রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬–১৮৮৬) – ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমি ঈশ্বরকে দর্শন করেছি’
যুগে যুগে এ উপমহাদেশে যেসব লোকোত্তর মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করে অমৃতত্ব লাভের পথনির্দেশ করে গেছেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁদের অন্যতম। যে সময় তাঁর জন্ম, সে সময়টি ছিল এদেশের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এদেশের জাতীয় জীবনে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির ঢেউ লেগেছিল সর্বত্র। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য যুবসমাজ এদেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর আস্থা হারিয়ে বিপথগামী হতে বসেছিল। এমনই এক যুগসন্ধিক্ষণে শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব।
শ্রীরামকৃষ্ণের জন্ম হয় ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার অনতিদূরে হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে। পিতার নাম ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম চন্দ্রমণি। একদিন ক্ষুদিরাম স্বপ্ন দেখেছিলেন, গয়াধামের তীর্থদেবতা গদাধর তাঁকে বলছেন, আমি শীঘ্রই তোর ঘরে গিয়ে জন্ম নেব। এই কথা শুনে ক্ষুদিরাম ভয়ে বিস্ময়ে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং জড়িতকণ্ঠে নিবেদন করেন, না প্রভূ, এত সৌভাগ্য আমার প্রয়োজন নেই। এই অভাজনকে যে আপনি দর্শন দিয়েছেন, এটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। আমি এক অতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ।
উত্তর শুনে দিব্যপুরুষের বদনমণ্ডল আরও প্রসন্ন হয়ে উঠল। তিনি স্নেহ ও করুণার ভাব প্রকাশ করে বললেন, তুমি যা দেবে, আমি তাতেই সন্তুষ্ট থাকব। আমার অভিলাষে তুমি বাধা দিও না।
নিদ্রাভঙ্গের পর তাঁর কেবলই মনে হতে লাগল, এ কী অলৌকিক স্বপ্ন তিনি দেখলেন!
অন্যদিকে এমনই অলৌকিক ঘটনা ঘটল চন্দ্রমণির ক্ষেত্রেও। তিনিও প্রকাশ্য দিবালোকে দেখলেন অনুরূপ এক দৃশ্য।
বাড়ির সামনেই ছিল যোগীদের শিবমন্দির। তিনি সেদিন মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মহাদেবকে দর্শন করছেন, এমন সময় চন্দ্রমণির মনে হতে লাগল, এক প্রগাঢ় দিব্যজ্যোতি শিবলিঙ্গ থেকে ছুটে এসে যেন তাঁর শরীরে প্রবেশ করতে লাগল। তিনি আতঙ্কে সহসা মূর্ছিত হয়ে পড়লেন।
প্রতিবেশী রমণীরা তাঁকে তুলে নিয়ে এল ঘরে। অনেকক্ষণ পরে তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। কিন্তু তার পর থেকেই ঘটতে লাগল বিস্ময়কর সব ঘটনা। সর্বক্ষণ মনে হতে লাগল তাঁর শরীর থেকে যেন দিব্যগন্ধ বের হচ্ছে, আর তার গন্ধে ভরে যাচ্ছে সমস্ত ঘরবাড়ি।
তীর্থস্থান থেকে স্বামী ঘরে ফিরলে স্বামীকে তিনি সব কথা খুলে বললেন। তখন ক্ষুদিরামও তাঁর অপূর্ব স্বপ্নদর্শনের কথা স্ত্রীর কাছে ব্যক্ত করলেন।
তখন ক্ষুদিরামের মনে দৃঢ় প্রত্যয়ের জন্ম নিল যে, নিশ্চয় কোনো মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটবে তাঁদের পর্ণ কুটিরে।
এই ঘটনার বছরকাল পরেই ক্ষুদিরামের ঘরে জন্ম নিলেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ। পিতা তাই স্বপ্নের কথা স্মরণ করে পুত্রের নাম রাখলেন গদাধর।
গদাধর বাল্যকাল থেকেই ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। প্রকৃতি তাঁকে আকর্ষণ করত বেশি। স্কুলের লেখাপড়ার দিকে তেমন মন ছিল না। গদাধর বলতেন, ওই টাকা রোজগারের পড়াশোনায় আমার প্রয়োজন নেই।
গদাধর ভাবুক প্রকৃতির হলেও বেশ চঞ্চল ছিলেন। অতি শৈশবেই তাঁর মধ্যে অনেক অসাধারণ গুণাবলিরও প্রকাশ ঘটেছিল। ভয়ের শাসন তিনি মানতেন না। তিনি যখন কোনো বিষয়ে জেদ ধরতেন, তখন তার থেকে তাঁকে নিরস্ত করা যেত না।
যেহেতু ক্ষুদিরামের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল, এই শিশু সাধারণ মানবশিশু নয়, তাই তাঁর দুরন্তপনা ও সকল আবদারকেই তিনি মেনে নিতেন।
তিনি লক্ষ করেছিলেন, স্কুলের পড়ার প্রতি আগ্রহ না থাকলেও ছেলের মেধা এবং স্মরণশক্তি খুবই প্রখর। পিতৃপুরুষদের নাম, নানা দেবদেবীর নাম, বেদমন্ত্র মুখে-মুখে শুনেই মুখস্থ করে ফেলতে পারেন। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার, একবার যা শেখেন, কখনও তা ভোলেন না।
পড়ার আগ্রহ না থাকলেও ক্ষুদিরাম তাঁর ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলেন গ্রামের লাহাবাবুদের চণ্ডীমণ্ডপের পাঠশালায়। কিন্তু মন দিয়ে লেখাপড়া করতেন না গদাধর। বিশেষ করে অঙ্ক তাঁর মোটেই ভালো লাগত না।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর মধ্যে যে বিশেষ গুণটির প্রকাশ হতে থাকে, তা হলো ভয়শূন্যতা। তাঁর মনে ভয়-ভাবনার লেশ মাত্র ছিল না। গ্রামের মধ্যে যেসব জায়গায় লোকে রাতে একা যেতে ভয় পেত, গদাধর সেসবখানে দিব্যি ঘুরে বেড়াতেন।
তাঁর দ্বিতীয় গুণ ছিল প্রচণ্ড আকর্ষণশক্তি। তাঁর মধ্যে ছিল অপূর্ব মোহিনীশক্তি, যার ফলে সবাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতো, তাঁর কথা শুনত, তাঁকে ভালোবাসত।
তৃতীয় গুণটি ছিল তন্ময়তা। সুন্দর দৃশ্য দেখে, পৌরাণিক কাহিনী গান বা কথিকা শুনে তিনি মাঝেমধ্যে এমন তন্ময় হয়ে পড়তেন যে, জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই ভাব-সমাধি আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি বলতেন, কোনো দেবদেবীর ধ্যান করতে বসলে তিনি অল্পক্ষণেই তাঁর ধ্যানের দেবতাকে দেখতে পান। তখন তাঁর আর কিছুই স্মরণ থাকে না তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
পিতার মৃত্যুর পর গদাধরের আরও ভাবান্তর দেখা দিল। তিনি সব কিছু ছেড়েছুড়ে পড়ে থাকতে লাগলেন শ্মশানে আর নির্জন স্থানে। একদিন বড় ভাই রাজকুমার তাঁকে নিয়ে (১৮৫৩ সালে) এলেন কলকাতায়। পিতার মৃত্যুর পর সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব পড়েছিল বড়ভাই রামকুমারের ওপরই। কিন্তু তিনি একা সামাল দিতে পারছিলেন না। ভাবলেন, এদিকে গদাধর যখন লেখাপড়াও করছে না, তাই শহরে নিয়ে যজমানি করে ও যদি দুটো পয়সা আয় করতে পারে, তাতেও তাঁর সহযোগিতা হয়।
কলকাতা এসে গদাধর ঝামাপুকুরের গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে পূজারি হিসেবে কাজ করতে লাগলেন।
এরপর দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণির অর্থ সাহায্যে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলে বড় ভাই রামকুমার সেখানকার পূজারি মনোনীত হন। তিনি সঙ্গে নেন ভাই গদাধরকেও। বড় ভাই রামকুমার ছিলেন পূজারি আর গদাধর হন মা ভবতারিণীর সজ্জাকর। ফুলমালা দিয়ে গাদাধব প্রতিদিন মাকে নানা রূপে সাজান মনের মতো করে আর আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে মুখে শুধু বলেন, মা মা।
এর কিছুদিন পরেই বড় ভাই রামকুমারের হঠাৎ করেই মৃত্যু হলো। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর এবার মা ভবতারিণীর পুজোর ভারও তাঁর ওপরেই বর্তালো।
যেমন অদ্ভুত মানুষ, তেমনি অদ্ভুত তাঁর পুজো-পদ্ধতি। অলৌকিকভাবের ঘোরে সর্বক্ষণ বিভোর হয়ে থাকেন তিনি। পুজোর ফুল নিজের মাথায় তুলে নেন। নৈবেদ্যর ফল, আর মিষ্টি মাকে খাওয়াবার জন্য আকুল প্রার্থনা জানান খা মা, খা মা বলে।
অনেক সময় তা নিজেই খেয়ে ফেলেন ছোট্ট ছেলের মতো। মায়ের সামনে নাচেন, হাসেন, কাঁদেন ছেলেমানুষের মতো। ভাবের ঘোরে মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। মৃন্ময়ী মা যেন চিন্ময়ী হয়ে ওঠেন ঠাকুর গদাধরের সামনে।
সবাই ভাবে, মানুষটা বুঝি পাগল হয়ে গেছে।
এদিকে ছেলের এই দিব্যোন্মাদনার কথা পৌঁছে যায় মায়ের কানে। ছেলে বিবাগি হয়ে যেতে পারে ভেবে মা বাড়িতে ডেকে এনে তাঁর বিয়ে দিলেন সারদা নামের এক পরমা সুন্দরী কন্যার সাথে। কিন্তু পত্নীকে তিনি কখনও স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেননি। পত্নীর মধ্যেও তিনি দর্শন করেছেন মাতৃভাব। এরকম ঘটনার দৃষ্টান্ত বিশ্বে সত্যিই বিরল।
সারদামণি থাকেন তখন বাবার বাড়িতে। তিনি কিন্তু ঠিকই চিনেছিলেন স্বামীকে। তাই তো তিনি অলৌকিক চরিত্রের প্রভাবে একদিন হতে পেরেছিলেন মা সারদা। যোগীশ্রেষ্ঠ শ্রীরামকৃষষ্ণদেবের যোগ্য সহধর্মিণী।
এদিকে পাগল ঠাকুর ছেলেমানুষের মতো তখনও কাঁদেন। মাটিতে গড়াগড়ি দেন, আর কণ্ঠে মাতৃদর্শনের ব্যাকুলতা প্রকাশ করে বলেন, দেখা দে মা, দেখা দে … ।
শেষে একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সাধনা কি তবে ব্যর্থ হলো তাঁর? মা ভবতারিণীর হাত থেকে খাড়া খুলে নিয়ে আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত হলেন—দেখাই যখন পেলাম না তখন এ জীবন রাখার প্রয়োজনই-বা কী?
পাগল ঠাকুরের সাধনা সফল হলো। সারা মন্দির যেন হাজার বাতির আলোয় ঝলমল করে উঠল। গদাধর সামনে দেখলেন জগজ্জননী মাকে জীবন্ত মূর্তিতে। অভয়া মূর্তি—সহাস্যবদন। পাগল ঠাকুরের অতৃপ্ত অশান্ত মন দারুণ প্রশান্তিতে ভরে উঠল
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে সিদ্ধা ভৈরবী যোগেশ্বরী এলেন দক্ষিণেশ্বরে এবং তিনি গদাধরকে দর্শন করে ঘোষণা করলেন তাঁকে অসামান্য যোগী ও অবতার বলে। এরপর তিনি প্রখ্যাত সাধক তোতাপুরীর কাছে সাধনার পথ, শাক্ত, বৈষ্ণব, তান্ত্রিক ও বেদান্ত বিষয়ে প্রচুর জ্ঞানলাভ করেন। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তিনি উপলব্ধি করেন যে, ঈশ্বরের ভাব অনন্ত। তিনি সাকার, আবার নিরাকারও।
১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনলীলানাট্যের এক নতুন দৃশ্যপট উন্মোচিত হয়। এবার আর তিনি আত্মসমাহিত সাধক নন, তিনি হন লোকগুরু। তাঁর বাণী শোনার জন্য দলে দলে লোক এসে তাঁর চারপাশে ভিড় করতে থাকে। কলকাতার শিক্ষিতসমাজের দৃষ্টিও নিবদ্ধ হয় তাঁর প্রতি। সেকালের মনীষী বাগ্মী কেশব সেন, বিজয়কৃষ্ণ, শশধর পণ্ডিত, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মুধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাধিকা গোস্বামী, নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ, আমেরিকার বুথ সাহেব, প্রতাপ মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি ছুটে আসেন তাঁর সান্নিধ্য পাবার জন্য।
একদিন কেশব সেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে বলেন, ঠাকুর, বলে দিন কেন আমার ঠাকুর-দর্শন হয় না। উত্তরে ঠাকুর সোজাসুজি বললেন, সংসারের সম্মান, প্রতিপত্তি আর বিদ্যার মোহ নিয়ে আছ কিনা, তাই হয় না; ছেলে চুষনি নিয়ে যতক্ষণ চোষে, ততক্ষণ মা আসে না। খানিকক্ষণ পরে চুষনি ফেলে দিয়ে ছেলে যখন দু’হাত তুলে মা বলে চিৎকার করে, তখনই মা ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে ছুটে আসেন।
তিনি বলতেন, ঈশ্বরকে যে আন্তরিকভাবে জানতে চাইবে, তারই হবে, হবেই হবে। সত্য কথাই কলির তপস্যা। ঈশ্বরলাভের জন্য ব্যাকুলতাকে তিনি তিনটি টানের সাথে তুলনা করে বলেছেন, বিষয়ের প্রতি বিষয়ীর টান, পতির প্রতি সতীর টান, এবং সন্তানের প্রতি যেমন মায়ের টান—এমনি আন্তরিক তিনটি টান একসঙ্গে হলে তবেই ঈশ্বরলাভ হয়। এই তিনটি ভালবাসা যদি কেউ একসঙ্গে করে ভগবানকে দিতে পারে, তবে তৎক্ষণাৎ তার ঈশ্বরলাভ হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশবাণী প্রচার করার চমৎকার একটি রীতি ছিল। তিনি তাঁর ঈশ্বরতত্ত্ব বিষয়ের কথাগুলোকে সাধারণ ভক্তের কাছে পরিষ্কার করে বলার জন্য অবতারণা করতেন সুন্দর সুন্দর গল্পের। তিনি গল্পের ছলেই তাঁর বাণীগুলোকে ভক্তদের কাছে গ্রহণীয় করে তুলতেন।
ঈশ্বরে বিশ্বাস ও ব্যাকুলতার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বলেছিলেন মধুসূদন দাদার গল্প। জটিল নামে এক অনাথ বালক। সে পাঠশালায় যেত। একটা বনের পথ দিয়ে পাঠশালায় যেতে হতো। তাই সে ভয় পেত। মাকে একথা বলাতে মা বললেন, তোর ভয় কী? তুই মধুসূদনকে ডাকবি। ছেলেটি জিগ্যেস করল, মা, মধুসূদন কে? মা বললেন, মুধুসূদন তোর দাদা হয়। যখন একলা যেতে যেতে ভয় করবে, তখন ডাকবি, দাদা মধুসূদন বলে।
ছেলেটিও তাই যখন বনের ভেতরে গিয়ে ভয় পেল, অমনি সে একান্ত বিশ্বাসে ও ব্যাকুলতায় ডাকতে লাগল, দাদা মধুসূদন। কিন্তু কোথাও কোনো সাড়া নেই। তখন উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল, কোথায় দাদা মধুসূদন, তুমি এসো। আমি বড় ভয় পেয়েছি। ছেলেটির ব্যাকুল কান্নায় ঈশ্বর থাকতে না পেরে সত্যি সত্যি দাদা মধুসূদনের ছদ্মবেশে এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। এই যে আমি তোর দাদা, ভয় কী? এই বলে তিনি সঙ্গে করে ছেলেটিকে পাঠশালায় পৌছে দিয়ে গেলেন। আর বলে গেলেন, তুই যখন ডাকবি আমি আসব। ভয় কী?
শ্রীরামকৃষ্ণ এই গল্পের দৃষ্টান্ত দিয়ে ভক্তদের বলতেন, এমনই বালকের মতো বিশ্বাস ও ব্যকুলতা যার আছে, তারই ঈশ্বরদর্শন হয়।
দেখতে দেখতে এই সিদ্ধ সাধকের খ্যাতি সর্বস্তরের লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রবীণদের মতো নবীনরাও ঠাকুরের কাছে আসতে থাকেন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য আদর্শের সংঘাতে দোলায়মান তরুণদের প্রতিভূ হিসেবে এলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ঈশ্বরদর্শন করেছেন এমন একজন সাধকের সন্ধান করে ফিরছিলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এসে তিনি বললেন, ঠাকুর, আপনার কি ঈশ্বরদর্শন হয়েছে? উত্তরে ঠাকুর বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই হয়েছে। তোকে যেমন দেখছি, তার চেয়ে স্পষ্ট দেখেছি। তুই যদি চাস, তোকেও দেখাতে পারি। নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃপালাভ করে ঈশ্বরদর্শন করে ধন্য হয়েছিলেন এবং নিজেকে ঠাকুরের কাছে সমর্পণ করেছিলেন। এই নরেন্দ্রথাই হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি পরবর্তীকালে ঠাকুরের বাণী ও আদর্শকে দেশ-দেশান্তরে প্রচার করে গেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশাবলি শুধু মুখের কথা নয়, সেগুলো ছিল তাঁর জীবনচর্চায় রূপায়িত সত্য। তিনি অহঙ্কারশূন্য হয়ে জীবকে শিবজ্ঞান করেছেন। কালীবাড়ির কাঙালিদের দরিদ্রনারায়ণজ্ঞানে নিজের হাতে ভোজন করিয়ে তিনি জীবসেবায় আদর্শ স্থাপন করেছেন। তাই তো ভক্তরা তাঁর উপদেশকে কথামৃত বলে গ্রহণ করে প্রতিনিয়ত ধন্য হচ্ছেন।
ধর্ম সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আন্তরিক হয়ে সব ধর্মের ভেতর দিয়েই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। বৈষ্ণবরাও ঈশ্বরকে পাবে, বেদান্তবাদীরাও পাবে, ব্রহ্মজ্ঞানীরাও পাবে। আর ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও পাবে। আন্তরিক হলে সবাই পাবে। কেউ কেউ ঝগড়া করে বসে—তারা বলে, আমাদের কৃষ্ণকে না ভজলে কিছুই হবে না, কেউ বলে, আমাদের মা কালীকে না ভজলে হবে না—এসব বুদ্ধির নাম মতুয়াবুদ্ধি। অর্থাৎ আমার ধর্ম ঠিক, আর সকলের ধর্ম মিথ্যা। এ বুদ্ধি খারাপ, ঈশ্বরের কাছে নানা পথ দিয়ে পৌঁছানো যায়। যত মত তত পথ।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের দিন ঘনিয়ে আসে। কিছুদিন থেকে তিনি ভুগছিলেন গলার ক্ষতরোগে। ভক্তবৃন্দ তাঁকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে। তাঁর চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি ছিল না। তবুও ঠাকুর মনে মনে হাসেন। প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দকে শোনান তাঁর প্রিয় সঙ্গীত—‘মন চল নিজ নিকেতনে’।
তিনি বিবেকানন্দকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নরেন, আমার এই ছেলেরা সব রইল। আর রইলি তুই। তুই ওদের দেখিস, ওদের সৎপথে চালাস, আমি শিগিরই দেহরক্ষা করব।
ভক্তরা কাঁদেন, ঠাকুর, তোমাকে ছেড়ে আমরা কী করে থাকব? তুমি আমাদের ছেড়ে যেও না। ঠাকুর বললেন, তা কি হয় রে? জন্ম যখন নিয়েছি মৃত্যু তো একদিন আসবেই। তবে চিন্তা করিস নে। আমি তোদের মাধ্যেই থাকব।
এই মহান সাধকপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট রোববার মহাসমাধিযোগে মানবলীলা সংবরণ করেন।