কুকুর কুণ্ডলী
খুব ছেলেবেলায়, কবিরা যাকে বলেন অস্ফুট শৈশবে, একটা কুকুরছানা কোলে নিয়ে আমার একটা ফোটো তোলা হয়েছিল। সব কিছু যে রকম যায়, ঠিক সেই ভাবে সারমেয়-বাহন মফস্বলি নাবালকের সেই সাদা-কালো আলোকচিত্রটি কবে কোথায় হারিয়ে গেছে। এমনকী সেই কুকুরছানাটি কী রকম, কী রঙের দেখতে ছিল, কী নাম ছিল কিংবা তার একেবারেই কোনও নাম ছিল কিনা এর কিছুই এতদিন পরে আর মনে নেই।
জমানা বদল হো গয়া। শুধু জমানাই নয়, শুধু সময়ই নয়; স্থান-কাল-পাত্র, জীবন, পরিবেশ সব বদল হয়ে গেছে। কিন্তু ওই কুকুরছানাটি আজও আমার পিছু ছাড়েনি।
আমি যেখানেই যাই একটা না একটা কুকুর আমার জুটে যায়, সে আমার কাছে এসে লেজ নাড়ে, আমার হাত চাটে। দেশে-বিদেশে সর্বত্র এ রকম হয়েছে। কুকুর বিষয়ে আমার এ রকম অহংকার আমার এক প্রাণের বান্ধবী একটি তির্যক মন্তব্যে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি ভুরু কুঁচকিয়ে আমাকে বলেছেন, ‘দ্যাখো তুমি যদি কাঁটা চামচে দিয়ে খাও, কিংবা খেয়ে উঠে আর সকলের মতো ভাল করে হাত ধোও, তা হলে কুকুর এসে আর তোমার হাত চাটবে না, হাত চেটে সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়বে না।’
মন্তব্যটি অবশ্যই আমার পক্ষে যথেষ্ট সম্মানজনক নয়। আসলে কুকুর ব্যাপারটাই তেমন সম্মানীয় নয়৷
এক সাহেব দোকানে কুকুর কিনতে গিয়েছিলেন। কুকুরের দোকানদার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কুকুর তো কিনছেন, কিন্তু এর যথেষ্ট যত্ন দরকার, আপনার মেমসাহেব কুকুরের যত্ন নিতে জানেন তো।’ নিজের নধর-ডাগর ভুঁড়ির ওপর হাত বোলাতে বোলাতে সাহেব বললেন, ‘আমাকে দেখে বুঝতে পারছেন না ?’
দোকানের কথাই যখন এল, আরেকটা বিলিতি কুকুরের দোকানের গল্প লিখি। এক ভদ্রমহিলা কুকুরের দোকানে গিয়ে এক জাতের বেঁটে কুকুর দেখে দোকানদারকে বলেন, ‘এ কুকুরগুলোর পা-গুলো বড় ছোট ছোট।’ দোকানদার বললেন, ‘ছোট কী বলছেন ? মেজে তো ছুঁয়েছে। পেট থেকে মেজে পর্যন্ত যতখানি লম্বা হওয়া দরকার এর চারটে পা-ই ঠিক ততখানিই লম্বা আছে।’
প্রসঙ্গান্তরে পৌঁছানোর আগে কুকুর সম্পর্কিত অপমানের আরেকটা কাহিনী বলি; তবে এটা কুকুরের পক্ষে অপমানের না মানুষের পক্ষে অপমানের সেটা বলা অবশ্য কঠিন।
গল্পটা কুকুরের ট্রেনিং নিয়ে। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আচ্ছা তুমি কী করে তোমার কুকুরকে এত ভাল ট্রেনিং দিলে। আমি তো আমার কুকুরটাকে হাজার চেষ্টা করেও কিছুই শেখাতে পারছি না ?’ এর জবাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত কুকুরের মালিক বলেছিল, ‘দ্যাখো, কুকুরকে কিছু শেখাতে গেলে সর্ব প্রথমে যেটা দরকার সেটা হল যে শেখাবে তাকে অবশ্যই কুকুরের থেকে কিছু বেশি জানতে হবে। তা না হলে তার কাছে কুকুর কী শিখবে ?’
অপমান থেকে দংশনে যাই। কুকুরের কামড় নিয়ে কাহিনীর অন্ত নেই।
এক ভদলোক একদা দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমার কুকুর আজ পর্যন্ত কাকে কামড়াতে বাদ রেখেছে বলুন, আমার শালাকে কামড়িয়েছে। আমার ভগিনীপতিকে কামড়িয়েছে; আমার মেসোমশায়, আমার পিসশ্বশুর, আমার বন্ধু, আমার স্ত্রীর বান্ধবী, ডাক পিয়ন, ডাক্তার, খবরের কাগজওলা, আত্মীয় প্রতিবেশী প্রায় প্রত্যেককে সে কামড়িয়েছে, এমনকী আমাকে, আমার স্ত্রীকে পর্যন্ত।
যাঁর কাছে ভদ্রলোক দুঃখ করছিলেন, তিনি তখন বললেন, ‘তা হলে বলুন সবাইকে আপনার কুকুর কামড়িয়েছে।’ কুকুরের মালিক ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না মিথ্যা কথা বলব না অবোলা জন্তুর বিষয়ে। অনেককে ও কামড়ায়নি, যেমন সেবার যখন আমার বাড়িওলা চারজন গুণ্ডা পাঠিয়েছিলেন আমাদের ফ্ল্যাট থেকে জোর করে তাড়ানোর জন্যে সেবার আমার কুকুর তাদের দেখে লেজ নেড়েছিল, তাদের হাত চেটে দিয়েছিল। আরেকবার ইনকাম ট্যাক্সের লোকেরা ভুল করে আমাদের বাড়িতে সার্চ করতে এসেছিল, তাদের দেখে আমার কুকুরের কী আনন্দ, তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়ে কী গড়াগড়ি। তারপর সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি চিলেকোঠার জানলার শিক ভেঙে একটা সিঁদেল চোর বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করছে। আর কুকুরটা সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে খুব লেজ নাড়ছে চোরটার দিকে আহ্লাদী চোখে তাকিয়ে।’
এই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই মনের দুঃখে অতিরঞ্জিত করে তাঁর কুকুরের নিন্দা করেছেন। তবে কুকুরের কামড়ানো নিয়ে একটা গ্রাম্য বাদানুবাদ বহুদিন আগে শুনেছিলাম সেটা উল্লেখ করা যেতে পারে।
ঘটনাটা ঘটেছিল এক ইউনিয়ন বোর্ডের সভাপতির এজলাসে। রামচন্দ্র এসে অভিযোগ করেছে, ‘হুজুর শ্যামচন্দ্রের কুকুর আমার পায়ে কামড়িয়েছে।’ শ্যামচন্দ্রকে তলব করে আনা হল, ‘বলো, তোমার কী বক্তব্য ?’
শ্যামচন্দ্র জানাল, ‘হুজুর আমার কুকুর রামকে কামড়িয়েছে, ঠিকই, কিন্তু সে জন্যে আমি ওকে দশ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছি।’
এবার রামচন্দ্র উত্তেজিত হয়ে গেলেন, পকেট থেকে দশ টাকার নোটটা বের করে বলল, ‘হুজুর আপনিই দেখুন শ্যামের বদমায়েসিটা। শ্যাম একটা অচল নোট দিয়েছে আমাকে।’
এতক্ষণে শ্যামচন্দ্র খাপ খুলল, ক্রাচবাহিত রামচন্দ্রের পায়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, ‘কিন্তু, হুজুর রামের যে পায়ে আমার কুকুর কামড়িয়েছে রামের সে পাটা তো আসল নয়, সেটা যে কাঠের পা। আপনিই বলুন, আমি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়েছি কি না, কাঠের পায়ে কামড়ানোর জন্যে ?’
কুকুরের কামড় নিয়ে আর মাত্র একটি গল্প।
গল্পটি অত্যন্ত পুরনো, যাঁরা আগে শোনেননি বা পড়েননি, শুধু তাঁদেরই জন্যে।
খুবই সংক্ষিপ্ত কাহিনী। এক ডাক্তারকে তাঁর রোগী ফোন করেছেন রাত এগারোটায়। ডাক্তার অত্যন্ত ক্লান্ত ও বিরক্ত, তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘জানেন না রাত দশটার পর আমি রোগী দেখি না।’ রোগী বললেন, ‘সে তো আমি ভালভাবেই জানি, ডাক্তারবাবু, কিন্তু যে কুকুরটা আমাকে একটু আগে কামড়াল সে বোধ হয় জানে না।’