ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

জরথুশত্র (৬২৮-৫৫১ খ্রি. পূ.) – পারশি ধর্মের প্রবর্তক

জরথুশত্র (৬২৮-৫৫১ খ্রি. পূ.) – পারশি ধর্মের প্রবর্তক

এখন যেটা আধুনিক ইরান, এককালে তার নাম ছিল পারস্য। এই প্রাচীন পারস্যেই একটি ধর্মমত প্রচলিত ছিল, যার নাম ‘পারশি’। পারশি ধর্ম মতবাদের যিনি প্রবর্তক, তিনি হলেন জ্ঞানের সাধক জরথুশ্‌ত্র (Zarathustra)। গ্রিক উচ্চারণে জোরোয়াস্টার (Zoroaster)।

জরথুশত্র ছিলেন গভীর ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী এক মহান পুরুষ এবং নেতা। তাঁর প্রচারিত মতবাদ ও আদর্শ একদা পারস্যে ধর্মীয় বিপ্লব আনতে সক্ষম হয়েছিল।

তাঁর আবির্ভাবকাল নিয়ে মত পার্থক্য আছে। জরথুস্ত্রীয় মতবাদে বিশ্বাসী পণ্ডিতবর্গ এবং পাশ্চাত্যের কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন, জরথুশত্রর জন্ম হয়েছিল মহাবীর আলেকজান্ডারের পারস্য আক্রমণের ২৯৮ বছর আগে। আলেকজান্ডার পারস্যের পার্সেপোলিস ধ্বংস করেছিলেন ৩৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। তা হলে জরথুশত্রর জন্মসাল দাঁড়ায় ২৯৮ + ৩৩০ = ৬২৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ।

তিনি জীবিত ছিলেন ৭৭ বছর। এ হিসেবে তাঁর জন্মসাল দাঁড়ায় ৬২৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ এবং মৃত্যু ৫৫১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ।

কিন্তু আরেকদল পণ্ডিত জরথুশত্রর জীবনকালের এই হিসেব মেনে নেননি। তাঁরা অনেক যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, এই ধর্মসাধকের আবির্ভাব হয়েছিল আরও বহু শতাব্দীকাল আগে। তাঁদের অনুমান, তিনি ২০০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের কোনো এক সময়ে জীবিত ছিলেন। হয়তো তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন ১৭০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যে।

এই হিসেবে দাবি করা হয়, তাঁর প্রচারিত ধর্মমত অর্থাৎ পারশি ধর্ম বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ধর্মমত। সনাতন হিন্দুধর্মের পরেই এর স্থান।

জরথুশত্রর জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। জরথুশ্‌ত্র—এটা কি তাঁর নাম, নাকি উপাধি, এ সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কোথাও কিছু বলা হয়নি। জরথুশত্র শব্দের অর্থ হলো ‘বুড়ো উটওয়ালা’। কে জানে, তিনি হয়তো তা-ই ছিলেন। এই নামেই লোকে তাঁকে চিনত। হয়তো একসময় উপাধির অন্তরালে হারিয়ে গেছে তাঁর সত্যিকারের নামটি।

তবে এটুকু জানা গেছে, বাল্যকালেই তিনি স্থানীয় পণ্ডিতদের কাছে ধর্মীয় শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর যখন আবির্ভাবকাল তখন তো ছাপানো বইপত্র ছিল না। পণ্ডিত মশাইরা মুখস্থ করে রাখতেন সেকালের তন্ত্রমন্ত্র এবং শ্লোক ইত্যাদি। আর এই মুখস্থ করা শ্লোকই তিনি তাঁর শিষ্যদের আবার মুখস্থ করাতেন। এভাবেই চলত মুখে-মুখে বিদ্যাশিক্ষা।

জরথুশত্রের আবির্ভাবের কাল পর্যন্তও একেশ্বরবাদের বিকাশ ঘটেনি। তখনও পারস্যে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বলতে ছিল কেবল নানা দেবদেবীর পূজা।

কিন্তু জরথুশত্রের এই প্রচলিত ধর্মকর্মে মন বসত না। তিনি ভাবতেন এসব বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে কোনো ঈশ্বরসাধনা বা সত্যসাধনা নেই। সত্যের সন্ধান করতে হলে তাঁকে যেতে হবে আরও অনেক দূরে, অন্য কোনোখানে।

তিনি চাইতেন সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও সুখী জীবন গঠন। সেখানেই রয়েছে সত্যিকার শান্তি। শান্তির আঙিনাতেই আবির্ভূত হবেন এক শক্তিমান ঈশ্বর।

তিনি তাঁর এই সময়কার দুঃসহ জীবন সম্পর্কে বলেছেন, “আমি আমার পরিবার এবং গোত্র থেকে যেন সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে আছি। আমি আমার গ্রাম কিংবা গোত্রপতির কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। তা হলে আমি শান্তির সন্ধানে কোন্ দেশে পালিয়ে যাব? কোথায় আমি আমার পা রাখব?”

তাঁর বয়স যখন ৩০, তখন এক বসন্ত উৎসবের দিনে তিনি গিয়েছিলেন পাশের নদীর ধারে ঝরনা থেকে জল আনতে। সেখানে তিনি ঝরনার স্রোতধারার পরিষ্কার পবিত্র জলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যান। তাঁর হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় এক বিস্ময়কর অনুভূতি। এই নির্মল জলধারার সৃষ্টি কে করেছেন? কে সৃস্টি করেছেন এই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীকে? কে তিনি?

তাঁকেই তিনি পেয়েছিলেন প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের মধ্যে। এখান থেকেই ঘটে যায় তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন। তিনি তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে আগে থেকেই বহু দেবতাবাদে বিশ্বাস করতেন না। এবার তাঁর মন গেল এ-ব্যাপারে আরও বদলে।

জরথুশ্‌ত্র এই যে সর্বশক্তিমান এক ঈশ্বরের সন্ধান পেলেন তাঁকেই তিনি অভিহিত করেছেন ‘আহুরা মাজদা’ বা ‘ওহরমাজদ’ বলে। তিনি হলেন মঙ্গলময়। শুধুই ভালো। আর ভালো মানেই আলো। সূর্য হলো আলোর প্রতীক। তিনি সূর্য আর আলোর রূপ ধারণ করে (আগুনের প্রতীকে) দেখা দেন।

জরথুশ্‌ত্র সম্পর্কে এ-রকমের কিংবদন্তি প্রচলিত আছে যে, কথিত ঝরনার পাড় থেকেই তিনি এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের সন্ধানে বের হয়ে পড়েন। আর ঘরে ফিরে যাননি। বহু দিন তাঁর খোঁজই পাওয়া যায়নি।

এভাবে কেটে যায় কুড়িটি বছর। এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন, কেউ বলতে পারে না। অনেক দিন পরে তিনি নেমে এলেন এক পাহাড় থেকে। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে ঝরতে লাগল আগুন। কিন্তু তাতে তাঁর কিছুই হলো না। তিনি আগুনের ভেতর থেকেই হেঁটে বের হয়ে এলেন।

অনেকে বলেন, তিনি হয়তো এই কুড়িটি বছর ঈশ্বরের ধ্যানেই কাটিয়েছেন দুর্গম পাহাড়ের কোনো নির্জনতায়। সাধনায় করেছেন সিদ্ধিলাভ। তারপর মনুষ্যসমাজে ফিরে এসে প্রচার করেছেন তাঁর ধর্মমত। সবাইকে শুনিয়েছেন এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের সত্যবাণী।

তাঁর মতে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হলেন আহুরা মাজদা। তিনি আলো ও মঙ্গলময়। এই আহুরা মাজদাকে যারা বিশ্বাস করে না, তারা পাপী। তারা অন্ধকারের বাসিন্দা। পাপ ও মন্দের প্রতীক হলো অন্ধকার। তার নাম আহ্রিমান। মন্দ বা আরিমানকে দমন করার জন্য মঙ্গলময় আহুরা মাজদা সর্বক্ষণ চেষ্টা করছেন।

পৃথিবীর মানুষকে সবসময় ভালোর দিকে থাকতে হয়। নইলে মন্দের দেবতা আরিমান তাকে দুঃখকষ্টের মধ্যে ফেলে দেন। তারপর মৃত্যুর পরও তাকে নিয়ে যান দুঃখময় নরকের অন্ধকারে।

জরথুত্র তাঁর ধর্মমত এবং উপলব্ধি পাঁচটি গাথাতে প্রকাশ করেছেন। তিনি যখন তাঁর বাণী বা গাথাগুলো প্রচারে ব্রতী, তখনও গ্রন্থ রচনার কোনো প্রচলন হয়নি। তাই প্রথমে তাঁর গাথাগুলো মুখে-মুখেই প্রচলিত ছিল। জরথুশত্রের গাথাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় যিশু খ্রিস্টের জন্মের সামান্য কিছু আগে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, এসব বাণী বা উপদেশ তিনি লাভ করেছেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা আহুরা মাজদার কাছ থেকে। তিনি ঈশ্বরের বাণীকেই বিশ্বের মানুষের কাছে প্রচার করছেন।

ঈশ্বরের বাণী প্রচার করলেও জরথশূত্রের প্রচারিত ধর্মমতে কোনো ব্যক্তিকে সহজে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষিত করেননি। তিনি তাঁর ধর্মমত প্রচার শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যে কেবল তাঁর এক মামাত বোনকে দীক্ষিত করেছিলেন।

জরথুশত্রের জন্মস্থান ছিল বর্তমান ইরানের রাজধানী তেহরানের উপকণ্ঠে রেজেস বা রাই নামের এক জায়গায়। ধর্মমত প্রচার করার কয়েক বছর পর তিনি স্বদেশ ছেড়ে চলে আসেন আরও অনেক পূর্বে রাজা ভিতাপার রাজ্যে। রাজা ভিতাপা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রচারিত নতুন ধর্মমতে দীক্ষা গ্রহণ করেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জরথুশত্র রাজা ভিত্তাস্পার কাছেই ছিলেন এবং তাঁর সহায়তায় দেশের ভেতরে তাঁর ধর্মমত প্রচার করার সুযোগ পান।

কিন্তু জরথুশত্রের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। বলা হয়, তিনিও আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল জামাপ্। এ ছাড়া তাঁর আরও দুজন স্ত্রী ছিল। তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীর গর্ভজাত একজন করে ছেলে এবং একজন করে মেয়ে ছিল। অর্থাৎ তিনি মোট তিন ছেলে এবং তিন মেয়ের জনক ছিলেন।

তিনি মোট সাতাত্তর বছর জীবিত ছিলেন। কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, এ নিয়ে মতভেদ আছে। তিনি একজন ধর্মপ্রচারক হলেও তাঁর অনেক শত্রু ছিল। যারা তাঁর মতাদর্শে বিশ্বাস করত না, তারা তাঁর বিরোধিতা করত।

একবার একদল দুষ্ট বুদ্ধির লোক তাঁর স্থাপিত অগ্নিমন্দির আক্রমণ করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি তাঁর অনুগামীদের নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেন। কিন্তু এই লড়াইতে তিনি নিজে গুরুতর আহত হন এবং এর কিছুদিন পরে মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর এই মৃত্যুর ঘটনাকেও কেউ কেউ রূপক অর্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি যেদিন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে পাহাড় থেকে নেমে এসেছিলেন, সেদিন আকাশ থেকে আগুন ঝরে পড়েছিল। তার পর আরেক দিন শুরু হলো অগ্নিবর্ষণ। এই অগ্নিবর্ষণের মধ্যেই সহসা তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এভাবেই হলো তাঁর মহাপ্রয়াণ। হয়তো মন্দিরে আগুন ধরানোর ঘটনাকেই অগ্নিবর্ষণের প্রতীক করে তোলা হয়েছে।

জরথুশ্‌ত্রীয় মতবাদে আলো যেহেতু আহুরা মাজদার প্রতীক, আলোর জন্ম যেহেতু আগুন থেকে, সেহেতু আহুরা মাজদার প্রতীক হিসেবে তাদের সব মন্দিরে সর্বক্ষণ আলো বা আগুন জ্বালিয়ে রাখার নিয়ম। আর এ-কারণেই পারশি ধর্মের মন্দিরকে বলা হয় অগ্নিমন্দির।

জরথুশ্‌ত্র বলেছেন, আদিতে দুটো শক্তির বিকাশ ঘটেছিল। এর একটি হলো ভালো এবং অপরটি মন্দ। এই পরস্পর বিরোধী দুটো শক্তির প্রকাশ ঘটছে মানুষের চিন্তাচেতনা ও কাজকর্মের জগতেও। যারা ভালো এবং বুদ্ধিমান মানুষ, তারা অনায়াসে ভালোকে বেছে নিতে পারবে। কিন্তু বোকারা তা পারবে না। তারা সত্য সুন্দর আহুরা মাজদার উপাসনা ছেড়ে মিথ্যা দেবদেবীর আরাধনা করে।

জরথুশত্র মতবাদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো : তিনি মন্দকেও পরিত্যাগ করতে বলেননি। তিনি বলেছেন, ঘৃণা করো পাপকে, পাপীকে নয়। আহুরা মাজদার সঙ্গে মিলিত হয়ে পাপ ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। পাপের বিরুদ্ধে জয় হবেই।

তিনি বলেছেন, দ্বৈতনীতি সত্যের পরিপন্থি এবং অশুভ কার্যকলাপ হলো বিশ্বের যাবতীয় দুঃখকষ্টের মূল কারণ। কিন্তু সত্য ও সুন্দরের জয় শেষ পর্যন্ত হবেই। সত্যের কাছে অসত্যের পরাজয় অবধারিত।

ধর্মীয় জীবনই হলো সবচেয়ে সুন্দর জীবন। সত্য ও নৈতিকতাই হলো আহুরা মাজদার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করার বড় অবলম্বন। তা হলে পৃথিবী থেকে অসত্যের বিনাশ ও সত্যের বিজয় হবে।

তিনি তাঁর গাথাসমূহে সরাসরি আহুরা মাজদাকে লক্ষ্য করে কিছু প্রশ্ন করেছেন। পৃথিবীতে সত্য প্রতিষ্ঠার আদিপিতা কে? সূর্য এবং নক্ষত্রপুঞ্জে যাওয়ার পথ সৃষ্টি করেছেন কে? পৃথিবীকে বিশ্বের যথাস্থানে সংস্থাপন এবং পৃথিবীর উপরিভাগে অপূর্ব সুন্দর মেঘমালার সৃষ্টি করেছেন কোন্ মহান শক্তিধর? এই জলরাশি এবং বৃক্ষলতাই-বা কে তৈরি করেছেন? কে সৃষ্টি করেছেন সকাল, সন্ধ্যা আর রাত্রি। পৃথিবীর সত্য ও সুন্দরের মধ্যে আমি যাদের সাথে কথা বলি, তারা কে? কেমন করে আমরা অশুভকে জয় করতে সক্ষম হব? এইসব প্রশ্ন করে তিনি নিজেই আবার বলেছেন, যিনি এইসব সৃষ্টি করেছেন, সেই সত্যের মহান প্রভুর সাথে আমি একাত্ম হতে চাই এবং আমার মুখনিঃসৃত বাণীই হোক তাঁর শক্তির প্রকাশ।

তিনি মৃত্যু, শেষ বিচার এবং পারলৌকিক জীবন সম্পর্কেও সুন্দর কথা বলেছেন।

জরথুশ্‌ত্র বিশ্বাস করতেন, যখন কোনো নারী বা পুরুষের আত্মা তার নশ্বর দেহ ত্যাগ করে পরলোকে যাত্রা করে, তখন সেই আত্মা পাপ-পুণ্যের বিচারক মিথ্রার সমীপে উপস্থিত হয়। সেখানে তার পাপ ও পুণ্যের সঞ্চয় বা ফসল নিক্তিতে ওজন করা হয়। যদি তার পুণ্য সঞ্চয়ের মাত্রা বেশি হয়, তখন সেই আত্মা সুন্দর এক বাগানের মধ্যে অবস্থিত একটি সেতু পার হয়ে স্বর্গে প্রবেশ করে। কিন্তু যদি তার পাপের বোঝা ভারি হয়, তখন সেই আত্মাকে আনা হয় এক ভয়ঙ্কর সরু ও পিছল সেতুর কাছে, যে সেতু পার হতে গিয়ে সে পড়ে যায় নিচের ভীষণ অন্ধকার এক পাপের জগতে। এই পাপের নরকের শাসনকর্তা হলেন আগ্রা মাইনিউ। সেই নরক অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও দুঃখময় স্থান। সেখানে পাপীরা তাদের পাপ মোচন না হওয়া পর্যন্ত শাস্তি ভোগ করে।

মানুষের মৃত্যু, তার শেষ বিচার এবং স্বগ-নরক সম্পর্কিত জরথুশ্ত্রের এই চিস্তার সাথে সনাতন ধর্মের অনেকটা মিল আছে। সনাতন ধর্মমতেও মানুষের মৃত্যুর পর-পরই তার বিদেহী আত্মাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। সেখানে যমরাজা বা ধর্মরাজা নিক্তিতে তার পাপ-পুণ্যের বিচার করে তাকে স্বর্গ বা নরকে প্রেরণ করেন। সেখানে আত্মারা তাদের সঞ্চিত পুণ্যের জন্য স্বর্গসুখ ভোগ বা পাপের জন্য নরক ভোগ করে শেষে উদ্ধার লাভ করে থাকে।

তবে জরথুত্র সনাতন ধর্মের মতো জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতেন না। এ সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেও যাননি। তবে আত্মার যে বিনাশ নেই, একথা তিনি বলেছেন। আত্মা সবশেষে পরিশুদ্ধ হয়ে আহুরা মাজদার কাছে ফিরে আসবে। সনাতন হিন্দু ধর্মেও এটা বলা হয়েছে, জীবাত্মা বিবর্তন বা জন্মান্তরের ঘূর্ণনের মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে অবশেষে পরমাত্মার সাথে বিলীন হয়ে যাবে।

জরথুস্ত্রের প্রবর্তিত ধর্মমত তাঁর মৃত্যুর পর আরও ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। পরবর্তীকালে প্রচারিত ইহুদি ধর্ম এবং খ্রিস্টধর্মকে তা গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ইহুদিদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ এবং খ্রিস্টধর্মের ওল্ড টেস্টামেন্ট গ্রন্থে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। মানুষের মৃত্যু এবং পরজগতের আত্মার বিচার সম্পর্কে এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আত্মার সংগ্রাম সম্পর্কে ওল্ড টেস্টামেন্টে যা বলা হয়েছে, তাতে জরথুশত্রের ধর্মমতের প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে বলেও অনেক পণ্ডিত মনে করেন।

অতি প্রাচীন হলেও আজ এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা খুবই সীমিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে আরব ও পারস্যে নবজাগ্রত মুসলিম শক্তির সশস্ত্র আক্রমণের মুখে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, সংখ্যালঘু ও অহিংসবাদী জরথুস্ত্রীয়রা হেরে যায়। অনেকে আত্মরক্ষার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আর যারা তা করেনি, তারা মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। তারা তাদের জন্মভূমি ইরান বা পারস্য থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেয় ধর্মীয় স্বাধীনতার দেশ ভারতবর্ষে। তারা ভারতের রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, মহিশূর প্রভৃতি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। পারস্য থেকে আগত বলে ভারতে এদেরকে ‘পারশি’ বলা হয়। আর এদের ধর্মের নামও হয় ‘পারশি ধর্ম’ অর্থাৎ পারসিয়ানদের ধর্ম। ভারতে প্রায় দেড় থেকে দু লাখের মতো পারশি ধর্ম মতাবলম্বী আছেন। এ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য স্থান তথা ইউরোপ ও আমেরিকাতেও আছেন অতি নগণ্যসংখ্যক পারশি ধর্মাবলম্বী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *