সোহম
কিশোরীবাবু ইচ্ছা করেই এই সময়টা নিজের পুরোনো ঘরে একা কাটাচ্ছিলেন। সোমবার থেকে আর এ ঘরে বসবেন না; যে ঘরে বসবেন, সে ঘর আজ প্রায় কুড়ি বছর ধরে তাঁর হৃদয়ের পীঠস্থান হয়ে বিরাজ করছিল। সোমবার থেকে সেই ঘর তাঁর হবে। তাঁর হুকুমমতো সে ঘরের সব ব্যবস্থা চলবে। ভাবা যায় না। কুড়ি বছর আগে, ঐ ঘরের দরজার বাইরে এখন খদ্দরের উর্দিপরা যে চাপরাশীটা বসে, সে না হলেও সেরেস্তা সম্পর্কে তার কোনো পূর্বপুরুষ, কিশোরী হাজরা বলে আনাড়ি পাড়াগেঁয়ে ছেলেটাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যদেবীর এমনি কারসাজি যে ঠিক সেই সময়, সেই প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা অতিমানবটি ওইখানে এসে উপস্থিত এবং চাপরাশীর মন্তব্যটি শুনে একেবারে অগ্নিশর্মা!
সেদিন থেকে কিশোরীলালকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ফিরে তাকাতে হয়নি, তার একটা কারণ এক মুহূর্তের জন্যও যদি চোখ ফিরিয়েছেন তো সামনের পথ থেকে পা হড়কে যাবার সম্ভাবনা। চারদিকে হিংসুটে প্রতিদ্বন্দ্বী গিজগিজ করছে। সম্মুখ পথে এক এক ইঞ্চি করে কামড়ে কামড়ে রাস্তা করে নিতে হয়েছিল। সে কামড় কচ্ছপের কামড়; একবার ধরলে আর ছাড়ে না। রাজনীতির মহাসড়কের দু হাতের গলিঘুঁজি কিশোরীর নখদর্পণে চলে এসেছিল। দিনে বিশ্রাম ছিল না, রাতে ঘুম ছিল না, প্রাণে শান্তি ছিল না।
তা না থাকতে পারে, তবু এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে লক্ষ্মীদেবীও যে গুটিগুটি তাঁর বাড়িতে ঢুকে আসন পেতে বসেছেন, তারও যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
কিশোরীবাবু একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। কোথাও একটুকরো কাগজ পড়ে নেই। থাকলে হেমের চাকরি থাকত না। পরবর্তীরা যাতে নিজেদের সুবিধা করে নিতে পারে এমন একটা সুতো কি একটা আলপিন হেম ফেলে রাখেনি। সব টানাগুলো বের করা, আলমারির দরজা হাট করে খোলা। সেরেস্তার বিশ্বস্ত কাগজপত্র নিজের চোখে শেষ একবার দেখে নিয়ে, কিশোরীবাবু নিজে চাবিবন্ধ করবেন। দেখা হয়ে গেছে, চাবি ঘোরানোটুকু বাকি।
ঘরের আলো-পাখা নতুন; অনেক খ্যাচাখেচি করে আগে যা আদায় করতে হত, এখন অযাচিতভাবে অবাধ স্রোতে সে সমস্তই এসে পৌঁছয়। আরো অনেক জিনিস পৌঁছল, যা সে সময় চিন্তা করবার সাহস ছিল না। প্রথম যখন নিজের টেবিল-চেয়ার হয়েছিল, বাড়ি গিয়ে সরলাকে বলতেই সে আহ্লাদে আটখানা হয়েছিল। এখন সরলা আপিসের কথা জিজ্ঞাসাও করে না। এই পদোন্নতি যদ্দিন হয়নি, কেবলি খুঁতখুঁত, মুখভার। হল যখন, ভাবখানা যেন এর মধ্যে তারি কৃতিত্ব বেশি! নতুন পাথর বসানো গয়না গড়াল সরলা, সোনা আজকাল সে পরে না। আগে একজোড়া লাল শাঁখা, একজোড়া সাদা শাঁখা, তিনখানা লোহা, আর মা’র হাতের সরু ফাঁপা বালাজোড়া পরেই সে খুশি ছিল।
মার হাতের ফাঁপা বালাজোড়ার কথা মনে হতেই, নখভাঙা শিলে ছ্যাঁচা পোড় খাওয়া মা’র হাতজোড়াও মনে পড়ল। আজকাল মাঝে মাঝে কিশোরীবাবুর বুকের বাঁদিকে টিপ টিপ করে ব্যথা করে। হেম, নাদু, এরা ছাড়বে কেন, টেনে শহরের সব চাইতে নামকরা হৃদ্রোগ বিশারদের কাছে নিয়ে গেল। তা নেবে না? কিশোরী হাজরা যতই উঠবেন সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়-জঙ্গলও তো টেনে তুলবেন। ডাক্তার বললেন, “ও কিছু নয়, অতিরিক্ত স্ট্রেন, একটু বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবে। একটা লং সি ভয়েজ ইন্ডিকেটেড স্যার।— না, না, ওকী, আপনাকে দেখতে পারাই আমার সৌভাগ্য, আপনাদের মতো দেশসেবকদের কাছ থেকে নিলে পাপ হয়।’
পুপুকে সময়মতো ইলেকট্রিক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়নি। ট্যাঁক তখন গড়ের মাঠ, দেবেন কোত্থেকে। পুপু চলে যাবার পর বহুদিন কিশোরীলালের সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করত না; তাতে তাঁর কাজেরও অনেক উন্নতি হয়ে গেছিল। আর পুপুর পর দিনু, দ্বিজু, সোনা, রুপো, অমরেশ সব ফাঁকটুকু ভরে দিয়েছিল। যাক মেয়েদের ভালো বিয়ে দিয়েছেন; ছেলেদের যার যেখানে বসিয়ে দিয়েছেন। অবিশ্যি অমরেশকে খুশি করা শক্ত; এ চাই ও চাই, এ নইলে চলে না, ও নইলে চলে না; বৌয়ের নিত্য খাঁই, উঃফ!’ এই বলে টেবিলের ওপর একটা সজোরে কীল মারলেন কিশোরীবাবু। বেশ লাগল।
তারপর উঠে টানাগুলো ঠেলে দিলেন, আলমারির দরজায় চাবি দিলেন। চারদিক নিস্তব্ধ; এত রাত পর্যন্ত এ বাড়িতে প্রায় কেউ কাজ করে না। আজকের কথা অবিশ্যি আলাদা। এরা কিশোরীবাবুকে আজ অভিনন্দন দিয়েছে, রুপোর চোঙায় সংবর্ধনাপত্র দিয়েছে, সবাই মিলে খাদ্য নিয়ন্ত্রণের আইন শিরোধার্য করে মুর্গির কাবাব, চিংড়ির কাটলেট, রাধাবল্লভী, আর আইসক্রিম খেয়ে বাড়ি গেছে। আছে কোথাও নিশ্চয় মুরারি; কিশোরীবাবুকে না বলে বাড়ি যাবে, তার ঘাড়ে ক’টা মাথা। আরে, ক্যালেন্ডারের পুরোনো পাতাটা ছেঁড়া হয়নি যে; না দেখলে এদের কাজ খারাপ হয়ে যায়।
পাতাটা ছিঁড়ে ময়লা কাগজের টুকরিতে ফেলে ঘুরে দাঁড়াতেই, কিশোরীবাবু ছেলেটিকে দেখতে পেলেন। কখন দরজা দিয়ে ঢুকে, দুহাত দিয়ে টেবিলে ভর করে দাঁড়িয়েছে। প্রথমটা একটু ঘাবড়ে গেছিলেন কিশোরীবাবু। আজকাল খবরের কাগজ খুললেই একে ছোরা মারা, ওকে গুলি করার খবর পাওয়া যায়। আক্রান্তরা কেউ হেঁজিপেঁজি নয়; হেঁজিপেঁজি মেরে কার কী লাভ? কিন্তু একটু নজর করে দেখেই কিশোরীবাবুর মনে ভয় ঘুচে বিরক্তি স্থান পেল। আজকাল এ-বাড়িতেও কেউ কিছু দেখে না নাকি? এসব আজেবাজে লোক ঢোকে কী করে?
কর্কশ কণ্ঠে কিশোরীবাবু বললেন, ‘কী চাও?’ তার গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না, নিচের ঠোঁটটা থরথর করে কাঁপছে। দুদিন খেউরি হয়নি, খদ্দরের জামাকাপড় খুব পরিষ্কারও নয়, সদ্য বাড়িতে কাচা মনে হয়, জঘন্য একজোড়া চটি দোরগোড়ায় খুলে রেখে, খালি পায়ে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। পাঞ্জাবিটা সম্ভবত কারো কাছ থেকে চেয়ে আনা, হাতে ঝুলে বড়ই খাটো। তবু কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল।
চেয়ারে বসে পড়ে ক্লান্তভাবে কিশোরীবাবু বললেন, ‘কপালে প্রার্থীর টিকিট লাগিয়ে এসেছ। বড় অভাব, না? বড্ড গরিব? এক্ষুনি কী বলবে আমার জানা আছে। বাবা নেই; আর কিছু না করুন গুটি চারেক অনাথ শিশু আর মুখ বউ রেখে অকালে স্বর্গে গেছেন, না? মা আধপেটা খেয়ে খেয়ে শয্যা নিয়েছেন, অর্থাভাবে বেশি দূর লেখাপড়া শেখা হয়নি, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে; হয় তোমাকে এক্ষুনি টাকা দিতে হবে, নয়তো চাকরি দিতে হবে, দুটো একসঙ্গে হলেই ভালো। ঠিক বলেছি কি না? কী, চুপ করে রইলে যে?”
ছেলেটার গলা শুকিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না বোঝা গেল; কাঁপা কাঁপা, হাড় জিরজিরে, কেঠো কেঠো হাত দিয়ে পকেট হাতড়াতে লাগল। এত চেনা মনে হচ্ছে কেন? কোথাও দেখেছেন কিশোরীবাবু এই মুখটাকে, কানের পাতার ওপরের আঁচিলটা ওঁর চেনা, চোখের কোণে ছোট্ট উঁচু জায়গাটাকেও আগে নিশ্চয় কোথাও দেখেছেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করলেই পেয়ে বসবে, তখন ঝেড়ে ফেলা মুস্কিল হবে। আঃ, হেম, নাদুও তো বেশ লোক; ‘একা থাকতে চাই’ বলেছেন বলে বেমালুম হাওয়া! একটা বিপদআপদও তো হতে পারে, সে খেয়াল নেই। দেশের কর্মীদের রক্ষা করবে না তো কাকে করবে?
ছেলেটা পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে এগিয়ে ধরতেই, রুষ্টস্বরে কিশোরীবাবু বললেন, ‘কী ওটা? নিজের ফিরিস্তি নাকি? একেবারে ভিখিরি বনে গেছ দেখছি, ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে!’— আরও কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবার ইচ্ছা ছিল, ছেলেটা হঠাৎ নরম গলায় বলল, ‘আজ্ঞে না, একটু লিখেছিলাম।’‘লিখেছিলে? কী লিখেছিলে?’ ‘বাংলা দেশের পাড়াগাঁর উন্নতি সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ।’
কিশোরীবাবু কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছাদফাটানো হাসি হাসলেন। ‘বাঃ, খুব ভালো, আমরা এক আপিস এক্সপার্ট দিয়ে উন্নয়ন করতে পারছি না, আর তুমি আমাদের শিক্ষা দেবে, মুখ ছোকরা! বেরোও এখান থেকে এক্ষুনি!’ ছেলেটার মুখ সাদা হয়ে গেল, অনেক কষ্টে বলল, ‘সত্যিই বড্ড গরিব আমরা, মাকে দেখলে কষ্ট হয়, না খেয়ে খেয়ে— যদি একটু লেখাটেখার কাজ দিতেন, কত নোটিশ, রিপোর্ট, বিজ্ঞাপন তো দরকার হয়—’
‘ওঃ, সেসব তুমি লিখবে, না? বলি বি-এ পাস করেছ?’ ছেলেটা মাথা নাড়ল, ‘হায়ার সেকেন্ডারির পর আর পড়া হল না।’—‘থাক, আর বলতে হবে না, ওসব জানা আছে। এখন মানে মানে কেটে পড় দিকি! আজ একটা বিশেষ দিন, তাই রাগমাগ করতে চাই না। যাও।’
ছেলেটা নিচু হয়ে মাটি থেকে কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে, এক পা দু পা করে পেছু হটতে লাগল। খোলা কাগজটাতে লেখা প্রথম লাইনটা কিশোরীবাবুর চোখে পড়ল, ‘নিরবধি বাংলার খেত খাল নদী—’ রোগা হাতটার ওপর চোখ পড়ল; কড়ে আঙুলে একটা রুপোর আংটি, তাতে একটা সিংহের মুখ তার চোখ দুটি দুটো লাল পলা, কপালে একটা নীল ফিরোজা।
বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। ও লেখা কোথায় যেন পড়েছেন; টুকে আনেনি তো ব্যাটা? কিন্তু হাতের লেখাটাও বড় চেনা। আংটিটাও বড় চেনা। কিশোরীবাবুর মাথাটা কেমন করে উঠল, চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলেন। বড় চেনা হাতের লেখা, ‘নিরবধি বাংলার খেত খাল নদী—’ তারপরে আছে ‘শ্যামল বনের সম্ভার কেহ যদি—’ আর মনে পড়ছে না। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। ও কার আংটি? বালিখালের মাসিমার ঐ রকম আংটি ছিল না? সেদিন কলকাতায় আসার সময় কিশোরীকে দিয়েছিলেন, নাকি বড় পয়মন্ত আংটি। দু’হাতে কিশোরীবাবু মুখ ঢেকে মাথা ঘোরা বন্ধ করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিশোরীর কপাল সত্যি ফিরে গেছিল, কিন্তু বড় কষ্টে বড় কষ্টে। ওই লেখাটাও কত কষ্টে লেখা, চেয়ে আনা কাগজে, কেরোসিনের ডিবের আলোতে। অমনি ফেলে দিলেন।
চমকে উঠে দাঁড়ালেন কিশোরীবাবু। কে ফেলে দিল? যেন সম্বিৎ ফিরে এল তাঁর। উঠিপড়ি করে দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলেন—‘ও কিশোরী, দাঁড়াও; মা তাহলে এখনো আছেন?’ কিন্তু সে ছেলেটা কখন চলে গেছে, কিশোরীবাবু বাইরের বারান্দা দিয়ে অনেকখানি দৌড়ে গিয়েও তাকে দেখতে পেলেন না। সিঁড়ি নিস্তব্ধ, লিফ্ট বন্ধ। অনভ্যস্ত গোলমাল শুনে কোথা থেকে মুরারি ছুটে এল, কিশোরীবাবুর উদ্ভ্রান্ত’ চেহারা দেখে হাঁকডাক লাগাল। হেম এল, নাদু এল, বিশুবাবু, হীরেন, সবাই এল। কেউ তা হলে বাড়ি যায়নি।
‘একটা খদ্দর পরা রোগা ছেলেকে এই দিক দিয়ে যেতে দেখেছ কেউ? দ্যাখ, দ্যাখ, তাকে আমার বড় দরকার।’ মুহূর্তের মধ্যে চাপরাশি, পাহারাওয়ালা, সার্জেন্ট পুলিস, অত বড় বাড়ির আনাচেকানাচে তল্লাস শুরু করে দিল। অবিশ্যি কিশোরীবাবু জানতেন তাকে পাওয়া যাবে না। ওরা ফিরে এসে বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, ‘আপনি চেনেন তাকে? কোনো ক্ষতি করতে আসেনি তো?’ কিশোরীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘না না, ভালোর জন্যই এসেছিল, আমিই শুনলাম না, তাড়িয়ে দিলাম। ‘চেনা লোক?— ওকী, এখানে বসুন, ও হেম, মাথায় একটু জলের ছিটে দাও। বাড়িতেও একটা খবর দিলে ভালো হয় না?’
কিশোরীবাবু কৌচে এলিয়ে পড়ে চোখ বুজলেন। চেনা নয়তো কী? বাবার ঐ পুরোনো জামা, ওই ঘরে কাচা কাপড়, ঐ কানে তিল, ঐ চোখের কোণে উঁচু ঢিপলি, আয়নায় কত দেখেছেন; এখনও তিলটা রয়েছে, ঢিপলিটার অপারেশনের দাগ রয়েছে। উনি চিনবেন না তো কে চিনবে? এরা কিশোরীবাবুর বাড়িতে টেলিফোন করে এখন কাকেও পাবে না। কিন্তু এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই যে বালিখালের সরু গলির টালির ছাদের একতলা বাড়িতে, ঐ ছেলেটা যেই ঢুকবে, রান্নাঘর থেকে মা ডেকে বলবেন, ‘কিশোরী, এলি? এই ভাতটা ফুটল বলে।’ তারপর ময়লা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছিয়ে, তাঁর নখভাঙা, শিলে ছ্যাঁচা, পোড়-খাওয়া হাতটা ওর গায়ে মাথায় বুলোবেন।