ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

ডায়োজিনিস (৪১২–৩২২ খ্রি. পূ.) – একনিষ্ঠ জ্ঞান সাধক

ডায়োজিনিস (৪১২–৩২২ খ্রি. পূ.) – একনিষ্ঠ জ্ঞান সাধক

তাঁকে নিয়ে সেকালে প্রচলিত ছিল নানা কথা। কেউ বলত তাঁকে পাগল, আর কেউ বলত মহান জ্ঞানসাধক। জ্ঞানের পাগল এই দার্শনিকের নাম ছিল ডায়োজিনিস। গ্রিসের সাইনব শহরে তাঁর জন্ম হয়েছিল ৪১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই মহান দার্শনিকের জীবন ছিল সত্যি বড় বিচিত্র। তাঁর গোটা জীবনটাই এক রূপকাহিনীর গল্পের মতো।

তিনি সাইনব শহরে যে স্কুলে পড়াশোনা করতেন, তার প্রধান শিক্ষকের নাম ছিল অ্যান্টিথেনেস। একদিন তিনি হঠাৎ করেই স্কুলের সব ছেলেকে ছুটি দিয়ে স্কুলঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। যেহেতু প্রধান শিক্ষকের আদেশ, তাই সব ছাত্র বইখাতা হাতে নিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল। কিন্তু গেলেন না শুধু ডায়োজিনিস। ছেলেদের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তাঁর আসন থেকে নড়লেন না। কথা শুনে রেগেমেগে বেত হাতে ছুটে এলেন অ্যান্টিথেনেস। তবু ডায়োজিনিস নড়লেন না। তাঁর যুক্তি, উপযুক্ত কারণ না হলে কিছুতেই সময়ের আগে তাঁর আসন থেকে নড়বেন না। তাতে করে যদি তাঁকে বেত দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্তও করে ফেলা হয়, তবুও নয়। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছিল। তাঁকে কিছুতেই সময়ের আগে ক্লাসঘর নড়ানো যায়নি। শত ভয় দেখিয়েও নয়।

তারপর যতই তাঁর বয়স বাড়তে লাগল, ততই তাঁর জীবনে দেখা দিল বৈচিত্র্য। তিনি শুরু করলেন এক অদ্ভুত জীবন-যাপন। চাল নেই, চুলো নেই, ঠায় নেই, ঠিকানা নেই—সত্যি সে এক দারুণ জীবন-যাপন। শোনা যায়, কৈশোর পেরনোর পর সারা জীবনে তিনি নাকি কখনও কোনোদিন বিছানায় পর্যন্ত শুয়ে দেখেননি।

এরই মধ্যে তাঁর মাথায় চাপল এক পাগলামি। তিনি সহসা ভাবলেন, না, এভাবে আর নয়। এবার থেকে ঘর বাঁধতে হবে। তাঁর থাকার জন্য ঘর বানাতে হবে, ঘরে শোবার জন্য বিছানা তৈরি করতে হবে। কিন্তু বললেই তো আর হল না। তার জন্য টাকা চাই।

কিন্তু তিনি টাকা পাবেন কোথায়? তাই তিনি তাঁর এক বন্ধুর কাছে লিখলেন টাকার জন্য। কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পেরিয়ে গেল তাঁর সেই বন্ধু তাঁকে ঘর বানাবার জন্য টাকা দিলেন না।

এদিকে ডায়োজিনিস একদিন দেখলেন, শহরের রাস্তার পাশে পড়ে আছে অনেকগুলো বড় বড় চোঙা। তার মধ্যে দিব্যি ঢোকা যায়। তিনি ভাবলেন, বেশ তো মজা! ওই চোঙাগুলোর মধ্যেই তো বাস করা যায়! তা হলে আর ঘর বানাবার দরকার কী? যা ভাবলেন তা-ই করলেন। পরিত্যক্ত ওই চোঙার ভেতরেই তিনি পাতলেন তাঁর আস্তানা।

শোনা যায়, ডায়োজিনিস এরপর তাঁর সারাটা জীবন নাকি এই পরিত্যক্ত চোঙার মধ্যেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর আর ঘর বাঁধা হয়নি। এই সময় তাঁর সম্পত্তি বলতে ছিল জল পান করার একটা পাত্র। এর কিছুদিন পরেই ঘটল আরও একটা ঘটনা। একদিন তিনি তাঁর চোঙার আস্তানায় বসে আছেন, এমন সময় দেখলেন, পাশের প্রস্রবন থেকে কতকগুলো ছেলে জল খাচ্ছে। তাদের সাথে কোনোকিছু ছিল না বলে তারা আঁজলা ভরেই জল খাচ্ছিল। তাই দেখে ডায়োজিনিসের দিব্যচক্ষু খুলে গেল।

তিনি ভাবলেন, ছেলেগুলো যদি কোনো পাত্র ছাড়াই আঁজলা ভরে জল খেতে পারে, তবে তিনি পারবেন না কেন? তা হলে তাঁরই-বা জল খাবার জন্য শখ করে মাটির পাত্র রাখার দরকারটা কী? সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর সেই মাটির পাত্রটিকে ভেঙে ফেলে দিলেন। এবার তিনি মুক্ত হলেন সব ধরনের জাগতিক বস্তুর অধিকার থেকে। পরিণত হলেন সত্যিকার অর্থে একজন নিঃস্বে। কিন্তু তাঁর এই নিঃস্বতা যে কতখানি শ্রদ্ধা-উদ্রেককারী ছিল, সে কথা ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়। জগতের কোনো বস্তুর প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র লোভও ছিল না। তাঁর কাছে একটি হীরের টুকরো এবং একটি ইটের ভাঙা টুকরোর মধ্যে কোনো পার্থক্যই ছিল না।

তাঁর এই নির্লোভ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আর একটি চমৎকার গল্প আছে। মহাবীর আলেকজান্ডার ছিলেন বিশ্ববিজয়ী বীর। সারা পৃথিবীতে তিনি ছিলেন অসীম সম্মান, প্রচণ্ড ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী। প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ছিল তাঁর পদানত। মহাবীর আলেকজান্ডারও নাম শুনেছিলেন এই মহান দার্শনিকের। তিনি যুদ্ধ জয় করতে করতে যখন সাইনব শহরে এসে উপস্থিত হলেন, তখন ভাবলেন, এখানে যখন এসেই পড়েছি, তখন ডায়োজিনিসের সঙ্গে একবার একটু দেখা করেই যাওয়া যাক।

শীতের সকাল। ডায়োজিনিস সেদিন চোঙার পাশে বসে সকালের রোদ পোহাচ্ছিলেন। এমন সময় সেখানে এসে সদলবলে হাজির হলেন আলেকজান্ডার। তিনি নিজেই সামনে এগিয়ে গিয়ে বিনীতভাবে ডায়োজিনিসকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, আমি সম্রাট আলেকজান্ডার। আমি কি আপনার কোনো উপকার করতে পারি?

ডায়োজিনিস কিছু না বলে কেবল বিরক্তির সঙ্গে সম্রাটের মুখের দিকে তাকালেন। আলেকজান্ডার ডায়োজিনিসকে ছায়া দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

ডায়োজিনিস খানিক পরে বললেন, পারেন।

—পারি? আলেজান্ডার মহা আগ্রহে বললেন, বলুন, আমি আপনার কী উপকার করতে পারি? আমি আপনার যে-কোনো সাহায্যের জন্য প্রস্তুত।

—আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে সকালের রোদটুকু আটকে রেখেছেন। সরে গিয়ে রোদটা ছেড়ে দিতে পারেন। তা হলে আমার উপকার হয়।

আলেকজান্ডার লজ্জা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেন। যারা সম্রাটের সঙ্গে এসেছিল, তারা তো অবাক। এই সামান্য ভিক্ষুক শ্রেণীর লোকটা মহাবীর সম্রাটকে এমনভাবে অপমান করতে পারে, সেটা তারা ধারণাও করতে পারেনি। তারা ভেবেছিল, হয়তো সম্রাট এক্ষুনি রেগে গিয়ে বুড়োটাকে কতল করার আদেশ দেবেন।

কিন্তু আলেকজান্ডার কিছুই করলেন না, শুধু বিষণ্ন মনে ফিরতে ফিরতে বলতে লাগলেন, আমি যদি মহাবীর আলেকজান্ডার না হয়ে দার্শনিক ডায়োজিনিস হতে পারতাম, তা হলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।

ডায়োজিনিসকে নিয়ে আরও অনেক মজার গল্প আছে।

একদিন তিনি নগরীর পথের ধারে দাঁড়িয়ে এই বলে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, হে এথেন্সবাসী, তোমরা শুনে যাও, তোমরা সবাই এসো আমার কাছে। আমি তোমাদের একটা কথা বলব।

মহান দার্শনিককে এথেন্সের সবাই শুধু চিনতই না, তাঁকে সম্মান করত। তাই তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে জড়ো হতে লাগল তাঁর চারপাশে। নিশ্চয়ই তিনি আজ তাদেরকে কোনো জ্ঞানের কথা শোনাবেন। লোক জড়ো হতে লাগল হাজারে হাজারে। শেষে সবাই বলতে লাগল, আমরা এসে গেছি, মহান দার্শনিক। এবার আপনি আপনার কথা বলুন। তখন দার্শনিক ডায়োজিনিস বলতে লাগলেন, দ্যাখো, আমি একজন ভালো লোক খুঁজছি। তোমাদের মধ্যে এমন ভালো লোক কেউ কি আছে? আমি তাকেই খুঁজছি, অন্য কাউকে নয়।

ডায়োজিনিসের কথা শুনে সবাই তো হতবাক। কোথায় তিনি তাদেরকে জ্ঞানের কথা বলবেন, তা নয়, এসব কী বলছেন পাগলের মতো!

হতাশ হয়ে সবাই চলে গেল যে যার পথে। তারা ডায়োজিনিসের এই পাগলামোর কোনো অর্থই খুঁজে পেল না।

আর একদিনের একটি ঘটনা। ডায়োজিনিস দিনের বেলা লণ্ঠন জ্বেলে হাঁটছিলেন এথেন্সের একটা পথ দিয়ে। তাই একজন তাকে দেখে বলল, এ কী ডায়োজিনিস, আপনি দিনের বেলা আলো জ্বেলে পথ হাঁটছেন কেন?

ডায়োজিনিস বললেন, আমি একজন ভালো লোক খুঁজছি, তাই আলো জ্বেলে হাঁটছি।

মহান দার্শনিক ডায়োজিনিসের মৃত্যু হয় ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি তাঁর এক বন্ধুকে ডেকে বললেন, আমি মারা গেলে আমার মৃতদেহকে কবর দিও না। খোলা মাঠের মধ্যে ফেলে রেখো।

বন্ধু বললেন, তা হলে যে শেয়াল-শকুনে ছিঁড়ে খাবে।

—তা হলে এক কাজ কোরো।

-কী কাজ?

—আমার মৃতদেহের পাশে একটি শক্ত লাঠি রেখে দিও। ওই লাঠি দিয়ে শিয়াল- শকুন তাড়ানো যাবে।

—মরা মানুষ কি লাঠি ধরতে পারে নাকি? ডায়োজিনিস, এমন দুঃখের দিনেও তুমি হাসালে।

–তাই যদি হয়, তা হলে একজন মৃত মানুষের জন্য শিয়াল-শকুনকেও ভয় পাবার কিছুই নেই। কারণ, যে মৃত, যে সব ধরনের ভয়-ভাবনার ঊর্ধ্বে।

এই ছিলেন দার্শনিক ডায়োজিনিস। আজকের এই হানাহানি আর স্বার্থপরতার যুগে দার্শনিক ডায়োজিনিসের আদর্শ রূপকথার গল্প-কাহিনীর মতো বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি সত্যিকারভাবেই ছিলেন একজন জ্ঞানী ও পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি মোহমুক্ত মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *