আলোছায়া
অপরাহ্নে বিজন পথে ঘোর ঘনঘটা করে বৃষ্টি নেমেছিল। দেখছিলাম সুনীল সুঘন মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন। পথের পাশের কৃষ্ণচূড়ার অঙ্গ বেয়ে অবিরাম জলধারা নেমেছে। তারই অন্তরালে কতকালের পুরোনো চকমেলানো ছাই রঙের বাড়ি।
খিলানে তার মাধবীলতার সম্ভার; দেয়ালে অশ্বত্থ গাছের আলিঙ্গন। না আছে দরজা-জানলার কপাট, না আছে জনমানবের বাসের চিহ্ন।
তবু একটা আশ্রয় তো বটে। ঝড়ে-ঝাপটে পথিমধ্যে একাকিনী বিপন্ন নারীর পক্ষে আশার অতীত আশ্রয়।
প্রবেশপথের পুরোনো শ্বেতপাথরের সিঁড়ির মাঝখানটা কোনো বিগত দিনের পাদস্পর্শে ক্ষয়ে গিয়েছে। প্রশস্ত আঙিনার ধারে কবে কে যেন পাথরের নারীমূর্তি সাজিয়ে ছিল। আঙিনার ওপারের শিশুগাছের পাতার নিরন্তর শিহরন তার কানে-কানে কার নামের রোমাঞ্চকর মন্ত্র দিত কে জানে!
আমি সেই ঘন সবুজ পত্রগুচ্ছের উপর অবিরাম বারি-বিন্দুপাত দেখছিলাম। আর কপাটভাঙা বিপুল হলঘরের ধূলিমলিন বিশাল ঝাড়লণ্ঠনের নীরব নিক্কণ ভেদ করে, কারা সব অদৃশ্য অশরীরীদের ক্ষীণতম সাড়াটুকুর জন্য, নিশ্বাস রোধ করে প্রতীক্ষা করেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম ওই পদচিহ্নবিহীন ধূলিরাশির উপর বাইরের পৃথিবীর ঝোড়ো হাওয়ার স্পর্শটুকুও কোনো দিন লাগবে না।
বারান্দার কোণ ঘেঁষে নীলমণি ফুলের লতা। আমি ভাবছিলাম যাদের বাড়ির বুকের কাছে নীলমণি ফুলের ঝাড়, তারা কী করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়? তাদের পুঞ্জীকৃত অশান্ত নিশ্বাসের শেষ কম্পনটুকুও কী করে কালের অতলে বিলীন হয়?
সহসা দেখলাম বারান্দার ভাঙা রেলিং-এর উপর রাখা আমার শামলা রঙের হাতের পাশে দুখানি পদ্মফুলের মতো কোমল গৌর হাত। তার ঈষৎ রক্তিমাভাযুক্ত আঙুলে মরকত মণির আংটি শোভিত। আশ্চর্য হয়ে চেয়ে দেখলাম কোনো অশরীরী নারীর ছায়ামূর্তি নয়, জীবন্ত মানুষ, তার দ্রুত ঘন নিশ্বাসে ত্রস্ত কালো চুল কম্পিত হচ্ছে।
চোখদুটি ঈষৎ পিঙ্গলবর্ণ কিন্তু শুকতারার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। বাঁকা ভুরুর নিচে টানা চোখ সুঘন পল্লবময়। গৌর মুখশ্রী। লাবণ্যময়ী, হাস্যমধুরা। তনুদেহ হয়তো পঞ্চবিংশতি বৎসর ধারণ করেছে, পীতবসনা, মণিবন্ধে মকরমুখী সোনার বালা, কণ্ঠে বেলফুলের গোড়ে মালা শোভা ও সৌরভ বিকিরণ করছে।
সে আমাকে বললে, ‘আমার নাম কৃষ্ণকলি। কেমন নাম?’
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘সুন্দর নাম। তুমিও সুন্দর।’
খুশিতে ঝলমল করে উঠে সে বললে, ‘দেখ, আমার চুল কীরকম কোঁকড়া। দেখ, দেখ, কেমন হাঁটু ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমার মতো গায়ের রং কারো আছে এ দেশে? দেখ, কেমন সোনালীও নয়, গোলাপীও নয়।”
ছোট-ছোট পুষ্প-পেলব হাত দুখানি আমার চোখের সুমুখে নেড়ে বলল, ‘চেয়ে দেখ, রাঙা কোকনদ কেন বলে! দেখ, আমার হাতের নখগুলি যেন ডালিমের কোয়া। সত্যি বল তো, আর কাউকে কখনো দেখেছ, যার মুখ দেখে মনে হয়েছে ইন্দু-নিভাননী?’
আমি অকপট চিত্তে বললাম, ‘না, না, তোমার মতো সুন্দরী আমি এ জন্মে দেখিনি।’
সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, ‘শুধু এ জন্মে দেখনি? বল, হেলেনের ভুরু এরকম ধনুকের মতো ছিল? ক্লিওপেট্রার নাক এমন বাঁশির মতো ছিল? না, না, লোকে বলত আমি তিলোত্তমার মতো সুন্দরী। যেখানে যা কিছু সুন্দর আছে, সব জড়ো করে এনে আমাকে গড়েছিল। সোনা দিয়ে, মুক্তো দিয়ে, হীরে দিয়ে, ফুল দিয়ে, তমালগাছের মাধুরী দিয়ে, সূর্য দিয়ে, নীল আকাশের নীলা দিয়ে আমি তৈরি। সত্যি বল তো জন্মান্তরেও কি আমার চেয়ে সুন্দরী দেখবার আশা কর?’
তার কণ্ঠস্বরে আমারও শিহরন জেগেছিল, আমি বারবার বলেছিলাম, ‘সেরা সুন্দর কি আর জন্মে-জন্মে চোখে পড়ে? লক্ষ কোটি যুগে যদি একবার দেখা যায়, অনন্তকাল ধরে ধন্য হয়ে যেতে হয়।’
আহ্লাদে আটখানা হয়ে সে আমাকে আলিঙ্গন করল। তার রেশমের মতো চুলের গুচ্ছ আমার চোখে-মুখে এসে পড়ল। মালা থেকে দু’-একটি ফুল ঝরে পড়ল।
তখুনি আবার মুখখানি ম্লান হয়ে গেল তার— সূর্যাস্তের বহুক্ষণ পরে দিগন্ত যেমন বিবর্ণ হয়। চোখ থেকে আলোর রশ্মি মুছে গেল। বিষণ্ণ কণ্ঠে সে আমাকে বললে, ‘কিন্তু একটা খুঁত থেকে গিয়েছিল। যেখানে যা কিছু সুন্দর সব দিয়েছিল বিধি। শুধু— হৃদয় দিতে ভুলে গিয়েছিল। তার বদলে দিয়েছিল সাদা মসৃণ একটা পাথর। দেখ, আমার বুকে হাত দিয়ে দেখ, হৃদয়ের স্পন্দন পাও কিনা!”
বাস্তবিক তার পাগলের মতো কথা শুনে আমারও মনে হতে লাগল সত্যিই যেন তার হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করছি না।
সে বললে, “পাথরের কি কখনো স্পন্দন হয়? পাথর দিয়ে কি কখনো ভালোবাসা যায়? জানো, ছোটবেলায় আমি কখনো বেড়ালবাচ্চা কোলে নিইনি। কখনো পাখির ছানার পালকে হাত বুলোইনি। কাউকে ভালোবাসিনি, বাবাকে না, মাকে না।”
হয়তো আমার মুখের ভাবের কোনো পরিবর্তন হয়ে থাকবে। কারণ তখুনি সে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠে আমার হাত ধরে বললে, “না, না, তুমি যতটা ভাবছ, ততটা নয়। তাঁরা কিছুই জানতেন না। তাঁদের একমাত্র সন্তানের যে হৃদয় নেই এ কথা তাঁরা সন্দেহও করেননি। আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম। আমার কর্তব্যবোধ ছিল।”
একটু চুপ করে থেকে সে আবার বললে, “আমার মাসতুতো বোন মেঘমালার সঙ্গে শঙ্কর দেবের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আমাকে দেখে সে আর কিছুতেই মেঘমালাকে বিয়ে করল না। আশীর্বাদের দিন বলে কিনা বিয়ে করবে না। ভাবতে পারো, মেঘমালা কপালে চন্দন পরে, শামলা রং গোপন করে, বালুচরী শাড়ি গায়ে, অপেক্ষা করে রইল, আশীর্বাদই হল না।”
অবাক হয়ে আমি বললাম, “তুমি তাকে বিয়ে করবে?”
বিস্ফারিত নয়নে কৃষ্ণকলি বললে, “আমি কেন বিয়ে করব শঙ্কর দেবকে? কীবা তার রূপগুণ, কীবা তার ধনদৌলত! সে সন্ন্যাসী হয়ে কোথায় যেন চলে গেল।”
“আর মেঘমালা?”
“মেঘমালা? সে নেই।”
একটু পরে সে আবার বললে, ‘রাজারা আসত আমাকে বিয়ে করবার জন্যে। আমি লাল রেশমি শাড়ি পরে সবাইকে প্রত্যাখ্যান করতাম। কেউ বিদেশে চলে যেত, কেউ বিবাগী হত, কেউ আত্মহত্যা করত, কেউ রাগ করে কালো মেয়ে বিয়ে করত।
“তারা আমাকে হীরে-জহরত কিংবা কিংখাব-মখমল উপহার দিত। আর দীপক নামের ছেলেটি গরিব ছিল, সে শুধু ফুল দিত। আর বলত— কী দেব তোমাকে? কিছু নেই যে আমার।— বিরক্ত লাগত এক কথা শুনে শুনে। রসিকতা করে বলেছিলাম— চুরি করেই যদি এনে দিতে না পারলে তবে আর কী ভালোবাসার গর্ব কর?— শেষটা সত্যি কোথা থেকে হীরে-মণি চুরি করে, ধরা পড়ে জেলে গেল।”
আমি নীরব হয়ে রইলাম। কৃষ্ণকলি আমার হাতে একটা ঝাঁকানি দিয়ে বললে, “কতদিন কাউকে মনের কথা বলিনি। আজ তোমাকে পেয়ে আমার কত আনন্দ হচ্ছে। তোমাকে কোথায় বসতে দিই বল তো? আমাদের সেই কারিকুরি-করা চৌকিগুলো যে কোথায় গেল মনে পড়ছে না।”
আমি বললাম, “কৃষ্ণকলি, আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই বল কী বলবে।”
সে বললে, “শোনো, শোনো, আমার প্রিয় বান্ধবী মালবিকার স্বামী আমার জন্য তাকে ত্যাগ করেছিল। কিন্তু আমি তাকে গ্রহণ করিনি। মালবিকা আগে আমাকে বলত রাক্ষসী, আবার শেষে বলত নিষ্ঠুর।
“আমার মতো যাদের রূপ থাকে, যুগে-যুগে তারা তো সংসার পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
মনে আছে মা-বাবা কত ব্যথা পেতেন! তবে বেশিদিনের জন্যে নয়। যুগ-যুগান্তরের বাবা-মাদের সঙ্গে একে-একে তাঁরা অতীতের নীল জলে হারিয়ে গেলেন।
“আমি রইলাম রূপের ডালি আর রাজার ঐশ্বর্য নিয়ে। এতদিনে আমার জীবনে প্রথম রৌদ্রকরস্পর্শ লাগল। আমার যৌবনের কুঞ্জবনে পিককুল ডেকে উঠল, তরুলতা পত্রপুষ্পে মঞ্জরিত হয়ে উঠল। আমার অন্তরের নিভৃত মহলে অমিতাভ এল। আমার বুকের পুরোনো পাথরখানা এক নিমেষে গলে জল হয়ে গেল।
“অমিতাভর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। সাতদিন আমি স্বর্গে বাস করেছিলাম। অষ্টম দিন সকালে উঠে দেখি অমিতাভ আমার সমস্ত হীরে-জহরত সোনা-রুপো, আমার সিন্দুক-ভরা মোহর নিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে।
“আর তাকে দেখিনি।
“তখন মেঘমালার জন্যে, শঙ্করদেবের জন্যে, দীপকের জন্যে, মালবিকার জন্যে আমার মন হাহাকার করে উঠল।”
কৃষ্ণকলি দোতলার ভাঙা খিলান নির্দেশ করে বললে, “ঐখান থেকে আমি নিচে পড়ে গেলাম, যেখানে নীলমণিলতার ঝরা ফুল স্তুপ হয়ে জড়ো হয়েছিল।
“তুমি বল আমার রূপ একটুও ম্লান হয়নি। বল আমার মতো সুন্দরী কেউ নেই পৃথিবীতে। যুগে-যুগে, জন্মজন্মান্তরে, জলে স্থলে শূন্যে কোথাও এমন রূপ দেখেছ, বল আমাকে!”
আমি আবেগে অধীর হয়ে বললাম, “কৃষ্ণকলি, কৃষ্ণকলি, তুমি কে, তুমি কোথায়?”
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, মেঘ কেটে গিয়েছে। ছিন্ন মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ সোনালি রোদ আঙিনাতে এসে পড়ল। সে রোদে কৃষ্ণকলিকে আর দেখতে পেলাম না।
শুধু বাতাসে ভেসে এল আমার কানে-কানে “দুলোকে ভূলোকে আকাশে আলোকে কোথায় এমন রূপরাশি!”