স্মৃতির খেয়া
হই হই করে বইমেলা চলছে শহরে। সারা বছর তুচ্ছাতিতুচ্ছ রসিকতায়, ইয়ারকি দিয়ে কেটে যায়। অন্তত এবার একটা বইয়ের কথা লিখি।
বাংলা কাগজের রীতি আছে, বৎসরান্তে লেখক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীদের কাছে জানতে চাওয়া এ বছর কী কী বই পড়লেন। তাঁরা যা বলেন, তার শতকরা নব্বইটি ইংরেজি বই। এমন কেউ কেউ আছেন এমনকী তার মধ্যে বঙ্গভাষার লেখকও আছেন যিনি একটিও বাংলা বইয়ের নাম উল্লেখ করেন না। সস্তা, বাজিমাৎ করা, গিমিক সর্বস্ব কিংবা পণ্ডিত পাঠ্য বিলিতি শুষ্ক কাষ্ঠ গ্রন্থের চমৎকার একটি তালিকা পাওয়া যায় এসব প্রতিবেদনে। এঁরা বোধহয় মনে করেন বাংলা বইয়ের নাম করলে নিজেদের দাম কমে যাবে। আমার বিদ্যা অতদূর নয়। তা ছাড়া এই সামান্য কথিকায় অত কচকচি পোষাবে না।
সরাসরি একটা বাংলা বইয়ের কথা বলি, সাহানা দেবীর ‘স্মৃতির খেয়া’। বইটি আগে দেখেছিলাম, দশ বছর হল বেরিয়েছে কিন্তু পড়া হয়নি। সম্প্রতি পড়লাম।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ভাগিনেয়া, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পাত্রী, শ্রীঅরবিন্দের শিষ্যা আজীবন সংগীত সাধিকা সাহানা দেবী— তাঁর এই বইতে শান্তিনিকেতনের গান আর অসহযোগের আন্দোলন, দেশবন্ধুর শেষযাত্রা আর অরবিন্দের পণ্ডিচেরি অনায়াস ভাষায় সাবলীল সহজ বর্ণনায় উপস্থাপন করেছেন।
এই শতকের প্রথম দুই দশক। কত ঘটনা, কত আন্দোলন তারই ফাঁকে ফাঁকে কৌতুকময় ঘটনাবলি। যে পৃথিবী চিরদিনের জন্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আমরা জন্মাবার আগেই সেই জগতের ছবি এঁকেছেন সাহানা দেবী।
বড় ঘটনা আপাতত থাক ইতিহাসের পৃষ্ঠার জন্যে। ইতিহাসে ঠাঁই পাবে না এমন দু’-একটা কৌতুকময় কাহিনী ‘স্মৃতির খেয়া’ থেকে তুলে দিচ্ছি।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে একটি বিয়েতে ঘরে দরজা বন্ধ করে মহিলাদের আসর বসেছে। সেখানে সাহানা দেবী অতুলপ্রসাদের ‘বঁধু ধরো ধরো মালা পরো গলে’ গানটি গেয়ে নাচ শুরু করেছেন। হঠাৎ দেখা গেল ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করে রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ সেই নাচ দেখছেন। সাহানা দেবী তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে কবিকে ধরলেন, ‘আপনি যে বড় লুকিয়ে আমার নাচ দেখছিলেন?’ উজ্জ্বল দুষ্টুমিভরা চোখে কবি তাঁর সেই অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি যদি কথা দাও যে নাচবে তাহলে আমি আবার একটা বিয়ে করি!’
* * *
পিতৃহীন সাহানা দেবী মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছিলেন। মামা হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। দেশবন্ধুর অনেক কাহিনী, অনেক গল্প স্মৃতির খেয়ায়।
সেটা সেই অসহযোগের বছর। ষাট ইঞ্চি বহরের শান্তিপুরী কোঁচানো ধুতি ছেড়ে দেশবন্ধু তখন চুয়াল্লিশ ইঞ্চি বহরের খদ্দর পরতে লেগেছেন। এই সময়ের একটা মজার ঘটনার কথা সাহানা দেবী লিখছেন।
…‘আমাদের এক পিসিমার বাড়িতে বিকেলের দিকে মামাবাবু বেড়াতে এসেছেন। এই পিসিমা দুর্গামোহন দাশের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ। মামাবাবুর পরিধানে খদ্দরের ধুতি চাদর ইত্যাদি ছিল; কিন্তু পায়ে ছিল বিলিতি জুতো। দেখে পিসিমা ঠাট্টা করে দেওরকে বললেন, ‘এ দিকে তো খদ্দর পরেছ, পায়ে তো দেখি বিলিতি জুতো!’ মামাবাবু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘বিলিতি বলেই তো পায়ের নীচে রাখতে ভালবাসি।’
* * *
রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এলেই রসা রোডের দেশবন্ধুর বাড়ি থেকে ডাক পড়ত সাহানা দেবীর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গান শিখতে যাওয়ার জন্যে। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারী দীনেন্দ্রনাথ যেবার কবির সঙ্গে আসতেন সেবার বেশির ভাগ গানই দীনেন্দ্রনাথ শেখাতেন, যদিও কবি সেখানে উপস্থিত থাকতেন। দীনেন্দ্রনাথ না এলে কবি নিজেই শেখাতেন।
একবার খুবই মজার একটা ব্যাপার হয়েছিল। দীনেন্দ্রনাথ কলকাতা এসেই টেলিফোনে সাহানা দেবীকে ডেকে পাঠালেন, বললেন, ‘চলে এসো। অনেক নতুন গান আছে।’
সাহানা দেবী ছটফট করছে যাওয়ার জন্যে, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোনও গাড়ি কিছুতেই জোগাড় করে ওঠা গেল না। ভবানীপুরের থেকে জোড়াসাঁকো কম দূরের পথ নয়, সাহানা দেবী আছেন মামার বাড়ি অর্থাৎ রসা রোডে চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে (এখন যেটা চিত্তরঞ্জন সেবাসদন) আর দীনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন — জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে।
প্রায় সত্তর আশি বছর আগের কথা এসব। রাস্তাঘাটে মহিলাদের যাতায়াত অত সহজ ছিল না, গাড়ি ঘোড়াও বা কোথায়।
সাহানা দেবী যেতে পারলেন না। কিন্তু তার জন্যে গান শেখা মোটেই বন্ধ রইল না। ব্যারিস্টার সি আর দাশের ব্যস্ত চেম্বারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই টেলিফোনযোগে চোদ্দটা গান শিখে নিলেন সাহানা দেবী। দীনেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো থেকে টেলিফোনে গাইছেন আর তিনি ভবানীপুর রস রোডে টেলিফোন ধরে গান শিখছেন।
সাহানা দেবীর ভাষায়, ‘সে ভারী মজা! কবি তো শুনে অবাক। এই কথা যে কত লোককে উনি পরে বলেছিলেন, এমন গান পাগলা আমি আর কোনও মেয়েকে দেখলুম না।’
গানের পরে অভিনয়ের কাহিনী বলি।
নিউ এম্পায়ারে ‘বিসর্জন’ অভিনয় হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জয়সিংহ।
অভিনয় আরম্ভ হত সাহানা দেবীর কণ্ঠে ‘তিমির দুয়ার খোলো এসো এসো নীরব চরণে’ গানটি দিয়ে। স্টেজে প্রবেশ করবার পথে সাহানা দেবী দেখলেন কবি জয়সিংহের সাজে সেজে ভোঁ হয়ে বসে আছেন, যেন কীসের মধ্যে তলিয়ে গেছেন।
সাহানা দেবীর ডাক নাম ঝুনু। তিনি গান শেষ করে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসতেই রবীন্দ্রনাথ রঙ্গ করে বললেন, ‘ঝুনু, তুমি তো দেখছি বেশ সহজভাবে স্টেজে চলে যাও? ভয় ভাবনার ধার ধারো বলে তো মনে হয় না?’
সাহানা দেবী হেসে বললেন, ‘আমার খুব আনন্দ হয়। খুব মজা লাগে স্টেজে ঢুকতে।’
একথা শুনে রবীন্দ্রনাথ আরও মজা করে বললেন, ‘তাই তো দেখছি। আর আমাকে এই বৃদ্ধ বয়সে এত স্টেজে অভিনয় করেও স্টেজে যাবার আগে আজও বলসঞ্চয় করে নেবার জন্যে একটু ব্র্যান্ডি খেয়ে নিতে হয়।’ যাঁরা কাছে ছিলেন সবারই হেসে গড়িয়ে পড়বার মতন অবস্থা কবির এই রকম মজার ভঙ্গি করে বলা দেখে।
অভিনয়ের দ্বিতীয় রাত্রে সাহানা দেবীর গায়ে জ্বর। সেই জ্বর গায়েই গান করলেন। সেদিন অভিনয় শেষ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সাহানা দেবীর কাছে এসে কবি কৌতুকভরা নয়নে মৃদু মৃদু হেসে বললেন, ‘শোনো ঝুনু, জ্বর হলে যদি তোমার এমন গান হয় তবে আমি তোমার জ্বর হয়েছে শুনে দুঃখ করব না খুশি হব, সে কথা তুমিই বলো, তোমার কী মত?
* * *
অজস্র ঘটনা। উজ্জ্বল স্মৃতি চিত্রমালা। আর কিছু সরস কিছু ব্যক্তিগত ব্যথা। বেদনার সুখ-দুঃখের ভালবাসার কথা, গানের কথা। মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু থেকে অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ থেকে দিলীপকুমার রায়। চমৎকার ভাষায় লেখা তরতর করে বয়ে গেছে স্মৃতির খেয়া। মহামানবদের আমাদের নিত্যদিনের চৌহদ্দির মধ্যে হাসি-ঠাট্টা গল্পগুজব আর গানের মধ্যে মিলিয়ে দিয়েছেন সাহানা। অনেক বড় কথার মধ্যে তুচ্ছ কৌতুকের স্মৃতিও তিনি জুড়ে দিয়েছেন। স্মৃতির খেয়ার মতো বই সচরাচর লেখা হয় না।
নব্বই অতিক্রান্ত হয়েছেন চিরসবুজ সাহানা দেবী। পণ্ডিচেরি আশ্রমে এখনও ভাগ্যবানেরা তাঁর কণ্ঠের গান, কোনও কোনও দিন গানের পর গান শুনতে পায়। এ রকম যেন আরও বহুদিন চলে।