সোফোক্লেস (আনু. ৪৯৫-৪০৬ খ্রি. পূ.) – গ্রিক ট্র্যাজেডি নাট্যধারার রূপকার
গ্রিক ট্র্যাজেডি নাটকের তিন পুরোধা পুরুষের অন্যতম হলেন সোফোক্লেস (Sophocles)। এঁর আদিপুরুষ এসকাইলাস, তারপর সোফোক্লেস এবং শেষের জন হলেন ইউরিপিডিস। এই তিন ব্যক্তিত্বকে ভিত্তি করেই গ্রিসের নাট্যধারার আদিপর্বের বিবর্তন সাধিত হয়েছিল।
আদিপর্বের গ্রিক নাটকের মূল প্রতিপাদ্য ছিল অপার্থিব রহস্যময় ব্যক্তিসমূহের সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম এবং এর থেকে বিস্ময়, হতাশা, ট্র্যাজেডি, পরাজয় ও ধ্বংস; দৈবশক্তির হাতে মানুষের পরাজয় ও মৃত্যু। এই ধারার আদিপুরুষ এসকাইলাসের নাটকের অধিকাংশ স্থান জুড়ে ছিল গীত ও আবৃত্তিগান। এর মধ্য দিয়েই আবর্তিত হয় মানুষের জীবনে দৈবশক্তির জটিল ক্রিয়া-প্রক্রিয়া, তার কর্ম, ফলাফল এবং অপ্রতিরোধ্য নিয়তির প্ৰশ্ন ইত্যাদি।
তবে সোফোক্লেসে এসে এই গান ও আবৃত্তির প্রাধান্য কিছুটা সংযত রূপলাভ করে। প্রাধান্য লাভ করে ঘটনা ও চরিত্রচিত্রণ। কোরাস সরে যায় ঘটনাকেন্দ্রের এক প্রান্তে। এবং সর্বশেষ মহাবলী ইউরিপিডিসে এসে এসব কোরাসের ভূমিকা আরও গৌণ হয়ে পড়ে।
গ্রিক ট্র্যাজেডি নাট্যধারার মাধ্যম পুরুষ সোফোক্লেসের জন্ম ৪৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের কাছাকাছি কালোনাস নামক একটি গ্রামে। পিতা সফিলাস ছিলেন এথেন্সের একজন দক্ষ কর্মকার। তিনি তৈরি করতেন যুদ্ধের সৈনিকদের বর্ম।
যে সময়ে সোফোক্লেস জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে সময়টা ছিল বড় উদ্দাম সময়। পারস্য বাহিনী আক্রমণ করেছিল গ্রিস। বিদেশি আক্রমণের হাত থেকে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সারা দেশ তখন যুদ্ধরত। এটাই ইতিহাসে সালামিসের যুদ্ধ নামে খ্যাত।
স্বদেশ রক্ষার উদ্দাম তরঙ্গ এসে আন্দোলিত করেছিল সোফোক্লেসকেও। তিনি ও একদিন তারুণ্যের উদ্দীপনায় নেমে পড়েন যুদ্ধে। একজন বীর সৈনিক দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিজেকে ব্যাপৃত করেন। শেষত দেশ হয় শত্রুমুক্ত।
যুদ্ধজয়ের পর তাঁর ওপর অর্পিত হয় আরও বড় গুরুদায়িত্ব। তাঁকে দেয়া হয় সারা দেশের যুবসমাজের নেতৃত্বের ভার। উল্লেখ্য, ঠিক এই সময়েই গ্রিক ট্র্যাজেডি নাট্যধারার শেষ মহাপুরুষ ইউরিপিডিসের জন্ম হয়।
যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর সোফোক্লেস মনোনিবেশ করেন সাহিত্যসাধনায়। তিনি গ্রিক ট্র্যাজেডি সম্পর্কে পাঠগ্রহণ করেন এসকাইলাসের কাছে। তবে এসকাইলাস তাঁর শিক্ষাগুরু হলেও স্বীয় প্রতিভা ও দক্ষতার গুণে তিনি গুরুকেও ছাড়িয়ে যান এক সময়ে।
ভায়োনিসিয় নাট্যোৎসবের এক প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম বারের মতো যোগদান করেন। পরে ৪৫২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আয়োজিত আরেক প্রতিযোগিতায় তিনি গুরু এসকাইলাসকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
এসকাইলাস নিজের পরাজয়ে আহত হলেও নিজের শিষ্যের কৃতিত্বে খুশি হন। কারণ সেও তো প্রকৃত পক্ষে তাঁরই বিজয়।
শুধু সাহিত্য-সংস্কৃতি নয়, রাজনীতির সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন সক্রিয়ভাবে। তিনি বহু সময় রাষ্ট্রের অনেক গুরুদায়িত্বও পালন করে গেছেন এবং পরিচয় দিয়েছেন দক্ষতার। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত মধুর এবং সুদৃঢ়। অ্যারিস্টোফানিস তাঁর ‘ফ্রগ’ নাটকে সোফোক্লেসের এই ব্যক্তিত্বের মধুরতারই সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন।
সোফোক্লেস নাটক রচনা করেছিলেন বহু, কিন্তু তাঁর সবগুলো নাটক আজ আর পাওয়া যায় না। এর মধ্যে যেগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো :
১. আয়াক্স (Ajax) : রচনাকাল ৪৫০ থেকে ৪৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে; ২. আন্টিগনে (Antigone) : রচনাকাল ৪৪২ থেকে ৪৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে; ৩. দি ওমেন অব ট্রাচিস (The Women of Trachis) : রচনাকাল ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে; ৪. ইডিপাস দি কিং (Oedipus The King) : রচনাকাল ৪৩০ থেকে ৪২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে; ৫. ইলেকট্রা (Electra) : রচনাকাল ৪০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে; ৬. ফিলোক্টেটিস (Philoctetes) : রচনাকাল ৪০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে; ৭. ইডিপাস অ্যাট কলোনাস (Oedipus at Colonus) : রচনাকাল ৪০৪ থেকে ৪০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। গ্রিক ট্র্যাজিক নাটকের আঙ্গিক গঠনেও সোফোক্লেসের সাফল্য ও বৈশিষ্ট্য ছিল অনেক। যেমন :
১. এসকাইলাসের নাটকের কোরাসে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিলো ১২ জন, সোফোক্লেস এই সংখ্যা বাড়িয়ে করেন ১৫ জন; ২. তিনি নাটকে কোরাসের প্রাধান্য হ্রাস করেন; ৩. গ্রিক ট্র্যাজিক নাট্যকারদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা ছিলেন তিনি; ৪. মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটলের মতে, সোফোক্লেসই প্রথম সার্থকভাবে নাটকে অঙ্কিত পশ্চাদ্পটের ব্যবহার শুরু করতে সক্ষম হন; ৫. তিনি এসকাইলাসের মতো ত্রয়ী নাটক রচনা করতেন না। তাঁর প্রতিটি নাটক ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। অবশ্য তাঁর আন্টিগনে, ইডিপাস এবং ইডিপাস অ্যাট কলোনাস—ত্রয়ী নাটক বলে পরিচিত ছলেও তিনটিই স্বয়ংসম্পূর্ণ।
সোফোক্লেসের প্রাপ্ত নাটকগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটক হল ‘ইডিপাস’। শুধু সেকালে কেন, আজও এই নাটক বিশ্বের সর্বাধিক প্রচারিত ও জনপ্রিয় নাটকগুলোর অন্যতম। এতে বর্ণিত হয়েছে এক বেদনাদীর্ণ ও ভয়াবহ করুণ কাহিনী, যার তুলনা শুধু গ্রিক সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিরল।
পৃথিবীর প্রজাধন্য ও পরাক্রমশালী রাজা ইডিপাস, যিনি যৌবনে আপন বিজ্ঞতায় দানব স্ফিংসের ধাঁধার জবাব দিয়ে দেশকে করেছিলেন অভিশাপমুক্ত এবং নিজে লাভ করেছিলেন গ্রিসের সিংহাসন। কিন্তু পরে আবিষ্কার করেন যে, তিনি অজ্ঞতাসারে হত্যা করেছেন তাঁর পিতাকে এবং দৈবক্রমে যাঁকে বিয়ে করেছেন, তিনি তাঁর আপন জননী। অথচ এটাই ছিল তাঁর নিয়তির লিখন, যাকে এড়ানোর জন্য শিশুকালেই পিতা কর্তৃক হয়েছিলেন পরিত্যক্ত। কিন্তু নিয়তির বিধান তিনি এড়াতে পারেননি।
এই নিষ্ঠুর সত্য জানার পর তিনি লজ্জায়, ক্ষোভে আর দুঃখে নিজের চোখ নিজেই উপড়ে ফেলেন এবং রাজ্য ছেড়ে চলে যান নির্বাসনে। এমন মর্মান্তিক কাহিনী বিশ্বে আর সৃষ্টি হয়নি। সোফোক্লেস মানবমনের এই জটিলতাকে তুলে ধরেছেন অপূর্ব কুশলতায়। তাঁর নাটকের কাহিনী সূত্রেই পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত হয়েছে একটি মনোবিজ্ঞানিক সূত্র, যা ‘ইডিপাস কমপ্লোক্স’ নামে বিশ্ৰুত।
এই মহান নাট্যকারের মৃত্যু হয় ৪০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।