মহাকবি কালিদাস (আনু. ৫৭০-৬৫০ খ্রি.) – সংস্কৃতি সাহিত্যের অমর কবি
কিংবদন্তির একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। প্রাচীন ভারতীয় রাজ্য উজ্জয়িনীতে কমলা নামে এক বিদুষী রাজকন্যা ছিল। সে ছিল বড় দেমাকি। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, যে তাকে শাস্ত্রীয় তর্কে হারাতে পারবে, তাকেই সে স্বামী বলে বরণ করবে।
কিন্তু সেই তর্কে আর কেউ তাকে হারাতে পারে না।
অবশেষে রাজধানীর সব পণ্ডিত যুক্তি করে কমলাকে জব্দ করার জন্য বেছে বেছে এক মূর্খকে ধরে পাঠালেন রাজকন্যার কাছে। মূর্খ লোকটা পণ্ডিতদের নির্দেশমতো শুধু বোবার ভূমিকায় অভিনয় করে রাজকন্যাকে হারিয়ে দিল।
এরপর কমলার বিয়ে হলো সেই বোকার সাথেই। তখনও সে জানে না তার স্বামী এক আস্ত মূর্খ। কিন্তু বাসরঘরে গিয়েই কন্যা জানতে পারল তার স্বামীর আসল পরিচয়। তখন সে রাগে-দুঃখে স্বামীকে সেই বাসরঘর থেকেই বের করে দিয়ে বলল, কোনোদিন যদি বিদ্যা অর্জন করে মানুষ হতে পার, তবেই ফিরে এসো।
এই যে রাজকন্যার স্বামীরূপী বোকা লোকটি, ইনিই ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের অমরকাব্য ‘মেঘদূতম’-এর কবি কালিদাস। প্রবাদ আছে, তিনি নাকি বাল্যে সত্যি সত্যি এমনি নিরেট মূর্খ ছিলেন। স্ত্রীর কাছে অপমানিত হয়ে বিদ্যার্জনের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ জন্মে। তিনি শুরু করেন বিদ্যার্জন। অবশেষে বেদ, পুরাণ, ইতিহাস, অর্থশাস্ত্র ও কাব্যে সুপণ্ডিত হয়ে সগৌরবে ফিরে আসেন স্ত্রীর কাছে।
মহাকবি কালিদাস সম্পর্কে এ ধরনেরই একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। অবশ্য কালিদাস সম্পর্কে আজ আর সঠিক কিছু জানবারও উপায় নেই। যাঁরা পরবর্তী সময়ে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা ও গবেষণা করেছেন, তাঁরা শুধু তাঁর কাব্যের কথাই বলেছেন, তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কিছু বলেননি। তাই তাঁর আবির্ভাবকাল আর কর্মভূমি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক মতভেদ আছে।
তবে তাঁর রচনাবলি এবং আধুনিক গবেষণার ফল থেকে কিছু কিছু তথ্য জানা গেছে। তাঁর কাব্যে যে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি, আচার-অনুষ্ঠান এবং খাদ্যের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তাতে মনে হয় তিনি বাঙালি ছিলেন। সম্ভবত বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কোনো এক স্থানে পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দিকে তাঁর জন্ম হয়েছিল। কোথাও বলা হয়েছে, তাঁর জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দের ভেতরে।
হয়তো তিনি পরবর্তীকালে উজ্জয়িনী ও দর্শনা দেশের রাজধানী অবন্তী, যার বর্তমান নাম মালব (প্রাচীন উত্তর-পশ্চিম ভারতে অবস্থিত) গমন করেন এবং রাজা যশোধর্ম দেবের রাজসভায় চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিক্রমাদিত্য যশোধর্ম দেবের নবরত্ন সভার অন্যতম রত্ন। এরপর তিনি এই উজ্জয়িনীতে থেকেই তাঁর যাবতীয় গ্রন্থ রচনা করেন।
কালিদাস ছিলেন সংস্কৃত ভাষার কবি। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা একশো। তবে কেউ কেউ মনে করেন, সংস্কৃত ভাষায় হয়তো আরও দুজন কালিদাস ছিলেন। কিন্তু মহাকবি কালিদাস বলতে উজ্জয়িনীর রাজসভাকবি কালিদাসকেই বোঝায়।
তাঁর শত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হল : ‘মেঘদূতম’ (কাহিনীকাব্য), কুমারসম্ভবম (মহাকাব্য), রঘুবংশম (মহাকাব্য) এবং ঋতুসংহার (খণ্ডকাব্য)। তা ছাড়া তাঁর ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম’ এবং ‘বিক্রমোর্বশি’ নামে তিনখানি প্রসিদ্ধ নাটকও রয়েছে।
মহাকবি কালিদাসের মৃত্যু হয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। তাঁর মৃত্যু নিয়েও রহস্যময় কিছু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। এই কিংবদন্তির ঐতিহাসিক সত্যতা কতটুকু, সে সম্পর্কে জানা যায় না। কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে, জ্ঞানতাপস মহাকবির মৃত্যু নাকি স্বাভাবিকভাবে হয়নি। স্বদেশ থেকে বহু দূরে সিংহলে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) গিয়ে তিনি নিহত হয়েছিলেন। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এই কথিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই জড়িত আছে সেই কলঙ্কময় কিংবদন্তিটি।
কথিত আছে, তদানীন্তন সিংহলের রাজা কুমারদাস ছিলেন কবি কালিদাসের একজন অনুরাগী ভক্ত। এই ভক্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কালিদাস বেশ কয়েকবার সিংহলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষবারই ঘটে সেই দুর্ঘটনা। সিংহলরাজা কুমারদাসের ছিল একাধিক পত্নী। একবার তিনি একটি শ্লোকের অর্ধাংশ লিখে তাঁর এক বিদুষী পত্নীকে বাকি অংশ পূরণ করার আদেশ দিলেন। শর্ত দেওয়া হলো, যদি রানি এই শ্লোকটি পূরণ করতে সক্ষম হন, তা হলে তাঁকে প্রচুর পুরস্কার দেওয়া হবে, আর ব্যর্থ হলে তাঁকে স্বামী-পরিত্যক্তা হতে হবে।
শ্লোকটি ছিল-
“কমলে কমলোৎপত্তি শুয়তে ন দৃশ্যতে।”
(অনুবাদ : কমলেই কমলের উৎপত্তি বলে শোনা যায়, কিন্তু কেউ দেখেনি)।
কবি কালিদাস ঠিক সে সময়েই এসে প্রবেশ করলেন রাজপ্রাসাদে। প্রাসাদে প্রবেশ করেই দেখলেন এই অর্ধসমাপ্ত কবিতাংশটি। কবির স্বভাব যা হয় তা-ই। তিনি কৌতূহলী হয়ে কোনো কিছু অনুসন্ধান না করেই এই অর্ধসমাপ্ত কবিতাটি সমাপ্ত করে দিলেন নিজেই। এই সময় রাজা কুমারদাস রাজপ্রাসাদে ছিলেন না। মৃগয়ায় (শিকারে গিয়েছিলেন। তাই কবির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি।
রানি এসে দেখলেন স্বয়ং মহাকবি কালিদাস তাঁর শ্লোকের অর্ধেক পূরণ করে দিয়েছেন এভাবে :
“বালে তব মুখন্তোষে দৃষ্ট ইন্দিবরদ্বয়ম।”
(অনুবাদ : হে নারী, তোমার মুখকমলে আঁখিরূপ দুটো নীলপদ্ম দৃষ্ট হচ্ছে)। ঠিক তখনই রানির মাথায় খেলে গেল দুষ্টবুদ্ধি। তিনি কোনো কিছু প্রকাশ না করে আত্মভোলা ও সরল প্রকৃতির মানুষ কবি কালিদাসকে ডেকে নিয়ে গেলেন অন্তঃপুরে।
তারপর নিজস্ব লোক দিয়ে হত্যা করালেন কবিকে, যাতে কালিদাস কর্তৃক এই শ্লোক-পূরণের কথা কেউ জানতে না পারে, এবং যাতে নিজের কৃতিত্ব জাহির করে রাজার কাছে পুরস্কার ও সম্মান আদায় করতে না পারেন।
কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। রাজা পরক্ষণেই দুষ্ট রানির সব কুকীর্তির কথা জানতে পারেন। প্রাসাদে ফিরে এসে তিনি মহাকবি কালিদাসের আগমনবার্তা জানতে পারেন। তারপর এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে যারপরনাই ক্রুদ্ধ ও মর্মাহত হন। তাই প্রতিশোধ নিতে তিনি কালিদাসের জ্বলন্ত চিতায় দুষ্ট রানিকেও জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন।
এই ছিল কিংবদন্তি।
তাঁর কালজয়ী প্রতভার জন্য কালিদাসকে শেক্সপিয়ার, মিল্টন, দান্তে ও গ্যয়টে প্রমুখ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকের পর্যায়ভুক্ত করা যায়।