ইবনে সিনা (৯৮০–১০৩৭) – জ্ঞানসাধনায় কাটিয়েছিলেন সমগ্র জীবন
প্রাচীন গ্রিসের মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটল ছিলেন মহাবীর আলেজান্ডারের প্রধান উপদেষ্টা এবং শিক্ষক। ইতিহাসে এ-রকমেরই আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ইস্পাহানের শাসনকর্তা আলাউদ্দৌলা বিন কাজুরির বেলায়। তিনিও তাঁর পাশে পেয়েছিলেন প্রাচ্যের অ্যারিস্টটল বলে খ্যাত ইবনে সিনাকে।
শুধু মুসলমানদের মধ্যে নন, ইবনে সিনা ছিলেন সারা পৃথিবীব অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী পুরুষ।
তিনি নিজেও ছিলেন উচ্চবংশীয় এক রাজপরিবারের সন্তান। সোনার চামচ মুখে নিয়েই তাঁর জন্ম হয়েছিল ৯৮০ সালে। পিতা ছিলেন খারমাইসন প্রদেশের গভর্নর আবদুল্লাহ্। তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে ছিল অঢেল ঐশ্বর্য আর বেশুমার জাঁকজমক। ইচ্ছে করলে তিনিও এই বিলাসব্যসন আর ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুব দিয়ে আর দশজনের মতো অনায়াসে ভেসে যেতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। তাঁর জীবন প্রবাহিত হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে। ভোগের বদলে তিনি আত্মমগ্ন হয়েছিলেন জ্ঞানের সমুদ্রে।
ছয় বছর বয়সে বোখারায় শিক্ষাজীবন শুরু হয় ইবনে সিনার। বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। অবিশ্বাস্যরকমের প্রতিভা লুকিয়ে ছিল তাঁর মধ্যে। দশ বছর বয়সেই গোটা কোরআন শরিফ মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। আর সেইসাথে অধ্যয়ন করেন সাহিত্য, অঙ্ক, বীজগণিত, দর্শন, জ্যোতিষশাস্ত্র, ধর্ম ও চিকিৎসাশাস্ত্র।
কিন্তু যত বিষয়ই তিনি অধ্যয়ন করুন না কেন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্র। তিনি অশেষ ধৈর্য আর দক্ষতার সাথে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চিকিৎসাশাস্ত্রের সমস্ত জটিল বিষয় উত্তমরূপে আয়ত্ত করে ফেলেন। মাত্র ষোল বছর বয়সেই তিনি হয়ে ওঠেন একজন পারদর্শী চিকিৎসাবিদ
ক্রমে তাঁর খ্যাতি আর পারদর্শিতার এই খবর গিয়ে পৌঁছয় শাহি দরবারে। এই সময় খলিফা নূহ ইবনে মনসুর আক্রান্ত হন কঠিন রোগে। খলিফার রোগ সারাতে শাহি দরবারের সব ঝানু ঝানু চিকিৎসকরা ব্যর্থতা বরণ করেন। খলিফাকে কিছুতেই রোগমুক্ত করা যাচ্ছিল না। অবশেষে ডাক পড়ে তরুণ চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনার।
কিন্তু বয়সে তরুণ হলে কী হবে, অদ্ভুত ছিল তাঁর চিকিৎসাকৌশল, সুনিপুণ তাঁর দক্ষতা। ইবনে সিনার নতুন পদ্ধতির চিকিৎসায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অসুখ থেকে সেরে ওঠেন খলিফা মনসুর।
এই তরুণ চিকিৎসকের দক্ষতা আর জ্ঞান অর্জনের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে খুবই খুশি হলেন খলিফা। পুরস্কারও দিলেন তাঁকে। ফলে খলিফার নিজস্ব গ্রন্থাগারে পড়াশোনা করার দুর্লভ অধিকার লাভ করলেন ইবনে সিনা। এই গ্রন্থাগারে ছিল অজস্র মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য সব গ্রন্থ। জ্ঞানপাগল ইবনে সিনা তাঁর সবই পড়ে ফেললেন একে একে। শিক্ষকের কাছ থেকে তিনি যে শিক্ষা লাভ করেছিলেন, ব্যক্তিগত পড়াশোনার ভেতর দিয়ে এবার তা পূর্ণতা লাভ করল।
ইবনে সিনা অল্পবয়সেই তাঁর প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। মাত্র একুশ বছর বয়সেই প্রণয়ন করেন একটি বিশ্বকোষ। একমাত্র গণিতশাস্ত্র ছাড়া বিজ্ঞানের যাবতীয় তথ্য তিনি নিপুণভাবে সন্নিবেশ ঘটান এই কোষগ্রন্থে। তাঁর এই গ্রন্থ দেখে দেশ-বিদেশের পণ্ডিতরা বিস্ময়ে আভিভূত হয়ে যান। তাঁর নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু এই সময়েই তাঁর জীবনে নেমে আসে এক বড় রকমের দুর্যোগ। মাত্র বাইশ বছর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তবে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে আসে রাজনৈতিকভাবে। ইবনে সিনার পূর্বপুরুষেরা সামানীয় বংশের সৌজন্যে রাজমর্যাদা ভোগ করে আসছিলেন। কিন্তু এই সময় গজনির সুলতান মাহমুদের হাতে সামানিদের পতন ঘটলো, ক্ষুণ্ণ হয় তাঁদের রাজমর্যাদা।
ফলে সুলতান মাহমুদ ইবনে সিনাকে ধরে আনার জন্য লোক পাঠান। এই খবর পেয়ে তিনি দেশ ছেড়ে পালালেন। তাঁর পেছনে ধাওয়া করতে থাকে সুলতান মহমুদের গুপ্তচরেরা।
ইবনে সিনা পালিয়ে খারিজমের রাজধানী কারকুনজিতে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু এ জায়গাও নিরাপদ নয় ভেবে তিনি চলে আসেন গুরগাঁওতে। কিন্তু এখানকার শাসকের মৃত্যু হলে তিনি চলে যান হামাদানে। ইবনে সিনা তাঁর বিদ্যা আর জ্ঞানের জন্য অচিরেই হামাদানের শাসনকর্তা শামসদ্দৌলার নজর কাড়তে সক্ষম হন। তাঁকে তিনি মন্ত্রীপদে বরণ করে নেন। কিন্তু এই সৌভাগ্যও বেশিদিন তাঁর কপালে সইল না। শামসদ্দৌলার মৃত্যু হলে তিনিও বন্দি হন। নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে। অবশ্য এই কারাবাস তাঁর জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। এতদিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য দর্শন ও বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন কারাবাসের নির্জনে বসে তাঁর জীবনে সেই সুযোগ উপস্থিত হয়। তিনি পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন গ্রন্থ রচনায়।
তিনি কারাবাসে থেকেই রচনা করেন ‘কিতাব শিফা’ নামে আঠারো খণ্ডে সমাপ্ত একটি বিশাল শাস্ত্রীয় গ্রন্থ। এই সময় তিনি ‘কিতাব আতিকিয়াত’ এবং ‘কিতাবুল হাইয়ান’ নামে আরও দুটো মূলবান গন্থ রচনা করেন।
বিজ্ঞান বিষয়ে ইবনে সিনার ছিল বিপুল অবদান। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি একজন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ হিসেবেই পৃথিবীর বুকে বিশেষভাবে বরণীয়।
চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিসেবে হিপোক্র্যাটিসের নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হলেও ইবনে সিনাই প্রথম চিকিৎসাতত্ত্বের সূত্রপাত করেন। এ-হিসেবে তাঁরও নাম চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে অতীব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে থাকে। অবশ্য তেমন যোগ্য উত্তরসুরি না থাকায় এই শাস্ত্রের আর তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বলা হয়ে থাকে হিপোক্র্যাটিসের যোগ্য উত্তরসুরি ইবনে সিনা। তিনিই এই শাস্ত্রকে পূর্ণতা দান করেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে ইবনে সিনার সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘কানুন ফি আল তিব্ব’, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় ‘আল কানুন’। এটি প্রায় দশ লাখ শব্দবিশিষ্ট চিকিৎসাশাস্ত্র সংক্রান্ত একটি বিশ্বকোষ জাতীয় গ্রন্থ।
শোনা যায়, বিজ্ঞান বিষয়েও তিনি প্রায় শতাধিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু সেসব গ্রন্থ হারিয়ে গেছে কালের অতল গর্ভে। এ ছাড়া ধর্মতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র, প্রকৃতিবিজ্ঞান, দর্শন এবং কবিতা বিষয়েও ছিল তাঁর অনেক গ্রন্থ।
ইবনে সিনার মৃত্যু হয় ১০৩৭ সালে। তিনি হামাদানেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটান। আজও সারা বিশ্বের মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে এই মহান জ্ঞানসাধকের নাম।