নরখাদকের কাহিনী
নরখাদক বিষয়ে আর বিশেষ কিছু লেখার নেই। পৃথিবী থেকে নরখাদকেরা হয়তো চিরকালের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আফ্রিকার কোনও গহনতম অরণ্যে কিংবা ভারত বা প্রশান্ত মহাসাগরের প্রক্ষিপ্ত কোনও অন্ধকার দ্বীপে কোনও কোনও মানব সম্প্রদায় আছে যারা একদা হয়তো মানুষ খেত কিন্তু এখনও খায়, এ বিষয়ে প্রামাণ্য কোনও সংবাদ জানা নেই।
রামায়ণ নর-বানরের সঙ্গে নরখাদক-রাক্ষসদের যুদ্ধের কাহিনী। মহাভারতেও রাক্ষসের কথা আছে। মহাবলী মধ্যম পাণ্ডব ভীম এবং রাক্ষসী হিড়িম্বার পুত্র রাক্ষস ঘটোৎকচ নিজেও মহাবীর ছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে মহারথী প্রবল পরাক্রান্ত ঘটোৎকচ পাণ্ডবদের পক্ষে লড়াই করে কৌরবপক্ষকে পর্যদস্ত করেছিলেন। দুঃশাসন, অশ্বত্থামা, কর্ণ প্রভৃতি মহাবীরগণ ঘটোৎকচের সঙ্গে মহাসমরে রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। অবশেষে কৌরবপক্ষীয়, মহাপরাক্রম, অসমসাহসী বীর অলম্বুষ রাক্ষসকে যখন ঘটোৎকচ নিহত করলেন তখন নিতান্ত নিরুপায় হয়ে অর্জুনকে হত্যা করার জন্যে বিশেষভাবে সংরক্ষিত একাঘ্নী বাণ ব্যবহার করে কর্ণ ঘটোৎকচকে হত্যা করেন।
একাঘ্নী বাণ কর্ণ অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধের জন্যে রেখেছিলেন, দুর্যোধনের অনুরোধে বিশেষ প্রয়োজনে যখন কর্ণ এই বাণ ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে নিয়োগ করলেন তখনই তিনি বুঝেছিলেন. অর্জুনকে পরাজিত করা তাঁর দ্বারা আর সম্ভব হবে না।
ঘটোৎকচ-ভীম-হিড়িম্বা কাহিনী মহাভারতের ঘরে ঘরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সুপরিচিত। চিরদিনের পিতামহীদের ঘুমপাড়ানি গল্পে হিড়িম্বা-ঘটোৎকচ বারবার ফিরে ফিরে এসেছে।
ভীম-হিড়িম্বা বিষয়ে একটি অসম্ভব অমহাভারতীয় গল্প লিখেছিলেন অবিস্মরণীয় পরশুরাম। ‘পুনর্মিলন’ নামে মাত্র আড়াইশো শব্দের সেই অতি ক্ষুদ্র আয়তনের গল্পটি ‘হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদি গল্প’ নামক সংগ্রহে প্রায় সকলেরই নিশ্চয় পড়া।
তবু নরখাদক সূত্রে গল্পটি আরেকবার স্মরণীয়। মৃগয়া করতে গিয়ে মধ্যম পাণ্ডব পাণ্ডবদের থেকে দলভ্রষ্ট হয়ে বনের মধ্যে এক তরুণ রাক্ষসের হাতে পড়েন। সে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় তার মার কাছে; সেই রাক্ষসী মা ব্রত করে উপোস করে আছে, ছেলেকে বলেছে একটি হৃষ্টপুষ্ট মানুষ নিয়ে আসতে ব্ৰত শেষ করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করার জন্যে।
ছেলে ভীমকে ধরে নিয়ে যেতে ভীম শুনলেন রাক্ষসী দাসীকে আদেশ দিচ্ছে, ‘মনুষ্যটিকে বড় বড় করিয়া কর্তন কর।… বক্ষস্থল ও বাহুদ্বয় ছেলের জন্য রাখিও, পদদ্বয় তোমার, মুণ্ডটি আমি খাইব।’
বলা বাহুল্য, এই রাক্ষসীই হিড়িম্বা এবং পুত্রটি ঘটোৎকচ। সুখের কথা দাসী কর্তন করার আগেই রাক্ষসী তার গুহা থেকে বেরিয়ে এসে ভীমকে দেখে চমকিয়ে যান এবং জিব কেটে বলেন, ‘ও মা, আর্যপুত্র যে! ছি ছি লজ্জায় মরি!, ওরে উন্মাদ, ওরে ঘটোৎকচ, প্রণাম কর বেটা।’
* * *
পৌরাণিক নরখাদক থেকে সরস নরখাদকের কাহিনীতে যাই।
বছর কুড়ি বা তারও কিছু আগে নিউইয়র্কের একটি রঙ্গমঞ্চে একটি জনপ্রিয় নাটক হচ্ছিল ক্যানিবাল অর্থাৎ নরখাদকদের নিয়ে। সেই নাটকে একটি মজার গান ছিল, খুব বিখ্যাত হয়েছিল সেই গানটা ওই সময়। গানটা হল, প্রগতিশীল নরখাদক শিশুরা মানুষের মাংস খেতে আপত্তি জানাচ্ছে। তাদের মা জোর করে তাদের মানুষের মাংস খাওয়াতে চেষ্টা করছে। তারা মোটেই খেতে চাইছে না। কাঁদতে কাঁদতে গাইছে, ‘উই শ্যাল নট ইট হিউম্যান বিইংস’ (We shall not eat human beings) মানে খুব সোজা, ‘আমরা মানুষ খাবো না’।
নাটক নয়, আধুনিক নরখাদকদের বিষয়ে একটি কাল্পনিক কাহিনী পড়েছিলাম অনেকদিন আগে একটা ইংরেজি জোকবুকে।
আফ্রিকার গভীর অরণ্যে এক দুঃসাহসিক সাহেব বিপজ্জনক এলাকায় প্রবেশ করে নরখাদকদের হাতে বন্দি হন। নরখাদকেরা তাকে তাদের গ্রামে নিয়ে যায় এবং একটি গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। তারপর তাদের সর্দারকে খবর দেয়।
নরমুণ্ডের মালা গলায়, মাথায় রক্ত রঙিন পাগড়ি, হাতে ধারালো বল্লম, সর্দার এসে বন্দি ভ্রমণকারীকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে টিপে টুপে দেখলেন। তারপর কী একটা ইঙ্গিত করতেই চারদিকে দামামা বেজে উঠল। নরখাদক পল্লীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যে যেখানে ছিল ওই দামামার ডাক শুনে সবাই ছুটে এল সেই গাছের কাছে, যে গাছে ভ্রমণকারীর বেঁধে রাখা হয়েছে।
ভ্রমণকারীর চোখের সামনেই মাটি খুঁড়ে বিরাট উনুন বানানো হল। শুকনো কাঠ দিয়ে সেই উনুন ধরিয়ে সেই উনুনের ওপরে এক অতিকায় কড়াই চাপানো হল, তাতে কী একটা তেল ঢালা হল প্রায় মণ খানেক।
এদিকে উনুনের চারপাশ ঘিরে নরখাদিকারা (নাকি নরখাদকীরা) বড় বড় পাথরের শিলে লোভনীয় গন্ধময় নানারকম বন্য মশলা নোড়া দিয়ে পিষতে লাগল। বন্দি পর্যটক স্পষ্টই বুঝতে পারলেন যে এ সবই হচ্ছে তাঁকে রান্না করার পূর্বপ্রস্তুতি। মশলার গন্ধে তাঁর জিভে জল এসে গিয়েছিল, তা ছাড়া তিনি যথেষ্ট ক্ষুধার্তও ছিলেন, কিন্তু নিজের মাংস খাওয়ার কারণে নিজের জিভে জল আসা অসংগত হবে এই ভেবে তিনি লালা সংবরণ করলেন। তা ছাড়া, আর মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার; মশলা বাটা প্রায় শেষ, উনুনের কড়ায় তেল প্রায় উত্তপ্ত হয়ে এসেছে। আর একটু পরেই এ জন্মের মতো খেলা শেষ।
ঠিক সেই মুহুর্তে সর্দারও বললেন, ‘খেলা শেয’।
কিন্তু বন্দি পর্যটক সবিস্ময়ে শুনলেন সর্দার বললেন, ‘দি এন্ড’ (The end)। ‘খেলা শেষ’, ‘তামাম সুদ’ না বলে পরিচ্ছন্ন ইংরেজি উচ্চারণে এ রকম কথা বলায় পর্যটক চমকিয়ে গেলেন। কিন্তু চমকের তখনও কিছু বাকি ছিল। সর্দার খাঁটি ইংরেজিতে বন্দিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মৃত্যুর আগে তোমার শেষ ইচ্ছা কী?’
পরিষ্কার উচ্চারণে এমন একটি সভ্য প্রশ্ন শুনে পর্যটক মহোদয় বীরের মতো বললেন, ‘স্যার, আপনার অনুমতি পেলে আমি একটা সিগারেট খেতাম।’
অনুমতি পেতে দেরি হল না। গাছের সঙ্গে দড়ির বাঁধন থেকে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে খুলে দেয়া হল। পর্যটকের পকেটেই সিগারেট ও লাইটার ছিল। তিনি একটা সিগারেট বার করে লাইটার জ্বালিয়ে ধরালেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটল লাইটার জ্বালানো মাত্র। সর্দার সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে কী যেন বললেন, মশলা বাটা থেমে গেল। উনুন থেকে কড়াই নামিয়ে ফেলা হল। বোঝা গেল পর্যটককে খাওয়া হচ্ছে না। পর্যটক ভাবলেন এই অসভ্যেরা বোধহয় কোনদিন লাইটার দেখেনি, তাই ভয় পেয়ে গিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। যেমন সাহেবি বুদ্ধি, তিনি সঙ্গে সঙ্গে লাইটার ক্লিক করে জ্বালিয়ে নরখাদকদের ভয় দেখিয়ে সব লুঠপাট করার চেষ্টা করলেন। তখন সর্দার তাঁর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘ওরে হতভাগা, তুই ভেবেছিস লাইটার দেখে আমরা ভয় পেয়েছি। তোর মতো লাইটারওলা সাহেব আমরা হাজার হাজার খেয়েছি। আমরা ঠিক করেছিলাম, কেউ যদি একবারে লাইটার জ্বালাতে পারে তাকে খাবো না, তাই তোকে ছেড়ে দিচ্ছি’। অতঃপর একটা লাথি মেরে সে পর্যটককে তাড়িয়ে দিল।
পুনশ্চঃ নরখাদকীয় পুনশ্চে এবার দুটি ছোট গল্প :-
ক) ভদ্রমহিলারা কখনও সত্যি বয়েস বলেন না। নরখাদকদের হাতে বন্দিনী স্থির-চল্লিশ এক মহিলা যখন জানতে পারলেন যে এরা পঞ্চাশোর্ধ কোনও ব্যক্তির মাংস খায় না, তিনি কবুল করলেন যে তাঁর বয়েস বাহান্ন।
খ) এক নরখাদক শিশু আকাশে এরোপ্লেন দেখে মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘মা, ওটা কী?’ মা বলেছিলেন, ‘ওটা কাঁকড়া বা চিংড়িমাছের মতো, খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের জিনিসটা খেতে হয়।’