নটরাজ
আমাদের রাঁধবার লোকটির খাসা রান্নার হাত থাকলেও একটা মুশকিল ছিল যে রান্নাঘরে সে কিছুতেই একা থাকবে না। বলুন তো আজকালকার দিনে এসব নবাবী করলে কেমন করে চলে? অথচ দিশি রান্না ছাড়াও সে আশ্চর্য সব বিলিতি রান্না জানত; পুদিনা দিয়ে একরকম অম্বল করত, বাতাসার সঙ্গে তার কোনো তফাত ছিল না। দুধ দিয়ে আর এক চামচ মাখন দিয়ে এমন চিংড়ি মাছ করত সে না খেলে বিশ্বাস হয় না। বন্ধুবান্ধবরাও তারিফও করত যেমন, হিংসাও করত তেমনি। এখন ঐ একটি অসুবিধার জন্য সব না পণ্ড হয়ে যায়।
আমি বললাম, “নটরাজ, তা বললে চলবে কেন, আজকাল একটা লোক পুষতেই ট্যাঁক গড়ের মাঠ! তোমার জন্য আবার একটি সঙ্গী এনে দিতে হবে, এ বাপু তোমার আব্দার। চারটি মনিষ্যির রান্নার জন্য দু-দুটো লোক এ কে কবে শুনেছে?”
নটরাজ মাথা নিচু করে বলল, “ঠিক তা নয়, মা। অন্য লোকটার রান্না না জানলেও চলবে। ওই সামান্য কাজ, সে আমি একাই করে নিতে পারি। সেজন্য নয়।”
অবাক হয়ে বললাম, “তবে?”
নটরাজ মাথা চুলকে বললে, “আসল ব্যাপার কী জানেন মা, রান্নাঘরে একা আমি কিছুতেই থাকতে পারব না।”
“তোর সব তাতেই বাড়াবাড়ি। একা আবার কী? সন্ধেবেলা টিকারামের সেরকম কাজ থাকে না, সে তো স্বচ্ছন্দে ওখানে বসতে পারে। ভূতের ভয় আছে বুঝি? পাড়াগাঁর লোকদের ওই এক মুশকিল। আসলে যে-সব ভয়ের জিনিস, এই যেমন চোর-ছ্যাঁচড়, তার ভয় নেই, দিব্যি পিছনের দরজা খুলে রেখে বিড়ি কিনতে যাবে, অথচ ভূত আছে কি নেই, তারই ভয়ে আধমরা। এটা কি ঠিক উচিত হল বাছা? গাঁ থেকে চলে এসেছিসও তো বহুদিন। আর দিনের বেলায় ভূতের উপদ্রব কে কবে শুনেছে?”
নটরাজ কখনো মুখোমুখি উত্তর দেয় না। নরম গলায় বললে, “গাঁয়ে থাকতে কিছুতেই ভয় করতাম না মা। গাঁ ছেড়ে এসেই তো যত বিপদ।”
আমি চালের বাক্সের উপর বসে পড়ে বললাম, “ব্যাপারটা একটু খোলসা করেই বল না, দেখি কী করতে পারি।”
যেন একটু খুশি হয়ে নটরাজ বললে, “মানুষ সাথী না হলেও চলবে, মা।” শুনে আমি দারুণ চমকে ওঠাতে আরো বলল, “মানে একটা কুকুর হলেও হবে, মা! একটা বড় দেখে কুকুর হলেই সবচেয়ে ভালো হয়।” আমি অবাক হয়ে বসেই রইলাম, নটরাজ বলল, “বুঝলেন মা, বাড়ি আমাদের অজয় নদীর ধারে, ইলেম বাজারের পাশে। বোলপুর সিউড়ির বাস ওর ধার ঘেঁষে যায়। আমাদের মা মহাময়ী এমনি জাগ্রত দেবতা, মা, যে গোটা গাঁটাকে বুকে আগলে রেখেছেন, কারো চুলের ডগা ছোঁয় ভূত-পিরেতের সাধ্য কী! ভূতের ভয় কোনোদিনই ছিল না।
“কিন্তু বাড়িতে খাওয়া জুটত না তাই নকুড়মামার সঙ্গে কলকাতায় এলাম। ঐ যে মিশিন রো, ঐখানে এক বাঙালি সাহেবের বাড়িতে নকুড়মামা চাকরি জুটিয়ে দিলেন। শুনতে বেশ ভালোই চাকরি মা। সাহেবের পরিবার নেই, দিনভর বাইরে বাইরে থাকে, দুপুরে আপিসে খায়, চাপরাশি পাঠিয়ে দেয়, আমি রেঁধে-বেড়ে টিপিনকারিতে গুছিয়ে দিই, সাদা ঝাড়নে পিলেট কাঁটা চামচ বেঁধে দিই; ওদিকে সৌখীনও ছিল মন্দ না। আর সারাটা দিনমান বাড়ি আগলাই, ঝাড়-পোঁচ করি, খাইদাই। আবার বিকেলে রাতের জন্য রাঁধাবাড়া করি, সাহেবের চানের জল গরম করে রাখি। রাত নটা-দশটার সময় সাহেব আসে, প্রায়ই দুটো-একটা বন্ধুবান্ধবও সঙ্গে আনে, তারাও খায়-দায়।
“সারাদিন বেশ যেত মা, ঐ রাতেই যত মুশকিল। সাহেব লোক খুব মন্দ ছিল না, মা, দয়ামায়াও ছিল, আমায় এটা ওটা দিত, দেশের চিঠিপত্তর এল কি না জিজ্ঞাসা করত। কিন্তু বোধ হয় নেশা-ফেশা করত ওরা সবাই, নিশ্চয় করত, নইলে হঠাৎ হঠাৎ এমন সব অদ্ভুত ফরমায়েস করত যে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যেত।
রাতে কীরকম গুম হয়ে থাকত। আমার দিকে চাইত যখন চোখ দুটোকে দেখে মনে হত, যেন ছেলেদের খেলার দুটো গোল গাল মাৰ্বল। কীরকম একদৃষ্টে চেয়ে থাকত, কথা বলত না, আমার বুকটা ঢিপ্ঢিপ্ করতে থাকত। ভাবতাম চলে যাই, আবার দেশের বাড়ির অভাব অনটনের কথা মনে করে থেকে যেতাম। অন্য সময় সত্যি লোক ভালোই ছিল। রাতে বদলে যেত।
“আমরা মিশিন রো’র ঐ আদ্যিকালের পুরোনো বাড়িটার তিন তলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকতাম। রান্নাঘরের পাশে চাকরদের সিঁড়ি, তারই ওধারে পাশের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের দরজা। তাইতেই আমার সুবিধা হয়ে গিয়েছিল। ঐখানে এমন ভালো এক মেম থাকত মা, আধ বুড়ি, সবুজ চোখ, লাল চুল, দিব্যি বাংলা বলে, আর মা, দয়ার অবতার।” বলে নটরাজ বোধ হয় তারই উদ্দেশে বার বার নমস্কার করল।
“বিপদে পড়লেই আমাকে বাঁচাত। দোরগোড়ায় একবার দাঁড়ালেই হল। কী করে যেন টের পেয়ে যেত, অমনি দরজা খুলে বেরিয়ে আসত।
“আজ আবার কী চায়? সাদা সির্কা? তা অত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? এই নে।’ বলে হয়তো একটা গোটা বোতলই দিল আমার হাতে। কাজ শেষ হলে কিছু বাকি থাকলে ফিরিয়ে দিতাম।
“কিংবা হয়তো, ‘কী হল আবার? গুলাস? আয় আমার সঙ্গে।’ ওদের রান্নাঘরটি মা সাক্ষাৎ স্বগ্গ! কী ছিল না সেখানে? যা দরকার দেরাজ খুলে, ডুলি খুলে বের করে দিত। সব ঝক্ ঝক্ তক্ তক্, করত। বাসনের পিঠে মুখ দেখা যেত। ঐখানেই মা ওনার কাছেই আমার রান্না শেখা, সকালে কি দিনের বেলায় কত যত্ন করেই যে শেখাত, মা। নইলে আর পাড়াগাঁয়ের মুখ্যু ছেলে আমি, এত সব জানব কোত্থেকে!”
“তাই বল নটরাজ, আমি বলি এত ট্রেনিং কোথায় পেলি? তাপ্পর, ও চাকরি ছাড়লি কেন?”
“ছেড়েছি কি আর সাধে, মা। একটি বচ্ছর এক নাগাড়ে কাজ করেছিলাম, একবারও দেশে যাইনি। কলকাতায় ঐ এক নকুড়মামাকে চিনি, তা সেও আমাকে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়ে এমনি ডুব মারল যে বচ্ছরান্তে তার আর পাত্তা পেলাম না। কেউ আমার সঙ্গীসাথী ছিল না, মা। বয়সটাও বেশি ছিল না, এমনি দারুণ মন খারাপ হয়ে যেত, মা, সময়ে সময়ে, মাঝে মাঝে দুপুরে হাঁটুর উপর মুখ গুঁজে কান্নাকাটি করতাম!
“একদিন মেম টের পেয়ে আমাকে একটি সুন্দর ছবির বই দিয়ে গেল— বিলেত দেশের কত ছবি। পেরথম পাতায় মেয়ের নাম ছিল, সে তো আমি পড়তে পারি নে, বলেছিল ওটা কেটে আমার নাম লিখে নিতে। করেছিলামও তাই। কিন্তু ও চাকরি আমার আর বেশিদিন টিকল না।
“একদিন রাত্রে সাহেবকে খাইয়ে-দাইয়ে রান্নাঘরে এসে বইটা ঘাঁটছি, আর থেকে থেকে মেমের দরজার দিকে তাকাচ্ছি, ভোরের চায়ের দুধ ছিঁড়ে গেছে, তাই ও আমায় এক কাপ দেবে বলেছিল। এমনি সময় বোধ হয় আমাকে ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া না পেয়ে, সাহেব এসে হাজির।
“আমার তো হয়ে গেছে, বুঝতেই পারছেন! রাগে সাহেবের মুখ লাল হয়ে উঠেছে, রাতে ঐরকম সামান্য কারণেই রেগে চতুর্ভুজ হয়ে উঠত। কী একটা বলতে যাবে, এমনি সময় বইটার উপর চোখ পড়ল!
“অমনি কী বলব মা, ওর মুখটা দেয়ালের মতো সাদা হয়ে গেল, দেহটা কাঁপতে লাগল। পাগলের মতো ছুটে এসে আমার গলা টিপে ধরে ঝাঁকাতে লাগল, ‘বল হতভাগা, ও বই কোথায় পেলি?’ অনেক কষ্টে বুঝিয়ে বলাতে, কীরকম অদ্ভুত করে হেসে বলল, ‘আমার সঙ্গে চালাকি! ওখানে মেম থাকে না আরো কিছু! ওটা আগাগোড়া গুদোমখানা, আমাদেরই অফিসের গুদোমখানা, কেউ থাকে না। বল্ কে তোকে এ সব শিখিয়েছে? নইলে মেরেই ফেলব। জানিস দরকার হলে মানুষ মারতেও আমার বাধে না।’
“ভয়ে কেঁদে তার পায়ে পড়ছিলাম, মা। বার বার বলতে লাগলাম ঐ রান্নাঘরে খোঁজ করতে, মেম নিশ্চয় স্বীকার করবে ও বই ও-ই দিয়েছে। তাই শুনে রাগে অন্ধ হয়ে সাহেব ছুটে গিয়ে দরজায় দমাদম কীল মারতে লাগল। কীলের চোটে দরজার ভিতরকার ছিটকিনি খসে গেল, দরজা খুলে গেল।
“অবাক হয়ে দেখলাম, কোথায় ঝকঝকে রান্নাঘর! এ ঘরের ছাদ থেকে মেজে অবধি পোকা খাওয়া কাগজপত্রে ঠাসা।
“সাহেব আমাকে ঘাড় ধরে এ ঘর থেকে ও ঘর নিয়ে ঘুরিয়ে আনল। কোথাও মানুষের বাসের কোনো চিহ্নই নেই মা, শুধু খাতাপত্র, কাগজের তাড়া।
“তার পর আবার ফিরিয়ে এনে, ওদের রান্নাঘরের দরজা ভেজিয়ে, আমাকে তেমনি করে ধরে আমাদের রান্নাঘরে এসে ঢুকল। এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। কিন্তু মা, তার ঐ মার্বেল পাথরের মতো চোখের কথা মনে করে এখনো গা শিউরে ওঠে। ঐরকম অদ্ভুত করে আমার দিকে চেয়ে, বইটাকে আমার মুখের কাছে তুলে ধরে, চাপা গলায় বলল, “শেষবারের মতো জিজ্ঞাসা করছি, কে তোকে আমার পেছনে লাগিয়েছে? এ বই কোথায় পেলি? মেমের কথা কে বলেছে?” সত্যি বলব মা, তখুনি আমি ভয়ের চোটেই মরে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়, ক্যাঁচ করে অন্য রান্নাঘরের দরজাটা খুলে গেল; সবুজ চোখ, লাল চুল, আধাবয়সি মেমটি আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে, সাহেবের হাত থেকে বইটা টেনে নিয়ে আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে আস্তে আস্তে আবার ওই রান্নাঘরে ঢুকে গেল, দরজাটা আবার ক্যাঁচ করে বন্ধ হয়ে গেল। আর সাহেবও গোঁ গোঁ শব্দ করে অজ্ঞানই হয়ে পড়ে গেল, না মরেই গেল সে আর আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম না; হুড়মুড় করে ঐ পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে, সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে বিনা টিকিটে একেবারে দেশে চলে গেলাম।”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, “তার পর সাহেবের খবর নিলি না?” নটরাজ বললে, “ও বাবা! আমি আর সেখানে যাই! পাঁচ বচ্ছর দেশে বসে রইলাম। রোজই ভয় হত ওই বুঝি পুলিশ এল সাহেব কী করে ম’ল জিজ্ঞাসা করতে। কিন্তু সে মরেনি নিশ্চয়।”
“তার পর দেশে খাওয়া জোটে না মা, তাই আবার এলাম কাজ করতে! এইখানেই মন বসে গেছে মা, যদি একটি বড় দেখে কুকুর রাখেন তো থেকেই যাই।”
আমি চিন্তিত হয়ে বললাম, “কুকুরে কি ওনাদের ঠেকাতে পারে রে।” নটরাজ জিব কেটে বললে, “ছি ছি! ও কথা ভাবলেও পাপ। ওনার জন্য কুকুর নয়, বলি কী সাহেবটা যদি আমার খোঁজ পায় তাই।”