ভাগ্যদেবী ব্রাঞ্চ হোটেল
নগার বাবার আন্নাপিসি ‘কাশীর গলিজীবন’ বলে একটা বই লিখে জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। সে নাকি অতি অভাবনীয় সব তথ্যে ভরা। একশো বছর আগেকার কাশীর সাধারণ একটা সরু গলির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার এক রকম বলা যেতে পারে হুবহু আলোকচিত্র। এমনকী, জাতীয় চলচ্চিত্র সংস্থাও নাকি এর জন্য প্রথম পুরস্কার দিতে চাইছিলেন, নেহাত বিচারকরা চাক্ষুষ ভাবে ছবি না দেখে পুরস্কার দিতে রাজি নন বলে এখনকার মতো হল না। ছবি যদি হয়, তখন আর ভাবতে হবে না।
বলা বাহুল্য এ-সমস্তই নগার ছোড়দাদুর দিল্লির বাড়িতে স্বয়ং আন্নাপিসির মুখে শোনা। পুজোর ছুটিতে সেখানে নগা, পল্টু বেঁড়ে, উটকো, এরা সব ঐ সময়ে গেছিল।
পিসির বয়স নব্বুই তো হবেই, কিছু বেশিও হতে পারে। খুনখুনে রোগা শরীর, ফরসা রং, চকচকে চোখ, মাথাভরা ছোট করে কাটা শাঁখের মতো সাদা কোঁকড়া চুল। খুরখুর করে সিঁড়ি ভাঙেন, থান পরেন, নিরামিষ খান, আর কোনো মানামানি নেই।
পিসি বললেন, “শীতকালে কাশী গিয়ে আমার ভাগ্যদেবী ব্রাঞ্চ হোটেলে উঠিস। চারজনে একটা ঘরে থাকলে খাওয়া-দাওয়ার পয়সা লাগবে না। ঘাটের ওপর দোতলা বাড়ি। একশো বছরের পুরনো। ৭৫ বছর আগে যখন প্রথম কাশী গেলাম, তখন আমার নিজের বলতে কিচ্ছু ছিল না। আমার বড়জেঠি কাশীবাসী হবেন, তাঁর একটা দেখাশুনো রান্নাবান্না করবার আর মুখঝামটা খাবার লোকের দরকার ছিল। আমি একটা পনেরো বছরের ফালতু বিধবা মেয়ে, সবাই মিলে আমাকে ঠেলে ওঁর সঙ্গে পাঠিয়ে দিল। হাপ-ঝি, হাপ-পাপোশ বলতে পারিস। এখন জেঠির সেই পোড়ো বাড়িই আমার ভাগ্যদেবী ব্রাঞ্চ হোটেল! যদি কিছু ভালো জরদা এনে দিস তো সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী বলি।”
নগা তক্ষুনি উঠে গিয়ে ছোড়দিদিমার জরদার কৌটো থেকে অর্ধেকটা ঢেলে এনে দিল। তাই নিয়ে পরে ঝামেলা। দাঁতের পেছনে একটু জরদা গুঁজে আন্নাপিসি বললেন, “কাশীতে মলে সব্বাই সঙ্গে যায়, ভালোরাও যায়, খারাপরাও যায়। কাশীতে সব পাওয়া যায়, টাকা-কড়ি, সুখ-সৌভাগ্য, নাম-খ্যাতি, সব। কিন্তু খুঁজতে জানা চাই। পেয়েও যদি চিনতে না পেরে দূরে ফেলে দিস, তবেই তো হয়ে গেল!
“বছর ত্রিশ আগে ঘাটের মাথায় যে কথকঠাকুর বসতেন, তিনি একদিন এইসব বললেন। আসলে হরিশ্চন্দ্রের গল্প বলছিলেন, তারই মধ্যিখানে বললেন যে, সব্বাই নাকি একদিন না একদিন সৌভাগ্যের মুখ দেখে। কিন্তু নিজেরা যদি সেটা টের না পায়, তা হলে অন্য কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। ভাগ্যদেবী নাকি সকলকেই সমান সুযোগ পাইয়ে দেন।”
ঐ অবধি শুনেই আন্নাপিসি তেরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, “যা নয় তাই বললেই তো আর সত্যি হয়ে যায় না ঠাকুর। আমার উনষাট বছর বয়স হল, আজ পর্যন্ত ভাগ্যদেবী আমাকে পেট ভরে খাবার মতো কাঁচকলাও দেননি, এ আমি একশোবার বলব।”
কথকঠাকুর তো এত কথা শুনে একেবারে থ। সেই ফাঁকে রেগেমেগে আন্নাপিসি বাড়ি চলে এসেছিলেন।
হরিশ্চন্দ্র বেচারা শেষ অবধি রাজ্য ফিরে পেল কি না, তা পর্যন্ত শোনা হল না। ঘণ্টাখানেক বাদে দূর-সম্পর্কের ভাইঝি উমাদিদি ফিরতেই পিসি বললেন, “রাজ্য ফিরে পেল আশা করি? দেবতাদের দিয়ে বিশ্বাস নেই।”
উমাদিদি বলল, “পেল বই কী। তা তুমি হঠাৎ চটেমটে গেলে কেন? মন্দ কথা তো বলেনি কথকঠাকুর। সত্যিই তো ভাগ্যদেবী সব্বাইকে দেন। আমার মতো আধামুখ্যু অনাথাকেই কেমন কর্পোরেশন ইস্কুলে মোটা মাইনার চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। মোটা মাইনাই বলব, দুশো টাকা কিছু ফেলনা নয়। তারপর ‘কোথায় থাকি’ ‘কোথায় থাকি’ কচ্ছি যখন, তোমার বাড়িতে জায়গা করে দিলেন। ভাগ্যদেবী ছাড়া কে দিয়েছে এসব বলো? কত লোকে তো তা-ও পায় না।”
আন্নাপিসি রাগের চোটে উঠে বসেছিলেন। “তাই বা তাদের দেন না কেন শুনি? তোকেই না হয় দিয়েছেন কিছু খুঁদকুড়ো, কই, আমাকে তো কিছু দেননি?”
উমাদিদি পিসির পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “দিয়েছেন বই কী। আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন তোমার কাছে। যাতে তুমি যদ্দিন বাঁচো, তোমার যত্ন করতে পারি। জেঠির এই বাড়িটা আর ভাইপোর কাছ থেকে ত্রিশ টাকা মাসোয়ারা, তাও তো তোমাকে পাইয়ে দিয়েছেন। দেন সবাইকে, আমরাই চিনতে পারি না, হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলি— নাও, এখন ওঠো, হাতমুখ ধোও। বামুনের দোকান থেকে গরম হাতরুটি, নরম চানা আর গুড়ের হালুয়া এনেছি। পরশু আমরা দলের সঙ্গে গঙ্গোত্রী যাচ্ছি, এখন শরীর খারাপ করলে চলবে কী করে?”
এ-কথা শুনে পিসির রাগ পড়ে গেলেও মেজাজটা খিঁচড়ে রইল। সন্ধ্যা-আহ্নিক আগেই সেরেছিলেন, খাওয়া-দাওয়ার পর উমাদিদি খাতা নিয়ে বসল আর পিসি বাড়ির সামনে গঙ্গা-ঘাটের সিঁড়িতে বসে মনে-মনে বলতে লাগলেন, ‘বেশ, এখন থেকে তাই হবে। ভাগ্যদেবী যা দেবেন, তাই আঁকড়ে ধরব। দেন তো ছাই, দিলে কি আর চোখে পড়ত না! এবার থেকে আজেবাজে নোংরা-খ্যাংরা যা দেবেন মাথা পেতে নেব। ঠাকরুনের একটা পরীক্ষা হয়ে যাক—’
ঝপ করে একটা শব্দ হতেই তারার আলোয় চেয়ে দেখেন একটা টিকিওলা ন্যাড়ামাথা ঢ্যাঙা লোক কতকগুলো কী সব ফালতু জিনিস গঙ্গায় ফেলে দিয়ে একরকম ছুটে চলে গেল। কিছু ডুবে গেল, কিছু ভেসে গেল, একটা পেতলের হাঁড়ি ঘাটের শেষ ধাপে এসে লাগল। কে জানে কার এঁটো-ছোঁয়া অশুদ্ধ জিনিস। পিসি উঠেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ভাগ্যদেবীর কথা মনে পড়াতে, ক’ধাপ নেমে হাঁড়িটাকে তুলে আনলেন।
ঐ অবধি বলে আন্নাপিসি একটু থেমে ওদের সকলের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। নগা, বেঁড়ে, বটু ইত্যাদি এত কাছে ঘেঁষে বসেছিল যে, পিসির পিঠে হাঁটুর খোঁচা লাগছিল। পিসি তাকাতেই ওরা আধ ইঞ্চি করে সরে বসে বলল, “হ্যাঁ, তারপর?”
“তারপর আবার কী? উমাকে হাঁড়ির কথা বলিনি। বেশ পরিষ্কার-ঝরিষ্কার টুপটুপ করছে একটা আধসেরি পেতলের হাঁড়ি, পোড়-খাওয়া, টোল-খাওয়া, দেখলেই বোঝা যায় অনেক ব্যবহার দেখেছে। তীর্থে যাবার সময় সেটিকে ছেঁড়া গামছায় জড়িয়ে সঙ্গে নিলাম। বোঁচকাবুঁচকির মধ্যখানে এতটুকু মালুম দিল না।
“এখন শুনি বাসে চেপে বদরীনাথ যায়। ছো ছো, আমরা পায়ে হেঁটে গঙ্গোত্রী গেলাম। সঙ্গে শক্ত শুকনো অখাদ্য সব জিনিস গেল। তাই চিবিয়ে পথ চলি। পাণ্ডা লোকটা ভালো হলেও, ঘটে বুদ্ধি ছিল না। মোট কথা ফেরার পথে ঝড় উঠল, ধস নামল, পথ হারাল। প্রাণও যে হারায়নি সেটা ভাগ্যদেবীর দয়া।
“ধুঁকতে ধুঁকতে একেবারে আঘাটায় একটা পরিত্যক্ত গুহায় গিয়ে উঠলাম, আমরা সাতজন তীর্থযাত্রী। গুহাটা পাহাড়ের গা কেটে তৈরি। ঘরের কোণে কিছু শুকনো কাঠকুটো, কবেকার কোন্ তীর্থযাত্রীরা রেখে গেছে। ব্যস, আর কিছু না। পাথরের দেয়াল দিয়ে গুহাটা দু-ভাগ করা। উমা, আমি আর দুজন আধবুড়ি বিধবা, তিন দিন প্রায় উপোস করা শরীরগুলোকে কোনোমতে টেনে নিয়ে ভিতরের গুহায় ঢুকে পুঁটলি মাথায় দিয়ে হাত-পা এলিয়ে শুয়ে পড়লাম। আর কিচ্ছু মনে নেই।
“ওরা পাশের গুহায় আগুন জ্বেলে থাকবে। তার মিষ্টি গরমে ঘুম ভেঙে দেখি খিদের চোটে পেটের এদিক-ওদিক একসঙ্গে সেঁটে গেছে। পুঁটলি খুলে হাতড়াতে লাগলাম, যদি এক-আধটা নারকোল-নাড়ু পাই। হাঁড়িটাতে হাত পড়ল। এই বুঝি ভাগ্যদেবীর দান, ছ্যা ছ্যা। তাও যদি ক্ষীড়ের নাড়ু আর মুড়কি ভরা থাকত। বলতে বলতে কী বলব ভাই তোদের, খুদে হাঁড়ি ভারী হয়ে উঠল। অন্ধকারে গামছাটার ওপর উপুড় করে ধরলাম, ঝরঝর করে নাড়ু, মুড়কি পড়তে লাগল। হাঁড়ি সোজা করতেই থামল। গামছার ওপর নাড়ু, মুড়কির ঢিপির দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় উমাকে ডাকলাম, ‘ওরে, তোদের খিদে পায়নি?’ হাঁড়িটাকে তাড়াতাড়ি ঝুলিতে পুরলাম।
“খাবার দেখে সবাই হাঁ! ‘ও ঠাকুমা! এত খাবার সঙ্গে ছিল, তবু কিছু বলেননি! কেমনধারা মানুষ আপনি!” উমা ছাড়া কাউকে হাঁড়ির কথা বলিনি। আড়ালে রেখে, তীর্থের যোগ্য নানারকম শুকনো খাবার বের করে সবাইকে খাইয়েছিলাম।
“তিন দিন পর আবার পথ খুঁজে পেয়ে, নিরাপদে কাশী ফিরে এলাম। আর আমাকে ফিরে দেখতে হয়নি। ঘাটের ওপর ওই পুরনো বাড়িতে প্রথমে মোয়া, মুড়কি, তালের সন্দেশ, সুজির নাড়ু, তিলের নাড়ু, এইসবের দোকান দিলাম। তারপর বাড়িঘর মেরামত করে পরোটা, আলুর দম, কালাকান্দ, মালাই। তারপর দো-তলা হল। হোটেল হল। ভাগ্যদেবী ব্রাঞ্চ হোটেল, যাস তোরা শীতকালে। তোদের উমাদিদি ম্যানেজারি করে। চারজনে একঘরে থাকবি, আমার খরচায় খাবি। কী বলিস নগা? তোর বাপ তো আমার কাছ থেকে খরচা নিচ্ছে না। তা চমৎকার হিসেব রাখে উমা, এক পয়সা ইদিক-উদিক হয় না। তা না হলে চলত কী করে, আমি তো আর লিখতে-পড়তে জানি না— এই রে!” এই বলে জিব কেটে আন্নাপিসি চুপ করলেন।
ওরা সবাই রহস্যের গন্ধ পেয়ে বুড়িকে ছেঁকে ধরল, “তা হবে না, দিদিমণি, বলতেই হবে, লিখতে পড়তে জানো না তো কাশীর গলি-জীবন লিখে লাখ টাকার সর্বভারতীয় পুরস্কার পেলে কী করে?”
আন্নাপিসি একটু ঝাঁঝালো সুরে বললেন, “কী করে আবার পাব? ভাগ্যদেবী পাইয়ে দিলেন। যেমন করে হাঁড়ি পাইয়ে দিয়েছিলেন। তোদেরও নিশ্চয় কত কী দেন, চিনতে পারিস না বলে ফেলে দিস।”
নগা রেগে গেল, “অন্য কথা পাড়লে হবে না দিদিমণি, বলে রাখলাম। বাবাকে বলেটলে একাকার করব।”
পিসি বললেন, “ওরে, না রে! বলেছি কি বলব না? তা হাঁড়িটা খোয়া গেলেও হোটেল ভালোই চলতে লাগল। কিছু ঠাকুর-বামনী রাখতে হল, এই যা। কী হল?”
“হাঁড়ি খোয়া গেল মানে? খোয়া গেল আবার কী? চুরি গেল? নাকি ভেঙে গেল? আরেকটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল।”
“না, না, ওরকম কিছু নয়। হল কী, দিনে-দিনে ছোকরা খদ্দেরদের খাঁই বাড়তে লাগল, চাঁপ চাই, কাটলিস চাই, মুরগি রোস চাই, পুটিন চাই, হেনাতেনা সাত-সতেরো। শেষটা উমা বলল, ‘চেয়েই দ্যাখো না পিসি, কী হয়।’ হল আমার মাথা আর মুণ্ডু। হাঁড়িটা হাত থেকে ছিটকে সটাং গঙ্গার গর্ভে গেল। ডুবুরি লাগিয়ে তোলা গেল না! উমা কেঁদে কেঁদে চোখ জবা ফুল বানাল।
“মনটন খুব খারাপ, ভাগ্যদেবীর দেওয়া অমন জিনিস পেয়েও হারালাম। বারবার তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলাম। বলতে লাগলাম, মা, আর দয়াটয়া করে কাজ নেই। উমা সব ভণ্ডুল করে দেবে। বুদ্ধি করে যদি আমাকে লিখতে-পড়তে শেখাতে, ‘তা হলে আর আমার কিছু বলবার ছিল না। এইরকম আজেবাজে কথা বলতে লাগলাম, দুঃখী লোকে যেমন বলে থাকে।
“হঠাৎ ঝুপ করে একটা শব্দ হল। চমকে চেয়ে দেখি একটা টিকিওলা ন্যাড়ামাথা ঢ্যাঙা লোক, ঝুড়ি থেকে কতকগুলো হাবিজাবি গঙ্গায় ফেলে দিয়ে, খড়ম পায়ে খটখট শব্দ তুলে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠে এমনি দৌড় দিল যে, সঙ্গে-সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল।
“সিঁড়ির শেষ ধাপের দিকে তাকিয়ে দেখি ভাঙা ঝাঁটা ঝুড়ি ইত্যাদি। ভেসে চলেছে আর কাগজের পুঁথি-পত্তরের মতো কী একটা ঘাটে এসে লেগেছে। আর এক মিনিটও অপেক্ষা করলাম না, ছোঁ মেরে সেটি তুলে বুকে করে ঘরে নিয়ে এলাম। জলে ভিজে চুপ্পুড় এক গোছা কাগজ, তার জল চুঁয়ে আমার কাপড়-চোপড়ও ভিজে গেল। তা যাক গে ভিজে, মা গঙ্গার জল তো কিছু খারাপ জিনিস নয়।
“ঘরে এসে উমাকে বললাম, ‘দ্যাখ তো এবার ভাগ্যদেবী কী দিলেন!’ উমা পুঁথিটা গামছা দিয়ে মুছে, কপালে ঠেকিয়ে বলল, ‘আরে, এ যে একটা পুরনো ডাইরি, না হিসাব খাতা, না কী যেন।’
“তারপর পুঁথিটা উমা আর ছাড়তে চায় না। বললাম ‘তা পড়গে, পরে আমাকে বলিস।’ সন্ধ্যাবেলায় উমা বলল, ‘ও মাসি, প্রথম পাতাটা জলে ধুয়ে গেছে, নাম ঠিকানা তারিখ কিচ্ছু পড়া যাচ্ছে না, কিন্তু তারপর যে পাড়াসুদ্ধ সক্কলের হাঁড়ির খবর লিখে রেখেছে বুড়ো। খুব পুরনো হবে, ভাষাটা যেন কেমনধারা। কার বাড়িতে কে কী করছে না করছে, কত আয় কত ব্যয়, কী রান্না হয়, কত খরচ পড়ে, কে কী বলেছে না বলেছে, এইসব দিয়ে ঠাসা। এমন মজার জিনিস জন্মে দেখিনি।’ আমি বললাম, ‘কী করে দেখবে! স্বয়ং ভাগ্যদেবীর বাড়ির গলির গল্প। হয়তো ওঁর কেরানিবাবু নকল করে দিয়ে থাকবে। এটাকে কপি করে দে দিকিনি। খবরদার কারো কাছে গল্প করবি না।’ তা উমার সঙ্গে সক্কলের ঝগড়া, এই একটা সুবিধা।
“কপি হয়ে গেলে মৌলিক-মাস্টারকে দিয়ে পড়ালাম। উনি আমাদের বাঙালি বিদ্যালয়ের তখনকার হেডমাস্টার। বললাম, ‘ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদে লেখা হয়েছে, পড়ে দেখুন।’ পড়ে মৌলিক মুচ্ছো যায় আর কী! সঙ্গে সঙ্গে ‘কাশী-কথা’য় ধারাবাহিক ছাপার ব্যবস্থা করল। প্রকাশকদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। তারপর একদিন পুরস্কারটাও ঘোষণা হল। ভাগ্যদেবী যখন দেন, মচ্ছি ভেঙেই দেন। তোদেরও দেন নিশ্চয়, তোরা ছেঁড়া কাগজ মনে করে তাই দিয়ে ঘুড়িতে তাপ্পি লাগাস!”
নগারা বলতে লাগল, “কিন্তু তুমি তো লেখনি, তুমি কেন লাখ টাকার পুরস্কার পাবে? জগু রাত জেগে কত বই লেখে, কেউ ছাপেও না! তুমি লেখাপড়া পর্যন্ত জানো না।”
আন্নাপিসি বলল, “আহা, একেবারেই কি আর জানি না? চার ক্লাস অবধি পড়েছি তো! ঐ তো কেমন কাশীর গলি-জীবন, লেখিকা আন্নাকালী দেবী পেরাইজ পেয়ে গেল। তাছাড়া লেখাপড়া জানার কিচ্ছু দরকার নেই। লিখতে না পারলেও কিচ্ছু এসে যায় না। ভাগ্যদেবীর সুনজরে পড়লেই হল।”
নগা বলল, “দেখাও না একবার পুঁথিটা!”
আন্নাপিসি যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “ওমা! বলিনি বুঝি? নকল দেখে যেমন বইটা ছাপা হতে লাগল, আমার সিন্দুকে রাখা আসল বইয়ের লেখাগুলোও উপে যেতে লাগল! শেষটা কাগজগুলোও আর খুঁজেই পেলাম না!”