যুগান্তর
ব্যাপারটা ঘটেছিল আমাদের হাফইয়ার্লির ফল বেরুবার ঠিক পরেই। পরীক্ষার আগে দু-তিন দিন ধরে না খেয়ে না ঘুমিয়ে এত পড়লাম, অথচ ফল বেরুলে দেখলাম ইংরেজিতে ২২, বাঙলায় ২৯, আর অঙ্কের কথা নাই বললাম। তাই দেখে শুধু বাড়ির লোকেদের কেন, আমার নিজের সুদ্ধ চক্ষুস্থির। শেষপর্যন্ত বাড়িতে একরকম টেকা দায় হল।
আমার বন্ধু গুপীরও সেই একই অবস্থা। ওর বাবা আরেক কাঠি বাড়া। ক্লাবের নাম কাটিয়ে-টাটিয়ে, মাউথ-অর্গ্যান কেড়ে নিয়ে একাকার করলেন! সন্ধেবেলায় গুপী এসে বলল, “জানিস, মানোয়ারি জেটি থেকে একটা মালবোঝাই জাহাজ আন্দামান যাচ্ছে আজ!” আমার হাত থেকে পেনসিলটা পড়ে গেল, বুকের ভিতরটা ধ্বক করে জ্বলে উঠল। বললাম, “কে বলেছে?” গুপী বলল, “মামাদের আপিস থেকে মালবোঝাই-এর পারমিট করিয়েছে। আজ রাত দুটোয় জোয়ারের সঙ্গে-সঙ্গে ভেসে পড়বে।”
বললাম, “ডায়মন্ডহারবারের কাছেই ওপার দেখা যায় না। আরেকটু এগুলে না জানি কেমন!” গুপী বলল, “যাবি? না কি জীবনটা রোজ বিকেলে অঙ্ক কষে কাটাবি?” পেনসিলটা তুলে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম। বললাম, “পয়সাকড়ি নেই, তারা নেবে কেন?” গুপী বলল, “পয়সা কেন দেব? অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এক সময়ে চড়ে বসে থাকব, মেলা জেলে ডিঙি রয়েছে, তার কোনো অসুবিধা হবে না। তার পর লাইফবোটের ক্যাম্বিশের ঢাকনির তলায় লুকিয়ে থাকতে হয়। তার পর জাহাজ একবার সমুদ্রে গিয়ে পড়লেই হল, ওরও ফেরবার নিয়ম নেই, আমাদেরও নামাবার উপায় থাকবে না! যাবি তো চল্। আজ রাত বারোটায় এসপ্ল্যানেডে তোর জন্য অপেক্ষা করব।”
চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম আন্দামানের ঝিনুক দিয়ে বাঁধানো রাস্তার উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ টিয়া পাখি উড়ে যাচ্ছে, আর মাথার উপর ঘোর নীল আকাশ ঝাঁ ঝাঁ করছে, দূরে সুন্দরী গাছের বন থেকে সারি সারি কালো হাতি বিরাট বিরাট গাছের গুঁড়ি মাথা দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছে। বললাম, “বেশ তাই হবে!”
তার পর যে কত বুদ্ধি করে রাত বারোটায় সেখানে গিয়ে গুপীর সঙ্গে জুটলাম সে আর কী বলব! সঙ্গে একটা শার্ট, প্যান্ট, তোয়ালে আর টর্চ ছাড়া আর কিছু নেই। রাতে খাবার সময় ঐ পুরোনো কথা নিয়ে আবার একচোট হয়ে গেছে। বাড়িতে থাকবার আর আমার একটুও ইচ্ছা নেই। আর গুপীর কথা তো ছেড়েই দিলাম। সে কোনও দিনই বাড়িতে থাকতে চায় না।
গঙ্গার দিকেই যাচ্ছিলাম। অনেকটা এগিয়েছি, লাটসাহেবের বাড়ির গেটটা পেরিয়ে আরো খানিকটা গিয়েছি এমন সময় দেখি ক্যালকাটা গ্রাউন্ডের পাশে, ইডেন গার্ডেনের সামনে দিয়ে একটা প্রকাণ্ড চার ঘোড়ার গাড়ি আসছে। আমরা তো অবাক। জন্মে কখনো চার ঘোড়ার গাড়ি দেখিনি। কলকাতা শহরে আবার চার গোড়ার গাড়ি যে আছে তাই জানতাম না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গেলাম।
দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম চারটে কালো কুচকুচে দৈতোর মতো বিরাট ঘোড়া। তাদের সাজগুলো তারার আলোয় জ্বলজ্বল করছে, ঘাড়গুলো ধনুকের মতো বাঁকা, মাঝে মাঝে মাথা ঝাড়া দিচ্ছে, নাক দিয়ে ফড়র্ ফড়র্ আওয়াজ করছে, ঝন্ঝন্ করে চেন বকলস্ বেজে উঠছে, অত দূর থেকেও সে আওয়াজ আমার কানে আসছে। ষোলোটা ক্ষুর থেকে মাঝে মাঝে স্পার্ক দিচ্ছে। সে না দেখলে ভাবা যায় না।
গাড়িটা ততক্ষণে ইডেন গার্ডেনের পাশ দিয়ে বাঁ-হাতে ঘুরে এসেম্বলি হাউসের দিকে বেঁকেছে। ঐখানে সারাদিন মিস্ত্রীরা কাজ করেছে, পথে দু-একটা ইঁট-পাটকেল পড়ে থাকবে হয়তো। তাতেই হোঁচট খেয়ে সামনে দিককার একটা ঘোড়ার পা থেকে নালটা খুলে গিয়ে শাঁই শাঁই করে অন্ধকারের মধ্যে একটা ভাঙা চক্র এঁকে কতকগুলি ঝোপঝাপের মধ্যে গিয়ে পড়ল। খানিকটা ক্ষুরের খটাখট, চেনের ঝমঝম শব্দ করে, আরো হাত-বারো এগিয়ে এসে, বিশাল গাড়িটা থেমে গেল।
ততক্ষণে আমরা দুজনে একেবারে কাছে এসে পড়েছি। দেখি গাড়ির পিছন থেকে চারজন সবুজ পোশাক পরা, কোমরে সোনালী বেল্ট-আঁটা সইস্ নেমে পড়ে, ছুটে গিয়ে চারটে ঘোড়ার মুখে লাগাম কষে ধরেছে। সামনের দিকের ডান-হাতের ঘোড়াটার চোখের সাদা দেখা যাচ্ছে! আকাশের দিকে মাথা তুলে সে একবার ভীষণ জোরে চিঁ-হি-হি-হি-হি করে ডেকে উঠল। সেই শব্দটা চারদিকে গম্গম্ করতে লাগল। গাড়ির মধ্যে থেকে একজন লম্বাচওড়া লোক নেমে পড়ল।
বোধ হয় ওরা কোনো থিয়েটার পার্টির লোক, কোনো বিদেশী জাহাজে অভিনয় করে ফিরছিল। কারণ লোকটার দেখলাম রাজার মতো পোশাক-পরা, কিংখাবের মখমলের জোব্বা পাজামা, গলায় মুক্তোর মালা, কানে হীরে। আর সে কী ফরসা সুন্দর দেখতে। মাথায় মনে হল সাত ফুট লম্বা। রাজা সাজবারই মতো চেহারা বটে! ততক্ষণে সবাই মিলে অন্ধকারের মধ্যেই নালটাকে খুঁজছে। আমাদের দিকে কারও লক্ষ্য নেই। আমি টপ করে থলি থেকে টর্চটা বের করে টিপতেই দেখি ঐ তো ঝোপের গোড়ায় নালটা পড়ে আছে। রূপোর মতো ঝক্ঝক্ করছে। গুপী ছুটে গিয়ে সেটি হাতে করে তুলে নিল, তখনো একেবারে গরম হয়ে আছে।
নাল হাতে ওদের কাছে গেলাম। এতক্ষণে আমাদের দিকে ওদের চোখ পড়ল। “কোথায় পেলি বাপ্?” “এখানে ঝোপের গোড়ায়”, গুপী ঝোপটা দেখিয়ে দিল। “বাঃ, বেড়ে আলোখানি তো বাপ। ওরাই দিয়েছে বোধ হয়। তা হলে আরেকটু দয়া করে, ঐদিকে কোথায় কামারের দোকান আছে বলে দে দিকিনি, ওটি না লাগালে তো আর যাওয়া যাবে না।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গুপীর দিকে তাকালাম। কামার কোথায় পাব? গুপী বললে, “চলুন, আগে একটা সাইকেল মেরামতের দোকান আছে, তাদের আমি চিনি, তারা করে দিতে পারবে মনে হচ্ছে।”
“তা হলে ওঠ্, বাপ, ওঠ্। আর সময় নেই।”
দুজনে গাড়ির মধ্যে ভদ্রলোকটির পাশে উঠে বসলাম। মখমলের সব গদি! থিয়েটারের লোকেরা আছে বেশ! আর ভুরভুর করছে আতরের তামাকের গন্ধ। ভদ্রলোকের সঙ্গে মেলা দলিলপত্রও রয়েছে দেখলাম!
গুপী বাতলিয়ে দিল, বাঁয়ে ঘুরে ডালহৌসী স্কোয়ারের দিকে পথ, আস্তে আস্তে চললাম! ঘোড়ার পায়ে ব্যথা লাগে। ছোট্ট গলির মধ্যে দোকান। অত বড় চার ঘোড়ার গাড়ি তার মধ্যে ঢুকবে না। ঢুকলেও আর ঘুরবার উপায় থাকবে না। ভদ্রলোক কেবলই তাড়া দিতে লাগলেন, দেরি করলে নাকি নন্দকুমার নামের একটা মানুষের প্রাণ যাবে। তখন গুপী নাল হাতে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে বলল, “এইখানেই দাঁড়ান, আমি গিয়ে যন্ত্রপাতি সুদ্ধ শম্ভুকে ডেকে আনি। তুই আয় আমার সঙ্গে।” অগত্যা দুজনেই নামলাম। শম্ভুকে ঠেঙিয়ে তুলতে একটু দেরি হল। তারপর প্রথমে কিছুতেই বিশ্বাস করে না। “চার ঘোড়ার গাড়ি আবার কী? এ তল্লাটে কোথাও চার-ঘোড়ার গাড়ি হয় না। একটা চার-ঠ্যাংওয়ালা ঘোড়াই দেখতে পাওয়া যায় না, তা আবার চারটে ঘোড়া একগাড়িতে।” শেষটা ঘোড়ার নালটা দেখে একেবারে থ! “এই এত বড় নাল হয় কখনো ঘোড়ার? হাতি নয় তো? হাতির পায়ে আমি নাল লাগাতে পারব না গুপী দাদা, এই বলে দিলাম।”
আমরা বুঝিয়ে বললাম, “চলো না গিয়ে নিজের চোখেই দেখবে। এত প্রকাণ্ড ঘোড়াই দেখলে কোথায় যে এত বড় নাল দেখবে? চলো, তোমার লোহা-টোহা নিয়ে চলো ওঁদের খুব তাড়াতাড়ি আছে, দেরি করলে কার যেন প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে। মেলা কাগজপত্র নিয়ে চলেছেন। চলো। নাও, ধরো, নালটাও তোমার যন্ত্রের বাক্সে রাখ। ভারী আছে”
শম্ভু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। “বড় ঘোড়া হয় না তা বলছি না। ফতেপুরসিক্রি গিয়ে আকবরের ঘোড়ার যে বিরাট নাল দেখে এসেছি, তার পরে আর কী বলি?”
কথা বলতে বলতে গলির মুখে এসে পড়েছি। কিন্তু কোথায় চার-ঘোড়ার গাড়ি? চারি দিক চুপচাপ থমথম করছে, পথে ভালো আলো নেই, একটা মানুষ নেই, কুকুর নেই, বেড়াল নেই, কিছুই নেই। ডাইনে-বাঁয়ে দু দিকে যত দূর চোখ যায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না।
রাস্তার আলোর কাছে গিয়ে কী মনে করে শম্ভু যন্ত্রপাতির বাক্সটা খুলে নালটা বের করতে গিয়ে দেখে বাক্সের মধ্যে নালও নেই। তখন শম্ভু ফ্যাকাশে মুখে আমার দিকে চেয়ে বলল, “ও গাড়ি আরো অনেকে দেখেছে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকে না। ঐ রাজাবাহাদুর মহারাজ নন্দকুমারের প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু সময়কালে পৌঁছতে পারেনি। তোমরা তাই দেখেছ!” বলে আমাদের একরকম টানতে টানতে ওর বাড়ি নিয়ে গেল। পরদিন সকালে যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম। গুপী আর জাহাজের কথা তুলল না।