পণ্ডিত
‘পণ্ডিত’ শব্দটি সংস্কৃত হলেও ইংরেজি ভাষার সূত্রে এখন সারা পৃথিবীর শিক্ষিতসমাজে সুপরিচিত। ইংরেজি অভিধানে বহুকাল হল শব্দটি ঢুকে গেছে। ভারতীয় প্রায় সব ভাষাতেই শব্দটি সচল।
আধুনিক বাংলা ভাষায় ‘পণ্ডিত’ শব্দটি অবশ্য বহু ক্ষেত্রেই বিদ্রূপার্থে ব্যবহৃত হয়। আগেও যে হত না তা নয়, টুলো পণ্ডিত বা বুনো পণ্ডিত এ জাতীয় বিশেষণযুক্ত কথা স্পষ্টই মনে করিয়ে দেয় যে পণ্ডিত শব্দের একটা হেয়ভাবে ব্যবহারও ছিল।
যে যুগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পণ্ডিত উপাধিতে ভাস্বর ছিলেন কিংবা তারপরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অথবা অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ পণ্ডিত বলে সম্মানিত হতেন সেই যুগেই ‘কানা-কানা খানা-খানা কেমন লাগে কুমির ছানা’ গল্পের শেয়ালপণ্ডিতমশাই ঘরে ঘরে জনপ্রিয়।
এই সময়েই এক স্বনামধন্য পণ্ডিত, খুব সম্ভব অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ মহোদয় পণ্ডিতের এক নতুন সংজ্ঞা দিয়েছিলেন।
কয়েক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসেছিলেন তাকে এক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। যাতে তিনি সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে রাজি হন সেই জন্যে তাঁরা বিদ্যাভূষণ মহাশয়কে পণ্ডিত, মহাপণ্ডিত ইত্যাদি নানারকম বিশেষণে তোয়াজ ও তোষামোদ করতে লাগলেন।
বিদ্যাভূষণ মহোদয় পণ্ডিত হলেও বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এইসব শুনে বললেন যে, ‘হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই বলেছেন, আমি অবশ্যই পণ্ডিত, তবে আমি হলাম সেই ধরনের পণ্ডিত—সর্ব কর্মং পণ্ডয়তি য সঃ—অর্থাৎ সব কাজ পণ্ড করে দেয় যে।’ এই বলে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের তিনি সভাপতি হতে রাজি না হয়ে বিদায় করে দিলেন।
পণ্ডিতদের সম্পর্কে চলতি অধিকাংশই তাদের বোকামির গল্প। বেশি লেখাপড়া জানা লোকের বৈষয়িক বা জাগতিক বুদ্ধির অভাব থাকে—এ রকম একটা ধারণা বহুদিন ধরেই চলছে।
এর বিপরীতধর্মী বৈষয়িক বুদ্ধি সম্পন্ন এক পণ্ডিতের আখ্যান বলি। গল্পটা অন্য আকারেও অবশ্য প্রচলিত আছে।
আগেকার দিনে জমিদার বাড়িতে বৎসরান্তে পুজোর সময় ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত বিদায়ের বন্দোবস্ত ছিল। পণ্ডিতেরা পুজোর আগে ধনীগৃহে গিয়ে বার্ষিকী নিয়ে আসতেন। তাঁদের নামের তালিকা জমিদার বাড়ির নায়েবের খাতায় লেখা থাকত। সেই তালিকা দেখে যার যা প্রাপ্য বৎসরান্তে দেওয়া হত।
এক পণ্ডিতের ওই বার্ষিকীর খাতায় নাম ছিল। পরপর কয়েক বছর নানা কারণে তিনি বার্ষিকী নিতে জমিদার বাড়িতে আসতে পারেননি। এসব ক্ষেত্রে অর্থাৎ কেউ দু’-তিন বছর বার্ষিকী নিতে না এলে তাঁর নাম খাতা থেকে কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হত।
এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সুতরাং দু’-তিন বছর পরে যখন পণ্ডিত আবার বার্ষিকী নিতে এলেন, এসে দেখলেন তাঁর নাম কাটা গেছে। গোমস্তা-নায়েবরা বললেন, এ বিষয়ে তাঁরা কিছু করতে পারবেন না। তখন বাধ্য হয়ে পণ্ডিতমশায় জমিদারবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন। জমিদারবাবু সদাশয় ব্যক্তি, তা ছাড়া সে বছরই তিনি সদ্য পিতামহ হয়েছেন, তাঁর প্রথম পুত্রের একটি পুত্র জন্মেছে। তিনি পণ্ডিতমশায়ের সব কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে নায়েববাবুকে ডেকে আবার তাঁর নাম বার্ষিকীর খাতায় তুলে নিতে নির্দেশ দিলেন।
নায়েববাবু পণ্ডিতমশায়কে বাইরের সেরেস্তা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাতা খুলে তাঁর নাম লিখতে বসলেন। পণ্ডিতমশায়কে নাম জিজ্ঞাসা করাতে পণ্ডিতমশায় বললেন, ‘লিখুন, শ্রীযুক্ত বৃষ ভট্টাচার্য।’
এ রকম নাম শুনে নায়েবমশায় বিস্মিত হলেন, বললেন, ‘বৃষ মানে তো ষাঁড়, গোরু। এটা আবার কী করে মানুষের নাম হল।’
পণ্ডিতমশায় বললেন, ‘ঠিকই ধরেছেন, এটা আমার নাম নয়, কিন্তু এই নামটাই লিখুন।’ নায়েবের মুখে তার এই অনুরোধে প্রশ্নবোধক একটা ভাব ফুটে উঠল, তখন পণ্ডিতমশায় বুঝিয়ে বললেন, ‘দেখুন ভবিষ্যতে আর যাতে নাম কাটা না যায় সেজন্যে এই নামটাই বলছি, আপনারা তো হিন্দু হয়ে গোরু কাটতে পারবেন না। কী করে আমার বৃষ নাম কাটা যায় সেটা আমি দেখব।’
পুরনো দিনের লোককথায় পণ্ডিত কাহিনীর অন্ত নেই। তখনকার সমাজজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পণ্ডিতমশায়। তিনিই শিক্ষক, তিনিই পুরোহিত কখনও গুরুদেব, তিনিই বিধায়ক এমনকী কখনও কখনও তিনি জীবনদাতা কবিরাজ বা চিকিৎসক।
বিদ্যাসাগর মহোদয় এঁদের কথা লিখেছেন, মজা করেই লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায় পর্যন্ত তরল কাহিনীতে পণ্ডিতমশায়কে বারবার এনেছেন। শরৎচন্দ্র তো ‘পণ্ডিতমশায়’ নামে আখ্যানই রচনা করেছেন।
মহাজন কথিত গল্পগুলির মধ্যে একটি চমকপ্রদ গল্প আমরা স্মরণ করছি।
দুই ভাই। বড় ভাই দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত। বেদ, উপনিষদ তাঁর নখাগ্রে। ছোট ভাই তেমন কিছু নন, তাঁর সম্বল পুরোহিত দর্পণ, যজমানি ব্যবসা তাঁর জমজমাট, গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে লোকজন তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসে, শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে তারা তাঁকে নিয়ে যায় বিবাহে, শ্রাদ্ধে, উপনয়নে, অন্নপ্রাশনে।
একবার তিনি দূরের এক গ্রামে একটা বিয়ে দিতে গেছেন, সেই সময় পাশের গ্রামের লোকেরা তাঁর কাছে একটা বিধান নিতে এল, ধোপাদের বাড়ির একটা শিশু মারা গেছে তাকে পোড়ানো হবে—না মাটিতে পুঁতে দিতে হবে।
ছোট ভাইকে না পাওয়ায় তারা বড় ভাইকে ধরল, ‘ঠাকুরমশায় আপনি তো শাস্ত্রজ্ঞ দিগ্গজ পণ্ডিত, আপনিই এর বিধান দিন।’
বড় ভাই পড়লেন ঘোরতর ফ্যাসাদে। তিনি তাক থেকে বড় বড় পুঁথি নামিয়ে বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ এমনকী রামায়ণ-মহাভারত মহাকাব্যের এবং শেষ পর্যন্ত কালিদাস বাণভট্টের অনেক পৃষ্ঠা ওলটালেন কিন্তু কোথাও কোনও সূত্র পেলেন না। তখন নিজের মনে সাত-পাঁচ অনেক কিছু ভেবেচিন্তে বললেন, ‘পুঁতে ফেলাই উচিত হবে।’
লোকেরা বিধান নিয়ে চলে গেল। তারা যখন ফিরে যাচ্ছে ছোট ভাই তখন বিয়ে দিয়ে ফিরছেন, পথে দেখা। এদের মুখে সব কথা শুনে ছোট ভাই বুঝলেন বড় ভাই ভুল নির্দেশ দিয়েছেন, কারণ এক্ষেত্রে পুড়িয়ে ফেলাই আচার-সম্মত। তিনি দ্রুত দাদার ভুল সংশোধন করে বললেন, ‘দাদা ঠিকই বলেছেন তবে না পুঁতে পুড়িয়ে ফেলাই ভাল। পুঁতলেও চলে কিন্তু তার চেয়ে পোড়ানো ঠিক হবে। বাচ্চাটা পুঁতে ফেলার বয়েস পার হয়ে গেছে।’
ভাই বাড়ি এসে দাদাকে বললেন, ‘দাদা, তুমি ভুল বিধান দিয়েছিলে, ওরা যদি না পুড়িয়ে পুঁতে ফেলত খুব অনাচার হত।’ দাদা বললেন, ‘কোনও অনাচার হত না আমি ভেবে-চিন্তেই পুঁততে বলেছিলাম।’
ছোটভাই বললেন, ‘এত ভাবনাচিন্তা করে ভুল করলে?’
দাদা বললেন, ‘যদি পোড়াতে বলতাম আর ওরা পুড়িয়ে ফেলত, তা হলে আসল ভুল হত যখন তুমি এসে বলতে যে না পুঁততে হবে। আমি পুঁতে রাখতে বললাম এই কারণে যে তুমি যদি এসে বলো পোড়াতে হবে তবে মাটি খুঁড়ে বাচ্চাটাকে তুলে পুড়িয়ে ফেললেই হবে কিন্তু একবার পোড়ানো হয়ে গেলে আর পোঁতা যেত না।’
এই অগ্রজ পণ্ডিতমশায়কে নিশ্চয় এরপরে আর কেউ নির্বোধ বলবে না।