অহিদিদির বন্ধুরা
অহিদিদির স্বামী যখন পেনশন নেবার পর গোড়িয়া ছাড়িয়ে কোন এক অজ পাড়াগাঁয়ে নতুন-খোলা এক হাতের কাজ শেখাবার স্কুলের প্রায় মিনি-মাগনার অধ্যক্ষ হয়ে, সপরিবারে চলে গেলেন, কেউ বলল “পাগল”, কেউ বলল “স্টুপিড” আর বেশির ভাগ বলল, “ঠিক ওঁরই উপযুক্ত কাজ হয়েছে!” পরিবার বলতে অহিদিদি আর তাঁর বুড়ি শাশুড়ি।
অবিশ্যি অজ পাড়াগাঁ ঠিক নয়, এককালে ভারী বর্ধিষ্ণু শহর ছিল, বোধ হয়। একটা মজা নদী গিয়ে গঙ্গায় পড়ত; নাকি মস্ত বন্দর ছিল; ব্যাবসা-বাণিজ্যের ঘাঁটি, বড় বড় বজরা এসে নোঙর ফেলত। মস্ত মস্ত ভাঙা ঘাট এখনো দেখা যায়। কিছুদিন আগে গ্রাম-সংস্কারক দুর্দান্ত ছেলেরা কাদা তুলতে গিয়ে মর্চে ধরা নোঙর আর অনেক মরা মানুষের কঙ্কাল তুলে, কাজ ফেলে পালিয়েছিল। অহিদিদির দেওর ধরণীবাবু বলেছিলেন কাদার নীচে নিশ্চয় মেলা ডুবো জাহাজ আছে। সরকার যদি বুদ্ধি করে এখানে হাতের কাজ শেখার ইস্কুল না করে, নদীর কাদা তোলার ব্যবসা খুলত, তাহলে তিন ডবল লোক চাকরি পেত আর সোনা-দানায় সব ব্যাটার ট্যাঁক ভরতি হত। অহিদিদির স্বামী সুরেনবাবু কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলেও, অহিদিদি একবার গিয়ে জায়গাটা ভালো করে দেখে হতাশ হলেন। মজা নদীতে বর্ষা কালেও হাঁটু জল হয় না, এখন পুজোর সময় পায়ের কবজি ডোবে না। তলাটা ইঁটের মতো শক্ত।
বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল। বুড়ি শাশুড়ি বেজায় খিটখিটে; তার ওপর দুধের ফরমায়েস নিতে এসে গয়লা ফিরে গেছিল; মাছের জন্য হাটে লোক পাঠানো হয়নি; তোলা উনুন নিবে-টিবে একাকার।
গুছিয়ে বসতেই দিন চারেক গেল। এ অঞ্চলটাতে বহু পুরনো পোড়ো-বাড়ির ধ্বংসাবশেষ; কয়েকটার দুটো-একটা মহল মেরামত করে মালিকরা বাসযোগ্য করে রেখেছে। কয়েকটা পড়ে গিয়ে ইটের স্তূপ হয়ে আছে; যত রাজ্যের সাপ-খোপের বাস। আর কতকগুলো যে-কোনও সময় ধ্বসে পড়বে সেদিক দিয়ে বাসিন্দাদের অদ্ভুত রকম নিশ্চিন্ত বলতে হবে। চারদিকে মস্ত মস্ত আম কাঁঠালের বাগান, যত্নের অভাবে নাকি ফল হয় না। মস্ত মস্ত পুকুর, তার পাঁক তোলা হয় না; মাছের চাইতে ব্যাঙ বেশি। একটা বেজায় পুরনো পাথরের তৈরি বিষ্ণু মন্দির, তাতে কষ্টি-পাথরের বিষ্ণুর পাশে লক্ষ্মী। পূজারী নেই; গয়লাপাড়ার বাসিন্দারা দু বেলা ফুল, গঙ্গাজল, বাতাসা দিয়ে আসে। এ দিকটাই নাকি সেকালে বড়লোক শেঠদের পাড়া ছিল। গুপ্তধন থাকা কিছুই বিচিত্র নয়। গয়লারা শেঠদের দুধ জোগাত, ফাই-ফরমায়েস খাটত।
মোট কথা, দিনের বেলা অত কিছু মনে না হলেও, সন্ধেবেলায় জায়গাটা বেজায় নির্জন হয়ে যেত; তার ওপর চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। কালীঘাটের সরু রাস্তাটাতে প্রত্যেকটা বাড়ির প্রত্যেকটা কথা শোনা যেত। এত গায়ে গায়ে বাড়ি যে চোর ঢুকবার জায়গা ছিল না। দিনের লোকদের হট্টগোল থামলেই, রাতের লোকদের হট্টগোল শুরু হত। মাত্র দু ঘণ্টার জন্য রাত দুটো থেকে চারটে একটু নিঝুম হত। এখানে সন্ধ্যা না নামতেই মাঝরাত।
সুরেনবাবু কিছু দেখে শুনে বাড়ি নেননি। যা দিয়েছে অমনি এসে উঠেছেন। কাছে পিঠে অন্য কেউ নেই। যত রাজ্যের পোড়ো বাড়ি আর মান্ধাতার আমলের আমবাগান। এ-বাড়িটারও নয়-ভাগ ভেঙে এই একটা ভাগ টিকে আছে। তবে এটাকে ভালো করে মেরামত করা হয়েছে। সেকালে হয়তো এটা কোনো বড় লোকের অন্দর মহলের খানিকটা ছিল। দক্ষিণ দিকে পাশাপাশি তিনখানা শ্বেত-পাথর দিয়ে বাঁধানো ঘর, পাশে কল-ঘর, আর পুব দিকে এই রান্নাঘর, এর মধ্যেই ভাঁড়ার ঘর। আলাদা ভাঁড়ারের কী দরকার? সব খুলে ফেলে রেখে দিলেও কেউ নেবে না। কালীঘাটে জানলার শিকের ওপর জাল দিতে হয়েছিল, নইলে আঁকশি ঢুকিয়ে পুরনো গামছা পর্যন্ত নিয়ে যেত। আর এখানে ভুলে সারারাত পেতলের ঘড়া বাইরে ফেলে রাখলেন, সকালে উঠে দেখলেন ঘড়া তো খোয়া যায়নি, বরং কিছু লাভ হয়েছে। পুরনো গন্ধরাজ লেবু গাছের মগডালের রস-টুসটুসে লেবুগুলো কেমন করে খসে পড়ে আছে ঘড়ার ভিতরে।
রান্নাঘরের সামনে চওড়া রক; তারপর শান বাঁধানো উঠোন; উঠোনের ধারে কুয়ো, লেবু-গাছ, সজনে-গাছ, বেল গাছ আর রান্নাঘরের মুখোমুখি ভাঙাচোরা গোয়াল-ঘর। সেখানে শেষ গোরু হয়তো থেকে গেছে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে। গয়লানী সকালে আড়াই সের আর এ-বেলা আধ সের ঘন লালচে সুগন্ধী দুধ দিয়ে গেছে। খিটখিটে শাশুড়ি আজকাল রান্নাঘরে আসেন না; এক দিক দিয়ে সেটা কিছু মন্দ না। তিনি দু বেলা দু বাটি এক-বলকা দুধ খান। সেটা আলাদা করে তুলে রাখা হয়। দু বেলার চায়ের দুধ-ও আলাদা করা হয়। বাকিটা পড়ন্ত আঁচে বসিয়ে রাখা হয়; আধ ইঞ্চি পুরু সর পড়ে; সোনালী রঙ, তাতে চাঁদের গায়ের মতো ফুট-ফুট দাগ। রাতে সেই সর তুলে মধ্যিখানে কাশীর বাটা চিনি ছড়িয়ে, ভাঁজ করে রাখেন অহিদিদি। শাশুড়ি এক চিলতে খান; সুরেনবাবু অর্ধেকটা মতো খান; কেউ এলে একটু খায়; কিছু বাকি থাকলে অহিদিদি চাখেন। রান্নাঘরের দরজায় শিক্লি তোলা থাকে, জানলায় বেড়ালের ভয়ে স্কুলের কর্তৃপক্ষই নতুন জাল লাগিয়ে দিয়েছেন। সরটি রোজ সুগন্ধী গোল টৈ-টম্বুর হয়ে থাকে।
দুপুরের একটু মাছ তোলা থাকে। রাতে জনতা স্টোভে একটু ছক্কা করেন অহিদিদি, দুজনার জন্য খান-কতক হাত রুটি করেন, কি অল্প তেলে পরটা ভাজেন। ঘণ্টাখানেকও লাগে না। বিকেলে স্কুলের কারখানার ফোরম্যানবাবুর স্ত্রী এসে বললেন, “ওমা! ভয় করে না দিদি? গোয়াল-ঘরের পেছনের দেয়ালে তো এতখানি ফাঁক! একটা দুটো ছোট ছেলে কি রোগা-পানা মানুষ দিব্যি গলে আসতে পারে। আর আপনি কিনা দধের সর আর রাজ্যের বাসনপত্র ছড়িয়ে রেখে, দরজায় শুধু শিক্লি তুলে ও ঘরে গিয়ে রেডিও শোনেন? বলিহারি আপনাকে।”
কর্তা-গিন্নি তাই নিয়ে হাসাহাসি করেছিলেন। কিন্তু রাতে হ্যারিকেন জ্বেলে রান্না ঘরে গিয়ে অহিদিদি দেখলেন সরের এক পাশ থেকে খানিকটা কে ছিঁড়ে নিয়েছে; মেঝেতে টপ টপ করে দুধ ফেলেছে; নতুন রঙ করা দেয়ালে ছোট ছোট আঙুল মুছেছে। অহিদিদি কাউকে কিছু না বলে, ঐ দিক থেকে একটুখানি সর কেটে ফেলে দিয়ে বাকিটাতে চিনি ছড়ালেন। পাথরের বাটিতে তিন জনের জন্য চিনি-পাতা দৈ বসিয়ে, বাটিটা ডেকচিতে রেখে, ঢাকা দিয়ে, শিল-চাপা দিলেন। চায়ের দুধ খাবার ঘরের ডুলিতে রাখলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
সকালে গিয়ে গোয়াল ঘরটা দেখলেন। বাড়ি সারানোর জিনিস ছাড়া কিছু ছিল না। তবে পাশের পাঁচিলে সত্যিই খানিকটা ফাঁক। সুরেনবাবু সেইদিনই সেটা সারাবার ব্যবস্থা করলেন। সকালে জেলে-বোউ পঁচাত্তর পয়সায় এক রাশি ছোট ছোট তেল টসটসে খয়রা মাছ দিয়ে গেল। অহিদিদি সবটা তেলে ভেজে, অর্ধেকটা দিয়ে দুপুরে চচ্চড়ি করলেন, বাকিটা রান্নাঘরের ছাদ থেকে ঝোলা শিকের ওপরে তুলে রাখলেন। সন্ধ্যাবেলায় দেখলেন, ঝাঁপি কাত, নীচে মেঝের ওপর দুটি মাছ পড়ে আছে, শিকেয় তোলা মাছ বেশ কম। অহিদিদি একেবারে তাজ্জব বনে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে গোয়াল ঘরের দিকে চোখ গেল। গোয়াল ঘরের উঠোনের দিকে দেয়াল ছিল না, খালি অহিদিদির কোমর অবধি উঁচু শক্ত একটা বাঁশের বেড়া। হঠাৎ মনে হল অন্ধকারের মধ্যে সারি সারি গোটা দশেক ছোট ছোট মাথা যেন বাঁশের বেড়ার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে আর অনেকগুলো রোগা রোগা কালো কালো হাত এ-ওকে ঠেলে সরিয়ে নিজের জন্য জায়গা করে নেবার চেষ্টা করছে।
অহিদিদির বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। আছে তা হলে ছেলেপুলে এই নির্বান্ধব পুরীতেও। কালীঘাটের বাড়িতে ছেলেপুলে ছিল না। বাড়িটা ছিল শ্মশান। অহিদিদির ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে এখানে ওখানে ছড়িয়ে পড়েছিল। শাশুড়ি কোনো ছোট ছেলের গলার আওয়াজ পেলে ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে যেতেন। কেউ আসত না ওঁদের বাড়িতে, কেউ গল্প শুনতে চাইত না, খাবার চুরি করে খেত না। বাড়ি, না কি শ্মশান! অহিদিদি গলা তুলে ডাক দিলেন।
“কে রে আমার সর খায়, মাছ খায়?” অন্ধকারের মধ্যে ঠেলাঠেলি চুপ।
অহিদিদি বললেন, “আয়! গোলাপী বাতাসা দেব, ভাজা-মশলা দেব, পরীদের দ্বীপের গল্প বলব।”
বলার সঙ্গে সঙ্গে সুড় সুড় করে তারা বাঁশের বেড়া টপকে এগিয়ে এল। আট দশটা রোগা রোগা ছেলেমেয়ে, গায়ে জামা নেই, রুক্ষ চুল, সাদা সাদা দাঁত বের করে ফিক-ফিক করে হাসছে।
অহিদিদি গোলাপী বাতাসার কৌটো খুলে বললেন, “কাছে আয়, হাত পাত!” অমনি দশটা নোংরা নোংরা হাত পাতা হল৷ অহিদিদি একটা করে বড় বাতাসা, একটু করে ভাজা-মশলা দিয়ে সামনেরটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোর নাম কী রে?”
ছেলেটা একটু খোনা। বলল “বঁগেশ।”
“এরা বুঝি তোর দল? দ্যাখ, ও-সব খাবার দাবারে হাত দিস নে। কেউ ছুঁলে বুড়ি ঠাকুমার খাবার নষ্ট হয়। আমি রোজ তোদের খাবার দেব।”
বগেশ বলল, “কী দেবে?”
“কেন, মুড়ি ল্যাবেনচুশ দেব, পান দেব, কুচো নিমকি দেব, নোনতা বিস্কুট দেব, আলু-নারকেল ঘুগনি দেব, কুচো-চিড়ি ভাজা দেব। কিন্তু নিজেরা কিচ্ছুটি নিবি না, কেমন?”
বগেশ মাথা দুলিয়ে সায় দিল।
অহিদিদি তাড়াতাড়ি জনতা-স্টোভ রকে এনে, আটার নেচি কাটতে কাটতে বললেন, “এখন তোদের খাওয়া হলে ঐখেনে বসে পড়, আমি তোদের পরীদের দ্বীপের গল্প বলি।”
ওরা যে যেখানে ছিল শান-বাঁধানো উঠোনের ওপর এসে বসে পড়ল। অহিদিদি বললেন, “অনেক অনেক দিন আগে রমেশ বলে একটা দুষ্টু ছেলে ছিল, তার মা ছিল না, সৎমা ছিল।”
বগেশ বলল, “রঁমেশ না, বঁগেশ।”
অহিদিদি বললেন, “বেশ, তাই হবে, রমেশ না বগেশ। সৎমা বগেশকে খেতে দিত না, পরতে দিত না, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাটাত। শোবার জন্য খাট দিত না, রাতে বগেশ ছাগলদের সঙ্গে শুত।…”
অহিদিদি গল্প বলে চলেন আর ক্রমে ওরা কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। ক্রমে অহিদিদির পরটা ছক্কা রান্নাও শেষ হয়, গল্পও শেষ হয়। আগে একটু জায়গা নিয়ে রেষারেষি, কোঁৎ কাঁৎ শব্দ হচ্ছিল, শেষের দিকে সব চুপ।
অহিদিদি গল্প শেষ করলেন, “তারপর রক্তাক্ত গায়ে ধুঁকতে ধুঁকতে, হাপরের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে, কাঁদতে কাঁদতে বগেশ গিয়ে সমুদ্রের তীরে আছড়ে পড়ল। অমনি সেই সুঁটকো বুড়ির নৌকো এসে তীরে ঠেকল। সঙ্গে সঙ্গে বুড়ির গা থেকে আলো বেরোতে লাগল, সুঁটকো বুড়ি পরী হয়ে গেল আর মা, মা, মা বলে বগেশ তার কোলে লাফিয়ে পড়ল। দুজনকে নিয়ে নৌকো পরীদের দ্বীপে চলে গেল।”
গল্প শুনতে শুনতে ছেলেমেয়েগুলো অহিদিদির পায়ের কাছে গাদাগাদি হয়ে পড়েছিল। অহিদিদি স্টোভ নিবিয়ে, খাবার তুলে বললেন, “আজকের মতো হল, মানিক, বুড়ি ঠাকুমার খাবার সময় হল, কাল আবার আসিস৷ ঝুরি ভাজা খেতে দেব আর ঘুঁটে-কুঁড়ুনীর রানী হবার গল্প বলব।”
এই বলে রান্নাঘরের দোরে শিকলি তুলে, এদিক ফিরে দেখলে ছেলেমেয়েগুলো নিমেষের মধ্যে ভেগেছে।
আর খাবার চুরি হত না সে দিন থেকে। আর অহিদিদি একা পড়তেন না। সন্ধ্যাবেলার ভয়-ভাবনা একেবারে দূর হয়ে গেল। কোনো চোর বা ভূত বা দুষ্টুলোক ঐ ছোঁড়াগুলোর চোখ এড়িয়ে আসতে পারবে না। বগেশ আমসি চুষতে চুষতে বলত, “কোনো ব্যাটা-চ্ছেলেকে এদিকে এগুতে দেব না মা।” অহিদিদি গল্প শেষ করে বললেন, “তোরা সব এত রোগা কেন রে? থাকিস কোথায়?” বগেশ পুরনো আম কাঁঠাল বটের বনের দিকে দেখিয়ে বলত, “ঐ হোথা মোদের আস্তানা।” অহিদিদি বলতেন, “ওগুলো কথা বলে না কেন? সব বোবা নাকি?” তাই শুনে সব খিলখিল করে হেসে উঠত। বগেশ বলত, “লজ্জা পায়। জিব-কাটাদের বড় লজ্জা, মা।” অহিদিদি বললেন, “দূর ব্যাটা, যারা বড্ড কথা বলে তাদের জিবকাটা বলে। কাল তালের বড়া করব, তালের ক্ষীর করব। খাবি তো?” তাই শুনে সব এ-ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ল! অহিদিদিও রকে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলেন। আহা, খেতে পায় না নিশ্চয়, নিশ্চয় পাতার কুঁড়েতে থাকে; মা-বাবাগুলো মানুষ না; অভাবে অনটনে—হয়তো এগুলোকে বেদম পেটায়! ওদের সুখী কর ঠাকুর।
এমনি করে প্রায় চারটে মাস কেটে গেল। সুরেনবাবুদের জন্য স্কুলের হাতায় চমৎকার নতুন কোয়ার্টার তৈরি হয়ে গেল। অহিদিদি বললেন, “ওমা, বলে কী, পৌষ-মাসে কখনো বাড়ি বদলাতে হয়? মাঘ পলে যাব।”
ছেলেপিলেগুলোর ওপর বেজায় মায়া; দিনগুলোকে ওরা দিব্যি জমিয়ে রেখেছিল। ওরা যে নতুন কোয়ার্টারে যাবে না, সে বিষয়ে অহিদিদির কোনো সন্দেহ ছিল না। প্রাণ ধরে চলে যাবার কথাটা ওদের বলতে পারছিলেন না। ওদেরও নিশ্চয় কষ্ট হবে, কে খাওয়াবে কালো কালো রোগা গরিবের ছেলেদের।
পৌষ পার্বণে অহিদিদি পাটিসাপটা, গোকুলপিঠে, নারকেল-নাড়ু, দুধ-পুলি করে সবাইকে খাওয়ালেন। সুরেনবাবুর সহকর্মীরা বেজায় প্রশংসা করলেন। শাশুড়ি বারণ শুনলেন না, তিনটে পাটিসাপটা, এক বাটি দুধ-পুলি খেয়ে ফেললেন। আর সবাই চলে গেলে, সুরেনবাবুও তাস খেলতে মুকুন্দদের ওখানে গেলে, অহিদিদি রান্নাঘরের রকে দাঁড়িয়ে ডাকলেন “অ্যাই, বগেশ!” অমনি ফিক-ফিক করে হাসতে হাসতে দশটা ছেলেমেয়ে হাজির হল। অহিদিদি সাধ মিটিয়ে ওদের খাওয়ালেন। তার আগে ঘটি থেকে জল ঢেলে হাত ধোয়ালেন।
খাওয়া শেষ হলে সবাইকে একটা করে পান দিয়ে অহিদিদি বললেন, “আমরা ইস্কুল পাড়ায় উঠে যাচ্ছি, জানিস বোধ হয়?”
বগেশ সকলের হয়ে বলল, “হুঁ!”
“যাবিনে আমাদের নতুন বাড়িতে?” সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল। অহিদিদি বললেন, “আমার দুঃখু হবে।” বলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। তাই দেখে সব কটা ফোঁচ্-ফোঁচ্ করে একটু কাঁদল। তারপর বগেশ বলল, “মোরাও থাকবনি, মা, মোরাও চলে যাব।” “কোথায় যাবি রে? পারিস তো আমাদের বাড়িতে আসিস।” খুশিতে সব মাথা দোলাতে লাগল। রান্নাঘরের শিকলি তুলে অহিদিদি ফিরে দেখেন সব পালিয়েছে। ভাবলেন আর ওদের সঙ্গে দেখা হবে না। খুব কষ্ট হল।
পরদিন সকালে বাক্স-প্যাঁটরা, বাসনের সিন্দুক বিছানা সব নতুন বাড়িতে রওনা করে দিয়ে সুরেনবাবুকে আর শাশুড়িকে একটা সাইকেল-রিকশাতে তুলে দিয়ে, অহিদিদি স্বামীকে এই প্রথম মিথ্যা কথা বললেন। “তোমরা এগোও, আমি গয়লা-বৌয়ের টাকা দিয়ে, তাকে সঙ্গে করে আসছি।”
সস্ক উঠোন, গাছতলা, গোয়াল-ঘর দেখলেন; পাঁচিল মেরামত হয়েছিল; কিন্তু যাদের আসবার তারা ঠিকই পাঁচিল টপকে আসত। অহিদিদি আম বনে ঢুকে অনেকখানি ঘুরে এলেন, কোথাও কোনো কুঁড়েঘর কি বস্তি দেখতে পেলেন না। তখন তাদের আরেকবার দেখবার আশা ছেড়ে দিয়ে, একটা রিকশা নিয়ে নতুন কোয়ার্টারে চলে গেলেন।
এর দু-মাস পরে, ছোট মেয়ে-জামাই ত্রিবাঙ্কুর বদলি হল, নাতি-নাতনিকে অনেক দিনের জন্য অহিদিদির কাছে রেখে গেল। তখন একদিন গয়লা-বৌ হঠাৎ বলে বসল, “এবার নতুন বাড়িতে উঠে এসেছ, এখন বললে দোষ নেই। কী করে পাঁচ মাস ঐ হানা-বাড়িতে বাস করলে মা, ভেবে পাইনে। সন্ধ্যার পর গ্রামের লোকরা ও-তল্লাটে যায় না, জিব-কাটাদের ভয়ে। তোমরা কিছু দেখোনি?”
অহিদিদি কাঠ হলেন। শাশুড়ি বললেন, “কী বলছ বৌ? জিব-কাটা আবার কী? আমরা কাউকে দেখি-টেখিনি। কে ওরা?”
“ওমা! শোনোনি ঠাকুমা? ঐ বাড়িটা ছিল এক মস্ত সদাগরের। একবার ভোর বেলায় গয়লাদের ছেলে-মেয়েরা পৌষ-পার্বণের বাসি পিঠে খেতে এসে এমনি হট্টগোল করেছিল যে কর্তা তাদের ন’জনের জিব কেটে দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড়টা পালিয়েছিল।…সে-ও আজ দু-শো বছরের কথা হবে। গয়লা-পাড়ায় আমরা আজও তাই নিয়ে দুঃখু করি। তারপর থেকে নাকি আম-বাগানে আর বোল ধরে না আর আশ্চর্যের কথা কী জান মা, এক্ষুনি দেখে এলাম গাছে গাছে মুকুল এসেছে। যাই, মা। এসব হলে আমরা দুঃখীরা দেবতাদের পুজো দিই।”