ডাক্তারের হাতে
ডাক্তার-অন্ত প্রাণ আমার। আমার আত্মীয়েরা ডাক্তার, আমার সহৃদয় প্রতিবেশী ডাক্তার, আমার বন্ধুরা ডাক্তার। আথচ রসিকতা করতে নেমে আমার আপন-পর জ্ঞান মোটে থাকবে না। তা ছাড়া আমার মতো রোগবাতিক, অসুখকাতর ব্যক্তির পক্ষে চিকিৎসক মহোদয়দের মোটেই ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত নয়।
উচিত অনুচিতের প্রশ্ন পরে। নামকরণেই মহা ভুল করে ফেললাম। ‘ডাকাতের হাতে’ নামে চমৎকার ছোটদের কাহিনীটি নিশ্চয়ই অনেকে ছোটবেলায় কিংবা পরে পড়েছেন। অন্য কিছু নয়। শুধু ধ্বনিমিলের খাতিরে এ-নিবন্ধের নাম দিয়ে ফেললাম। দুটোর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও অত্যুৎসাহী দুরভিসন্ধি খুঁজতে যাবেন না।
অবশ্য আমার চেয়েও বিপজ্জনক কাজ অনেকে করেছেন। হাতের সামনে রয়েছে একটি টাটকা কেনা মার্কিনি জোকবুক। (জোকবুক শুনে শুচিবায়ুগ্ৰস্তা পাঠিকঠাকরুন দয়া করে নাক সিঁটকোবেন না; জোকবুক আমার সদা শিরোধার্য, জোকবুকই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে)।
ওই মার্কিন জোকবুকে ডাক্তারের একটি চমকপ্রদ সংজ্ঞা দিয়েছে। সংজ্ঞাটি হল,
‘ডাক্তার হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আজ তোমাকে হত্যা করবেন যাতে তুমি কাল মারা না যাও।’
এ প্রসঙ্গে একটি পুরনো গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। গল্পটি কখনও স্যার নীলরতন সরকারের নামে চলেছে, আবার কখনও ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের নামে। গল্পটি চমৎকার কিন্ত যতদূর মনে হয় সত্যি নয়, কিংবা কী জানি হয়তো সত্যি হতে পারে।
স্যার নীলরতন (অথবা বিধানচন্দ্র) গিয়েছেন এক দরিদ্র রোগীকে দেখতে। শহরতলির শেষ সীমানার একটি ভাঙা টিনের ঘরে রোগীর বাস। রোগীর ঘরের বাইরে টিনের পুরনো রং-জ্বলে-যাওয়া সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘ডাক্তার অমুক চন্দ্র অমুক, এইচ এম বি, প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার।’
স্যার নীলরতনের সঙ্গে সহকারী রয়েছে জনৈক তরুণ ডাক্তার। দু’জনে মিলে রোগীর ঘরে ঢুকে রোগীর অবস্থা দেখলেন। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ, ঘরের দৈন্যদশা ততোধিক। ভাঙা আয়না থেকে শতচ্ছিন্ন ময়লা বিছানা, সর্বত্র কঠোর দারিদ্র্যের অমোঘ ছাপ।
রোগী দেখা হয়ে যাওয়ার পর স্যার নীলরতন আর তাঁর সহকারী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পথে নামতেই রোগীর স্ত্রী তাঁর আঁচল থেকে খুলে ময়লা পুরনো এক টাকা-দু’ টাকার নোটে বত্রিশটা টাকা, ডাক্তারবাবুর ভিজিট, স্যার নীলরতনের দিকে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু নীলরতন ভিজিট প্রত্যাখ্যান করে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
গাড়িতে ওঠার পর তরুণ সহকারীটি নীলরতনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যার আপনি এখানে ভিজিট নিলেন না কেন?’ নীলরতন জবাব দিলেন, ‘দেখলাম বড় গরিব, তা ছাড়া ডাক্তারমানুষ, আমাদেরই সম ব্যবসায়ী।’তরুণ চিকিৎসকটি একটু উত্তেজিত হল। সে ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, ‘স্যার, এ কীসের ডাক্তার? এ তো কোয়াক, সাধারণ একজন হাতুড়ে হোমিওপ্যাথ, একে আপনি ডাক্তার বলতে পারেন না। আপনিও ডাক্তার, আর এও ডাক্তার?’
তরুণ সহকারীর উত্তেজনা দেখে স্যার নীলরতন মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, ‘তফাত খুব বেশি কী?’ সহকারী অবাক হয়ে বললেন, ‘তফাত নেই।’ নীলরতন সরকার বললেন, ‘খুব সামান্য তফাত। আমরা রোগীকে হত্যা করি আর এঁরা রোগীকে মরতে সাহায্য করেন।’
এই সূত্রে হাতুড়ে ডাক্তারের বিখ্যাত কাহিনীটি মনে পড়ছে। গল্পটি সুপরিচিত, বাংলা সিনেমাতেও ঢুকে গিয়েছিল।
পাড়াগাঁয়ে এক ভদ্রমহিলার প্রসববেদনা উঠেছে। কাছে পিঠের মধ্যে রয়েছে এক হাতুড়ে, তাঁকেই ডাকা হল। তিনি আঁতুড়ঘর অর্থাৎ রোগিণীর প্রসবকক্ষে তাঁর ডাক্তারি বাক্স নিয়ে ঢুকে পড়লেন এবং ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। বন্ধ দরজার বাইরে তখন আত্মীয় প্রতিবেশীরা অধীর প্রতীক্ষা করছেন। প্রায় দশ মিনিট অস্থির অপেক্ষার পর ডাক্তারবাবু দুম করে দরজা খুলে মুখ বার করলেন, সবাই চেঁচিয়ে জানতে চাইল, ‘কী হল ডাক্তারবাবু, ছেলে না মেয়ে?’ ডাক্তারবাবু বললেন, ‘এখনও কিছু হয়নি, আগে একটা ছুরি দিন।’
একজন দৌড়ে গিয়ে একটা ছুরি এনে ডাক্তারবাবুকে দিল, ছুরিটি হাতে নিয়েই ডাক্তারবাবু সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সবাইয়ের তখন ভীষণ দুশ্চিন্তা, কী জানি অপারেশন করতে হচ্ছে কি না? এ ডাক্তার পারবে কি না?
কিন্তু সমস্ত দুশ্চিন্তা নিরসন করে আবার ডাক্তারবাবু দরজা খুলে মুখ বার করলেন, কী ব্যাপার, না ওই ছুরিতে হচ্ছে না, একটা বঁটি, দা কিংবা কাটারি হলে ভাল হত। সঙ্গে সঙ্গে একদিক থেকে একজন একটা কাটারি আর অন্যদিকে থেকে আরেকজন একটা বঁটি দ্রুত নিয়ে এসে ডাক্তারকে এগিয়ে দিলেন।
সকলের চিন্তা কিন্তু আরও বেড়ে গেল। এ কী ধরনের সন্তান প্রসব, যার জন্যে কাটারি, বঁটি, দা লাগে। ইতিমধ্যে ডাক্তারবাবুর মুখ আবার দরজার পাল্লা গলিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তাঁর কপালে ঘাম, মুখে উদ্বেগের স্পষ্ট ছাপ। তিনি কাতর স্বরে অনুরোধ করলেন। ‘আপনারা কেউ একটা ভাল হাতুড়ি দিতে পারেন আমাকে?’
ছুরি কাটারি পর্যন্ত তবু সবাই সহ্য করেচিল, কিন্তু হাতুড়ি কী কাজে লাগবে শিশু জন্মের সময়ে, একথা ভেবে প্রায় সকলেই হতবাক হয়ে গেল। সত্যি কী ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে কেউই কিছু বুঝতে পারছিল না।
ঠিক এই সময়ে আঁতুড় ঘরের মধ্য থেকে নবজাতকের ক্রন্দন ধ্বনি শোনা গেল, সে দিকে দৃষ্টিপাত করে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘যাক ভালয় ভালয় বাচ্চাটা জন্মাল। হাতুড়িটা আর দরকার নেই।’ বলে ডাক্তারবাবু ঘর থেকে ডাক্তারির বাক্স বার করে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
তখন সবাই ছেঁকে ধরল ‘আপনি হাতুড়ি চেয়েছিলেন কেন? আর এতক্ষণ ছুরি-কাটারি দিয়েই বা কী করলেন?’ ডাক্তারবাবু তাঁর হাতের কালো বাক্সটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওষুধ বার করতে পারছিলাম না। বাক্সটার চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না, বোধ হয় বাসায় ফেলে এসেছি। ছুরি, কাটারি দিয়েও খোলা যায়নি। তাই হাতুড়ি চেয়েছিলাম। যাক ওষুধ দরকার পড়ল না, ভালয় ভালয় বাচ্চাটা হয়ে গেল।’ ডাক্তার দ্রুত পদে বেরিয়ে গেলেন।
উপরের হাতুড়ি ও ডাক্তারের এই গল্পটি খুব পুরনো কিন্তু কতদিনের পুরনো, কে জানে। হাতুড়ে ডাক্তার কথাটা কি এই গল্প থেকেই জন্ম নিয়েছে?