ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) – বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) – বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক

নিমাই পণ্ডিত গয়া থেকে ফিরে এসেছেন নবদ্বীপে। কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ এক নতুন মানুষ। পাণ্ডিত্যের অভিমান, শাস্ত্রীয় তর্কের বিলাস, কিছুই আজ তাঁর নেই। তিনি আজ নিরভিমান, আপনভোলা এক মহাসাধক। মুখে তাঁর শুধু কৃষ্ণনাম, দু চোখ বেয়ে ঝরে অশ্রুধারা। নবদ্বীপের লোকজনতো অবাক—কেমন করে তাঁর রাতারাতি এমন পরিবর্তন হয়ে গেল।

নিমাই পরলোকগত পিতার পিণ্ডদান করার জন্য গিয়েছিলেন গয়ায়। সেখানে ফল নদীতে স্নান করে শুদ্ধচিত্ত হয়ে বিষ্ণু-মন্দিরে প্রবেশ করেন। দলে দলে তীর্থযাত্রীরা আসছে, শ্রদ্ধা নিবেদন করছে— চারদিকে পবিত্র ভাব। এ সমস্ত দেখতে দেখতে নিমাই পণ্ডিতের এক সময় ভাবান্তর হলো। থরথর করে কেঁপে তাঁর সমস্ত শরীর। দু চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে অবিরল অশ্রুধারা, ভক্তিরসের আবেশে তিনি আত্মহারা। একপর্যায়ে ভাবাবেশে মূর্ছা যাবার দশা হয়। এমন সময় একজন বৈষ্ণব তাঁকে ধরে ফেলেন। তাঁর বাহ্যজ্ঞানহীন দেহটাকে বুকে আশ্রয় দিয়ে আদর করতে থাকেন।

এই বৈষ্ণব আর কেউ নন, পরম ভগবত ঈশ্বরপুরী। নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁর আগে থেকেই পরিচয় ছিল। জ্ঞান ফিরে আসামাত্রই নিমাই পণ্ডিত ঈশ্বরপুরীকে চিনতে পারেন এবং তাঁকে প্রণাম করে বিনীতভাবে বলেন, “প্রভু, কৃপা করে আমায় মন্ত্র দিন, চরণে আশ্রয় দিন। সংসারবন্ধন থেকে মুক্তিলাভের মন্ত্র আমায় দান করুন। কীভাবে কৃষ্ণলাভ হবে আমায় বলে দিন।”

কয়েকদিনের মধ্যে ঈশ্বরপুরী তাঁকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা দিলেন। সেদিনের নিমাই পণ্ডিত হলেন পরবর্তীকালের প্রেম-ভক্তিধর্মের প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য বা মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব।

আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে ১৪৮৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনী দোল পূর্ণিমা তিথিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ শহরের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে শ্রীচৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতার নাম শচীদেবী 1 জগন্নাথের পিতা উপেন্দ্র মিশ্রের আদি নিবাস ছিল সিলেট জেলার ঢাকা-দক্ষিণ গ্রাম। বিদ্যার্জনের জন্য জগন্নাথের সিলেট থেকে নবদ্বীপে আগমন। এখানে শচীদেবীকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। শ্রীচৈতন্য জন্মগ্রহণ করার আগেও তাঁর মাতা শচীদেবীর কয়েকটি সন্তানের অকাল মৃত্যু হয়। বেঁচে থাকেন কেবল জ্যেষ্ঠপুত্র বিশ্বরূপ ও কনিষ্ঠপুত্র চৈতন্য। শ্রীচৈতন্যের বাল্যনাম নিমাই। কথিত আছে, তিনি নিম গাছের নিচে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল নিমাই। তাঁর আরও একটি নাম ছিল বিশ্বম্ভর। পাড়ার লোকেরা তাঁর সোনার বরণ রূপ দেখে ডাকতেন শ্রীগৌরাঙ্গ বলে। আর ভক্তদের কাছে তিনি নবদ্বীপচন্দ্র, মহাপ্রভু এবং গৌরসুন্দর নামে পরিচিত হন।

নিমাইয়ের যখন দশ-এগারো বছর বয়স, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। বিধবা মাতা পুত্রকে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে পড়তে পাঠালেন। নিমাইয়ের ছিল অসাধারণ মেধা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করে নিজেই অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই কিশোর বয়সেই তিনি কাশ্মিরের বিখ্যাত পণ্ডিত কেশব মিশ্রকে শাস্ত্রীয় তর্কে পরাজিত করে খ্যাতি অর্জন করেন।

নিমাইয়ের বড় ভাই বিশ্বরূপ সংসার ছেড়ে চলে গেছেন— নিমাইও যাতে বিবাগী না হন, সেজন্য শচীদেবী এক পরমা সুন্দরী কন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিলেন অল্প বয়সেই। চৈতন্যদেবের প্রথম বিয়ে হয়েছিল ১৫০২ সালে পণ্ডিত বল্লভাচার্যের কন্যা লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে।

এই সময় তাঁর খুব আর্থিক কষ্ট যাচ্ছিল। তার পিতৃপুরুষদের অনেক সম্পত্তি ছিল সিলেটে। সেই সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য তিনি জলপথে সিলেট গমন করেন। তাঁর অনুপস্থিতকালে সর্পদংশনে লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যু হয়। টাকাকড়ি নিয়ে তিনি সিলেট থেকে নবদ্বীপ ফিরে আসেন। তিনি স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ শুনে ব্যথিত হন এবং ভক্তি অনুশীলনে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু মায়ের অনুরোধে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন রাজপণ্ডিতের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়াকে। কিন্তু সংসারের বন্ধন তাঁকে ধরে রাখতে পারল না।

ততদিনে চৈতন্যদেবের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরি, পুরীর বাসুদেব সার্বভৌম ও কাশীর প্রকাশনন্দ সরস্বতীকে বিদ্যার প্রতিযোগিতায় তিনি পরাজিত করেন।

তিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সে পিতার পিণ্ডদানের জন্য গয়ায় গমন করেন ১৫০৮ সালে। সেখানে তিনি বৈষ্ণবভক্ত ঈশ্বরপুরীর কাছে দশাক্ষর গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ’ করেন। দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর মনে প্রবল ভক্তিভাবের উদয় হয়। কৃষ্ণপ্রেমে আসক্ত হয়ে তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। টোলের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে নিজে নাম-সংকীর্তন শুরু করলেন এবং অন্য আর সবাইকে উৎসাহিত করতে লাগলেন। তিনি ছাত্র ও শিষ্যদের স্বরচিত পদ গেয়ে সংকীর্তনে শিক্ষা দিতে লাগলেন এই বলে—

“হরি হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ।
গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসুগন। ”

অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দ, হরিদাস, শ্রীবাস পণ্ডিত, মুকুন্দ দত্ত প্রমুখ বৈষ্ণবভক্ত চৈতন্যদেবের সঙ্গে যোগ দিলে বৈষ্ণবদের প্রভাব বেড়ে যায়। এরপর নবদ্বীপের ঘরে ঘরে “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”–সংকীর্তন শুরু হয়ে যায়। কৃষ্ণপ্রেমের বন্যায় “শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে (নদীয়া) ভেসে যায়” অবস্থার সৃষ্টি হয়।

হিন্দুদের মধ্যে যারা বৈষ্ণমতের বিরোধী ছিল, তারা চৈতন্যদেবের কার্যকলাপকে হিন্দু ধর্ম বিরোধী বলে আখ্যায়িত করে নবদ্বীপের মুসলিম শাসক চাঁদ কাজির কাছে অভিযোগ করে। এছাড়া নবদ্বীপের মুসলিম শাসকরা তাঁকে ভুল বুঝতেও শুরু করেন। তাঁরা চৈতন্যদেবের কার্যক্রমের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজতে থাকেন। তারা এও বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর সংকীর্তন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দু জাগরণ এবং নিজের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ঘটাতে শুরু করেছেন।

শ্রীচৈতন্য প্রতিদিন তাঁর শিষ্যদের নিয়ে সন্ধ্যাউত্তীর্ণ হলেই সংকীর্তণ করে নগর পরিক্রমণ করতেন। মুসলিম শাসক বৈষ্ণবদের এই কীর্তন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও শ্রীচৈতন্যদেব ব্যাপারটিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। সেদিনই তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে সংকীর্তন শোভাযাত্রা করে কাজির বাড়ির কাছে পৌঁছুলেন। তখন তাঁর বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তার ভক্ত হয়ে যান। চাঁদ কাজি তার সংকীর্তন সম্পর্কে জারি করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। এঘটনার পর চারদিকে শ্রীচৈতন্যের জয় জয়কার শুরু হয়ে যায়।

শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবতত্ত্ব হিন্দু ধর্মের নব সংস্করণ। তাঁর উদ্ভাবিত বৈষ্ণবধর্মের একটি সামাজিক তাৎপর্য বিদ্যমান। জাতিভেদ প্রথা অস্বীকার করায় বৈষ্ণবতত্ত্ব সমাজের নির্যাতিত মানুষের কাছে প্রবল আবেগের সঞ্চার করে।

তিনি সংসারের সমস্ত চিন্তা পরিত্যাগ করে বিভোর হয়ে থাকতেন কেবল ভগবানের ধ্যানে। তিনি কৃষ্ণনামের সংকীর্তন করার জন্য নবদ্বীপে গঠন করেন দল। দলে দলে বৈষ্ণবরা এসে তাঁর সাথে মিলিত হতে থাকে। শ্রীবাসের অঙ্গনে নিয়মিত কীর্তন চলতে থাকে। আর তিনি কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে থাকেন। একদিন তিনি তাঁর ভক্তদের ডেকে বললেন, এই নবদ্বীপে আরেক মহান পুরুষ আছেন। আমি তাঁর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়েছি। এরপর তিনি একদিন সকল শিষ্যকে নিয়ে সোজা নন্দন আচার্যের গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন। যে মহাপ্রেমিক সন্ন্যাসীকে সেদিন তিনি আবিষ্কার করে নিয়ে এলেন, তাঁর নাম শ্রীনিত্যানন্দ। তিনি চৈতন্যদেবের পরম ভক্ত হয়ে তাঁরই নামের সাথে যুক্ত হয়ে আছেন গৌরনিতাইরূপে।

এভাবে চৈতন্যদেব তাঁর পাশে টেনে আনলেন চট্টগ্রামের পুণ্ডরীক বিদ্যানিধিকে, দরিদ্র শ্রীধর পণ্ডিত এবং ভক্ত হরিদাসসহ আরও অনেককে। এমনি করেই তাঁর নবপ্রবর্তিত প্রেম-ভক্তির ধর্ম দেখতে দেখতে শক্তিশালী হয়ে উঠল। এ-রকম অবস্থাতেই নিমাই একদিন সংসারত্যাগী হলেন—হলেন সন্ন্যাসী। নাম হলো চৈতন্য। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪।

এই বয়সেই তিনি অর্থাৎ ১৫১০ সালের ২৬ জানুয়ারি মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একরাত্রে সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য গৃহত্যাগ করে কাটোয়ায় গমন করেন। সেখানে কেশব ভারতী নামের একজন প্রসিদ্ধ আচার্যের কাছে সন্ন্যাসদীক্ষা গ্রহণ করেন। গুরু কেশবভারতী শিষ্যের নাম রাখেন শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। সন্ন্যাস নেয়ার পর চৈতন্যভক্তির ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লে শিষ্যরা বৃন্দাবন যাবার নাম করে তাঁকে ভুলিয়ে শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু সেখানেও তাঁকে বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি।

চলে এলেন পুরীতে। পুরীতে জগন্নাথদেবের মন্দির। মন্দিরে ঢুকেই চৈতন্যদেব ভাবে বিভোর হয়ে গেলেন। দু হাত বাড়িয়ে জগন্নাথদেবকে বুকে জড়িয়ে ধরতে গেলে পাণ্ডারা বাধা দিলেন। শ্রীচৈতন্যদেব পড়ে গেলেন। জ্ঞানহারা হলেন। এ সময়ে মন্দিরে এলেন পুরীর রাজপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম। তিনি চৈতন্যদেবকে দেখে অবাক হলেন। তিনি তাঁকে এ-অবস্থায় নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। ভক্তরা সাথে গেলেন। বাসুদেব শ্রীচৈতন্যদেবের পরিচয় জানলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। বাসুদেব তাঁর সাথে শাস্ত্র আলোচনা করে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। শেষে তিনি শ্রীচৈতন্যদেবকে প্ৰভু বলে স্বীকার করলেন।

সেখান থেকে তিনি যান নীলাচলে। পুরী থেকে প্রেমভক্তি প্রচারের জন্য তিনি দাক্ষিণাত্য গমন করেন। সেখানে তিনি ১৫১০ থেকে ১৫১২ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের তীর্থস্থানসমূহ দর্শন করে বেড়ান। এসময় রামানন্দ রায় এবং পরমানন্দপুরী তাঁর ভক্তিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

এরপর তিনি সেখান থেকে বৃন্দাবন যান। সেখানে গিয়ে তিনি অনেক লুপ্ত তীর্থস্থান উদ্ধার করেন। এখানে রূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, শ্রীজীব ও গোপাল ভট্টকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দান করেন। তাঁরা ‘ছয় গোসাই’ নামে পরিচিত। চৈতন্যদেবের নির্দেশে তাঁরা বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন।

এরপর অরণ্যপথে কাশী, প্রয়াগ, মথুরা ও বৃন্দাবন ভ্রমণ করেন তিনি। ১৫১৬ সালে তিনি আবার নদীয়াতে ফিরে আসেন। নবদ্বীপ এসে মাকে শেষবারের মতো দেখে যান। তিনি এসেছেন জেনে পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়া স্বামীকে দেখার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন। মাকে দেখে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়ার ঘরের দিকে তাকান। বিষ্ণুপ্রিয়াও স্বামীকে প্রণাম করলেন।

শ্রীচৈতন্যদেব পত্নীকে জিগ্যেস করেন, তুমি কে? বিষ্ণুপ্রিয়া উত্তর দেন, আমি বিষ্ণুপ্রিয়া।

—তুমি কৃষ্ণপ্রিয়া হও। একথা বলেই তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করেন সেখান থেকে।

তখন বৃন্দাবনের খুবই দুরবস্থা। তাই শ্রীচৈতন্যদেব সেখানে বৈষ্ণবধর্মের প্রচার ও সংস্কার করলেন। বৃন্দাবনের কাজ শেষ করে তিনি গেলেন কাশীতে। এভাবে শ্রীচৈতন্যদেব ২০-২২ বছর কাটিয়ে দিলেন জীবনের শেষ আঠারো বছর তিনি পুরীতে বসবাস করেন। শেষ জীবনে তিনি সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে দিব্যভাবে বিভোর অবস্থায় দিন যাপন করতেন।

জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যে আছে রথের সামনে নাচবার সময় চৈতন্যদেবের পায়ে ইটের টুকরো বিধে যায়। পরে সেখান থেকেই বিষাক্ত ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এই ব্যাধিতেই তাঁর জীবনের অবসান ঘটে ১৫৩৩ সালের ২৯ জুন।

তাঁর মৃত্যুমুহূর্ত নিয়ে একটি কিংবদন্তিও প্রচলিত আছে। সেখানে বলা হয়েছে, তিনি সেদিন জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করার। সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের দরজা গেল বন্ধ হয়ে যায়। সবাই বাইরে অপেক্ষা করছেন, ভেতরে শুধু তিনি আর জগন্নাথ।

তারপর যখন কপাট আপনা থেকেই খুলে গেল, তখন ভেতরে আর শ্রীচৈতন্যদেবকে দেখা গেল না। তিনি চিরতরে অন্তর্হিত হয়েছেন। অনেকের ধারণা, তিনি জগন্নাথদেবের বিগ্রহে বিলীন হয়ে যান।

শ্রীচৈতন্য ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের নেতা। প্রাচীন বৈষ্ণবধর্মের দ্বৈতবাদ অস্বীকার করে তিনি অচিন্ত্যভেদাভেদবাদের আদর্শে বৈষ্ণবধর্মকে নতুন রূপদান করেন। তাঁর মত অনুসারে ভক্তির দ্বারাই ঈশ্বর লাভ করা সম্ভব। ঈশ্বর প্রেমময় ও করুণার আধার। প্রেমাস্পদে ও সর্বজীবে মায়া ও মমতারূপে তাঁর প্রকাশ। ঈশ্বরকে প্রেমাস্পদের মতো ভালবাসলে তাঁকে লাভ করা যায়। রাধাকৃষ্ণের (জীবাত্মা-পরমাত্মা) প্রেমের রূপকল্পে তিনি ভগবানের প্রতি ভক্তের প্রেমের লীলামাধুর্য উপস্থাপন করে গেছেন। শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবতত্ত্ব হিন্দুধর্মের নব সংস্করণ। বর্ণাশ্রম প্রথাকে অস্বীকার করে গীতার ভক্তিবাদকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে তিনি হিন্দুধর্মকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে গেছেন। তাঁর উদ্ভাবিত বৈষ্ণব ধর্মের একটি সামাজিক তাৎপর্য বিদ্যমান। জাতিভেদ প্রথায় নিপীড়িত হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকলে চৈতন্যদেব তাঁর ধর্মীয় আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন।

ধর্ম সাধনায় নর্তন-কীর্তন ও শোভাযাত্রার প্রবর্তন এবং জাতিভেদ প্রথা অস্বীকার করায় বৈষ্ণবতত্ত্ব সমাজের নির্যাতিত মানুষের কাছে প্রবল আবেগের সঞ্চার করে। বর্ণাশ্রম প্রথায় নিপীড়িত বাঙালি হিন্দু-সমাজ ব্যাপকভাবে চৈতন্যবাদ গ্রহণ করে। ভক্ত হরিদাসের মতো অনেক মুসলমানও বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে তাদের জীবন ধন্য করে।

চৈতন্যদেবের আবির্ভাব কেবল ধর্ম ও সামাজিক ক্ষেত্রে নয়, বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনেও এক বৈপ্লবিক ঘটনা। তাঁর বৈষ্ণবতত্ত্বকে অবলম্বন করে বৈষ্ণব কবিরা রচনা করেন পদাবলী গান। বৈষ্ণবদের কীর্তনের জন্য রচিত হলেও প্রেমমূলক গীতিকবিতা হিসেবে এর মূল্য অসাধারণ। বৈষ্ণবতত্ত্বের অনেক শিক্ষাগুরু চৈতন্যদেবকেও ঈশ্বররূপে বিশ্বাস করে তাঁর প্রতি ভক্তি প্রকাশের জন্য তাঁর প্রশংসামূলক জীবনী রচনা করেন।

বৈষ্ণবতত্ত্বকে কেন্দ্র করে বাংলা কাব্যসাহিত্যে যে নতুন ধারার সৃষ্টি হয়, সাহিত্যের ইতিহাসবিদরা তাকে ‘চৈতন্যযুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। চৈতন্যদেবের ভক্তদের মতে তিনি কৃষ্ণের অবতার। কিন্তু তাঁর দেহকান্তি ও আচরণ বিরহিণী রাধার মতো। তাই তাঁকে বলা হয় রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ।

সনাতন ধর্মের এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব হয়েছিল। এই সময়েই তিনি প্রচার করলেন ঈশ্বরের আরাধনায় সকলের সমান অধিকার। প্রাণে ভক্তি নিয়ে ঈশ্বরকে ডাকলে তাঁকে পাওয়া যায়। ভক্তিতেই মুক্তি।

যেই ভজে সেই বড় অভক্তিহীন ছার।
কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি-কুলাদি বিচার

—শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত

তিনি সকল মানুষের জন্য যে মহানাম প্রচার করে গেছেন, তা হলো-

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে,
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।

শ্রীচৈতন্যদেবের লীলা ছিল চিরন্তন এবং শাশ্বত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *