জিওর্দানো ব্রুনো (আনু. ১৫৪৮–১৬০০ ) – সত্যপ্রচারের অপরাধে যাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল
টলেমির ভ্রান্ত দর্শনের বিরুদ্ধে কোপারনিকাস যে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে যান তার প্রজ্বলিত শিখাতেই আত্মাহুতি দিতে হয় আরেক জ্ঞানের সাধককে। তিনিও কোপারনিকাসের মতো করেই সমস্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, না, সৌরজগতের কেন্দ্র পৃথিবী নয়। তার মধ্যমণি হলো সূর্য। গ্রহগুলো সূর্যকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।
কোপারনিকাসের এই যোগ্য ভাবশিষ্যের নামই জিওর্দানো ব্রুনো। তাঁর জন্ম ১৫৪৮ সালে ইতালির নেপল্স বন্দরের নিকটবর্তী নোলা নামের ছোট্ট একটি শহরে।
যে ব্রুনো পরবর্তীকালে সারা বিশ্বের মহাজ্ঞানীদের অন্যতমরূপে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তিনি ছিলেন এক দরিদ্র ঘরের সন্তান। বলতে গেলে জন্ম-অনাথ ছিলেন তিনি।
জন্মের পর থেকেই তিনি মানুষ হয়েছিলেন এক গির্জায়। সেকালে গির্জাগুলো ছিল গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের কেন্দ্র বলতে যা বোঝায় তাই। আর এই কুসংস্কারের মূল কেন্দ্রেই আজন্ম লালিতপালিত হয়েছিলেন ব্রুনো। অথচ তাঁকে এসবের কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি, না ভেতরে, না বাইরে। তিনি বরং বড় হয়ে ভ্রান্ত ধারণা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন।
ব্রুনো ডমিনিকান নামে, একটি শক্তিশালী ধর্মীয় বর্গ বা গোত্রের মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন। শিক্ষাও লাভ করেছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৫৬৫ সালে তিনি আবার এই গির্জাতেই যোগ দিয়েছিলেন। গির্জায় যোগদানের আগে তাঁর নাম ছিল ফিলিপ্পো ব্রুনো (Filippo Bruno)। কিন্তু গির্জার পাদরি হওয়ার পর তাঁর নতুন নামকরণ করা হয় জিওর্দানো ব্রুনো।
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, গির্জার দেয়া এই ধর্মীয় নামেই পরবর্তীকালে তিনি জগদ্বিখ্যাত জ্ঞানী-পুরুষের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আবার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য এই গির্জার ধর্মান্ধ সন্ন্যাসীরাই তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছিল।
তিনি গির্জায় যখন প্রথম প্রবেশ করেন, তখন তাঁর এই কুসংস্কার সম্পর্কে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এখানেই সংঘটিত একদিনের এক আকস্মিক ঘটনার ভেতর দিয়ে তাঁর জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটায়।
গির্জার গ্রন্থাগারে একদিন তিনি আবিষ্কার করেন একটি বই। নিকোলাস কোপারনিকাসের লেখা গ্রহগতি সংক্রান্ত এই বইটিই তাঁর গোটা জীবনকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দেয়। তিনি বইটি পড়ে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েন যে, তাঁর পক্ষে আবেগ দমন করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। উৎসাহের বশে একদিন তিনি গির্জাবাসী এক সহযোগীর কাছে প্রকাশ করে ফেলেন তাঁর মনের কথা। জানান, কোপারনিকাসের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার কথা। ফলে ব্রুনোর এই নতুন চিন্তাধারার কথা ক্রমেই জানাজানি হয়ে গেল চারদিকে।
কোপারনিকাসের মতের সমর্থন করার অর্থ তখন আর কিছু ছিল না, ছিল সোজাসুজি ধর্মের বিরোধিতা করা। গির্জা আর ধর্মের বিরুদ্ধাচারণের কী ভয়ানক শাস্তি, তা ব্রুনোও জানতেন। তাই আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় তিনি গির্জা ছেড়ে পালালেন। ১৫৭৬ সালে তিনি নোলা থেকে পালিয়ে চলে যান রোমে। তারপর সেখানেও নিরাপদ নয় ভেবে চলে যান সুইজারল্যান্ডে। ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার জন্য তাঁকে একাকী নিঃস্ব অবস্থায় দুর্গম আস্ পর্বত ডিঙোতে হয়। সে ছিল এক ভয়ংকর ব্যাপার। কিন্তু জেনেভায় গিয়েও তিনি নিরাপদ থাকতে পারলেন না। ১৫৮১ সালে তিনি পালিয়ে চলে যান প্যারিসে। এখানে দু বছর কাটিয়ে ১৫৮৩ সালে চলে যান লন্ডনে।
তবে তাঁর কোপারনিকাসীয় মতবাদ লন্ডনে হালে খুব একটা পানি পেল না। কারও কারও হৃদয়ে সামান্য স্পর্শ করলেও, অধিকাংশ মানুষই তা প্রত্যাখ্যান করলেন।
ব্রুনো তাঁর এই নির্বাসিত জীবনের কোথাও স্থির থাকেননি। ক্রমাগত স্থান বদল করে প্রচার করেছেন তাঁর নতুন মতবাদ। আর একাজ করেছেন তিনি একান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। প্রচার করার সময় কোথাও তিনি তাঁর বক্তব্যকে ঘোলাটে করার চেষ্টা করেননি।
১৫৮৫ সালে তিনি প্যারিসে গিয়ে টলেমি ও অ্যারিস্টটলের মতবাদের বিরুদ্ধে প্ৰবন্ধ লিখেন। ফলে সেখানে থাকাও তাঁর জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। ১৫৯০ সালে তিনি তাঁর বক্তব্য পেশ করেন জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের এক জ্ঞানী সমাবেশে। এ সময় প্রদত্ত তাঁর বক্তব্যের সার-বিষয়বস্তু কোপারনিকাসের মতবাদ অধিকার করে থাকলেও, পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব চিন্তা-চেতনার অংশও তাতে কম ছিল না।
ব্রুনো যেকথা বলতে চেয়েছিলেন, তা হলো : খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা ঈশ্বরের সৃষ্টির যে অসীম ক্ষমতার কথা বলেন, তা অসীম ব্রহ্মাণ্ডের সাথে সমাঞ্জস্যপূর্ণ। ঈশ্বর এবং ব্রহ্মাণ্ড—এ দুই যেন একই নিয়মের দুটো ভিন্ন দিক মাত্ৰ।
ব্রুনোর বক্তব্য ছিল, মানুষ নিজেই একটি ক্ষুদ্র জগৎবিশেষ। আর ঈশ্বরের অস্তিত্ব তাঁর মনের একান্ত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার।
কিন্তু ব্রুনোর এই মতবাদ তখনকার চার্চের এবং প্রচলিত ধর্মীয় মতবাদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হওয়ায় অচিরেই তিনি চার্চ এবং ধর্মযাজকদের কোপানলে পতিত হন।
চার্চকে সেকালে সবাই শ্রদ্ধা করত ধর্ম আর ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে। চার্চের মতামতই চরম সত্য, আর সবই ছিল বাতিলযোগ্য মতবাদ। এই ছিল তাদের সর্ববাদী বিধান।
তাই একদা চার্চের ধর্মযাজক এবং কুসংস্কার বিরোধী জোতির্বিজ্ঞানী ব্রুনো হয়ে ওঠেন চার্চের ঘোরতর শত্রু। তাঁর বিরুদ্ধে উঠতে থাকে অজস্র অভিযোগ।
এই চরম বিরুদ্ধ পরিবেশেও দুঃসাহসিক ব্রুনো তাঁর মতবাদ প্রচার করে ঘুরতে লাগলেন দেশ থেকে দেশান্তরে।
এই অবস্থাতেও দেশে ফেরার জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদে, কিন্তু সাহস হয় না। দেশের গোঁড়াপন্থিরা তাঁর প্রতি যে ভয়ানক ক্ষিপ্ত।
অবশেষে ১৫৯১ সালে জিলোভানি মচেনিগো নামের এক নবীন ইতালীয় নেতার আশ্বাসে ও সহায়তায় ব্রুনো দীর্ঘদিন পর পা রাখেন স্বদেশের মাটিতে।
কিন্তু এই মচেনিগো ছিলেন বিশ্বাসঘাতক। সেখানে আসার এক বছরের মধ্যেই তিনি স্থানীয় ইনকুইজিশনের হাতে তুলে দিলেন ব্রুনোকে। ধর্মের বিরুদ্ধাচরণের অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার করার জন্য গঠিত বিচারসভাকে বলা হয় ইনকুইজিশন। ইনকুইজিশন তো এমনিতেই তাঁকে খুঁজে ফিরছিল—এবার তাকে সরাসরি হাতে পেয়ে তার মৃত্যুদণ্ডদানের ব্যবস্থা করল।
১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে ব্রুনো বন্দি হন। বন্দি অবস্থায় তিনি কাটান আট বছর। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্রুনো যদি তাঁর মত পরিবর্তন করেন, তবে চার্চের জয় হবে এবং চার্চের মত অভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হবে। কিন্তু যা সত্য, যা ধ্রুব, তাকে ব্রুনো অস্বীকার করতে পারেন না। তাই ব্রুনো তাঁর সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
ফলে মৃত্যুদণ্ডের খড়্গগ নেমে আসে তাঁর মাথার ওপর। ইনকুইজিশনের নির্মম এবং ধর্মান্ধ লোকজনেরা ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি মহান সত্যের সাধক ব্রুনোকে আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে। এমনি করেই ব্রুনো সত্যের জন্য বিসর্জন দেন নিজের জীবন। জীবনের চেয়ে তাঁর কাছে সত্য ছিল অনেক বড়। তাই তিনি সত্যের জন্য জীবন দিয়েছেন। মিথ্যার কাছে নতি স্বীকার করেননি। এ-রকম দৃষ্টান্ত জগতে একান্তই বিরল।