2 of 8

সচিত্র ভারত

সচিত্র ভারত

‘লালেরা সব লালই ছিল, কৃষ্ণেরা লাল হচ্ছে কি? রাধাকৃষ্ণ কৃষ্ণ মেনন, কৃষ্ণা হাতী সিংহেরা মন্দিরেতে ঠেকা দিয়ে ইন্দিরা গান ধরছে কি? রুশ ভালুকের কাঁধে চড়ে নাচছে ভারত ফিঙ্গেরা। আমরা সবাই নাচব কি?

অবাক কাণ্ড তেলাপোকা ধরছে যে আজ কাঁচপোকী!’

সজনীকান্ত দাস

শারদীয়া সচিত্র ভারত

১৩৬০

* * *

সচিত্র ভারত থেকে অসচিত্র এই মহাভারত অনেক দূর, সময়ের হিসেবে উপরোক্ত শারদীয়া সংখ্যা থেকে সাড়ে তিন দশকের দূরত্ব।

অল্প কিছুদিন আগে মহাভারতের এই কলমে স্বর্গীয় দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল মহোদয়ের অচলপত্রের কথা লিখেছিলাম। সেটাও সম্ভব হয়েছিল এক সহৃদয় পাঠকের সৌজন্যে, যিনি পুরনো অচলপত্র পাঠিয়ে আমাকে ঋণপাশে আবদ্ধ করেছেন।

সেই সময়েই ভেবেছিলাম ‘সচিত্র ভারত’ নিয়েও আমার কিছু লেখা কর্তব্য। রসিকতার পাঠশালায় যেসব শিক্ষাদাতার কাছে আমি ঋণী তার মধ্যে অধুনালুপ্ত ওই সাপ্তাহিক সচিত্র ভারত পত্রিকার স্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত আমার নিকটে।

একটা উদাহরণ দিই। অনেক দিন আগে সেই কাণ্ডজ্ঞানে উল্লেখ করেছিলাম।

‘চুল কাটার সেলুন নিয়ে অনেক মজার ছবি এঁকে ছিলেন প্রমথ সমাদ্দার। প্রমথবাবুকে কেউ কি মনে রেখেছেন? আজ থেকে পঁচিশ-তিরিশ বছর এবং আরো আগে কার্টুন আঁকতেন প্রমথ সমাদ্দার, তাঁর হাতের আঁকা এবং রসবোধ দুইই ছিল চমৎকার।’

কাণ্ডজ্ঞানে কেশচর্চার ওই নিবন্ধে যে কথাটা উল্লেখ করা হয়নি সেটা হল এই যে প্রমথ সমাদ্দারের ওই চমৎকার কার্টুনগুলো সবই আমি দেখেছিলাম সচিত্র ভারত সাপ্তাহিকে, সেই তিন যুগ আগে।

সচিত্র ভারতের ওই কার্টুনটার কথা বলি। সেলুনে এক ভদ্রলোক চুল কাটছেন। ভদ্রলোকের পায়ের কাছে ঠিক চেয়ারের নীচেই বসে রয়েছে একটি অতিকায় হিংস্রদর্শন কুকুর। কুকুরটি খুব মনোযোগ দিয়ে চুলকাটা লক্ষ করছে। সারমেয় প্রবরের এই মনোযোগ দেখে খদ্দের ক্ষৌরকারকে বললেন, ‘আপনাদের এই কুকুরটা দেখছি খুব শিক্ষিত। কী রকম স্থির হয়ে বসে চুলকাটা দেখছে।’ ক্ষৌরকার চুল কাটতে কাটতেই নিজের জিভ কেটে বললেন, ‘না স্যার, শিক্ষিত-টিক্ষিত কিছু নয়, ও বড় লোভী স্যার।’

খদ্দের অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘লোভী?’ ক্ষৌরকার উত্তর দিলেন, ‘আমি স্যার অনেক সময়ে চুল কাটতে কাটতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে খদ্দেরদের জুলফির মাংস, কানের লতি এই সব হাত ফসকিয়ে কেটে ফেলি। আমার কুকুরটা সেই মাংসের টুকরোর লোভে বসে আছে স্যার।’

পঁয়ত্রিশ বছর আগের দেখা কার্টুন এটা। কিঞ্চিৎ ভুলভ্রান্তি, অতিরঞ্জন হয়তো হয়ে গেল। তবু স্বীকার করা ভাল যে এ রকম কার্টুন আজকাল চোখেই পড়ে না। সরল, সরস, নির্দোষ কার্টুনের দিন যেন সচিত্র ভারত আর প্রমথ সমাদ্দারের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে।

প্রমথ সমাদ্দার ছাড়াও সচিত্র ভারতে আরও কার্টুন আঁকতেন স্বনামধন্য কাফী খাঁ এবং শৈল চক্রবর্তী। সেই সঙ্গে ছিলেন রবীন ভট্টাচার্য এবং অমিয় (ওমিয়ো-Omio)। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে একমাত্র কাফী খাঁ এবং শৈল চক্রবর্তী ছাড়া সবাই কার্টুনে ইংরেজিতে নাম সই করতেন। কাফী খাঁ তাঁর এই ছদ্মনামেই সই করতেন আর শৈল চক্রবর্তী কার্টুনের নীচে স্বাক্ষর দিতেন শ্রীশৈল।

সচিত্র ভারত ঠিক অচলপত্র জাতীয় কাগজ ছিল না। রাজনৈতিক বা সাময়িক ব্যাপারে তার খুব মাথাব্যথা ছিল না। তবে তখনকার দেশ পত্রিকায় ‘ট্রামে বাসে’ কিংবা পরবর্তীকালে আনন্দবাজারে শিবরাম চক্রবর্তীর ‘অল্পবিস্তর’ জাতীয় একটা কৌতুক কলম ছিল যাতে সাময়িক ঘটনা নিয়ে সরস মন্তব্য করা হত।

একটা উদাহরণ দিই, ‘এবার পূজার ভোগের চাউল বরাদ্দের জন্য সরকারি ভোগ কমিটি গঠিত হইয়াছে। প্রার্থীরা ইহাকে বলেন ভোগান্তি কমিটি।’

কার্টুন, কৌতুকী এবং হাসির লেখা থাকলেও সচিত্র ভারত ছিল উচ্চমানের সাহিত্য পত্রিকা। পরশুরাম কিংবা বনফুল, সুবোধ ঘোষ কিংবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এমনকী অন্নদাশংকর রায় এই পত্রিকায় লিখতেন। কদাচিৎ তরুণ বা অনামি লেখকের রচনা দেখা যেত। কবিতা বা ভারী প্রবন্ধ কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

বিলিতি ‘পাঞ্চ’ জাতীয় কাগজ ছিল না সচিত্র ভারত তবে সরস সাহিত্যপত্র হিসেবে হয়তো ‘নিউইয়র্কার’ কাগজের সঙ্গে এর কিছুটা তুলনা চলতে পারে।

হাতের কাছে রয়েছে সচিত্র ভারতের শারদীয়া ১৩৬০ সালের সংখ্যাটি। যেখান থেকে এ নিবন্ধের প্রথমেই সজনীকান্ত দাসের ‘খাপ ছাড়া’ কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছি।

এই সংখ্যাতেই পরশুরামের ‘একগুঁয়ে বার্থার’ মতো অবিস্মরণীয় গল্প প্রকাশিত হয়েছে, সে গল্পের ছবি এঁকেছেন শৈল চক্রবর্তী স্বয়ং। এ ছাড়া রয়েছে বনফুলের, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের, প্রমথনাথ বিশীর গল্প এবং অন্নদাশংকরের ছড়া।

সুবোধ ঘোষের বিখ্যাত গল্প ‘নিমের মধু’ও এই সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, পরিমল গোস্বামী এবং বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সরস গল্প।

* * *

নিজের অজান্তে একটু অ্যাকাডেমিক হয়ে গেল এই আলোচনাটি, এখন আর ফেরার পথ নেই। তবু সরসতার খাতিরে সচিত্র ভারতের দু-একটা কৌতুকের কথা বলি।

প্রমথ সমাদ্দারের একটা কার্টুন। জেলের সুপার ওয়ার্ডেনকে বলছেন, ‘কী—জেলের কয়েদিরা সব স্ট্রাইক করেছে? কাজ করছে না? লক আউট করে দাও জেলের দরজা।’

রবীন ভট্টাচার্যের কার্টুনগুচ্ছে রয়েছে একটি কৌতুক কাহিনী, কোনও ক্যাপশান নেই, ছবির মধ্যেই গল্প নিহিত রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে মার্কেটিং করতে বেরিয়েছেন। স্ত্রী দু’হাতে জিনিস কিনছেন আর একটার পর একটা প্যাকেটের বোঝা স্বামীর কাঁধে চাপিয়ে যাচ্ছেন। এইভাবে প্যাকেটের নীচে ডুবে গেলেন স্বামী। বাজার থেকে বাড়ি ফিরে স্বামীকে নিয়ে ঘরে ঢুকে প্যাকেটের বোঝায় মুখ ও অবয়ব ঢাকা স্বামীর ওপর থেকে প্যাকেটগুলো নামিয়ে নিতে দেখা গেল এ স্বামী সে স্বামী নয়, স্বামী বদলিয়ে গেছে প্যাকেটের নীচে।

অবশেষে পুরনো সচিত্র ভারত থেকে একটি মজার আখ্যান বলি, এটি একটি কথোপকথন।

সহকারী: স্যার বাইরে একটি লোক আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে অপেক্ষা করছে।

স্যার: (মোটা ফাইল থেকে চোখ না তুলে) বলে দাও আমি খুব ব্যস্ত।

সহকারী: বলেছি স্যার। কিন্তু লোকটি বলছে, তার হল জীবন-মরণের ব্যাপার, ওই যাকে বলে লাইফ অ্যান্ড ডেথ কোশ্চেন।

স্যার: কী সাংঘাতিক কথা। লোকটাকে নিয়ে এসো।

লোকটিকে সহকারী গিয়ে বাইরে থেকে স্যারের ঘরের মধ্যে নিয়ে এল, একটু পরে বোঝা গেল লোকটি লাইফ ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট, জীবনবিমার দালাল।

এবারের নিবন্ধ কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হয়ে গেল তবু সচিত্র ভারতের অন্তত আরেকটা সরস, আখ্যান উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে।

মেসের ম্যানেজারবাবু নবনিযুক্ত ভৃত্যকে বলছেন, ‘দ্যাখো বোর্ডারদের কারও বাড়ি থেকে যদি কোনও টেলিগ্রাম আসে বা খারাপ খবর, মৃত্যুসংবাদ, অসুখ-বিসুখ, মামলায় পরাজয় বা কারও পরীক্ষার ফেলের খবর অফিস থেকে সে মেসে ফেরা মাত্র বিকেলের চা জলখাবার বা রাতের খাওয়ার আগেই তাকে জানিয়ে দেবে।’

এই আদেশ শুনে সরল ভৃত্যটি প্রশ্ন করল, ‘কেন বাবু?’ ম্যানেজারবাবু বললেন, ‘আরে এতে খাবার অনেক বেঁচে যায়। মাস-খরচা অনেক কম পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *