আবার তামাক
অনেক ধূমপায়ী আছেন যাঁদের বলা হয় চেন স্মোকার (Chain Smoker), যাঁরা ধোঁয়ার শেকল তৈরি করেন, মানে ক্রমাগত, একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যান ধোঁয়ার শেকল অবিচ্ছিন্ন রেখে। এঁদের অনেকের দেশলাই পর্যন্ত থাকে না, একটা সিগারেটের আগুন থেকে অন্য সিগারেট, তার থেকে পরেরটা এইভাবে পরপর ধরিয়ে যান।
সেই সূত্র ধরে এই তামাক নিবন্ধমালা আমি ওই চেন স্মোকিংয়ের মতো টেনে নিয়ে যাব সেরকম আশঙ্কা করার কোনও কারণ নেই। আমি নিজে বহুকাল ধূমপান করি না এবং এ দেশের বিধিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের ঘোষিত নির্দেশ—‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’—মান্য করে ধূমপান বা তামাক বিষয়ে আলোচনা এবারেই শেষ করব।
পৃথিবীতে সম্ভবত এমন কোনও ধূমপায়ী নেই যে কখনও প্রতিজ্ঞা করেনি যে সে আর ধূমপান করবে না এবং মাত্র কয়েক ঘণ্টা বা এক সন্ধ্যার জন্যে হলেও চেষ্টা করে ধূমপান করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেনি।
অবশ্য কয়েক ঘণ্টা বা বড়জোর কয়েকদিন বাদে সেই প্রতিজ্ঞা সে ভঙ্গ করেছে।
বোধহয় মার্ক টোয়েন সাহেবই বলেছিলেন যে ‘ধূমপান ছেড়ে দেওয়া খুব সোজা, আমি নিজে বহুবার ছেড়েছি।’ বঙ্কিম বাক্যবিলাসী মহামতি মার্ক টোয়েনের উক্তিটি আপাতশ্রবণে যতটা সরল মনে হচ্ছে তা কিন্তু নয়।
‘আমি ধূমপান করা বহুবার ছেড়েছ’, একথার আসল অর্থ হল ‘ধূমপান ছেড়েছি এবং আবার ধরেছি’। এবং এই উক্তির বিশেষ তাৎপর্য হল ধূমপান কখনওই একেবারে ছাড়তে পারিনি, ছেড়েছি বটে, ছাড়বার চেষ্টা করেছি বটে তবে আবার ধরেছি, ধরতে হয়েছে।
মার্ট টোয়েন ছিলেন মার্কিনি সাহিত্যিক। গত শতকের ইংরেজ লেখকেরাও তামাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কিপলিং বলেছিলেন চমৎকার কথা, ‘একজন রমণী শুধুই রমণী, কিন্তু একটা ভাল চুরুট হল ধোঁয়া।’
চার্লস ল্যাম্ব লিখেছিলেন ‘তামাকু বিদায়’ (A Farewell to Tobacco), যাতে ছিল সেই দুই বিখ্যাত পঙ্ক্তি,
‘তামাক,
আমি সব কিছু করতে পারি
তোমার জন্যে,
এক মরে যাওয়া ছাড়া।’
তামাক নিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞান, কাব্য সাহিত্যের কথা অনেক হল অতঃপর ধোঁয়ার মতো বায়বীয় বিষয়ে একটু তারল্যের দিকে যাই।
অনেক কাল আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে, কোথায় যেন অন্য কী এক সূত্রে সেটা লিখেও ফেলেছি।
সে যা হোক, গল্পটা না হয় আরেকবার বলি। পুরনো কার্জন পার্কে (এখনকার সুরেন্দ্রনাথ পার্ক) একদিন অফিসের শেষে একটা বেঞ্চিতে বসেছিলাম। অফিস ছুটি হয়েছে পাঁচটায়, তখনও অফিস টাইম দশটা-পাঁচটা ছিল সাড়ে দশটা-সাড়ে পাঁচটা হয়নি। কার সঙ্গে যেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল মেট্রোর সামনে ছ’টা নাগাদ, এক ঘণ্টা সময় হাতে, কী করব পার্কের একধারের বেঞ্চে বসে এক ঠোঙা চিনেবাদাম কিনে খোসা ছাড়িয়ে খাচ্ছিলাম। এবং সেই সঙ্গে ফণিমনসার দুর্গে ছুঁচো ইঁদুরদের ক্রীড়া কৌতুক দেখছিলাম।
আমি বসেছিলাম উত্তর-পশ্চিম কোনায় সর্বশেষ বেঞ্চে। কার্জন পার্ক তখনো এত গিজগিজে ভিড়ে ঠাসা হয়ে ওঠেনি। লোকজন যথেষ্টই ছিল কিন্তু এখনকার মতো এত গাদাগাদি ছিল না।
ওই বেঞ্চে আমার পাশেই বসেছিল এক আধা পাগল, আধা ভবঘুরে ধরনের লোক। জামাকাপড় খুব ফর্সা নয়, খুব ময়লাও নয়। ঠিক রাস্তায় শুয়ে থাকা টাইপ নয়। হয়তো কিছু করে, হয়তো কিছু করে না। সারাদিন পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, হয়তো রাতে বাড়ি ফিরে যায়।
তা এই লোকটি কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বেঞ্চির সামনে ঘাসের ওপরে নেমে গেল। বেঞ্চির সামনে এবং আশেপাশে ঘাসের মধ্যে প্রচুর পোড়া সিগারেটের টুকরো পড়ে রয়েছে। লোকটি উবু হয়ে বেছে বেছে সিগারেটের টুকরোগুলো কুড়োতে লাগল।
আমি তখন সিগারেট খেতাম। একটা সিগারেট একটু আগেই ধরিয়েছিলাম। লোকটির প্রতি দয়া পরবশ হয়ে মাত্র দুটো টান দিয়েই সিগারেটটা ফেলে দিলাম, যাতে লোকটি একটা বড় অর্থাৎ কমপোড়া সিগারেট পায়।
এই লোকটি কিন্তু আমার ফেলা সিগারেটের টুকরো সমেত আরও বেশ কয়েকটি বড় টুকরো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট ছোট দগ্ধাবশিষ্ট সিগারেটের টুকরো কুড়িয়ে পকেটে ভরতে লাগল।
লোকটির এই খামখেয়ালিপনা লক্ষ করে আমি একটু অধৈর্য হলাম। আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বড় বড় সিগারেটের টুকরোগুলো বিশেষ করে আমার ফেলে দেওয়া টুকরোটা অঙ্গুলি নির্দেশ করে তাকে বললাম, ‘এই তো বেশ বড় টুকরো রয়েছে।’
লোকটি অত্যন্ত সন্দেহজনক ভঙ্গিতে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। তারপর অভিমানাহত কণ্ঠে আমাকে বলল, ‘আপনি আমাকে যা ভেবেছেন আমি তা নই। আমি ফিলটার সিগারেট ছাড়া খাই না।’
অতঃপর একটা বাজে তস্য বাজে যাকে অকহতব্যই বলা যায় তেমন একটা গল্প বলি। এই গল্পটা যদি কোনও নীতিবাগীশ বলেন, ‘অশ্লীল’, কিংবা নীতিবাগীশিনী বলেন ‘অসভ্য’, আমি করজোড়ে বলব, ‘ভাই, এ গল্পটা তো আগেও অন্যভাবে লিখেছিলাম তখন তো আপত্তি করেননি।’
অতীতে যদি আপত্তি না করে থাকেন তবে বর্তমানে কেন আপত্তি করবেন? আর আপত্তি করার মতো এ গল্পে কিছু আছে বলে যদি আপনি ভাবেন, সে আপনার নিজ গুণে তাতে আমার কোনও দোষ নেই।
বিড়ি-সিগারেট খেলে, চুরুট খেলে তো বটেই, মুখে গন্ধ পাওয়া যায়। অল্পবয়েসি ছেলেরা যখন প্রথম লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া শুরু করে তখন গুরুজনরা যাতে মুখের গন্ধ টের না পায় সেই জন্যে খুব কাছে ঘেঁষে না। আবার কেউ কচি পেয়ারা পাতা বা লেবুপাতা চিবিয়ে বাড়ি আসে কিংবা বাড়ি এসেই গায়ে সেন্ট পাউডার মাখে যাতে তামাকের গন্ধ চাপা পড়ে।
আমাদের গল্পটা অবশ্য এর থেকে আলাদা। এক নববিবাহিত যুবক তার বন্ধুর কাছে অনুযোগ করেছিল, ‘ভাই বউয়ের মুখে বড় সিগারেটের গন্ধ’। বন্ধু বলল, ‘তুই তো সিগারেট খাস না সেই জন্যে তোর অসুবিধা হচ্ছে। তোর বউ একালের মেয়ে দু’একটা সিগারেট খায় খাবে, স্কুল কলেজে পড়ার সময় হয়তো নেশা করে ফেলেছে। মুখে একটু আধটু গন্ধ, ও নিয়ে আপত্তি করতে যাস নে।’ বর বলল, ‘না রে সেটা কথা নয়। খোঁজ নিয়ে দেখেছি বউ নিজেও সিগারেট খায় না। অথচ বউয়ের মুখে সিগারেটের গন্ধ? কেমন খটকা লাগে রে।’
অবশেষে একটি সরল আখ্যান দিয়ে তামাক বৃত্তান্ত শেষ করি।
এক মধ্যবয়সি রোগীকে বিশদভাবে পরীক্ষা করার পরে ডাক্তার নির্দেশ দিলেন, ‘ডিম, আলু, মাংস—এসব খাওয়া কমাতে হবে। মিষ্টি বন্ধ, নুন চিনি কম। মদ একেবারে খাবেন না। ছোট মাছ খাবেন, ডালের সুপ। সিগারেট দৈনিক এক প্যাকেট, ঠিক দশটা।’ রোগী কী একটা আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন। ডাক্তার বললেন, ‘না, কোনও আপত্তি নয়। কষ্ট করে যা বলছি মেনে চলতে হবে।’
সাতদিন পরে রোগী আবার এলেন ডাক্তারবাবুর কাছে, ‘ডাক্তারবাবু, খুব কষ্ট হচ্ছে। আর পারছি না।’ ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কেন কী হল?’ রোগী বললেন, ‘ওই যে দশটা সিগারেটের কথা বলেছিলেন। সারা জীবন সিগারেটে টান দিইনি। এখন এই বয়েসে হঠাৎ দৈনিক দশটা করে সিগারেট খাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।’