2 of 8

স্বর্গ

স্বর্গ

রবীন্দ্রনাথকেও নাকি একবার নরকে যেতে হয়েছিল। গল্পটা পুরনো, জর্জ বিশ্বাসের নামে প্রচলিত রয়েছে। সম্প্রতি গল্পটা আবার শুনলাম।

সেটা সেই সময়ের কথা, যখন জর্জ বিশ্বাসের রবীন্দ্রসংগীত ‘বিশুদ্ধ’ না হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ। তখন তিনিই গল্পটা বলেছিলেন, “আমি যখন মারা গেলাম, মারা গিয়ে দেখি নরকে গেছি, নরকে তো আমি যামুই। তা সেই নরকের বারান্দায় দেখি আলখাল্লা গায়ে দিয়া রবীন্দ্রনাথ হাঁটতেছেন। আমি তো অবাক, ‘কইলাম, গুরুদেব আপনি এখানে!’ গুরুদেব কইলেন, ‘আমি ভদ্রঘরের মাইয়াদের স্টেজে নাচাইছিলাম, তাই ভগবান আমারে নরকে পাঠাইছে।’

বলা বাহুল্য, অনন্য ও অদ্বিতীয় জর্জ বিশ্বাসের এ এক মর্মান্তিক বিদ্রুপ নীতিবাগীশদের বিরুদ্ধে।

* * *

জর্জ বিশ্বাসকে দিয়েই যখন আরম্ভ করে ফেললাম, তা হলে নরক নয় স্বর্গের কথা হোক।

মানুষের জ্ঞান হওয়া অবধি স্বর্গ নিয়ে তার কল্পনার অভাব হয়নি। সব ধর্মে যেমন পাপ-পুণ্যের কথা আছে, তেমনই স্বর্গ নরকের কথা আছে। মানুষকে বলা হয়েছে পাপ কোরো না, মিথ্যে কথা বোলো না, কুকর্ম কোরো না, মানুষের উপর এইসব নিষেধাজ্ঞা জারি করে তারপর তাকে লোভ দেখানো হয়েছে স্বর্গবাসের।

সেই স্বপ্নের স্বর্গে অনন্ত বসন্ত, অনন্ত যৌবন। তার পারিজাত কাননে কোনওদিন ফুল ঝরে পড়ে না, স্বর্গ নর্তকীর চঞ্চল চরণ কোনওদিন ক্লান্ত হয় না, স্বর্গের অমৃতসুধা পান করে লিভার খারাপ হওয়ার অথবা হ্যাং-ওভার হওয়ার আশঙ্কা নেই।

মহাভারতের রাজা যুধিষ্ঠির স্ত্রী এবং ভাইদের নিয়ে এই স্বর্গে পৌঁছানোর জন্যে যাত্রা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত সবাই পথে পড়ে যায়, এক সারমেয়বেশী ধর্ম ছাড়া তাঁর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত আর কেউ ছিল না।

রামায়ণের লঙ্কেশ্বর রাবণ স্বর্গের সিঁড়ি বানাতে চেয়েছিলেন, তিনিও শেষ পর্যন্ত পারেননি। মৃত্যুর সময়ে তিনি বলেছিলেন, ‘শুভ কাজ শীঘ্র করতে হয়, আর অশুভ কাজে কালহরণ করতে হয়।’ তবে স্বর্গের সিঁড়ি বানানোটা শুভ কাজ হত কিনা সেটা বলা কঠিন।

স্বর্গের সিঁড়ির আরও একটা গল্প আছে। সেটা পৌরাণিক উপকথা।

তখন সৃষ্টির আদিযুগ। পৃথিবীর সব মানুষের মুখে একই ভাষা। সেইসময় মানুষেরা ঠিক করল স্বর্গের সিঁড়ি বানাবে। সিঁড়ি বানানো শুরু হল, কাজ পুরোদমে চলছে, স্বর্গ প্রায় ছুঁই ছুঁই। ঈশ্বর তখন প্রমাদ গুনলেন, সর্বনাশ! মানুষ যে সিঁড়ি পেয়ে সরাসরি স্বর্গে উঠে আসবে। তাঁর আর মাহাত্ম্য রক্ষা হবে কী করে? ঈশ্বর তখন বুদ্ধি করে একেক মানুষের মুখে একেকরকম ভাষা দিলেন। তুমুল গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। এ চাইছে ইট, ও নিয়ে এল জল। সে চাইছে পাথর এ নিয়ে আসছে বালি। বিশাল কর্মকাণ্ড ভণ্ডুল হয়ে গেল। রচিত হল মানুষে মানুষে প্রথম ব্যবধান। ভাষার ব্যবধান। এ ব্যবধান ঈশ্বরেরই সৃষ্টি এবং তার কারণ ওই স্বর্গ।

নিউ টেস্টামেন্টে আছে, ‘আমার পিতৃগৃহে রয়েছে বহু প্রাসাদ।’ এই পিতৃগৃহই হল স্বর্গ।

এক অবিশ্বাসী পরিহাস করে এক খ্রিস্টীয় ধর্মযাজকের কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘আজ্ঞে বলতে পারেন স্বর্গের পথটা কোনদিকে?’ ধর্মযাজক মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এখন থেকে সরাসরি সোজা রাস্তায় যাবেন, তা হলেই স্বর্গে পৌঁছে যাবেন।’

এই যাজক যে ধর্মের অনুসারী সেই ধর্মের মূল গ্রন্থে এ রকম কথা বলা আছে যে সূচের ফুটো দিয়ে একটা উট পর্যন্ত গলে যেতে পারে কিন্তু ধনী ব্যক্তিরা কখনওই স্বর্গে যেতে পারবে না।

বলা বাহুল্য ধনী ব্যক্তিরা স্বর্গে যাওয়া নিয়ে তেমন চিন্তিত নন। তার প্রধান কারণ হল এই যে ধনী হতে গেলে সাধারণত যেসব কাজ করতে হয় সেসব কাজ করে স্বর্গে যাওয়া যায় না।

তবে ভাল কাজ করলেই সর্বদা স্বর্গে যাওয়া যাবে এমন কোনও কথা নেই। একটা পুরনো গল্প এখানে আবার বলা যেতে পারে।

এক ভদ্রলোক মৃত্যুর পরে পরলোকে পৌঁছেছেন। পরলোকের দরজায় তিনি দেখলেন চিত্রগুপ্ত বসে রয়েছেন দরজার সামনে। তিনি চিত্রগুপ্তকে বললেন, ‘আপনার খেরোর খাতাটা একবার বার করে দেখুন তো আমার পাপ-পুণ্যের হিসেবটা। আমি কি স্বর্গে যাব নাকি নরকে যেতে হবে?’

চিত্রগুপ্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আমার আবার খাতা কী? ওসব পৃথিবীর মানুষের মনগড়া কথা। আমি লেখাপড়াই শিখিনি কখনও, খাতা কী করে রাখব? পাপপুণ্যের হিসেব বলে কিছু নেই, স্বর্গ-নরক বলেও কিছু নেই। তুমি স্বচ্ছন্দে ভিতরে ঢুকে যাও!’

ভদ্রলোক দরজা দিয়ে পরলোকের ভিতরে প্রবেশ করে দেখেন সেখানে ভয়াবহ কাণ্ড হচ্ছে। হাজার হাজার লোক, মারামারি, গালাগালি, চুলোচুলি করছে পরস্পরের সঙ্গে। এর মধ্যে অনেক মহাজ্ঞানী, মহাজন, প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ পর্যন্ত রয়েছেন। এঁরাও অশ্রাব্য, অশ্লীল ভাষায় কথা বলছেন, এঁকে তিনি লাথি মারছেন, তাঁকে ইনি থুথু ছিটোচ্ছেন।

এই অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে নবাগত ভদ্রলোক একদম হকচকিয়ে গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বেরিয়ে এলেন পরলোকের দরজা দিয়ে। গেটের পাশে একটা মেহগনিকাঠের কালো চেয়ারে তখনও চিত্রগুপ্ত নির্বিকার, নির্লিপ্ত বসে রয়েছেন।

ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে চিত্রগুপ্তকে বললেন, ‘ভেতরে এসব কী ব্যাপার হচ্ছে? এইসব মহাপুরুষেরা এসব কী করছেন? কেন করছেন?’

শান্তভাবে চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘সেকথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কে মহাপুরুষ, কে মহাপুরুষ নয় তাও আমি জানি না।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘মানে?’

ততোধিক শান্তভাবে চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘মানে-টানে জানি না। তবে এতদিন ধরে একটা জিনিস লক্ষ করেছি যে এরা যখন একজন আসে, এসেই জিজ্ঞাসা করে, স্বর্গটা কোনদিকে। এদের যেইমাত্র বলি স্বর্গ নরক বলে কিছু নেই। আর ওই পাপপুণ্যের হিসেব-টিসেব সব বাজে কথা। এখানে কোনও রকমের হিসেব রাখা হয় না। সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো কেমন যেন ক্ষেপে যায়। পাগলের মতো করতে থাকে। তারপর শুরু হয় গালাগালি, হাতাহাতি, লাথালাথি।’

চিত্রগুপ্তের এইকথা শোনামাত্র নবাগত ভদ্রলোক এক দৌড়ে পরলোকের ভিতরে ঢুকে গেলেন এবং প্রথমেই যাঁকে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন, তাঁর ফটোতে মৃত্যুর আগের দিন সকালেও তিনি মালা দিয়েছেন।

পুনশ্চঃ একটি গ্রাম্য বালক তার বাবার সঙ্গে শহরে এসেছে। শহরের রাস্তাঘাট, ট্রাম-বাস বহুতল বাড়ি যা কিছু সে দেখছে, দেখে বিস্মিত হচ্ছে। তার বাবা ঠিক করল যে একটু খুব উঁচু বাড়িতে ঢুকে ছেলেকে লিফটে চড়াবে। ছেলেটি এর আগে লিফটে চড়া তো দূরের কথা এ জিনিস চোখেই দেখেনি। সুতরাং লিফটে চড়ার পরে লিফট যখন দ্রুতগতি উপরের দিকে উঠতে লাগল, ছেলেটি বিস্মিত হয়ে তার বাবাকে প্রশ্ন করল, ‘বাবা, ভগবান কি জানে যে আমরা স্বর্গে যাচ্ছি?’

পুনশ্চঃ: মহাত্মা মার্ক টোয়েনকে একদা এক ভদ্রমহিলা স্বর্গ এবং নরক বিষয়ে তাঁর অভিমত জানতে চান। মার্ক টোয়েন করজোড়ে বলেন, ‘মাফ করবেন। কোনওটারই নিন্দে করতে পারব না। দু’জায়গাতেই আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *