জীবনবিমা
সারা জীবনে অন্তত একবারের জন্যেও একটি জীবনবিমা বা লাইফ ইন্সুরান্স করেননি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। আবার বিমা করে তার কিস্তি খেলাপ করে সেটাকে পচিয়ে দিয়েছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যাও সংসারে অগণ্য।।
শখ করে বা সাধ করে কেউ অবশ্য জীবনবিমা করতে চান না। নতুন চাকরি পাওয়ার পরে কিংবা বিয়ের অব্যবহিত পূর্বে বা পরে বন্ধু, আত্মীয় বা হিতৈষীর ছদ্মবেশে জীবন বিমার দালাল (মার্জিত ভাষায় এজেন্ট) দেখা দেন। তাঁর উদ্দেশ্য কিন্তু মহৎ। তিনি অনিত্য মানব জীবনের বিপুল অনিশ্চয়তা সম্পর্কে তাঁর গ্রাহককে দিনের পর দিন প্রাঞ্জলভাবে অবহিত করেন এবং মাসে যৎসামান্য শ দুয়েক টাকা গুণলেই যে দুম করে হঠাৎ মরে গিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকার ন্যায্য অধিকার অর্জন করা সম্ভব, সেই সৌভাগ্যের দিকে গ্রাহরে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকেন।
এবং বহু ক্ষেত্রেই নাছোড়বান্দা এজেন্ট মহোদয় সফল হন। প্রথম দু’-চার কিস্তি প্রিমিয়াম ঠিকই জমা পড়ে, এজেন্ট সাহেব নিজেই সংগ্রহ করে নিয়ে যান কিংবা তাগাদা দিয়ে পাঠিয়ে দেন। এজেন্ট সাহেব এমন ভরসাও দেন যে, চিরকাল তিনি একই ভাবে তাঁর গ্রাহককে সহায়তা করে যাবেন।
দুঃখের বিষয় কোনও এজেন্ট সাহেবই সেই অর্থে অমর নন। কোনও কোনও সময় এই মর পৃথিবী থেকে তাঁর গ্রাহকদের ঢের আগে তিনি বিদায় গ্রহণ করেন। কখনও কখনও তিনি অন্য পেশায় চলে যান, আবার কখনও পাড়া বা শহর বদল করে দূরের মানুষ হয়ে যান। পুরনো গ্রাহকদের তত্ত্ব-তালাশ তাঁর পক্ষে আর করা সম্ভব হয় না।
এদিকে, অভিভাবকহীন গ্রাহক বেচারা তাগিদের এবং আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কার অভাবে, তদুপরি আয়ের চেয়ে ব্যয় ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় কিস্তির খেলাপ করতে থাকেন।
তা হোক, বিমার কিস্তি যত খেলাপ হবে ততই গ্রাহকের ক্ষতি কিন্তু খেলাপ কিস্তির উপরেই নির্ভর করছে বিমার ব্যবসা। যত বেশি গ্রাহক কিস্তি খেলাপ করবে যত বেশি বিমার পলিসি পচে যাবে বা দায়বদ্ধ হয়ে যাবে ততই রমরমা, ততই জমজমাট হবে বিমার ব্যবসা।
এসব অনেক কাল আগের ব্যাপার। তারও আগে এক বিদেশি বলেছিলেন, ‘জীবনবিমা করেছ বলে তোমার স্ত্রী হয়তো আপত্তি করতে পারেন। কিন্তু তোমার বিধবা কিছুতেই আপত্তি করবেন না।’
জীবনবিমা নিয়ে হাজার রকম মজার ছড়া এবং গল্প প্রচলিত আছে, তার অধিকাংশই বিমার এজেন্টদের নিয়ে। সেসব পুরনো গল্প পাশ কাটিয়ে আমরা অনেকদিন পরে একটু তরতাজা গল্পের দিকে যাই।।
এক পাড়ায় এক শতায়ু ভদ্রলোকের খুব ধুমধাম করে জন্মের শতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। সেখানে বহিরাগত এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপারটা কী?’ তখন স্থানীয় এক ব্যক্তি গরদের ধুতি, রেশমের চাদর শোভিত এক বৃদ্ধকে দেখিয়ে বললেন, ‘নগেনবাবুর একশো বছর পূর্ণ হল, তাই আমরা একটু আনন্দ করছি।’
বাইরের লোকটি বললেন, ‘আপনারা সবাই এত আনন্দ করছেন, কিন্তু ওই দিকে শুকনো মুখে করুণ চোখে ওই যে ভদ্রলোক গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছেন, উনি কে?’
সেই ভদ্রলোক তখন জবাব দিলেন, ‘আরে উনি হলেন নগেনবাবুর পঁচিশ বছরের ছোট ভাই খগেনবাবু। নগেনবাবুর ষাট বছর বয়েসে একবার মর মর অসুখ হয়। তখন খগেনবাবু নগেনবাবুর নামে একটা জীবনবিমা করেন। সেই থেকে জীবনবিমা খগেনবাবু টেনে চলেছেন, এখন তাঁর নিজেরই পঁচাত্তর বছর বয়েস অথচ নগেনবাবু বহাল তবিয়তে, জীবনবিমার কোনও ফয়সালা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তাই খগেনবাবুর এ রকম কাহিল অবস্থা।
এ কাহিনীটি যাই হোক পরের কাহিনীটি কিন্তু প্রায় অবিশ্বাস্য।
এক গণ্ডগ্রামে ঘনশ্যাম নামে এক ব্যক্তি একটি জীবনবিমা করেছিলেন, পঁচিশ বছর মেয়াদি বিমা ছিল ঘনশ্যামবাবুর। দীর্ঘ একুশ বছর ধরে মাসে মাসে যথা নির্দিষ্ট সময়ে তিনি নিয়মিত প্রিমিয়াম দিয়েছেন, কোনওদিন কখনও সামান্য দেরি হয়নি।
যখন বিমার মেয়াদ শেষ হতে আর মাত্র চার বছর বাকি তখন কিস্তির খেলাপ হল। পর পর বেশ কয়েক মাস। সাধারণত জীবনবিমার শেষ পর্যায়ে এ ধরনের খেলাপ ঘটে না। বিমা কোম্পানি সদর থেকে এক চিঠি দিল ঘনশ্যামবাবুর নামে। কেন কিস্তির খেলাপ হল, কীসের অসুবিধে সেই সব প্রশ্ন ছিল সেই পত্রে।
কিছুকাল পরে ঘনশ্যামবাবুর বিধবা স্ত্রীর চিঠি এল, অত্যন্ত দুঃখের সেই চিঠি। চিঠিটিতে বিধবা জানিয়েছেন যে, আজ প্রায় বছর খানেক হল ঘনশ্যামবাবু মারা গেছেন। তিনিই ছিলেন তাঁর সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী। বিধবা প্রথম কয়েকমাস যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন কিস্তি দিয়ে যেতে, কিন্তু আর্থিক কষ্টের জন্যে এখন আর পারছেন না। কোম্পানি যদি দয়া করে মাপ করে দেন।
চিঠির বক্তব্য শুনে কোম্পানি অবশ্যই খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন, বিধবা কোথায় বিমার টাকা দাবি করবে, তা নয় বিমার কিস্তি খেলাপ হয়েছে বলে মাপ চাইছে।
অন্য এক বিধবার গল্প বলি। স্বামীর মৃত্যুতে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তারপর যখন দেখা গেল তাঁর স্বামী তাঁর জন্যে এক লক্ষ টাকার জীবনবিমা রেখে গেছেন, তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘কিন্তু ওঁকে আমি এত ভালবাসতাম, উনি আমাকে এমন শূন্য, এমন ফাঁকা করে ফেলে চলে গেছেন, এই একলক্ষ টাকার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েও যদি ওঁকে ফিরে পাওয়া যেত—আমি কত সুখী হতাম।’
উপসংহার: একটি দুর্ঘটনা বিমার বিজ্ঞাপন—
“হালিশহরের নরহরি চক্রবর্তী গতকাল সকালে একটি দুর্ঘটনা বিমা করেন এবং সন্ধ্যাবেলাতেই শেয়ালদা স্টেশনে চলন্ত ট্রেনে উঠে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পড়ে গিয়ে সামনের দিকের চারটি দাঁত ভাঙে এবং মাথা ফেটে যায়। এই দুর্ঘটনার জন্যে আজকেই আমাদের কোম্পানি তাঁকে চারশো টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।
আপনিও অবিলম্বে দুর্ঘটনা বিমা করে ফেলুন। নরহরিবাবুর মতো সৌভাগ্য আপনারও তো হতে পারে, নিশ্চয়ই পারে।”