2 of 8

সমস্যা

সমস্যা

এই কিছুদিন আগে একজন আধুনিক কবি লিখেছিলেন,

‘সেই যে লোকটা বলেছিল,

তার কোনও সমস্যা নেই।

আসলে সেই লোকটা

নিজেই একটা সমস্যা।’

এই কবিটিকে আমি ভাল করে চিনি না কিন্তু যদি কখনও সামনা-সামনি দেখা হয় তার সঙ্গে, আমার একটু বোঝাপড়া করার আছে।

আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। আলো নেই, জল নেই টেলিফোন বাজে না। আমাদের দরকারি চিঠি ডাকে হারিয়ে যায়। মাছের বাজারে আমরা ঢুকতে ভয় পাই। মেয়ের পরীক্ষার রেজাল্টটা বেরয় না। ছেলের চাকরির দরখাস্তের উত্তর আসে না। সকালবেলা হরিণঘাটার দুধের গাড়ি আসে না। বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়াতে বলেন অন্যথায় বাড়ি ছাড়তে বলেন। রাস্তায় বেরিয়ে বাসে উঠতে পারি না, উঠতে পারলে নামতে পারি না।

আমাদের সমস্যার শেষ নেই।

অথচ এ হেন সময়ে অবশেষে একজন সমস্যাহীন লোকের সন্ধান দিয়ে কবি নিজেই তাকে নিয়ে উপহাস করলেন। কবির সঙ্গে আমার বিশেষ বোঝাপড়া করার আছে।

আপাতত গোলমাল থাক। সমস্যা সংক্রান্ত নির্ভেজাল গল্পটি আগে বলি।

জাহাজডুবির পর প্রায় সবাই মৃত অথবা নিরুদ্দেশ। শুধু একজন যাত্রী কিছুটা ভাগ্যের জোরে, আর কিছুটা ভাল সাঁতার জানার দৌলতে সাঁতরিয়ে, প্রচুর সাঁতরিয়ে অবশেষে একটি নির্জন দ্বীপে এসে আশ্রয় নেয়।

দ্বীপটি খুব খারাপ নয়। মানুষজন অবশ্য নেই, তবে হিংস্র জীবজন্তুও তেমন নেই। গাছে পাকা ফল আছে, মিষ্টি জলের ঝরনা আছে। ভালই দিন কেটে যাচ্ছিল জাহাজডুবির যাত্রীটির।

এর মধ্যে একদিন সেই ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধানে আরেকটি জাহাজ এল সভ্য পথিবী থেকে। অকুস্থলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই জাহাজের লোকেরা আগের জাহাজের কোনও চিহ্ন আবিষ্কার করতে পারল না। অবশেষে একেবারে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তে মহাসমুদ্রের ঢেউয়ের আড়ালে নির্জন দ্বীপটি নজরে পড়ল তল্লাশকারী জাহাজের ক্যাপটেনের।

তখন সেই দ্বীপের পাশে গিয়ে জাহাজটা ভিড়িয়ে দিলেন তিনি। জাহাজের ডেক থেকে ক্যাপটেন সাহেব নিরুদ্দেশ যাত্রীটিকে দেখতে পেলেন। ঘাসের বিছানায় সে পরম আরামে চোখ বুজে এলিয়ে পড়ে রয়েছে। তার হাতের কাছেই নানারকম জানা অজানা লাল-সবুজ ফল।

দ্বীপের পাশে যে একটা জাহাজ এসে দাঁড়িয়েছে লোকটি সেটা খেয়াল করেনি। সে ভাবতেও পারেনি তাকে উদ্ধার করার জন্যে জাহাজ এসেছে। সে শান্তিতে চোখ বুজে আছে।

জাহাজের ক্যাপটেনের লোকটিকে দেখে খুব মায়া হল, একবার ভাবলেন, ও এখানে বেশ আছে, শান্তিতে আছে, তাই থাকুক, আমরা ফিরে যাই। কিন্তু সেটা কর্তব্যে অবহেলা করা হবে, তাই লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে একবার জাহাজের সিটি বাজালেন। তন্দ্রাবিষ্ট লোকটি সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে জেগে উঠল এবং জাহাজ দেখে দৌড়ে দ্বীপের কিনারে চলে এল।

জাহাজের ক্যাপটেন কিন্তু তখনই তাকে জাহাজে তুললেন না, তাকে বললেন, ‘তুমি তো এখানে দেখছি চমৎকার আছ। ঝামেলাভরা পৃথিবীতে আবার সেই সমস্যা জর্জরিত জীবনে ফিরে গিয়ে কী হবে।’ লোকটি এই কথা শুনে দোনামনা করতে লাগল, তার মনেও কেমন দ্বিধা দেখা দিল।

ঠিক এই সময়ে ক্যাপটেন সাহেব তাঁর খাস কামরা থেকে বিগত কয়েক সপ্তাহের এক গাদা খবরের কাগজ দ্বীপবন্দি লোকটির দিকে ছুড়ে দিলেন, দিয়ে বললেন, ‘এই কাগজগুলো একবার পড়ো। এসব খবর পাঠ করার পরেও যদি সংসারে ফিরে যেতে চাও বলবে।’

লোকটি খবরের কাগজগুলো বগলদাবা করে দ্বীপের গহনে চলে গেল। তারপর সে আর ফিরে আসেনি। চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে জাহাজটি ফিরে যায়।

* * *

অতঃপর আরেকটি দার্শনিক সমস্যার গল্প বলি। এক ব্যক্তি হাওড়া স্টেশনের অনুসন্ধান কাউন্টারে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মশায়, এখান থেকে বর্ধমান যেতে কতক্ষণ লাগে?’ কাউন্টার শীতল কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘আড়াই ঘণ্টা।’

এবার ওই ব্যক্তি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা বর্ধমান থেকে এখানে আসতে কতক্ষণ লাগে?’ এবার কাউন্টার উত্তপ্ত হল, ‘এ প্রশ্নের মানে কী? এখান থেকে বর্ধমান যেতে যদি আড়াই ঘন্টা লাগে তবে বর্ধমান থেকে এখানে আসতেও আড়াই ঘণ্টা লাগবে। এই সামান্য কথাটা বুঝতে অসুবিধে কোথায়? কী সমস্যা?’

প্রশ্নকারী নির্বিকারভাবে বললেন, ‘সমস্যা আছে।’ কাউন্টারে ভিড় ছিল না, তাই কাউন্টার প্রশ্নোত্তরের খেই হারিয়ে ফেলেনি, তা ছাড়া তার মনে কৌতুহলও দেখা দিয়েছে। সুতরাং কাউন্টার আবার জানতে চাইল, ‘কী সমস্যা?’ প্রশ্নকারী মৃদু হেসে বললেন, ‘সমস্যা নয়? একবার ভেবে দেখুন তো, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসে আসতে লাগে ন’মাস আর অক্টোবর থেকে ওই জানুয়ারিতে ফিরতে লাগে মাত্র তিনমাস। যাতায়াত কি সর্বদা একসময়ে হয়? হাওড়া থেকে বর্ধমান আড়াই ঘণ্টায় গেলেই বর্ধমান থেকে হাওড়ায় আড়াই ঘণ্টায় আসবে এমন কোনও কথা নেই।’

এই প্রশ্নকারীর যেমন সমস্যা আছে, তেমনিই সমস্যা সকলেরই আছে এবং থাকবে। এবার আমরা সমাধানের কথা ভাবি। এক সাহেব বুদ্ধিজীবী সমস্যা সমাধান নিয়ে একটা চমৎকার উদাহরণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে যদি ন’টা টুপি থাকে আর দশটা মানুষ থাকে তবে একজন মানুষের মাথা কেটে সে সমস্যার সমাধান না করে অনেক ভাল হবে আর একটা টুপি বানিয়ে সে সমস্যার দূর করা।

তবে সব সময়ে সমস্যা দূর করতে চাইলেই যে সেটা দূর করা যায় তা নয়। মিশরদেশীয় আখ্যানটি স্মরণ করছি।

এক গৃহস্থের একটা বেতো ঘোড়া ছিল। সেটা এত বুড়ো হয়ে গিয়েছিল যে কোনও কর্মে লাগত না। শুধু শুধু সেটাকে দানাপানি খাওয়াতে হত।

গৃহস্থের বাড়ির পিছনে একটা শুকিয়ে যাওয়া কুয়ো ছিল। সেটায় কোনও জল ছিল না, একেবারে শুকনো, খটখটে। পড়বি তো পড়, একদিন সেই বেতো ঘোড়াটা সেই কুয়োর মধ্যে পড়ে গেল।

একটু চেষ্টা করার পর গৃহস্থ যখন বুঝতে পারল ঘোড়াটাকে কুয়ো থেকে তোলা অসম্ভব, সে এক বুদ্ধি করল, সে ঠিক করল মাটি ঢেলে কুয়োটাকে ঘোড়া সমেতু বুজিয়ে দেবে, তাতে একসঙ্গে মজা কুয়ো আর বেতো ঘোড়ার সমস্যার সমাধান হবে।

সে কোদাল দিয়ে অন্য জায়গা থেকে মাটি কেটে ঝুড়িতে করে এনে শুকনো কুয়োয় ঢালতে লাগল। কিন্তু ফল হল হিতে বিপরীত অথবা বিপরীত ক্রমে ঘোড়ার পক্ষে বিপরীতে হিত।

গৃহস্থ কুয়োর মধ্যে যত মাটি ফেলে, ঘোড়া তত মাটির ওপরে উঠে দাঁড়ায়, এই করতে করতে সেই ঘোড়া একসময়ে কুয়োর ওপরে উঠে বেরিয়ে এল। কুয়ো বোজানো হল বটে কিন্তু গৃহস্থের বেতো ঘোড়ার সমস্যা রয়েই গেল।

* * *

পুনশ্চ

লেখার শেষে একটা অলৌকিক সমস্যার কথা বলি।

কয়েকদিন আগে এক বাড়িতে গেছি। বাড়ির ছোট মেয়েটি বাইরের ঘরে পুতুল নিয়ে খেলছে। তার কোলে দুটো পুতুল। আমি তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী খুকু খবর কী?’ খুকু ঠোঁট উলটিয়ে জবাব দিল, ‘আর খবর। খুব বিপদ হয়েছে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তোমার আবার কী বিপদ?’ কোলের ডল পুতুলের মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে সাত বছরের খুকু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এই দুটোকে নিয়েই পারছি না। এদিকে এই পুজোর সময় আমার আবার বাচ্চা হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *