তেপান্তরের পারের বাড়ি
নটের বেশি সাহস। সে বলল, “কী যে বলিস, গুরু! লোকে বলে তেপান্তরের মাঠ জায়গা ভালো নয়। তোর যেমন কথা! আরে, লোকে তো এও বলে যে নটে-গুরু ছেলে ভালো নয়!” বলতেই গুরু ফিক করে হেসে ফেলল।
তা ছাড়া একেবারে দশ-দশটা টাকা কেই-বা দিচ্ছে কাকে? ওখানে এক রাত্তির বাস করলেই বাড়ির মালিক যদি ওই অতগুলো টাকা দেয়, তা হলে থাকবে নাই-বা কেন? নাকি একশো বছর কেউ ওখানে রাত কাটায়নি। মনে পড়তেই গুরু অবাক হল, “হ্যাঁরে নটে, সত্যি কেউ রাত কাটায় না?”
“কেউ না, কেউ না, উদ্বাস্তুরাও তেপান্তরের মাঠ পার হয় না।”
আড়চোখে গুরুর দিকে চেয়ে নটে বলল, ‘কেউ কিছু বললে না হয় পালিয়ে আসব। তাই বলে এমন একটা সৎ কাজ করব না?”
তাই বটে। ওখানে রাত কাটাতে পারলে, বাড়িওলার বাড়ি বিক্রি হবে, কল্যাণ সঙ্ঘ সস্তায় ওটা কিনবে, কিনে ভেঙে ফেলবে, এক দঙ্গল লোক মজুরি পাবে। উদ্বাস্তুরা মিনি-মাগনায় ইঁট কাঠগুলো পাবে, নতুন বাড়ি উঠবে, মুটে, মজুর, মিস্ত্রি, ঠিকাদার, সক্কলের কম বেশি রোজগারপাতি হবে। যাদের কেউ নেই, তারা সেখানে থাকবে, ইস্কুল হবে, কাঠের আসবাবের কারখানা হবে, বই বাঁধাইয়ের দোকান হবে, হাঘরেরা চাকরি পাবে, আর— আর নটে-গুরুও দশ টাকা পাবে।
বাড়ির মালিক কালো চশমার ভিতর দিয়ে ওদের মাথা থেকে পা অবধি দেখে নিয়ে বললেন, “খারাপ জায়গা হলে থাকতে বলব কেন? আমার নিজের ঠাকুরদার বাবার তৈরি, চার দিকে আম জাম কাঁঠাল নারকোলের গাছ, তার বাইরে এক মানুষ উঁচু পাঁচিল। অথচ কেউ না থাকলে কল্যাণ সঙ্ঘের বাবুরা কিনবে না। শোনো একবার কথা! অমন ভালো বাড়ি, পুব-দক্ষিণ খোলা, আদি গঙ্গার ধারে।”
নটে বলল, “আপনি নিজে গিয়ে একরাত থেকে ওদের দেখিয়ে দিন না কেন? আপনার দশ টাকা বেঁচে যায়।”
মালিক বললেন, “দশ টাকা বেঁচে যায়? দশ টাকাকে আমি নস্যির মতো মনে করি। তোরা একটি রাত কোনোরকমে থাক-না বাপ, দশ কেন পনেরো টাকা দেব। আজ রাতেই যা।”
তাই শুনে গুরু নটের দিকে তাকাতেই মালিক বললেন, “কচুরি, আলুর চাট, মিঠে গজা আর লিমনেট টিপিন দেব সঙ্গে। কিন্তু সব ঘরের দেয়ালে হরিনাম লিখে আসতে হবে। তবেই কল্যাণ সঙ্ঘ বিশ্বাস করবে অপদেবতা টেবতার বাস নয় ও বাড়ি। বলে কিনা আমার অতি বড় বৃদ্ধ প্রপিতামহ দুই সন্ধে শিবপুজো করতেন!”
নটে-গুরু চলে গেল, মালিকের বউ আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে তেরিয়া হয়ে বলল, “একটু দয়ামায়াও নেই শরীলে? দুধের বাছাদের দিলে পাঠিয়ে ভূতের খপ্পরে! বলি, তুমি কি মানুষ?”
শুনে মালিক অবাক, “কাকে দুধের বাছা বলছ? ওদের দেখলে দুধ কেটে ছানা বেরোয়। ওরা হল গিয়ে কালীঘাটের মার্কামারা ছোঁড়া। বাড়িটা বিক্রি হয় তুমি চাও না? ভূত ভাগাতে ওরাই পারবে। উপরন্তু টাকাও পাবে।”
এর ওপর আর কথা চলে না।
পরে গুরু বলল, “সন্ধে অবধি অপেক্ষা করে কাজ নেই, রোদ থাকতে থাকতেই চল, তেপান্তর পেরিয়ে ওখানে গিয়ে আড্ডা গাড়ি। টিপিন তো বুড়োই দেবে বলেছে। অন্ধকারে তেপান্তরে গা ছম ছম করবে।”
যেমন কথা তেমনি কাজ। পাঁচটা না বাজতেই মালিকের বউয়ের রান্নাঘর থেকে পুরনো একটা চুপড়ি ভরে কচুরি, আলুর চাট, জিবে গজা, কাঁচকলার আচার আর থলিতে চার বোতল লেমোনেড নিয়ে, বিকেলের পড়ন্ত রোদে নটে-গুরু তেপান্তরের ওপর দিয়ে পুবমুখো হাঁটা দিল। ওদের সামনে সামনে সরু লম্বা হয়ে ওদের ছায়া দুটোও চলল। গুরু থমকে দাঁড়িয়ে নটেকে বলল, “হাঁরে, সত্যি আমাদের ছায়া তো? মানে আর কিছু যদি সঙ্গে—” নটে ওর কান টেনে, ঘাড়ে রদ্দা মেরে দেখিয়ে দিল ওদেরই ছায়া বটে।
খুব বড় মাঠের জায়গাই-বা হবে কোত্থেকে ওই এলাকায়। দেখতে দেখতে ডাঙা পেরিয়ে ওপারের রাস্তায় কাছাকাছি পৌঁছে ওদের চক্ষুস্থির! বলে নাকি একশো বছর কেউ বাস করেনি ও বাড়িতে! নটে-গুরু দেখল বাড়ি লোকজনে গমগম করছে। আশেপাশের যত উদ্বাস্তুদের সব চাইতে বদমাইস ছেলেমেয়েরা ঐ বাড়ির বাগানে জমায়েত হয়ে, সে কী হুল্লোড় লাগিয়েছে! সিকি কিলোমিটার দূর থেকে তাদের হৈ-চৈ, হ্যা হ্যা হাসি, চ্যাঁ ভ্যাঁ কান্নায় কানে তালা লাগার জোগাড়।
এ আবার কী গেরো রে বাবা। ওরা যে কাউকে ও-বাড়ির ত্রিসীমানায় এগোতে দেবে তা তো মনে হয় না। আম-কাঁঠাল গাছের পাতা দেখা যাচ্ছে না, ফটকে চড়ে কম করে কুড়িটা ছেলেমেয়ে দোল খাচ্ছে। কেউ গেঞ্জি, কেউ জাঙিয়া পরা, কেউ উদোম গায়ে, কুচকুচে কালো রঙ, উস্কোখুস্কো মাথার চুল, বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে। কারো হাতে ঢিল, কারো হাতে চ্যালা কাঠ। এগোয় কার সাধ্যি!
নটে বলল, “থামলি যে বড়? বাড়ির ভিতর ঢুকে দ্যালে হরিনাম লিখতে হবে না? বাড়ি তো বন্ধ দেখছি, চাবি-টাবিও দেয়নি বুড়ো! নাকি কোন্ কালে হারিয়ে গেছে।”
ছোট ছোট এক রাশি পাথরের কুচি ওদের গায়ে মাথায় এসে পড়ল। রাগলে গুরুর জ্ঞান থাকে না, চটেমটে বলল, “কী হচ্ছেটা কী?” একটা ঢিঙটিঙে রোগা ছেলে আঙুল দিয়ে চুপড়ি দেখিয়ে বলল, “কী আছে রে ওতে?”
“আমাদের টিপিন? এই বাড়িতে রাত কাটাব, তাই টিপিন এনেছি।” অমনি বিচ্ছুগুলো বলে কি না, “এ্যাঁ! তাই নাকি? তা টিপিনটা কী জিনিস বাপু?”
নটে বলল, “কচুরি, আলুর চাট, জিবেগজা, কাঁচকলার আচার।”তাই শুনে আমগাছের ওপর থেকে বিশ-পঁচিশটা এক সঙ্গে বলে উঠল, “বলিস কীরে! তা আমরাও তো এখানে রাত কাটাব। দে দে আমাদেরও ভাগ দে।” এই-না বলে একটার ঠ্যাং আরেকটা ধরে ঝুলতে ঝুলতে বিশ হাত লম্বা একটা দুষ্ট ছেলের মালা বানিয়ে নটের হাত থেকে টিপিনের চুপড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে, ঢাকনি খুলে, এক খাবলা এ খায় তো আরেক খাবলা ও খায়, এক নিমেষে চুপড়ি খালি করে ফেলে দিয়ে, ফটক হাট করে খুলে দিয়ে বলল, “আয় আয়, ভিতরে আয়, আমাদের এত খাওয়ালি, তোরা আমাদের বন্ধু।”
নটে-গুরুর মুখে কথাটি নেই। তবে বদমাইশ দেখে ভড়কাবার পাত্র ওরা কেউ ছিল না। ওরা ভাবছিল এই তো ভালো হল, খাবারটা গেল তার আর কী করা যাবে। এমন তো আর নয় যে না খেয়ে রাত কাটিয়ে ওদের অভ্যেস নেই। এবার ওদের দিয়েই বাড়ি খুলিয়ে দেওয়ালে হরিনাম লিখিয়ে কোনো মতে রাতটাকে ভোর করতে পারলেই হয়ে যাবে। তার পর কল্যাণ সঙ্ঘ এসে উদ্বাস্তু তুলুক, কিংবা যা-খুশি করুক নটে-গুরুর কোনো আপত্তি নেই।
ওদের ঘিরে দাঁড়াল ছেলেমেয়েগুলো, “বল তোদের জন্য আমরা কী করতে পারি? তোদের মতো কেউ হয় না রে, বাপ!” নটের সাহস বেশি, সে বলল, “তবে শোন, আমরা কেন এইচি বলি। এই বাড়িতে রাত কাটালে, বাড়ির মালিক আমাদের পনেরো টাকা দেবে বলেছে!” শুনে ওদের কী হাসি! “ধেৎ! তাই কখনো দেয়! বলে দোরগোড়ায় মলেও মুখে একমুঠো গরম ভাত কেউ দেয় না।” অমনি সকলে চাকুমচুকুম ঠোঁট চেটে বলল, “ই-ই-স! গরম গরম ভাত কী ভালো জিনিস রে বাবা!”
ওদের মধ্যে সব চেয়ে লম্বা, সব চেয়ে রোগা, সব চেয়ে কালো যে তার নাম নাকি ঢ্যাঙা। সেই ঢ্যাঙা বললে, “তা বললে তো হবে না, চাঁদ। মিছিমিছি পনেরো টাকা দেবে কেন? একসঙ্গে পনেরো টাকা তো আমরা কেউ চক্ষেও দেখিনি!”
গুরু বলল, “মিছিমিছি নয়। এখানে কেউ রাত কাটাতে পারলে, কল্যাণ সঙ্ঘের বাবুরা বাড়িটা কিনবে, আশ্রম বানাবে, ইস্কুল করবে, ছুতোরের দোকান করবে, বই বাঁধাবার কারবার করবে—”
হেঁড়ে গলায় ঢ্যাঙা বলল, “তা ওই আশ্রমে কে থাকবেটা শুনি?” “কেন, যাদের কেউ নেই, বাড়িঘর নেই, তারা থাকবে।” হি হি করে হেসে একদল বলে উঠল, “আমাদের তো বাড়িঘর নেই, কেউ নেই। তা হলে আমাদের মতো ছেলেমেয়েরা থাকবে বলছিস! ভাত রাঁধা হবে তাদের জন্য? রোজ রোজ ভাত, রুটি, খিচুড়ি এইসব হবে!” “সদরের তালাটা খুলে দিতে পার?” দেখা গেল উদ্বাস্তু ছেলেমেয়েগুলো লোক খারাপ নয়। অমনি ওরা হাঁক পাড়ল, “গিরগিট রে, ওরে গিরগিটি, কোথা গেলি?” বলতে বলতে একটা হিলহিলে রোগা ছেলে এসে বলল, “কেন, কী করতে হবে?”
“কিচ্ছু না, কিচ্ছু না, শুধু দেয়াল বেয়ে তিন তলার ছাদে উঠে, চিলেকোঠার শিকলি খুলে বাড়ির সব দোর-জানলা খুলে দে।”
ব্যস, আর বলতে হল না। যেমন কথা তেমনি কাজ। সত্যিকার গিরগিটির মতো সর সর করে দেয়াল বেয়ে ছেলেটা ওপরে গিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব দরজা জানলা খুলে হাট করে দিল। শুধু তাই নয়, কোত্থেকে সব কাঠকয়লার টুকরো, ভাঙা ইটের কুচি এনে, এর পিঠে ও চেপে, দেখতে দেখতে প্রত্যেক ঘরের ছাদ থেকে নীচে পর্যন্ত হরিনাম লিখে ফেলল! নটে গুরু হাঁ।
এর মধ্যে কখন সূর্য ডুবে গেল, চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল, শুকনো কাঠের মশাল জ্বালা হল, বোধ হয় গাছ নেড়িয়ে কাঁচা আমের গুটি তুলে এনে কচকচিয়ে টিপিন খাওয়া হল আর সে কী চ্যাঁচামেচি, গান, তিড়িং-বিড়িং নাচ আর হ্যা হ্যা হাসি! এরকম ছেলেমেয়ে বাপের কালে কখনো ওরা চোখে দেখেনি। কখন যে কোন ফাঁকে রাত কেটে ভোর হয়ে এল তাও ওরা টের পেল না। শেষে এক সময় ছেলেমেয়েগুলো ওদের ঠেলা দিয়ে বলল, “ওকী! ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না, আগে কথা দাও হঙ্ক-বঙ্করা সত্যি সত্যি এখানে ইস্কুল করবে, রোজ ভাত বেঁধে ছেলেদের খাওয়াবে। নইলে সব পণ্ড করে দেব। বাড়ি ছেড়ে এক চুল নড়ব না।”
নটে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ হবে, হবে। তোদের তখন এ বাড়িতে আর হুল্লোড় করা হবে না। বলিস তো লিখে দিচ্ছি!” শুনে ওদের কী খিল খিল হাসি। “পড়তেই জানি না তো লিখব কী রে! আচ্ছা, তোদের মুখের কথাতেই হবে।”
এর পর ওরা ঘুমিয়ে পড়ে থাকবে। জাগল অনেক বেলায়, চার দিক ভোঁ ভোঁ, কারো টিকিও দেখা নেই, গেছে সব নিশ্চয় ওদের উদ্বাস্তু কলোনিতে। দুপুরে এসে আবার নিশ্চয় আমগাছের ডাল ভাঙবে। ভাঙুক তো, ওদের কথা মালিককে বলে দরকার নেই। শেষটা যদি কলোনিতে গিয়ে মালিক গোল বাধায়!
মালিকের কাছে কল্যাণ সঙ্ঘের বাবুরাও বসেছিল, নটে-গুরুর সঙ্গে তারাও চলল, বাড়ি দেখতে। দেয়ালে কেমন হরিনাম লেখা হয়েছে দেখা দরকার। তবেই প্রমাণ হবে ভূতটুত সব বাজে কথা।
তেপান্তরের মাঠ শেষ হয়ে এসেছে, দূর থেকে হই হুল্লোড়ের শব্দ আসছে। গুরু নটের দিকে তাকাল। কী সাংঘাতিক! বিচ্ছুগুলো এরই মধ্যে আবার শুরু করে দিয়েছে নাকি! কিন্তু আর একটু কাছে যেতেই দেখা গেল তা নয়, ওদের সাড়া পেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা পাখি কিচির মিচির করতে করতে নীল আকাশে উড়ে পড়ল।
আর কী বাকি রইল? কল্যাণ সঙ্ঘ বাড়ি কিনল, আশ্রমও হল, একপাল হাঘরে ছেলেমেয়েদের থাকবার জায়গা হল, রোজ বড় বড় হাঁড়ায় তাদের জন্য ভাত রান্না হয়। বাড়ির মালিক খুশি হয়ে নটে-গুরুকে পনেরো টাকা দিয়েছিল! কথাটা জানাজানিও হয়েছিল। নানা লোকে নানা কথা বলেছিল। অন্য লোক টাকা পেলে ওরকম তো বলবেই! খালি গুরুর বাউন্ডুলে ছোটদাদু একটু অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। ষাট বছর আগেও ওই বাড়ি খালি পড়ে থাকত। উনি নাকি একবার পিট্টির ভয়ে সন্ধেবেলায় বাড়ি থেকে পালিয়ে ওই বাড়িতে গা ঢাকার তালে ছিলেন। তা বিচ্ছুগুলো ওঁকে ঢুকতেই দেয়নি। মহা বদমাইস ছেলেগুলো, বিশেষ করে ঢ্যাঙা বলে একটা লম্বা কালো ছেলে আর গিরগিটি বলে একটা হিলহিলে ছোকরা, সে ব্যাটা সটান দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে ঢিল ছুঁড়তে আরম্ভ করেছিল!
তবে ওরা আর কখনো আসেনি!