কর্তাদাদার কেরদানি
ছোটবেলা থেকে আমার মেজো কর্তাদাদামশায়ের গুণগান শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে যেত। ছুটি-ছাটাতে যখনি ডায়মন্ডহারবারে বাবাদের বিশাল পৈতৃক বাড়িতে যেতাম বুড়ো-ঠাকুমা, ঠাকুমা আর মা-পিসিমাদের মুখে মেজো কর্তাদাদামশায়ের প্রশংসা আর ধরত না। ঐ অত বড় বাড়ি, বাড়ি ভরতি কালো কালো কাঠের বিশাল বিশাল আসবাব, দেয়াল জোড়া চটা-ওঠা গিলটি ফ্রেমের বিরাট আয়না, একশো বিঘে জমি, তার মধ্যে পাঁচটা কালো জলে ভরা প্রকাণ্ড পুকুর, তাতে মাছ কিলবিল করত, আম-কাঁঠালের বন, নারকেল বাগান, বাঁশ-বন, সবই ছিল যেন সোনার খনি আর সবই নাকি হয়েছিল ঐ মেজো কর্তাদাদামশায়ের দয়ায়। প্রশংসা করবে না কেন লোকে! ছেলেপুলে ছিল না যে ভাগ বসাবে। বিয়েই করেননি যে শ্বশুর বাড়ির লোকরা এসে হাঙ্গামা বাধাবে। তিন পুরুষ ধরে সবাই মিলে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে, ছাপর খাটে অষ্টপ্রহর হাত-পা মেলে, কেবল খেয়েছে আর ঘুমিয়েছে আর লোহার সিন্দুক থেকে নগদ টাকা বের করে নিয়ে খরচ করেছে।
অবিশ্যি এক পুরুষ পেরোবার আগেই লোহার সিন্দুকের টাকাকড়ি চাঁচাপোঁছা, তখন আরো লোহার সিন্দুক থেকে গয়নাগাঁটিগুলো বের করে ওয়ারিশদের মধ্যে পঞ্চায়েতের মোড়ল এসে সমান-সমান ভাগ করে দিয়ে গেল। তবু কি আর সবাই খুশি হল। আমাদের বুড়ো-ঠাকুমা বলতেন কিন্তু ওই থেকেই কান্তি মোড়লের আত্মার সদগতিও হয়ে গেছিল। কারণ ঐ গয়নার ডাঁই দেখে অবধি তার চোখ থেকে রাতের ঘুম বিদায় নিয়েছিল। তা ছাড়া কোনো কোনো ছোকরা ওয়ারিশ ভাগাভাগিতে অসন্তুষ্ট হয়ে বাঁশপেটা করে বুড়োকে গাঁ ছাড়া করবে বলেও হয়তো ভয় দেখিয়ে থাকবে। মোট কথা শেষপর্যন্ত সে বিষয়-আশয় ছেলেপুলেদের বুঝিয়ে দিয়ে লোটা-কম্বল ও গিন্নিকে নিয়ে কাশীবাসী হয়েছিল। বলা বাহুল্য সেখানে কিছু পয়সাকড়ি ও গঙ্গাতীরে ছোট একটা বাড়ি আগে থাকতেই ব্যবস্থা করা ছিল।
সে যাই হোক গে, গয়নাগাঁটিও কারো চিরকাল থাকে না। শেষে এমন দিন এল যখন একটা একটা করে সেগুলো বেচে বেচে, আর কিছু অবশিষ্ট রইল না! তখন ফলের বাগান, পুকুরের মাছ জমা দেওয়া ছাড়া গতি রইল না। তার পর সেগুলোকেও একে একে বেচে দিতে হল। মোট কথা আমরা যখন ছোটবেলায় ছুটি-কাটাতে ডায়মন্ডহারবার যেতাম তখন দেখতাম আমাদের বলতে আছে শুধু বিশাল এক পোড়ো বাড়ি, তার মধ্যে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব কালো হয়ে যাওয়া খাট আলমারি, যা কেউ কিনতে তো রাজি হয়ই না, দিতে চাইলেও নিতে চায় না, কারণ কারো দরজা দিয়ে ও-সব ঢুকবে না।
আর ছিল দেয়াল জোড়া রঙচটা আয়না, যাতে মুখ দেখে কার সাধ্যি, আর একটা পুকুর, তাও শ্যাওলাতে ঢাকা, কিন্তু নাকি হাঙরের মতো বড়-বড় মাছে ভরা। আর ছিল বিশাল পোড়ো বাড়িটাকে ঘিরে শতখানেক আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, তেঁতুল, নারকেল, জামরুলের গাছ আর আগাছায় ভরা বিঘে পাঁচেক জমি। সেগুলো নাকি এমনিভাবে দলিল দিয়ে লেখাপড়া করা যে কোনোকালে কেউ বেচতে পারবে না। বুড়ো-ঠাকুমার মুখে শুনেছি, তা না হলে ওগুলোরও ল্যাজের ডগা বাকি থাকত না। অথচ মেজো কর্তাদাদামশাই নাকি মহা পাজি ছিলেন। পড়াশুনোর নাম নেই; দিনরাত পাড়ার যত ডানপিটে বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো ছোকরা জুটিয়ে, আজ এর পুকুরে মাছ মারা, কাল ওর আম বাগান সাফাই করা আর যেখানে যত কুস্তির আখড়া আর গান-কেত্তন, যাত্রা-নাটকের আস্তানায় গিয়ে পাল্লা দেওয়া। তায়ই মধ্যে হঠাৎ একদিন ওদের দলকে দল নিখোঁজ হয়ে গেল। দুদিন একটু সোরগোল, মা-ঠাকুমাদের অল্প একটু আপসোস, তার পর গাঁয়ে এমনি গভীর শান্তি বিরাজ করতে লাগল যে শোক-দুঃখ ভুলে দুবেলা সবাই শিবঠাকুরকে দুহাত তুলে ধন্যবাদ জানাত।
গাঁয়ের দেবতা বুড়ো-শিবতলার শিবঠাকুর। সেকালে প্রতি বছর পুজোর সময় ঘটা করে শিবতলায় আলাদা করে ওই শিবঠাকুরের পুজো হত। ‘শিবঠাকুরের বিয়ে’ নাটক হত। গাঁয়ের মাতব্বররা অভিনয় করতেন। তাই নিয়ে মেজো কর্তাদাদামশাইয়ের কী রাগ। নারদের পার্ট কখনো ঐ আধবুড়োরা করতে পারে নাকি? নারদ সাজত কান্তি মোড়লের ঠাকুরদা জগা মোড়ল। সে কি নাচতে পারে, না গাইতে পারে? নারুদে চেহারা ছিল একটারও? মোটকথা মেজো কর্তাদাদামশায়ের নারদ সাজার বড় সখ ছিল। তিনি ফেরারি হবার পর তাই নিয়ে দু-চারজনাকে আক্ষেপ করতেও শোনা যেত। নাকি অদ্ভুত ভালো অভিনয় করতে পারতেন। চমৎকার দেখতে ছিলেন, খাসা গানের গলা ছিল আর নাচতেন যেন কার্তিকের ময়ূরটি। বছরের পর বছর কেটে যেতে লাগল, মেজো কর্তাদাদামশাইয়ের কথা লোকে একরকম ভুলেই গেল। তাঁর কপালের মাঝখানে যে তৃতীয় নেত্রের মতো একটা বড় তিল জ্বলজ্বল করত তা পর্যন্ত কারো মনে রইল না। তার মধ্যে আমাদের বাড়ির অবস্থা ক্রমে পড়তে পড়তে আর কিছুই রইল না। ঐ যে কান্তি মোড়লের কথা বললাম, তার ঠাকুরদা জগা মোড়লের তখন তেজারতি ব্যবসার ভারি বোলবোলা। আমাদের বাড়ির অর্ধেক জিনিসপত্র তারই কাছে বাঁধা দেওয়া, মায় আমাদের ও গ্রামের অর্ধেক লোকের জমিজমার দলিলপত্র সুদ্ধ। থেকে থেকে জগা বুড়ো ভয় দেখাত, টাকা শোধ না করলে সম্পত্তি অধিকার করবে।
এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই, একদিন পুজোর সময় ‘শিবঠাকুরের বিয়ে’ নাটক দেখতে সকলে ব্যস্ত, এমন সময় জগা মোড়লের বাড়িতে ডাকাত পড়ল। তারা সিন্দুক ভেঙে গয়নাগাঁটি আর তার চেয়েও সাংঘাতিক কথা, ইস্টিলের ক্যাশ বাক্স বোঝাই বন্ধকী দলিলপত্র নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। আর কোনোদিনও তাদের টিকিটিও দেখা গেল না। জগা সেই যে শয্যা নিল, আর উঠল না। কিন্তু গ্রাম সুদ্ধ সবাই বুড়ো শিবঠাকুরকে বিশেষ পুজো দিয়ে এল। আমাদের সকলের জমিজমা বেঁচে গেল। ও-সব যে বাঁধা দেওয়া জিনিস তার কোনো প্রমাণই রইল না।
আরো কয়েক বছর পরে ঘোড়ার ডাকে মাসে মাসে আমাদের গাঁয়ের ফেরারি ছেলেদের সবার বাড়িতে পয়সাকড়ি আসতে লাগল। একবার আমার বুড়ো-ঠাকুমার নামে এক ছড়া মুক্তোর মালা আর একটি চিঠি এল। তাতে লেখা মেজো কর্তাদাদামশাই জাহাজে নাবিক হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে নৌকাডুবি হয়েছিলেন। কিন্তু রাখে হরি মারে কে, একটা ভাসমান নারকেল গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে জোয়ারের জলের সঙ্গে তিনি একটা নির্জন দ্বীপে গিয়ে পড়লেন। দ্বীপের উপকূলে ঝিনুকের ছড়াছড়ি। একেকটা খোলেন আর ভিতর থেকে এই বড় একটা করে মুক্তো বেরোয়। খিদের চোটে পোকাটাকে খেয়ে ফেলেন আর মুক্তোটিকে কোঁচড়ে বাঁধেন। এমনি করে দুটি বছর কাটাবার পর আরেকটা জাহাজ তাঁকে উদ্ধার করে। মুক্তোর কথা কাউকে বলেননি। দেশেও ফেরেননি। কিন্তু পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে মুক্তো বেচার টাকা বাড়িতে পাঠিয়েছেন। এর বেশি যেন কেউ আশা না করে। এখনো কি জগা মোড়ল নারদ সাজে? ইতি…
ঠাকুমা বললেন চিঠিটা যে জাল নয়, তার প্রমাণ চিঠির ঐ শেষের লাইনটি। নইলে, মেজো কর্তা কি আর লিখতে শিখেছিল যে অতবড় একখানা চিঠি ফাঁদবে। কাউকে দিয়ে লিখিয়েছিল।
সেবার আমরা ঠিক করলাম ‘শিবঠাকুরের বিয়ে’ নাটক আমরা করব। হলদে হয়ে যাওয়া নাটকের পালার কপি খুঁজে বের করলেন ঠাকুমা। পোড়ো বাড়ির আগাছা কিছু পরিষ্কার হল, পুরোনো পুজোমণ্ডপ ঝাড়াঝোড়াই হল, সেখানে সেকালে যেমন হত, সেইভাবে নাটক করা হবে। তবে বুড়োদের অভিনয় করতে দেওয়া হবে না। অনেক বছর পরে আবার ঘটা করে শিবতলার বুড়োশিবের পুজো হচ্ছে, বুড়োরা সেটা হাতে নিক কিন্তু নাটক করব আমরা। অর্থাৎ ছেলে-ছোকরারা। মেয়েদের পার্টও ছেলেরা করবে। গানের দলে মেয়েরা থাকবে। পয়সাকড়ি আমরা জোগাড় করলাম, কাজেই কেউ আপত্তি করল না।
সবই হল, খালি নারদের পার্ট করার লোক পাওয়া গেল না। নাচবে, গাইবে, দেখতে ভালো হবে, এমন লোক পাওয়া গেল না। শেষটা ঠাকুমাই বললেন, “আরে, আমার ভাগ্নি দুষ্টুর জামাই কৃষ্ণ কর কলকাতার নামকরা অভিনেতা। ওকে আনিয়ে নে না, যেমনি দেখতে তেমনি নাচে গায়। তোদের সবাইকে ওর পাশে একেকটা দাঁড়কাগের মতো দেখাবে। বলিস তো আমিই সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি।” দাঁড়কাগের কথাটাতে কেউ খুশি না হলেও, রাজি না হয়েও পারল না।
তাই ঠিক হয়ে গেল; কৃষ্ণ কর নারদ সাজবে। তবে ব্যস্ত মানুষ, রিহার্সাল দিতে পারবে না। নাটকের এক কপি ওকে পাঠিয়ে দিলে, নিজেই তৈরি হয়ে নেবে। নাটকের দিন বঙ্কুদা ওকে গাড়ি করে নিয়ে আসবেন। আমবাগানের পিছনে বঙ্কুদাদের ছোট্ট অতিথিশালায় যেন ওর ড্রেস রেডি থাকে। ও সন্ধ্যার মধ্যে সাজ বদলে, নাটক শুরু হবার দশ মিনিট আগে মণ্ডপে উঠবে। কারো কারো একটু মন খুঁৎ খুঁৎ করলেও, বঙ্কুদা বললেন, “কৃষ্ণ করের কথার কখনো একচুল নড়ন-চড়ন হয় না।” তাইতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হল।
ষষ্ঠীর আগে বুড়োশিবের মন্দিরে পুজো হল। ষষ্ঠীর দিন নাটক হল। নিজেদের প্রশংসা করা উচিত নয় জানি, তবু সত্যের খাতিরে বলতে বাধ্য হলাম যে অমন নাটক ইহলোকে খুব কম দেখা যায়। স্টেজ সাজানো, পার্ট মুখস্থ, ড্রেস পরা, সামিয়ানার নীচে লোক ধরে না। পুরোনো পুজোমণ্ডপ আমাদের বাড়ির লাগোয়া। গ্রিন রুমটা বাড়ির একতলার একটি ঘরে। তার একটা দরজা থেকে মণ্ডপে যাবার পথ, সেটা দরমা দিয়ে ঘেরা। আরেকটা দরজাও আছে, বাইরে থেকে যাওয়া আসার জন্য।
বিকেলেই বঙ্কুদা এসে জানিয়ে গেলেন, কৃষ্ণ কর এসে গেছেন। অতিথিশালায় বসে বঙ্কুদার সঙ্গে একবার মহড়াও দিয়েছেন। এখন বিশ্রাম করছেন, একেবারে সেজেগুজে স্টেজে উঠবেন। আমরা কেউ যেন ঝামেলা না করি। অনেকেই বলেছিল এ-সব চাল ছাড়া আর কিছু নয়। যাই হোক অত নামকরা অভিনেতা বিনি পয়সায় অভিনয় করে যাচ্ছেন, সেই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট।
সন্ধ্যা এগিয়ে এল, সবাই রেডি। অথচ কৃষ্ণ করের দেখা নেই। আমার ভাই অমি বড্ড মোটা বলে তাকে কোনো পার্ট দেওয়া যায়নি। তার কাজ ছিল গ্রিন রুম আগলানো। শেষটা বঙ্কুদা তাকেই বললেন, “যা তো, একটু এগিয়ে দেখ। হয়তো অন্ধকারে আমবাগানে পথ হারিয়েছে। যা জঙ্গল তোমাদের বাড়িতে। আমরা এদিকে শুরু করে দিচ্ছি! প্রথম সিনে তো আর নারদ নেই।”
মণ্ডপের পেছনে প্যাঁ করে ক্ল্যারিয়োনেট বেজে উঠল, অমি আর আমি কৃষ্ণ করের খোঁজে বেরুলাম। বেশি দূর যেতেও হল না, আমরা গ্রিনরুমের দরজা খুলেই দেখি নারদের বেশে কৃষ্ণ কর সিঁড়ির ছোট ধাপটাতে দাঁড়িয়ে। কী ভালো দেখতে কী বলব। রঙ-টঙ মেখে মাথায় জটার ওপর জরির কাঁটা বেঁধে এমনি রূপ খুলেছিল যে সত্যিকার নারদ যদি একবার দেখতেন তো নিশ্চয় বলতে পারি হিংসায় জ্বলে যেতেন। সে কী রূপ! কপালে চিত্র করেছেন, সেটা জ্বলজ্বল করছে। যাক সবাই নিশ্চিন্ত হল।
ততক্ষণে প্রথম সিনও শেষ হয়ে এসেছে, কৃষ্ণ কর আর বিলম্ব না করে মণ্ডপে উঠে পড়লেন। সে যে কী অদ্ভুত অভিনয়, যারা দেখেছিল সবাই একেবারে হাঁ! কৃষ্ণ কর নিজেও নাকি কখনো এত ভালো অভিনয় করেননি। সিনের পর সিন হয়ে যেতে লাগল। কৃষ্ণ করের দেখাদেখি অন্য সকলেও বেজায় ভালো অভিনয় করতে লাগল। ইন্দ্রজালের মতো নাটক চলতে লাগল। দ্বিতীয় অঙ্কের পর আর নারদের পার্ট ছিল না। তাঁর শেষ সিনটি এবার শুরু হবে, এমন সময় কৃষ্ণ কর অমিকে কানে কানে বললেন, “পেছনের দরজায় আমার শত্রু এসেছে। যেমন করে পারো ঠেকাও, আমার পালাটুকু শেষ না হওয়া পর্যন্ত— তার পর যা হয় হোক।” এই বলে তিনি মণ্ডপে উঠে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে বাইরে যাবার ছোট দরজাতে আস্তে আস্তে কে টোকা দিতে লাগল। আমরা কেউ কান দিলাম না। আমি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে কাকে যেন এক ধমক দিয়ে, আবার এসে বসল। জিজ্ঞাসা করাতে বলল, “ঢং কার জায়গা পায়নি, ব্যাটা, কলাপাতা জড়িয়ে সঙ সেজে, ভয় দেখাবার তালে আছে।” আমি কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও লোকটার দেখা পেলাম না।
দ্বিতীয় অঙ্ক শেষ হয়ে গেল। কৃষ্ণ কর বিপুল হাততালিতে কানে তালা লাগিয়ে গ্রিনরুমে এসে অমিকে বললেন, “বাঃ ব্যাটাকে খুব ঠেকিয়েছ দেখছি। তোমার জন্য কী করতে পারি বল দিকিনি? বড় আনন্দ দিয়েছ। আচ্ছা, পুকুরটাকে সাফ করিয়ে একটু জল ছেঁচে ফেলার ব্যবস্থা কোরো।” এই বলে দরজাটা একটু ফাঁক করে অন্ধকার পথে বেরিয়ে পড়লেন। সেখানে শত্রু আছে বলে এতটুকু ভয় দেখলাম না।
অভিনয় শেষ হয়ে গেল। সবাই কৃষ্ণ করকে খুঁজতে লাগল। অথচ তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বঙ্কুদারা কয়েকজন শেষপর্যন্ত আমবাগানের অতিথিশালায় গিয়ে হাজির হলেন। দেখেন বাইরে থেকে তালা দেওয়া, যেমন কৃষ্ণ করকে বলে দেওয়া হয়েছিল। সবাই অবাক হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, “কে? কে? ওটা কে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছে?”
সবাই মিলে তাকে হিড়হিড় করে টেনে আলোর সামনে আনতেই দেখা গেল কিম্ভূতকিমাকার এক মূর্তি, পরনে কলাপাতা ছাড়া আর কিছু নেই, চোখে মুখে প্রচুর মেক-আপ লেপটে রয়েছে। বঙ্কুদাকে দেখেই সে তাঁকে জাপটে ধরে বলল, “দাদা, এই বিপদে ফেলবার জন্যই কি আমাকে কলকাতা থেকে নিয়ে এলেন?”
বঙ্কুদার দু চোখ কপালে উঠে গেল। “সেকী! কেষ্ট, তুমি? তবে কে অভিনয় করে গেল?” লোকটা হতাশভাবে মাথা নাড়ল। “তা তো জানি না, আমবাগানের সবচেয়ে অন্ধকার জায়গায় ড্রেস-ট্রেস পরে যেই পৌঁচেছি অমনি বাঘের মতো আমার ঘাড়ের উপর পড়ল। কোনো কথা বলল না, খালি আমার ড্রেস খুলে নিয়ে নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি কী করি, সেই ইস্তক কলাপাতা জড়িয়ে বেড়াচ্ছি—এটা কি খুব ভালো কাজ হল?”
বঙ্কুদা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। “কী আশ্চর্য, না হয় কলাপাতা পরেই গ্রিনরুমে যেতে। দরজাটা তো দেখিয়ে দিয়েছিলাম।”
“গেছিলাম। কিন্তু একজন ষণ্ডামতো ভদ্রলোক এমন তেড়ে এলেন যে পালাবার পথ পাইনে।”
“আহা, এখানে ফিরে এসেও তো অন্য কাপড় পরে গিয়ে আমাদের খবর দিতে পারতে। জাল নারদকে তা হলে ধরা যেত।”
“কী করে ঢুকব! দরজায় তালা দেওয়া, চাবিটা পাছে হারায় বলে মাথার ফাট্টার সঙ্গে সেপটিপিন দিয়ে আঁটা। মাথার ফাট্টা তো তার মাথায়।”
সত্যি বলব কী, সবাই তাজ্জব বনে গেল। গোরুখোঁজা করেও সে লোকটাকে পাওয়া গেল না। ড্রেস সুদ্ধু একেবারে হাওয়া। শেষ পর্যন্ত তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে সবাই একেবারে থ। ঘরের মেঝেতে নারদের ড্রেস পড়ে আছে, যেন কেউ এইমাত্র ছেড়ে গেছে। মাথার জরির ফাট্টার সঙ্গে চাবিটা সেপটিপিন দিয়ে আঁটা। অথচ দরজাটা বাইরে থেকে যেমন তালাবন্ধ করা হয়েছিল, তেমনি ছিল।
অনেক কষ্টে সেদিন কৃষ্ণ করকে ঠাণ্ডা করতে হয়েছিল। ঠাকুমা নিজে এসে তার পায়ে ধরাতে তবে তার রাগ পড়েছিল। পরদিন লোক ডেকে পুকুর ছাঁচা হল; কী জানি জলে ডুবে-টুবে গিয়ে থাকে যদি। কিচ্ছু উঠল না, শুধু রাশি রাশি মাছ আর কচ্ছপ, শ্যাওলা আর কয়েকটা সেকালের ঘটি ঘড়া আর ইস্টিলের একটা মকরের নকশা দেওয়া ক্যাশবাক্স। শ্যাওলা জমে তার দফা শেষ। ঢাকনা খুলতেই ভিতর থেকে কতকগুলো কাগজপত্র আর একটা হীরের কণ্ঠি মাটিতে পড়ল।
তাই দেখে আমার বুড়ো-ঠাকুমা বলে উঠলেন, “আরে, এ যে বুড়োশিবতলার শিবঠাকুরের হারানো গলার কণ্ঠি। আমার শাশুড়ি বলতেন পুরুতঠাকুর ওটাকে সরিয়ে জগা মোড়লের কাছে বন্ধক দিয়ে গাঁজার পয়সা জোগাড় করেছিল।”
তখন সকলের খেয়াল হল। কে যেন বলল, “তাইতো, তাইতো, এই ভাঙা ক্যাশবাক্সটাও তবে বুড়োর সেই দলিলপত্রের হারানো ক্যাশবাক্স। তার উপরেও তো এইরকম মকর নকশা তোলা ছিল বলে শোনা যায়। আর ঐ পচা ধচাগুলো তাহলে কি”— অমনি পাঁচজনে তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল, “দূর, দূর, বাজে বকিসনে। আমাদের দলিল-টলিল ঠিক আছে।”
হীরের কণ্ঠিটাকে শুদ্ধি করে নিয়ে আবার শিবঠাকুরের মাথায় পরানো হল। সেই উপলক্ষে রাতে আমার ঠাকুমা সবাইকে খুব মাছ কচ্ছপ খাওয়ালেন। শোবার আগে বার বার বলতে লাগলেন, “যাক যেখানকার যা সব ভালোভাবে শেষ হল। শিবঠাকুর তাঁর কণ্ঠি ফিরে পেলেন।”
বুড়ো-ঠাকুমা ফিক করে হেসে বললেন, “আর মেজো কর্তাদাদামশায়ের নারদ সাজার সখও মিটল। ওর কাছে কৃষ্ণ কর! কীসে আর কীসে, সোনায় আর সীসে! কপালের মধ্যিখানে কালো কুচকুচে তৃতীয় নেত্রটি দেখেই আমি তাঁকে ঠিক চিনে ফেলেছি।”
তাই-না শুনে তিন-চার জন ধুপধাপ্ মুচ্ছো গেল।