল।’
এবার শেষ কাহিনী, আবার চাঁদা।
এ ঘটনা স্বচক্ষে দেখা আমার। পুজোর আরতি হচ্ছে। পুজোর চাঁদা এ বছর ভাল ওঠেনি। একটা তামার থালায় কয়েকটা খুচরো পয়সা ফেলে সম্পাদক দু’জন ভলানটিয়ারকে সেই থালা হাতে দর্শকদের মধ্যে পাঠালেন যদি দর্শনী কিছু ওঠে। ঝনঝন করে পয়সা বাজাতে বাজাতে জনতার মধ্যে থালা ঘোরাতে লাগল ভলানটিয়ার দু’জন। দ্রুত ভিড় হালকা হয়ে গেল। একজন তাড়াতাড়ি সরতে গিয়ে থালাটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। সন্ত্রস্ত সম্পাদক অবস্থা দেখে ভলানটিয়ারদের নির্দেশ দিলেন, ‘ওরে, পয়সা তুলতে হবে না। থালাটা কোনওরকমে রক্ষা কর, থালাটা শিগগির ফিরিয়ে আন।’