বাপের ভিটে
আমার গয়নাদিদি, আসলে অন্য নাম, চটে যাবেন বলে ঐ নাম দিয়েছি। ভালো নাম না?— একবার বুড়ো বয়সে ছেলে বৌয়ের ওপর রেগেমেগে, কলকাতা থেকে গঙ্গাসাগর যেতে, আধাপথ দূরে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, তাঁর বাপ-পিতেমোর আদি বাড়িতে চলে গেছিলেন। সে এক অদ্ভুত জায়গা। জগন্নাথঘাট থেকে নৌকোয় উঠে, সাত ঘণ্টা বাদে মকরঘাটায় নামতে হয়। যেমন নাম, তেমনি জায়গা। সেকালে নাকি বড় বড় শুঁড়তোলা মকর ড্যাঙায় উঠে শীতকালে রোদ পোয়াত। তাদের মুখের লালা শুকিয়ে নদীর পাড়ে ঝিনুকের মতো রঙের মুক্তোর মতো গোল সব মণি তৈরি হত। সেই মকর-মণি যারা কুড়োত, তাদের আর ফিরে চাইতে হত না। বলেছি না অদ্ভুত জায়গা!
মকরঘাটায় একটা ছোট টিনের ট্রাঙ্ক, একটা ছোট শতরঞ্চির বিছানা আর একটা আরো ছোট বেতের ঝুড়িসুদ্ধ গয়নাদিদিকে নামিয়ে দিয়ে দুকুল মাঝি বলল, “তা বুড়ো মায়ের থাকা হবেটা কোথায়? নিতে তো কেউ এসেনি।” গয়নাদিদি রেগে বললেন, “এসবে আবার কেটা রে? বাপ-পিতেমোর বাড়ি আসছি, তার জন্য কি মিছিল করতে হবে? জিনিস বইবার লোক দে। নন্দীবাড়ি পৌঁছে দেবে, কাছেই কোথাও হবে। ঘাট থেকে হাঁক দিয়ে বুড়ো-ঠাকুরদা বরকন্দাজ আনাতেন।”
শুনে মাঝি কাঠ! “সে-বাড়ি তো ভালো না মা। ওখানে জনমানুষ থাকে না।” গয়নাদিদি চটে গেলেন, “কথার ছিরি দেখো! আমার বাপ-পিতেমোর ভিটে। তাঁরা এক দিনের জন্যেও নিজেদের ভিটে ছেড়ে আর কোথাও রাত কাটাননি৷ আজ বলে কিনা কেউ থাকে না।” মাঝি বলল, “ঠিক তাই। সেই জন্যেই মানা করতিছি।” তারপর গয়নাদিদিকে নিজেই বাক্স তোলার জোগাড় করতে দেখে, গলুইয়ের ওপর যে লোকটা এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল, তাকে ঠেলে তুলে দিয়ে বলল, “এই মাধো! মাঠানের জিনিস নন্দীবাড়ি পৌঁছে দে আয়! এক টাকা পাবি।” গয়নাদিদি ভেবেছিলেন পঞ্চাশ পয়সা দেবেন, তা গতিক দেখে চুপ করে রইলেন।
মাধো জিনিস নিয়ে বাঁশবাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটা দিল। গয়নাদিদি পাঁচ-সাত মিনিটে বাপ-পিতেমোর ভিটেয় পৌঁছে গেলেন। মাধো পাঁচিলে বসানো তালাবন্ধ দরজার সামনে মোট নামিয়ে বলল, “টাকাটে দেখি। আমি ভেতরে পা দিচ্ছিনে। জিনিস কে ঘরে তুলবে?”
গয়নাদিদি বললেন, “দেখি ডাকাডাকি করে, কেউ যদি থাকে।”
মাধো জিব কেটে বললে, “ও কাজ করবেন না। ডাকলে ঠিক এসে হাজির হবে। নিন দরজা খুলুন, আমিই তুলে দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কাজের লোক এ মুলুকে পাবেন নি মা। বাঁশবাগানের পাশে বামুনের দোকানে কেরাসিন, কয়লা, রান্না খাবার পর্যন্ত পাবেন। এ বাড়িতে জন-মানুষ থাকবেনি।”
গয়নাদিদি চারদিকে চেয়ে বললেন, “না, থাকবে না! চালাকি পেয়েছ? থাকবে না তো তুলসীতলা ঝাঁটপাট দিয়েছে কে শুনি?”
মাধো শিউরে উঠে বলল, “সেই কথাই তো বলছিলাম। টাকাটে দেন।” গয়নাদিদি টাকা দিয়ে বললেন, “বাঁশবাগানের ও-ধারে গয়লাবাড়ি দেখলাম। সেরটাক দুধ পাঠিয়ে দিস, নগদ দাম দেব।” মাধো বলল, “তা হলে দরজা খোলা রাখবেন।” ঘরের তক্তাপোষ, জলচৌকি, পিঁড়ি সব কাঁঠাল কাঠের তৈরি। পরিষ্কার-টরিষ্কার। বাক্সপ্যাঁটরা খুলতে খুলতে গয়লা দুধ নিয়ে এসে বাইরে থেকে ডেকে বলল, “দুধ লেন, আমি ভেতরে যাবনি। সূয্যি হেলেছেন।” যত সব কুসংস্কার! গয়নাদিদি দুধের হাঁড়ি নিয়ে বেরোতেই গয়লা বলল, “মোক্ষদা পিসির বাড়িতে ঘর পেতেন। সেইটেই ভালো হত।”
দিদি রেগে গেলেন, “বাপ-পিতেমোর বাড়ির চেয়ে সেইটেই কি ভালো হত? তাঁরা তেতে-পুড়ে এইখানে প্রাণ জুড়াতেন। সিপাই হাঙ্গামার সময় বুড়ো-ঠাকুমা ছেলেপুলে নিয়ে এইখানে উঠে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। কেন, হয়টা কী? চোর-ডাকাত আসে?”
“এজ্ঞে রেতে ছাদে ধুপধাপ পড়ে!”
“পড়ুক। আর কী?”
“গোয়ালে কারা রাত কাটায়। তুলসীতলায় আলো দেয়।”
“ভালো করে। আমার বাড়িতে আজ আমি আলো দেব।”
গয়লা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “তবে আর কিছু বলব নি।”
ভেতরের উঠোন কিন্তু আবর্জনায় ভরা। গয়নাদিদি গোয়াল ঘরের দিকে মুখ করে হাঁক দিলেন, “কে আছিস ওখানে, উঠোন ঝেঁটিয়ে-পেটিয়ে রাখতে পারিস না।” ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে। কে একটা গোয়াল থেকে বেরিয়ে এসে ঝাঁট দিতে শুরু করে দিল।
উঠোনের কোণে ছোট কুয়ো। গয়নাদিদি ঝুড়ি থেকে খুদে বালতি আর দড়ি বের করে, তারার আলোয় সাবান মেখে চান করে ঘরে এসে, আহ্নিক করলেন। গোয়ালঘর চুপচাপ। আর কি তারা আসে, যদি কাজ করতে হয়। লুচি, সন্দেশ, মর্তমান কলা খেয়ে ঘুম। রাতে একবার ছাদে ধুপধাপ শব্দ হল বটে। তা হোক।
ভোরে উঠে গয়নাদিদি দিনের আলোয় দেখলেন গোয়ালঘরের দোরে তালা দেওয়া। কুয়োর পাশের চৌবাচ্চাতে কানায় কানায় জল। ছাদে গিয়ে দেখলেন তাল পড়েছে, নারকেল পড়েছে, তা ধুপধাপ হবে না? নীচে এসে দেখলেন ভেতরের দালানে এক কাঁদি কলা। চোরই হোক, ছ্যাঁচড়-ই হোক, যারা গোয়ালে রাত কাটায় তারা লোক ভালো। দয়ামায়া আছে শরীরে।
গয়লা যেমন বলেছিল সদর দরজা খুলেই রাখলেন। সে দুধের সঙ্গে চাল, ডাল, আনাজপত্র দিয়ে পয়সা নিয়ে গেল। এক পয়সা বাকি রাখল না। বলল, “কিছু বলা যায় না মা, ভালো কথা তো শুনলেন না। রেতে কেউ আসেনি?”
গয়নাদিদি বললেন, “না।”
সন্ধেবেলায় দালানের পাশে ইট পেতে উনুন করে, তালের বড়া, তালের ক্ষীর তৈরি করে আহ্নিক সেরে উঠেই থামের পেছন থেকে একটা কালো রোগা ছেলেকে হিড়হিড় করে টেনে বের করলেন। হতভাগার গায়ে একটা ত্যানা নেই। “কী নাম তোর?” কিলবিল করতে করতে সে বলল, “এজ্ঞে, পেঁচো।”
“এত ধেড়ে ছেলে উদোম ঘুরছিস, লজ্জা করে না?”
“এজ্ঞে, না।” গয়নাদিদি তাকে গায়ের চাদর খুলে দিয়ে বললেন, “কলাপাতায় তালের বড়া, তালের ক্ষীর দিচ্ছি, নিয়ে যা। ঘরে আর কে আছে?”
“এজ্ঞে, মা আছে।” বেশি করেই দিলেন, ছেলেটা এক দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
সাত দিন ছিলেন গয়নাদিদি, কোনো কষ্ট হয়নি। দিনের বেলায় শুনশান, রাতে তারা কাজ সেরে দিত। চোরের পরিবার সন্দেহ নেই। তবে দেখা পাননি আর। সাতদিন পরে ছেলে-বৌ এসে পায়ে ধরে মাপ চেয়ে, কেঁদেকেটে তাঁকে ধরে নিয়ে গেল। শেষ বারের মতো ভেতরের দালানে দাঁড়াতেই তাদের দেখতে পেলেন, দিনের আলোতেই। চাদর-জড়ানো পেঁচো আর তার রোগা কালো নাক-কাটা মা। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল তারা, তারপরেই আর দেখতে পেলেন না। ছেলে বাঁধা-ছাঁদা সেরে বলল, “বেশ তো ছিলে মনে হচ্ছে, মা। অথচ এদিককার লোকদের এমনি কুসংস্কার, নৌকোর দুকুল মাঝি বললে কিনা বুড়ো কর্তাদাদার সময়ে গয়লাপাড়া থেকে কে তার দুষ্টু বৌয়ের নাক কেটে, ছেলেসুদ্ধ তাড়িয়ে দিয়েছিল। ছেলেটাও নাকি মহা পাজি ছিল। তা বুড়ো কর্তাদাদু তাদের সারাজীবন তাঁর গোয়ালঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এমনি তাঁর বুকের পাটা যে কেউ তাদের চুলের ডগাটি ছুঁতে পারেনি। তারাই নাকি এখনও বাড়ি আগলায়, কাউকে আধ ঘণ্টার বেশি টিকতে দেয় না। তুমি কিছু দেখেছিলে? গবর্নমেন্ট নাকি নিতে চেয়েছিল, তা সব ভয়ে পালিয়ে এসেছিল।”
গয়নাদিদি বললেন, “নিজের বাড়িতে দেখবার কী আছে? এই আমি বলে দিলাম তোকে মদন, এখন থেকে আম-কাঁঠালের সময় প্রত্যেক বছর ছয় মাস আমি এখানে কাটাব। কী জায়গা বল দিকিনি! নদীর ধারে এই বড় বড় মুক্তো গজায়, বলেনি দুকুল মাঝি? ভূত আসে না আরও কিছু। ভূত এলে আমি দেখতে পেতাম না।”
মদনের বউ বলল, “একলা কী করে থাকবেন, মা? শুনেছি কাজ করবার লোক পাওয়া যায় না।”
দুকুল মাঝি দড়ি খুলে দিয়ে বলল, “অন্য জায়গায় থাকলে পাওয়া যেত। নন্দীবাড়িতে কেউ পা দেবে না।”
গয়নাদিদি ফেঁস করে উঠলেন, “যত রাজ্যের বাজে কথা। লোক ওখানে যথেষ্ট আছে। কী ঝটিতি-পটিতি কাজ তাদের! কী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন! এক কণা ধুলো তো পড়ে থাকেই না, রেতে টেমির আলোতে স্পষ্ট দেখেচি দু’দুটো লোক কাজ করে যায়, তা মাটিতে এতটুকু ছায়া পড়ে না! হাঁ করে আছিস যে বড়, কী হল তোদের?”