নাথু

নাথু

আমার বন্ধু বটু নিজে কখনও নাথুকে দেখেনি। গল্প শুনেছে। ওর দাদুর বাড়িতে সে আসত। দাদু বললেন, “ওর ভালো নাম হল নাথিং, তার থেকেই ছোট করে হয়েছে নাথু। দেখিসনি, কেমন কেউ-না হয়ে থাকে। ঘরে থাকলেও মালুম দেয় না। আগে নাকি কোন সার্কাসের ম্যাজিশিয়ানের চ্যালা ছিল। ম্যাজিশিয়ান মলে অর্ডার-সাপ্লায়ার হয়েছে।”

যা বলা যায় এনে দেয়। ইনকম ট্যাক্সফ্যাক্স দেয় না নিশ্চয়। পারমিটেরো ধার ধারে না। কেউ কিছু বলেও না। কারো চোখে পড়লে তবে তো বলবে। ঘরে ঢুকলে একেবারে দেয়ালের সঙ্গে মিশে থাকত। পথে বেরোলে, ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যেত। বটুর দাদুর বাড়ির লোকরা ওকে এতকাল দেখেছে, তবু কেউ ওর নাক মুখ চোখ কান আলাদা করে মনে করতে পারে না। স্রেফ একটা বড় জনতার গড়পড়তা চেহারা নিয়ে, লোকটা সকলের চোখের সামনে নিখোঁজ হয়ে থাকে! রোগাও না, মোটাও না; লম্বাও না বেঁটেও না; কালোও না, ধলাও না; কাপড়চোপড় হল ভিড়ের অন্য প্রত্যেকটা লোকের মতো! কে চিনে রাখবে ওকে!

নাথুর পথ চেয়ে থাকত সবাই। আসত হয় ভোরে, পুরুষেরা কাজে বেরোবার আগে, নয়তো সন্ধ্যায় তারা ফিরলে পর। ধামু মাঝে মাঝে বলতেন, “আহা, বড় উপকার করে আমাদের। যে-সব জিনিস বাজারে মোটে পাওয়া যায় না, কত কম দামে সে-সব জোগাড় করে আনে কোত্থেকে তাই ভাবি। আমার ডাইবিটিসের ওষুধটা ডাক্তারবাবু কোথাও পেলেন না, আর ও ঠিক এনে দিল!”

বড় জ্যেঠিরা কিছুদিন হল পুনে থেকে বদলি হয়ে এসেছিলেন। নাথুকে আগে দেখেননি। একটু কড়া গলায় বললেন, “কিন্তু আনলে কী করে? কোম্পানি তো বন্ধ হয়ে আছে।’ ধামু শুনে অবাক! তা হলে আনল কী করে?” “কী করে আবার, নিশ্চয় ওর চোরাই কারবার। বে-আইনীভাবে সব হয়। কোনোদিন না আমাদের সুদ্ধু হাতে হাতকড়া পড়ে!”

বড় জ্যাঠা কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন, “তোমার যত বাজে কথা! চোরাই কারবার আবার কী? ছোটবেলা থেকে দেখেছি আমাদের যখন যা দরকার হয়েছে, সব এনে দিয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চিনি চাল ময়দা তেল, সব এনে দিত। কেউ পেত না, আমরা পেতাম। দামও বেশি নিত না।”

বড়জ্যেঠিমা তেরিয়া হয়ে উঠলেন, “কী এমন মন্দ বললাম? যা কেউ পায় না, তা ও পায় কোথায়? কালো-বাজারে ছাড়া আবার কোথায়? আমাদের উপকার হতে পারে, কিন্তু কাজটা বে-আইনী। ওকে পুলিশে দেওয়া উচিত। তোমাদের মায়া লাগে তো আমি দেব। দাদা স্পেশ্যাল পুলিশের বড় অফিসার। তাঁর কানে একবার কথাটা তুলে দিলেই হল। যাবেন বাছাধন শ্রীঘরে!”

ছোড়দাদু বেজায় চটে গেলেন, “তা তো বটেই। তা হলে কবে কোন ঘোড়া জিতবে কে খবর এনে দেবে শুনি? ড্রাইভার ছাড়াতে গাড়ি বেচতে হবে! বেশ তো ছিলে বাপু পুনেতে, আবার বদলি হয়ে আসবার কী দরকার ছিল? যার যা পেশা। ওর ব্যাপারে তুমি নাক গলিও না।”

বড়জ্যাঠা আবার মুখ তুললেন, “লোকের উপকার করা কিছু খারাপ কাজ নয় বড়বউ। চুরি-ডাকাতি নয়, কিছু না!”

“খারাপ কাজ কি না জানি না, তবে বে-আইনী কাজ।” এই বলে জ্যেঠি রাগ করে চলে গেলেন।

ছোড়দাদু এক দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন, সবই তো এনে দেয়। কিন্তু বুধবার আমাদের চারজনের জন্য দিল্লি যাবার চারটে থ্রি-টিয়ারের টিকিট যদি দিতে পারত, ক্রিকেট খেলাটা দেখে আসা যেত।”

বটুর বড়জ্যাঠার ছেলে নিখিলেশ ওই বাড়িতে থেকেই পড়াশুনো করত। নাথুর সঙ্গে বেজায় ভাব ছিল। সে বলে বসল, “মা যদি নাথুকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়, আমি কিন্তু নিরুদ্দেশ হয়ে যাব। তোমরা কাগজে ‘মাদার ইল কাম ব্যাক!’ লিখলেও ফিরব না। অ্যানুয়েলের আগে তোমরা সবাই আমাকে কী না বলেছিলে, কিন্তু কেউ কোনো উপায় বাতলাওনি। শেষটা ওর কাছে দুঃখ জানাতে, পরদিন থলি থেকে একটা চিরকুট বের করে দিল, তাতে সব সাবজেক্টের ইম্পর্ট্যান্ট প্রশ্ন আর তার উত্তর লেখা ছিল। সেইটে পড়েই না তরে গেলাম।” এই বলে নিখিলেশ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিল। কাঁদতে কঁদতে বলল, “বলেছিল আমার বাপ-ঠাকুরদার কাছে ঋণী। পয়সা নেয়নি!”

তাই শুনে সবাই ব্যস্ত হয়ে বলল, “অ্যাই চুপ, চুপ! তোর মা শুনতে পেলেই হয়ে গেল!” ঠিক সেই সময় নাথু এসে দেখা দিল। হাতে সেই নেই-রঙা ক্যাম্বিসের থলি, জিনিসপত্র এমনি ঠাসা যে মাটিতে রাখতে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কখন যে নিঃশব্দে দরজা খুলে ফুশ করে ঘরে ঢুকেছিল কেউ টের পায়নি। ঐরকম ওর যাওয়া আসা। বড় জ্যেঠি একদিন বলেছিলেন, “দুষ্কৃতকারীদের সর্বদা পা টিপে টিপে চলতে হয়, নইলে ধরা পড়বে যে! তোমাদের পেয়ারের নাথু যদি আপিং-কোকেন সরবরাহ করে, তা হলেও আশ্চর্য হব না!”

কথাটা কারো পছন্দ হয়নি। বড় জ্যেঠি তবু ছাড়েননি, “উপকার করে আমাদের সকলকে পাপের ভাগী করে। নইলে আমাদের সঙ্গে ওর কী! এত উপকার করে নাকি কোনো ভালোমানুষের বেটা। হুঁঃ আমরা কি ওর বাপের পিতেমো!”

সেদিন বড় জ্যেঠি চলে গেলে দাদু বলেছিলেন, “আমরাও যে একেবারে কখনোই ওর উপকার করিনি তা নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কোথায় যেন অনেক টাকা লোন্‌ নিয়ে শোধ করতে পারছিল না। মিলিটারি ব্যাপার। ওর নামে হুলিয়া বেরিয়েছিল। আমি উকিল পাঠিয়ে ঐ লোন্‌ শোধ করে দিয়েছিলাম। তার আগে নাপতেনী সাজিয়ে আমাদের এই বাড়িতে ওকে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের শখের থিয়েটার ছিল, তাই মেলা উৎকৃষ্ট দাড়ি গোঁপ পরচুলা থাকত আমার কাছে। তবে সে অনেক দিনের কথা: নাথু না হয়ে, ওর বাবাও হতে পারে। তারও নাম নাথু ছিল।”

বড়পিসি রেগে গেলেন, “কী যে বল বাবা, নাথু আবার একটি পদবী নাকি যে বাপও নাথু ছেলেও নাথু।” “তা হবে না কেন? দেবনাথ যদি একটা পদবী হতে পারে, নাথুলালই বা হবে না কেন?”

সেদিনের কথা থাক। মোট কথা আজও নাথু এল, গলাভরা হাসি, থলি ভরা জিনিস। এসেই বলল, “কিছু দরকার নাকি, স্যার?” ছোড়দাদু রসিকতা করে বললেন, “তা দরকার বই কী। বুধবারের জন্য চারটে দিল্লি যাবার থ্রি-টিয়ারের টিকিট দিতে পারিস?” নাথু বলল, “পারি স্যার, আছে আমার কাছে।”

এই বলে থলি থেকে বের করে দিল। সবাই হাঁ! ছোড়দাদুর চোখ কপালে উঠল, “কী করে পেলি, নাথু?” নাথু মুচকি হাসল, “সে এক খোদ্দের ফরমায়েস করেছিল স্যার, তা তার বাড়িতে ব্যামো। তাই নিল না। ১০% রিবেট আছে স্যার।’ বলা বাহুল্য নগদ টাকা দিয়ে তখুনি ছোড়দাদু টিকিট নিতে প্রস্তুত। নাথু টাকা নিল না। “থাক স্যার, তা হলে পুরোনো ধারটা পুরোপুরি শোধ হয়ে যায়। বড়কর্তা তো জানেন সব।”

বড় জ্যাঠাও খুব হাসলেন, “তুমি আমাদের এত উপকার কর নাথু, কিন্তু আমার গিন্নি তোমাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। চেনেন না তো। মফঃস্বলের মেয়ে। ছিলাম পুনেতে। বলেন যে, তুমি আপিং-কোকেন সরবরাহ করলেও আশ্চর্য হবেন না। আছে নাকি তোমার কাছে?”

নাথু লাফিয়ে উঠল, “তা বলতে হয় স্যার। এই নিন।” এই বলে থলি থেকে দুটো খুদে শাদা প্যাকেট বের করে বাড়িয়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে খাবার ঘরের দরজার পরদা সরিয়ে বড় জ্যেঠির স্পেশ্যাল পুলিশ দাদা ঘরে ঢুকে কাষ্ঠ হেসে বললেন, “বাঃ, একেবারে বমাল সমেত হাতে হাতে! না, নড়বে না! প্যাকেটসুদ্ধ দুহাত ওপরে তোল! টোপল, মগনলাল, হাতকড়া লাগাও, থলি তল্লাশ কর।”

বাকি সকলের চক্ষু চড়কগাছ। ই কী কাণ্ড! বড় জ্যাঠা চটে লাল, “দেখ জ্যোতিষ, বাড়াবাড়ি ভালো না। নাথুকে আজন্ম চিনি, ওর মতো সৎ উপকারী লোক—” সেদিকে কান না দিয়ে বড়জ্যেঠির দাদা আঁতকে উঠলেন, “আরে, আরে, এ কী! এক মুহূর্তের জন্যে চোখ ফিরিয়েছি, এরি মধ্যে লোকটা গেল কোথায়! মগনলাল, ক্যা হুয়া?” টোপল আর মগনলাল হাতকড়া হাতে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। “এ কী তাজ্জব-কি ব্যাপার, স্যার? সিরেফ দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেল!!”

স্যার রেগে গেলেন, “ক্যা দেখতা? খানাতল্লাশি কর!” ওরা ছুটে বাড়িময় তাকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। স্যার নিজে থলিটা তুলে নিয়ে হাঁ। তাতে এক্কেবারে কিচ্ছু নেই! ছুঁতেই প্যাত প্যাত করে কাত হয়ে পড়ল। কী করে অমন ঠাসা দেখাচ্ছিল কে জানে। বলা বাহুল্য, শেষ পর্যন্ত কিচ্ছু পাওয়া গেল না। না মানুষ, না জিনিস!

বড় জ্যেঠির দাদা অপ্রস্তুতের একশেষ। পারলে বড় জ্যাঠার পায়ে ধরেন। সম্পর্কে বড় হলেও, বয়সে ৫ বছরের ছোট। “কিছু মনে কর না, বকুদা; মিনু যে কী বাজে খবর দেয়, তার ঠিক নেই। ছোটবেলা থেকে ঐ সন্দেহবাতিক। যেন দুনিয়াসুদ্ধ ও ছাড়া সবাই দুষ্কৃতকারী! ভালো মানুষটাকে ভয় দেখিয়ে ভাগাল! আমার লোকগুলোরও বুদ্ধির বহর দেখলে? নাকি দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেল! তাই পারে কখনো জ্যান্ত মানুষে!” জ্যেঠির দাদা চলে গেলে, কারো মুখে কথা নেই। খানিক বাদে ভয়ে ভয়ে পকেটে হাত দিয়ে ছোড়দাদু লাফিয়ে উঠলেন, “আরে৷ টিকিটগুলো তো ঠিকই আছে দেখছি!”

আর আসেনি নাথু। পরে ওর থলিটাকেও বটুরা খুঁজে পায়নি। ছোড়দাদুর কী দুঃখ, “আশা করি ও ভাবেনি আমরাই ওর পেছনে পুলিশ লেলিয়েছি।”

বড় জ্যাঠা মাথা নাড়লেন, “না, তা ভাবেনি। পুরনো ধার শোধ হয়ে গেছে, তাই আর আসার দরকার নেই। তবে শেষবার এই খারাপ ব্যবহারটা পেল, এই যা দুঃখ।” বড় জ্যাঠা জোরে জোরে নাক টানতে লাগলেন। এই হল বটুর গল্প।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *